সোনালী চক্রবর্তীর ‘জামার নীচে অলীক মানুষ’ : মলয় রায়চৌধুরী
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত ‘জামার নীচে অলীক মানুষ’ কাব্যগ্রন্হটি
সোনালী চক্রবর্তী আমাকে পাঠিয়েছিলেন ২০১৮ সালের জুন মাসে ।
এই বইতে আমাকে নিবেদিত একটি কবিতা আছে ‘অবতার’ শিরোনামে, যেটি পড়ার পর
-- আমি কবিতাটা প্রায়ই পড়ি -- বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে উনি আমার নিকট-কবিদের অন্যতম,
কেননা কবিতাটিতে আমার কয়েকটা কবিতার লাইন আছে, যা ওনাকে আকৃষ্ট বা বিস্মিত করে থাকবে ।
আজকে পয়লা বৈশাখ, বইটা নিয়ে লেখার আগ্রহ হলো । কবিতাগুলো আমি অনেকবার পড়েছি,
হ্যাঁ, সোনালী চক্রবর্তীর কবিতা বলেই । ওনার শৈশব কৈশোর কেটেছে বেনারসে আর উত্তরবঙ্গে।
উনি ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এবং লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের গবেষক ।
সোনালী চক্রবর্তী থাকেন কৃষ্ণনগরে । গ্রামীণ উন্নয়নের চাকুরিসূত্রে কৃষ্ণনগরে গেছি ।
প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে। অনুমান করি সোনালী চক্রবর্তীর তখন জন্ম হয়নি ।
সেই সময়ে অফিসের ট্যুরে আমি আমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যেতুম, পশ্চিমবাংলাকে দেখাবার জন্য ।
আমরা ছিলুম একটি বাঙালি পরিবারের পেইঙ গেস্ট ; পরিবারটি আমাদের জন্যে তাঁদের দুই মেয়ের
শোবার ঘরটা দিয়েছিলেন । ড্রেসিঙ টেবিলে রাখা নানা কসমেটিকস দেখে আন্দাজ করেছিলুম
যে সাম্প্রতিকতম কসমেটিকস, কেবল মুম্বাইতে নয়, কৃষ্ণনগরেও পৌঁছে যায় ।
আমি ট্যুরে গিয়ে নিজের সাহিত্যিক পরিচয় দিতুম না ; আমার স্ত্রীও সেসময়ে চুড়িদার পরত বলে
আত্মপরিচয়কে গোপন রাখতে পারতুম । কৃষ্ণনগরের শিল্পীদের কাজ দেখার সুযোগ হয়েছিল
এবং অনেকে মূর্তি বা মুখ উপহার দিতে চাইতেন । নিয়ে যেতে গেলে ভেঙে যাবে,
জানিয়ে ছাড়া পাওয়া যেতো । এখন সোনালী চক্রবর্তীর বইটা আলোচনা করতে বসে
সেই দিনকার কৃষ্ণনগর স্মৃতিতে ভেসে উঠল । এমন এক কৃষ্ণনগর যেখানে সোনালী চক্রবর্তী
নামে এক কবি অনুপস্হিত । তাই বইটা পড়তে-পড়তে কৃষ্ণনগরে ওনার উপস্হিতির
ঔজ্বল্য তৈরি করে নিতে হয়েছে ।
ওনার কাব্যগ্রন্হের ‘অবতার’ কবিতাটা পড়ে মনে আসে কবি জন ডন-এর উক্তি যে
"কোনও মানুষ দ্বীপ নয়," এবং সোনালী চক্রবর্তীর কবিতাপাঠ দ্বীপ নয়।
কবিতার লাইনগুলোর মধ্যে সংযোগ ঘটিয়েছেন বিভিন্ন উপায়ে আর উল্লেখ করেছেন বাক্যের
সঙ্গে আপাত-বিচ্ছিন্ন লিঙ্কগুলি হাইলাইট করার জন্য । ব্যবহার করেছেন এমন সমস্ত কৌশল
যাকে বলা যায় আন্তঃসংযোগ কৌশল । সোনালী চক্রবর্তীর কবিতা লেখার একটা বিশেষ শৈলী আছে ।
কেবল এই বইতেই নয় । এর পরেও উনি যে কবিতাগুলো লিখছেন, লিখেছেন, তাতেও টের পাওয়া যায়,
জটিলতা বা কমপ্লেকসিটিকে মাল্টিলিনিয়র বা বহুরৈখিক প্রস্তাবনা দিয়ে প্রতিটি পংক্তিকে
উপস্হাপনার কৌশল । বহু কবিতার লাইন এবং পর-পর কয়েকটা লাইন সেকারণে কয়েকবার
পড়ে নিতে হয় । ‘অবতার’ কবিতাটা পড়া যাক ; এই কবিতায় আমার বেশ কিছু কবিতার প্রসঙ্গে আছে ;
আমি অন্য আরেকজন কবির পংক্তি ব্যবহার করেছি আমার কবিতায়, সেই লাইনও আছে,
অর্থাৎ ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি, তার সাথে মেটাফিকেশন, অবিশ্বাস্য আখ্যান, স্ব-প্রতিচ্ছবি,
আন্তঃদ্বন্দ্বীকরণ এবং সাংস্কৃতিক ইস্যুকে থিম্যাটাইজ করেছেন সোনালী চক্রবর্তী।
অবতার
( মলয় রায়চৌধুরীকে )
এক ভোররাতে কবিতা খুঁজতে ঈশ্বর ধুলো মাখলেন…
প্রথমেই দেখলেন,
জে এন ইউ-এর লেডি কিলারকে অনুবাদক বলছেন,
“সিরফ এক জাভেদানি সি নজর দে দে “
স্মিত হেসে না সরতেই চোখে ধরা দিল
সাহিত্য অ্যাকাডেমি পাওয়া সাহিত্যিকের হাতে
‘বাচ্চাদানি’ না থাকা মীরাবাঈয়ের গজল…
ঈষৎ বিষণ্ণ, চোখ ফেরালেন উপান্তে…
যেখানে নিশীথিনী চ্যাট বক্সে টাইপ করছেন ‘পদ্মের প্রস্ফুটন’
আর ট্রিপ বেশি হয়ে যাওয়ায়
যাদবপুর এইট বির ভবঘুরের মনে পড়ে যাচ্ছে
তার মাকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাওয়ার দুপুর ।
কেঁপে উঠল বুড়ো ভায়োলিন মাস্টারের ছড়
অথবা মায়াভ্রমে কীর্তনের আখর…
নির্লিপ্ত, ক্লান্ত...আলোকবর্ষের অন্তরীপ পার করে
ফিরিয়ে আনলেন বিস্মৃতির অতল ।
ফিরে গেলেন সেই জন্মে আবার, যেদিন তিনিও কবি ছিলেন…
মৌলিক শৈলী একজন কবি উদ্ভাবনার প্রয়াস করেন তাঁর সংস্কৃতিতে পুরোপুরি
জীবনযাপন করার জন্য ; তাঁর সম্ভাবনার বোধকে সামঞ্জস্য দেবার জন্য ।
সোনালী চক্রবর্তী কবিতার পংক্তিগুলোয় যে আকস্মিক কমপ্লেকসিটি দিতে চেয়েছেন তা
গতানুগতিক কাব্যিক কবিতার চৌহদ্দিকে এড়াবার কৌশল হিসেবে । তিনি কবিতাগুলোতে
ঘটমান যেমন হয়েছে তেমনের পরিবর্তে কবির হাতে কী ঘটে তার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন ।
কবিতাবিশেষের অন্তর্গত গুরুত্বপূর্ণ ধারণাটি বাস্তব এবং কল্পনার মধ্যে ফারাক দেখাতে চায় ।
যার দরুন কবিতাটি হয়ে ওঠে মনের কবিতা । অর্থাৎ যাপন থেকে শ্রমসাধ্য অভিযোজন ।
রচনা কৌশল হিসাবে সোনালী চক্রবর্তী বঙ্গবিশ্বের ভঙ্গুরতাকে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন
কোনো-কোনো কবিতায় । পড়া যাক ‘সমাপতন’ কবিতাখানা :
সমাপতন
এত দ্রুত কী করে বদলাও বলোতো ?
কই আই তো পারি না…
রক্তস্রোতে বিষ একবার মিশলে
শরীএর নীল হয়ে কালঘুম না আসা অব্দি
নির্লিপ্তির দায় কি শুধু আমার একারই হয় ?
ওই ধূসর গভীর দর্পণে চোখ মেলে
সূর্যকে অনুমতি দিতাম স্পর্শের,
শেষ রাতের আঙুলে যে মায়াটুকু লেগে থাকে,
আমি তার ঘ্রাণে ঘুমোতে চাইতাম অন্তত হাজার বছর ।
কস্তুরী গন্ধ ফিকে হতে হতে আর্দ্রতায় মিশে না গেলে
স্নানের জল নাগাল পায়নি আমার কোনওদিনই…
কানের কবিতায়, কোমরের হাঁসুলি বাঁকে,
যত যত উপকথা লিখে রাখা হত
লাসা ভ্রমণেরও অধিক আলো
তারা ছড়াত মরাল অন্ধকারে ।
.
আসলে কবিনী বলে কোনও শব্দ অভিধানে নেই,
মন্হনে অসুর আর অমৃত সহচরী গরল অনিবার্য হলেও
অমরত্ব লাভে বঞ্চনার নির্লজ্জ কৌশলটুকু
কৃতিত্ব বলেই গণ্য হয় ।
কবিতাগুলোর দুটি সত্তাতাত্বিক দিকগুলির মধ্যে গোপন উদ্বেগ রয়েছে।
কবিতার দ্বৈতসত্তা গড়ে তোলার প্রয়াস দেখা যায় সোনালী চক্রবর্তীর রচনায়,
যেন কবিতাবিশেষ একটি দ্বি-বিশ্ব সত্তাতাত্বিক গঠন, একটি হল: কবিতাটির বহির্মুখী সীমানা
এবং কবিতা এবং বিশ্বের মধ্যে সম্পর্ক । অন্যটি হল অভ্যন্তরীণ সীমানা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ,
অর্থাৎ টেক্সট ও মর্মার্থের সম্পর্ক বা বলা যায় উপস্হাপনার চেয়ে রচনাকে গুরুত্ব দেয়া।
সমাজকে দূরে সরিয়ে রেখেও, ব্যক্তিগত এবং নৈর্ব্যক্তিকতার মধ্যে এবং ঐতিহ্য ও নতুন পথ
গড়ে তোলার আকর্ষণের মধ্যে----প্রধান মতবিরোধগুলো ‘সমাজ’ এর মতো সিরিয়াস ব্যাপারের
আধিপত্য অবলম্বন না করেই সমাধান করা যেতে পারে। পড়া যাক সোনালী চক্রবর্তীর ‘মা’ কবিতাটি :
মা
প্রখর রৌদ্রের কোলিয়ারিতে তোকে পেয়েছিলাম ছেলে
কোন খনিতে লুকিয়েছিলিস জানি না
খাদের ধারে দাঁড়িয়ে শেষ পা এগোনোর আগে
চৈত্রের হলকায় তোর চুলের ঝাপটা
আমার চোখ ঢেকে দিয়েছিল…
ধাঁধায় আমি আলাদা করতে পারিনি
ব্যারেজের জল, নীল আকাশ
পাথরের তাঁত আর তোর ফসফরাসের মতো চোখগুলোকে
তারপর হ্যামেলিন বাঁশি
প্রত্যন্ত ঘাঘরবুড়ি মন্দিরে সিঁদুর পুজো
দুই সন্ধ্যা মহুয়ামাদল
সিগারেট হাতে দিগন্ত পেরিয়ে
হাইওয়ে ধরে হেঁটে চলা
চলে আসতে হল, যেভাবে স্টেশন এলে নেমে যেতে হয়
তুই খনিজ, আকরিকতায় রয়ে গেলি
কোহিনুর দুর্ভাগ্য তোর নয়
যাকে এখনও এলিজাবেথের মুকুটের দাসত্ব করতে হয়
সিলসিলা ফুরাল কি ?
ইতিহাস বলে ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায়’ ।
তুই ভূমিপুত্র, মুকুটহীন সম্রাট
দূরভাষ আমার পক্ষেও নিরাপদ নয়
ফেসবুকের গণ্ডি তোকে পোষ মানাতে পারেনি
অগত্যা হোয়াটসঅ্যাপে
চব্বিশ ঘণ্টা সবুজ আলো জ্বলে এখন
যে রাজত্বই জয় হোক,
আমার স্ক্রিনে আসে
“মা কই ? আমি মা কাছে যাব”
আমার শীতল শিরায় কয়লার আগুন ফিরে আসে
ঈড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্না জানিয়ে দেয়,
‘মা’ বলে ডাকলে সর্বপ্রথম অধিকার যোনির উপরই বর্তায় ।
এটা অনস্বীকার্য যে ঐতিহ্যমুক্ত হওয়ায় আছে নতুন ধরণের লেখার প্রতি অনুপ্রেরণা।
কবিতা লিখতে বসে প্রভাবের সমস্যাটা অসুখের মতন চাগিয়ে ওঠে । সৃজনশীল মনকে
প্রভাবমুক্ত থাকতে হবে মাথায় এলে তা কবিতাতেও উদ্বেগ হয়ে উঁকি মারে । এ এক উত্তেজনা যা
কবিতায় উত্তেজনা হয়েই দেখা দেয় । প্রাতিস্বিকতা এবং নৈর্ব্যক্তিকতার প্রশ্নে সমাধান খোঁজার চেষ্টা
কবিকে নীতিমালার থেকে সরিয়ে নিয়ে যায় । এটা ঠিক যে কবিতাগুলির বেশিরভাগই নৈর্ব্যক্তিকতার
দিকে এবং বর্ণনার একটি নির্দিষ্ট নিরপেক্ষতার দিকে ঝুঁকছে। কবিতার মাঝে ব্যক্তিগত লাইনগুলি
নিয়মিত পিছলে যায় এটাও অনস্বীকার্য। এই সত্য বেমানান নয় । কবির প্রাতিস্বিকতা থেকে কবিকে
জোর করে ছাড়িয়ে আনা যায় না । ফলে কবির মধ্যে সৃষ্টি হয় টেনশান, আগের প্রজন্ম,
সমসাময়িকদের কবিতা রচনা এবং কবিতার ঐতিহ্যের মধ্যে টেনশন ।
পাণ্ডুলিপিতে কাটাকুটির মাধ্যমে কবি নিজেকে বোঝাতে থাকেন, চাপ নিও না, চাপ নিও না,
চাপ নিও না । সোনালী চক্রবর্তীর শৈলীতে আছে চাপ কাটিয়ে ওঠার চর্চা ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিবেদিত ‘স্বীকারোক্তি’ কবিতাটা পড়া যাক ;
অগ্রজ কবির প্রণয়ের কবিতায় আত্মঅন্তর্ভুক্তির স্বতঃপ্রণয়ন :
স্বীকারোক্তি
( সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে )
দেখা হয়নি আপনার সঙ্গে কখনও
কিংবদন্তির নশ্বর মৃত্যুপরবর্তী শোকসভাসমূহের
একটিতেও যোগ দেওয়া হয়নি,
অথচ সুচতুর গোপন প্রেমিকার অন্তরমহলে
উরু ও জিভের ঘোরতর দ্বন্দ্ব যখন বিক্ষত করেছে
আপনি বলে উঠেছেন---
“আমি কুকুর আটকাবো, যাও, আজ ভয় নেই”
মাতাল, চণ্ডাল হয়ে নিজেকে পুড়িয়ে ফের ছাই থেকে উঠে এসে
আমি নিজস্ব নির্জনতায় নতজানু হয়ে স্বীকার করেছি
“কুসুমের বুক থেকে ঝরে গেছে সব পবিত্রতা”
কবিতাটিতে আছে লুকোনো আবেগ , যা তাঁর বার্তাকে একযোগে বহু দিক দিয়ে চালিত করে,
কেবলমাত্র দ্বৈত আবেগ নয়, অর্থাৎ ‘আমি’ এবং ‘কবি’ নয়, পাঠককেও তার ভেতরে টেনে
নিয়ে যেতে চেয়েছেন সোনালী চক্রবর্তী । কবিতার ইশারা পাঠককে "ক্লান্ত" করে না,
বরং গড়ে তোলে মার্জিত কৌতূহলী গতিশীলতার আবহ । বাংলা কবিতায় নারীকবির কন্ঠস্বর,
পুরুষ কবির থেকে তার কন্ঠস্বরের পার্থক্য, আমি নারীবাদের কথা বলছি না,
প্রায়শই স্বীকৃত হয় না বা গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয় না। এটি কারুবাসনায়,
পরাজয়
রঘুকুলতিলক,
আপনি অগ্নিপরীক্ষা নামে এক নিদর্শন
স্হাপন করেছিলেন ত্রেতা যুগে,
জানলে প্রীত হতেন,
আজ তার খ্যাতি ডাস্টবিনের বিড়ালের থেকেও বেশি ফুলে
পুজোর জন্ম দিয়েছে
রণে-বনে-হিন্দি আর বাংলা সিরিয়ালে ।
ক্ষমা করবেন,
আপনার অজুহাত ছিল নিজেকে ত্রাতা প্রমাণের ।
.
আপনি সোনার লঙ্কা ছারখারের পর
বড় বৌদ্ধিক নির্লপ্ততায় উচ্চারণ করেছিলেন
যুদ্ধের কারণ জানকী নয়,
ছিল আপনার ধর্মরক্ষা ।
ধর্মের আফিমখেকোরা কোনওদিন ভক্তিরসের আঠাটুকু এড়িয়ে
যুদ্ধ পরবর্তী পাঠটা নেয় না ।
নিলে জানত
দামি চকোলেটের নীচের, সস্তার আটার কেকটা
খেতে ভালো না হলেও উপস্হিতিটা খুব দরকারি,
ঠিক যেমন,
অশোকবন থেকে মুক্তির পর বিনা আহ্বানে
পায়ে হেঁটে কুললক্ষ্মীর স্বামী সন্দর্শনে আসাটা আবশ্যক,
নাহলে পুরুষোত্তমের মর্যাদা খর্ব হয় ।
রাজসত্তার কাছে ম্লান প্রণয়ীর প্রেম,
যা যমজ ঔরস দানকালে সুখে প্লাবিত হতে পারে
কিন্তু বাজারের ধোপার কথা শুনে
সেই শয্যাকে
গৌরব বৃদ্ধির কৌশল বানাতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করে না ।
এ কি ক্ষুদ্রবুদ্ধি রাক্ষসের পক্ষে সম্ভব ?
.
সন্দেহ নিরসনে প্রকাশ্য প্রমাণের দাবি ধর্ষণ ছাড়া কিছু দিয়েছিল কি ?
আগুন ছোঁয়ার আগেই তো সেখানে দৈবী শরীর
রক্তমাংসের মনের অন্তর্লীন দাহে ভস্মীভূত ।
.
স্মরণে ছিল না, আপনি বোধিপ্রাপ্ত অবতার বটে
নাহলে এই বোধ,
ভিক্টোরিয়ার বাগানে এক দুপুরের জন্যে বসা
কিশোরের থেকেও প্রত্যাশিত ।
.
চলুন, এই বহুচর্চিত প্রসঙ্গকে আজ আমার দৃষ্টিতে দেখা যাক,
কিসের পরীক্ষা, কী তার ব্যাখ্যা, কেন এই প্রহসন,
এই ধর্মপাঠ রেখে,
আসুন মহামান্য,
চিয়ার্স করি আপনার পরাজয়ের উল্লাসে ।
.
তিনবারই আপনি অবগত ছিলেন অভিযোগের অসত্যতা নিয়ে
কিন্তু ইতিহাসের কাছে মহাপুরুষ প্রমাণিত হওয়ার লালসা
আপনার অসহায় পরাজয় ।
আর মহত্ব প্রমাণের প্রবল নেশায়
আপনি ভুলে গিয়েছিলেন
পরীক্ষার মাধ্যমটিকে,
এ আপনার নির্বোধ পরাজয় ।
.
কারণ,
.
অগ্নি এক পুরুষ ছিলেন ।
.
আপনি আপনার রাজনীতি, সমাজ, রাষ্ট্রতন্ত্র
যখন প্রত্যক্ষ সাক্ষী হচ্ছিল
এমন সতীত্বের যা আগুনেও অস্পৃশ্য
আমি দেখছিলাম,
আপনার রাহুগ্রাসমুক্ত এক নারীকে
যে তীব্র, উজ্জ্বল, প্রবল, শক্তিশালী
এক পরপুরুষের আলিঙ্গনে সুরক্ষিত ।
.
আপনারা দেখছিলেন অগ্নির অক্ষমতা,
আমি দেখলাম তার রমণ
আর অন্তে
সশ্রদ্ধ প্রণাম ।
সোনালী চক্রবর্তীর কবিতা এখানেই পূর্ণতা পায় : শব্দগুলি লিখে তাদের নিজের
বাইরের করে তোলেন এবং তিনি নিজের কাজে নিজেকে প্রতিবিম্বিত দেখতে পান।
নারীর কণ্ঠস্বর এবং কবিতার মধ্যে একটি মূল্যবান সম্পর্ক তৈরি হয় ।
একবার প্রকাশিত হয়ে গেলে তাকে সহজে পরিবর্তন করা সম্ভব নয় । লেখার কাজটি পাঠ্যটিকে
একটি ভৌত ব্যাপারে পরিণত করে। কন্ঠস্বর কবিতাবিশেষকে একটি মুক্তরূপের মত প্রকাশ করে ।
তা এক বস্তুগত অস্তিত্বে পরিণত হয়, এমন একটি বক্তব্যকে মঞ্জুর করে,
যার মাধ্যমে অন্যের সঙ্গে কথা বলার বদলে নিজেকে জ্যোতির্ময়ী করে তোলা সম্ভব।
কবিতা তখন অন্তরালের ভাষা ব্যবহার করে; এটি কেবলমাত্র টেক্সট এর কারণে নয় ;
নারীকবির কাছে কবিতাবিশেষ একটি ভাল আউটলেট তৈরি করে । পড়া যাক ‘অতঞ্চিত’ কবিতাখানা :
অতঞ্চিত
পূর্বজন্মের স্মৃতির সমান জলছবি পঙক্তি
মরশুমি ফুলের সামাজিক উজ্বলতায়
প্রতিবন্ধী স্বপ্নের মতো চৌকাঠে দাঁড়ায় ।
অতঞ্চিত কবিতা মূলত সেই স্বৈরিণী
যার কলিজা কোনও বাগের কবরে,
শান্তির পপত্যাশা রাখে না ।
নিঃস্ব সমর্পণ খাক করে
স্বর্গবেশ্যার অভিশাপ কুড়ায় ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন