মলয় রায়চৌধুরীর “মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো” কবিতা ও তাঁর মৃত্যুবোধ অভিজিৎ পাল মলয় রায়চৌধুরী এবং তার আরম্ভ করা হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের গুরুত্ব নিয়ে বিতর্কের সমাপ্তি ঘটলেও, তাঁর চিন্তাধারা ও সাহিত্যিক সৃজনশীলতাকে কোনও একটি প্রকোষ্ঠে ফেলা বেশ কঠিন । তাঁর চিন্তা ও সাহিত্যকর্মের বিকাশ সম্পর্কে যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে বাঙালির উনিশ ও বিশ শতক ও ইউরোপের বিশ শতকের কবি ও ভাবুকদের যাত্রাপথে তাঁর পরিভ্রমণ অস্বীকার করা যায় না । প্রায় প্রতিটি ভাবনা ও সাহিত্য আন্দোলন তাঁকে আগ্রহান্বিত করেছে, তিনি বহু প্রবন্ধ লিখেছেন সেই সমস্ত বিষয়ে, কবিতা, উপন্যাস ও গল্পে সেগুলো প্রয়োগ করেছেন, যা সচরাচর বাঙালি সাহিত্যিকরা করেন না । তাঁর চিন্তাধারাকে যে নির্দিষ্টভাবে তাঁরই লিখিত ও পঠিত বর্গে সীমিত করা অসম্ভব তা তাঁর “মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো “ কবিতাটির মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট করে তুলেছেন । ইতোপূর্বে তিনি তাঁর বিখ্যাত কবিতা “প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” কবিতায় যে মলয় রায়চৌধুরীকে উপস্হাপন করেছিলেন সে অভিমন্যুর মতন ঘেরাওকে প্রতিরোধ করে, এবং যা নিরবধিকালীন, নামহীন এবং মূলত অপর, সেই ব্যাপারে অবিরাম সাড়া দেয়। মলয় নিজে স্বীকার করেছেন যে “মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো” কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন মরিস ব্লাশোঁর চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে ; কবিতাটি তিনি উৎসর্গ করেছেন সোনালী চক্রবর্তী নামের একজন অপরূপা সুন্দরী তরুণীকে, তার কারণ সৌন্দর্য নিরবধিকালীন অথচ সময়ের পরিসরে আবদ্ধ । মলয় বলেছেন উপরোক্ত কবিতাটির উৎস মরিস ব্লাশোঁর এই উক্তিটি “Every artist is linked to a mistake with which he has a particular intimacy. All art draws its origin from an exceptional fault, each work is the implementation of this original fault, from which comes a risky plenitude and new light.” যে ভুলের সাথে মলয়ের ঘনিষ্ঠতা আছে তা হল ভুল যুবতীর সঙ্গে মলয়ের প্রণয়সম্পর্ক । মলয়ের দাদা সমীর রায়চৌধুরী তাঁর বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে আমাকে বলেছিলেন যে মলয় একবার আত্মহত্যার প্রয়াস করেছিলেন এবং তাঁর পিসেমশায় তাঁকে তাঁর বাবার ফোটোর রাসায়নিক আলমারি থেকে পটাশিয়াম ফেরিসায়ানাইডের শিশি চুরি করে দেখে ধরে ফেলেছিলেন, এই কথা মলয় তাঁর আত্মজীবনীতে কেন লেখেননি তা জানি না । আশ্চর্য যে, বহুকাল পর তাঁর পিসেমশায় নিজেই আহিরিটোলার ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন এবং কলকাতা পুলিশ তাঁর পকেটে যে চিরকুট পায় তাতে লেখা ছিল “আনন্দধারা বহিছে ভূবনে । হাংরি আন্দোলনে মলয় রায়চৌধুরীর জেল-জরিমানা, বন্ধুদের সঙ্গে বিচ্ছেদ, সাহিত্য ও কলকাতা থেকে এক দশকের জন্য বিদায়, সমস্তকিছুর মূলে মলয়ের সেই ভুল । মলয়ের উপন্যাসগুলিতে এবং বহু প্রবন্ধে তাঁর সেই ভুলের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় । দার্শনিক তত্বাদি ও থিম তাঁর সমগ্র রচনায় ছেয়ে আছে, বলা যায় মরিস ব্লাশোঁর মতনই, কিন্তু আনুষ্ঠানিক বিতর্ক এড়িয়ে গেছেন এবং নিজস্ব কোনও নিয়মতান্ত্রিক দার্শনিক তত্ত্বের প্রস্তাব দেননি । তাঁর আরম্ভ করা হাংরি জেনারেশন আন্দোলনও, তিনি নিজেই লিখেছেন, পরাবাস্তববাদীদের মতো নির্দিষ্ট ছকে ফেলা যাবে না । তাঁর প্রবন্ধগুলিতে বহু দার্শনিকের উল্লেখ পাওয়া যাবে, কিন্তু তাঁদেরই চিন্তাপ্রণালীর বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি ব্যবচ্ছেদ ও প্রয়োগযোগ্যতা বিশ্লেষণ করেছেন এবং বহির্জগতে আনতে চেয়েছেন । এই যে টানাপোড়েন, প্রণালীগুলির প্রক্রিয়াকরণ, তা দার্শনিক, রাজনৈতিক বা টেকস্টিয়, যাই হোক না কেন, এবং তাদের নৈরাজ্যিক, প্রতিনিধিত্ব-করতে-অক্ষম, বহির্জগত, মলয় রায়চৌধুরীর রচনাবলীর একটি বৈশিষ্ট্য, যার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা যায় উপন্যাস, নাটক, কবিতা ও প্রবন্ধভাবনায় । আরেকটি থিমের পুনরাবৃত্তি চোখে পড়বে ; তা হল মৃত্যু, সময়, ও বহুবিধ আদি-অন্ত বিষয়ক কূটাভাস ; এর পরিধিতে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও বিশ্লেষণের দাবি রাখে । তিনি অবিরাম দর্শন ও সাহিত্যকে অপরত্বের আয়নায়, সীমার ও অন্তর্জগতের বাইরে থেকে আহরণ করতে চেয়েছেন । মলয় রায়চৌধুরীর জন্ম পাটনায়, ১৯৩৯ সালে, শৈশব কাটিয়েছেন সেই শহরের অন্ত্যজ বস্তি ইমলিতলায়, বিখ্যাত করে দিয়েছেন একদা কুখ্যাত ইমলিতলা পাড়াকে, যে পাড়ায় নষ্ট হয়ে যেতেন অনুমান করে তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে ম্যাট্রিক পাশের পর কলেজে পড়ার জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল । মলয়দের আদিবাড়ি হুগলি জেলার উত্তরপাড়া, যে শহরটি ১৭০৯ সালে পত্তন করেছিলেন তাঁর সাবর্ণ রায়চৌধুরী পূর্বপুরুষ রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী । তাঁদের একান্নবর্তী পরিবারে জ্যাঠারা ও কাকারা ছিলেন সংরক্ষণশীল । তাঁর বাবা ও মা ছিলেন উদার প্রকৃতির । বাবার বন্ধু জনৈক কনভেন্ট-যাজকের বদান্যতায় মলয় চার বছর খ্রিস্টধর্মীদের ক্যাথলিক স্কুলে পড়েছিলেন। তাঁর বাংলা শিক্ষা অবহেলিত হচ্ছে এই আশঙ্কায় তাঁকে ব্রাহ্মদের বাংলা-মিডিয়াম স্কুলে স্হানান্তরিত করা হয়েছিল। বাবা ও মায়ের উৎসাহ-প্রদান ও দাদা সমীর রায়চৌধুরী কর্তৃক কলকাতা থেকে আনা সাহিত্যগ্রন্হ মলয়কে চিন্তার জগতে প্রবেশ করতে সাহায্য করেছিল । মলয় তাঁর আত্মজীবনী ও জীবন-নির্ভর উপন্যাস ‘রাহুকেতু’-তে লিখেছেন যে ব্রাহ্ম স্কুল রামমোহন রায় সামিনারিতে গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তীর প্রতি ক্রাশের কারণে তিনি ব্রাহ্ম কবি ও লেখকদের কবিতা-প্রবন্ধ-উপন্যাস পাঠে আগ্রহান্বিত হন । নমিতা চক্রবর্তী তাঁকে নির্দিষ্ট বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করতেন যে-কারণে তিনি মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন । তাঁর আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে ইমলিতলায় থাকাকালীন তিনি আকৃষ্ট হন মুসলমান তরুণী কুলসুমের প্রতি । মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরী লিখিত ‘দি হাংরিয়ালিস্ট’ গ্রন্হে বর্ণিত হয়েছে মলয়ের সঙ্গে কুলসুমের যৌন সম্পর্ক এবং উর্দু কবি ফিরাক ও গালিবের রচনার সঙ্গে পরিচয় । তাঁর চরিত্র স্বাভাবিকভাবে বাড়ির হিন্দুধর্ম, স্কুলের খ্রিস্ট এবং ব্রাহ্মধর্ম ও প্রণয়িনীর ইসলামধর্মের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে । হয়তো হাংরি আন্দোলন ও পরবর্তীকালের পোস্টমডার্ন চিন্তাচেতনা এই সমন্বয়প্রসূত ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন