জাঁ লুক গোদার : জীবন ও সিনেমা
মলয় রায়চৌধুরী
আমি পেশাদার ফিল্ম ক্রিটিক নই । কিন্তু একজন আইকনোক্লাস্ট, ফোটোগ্রাফারের ছেলে আর নাতি এবং চিন্তার টেকনিশিয়ান হিসাবে অন্যান্য আইকনোক্লাস্টদের শ্রদ্ধা করি ; তাঁদের কাজ ও জীবন সম্পর্কে আগ্রহী। জাঁ লুক গোদার, যাঁর মৃত্যুতে উটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, "তোমরা যারা সিনেমার ছাত্র, তাঁকে ভালোবাসো— তিনি আমাদের শেষতমদের আইকোনোক্লাস্ট, আ্যনার্কির মহা-মহাশয়, তিনি নিজেই তাঁর বিদায়কালের সময়টা বাছলেন— মনে রেখো তোমরা— এই ইস্কুল চলবে— বন্ধ হবেনা। আর আমাদের এই শোক বিশ্বজুড়ে এ মূহুর্তে রাজতন্ত্রের গেঁজিয়ে ওঠা শোকের মুখে সপাট খাবলে দিক। সিনেমার জয় হোক। আদিউ জিনিয়াস!" আমি এই ইস্কুলের একজন ছাত্র । গোদার সম্পর্কে একসময়ে কিছু অনুবাদ করেছিলুম আর ওতেয়া তত্ব সম্পর্কে লিখেছিলুম । এখন ওনার জীবন আর সিনেমা সম্পর্কে আমার ভাবনা জড়ো করার চেষ্টা করছি ।
.
মৃত্যুর জন্য গোদার যে ১৩ তারিখ বেছে নিলেন, সেটাও আমার মনে হয়েছে গোঁড়া খ্রিস্টধর্মীদের প্রতি ওনার বিদায়বার্তা । লাস্ট সাপার (যিশুর শেষ খাবার গ্রহণের রাত্রি)-এ ১৩ জন মানুষ ছিলেন এবং কথিত আছে যে ১৩ তম আসন গ্রহণের জন্য যিশু অথবা জুডাস (যিশুকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী) নিজে আগ্রহী ছিলেন। কেউ কেউ মনে করেন লাস্ট সাপার গ্রহণ করা হয়েছিল নিসান মাসের ১৩ তারিখে। নিসান হলো ইহুদী ক্যালেন্ডারের একটি মাস। আর কেউ কেউ বলেন ক্রুসবিদ্ধকরণের তারিখ-ও ছিল ১৩ নিসান।ইনকুইজিশনের সময়ে ফাঁসি কাঠে ওঠার সিঁড়িতে ১৩টি ধাপ থাকত।প্রচলিত আছে যে কারোর নামে যদি ১৩ অক্ষর থাকে, তবে আপনি অভিশপ্ত হতে বাধ্য। ভাগ্য গণনার জন্য বহু বছরের পুরোনো যে অশুভ ট্যারট কার্ড রয়েছে তার মোট ৭৮টি কার্ডের ভিতরে ১৩ নম্বর কার্ডটির মানে হল মৃত্যু! । আগে বিমানে ১৩ নম্বরের কোনও সিট থাকত না। ইউরোপ বা বিশেষ করে আমেরিকায় বহুতল ভবনের লিফটে ১৩ নম্বরের কোনও বোতাম থাকে না, হোটেলে থাকে না ১৩ নম্বর রুম। অভিত্তিকর শোনালেও বেশ কয়েকটি কুখ্যাত খুনীদের নাম যেমন, চার্লস ম্যানসন (Charles Manson), জ্যাক দ্য রিপার (Jack the Ripper), জেফরি দামের (Jeffrey Dahmer), থেডর বানডি (Theodore Bundy) এবং আলবার্ট ডি স্যালভো (Albert De Salvo) ১৩ অক্ষর রয়েছে । Jean Luc Godard নামেও তেরোটি অক্ষর ।
.
ফরাসি-সুইস চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, এবং চলচ্চিত্র সমালোচক জাঁ-লুক গোদার ৩ ডিসেম্বর ১৯৩০ সালে প্যারিসের সপ্তম ওয়ার্ডে জন্মেছিলেন । তাঁর বাবা পল গোদার ছিলেন একজন সুইস ডাক্তার এবং মা ওলদি মনোদ। ছিলেন ব্যাঙ্ক পারিবাসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়েন মনোদের মেয়ে, ধর্মতত্ত্ববিদ আদলফ মনোদের প্রপৌত্রী। জাঁ লুক গোদারের মায়ের পক্ষের অন্যান্য আত্মীয়দের মধ্যে উল্লেখ্য সুরকার জ্যাক-লুই মনোদ, প্রকৃতিবিদ থিওডোর মনোদ, যাজক ফ্রেদেরিক মনোদ, এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং পরে পেরুর রাষ্ট্রপতি পেদ্রো পাবলো কুকজিনস্কি। জাঁ-লুকের জন্মের চার বছর পর, তাঁর বাবা সপরিবারে ফ্রান্স থেকে সুইজারল্যান্ড চলে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, গোদার ফ্রান্সে ছিলেন এবং অসুবিধার কারণে সুইজারল্যান্ডে ফিরে যান। তিনি যুদ্ধের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডে, যদিও তাঁর পরিবারের সদস্যরা জেনেভা হ্রদের ফরাসি দিকটায় তাঁর দাদুর বাড়িতে লুকিয়ে যাতায়াত করতেন । তাঁর ধনী বাবা-মা ফ্রাঙ্কো-সুইস বংশোদ্ভূত প্রোটেস্ট্যান্ট পরিবারের সদস্য ছিলেন ।
.
জাঁ লুক পড়াশুনা করেছিলেন সুইজারল্যান্ডের নিয়নে স্কুলে । ১৯৪৬ সালে, তিনি প্যারিসের বুফোঁ হাইস্কুলে ভর্তি হন আর বৈভবশালী পারিবারিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্যারিসের অভিজাত সাংস্কৃতিক সদস্যদের সাথে মেলামেশার সুযোগ পান। ১৯৪৮ সালে স্নাতক পরীক্ষায় ফেল করে জাঁ লুক সুইজারল্যান্ডে ফিরে যান। সেখানই লুসানে পড়াশোনা করতেন আর বাবা-মায়ের সাথে থাকতেন, যাদের বিয়ে ভেঙে যাবার কানায় পৌঁছে গিয়েছিল। তাঁর বড়ো বোন রাচেল তাকে আঁকতে উৎসাহিত করায় জাঁ লুক বিমূর্ত শৈলীতে আঁকা আরম্ভ করেন। থোননের একটা বোর্ডিং স্কুলে আবার পরীক্ষা দেবার পর, জাঁ লুক পাস করে ১৯৪৯ সালে প্যারিসে ফিরে যান। জাঁ লুক প্যারিস সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু কখনও ক্লাস করেননি ।
.
ঘন ঘন সিনেমা দেখার নেশা ছিল না জাঁ লুক গোদারের । তিনি প্রথম আন্দ্রে ম্যালরোর প্রবন্ধ আউটলাইন অফ আ সাইকোলজি অফ সিনেমা পড়ার পর এবং ১৯৪৬ সালে যখন লা রেভ্যু দ্যু সিনেমা পত্রিকা আবার প্রকাশিত হওয়া আরম্ভ হলো তখন সিনেমার সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে । প্যারিসে, ১৯৫০ সালের ঠিক আগে লাতিন কোয়ার্টারে, সিনে-ক্লাবগুলো (চলচ্চিত্র সমিতি) বুদ্ধিজীবীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । জাঁ লুক গোদার এইসব ক্লাবে যাতায়াত আরম্ভ করেন—সিনেম্যাথেক ফ্রানসেইজি, সিনে-ক্লাব দ্যু কোয়ার্টিয়ার ল্যাটিন (CCQL), ওয়ার্ক অ্যান্ড কালচার সিনে ক্লাব এবং অন্যান্য—সেগুলোতে গোদার নিয়মিত আড্ডা দিতে যেতেন । ১৯৩৬ সালে হেনরি ল্যাংলোই এবং গেয়র্গে ফ্রাঞ্জু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘সিনেমাথেক’। ‘ওয়ার্ক অ্যান্ড কালচার’ নামে শ্রমিকদের জন্য একটা শিক্ষা গোষ্ঠী আরম্ভ করেছিলেন অঁদ্রে ব্যাজাঁ যে মঞ্চে যুদ্ধকালীন চলচ্চিত্র প্রদর্শন আর আলোচনা করা হতো যা লিবারেশনের পরে পুরো ফ্রান্সে মডেল চলচ্চিত্র ক্লাব হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছিল । CCQL, যার প্রতিষ্ঠা ১৯৪৭ বা ১৯৪৮ সালে হয়, তা মরিস শেরারের নেতৃত্বে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল।
এই ক্লাবগুলোতে তিনি জ্যাক রিভেত, ক্লুদ শ্যবরল এবং ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো সহ চলচ্চিত্র উৎহীদের সাথে আলাপ আলোচনার সুযোগ পান । বন্ধু সংসর্গে গোদার হয়ে উঠলেন এমন একটা প্রজন্মের যুবক যাদের কাছে সিনেমা ব্যাপারটা বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে দেখা দিয়েছিল। গোদার বলেছিলেন: "১৯৫০-এর দশকে সিনেমা ছিল রুটির মতো গুরুত্বপূর্ণ –-কিন্তু এখন আর তা নেই। আমরা ভেবেছিলাম সিনেমা জ্ঞান প্রসারণের একটি যন্ত্র, একটি মাইক্রোস্কোপ... একটি টেলিস্কোপ হিসাবে নিজেকে জাহির করবে। সিনেমাথেকে এমন এক জগত আবিষ্কার করেছিলাম যে বিষয়ে কেউ আমাকে আগে কিছু বলেনি। তারা আমাদের গ্যেটে সম্পর্কে বলেছিল, কিন্তু ড্রেয়ার সম্পর্কে নয়। আমরা টকির যুগেও নীরব চলচ্চিত্র দেখতাম। আমরা চলচ্চিত্রের স্বপ্ন দেখতাম। আমরা মাটির তলাকার ঘরের খ্রিস্টানদের মতো ছিলাম।"
.
চলচ্চিত্রে গোদারের পথচলা শুরু হয় ফিল্ম সমালোচনার এলাকা থেকে । মরিস শেরার (যিনি এরিক রোহমার নামে খ্যাত) এবং জ্যাক রিভেতের সাথে, তিনি স্বল্পস্থায়ী চলচ্চিত্র জার্নাল ‘লা গেজেট দ্যু সিনেমা’ প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি ১৯৫০ সালে পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশ করে । যখন অঁদ্রে ব্যাজাঁ ১৯৫০ সালে প্রভাবশালী সমালোচনামূলক ম্যাগাজিন Cahiers du Cinema,[ সেনেমার নোটবুক ] শুরু করেন, তখন গোদার CCQL/Cinémathèque [ লাতিন কোয়ার্টারের সিনে ক্লাব/ফরাসি সিনেমাথেক] গোষ্ঠীর প্রকাশিত সমালোচকদের মধ্যে ছিলেন সবচেয়ে কমবয়সী। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় রুডলফ ম্যাটে পরিচালিত একটি আমেরিকান মেলোড্রামা, ‘নো স্যাড সংস ফর মি’ ফিল্মের রিভিউ করেন গোদার।
১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত তাঁর "ডিফেন্স অ্যান্ড ইলাস্ট্রেশন অফ ক্লাসিক্যাল ডিকোপেজ", প্রবন্ধে তিনি অঁদ্রে ব্যাজাঁর একটি আগের নিবন্ধকে আক্রমণ করেন এবং শট-রিভার্স শট টেকনিকের ব্যবহারকে সমর্থন করেন, তা ছিল সিনেমা সমালোচনায় তাঁর প্রথম দিকের গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলির একটি। অটো প্রিমিংগার এবং "সর্বশ্রেষ্ঠ আমেরিকান শিল্পী-হাওয়ার্ড হকস" এর প্রশংসা করে, গোদার তাদের কঠোর মেলোড্রামাগুলিকে "ওয়েলেস, ডি সিকা এবং ওয়াইলারের আরও "আনুষ্ঠানিক এবং প্রকাশ্যভাবে শিল্পপূর্ণ চলচ্চিত্রের উপরে তুলে ধরেন যা ব্যাজাঁ অনুমোদন করেছিলেন"। সেই মুহুর্তে গোদারের পরিকল্পনায় চলচ্চিত্র নির্মাণ ছিল না। বরং, তিনি চলচ্চিত্র দেখতেন, এবং সেগুলি সম্পর্কে লিখতেন, আর অন্যদের চলচ্চিত্র তৈরি করতে সাহায্য করতেন, বিশেষত রোহমারকে, যাঁর সাথে তিনি Présentation ou Charlotte et son steak [ শার্লট এবং তার মাংসের ফালির উপস্হাপনা ] ফিলমে কাজ করেছিলেন।
.
ফরাসি প্রভাবশালী ম্যাগাজিন Cahiers du Cinema-এর চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে তাঁর প্রথম কর্মজীবনের সময়, গোদার মূলধারার ফরাসি সিনেমার "ঐতিহ্যের গুণমান"-এর সমালোচনা করেন, যা উদ্ভাবন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর জোর দিতো না। অমন সিনেমার প্রতিক্রিয়ায় , তিনি এবং সমমনা সমালোচকরা তাঁদের নিজস্ব চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন, আর ফরাসী সিনেমার পাশাপাশি হলিউডের ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জ করেন। গোদার তাঁর প্রথম ফিল্ম ‘ব্রেথলেস’-এর জন্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসা পাবার ফলে তিনি ও সমমনা বন্ধুরা ফরাসি La Nouvelle Vague [ নিউ ওয়েভ] আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন । গোদারের কাজে পাওয়া যায় চলচ্চিত্র ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা, এবং প্রায়ই তাঁর রাজনৈতিক মতামতের প্রকাশ ; তিনি অস্তিত্ববাদ এবং মার্কসবাদী দর্শনের একজন আগ্রহী পাঠক ছিলেন এবং ১৯৬৯ সালে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী উপস্হাপনের জন্য অন্যান্য প্রতিষ্ঠানবিরোধী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে Dziga Vertov Group [জিগা ভার্তোভ গ্রুপ ] গঠন করেন। নিউ ওয়েভের কিছুকাল পরে, তাঁর রাজনীতিতে উগ্রবাদ ফিকে হয়ে আসে আর পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলো মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণের বদলে মানবতাবাদী বিশ্বাস, মানব সংঘাত এবং শৈল্পিক উপস্থাপনাকে গুরুত্ব দিয়েছে ।
.
১৯৫২ সালের শরৎকালে প্যারিস ছাড়ার পর, গোদার সুইজারল্যান্ডে ফিরে যান এবং লুসানে তাঁর মায়ের সঙ্গে থাকা আরম্ভ করেন । তিনি তাঁর মায়ের প্রেমিক, জাঁ-পিয়ের লবশারের বন্ধু হয়ে ওঠেন । লবশার গ্র্যান্ডে ডিক্সেন্স বাঁধের শ্রমিক ছিলেন। লবশার-এর মাধ্যমে তিনি বাঁধের প্লাজ ফ্লুরি সাইটে কর্মী হিসাবে চাকরি করা আরম্ভ করেন। তিনি বাঁধ নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের কথাও ভেবেছিলেন । তাঁর প্রাথমিক চুক্তি শেষ হলে, চাকরির মেয়াদ বাড়াবার জন্য, গোদার টেলিফোন সুইচবোর্ড অপারেটর পদে যোগ দেন। ডিউটিতে থাকাকালীন, ১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে, লবশারের ফোনে তিনি জানতে পারেন যে তাঁর মা ওদিল মনোড স্কুটার দুর্ঘটনায় মারা গেছেন । সুইস বন্ধুরা গোদারকে একটা ৩৫ মিমি মুভি ক্যামেরা ধার দিয়েছিল । সেই ক্যামেরায় তিনি বাঁধটা নিয়ে একটা ফিল্ম তোলেন আর তার নাম দেন ‘অপারেশন কংক্রিট’ । বাঁধ পরিচালন সংস্থা ছবিটি কিনে নিয়ে প্রচারের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতো ।
.
গোদার যখন Cahiers-এর জন্য কাজ করছিলেন, সেসময়ে জেনেভায় Une femme coquette (১৯৫৫), [ একজন ফ্লার্ট মহিলা ] নামে একটা দশ মিনিটের ছোট ফিল্ম তৈরি করেন; আর ১৯৫৬ সালের জানুয়ারিতে প্যারিসে ফিরে যান। গ্যোটে-র ‘ইলেকটিভ অ্যাফিনিটিস’ নিয়ে ফিচার ফিল্মের পরিকল্পনা রূপায়িত করতে পারবেন না অনুমান করে তা বাতিল করেন । ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো সেসময়ে একজন ছিঁচকে অপরাধী মিশেল পোরতাইল-এর সত্যকার অপরাধ-জীবনের ঘটনা নিয়ে একটা ভাবনাকে ফিল্মে রূপান্তরণের জন্য গোদারের সাহায্য চান। মিশেল পোরতাইল একজন মোটরসাইকেল-আরোহী পুলিশকে গুলি করে আর তার বান্ধবী তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয় । ফিল্মটা তুলতে ত্রুফো ব্যর্থ হন। কোনও আগ্রহী প্রযোজক পাননি তিনি। ত্রুফোর সাথে আরেকটা পরিকল্পনা, প্যারিসে আসা একটি গ্রাম্য মেয়েকে নিয়ে কমেডি, তাও পরিত্যক্ত হয়েছিল। গোদার তখন দুই তরুণী, শার্লট এবং ভেরোনিকের জীবনকে কেন্দ্র করে একটা ছোটো ফিল্মে রোহমারের সঙ্গে কাজ করছিলেন; আর ১৯৫৭ সালের শরৎকালে, পিয়ের ব্রোনবেয়ার-এর সিরিজের প্রথম ফিল্ম ‘অল দ্য বয়েজ আর কলড প্যাট্রিক’ , রোহমারের স্ক্রিপ্ট নিয়ে, গোদার পরিচালনা করেন।
.
১৯৫৮ সালে ‘এ স্টোরি অফ ওয়াটার’ মূলত ত্রুফোর অব্যবহৃত ফুটেজ থেকে তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে, জাঁ-পল বেলমন্ডো এবং অ্যান কোলেটকে নিয়ে গোদার তাঁর শেষ ছোটো ফিল্ম Charlotte et son Jules [ শার্লট এবং তাঁর জুলস] তৈরি করেন, যেটা ছিল কবি ও ফিল্মনির্মাতা জাঁ ককতোর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন । ফিল্মটা গোদারের রেনে রোডের হোটেলঘরে শ্যুট করা হয়েছিল আর ফিল্মটায় সেই সময়ে গোদারের নিজের জীবনের ‘টাকা বাঁচানোর রোমান্টিকতা’ প্রতিফলিত হয়েছিল। তার সুইস বন্ধু রোল্যাঁ টলম্যাচফ জানিয়েছেন যে; "প্যারিসে গোদারের হোটেলের দেওয়ালে শুধু একটা হামফ্রি বোগার্ট পোস্টার ছিল আর অন্য কিছুই ছিল না।”
.
১৯৫৮ সালের ডিসেম্বরে, গোদার ত্যুরের ফেস্টিভ্যাল অফ শর্ট ফিল্ম থেকে প্রতিবেদন পাঠান আর জ্যাক ডেমি, জ্যাক রোজিয়ার এবং অ্যাগনেস ভার্দার কাজের প্রশংসা করেন এবং তাঁদের সাথে বন্ধুত্ব করেন–-তিনি আগে থেকেই অ্যালাইন রেসনাইসকে চিনতেন যার ফিল্মের তিনি প্রশংসা করেন । কিন্তু গোদার এই সময়ে চাইছিলেন নিজের একটা ফিচার ফিল্ম তৈরি করতে। ১৯৫৯ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভালে গিয়ে গোদার ত্রুফোকে অনুরোধ করেন সেই গাড়ি চোর মিশেল পোরতাইল সম্পর্কে ১৯৫৬ সালে যে গল্পটা তাঁরা করতে চেয়েছিলেন তা তাঁকে ব্যবহার করতে দিতে । গোদার প্রযোজক জর্জ দ্য বোগোদেয়ারকে প্রস্তাব দিলেন ফিল্মটার জন্য টাকা খরচ করতে । গোদার তাঁর সাথে আগে টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্সের প্যারিস অফিসের প্রচার বিভাগে কিছুদিন কাজ করার সময় থেকে জানতেন । বোগেদেয়ার পিয়েরে লোটির গল্পের উপর ভিত্তি করে দুটি প্রযোজনা করে বেশ ঋণী হয়ে গিয়েছিলেন । শেষে, ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটর রেনে পিগনিয়েরেসের কাছ থেকে অর্থায়নের প্রস্তাব পেলেন গোদার।
.
ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, অ্যাগনেস ভার্দা, এরিক রোহমার এবং জ্যাক ডেমির মতো চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সাথে তিনি ষাটের দশকের ফরাসি নিউ ওয়েভ ফিল্ম মুভমেন্টের পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি যুদ্ধোত্তর যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন। আখ্যান, ধারাবাহিকতা, শব্দ এবং ক্যামেরাওয়ার্ক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁর কাজ "মোশন পিকচার ফর্মে বিপ্লব ঘটিয়েছে"। তাঁর সর্বাধিক প্রশংসিত চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে রয়েছে ব্রেথলেস (১৯৬০ ), ভিভরে সা ভি (১৯৬২), কনটেম্পট (১৯৬৩), ব্যান্ড অফ আউটসাইডার্স (১৯৬৪), আলফাভিল (১৯৬৫ ), পিয়েরোট লে ফাউ (১৯৬৫), ম্যাসকুলিন ফেমিনিন (১৯৬৬), উইকেন্ড (১৯৬৭ ) ), ভাষাকে বিদায় (২০১৪)। পরিচালক হিসেবে গোদারের সবচেয়ে চর্চিত সময়কাল তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্ম ব্রেথলেস ( ১৯৬০) থেকে উইক এন্ড (১৯৬৭ ) পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সময়ে করা তাঁর কাজগুলো তুলনামূলকভাবে প্রচলিত চলচ্চিত্রের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে যা প্রায়শই চলচ্চিত্র ইতিহাসের বিভিন্ন দিক নির্দেশ সম্পর্কিত। যদিও এই সময়ের কাজগুলো গোদারের ফিল্মনির্মাণ জীবনের নিজস্বভাবে যুগান্তকারী হিসাবে বিবেচিত হয়, তবে পরবর্তী সময়ে গোদার আদর্শগতভাবে সিনেমার ইতিহাসের বেশিরভাগ অংশকে বুর্জোয়া হিসাবে নিন্দা করেছেন আর বলেছেন তারা যোগ্যতাহীন ।
.
গোদারের জলবিভাজক ফিল্ম ‘ব্রেথলেস’ (À bout de souffle, ১৯৬০ ), জাঁ-পল বেলমন্ডো এবং জিন সেবার্গ অভিনীত ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের শৈলীকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছে এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান নিয়েছে— বিশেষ করে আমেরিকান সাদাকালো ফিল্ম থেকে । ফিল্মটিতে বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে যেমন জাম্প কাটের উদ্ভাবনী ব্যবহার (যা সেই সময়ে অপেশাদার হিসেবে বিবেচিত হত), চরিত্রকে বাদ দিয়ে, এবং ধারাবাহিকতা সম্পাদনায় দৃষ্টিরেখার মিল ভাঙা। ব্রেথলেসের আরেকটি অনন্য দিক ছিল শুটিংয়ের দিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে চিত্রনাট্য লেখা - এমন একটি কৌশল যা অভিনেতাদের অস্থির করে তুলেছিল - যা চলচ্চিত্রের স্বতঃস্ফূর্ত, তথ্যচিত্রের মতো পরিবেশে ছিল নতুন অবদান ।
.
তাঁর কর্মজীবনের শুরু থেকে, গোদার তাঁর ফিল্মে নিউ ওয়েভ সহকর্মীদের তুলনায় বেশি চলচ্চিত্রের উল্লেখ অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ব্রেথলেস-এ, তার উদ্ধৃতিগুলির মধ্যে রয়েছে হামফ্রে বোগার্টকে দেখানো একটি সিনেমার পোস্টার- দ্য হার্ডার দ্য ফল থেকে, তাঁর শেষ চলচ্চিত্র–(যাঁর অভিব্যক্তি প্রধান অভিনেতা জাঁ-পল বেলমন্ডো শ্রদ্ধার সাথে অনুকরণ করার চেষ্টা করেন) - ইঙ্গমার বার্গম্যান, স্যামুয়েল ফুলার, ফ্রিৎস লাঙের চলচ্চিত্রের ভিজ্যুয়াল উদ্ধৃতি ; এবং মনোগ্রাম পিকচার্সের প্রতি একটি অনস্ক্রিন উৎসর্গ, একটি আমেরিকান বি-মুভি স্টুডিও। যাঁদের উদ্ধৃতি, এবং সাহিত্যের উল্লেখ আছে তাঁরা হলেন উইলিয়াম ফকনার, ডিলান থমাস, লুই আরাগঁ, রিল্কে, ফ্রাসোয়াঁ সাগাঁ এবং মরিস শ্যাক্স প্রমুখ। ছবিটিতে ইমেজ বা সাউন্ডট্র্যাকের উদ্ধৃতিও রয়েছে—মোৎসার্ট, পিকাসো, জে এস বাখ, পল ক্লি এবং অগাস্ট রেনোয়ার। "ব্রেথলেস ফিল্মটা পরিচালকের অভিজ্ঞতা নয়, তাঁর উপস্থিতিকে জাহির করেছে"।
.
১৯৬৮ সালের মে মাসের ঘটনার পর, যখন প্যারিস শহর চার্লস দ্য গলের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে একটি যুবছাত্র উত্থান প্রত্যক্ষ করেছিল তখন গোদার তাঁর পেশাগত উদ্দেশ্য পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হব। তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারে সমমনা ব্যক্তিদের সাথে সহযোগিতা করতে শুরু করেন। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সহযোগী ছিলেন জিন-পিয়ের গোরিন, (লুই আলথুসার, মিশেল ফুকো এবং জ্যাক লাকাঁর মাওবাদী ছাত্র )। গোরিনের সিনেমার প্রতি আবেগ গোদারের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।
.
১৯৬৮ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে, গোদার আর গোরিন দুজনে মিলে মাওবাদী বার্তা প্রচারের মোট পাঁচটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। সহযোগিতার সবচেয়ে বিশিষ্ট চলচ্চিত্রটি ছিল Tout Va Bien ( ১৯৭২ )। ফিল্মে জেন ফন্ডা অভিনয় করেছিলেন, যিনি সেই সময়ে ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা রজার ভাদিমের স্ত্রী ছিলেন। ফন্ডা তাঁর অভিনয় জীবনের তুঙ্গে ছিলেন সেসময়ে , সদ্য Klute (১৯৭১ ) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য একাডেমি পুরস্কার জিতেছেন এবং একজন বামপন্থী যুদ্ধবিরোধী কর্মী হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছেন। নায়ক ছিলেন কিংবদন্তি ফরাসি গায়ক এবং অভিনেতা ইভেস মন্ট্যান্ড, যিনি জর্জেস ক্লুজট, অ্যালেন রেসনাইস, সাচা গুইট্রি, ভিনসেন্টে মিনেলি, জর্জ কুকর এবং কোস্টা-গাভরাসের চলচ্চিত্রগুলিতে অভিনয় করেছিলেন।
.
১৯৬৮ সালের মে থেকে ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত গোদারের জীবনের বিস্তৃত সময়কালকে বিভিন্ন লেবেল দেওয়া হয়েছে - তাঁর "জঙ্গি" সময় থেকে তাঁর "রেডিকাল’ বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের সাথে "মাওবাদী" হিসাবে চিহ্ণিত হয়েছেন এবং "রাজনৈতিক" ফিল্মনির্মাণকারী হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছেন। এই কালখণ্ডে গোদার তাঁর চলচ্চিত্রে এবং সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতায় বৈপ্লবিক সমাজবদলের ওপর জোর দিয়েছেন। ১৯৬৮ সালে ছাত্রদের মে অভ্যুত্থানে অনুপ্রাণিত হয়ে, গোদার, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো’র সাথে, ছাত্র ও শ্রমিকদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ১৯৬৮ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবকে বন্ধ করে দিতে প্রতিবাদের নেতৃত্ব দেন। শ্রমিকদের গোদার বলেছিলেন যে উৎসবে একটিও চলচ্চিত্র দেখানো হচ্ছে না যা তাদের সমস্যাগুলোকে তুলে ধরে। "একটি ফিল্মও নয়, তা সে ফরম্যান মিলোস , আমি নিজে, রোমান পোলানস্কি বা ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, যারই হোক না কেন। একটাও ফিল্ম নেই। আমরা সময়ের থেকে অনেক পেছনে রয়েছি।”
.
১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে গোদার "রাজনৈতিকভাবে রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ" সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। যদিও ১৯৬৮ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত তাঁর অনেকগুলি ফিচার-দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র ছিল কম বাজেটের এবং এই ফিল্মগুলোয় একটি চলচ্চিত্র কী হতে পারে তার ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে আরম্ভ করে। মূলধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ পরিত্যাগ করার পাশাপাশি, গোদার তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা ব্যক্তিত্বের কাল্ট থেকেও মুক্তি পেতে চাইছিলেন । তিনি অন্যান্য চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সাথে বেনামে কাজ করছিলেন, বিশেষত জাঁ-পিয়ের গোরিনের সঙ্গে , যাদের নিয়ে তিনি ডিজিগা-ভার্তোভ সিনেমা গোষ্ঠী গঠন করেছিলেন। এই কালখণ্ডে গোদার ইংল্যান্ড, ইতালি, চেকোস্লোভাকিয়া, প্যালেস্টাইন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ফ্রান্সেও চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
.
তিনি এবং গোরিন তাঁদের ফিল্ম নিয়ে বিভিন্ন কলেজে গিয়ে বিতর্কিত বিষয় সম্পর্কে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করতেন । ইয়েভেস মন্ট্যান্ড আর জেন ফন্ডা অভিনীত বেশি বাজেটের ফিল্ম Tout Va Bien [ সবকিছু ভালোভাবেই চলছে ] তৈরি করার সময়ে তাঁর জীবনের বাঁকবদল ঘটলো । একটি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণে গোদার গুরুতরভাবে আহত হবার ফলে গোরিন প্রায় এককভাবে তাঁদের সবচেয়ে বিখ্যাত এই কাজটি পরিচালনা করেছিলেন। Tout va bien-এর পরবর্তী পর্ব হিসাবে, তাঁরা দুজনে Letter to Jane নামে একটি পঞ্চাশ মিনিটের ফিল্ম তৈরি করেন যাতে জেন ফন্ডার ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ভিয়েত কং যোদ্ধাদের সাথে মেলামেশার স্হির ছবিগুলোকে সাজিয়ে দেখানো হয়। চলচ্চিত্রটি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিনির্মাণ। এটাই ছিল গোদার আর গোরিনের একসঙ্গে তৈরি শেষ চলচ্চিত্র।
.
গোদার তাঁর "উগ্র রাজনৈতিক মতামত" এর জন্য পরিচিত ছিলেন এবং তাঁর চলচ্চিত্রে নিয়মিত রাজনৈতিক বিষয়বস্তু দেখাতেন। তাঁর প্রথম দিকের ফিল্মগুলোর মধ্যে একটি, দ্য লিটল সোলজার, যার বিষয়বস্তু ছিল আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ, বিবাদটার জটিলতা উপস্থাপনের প্রচেষ্টার জন্য উল্লেখ্য । আন্তর্জাতিক সমস্যার পাশাপাশি গোদার ফ্রান্সের সামাজিক সমস্যা নিয়ে বিচলিত ছিলেন। এর প্রথম এবং সর্বোত্তম উদাহরণ হল Vivre sa vie-তে কারিনার পতিতা চরিত্রে শক্তিশালী চিত্রায়ন। ষাটের দশকের প্যারিসে, রাজনৈতিক পরিবেশ কোনও একটা নির্দিষ্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েনি ; নানা ছোটোবড়ো আন্দোলন চলছিল । উত্তর আফ্রিকা আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপনিবেশগুলোর আন্তর্জাতিক সংঘাতের কারণে যুদ্ধ-পরবর্তী একটি স্বতন্ত্র আবহাওয়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল ফরাসি সমাজে। La Chinoise এবং Weekend ফিল্মের পর গোদারের মার্কসবাদী মনোভাব স্পষ্ট হতে থাকে, আর তা ধরা পড়ে তাঁর Pierrot [চড়ুই ] আর Une femme mariée [একজন বিবাহিতা মহিলা ] ফিল্মগুলোতে ।
.
জার্মান কবি ও নাট্যকার বার্টোল্ট ব্রেখটের সাথে গডার্ডের সম্পর্ক ছিল মূলত ব্রেখটের এপিক থিয়েটারের তত্ত্বকে ফিল্মে প্রয়োগ । ব্রেখটের প্রভাব গোডার্ডের বেশিরভাগ কাজের মাধ্যমে গভীরভাবে অনুভূত হয়, বিশেষ করে ১৯৮০ সালের আগে, যখন গডার্ড নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের জন্য সিনেমাটিক অভিব্যক্তি ব্যবহার করেছিলেন। যেমন, ব্রেথলেস ফিল্মে এলিপটিকাল সম্পাদনা, যা দর্শককে মূলধারার সিনেমার সরল ন্যারেটিভ শৈলীকে বর্জন করে, দর্শকদের আরও সমালোচনামূলক ভূমিকা নিতে বাধ্য করে । গোদারের বেশিরভাগ রাজনৈতিক ফিল্মে , বিশেষ করে Weekend, Pierrot le fou এবং La Chinoise-তে চরিত্রগুলো সরাসরি দর্শকদের চিন্তাভাবনা, অনুভূতিকে বার্তা পাঠায় ।
.
গোদারের প্রথম দিকের সব কয়টা ফিল্মে দেখা না গেলেও বেশিরভাগ ফিল্মের মার্কসবাদী পাঠ সম্ভব। মার্কসবাদের সাথে গোদারের সরাসরি মিথস্ক্রিয়া Weekend ফিল্মের আগে স্পষ্ট হয় না, যে ফিল্মে কার্ল মার্কস নামটি যিশু খ্রিস্টের মতো অবতারের সঙ্গে একইসাথে উচ্চারিত। গোদারের সিনেমার পুরো কালখণ্ড জুড়ে একটা নিরবিচ্ছিন্ন অভিযোগ হল বুর্জোয়াদের ভোগবাদ, দৈনন্দিন জীবন ও কার্যকলাপের পণ্যীকরণ, এবং মানুষের এলিয়েনেশান—- মার্কসের পুঁজিবাদের সমালোচনার সমস্ত কেন্দ্রীয় বিতর্ক।
.
১৯৬৮ সালে দুই রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, জাঁ-লুক গোদার এবং জাঁ-পিয়ের গোরাঁ জিগা ভার্তোভ গ্রুপ নামে একটা গোষ্ঠী তৈরি করেন। জঁ অঁরি রোজে এবং আরমাঁ ম্যাকো ১৯৬৯ সালে এই গোষ্ঠীতে যোগদান করেন। তাদের চলচ্চিত্রগুলো প্রাথমিকভাবে ব্রেখটিয়ান আঙ্গিক, মার্কসবাদী মতাদর্শ এবং রচনা থেকে লেখকর স্বামীত্ব বাদ দেবার প্রচেষ্টা দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়েছিল। ১৯২০-৩০ এর দশকের সোভিয়েত চলচ্চিত্র নির্মাতা ডিজিগা ভার্তোভের নামে এই গ্রুপটা ১৯৭২ সালের Letter to Jane : An Investigation About a Still-এর পরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
.
এটা ছিল প্যারিসের ষাটের দশকের ছাত্র-বিপ্লবের পৃষ্ঠপটে একটি রাজনৈতিকভাবে র্যাডিক্যাল ফিল্ম গোষ্ঠী । মার্কসবাদী-লেনিনবাদী এবং মাওবাদী তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, যা প্যারিসের সেই সময়ের বুদ্ধিবৃত্তিক আবহাওয়াকে গভীরভাবে প্রবাভিত করেছিল আর ফিল্মনির্মাণকে বুর্জোয়া উদ্যোগ হিসাবে মর্যাদায় অসন্তুষ্ট হয়ে এই গোষ্ঠীটি কেবল রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ নয়, রাজনৈতিকভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে কাজ করেছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সূত্রপাতের পর বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশেষ করে ষাটের দশকে ফ্রান্সের বিদেশ নীতির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটা প্রতিষ্ঠানবিরোধী চলচ্চিত্র গোষ্ঠীর জন্ম ঘটিয়েছিল, যারা চলচ্চিত্রকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল। চলচ্চিত্র নির্মাতা জাঁ লুক গোদার এবং জাঁ পিয়ের গোরাঁর নেতৃত্বে ডিজিগা ভার্তোভ গ্রুপ ছিল সত্যিকার অর্থে সম্ভাবনাপূর্ণ রাজনৈতিক সিনেমার ব্র্যান্ড গড়ে তোলার এমনই একটি প্রচেষ্টা।
.
জিগা ভার্তোভ গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত সিনেমাটিক ব্যবস্হার প্রতিটি দিককে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছিল এবং তার দরুন, নির্দিষ্ট কয়েকটি সহমর্মী সম্প্রদায়ের বাইরে খুব কম প্রচারিত হয়েছে ও দর্শক আকৃষ্ট করতে পেরেছে। একটি বিপ্লবী সিনেমার উদ্দেশ্যে কাজ করার এবং প্রযোজনা, নির্দেশনা এবং প্রদর্শনীর জনপ্রিয় মডেলগুলিকে প্রত্যাখ্যান করার এই বিরোধিতামূলক অবস্থান গোষ্ঠীর পক্ষে এক ধরণের অচলাবস্থা তৈরি করে দিয়েছিল। যাইহোক, সত্যিকারের রাজনৈতিক আকাঙ্খা রয়েছে এমন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের আর সংশ্লিষ্ট লোকজনদের জন্য এই গোষ্ঠীর চলচ্চিত্রগুলি অপরিহার্য সমাবেশ-কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ।
.
Letter to Jane (১৯৭২ ) ছিল একটি ফিচার-ফিল্ম দৈর্ঘ্যের প্রযোজনা যা উত্তর ভিয়েতনামী প্রতিরোধ বাহিনীর মাঝে শুধুমাত্র জেন ফণ্ডার স্থির ছবি জুড়ে-জুড়ে ঐতিহাসিক, নান্দনিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি একক চিত্রকে কঠোরভাবে বিশ্লেষণ করে। অকল্পনীয়ভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নির্মমভাবে সমালোচনামূলক, ছবিটি ইমেজ তৈরির রাজনীতিতে একটি শিক্ষণীয় ফিল্ম। সম্ভবত অন্য যে-কোনও চলচ্চিত্র আন্দোলনের চেয়ে বেশি, জিগা ভার্তোভ গ্রুপটি প্রচলিত সিনেমাটিক মডেলকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তার মানে কেবল জনপ্রিয় সিনেমা এবং আর্টহাউস প্রযোজনা উভয়েরই প্রত্যাখ্যান নয়, যাকে গ্রুপটা মনে করেছিল যে ওগুলো শুধু প্রভাবশালী পুঁজিবাদী মতাদর্শকে সমর্থন করে আর প্রযোজনা, বিতরণ এবং প্রদর্শনীর পুঁজিবাদী মডেলগুলোকে রক্ষা ধরে। প্রতিরূপের সমস্যাটি ছিল ডিজিগা ভার্তোভ গ্রুপের অন্যতম দুশ্চিন্তা, যার চলচ্চিত্রগুলো জনপ্রিয় ইমেজ তৈরির রাজনৈতিক অনুমানগুলোকে পরীক্ষা করতে চাইছিল। নন-ন্যারেটিভ এবং প্রাবন্ধিক বিন্যাস প্রয়োগ করে, গোষ্ঠীর ফিল্মগুলো শব্দ, ইমেজ এবং দর্শকদের একটি অসংলগ্ন কেরামতির মাধ্যমে ব্যবহার করতো যাতে মানে তৈরির প্রক্রিয়ায় তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য প্ররোচিত হয়। এই চলচ্চিত্রগুলি লেখকসত্বের ধারণাকেও প্রত্যাখ্যান করতো, যা স্পষ্ট হয়ে উঠতো তাদের যৌথ স্বাক্ষর থেকে ।
.
গোদার তাঁর পরিচালিত ফিল্মের দুই নায়িকাকে বিয়ে করেছিলেন: আনা কারিনা (১৯৬১-১৯৬৫) এবং অ্যান উইজেমস্কি (১৯৬৭-১৯৬৯)। ১৯৭০ সালের শুরুতে, তিনি অ্যান-মারি মিভিলের সাথে ফিল্ম নির্মাণের সূত্রে পেশাগতভাবে এক সঙ্গে কাজ করা আরম্ভ করেন। গোদার ১৯৭৮ সাল থেকে সুইজারল্যান্ডের রোলেতে মিভিলের সাথে বসবাস করতেন ।তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী করিনা গোদারকে "নির্জনবাসী" হিসাবে বর্ণনা করেছেন৷ গোদারের একজন উপদেষ্টা প্যাট্রিক জেনারেটের মতে, ২০১০ সালে গোদার মিভিলকে বিয়ে করেন৷
.
কারিনার সাথে তাঁর সম্পর্কের সময়ে গোদার সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত কয়েকটি চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন এবং তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে সংবাদপর্র ও পত্রিকায় ব্যাপকভাবে খবর বেরোতো: দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট তাঁদের দুজনকে “১৯৬০ এর দশকের সবচেয়ে বিখ্যাত জুটিগুলির মধ্যে একটি" হিসাবে বর্ণনা করেছিল৷ ফিল্মমেকার ম্যাগাজিন তাঁদের পারস্পরিক সহযোগিতাকে "তর্কাতীতভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী জুটি যাঁরা সিনেমার ইতিহাসে স্বাক্ষর রেখে গেছেন।" জীবনের শেষ দিকে,, করিনা বলেছিলেন যে তাঁরা আর একে অপরের সাথে কথাবার্তা বলেন না।
.
মিশেল অ্যাভেনিয়াশূ ২০১৭ সালে ওয়ান ইয়ার আফটার (ফরাসি: Un an après; ২০১৫) নামে ওয়াইজামস্কির লেখা রচিত স্মৃতিকথার উপর ভিত্তি করে গোদার সম্পর্কে Redoubtable ফিল্ম চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন। ফিল্মটা ষাটের দশকের শেষের দিকে তার জীবনকে কেন্দ্র করে তৈরি, যখন গোদার আর ওয়াইজেমস্কি একসঙ্গে ফিল্ম তৈরি করতেন। ফিল্মটা ২০১৭ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হয়। গোদার বলেছিলেন যে ছবিটা তৈরি করার ধারণা একদম বোকা, বোকা ।
.
করিনার সাথে তার সহযোগিতায় কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ফিল্ম তৈরি হয়েছিল, যেমন Vivre sa vie ( ১৯৬২ ) Bande a part ( ১৯৬৪ ), এবং Pierrot le Fou (১৯৬৫ ) যেগুলো সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল ফিল্মগুলো "তর্কাতীতভাবে সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী কাজ" । ফিল্মমেকার ম্যাগাজিন ২০০২ সালের একটি ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ জরিপে, জাঁ লুক গোদার সর্বকালের সেরা দশ জন পরিচালকের মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। ২০১০ সালে, গোদার একাডেমির অনারারি পুরস্কারে ভূষিত হন, কিন্তু তিনি পুরস্কার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাননি ।
.
গোদার Sauve qui peut ( la vie) ( ১৯৮০) ফিল্মের সময় থেকে কিছুটা ঐতিহ্যগত কথাসাহিত্যে ফিরে যান, যেগুলোতে আত্মজীবনীমূলক ঘটনার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় । তিনি মূলধারার চলচ্চিত্রগুলোর অনুসরণে একটি সিরিজের করেন: Passion, ( ১৯৮২ ) Lettre a Freddy Bauche ( ১৯৮২ ) ,Prenom Carmen ( ১৯৮৩ ) এবং Grandeur et decadence d’un petit commerce de cinema ( ১৯৮৬ ) । Je vous salue, Marie ( ১৯৮৫) ফিল্মটা নিয়ে আরেকটা বিতর্কের ঝড় উঠেছিল, যেটাকে রোমান ক্যাথলিক চার্চ ধর্মদ্রোহিতার নামে নিন্দা করেছিল আর এছাড়াও উইলিয়াম শেক্সপিয়রকে নিয়ে প্রবন্ধমূলক চলচ্চিত্র King Lear ( ১৯৮৭ ) নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয় ।
.
তাঁর পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলি অসাধারণ আনুষ্ঠানিক সৌন্দর্য এবং প্রায়শই শোকের অনুভূতিতে প্রচ্ছন্ন : Nouvelle Vague (নিউ ওয়েভ, ১৯৯০), আত্মজীবনীমূলক JLG/JLG, autoportrait de decembre (JLG/JLG: সেলফ-পোর্ট্রেট ইন ডিসেম্বর, ১৯৯৫ ), এবং For Ever Mozart (১৯৯৬)। Allemange annee 90 neuf zero (জার্মানি ইয়ার 90 নাইন জিরো, ১৯৯১ ) যা Alphaville ফিল্মের পরিশিষ্ট, তবে ফিল্মটিতে সুমধুর এলেজিয়াক সুরের মিশ্রন ছিল এবং বয়সের অনিবার্য ক্ষয়কে প্রদর্শন করা হয়েছে। ১৯৯০ সালে, গোদারকে ন্যাশনাল সোসাইটি অফ ফিল্ম ক্রিটিকস-এর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। ১৯৮৮ এবং ১৯৯৮-এর মধ্যে, তিনি বহু-অংশযুক্ত Histoire( s ) du cinema সিরিজ তৈরি করেছিলেন ; এটি একটি স্মারক প্রকল্প যা বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস এবং চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সমস্যাগুলি নিয়ে তৈরি ।
.
২০০১ সালে, Éloge de l'amour (In Praise of Love) মুক্তি পায়। সিনেমাটায় ফিল্ম আর ভিডিও দুটিরই ব্যবহার করেছিলেন গোদার - প্রথমার্ধটি ৩৫ এমএম কালো এবং সাদাতে তোলা হয়েছে, পরবর্তী অর্ধেক ডিজিটাল ভিডিওতে রঙিন শট নেয়া হয়েছে - তারপর তাকে সম্পাদনার জন্য চলচ্চিত্রে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। ফিল্মটায় বার্ধক্য, প্রেম, বিচ্ছেদ আর ফিরে পাওয়াকে বিষয়বস্তু হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে । ফিল্মটায় এডগার নামের এক তরুণ শিল্পীর প্রেমের চারটি পর্যায়কে পর্যালোচনা করা হয়েছে । Notre musique (২০০৪) ফিল্মে গোদার আরেকবার যুদ্ধের দিকে দর্শকদের চোখ আর মনকে ফেরত নিয়ে আসেন, বিশেষ করে সারাজেভোর যুদ্ধ, এমনকি নানা যুদ্ধের ক্ষতিকর দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান, যেমন আমেরিকান গৃহযুদ্ধ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে যুদ্ধ এবং ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাত সহ সমস্ত যুদ্ধের দিকে ক্যামেরার চোখ ঘুরিয়ে ছিলেন গোদার। ফিল্মটি ডিভাইন কমেডির তিনটি দান্তীয় রাজ্যকে অবলম্বন করে তৈরি: নরক, প্রায়শ্চিত্তের এলাকা এবং স্বর্গ। কূটাভাসের প্রতি গোদারের আকর্ষণ এই ফিল্মের দেখতে পাওয়া যায় । ফিল্মটি যুদ্ধের ছবিগুলোর একটা দীর্ঘ, বিস্ময়কর মন্তাজ দিয়ে শুরু হয় যা মাঝে মাঝে হাস্যরসের উদ্রেক করে । দেখানো হয়েছে সমুদ্র সৈকতে মার্কিন সৈন্যরা গাছগাছালিতে ভরা স্বর্গে অস্ত্র নিয়ে টহল দিচ্ছে ।
.
গোদারের Film Socialisme (২০১০) কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে Un Certain Regard বিভাগে ২০১০ সালেই প্রিমিয়ার হয়েছিল। ফিল্মটা ২০১০ সালের মে মাসে ফ্রান্সের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। ২০১৩ সালে, গোদার Les trois désastres (The Three Disasters) চলচ্চিত্র নির্মাতা পিটার গ্রিনওয়ে আর এডগার পেরার সাথে 3X3D এর অংশ হিসাবে তৈরি করেন। 3X3D ২০১৩ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হয়েছিল। গোদারের ২০১৪ সালের চলচ্চিত্র Goodbye to Language, থ্রি ডাইমেনশনে তোলা, এমন এক দম্পতিকে ঘিরে যারা একে অপরের সাথে বার্তা বিনিময় করতে পারেন না আর তাই তাদের পোষা কুকুর তাদের জন্য দোভাষী হিসাবে কাজ করে । ফিল্মটিতে নিকোলাস ডি স্টায়েলের চিত্রকর্ম এবং উইলিয়াম ফকনারের লেখার বিস্তৃত উল্লেখ আছে, সেইসাথে গণিতবিদ লরেন্ট শোয়ার্টজের প্রসঙ্গে এবং নাট্যকার বার্টোল্ট ব্রেখটের কথা —গোদারের ওপর যাঁর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। ফিল্মটা ২০১৪ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের প্রধান প্রতিযোগিতা বিভাগে পালমে ডি'অরের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল আর জুরির পুরস্কার পায় । চলচ্চিত্রটির জন্য ব্যবহৃত গোদারের হাতে লেখা স্ক্রিপ্ট আর ছবির কোলাজকে শিল্পকর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল ।
..
২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর তারিখে, মিলানের ফন্ডাজিওন প্রাদা-তে গোদারের তৈরি একটি আর্ট ইনস্টলেশন দেখানো হয়। লে স্টুডিও ডি'অর্ফি শিরোনাম, ইনস্টলেশনটি গোদারের একটি পুনঃনির্মিত কর্মক্ষেত্র হিসেবে উপস্হাপিত হয়েছিল আর সেখানে সম্পাদনা সরঞ্জাম, আসবাবপত্র এবং গোদারের পোস্ট-প্রোডাকশনে ব্যবহৃত অন্যান্য উপকরণ রেখে প্রদর্শনী করা হয়েছিল ।
.
গোদার ২০২০ সালে Les Inrockuptibles পত্রিকাকে বলেছিলেন যে তাঁর নতুন ফিল্মটা একজন “হলুদ ভেস্ট প্রতিবাদী” সম্পর্কে হবে এবং ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে আর্কাইভাল ফুটেজের সাথে " শুটিংও হবে। আমি জানি না যে অভিনেতাদের খুঁজে পাব কিনা... আমরা নিউজ চ্যানেলে যে লোকদের দেখি তাদের নিয়ে ফিল্ম করতে চাই আর তাদের এমন পরিস্থিতিতে ফেলতে চাই যেখানে তথ্যচিত্র এবং কথাসাহিত্য এক হয়ে যায়।" ২০১৮ সালের মে মাসে পোস্ট করা একটা অনলাইন পিটিশন প্রায় দশ লক্ষ লোক স্বাক্ষর ণ করার পরে, ফ্রান্সে ১৭ নভেম্বর গণ বিক্ষোভ শুরু হয় যাতে সরকারি হলুদ ভেস্ট পরা প্রতিবাদীর সংখ্যা বেশি ছিল। আন্দোলনটি প্রাথমিকভাবে অপরিশোধিত তেল আর জ্বালানীর দাম বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদি নিয়ে শুরু হয়েছিল। আন্দোলনকারীরা যুক্তি দিয়েছিল যে ফ্রান্সে করের একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ বোঝা শ্রমিক এবং মধ্যবিত্তদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ।
.
২০২১ সালের মার্চ মাসে কেরালার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে একটি ভার্চুয়াল সাক্ষাত্কারের সময় গোদার বলেছিলেন যে তিনি দুটি নতুন ছবি নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছেন। গোদার বলেছিলেন "আমি আমার চলচ্চিত্র জীবন শেষ করছি - হ্যাঁ, আমার চলচ্চিত্র নির্মাতা জীবন - দুটি স্ক্রিপ্টের ফিল্ম করে... তারপর, আমি বলব, 'বিদায়, সিনেমা'।
.
গোদার বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের অন্যতম নেতা হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৬৯ সালে, চলচ্চিত্র সমালোচক রজার এবার্ট সিনেমায় গোদারের গুরুত্ব সম্পর্কে লিখেছিলেন: “গোদার একেবারে প্রথম সারির একজন পরিচালক; ষাটের দশকে অন্য কোনো পরিচালক ফিচার-লেংথ ফিল্মের বিকাশে তাঁর চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেনি। কথাসাহিত্যে জয়েস বা থিয়েটারে বেকেটের মতো, তিনি একজন পথপ্রদর্শক যাঁর বর্তমান কাজ সাধারণ দর্শকদের কাছে ততো গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু অন্যান্য পরিচালকদের উপর তাঁর প্রভাব ধীরে ধীরে এমন একদল দর্শক তৈরি এবং শিক্ষিত করে তুলছে যা, সম্ভবত পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে, তাঁর চলচ্চিত্রগুলির দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য হবে এবং দেখতে পাবে যে এখান থেকেই তাদের সিনেমা শুরু হয়েছিল। চলচ্চিত্র নির্মাতা কুয়েন্টিন ট্যারান্টিনো একটি প্রযোজনা সংস্থার নাম দেন ‘এ ব্যান্ড অ্যাপার্ট’, যা ছিল গোদারের ১৯৬৪ সালের একতা চলচ্চিত্রের নাম। ইতালীয় পরিচালক বার্নার্ডো বার্তোলুচ্চি তাঁর চলচ্চিত্র দ্য ড্রিমার্স-এ গোদারের ‘ব্যান্ড অফ আউটসাইডার্স’ ফিল্মকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে ছিলেন।
.
গোদারের কাজ এবং উদ্ভাবনগুলো মাইকেলেঞ্জেলো আন্তোনিওনি, সত্যজিৎ রায় এবং অরসন ওয়েলেসের মতো উল্লেখযোগ্য পরিচালকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে । পরিচালক হিসেবে গোদারের অসাধারণ ফিল্মনির্মাণের কারণে ফ্রিটজ ল্যাং গোদারের চলচ্চিত্র Le Mepris-এ অংশ নিতে রাজি হন। আকিরা কুরোসাওয়া 'ব্রেথলেস'কে তার একশোটি প্রিয় চলচ্চিত্রের অন্যতম হিসেবে চিহ্ণিত করেছেন৷ রাজনৈতিক কর্মী, সমালোচক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা তারিক আলী ২০১২ সালের সাইট অ্যান্ড সাউন্ড সমালোচকদের জরিপে গোডার্ডের চলচ্চিত্র Tout Va Bien-কে তার সর্বকালের দশটি প্রিয় চলচ্চিত্রের একটি হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছেন৷ মার্কিন ফিল্ম সমালোচক আরমন্ড হোয়াইট একই জরিপে গোদারের ফিল্ম Nouvelle Vagueকে তাঁর সেরা দশটি প্রিয় চলচ্চিত্রের একটি হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছেন।
.
ভারতে, Adieu Godard ফিল্মের প্রযোজক স্বস্তিক চৌধুরী বলেছেন যে অনুরাগ কাশ্যপের ‘গুলাল’, ‘দেব.ডি’ এবং ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’-এর মতো চলচ্চিত্রগুলি গোদারের নিয়ম ভাঙা সিনেমার সাক্ষ্য দেয়। পরিচালক কমল স্বরূপের ‘ওম-দার-বি-দার’, ভারতের ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন দ্বারা প্রযোজিত ১৯৮৮ সালের একটি পোস্টমডার্নিস্ট ফিল্ম, বলা হয় যে সেটি গডার্ড এবং তার মুক্ত-প্রাণ, অস্থির এবং নাটকীয়ভাবে তীব্র গল্প দ্বারা প্রভাবিত এবং অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
.
ষাটের দশক থেকে, নব্বইয়ের দশক হয়ে, এবং সহস্রাব্দের মধ্যে, ভারতে গোদারের সমসাময়িক - মণি কৌল, কুমার শাহানি, সত্যজিৎ রায়, অদুর গোপালকৃষ্ণান, মৃণাল সেন এবং ঋত্বিক ঘটক - ফরাসি ফিল্মের নতুনত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন আর ভারতে নিজস্ব তরঙ্গের সূচনা করেছিলেন যাকে অনেকে বলেন কমার্শিয়াল সিনেমার বিপরীতে সমান্তরাল সিনেমা।
.
তাঁর মার্কসবাদী ঝোঁকের কারণে, গত কয়েক দশকের মালয়ালম এবং বাংলা সিনেমায় গোদারের প্রচুর শিষ্য গড়ে উঠেছে। ডন পালাথারা'র ‘এভরিথিং ইজ সিনেমা’ (২০২১) শুধু যে গোদারের জীবনী থেকে এর শিরোনাম নিয়েছে তাই নয়. এমনকি তাঁর জাম্প কাট, সাউন্ড ডিজাইনিং এবং দর্শকদের গল্প বলার অভিজ্ঞতার সাথে নিমগ্ন ও বাধা দেওয়ার উপায়গুলিও নিয়েছে। কেরালায় গল্পের দিক থেকে গোদারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ২০১৭ সালের চলচ্চিত্র, ‘মায়ানাধি’, আশিক আবু দ্বারা পরিচালিত এবং সহ-প্রযোজিত। গোদার যে সামাজিক-রাষ্ট্রিক আধিপত্য এবং ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মুখ হয়ে উঠেছেন তা কেরালার সিনেমায় স্পষ্ট নজরে পড়ে। তাঁর চলচ্চিত্রগুলি সাজানো-গোছানো নয়, তাঁর নান্দনিকতা জৈব, স্বতঃস্ফূর্ত এবং তাঁর শৈলীতে একটি অতি সত্যতা এবং স্পষ্টতার অনুভূতি রয়েছে। তাঁর পরে প্রতিটি সিনেমাই তাঁর কাছ থেকে নিয়েছে। গোদারের আগে এবং পরবর্তী সিনেমাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে ফর্ম, ভাষা এবং শৈলীতে বিশাল পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন