মহর্ষি এবাদুল হক
মলয় রায়চৌধুরী
এবাদুল হক ছিলেন মহর্ষি, লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্যজগতের উদ্ভাবনাকেন্দ্রের মহর্ষি, উন্নতভাবনার, উন্নতমানসের উন্নতধী শিক্ষক । ‘ঋষ্’ ধাতুর অনেকগুলি অর্থের মধ্যে একটি অর্থ হচ্ছে ঊর্ধ্বগতি অর্থাৎ ওপরের দিকে ওঠা৷ কোনও বাড়ির একতলা থেকে ওপরে ওঠার জন্যে এই ‘ঋষ্’ ধাতু ব্যবহৃত হতো৷ ‘ঋষ্’ ধাতুূ‘ইন্’ করে ‘ঋষি’ শব্দ পাচ্ছি, যার ভাবার্থ হচ্ছে যিনি ওপরের দিকে ওঠেন আর যোগার্থ হচ্ছে উন্নতমানস, উন্নতধী,.উন্নত ভাবনার পুরুষ৷ ‘ঋষি’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ ‘ঋষ্যা’ হলেও অভিন্নলিঙ্গ (ন্তুপ্সপ্পপ্পপ্সু ন্ধন্দ্বুস্তুন্দ্বব্জ) ‘ঋষি’ শব্দটিও চলতে পারে৷ অর্থাৎ কোন পুরুষকে যেমন ‘ঋষি’ বলা যায় কোন নারীকেও তেমনি ‘ঋষি’ বলা যেতে পারে আবার ‘ঋষ্যা’ তো চলতেই পারে ।উন্নত চেতনার মানুষদের ঋগ্বেদীয় যুগ থেকে ‘ঋষি’ বলে আসা হয়েছে৷ প্রতিটি মন্ত্র যেমন একটি ছন্দে রচিত, অধিকাংশ মন্ত্র যেমন পরমপুরুষের একটি বিশেষ নামে সম্বোধিত, তেমনি প্রতিটি মন্ত্রেরই একজন করে দ্রষ্টা-ঋষি থাকতেন যিনি তাঁর সাধনায় বা ধ্যান-ধারণায় সত্যকে উপলব্ধি করে তা শিষ্যকে কানে কানে শুনিয়ে দিতেন (গোড়ার দিকে অক্ষর ছিল না৷ তাই লিখে শেখানো সম্ভব ছিল না৷ যেহেতু লিপি ছিল না তাই ‘লেখক-ঋষি’ বলা হত না ;বলা হত দ্রষ্টা-ঋষি, অর্থাৎ যে ঋষি ধ্যানে সত্যকে দেখেছেন)৷
ঋগ্বেদীয় যুগ থেকে ঋষিদের মুখ্যতঃ চারটি ভাগে বিভাজিত করে রাখা হয়েছিল–(১) মহর্ষি, (২) দেবর্ষি, (৩) রাজর্ষি ও (৪) ব্রহ্মর্ষি৷ যে সকল মানুষ তাঁদের জাগতিক কর্ত্তব্য যথাবিধি সম্পাদন করার সঙ্গে সঙ্গে ঊধর্বতর জগতের খোঁজে ধ্যান–ধারণা–সাধনা (আরণ্যক ও উপনিষদ) প্রভৃতি করতেন ও তৎসহ সেই অধ্যাত্ম মার্গে সিদ্ধিলাভ করে জগতের সেবা করতেন তাঁদের বলা হত মহর্ষি (যেমন, মহর্ষি বিশ্বামিত্র)৷ (২) যাঁরা দেবকুলে (নর্ডিক, এ্যলপাইন অথবা মেডিটারেনিয়ান উপবর্গীয় ও ককেশীয় বর্গীয় কুলে) জন্মগ্রহণ করে সাধনার দ্বারা আধ্যাত্মিক চেতনায় অধিষ্ঠিত হতেন তাঁদের বলা হত দেবর্ষি (যেমন, দেবর্ষি নারদ) (৩) যাঁরা জাগতিক কর্তব্যের অতিরিক্ত সামাজিক কর্তব্য (যেমন, রাজা) প্রতিপালনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের হূদয়বৃত্তিকে...মনীষাকে আধ্যাত্মিক চেতনায় অভিক্লপ্ত করতেন (হূদামনীষা মনসাহভিক্লপ্তঃ) তাঁদের বলা হত রাজর্ষি (যেমন, রাজর্ষি জনক) । এবাদুল হক তাঁর জাগতিক কর্তব্য অর্থাৎ নিজের সংসার প্রতিপালন ও স্কুলের শিক্ষকতার চাপ সত্তেও সাহিত্যের উর্ধ্বতর ধ্যান-ধারণা-সাধনা করে গেছেন আজীবন ।
পৌরাণিক যুগের বহু ঋষিদের নাম আমরা জানি : “পৌর, শ্রুতবিদ, মধুচ্ছদা, জেতৃ, মেধাতিথি, অর্চনানা, অজীগর্ত্ত, হিরণ্যস্তুপ, ঘোর, যজত, প্রস্বম্ব, সব্য, নোধা, শক্তি, পরাশর, সপ্তবধ্রি, রহুগণ, দীর্ঘতমা, দিবোদাস, পুরুচ্ছেদ, উচথ্য, উরুচক্রি, সোমাহুতি, উৎকীল, বাহুবৃক্ত, কুশিক, গাধী, ইষীরখ, বুধ, গবিষ্টি, বসুশ্রুত, ইষ, গয়, সুতম্ভর, সত্যশ্রবা, ধরুণ, মৃক্তবাহ, দ্বিত, বব্রি, প্রযস্বস্বৎ, বিশ্বসামা, দুম্ন, বসুযু, গোপায়ন, পুরুকুৎসা, লোপায়ন, লোপামুদ্রা, সুবন্ধু, শ্রুতবন্ধু, বিপ্রবন্ধু, ত্রিকৃষ্ণ, ত্র্যরুণ, ভরত, গৌরিবীতি, বক্র, অষ্টবক্র, অবস্যু, গাতু, সম্বরণ, স্বস্তি, প্রভুবসু, কশ্যপ, সাদাপৃণ, প্রতিবথ, প্রতিক্ষত্র, প্রতিভানু, শ্যাবাশ্ব, ঘোষা, অপালা, বিশ্ববারা, ভারতী, গার্গী, বীতহব্য, কৃতযশা, দক্ষিণা, ব্রহ্মজায়া, মৈত্রেয়ী, সরমা, সুহোত্র, শুনহোত্র, নর, শুংযু, ঋজিশ্বা, প্রিয়মেধ, সধ্বংসাখ্যা, কপিল, কনাদ, অন্ধ, বৎস, নীপাতিথী, নারদ, সুদিতি, উশনা, ত্রিশোক, দূষ্মীক, ত্রিত, নাভাক, সোভরি, নৃমেধ,অগস্তি, জৈমিন, দার্ঢ়াচ্যুত, ইম্ববাহ, অগ্নিবৈশ্য, বার্হস্পত্য, অত্রি, আত্রেয়, শাতাতপ, অনাবৃকাক্ষ, গার্গ্য, অব্য, সারস্বত, সাংখ্য, আলম্বায়ন, আস্তিক, দেবল, দুর্বাসা, ভূধর, বাল্মীকি, বৈশ্বানর, মার্কন্ডেয়, জমদগ্নি, প্রজাপতি প্রমুখ । আমাদের সময়ে তেমনই হলেন এবাদুল হক । এবাদুল কেবল যে নিজেই উন্নতভাবনার পুরুষ ছিলেন, তাই নয় ; তিনি নিজের সঙ্গে অন্যদেরও উন্নতভাবনায় নিয়ে যাবার প্রয়াস আজীবন চালিয়ে গেছেন । উপরোক্ত ঋষিদের মতনই এবাদুল রেখে গেছেন লিখিত পাঠবস্তু ; কোনও প্রাসাদ, শিলালেখ তৈরি করিয়ে যাননি । তাঁর বাবার নাম জয়নাল আবেদীন আর মায়ের নাম হামিদা ।
এবাদুল হককে মহর্ষি বলেছি বলে অনেকের গায়ে লেগেছে । সম্ভবত তাঁরা নিজেদের এবাদুল হকের চেয়ে উন্নতধী, উন্নতমনা, লোভ-লালসা বর্জিত মনে করেন । তা-ই যদি হবে, তাহলে এবাদুল হককে মহর্ষি বলায় ঈর্ষা কেন? পৌরানিক যুগে অনেকেই ঈশ্বর ও ধর্ম সম্পর্কে জানতে গভীর অরণ্যে তপস্যা করতেন । এনারা তপস্যার বলে সমস্ত লোভ-লালসা ত্যাগ করেছিলেন । এই মহাত্মাদের বলা হতো মুনি । যেইসব মুনি তপস্যাবলে বেদের মন্ত্র প্রকাশ করতে পারতেন, তাদের বলা হতো ঋষি । সুতরাং বোঝা যায় যে, সব ঋষিই মুনি কিন্তু সকল মুনি ঋষি নয় । মুনির স্থান অতিক্রম করেই ঋষির স্থানে অধিষ্ঠিত হতে হয় । এজন্য ঋষিরা ছিলেন মুনিদের থেকে উচ্চস্তরের । ঋষিদের সাতটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে । যথা : ব্রহ্মর্ষি, মহর্ষি, দেবর্ষি, কান্ডর্ষি, রাজর্ষি, পরমর্ষি ও শ্রুতর্ষি ।ব্রহ্ম বা ঈশ্বর সম্পর্কে যেসব ঋষিদের বিশেষ জ্ঞান ছিল, তাদের বলা হতো ব্রহ্মর্ষি । ঋষিদের মধ্যে যারা মহান ও প্রধান ছিলেন তাদের বলা হতো মহর্ষি = মহা + ঋষি । দেবতা হয়েও যারা ঋষি ছিলেন তাদের বলা হতো দেবর্ষী = দেবতা + ঋষি ।বেদের রয়েছে দুইটি কান্ড (জ্ঞানকান্ড ও কর্মকান্ড) এর মধ্যে যে কোন একটির বিষয়ে যাদের বিশেষ জ্ঞান ছিল তাদের বলা হতো কান্ডর্ষি । রাজা হয়েও যিনি ঋষি বা ঋষির মতো আচরন করেন তাকে বলা হতো রাজর্ষি ।পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে যিনি দর্শন করেছেন তাকে বলা হতো পরমর্ষি ।যেসব ঋষিগণ শুনে শুনে বেদ মন্ত্র লাভ করেছিলেন তাদের বলা হতো শ্রুতর্ষি । বলাবাহুল্য যে সাহিত্যের জন্য যে ত্যাগ এবাদুল হক করেছিলেন তা আর কেউ করেছেন বলে মনে হয় না ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, খ্রিষ্টধর্মের প্রভাব থেকে ভারতীয় যুবকদের রক্ষার জন্য ১৮৬৭ সালে রাধাকান্ত দেব তাঁকে ‘জাতীয় ধর্মের পরিরক্ষক’ ও ব্রাহ্ম সমাজের ‘মহর্ষি’ উপাধিতে ভূষিত করেন । ১৮৪২ সালে দেবেন্দ্রনাথ তত্ত্ববোধিনী সভা ও ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরের বছর তাঁরই অর্থে এবং অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। এই পত্রিকায় দেবেন্দ্রনাথকৃত বৃত্তি ও বঙ্গানুবাদসহ উপনিষদ প্রকাশিত হতে থাকে। দেবেন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায় প্রকাশ্য সভায় বেদপাঠও শুরু হয়। ১৮৪৪ সালে দেবেন্দ্রনাথ প্রথম ব্রহ্মোপাসনা পদ্ধতি প্রণয়ন করেন এবং পরের বছর থেকে তা ব্রাহ্মসমাজে ব্যবহৃত হতে থাকে। দীর্ঘ শাস্ত্রচর্চার ফলে তিনি উপলব্ধি করেন যে, শুধু উপনিষদের ওপর ব্রাহ্মধর্মের ভিত্তি স্থাপন সম্ভব নয়। তাই ১৮৪৮ সাল থেকে তিনি ক্রমাম্বয়ে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ঋগ্বেদের অনুবাদ প্রকাশ করতে শুরু করেন, যা ব্রাহ্মধর্ম (১৮৬৯) নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৮৫০ সালে তাঁর অপর গ্রন্থ আত্মতত্ত্ববিদ্যা প্রকাশিত হয়। ১৮৫৩ সালে তিনি তত্ত্ববোধিনী সভার সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং ১৮৫৯ সালে ব্রাহ্মবিদ্যালয় স্থাপন করেন। কিন্তু তিনি নিজের বাবা দ্বারকানাথ ঠাকুরকে শ্রদ্ধা করতেন না, এমনকী দ্বারকানাথ ব্রিটেনে মারা গেলে কোনও খোঁজ নেননি ; দ্বারকানাথকে সেখানেই কবর দেয়া হয় । অথচ দ্বারকানাথ ঠাকুরের রোজগারে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের কাজ করতেন । দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মা মারা গেলে দেবেন্দ্রনাথ শবানুগমন করেননি । তাঁকে যদি মহর্ষি উপাধিতে ভূযিত করা হয়ে থাকে তাহলে এবাদুল হককে করা হবে না কেন ?
এখানে ‘আবার এসেছি ফিরে’ পত্রিকার নভেম্বর ২০১৯ উৎসব সংখ্যা থেকে এবাদুল হকের লেখা সম্পাদকীয়র অংশ তুলে দিচ্ছি, তা থেকে স্পষ্ট হবে কেন তিনি মহর্ষি : “আবার এসেছি ফিরে আমৃত্যু কথাটি বলে যেতে হবে। ‘আমৃত্যু’ কথাটির ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন । আমি ব্যক্তি এবাদুল ও ‘আবার এসেছি ফিরে’ এক সত্বার দুটি ভিন্ন নাম । কারণ আমার ব্যক্তিজীবন ও পত্রিকার জীবনে অনভ কারোর স্হান কোনোদিন ছিল না । আর এই বয়সে হয়তো কেউ আর আসবেও না । হ্যাঁ, বলে রাখা ভাল আমার সঙ্গে আছেন অগণিত মান্যবর কবিসমাজ । আছেন গবেষক ও কিছু ঋজুদৃঢ় পাঠক । ওনারাই আমার সহায় ও সম্বল । আর আছে শহুরে সভ্যতার দ্বারা লালিত কিছু ঈর্ষাকাতর সাহিত্যের মানুষজন । যাঁরা ভুলে যান ‘আবার এসেছি ফিরে’ পত্রিকার ইতিহাস । ক্ষুদ্র পত্রিকার আঙিনায় এই পত্রিকার যে ইতিহাস আছে তা থেকে বিস্মৃত হয়ে লেখা পাঠান । কিন্তু নিজের পত্রিকা নিয়ে যখন লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে লিখতে বসেন, তখন এককলম আমার জন্য রাখতে ভুলে যান । কেন এই ঔদাসীন্য? গ্রামে লালিত হয়েও বর্তমানে সদর শহরগুলোতে বাস করেন বলে ? আমি অবশ্য অন্যমানুষ । আমার কোনো দল নেই । কোনো রাজনৈতিক দাদাদের দ্বারা পুষ্ট নই । গোষ্ঠীবাজি করা আমার ইতিহাসে ছিল না । হ্যাঁ, রাজনীতি, সমাজনীতি সম্পর্কে দৃঢ় ধারণা আছে বৈকি । আমি বুঝি পৃথিবীতে শাশ্বত বলে কিচু নেই । আছে মানুষ, আছে মানুষের ভাবনাচিন্তা । সেই ভাবনার দোসর হয়ে তাঁদের স্যালুট জানাতে জানি । আমি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের দাসত্ব করি না । ধর্মবোধের মধ্যে যেখানে মিলনের সুর আছে, আমি সেখানেই যাই । আমি কোনো ধর্মের তথাকথিত আইডেনটিটি পাওয়ার জন্য লালিত নই ।মুসলমান ঘরে জন্মেছি তাই আমি মুসলমান, আমি একথাই জেনে এসেছি আজীবন ।মান্যতাও দিই । ডোম.চামার ছুঁলে জাত যায় না আমার । এক থালায় খাবার খেতে আমার এতটুকু কুন্ঠা হয় না । হ্যাঁ, আমার কাছে মানুষের ভালোবাসা আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় প্রাধান্য প্রায়।
তবে, পত্রিকার ব্যাপারে বলি, কারোর খবরদারি একদম পছন্দ করি না । এক্ষেত্রে আমি নিজেকে হিটলারের সাথে তুলনা করি । কারোর উপদেশ আমার কাম্য নয় । কেন এত আত্মকথন ? চল্লিশ বছর সাহিত্যজগতে থেকে দুর্গন্ধ, বস্তাপচা পড়ে পড়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি ।জীবনানন্দীয় ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে ।সুনীল-শক্তির দ্বারা পুষ্টতা আর নয় । ভাঙুন, ভেঙে ফেলুন সাহিত্যের খোলনলচে । নতুন কিছু বলুন, নতুন করে । আর তার জনভই ধরে নিন এলাম ফিরে ।কবি-সাহিত্যিকদের কাছে একান্ত অনুরোধ নতুন ভাবনা চাই ল চাই নতুন আঙ্গিক । গদ্যে-পদ্যে সর্বত্রই আসুক প্লাবন ।”
হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল ১৯৬১ সালে আর তার এক বছর আগে জন্ম হয় এবাদুল হকের, ১৯৬০ সালের চৌঠা জানুয়ারি । নিজের শৈশব সম্পর্কে এবাদুল হক যা লিখেছেন, তা বেশ মজার, কেননা এবাদুল ( পূর্ব পাকিস্তান ) বাংলাদেশে গিয়েছিলেন, কিন্তু ভালোলাগেনি বলে মুর্শিদাবাদে ফিরে এসেছিলেন ; এরকম ঘটনা বোধহয় সংখ্যায় কম। স্টোইকসদের থেকে কান্ট পর্যন্ত, একটি সর্বজনীন নৈতিকতার পক্ষে যুক্তি দেয়া হয়েছিল । তাছাড়া ঐতিহাসিকভাবে গঠিত সমাজে নানা রকমের মানবতার বিভাজন সত্ত্বেও, মানুষের সাথে নিজেকে চিহ্নিত করা এবং মানবতার জন্য নৈতিক উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক । বিশ্বজনীনতার প্রধান কাজ হল এই যে তা সার্বজনীনতাকে রক্ষা করে । এবাদুল হক শৈশবে এই বোধের কারণে ফিরে এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে। এবাদুল হক বুঝেছিলেন, ‘প্রলয়’ পত্রিকা প্রকাশের সময় থেকে, যে, অনুভূতির মূর্ত অবস্থাগুলো - ভালবাসা, ব্যথা, আনন্দ, কৌতূহল, যন্ত্রণা, অহংকার - সবই সাহিত্যে পাওয়া যায় । সাহিত্যে তা এত ভালভাবে বর্ণনা করা হয়, এত তীব্রভাবে যে উনি অনুভব করেছিলেন, এবং বেশ গভীরভাবে, এমন-কিছু যা হয়তো অনেক বছর আগে কেউ অনুভব করেছিলেন। এই বোধ এবাদুলকে জানিয়েছিল যে মানুষের অভিজ্ঞতা ভাগ করা জরুরি । কেননা তা সান্ত্বনা দেয়, পাঠককে স্পর্শ করে এবং বর্তমান দুঃসময়ে তাকে অনুপ্রাণিত করে। অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী পাঠকের বর্তমানকে রূপ দিতে পারে।
ওনার ভাষ্যেই শোনা যাক : “তখন আমি ক্লাস সিক্স। আমরা যেমনটি আট ভাই এক বোন। আমার কাকা জ্যেঠারা তেমনটিই আট ভাই দুই বোন । পাঁচ জ্যেঠা এক কাকা আর একজন পিসিমা বাংলাদেশে বিনিময় করে চলে গেছিলেন। আমার আব্বা এখানকার ২১ বিঘা জমি বিনিময় করে দুই দাদাকে সঙ্গে দিয়েছিলেন। আব্বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তাছাড়াও এখানকার কংগ্রেসি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমার তিন দাদা দুই ভাই এখানে থেকে গেলাম। বাংলাদেশের রাজশাহীতে আমার দুই বড় দাদা চাকরি পেয়ে গেছিল। কিন্তু বাড়িঘর করতে পারেননি। ল কাকার বাড়িতে এক দাদা আর একজন আমাদের গ্রামের মানুষ, এখান থেকে যাওয়া ওদের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছেন। আমি ছাত্র হিসাবে খারাপ ছিলাম না। বাড়ির সবাই বলতেন, আট ভাই এক বোনের মধ্যে আমার ব্রেন শার্প । কঠিন পড়া সহজে ক্যাচ করতে পারতাম। মেধা ছিল। তাই বাংলাদেশে নিয়ে গিয়ে রাজশাহীর কোর্ট একাডেমিতে ভর্তির আবেদন জমা দিলাম। ভর্তির পরীক্ষা দিয়ে তের জনের মধ্যে আমি দ্বিতীয় হয়েছিলাম। ১৯৭০ সাল। ভাষা আন্দোলন আর তথাকথিত ভাষা আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। স্বাধীন সার্বভৌমত্বের দাবী করে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে জোর আন্দোলন। মিটিং মিছিল থেকে শুরু করে আইন অমান্য সবকিছু হচ্ছিল। একমাস ক্লাস করার পরেই স্কুলে অশান্তি। উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধের ডাকে সাড়া দিয়ে ক্লাস বয়কট করল। চলল পুরো দশদিন। চুপচাপ ঘরে কাঁহাতক বসে থাকা যায়। খুব বোরফিল করছিলাম। হঠাৎ শোনা গেল বিদ্যালয় খুলছে। কিছুদিন ক্লাস করে বুঝতে পারলাম, না এখানকার জল -হাওয়া, বিদ্যালয়ের পরিবেশ আমার স্যুট করবে না। আমি দূরন্ত ছিলাম ভেতরে ভেতরে কিন্তু বাইরে খুব লাজুক ছিলাম। ঠিক লজ্জাবতীর মত। যেমন হাত দিলেই নিজেকে গুটিয়ে নেয়। আমিও বাইরের দিকে গুটিয়ে রাখা স্বভাবের ছিলাম। এখন পর্যন্ত ওই রকমের থেকে গেছি। যারা এগিয়ে আসে তাদের সঙ্গে পিরীত হয়। গায়েগোছে বন্ধুত্ব নৈব নৈব চ। তাই আমার বন্ধুর সংখ্যা হাতেগোনা। পঁয়তাল্লিশ বছরের পত্রিকা সম্পাদনার পরেও সব লেখকদের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। সে যাইহোক, পারলাম না, রাজশাহী থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হলাম। সদ্য ইণ্ডিয়া থেকে পাকিস্তানে যাওয়া আত্মীয় স্বজনেরা কেমন ধারার হয়ে গেছে। এমনকি মুখের কথাতেও যেন কেমন তথাকথিত ভদ্রতার প্রলেপ পড়েছে। এখনও রাজশাহীর ভাষা আমাদের মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলার ভাষার মত। এখনও রাজশাহীতে আমাদের মতই কথ্য ভাষার প্রচলন রয়েছে। কোভিড ১৯ এর দুতিন মাস আগে বড়দা এসেছিলেন। ব্যাঙ্কে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে মক্কা পরিদর্শন করে ইণ্ডিয়া এসে সকলের সঙ্গে দেখা করে গেছেন। কই তাঁর বলনে - চলনে কোন পরিবর্তন তো আসেনি। আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল আমার কাকার বাড়িতে। কি ক্রমবর্ধমান কৃত্রিম হয়ে ওঠেছে গোটা পরিবার। ক 'বছরের মধ্যে কি সাবলীল অদ্ভূটে পরিবর্তন। এখানে থাকতে মাটির গর্তের পায়খানা ব্যবহার করত। ছেলেরা অধিকাংশ বর্তন হাতে উঁচু নবাবী বাঁধের জঙ্গলের ভিতর ঢুকে পড়ত। ভূতরাজের আকাট জঙ্গল। এখনও সবুজ নধর পাতার গন্ধ নাকে আসে। মন উদাস হয়ে যায়। বনকুলের জঙ্গলে পাকা কুলের ঝোঁপে বনবাটুল, ঘুঘুর আনাগোনা। লক্ষ্মীপুরের বাসায় মোজাইক বসানো সেনেটারি পায়খানা। ঝাঁচকচকে। বয়সে আমার বড় কাকাতুতো বোন শিরীন বলেছিল, এই ছোঁড়া পায়খানায় গেলে বেশি করে পানি ঢালবি। খুব সহজ কথা কিন্তু আমার আঁতে লেগেছিল। একি কথা? আমি ভালো করে টয়লেট পরিস্কার না করেই একগুচ্ছের নোংরা রেখে চলে আসব ? দ্বিতীয়ত দাদারা অফিস চলে গেলে ডাইনিং টেবিলে নাস্তা খাবার ডাক পড়ত। ল কাকীমা মেয়েদের কারো নাম করে ডেকে বলতেন - " অলকা, শিরীন, ডলি কইরে, কোথায় আছিস, এবাদুলকে পাঠাইয়া দে নাস্তা করে নিক। "-প্রসঙ্গত বলি, এখানে থাকাকালীন ওরা কুনঠে > কোথায় , প্যাঠিয়ে > পাঠাইয়া, লাহারি> নাস্তা, লেক > নিক অর্থাৎ শুদ্ধ উচ্চারণে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। আমার কথা শুনে চোখ টিপাটিপি করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করত ; তা এখনও চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ভাসে। এমন উচ্চারণ শুনেছি, অতিমাত্রার হয়ে বিসদৃশ্য মনে হত। আমি মনকে শান্ত করতে পারিনি। কাকীমা মুখের সামনে বিপরীত টেবিলে বসে। আমি সামনে গিয়ে বসলাম। টেবিলটা আমার উচ্চতার তুলনায় একটু বেশি। তবুও বসলাম। একটা চিনা খালি থালা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন - " তোমার তো পান্তা ভাত ( আমরা এখনও বাসি ভাত বলি ) খাওয়া অভ্যেস,পরোটা ফরোটা খাও না, দেখ কেমন লাগে। " ছোট্ট পাতলা সাইজের একটা পরোটা আর থালার একপাশে ঝাল আলুর দম তুলে দিলেন। চিবোনা কঠিন হয়ে পড়ছে। কারণ পান্তা ভাতের খোঁচা খিচখিচ করে বুকে বিঁধছে। ল কাকীমা গামলার ঢাকনা তুলতে তুলতে বললেন - " আর নিবা? " মেজাজ টংয়ে। বলেন কি। আমি এধরনের পরোটা চারটি খাব, আর একটা দিয়ে বলেন কিনা, আর একটা দিই ? আমি হাত নেড়ে বলছিলাম, না না আর খেতে পারব না।”
যাঁরা অন্য রকম লিখছেন বা লিখতে চাইছেন, তাঁদের সম্পর্কে এবাদুলের আগ্রহ ছিল সেই ক্লাস নাইনে পড়ার সময় থেকে যখন উনি ‘প্রলয়’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ আরম্ভ করেন । ‘প্রলয়’ নামটি থেকেই এবাদুল হক স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে তিনি ভবিষ্যতে সাহিত্যজগতে কী করতে চলেছেন । ‘প্রলয়’ পত্রিকার জন্য তিনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা সংগ্রহ করে এনে প্রকাশ করেছিলেন ।এরপর ১৯৭৭ সালে যখন উনি ‘রামধনু’ নামে একটা পত্রিকা বের করা আরম্ভ করেন, তখন ওনার কেবল সতেরো বছর বয়স । পত্রিকাটা কোনো কারণে বন্ধ হয়ে যায় এবং ১৯৭৯ সালে আবার প্রত্রিকা সম্পাদনা আরম্ভ করেন । আগের পত্রিকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে নতুন ত্রৈমাসিকটির নাম রাখলেন ‘আবার এসেছি ফিরে’ । একদিকে বট গাছ অন্য দিকে পাকুড় গাছ মাঝ দিয়ে রাস্তা, একটু এগিয়ে বাঁ দিকে পুকুরপাড়ে ছিল ‘আবার এসেছি ফিরে’ আর ‘এবং পুনশ্চ’ পত্রিকা দুটির আশ্রম ।
মুর্শিদাবাদের সীমান্তবর্তী ভগবানগোলার কানাপুকুরে ছিল এবাদুলের বাড়ি আর সেখান থেকেই পত্রিকা প্রকাশ করতেন । কলকাতা থেকে বহুদূরে একটি প্রায়-গ্রামে বসে যে সাড়া ফেলে দেয়া যায় তা ‘আবার এসেছি ফিরে’ পত্রিকার মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছিলেন এবাদুল । স্হানীয় স্কুলে শিক্ষকতা করতেন এবং অবসর নিয়ে আরেকটি পত্রিকা, কেবল কবিতার জন্য, নতুন কবিদের সবাইকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেবার সুবিধার জন্য ‘এবং পুনশ্চ’ নামে, প্রকাশ করা আরম্ভ করেন । আমার ‘আভাঁ-গার্দ’ কবিতাগুলো প্রকাশ করার সাহস ছিল এবাদুল হকের । কলকাতায় তো বহু হামবড়ুয়ে সম্পাদক জানেনই না কাকে আভাঁ গার্দ বলে । তিনি ঋষি এইজন্যই যে স্কুলের ছাত্ররা তাঁর কাছ থেকে নিজেদের সন্দেহ দূর করতে পারতো । তিনি মহর্ষি এই জন্যে যে দুটি পত্রিকার সম্পাদক হওয়া সত্তেও দাদাগিরি ফলাতেন না, কাঁচি চালাতেন না, দল গড়ে নেতাগিরি ফলাতেন না, যা অধিকাংশ লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকের চরিত্রে দেখা যায় । সংসারের খরচপত্র যতটুকু হয়, তা করার পর নিজের সমস্ত আয় খরচ করতেন ‘আবার এসেছি ফিরে’ আর ‘এবং পুনশ্চ’ পত্রিকা দুটির জন্য । মনে রাখতে হবে যে পত্রিকা দুটির কলেবর ক্ষীণ হতো না ।
বিয়াল্লিশ বছর পত্রিকা সম্পাদনা করে ১৭ই মে ২০২১ তারিখে এবাদুল হক মারা গেলেন করোনা রোগে । দুর্ঘটনার দরুন প্রচুর ওষুধ খেতে হতো এবাদুলকে । মুর্শিদাবাদের বাইরে সাহিত্য সভাগুলোয় যাবার সময়ে ওষুধের ডিবে নিয়ে বেরোতেন । শরীরের সমস্যা দেখা দিয়েছিল ১২ই মে এবং তাঁকে মুর্শিদাবাদ নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয় যেখানে তাঁর করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে । করোনায় যা হয়, দেহে প্রবেশ করার দিন পনেরো পর আচমকা কাবু করা আরম্ভ করে । এবাদুলের হার্টে ব্লক ছিল, যা উনি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা পর বইছিলেন, কেননা উনি মারা যান হৃদরোগে । এবাদুল হক ছিলেন তরুণতমদের ছত্রছায়া । বিশ্বাস করতেন তারুণ্য-শক্তিই পারে নতুন-যুগের আগমন ঘোষণা করতে । এবাদুলের মতন নির্মোহ নির্লোভ মানুষ পাওয়া বিরল। তিনি ছিলেন বিরলপ্রজ মানুষ । তাই আমি তাঁকে বলেছি মহর্ষি ।
মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা এবং আরেকটি দুর্ঘটনা সম্পর্কে এবাদুলের বয়ানই শোনা যাক : “ভয় ব্যাপারটা আমার খুব কম। তবুও সাইকেল, মোটর বাইক, আমার কাছে অচ্ছুত ছিল। অথচ কে জানে, আমারই মোটর বাইক দূর্ঘটনা হল। পেছনে বসে ছিলাম। পাড়ার ভাগনে গাড়ি চালাচ্ছিল। ৯ জানুয়ারি ২০০৭ সাল। কুয়াশাভরা শীতের সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে আসছে। বহরমপুর প্রেসে সারাদিন পত্রিকার ফাইনাল কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলাম। সামনের দিক থেকে একটা লরি আসছিল। আমার ভাগ্নে যথারীতি নিজস্ব সাইড দিয়েছে, অন্যদিকে পেছন দিক থেকে একটা লরি এসে আমাদের মোটরসাইকেলে ধাক্কা মেরে দিল। আমার উপরে আমাদের বাইক পড়ে গেল। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ভাগ্নে সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে জঙ্গলের মধ্যে পড়েছিল। তারপর যা ঘটেছে সবই আমার অজানা। পরে যতটুকু জেনেছি তা প্রত্যক্ষ দর্শকের কাছ থেকে। পেছন দিক থেকে আসছিলেন অশোক রায় নামে এক ভদ্রলোক। বানজেটিয়ায় বাড়ি। আমাদের ঘিরে আছেন চায়ের দোকানে আড্ডাবাজ কিছু ব্যক্তি। অশোক বাবু এসে স্কুটি থামিয়ে সবাইকে ধমকে আমার উপর থেকে মোটরবাইক তুলেছিলেন। সবাই ভেবেছিলেন মারা গেছি। পুলিশ না এলে হাসপাতালে নেওয়া যাবে না। কিন্তু অশোকবাবু জোর করে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলেন। আমার কাঁধে সবসময়ই শান্তিনিকেতনী ব্যাগ থাকে। সেই ক্লাশ নাইন থেকেই। তো ব্যাগটাই আমার আশ্রয়স্থল। সবকিছু ব্যাগেই থাকত। একটা ক্যামেরা সবসময়ই । সেদিন ব্যাগের মধ্যে ছিল ত্রিশহাজার টাকা এবং খরচের জন্য আলাদা কিছু খুচরো টাকা পয়সা। ব্যাগটা কাঁধেই ছিল। অশোকবাবু নিজ হেফাজতে নিয়েছিলেন। মোবাইলও ছিল। মোবাইল নিয়ে কল লিস্ট ঘেটে দেখছিলেন বহরমপুরের কেউ চেনাশোনা আছে কিনা। ভাগ্নের কাছে জেনেছিলেন আমার সংক্ষিপ্ত পরিচয়। সেই ভরসায় তিনি কললিস্ট সার্চ করে একদা আনন্দবাজারে সাংবাদিক অনল আবেদিনকে ফোন করেছিলেন। অনলদা আবার আমার প্রেসের মালিক গল্পকার অংশুমান রায়কে ফোন করে। তারপর অংশুমান আমার বন্ধু পত্রিকার সহসম্পাদক এমদাদউল হক ( ইন্দ্রপ্রস্থে থাকত ) কে ফোন করে। ছুটে আসে সকলে। আমি অজ্ঞান অবস্থায় ছিলাম। ডাক্তার দেখেছেন। নীলরতন হাসপাতালে রেফার করে দিয়েছেন। আমার হিপ জয়েন্ট চুরমার হয়ে গেছে। ডান হাতের কাঁধ ভেঙ্গে গেছে। ডান পা ভেঙ্গে খানখান। রক্তাক্ত শরীর। ক্ষতবিক্ষত। আমি জানিনা কিছুই। আমার যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি নীলরতন হাসপাতালে ইমারজেন্সী ওয়ার্ডের ওয়েটিং রুমে। আমার সঙ্গে আমার বন্ধু এমদাদউল হক। সে জ্ঞান ফিরে পেতেই কি যন্ত্রণা শরীরে। ঈশ্বর যদি থাকেন তিনিও হয়তো এই যন্ত্রণার পরিমাণ পরিমাপ করতে পারেননি। না হলে অন্ততপক্ষে একফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়ত।আমি শীতল হতাম। আমি চিৎকার করে উঠলাম। চেঁচিয়ে উঠে আল্লা, মাগো মরে গেলাম। জীবনে দ্বিতীয়বার আল্লাহ্ শব্দটা উচ্চারণ করেছি বোধহয়। আরেকবার আমার কলিগ শিক্ষকবন্ধু ভাগ্যধর দাস কর্মকারের বিয়েতে বরযাত্রী গেছিলাম বর্ধমান। যে গাড়িতে গেছিলাম সেটি নড়বড়ে। যাইহোক বিয়ে বাড়ির অব্যবস্থায় সারারাত মন বিষাক্ত করে তুলেছিল। বাড়ি ফেরার পথে ড্রাইভার, মেজাজ হারিয়ে সোজা গর্তে নামিয়ে দিয়েছিল। সারারাত আমাদের সঙ্গে ড্রাইভারও উপোস দিয়েছে। বিয়ে শেষ হয়েছে গভীর রাতে। আমাদের যখন খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল তখন প্রায় শেষ রাত। আমরা কেউই খেতে পারিনি। বিয়ে বাড়ির লোকজন ড্রাইভারের খোঁজখবর নেয়নি। ফলে সকালবেলায় বরবন্ধুর কাছে বিদায় নিয়ে গাড়িতে। বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে ফুটিসাঁকো স্টপেজে গাড়ি দাঁড়িয়ে পাউরুটি আর গরম গরম দুধ চা। মিষ্টির দোকান থেকে কিছু মিষ্টি আর পরোটা বেঁধে নিলাম। একটা ফাঁকা জায়গাই গাড়ি দাঁড়িয়ে পরোটা মিষ্টি খেলাম। ড্রাইভার কোনমতেই নিলেন না। অনেকখানি রাস্তা পেরিয়ে তারপর তো বাড়ি। মেজাজ টকেছিল তার। মেজাজে গাড়ি জোরে চালাতে গিয়ে খাদের গভীরে। সামনের একটা চাকা খুলে বনবন সামনের দিকে। হেলে পড়েছে গাড়ি। আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে ছিলাম। সবকিছু দেখতে পাচ্ছি। চোখের সামনে দিয়ে নেমে পড়ছে গাড়ি। মাথা ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ গাড়িটা উল্টাপাল্টা খেয়ে জোরে ধাক্কা মেরে দাঁড়িয়ে পড়ল। লাফিয়ে উঠল গাড়ি। আমার মাথাটা গাড়ির ছাদে গিয়ে ধাক্কা মারতেই ইয়া আল্লাহ্ বলে নাকি চিৎকার করে উঠেছিলাম। অজ্ঞাতে অজান্তেই। আর এখানে এই হাসপাতালে। আল্লাগো মাগো। কথায় আছে না, ঠেলার নাম বাবাজী।” ২০১৬ সালের পথদুর্ঘটনায় মারাত্মক জখম হওয়ার পর বন্ধ হয়ে গেছিল, ‘আবার এসেছি ফিরে’ আর ‘এবং পুনশ্চ’। দুটিকে ফিরিয়ে এনেছিলেন এবাদুল হক। নিজের খরচে পত্রিকা দুটি প্রকাশ ও সম্পাদনা করতেন, কোনও বিজ্ঞাপন থাকতো না পত্রিকাতে। শুধু লেখা প্রকাশ করা নয়, লেখক কপিও নিজের খরচে লেখককে পোস্ট বা বিভিন্ন উপায়ে পৌঁছে দিতেন। নিজের প্রচুর গল্প নাটক লেখা থাকলেও তিনি তা নিজ পত্রিকায় প্রকাশ করতে সঙ্কোচ বোধ করতেন। নতুন লেখকদের আত্মপ্রকাশের জায়গা করে দেওয়াই তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল।
সাহিত্য নিয়ে যেভাবে কাজ করছিলেন, খুব কম সময়ের মধ্যেই পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। সাহিত্যের জন্য কখনো এবাদুল হকশহরমুখী হতে চাননি। বাণিজ্যিক কাগজে লেখা প্রকাশেও তাঁর আগ্রহ ছিল না। কাউকে ধরাধরি করেননি কখনও । পৌরাণিক ঋষিদের মতন নিজেকে নিজেই সুশিক্ষিত করেছেন নিজের স্বভাবসিদ্ধ গরিমায় । কলকাতা থেকে বহুদূরে এক মফসসল এলাকায় বসবাস করেও যে পত্রিকা তিনি প্রকাশ করতেন তা ছিল ঋষিতুল্য কর্মোদ্যম ও আত্মাভিমানের প্রমাণ । ‘আবার এসেছি ফিরে’ পত্রিকার এক একটি সংখ্যা প্রায় হাজার পৃষ্ঠার বা তারও বেশি হতো। একজন কবি, প্রাবন্ধিক বা গল্পকার তিনি যত নতুন লেখকই হোন না কেন, তাঁর পত্রিকায় সমান মর্যাদা পেতেন। কলকাতা ও জেলাশহরের দলবাজ নেতা-সম্পাদকদের দ্বারা উপেক্ষিত, অপমানিত, অপরিচিত-নামের প্রান্তিক লেখকদের তিনি বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা দিতেন । তিনি তাঁদের নিয়ে পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাও করেছিলেন। আগামীতেও কয়েকটি সংখ্যা করবেন বলে লেখা সংগ্রহ করছিলেন। অজিত রায়, রবীন্দ্র গু্হ প্রমুখ, যাঁরা ভিন্নধর্মী গদ্যবিন্যাসের কারণে কলকাতার পত্রিকাগুলোর ডাক পান না, তাঁদের কাছ থেকে গদ্য চেয়ে এবাদুল হক প্রকাশ করেছেন নিজের পত্রিকায় । বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন দেবী রায়, অজিত বাইরী, কবিরুল ইসলাম, বেণু দত্ত রায় প্রমুখকে নিয়ে । রাণা চট্টোপাধ্যায়, অনন্ত রায়, পুষ্পিত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে সংখ্যা করার জন্য প্রবন্ধ সংগ্রহ করা আরম্ভ করেছিলেন ।
‘আবার এসেছি ফিরে’ সাহিত্য পত্রিকার জন্য ১৯৯২-৯৩ সালে পর-পর দুবার এবাদুল হক পেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর এর ‘সারা বাংলা শ্রেষ্ঠ লিটিল ম্যাগাজিন সম্মান’, ১৯৯৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র যুব উৎসব পুরস্কার, ১৯৯৫ সালে নিজের লেখা নাটকের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একাঙ্ক নাটক পুরস্কার, ২০১৩ সালে অদ্বৈত মল্লবর্মণ জ্মশতবর্ষ স্মারক পুরস্কার, ২০১৬ সালে সারা ভারত লিটল ম্যাগাজিন প্রতিযোগীতায় সাদাত হাসান মান্টো পুরস্কার এবং ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমির দেওয়া শ্রেষ্ঠ লিটল ম্যাগাজিনের পুরস্কার । এই পুরস্কারটি সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী তুলে দিয়েছিলেন এবাদুল হকের হাতে । এছাড়াও বিভিন্ন জেলার লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার পেয়েছিলেন এবাদুল ওঁর পত্রিকার ডাকাবুকো সম্পাদনার জন্য।
ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা জনিত কারণে কয়েক বছর যাবৎ তিনি অত্যন্ত অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু তাঁর ছিল অদম্য মনোবল । শরীরের সমস্যা কোনোদিন তাঁর সাহিত্যকর্মকে প্রভাবিত করতে পারেনি। তাঁর কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৭টি নাটকের সংকলন ‘এখনও লক্ষিন্দর’ এবং প্রায় একশটি গল্পের সংকলন ‘অনন্ত’ । নিজের লেখা নাটকে অভিনয় করেছেন।। তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা সাতটি । সেগুলি হল ‘কবিতা ও কাকলি’, ‘সূর্যাস্তের আগে ও পরে’, ‘নাগকেশরের ফুল’,’অগ্নিজল’, ‘বাউলজল’, ‘এক গ্লাস জলের ছায়া’ আর ‘পলাতক ছায়া। 'একগ্লাস জ্বলের ছায়ায়' গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই ভার্স লিবরে আঙ্গিকে লেখা । তিনি উপন্যাসও লিখতে শুরু করেছিলেন । মুর্শিদাবাদের ডোমকল শহরে ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ অনুষ্ঠিত হয়েছিল একটি সাহিত্য সভা। এবাদুল হক তাঁর স্বাগত ভাষণে তরুণ ফেসবুকীয়া কবিদের বলেন যে কবিরা তাঁদের নিজস্ব ভাবনা ও ভঙ্গিতে কবিতা লিখবেন , তা কেউ ভালো বলুক বা না বলুক, কিন্তু কারো নকল বা কপি করে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া কখনই উচিত নয় । ২০১২ সালে যখন সারাবাংলা লিটিল ম্যাগাজিন প্রতিযোগিতায় ‘আবার এসেছি ফিরে’ প্রথম স্থান অধিকার করেছিল সেইদিন রবীন্দ্রসদন চত্বরে স্টেজে ছিলেন জয় গোস্বামী এবং মহাশ্বেতা দেবী । পুরস্কার দেবার সময়ে ‘আবার এসেছি ফিরে’ পত্রিকাকে মফসসলের পত্রিকা বলে উল্লেখ করা হলে, এবাদুল হক চিৎকার করে বলেছিলেন “মফসসল কথাটা আপনারা ব্যবহার করবেন না ; আমি মফস্বল থেকে এসছি এবং ‘আবার এসেছি ফিরে’ আপনাদের কাছে আজ মফস্বল থাকলো না।” এবাদুল হক এমনই ডাকাবুকো মানুষ ছিলেন। যা বলতেন সামনাসামনি এবং সত্যি কথাটা জোর দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন, বলে দিতেন, কারও তোয়াক্কা করতেন না। কিন্তু সব কিছুর চেয়ে বেশি, এবাদুলের কাছে সাহিত্য ছিল মানবসংযোগ। পত্রিকার সূত্রে অখ্যাত অথচ অসাধারণ ব্যক্তির সংগে যোগাযোগ ঘটেছে তাঁর, অখ্যাত হলেও যাদের কাছ থেকে নতুন কিছু শেখা যায় ; যাদের সাথে মিশে হাসা যায় এবং আনন্দ ভাগাভাগি করা যায় ।
মহর্ষি এবাদুল হকের সঙ্গে আমার পরিচয় বহুকাল আগে । গ্রামীণ উন্নয়নের চাকুরির সূত্রে আমি যখন বদলি হয়ে কলকাতায় ফিরি, তখন নাকতলার ফ্ল্যাটে থাকতুম । আমি কলকাতার সাহিত্যজগতকে এড়িয়ে চলতুম বলে কবি-লেখকদের বিশেষ আনাগোনা ছিল না আমার ফ্ল্যাটে । একদিন হঠাৎই এক যুবক এলেন, নিজের নাম বললেন এবাদুল হক, এসেছেন মুর্শিদাবাদের কানাপুকুর থেকে, আমার লেখা চান আর আমাকে নিয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করতে চান । যুবকটির প্রস্তাব ছিল স্তম্ভিত করে দেবার মতন কেননা সাহিত্যিক হিসেবে কলকাতায় আমাকে বড়ো একটা পছন্দ করা হতো না আর একজন যুবক কিনা বহুদূর থেকে এসেছেন আমার লেখা নিতে আর আমাকে নিয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করার প্রস্তাব নিয়ে । সেই থেকে এবাদুলের সঙ্গে আমার আলাপ । এবাদুল আমার দুটি বই প্রকাশ করেছিলেন, একটি ছোটোগল্পের, “অতিবাস্তব গল্পগাছা” নামে এবং আরেকটি “হাংরি ইশতাহার সংকলন” । আমার লেখালিখি নিয়ে বহুকাল আগে সেই প্রথম ক্রোড়পত্র প্রকাশের পর নভেম্বর ২০১৯ সালে ৪১ বর্ষ প্রথম সংখ্যায় আবার ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেন ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন