মারুফুল আলম নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
মারুফ :যদিও এখন আমরা এসব আর কেউ কাউকে জিজ্ঞাসা করি না–তবুও বলি,এখন এই তীব্র সময় বা অসময়ে সবমিলিয়ে কেমন আছেন?
মলয় : বেশ কোনঠাশা হয়ে আছি ।
মারুফ :পাটনাতেই তো লেখালেখি শুরু হয়েছিল?প্রথমে কি লিখেছিলেন– গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ নাকি অন্যকিছু?
মলয় : ইতিহাসের দর্শন নামে একটা ধারাবাহিক লেখা : বিংশ শতাব্দী পত্রিকায় ।
মারুফ :লেখালেখি শুরুর আগেও তো নানা রকম পড়ালেখা করেছেন–সেই 'পাঠ পর্যায়' সম্পর্কে কিছু জানাবেন কি?
মলয় : প্রথমে ক্যাথলিক স্কুলে পড়তুম । সেখানে ফাদার হিলম্যানের কাছে ওল্ড আর নিউ টেস্টামেন্টের ঘটনা জানলুম । তারপর, রামমোহন রায় সেমিনারি ব্রাহ্ম স্কুলে পড়তে গিয়ে গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তীর ওসকানিতে ব্রাহ্ম লেখক আর কবিদের পড়া আরম্ভ করলুম। দাদা সমীর রায়চৌধুরী কলকাতায় সিটি কলেজে পড়তেন আর আসার সময়ে তিরিশের দশকের কবিদের বই আনতেন । পাটনায় বাবা বই কিনে দিতেন । যাকে বলে বুকওয়র্ম, তাই ছিলুম।
মারুফ :আপনার প্রথম বই 'শয়তানের মুখ' না 'মার্কসবাদের উত্তরাধিকার' – কোনটি? 'শয়তানের মুখ' তো 'কৃত্তিবাস'ই করেছিল–সেই সময়ে বইটি সাড়াও ফেলেছিল বেশ।তারও পরে 'হাংরি আন্দোলন'–তাই তো?তো,ব্যাপারটি এমন নয় যে,চসার,স্পেংলার বা অন্য কেউ তা ঘটিয়ে দিল,নিশ্চয়ই প্রস্তুতিটা ছিল—তা এই যে 'হাংরি আন্দোলন' তার প্রস্তুতি এসবের অনুপ্রেরণার উৎস কি?
মলয় : প্রথম বই ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ । ছোটোলোক অন্ত্যজদের ইমলিতলা পাড়ায় শৈশব-কৈশোর কেটেছিল আর ওই পাড়াটাই ছিল প্রস্তুতির বনেদ । আমার ছোটোলোকের ছোটোবেলা, ছোটোলোকের যুববেলা, ছোটোলোকের শেষবেলা বইগুলো পড়লে ব্যাপারটা বুঝতে পারবে । সুনীল গাঙ্গুলি শয়তানের মুখ বইটার প্রকাশক ছিলেন, কিন্তু সাড়া ফেলতেই অস্বীকার করতে থাকেন । তারপর আমারিকায় কবিতা লেখা শিখতে গিয়ে সেখান থেকে আমাকে হুমকি দিয়ে চিঠি লিখতেন । ইমলিতলার অন্ত্যজদের জীবন আর পঞ্চাশ দশকে কলকাতায় উদ্বাস্তুদের দুর্দশা কাজ করেছিল সুতলিতে আগুন ধরাবার ।
মারুফ :সাহিত্যের বহুল আলোচিত 'হাংরি মুভমেন্ট' সম্পর্কে আজ এই এতোকাল পরে যদি অতি সংক্ষেপে আপনার মতামত জানতে চাই–তো কি বলবেন?
মলয় : কিংবদন্তির ব্যাখ্যা হয় না, আন্দোলনটা ছিল গ্রিসের ইউলিসিসের মতন সবকিছুর বিরুদ্ধে লড়াইও করে লক্ষে পৌঁছোনোর ব্যাপার ।
মারুফ :আপনার এক বাক্যে লিখিত দু'টি নভেলার একটি 'ভিড়পুরুষ ও নরমাংসখোরদের হালনাগাদ' এর শেষটা একটা অভিনব সমাপ্তি। ফিল্মিক যবনিকাপাত। বেশ্যাপাড়ার একটি ঘরে গিটার বাজিয়ে পতিতারা সমবেত কণ্ঠে একটি ইংরেজি গান গাইছে। এ নভেলায় ১৯৭১-এ পাকবাহিনীর নির্যাতন,স্বাধীন দেশে মৌলবাদের উত্থান এবং অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের নিহতের ঘটনার উল্লেখ আছে।বিরামচিহ্নহীন এ লেখার প্রেরণা এবং আইডিয়া আপনি কিভাবে পেলেন?
মলয় : লিখতে-লিখতে আপনা থেকেই ঘটে গিয়েছিল ।
মারুফ :'অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা' উপন্যাস লেখার ভাবনার কথা জানতে চাচ্ছি। এরকম দুঃসাহসিক আখ্যান তীর্থস্থানে নেশা ও যৌনতাময় ক্যাওস নিয়ে টেক্সট আমাদের পাঠ অভিজ্ঞতায় একটা অনন্য পাঠকৃতি।বাংলা উপন্যাসের টেক্সটে আপনার বাক্য নির্মাণ,ভাষাগত দিক ও উপন্যাসটি রচনার পুর্ব প্রস্তুতি নিয়ে কিছু বলুন।
মলয় : বেনারস আর কাঠমাণ্ডুতে হিপি কলোনিতে কয়েকমাস সময় কাটিয়েছিলুম । সঙ্গে ছিল আমার পেইনটার বন্ধুরা । সেই অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছি । আমার বেশিরভাগ উপন্যাস নিজের জীবনের ঘটনা থেকে সংগ্রহ করা । পেইটারদের মতন এই উপন্যাসে আমি ফ্রেম থেকে বেরিয়ে জীবনকে আঁকতে চেয়েছি, সব রকমের রঙসুদ্দু ।
মারুফ :'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস' থেকে 'জলাঞ্জলি' 'নখদন্ত' হয়ে 'একটি নিরুপন্যাস'–এগুলো শুধু বিচিত্র আখ্যান নয়।ভিন্ন ভিন্ন নির্মাণ পদ্ধতিও বটে।আখ্যানের সাথে সাথে পৃথক টেকনিকের এপ্লিকেশন বা আইডিয়াও কি মাথায় রেখে লিখতে থাকেন?আপনার নিজের প্রস্তুতিটা একটু বলুন।
মলয় : হ্যাঁ । একটা উপন্যাস লেখার মশলা যোগাড় হয়ে গেলে তার আঙ্গিক নিয়ে ভাবি। চেষ্টা করি যাতে কমার্শিয়াল লেকখদের মতন একই ভাষা আর আঙ্গিক না হয়ে যায় ।
মারুফ ।আপনি খুব সচেতন লেখক,সবার সাথে পংক্তিভোজে আপনাকে দেখা যায় না।সেজন্য লেখকদের প্রতি একটা সমীহবোধ পাঠকদেরও থাকে।কিন্তু একটা কমন টেন্ডেন্সি হলো ওই লেখকগণই যখন বাংলাদেশে কোথাও লেখেন তখন তাঁর এই রুচি,বাছ-বিচারটা অটুট থাকে না।লিটলম্যাগাজিন বা উৎকৃষ্ট সাহিত্য পত্রিকা নয়,একেবারে ঈদ সংখ্যায় বাংলাদেশের তৃতীয় শ্রেণির ট্রাশ লেখকদের পাশেই লেখেন।এটা কেন হয় বলে আপনি মনে করেন?
মলয় : ভারতে বসে টের পাওয়া যায় না কোনটা ঈদের আর কোনটা মৌলবাদী নয় । যারা মৌলবাদী নয় তারাও দাড়ি রাখে । এই যেমন তুমি ; আমি কেমন করে জানবো তুমি মৌলবাদী কি না । হুমায়ুন আহমেদকে বাংলাদেশে গুরুত্ব দেয়া হয়, আমি দিই না । তবু ওনার লেখা যে পত্রিকায় বেরোয় তাতে লিখেছি । বাংলাদেশের তরুণীরা আমাকে তাঁদের কবিতা পড়তে বলেন ; তাঁরা গোঁড়া মতবাদের বা কাব্য-প্রতিভার চিন্তা করি না ; সুন্দরী হলেই হলো ।
মারুফ :বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কথাসাহিত্য চর্চা সম্বন্ধে আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন।এ বিষয়ে আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা জানতে চাইছি।
মলয় : এখন আর তেমন পড়ি না ; বইপত্র পাই না । তবে ইনটারনেট থেকে টের পাই যে নানারকমের বাঁকবদল ঘটে চলেছে, ভাষায়, আঙ্গিকে, বিষয়বস্তুতে, ভাবনায় । আমি তো মুনিরা চৌধুরীর কবিতা প্রথমবার পড়ে স্টানড হয়ে গিয়েছিলুম ।
মারুফ :আপনার 'নামগন্ধ' শুরুই হচ্ছে পাঠক চেতনায় একটা ভায়োলেন্স তৈরি করে।উপন্যাসের আখ্যানের প্রথাগত টেকনিক আপনি ভেঙে দিয়েছেন। এটা তো শুধু টেকনিক না,এর পেছনে কোন সাংস্কৃতিক চেতনা ক্রিয়াশীল,যা থেকে আপনি এটা করেন?
মলয় : ওটা সত্যিকার ঘটনা, দেখেছি, তাই মানসিক আক্রমণটা কাজে লাগিয়েছি। চাকুরিসূত্রে আলুচাষিদের দুর্দশা দেখেছি, সেগুলো কাজে লাগিয়েছি । বলা যায় যে আমি যাদের দুর্দশা নিয়ে লিখি তাদের দুর্দশা হয়ে ওঠে টেকনিক । বইয়ের শেষটা আপনা থেকে মাথায় এসে গিয়েছিল। শেষটা মাথায় আসার পর রিভাইজ করার সময়ে অনেক ঘটনা আর নামধাম পালটে দিয়েছিলুম।
মারুফ :সুবিমল মিশ্রের সাহিত্য কীর্তি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি? দেবেশ রায়?
মলয় : সুবিমল মিশ্র অসাধারণ লেখক ; দেবেশ রায়কে কম পড়েছি । তিস্তাপারের বৃত্তান্ত পড়িনি।
মারুফ :সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আপনি নিজেও তৎপর।বর্তমান চলমান ধারায় শিল্পসাহিত্যের কিছুটা প্রতিফলনও সেখানে ঘটেছে।ওয়েবজিন,ইবুকও ইতোমধ্যে চলে এসেছে।অনেকেই শুধু ফেসবুক ব্যবহারকারী সাহিত্যিক।আবার অতিসামান্য দু'একজন যেমন 'প্রতিশিল্প' সম্পাদক অভাজন এই আমার ধারণা,ফেসবুক নানান চর্চা সহ সাহিত্য চর্চায়ও দ্রুত 'মেইনস্ট্রিম'ই হতে যাচ্ছে।তাছাড়া ফেসবুকও তো পুঁজি এবং অন্যান্য বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠানই,নয়? সার্বিকভাবে এইসব বিষয়-আশয় আপনি কীভাবে দেখেন?
মলয় : আমরা পাঠকের কাছে কেমন করে পৌছোবো ? আমার বই তো বাংলাদেশে এখন কয়েকটা গেছে ; প্রকাশক পাচ্ছি । ইনটারনেটের সাহায্যে পাঠক জানতে পারছেন আমাকে। তার আগে সবাই জানতো প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার-এর কবি হিসেবে ।
মারুফ :উপন্যাসের তুলনায় ছোটগল্প এতো কম লিখলেন?
মলয় : সত্যি কথা । লিখলে কোথায় দেবো সেটা একটা বড়ো ব্যাপার । অনেকে আমার লেখা ছাপতে চাইতো না । ফলে আগ্রহ হতো না । যে ছোটোগল্পগুলো লিখেছি তা সবই পরিচিত সম্পাদকদের পত্রিকায়।
মারুফ :সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কথাসাহিত্য নিয়ে আপনার অভিমত কি?
মলয় : ওনার সম্পর্কে বলতে হলে যে উচ্চতার দরকার, আমি সেই তুলনায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র ।
মারুফ :ছোটলোকের ছোটবেলা, ছোটলোকের যুববেলা,এই অধম ওই অধম– এসবই আত্মজীবনীমূলক।তারপরও কি আপনি আত্মজীবনী লিখবেন?
মলয় : লিখেছি তো ! ছোটোলোকের শেষবেলা । ইনটারনেটে পাবে ।
মারুফ :'কবিতীর্থ' আপনার ৩টা নাটক দিয়ে নাটকসমগ্র বের করেছিল।নাটক আর লিখবেন না? ১৯৬৩-তেই প্রথম নাটক – 'ইল্লত' লিখেছেন। বাংলাসাহিত্যে আপনার পছন্দের নাট্যকার কারা?
মলয় : না, নাটক আর লিখিনি । তবে চারটে কাব্যনাট্য লিখেছি ।
মারুফ :বাইরের দেশের কার কার লেখা আপনার কথাসাহিত্য চর্চায় প্রণোদনা দিয়েছে বলে আপনি মনে করেন।প্রভাবিত হওয়ার কথা বলছি। এমন মনে হয় আপনার?
মলয় : আমি বুকওয়র্ম হবার দরুন শেকসপিয়ার থেকে মুরাকামি সবই পড়েছি । তাই বলা কঠিন ।
মারুফ :আপনার একটা বই প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে আপনি নিজেই নিজের ইন্টারভিউ নিয়েছেন।এটা একটা বিরল ঘটনা। আপনি কোন মন্তব্য করতে চান? এটা কি নিজের সাহিত্যের সারবস্তু,নিজের শিল্পদর্শন,নিহিত ভাবনাসকল অন্য কেউ ঠিকমতো অবতারণা করতে পারবে না বুঝে নিজেই প্রশ্ন এবং নিজেই উত্তর করলেন?
মলয় : সম্পাদকের অনুরোধে ঘটেছিল । আমিও সুযোগটা নিলুম, নতুন ধরণের ব্যাপার বলে ।
মারুফ :একটু জানতে চাইছি,আপনার সবচে' উল্লেখযোগ্য 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস' আপনি কতোদিনে শেষ করেছিলেন?
মলয় : ওটাই আমার প্রথম উপন্যাস । বেশ সময় লেগেছিল । বছর খানেক তো হবেই ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন