শুক্রবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২১

খাজুরাহো ধ্বংস - একটি পোস্টমডার্ন নাটক

 

খাজুরাহো ধ্বংস - একটি পোস্টমডার্ন নাটক : মলয় রায়চৌধুরী


নাদির শাহ : দ্যাখ আবদালি, এটা ১৭৭৪ সাল । তোর দু’কানের লতি এই জন্যে কেটে দিলুম যে তুই চিরজীবন মনে রাখবি তুইই আমার ভাবশিষ্য ; আমার তো কোনও বংশধর নেই । মনে রাখিস যে আমি আর আমার মা উজবেক-তুর্কীদের  দাস হিসেবে কাজ শুরু করেছিলুম কিন্তু আমি ওদের ফাঁদ কেটে পালাই। আমি তারপর  সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়ে ক্রমশ  প্রধান হয়ে উঠি ।  পৃথিবীকে কাফেরমুক্ত করার দায়িত্ব তোকে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের স্লোগান মনে আছে তো তোর ? জান, জর, জমিন । মানে, মেয়েমানুষ, সোনা, এলাকাদখল । আমাকে ভালো করে কবর দিয়ে তুই কাজে এগো । 


আদিল শাহ আবদালি : মনে থাকবে সম্রাট ; আফগানদের নাম রওশন করব । কাফের বলতে তো ওই একটাই দেশ, আল-হিন্দ । তিব্বত আছে বটে, কিন্তু ওখানে সোনাদানা আর কাজের জমি পাওয়া যায় না । বাঁচলো চিন ; সেখানে চেঙ্গিজ খানের বৌদ্ধ বংশধরদের রাজত্ব, পেরে ওঠা যাবে না । খোয়াজা চিশতির আশীর্বাদ নিয়ে আমি তাহলে এগোই।


নাদির শাহ : হ্যাঁ, বেস্ট অফ লাক ।


হজরত ইবলিশ : আপনি চিন্তা করবেন না হুজুর । আবদালিকে আমি গাইড করব । খাজুরাহোর সংবাদ ওকে জানতে দেবো না ।


নান্নুকা : ৮৩১ থেকে ৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আমি ছিলুম ভারতের চান্দেলা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। আমি জেজকভূক্তি এলাকায়, যা এখন মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ড, শাসন করতুম। আশ্চর্য যে চান্দেলাদের সম্পর্কে কাব্যিক গীতগুলিতে আমার কথা  উল্লেখ করা হয়নি, আর তার বদলে চন্দেলা বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে "চন্দ্রবর্মণ" উল্লেখ করা হয়েছে। খাজুরাহোতে ওরা যে দুটো শিলালিপি পেয়েছে, তাতে আমার, মানে নান্নুকাকে, রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । আরেকটা শিলালিপিতে বলা হয়েছে যে আমি অনেক শত্রু জয় করেছিলুম আর অন্যান্য রাজকুমাররা আমাকে ভয় পেয়ে আমার আনুগত্য স্বীকার করেছিল। তাতে আরও বলা হয়েছে যে আমাকে দেখতে ছিল "প্রেমের দেবতার মতো” । খ্রিস্টীয় ১০০২-এর  শিলালিপিতে আমাকে সূর্য আর আমার পরিবারের সদস্যদের মণি-মুক্তো হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আমার তীরন্দাজির দক্ষতা কিংবদন্তি নায়ক অর্জুনের সাথে তুলনা করেছে।সুতরাং, খাজুরাহো বেড়াতে এলে, কথাগুলো মনে রাখবেন ।


ঐতিহাসিক আর. কে, দীক্ষিত : চান্দেলার রেকর্ডে নান্নুকাকে দেওয়া খেতাবগুলোর মধ্যে রয়েছে নাপা, নরপতি আর মহাপতি। এগুলো খুব উঁচু স্তরের খেতাব নয় । তাই কয়েকজন আধুনিক ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে নান্নুকা কেবল একটি সামন্ত  শাসক ছিলেন। বুন্দেলখণ্ডের স্থানীয় ঐতিহ্য অনুসারে, চন্দেলারা প্রতিহারদের পরাধীন করার পরে সেই অঞ্চলের শাসক হয়েছিলেন।


আবু রিহান আল বিরুনি : আমি আমার ভ্রমণকাহিনিতে লিখেছিলুম, তাই । নয়তো লোকে জানতে পারতো না যে খাজুরাহো ধ্বংসের কাজ প্রথম আরম্ভ  করেছিল গজনির সুলতান মাহমুদও ভেবেছিল যে কাফেরদের মন্দির মানেই তাতে অঢেল সোনাদানা মিলবে । সপ্তাহখানেক ভাঙচুর করার পর কিছুই না পেয়ে ওর সেনারা যখন চটে লাল, তখন ওদের বোঝালো যে মূর্তিপূজকদের মূর্তিগুলো ভাঙা ওদের কর্তব্য । পঁচাশিটা মন্দির ছিল, সুলতানের সেনারা তিরিশটার মতন ভাঙার পর হাল ছেড়ে দিলে । এরকম মূর্তি আমি দুনিয়ার কোথাও দেখিনি ।


রমেশচন্দ্র মজুমদার : চান্দেলারা প্রথমে কন্যাকুবজার (কান্নৌজ) গুর্জারা-প্রতিহারদের সামন্ততন্ত্র হিসাবে শাসন করেছিল। দশম শতাব্দীর চান্দেলা শাসক যশোবর্মন কার্যত স্বাধীন হয়েছিলেন, যদিও তিনি প্রতিহারদের  স্বীকৃতি অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর উত্তরসূরী ধঙ্গদেবের সময়কালে, চান্দেলারা সার্বভৌম শক্তি হয়ে উঠেছিল। তারা প্রতিবেশী রাজবংশ, বিশেষত মালওয়ার পরমার এবং ত্রিপুরীর কালাচুরিদের সাথে যুদ্ধ করার সাথে সাথে তাদের শক্তি  হ্রাস পায়। একাদশ শতাব্দীর পর থেকে, চান্দেলারা গজনভি আর মুহম্মদ ঘুরিসহ  মুসলিম শাসকদের কাফের-নিধন ধ্বংসযজ্ঞে অভিযানের মুখোমুখি হয়েছিল। চান্দেলা শক্তি কার্যকরভাবে তেরো শতাব্দীর শুরুতে চাহমন ও ঘুরি আক্রমণগুলির পরে শেষ হয়ে গিয়েছিল ।


বিজয়শক্তি :  মধ্য ভারতের বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলের চান্দেলা রাজবংশের নবম শতাব্দীর শাসক ছিলুম আমি। যদিও চান্দেলাদের নথিতে সাধারণত আমার বড় ভাই আর পূর্বসূরি জয়শক্তির সাথে আমার উল্লেখ পাওয়া যায়। আমরা দু'জনে মিলে  ৮৬৫ থেকে ৮৮৫ পর্যন্ত শাসন করেছিলুম । আমি ছিলুম বাকপতির ছেলে আর আমার বড় ভাই জয়শক্তির স্থলাভিষিক্ত হন। আমাকে ভিজা, বিজয়া এবং বিজজাকা নামেও জানতো লোকেরা । আমার পর আমার ছেলে রাহিলা চান্দেলার শাসক হয়েছিল । খাজুরাহো হলো মন্দিরের দেশ, চান্দেলাদের দেশ । খাজুরাহোতে পা রাখা মানেই চান্দেলাদের রাজত্বে ফিরে যাওয়া। চোখের ওপর আশ্চর্য মন্দিরগুলির অলঙ্করণ শিল্প ফিরিয়ে আনবে ৯৫০ থেকে ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দের বাতাবরণ। মন্দিরের গায়ে দেবদেবী, অপ্সরা, নর্তকী, মিথুন মূর্তিগুলোতে  প্রাণস্পন্দন পাওয়া যাবে। এক্কেবারে শহরের কেন্দ্রে মন্দিরগুলোর অবস্থান। ফুলবাগিচায় সাজানো চত্বর জুড়ে কাণ্ডারীয় মহাদেব, লক্ষণ, জগদম্বা, চৌষটযোগিনী, চিত্রগুপ্ত প্রমুখ মন্দিরের রাজমালা। ভেবে দেখুন, বিদেশ থেকে এসে একদল ম্লেচ্ছ, যাদের কোনও শিল্পবোধ ছিল না, বেশিরভাগ স্হাপত্য গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে । ওদের বংশধরদের কোনও লজ্জা-শরম নেই ; ধ্বংসের কথা বুক ফুলিয়ে স্কুলের বাচ্চাদের পড়ায় ।


সবুক্তগিন : আমি তেমন বিখ্যাত নই । আমার ছেলে গজনির সুলতান মাহমুদ বেশি বিখ্যাত । আমি তো ক্রিতদাস ছিলুম । অবশ্য বলতে পারেন যে আমি গজনভি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আবু মনসুর  সেবুক তিগিন । ৯৭৭ থেকে ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কুড়ি বছর রাজত্ব করেছিলুম।  প্রথম জীবনে  দাস হলেও আমি আমার মালিক আল্প তিগিনের মেয়েকে বিয়ে করেছিলুম ।  বুখারার সামানি সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রথমে আমার শশুর আর তারপর আমি স্বাধীনভাবে  আফগানিস্তানের  গজনির শাসক হই । আমরা নামে সামানিদের কর্তৃত্বকে স্বীকার করলেও আমার ছেলে মাহমুদ নিজেকে পুরোপুরি স্বাধীন বলে ঘোষণা করে। 

 

ঐতিহাসিক উমা চক্রবর্তী : কল্পিত কিংবদন্তীতে চান্দেলাদের উৎস অস্পষ্ট। রাজবংশের লিপিবদ্ধ রেকর্ডগুলির পাশাপাশি বালভদ্র-বিলাস এবং প্রবোধ-চন্দ্রোদয়ের মতো সমসাময়িক গ্রন্থগুলো থেকে  বোঝা যায় যে চান্দেলরা কিংবদন্তি-কথিত চন্দ্রবংশের অন্তর্ভুক্ত ছিল । খ্রিস্টীয় ৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে খাজুরাহো শিলালিপিতে রাজবংশের প্রথম রাজা নান্নুকা ছিলেন চান্দেলা ঋষি চন্দ্রত্রেয়, যিনি ছিলেন আত্রির পুত্র। ১০০০ খ্রিস্টাব্দে খাজুরাহো শিলালিপিতে কিছুটা আলাদা বিবরণ দেওয়া হয়েছে, যেখানে চন্দ্রাত্রেয়কে ইন্দুর (চাঁদ) পুত্র এবং আত্রির নাতি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে বাঘারী শিলালিপি এবং ১২৬০ খ্রিস্টাব্দ অজয়গড় শিলালিপিতে অনুরূপ পৌরাণিক বিবরণ রয়েছে। বালভদ্র-বিলাস চন্দ্রের পূর্বপুরুষদের মধ্যে অত্রির নামও রেখেছিলেন। আর একটি খাজুরাহো শিলালিপিতে চান্দেলা রাজা ধঙ্গদেবকে যাদবদের বর্ধনী বংশের সদস্য হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে  (যিনি চন্দ্র রাজবংশের অংশ হিসাবে নিজেকে দাবি করেছিলেন)।

 

বাকপতি :  ৮৪৫ থেকে ৮৬৫ সালে মধ্য ভারতের চান্দেলা রাজবংশের  শাসক ছিলুম।  চান্দেলার শিলালিপিতে আমার পদবী কেতিপা ("দেশের কর্তা") হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।  খাজুরাহোর  দুটো শিলালিপি থেকে জানা যাবে, আমার বাবা ছিলেন নান্নুকা । শিলালিপিতে আমাকে আমার সাহসিকতা, শালীনতা এবং জ্ঞানের জন্য বিখ্যাত রাজা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। শিলালিপিগুলোতে বলা আছে যে আমি বেশ কয়েকটি শত্রু দেশকে যুদ্ধে হারিয়েছিলুম আর আমি  প্রজাদের প্রিয় ছিলেন।আমার জ্ঞান ও বাকশক্তির জন্য আমার নাম বাকশতীর সাথে তুলনা করা হয়, যিনি ছিলেন আমাদের বক্তৃতার দেবতা। শিলালিপিতে  আরও বলা হয়েছে  যে আমি বুদ্ধির সাথে সাহসের সংমিশ্রণে পৃথু এবং কাকুৎস্যের মতো কিংবদন্তী রাজাদেরকে অতিক্রম করে গিয়েছিলুম।  ৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের একটা শিলালিপিতে বলা হয়েছে যে বাকপতির "আনন্দ পর্বত" (ক্রিড়া-গিরি) ছিল বিন্ধ্যপর্বতে, যেখানে পদ্মের উপর বসে কিরাতা মহিলারা তাঁর সম্পর্কে গান গেয়েছিলেন, আর ময়ূররা জলপ্রপাতের শব্দে নেচেছিল। 

 

ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার : পূর্ব ভারতের পাল রাজা দেবপালার দক্ষিণ সম্প্রসারণকে বাকপতি সম্ভবত সমর্থন করেছিলেন। বাকপাতির দুটি পুত্র ছিল: জয়শক্তি (জেজা) এবং বিজয়শক্তি (বিজ)। তাঁর পরে তাঁর বড় ছেলে জয়শক্তি তাঁর উত্তরসূরি বিজয়শক্তি রাজ্য শাসন করেছিলেন । 

 

তসলিমা নাসরিন : ভারতের মধ্যপ্রদেশে একটি ছোট গ্রামের নাম খাজুরাহো। খেজুর হতো বলেই হয়তো খাজুরাহো নাম গ্রামটির। খাজুরাহোর জঙ্গলের  মন্দিরগুলো চান্দেলা রাজপুত রাজারা বানিয়েছিলেন ৯৫০ সালের দিকে। ওরা রাজত্ব করেছিল দশম শতক থেকে চতুর্দশ শতক পর্যন্ত। মহারাজা রাও বিদ্যাধরের সময় শুরু হয়েছিল খাজুরাহোর মন্দির নির্মাণ। খাজুরাহোর জঙ্গলে ৮৫টি মন্দির ছিল। এখন আছে সাকুল্যে ২৫টি। বাকিগুলো ধ্বংস করেছে শত্রুসৈন্য। গজনির সুলতান মাহমুদ ছিলেন ধ্বংসকারীদের একজন। সেই প্রাচীনকালে যৌনতার যে চর্চা ছিল ভারতবর্ষে, তার কিছু নিদর্শন দেখতে পাই মন্দিরগুলোর গায়ে। আমি তো মুগ্ধ দেখে নারীপুরুষের কামশিল্প। কোনও সংকোচ নেই কারওর। নারীও পুরুষের মতো যৌনশিল্পে দক্ষ। কবে যে রক্ষণশীলতা গ্রাস করে ফেলেছে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ, জানি না। সম্ভবত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের ভিক্টোরিয়ান রক্ষণশীলতা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দেওয়ার পর। মানুষের মগজধোলাই তো অনেকটাই হয়েছে। তা না হলে যৌনতার যে চিত্র আমরা ধর্মের মন্দিরে দেখি, সেই যৌনতা এত শীঘ্র এই অঞ্চলে ট্যাবু হয়ে যায় কী করে?! আজকাল তো হিন্দু আর মুসলিম— দুই ধর্মীয় মৌলবাদীই নারী স্বাধীনতাবিরোধী, খাজুরাহো মন্দিরের যৌনশিল্পের ঘোরবিরোধী তারা।কামসূত্রের অনেক আসনই দেখি মন্দিরের গায়ে। কামসূত্র ভারতবর্ষে লেখা হলেও জনপ্রিয় ভারতবর্ষের বাইরে, বিশেষ করে ইউরোপে। ভারতবর্ষের মানুষ কামসূত্রের চর্চা করে না বললেই চলে। যৌনতা, এখনকার সাধারণ হিন্দুরাও মনে করে, পাপ। গান্ধীও তো বলেছিলেন সন্তান উৎপাদনের উদ্দেশ্য ছাড়া সুখভোগের উদ্দেশে যে সেক্স করে, সে পাপ করে।মন্দিরে নারী পুরুষের যৌনশিল্প আমাকে মুগ্ধ করলেও, পশুর সঙ্গে পুরুষের সঙ্গম আমাকে ভীষণ অস্বস্তি দিয়েছে। পশু-ধর্ষণ তাহলে প্রাচীনকাল থেকেই ছিল ! পশুরা নিশ্চয়ই মানুষের সঙ্গে সঙ্গম করতে চায় না, মানুষকে সঙ্গমের অনুমতি নিশ্চয়ই দেয় না তারা। তাহলে এই সঙ্গম সঙ্গম নয়, এ নিতান্তই ধর্ষণ। সেই প্রাচীনকাল থেকে পশুপাখিদের নির্যাতন করে আসছে মানুষ। তাদের হত্যা করেছে, বন্দি করেছে, যন্ত্রণা দিয়েছে। পশুপাখিরাও পুরুষের যৌন-নির্যাতনের শিকার।এখনও সব বয়সের নারী তা আছেই, দুধের শিশুরা, এমনকী পশুও পুরুষের যৌন নির্যাতন থেকে রেহাই পায় না। পুরুষ যে কবে মানুষ হবে ! জানি সব পুরুষই মন্দ নয়, সব পুরুষই ধর্ষক নয়, কিন্তু ভালো পুরুষের ওপর তো দায়িত্ব বর্তায় পুরুষ জাতটাকে মানুষ করার। ধর্ষণের বিরুদ্ধে, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে, পশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভালো পুরুষরা কেন সংগঠিত হচ্ছে না। তারা কিভাবে আন্দোলন করার দায়িত্ব শুধু ভিকটিমদের, তাদের নয়? সমাজটাকে কলুষমুক্ত করার, বৈষম্যমুক্ত করার, শুদ্ধ করার দায়িত্ব শুধু নারীদের, পুরুষদের নয়?

 

গজনির সুলতান মাহমুদ : এটা সত্যি যে আমার বাবা ক্রিতদাস ছিলেন বলে আমি ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগতুম আর দুর্বলদের ওপর অত্যাচার করে নিজেকে সবার চেয়ে সুপিরিয়র মনে করতুম । গজনি আসলে বেশ গরিবদের রাজ্য ছিল । আমি নানা রাজ্য আক্রমণ করে সোনাদানা মণিমুক্ত আনতুম । যাদের যুদ্ধে হারিয়ে দিতুম তাদের রাজ্য থেকে অনেককে এনে দাস হিসেবে খাটাতুম । যেসব মেয়েদের তুলে আনতুম তাদের বিলিয়ে দিতুম আমার দরবারীদের মধ্যে ।  ৯৯৭ থেকে ১০৩০ সালে আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি পূর্ব ইরানিয় এলাকা আর ভারত উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম অংশ , বর্তমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তান, জয় করি।  সাবেক প্রাদেশিক রাজধানী গজনিকে এক বৃহৎ সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধশালী রাজধানীতে পরিণত করেছিলুম। আমার সাম্রাজ্য বর্তমান আফগানিস্তান, পূর্ব ইরান ও পাকিস্তানের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে ছিল। আমি সুলতান  উপাধিধারী প্রথম শাসক যে আব্বাসীয় খিলাফতের আনুগত্য স্বীকার করে নিজের শাসন চালু রেখেছিলুম। ১০২২ সালে আমি খাজুরাহো ধ্বংস করেছিলুম, কিন্তু সোনাদানা কিছুই পাইনি । 

 

তাপ্তী গুহঠাকুরতা : এটি সর্বজনবিদিত যে, ১১৯২ এর  দুই শতাব্দীর আগে, যখন আদিবাসী ইন্দো-মুসলিম রাষ্ট্র এবং জনগোষ্ঠী উত্তর ভারতে প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল, ইরানি আর তুর্কিরা পরিকল্পিতভাবে দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান নগর কেন্দ্রগুলিতে অভিযান চালিয়ে এবং লুটপাট করে, মন্দিরগুলো ভেঙে ফ্যালে  এবং প্রচুর সোনা মণিমুক্ত দাস-দাসী ও তরুণীদের পূর্ব আফগানিস্তানে নিজেদের ঘাঁটিতে নিয়ে যায়। রীতিটি শুরু হয়েছিল ৯৮৬ সালে, যখন গজনভির সুলতান সবুকতিগিন ( ৯৭৭-৯৯৭এর রাজত্বকালে) হিন্দু  রাজাদের আক্রমণ করে হারিয়েছিল ।তারা কাবুলের উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাবের মধ্যবর্তী অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করতো । সুলতানের ছেলের একান্ত সচিব আবু নসর `উতবির মতে, সাবুক তিগিন লামঘান (কাবুলের তাৎক্ষণিক পূর্বে অবস্থিত) অভিমুখে যাত্রা করেছিল, এটি একটি বিশাল শক্তি ছিল সেই সময়ে আর সমৃদ্ধ শহর হিসাবে চিহ্নিত ছিল । সাবুকতিগিন এটি আক্রমণ করেছিল আর কাফেরদের বসবাসের আশেপাশের জায়গাগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয় । তারপর মূর্তি-মন্দির ভেঙে সাবুকতিগিন সেখানে ইসলামধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিল ।

 

ব্রিটিশ ইন্ডোলজিস্ট ভি. এ. স্মিথ :  চান্দেরালরা ভর বা গোন্ডের কোন এক উপজাতি ছিল । আর সি সি মজুমদার সহ আরও কয়েকজন পণ্ডিত এই তত্ত্বকে সমর্থন করেছিলেন। চান্দেলারা মানিয়া নামে একটি উপজাতির দেবী উপাসনা করতেন, যার মন্দিরগুলি মহোবা এবং মানিয়াগড়ে রয়েছে ।   গোন্ডের সাথে সম্পর্কিত  জায়গা গুলোর সাথে তাদের সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়াও, রানী দুর্গাবতী, যার পরিবার দাবি করেছিল যে চান্দেলা বংশোদ্ভূত গারহ-মন্ডলার একজন গন্ড প্রধানকে বিয়ে করেছিলেন। ঐতিহাসিক আর. কে. দীক্ষিত এই যুক্তিগুলি বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন না । তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে মানিয়া কোনও উপজাতি দেবতা ছিলেন না। এছাড়াও, গোন্ড অঞ্চলের সাথে রাজবংশের যোগসূত্রটি  কোনও সাধারণ বংশোদ্ভূত হওয়ার ইঙ্গিত দেয় না । রাজবংশের পূর্বসূরিদের এই অঞ্চলগুলিতে শাসক পদে পোস্ট করা হতে পারে।  গোন্ড প্রধানের সাথে দুর্গাবতীর বিবাহকে এক-কথায় খারিজ করা যেতে পারে।  চান্দেলারা মূলত গুজর-প্রতিহারের প্রতিনিধি ছিল। নান্নুকা  রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। খাজুরাহোকে কেন্দ্র করে একটি ছোট রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। 


চন্দ্রবর্মণ : সুলতানটা মূর্খ ছিল । ব্যাটা জানতো না শিল্প কাকে বলে । নিজের হারেমে হাজার খানেক বউ-বাঁদি-রাখেল নিয়ে রেলা করেছে সারাজীবন, আর মূর্তিগুলো দেখে ওর গায়ে জ্বর এলো, মাথা গণ্ডোগোল হয়ে গেল । মন্দিরগুলো গড়তে কতো শিল্পীকে দিনের পর দিন কাজ করতে হয়েছে, কতো শ্রমিককে সকাল-সন্ধ্যা পাথর বয়ে আনতে হয়েছে, তা খেয়াল করলো না । একশো বছর লেগেছিল, আর সুলতান ব্যাটা যখন দেখলো এখানে সোনাদানা নেই তখন তিন দিনে যতোটা পারলো মাটিতে মিশিয়ে কেটে পড়ল । যত্তোসব বহিরাগত ইডিয়ট ।

 

সিকন্দর লোদি : আসলে আমার মা ছিলেন হিন্দু স্যাকরার মেয়ে । সুন্নি আলেমরা আমাকে খুব হ্যাটা করতো । লুকিয়ে হাসাহাসি করে বলতো কাফারের বাচ্চা কোথাকার । আমি যখন খবর পেলুম যে খাজুরাহোতে অনেক মন্দির আছে তখন ভাঙচুর করতে বাধ্য হলুম । তাছাড়া আমি আব্বাসীয় খিলাফতকে মানতুম, কেননা নবী মুহাম্মদ এর চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের বংশধরদের  ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে কুফায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে রাজধানী নিয়ে যান। আসল ভাঙাভাঙি করেছিল  গজনির সুলতান মাহমুদ । ও ভেবেছিল সোমনাথ মন্দিরের মতন এখানকার মন্দিরেও সোনাদানা মণিমুক্ত পাবে । সেসব না পেয়ে ক্ষেপে গিয়ে আরও ভাঙাভাঙি করেছে । কিন্তু আমাকে পদে-পদে প্রমাণ করতে হয়েছে আমি খাঁটি মুসলমান। তাই আমি সালার মাসুদের বার্ষিক শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করেছিলুম আর হুকুম দিয়েছিলুম যে মেয়েরা কোনও সন্তের মাজারে যেতে পারবে না । মরবার দিন পর্যন্ত ভুলিনি যে আমার গায়ে মূর্তিপুজক কাফেরের রক্ত ।


হজরত ইবলিশ : এখন বুঝলি ? আমি তোদের সবায়ের ঘাড়ে চেপে আল-হিন্দে টেনে এনেছিলুম ।


জয়শক্তি : আমি বাবা বাকপাতির উত্তরসূরি । আমি জেজা বা জেজক নামেও পরিচিত। মহোবায় প্রাপ্ত একটি শিলালিপিতে বলা হয়েছে যে চান্দেলা অঞ্চলটিকে (পরে বুন্দেলখণ্ড বলা হয়) আমার নামানুসারে "জেজকভূক্তি" রাখা হয়েছিল। চান্দেলার নথিগুলোতে আমার আর বিজয়শক্তি সম্পর্কে বেশিরভাগ তথ্য প্রকৃতির গৌরবময়, এবং অল্প ঐতিহাসিক গুরুত্বের, তার কারণ আমাদের রাজত্বে স্হপতি ও ভাস্কর অনেক ছিল কিন্তু লেখক বেশি ছিল না।  এই নথিগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে যে আমরা আমাদের শত্রুদের ধ্বংস করেছিলুম, কিন্তু পরাজিত কোনও শাসকের নাম লেখকরা উল্লেখ করেনি ।কালাচূড়ির রাজা কোক্কাল  চান্ডেলার রাজকন্যা নাভ-দেবীকে বিয়ে করেছিলাম। বিষয়টা অবশ্য তর্কসাপেক্ষ । ঐতিহাসিক আর সি সি মজুমদারের মতে এই রাজকন্যা জয়শক্তির কন্যা হতে পারেন। আবার ঐতিহাসিক আর. কে. দীক্ষিত বিশ্বাস করেন যে মেয়েটি সম্ভবত রাহিলার মেয়ে বা বোন ছিলেন।ওনারা মনে করেন আমি  সম্ভবত উত্তরাধিকারী না রেখে মারা গিয়েছিলুম, যার কারণে আমার ছোট ভাই আমার সিংহাসনে বসেছিল ।



আবু রিহান-আল-বিরুনি : গজনির সুলতান মাহমুদের সঙ্গে আমি ছিলুম যখন ও খাজুরাহোর মন্দিরগুলো ভাঙছিল। ও বেটা ভেবেছিল এই মূর্তিগুলোর ভেতরে সোমনাথ মন্দিরের মতন অঢেল মণিমুক্ত সোনাদানা আছে। সোমনাথ মন্দিরে আক্রমণের কারণে এখনো মুসলিমদের কাছে মাহমুদ একজন ইসলাম প্রচারক বীর যোদ্ধা। পাকিস্তানের জাতীয় পাঠ্যক্রমে মাহমুদের ভারত আক্রমণকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হয়। মাহমুদ বুঝতে পেরেছিল, হাজার হাজার হিন্দু সোমনাথে পুজো দেবার সময় বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ দক্ষিণা হিসেবে মন্দিরে দিতো। ফলে সোমনাথ মন্দির ছিল  ধন-সম্পদ, সোনা, রত্নের বিশাল ভাণ্ডার। মাহমুদের সতেরোতম আক্রমণ ছিল সোমনাথ মন্দিরে লুট করার উদ্দেশ্যে। রাজপুত সৈন্যবাহিনী সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করলেও সোমনাথ মন্দিরের শেষ রক্ষা করতে পারেনি। তিনদিন যুদ্ধের পর মাহমুদের বাহিনী মন্দিরে ঢুকে পড়ে, মন্দিরের সব মূর্তি এবং শিবলিঙ্গ ভেঙে ফেলে, সোনার মূর্তি, মূল্যবান পাথর, নগদ অর্থ, অলংকার যা ছিল সব নির্বিচারে লুট করে নিয়ে যায়, মূর্তি যেহেতু ইসলামে নিষিদ্ধ তাই মাহমুদ সোনার মূর্তি গলিয়ে  ২ কোটি দিনার মুদ্রায় পরিণত করে। মাহমুদ সোমনাথ মন্দির লুটের সময় ৫০০০ রাজপুত সৈন্যকে মন্দিরের মধ্যেই ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দিয়েছিল ।


হজরত ইবলিশ : আরে গজনির মাহমুদটা তো জাহিল । পাকিস্তানের আরেক নাম জাহিলিয়া, জানিস না ?


দিল্লীর গার্গী কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক মীনাক্ষী জৈন :  মাহমুদ সোমনাথ মন্দির এতটাই ধ্বংস করে দিয়েছিল যে ১০২৫ থেকে ১০৩৮ সাল পর্যন্ত সেখানে কোনও তীর্থযাত্রী যেতে পারেনি। তুর্কি-ইরানি সাহিত্যে মাহমুদের সোমনাথ মন্দিরে আক্রমণের ইতিহাসকে মহিমান্বিত করে উপস্থাপিত হয়। মাহমুদের আক্রমণে সোমনাথ মন্দিরের নগরী সৌরাষ্ট্রে ৫০,০০০ মানুষের মৃতদেহের যে স্তূপ জমে উঠে তা সৎকার করার মত অবশিষ্ট লোক পর্যন্ত ছিল না।


হজরত ইবলিশ : ওর ঘাড়ে তো আমিই চেপে ছিলুম । এখন ব্যাটা জাহান্নমে গরম তেলেতে টগবগ করে ফুটছে।


ইবন বাতুতা : কুতুবুদ্দিন আইবকও সুলতান মাহমুদের দেখাদেখি গিয়েছিল খাজুরাহোতে । ও বেটা মূর্তিগুলো ভেঙেছিল কেননা ওগুলো ওর যৌনতাকে চাগিয়ে তুলছিল অথচ মাঠের মধ্যে মেয়েদের ধরে-ধরে ধর্ষণ করতে পারছিল না ; সে কাজগুলো করছিল ওর সেনারা, ঘোড়ায় তুলে নিয়ে খোলা মাঠেই ধর্ষণ করছিল । কুতুব উদ্দিনের মূল কৃতিত্ব আসলে রাজ্য বিস্তারের থেকেও ইসলামের প্রচার আর প্রসার ।  কুতুবউদ্দিন আইবেক কমপক্ষে এক হাজার মন্দির ধ্বংস করে সেই ভিত্তির উপরেই নতুন করে মসজিদ নির্মাণ করেছিল। হিন্দুদের উপর ন্যক্কারজনক হত্যা, নিপীড়ন, তাদের মন্দির দখলের প্রক্রিয়া চলতেই থাকল শাসক শ্রেণীর প্রত্যক্ষ মদতে আর ছত্রছায়ায়। দিল্লীর জামে মসজিদের পূর্বদিকের প্রবেশপথে কোরআনের আয়াত লেখা সোনার পাতগুলো বানানো হয়েছে বিভিন্ন মন্দির থেকে লুট করা সাতাশটা সোনার প্রতিমা গলিয়ে। 


হজরত ইবলিশ : তাহলেই বোঝো কেমন প্রজাবৎসল শাসক ছিল ।


কিশোরী শরণ লাল : কুতুবউদ্দিন আইবেকের মন্দির এবং প্রতিমা ভাঙার খ্যাতি অতীতের সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তার সমসাময়িক বা পরেও মন্দির বা প্রতিমা ভাঙার ক্ষেত্রে তার ধারে কাছে কেউ নেই।তাদের ওসকাতে ইরান, আফগানিস্তান থেকে দলে আসতে লাগল সুফি দরবেশ, ইসলামী পণ্ডিত। রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় এবং পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় হিন্দুদের ইসলামের দাওয়াত দেয়া চলতে লাগল সমানতালে। পরিস্থিতি কেমন ছিল, একটা উদাহরণ দিলে হয়ত একটু বোধগম্য হবে, কুতুবউদ্দিন আইবক যখন কৈল/কালিঞ্জার, এখনকার আলীগড়ে পৌঁছায়, তখন যেসব সৈন্য বুদ্ধিমান এবং ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরেছিল, তারা দলে দলে ইসলাম কবুল করতে শুরু করে। আর যারা নিজেদের আবহমান কাল ধরে পিতৃপুরুষের প্রচলিত ধর্ম ত্যাগ করে ইসলামের ছায়া তলে আসেনি তারা চিরতরে তলোয়ারের ছায়াতলে চলে যায়। আলীগড়ে মুসলমানের আধিক্য এই কারণেই আর ওরা সেই জন্যই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে পেরেছিল ।


কুতুবউদ্দিন আইবক : আমার পূর্বপুরুষেরা ছিল তুর্কি হাবশি  । আমার একটা আঙুল কাটা  । শৈশবে হাবশি  দাস  হিসেবে বিক্রি করা হলে আমাকে কেনে  ইরানের খোরাসান অঞ্চলের  নিসাপুরের প্রধান কাজী  । কাজী  আমাকে পড়াশোনার সুযোগ দিয়েছিল, আর ফার্সি এবং আরবি ভাষায় দক্ষ করে তোলে। সেই সঙ্গে আমাকে তীর চালানো আর ঘোড়ায় চড়া শিখিয়েছিল ।কাজি মারা যাবার পরে ওনার ছেলে আমাকে আবারও এক দাস বণিকের কাছে বিক্রি করে দেয়। আমাকে এবার কিনে নেয় গজনির গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ ঘুরি।  মুহাম্মদ ঘুরি আমাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেয় আর নিজের সহচর হিসেবে নিয়োগ করে। আমিও ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগতুম, আমার কাটা আঙুল, কেনা গোলাম আর গায়ের রঙ কালো বলে ।  হাসান নিজামী ঠিকই বলেছে যে আমার নির্দেশে হিন্দু মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি করা হত, যেমন স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ দিয়ে দিল্লির কুতুব মিনার কমপ্লেক্স এবং আজমিরের আধাই দীন কা ঝোপড়া তৈরি করা হয়েছে । আমি বেশিদিন রাজত্ব করিনি ;   সুলতান হিসেবে ১২০৬ থেকে ১২১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ,মাত্র চার বছর  সুলতানগিরি করেছিলুম ।ওইটুকু সময়েই খাজুরাহোর অনেকগুলো মন্দির ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিলুম । কুতুব মিনার তৈরি করতে অনঙ্গপাল তোমারের দুর্গ ভেঙে তার মালমশলা ব্যবহার করেছিলুম । অনঙ্গপালের লোহার মিনার কুতুবমিনারের পাশেই আছে । দেখেছেন নিশ্চয়ই ?


হজরত ইবলিশ : কুতুবউদ্দিন আইবক শাসক না হলে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভব হতো না ; ওখানে অতো ছাত্র-ছাত্রীর জমায়েত তো কাফেরদের ধর্ম পালটানোর কারণে ।


তসলিমা নাসরিন : খাজুরাহোর পুলিশদের একজনের নাম বিধু বিশ্বাস। আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বলেছেন। পূর্ববঙ্গে ছিল তাঁর পূর্বপুরুষের বাড়ি, ১৯৬৫ সালে বাবা মা চলে আসেন ভারতের মধ্যপ্রদেশে, এখানেই বাবার চাকরি হয়ে যায়, এখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যান। বিধু বিশ্বাস কোনও দিন পূর্ববঙ্গে যাননি, ঢাকায় তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিও দেখেননি। নচিকেতার গান শুনেছেন ? জিজ্ঞেস করে টের পেলাম নচিকেতার নামই শোনেননি কখনও। বাংলাটা বলতে শিখেছেন বাড়িতে বাবা মা বাংলা বলতেন বলে, আর প্রতিবেশীদের অনেকে ছিলেন বরিশাল থেকে আসা, তাদের কাছ থেকেও শিখেছেন বাংলা। বাংলা পড়তে পারেন কি না জিজ্ঞেস করলে আমার আশঙ্কা হয় বিধু বিশ্বাস বলবেন যে তিনি বাংলা পড়তে পারেন না। এই উত্তরটি শুনতে ভালো লাগবে না বলেই জিজ্ঞেস করিনি। তাঁর বাবা নাকি একবার বলেছিলেন, ‘দেশের গাছ থেকে আম খেতাম, এত বড় বড় কাঁঠাল হতো কাঁঠাল খেতাম, পেয়ারা খেতাম, লিচু খেতাম, পুকুরের মাছ খেতাম, আহা কী সুখেই না ছিলাম! এ কোন দেশে এলাম, এখানে তো মাটি নেই, চারদিক শুকনো, কিছুই ফলে না, চারদিকে শুধু পাথর, শুধু পাথর।’ বিধু বিশ্বাস আমার মনে হয় তাঁর বাবার কথাগুলো শুধু শুনে গেছেন, অনুভব করতে পারেননি। তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, সব মধ্যপ্রদেশে। মধ্যপ্রদেশের বাইরেও কোথাও যাননি। জানেন না বাংলা ঠিক কাকে বলে, কেমন দেশকে বাংলাদেশ বলে। তাঁকে বলি একবার ঢাকা ঘুরে আসতে। একবার দেখে আসতে তাঁর বাপ-দাদার ভিটেমাটি, দেখে আসতে গাছগাছালি, পুকুর নদী। মনে আছে নচিকেতা কেমন কেঁদেছিলেন পূর্বপুরুষের মাটিতে গিয়ে ! জানি না বিধু বিশ্বাস সেভাবে কাঁদবেন কি না। ধর্মের কারণে মানুষের উদ্বাস্তু হওয়াটা আমাকে কাঁদায়। ‘ফেরা’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলাম অনেক আগে, ওই উপন্যাসে লিখেছিলাম নিজের দেশের মাটি ত্যাগ করার কষ্টের কথা। আমার নিজের কিন্তু তখনও নির্বাসন দণ্ড হয়নি। তার আগেই মানুষের নির্বাসনের কষ্টটা কী করে অনুভব করেছিলাম জানি না। ধর্মের কারণে মানুষ নিষ্ঠুর হয়েছে, স্বার্থান্ধ হয়েছে। নিষ্ঠুরতা আর স্বার্থান্ধতার কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। বিধু বিশ্বাসের বাবার মতো কত মানুষ যে উদ্বাস্তু হয়েছে, নিজের ভাষা আর সংস্কৃতি থেকে দূরে সরতে বাধ্য হয়েছে! বিধু বিশ্বাসের ছেলে মেয়েরা কি নিজেদের বাঙালি বলে? হয়তো বলে না। কিন্তু বিধু বিশ্বাস ইচ্ছে করলে যেতে পারেন বাংলাদেশে, ঘুরে বেড়াতে পারেন ও দেশে। আমি পারি না। আমারই অনুমতি নেই বাংলাদেশে ফেরার। মাঝে মাঝে ভাবি ওরা অমুসলিম হয়ে যত অপরাধ করেছে, আমি অধার্মিক হয়ে তার চেয়েও বেশি অপরাধ করেছি। আসলেই কি আমরা অপরাধ করেছি? নাকি তারাই অপরাধী যারা আমাদের আদর্শ বা বিশ্বাসের কারণে আমাদের অত্যাচার করে, আমাদের ধর্ষণ করে, হত্যা করে, আমাদের জেলে পোরে, নির্বাসনে পাঠায়?


রাহিলা :  আমি  বিজয়শক্তির ছেলে । আমার রাজত্বকাল ৮৮৫ সাল থেকে ৯০৫ সাল ।অন্যান্য প্রারম্ভিক চান্দেলা শাসকদের মতো আমিও প্রতিহারের অধস্তন ছিলুম।আমি বহু সামরিক অভিযান চালিয়েছিলুম যার কথা পাওয়া যাবে আমার বংশধরদের লেখা  দুটো খাজুরাহো শিলালিপিতে  । শিলালিপিতে যোদ্ধা হিসাবে আমার প্রশংসা করা হয়েছে ।  ‘পরমালা রাসো’ কিংবদন্তিতে, আমার সামরিক অভিযানের  বিবরণ আছে । প্রজাদের জন্য আমি  বেশ কয়েকটা কাজ করেছিলুম ।  অজয়গড় মন্দিরের শিলালিপিতে আমার নাম আছে । মহোবার রহিল্য সাগর হ্রদ, যার তীরে একটা মন্দির আছে, তা আমার নামে । ‘পরমালা রাসো’ অনুযায়ী  রাজাবাসিনী জনপদটা প্রতিষ্ঠা করেছিলুম, যা বাদৌসার কাছে এখন রসিন গ্রাম । এই গ্রামে চান্দেলা ধাঁচের মন্দির আছে। 


যশোবর্মণ : কোনও ব্যাটা নেড়ে রাজা-সুলতান মন্দিরগুলোর পেছনে যে কাহিনি আছে তা জানার চেষ্টা করেনি। গল্পটা এই রকম । বারানসীতে হেতম্বী নামে পরমা সুন্দরী এক ব্রাহ্মণ কন্যা ছিলেন। অল্প বয়সেই তিনি বিধবা হন। একবার গ্রীষ্মের এক জ্যোৎস্না আলোকিত রাতে তিনি যখন ঝিলের জলে স্নান করছিলেন, তখন স্নানরতা অবস্থায় তাঁকে দেখে চন্দ্রদেব মুগ্ধ হন ও তাঁকে কামনা করেন। চন্দ্র মানুষের রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে আসেন এবং হেতম্বী ও চন্দ্রদেব মিলিত হন। শারীরিক মিলনের ফলে হেতম্বী গর্ভবতী হয়ে পড়েন ও নিজের ভুল বুঝতে পেরে চিন্তিত হয়ে পড়েন। চন্দ্রদেব তখন ভবিষ্যৎবাণী করেন যে হেতম্বীর গর্ভে যে সন্তান আছে, সে হবে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী ও খাজুরাহোর প্রথম রাজা। হেতম্বী বারানসী ত্যাগ করে দূরে খেজুরবনে গিয়ে সন্তানের জন্ম দেন। সন্তানের জন্মের পর হেতম্বী তাঁর নাম রাখেন চন্দ্রবর্মণ। পিতার মতোই সে সাহসী ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। চন্দ্রের আদেশে চন্দ্রবর্মণ ওই এলাকায় মন্দির নির্মাণ করেন ও মন্দিরগাত্রে চন্দ্রপ্রভাবিত মূর্তি খোদাই করেন।  হেতম্বী আর চন্দ্রদেবের কাম ও প্রেমের নিদর্শন হিসেবেই খাজুরাহো মন্দির তৈরি করিয়েছিলুম । বেশিরভাগটাই দেবদেবীদের মিলন মুহূর্তের ছবি। নগ্ন শরীর, আর যৌনতা–--প্রাচীন বা ভারতীয় ঐতিহ্যে বিভিন্ন সংস্কৃত কাব্যে দেখি যে এই সমস্তর অনুপুঙ্খ বিবরণ। অর্থাৎ প্রাচীনকালে ভারতীয় সংস্কৃতিতে মিলনের বর্ণনাকে অশ্লীল বলে চিহ্নিত করা হয়নি । তাই মন্দির জুড়ে শুধু যৌনতা আর কামের ছবি। চন্দ্রের ভবিষ্যৎবাণী ছিল এই মন্দির  হেতম্বীকে তার পাপ থেকে মুক্তি দেবে। যাঁরা খাজুরাহো দেখতে আসেন তাঁরা নিজস্বপাপ মুক্তির জন্য আসেন ।

 

চন্দ্রবর্মণ : চন্দ্র দেবতা এবং এক রূপসী ব্রাহ্মণকন্যা হেমবতীর মিলনে এক পুত্র জন্মায়৷ নাম দেওয়া হয় চন্দ্রবর্মন৷ আমি সেই চন্দ্রবর্মন, যার হাতে চান্দেলা রাজবংশের জন্ম৷ খাজুরাহো ছিল চান্দেলা রাজপুত রাজাদের রাজধানী৷ চন্দ্রবর্মনের হাতে শুরু হয়ে ৯৫০ সাল থেকে ১০৫০ সাল পর্যন্ত একশো বছর ধরে বংশের নানা রাজার সময়ে বেলেপাথরের পঁচাশিটা মন্দির গড়ে ওঠে খাজুরাহোয়৷ তৈরি হয়েছে সৃষ্টিরক্ষার দেবতা বিষ্ণু ও সৃষ্টি-ধ্বংসের দেবতা শিবের এইসব মন্দির৷ অবস্থান হিসাবে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে খাজুরাহোর মন্দিররাজি : পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ । এক,  অনবদ্য লক্ষ্মণ-- পশ্চিমের মন্দির, বারোটা মন্দির নিয়ে৷ মিথুন মূর্তির আধিক্য ঘটেছে লক্ষ্মণ মন্দিরের নিম্নভাগে৷ দুই, যুদ্ধ জয়ের স্মারক--- রয়েছে একত্রিশ মিটার উঁচু শিখরওয়ালা কাণ্ডারীয় মহাদেব মন্দির৷ খাজুরাহোর বৃহত্তম আর উচ্চতমও বটে ।  গজনির মাহমুদের সাথে যুদ্ধজয়ের স্মারক রূপে ১০৩০-এ মহারাজা বিদ্যাধরের তৈরি কান্ডারীয় মন্দির৷ তিন, পান্নার শিব- জগদম্বা থেকে সামান্য উত্তরে পুবমুখী চিত্রগুপ্ত অর্থাৎ সূর্য মন্দির৷ অর্ধমণ্ডপ, মহামণ্ডপ, অন্তরাল ও সভাগৃহ–চার স্তরে তৈরি মন্দিরের ভাস্কর্য  ৷ সিলিং-এর অলঙ্করণে অভিনবত্ব আছে৷চার, দুলাদেও--- দুলাদেও অর্থাৎ নববধূ৷ দুলাদেও আর চতুর্ভুজ এই দুই মন্দির নিয়ে দক্ষিণমন্দির গোষ্ঠী৷ মূল চবুতরা থেকে দেড় কিলো মিটার দক্ষিণে দুলাদেও মন্দির৷


হজরত আদম : খাজুরাহোর মন্দিরগুলোর আনাচে কানাচে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক কাহিনী। একটা গল্প পাপমোচনের আবার একটা  অভিশাপের। হেতম্বী চন্দ্রদেবের সঙ্গে মিলনের পাপবোধে ভুগছিলেন। তাকে সেই পাপবোধ থেকে মুক্তি দিতেই তার সন্তান চন্দ্রবর্মন রতিক্রিয়ায় রত এই পঁচাশিটা মূর্তি নির্মাণ করান। সব মূর্তিতেই  দেব-দেবীদের দেখানো হয়েছে।  আরেকটি কাহিনী রয়েছে অভিশাপের। খাজুরাহো গ্রামে এক সাধু আসেন। তিনি তার শিষ্যদের সেখানে রেখেই যান কোথাও। সেই সময়েই তার শিষ্যরা এক রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। তবে গ্রামের কেউই তাদের সাহায্য করেনি ভেষজ বা জল দিয়ে। সাধু ফিরে এসে সেইসব কথা জানতে পেরে রেগে গিয়ে গ্রামবাসীদের অভিশাপ দিয়েছিলেন যে পাষাণের মতো কঠোর বাসিন্দারাও পাথর হয়ে যাবে। সেই থেকেই গ্রামবাসীরা নাকি পাষাণে পরিণত হয়েছে কামরত অবস্থায়। আবার অন্যদিকে এক মহিলা তাদের শুধুমাত্র অল্প সাহায্য দিতে এগিয়ে এসেছিলেন। তার ভূমিকায় মুগ্ধ হয়ে সাধু তাকে বলেছিলেন পিছনে না তাকিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে। তবে কৌতূহলী মেয়েটি তার বিপরীত কাজটি করেছিল। কিছুদূর গিয়েও সাধুর আদেশ অমান্য করে পিছনে ফিরতেই সেও পাথর হয়ে যায়। সেই থেকেই এই মন্দিরে সন্ধের পর আর কেউ যায় না, পাথর হয়ে যাওয়ার ভয়ে।


যশোবর্মণ : খাজুরাহো (খর্জুরবাহক) স্মারকগুলো রাজপুত বংশোদ্ভুত চান্দেল রাজবংশের অধীনে ৯৫০ ও ১০৫০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে নির্মিত।   এই সময়টা ছিল আমাদের রাজবংশের শাসনের স্বর্ণযুগ। বর্তমানে এই স্মারকসমূহের যেগুলো অক্ষত অবস্থায় আছে সেগুলো যৌথভাবে হিন্দু ধর্ম এবং জৈন ধর্ম-এর স্থাপত্য। এগুলোতে  নানান স্থাপত্যশৈলীর বিস্ময়কর মিশ্রণ দেখা যায়। এই স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন কন্দারিয়া মন্দির। ছয় বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট মন্দিরপ্রাঙ্গণে নির্মিত পঁচাশিটা মন্দিরের মধ্যে মাত্র বাইশটা মন্দির এখনো টিকে আছে ; বাকিগুলো ভেঙে দিয়ে গেছে বহিরাগত ম্লেচ্ছ শাসকরা। মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত এই অঞ্চলটি ১৯৮২ সালের ১৫ অক্টোবর ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয় । দ্বাদশ শতাব্দীর ম্লেচ্ছ-আক্রমণের আগে চন্দেলা সংস্কৃতির অনন্য এবং মৌলিক শিল্পকৌশলের নিদর্শন ও প্রমাণ এবং একটি সাংস্কৃতিক সম্পত্তি হিসাবে মন্দিরগুলো পৃথিবীর বিস্ময় ।


ঐতিহাসিক লীলা গান্ধি : অঞ্চলটা ঐতিহাসিকভাবে অনেক রাজ্য এবং সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। খাজুরাহোর এই অঞ্চলে সর্বাধিক পরিচিত শক্তি ছিল ভটসা। এই অঞ্চলে তাদের উত্তরসূরিদের মধ্যে মৌর্য, সুঙ্গাস, কুশান, পদ্মাবতীর নাগ, ভাকাতক রাজবংশ, গুপ্ত, পুষ্যভূতি রাজবংশ এবং গুজরা-প্রথর রাজবংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। গুপ্ত আমলে বিশেষত এই অঞ্চলে স্হাপত্য এবং শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল, আর তাদের উত্তরসূরীরা শৈল্পিক ঐতিহ্য অব্যাহত রেখেছিল।  চান্দেলারা এই অঞ্চলটি নবম শতাব্দী থেকে শাসন করেছিলেন যদিও তারা গুজারা-প্রথারাসের অধীন ছিল। ধঙ্গদেবের রাজত্বকালে চান্দেলা স্বাধীন হয়েছিল এবং এই সময়ে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ মন্দির নির্মিত হয়েছিল। ১১৮২ সালে শাকম্ভরীর চাহামানাসের পরে কুতুব উদ্দিন আইবক  ১১০২ সালে চান্দেলাদের মারাত্মক আক্রমণ করে। চান্দলারা মহোবা, কালিনজর এবং অজয়গড়ের দুর্গে চলে যাওয়ার ফলে খাজুরাহো একটি ছোট্ট গ্রামে পরিণত হয়। ইবনে বতুতা খাজুরাহো ঘুরে দেখেছিল এবং মন্দিরের উপস্থিতি এবং কয়েকজন তপস্বীর বর্ণনা দিয়েছিল। কিছু মন্দির ১৪৯৯ সালে সিকান্দার লোদি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে খাজুরাহো একটি তুচ্ছ জায়গা হয়ে যায় এবং ১৮১৯ সালে সিজে ফ্রাঙ্কলিন (সামরিক সমীক্ষক) দ্বারা  "পুনরায় আবিষ্কার" করার আগে এলাকাটি অবহেলিত ছিল। তবে খাজুরাহোকে বিশ্বের নজরে ফিরিয়ে আনার প্রকৃত অবদান টি.এস. বার্ট-এর (একজন ব্রিটিশ সেনা ক্যাপ্টেন)  যিনি এটি ১৮৩৮ সালে পরিদর্শন করেছিলেন। পরবর্তী উল্লেখযোগ্য দর্শনার্থী ছিলেন ১৮৫২ থেকে ১৮৫৫ সালের মধ্যে আলেকজান্ডার কানিংহাম। 


ধঙ্গদেব :  শিলালিপিতে আমি ধঙ্গদেব নামে খ্যাত, ভারতের চান্দেলা রাজবংশের একজন রাজা ছিলুম। আমি জেজকভূক্তি অঞ্চলে (বর্তমান মধ্য প্রদেশে বুন্দেলখন্ড) শাসন করতুম। আমি প্রতিহরদের অধীনতা অস্বীকার করে চান্দেলাদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলুম।  বিশ্বনাথ মন্দির সহ খাজুরাহোতে চমৎকারর মন্দিরগুলি গড়িয়েছিলুম । আমার বাবা ছিলেন যশোবর্মণ এবং তাঁর রানী পুপা (পুষ্প) দেবী। আমার রাজত্বকালে  প্রথম শিলালিপি ৯৫৩-৯৫৪ সালের  চতুরভুজ শিলালিপি। এর আগেই আমি সিংহাসনে আরোহণ করেছিলুম। আমার আরোহন বিতর্কিত ছিল, কারণ তাঁর ভাই কৃষ্ণকে রাজ্যের মালওয়া সীমান্ত রক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল।  আমার সময়ের অন্যান্য শিলালিপিগুলির মধ্যে রয়েছে নানারা (বা নানৌউরা) শিলালিপি, ৯৯৮ সালের এবং খাজুরাহোতে লালাজি শিলালিপি -- ৯৯৯ সালের ।  বংশধরদের শিলালিপিতেও আমার নাম পাওয়া যাবে।


ঐতিহাসিক বিশ্বনাথ দত্ত : পরবর্তী মধ্যযুগীয় গ্রন্থগুলো ছত্রিশটা রাজপুত বংশের মধ্যে চান্দেলাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে করে, যদিও সেই সময়কালে রাজপুত বলে কিছু ছিল না । তারা ষোড়শ শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়েছিল। এই ধরনের গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে মহোবা-খন্দ, বর্ণ রত্নাকারা, পৃথ্বীরাজ রাসো এবং কুমারপাল-চরিত। বংশের উৎসের মহোবা-কাণ্ড কিংবদন্তিটি এইরকম: বেনারসের গহরওয়ার রাজার পুরোহিত হেমরাজের এক সুন্দর কন্যা ছিল, যার নাম হেমাবতী। একবার, হেমাবতী যখন একটি পুকুরে স্নান করছিলেন, তখন চাঁদ দেবতা চন্দ্র তাকে দেখে তাঁর প্রতি প্রেম করেছিলেন। অবিবাহিত মা হওয়ার অসম্মান নিয়ে হেমাবতী উদ্বিগ্ন ছিলেন, কিন্তু চন্দ্র তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে তাদের পুত্র মহান রাজা হয়ে উঠবেন। এই শিশুটি ছিলেন রাজবংশের পূর্বসূরি চন্দ্রবর্মা। চন্দ্র তাঁকে একজন দার্শনিকের পাথর দিয়ে উপস্থাপন করেছিলেন এবং তাঁকে রাজনীতি শিখিয়েছিলেন।  রাজবংশের নিজস্ব রেকর্ডগুলিতে হেমাবতী, হেমরাজ এবং ইন্দ্রজিৎ উল্লেখ নেই। এইরকম কিংবদন্তিগুলি পরে দরবারি কবিদের আবিষ্কার বলে মনে হয়। সাধারণভাবে, মহোবা-কাণ্ড ঐতিহাসিকভাবে অবিশ্বাস্য। এমনকি পৃথ্বীরাজ রসোও  ঐতিহাসিকভাবে অবিশ্বাস্য  হিসেবে বিবেচিত।


হাসান নিজামি : আমার বই ‘তাজ-উল-মাসির-এ লিখেছি যে, সোমনাথ মন্দিরের ছাদ থেকে ঝুলন্ত ঝাড়বাতি মূল্যবান রত্নাদিতে খচিত ছিল। পরবর্তীকালের লেখক ফিরিস্তার মতে, গজনির সুলতান মাহমুদ ফাঁপা পাথরে তৈরি বিগ্রহ ভেঙে ফেলে তার ভেতরে রাখা হীরা ও মণি-মাণিক্য হস্তগত করে।  লিঙ্গদেবতাটি সম্পূর্ণরূপে নিরেট স্বর্ণের তৈরি ছিল। লোদি সুলতানরা মুসলমান ছিল এবং তাদের পূর্বসূরীদের মতো তারাও মুসলিম বিশ্বের উপর আব্বাসীয় খিলাফতের কর্তৃত্বকে স্বীকার করতো । যেহেতু সিকান্দার লোদির মা একজন হিন্দু ছিলেন, তাই সিকন্দার লোদি রাজনৈতিক সাফল্য হিসাবে শক্তিশালী সুন্নি গোঁড়ামির আশ্রয় নিয়ে তার ইসলামিক প্রমাণাদি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিল। ও হিন্দু মন্দিরগুলি ধ্বংস করেছিল আর আলেমদের চাপের মুখে একজন ব্রাহ্মণকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার অনুমতি দিয়েছিল, যিনি হিন্দু ধর্মকে ইসলামের মতো ভদ্র বলে ঘোষণা করেছিলেন। সিকন্দর লোদি মহিলাদের মধ্যে মুসলিম সাধুদের মাজার (সমাধি) দেখতে নিষেধ করেছিল এবং কিংবদন্তি মুসলিম শহীদ সালার মাসুদের বর্শার বার্ষিক মিছিল নিষিদ্ধ করেছিল। 


হজরত ইবলিশ : সিকন্দর লোদি বেজন্মা বলে পরিচিত ছিল, ওর সভাসদদের মাঝে । 


মুহম্মদ নাজিম :  গজনির সুলতান মাহমুদ তার তলোয়ারের এক আঘাতে সোমনাথের শিবলিঙ্গটি ধ্বংস করেন। যদিও তিনি বিগ্রহ ধ্বংস করেন তা হলেও একথা নিশ্চিত করে বলা যায় না যে, বিগ্রহে রক্ষিত রত্নাদি  অথবা এর গায়ে খচিত মণি-মাণিক্য ) সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই তিনি মূর্তি ধ্বংস করেন। স্বর্ণ ব্যতীত গজনভী মুদ্রা প্রস্তুত অসম্ভব বলেই সম্ভবত এটি করা হয়। মুহম্মদ হাবিব বলেন যে, সোনা এবং রূপার তৈরি বিগ্রহ গলিয়ে গজনভীর মুদ্রায় রূপান্তরিত করা হতো। ধ্বংস করেছিল কাফেরনিধনের উদ্দেশ্যে ।


হজরত আহনাফ : মুহম্মদ ঘুরির আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর পরামর্শে শেষ রাতের দিকে পৃথ্বীরাজ চৌহানের উপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অতর্কিত আক্রমণে চৌহানের সেনাবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। রাতের আঁধারে ঘোড়সওয়ারী তরোয়ালধারী ম্লেচ্ছ আফগান-তুর্কি সেনাদের যৌথ আক্রমণ প্রতিহত করে পাল্টা আক্রমণ  করেই বিপুল সৈন্যক্ষয় হয়ে যায়। ঘোড়ায় চড়া তীরের মত গতিবেগের ম্লেচ্ছ সেনাদের রুখতে পারে না চৌহানবাহিনী। শেষ রাত থেকে অভুক্ত অবস্থায় যুদ্ধ করতে করতে পৃথ্বীরাজের সেনাবাহিনী তখন ক্লান্ত, তাদের শেষ শক্তি ক্ষয় হয়ে আসছে, এদিকে যুদ্ধ চলছে একনাগাড়ে শেষরাত পেরিয়ে সকাল গড়িয়ে দুপুর পর্যন্ত। ইতিমধ্যে সেনাদের মাঝে সেনাপতি খাণ্ডেরাও মারা যাওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার ফলে তাদের মনোবল ভগ্নপ্রায় এবং অবিন্যস্ত। এরকম ছত্রভঙ্গ সেনাদের উপর নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ল তরোয়াল হাতে দ্রুত গতির অশ্বারোহী  ১২০০০ ম্লেচ্ছ সেনা। তাদের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তখন  পৃথ্বীরাজের সেনাবাহিনীর আর অবশিষ্ট ছিল না। তারা  বেঘোরে ম্লেচ্ছদের হাতে মারা পড়তে লাগল। এদিকে যুদ্ধ দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত যুদ্ধ চলতে থাকে। যুদ্ধের নতুন কৌশল নিয়ে আলোচনার জন্য ১৫০ জন ঊর্ধ্বতন সেনানায়ক এবং মিত্র রাজাদের নিয়ে পৃথ্বীরাজ চৌহান একটা গাছের ছায়ার নিচে দাঁড়ায়। তারা মরণপণ যুদ্ধের শপথ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরার আগেই তুর্কি আফগান ম্লেচ্ছ বাহিনী চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং একই সাথে চলতে থাকে বৃষ্টির মত তীর নিক্ষেপ, তখনই আসলে বেজে গেছে মরণঘন্টা। তুর্কি এবং আফগান ম্লেচ্ছবাহিনীর আক্রমণে রাজপুতরা নিমেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। শেষ মুহূর্তে চৌহান রাজপ্রাসাদের দিকে পালানোর চেষ্টা করলেও ঘুরির হাতে বন্দী হয়ে যায়। পৃথ্বীরাজ চৌহানকে বন্দী করেই মুহম্মদ ঘুরি চলে যায় রাজপ্রাসাদে রাণী সংযুক্তার খোঁজে। তখন সম্ভ্রম রক্ষায় সংযুক্তা তার দাসীদের নিয়ে জহরব্রত করার জন্য প্রস্তুতি নিলেও ততক্ষণে ঘুরি রাজপ্রাসাদে পৌঁছে যায় এবং তাকেও বন্দী করে নিয়ে আসে। বাইরে তখনো যুদ্ধ চলছে সমান তালে, এদিকে কিছুমাত্র সময় দেরী না করে পৃথ্বীরাজ চৌহানের সামনেই তার প্রিয়তমা সুন্দরী স্ত্রী সংযুক্তাকে ধর্ষণ করে ঘুরি। পৃথ্বীরাজকে ইসলাম কবুল করার জন্য চাপ দিতে থাকে ঘুরি। কিন্তু চৌহান রাজি হয় না। আর এদিকে চলতে থাকে সংযুক্তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ। বন্দী অবস্থায় চৌহান ঘুরিকে হুংকার দিলে ঘুরি চৌহানের চোখ অন্ধ করে দেয়। ১৫ দিন একনাগাড়ে সংযুক্তাকে ধর্ষণ করার পর ঘুরি চৌহানের শিরশ্ছেদ করে কাটা মাথাটা খাজা মইনুদ্দিন চিশতীকে উপহার দেয়। চৌহানের কাটা মাথা দেখে, খাজা মইনুদ্দিন চিশতী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “অনেক কষ্টের পর অবশেষে আমরা চূড়ান্ত বিজয় পেলাম।”

ঐতিহাসিক পাপিয়া ঘোষ : রাজপুত (সংস্কৃত রাজা-পুত্র থেকে, "একজন রাজার পুত্র") বর্ণ, গোত্র এবং স্থানীয় গোষ্ঠীগুলির একটি বৃহত  উপাদানে গড়া, যা ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভূত  বংশদ্ভুত সামাজিক অবস্থান  নিয়েছে। রাজপুত শব্দটি কোনও বর্ণকে চিহ্ণিত করে না । গোষ্ঠীটিতে আকাধিক বর্ণ আছে । বৌদ্ধিকতার সাথে ঐতিহাসিকভাবে  বিভিন্ন পিতৃতান্ত্রিক গোত্রকে অন্তর্ভুক্ত করেছে: বেশ কয়েকটি গোষ্ঠী রাজপুত মর্যাদার দাবি করে, যদিও সমস্ত দাবি সর্বজনস্বীকৃত নয়। আধুনিক পণ্ডিতদের মতে প্রায় সমস্ত রাজপুত বংশের উৎপত্তি কৃষক বা যাজক সম্প্রদায়ের থেকেই হয়েছিল এবং বহু গোষ্ঠির জন্ম গ্রিকদের বংশধর থেকে । সুতরাং চান্দেলাদেরও সেই দৃষ্টিকোন থেকে দেখতে হবে । 

হজরত ইবলিশ : ম্লেচ্ছরা যদি খাজুরাহোর মন্দিরগুলো অক্ষত রাখতো তাহলে তারা এদেশের লোকেদের শ্রদ্ধা অর্জন করতো । তাদের জন্যই এখন সারা আল-হিন্দে ম্লেচ্ছদের সবাই ঘেন্না করে । আর খাজা মইনুদ্দিন একন চিশতি হয়ে কেমন করে জঘন্য কাজকে উৎসাহ দিয়েছিল । লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে ।

                                     ---------------XXXXXXX------------------

 


বুধবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২১

সোনালী চক্রবর্তীর 'জামার নীচে অলীক মানুষ' : মলয় রায়চৌধুরী

 

সোনালী চক্রবর্তীর ‘জামার নীচে অলীক মানুষ’ : মলয় রায়চৌধুরী

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত ‘জামার নীচে অলীক মানুষ’ কাব্যগ্রন্হটি 

সোনালী চক্রবর্তী আমাকে পাঠিয়েছিলেন ২০১৮ সালের জুন মাসে । 

এই বইতে আমাকে নিবেদিত একটি কবিতা আছে ‘অবতার’ শিরোনামে, যেটি পড়ার পর 

-- আমি কবিতাটা প্রায়ই পড়ি -- বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে উনি আমার নিকট-কবিদের অন্যতম,

 কেননা কবিতাটিতে আমার কয়েকটা কবিতার লাইন আছে, যা ওনাকে আকৃষ্ট বা বিস্মিত করে থাকবে । 

আজকে পয়লা বৈশাখ, বইটা নিয়ে লেখার আগ্রহ হলো । কবিতাগুলো আমি অনেকবার পড়েছি,

 হ্যাঁ, সোনালী চক্রবর্তীর কবিতা বলেই । ওনার শৈশব কৈশোর কেটেছে বেনারসে আর উত্তরবঙ্গে। 

উনি ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এবং লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের গবেষক ।


সোনালী চক্রবর্তী থাকেন কৃষ্ণনগরে । গ্রামীণ উন্নয়নের চাকুরিসূত্রে কৃষ্ণনগরে গেছি । 

প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে। অনুমান করি সোনালী চক্রবর্তীর তখন জন্ম হয়নি ।

 সেই সময়ে অফিসের ট্যুরে আমি আমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যেতুম, পশ্চিমবাংলাকে দেখাবার জন্য । 

আমরা ছিলুম একটি বাঙালি পরিবারের পেইঙ গেস্ট ; পরিবারটি আমাদের জন্যে তাঁদের দুই মেয়ের

 শোবার ঘরটা দিয়েছিলেন । ড্রেসিঙ টেবিলে রাখা নানা কসমেটিকস দেখে আন্দাজ করেছিলুম

 যে সাম্প্রতিকতম কসমেটিকস, কেবল মুম্বাইতে নয়, কৃষ্ণনগরেও পৌঁছে যায় । 

আমি ট্যুরে গিয়ে নিজের সাহিত্যিক পরিচয় দিতুম না ; আমার স্ত্রীও সেসময়ে চুড়িদার পরত বলে

 আত্মপরিচয়কে গোপন রাখতে পারতুম । কৃষ্ণনগরের শিল্পীদের কাজ দেখার সুযোগ হয়েছিল

 এবং অনেকে মূর্তি বা মুখ উপহার দিতে চাইতেন । নিয়ে যেতে গেলে ভেঙে যাবে,

 জানিয়ে ছাড়া পাওয়া যেতো । এখন সোনালী চক্রবর্তীর বইটা আলোচনা করতে বসে

 সেই দিনকার কৃষ্ণনগর স্মৃতিতে ভেসে উঠল । এমন এক কৃষ্ণনগর যেখানে সোনালী চক্রবর্তী

 নামে এক কবি অনুপস্হিত  । তাই বইটা পড়তে-পড়তে কৃষ্ণনগরে ওনার উপস্হিতির

 ঔজ্বল্য তৈরি করে নিতে হয়েছে ।


ওনার কাব্যগ্রন্হের ‘অবতার’ কবিতাটা পড়ে মনে আসে কবি জন ডন-এর উক্তি যে

 "কোনও মানুষ দ্বীপ নয়," এবং সোনালী চক্রবর্তীর কবিতাপাঠ  দ্বীপ নয়।

কবিতার লাইনগুলোর মধ্যে সংযোগ ঘটিয়েছেন বিভিন্ন উপায়ে আর  উল্লেখ করেছেন বাক্যের

 সঙ্গে আপাত-বিচ্ছিন্ন লিঙ্কগুলি হাইলাইট করার জন্য ।  ব্যবহার করেছেন এমন সমস্ত কৌশল 

 যাকে বলা যায় আন্তঃসংযোগ কৌশল । সোনালী চক্রবর্তীর কবিতা লেখার একটা বিশেষ শৈলী আছে ।

 কেবল এই বইতেই নয় । এর পরেও উনি যে কবিতাগুলো লিখছেন, লিখেছেন, তাতেও টের পাওয়া যায়,

 জটিলতা বা কমপ্লেকসিটিকে মাল্টিলিনিয়র বা বহুরৈখিক প্রস্তাবনা দিয়ে প্রতিটি পংক্তিকে

 উপস্হাপনার কৌশল । বহু কবিতার লাইন এবং পর-পর কয়েকটা লাইন সেকারণে কয়েকবার 

পড়ে নিতে হয় ।  ‘অবতার’ কবিতাটা পড়া যাক ; এই কবিতায় আমার বেশ কিছু কবিতার প্রসঙ্গে আছে ; 

আমি অন্য আরেকজন কবির পংক্তি ব্যবহার করেছি আমার কবিতায়, সেই লাইনও আছে, 

অর্থাৎ ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি, তার সাথে মেটাফিকেশন, অবিশ্বাস্য আখ্যান, স্ব-প্রতিচ্ছবি, 

আন্তঃদ্বন্দ্বীকরণ এবং সাংস্কৃতিক ইস্যুকে থিম্যাটাইজ করেছেন সোনালী চক্রবর্তী।

 

অবতার

( মলয় রায়চৌধুরীকে )

এক ভোররাতে কবিতা খুঁজতে ঈশ্বর ধুলো মাখলেন…

প্রথমেই দেখলেন,

জে এন ইউ-এর লেডি কিলারকে অনুবাদক বলছেন,

“সিরফ এক জাভেদানি সি নজর দে দে “

স্মিত হেসে না সরতেই চোখে ধরা দিল

সাহিত্য অ্যাকাডেমি পাওয়া সাহিত্যিকের হাতে

‘বাচ্চাদানি’ না থাকা মীরাবাঈয়ের গজল…

ঈষৎ বিষণ্ণ, চোখ ফেরালেন উপান্তে…

যেখানে নিশীথিনী চ্যাট বক্সে টাইপ করছেন ‘পদ্মের প্রস্ফুটন’

আর ট্রিপ বেশি হয়ে যাওয়ায়

যাদবপুর এইট বির ভবঘুরের মনে পড়ে যাচ্ছে

তার মাকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাওয়ার দুপুর । 

কেঁপে উঠল বুড়ো ভায়োলিন মাস্টারের ছড়

অথবা মায়াভ্রমে কীর্তনের আখর…

নির্লিপ্ত, ক্লান্ত...আলোকবর্ষের অন্তরীপ পার করে

ফিরিয়ে আনলেন বিস্মৃতির অতল ।

ফিরে গেলেন সেই জন্মে আবার, যেদিন তিনিও কবি ছিলেন…


মৌলিক শৈলী একজন কবি উদ্ভাবনার প্রয়াস করেন তাঁর সংস্কৃতিতে পুরোপুরি 

জীবনযাপন করার জন্য ; তাঁর সম্ভাবনার বোধকে সামঞ্জস্য দেবার জন্য । 

সোনালী চক্রবর্তী কবিতার পংক্তিগুলোয় যে আকস্মিক কমপ্লেকসিটি দিতে চেয়েছেন তা

 গতানুগতিক কাব্যিক কবিতার চৌহদ্দিকে এড়াবার কৌশল হিসেবে । তিনি কবিতাগুলোতে

 ঘটমান যেমন হয়েছে তেমনের পরিবর্তে কবির হাতে কী ঘটে তার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন ।

 কবিতাবিশেষের অন্তর্গত গুরুত্বপূর্ণ ধারণাটি  বাস্তব এবং কল্পনার মধ্যে ফারাক  দেখাতে চায় ।

 যার দরুন  কবিতাটি হয়ে ওঠে মনের কবিতা । অর্থাৎ যাপন থেকে শ্রমসাধ্য অভিযোজন ।

 রচনা কৌশল হিসাবে সোনালী চক্রবর্তী বঙ্গবিশ্বের ভঙ্গুরতাকে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন 

কোনো-কোনো কবিতায় । পড়া যাক ‘সমাপতন’ কবিতাখানা :


সমাপতন

এত দ্রুত কী করে বদলাও বলোতো ?

কই আই তো পারি না…

রক্তস্রোতে বিষ একবার মিশলে

শরীএর নীল হয়ে কালঘুম না আসা অব্দি

নির্লিপ্তির দায় কি শুধু আমার একারই হয় ?

ওই ধূসর গভীর দর্পণে চোখ মেলে

সূর্যকে অনুমতি দিতাম স্পর্শের,

শেষ রাতের আঙুলে যে মায়াটুকু লেগে থাকে,

আমি তার ঘ্রাণে ঘুমোতে চাইতাম অন্তত হাজার বছর ।

কস্তুরী গন্ধ ফিকে হতে হতে আর্দ্রতায় মিশে না গেলে

স্নানের জল নাগাল পায়নি আমার কোনওদিনই…

কানের কবিতায়, কোমরের হাঁসুলি বাঁকে,

যত যত উপকথা লিখে রাখা হত

লাসা ভ্রমণেরও অধিক আলো

তারা ছড়াত মরাল অন্ধকারে ।

.

আসলে কবিনী বলে কোনও শব্দ অভিধানে নেই,

মন্হনে অসুর আর অমৃত সহচরী গরল অনিবার্য হলেও

অমরত্ব লাভে বঞ্চনার নির্লজ্জ কৌশলটুকু

কৃতিত্ব বলেই গণ্য হয় ।



কবিতাগুলোর দুটি সত্তাতাত্বিক দিকগুলির মধ্যে গোপন উদ্বেগ রয়েছে।

 কবিতার দ্বৈতসত্তা গড়ে তোলার প্রয়াস দেখা যায় সোনালী চক্রবর্তীর রচনায়, 

যেন কবিতাবিশেষ একটি দ্বি-বিশ্ব সত্তাতাত্বিক গঠন, একটি হল: কবিতাটির বহির্মুখী সীমানা 

এবং কবিতা এবং বিশ্বের মধ্যে সম্পর্ক । অন্যটি হল অভ্যন্তরীণ সীমানা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ, 

অর্থাৎ টেক্সট ও মর্মার্থের সম্পর্ক বা বলা যায় উপস্হাপনার চেয়ে রচনাকে গুরুত্ব দেয়া।

 সমাজকে দূরে সরিয়ে রেখেও,  ব্যক্তিগত এবং নৈর্ব্যক্তিকতার মধ্যে এবং ঐতিহ্য ও নতুন পথ 

গড়ে তোলার আকর্ষণের মধ্যে----প্রধান মতবিরোধগুলো  ‘সমাজ’ এর মতো সিরিয়াস ব্যাপারের 

আধিপত্য অবলম্বন না করেই সমাধান করা যেতে পারে। পড়া যাক সোনালী চক্রবর্তীর ‘মা’ কবিতাটি :


মা

প্রখর রৌদ্রের কোলিয়ারিতে তোকে পেয়েছিলাম ছেলে

কোন খনিতে লুকিয়েছিলিস জানি না

খাদের ধারে দাঁড়িয়ে শেষ পা এগোনোর আগে

চৈত্রের হলকায় তোর চুলের ঝাপটা

আমার চোখ ঢেকে দিয়েছিল…

ধাঁধায় আমি আলাদা করতে পারিনি

ব্যারেজের জল, নীল আকাশ

পাথরের তাঁত আর তোর ফসফরাসের মতো চোখগুলোকে

তারপর হ্যামেলিন বাঁশি

প্রত্যন্ত ঘাঘরবুড়ি মন্দিরে সিঁদুর পুজো

দুই সন্ধ্যা মহুয়ামাদল

সিগারেট হাতে দিগন্ত পেরিয়ে

হাইওয়ে ধরে হেঁটে চলা

চলে আসতে হল, যেভাবে স্টেশন এলে নেমে যেতে হয়

তুই খনিজ, আকরিকতায় রয়ে গেলি

কোহিনুর দুর্ভাগ্য তোর নয়

যাকে এখনও এলিজাবেথের মুকুটের দাসত্ব করতে হয়

সিলসিলা ফুরাল কি ?

ইতিহাস বলে ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায়’ ।

তুই ভূমিপুত্র, মুকুটহীন সম্রাট

দূরভাষ আমার পক্ষেও নিরাপদ নয়

ফেসবুকের গণ্ডি তোকে পোষ মানাতে পারেনি

অগত্যা হোয়াটসঅ্যাপে

চব্বিশ ঘণ্টা সবুজ আলো জ্বলে এখন

যে রাজত্বই জয় হোক,

আমার স্ক্রিনে আসে

“মা কই ? আমি মা কাছে যাব”

আমার শীতল শিরায় কয়লার আগুন ফিরে আসে

ঈড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্না জানিয়ে দেয়,

‘মা’ বলে ডাকলে সর্বপ্রথম অধিকার যোনির উপরই বর্তায় ।


এটা অনস্বীকার্য যে ঐতিহ্যমুক্ত হওয়ায় আছে  নতুন ধরণের লেখার প্রতি অনুপ্রেরণা। 

কবিতা লিখতে বসে প্রভাবের সমস্যাটা অসুখের মতন চাগিয়ে ওঠে । সৃজনশীল মনকে

 প্রভাবমুক্ত থাকতে হবে মাথায় এলে তা কবিতাতেও উদ্বেগ হয়ে উঁকি মারে । এ এক উত্তেজনা যা 

 কবিতায় উত্তেজনা হয়েই দেখা দেয় । প্রাতিস্বিকতা এবং নৈর্ব্যক্তিকতার প্রশ্নে  সমাধান খোঁজার চেষ্টা 

কবিকে নীতিমালার থেকে সরিয়ে নিয়ে যায় । এটা ঠিক যে কবিতাগুলির বেশিরভাগই নৈর্ব্যক্তিকতার

 দিকে এবং বর্ণনার একটি নির্দিষ্ট নিরপেক্ষতার দিকে ঝুঁকছে। কবিতার মাঝে ব্যক্তিগত লাইনগুলি 

নিয়মিত পিছলে যায় এটাও অনস্বীকার্য। এই সত্য বেমানান নয় । কবির প্রাতিস্বিকতা থেকে কবিকে

 জোর করে ছাড়িয়ে আনা যায় না । ফলে কবির মধ্যে সৃষ্টি হয় টেনশান, আগের প্রজন্ম, 

সমসাময়িকদের কবিতা রচনা এবং কবিতার ঐতিহ্যের মধ্যে টেনশন । 

পাণ্ডুলিপিতে কাটাকুটির মাধ্যমে কবি নিজেকে বোঝাতে থাকেন, চাপ নিও না, চাপ নিও না,

 চাপ নিও না । সোনালী চক্রবর্তীর শৈলীতে আছে চাপ কাটিয়ে ওঠার চর্চা । 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিবেদিত ‘স্বীকারোক্তি’ কবিতাটা পড়া যাক ; 

অগ্রজ কবির প্রণয়ের কবিতায় আত্মঅন্তর্ভুক্তির স্বতঃপ্রণয়ন :


স্বীকারোক্তি

( সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে )

দেখা হয়নি আপনার সঙ্গে কখনও

কিংবদন্তির নশ্বর মৃত্যুপরবর্তী শোকসভাসমূহের

একটিতেও যোগ দেওয়া হয়নি,

অথচ সুচতুর গোপন প্রেমিকার অন্তরমহলে

উরু ও জিভের ঘোরতর দ্বন্দ্ব যখন বিক্ষত করেছে

আপনি বলে উঠেছেন---

“আমি কুকুর আটকাবো, যাও, আজ ভয় নেই”

মাতাল, চণ্ডাল হয়ে নিজেকে পুড়িয়ে ফের ছাই থেকে উঠে এসে

আমি নিজস্ব নির্জনতায় নতজানু হয়ে স্বীকার করেছি

“কুসুমের বুক থেকে ঝরে গেছে সব পবিত্রতা”


কবিতাটিতে আছে লুকোনো আবেগ , যা তাঁর বার্তাকে একযোগে বহু দিক দিয়ে চালিত করে, 

কেবলমাত্র দ্বৈত আবেগ নয়, অর্থাৎ ‘আমি’ এবং ‘কবি’ নয়, পাঠককেও তার ভেতরে টেনে 

নিয়ে যেতে চেয়েছেন সোনালী চক্রবর্তী । কবিতার ইশারা পাঠককে "ক্লান্ত" করে না, 

বরং গড়ে তোলে মার্জিত  কৌতূহলী গতিশীলতার আবহ । বাংলা কবিতায় নারীকবির কন্ঠস্বর, 

পুরুষ কবির থেকে তার কন্ঠস্বরের পার্থক্য, আমি নারীবাদের কথা বলছি না, 

প্রায়শই স্বীকৃত হয় না বা গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয় না। এটি কারুবাসনায়, 

 

পরাজয়

রঘুকুলতিলক,

আপনি অগ্নিপরীক্ষা নামে এক নিদর্শন 

স্হাপন করেছিলেন ত্রেতা যুগে, 

জানলে প্রীত হতেন,

আজ তার খ্যাতি ডাস্টবিনের বিড়ালের থেকেও বেশি ফুলে

পুজোর জন্ম দিয়েছে

রণে-বনে-হিন্দি আর বাংলা সিরিয়ালে । 

ক্ষমা করবেন, 

আপনার অজুহাত ছিল নিজেকে ত্রাতা প্রমাণের ।

.

আপনি সোনার লঙ্কা ছারখারের পর

বড় বৌদ্ধিক নির্লপ্ততায় উচ্চারণ করেছিলেন

যুদ্ধের কারণ জানকী নয়,

ছিল আপনার ধর্মরক্ষা ।

ধর্মের আফিমখেকোরা কোনওদিন ভক্তিরসের আঠাটুকু এড়িয়ে

যুদ্ধ পরবর্তী পাঠটা নেয় না ।

নিলে জানত

দামি চকোলেটের নীচের, সস্তার আটার কেকটা

খেতে ভালো না হলেও উপস্হিতিটা খুব দরকারি,

ঠিক যেমন,

অশোকবন থেকে মুক্তির পর বিনা আহ্বানে

পায়ে হেঁটে কুললক্ষ্মীর স্বামী সন্দর্শনে আসাটা আবশ্যক,

নাহলে পুরুষোত্তমের মর্যাদা খর্ব হয় ।

রাজসত্তার কাছে ম্লান প্রণয়ীর প্রেম,

যা যমজ ঔরস দানকালে সুখে প্লাবিত হতে পারে

কিন্তু বাজারের ধোপার কথা শুনে

সেই শয্যাকে

গৌরব বৃদ্ধির কৌশল বানাতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করে না ।

এ কি ক্ষুদ্রবুদ্ধি রাক্ষসের পক্ষে সম্ভব ?

.

সন্দেহ নিরসনে প্রকাশ্য প্রমাণের দাবি ধর্ষণ ছাড়া কিছু দিয়েছিল কি ?

আগুন ছোঁয়ার আগেই তো সেখানে দৈবী শরীর

রক্তমাংসের মনের অন্তর্লীন দাহে ভস্মীভূত ।

.

স্মরণে ছিল না, আপনি বোধিপ্রাপ্ত অবতার বটে

নাহলে এই বোধ,

ভিক্টোরিয়ার বাগানে এক দুপুরের জন্যে বসা

কিশোরের থেকেও প্রত্যাশিত ।

.

চলুন, এই বহুচর্চিত প্রসঙ্গকে আজ আমার দৃষ্টিতে দেখা যাক,

কিসের পরীক্ষা, কী তার ব্যাখ্যা, কেন এই প্রহসন,

এই ধর্মপাঠ রেখে,

আসুন মহামান্য,

চিয়ার্স করি আপনার পরাজয়ের উল্লাসে ।

.

তিনবারই আপনি অবগত ছিলেন অভিযোগের অসত্যতা নিয়ে

কিন্তু ইতিহাসের কাছে মহাপুরুষ প্রমাণিত হওয়ার লালসা

আপনার অসহায় পরাজয় ।

আর মহত্ব প্রমাণের প্রবল নেশায়

আপনি ভুলে গিয়েছিলেন

পরীক্ষার মাধ্যমটিকে,

এ আপনার নির্বোধ পরাজয় ।

.

কারণ,

.

অগ্নি এক পুরুষ ছিলেন ।

.

আপনি আপনার রাজনীতি, সমাজ, রাষ্ট্রতন্ত্র

যখন প্রত্যক্ষ সাক্ষী হচ্ছিল

এমন সতীত্বের যা আগুনেও অস্পৃশ্য

আমি দেখছিলাম,

আপনার রাহুগ্রাসমুক্ত এক নারীকে

যে তীব্র, উজ্জ্বল, প্রবল, শক্তিশালী

এক পরপুরুষের আলিঙ্গনে সুরক্ষিত ।

.

আপনারা দেখছিলেন অগ্নির অক্ষমতা,

আমি দেখলাম তার রমণ

আর অন্তে 

সশ্রদ্ধ প্রণাম ।


সোনালী চক্রবর্তীর কবিতা এখানেই  পূর্ণতা পায় : শব্দগুলি লিখে তাদের নিজের 

বাইরের করে তোলেন এবং তিনি নিজের কাজে নিজেকে প্রতিবিম্বিত দেখতে পান।

 নারীর কণ্ঠস্বর এবং কবিতার মধ্যে একটি মূল্যবান সম্পর্ক তৈরি হয় । 

একবার প্রকাশিত হয়ে গেলে তাকে সহজে পরিবর্তন করা সম্ভব নয় ।  লেখার কাজটি পাঠ্যটিকে 

একটি ভৌত ব্যাপারে পরিণত করে। কন্ঠস্বর কবিতাবিশেষকে একটি মুক্তরূপের মত প্রকাশ করে । 

তা এক বস্তুগত অস্তিত্বে পরিণত হয়, এমন একটি বক্তব্যকে মঞ্জুর করে,  

যার মাধ্যমে অন্যের সঙ্গে কথা বলার বদলে নিজেকে জ্যোতির্ময়ী করে তোলা সম্ভব। 

কবিতা তখন অন্তরালের ভাষা ব্যবহার করে; এটি কেবলমাত্র টেক্সট এর কারণে নয় ; 

নারীকবির কাছে কবিতাবিশেষ একটি ভাল আউটলেট তৈরি করে । পড়া যাক ‘অতঞ্চিত’ কবিতাখানা :


অতঞ্চিত

পূর্বজন্মের স্মৃতির সমান জলছবি পঙক্তি

মরশুমি ফুলের সামাজিক উজ্বলতায়

প্রতিবন্ধী স্বপ্নের মতো চৌকাঠে দাঁড়ায় ।

অতঞ্চিত কবিতা মূলত সেই স্বৈরিণী

যার কলিজা কোনও বাগের কবরে,

শান্তির পপত্যাশা রাখে না । 

নিঃস্ব সমর্পণ খাক করে

স্বর্গবেশ্যার অভিশাপ কুড়ায় ।