শনিবার, ৫ আগস্ট, ২০২৩

লিটল ম্যাগাজিন

 আমাদের লিটল ম্যাগাজিন : মলয় রায়চৌধুরী

আমার মনে হয় পশ্চিমবাংলায় লিটল ম্যাগাজিন বলতে যা বোঝায় তা অন্যান্য দেশে, পাশের বাংলাদেশেও, তা বোঝায় না । আমাদের এখানে কয়েক হাজার লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় এবং তা অনুস্তর আস্ফালন হিসাবে । সে আস্ফালন একটি বিরোধী প্রক্রিয়া । রাজ্যের, রাষ্ট্রের, প্রথাগত রাজনৈতিক মূল্যবোধের, সাহিত্যিক মানদণ্ডের, যথেচ্ছ লেখা সম্পর্কিত ভাবনা-বিস্তারের । পশ্চিমবাংলায় লিটল ম্যাগাজিন বিস্ফোরণ ঘটেছে জরুরি অবস্হার পরে-পরেই । জরুরি অবস্হায় লেখক-কবিদের মুখ বেঁধে দেয়া হয়েছিল, কলম কেড়ে নেয়া হয়েছিল । সেই দুর্ভোগের বিরুদ্ধে ফেটে পড়েন তরুণরা এবং ধারাটি এখনও প্রবহমান । বহু লিটল ম্যাগাজিন মাত্র কয়েকশো কপি ছাপা হয় আবার কিছু ম্যাগাজিন পাঁচশো  কপি ছাপা হয় । পত্রিকা যদি এক হাজার ছাপার পর্যায়ে চলে যায় তাহলে তাকে আর লিটল ম্যাগাজিন বলা যায় না কেননা তখন পত্রিকাটিকে বাজারে বিক্রির কথা ভাবতে হয় । বাজারে ঝাঁপি নিয়ে বসলে চলমান ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তাধারা ও মতামত ব্যক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে কেননা বাজারটা ক্রেতা-পাঠকের । তখন লিটল ম্যাগাজিন অনিয়মিত এবং অবাণিজ্যিক থাকে না । লিটল ম্যাগাজিন তো  একটা ছোট সমমনা তরুণ গোষ্ঠীর, যার চিন্তা-ভাবনা-দর্শন চলমান ধারা থেকে ভিন্ন । লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠী ভেঙে যায় এই কারণে যে একটা পর্যায়ে মতের অমিল আরম্ভ হয় । অর্থাৎ লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীতে মতের অমিল হওয়া জরুরি ।  

উনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় যে  গোষ্ঠীবদ্ধ পত্রিকা বেরোতো তাকে লিটল ম্যাগাজিন বলা যায় না । অবশ্য ইংরেজি সমালোচনা সাহিত্যের ইতিহাস মতে ইউরোপ-আমেরিকায় অবাণিজ্যিক ম্যাগাজিনের অভিযাত্রা শুরু হয় Ralph Waldo Emerson ও Margaret Fuller সম্পাদিত The Dial (Boston, 1840-1844)-এর মাধ্যমে। ইমার্সনের নতুন দর্শন Transcendentalism-এর যাঁরা সমর্থক তাঁরাই শুধু Dial ম্যাগাজিনে লিখতেন।  আরেকটি প্রভাবশালী পত্রিকা ছিল ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত Savoy। ভিক্টোরীয়ান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে  উদারপন্থী ও সাম্যবাদী লেখকদের প্রধান বাহন ছিল এটি। সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশ শতকের গোড়ার দিকে সবচেয়ে প্রচারিত লিটল ম্যাগাজিন ছিল Poetry: A Magazine of Verse (Chicago 1912)। এর সম্পাদক ছিলেন হেরিয়েট মনরো ও এজরা পাউন্ড। ওনারা এগুলোকে লিটল ম্যাগাজিন হিসাবে দাবী করলেও, আমি মান্যতা দেবো না । কারণ পশ্চিমবাংলার লিটল ম্যাগাজিন স্তরে কোনো সোফেসটিকেশন নেই । মনে করিয়ে দিই যে ‘মহাপৃথিবী’ পত্রিকার সম্পাদক প্রেসে গিয়ে নিজের হাতে টাইপ সেটিং করতেন । আমরা হাংরি আন্দোলনে পত্রিকার বদলে লিফলেটে ছাপাতুম যাতে ক্রেতা-পাঠককে দোকানে যেতে না হয় ; আমরা দেদার বিলি করতুম যাএর ফলে দ্রুত পৌঁছে গিয়েছিল আমাদের বার্তা, পশ্চিমবাংলায়, তারপর সারাদেশে, তারপর বিভিন্ন দেশে ।

পাশ্চাত্যের আদলে কলকাতায় প্রথম সোফিসটিকেটেড  ম্যাগাজিন প্রবর্তন করেন প্রমথ চৌধুরী। তাঁর সম্পাদিত সবুজপত্র (১৯১৪)-কে বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের প্রথম ধাপ বলে গণ্য করা হয় এবং তা ছিল বিশেষ উদ্দেশ্যে, চলিত বাংলাকে সাহিত্যে স্বীকৃতি দেবার জন্য । তার আগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়  বঙ্গদর্শন (১৮৭২) সম্পাদনা করতেন যার উদ্দেশ্য ছিল  বাংলা ভাষার প্রসার ও প্রতিষ্ঠা । এই পত্রিকায় অনেকের লেখা প্রকাশিত হয়েছে যাতে লেখকের নাম থাকতো না । লেখকের নামকে জরুরি করে তোলেন ব্রাহ্মরা, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।

লিটল ম্যাগাজিন এক বিশেষ বার্তা  নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে এবং লেখক ও পাঠকদের মধ্যে সেটা পৌঁছে দেবার প্রয়াস করে । কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনও পাঠককে কিনতে হয় । যারা টার্গেট পাঠক, তাঁরা হয়তো নাও কিনতে পারেন এবং সেকারণে তাঁদের কাছে পৌঁছে দেবার আয়োজন করতে হয় । পশ্চিমবাংলায় লিটল ম্যাগাজিনের প্রয়োজনের আরেকটি কারণ হলো আনন্দবাজারের দখলদারি। আনন্দবাজার বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা দিয়েছে । বিশেষ সাহিত্যিক মানদণ্ড গড়ে দেবার চেষ্টা করেছে । ফলে যারা সাহিত্য, দর্শন ও শিল্প-চেতনায় ওই প্রাতিষ্ঠানিক ধারার বিরোধী, তাঁরা তাঁদের চিন্তাচেতনার প্রকাশ ঘটান নিজেদের  মুখপত্রের মাধ্যমে । কোনো কোনো সম্পাদক অবশ্য আনন্দবাজার আর সেই সময়কার রাজ্য সরকারের পতাকা বাহকদের নেকনজরে পড়ার জন্য পত্রিকা বের করেন—সেগুলোকে মোটেই লিটল ম্যাগাজিন বলা যায় না । আনন্দবাজারে লেখা ছাপাবার জন্য এক কালে বহু কবি-গদ্যকার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে তেল দিতেন । সুনীল দ্বিতীয় পর্যায়ে যখন ‘কৃত্তিবাস’ প্রকাশ করা আরম্ভ করলেন তখন তা লিটল ম্যাগাজিন ছিল না । পত্রিকাটি লিটল ম্যাগাজিন ছিল যখন দীপক মজুমদার আর আনন্দ বাগচী সহসম্পাদক ছিলেন । সুনীল আনন্দবাজারে যোগ দেবার পর ‘কৃত্তিবাস’ হয়ে গিয়েছিল তেলুড়েদের কলুর বলদগিরি । লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকরা ভালোই জানেন যে পাঠক-সাধারণের কাছে তাঁরা পরিচিত নন আর বাণিজ্যিক কারণে আনন্দবাজার পত্রিকার পরিচালকেরা তাঁদের পরিহার করে চলেন। ওপারে, মানে বাংলাদেশে আমার মনে হয় আনন্দবাজার গোষ্ঠীর মতন ক্ষতিকর সংস্হা নেই ।

অবশ্য বাংলাসাহিত্যের আধুনিক যুগের প্রথম দিকে এমন পত্রিকা  প্রকাশিত হয়েছে যেগুলো বাণিজ্য ব্যাপারটা অবহেলা করতে চায়নি।  যেমন, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর (১৮৩১), অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পাদিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা (১৮৪৩), প্যারীচাঁদ মিত্র ও রাধানাথ শিকদার সম্পাদিত মাসিক (১৮৫৪), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বঙ্গদর্শন (১৮৭২), দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ভারতী (১৮৭৭), সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত সাধনা (১৮৯১), রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত প্রবাসী (১৯০১), জলধর সেন ও অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত ভারতবর্ষ (১৯১৩) ইত্যাদি। এসব পত্রিকা ছিল সনাতন সামাজিক চিন্তা ও  প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শের বাহক । নতুন শিক্ষিত বাঙালিরা এই পত্রিকাগুলোর গ্রাহক হিসেবে গর্ববোধ করতেন ।

বাণিজ্যের কথা না ভেবে টার্গেট পাঠকদের জন্য  আবির্ভাব ঘটে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্র (১৯১৪) পত্রিকা । পরে কল্লোল (১৯২৩), শনিবারের চিঠি (১৯২৪), কালিকলম (১৯২৭), প্রগতি (১৯২৭), পূর্বাশা (১৯৩২) পত্রিকা সাহিত্যধারায় রদবদল আনার প্রয়াস করে লিটল ম্যাগাজিনের খাল কেটে দেন। এই পত্রিকাগুলোর আসল  উদ্দেশ্য ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন সাহিত্যিক মানদণ্ড গড়ে তোলা । এনারা বেশির ভাগ ছিলেন ইউরোপের সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত । আসলে এই কারণেই কাজী নজরুল ইসলাম ও জসিম উদ্দীন এই গোষ্ঠীগুলোর সাহিত্যিক মানদণ্ড থেকে বাদ পড়ে যান।

যাঁদের তিরিশের সাহিত্যিক বলা হয়,  তাঁরা ইউরোপীয় আদর্শে বাস্তবজীবন, মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশে­ষণ এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রসঙ্গকে তাঁদের রচনার প্রধান উপাত্ত করেছিলেন। উপরোক্ত পত্রিকাগুলোর উন্মেষকালে রবীন্দ্রনাথের অনেক কালজয়ী রচনা প্রকাশিত হলেও তিরিশের দশকের প্রভাবই বেশি লক্ষ করা যায়, বিশেষত বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা (১৯৩৫) পত্রিকার মাধ্যমে। বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকাকে এখনকার লিটল ম্যাগাজিনের প্রেক্ষাপটে লিটল ম্যাগাজিন বলা যায় না কেননা তিনি একটা নিজস্ব সাহিত্যিক মূল্যবোধের পাঁচিল তুলে দিয়েছিলেন এবং বহু কবিকে তার ভেতরে ঢুকতে দিতেন না ; এমনকী জীবনানন্দ দাশকেও কিছুকাল পাত্তা দেননি ; ঠিক ওই সময়েই সাগরময় ঘোষ জীবনানন্দ দাশের কবিতা দেশ পত্রিকায় ছাপতে চাননি এবং অপমানিত জীবনানন্দ সেগুলো ফেরত চেয়ে নেন । বাংলা ভাষার পরীক্ষা-নিরীক্ষা লিটল ম্যাগাজিনেই হয় ।

জ্বলদর্চি পত্রিকার সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠী যেমন লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কিত তাঁর বইতে বলেছেন, লিটল মানে ক্ষুদ্র নয়, লিটল মানে হীনমন্যতা নয়,  লিটল মানে সাংস্কৃতিক ভিত্তি। লিটল মানে নিজের মাতৃভাষার সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ;  এক থেকে বহুত্বের মধ্যে নিজেকে যে খোঁজা সেখানেই রয়েছে লিটল ম্যাগাজিনের উদ্দেশ্য। লিটল শব্দের ক্ষুদ্রত্বের মধ্যেই উঠে আসে বৃহতের অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা। পশ্চিমবাংলায় লিটল ম্যাগাজিনের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন শ্রদ্ধেয় মানুষেরা, যেমন সন্দীপ দত্ত  ও জাহিরুল হাসান । সন্দীপ দত্তের লিটল ম্যাগাজিন গবেষণাগার ও লাইব্রেরিতে রয়েছে প্রায়  পঁচাত্তর হাজার পত্র পত্রিকা বইয়ের সংগ্রহ। সব লিটল ম্যাগাজিনকেন্দ্রিক। আমাদের দেশের ও বিদেশের গবেষকরা সন্দীপ দত্তের লাইব্রেরিতে যাওয়া জরুরি মনে করেন, যা থেকে বোঝা যায় যে বাণিজ্যিক পত্রিকায় নয়, এখন মূল্যবান লেখা প্রকাশিত হয় লিটল ম্যাগাজিনে । 

পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে, গোটা শীত জুড়েই বিভিন্ন জায়গায় আয়োজিত হয় লিটল ম্যাগাজিন মেলা। তারপর হয় কলকাতায় । লিটল ম্যাগাজিন মেলা শুধুমাত্র পত্রিকার উৎসব নয়, এক জেলা থেকে আরেক জেলায় গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আর নতুন কবি-লেখকদের সঙ্গে পরিচয়ও গুরুত্বপূর্ণ । বহু লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠী প্রকাশক হিসাবে খ্যাতি পেয়েছে এবং তাদের কাজের জন্য পুরস্কৃত হয়েছে । বুদ্ধদেব বসু বা সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এরকম মেলার টেবিলে বসে আছেন, তা ভাবা যায় না । যাদের গল্প-উপন্যাস এমনকী কয়েকবার কবিতা দেশ পত্রিকায় আর শারদীয়গুলোতে প্রকাশিত হয়, তাঁরাও বসেন না, অর্থাৎ লিটল ম্যাগাজিন যে একটা আলাদা এলাকা তা স্পষ্ট হয় মেলাগুলোতে । মেলাগুলো জরুরি কেননা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশকদের বই বিক্রির একটা সময় আর ঠেক পাওয়া যায় । 

আমি ছিলুম লিফলেটের লেখক । প্রোমোশান পেয়ে লিটল ম্যাগাজিনের লেখক হয়েছি ।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন