নিজের পায়ে কুড়ুল মারার একটা বদভ্যাস আমার চিরকালের। আর তাই নিতান্ত গাড়লের
মতন কথা দিয়ে বসেছি মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা নিয়ে একটা লেখা লিখব। মলয়্দাকেই
কথা দিয়েছি আবার। সম্ভবত Notebook-এর প্রথম সংখ্যায়। কতটা অপরিণামদর্শী হলে
এটা করা যায়? মানে যার কবিতা নিয়ে লিখতে বাঘা বাঘা পণ্ডিতদের শুকিয়ে যায়
তাঁর কবিতা নিয়ে লিখবে আমার মতন এক অর্বাচীন “ফেসবুক কবি”। যাই হোক কথা যখন
দিয়েছি লিখব তো বটেই, কিন্তু আপাতত তাঁর “যা লাগবে বলবেন” কাব্যগ্রন্থ
পড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখব। মূল কাজে হাত দেওয়ার আগে হাতমকশো আর কি!
মলয়্দার
কবিতা প্রথম পড়ার এক বিপদ আছে। বিপদ হোলো তরতর করে পড়ে ফেলা যায় না, কেমন
যেন দরজায় ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়। অথচ তাঁর কবিতা কিন্তু সম্পূর্ণ
“কাব্যময়তা” রহিত। আসলে তাঁর কবিতার শব্দগুলো পরপর যৌক্তিক কাঠামো মেনে
চলতে চায় না অনেকসময়েই। “নীল চামড়ার বাঁধানো আকাশ সেখানে ধিকিধিকি
ধ্বংসস্তূপ/ আগুনের ব্যারিকেড ভেঙে ঝাঁপিয়ে পড়ল তিনতলা বাড়ি”- ঘটনার সহজাত
সরলরৈখিক বিন্যাস ভেঙে গেছে। কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা শেষ হচ্ছে এভাবে-
“কোনো কারণ নেই, স্রেফ/ চিৎকারের জন্যে চিৎকার/ চিৎকারের ভেতরে চিৎকার”। এই
যে কারণহীনতা, কার্যকারণ সম্পর্কের ভেঙে পড়া তা ছড়িয়ে আছে এই কবিতাগুলোর
ছত্রে ছত্রে। যেন কবিতাগুলো হঠাৎ করে সৃষ্টি হচ্ছে কবির কলমে, আবার হঠাৎ
করে লয় হয়ে যাচ্ছে। কবিতার কোনো “বক্তব্য” নেই, নৈতিক অবস্থান নেই, শুধু
কিছু অভিজ্ঞতা আছে। “আমি এরকম নারীকে সঙ্গম করিনি কখনো/ স্তব্ধতা-ফাটানো
চিৎকারে দুর্গন্ধের শতচ্ছিন্ন নারী জড়িয়ে ধরে”। কবিরা নাকি যে কোনো একটা
সাধারণ আটপৌরে জিনিষের সূত্র ধরেই কবিতাকে খুঁজে পান। তখন আর পাঠকের কাছে
সেই সূত্র সাধারণ দৈনন্দিন থাকে না। এবার এই জিনিষটাকে একটু ঘেঁটে নিন।
মলয়্দার এই কবিতাগুলোয় এইভাবে কোনো দৈনন্দিন বিষয়ের সূত্র ধরে অসীম বা
অরূপকে ধরার প্রচেষ্টা নেই। তিনি যেন “শিল্প”-এর কবর খুঁড়ে রেখেছেন তাঁর
কবিতায়। তাঁর দৈনন্দিনতাই তাঁর কবিতা। প্রতিমুহূর্তের অতিসাধারণ বেঁচে
থাকাই তো তাঁর কবিতা। যেমন হাসপাতালের আনাস্থেসিয়া- “তবু আয়েশে উপভোগ করতে
থাকি অজ্ঞানতার দিকে এগোনো।” কবিতাগুলোয় বারবার ফিরে এসেছে একটাই কথা বেঁচে
থাকা, প্রবলভাবে বেঁচে থাকা- “মরে যাবার কথা মোটেই ভাবি না/ যৌনক্ষমতা শেষ
হয়ে যাবার ভয়ের কথা ভাবি”। বেঁচে থাকার চিৎকার, খিদের চিৎকার- এর থেকে বড়
কবিতা আর কী আছে?
শনিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১
মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা সম্পর্কে রাজর্ষি দে
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন