মঙ্গলবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
রবিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা "সুফিয়ানা" : সাঁঝবাতির কন্ঠে
শনিবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
মলয় রায়চৌধুরীর "মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো" কবিতা ও তাঁর মৃত্যুভাবনা
মলয় রায়চৌধুরীর “মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো” কবিতা ও তাঁর মৃত্যুবোধ অভিজিৎ পাল মলয় রায়চৌধুরী এবং তার আরম্ভ করা হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের গুরুত্ব নিয়ে বিতর্কের সমাপ্তি ঘটলেও, তাঁর চিন্তাধারা ও সাহিত্যিক সৃজনশীলতাকে কোনও একটি প্রকোষ্ঠে ফেলা বেশ কঠিন । তাঁর চিন্তা ও সাহিত্যকর্মের বিকাশ সম্পর্কে যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে বাঙালির উনিশ ও বিশ শতক ও ইউরোপের বিশ শতকের কবি ও ভাবুকদের যাত্রাপথে তাঁর পরিভ্রমণ অস্বীকার করা যায় না । প্রায় প্রতিটি ভাবনা ও সাহিত্য আন্দোলন তাঁকে আগ্রহান্বিত করেছে, তিনি বহু প্রবন্ধ লিখেছেন সেই সমস্ত বিষয়ে, কবিতা, উপন্যাস ও গল্পে সেগুলো প্রয়োগ করেছেন, যা সচরাচর বাঙালি সাহিত্যিকরা করেন না । তাঁর চিন্তাধারাকে যে নির্দিষ্টভাবে তাঁরই লিখিত ও পঠিত বর্গে সীমিত করা অসম্ভব তা তাঁর “মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো “ কবিতাটির মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট করে তুলেছেন । ইতোপূর্বে তিনি তাঁর বিখ্যাত কবিতা “প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” কবিতায় যে মলয় রায়চৌধুরীকে উপস্হাপন করেছিলেন সে অভিমন্যুর মতন ঘেরাওকে প্রতিরোধ করে, এবং যা নিরবধিকালীন, নামহীন এবং মূলত অপর, সেই ব্যাপারে অবিরাম সাড়া দেয়। মলয় নিজে স্বীকার করেছেন যে “মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো” কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন মরিস ব্লাশোঁর চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে ; কবিতাটি তিনি উৎসর্গ করেছেন সোনালী চক্রবর্তী নামের একজন অপরূপা সুন্দরী তরুণীকে, তার কারণ সৌন্দর্য নিরবধিকালীন অথচ সময়ের পরিসরে আবদ্ধ । মলয় বলেছেন উপরোক্ত কবিতাটির উৎস মরিস ব্লাশোঁর এই উক্তিটি “Every artist is linked to a mistake with which he has a particular intimacy. All art draws its origin from an exceptional fault, each work is the implementation of this original fault, from which comes a risky plenitude and new light.” যে ভুলের সাথে মলয়ের ঘনিষ্ঠতা আছে তা হল ভুল যুবতীর সঙ্গে মলয়ের প্রণয়সম্পর্ক । মলয়ের দাদা সমীর রায়চৌধুরী তাঁর বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে আমাকে বলেছিলেন যে মলয় একবার আত্মহত্যার প্রয়াস করেছিলেন এবং তাঁর পিসেমশায় তাঁকে তাঁর বাবার ফোটোর রাসায়নিক আলমারি থেকে পটাশিয়াম ফেরিসায়ানাইডের শিশি চুরি করে দেখে ধরে ফেলেছিলেন, এই কথা মলয় তাঁর আত্মজীবনীতে কেন লেখেননি তা জানি না । আশ্চর্য যে, বহুকাল পর তাঁর পিসেমশায় নিজেই আহিরিটোলার ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন এবং কলকাতা পুলিশ তাঁর পকেটে যে চিরকুট পায় তাতে লেখা ছিল “আনন্দধারা বহিছে ভূবনে । হাংরি আন্দোলনে মলয় রায়চৌধুরীর জেল-জরিমানা, বন্ধুদের সঙ্গে বিচ্ছেদ, সাহিত্য ও কলকাতা থেকে এক দশকের জন্য বিদায়, সমস্তকিছুর মূলে মলয়ের সেই ভুল । মলয়ের উপন্যাসগুলিতে এবং বহু প্রবন্ধে তাঁর সেই ভুলের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় । দার্শনিক তত্বাদি ও থিম তাঁর সমগ্র রচনায় ছেয়ে আছে, বলা যায় মরিস ব্লাশোঁর মতনই, কিন্তু আনুষ্ঠানিক বিতর্ক এড়িয়ে গেছেন এবং নিজস্ব কোনও নিয়মতান্ত্রিক দার্শনিক তত্ত্বের প্রস্তাব দেননি । তাঁর আরম্ভ করা হাংরি জেনারেশন আন্দোলনও, তিনি নিজেই লিখেছেন, পরাবাস্তববাদীদের মতো নির্দিষ্ট ছকে ফেলা যাবে না । তাঁর প্রবন্ধগুলিতে বহু দার্শনিকের উল্লেখ পাওয়া যাবে, কিন্তু তাঁদেরই চিন্তাপ্রণালীর বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি ব্যবচ্ছেদ ও প্রয়োগযোগ্যতা বিশ্লেষণ করেছেন এবং বহির্জগতে আনতে চেয়েছেন । এই যে টানাপোড়েন, প্রণালীগুলির প্রক্রিয়াকরণ, তা দার্শনিক, রাজনৈতিক বা টেকস্টিয়, যাই হোক না কেন, এবং তাদের নৈরাজ্যিক, প্রতিনিধিত্ব-করতে-অক্ষম, বহির্জগত, মলয় রায়চৌধুরীর রচনাবলীর একটি বৈশিষ্ট্য, যার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা যায় উপন্যাস, নাটক, কবিতা ও প্রবন্ধভাবনায় । আরেকটি থিমের পুনরাবৃত্তি চোখে পড়বে ; তা হল মৃত্যু, সময়, ও বহুবিধ আদি-অন্ত বিষয়ক কূটাভাস ; এর পরিধিতে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও বিশ্লেষণের দাবি রাখে । তিনি অবিরাম দর্শন ও সাহিত্যকে অপরত্বের আয়নায়, সীমার ও অন্তর্জগতের বাইরে থেকে আহরণ করতে চেয়েছেন । মলয় রায়চৌধুরীর জন্ম পাটনায়, ১৯৩৯ সালে, শৈশব কাটিয়েছেন সেই শহরের অন্ত্যজ বস্তি ইমলিতলায়, বিখ্যাত করে দিয়েছেন একদা কুখ্যাত ইমলিতলা পাড়াকে, যে পাড়ায় নষ্ট হয়ে যেতেন অনুমান করে তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে ম্যাট্রিক পাশের পর কলেজে পড়ার জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল । মলয়দের আদিবাড়ি হুগলি জেলার উত্তরপাড়া, যে শহরটি ১৭০৯ সালে পত্তন করেছিলেন তাঁর সাবর্ণ রায়চৌধুরী পূর্বপুরুষ রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী । তাঁদের একান্নবর্তী পরিবারে জ্যাঠারা ও কাকারা ছিলেন সংরক্ষণশীল । তাঁর বাবা ও মা ছিলেন উদার প্রকৃতির । বাবার বন্ধু জনৈক কনভেন্ট-যাজকের বদান্যতায় মলয় চার বছর খ্রিস্টধর্মীদের ক্যাথলিক স্কুলে পড়েছিলেন। তাঁর বাংলা শিক্ষা অবহেলিত হচ্ছে এই আশঙ্কায় তাঁকে ব্রাহ্মদের বাংলা-মিডিয়াম স্কুলে স্হানান্তরিত করা হয়েছিল। বাবা ও মায়ের উৎসাহ-প্রদান ও দাদা সমীর রায়চৌধুরী কর্তৃক কলকাতা থেকে আনা সাহিত্যগ্রন্হ মলয়কে চিন্তার জগতে প্রবেশ করতে সাহায্য করেছিল । মলয় তাঁর আত্মজীবনী ও জীবন-নির্ভর উপন্যাস ‘রাহুকেতু’-তে লিখেছেন যে ব্রাহ্ম স্কুল রামমোহন রায় সামিনারিতে গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তীর প্রতি ক্রাশের কারণে তিনি ব্রাহ্ম কবি ও লেখকদের কবিতা-প্রবন্ধ-উপন্যাস পাঠে আগ্রহান্বিত হন । নমিতা চক্রবর্তী তাঁকে নির্দিষ্ট বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করতেন যে-কারণে তিনি মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন । তাঁর আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে ইমলিতলায় থাকাকালীন তিনি আকৃষ্ট হন মুসলমান তরুণী কুলসুমের প্রতি । মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরী লিখিত ‘দি হাংরিয়ালিস্ট’ গ্রন্হে বর্ণিত হয়েছে মলয়ের সঙ্গে কুলসুমের যৌন সম্পর্ক এবং উর্দু কবি ফিরাক ও গালিবের রচনার সঙ্গে পরিচয় । তাঁর চরিত্র স্বাভাবিকভাবে বাড়ির হিন্দুধর্ম, স্কুলের খ্রিস্ট এবং ব্রাহ্মধর্ম ও প্রণয়িনীর ইসলামধর্মের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে । হয়তো হাংরি আন্দোলন ও পরবর্তীকালের পোস্টমডার্ন চিন্তাচেতনা এই সমন্বয়প্রসূত ।
সোমবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
শনিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
শ্রীমতী ঘিলু : আভাঁ গার্দ গদ্য
শ্রীমতিঘিলু, কথাটা তোকে নিয়েই, তাই শুরু করি, অ্যাঁ ?
ঘিলুতে ঘাপটি মেরে থাকে ভাবনা, নতুন নিমন চকচৌঁধ ধারণা, আর ধারণা মানেই বিপদ, যেমন সৌর্ন্দয্য, জাস্ট ধারণা । কে ওসকায় নতুন নিমন ধারণা ঘিলুতে বুজকুড়ি কেটে ফেনাতে ? বাঞ্চোৎ পাগল না কি, মানুষেরা ? নিরাকার মানে কি ট্র্যান্সজেণ্ডার ? কিন্তু এই কলকাতা শহরটা নিজের নিজস্ব একটি দেশ, দেশের একটি দেশ, জাস্ট ধারণা, বিদেশে বসে মন কেমন করে, কলকাতা শহরের কোনো বিশেষ ব্যাপার নিয়ে, যেন সেটাই কলকাতা! কফিহাউস, গড়িয়াহাট, কষামাংস, ট্যাগোরগান, নাটোক, যাদবপুরের বিপ্লব, কত্তো ব্যাপার ! বাঞ্চোৎ পাগল নাকি, মানুষেরা ?
মানুষ পুরানোকে মেনে নেয়, আর তা খবর হয়; আর খুব, নতুন মেনে নেয়া এবং পুরানো এটাও ব্যবহার করা হয়। বলা হয়, প্রতিটি গ্লাস জল তার নল থেকে আরেকটা কিডনি দিয়ে ছয়বার পাস করেছে আর মাংসের মাটি প্রতিটি স্ক্র্যাপকে টুকরো টুকরো করে পাথর করে ফেলেছে, লড়াই করেছে, খুঁড়ছে ; শতাব্দী ধরে ভাঙ্গা হয়েছে। একটি নিখুঁত জগত পাবার ধান্দায়, তুই তাদের হৃদয়, হা হা, হৃদয়টাও ঘিলু, সেটা না থাকলে মানুষ সবরকম সঙ্গম পারলেও, যৌনসঙ্গম পারে না।
"আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতে চাই: মানুষ প্রেম এবং বিপ্লবের জন্য জন্মগ্রহণ করেছিল।" বলেছিলেন বুড়ো মার্কস । মানুষ পাগল না কি রে ! প্রতিটি চিত্তাকর্ষক চুমুতে লালা থাকবেই, ঘিলুর ঘাসলেট জ্বলছে, দুজনেই টের পাচ্ছে ! মাংসের সঙ্গে মাংসের যেমন যেমন ছোঁয়া তুই দেখতে পাবি না। সাধারণত মানুষ হোক বা বেবুন, হাতের বা চার হাতের বা পায়ের, বিশ্বাস নিজেদের শরীরে ছড়িয়ে দিয়ে হাঁটে । সিংহিনীর যোনি না শুঁকে সিংহ কখনও সঙ্গম করতে রাজি হয় না । কেন ? শালা, মানুষ নাকি ? আ্যাঁ ।
তুই বলছিস "আমি ঠিক আছি" "আমি ঠিক আছি" ! কিন্তু কখনও কখনও তুই যাকে সত্য বলে ভাবছিস তা একটা ধারণা । তুই যাকে সত্য বলে বিশ্বাস করছিস তা তোর ঘিলুর ঘাসলেটে আসে আর তুই সন্দেহে ভুগবি যে ও কি আমাকে ভালোবাসে ? ব্যাস অবিশ্বাস করা আরম্ভ করে বিয়ে বা সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে চলে যা। তখন ভাববি, শালা মানুষ তো ভেঙে দেবার জন্যে জন্মেছিল । মানুষরা পাগল নাকি ! এই ভাবনার ঘাপটি-মারা বন্ধ করতে পারবি না। তখন তুই বুঝতে পারবি যে এটা আসলে উত্তর নয়, এটা একটা প্রশ্ন।
এটা স্রেফ ঘিলুর ঘাসলেটের খেলা । মাংসদণ্ড দাঁড়ায় কেন ? স্ত্রীমাংস ফুলে ওঠে কেন ? বুকের বোঁটায় কাঁটা দেয় কেন ? ঘাসলেটের কারণে, যার নাম রাসায়নিক ক্রিয়া । চিৎ হয়ে না শুলে শুক্রবীজগুলো দৌড়ুতে পারবে না, ঠিকমতন দৌড়ুতে না পারলে মাঝ রাস্তায় দম ফুরিয়ে যাবে । সিংহী জানে, বাঘিনী জানে, হায়েনানী জানে, বিড়ালনি জানে, মানুষীরা গুহার বাইরে নীলাকাশ দেখতে চেয়েছিল । ওরা কেউ কি বলে, "আমি তোমাকে এভাবে সারা জীবন জড়িয়ে ধরে থাকতে চাই, আর তাকে স্হাপত্যের স্থিরতা দিতে চাই।" রদাঁ, তুই ভাবছিস !
ভাবনা ভাবো আর একে ওসকাও, তাকে ওসকাও, পোঁদে লাগো, লাগাও, ঘিলুতে জবরজং ভাবনার ফেনা তৈরি করো, আর পচতে থাকলেই পাবলিককে বিলোও । প্রত্যেকেই তার লুকোনো অস্পষ্ট বিশ্বাসের মধ্যে অন্যের সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পেলেও মনে করে যে তার পথ নিশ্চিতভাবে অন্য সকলের থেকে আলাদা। ফলে, যুদ্ধ করাই একমাত্র উপায়, আর সেটা নোংরা। পরিষ্কার সাজানো যুদ্ধ হলেও তা গামবাটিয়া । শবের পাহাড়, পচা রক্তের শুকনো স্রোত, ভনভনে মাছি। গণকবরের সৌন্দর্য্য । বালিয়াড়ি । তোকে পালাতে হবে । ত্রাসের মুখে পড়লে তোকে হয় লড়তে হবে বা পালাতে হবে ।
ভালোবাসা মানুষকে একে আরেকের কাছে কুৎসিত করে তুলবেই । সস্তা শট ট্রাই কর, কম দামের চোট । সে নোংরা অনুভূতি বয়ে বেড়াতে হবে, কেউই নিজের মাংসের স্মৃতি পছন্দ করে না । অথচ তা সত্য না মিথ্যা জানে কেবল ঘিলুর ঘাসলেট । সুন্দর ভেবে তার দিকে চেয়ে থেকে আকৃষ্ট হয়; ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, তুই সুন্দর জিনিসের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিস আর যেন তোকে গড়ে নিয়ে গলিতে ছেড়ে দিয়ে গেছে । তোর আকৃতি বদলে গিয়েছিল, আর কুৎসিত হয়ে গিয়েছিলিস। তুই মনে করিস যে, মানুষেরা ঈশ্বরের গুহ্যের সিংহদুয়ার দিয়ে ডানা মেলে আকাশ থেকে নেমে এসেছিল, উড়ন্ত কুমারী ডায়নোসরদের সঙ্গে । ঈশ্বর ট্র্যান্সজেন্ডার কেননা কেউ তাঁর জেণ্ডার জানে না ।
কুমারীত্ব ! বাঞ্চোৎ ভারতীয়রা বিয়ে করার সময়ে ভাবে বউটা কুমারী হবে, প্রথম রাত্তিরে কোঁচড়ের ফিনফিনে পর্দা ছিঁড়ে রক্ত বেরোবে ! ঘিলুর ঘাসলেট ছাড়া আর কি, অ্যাঁ ? মেয়েদের সম্পর্কে সবচেয়ে খারাপ ভাবনা মানুষ তৈরি করেছে ! পুরুযের বেলায় তা ভাবে না । কবে তৈরি হল ঘিলুর এই ঘাসলেট, কুমারীপুজো! বীরেনকেষ্টর চণ্ডীপাঠ শুনে শুনে তুই এখন বোর । মোবাইলে বাজছে, ইউ টিউবে বাজছে, রিকশাস্ট্যাণ্ডে বাজছে, টিভিতে দেখাচ্ছে । তোর বন্ধুদের একটা জমঘট আছে, যারা কুমারীত্বকে ঐশ্বরিক বলে মনে করে । আসলে এটা প্রেমিকের অবর্তমানে সুযোগের অভাব। তুই মনে করিস যে এটা বেশ পছন্দসই বিষয় আর আলোচনা করলে মনের ভেতরে সতীচ্ছদ ছেঁড়ার আনন্দ পাবে। জাস্ট ঘিলু । বাঞ্চোৎ মানুষ নাকি পাগলক্ষ্যাপা !
দেয়ালে দেয়ালে ভুল বানানে বিপ্লবের স্লোগান থাকতো । বিষ্টিতে আর অন্য দলের লাথিতে ধুয়ে গেছে । বাড়ির মালিকদের আনন্দ । যাক দেয়ালের কুমারীত্ব ফিরে এলো । কিন্তু নাঃ । বেচারার ঘিলুর ঘাসলেট, ভুল বানান নতুন দলরা বজায় রেখেছে । তুই একদিন জানলা গলিয়ে দলগুলোর সদর দপতরে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ ফেলে এসেছিলিস । ধপাস ধপাস, দুবার আওয়াজের পরেও দেয়ালগুলোয় যে কে সেই । বাঞ্চোৎ, পাগল নাকি মানুষেরা । পাগল নয়, পাগল নয়, তোরা স্তালিনের খাটের তলায় তৈরি পেচ্ছাপের পুকুরে ডুবে গিয়েছিলি । হায়, পেচ্ছাপে ডুবে বিপ্লবীর ইন্তেকাল ! কেন হলো ? ঘিলুর ঘাসলেটের জন্য। অসংখ্য লুমপেন পয়দা হলো লুমপেন মাংস-মাংসীর যৌথ পরিশ্রমে । কলেজের পায়খানার দেয়ালেও বানান ভুল। কী আর করা যাবে ! কলকাতার জন্যে নসটালজিয়ায় তাও ক্রাইটেরিয়া ।
অনেকের মনে হয় যে অপেক্ষা করা উচিত, যাতে সম্পর্ক জোড়া লাগে। গেরুয়া আর সবুজ রাজনীতি কি জোড়া লাগবে ? তুই ওদের দেখলে, ওদের কথা শুনলে, ওরা জিতলে, ত্রাসে আক্রান্ত হোস । যারা মৃত্যুর বিষয়ে ধর্মীয় সান্ত্বনা দেয় আর মৃত্যুর মানে পালটাতে চায়, স্বাভাবিক হিসাবে মৃত্যু নয়, তাদের জন্য মৃত্যু হল অশ্লীল রহস্য, চরম বিরক্তি, যা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কটা লাশ মর্গে গিয়ে ঘুমোলো তা নিয়ে ওরা ভাবে আর আনন্দ পায় । তোর মনে আছে তো ট্রেন ভরে ভরে মানুষ পালিয়ে আসছে? বাড়িগুলোর দেয়ালে, এমনকি দপতরের ভেতরের দেয়ালে অশ্লীল পরামর্শগুলো যারা লেখে, এমন লোকেদের ওপর পুলিশ এখনও কোনও নজর দেয় না। দেবে কেমন করে ! অশ্লীল গালাগাল দিতে দিতে ধানখেতের ওপর দিয়ে বউ-বাচ্চাদের পেছনে দৌড়েছিল !
তুই একথাও বলছিলিস, হা হা, জয় মা কালী কলকাত্তাওয়ালি, যখন উন্নয়নের কাজে শ্রেণিভাগ মুছে যায়, আর সমস্ত উৎপাদন সমগ্র জাতির এক বিশাল সংস্থার হাতে থাকে, তখন জনগণের শক্তি তার রাজনৈতিক চরিত্র হারায় । হা হা। রাজনৈতিক ক্ষমতা, এক শ্রেণির আধিপত্য, অন্যের উপর অত্যাচার করার জন্য কাজ করে। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করে কী হয়েছে তা দেখিয়ে দিয়েছে চোকসি, মোদি, মাল্যরা । যতোই যাই করো, কিছু মাংস-মাংসীর অবদান লুটেরা-দানব পয়দা করবেই, তুই বলেছিলিস । সবই ঘিলুর ঘাসলেট । অনেক ভারতীয় জন্মায় সুইস ব্যাঙ্কের ভল্টে । পুচুৎ ।
তুই বিশ্বাস করিস মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে ; সঙ্গীতকে, সেটা মানুষের মধ্যে দানবদের দমিয়ে রাখে, অধচ দানব-অসুর-ডাইনি সবই ঘিলুর ঘাসলেটে ফেনানো । তারপর বলেছিলিস, বেকার ব্যাকুল ব্যক্তির পক্ষে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা উপভোগ করা যে কি ব্যাপার তা তোর পক্ষে কল্পনা করা কঠিন। তুই বললি, সত্যিকারের স্বাধীনতা শুধুমাত্র এমনই হতে পারে যেখানে অন্যের দ্বারা কোনও ব্যক্তির শোষণ আর নিপীড়ন হয় না; যেখানে কোন বেকারত্ব নেই ; একজন লোক তার চাকরি হারানোর ভয়, তার বাড়ির আর তার ভাতকাপড় হারানোর ভয়ে বাঁচতে পারে না। শুধুমাত্র এমন একটি সমাজে ব্যক্তিগত এবং অন্য কোনও স্বাধীনতা প্রকৃতপক্ষে সম্ভব । কিন্তু এই সমাজ শুধু ঘিলুর ঘাসলেটে পয়দা হয় । এই শুরু হলো বলে বিশ্বকর্মা পুজোর লাউডস্পিকার ।
তুই মনে করিস, কৃতজ্ঞতা ব্যাপারটা কুকুরের ভোগা এক ধরণের অসুস্থতা। মানবজাতিকে ধনী, মানে ভালো ব্রিডের কুকুর আর গরিব, মানে রাস্তার কুকুরে ভাগ করা হয় । এটা মজার, না। তুই চিরটাকাল নিজের ভালোবাসা উপভোগ করার চেয়ে অনেক বেশি ঘৃণা উপভোগ করছিস। প্রেম একরকমের মেজাজ। ক্লান্তিকর। বড্ডো দাবি তোলে। ভালবাসা তোকে অপমান করে, কিন্তু ঘৃণা তোকে কষ্ট দেয়। তুই খুব সুন্দর, এটা অনেকসময়ে তোর একটা ব্যাথা । সৌম্যকান্তি যুবকদের দেখলে, সুন্দরী তরুণীদের দেখলে, যেমন ফিল্ম অভিনেতা-অভিনেত্রীরা, তাদের দেখলে, তোর বুক ভয়ে ছাঁৎ করে ওঠে । কেন করে ? আসলে মনে-মনে তাদের ভাল্লাগে না, বানাওটি মনে হয়, ফালতু, নকল । ওদের কাজ সামনের লোকটাকে নির্বোধ করে তোলা, হীন করে তোলা, সস্তা আর খেলো করে তোলা । ওরা জাস্ট ঘিলুর ঘাসলেট ।
তুই কি সত্যিই বিশ্বাস করিস যে ই ইতিহাসবিদরা পুরুষ সম্পর্কে, নারীদের সম্পর্কে যা যা বলছেন - তা সত্য? তোর এই বিষয়টা বিবেচনা করা উচিত যে এই ইতিহাস পুরুষরা লিখেছে, যারা দুর্ঘটনা ছাড়া সত্যকে কখনও সত্য বলে না। আজকে আমরা এমন সমাজে বাস করি যেখানে প্রচার মাধ্যম, , সরকার, পেল্লাই কর্পোরেশন, ধর্মীয় গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল মিলেমিশে জঘন্য বাস্তবতাগুলি তৈরি করে ।. তাই তুই কি তোর লেখায় জানিস, সত্য কি? কারণ মানুষ অত্যন্ত অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করে খুব পরিশীলিত বিজ্ঞানীদের তৈরি ছদ্ম-বাস্তবতার সাথে বোমা হামলা করেছে । তুই তাদের উদ্দেশ্য অবিশ্বাস করিস নাকি তাদের ক্ষমতা অবিশ্বাস করিস ? ভেবে বলিস । মনে রাখিস যে এটা একটা বিস্ময়কর শক্তি: সমগ্র মহাবিশ্বের, ধ্বংসের সর্বজনীন সৃষ্টি । তোকে জানতে হবে। যারা ভয়ানক, ভয়ঙ্কর তারা প্রতারিত হয় না । রাষ্ট্র মাত্রেই ব্যক্তিকে ছেড়ে চলে যায় । শুধুমাত্র এই বিশৃঙ্খল অন্তর্দৃষ্টির শর্ত হলো বিশ্বের একটি পূর্ণ উপলব্ধি, সমস্ত ধারণা বিবেচনা করে তুই জানা । তোর মধ্যে একটা শীতল বিষণ্ণতা কাজ করে, তাতে তোর নিজস্ব পূর্ণ অধিকার আছে।
তুই মনে করিস, ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে শুধু ভয়াবহ ঘিলুর রসায়নে লুকিয়ে থাকতে পারিস । এ তো নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা । অথচ বয়স বাড়ার সঙ্গে তা অভ্যাসের ব্যাপার হয়ে ওঠে। যদি তুই নিজেকে খোঁচা দিয়ে তাকে কাটাতে চাস তবে ঘিলু থেকে সেই দুশ্চিন্তা দূর হবার সম্ভাবনা থাকতে পারে । শেষ পর্যন্ত তুই নিজেকে দুঃখ ভোগার জন্য অনুমতি দিয়ে ফেলবি । ভারতীয়রা নিজের মতন দেখতে দেবী-দেবতা সৃষ্টি করেছিল । কেন ? বেদ লেখার সময়ে তারা ভীষণ সন্ত্রাসে আক্রান্ত হয়ে এটি করেছিল । কে তাদের দোষারোপ করতে পারে? তুই শুধু লিখতে চাস, মনের মতন লিখে যেতে চাস, আর কিছু চাইবার নেই । তাও কিন্তু ঘিলুর অপকম্মো ।
তুই কখনও বুঝিসনি কেন অভিশাপ, গালাগাল আর অপমান বেশির ভাগ সময়ে যৌনাঙ্গ আর যৌনকর্ম নিয়ে হয় । হৃৎস্পন্দনের মাংস তো বিস্ময়কর আর তাতে থাকে সৌন্দর্য, আনন্দ আর পরিতোষ । যৌন অঙ্গগুলোর নাম কীভাবে ছুঁড়ে মারা হয় এটা অস্বীকার করা যায় না । হা মাংসময় প্রাণ, এই ছিল মানুষের পোকামাকড়ের মতন নিয়তি ! অথচ পোকামাকড়ের ধারণা করার দরকার হয় না, তারা ঘিলুর ঘাসলেটে ডোবে না । ধারণা হলো বোবা কন্ঠস্বর যা পোকার মতন মানুষের চামড়ায় হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায় । ঘিলুর ঘাসলেট একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সামনে তোকে দাঁড় করায় : “ভাল মানুষ কতটা খারাপ হতে পারে?”
সাধারণ মানুষ কি ভাল হতে পারে, যদি তারা অন্যের ক্ষতি না করে , বল তুই ? এটা ভুল প্রমাণিত। প্রতিদিন যে দুই মাসের বাচ্চা থেকে সত্তর বছরের বুড়িকে ধর্ষণ করা হচ্ছে, সেই ধর্ষকগুলো তো সাধারণ মানুষ, নয়কি ? কী ঘটেছে যে শহরে গাঁয়ে ধর্ষকদের বাড়বাড়ন্ত ?এটাও ঘিলুর বজ্জাতি । সবাই ভাল হতে চেষ্টা করে না । তবুও এটা অন্তর্নিহিত প্রশ্নগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যদি অত্যাবশ্যক বৈশিষ্ট্যগুলির প্রয়োজন হয়, যেমন প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিমত্তা, তাহলে অনেক লোককে বাদ দেওয়া হবে - যেমন জ্ঞানীয় অক্ষমতাযুক্ত ব্যক্তিরা আজকের দিনে সঠিক বলে মনে হচ্ছে না।রাজনীতিকদের চামচায় ছেয়ে গেছে চারিদিক, মূর্খের সমাজে তাদের বীর্যের দোলপূর্ণিমা ।
তুই বলেছিলিস যে, তোর দেহের দুর্বল সুগন্ধ, তোর রেশমি চুলের স্মৃতি আমার দুঃখ হয়ে দেখা দেবে, দুঃখের কারণে মরতে পারব না, যদিও আপনি তা করতে পারেন বলে মনে হয়। হৃদয় আসলে স্টপগ্যাপ বন্দোবস্ত নয়, যদিও কখনও কখনও আপনার বুকে তা আছড়ে ভেঙে পড়বে, আপনি সামলাতে হিমশিম খাবেন, অথচ আপনিই বলছেন যে সবই হলো ঘিলুর ঘাসলেট । দুঃখ সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে গেলেও টিমটিমে চিনচিনে দরদ ছেড়ে যায়, ঘায়ের দাগের মতন । এটা একমাত্র উপায়। একদিন এমন আসে যখন আপনি আবার হাসেন, কিন্তু তা কি বিশ্বাসঘাতকতা নয় ? আমি কিভাবে খুশি মনে সাহস যোগাড় করেন ? তারপর আপনি নতুন অশ্রু ঝরাবেন, কারণ আপনি একবার যেমনটি করেছিলেন তেমনভাবে তাকে মিস করবেন না । আপনার দুঃখ প্রকাশ করা হবে সেই প্রেমিকার মৃত্যু। দুঃখের একচেটিয়াপনা, যখন আপনি অন্ধকারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন একা, ক্ষুব্ধ, এবং ভয়ানক। শব্দ আপনার ব্যথা প্রকাশ করতে গিয়ে ক্ষমতাহীন হয়ে যায়; আপনার কথাগুলো থেকে অন্যেরা কী বোঝে ? স্রেফ বায়ু নাচ। ঘুরেফিরে সেই, মানুষ না পাগল রে ! তুই আস্তে আস্তে, পরিমিত পদক্ষেপ নিতে নিতে, বাতাসে ভাসানো তোর রুপান্তরিত ছবি পাঠাবি। একটি দীর্ঘ, সাদা, গোলাপি ব্রোকেড শাড়ির আঁচল উড়িয়ে । তারপর কালো চুলে ব্রাশ করবি ।
তোর মনে হয়েছিল, যে কারনগুলোর জন্য মানুষ কাজ করে সেই কারণগুলির উপর ভিত্তি করে পুরোনো ধারণা আকর্ষণীয় হলেও তাকে ত্যাগ করা যায় । তুই বিশ্বাস করিস যে, খুব গরিব এবং খুব সুন্দর হতে হবে এই ধারণা একটা নৈতিক ব্যর্থতা আবার তা এক হিসেবে পুরোনো দিনের শৈল্পিক সাফল্য। রবীন্দ্রনাথ যে প্রজন্মেই জন্মান না কেন, ভাল কাজ করতেন, কারণ তিনি একটি নোংরা ঘরের অন্ধকারে মারা যেতে অস্বীকার করতেন । উনি বর্তমান সূত্রগুলো বেছে নিতেন আর তাদের হাতে গোনা লোকেদের মেনে নিতে বাধ্য করতেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত তো বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে, শ্রেণিবিভাজক, তা জানতে পারেননি মাও সে তুঙ । রেড বুক আর কেউ পড়ে না, ছত্তিশগড়ের জঙ্গলেও পড়ে না । ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে ঘিলুর ঘাসলেট । হা বাঙালি, হা বাঙালি, হা বাঙালি ।
তোর প্রশ্ন ছিল, “আচ্ছা, সাহিত্য কি একটা মাধ্যম ? কোন কাজের মাধ্যম ? এই মাধ্যমটা মোটেই ভাল নয় ।” কিছু লোক যদি সাহিত্যকে সস্তা বুজরুকি মনে করে, তাহলে তার কোনও অযৌক্তিকতানেই। তুই তোর বক্তব্য প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করলি । বললি, "এটা সমস্ত অর্জনের অবমাননাকারী, ভন্ডামি, স্থিতি অস্বীকারকারী, আইকনভাঙার খেলা, যা কোনও কার্যকর নিয়ম বা অনুক্রমের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। কেউ যদি বিংশ-একবিংশ শতাব্দীকে বুঝতে চায়, তাকে মনে রাখতে হবে যে সবসময় বর্বরতা একতা ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করে চলেছে ।” কিছু বলার নেই । যে যার নিজের ভাবনা ভাবার অধিকারিণী ।
আধুনিকায়নের মধ্যে একেবারে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল খুনখারাপি, এবং এখনও একটি বড় জমঘটের সামনে খুনখারাপি ও সাফল্যের মধ্যে একটি সংযোগের অনুমতি দেওয়া হয়, প্রাথমিকভাবে অসংগঠিত সাম্রাজ্যবাদের আকারে । ভেবেছিলিস কখনও যে বিশ্বাসঘাতকরা তাদের বিশ্বাসঘাতকতার একটা তত্ব বানিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করবে ? আজকে তাদের নিবাস সেই আক্রমণাত্মক অশ্রুপন্থী মগজের মধ্যে, যা কার্যত সমস্ত শিষ্যদের মাধ্যমে গড়িয়ে চলে, হা হা, দলদাসদের জনপ্রিয় সংস্কৃতির গাড়ি। যে বিংশ শতাব্দী স্বাধীন ভারতে খুনখারাপি দিয়েই দেশটার আরম্ভ হয়েছিল সেখানে পয়সাঅলা মানে উচ্চ সংস্কৃতির দাপট । আসলে নিম্নসংস্কৃতি বলে কিছু হয় না রে, তুই তো জানিস ।
প্রকৃতপক্ষে অজ্ঞতাকে পরিষ্কার স্লেট ভেবে ইউটোপিয়ার কথা ভাবেছিলিস । মানুষেরা ক্রমাগত ম্যানিপুলেশনের প্রচেষ্টা সাপেক্ষে এগিয়ে না পেছিয়ে চলেছে তা তুই নিজেই নির্ধারণ করিস, আমার কোনো বক্তব্য নেই এই ব্যাপারে । অপরাধী নিজের তত্ব ফাঁদে । কিন্তু যা করতে চায় তা করতে ব্যর্থ হলে তাকে ধড়িবাজ মনে হয়, ধড়িবাজ কবির সংখ্যা নির্ভর করে চেলাদের সংখ্যার ওপর । ম্যানিপ্যুলেটের, অনুমোদন সম্পর্কে এত যত্ন করে গড়ে তোলে, যাতে চেলারা তাকে শুভেচ্ছা ভেবে অনুপ্রাণিত হবে । তুই কিভাবে এটা অস্বীকার করতে পারিস?
যখন তুই উপলব্ধি করলি যে তুই অন্য কারো সাথে জীবনের বাকি সময় কাটাতে চাস, তখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোর বাকি জীবন শুরু করতে চাইলি । তোর শরীরের কোনো অংশ সম্পর্কে গোপন বা অশ্লীল কিছু মনে ছিল না। এখন, আমি স্বীকার করি যে কিছু অঙ্গভঙ্গি এবং কোণ রয়েছে যা লোকেদের ভালো দেখায়, যা তুই এড়াতে পারতিস। যত বেশি তুই গণতন্ত্র নামের সিসটেম দেখিস তত বেশি তাকে তুই অপছন্দ করিস । বিপ্লব এসেও ফিরে গেছে দেশে দেশে, যেমন চীনদেশে, রাশিয়ায়, ভিয়েতনামে, কিউবায় । তুই যুগোস্লভিয়ার কোথায় থাকতিস রে ? এখন সেটা অন্য দেশ ?
নৈরাজ্যের ষড়যন্ত্র থেকে পালাতে চেষ্টা করছিস তুই । সমস্যা হলো যে পালাবার জন্যে ঘুরেফিরে সেই তো মুখের ভাষার আশ্রয় নিতে হচ্ছে, আর তুই বোবা সেজে থাকতে পারবি না । তোকে প্রতিআক্রমণের জন্যে সদাসর্বদা তৈরি হয়ে থাকতে হবে । একবার যদি কেউ তোর পিঠে ছুরি মারার চেষ্টা করে থাকে, তাহলে সে সারাজীবন ধরে চেষ্টা করে যাবে । তাই প্রথম আঘাতটা তোকেই দিতে হবে, বিনা দ্বিধায়, বেপরোয়া হয়ে ।
বৃহস্পতিবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
কোনো কোনো কবি কেন জনপ্রিয়
কবি এবং কবিতার জনপ্রিয়তার পেছনে কি রহস্য আছে ? অনেক কবি আছেন যাঁদের কবিতা জনপ্রিয়তা পায়নি, এমনকি যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁরাও সেই কবির কবিতার বইয়ের নাম বা কোনো কবিতার নাম বলতে পারবেন না। আবার এমন কিছু কবি আছেন যাঁদের কবিতা মানুষ পাঠ করে, টাকাকড়ি রোজগার করেন, গান হয়, মানুষের মুখে ফেরে। কেন ? এর পিছনে কী রহস্য লুকিয়ে থাকে বা আছে ?
এই ভাবনা সাম্প্রতিক, কেননা আমরা যখন হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করি, তখন ‘জনপ্রিয় কবি’ বলতে বোঝাতো ‘আলোচিত কবি’, যাঁর কবিতা নিয়ে কফিহাউসে বা পত্রিকা দপতরে আলোচনা হয় । তাঁরা কেউ কেউ ছিলেন ‘শিষ্ট’ পত্রিকার সম্পাদক, বিশেষত কবিতা পত্রিকার সম্পাদক । কিন্তু সব পত্রিকার সম্পাদকরা আলোচিত হতেন না । যেমন পূর্ব্বাশা পত্রিকার সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য । পূর্ব্বাশা পত্রিকা ১৯৩৯ থেকে ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৩২ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত পূর্ব্বাশা-র সম্পাদনা করতেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য । কিংবা ধ্রুপদী পত্রিকার সম্পাদক সুশীল রায়। তাঁরা কবি হিসাবে তেমন আলোচিত ছিলেন না যেমন ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু ।
আমার মনে হয়, সেসময়ে, আর পরেও, যে কবিরা অধ্যাপনা করতেন, তাঁদের ছাত্র-ছাত্রীরা সাধারণত নিজেদের মধ্যে ‘স্যারদের’ আলোচনা করতেন । বুদ্ধদেব বসু সতীর্থ কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সহযোগিতায় ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ত্রৈমাসিক কবিতা (আশ্বিন ১৩৪৪) পত্রিকা সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। পঁচিশ বছরেরও বেশি তিনি পত্রিকাটির ১০৪টি সংখ্যা সম্পাদনা করেছিলেন । অধ্যাপক ছিলেন বলে ছাত্র-ছাত্রীদের মাধ্যমে ‘আধুনিক কবিতা’ বলতে কী বোঝায় তার বার্তা ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন । ফলে মনে করা হয় তিনি আধুনিক কাব্যআন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তৃতীয় বর্ষ ১ম সংখ্যা (আশ্বিন ১৩৪৪) থেকে বুদ্ধদেব বসু ও সমর সেন এবং ষষ্ঠ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা (চৈত্র ১৩৪৭) থেকে বুদ্ধদেব বসু একাই এর সম্পাদক ছিলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র আটটা কবিতার বই লিখেছেন, ফিল্ম লাইনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর মতন আলোচিত ছিলেন না । তিরিশের কবিরা সবাই অধ্যাপনা করতেন বটে কিন্তু সবাই বুদ্ধদেব বসুর মতন আলোচিত ছিলেন না । বুদ্ধদেব বসু হয়ে উঠেছিলেন কবিতার প্রতিষ্ঠান। জীবনানন্দ ক্রমশ আলোচিত হয়ে ওঠেন এবং তা শিক্ষকতার জন্য নয় ; তাঁর কবিতার আকর্ষণ ক্ষমতার জন্য । তবু, সেসময়ে তিনি বুদ্ধদেব বসুর মতন আলোচিত ছিলেন না ।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে, ১৪ আগস্ট রাত এগারোটায় কলকাতা বেতারে প্রাসংগিক কথিকা ও কবিতা আবৃত্তিতে অংশ নেন অমল হোম, সজনীকান্ত দাস, প্রবোধ কুমার সান্যাল, নিরঞ্জন মজুমদার প্রমুখ। অর্থাৎ সেই সময় থেকে কবিতার প্রচারে প্রযুক্তির প্রয়োগ আরম্ভ হল । পরে আকাশবাণী থেকে নিয়মিত কবিতাপাঠের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কবিদের শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরার ব্যবস্হা হয় । সবাই সুযোগ পেতেন না ; যাঁদের যোগাযোগ ছিল তাঁরা কবিতাপাঠ করতেন । দূরদর্শন আসার পর সেখানেও কবিতাপাঠের সুযোগ পেতে লাগলেন এবং আলোচিত হতে লাগলেন নির্দিষ্ট কবিরা । পাঠকবৃদ্ধির জন্য সংবাদপত্রগুলো কবিদের সুযোগ দেয়া আরম্ভ করলো ; সব কবিদের নয়, নির্দিষ্ট কবিদের ।
স্বাভাবিকভাবে, জনপ্রিয়তা বলতে যা বোঝায় তা আরম্ভ হলো পঞ্চাশের দশকে, যখন কিনা চল্লিশের দশকের অধিকাংশ কবি জনগণের কবিতা লিখতেন । বুদ্ধদেব বসুর যাত্রাপথ অনুসরণ করে পঞ্চাশের দশকে দীপক মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও আনন্দ বাগচী আরম্ভ করেন ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা । কৃত্তিবাস প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। দীপক মজুমদার ও আনন্দ বাগচীর সঙ্গে মতবিরোধের কারণে কেবল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই পত্রিকার অভিভাবক হয়ে ওঠেন এবং বুদ্ধদেব বসু যেমন ছাত্র-ছাত্রীদের আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আকর্ষণ করতে চাইলেন উঠতি কবিদের । বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকা তখনও চলছে। । সেই সময়ে জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, সমর সেনের মত কবিরা থাকতেও এঁদের থেকে কবিতা না নিয়ে যুবকদের কবিতা নিয়ে প্রকাশ হতে থাকল কৃত্তিবাস। তরুণদের দলে টানার জন্য অধ্যাপক-কবি কবি শঙ্খ ঘোষের খাতা জোর করে নিয়ে এসেছিলেন সুনীল। প্রকাশিত হয় তাঁর ‘দিনগুলি রাতগুলি’ কবিতাটি।
দেড় দশক ধরে চলা এই পত্রিকাটি ‘কবিতা’ পত্রিকাকে সরিয়ে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। পনেরো বছর পরে কৃত্তিবাসের পঁচিশতম সংখ্যা প্রকাশ পায়। ১-২৫ সংখ্যাই কৃত্তিবাসের প্রথম পর্ব । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ততোদিনে নিজের ভক্তদের দল গড়ে ফেলতে পেরেছেন । ১৯৬৯ সালের পর ‘কৃত্তিবাস’ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে। এরপর আবার চালু হয়, নতুন উঠতি কবিদের ধরে রাখার জন্য, মাসিক পত্রিকা হিসেবে। তখন থেকে ‘কৃত্তিবাস’ আর শুধু কবিতার পত্রিকা থাকে না, গদ্যও সমান তালে ছাপা হতে থাকে, কেননা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন কেবল আলোচিত নন, জনপ্রিয়ও । এই জনপ্রিয়তা্র ইশারাও কিন্তু বুদ্ধদেব বসু দিয়েছিলেন শার্ল বোদলেয়ারের ‘ক্লেদজ কুসুম’ অনুবাদ করে এবং কৃত্তিবাসের কবিদের সঙ্গে বোদলেয়ারের জীবনযাপনের পরিচয় করিয়ে । কৃত্তিবাসের কবিরা বোদলেয়ারের মতন কলকাতার লাতিন কোয়ার্টার, আবসাঁথের জায়গায় খালাসিটোলা, মাতলামির অভিনয়, মাঝরাতের হইচই ইত্যাদির মাধ্যমে তরুণ কবি ও সম্পাদকদের মাঝে লোকমুখে একধরণের জনপ্রিয়তা গড়ে তুলতে পারলেন । এ ক্ষেত্রেও সবাই নন, নির্দিষ্ট কয়েকজন, যাঁরা অনুরাগীর দল গড়ে নিতে পারলেন । একই আচরণ করে শক্তি চট্টোপাধ্যায় জনপ্রিয় হলেও অমিতাভ দাশগুপ্ত হলেন না, কেননা অমিতাভ দাশগুপ্ত বাজারের প্রশ্রয় পেলেন না ।
কেন কেউ অনুরাগী হতে চাইবে ? তা টের পাওয়া যায় ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা কিছুকাল বন্ধ থাকার কারণে । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আনন্দবাজারে যোগ দেবার পর অভীক সরকারের সঙ্গে বন্ধুত্ব এমন পর্যায়ে নিয়ে যান যে দেশ পত্রিকার কবিতার পৃষ্ঠা দ্বিগুণ করা থেকে কোন কবিকে আনন্দ পুরস্কার দেয়া হবে তাও নির্ণয় করার ক্ষমতা পেয়ে যান । ফলে কাদের কবিতা পড়া দরকার তার ইশারা দিতে লাগলেন পাঠকদের । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবিতার পাতার দায়িত্ব দিয়েছিলেন জয় গোস্বামীকে । তাঁর কাছ থেকে নিয়ে দিলেন শ্রীজাতকে। ইতিমধ্যে প্রাইভেট টিভির প্রসার ঘটতে থাকলো । তার মালিকরা যাঁদের তুলে ধরতে চাইলেন তাঁরা প্রচার পেলেন ।
এর পরই ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্হা ঘোষণার দরুন বিভিন্ন ধরনের গান, কবিতা, উপন্যাস, ছোটোগল্প- এগুলিও সেন্সর করা হয়েছিল। জ্যোতির্ময় দত্ত, শঙ্খ ঘোষ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গাঙ্গুলী,, মণীশ ঘটক, কমলেশ সেন, শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়, পান্নালাল মল্লিক, অঞ্জন কর, মণিভূষণ ভট্টাচার্য, দীপক মজুমদার, সুনীল গাঙ্গুলি, গৌরকিশোর ঘোষ, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, বিদ্যুৎবরণ চক্রবর্তী, শম্ভু রক্ষিত প্রমুখের কবিতা, সমর সেনের গদ্য, কৃষ্ণ চক্রবর্তী ও সুখরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস, উদয় রায়ের গল্প প্রভৃতির পাশাপাশি নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথের গান এবং কবিতার প্রচারেও সেন্সর আরোপ করা হয়েছিল। জরুরি অবস্হা তুলে নেবার পর বাংলায় যে লিটল ম্যাগাজিন বিস্ফোরণ হলো, তাতে কবিদের জন্যে প্রচারিত ও জনপ্রিয় হবার সুযোগ হলো, বিশেষ করে সেই কবিদের যাঁরা দেশ-আনন্দবাজারের সমর্থন পেতে লাগলেন । বামপন্হী সরকার এসে সংস্কৃতি বিভাগ আর অ্যাকাডেমির মাধ্যমে পাল্টা প্রতিষ্ঠানের বনেদ তৈরি করলেন বটে কিন্তু জনপ্রিয় হতে চান এমন কবিদের নিজের দিকে টানতে পারলেন না । সেই টানার কাজটা করতে পারল তৃণমূল দল, কয়েকজন কবিকে গুরুত্ব দিয়ে কবিদের দলে টানার প্রক্রিয়া।
কবিতা মাসে-মাসে, সপ্তাহে-সপ্তাহে, ঘণ্টায়-ঘণ্টায় শেষ হবার পর বাণিজ্যিকভাবে সম্ভবত কবিতাপাঠের প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড করলেন শান্তি লাহিড়ী । অনেকের কবিতাপাঠ ছিল সেই রেকর্ডে । এখন ওটা সিডিতে পাওয়া যায় । শম্ভু মিত্র, কাজী সব্যসাচী তিরিশের কবিদের কবিতা টেপ রেকর্ডে পাঠ করলেন। বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্তও পাঠ করলেন । দেখা দিলেন বাচিক শিল্পীরা, যাঁরা প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, তিরিশের কবিদের কবিতা আবৃত্তি করতেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে লাগলেন নতুন কবিরা এবং বাচিক শিল্পীদের জন্য আয়ের পন্হা গড়ে দিতে পারলো কবিতা । নতুন কবিরা টাকা দিয়ে বাচিক শিল্পীর ক্যাসেট-সিডি ইত্যাদি বের করা আরম্ভ করলেন । কবিতা বইয়ের প্রকাশকরা প্রভাব খাটিয়ে, বিক্রি বাড়াবার জন্য, কাব্যগ্রন্হের রিভিউ করাতে লাগলেন । নামের দামামা বাজানো ছাড়া যে মনে করিয়ে রাখা যাবে না তা কবি এবং তাঁর প্রকাশকদের টের পেতে অসুবিধা হলো না ।
কবির সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে । বুদ্ধদেব বসু, সুশীল রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ আধুনিকতাবাদী চিন্তাভাবনার সম্পাদকরা বিশ্বাস করতেন ছাঁটাই করার, একে-তাকে বাদ দেবার মানদণ্ডে । সেই মানদণ্ডকে ভণ্ডুল করতে দেখা দিলেন প্রভাত চৌধুরী, যিনি সবাইকে নিজের ছাতার তলায় এনে ‘কবিতা পাক্ষিক’ পত্রিকায় অচেনা-অজানাদের কবিতাও প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন এবং সেই মানদণ্ডের নাম দিলেন ‘অধুনান্তিক’। প্রভাত চৌধুরী কাঁধে ঝোলা নিয়ে বিভিন্ন জেলার কবিতাপাঠের আসরে বা জমায়েতে পৌঁছোতে লাগলেন যা বুদ্ধদেব বসু, সুশীল রায়, অরুণকুমার সরকার, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সোফিসটিকেটেড চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না । কবির সংখ্যাবৃদ্ধির ফলে কবিরাও সবাইকে মনে রাখার অসুবিধা ভোগ করা আরম্ভ করলেন ।
এতো সব করার পরও অনেকে থেকে গেলেন অনালোকিত । তার কারণ প্রযুক্তি আসার পর যে নেটওয়র্কিঙ প্রয়োজন, যোগাযোগ দরকার তা সবাই, লজ্জাবশত, আত্মাভিমানের কারণে, করে উঠতে পারলেন না । প্রচার বেশি, এমন পত্রিকাতে কবিতা পাঠানোয় কুন্ঠা বোধ করলেন । নেটওয়র্কিঙ রবীন্দ্রনাথ যেমন করতেন, তেমন নেটওয়র্কিঙ যাঁরা করতে পারলেন, তাঁদের মনে রাখায় অসুবিধা দেখা দেয়নি । যেমন সুমন চট্টোপাধ্যায়, যিনি কবিতা লিখেছেন, মঞ্চে গিটার বাজিয়ে গান গেয়েছেন, রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকেছেন । ফেসবুক এবং ইনটারনেট আসার পর প্রয়োজন হয়েছে বিশ্বব্যাপী নেটওয়র্কিঙের । কবি বা কবি-বিশেষের অনুগামীরা, কাব্যগ্রন্হের প্রকাশকরা, ‘নাম’ ও বিশেষ ‘কবিতার নাম’ অবিরাম মনে করিয়ে দিতে থাকেন । সুতরাং জনপ্রিয়তা ব্যাপারটায় রহস্য নেই । সংসারত্যাগী বাউলদেরও আজকাল নেটওয়র্কিঙের মাধ্যমে জনপ্রিয় হতে হয়, ডলার রোজগারের জন্য বিদেশে গিয়ে মঞ্চে নাচতে হয়।