সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে চিনি বাংলাদেশ থেকেই৷ আশির দশকের শেষ দিকে পরিচয়৷ বাংলাদেশে দেখা হত, কলকাতায় বেড়াতে এলেও দেখা হত৷ বাড়িতে নেমন্তন্ন করতেন৷ কবিতা এবং কলাম লিখে তখন আমার বেশ নাম হয়েছে দেশে৷ তার পর বিরানব্বইয়ের ‘আনন্দ পুরস্কার’ পাওয়ার পর তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আবারও দেখা হল৷ অনেককে বলতেও শুনেছি, ‘সুনীলই তো তসলিমাকে আনন্দ পুরস্কার পাইয়ে দিয়েছে৷’ আমিও তাই ভেবেছিলাম৷ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেও এমন মন্তব্যের প্রতিবাদ করতে দেখিনি৷ বেশ কয়েক বছর পরে অবশ্য জেনেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ই ‘আনন্দ পুরস্কার’ কমিটির দশ জন সদস্যের মধ্যে একমাত্র সদস্য যিনি আমার পুরস্কার পাওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন৷ শুধু বিরানব্বইয়ে নয়, দু’হাজার সালেও বিরোধিতা করেছেন, যখন দ্বিতীয়বার ‘আনন্দ পুরস্কার’ পেয়েছি৷ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখে অবশ্য কখনও আমি বুঝতে পারিনি তিনি গোপনে গোপনে আমার বিরুদ্ধে কাজ করেন৷ বন্ধুর মতো, শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো, দাদার মতো, পিতার মতো তিনি পাশে ছিলেন বলেই বিশ্বাস করতাম৷ অবশ্য সব ভাবনার অবসান হল, যখন তিনি প্রকাশ্যে আমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ বইটি নিষিদ্ধ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবদার করলেন এবং বইটি শেষ অব্দি নিষিদ্ধ করিয়ে ছাড়লেন৷ একজন লেখকের জন্য এর চেয়ে ভয়ঙ্কর হৃদয়বিদারক আর কী হতে পারে, যখন সে প্রত্যক্ষ করে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ লেখক তাঁর বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গিয়ে, মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এই অজুহাতে তাঁর বই নিষিদ্ধ করার জন্য রাজা-মন্ত্রীর কাছে দৌড়ায়! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অবিশ্বাস্য বিরোধিতা সত্ত্বেও, কখনও দেখা হলে স্বভাবসুলভ সশ্রদ্ধ আন্তরিক ব্যবহারই করেছি৷ কখনও আমি ভুলে যাইনি তিনি আমার প্রিয় লেখক, কিশোর বয়স থেকে আমি তাঁর লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি, কখনও ভুলে যাইনি অন্য একশ বিষয়ে তাঁর মতের সঙ্গে মেলে আমার মত৷ নিজেকে বুঝিয়েছি৷ তিনি মুখে আমার লেখা ভীষণ পছন্দ করেন বললেও হয়তো সত্যিকার পছন্দ করতেন না, সেই কারণেই আমার পুরস্কার পাওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন৷ নিজেকে বুঝিয়েছি, মুক্ত চিন্তার পক্ষে বললেও তিনি হয়তো আমার লেখা পছন্দ করতেন না বলে আমার বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন, এই যাওয়ার অধিকার হয়তো তাঁর আছেই৷
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন