মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০২২

চাইবাসা আবিষ্কার : মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস

 চাইবাসা আবিষ্কার : মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস


সকালবেলার তন্দ্রাচ্ছন্ন গোরস্তানে, কালো হোসপাইপ-লিঙ্গ ঝুলিয়ে-দুলিয়ে দৌড়োচ্ছিল গাধাটা ।

এখনকার পেণ্ডুলাম । যেন সময়ের কন্ঠস্বর । সুযোগ পেলে হড়হড় করে ঝরবে বিদ্রুপ । কান নাচিয়ে দৌড়।গাধাটার ডাকে এমন তীব্র স্বরাঘাত ছিল যে মনে হচ্ছিল পুরো সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা’র ভাঙা আয়নার টুকরো-টাকরা দিয়ে সাজানো । আতঙ্কের বিস্ফোরণে গাধাটা, যার অভ্যাস শুধু ধোপার ধাতানি খাওয়া, সমবেত লোকগুলোকে এড়িয়ে দৌড়চ্ছিল , ছায়ায় গলতে থাকা একটা আকৃতি, যার ফাঁপা ডাকের মোড়ক ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে সূর্যের আলো, উত্তেজনার অবরোহণের আদল-আদরায় ।


গাধাটা নিজের ডাকে তাজা পরিষ্কার বাতাস দিয়ে  ফুসফুস ধুয়ে ফেলছে মনে হয় । রাহু, রাহুল সিংহের মগজে, ওই দৃশ্য দেখে, আপনা থেকেই, অনিকেতের বন্ধু রূপক মজুমদারের একটা গান নিঃশব্দে বাজতে আরম্ভ করল, কে জানে কেন,


চোখ মেরো না বেদানা চুল বেঁধো না

তোমার ঐ হলুদ জানালায়

তুমি ঝুলিয়ে রেখো না বেদানা

ঝুলিয়ে রেখো না

আমি যখন আব ঘরে

তুমি নাইতে যেও না বেদানা নাইতে যেও না


জাল-বসানো ঘন নীল ভ্যান থেকে নেমেই  জন-পনেরো পুলিশ  তাড়া করে ধরতে লাগলো ধুলোটেলাঠি  আর জংধরা তরোয়ালধারী লোকগুলোকে, যারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছিল । তরোয়াল উঁচিয়ে গাধাটার দিকে দৌড়োচ্ছিল লুঙ্গিপরা রোগাটে একজন দাড়িয়াল প্রৌঢ়, যার লুঙ্গিতে পুলিশের টান পড়তেই উলঙ্গ হয়ে সে তরোয়াল ফেলে দিয়ে অসাড় আতঙ্কের গ্রাসে পড়ে দু’হাত দিয়ে নিজের লিঙ্গের নগ্নতা সামলানো জরুরি মনে করলো । কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে লুঙ্গিটা  পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো কনসটেবল । ল্যাংটো অবস্হাতেই, ঢুকতে না চাইলেও,  পুলিশ তাকে ভ্যানে ঢোকালো, লোকটার পোঁদে সূর্যের আলো পড়ে তামার খাদ মেশানো সোনার মতন ঝিলিক মারছিল, যেন লোকটার দুঃখের জানালার সামান্য ফাটল থেকে ছড়িয়ে-পড়া আলো । অনেক সময়ে সেই সব মানুষের পোঁদও তাদের অভিব্যক্তির  আয়না হয়ে ওঠে, যাদের মাতৃভাষা হলো টাকাকড়ির খাঁকতি, অন্নের অভাব । কোনো ভয় খিদের সামনে টিকতে  পারে না, কোনো ধৈর্য তা শেষ করতে পারে না, যখন খিদে আর সামলানো যায় না তখন ঘৃণাও কাজে লাগে না, আর একজন লোকের খিদের সামনে কুসংস্কার, বিশ্বাস আর নীতি স্রেফ অস্তিত্বহীন । নগ্নতার কথা আলাদা, সম্ভবত ।


মারামারিটা হয়তো সমষ্টির খিদে থেকে প্রশ্রয় পেয়েছে । সমষ্টির ক্ষমতার কাছে নতি স্বীকার করতে বলপ্রয়োগ বা মতাদর্শিক প্ররোচনার মাধ্যমে ব্যক্তিকে প্ররোচিত করার ক্ষেত্রে; সমষ্টির কাছে আত্মসমর্পণ অবশেষে অভ্যাস, আদর্শ, রীতি আর ঐতিহ্যে পরিণত হয় আর এই ঘটনা কোনো  সংস্কৃতিবিশেষের জন্য অনন্য নয়। মনের ভেতরে যুক্তি পাকাচ্ছিল রাহুল ।


বন্দুকের কুঁদো আর লাঠির মার দিয়ে পুলিশ  যে কজনকে পাকড়াও করতে পারলো,  নিয়ে গিয়ে ঢোকালো ভ্যানে । একজন কনসটেবল গাধাটার কান দুটো ধরে, আরেকজন  পেছনে লাথি মেরে-মেরে ঢোকালো  । পুলিশকে অবজ্ঞা করে, গাধাটাই শুধু ঢুকতে আপত্তি করল না, বিশাল কালো লিঙ্গ ঝুলিয়ে আর দুলিয়ে ভ্যানের ভেতরে চলে গেল ! গাধার ডাক থামতেই ভারি আর আরামদায়ক স্তব্ধতায় ছেয়ে গেল কয়েকশো বছরের পুরোনো গোরস্তানের খণ্ডহর । কিছুক্ষণের নৈঃশব্দ আশেপাশের লোকজনের ছেঁড়া-ছেঁড়া গুঞ্জনে গড়ে তুললো গাধাটার না-বলা উক্তির গিঁট। তারপর লোকগুলোর হাসি, হেঁচকি-হাসি,  যাকে এখানকার মানুষ বলে ঠহাকা, তাদের কথার শব্দাংশগুলোকে কন্ঠনালিতে বুদবুদের আদল দিল । যেমন হয় আরকি, ভিড়ের ন্যাকানাট্যম। এদের ছোটোবেলা থেকে শেখানো হয়নি হাত দুটো কেমনভাবে ব্যবহার করতে হবে । তাই এই মানুষগুলো সম্পদ আর ক্ষমতার বিকৃত ভান থেকে মুক্ত ।


রাহুলের মগজে তখনও গানটা নিঃশব্দে বেজে চলেছে

মোহামেডান স্পোর্টিং তুঝে লাখোঁ সেলাম

তুম তো দেশ কা রাজা বনে সব শালে গোলাম

মাসুম নে লেঙ্গি মারা ল্যাংচামিত্তির ল্যাংড়া হুয়া

রেফরি উসকো ওয়ার্নিং দিয়া

ক্লাব দিয়া ইনাম

বাচ্চু খাঁ নে দারু পিয়া আ-আ-আ-আ


রাহুল সিংহ, মানে রাহু, যে, একটা চিঠি মা-বাবাকে পড়ে শোনাবে বলে নিমপাতা প্রকাশনীর ‘রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারী অসীম গাঙ্গুলিকে লেখা চিঠি-চাপাটি’ বইটা সবে খুলেছিল, তখনই বারান্দা থেকে মারামারি দেখতে পেল আর আঁচ করল ব্যাপারটা হিন্দু-মুসলমানের নয়, কেননা গাধাটার গায়ে উর্দু, বা ফারসি কিংবা আরবি হরফে আলকাৎরা দিয়ে কয়েকটা শব্দ লেখা  । আব্রাহামিক বিশ্বাসের মানুষেরা লিখে রাখা অক্ষরকে ভয় পায়, ক্যাথলিক স্কুলে পড়ার সময়ে টের পেয়েছিল রাহুল । 


একটু আগে, গাধাটা, ওই আলকাৎরা রঙের লিঙ্গ ঝুলিয়ে আর দুলিয়ে চ্যাঁভোঁ চ্যাঁভো ডেকে দৌড়োচ্ছিল ।  রাহুলের মনে হঠাৎ প্রশ্ন জাগলো, গাধাদের লিঙ্গ এতো বড়ো হয় কেন ? অমন কালো হয় কেন, শিশ্ন তাহলে কোথায়, নাকি পুরোটাই শিশ্ন ? বাঘ, সিংহ, চিতা, লেপার্ড, মোষ, ষাঁড়, বাঁদরদের তো অমন পেল্লাই হয় না ; ছোট আর গোলাপি হয় । হাতিদের হয়, হাতিরা নিজেরাই বিশাল, তাই, তবে দুটো প্রাণীর দেহের তুলনা করলে, গাধাদের লিঙ্গকে বড়োই মনে করতে হবে । পূর্ণ আকারের গাধার লিঙ্গ পূর্ণ আকারের ঘোড়ার মতন। মানে দাঁড়ানো অবস্হায় একটা ছোটো গাধার লিঙ্গের দৈর্ঘ্য প্রায় চৌদ্দ থেকে আঠারো  ইঞ্চি হয়, ঘোড়ার চেয়ে লম্বা !  তবু কেন গাধাটা ভয়ে দৌড়োচ্ছিল, নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তর না পেয়ে, রাহুর মনে হলো, যৌনতা সম্পর্কে ওর জ্ঞানগম্যি বেশ সীমিত । হাতি আর বাঘ দশ কিলোমিটার দূর থেকে মাদি-হাতি, বাঘিনীর হিটে থাকার সুগন্ধ বাতাসে পায়, অথচ মানুষের অমন ইন্দ্রিয় নেই ! আশ্চর্য !


পুঁটলিকরা লুঙ্গিটা একটা ন্যাড়ামাথা খালি-গা বাচ্চা ছেলে, প্যান্টের পেছন-ছেঁড়া, তুলে নিয়ে গোরস্তানের সামনের রাজপথ ধরে দৌড় দিয়ে উধাও। পেছন-পেছন দৌড়োলো বাচ্চাটার ছায়া ।



অনিকেত সিংহ, মানে কেতু, রাহুলের দাদা, তার একটা চিঠি পড়া আরম্ভ করল রাহুল , মুম্বাই থেকে অসীম গাঙ্গুলিকে লেখা । অফিসের কাজে বেশ কয়েক মাসের জন্য চাইবাসা থেকে মুম্বাই গিয়েছিল অনিকেত।চিঠিটা পড়ার সময়ে রাহুল সিংহর মনে পড়ল, ভারতে আশ্রয়-নেয়া প্রতিবেশী দেশের এক লেখিকা লিখেছেন যে, “অসীম গঙ্গোপাধ্যায়  মানুষ হিসেবে ধুরন্দর, প্রতিশোধপরায়ণ, এবং কামুক প্রকৃতির ছিলেন। আমরা ভেবেই নিয়েছি বড় শিল্পী, বড় সাহিত্যিক, বড় দার্শনিক মানেই সৎ মানুষ, উদার মানুষ। তা কিন্তু সবসময় নয়।” একজন মহিলা লিখছেন যে লোকটা কামুক ছিল, নিশ্চয়ই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। সেই লোকটা কিনা ছিল অনিকেতের বন্ধু ।


“অসীম,

তোর দীর্ঘ চিঠি পেলাম । তোর মানসিক অবস্হা জেনে যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছি। রক্তিমকে আমরাই এত বড় করে তুলেছি । এর মূল দায়িত্ব তোর, আমার ও রাহুর । এবং এখনো আমার প্রতিটি বন্ধুকে বড় করেই তুলতে চাই আমি । রক্তিমকে লেখার জন্য প্রাথমিক উৎসাহ তুইই দিয়েছিলি । বারেবারে বাহবা দিয়ে “বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ নট” একথা তুইই প্রথম তুলেছিস । অর্থাৎ শুধু এই যে আজ রক্তিম সেকথা নিজে বলছে । চাইবাসায় থাকতেই তোকে বাদ দিয়ে শিল্পের সিংহাসনে বসার একটা ঘোরতর প্ল্যান নীলোৎপল ও রক্তিম অনেকদিন আগেই করেছিল । আমাকেও উপস্হিত থাকতে হয়েছিল এই সব আলোচনায় । নতুন নট্ট কোম্পানি খোলবার প্ল্যান তখনই হয়। মঞ্চস্হ করার ব্যাপারটাও রাহু বারবার তাগাদা দিতে থাকে । আমি বরাবরই রামায়ণ নট্ট কোম্পানি ছাড়তে পারব না জানিয়েছি । নানান সেন্টিমেন্টাল কারণে রামায়ণ নট্ট কোম্পানিকে আমি আমার নিজের যাত্রাদল মনে করি । অনেকের মতন ‘অসীমের নট্টকোম্পানি’ মনে করা সম্ভব নয় । রক্তিম ও নীলোৎপল তোকে বাদ দিয়ে ‘লোচনদাস’ নট্ট কোম্পানি তৈরি করতে পারবে কিনা মনে হয় না । অন্তত রাহু এটা হতে দেবে না। তাছাড়া সমস্ত নীচতার মধ্যেও সূক্ষ্ম বোধশক্তির দংশন রক্তিমও এড়াতে পারবে না । আমাদের মধ্যে একটা ভাঙন গড়ে উঠবে এ আমার বিশ্বাস হয় না । হলে রক্তিমেরই প্রচণ্ড ক্ষতি হবে । টাকাপয়সার দরকার ওর মদ-মাংসের জন্যও, নীলাও আছে, দার্শনিক ঋণও প্রয়োজন, অনিকেত সিংহ ও রাহুল সিংহ ও সেইসঙ্গে অসীমকে বাদ দিলে যে মারাত্মক অবস্হায় ও পড়বে তা ও জানে । আমাকে রক্তিম লিখেছে ‘লোচনদাস’ নট্ট কোম্পানিতে তোর লেখা নাটক অভিনীত হবে । মঞ্চস্হ করতে নাকি মাস দুয়েক দেরি । বরং নীলোৎপলই একটু বেশিমাত্রায় তোর বিরোধী । হয়তো ঈর্ষা, হয়তো অন্য কোনো কারণ । নীলোৎপলকে খুশি রাখতে গিয়ে হয়তো এই সব জটিলতায় রক্তিম বাধ্য হচ্ছে । রাহুলের  অভিমান এই যে তুই ওকে বিন্দুমাত্র স্নেহ করিস না ; নিতান্ত ছেলেমানুষী । সেবার নীলা কানপুরে ভর্তি হতে গেলে রক্তিমকে কানপুরে নিয়ে যাই আমি । সেখানে রাহুল ওকে এই নব্যনাটক সম্পর্কে Convince করে । ছুটকো নট্ট কোম্পানির কাগজে যে নাটকটা লিখেছে , তারই প্লট ও প্ল্যান রাহুল রক্তিমকে দেয় ( দুর্ভিক্ষের আক্রমণ )। ঠিক হয় যে কলকাতায় গিয়ে পুস্তিকা বের করে ব্যাপারটা আরম্ভ হবে । আমরা সবাই থাকবো। তুইও নিশ্চয়ই । আমাদের পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা না করেই রক্তিম কলকাতায় ফিরেই ব্যাপারটা আরম্ভ করে দেয় । এদিকে ট্রেনিং-এ চলে আসতে হয় আমাকে । রাহুল কানপুরে । কলকাতায় রক্তিম একা নানান ভাবে নিজের স্বপক্ষে সিংহাসন গড়ে তোলে ক্রমে । তুই ব্যাপারটায় যোগ না দেওয়ায়, যেটা ভুল-বোঝাবুঝিতে পেছিয়ে গেছে, আজ অবস্হা এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। এটা রাহুলও বলেছে । রাহুল এখন যেকোনো রকমে তোকে চায় । ফলে হয়তো তোকে এই ধরণের আক্রমণ চালাচ্ছে । অদ্ভুত সব জটিলতা । ‘দুর্ভিক্ষ’ নামে একটা কবিতা সংকলন বার করতে চায় ও । আমাকে লিখেছে তোকে পদ্য পাঠাতে বলতে । ব্যাপারটা নিজেই সম্পাদনা করতে চায়, রক্তিমের জটিলতা এড়িয়ে । প্রদীপনও বোধহয় একটা নাটক সংকলন বের করবে । আমি কয়েকটা নাটক পাঠিয়েছি, ওদেরই অনুরোধে ।”

রঞ্জিত সিংহ, রাহু-কেতুর বাবা, এই পর্যন্ত শুনে, রাহুকে বললেন, এ তো বেশ বড়ো চিঠি রে, বাকিটা পরে পড়িস, আগে নন্দার চায়ের দোকানে খবর নে তো কিসের মারামারি । পুলিশ খবর পেয়ে এসেছিল মানে তো সিরিয়াস ব্যাপার, গাধাটার গায়ে কী লেখা ছিল, কেই বা লিখেছিল ।

পুলিশের ভ্যান দেখে চায়ের ঠেক থেকে যে আড্ডাবাজরা পালিয়েছিল মনে হয়, বেঞ্চে আধ গেলাস চা, প্লাস্টিকের প্লেটে আধ-খাওয়া বিস্কুট, দেখে আঁচ করতে পারলো রাহু, তারা ফিরছিল একে-একে।কিছু শহুরে মানুষ ভোরবেলা উঠেই চায়ের ঠেকে আড্ডা মারা জরুরি মনে করে । কারোর কারোর মুখে তখনও ঘুমশেষের হাইগুলো জমে থাকে আর নানা রকমের আওয়াজের সঙ্গে মুক্তি পায় ।

রাহু ঝুঁকে স্হানীয় বুলিতে জিগ্যেস করল, “এই নন্দা, কী হয়েছে রে ? পুলিশ এসেছিল কেন?” এই বুলির সুবিধা হলো যে সবায়ের সঙ্গে তুইতোকারি করতে হয়, আপনি আর তুমি নেই ।

নন্দার লিভ-ইন বউ, যে তার পরিবারের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে শশুরবাড়ির গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছে, ছেলে-পুলেদের সেখানেই ফেলে রেখে, ওপরে মুখ তুলে বলল,”মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছিল ; শুনলুম যে কোনো শিয়া ওই গাধাটার গায়ে কিছু লিখে দিয়েছিল, যা পড়ে পাড়ার সুন্নিরা ক্ষেপে গেছে।”

বাবা শুনছিলেন নন্দার ধুমসি বউয়ের কথা । বললেন, “এ পাড়ায় শিয়া পরিবারের লোকেরা তেমন নেই, যেমন আমাদের আগের পাড়াটায় ছিল । ওদের মারামারি লখনউতে হয় বটে, এখানে কে গোলমাল বাধালো ? অবশ্য পাশের কবরে শুনেছি শের শাহের আফগান সেনাদের গোর দেয়া হয়েছিল । তা শের শাহ কি শিয়া ছিল ?  ও তো আফগানি পুশতুন ছিল, যদ্দুর জানি। আসল কারণ এতো বড়ো কবরের এলাকাটা, দখল করার মারামারি চলছে অনেককাল যাবত ; এখন কেউ নতুন প্যাঁচ কষেছে । কোনো কবর তো আস্ত নেই, চুন-সুরকি ক্ষয়ে ক্ষয়ে টের পাওয়া যায় না, কোথায় কবর আর কোথায় ফকিরদের আস্তানার খণ্ডহর। শবে বরাতের রাত্তিরে প্রদীপ জ্বেলে কেউ-কেউ চুন-সুরকিতে নিজের পূর্বপুরুষকে খুঁজে পায় । হয়তো সিরিয়া আর ইরাকের খেয়োখেয়ি এখানে কয়েকজনের মাথায় সেঁদিয়েছে ।

গোরস্তানের পূর্ব দিকের ঘিঞ্জি নোংরা পেঁকো গলিতে, যেখানে চাঁদ আর সূর্য কোনও ঋতুতে আলো ফেলতে চায় না, সেই গলিতে থাকে মুসলমানরা । দারিদ্র্যের, পেট ভরে দুবেলা না-খেতে পাবার লড়াইটা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মেটাবার চেষ্টা করে । ওই গলির ভেতর দিয়ে রাহু নিজের বিএসএ সাইকেলে চেপে পাঁঠার মাংস কিনতে যাবার সময়ে দেখেছে, খ্যাংরাটে লোকগুলো আর মেয়ে-বউরা উদাসীন বসে আছে । বউগুলো শতচ্ছিন্ন পোশাকে, কোনো সময়ে সেগুলোর কোনও রঙ ছিল, কবে শেষ চান করেছে কে জানে। খাবার টাকাকড়ি নেই তো বোরখার খরচ আসবে কোথ্থেকে । ওদের কেউ নিজেদের শেরশাহের আফগান সেনার বংশধর বলে দাবি করে, কেউ আবার নিজেদের মোগল বাদশাহের পরিবারের বংশধর বলে । রাহুর বাবার কাছে এসে, অনেকে দাবি করে তাদের পূর্বপুরুষরা শের শাহ সুরির সৈন্যবাহিনীতে বাঙালি মুসলমান ছিল । শের শাহ মারা যাবার ফলে তারা অনাথ হয়ে নোংরা গলিতে ঘাঁটি গাড়তে বাধ্য হয়েছে । একজন সাধারণ সেনাকর্মচারী হয়ে নিজের কর্মজীবন শুরু করে শের শাহ মুঘল সম্রাট বাবরের সেনাবাহিনীর সেনানায়কের কাজ পেয়েছিল । শেষপর্যন্ত তাকে বিহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। বাবরের ছেলে মুঘল সম্রাট হুমায়ুন যখন অন্য কোথাও অভিযানে ব্যস্ত , সেই ফাঁকে শের শাহ সুরি বাংলা জয় করে সুরি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে নিজেকে নতুন সম্রাট ঘোষণা করেছিল।ঘিঞ্জি গলির আখছার ঝগড়াঝাঁটি  হয়তো শের শাহের সম্রাট হওয়া নিয়ে । 

গোরস্তানের পশ্চিমে থাকে হিন্দুরা । সেদিকটাতেই রাহুলদের বাড়ি, যদিও প্রধান সড়কের ওপরে,  নিচের তলায় দোকান, স্টুডিও, ডার্করুম। পাশে একটা মন্দির, যখন-তখন লাউডস্পিকার । তুলসীদাসের রামচরিতমানস আর হনুমান চালিসার কী দুরবস্হা, রেকর্ড-ক্যাসেট-সিডির অত্যাচারে । অবিরাম বেজে চলেছে,শ্রীগুরু চরণ সরোজ রজ নিজ মন মুকুরু সুধারি।বরনউ রঘুবর বিমল জসু জো দায়কু ফল চারি।”

 হিন্দুদের এলাকাটা মুসলমানদের ঘিঞ্জি গলির মতন আলোহীন নয় । চালাবাড়ি । কাজের মাসিরা এই চালাবাড়িগুলো থেকে কাজ করতে বেরোয় ভোরবেলা । নানা বাড়িতে কাজ করে দুপুরে ফেরে । বাড়ির পুরুষরাও শ্রমিক বা ফিরিঅলা। ১৯৫৬ সালের চারটে  আইনে ভাগ করা হিন্দু কোড বিল যে কী জিনিস তা কেউই জানে না, সবাই নিজের জীবনকে নিজের আইন মেনে চালায়। এই পাড়ায় স্বামীর দ্বারা প্রহৃত হওয়ার মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই। আপত্তিরও না। যথাযথ কিছু কারণে সোয়ামি  তার মৌগির ওপরে হাত তুলতেই পারে। মৌগিও চটে গিয়ে কারোর সঙ্গে রাত কাটিয়ে আসতে পারে । পরপুরুষ বা পরকীয়া বলে যে কোনো ভাবনা আছে তা এই পাড়ায় খাটে না ।

রাহুলদের কাজের মেয়েকে, যার বয়স তিরিশের কাছাকাছি , পায়খানায় বসে হিসি করতে দেখে ফেলেছিল ও । ঠিক তখনই হিসিটা শব্দ করে বেরিয়ে আসছিল গোলাপি ফাটল থেকে । রাহুলকে দেখে মুচকি হাসি দিয়েছিল মেয়েটা, অপ্রস্তুত হয়নি । রাহুল রাগ দেখাবার ভান করে বলেছিল, দরোজা বন্ধ করে হাগতে-মুততে পারিস তো। রাহুলের মগজে তখন লাবিয়া মেজরা । বাংলায়, বহিস্হ যোনিওষ্ঠ । ওষ্ঠ ! বাঙালিরাও একরকম চিজ, যোনিতে খুঁজে পেলো ওষ্ঠ ।

আফগান আর মোগলদের ঝগড়াঝাঁটি দেখে অনিকেত একবার রাহুলকে বলেছিল, পরীক্ষায় শের শাহ আর শাহজাহান গোলমাল করে ফেলিসনি যেন । একইরকম নাম বলে অনেক ছাত্র গোলমাল করে ফ্যালে।

চায়ের ঠেকটা রাহুর ছোটোকাকা, রঞ্জিত সিংহের ছোটো ভাই তোতোন সিংহ, দোকানের প্যাকিঙ বাক্স নন্দাকে সাপলাই করে, বছর আষ্টেক আগে, বসিয়েছিল, যাতে দিনে তিনবার বিনে পয়সায় চা খেতে পারে । ছোটোকাকা চলে গেছে দেশের বাড়ি শ্যাওড়াফুলিতে, বাচ্চাকাচ্চা হয়নি । নন্দার দোকান চায়ের ঠেক থেকে প্রোমোশান পেয়ে নানা টুকিটাকির দোকান হয়ে উঠেছে । এখন নন্দা সারাদিন মদ খেয়ে পড়ে থাকে আর ওর লিভ-ইন বউ ঠেকটা চালায় । চব্বিশঘন্টার মাতালও চারটে বাচ্চা পয়দা করে ফেলেছে পাঁচ বছরে । চায়ের ঠেক হয়ে রাহুলদের সুবিধা হয়েছে । কোনো প্রোমোটার যদি গোরস্তানটা হাতিয়ে বাড়ি বা দোকানপত্তর তোলার তাল করে, তাহলে নন্দার দোকানের পাশ দিয়ে যাতায়াতের রাস্তা রাখতে হবে ।

রাহুর মা বললেন, “যাকগে, তুই কেতুর চিঠির বাকিটা পড় । কেতু যে উড়নচণ্ডী তা আমি আগেই জানতুম। এখন চাইবাসায় থিতু হয়ে চ্যাঙড়া আর বেকার বন্ধুদের টাকা বিলোচ্ছে । রক্তিম নামে ছোঁড়াটা ওর বাড়িতেই থাকে শুনেছি । যত্তোসব পরগাছাদের এনে জুটিয়েছে । তখনই তোর বাবাকে বলেছিলুম কেতুকে কলকাতার কলেজে ভর্তি করার দরকার নেই, এখানে পাটনায় পড়ুক, কিংবা লখনউ গিয়ে হোস্টেলে থেকে কলেজের পড়াশুনা করুক।

চিঠির বাকি অংশ পড়া আরম্ভ করার আগে  রাহু বলল, চাইবাসা জায়গাটা আবিষ্কার করেছে কেতু, যাকগে, নাও শোনো বাকিটা।

“খ্যাতির প্রতি রক্তিমের প্রলোভন চিরদিনই আছে । ওর পরিবেশ অনুযায়ী হয়তো এটা স্বাভাবিক । আসলে মানুষ না হয়েও শিল্পী হওয়া যায়, এটাই যতো গণ্ডগোলের। ছোটোলোক, নীচ ও চোরও শিল্পী হতে পারে । শিল্পী হওয়ার জন্য বরং এসব ব্যাপার সাহায্যই করে । ফলে বন্ধুত্ব, মনুষ্যত্ব নিয়ে গণ্ডোগোল বাধে ।

এক মুহূর্তেই হয়তো রক্তিমের সমস্ত দম্ভ, অহংকার, নীচতা ভেঙে চুরমার করে দেওয়া যায় বাঙালি সমাজের কাছে । এর উপযুক্ত নজিরের অভাব নেই আমার কাছে ; আমার কতো জিনিস ও লোপাট করে দিয়েছে, বড়োজেঠার দেয়া রোলেক্স ঘড়িটাও । দেখেছিস তো, সেই থেকে আমি ঘড়ি পরি না । কিন্তু রক্তিমের বিরুদ্ধে বা কারোর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় কোনোদিন । আমার কতকগুলো নিজস্ব আদর্শ আছে, তা ভুল বা ঠিক হোক আমি তা নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই । প্রতিক্রিয়া হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না ।

রামায়ণ নট্ট কোম্পানির জন্যও তোর যে আদর্শ, তাকে ধরে রাখতে হবে তোকে, আশপাশের কারো চিৎকারে বিব্রত হওয়ার কিছুই নেই রামায়ণ নট্ট কোম্পানি আমরা চালিয়ে যাবোই । আমি ব্যক্তিগতভাবে শিল্পের চেয়ে মানুষকে বেশি ভালোবাসি । রক্তিম অভিনেতা  হিসেবে অনেক বড়ো ; ও মানুষের চেয়ে শিল্পকে অনেক অনেক বড়ো মনে করে । আমি শিল্পকে পৃথক মনে করতে পারি না ।

প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গী পৃথক হওয়াই স্বাভাবিক এবং উচিতও । রক্তিম  বা নীলোৎপলের মতো পদ্যনাটক না লিখলে নাট্যকার নয়, এসব ছেলেমানুষীতে আমি বিশ্বাস করি না । রক্তিমের কিছু-কিছু পদ্যনাটক যেমন আমাকে উন্মত্ত বিহ্বল করে, রশ্মিরঞ্জনের কোনো কোনো দর্শনে আমি তেমনই প্রস্ফূট হয়ে যাই । সেই মুহূর্তে রশ্মিরঞ্জনকে আমার সমস্ত সত্তার মালিক মনে হয় । কি করে তাকে অস্বীকার করি ? তেমনই হয়তো এমনও কেউ আছেন যাঁর হরিপদ রায়ের কাতুকুতু দেয়া পদ্যে আরোগ্য হয় । এসব শ্রেষ্ঠত্ব স্হির করার আমরা কে ? যাঁরা পদ্যনাটক করেন বা দর্শন পড়েন তাঁদের ওপরই, সময়ের ওপর, এসব ছেড়ে না দিয়ে নিজেদের ঢাক ঢোল নিয়ে কাড়াকাড়ি করার কি যে সুখ আমি বুঝি না । এসব চালিয়ে গেলে রক্তিম অনেক বড়ো ভুল করবে । যতো বড়ো হতে পারে ও তাকে নিজ হাতে খর্ব করবে । হয়তো ওই বিটনিক কবির বিশ্বজোড়া নাম দেখে ও কিছুটা উত্তেজিত হয়েছে । একথা রক্তিম কয়েকবার বলেওছে আমাকে ।

জুনে পনেরো তারিখে এখান থেকে রওনা হয়ে সতেরো তারিখে চাইবাসা পৌঁছোব। তুই আয় না তখন । রক্তিমকেও আসতে বলব । একসঙ্গে তিনজন থাকলে অনেক ভুল বোঝাবুঝি ভেঙে যাবে আপনা থেকেই । চারিদিকে বেড়িয়ে বেড়ানো যাবে ।

চিঠি দিস । রাহুলদের বিরুদ্ধেই না হয় কয়েকটা প্রচণ্ড গদ্য ও পদ্য লেখ । রাহুলদের একটা বিশেষ পুস্তিকা বের করব আমি ; রাহুলও রাজি হবে । আসলে এই সব আন্দোলনের চেয়ে হৃদয়ের আন্দোলনটাই আগে দরকার ।

সারা জীবন একাকীত্বের দুর্ভোগ হয়তো এভাবেই আত্মসাৎ করে যেতে হবে আমাকে । তবু এবং হয়তো এই জন্যেই, শিল্পের চেয়ে আমি মানুষকে পৃথক করতে পারি না, বড়ো মনে করার বা ছোট মনে করার কারণ খুঁজে পাই না ।

অনিকেত সিংহ” 

—হ্যাঁরে, কেতু বারবার চাঁইবাসায় পোস্টিঙ নেয় কেন ? সারা জীবন একাকীত্বের দুর্ভোগ, ও আবার কেমন কথা ? চিঠিটা পড়া শেষ হলে, রাহুলকে জিগ্যেস করলেন ওর বাবা রঞ্জিত সিংহ।


রাহুল বাবার প্রশ্নের উত্তরটা মগজের মধ্যে সাজাচ্ছিল, ততোক্ষণে ওর মা বলে উঠলেন, “ওর কলেজের চ্যাঙড়া বেল্লিক বন্ধুগুলো এসে বেলেল্লাপনা আর গুলতানি করে, সবকটা তো বেকার আর হাঘরে, কেতুর ঘাড়ে বসে খায় ; এখন বম্বেতে ট্রেনিঙে একলা রয়েছে বলে বোধ হয় মনকেমন করছে সবায়ের জন্য ।” 


রাহু বলল, চাইবাসা জায়গাটা আবিষ্কার করেছে কেতু । যদি কেতু চাইবাসায় বারবার পোস্টিঙ না নিতো, তাহলে বাংলা কবিতায়, উপন্যাসে, ফিলমে চাইবাসা কোনোদিনও দেখা দিতো না । নিমডি টিলার ওপর যে চালাবাড়ি ভাড়া নিয়েছে কেতু, ইংরেজ আমলে ভাটিখানা ছিল, তার একটা ঘরে একজন আবগারি ইন্সপেক্টারকে থাকতে দিয়েছে, যাতে ও ট্যুরে গেলে দামি জিনিসপত্র ওর ঘরে রেখে যেতে পারে । বন্ধুগুলো তো ওকে ভালোবাসে না, যখন-তখন কলকাতা থেকে এসে ঘাঁটি গাড়ে, কেতু বাড়িতে না থাকলেও আবগারি ইন্সপেক্টারের কাছ থেকে চাবি নিয়ে দল বেঁধে কেতুর ঘরে থাকে । কেতুর আরদালি গুলাব মুণ্ডাকে দিয়ে মহুয়ার মদ আনিয়ে টঙ হয়ে নাচনকোদন করে। ওরা কেউই কিন্তু বাঁকুড়ায় মহানন্দ বাগচির ডেরায় যায় না, যখন কিনা পাশেই বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির মন্দিরগুলো । মহানন্দ বাগচিই তো রামায়ণ নট্ট কোম্পানি পত্তন করেছিলেন । কেতুর বন্ধুরা চাইবাসায় ওর বাড়িতে দল বেঁধে থাকে, অথচ কেতু কলকাতায় গেলে কোনো বন্ধু ওকে নিজের বাড়িতে থাকতে বলে না ; কেতু সেই আমাদের আদিবাড়ির খণ্ডহরের ঘরে আশ্রয় নেয় আর পাইস হোটেলে খায় । পাইস হোটেলে আমি দাদার সঙ্গে বা একলা অনেকবার খেয়েছি, কলাপাতায় ভাত, মাছ, বেগুনভাজা, শুক্তো, রুইমাছের ঝোল, দারুন স্বাদ । আর অতি সস্তা।


অনিকেতের চালাবাড়িটা কিন্তু আইডিয়াল জায়গায়, বেশ উঁচুতে, সেখান থেকে অনেক দূরের গ্রামগুলো দেখা যায়, হো আর মুণ্ডা বউরা কাঁখে করে জল নিয়ে যায় সবুজের ভেতর দিয়ে । কেতুদের জলও দিয়ে যায় একজন বউ । গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জঙ্গলের গাছগাছালি কোন কোন রোগ সারাবার জন্য লাগে তা কাজে লাগিয়ে আয়ুর্বাদাচার্য হয়ে গেছে কেতু, শিবকালী ভটচাজের বইয়ের পাতায় নোট লিখে রাখে ।


সবুজ জঙ্গলের অজস্র গাছে ভরা চাইবাসার পাহাড়ভূমির আর এক আকর্ষণ আদিবাসীরা । পশ্চিম সিংভূমজেলার সদর ছিল একসময়ে, এই চাইবাসা, অনিকেতের প্রিয় আত্মনির্বাসনের কারাগার। ছোট ছোট টিলা, ভিলা ধর্মী বাড়িঘর, শাল, সেগুনে ছাওয়া উঁচুনিচু পথঘাট যেন গঁগার আঁকা তাহিতির ছবি এই চাইবাসা। ওঁরাও, মুন্ডাদের বাস। গোধূলির আগুন দিয়ে দিগন্তের রাংঝাল করা প্রান্তর । বাঙালিয়ানাও ছিল ইংরেজদের আমলে কেননা বিহার তখন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে ছিল ; কলকাতায় পড়াশুনা করে ইংরেজ সাহেবদের পেছন-পেছন ছড়িয়ে পড়েছিল বাঙালিরা । কিন্তু তারা চাইবাসা আবিষ্কার করতে পারেনি, যেমনটা অনিকেত সিংহ করেছে।

 

চাইবাসায় আছে দিঘির পর দিঘি, নাম তার বাঁধ। মধুবাঁধ, রানিবাঁধ, শিববাঁধ, জুবিলি বা সাহেববাঁধ। এরাও অনিকেতকে ধরে রেখেছে । আর আছে সুবর্ণরেখার শাখা বোরো নদী, সেও নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী জল আনে বা আনে না । চাইবাসার আরেক আকর্ষণ মুঙ্গালাল রুংটা গার্ডেন। রুংটাদের আদিবাড়ি মধুটোলার কাঁকরপথের একেবারে শেষে । কাছাকাছি  গুরুত্বপূর্ণ গঞ্জ বড় জামদা। চাইবাসা থেকে সাতাত্তর কিলোমিটার। বন আর পাহাড়ে ঘেরা জামদা। ঝাড়খণ্ড আর ওড়িশার এক বিচিত্র মেলবন্ধন ঘটেছে জায়গাটায়। সারান্ডায় ঢোকার মুখেই  বড় জামদা। ঠাকুরানি পাহাড়ের নীচে ওড়িশার শহর বারবিল। হাওড়া-বারবিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেস ধরেই চাইবাসায় পৌঁছে যেতো অনিকেতের কলকাতার বন্ধবান্ধব । এ ছাড়া কলকাতার বাবুঘাট থেকে রোজ ডিলাক্স বাস যায় চাইবাসায়, বড় জামদা হয়ে কিরিবুরু। অনিকেতের আতিথ্যের কথা কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা দল বেঁধে  চাইবাসা গেছে নিমডি টিলার বাড়িতে থাকতে । বাবুঘাট থেকে চাইবাসা যাওয়ার বাসও রয়েছে রোজ বিকেলে।অনিকেত কেন যে ডায়েরি রাখেনি ? কতো জরুরি ইতিহাস লুকোনো থেকে গেছে । কোন-কোন যুবতীর সঙ্গে কোন-কোন কবি কেতুর বাড়িতে কয়েকটা রাত কাটিয়ে গেছে তা রয়ে গেছে অনিকেতের স্মৃতিতে । অনেক সময়ে সেসব কথা বেফাঁস বলে ফ্যালে রাহুলকে ।


রাহুর মা বললেন, ওই অসীম গাঙ্গুলি কলেজে পড়ার সময়ে এবাড়িতে এসেছিল, মনে নেই তোর ? কেতু ওকে দিশি মদ খাইয়েছিল আর রাতভর বারান্দার নর্দমায় বমি করেছে । লেবুর শরবত খাওয়ালুম, তারপর ঘুমোতে গেলো । তোর হিপি বন্ধুগুলো বরং ভালো । মদ-ফদ খায় না, গাঁজা-ভাঙ টেনে নেপালে রওনা দেয়। তবে ওদের মেমগুলো বড্ডো গায়ে পড়া, তোর সঙ্গে এতো মাখামাখি করতো যে কাজের মেয়েটা পর্যন্ত আমাকে নালিশ করেছিল । বিটনিক সাহেবটা তো ল্যাংটো হয়ে কলতলায় চৌবাচ্চা থেকে মগে করে জল নিয়ে চান করছিল ; ওপর থেকে তোয়ালে ফেলে বললুম ওকে যে এটা পরে চান করো । সাহেব-মেমরা যে মেঝেয় বসে হাত দিয়ে ডাল-ভাত-তরকারি খেতে পারে সেই প্রথম দেখলুম । আমি তো জানতুম ওরা ছুরি কাঁটাচামচ ছাড়া খেতে পারে না । কাগজ ছাড়া ছোঁচাতে পারে না ।


রাহুর বাবা বললেন, মা বলছিল যে দেশের বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে কেতুর বন্ধুরা এসে আড্ডা মারতো কলেজে পড়ার সময়ে । সিগারেট আর মদের গন্ধ পেতো । কেতু জানতো ওর ঠাকুমা অতো ওপরে উঠতে পারবে না, তাই ওই ঘরটা বেছে নিয়েছিল । 


মা তো কেতুর সবকথা জানেন না । উনি জানেন না কেন কেতু বিষণ্ণ হাসির আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে যা ওকে ছায়ার মতো  সারাজীবন অনুসরণ করছে । ডুবে গেছে এমন এক বধির নীরবতায় যে, তাদের কোনোরকম শব্দ দিয়ে দমিয়ে রাখতে শেখেনি । একটা রহস্যময় হাসির ঝলকানি  মাঝে মধ্যে কেতুর মুখময় ছড়িয়ে পড়ে যা দেখে মনে হয় তা কেতুর বন্ধু  রক্তিম চাটুজ্যের ব্যর্থ প্রেমের কবিতা থেকে ধার করা । কেতুর এক গোপন বিপজ্জনক প্রেম আছে। গোপনীয়তার মূল্য নির্ভর করে সেই লোকেদের ওপর যাদের থেকে এটি লুকানো হয়েছে । মা আর বাবার কাছে চিরকাল গোপন থেকে গেছে কেতুর প্রেম । এই বিপজ্জনক প্রেমই অনিকেত সিংহকে বাধ্য করেছে চাইবাসা আবিষ্কার করতে ।  


রাহু প্রথম জেনেছিল গৌরীর বোন নীলার কাছ থেকে, যে ওদের পাটনার বাড়িতে থাকতো, এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা স্নাতকোত্তর পড়ার সময়ে ।নীলা বলেছিল,  না, এভাবে চলবে না, চলতে পারে না । ও নিজেই ধরা পড়ে গিয়েছিল দিদি গৌরীর কাছে , রক্তিম চাটুজ্যের সঙ্গে হৃদ্যতার জন্য । রক্তিম চায়নি নীলা পাটনায় রাহু-কেতুদের বাড়িতে থাকুক । রক্তিমের সন্দেহ যে নীলাকে পাঠানো হয়েছে যাতে রাহুল ওকে পছন্দ করে। দিদি গৌরী নীলার সঙ্গে রক্তিমের প্রেমের কথা জানে । চাইবাসায় নীলার কলেজ যাবার আর ফেরার সময়ে রক্তিম চাটুজ্যে কোনো গাছের ডাল ভেঙে গাইতে গাইতে যেতো কলেজের দিকে, শুনেছিল যে হো আর মুণ্ডা যুবকেরা তাদের হবু বউয়ের জন্য অমনটাই করে । তবে তারা নাচতে নাচতে যায় । পথ ফাঁকা থাকলে রক্তিম চাটুজ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত  গেয়ে নাচতে নাচতে যেতো । অনিকেতের সঙ্গে মাঝে-মাঝে আদিবাসীদের গ্রামে যেতো রক্তিম । মানুষ তার পরিবেশ আর কালখণ্ডের দয়ায় বাঁচে । নীলাকে রক্তিম একদিন বলেছিল, ভালো হওয়ার শর্ত মেনে টিকে থাকার চেয়ে খারাপ হওয়া বেছে নেওয়া একজন মানুষের পক্ষে ভাল । গাছের ডালগুলো নীলা ওদের বাড়ির সামনের রাস্তার ধারে রোজ সন্ধ্যাবেলা পুঁতে দিতো ।


রাহু নীলাকে বলেছিল, তোমার কথা শুনেছি অনিকেতের কাছে,  । রক্তিমের প্রতি তোমার শ্রদ্ধা-ভালোবাসার কথাও জানি । এও জানি যে রক্তিমের কাছ থেকে তোমাকে দূরে পাঠাবার জন্য অনিকেত আর অপূর্ব ব্যানার্জি ষড় করে এই ব্যবস্হা করেছেন । আমার মা কিন্তু তোমাকে পছন্দ করেন না, কেন জানো ? তুমি নাকি সংসারের কোনো কাজ পারো না । ভাত গালতে জানো না, রুটি বেলতে পারো না, ডিম ফাটাতে পারো না, সবজি কাটতে পারো না, ছাদে কাপড় শুকোতে দিতে পারো না, উনোনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকো অথচ দুধ উথলে পড়ে যায়, একটা দামি টেবল ল্যাম্প ভেঙে ফেলেছো।


নীলা বলেছিল, জানি, দামি সুন্দর সোনালী ল্যাম্পটা টেবিল থেকে পড়ে ভেঙে গিয়েছিল । এতো ভয় পেয়েছিলাম, আপনার বাবা-মা কী ভাবলেন জানি না, আমাকে বলেননি কিছু এ-ব্যাপারে ; শুধু বলেছিলেন যে টেবলল্যাম্পটা আপনার পছন্দের, সান্মানিক স্নাতক পড়ার সময়ে কিনেছিলেন । আপনার মায়ের অপছন্দই আমার সৌভাগ্য । জানেন তো, দিদি গৌরী  মুখ ফুটে কিছু বলে না। দিদি আপনার দাদা অনিকেতকে ভালোবাসে, সত্যিকার ভালোবাসা । দিদিকে আজকাল বেশ অচেনা মনে হয়।  দিদি যেন অনিকেতদার আলোয় একটু-একটু করে বদলে বদলে যাচ্ছে ।  আপন অন্তর্বেদনায় ভুগছে ।  দিদি এক অদ্ভুত আর অপ্রতিরোধ্য প্রেমের জটিল আবর্তে জড়িয়ে পড়েছে । আমি সাবধান করেছিলাম  দিদিকে  তবু কোনও লাভ হয়নি । দিদি  নিজে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, ছোটোবেলা থেকে দেখছি তো, তবু এগিয়ে গেছে অনিকেতদার দিকে । দিদির উচিত ছেলেপুলে নিয়ে শশুরবাড়িতে  জ্যোতিদার কাছে চলে যাওয়া  । দিদির বরও কেমন ? বউ আর ছেলেপুলেকে চাইবাসায় ফেলে রেখেছে ।  দিদি কেমন করে ওঁকে ঠকাচ্ছে বলুন তো !  বাবাও গৌরী-অনিকেতের সম্পর্কটা আঁচ করেছেন । ভেবে পাচ্ছেন না কেমন করে দুজনকে আলাদা করবেন । রাহুল, তুমি বরং তোমার বাবা-মাকে জানিয়ে দাও যাতে অনিকেতদাকে চাইবাসা থেকে অন্য কোনো জেলায় ট্রান্সফারের ব্যবস্হা হয় । 


বাবা-মাকে কিছুই জানায়নি রাহু । অনিকেত যা ভালো বোঝে করবে । রাহু তো অনিকেতের চেয়ে পাঁচ বছরের ছোটো । রাহুর প্রেমের ঘটনাগুলো একেবারে ভিন্ন, আদপে প্রেমই নয় সেগুলো, ওর সম্পর্কগুলোর নতুন পরিভাষা দরকার । রাহুলের পূর্বলক্ষণমূলক চোখের পাতার কাঁপুনি দেখে, এমনকী বাবা-মাও জেনে যান । 


গোরস্তানের ধারে চেঁচামেচি শুনে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো রাহু আর ওর বাবা-মা । ফর্সা রোগাটে ছেঁড়া আর নোংরা চুড়িদার পরা একটা বউ চেঁচাচ্ছিল । বোঝা গেল ও লুঙ্গির খোঁজে এসেছে, কেউ ওকে বলে থাকবে ওর বরকে ল্যাংটো করে নিয়ে গেছে পুলিশ । বউটা চেঁচিয়ে বলছিল যে ওই একটাই তো লুঙ্গি ছিল ওর বরের, সেটাও চোরে চুরি করে নিয়ে পালালো ; এখন থানায় ওকে ল্যাংটো করে বসিয়ে রেখেছে । লজ্জায় আসতে পারছে না । বুঝেছে যে লুঙ্গির প্রয়োজন তরোয়ালের চেয়ে বেশি ।


রাহুলের মা বললেন, তোর একটা পুরোনো ফুলপ্যান্ট দিয়ে দে, যেটা আঁট হয়ে গেছে বলে আর পরিস না। রাহুলের বাবা বললেন, লোকটা ফুলপ্যান্ট পরলে গলির পড়শীরা হাসাহাসি করবে । তার চেয়ে আমার একটা লুঙ্গি দিয়ে দাও । 


নন্দার লিভ-ইন বউকে ডেকে ওপর থেকে একটা লুঙ্গি ফেলে দিয়ে রাহুলের মা বললেন, ওকে বল লুঙ্গিটা থানায় নিয়ে গিয়ে বরকে পরিয়ে বাড়ি ফেরত আনতে । লুঙ্গি শব্দ শুনে আর রাহুর মায়ের হাতে সেটা দেখে মুসলমান বউটা নিজেই এগিয়ে এসে লুফে নিলো আর দৌড় দিলো থানার দিকে । তার পেছনে দৌড় দিল আওরংজেব পাংচারওয়ালার বউ, সে চুড়িদার পরেনি, শাড়ি ব্লাউজে, হয়তো কেউ দিয়ে থাকবে। ঘিঞ্জি গলি দিয়ে মাংস কিনতে যাবার সময়ে সাইকেল পাংচার হয়ে গেলে আওরঙজেবের দোকানেই সারাতো রাহুল। এখন স্কুটার কিনেছে বলে ঘুরপথে মাংস কিনতে যায় । নন্দার লিভ-ইন বউয়ের জিভে প্রচুর গুজব জমে থাকে , এখন আরও কয়েকটা পরত জমছে ।


কেতু মানে অনিকেত সিংহ, রাহুলের দাদা । ওরা দুই ভাই, বোন নেই । জাঠতুতো-খুড়তুতো বোনেরা আছে, পুরোনো পাড়ার বাড়িতে। রাহুল, যার ডাক নাম রাহু, বলল, তোমাদের কতোবার বলেছি জায়গাটার নাম চাইবাসা । চাঁইবাসা নয় ।


—চাঁইবাসা হোক বা চাইবাসা, ওই একই । ওখানে তো অপুর শশুরবাড়ি, তা অপু তো অতো যাতায়াত করে না । যায়ই না বলা যায় । কেতুর বাবা ধুতির কোঁচা গুঁজতে-গুঁজতে বললেন । তারপর যোগ করলেন, তা চ্যাঙড়া হাঘরে বন্ধুগুলো তো অন্য জেলায় পোস্টিঙ হলেও গিয়ে ওর ঘাড়ে বসে মাসকতক খাবে । ভর্মা সাহেব বলছিলেন, মুঙ্গেরের মতন ভালো জায়গা্য় পোস্টিঙ নিলে মাছের ব্যবসা থেকেই খাইখরচ উঠে আসে। চিরকাল, সেই ইশকুলের সময় থেকে, বন্ধু না হলে ওর চলে না, ওর আবার কীসের একাকীত্বের দুর্ভোগ, শুনি?


রাহু আবার মনের ভেতরে প্রশ্ন সাজাতে আরম্ভ করেছিল । বাবা তো চিরকাল ঘুষ নেয়া-দেয়ার বিরুদ্ধে, তাহলে খাইখরচ শব্দে ঠিক কোন বার্তা দিতে চাইলেন । অনিকেত ঠিকই খাইখরচ তুলে নিচ্ছে, বিহারে সরকারি অফিসাররা যা করে অনিকেতও তাই করছে । আর সারাজীবন একাকীত্বের দুর্ভোগ, চার গণ্ডা বন্ধু ঘিরে থাকলেও হয়, মা-বাবাকে আসল কথাটা তো বলা যাবে না । 


অনিকেত বলেছিল, মুঙ্গেরে বিশাল ঝিল আছে মছলি তালাও নামে, তা থেকে জেলেরা আর নেতারা যেমন ঘুরপথে আয় করে, তেমন মৎস্য দপতরের সরকারি কর্তারাও ।  আরে এতো ইডিয়ট নেতাদের সামলাতে হয়, তাদের সামলাতেই দিন কাবার, তার ওপর জেলেদের আবদার । এর চেয়ে যা মাইনে সরকার দেয় আর যেটুকু উপরি অন্য জেলায় পাওয়া যায়, চাইবাসায় ঝিলগুলো থেকে তার চেয়ে বেশিই খাইখরচ ওঠে, তাইই যথেষ্ট । তাছাড়া মুঙ্গের হলো দিশি পিস্তল আর বন্দুক তৈরির বেআইনি ঘাঁটি ; নেতাদের কেউ চটে গেলেই চেলাদের লেলিয়ে দেবে ।


চাইবাসায় লুপুংগুটু নামে একটা মজার প্রস্রবণ আছে  । গরমকালে কিছুদিন সম্পৃক্ত স্তরে জলের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় কিংবা জলপীঠ সাময়িক সম্পৃক্ত স্তরের নীচে চলে গেলে  শুকিয়ে যায়। বৃষ্টি হলে তা আবার সচল হয়ে ওঠে। চাইবাসা জেলার লুপুংগুটুর প্রস্রবণমালার কয়েকটা বর্যাশেষে শীতের শুরুতে শুকিয়ে যায়। রাহুকে দেখিয়েছিল কেতু, যখন রাহু প্রথমবার চাইবাসায় গিয়েছিল । অনিকেতকে নিয়ে লুপুংগুটুতে কতোবার গেছে গৌরী ।


–না, না, বাবা-মাকে বলল রাহুল, ওখানে বিরাট-বিরাট ঝিল আছে,  মধুবাঁধ, রানিবাঁধ, শিববাঁধ, জুবিলিবাঁধ, কেতুর জন্যই ওগুলোতে এখন নানা রকমের প্রচুর মাছ পাওয়া যায় । মাছেদের পিটুইটারি গ্রন্হি পিষে সেটা ইনজেক্ট করে জেলেদের জন্যে একগাদা নার্সারি আরম্ভ করেছে কেতু । 


–পিটুইটারি গ্রন্হি ? সেটা আবার কী ? কেতু যে কী-কী করে বেড়ায় ! বললেন মা ।


রাহুল বোঝালো মাকে, হ্যাচারির পুকুরে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটাবার জন্য মা আর পুরুষ মাছের দেহে নির্দিষ্ট মাত্রায় পিটুইটারি গ্রন্হি-গুঁড়োনো রস সিরিঞ্জ দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এতে মাছের দেহে উত্তেজনা আসে। এ সময় মাছের প্রজনন হয়। প্রাকৃতিক এই হরমোন ব্যবহারে মাছের জীবনচক্রে কোনো খারাপ ফল হয় না । কেতু তো হো আর মুণ্ডা জেলেদের কেমন করে এটা করতে হবে দেখিয়ে হিরো হয়ে গেছে । কলকাতার চেতলা মাছের হাট থেকে নানা জিনিস কিনে এনে জেলেদের মাঝে বিলোয় । 


–তা তো সব জেলাতেই করতে পারে । তাই বলে বারবার ঘুরে ফিরে চাইবাসায় পোস্টিঙ নেয় কেন ? জানতে চাইলেন বাবা।


রাহুল ভাবলো, বলবে কী যে অনিকেত সিংহ চাইবাসায় গিয়ে এক বিবাহিতা নারীর প্রেমে পড়েছে । তাঁর নাম গৌরী । নীলার বড়দি । নীলা নিজেও তো রাহুর বাবা-মাকে ভাসা-ভাসা ইশারা দিতে পারতো । অবশ্য বাবা-মা জানতে পারলে নিজেদের সামলাতে পারবেন না । ওনারা মেনে নিয়েছেন যে রাহুটা বজ্জাত, ইসকুলে পড়ার সময় থেকে টাচি-ফিলি প্রেম করছে, তারপর হিপি মেয়েদের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করতো, তা কাজের মেয়েটাও জানে, সিংহ জমিদারবাড়ির বদরক্ত  পেয়েছে, ওকে রাস্তায় আনা যাবে না ; কিন্তু অনিকেত ! ও তো সোজা পথের মানুষ ।


অনিকেতকে চাকরিটা পাইয়ে দিয়েছিলেন ভর্মা সাহেব, রাহু-কেতুর বাবার, ঠিক বন্ধু নয়, আবার খদ্দেরও নয়, ফোটোগ্রাফি ভালোবাসেন, রাহু-কেতুর বাবার ফোটোগ্রাফির দোকানে আসেন, সময় কাটাতে। চাকরিটার জন্যে টেলিগ্রাম করে ডেকে পাঠিয়ে অনিকেতের জার্নালিজম পড়া আধখ্যাঁচড়া করে ছাড়িয়ে এনে সরকারি চাকরির আরামপ্রদ চেয়ারে বসিয়েছেন । সিটি কলেজ থেকে বিএসসি করার পর জার্নালিজম পড়ছিল ।  কেতুর বিভাগে কোয়ার্টার নেই বটে কিন্তু চাকরের সুবিধে আছে, জিপগাড়ি আর ড্রাইভারের সুযোগ আছে । দশটা-পাঁচটা করতে হয় না, প্রতিদিন দপতরে না গেলেও চলে, দপতর নিজেই ওর বাসায় চলে আসে ।  


—কেতুর চেয়ে অপুর চাকরিটা ভালো । বললেন মা । তারপর যোগ করলেন, কী এক মশা মারার চাকরি, অ্যানোফিলিস মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হয়, তাতো আমার বাবার সাহায্যে ডোনাল্ড রস সাহেবটা জানতে পেরেছিল । 


—এখন ছাড়ো, নোবেল পুরস্কারের গল্প, রোনাল্ড রসকেও অনেক ধরাধরি যোগাযোগ লেখালিখি করে নোবেল পুরস্কার পাবার চেষ্টা করতে হয়েছিল । রবিঠাকুর কি কম দৌড়ঝাঁপ করেছিলেন নোবেলের জন্যে? এখনকার কবিগুলো তো অশিক্ষিত, ইংরেজি জানে না, যোগাযোগ করতে পারে না, রবিঠাকুরের মতন অনুবাদও করতে পারে না । সে যাকগে, যা বলছিলুম, অপুর শশুরবাড়ি চাঁইবাসা, তবু ওদিক মাড়ায় না, আর অপুর বিয়েতে বরযাত্রী গিয়ে কেতু চাঁইবাসার পাহাড়-জঙ্গলের নেশায় আটকে পড়ল !


—হ্যাঁ, পলি বলছিল, অপু যেতেই চায়না । কেতুর মা বললেন ।


অপুর বউয়ের নাম পলি, গৌরীর পরের বোন । মোক্তার চক্রবর্তী মশায়ের মেজ মেয়ে, ফর্সা, সব কয়টা মেয়ের মধ্যে পলি আর নীলাকে ভালো দেখতে। পলি বেশ ঢ্যাঙা, ফর্সা, গড়ন-পেটন দেখে এক পলকেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল অপুর্ব ব্যানার্জির । পলির পরের বোন মলিও ফর্সা, তবে নীলার মতন সুন্দরী নয় । বাদবাকি বোনগুলোর নাকের ওপর দিয়ে স্টিমরোলার চলে গেছে । সবচেয়ে ছোটো বোন, যার নাম প্রীতি, তার নাকের ওপরে গিয়ে থেমে গেছে স্টিমরোলারটা । একইভাবে, তিন ভাইয়ের সব চেয়ে ছোটো ভাইয়ের নাকের ওপরে গিয়ে থেমে গেছে । চক্রবর্তী মশায় বা ওনার স্ত্রী, কারোর তো অমন নাক নয় ! 


অপূর্ব ব্যানার্জি বলেন, ওটা চাইবাসার জলের প্রভাব হে, পলি প্রেগনেন্ট হলে ওকে চাইবাসায় পাঠাবো না, আমি নাকচ্যাপ্টা ছেলে বা মেয়ে চাই না । 


অনিকেত যখন ভাগলপুরে পোস্টেড , ওদের অফিসারদের মেসে রুমমেট ছিলেন অপূর্ব । অপূর্বর দাদা চাইবাসার কাছে এক সিমেন্ট কারখানায় ইনজিনিয়ার । মেয়ে পছন্দ করার জন্য অপুকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। অপু নিজের সঙ্গে কেতুকে নিয়ে গিয়েছিল ।


কেতুকে আকর্ষণ করলেন পলির দিদি, যাঁর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল  ইনজিনিয়ার জ্যোতির্ময়ের সঙ্গে। পলির দিদি আকর্ষিত হলেন কেতুর দিকে । দুজনের চোখাচোখিতে, সারা জীবনের জন্য, আবিষ্কার হলো চাইবাসা নামের এক আদিবাসী স্বর্গ । যে স্বর্গ দেখার জন্য কলকাতা থেকে কতো কবি, লেখক, সম্পাদক, সাংবাদিক, ছাত্র-ছাত্রী, চিত্র পরিচালক, চিত্রকর নিমডির টিলায় গিয়ে বাসা বাঁধবেন ।


অপূর্ব ব্যানার্জি এখন পাটনা শহরে পোস্টেড,  ম্যালেরিয়া উন্মীলন বিভাগে এনটেমলোজিসজ্ট, গেজেটেড পোস্ট।অনিকেতের বিভাগ থেকে জোরাজুরি করা হচ্ছে না বলে ওর পোস্টটা এখনও গেজেটেড নয়। সেকারণে রাহু-কেতুর মা একটু ক্ষুন্ন । কেতুর বিপজ্জনক প্রণয়ের কথা অপু জানতে পেরেছিলেন, পলিও জানতে পেরেছিল, কিন্তু সবই রইলো গোপন । সমুদ্রের তলাকার আপওয়েলিঙের কথা জেনেও মেনে নিলেন সবাই।জানতে পারলো কেতুর কলকাতার বন্ধুরাও ।


গৌরীকে নিবেদিত অনেক কবিতা লিখেছিল অনিকেত, তার একটা, শিরোনাম ‘সমর্পণ’, মনে আছে রাহুলের, কে জানে গৌরীর মনে আছে কিনা :


ভ্রমরের ঠোঁটে আছে অমৃতের নেশা

ফুলে ফুলে ফুলবনে ভ্রমিয়া নির্ভর

স্রোতোশীল স্হানপাত্রে ধমণী শোণিত।

.

নির্ভর গাইছে নিজ শোণিত-সঙ্গীত

স্পন্দন ক্রন্দন করে ফুলে ওষ্ঠ রেখে

মধু চাই, ঘ্রাণ চাই, রঙ চাই রঙ

.

মধু নাও, ঘ্রাণ নাও, সুখ ভরে নাও

তুমি নাও রেণুদুটি পদপ্রান্তে মেখে

ঐ ফুলে রেখে দিও মধুময় ফুলের মাশুল

.

এ-বসুধা ফুল আর ভ্রমরের গানে-গানে ভরা

সাগরের কাছে মাটি রেখেছে লবণ,

সবার শোণিত, অশ্রু, স্বেদের মৃত্তিকা !


রাহু বাবা-মাকে বলল, রামায়ণ নট্ট কোম্পানির  অধিকারী মশায়ের নিমপাতা প্রকাশনীর চিঠি-চাপাটির বই বেরোনোর পর কেতুকে নিয়ে একটা অদ্ভুত লেখা লিখেছেন অসীম গাঙ্গুলি । ঘাড়ে বসে খাবার ব্যাপার ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন ।


—তাই বুঝি ? জিগ্যেস করলেন মা । তারপর যোগ করলেন, ওটাও পড়ে শোনা দিকিনি ।

রাহু পড়তে আরম্ভ করল লেখাটা :


“একটি চিঠিপত্রের সংকলন প্রকাশিত হচ্ছে, আমাকে লেখা বিভিন্ন সময়ে অনেকের লেখা চিঠি । তাতে ছাপা হচ্ছে অনিকেত সিংহের কয়েকটি চিঠি । আমার স্মৃতিশক্তি ইদানিং দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, ওই চিঠিগুলির বিষয়বস্তু আমার মনে ছিল না ।  সেই সব চিঠিতে বিধৃত হয়েছে ওদের দুই ভাইয়ের কর্মকাণ্ডের ইতিহাস আর রামায়ণ নট্ট কোম্পানির সঙ্গে অনিকেত সিংহের সম্পর্ক । আমার মনে পড়ে গেল, এক সময় আমি রামায়ণ নট্ট কোম্পানি  নিয়ে বেশ সংকটে পড়েছিলাম । তখন আমার পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল অনিকেত । সে আমাকে বুঝিয়েছিল যে কিছুতেই রামায়ণ নট্ট কোম্পানি বন্ধ করা যাবে না । সে সব রকম সাহায্য করতেই প্রস্তুত, এমনকী টাকা পয়সা দিয়েও ।

“অনিকেত অন্য অনেক সময়েও আমাকে অনেক সাহায্য করেছে । একই কলেজে পড়ার সময়ে বন্ধুত্ব, যদিও আমাদের বিষয় ছিল আলাদা । অনিকেতের জীববিজ্ঞান আর আমার অর্থনীতি । কলেজে তো অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়, কিন্তু কারুর কারুর সঙ্গে সে-বন্ধুত্ব খুব গাঢ় হয়ে ওঠে । গ্র্যাজুয়েশানের পর অনিকেত খুব তাড়াতাড়ি চাকরি পেয়েছিল । আমি বেশ কয়েক বছর বেকার অবস্হায় টিউশানি-মিউশানি করে কাটিয়েছি । সেই সময়ে অনিকেত রামায়ণ নট্ট কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে । ওর ছোটো ভাই আর রূপক-রক্তিম-প্রদীপনের সঙ্গে রামায়ণ নট্ট কোম্পানির খানিকটা টানাপোড়েন তো ছিলই, অনিকেত  সেটা মেটাবার অনেক চেষ্টা করেছে । ওর ছোটো ভাই রাহুল সিংহকে পুলিশ গ্রেফতার করে, তাতে, ওদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও, রাহুর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলাম আমি ।

“বিহারে চাকরিরত হলেও অনিকেত কলকাতা থেকে একটি প্রকাশনা সংস্হা চালু করতে চেয়েছিল । তার প্রথম বই, আমার কাব্যগ্রন্হ  ‘আমরা কয়েকজন’ । তখন আমাকে কবি হিসাবে ক’জনই বা চেনে । তবু আমার কবিতার বই প্রকাশ করায় অনিকেতের অনেকখানি ঔদার্য প্রকাশ পেয়েছিল । অনিকেতের প্রথম কাব্যগ্রন্হ বেরুল, ‘নদীর ধারে শুয়ে আছি’ । নামটা বোধহয় আমারই দেওয়া । প্রেসেও ছোটাছুটি করেছি আমি । সে সময় অনিকেত চমৎকার রোমান্টিক কবিতা লিখত । পরে তার কবিতা একটা অন্য দিকে বাঁক নেয় । ওই সংস্হা  থেকে অনিকেতের আরেকটা কবিতার বই বেরিয়েছিল, ‘ ভিয়েৎনাম’ । পরে সেই প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায় ।

“লেখালিখি ছাড়াও  অনিকেতের সঙ্গে আমার একটা গভীর নৈকট্যের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় , সে সম্পর্কের মধ্যে কখনো ভুল বোঝাবুঝির প্রশ্ন থাকে না । আমি জানতাম এই দীর্ঘকায় সুঠাম চেহারার বন্ধুটির ওপর সব সময় নির্ভর করা যায় । আমার দিক থেকে ওকে কখন কী সাহায্য করেছি, তা বলতে পারি না । চাকরিসূত্রে অনিকেত যখন যেখানে বদলি হয়েছে, আমি সেখানে উপস্হিত হয়েছি । যেমন ডালটনগঞ্জ, দ্বারভাঙ্গা, চাইবাসা, ধানবাদ, মুজফফরপুর,  এবং ওদের নিজস্ব বাড়ি পাটনায় । সেই সময়কার আড্ডার উজ্জ্বল, মধুর স্মৃতি কখনো ভোলার নয় । বিয়ের সময় অনিকেত বেশ একটা কৌতুক করেছিল । আমরা জানতাম, চাইবাসার মলির সঙ্গেই ওর ভালোবাসার সম্পর্ক । কিন্তু অনিকেত  রটিয়ে দিল, ও অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করছে । খুবই উদ্বিগ্ন অবস্হায় আমরা কয়েকজন বিবাহবাসরে যোগ দিতে গেলাম চাইবাসায় । অনিকেতকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে সে মুচকি হাসে । অনুষ্ঠান শুরুর আগে নববধুর মুখ দেখে আমার বুক থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো । লাবণ্যময়ী মলি পরে অনিকেতের সব বন্ধুকেই আপন করে নিয়েছিল । নীরার সঙ্গে আমার বিয়ে উপলক্ষেও অনিকেত আর মলি দুজনে এসে উপস্হিত হয়েছিল আমাদের দমদমের বাড়িতে । বউভাতের রাতে যে নববধুকে কিছু একটা উপহার দিতে হয়, তা আমার জানা ছিল না । জানব কী করে ? আমি যে কাঠবাঙাল ? অনিকেতই প্রায় শেষ মুহূর্তে সেই কথাটা মনে করিয়ে দেওয়ায় দুজনে বেরিয়ে কিনে আনলাম একটা লেডিজ ঘড়ি, খুব সম্ভবত অনিকেতই সেটার দাম দিয়েছিল । তারপর এই দুই পরিবারের একটা ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায় ।

“অনিকেতের সঙ্গে রক্তিম চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয় প্রথমে আমিই করিয়ে দিই । তারপর রক্তিম-অনিকেতের চাইবাসা পর্ব নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অনেক কিছু লেখা হয়েছে । বিহারে থাকলেও অনিকেত মাঝে মাঝেই কলকাতায় এসে অন্য সব লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে ।

“রাহুল-রক্তিম-নীলোৎপলদের কর্মকাণ্ড শুরু  হবার পর ওদের সঙ্গে আমার খানিকটা দূরত্ব তৈরি হয় । আমার ‘আনন্দসেবকে’ যোগ দেওয়া ও কবিতা ছাড়াও প্রচুর গদ্য লেখালিখি ওরা অনেকেই পছন্দ করেনি, শুনেছি । সেটা তো ” এস্টাবলিশমেন্টের” খপ্পরে পড়া, এবং কথাটা ঠিকই । কয়েক বছর পর রক্তিমও অবশ্য “আনন্দসেবক” সংস্হায় যোগ দিয়েছিল ।

“রাজনীতির মতন সাহিত্য জগতেও নীতিগত আপত্তি ও দূরত্ব থাকতেই পারে । কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে সেই দূরত্ব সৃষ্টি করার পক্ষপাতী আমি কোনোদিনই নই।  ওদের কর্মকাণ্ডের  পর্ব চুকে গেলে রক্তিমের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতায় সাময়িক সামান্য ফাটল খুব সহজেই জোড়া লেগে যায় । যেমন প্রদীপনেরও । কিন্তু কেউ কেউ দূরত্বটাই পছন্দ করে ।  অনিকেতের সঙ্গে বিচ্ছেদটাই আমার মনে বেশি লাগে । অনিকেতের লেখা, সাহিত্য সম্পর্কে ওর নানারকম পরিকল্পনা আমার বরাবরই পছন্দ ছিল । সবচেয়ে বেশি আপন মনে করতুম মানুষ অনিকেতকে।

“জীবন কতো নিষ্ঠুর ! জীবনের গতি কোন সময় কোন বাঁক নেবে, তা আগে থেকে কিছুই বলা যায় না । এক সময়কার সেই প্রগাঢ় বন্ধুত্ব, আড্ডা, পানাহার, পরস্পরের স্বপ্ন বিনিময়, এসবই কখন যেন ধূসর হয়ে যায় । বিহার ছেড়ে অনিকেত এখন কলকাতারই উপকন্ঠে বাড়ি করে সপরিবারে চলে এসেছে । অথচ ওর সঙ্গে আমার প্রায় দেখাই হয় না । কেন, কে জানে ! হয়তো আমার দিক থেকেই অনেক ত্রুটি আছে ।

“একটা সাম্প্রতিক ঘটনা বলি । চোখের চিকিৎসার ব্যাপারে নীরা আর আমি গেছি  ডাক্তার নন্দিনী রায়ের হাসপাতালে । বেশ ভিড় । তারই মধ্যে নীরা আঙুল দেখিয়ে বলল, ওইখানে অনিকেত বসে আছে না ? কাছে গিয়ে দেখি সত্যিই অনিকেত আর মলি । কুশল বিনিময় হল । ছেলে মেয়েদের কথা হল । এক সময় আমি অনিকেতকে বললাম, কানাইলাল জানার বাড়িতে যে একটা উৎসব ক’দিন আগে হয়েছিল, শুনলাম তোরও সেখানে যাবার কথা ছিল । তুই গেলি না কেন ? তোর বাড়ির তো কাছেই ?

“অনিকেত আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল, আমি যাইনি, যদি তুই আমাকে সেখানে চিনতে না পারিস !

“আমার বুকে যেন একটা বুলেট বিদ্ধ হল । এরকম নিষ্ঠুর কথা আমি বহুদিন শুনিনি । যে বন্ধুর সঙ্গে আমার তুই-তুই সম্পর্কে, যার সঙ্গে আমার কখনো ঝগড়াঝাঁটি হয়নি, কোনোদিন তিক্ততার সৃষ্টি হয়নি, তার সঙ্গে দেখা হলে আমি চিনতে পারব না ? এমন অভিযোগ শোনার জন্য কী দোষ বা অন্যায় করেছি আমি, তা জানি না । এর পর কয়েকদিন বেশ বিমর্ষ হয়ে ছিলাম । মনে হল জীবনের কাছ থেকে এরকম আকস্মিক আঘাত আরও কতো পেতে হবে কে জানে !

“হয়তো অনিকেতও কোনো গভীর অভিমানবোধ থেকে এই কথা বলেছিল । আমি নিজেই নিশ্চয়ই সেরকম কোনো কারণ ঘটিয়েছি, কিন্তু তার বিন্দুবিসর্গও আমার জানা নেই ।”

রাহু নিজেকে নিঃশব্দে বলল, এই অসীম গাঙ্গুলি লোকটা বিটকেল, নয়তো অনিকেত-গৌরীর প্রেমের কথা চেপে গেল কেন ? নিজের মুখপত্রে অনিকেতকে কেন লিখতে বলতো না আর অনিকেতের পত্রিকায় কেন লেখা দিতো না তা বেমালুম চেপে গেছে । 

রাহুলের মা বললেন, এসব ন্যাকামির কথা শুনলে গা রি-রি করে । অসীমের ছেলের জন্যে তো কেতু লাহেরিয়া সরাইতে গরু পুষেছিল, আমি নিজে দেখে এসেছি, ওর বউ নীরা আর কচি ছেলেকে কলকাতায় গিয়ে  নিয়ে এসেছিল কেতু। নিমডির বাড়ির আবগারি ইন্সপেক্টারটা কতো নিন্দে করেছিল অনিকেতের বন্ধুদের ; ওরা মদ খেয়ে বেহেড হয়ে যেতো আর সামলাতে হতো, বমি পরিষ্কার করতে হতো, অনিকেতের অফিসের পিওনদের । সিগারেট দিয়ে তোষকে কতো যে জ্বলন্ত ফুটো করেছে বেল্লিকগুলো, কী বলব !

রাহু ভাবছিল, ‘আমরা কয়েকজন’ আর ‘নদীর ধারে শুয়ে আছি’, দুটো নামই তো গৌরীর দেয়া, তা কি অসীম গাঙ্গুলি জানতেন না ! ‘আমরা কয়েকজন’ বইয়ের কবিতাগুলো গৌরী আর অনিকেত দুজনে মিলে নির্বাচন করেছিল, তা কি অসীম গাঙ্গুলি জানতেন না ! ‘ভিয়েৎনাম’ বইটা রামায়ণ নট্ট কোম্পানি থেকে বেরিয়েছিল, তাও কেমন করে ভুলে গেলেন অসীম গাঙ্গুলি ! গৌরীর সঙ্গে সম্পর্কের কথা অসীম গাঙ্গুলি জানতেন । রক্তিম চাটুজ্জে তো নিজের উপন্যাসে সবই লিখেছেন খোলাখুলি । অন্যের স্ত্রীকে নিয়ে সংসার বাঁধার কথা কেতু যেমন ভাবেনি, তেমনই গৌরী নিজের স্বামী-সন্তানদের ছেড়ে কেতুর সঙ্গে সংসার বাঁধার কথা ভাবেনি । ভালোবাসার এক নতুন পরিভাষা গড়তে চেয়েছিল আর পেরেছিল দুজনে মিলে ।  কেতু কি কখনও গৌরীকে চুমু খেয়েছিল ? নাহ, কেতু অমন ভাবতেও পারবে না ।

‘দুর্যোধন’ পত্রিকার সম্পাদক চপল চক্রবর্তীর স্ত্রী সুচেতনা অন্য একজনের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে সংসার বেঁধেছে, তাতে চপলের ভালোই হয়েছে । পাহাড়ি জঙ্গল কিনে প্রচুর গাছগাছালি পুঁতে  ‘পেঁড়পৌধা-বাবা’ নামে খ্যাতি পেয়েছে ; পাকা দাড়ি আর ধুতি-ফতুয়া পরে ঋষি অরবিন্দর ডুপলিকেট ; ক্রিপটিক বাক্যে লেখালিখি করে বছরের পর বছর বই ছাপাচ্ছে পেনশনের টাকায় । রাজ্য সরকারের কেঠো পুরস্কার পেয়ে কাগজে বিগলিত চেহারার ছবি ছাপিয়েছিল । তবে ‘দুর্যোধন’ পত্রিকাটা যেমন একশো ভাইয়ের হল্লাবোল হয়ে দাঁড়িয়েছিল, চপল চক্রবর্তীর সংসার ভাঙলো আর সেই সঙ্গে ছিৎরে গেল একশো ভাই-বেরাদরের দল । রাহুর সন্দেহ হয়, চপলের বউকে নিশ্চয়ই কোনো হিংসুটে কবি বা লেখক ভুল বুঝিয়ে নিয়ে গেছে, একশো ভাইয়ের হল্লাবোলকে ছিৎরে দেবার প্যাঁচ কষে ।

রাহু-কেতুর পিসতুতো বোন গীতা ওর বরের ভাগ্নের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে সংসার পেতেছিল । পিসেমশায় একটা মিটিঙ ডেকেছিলেন ফয়সালা করার জন্য । আত্মীয়-জ্ঞাতিরা ছিল উপস্হিত, নির্ণয় নেবার জন্য । রাহু আর অনিকেতও ছিল । অনিকেত মত দেয়নি, নিরপেক্ষ ছিল । পালিয়ে গিয়ে নতুন সংসার পাতার পক্ষে মত দিয়েছিল রাহু । প্রতিদান হিসেবে বিরিয়ানি আর হুইস্কি খাইয়েছিল গীতা ।

রাহু-কেতুর নতুনকাকার বড়ো মেয়ে একজন হোটেলের বেয়ারাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল । বোকা । দুজনে পালিয়ে গিয়ে সংসার বাঁধলেই পারতো । তার বদলে নতুনকাকার মত নিতে গিয়ে নিষেধ সামলাতে না পেরে মেয়েটা আত্মহত্যা করে নিয়েছিল । অমন ঘটনার দরুন নতুনকাকার ছেলে  নিম্নবর্ণের যে মেয়েটাকে ভালোবাসতো, তাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে সংসার পেতেছিল । এক মেয়ে যখন ধোপার ছেলেকে বিয়ে করতে চাইলো, নতুনকাকা আর নিষেধ করেননি ।

জীবনানন্দ দাশ আবার চাইতেন, বউটা মরে যাক । উনিও ক্রিপটিক বাক্যে লুকিয়ে লিখে গেছেন সেসব । বিয়ের একবছরের মধ্যে নিজের স্ত্রী সম্পর্কে জীবনানন্দর মন্তব্য: 'প্রধানত লাবণ্যকে ঘিরে এক হাজার একঘেয়ে পারিপার্শ্বিকতার কারুণ্য ও আইরনি এবং তার  দশ হাজার প্যাথেটিক ডিটেলস।আর এতটাই গভীর সেই ভার যে মধ্যে মধ্যে মনে হয় লাবণ্যর মৃত্যু হলে বা গোপনে পালিয়ে গেলে বা  ডিভোর্স হলে আমি মুক্তি পাই।' অতঃপর প্রায় সারাটা জীবন ধরে ব্যর্থ, নষ্ট ও পতনোন্মুখ এক দাম্পত্যের কাহিনী লিখবেন জীবনানন্দ দাশ নামক তেজস্ক্রিয় পদার্থটি! কী সেই গল্প? রণজিৎ-ঊষা, প্রমথ-সুমিত্রা, সুধীশ-কাঞ্চনমালা, অভয়-স্বর্ণ, অচ্যুত-জ্যোৎস্না, প্রবোধ-উর্মিলা, বিরাজ-কমলা, সুবোধ-মালতী...১৯৩২-এর এপ্রিল মাস জুড়ে জীবনানন্দ দাশের লেখা ১০টি গল্পেই  এক অসুখী দাম্পত্যের দীর্ঘ ছায়া! 'স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক...  খানিকটা মাংস নিয়ে, আবার সেই টাকার হিসেব নিয়ে।' শাড়ি গল্পে স্ত্রী ঊষার 'হিংস্র লিপ্সার সামনে' রণজিতের নিজের 'ঠান্ডা কল্পনা ও চিন্তার পৃথিবী' র জীবনকে কেমন অর্থহীন মনে হয়। সেইসব  সম্পর্কে 'যৌন রেমাঞ্চের' চেয়ে 'একটা জিহ্বার স্পৃহা' বড়ো হয়ে দাঁড়ায়।এমন উপলব্ধতিতে পৌঁছান শেষে: 'কোনও বধূকে নিয়েই আর্টিস্টের একাকী জীবনের কোনও সাহায্য হয় না।'

বউ মরে গেলে কিংবা পালিয়ে গেলে, তার মানে, নট্ট কোম্পানির লোকেদের সুবিধেই হয় । রবীন্দ্রনাথের বউ যদি তাড়াতাড়ি মারা না যেতেন তাহলে কি নোবেল পুরস্কার পেতেন ! কিন্তু জীবনানন্দ দাশ, লুকিয়ে আপশোষও করেছেন. “আমি বিশিষ্ট বাঙালিদের মধ্যে পড়ি না; আমার বিশ্বাস জীবিত মহত্তর বাঙালিদের প্রশ্রয় পাওয়ার মতোও কেউ নই আমি। কিন্তু আমি সেই মানুষ,  যে প্রচুর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রতিটি দ্রব্যকে সোনা বানিয়ে তুলতে চায় অথবা মহৎ কিছু --- যা শেষ বিচারে কোনও একটা, জিনিসের-মতন-জিনিস--- কিন্তু ভাগ্য এমনই যে, তার খাদ্য জুটছে না।কিন্তু, আশা করি, ভবিষ্যতে খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে; আমার ভয় হয়,  সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না।” 

সত্যিই উনি দেখে যেতে পারলেন না । অসীম গাঙ্গুলি, রক্তিম চাটুজ্জে, নীলোৎপল, প্রদীপন চাটুজ্জেরা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, ঘাপটি মেরে আনন্দসেবক আর দিনসেবক নট্ট কোম্পানিতে সেঁদিয়ে সেসব দেখে যেতে পেরেছে । অনিকেত পারেনি । ওর আত্মাভিমান । অনিকেতের মনে হয়েছে ওর বন্ধুরা তেমন পরিশীলিত নয়, সবকটাই লোভী । 

রাহুল কফিহাউসের জমায়েতে শুনেছিল, কাকদ্বীপের কবি সামসুল হক গোপনে ডায়রিতে লিখেছিল বউয়ের বিরুদ্ধে । শেষে কবর থেকে শবদেহ তুলে পোস্টমর্টেমের যোগাড় । 

নীলোৎপল লিখেছিল,  “আনন্দসেবক” সংস্হায় চাকরি নিয়ে, রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারী বলেছিলেন, ‘প্রতিষ্ঠানকে ভেতর থেকে ভাঙতে হবে। বাইরে থেকে ভাঙা যায় না।’ অসীম গাঙ্গুলি কি সত্যিই তাকে ভাঙতে চেয়েছিল ? নাকি ব্যবহার করতে চেয়েছিল ? আর তা করতে গিয়ে নিজেই ক্রমশ হয়ে উঠেছিল ব্যবহৃত, ব্যবহৃত এবং ব্যবহৃত।” নীলোৎপল নিজে অবশ্য অসীম গাঙ্গুলিকে বশে এনে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার নিতে ছাড়েনি ; আনন্দসেবকের মোটা টাকার পুরস্কারটাও হাতিয়েছে । লণ্ডনে থাকতে প্রদীপনকে একটা গরমাগরম চিঠি লিখেছিল, দেশে ফিরে সেসব ভুলে গিয়ে ডিগবাজি :

“প্রিয় প্রদীপন,      

আপনার পাঠানো ‘ক্লুজ’ পত্রিকায় অনুকুল আচার্য লিখিত একটি প্রবন্ধ  পড়েছি এবং এ-বিষয়ে আমার দু'একটি কথা বলার আছে । আপনার পত্রিকায় এই চিঠিটা ছাপবেন যদি স্হানাভাব না হয় এবং যদি ছাপান তবে পুরোটাই ছাপাবেন । ঐ লেখাটির প্রধান গুণ সরলতা বা ইংরেজিতে যাকে বলে ডিরেকটনেস কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার দু'একটি জায়গা বুঝতে অসুবিধে হয়েছে যদিও আমি নিজের মতো একটা মানে করে নিয়েছি ঐ কঠিন অংশগুলির এবং সেই মতোই এই চিঠি লিখছি । আমার বোঝায় ভুল থাকলে আপনারা, বলা বাহুল্য, আমাকে সংশোধন করে দেবেন ।   কলকাতা শহর কারা চালায় ? অধ্যক্ষরা, মন্ত্রীরা, ব্যবসায়ীরা, চিত্রপরিচালকরা, খবরকাগজওয়ালারা এবং মালিকেরা ও বিদেশী কোম্পানী, জুট মিল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলি, অসংখ্য ছোটোখাটো কলেজ, তাদের অধ্যাপকরা --- এঁরাই কলকাতা শহর চালান । এঁদেরই ব্যবহারের জন্য কলে জল পড়ে, এঁদেরই অর্থবৃদ্ধির জন্য সিনেমা তৈরি হয়, বই লেখা হয়, ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় পাশ করে । এঁদের এক কথায় বলা চলে 'প্রতিষ্ঠান' এবং সেই প্রতিষ্ঠানেরই উপকারে লাগি আমরা । যতোদিন এই প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা এবং পয়সা আছে ততদিন সমরেশ বসু আন্তরিক না বিমল কর আন্তরিক এই প্রশ্ন হাস্যকর কেননা উ্যয়েই ঐ প্রতিষ্ঠানের কাজে লাগছেন । প্রতিষ্ঠান উপকৃত হচ্ছে উভয়কে দিয়েই । সুতরাং প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছামতো অমুক লেখক আধ ইঞ্চি বেশি আন্তরিক হল এই শারদীয় সংখ্যায় --- সামনের বছর অন্য কেউ দেড় ইঞ্চি আন্তরিক হবেন । এই ষড়যন্ত্র কতখানি গভীর এবং ব্যাপক তা প্রত্যেক তরুণ লেখকের, আজ, বাংলা দেশে, বোঝার সময় এসেছে এবং এখনি সময়, ঐ প্রতিষ্ঠানকে আমূল উপড়ে ফেলার । তার জন্য দুটি জিনিস দরকার : ( এক ) ভাষা, ( দুই ) বন্দুক । প্রথম, ভাষা ব্যাপারটিকে ধরা যাক । আমরা যে বাংলা ভাষায় আজ কথা বলি বা লিখি তা মোটামুটি রবীন্দ্রনাথেরই তৈরী । আমাদের বাক্যগঠন, বানানরীতি, শব্দবিচার সবই ঐ ছাব্বিশখণ্ড থেকে তৈরী হয়েছে । এবং আমি বা আপনি এটা যতো না ভালো জানি, প্রতিষ্ঠান জানে আরো ভালো ভাবে । সুতরাং আমাদের শাসনের জন্য, আমাদের সর্বস্ব গ্রাস করার জন্য ঐ ভাষাই ব্যবহৃত হচ্ছে । ঐ ভাষায় 'আত্মার স্বাধীনতা' ঘোষণা করা যায় না এবং 'আত্মার স্বাধীনতা' ঘোষণা যদি কবিতা হয়, তবে ঐ ভাষায় আজ আর কবিতা লেখাও চলে না । অর্থাৎ 'বাংলা ভাষা'তেই কবিতা লেখা অসম্ভব ।  কিন্তু বাংলা ভাষা মানে রবীন্দ্রনাথের ভাষা নয় ।এবং কবিতা কী?   মেদিনীপুরে একবার এক মহিলা কথাচ্ছলে বলেছিলেন : “চাষা কিবা বোঝে ঘি-এর মর্ম ; আনে কর্পুর লাগায় পোঁদে” বস্তুত ঐ উক্তির গম্ভীর সারল্যে আমি অভিভূত হয়ে যাই এবং আজ আমার মনে হয় , সুতরাং, আমাদের নির্মমভাবে, এক নতুন ভাষা তৈরী করা দরকার । আমাদের প্রচলিত বাক্যরীতি, শব্দব্যবহার সমস্তই বর্জন করে এক অভিনব গদ্য তৈরি করা দরকার যা দিয়ে নাটক, কবিতা, গল্প সবই লেখা চলে । এর জন্য আমাদের খুঁজে বের করতে হবে গ্রামের শব্দ, লৌকিক বাক্যরীতি, আসামী উড়িয়া বিহারী বাক্যরীতি --- আমাদের যে নতুন ভাষা তৈরী হবে তা হল ঐ বিভিন্ন ভাষা পদ্ধতির সমন্বয় । আমরা ত্রাণ করতে পারি একমাত্র ঐ নতুন ভাষা দিয়ে । আর পারি বন্দুক দিয়ে । কেননা কর্তারা অনেকদিন হল ভুলে গেছেন ভয় কাকে বলে । লাইসেন্স নিয়ে মাথা ঘামাবেন না, কারণ যে কাজে ঐ মারণাস্ত্র ব্যবহার হবে তার জন্য পৃথিবীর কোনো সরকারই কোনোদিন লাইসেন্স দেয়নি । আমরা কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে, জলের পাইপ বেয়ে, রাত্রির অন্ধকারতে উঠে যেতে চাই প্রিন্সিপালের শোবার ঘরে । ওখানেই আমরা তাঁর ইন্টারভিউ নিতে চাই । ভয় হচ্ছে সেই বস্তু যা শয়তানকে দিয়েও সত্য কথা বলায় । বলা বাহুল্য, প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসে প্রথমে আপনাকে নানারকম বোঝানোর চেষ্টা করবে । প্রতিষ্ঠান বলবে : ও হে, না হে, এটা ভালো নয় । আপনার তখন খুবই ইচ্ছে হবে তর্ক করে পরাস্ত করার । ( কেননা আপনার গায়ে তখনও শিক্ষিতের দুর্গন্ধ লেগে আছে ) প্রতিষ্ঠানই আপনাকে বুঝিয়েছে আপনি বুদ্ধিমান যেহেতু আপনি তর্ক করেন )। কিন্তু প্রতিষ্ঠান যখন আপনার হাত থেকে ছোঁ মেরে পয়সাগুলো কেড়ে নেয় তখন সে আপনাকে তর্কের অবকাশ দেয় কি ? ধরে নিলাম, আপনি ঐ ফাঁদে পা দিলেন না, কেননা আপনি তেমন লেখাপড়া করেননি । তখন প্রতিষ্ঠান বলবে : ওহে, অবনীবাবুকে মেরো না, ধরণীবাবুকে মারো । অর্থাৎ আপনার মনে সন্দেহ জাগানোর চেষ্টা করবে । আপনি ষদি ভাবতে শুরু করেন তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার চিন্তা কেটে যাবে কারণ নিজে শুনবেন পুলিশের বাঁশি ডাকছে । তরুণ লেখক ! আপনার উদ্দেশ্য হত্যা । আপনার লক্ষ্য ভায়োলেন্স । আপনি এতদিনে বুঝেছেন কবিতারই অপর নাম কার্তুজ এবং কবির অস্তিত্ব শতকরা একশোভাগ পোলিটিকাল ।প্রতিষ্ঠান আপনাকে আরো নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করবে । সে ব্যবহার করবে আপনারই অতিপরিচিত শঠ শব্দগুলি । সে বলবে : তবে কি তোমরা সশস্ত্র বিপ্লব চাও ( খবরের কাগজের ভাষা : ঐ প্রতিষ্ঠানেরই মালিক । ) তবে কি তোমরা নিরীহ মা-বাপ ভাই-বোনেদের কথা ভুলে গেলে ( নাটকের ভাষা : ঐ প্রতিষ্ঠানেরই অভিনীত  । ) আপনার তখন চিৎকার করে শুধু একটাই ঘোষণা করার থাকবে : আমি চাই কবিতা । আমরা চাই বন্দুক । আমরা, আজ, চাই কবিতা ও বন্দুক । এর মাঝামাঝি কোনো রফা নয় ।”     

রাহুলের মনে পড়ল,   পঞ্চদশ সংখ্যায়, রামায়ণ নট্ট কোম্পানির মুখপত্রে, অসীম গাঙ্গুলি লিখেছিলেন, ”অকাদেমি পুরস্কার । যারা পুরস্কার দেয় আর যারা পুরস্কার পায় তাদের হাস্যকর ধৃষ্টতার প্রতিবাদ করার লোক নাই । পুরস্কার পায় কারা ? যারা তথাকথিত জীবনে নিরুদ্বেগ — যাদের অর্থসম্পদ  এবং প্রতিভা যথাক্রমে প্রচুর আছে এবং সামান্যতম নেই এবং যাদের হাত সব সময়েই অপরের পদধুলি নিয়ে-নিয়ে নোংরা হয়ে থাকে । কোনো শিল্পীই পুরস্কার প্রত্যাশী নয় । পুরস্কার একমাত্র নেওয়া সম্ভব ঈশ্বর অথবা শয়তানের হাত থেকে — ভোটে জেতা মানুষের কাছে কোন শিল্পী পুরস্কার নেবে ?” তারপর নিজেই ডিগবাজি খেয়ে পুরস্কার নিলেন আর মোদোমাতাল বন্ধুদের বিলোলেন । হিক হিক হুররে !

রাহুলের দাদা অনিকেত একবার জিগ্যেস করেছিল, আচ্ছা রামকৃষ্ণের মাথার চুল কে কেটে দিতো আর চৈতন্যদেবের দাড়ি কে কামিয়ে দিতো বলতো, নিশ্চয়ই কোনো নাপিত, মানে তখনকার দিনে নাপিত জাতের লোক ! অনিকেত ওইরকমই, যেন এক অস্পষ্ট বিষাদের সঙ্গে ওর জন্মের সময়ে বিয়ে হয়েছিল, যা সারাজীবন রয়ে গেছে ওর সঙ্গে । কোন কথার ভেতরে কী অর্থ পুরে দিচ্ছে তা ঠাহর করতে বহুকাল কেটে যাবে ।


রাহুল সিংহের পাঞ্জাবি সহকর্মী সুশীল কোশলের বউ ছোটো ছেলেকে নিয়ে একজন শিখ সরদারের সঙ্গে পালিয়েছিল। রাহুল কতোবার বলেছিল যে ভুলে যা, চল তার চেয়ে মাগিবাড়ি, আমার সব ঘাঁতঘোঁত জানা আছে। পালানো বউকে ভুলতে পারেনি বেচারা । বড়ো ছেলে আর মেয়েকে একাই সামলেছে । ওর বাবা কতোবার বলেছিলেন, আরেকবার বিয়ে কর, নয়তো লিভ টুগেদার কর ; রাজি হয়নি সুশীল কোশল । কুড়ি বছর পর সুশীল কোশল বদলি হয়ে পাটনায় এসেছে শুনে দেখা করতে গিয়েছিল রাহুল । গিয়ে দ্যাখে, বউটা ছোটো ছেলের সঙ্গে ফিরেছে। সুশীল কোশল বলল, হ্যাঁ রে, ফিরেছে, জানতে পেরেছে আমি লিভার ক্যানসারে ভুগছি, বছরখানেকে মরে যাবো, তাই দেখতে এসেছে পেনশনে ও-ই নমিনি আছে কিনা । রাহুলের জন্যে চা সিঙাড়া এনে রাখার সময়ে দেখলো যে বউটা তো এখনও সঙ্গম করার মতন টইয়ল টইয়ল ।

সুশীল কোশলকে রাহুল বলল, হুমকি দিয়ে দে যে রোজ সঙ্গম করতে দিতে হবে । মুচকি হেসে সুশীল বলল, ওর সঙ্গে শোয়া মানে তোর সেই প্রোপোজাল মেনে মাগিদের সঙ্গে শোয়া । তুই যদি শুতে চাস তো বলতে পারি, রাজিও হয়ে যাবে, তোকে তো পছন্দ করতো ।

—কবে মরবি ? ডাক্তার ডেট দিয়েছে ? কথাগুলো জোরে জোরে হিন্দিতে বলে বেরিয়ে এসেছিল রাহু, টেবিলে চা-সিঙাড়া ফেলে রেখে।

অনিকেত একবার রাহুকে বলেছিল, আমার কলকাতার বাড়িতে আজকাল বিরল গঙ্গোপাধ্যায় থাকেন। তুই অফিসের কাজে কলকাতা গেলে ওনার সঙ্গে দেখা করতে পারিস । উনি নিজের বাড়ি ছেড়ে কম বয়সী প্রেমিকা কান্তার সঙ্গে থাকেন । সামনের বারান্দার মাপে বিরাট একখানা মশারি তৈরি করিয়েছেন আর তার ভেতরে আমার চেয়ার টেবিল পেতে লেখালিখি করেন । দেখেছিস তো, বাড়িটায় এতো মশা যে মসকিটো রেপেলেন্ট জ্বালালে  ঝরে-ঝরে মৌরির মতন পড়ে থাকে ।

রাহুর যেমন আদেখলা চরিত্র । গিয়েছিল । বিরল গঙ্গোপাধ্যায়কে নয়, ওনার প্রেমিকাকে দেখতে । রাহুলের দুর্ভাগ্য, প্রেমিকা কান্তা ছিল না । বিরল গঙ্গোপাধ্যায় খালি গায়ে, পৈতে পরে, সামনে কোষাকুষি রেখে হোমযজ্ঞ করছিলেন । একজন বুড়ো পুরোহিত ছিল । চোখজ্বালা-করা ধোঁয়ায় রাহু দেখলো, অনিকেতের সবেদা গাছটা কেটে ফেলেছেন বিরল গঙ্গোপাধ্যায় আর সেই কাঠে হোমযজ্ঞ করছেন, মন্ত্র পড়ছেন । রাহু নিজের পরিচয় দিতে, উনি বললে, ওটা পুরুষ সবেদাগাছ ছিল, অনিকেত তো জানতো না, তাই ভালো কাজে ব্যবহার করলাম।চাষবাস সম্পর্কে অনিকেতের চেয়ে আমি বেশি জানি ; মাঝে চাঁদের হাট গ্রামে জমি কিনে সেখানে ছিলাম বেশ কয়েক বছর, উপন্যাস লেখার কাঁচা-মাল সংগ্রহের আশায় । অশোক ফকিরকে তো চিনতে ; উনি বলেছিলেন তুমি ওনার বাড়িতে গিয়ে আফিম খেয়েছিলে। ওনাকে নিয়ে একটা বই লিখেছি। এখন যে বইটা লিখছি তা বেশ অ্যাম্বিশাস, শাহজাহানের ছেলেকে নিয়ে, তাই এই হোমাগ্নি । তুমি তো শুনেছি ধর্ম মানো না ; অনিকেত কিন্তু মানে, মহালয়ায় পূর্বপুরুষদের জল দেয়, প্রতি বছর সরস্বতী পুজো করে ।

রাহুল তো নিজেই জানে না ও হিন্দু ধর্ম মানে কি না । ওকে দেখে যার যেমন ইচ্ছে ধারণা তৈরি করে নেয় । ওর ইচ্ছে ওর শবদেহ নিয়ে গিয়ে কাশীর মণিকর্ণিকায় পোড়ানো, মানে দাহ, করা হোক । 

 রাহু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল দেখে বিরল গঙ্গোপাধ্যায় বললন, ও তুমি কান্তাকে দেখতে চাইছো? ও তো আজকে ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে গেছে কয়েকটা বই আনতে, তারপর কলেজ স্ট্রিট যাবে । আজকে তোমার সঙ্গে দেখা হবে না । আরেকদিন বরং এসো । শুনেছি তুমি শুধু সিঙ্গল মল্ট খাও, একটা বোতল এনো ; অনিকেতের আলমারিতে বেশ কয়েকটা কাচের গ্লাস আছে । ফ্রিজে বরফও জমে । ফ্রিজটা যে তোমার, তা অনিকেত আমাকে বলেছে, তোমাদের পাটনার বাড়ি থেকে এনেছে । তুমি পাটনার বাড়ি ছাড়ার পর তোমার ফেলে-আসা যাবতীয় আসবাবপত্র, ব্‌ই-টই, এই বাড়িতে নিয়ে চলে এসেছে । ভালোই । আমার কাজে লাগছে ওগুলো ।

মাস কতক পরে, রাহুল সিংহ গিয়েছিল আঠারো বছরের পুরোনো গ্লেনফিডিচের বোতল নিয়ে, স্পোর্টস ব্যাগে করে । গিয়ে দ্যাখে অনিকেতের বাড়ির গেট তালাবন্ধ । অনিকেতের বাড়ির পাশের পুকুরের অন্য পারে কান্তি লাহিড়ির বাড়িতে খোঁজ নিতে গেলে, কান্তি লাহিড়ি বললেন, “বিরল গঙ্গোপাধ্যায়ের বইটা কমপ্লিট হয়ে গেছে ; উনি কান্তাকে ছেড়ে নিজের বউ-মেয়ের কাছে ফিরে গেছেন । কান্তা নিজের বাড়ি ফিরে গেছে । তবে বইটা কান্তাকে উৎসর্গ করেছেন। কান্তি লাহিড়ি খেতে বসেছিলেন । এক চুমুক ওল্ড মঙ্ক খাচ্ছিলেন আর এক গ্রাস পেঁয়াজকলি-ট্যাংরার ঝোল মাখা ভাত, এক চুমুক ওল্ড মঙ্ক আর এক গ্রাস পেঁয়াজকলি-ট্যাংরার ঝোল মাখা ভাত, এক চুমুক ওল্ড মঙ্ক আর এক গ্রাস পেঁয়াজকলি-ট্যাংরার ঝোল-মাখা ভাত, এক চুমুক ওল্ড মঙ্ক আর এক গ্রাস পেঁয়াজকলি-ট্যাংরার ঝোল মাখা ভাত, এক চুমুক ওল্ড মঙ্ক আর এক গ্রাস পেঁয়াজকলি-ট্যাংরার ঝোল-মাখা ভাত, এক চুমুক ওল্ড মঙ্ক আর এক গ্রাস পেঁয়াজকলি-ট্যাংরার ঝোল মাখা ভাত, এক চুমুক ওল্ড মঙ্ক আর এক গ্রাস পেঁয়াজকলি-ট্যাংরার ঝোল-মাখা ভাত, এক চুমুক ওল্ড মঙ্ক আর এক গ্রাস পেঁয়াজকলি-ট্যাংরার ঝোল মাখা ভাত, এক চুমুক ওল্ড মঙ্ক আর এক গ্রাস পেঁয়াজকলি-ট্যাংরার ঝোল-মাখা ভাত, এক চুমুক ওল্ড মঙ্ক আর এক গ্রাস পেঁয়াজকলি-ট্যাংরার ঝোল মাখা ভাত, এক চুমুক ওল্ড মঙ্ক আর এক গ্রাস পেঁয়াজকলি-ট্যাংরার ঝোল-মাখা ভাত, এক চুমুক ওল্ড মঙ্ক আর এক গ্রাস পেঁয়াজকলি-ট্যাংরার ঝোল মাখা ভাত, এক চুমুক ওল্ড মঙ্ক আর এক গ্রাস পেঁয়াজকলি-ট্যাংরার ঝোল-মাখা ভাত, এক চুমুক ওল্ড মঙ্ক আর এক গ্রাস পেঁয়াজকলি-ট্যাংরার ঝোল মাখা ভাত, এক চুমুক ওল্ড মঙ্ক আর এক গ্রাস পেঁয়াজকলি-ট্যাংরার ঝোল-মাখা ভাত । মনে হচ্ছিল, সব রকমের অভিব্যক্তি কেউ কেড়ে নিয়েছে ওনার মুখাবয়ব থেকে ; অপরাধবোধ আর লজ্জার মধ্য দিয়ে স্মৃতিগুলো চাপা পড়ে গেছে। হাসিও যেন ঠোঁটে পেরেক দিয়ে গেঁথা ।

রাহুল অমনভাবে মদ খেতে পারে না বলে আর সিঙ্গল মল্টের প্রসঙ্গ তোলেনি । কে কী লুকোতে চাইছে জানার ইচ্ছেতে ভোগে রাহুল । কান্তি লাহিড়িকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও গভীর দুঃখ লুকিয়ে রেখেছেন । বিস্ফোরক ফলাফলের ভয়ে  তার প্রতিরক্ষার বাইরে বসবাস করছেন । ওনার চাউনির দ্রুত এবং উদাসীন সারল্য রাহুলকে চিন্তায় ফেলেছিল, যেন মেলে ধরতে চাইছিলেন উদ্বিগ্ন প্রজ্ঞার এক দ্রুত ঝলক।  ফিরে গিয়েছিল পুকুরটা দেখতে-দেখতে রাহুল। মাছের ঝাঁকের তৈরি ঢেউ জলকে  সুরেলা করে তুলছিল আর মৃদু বাতাসকে আছড়ে পড়ার অনুমতি দিচ্ছিল জলের ওপরে ।

কলকাতায় মন্দার ভাদুড়ির একঘরের ফ্ল্যাটে আড্ডা মারার সময়ে একজন যুবক ঘরে ঢুকতেই মন্দার রাহুর হাত ধরে চেয়ার থেকে তুলে বলেছিল, ‘তুমি এখন যাও শালা, এনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।’ যুবক আসলে মন্দার ভাদুড়ির প্রথম পক্ষের ছেলে । বুড়ো বয়সে  স্নাতক ছাত্রীর প্রেমে পড়েছিল মন্দার,  আর টিউশানির বদলে ঘরে খিল এঁটে যৌনতায় মেতে উঠতো । পেটে বাচ্চা এসে গেলে মেয়েটির বাবা-মা মন্দারকে জোরাজুরি করেন বিয়ে করার জন্য। আগের বউকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হয়েছিল । দ্বিতীয় পক্ষের বউকে ওর ঘরে আসতে বারণ করে দিয়েছে মন্দার, কেননা মুখার্জিবাগান আবাসনের পড়শীরা বলতো, ‘বাহ, আপনার নাতনিরও ছেলে হয়েছে।’ আরেকদিন মন্দার বলে উঠেছিল, ‘শালা, আমার ছেলেটা পেনশনের দিন ঠিক পৌঁছে যাবে আর অপেক্ষা করবে, যাতে আমি ওর সামনে মুখ নামিয়ে বসে থাকি ; কতো যে যন্ত্রণা, তুমি বুঝতে পারবে না, রাহুল।’ মন্দারের ক্রুদ্ধ শ্বাসকে মনে হচ্ছিল ওর বৈবাহিক ব্যর্থতার অভয়ারণ্য । এককালে যে ছেলেটাকে কোলে নিয়ে কতো আদর দিয়েছেন, এখন সে হয়ে উঠেছে অসহ্য ।

রাহুল বলেছিল, “শুয়োর মারা গর্তে পড়েছেন, এখন সারা জীবন গনগনে লোহার রড ঢুকবে আপনার পোঁদে।’ রাহুল এরকম যৌনতার ফাঁদ এড়িয়ে গেছে চিরকাল । ওর মনে হয়, প্রেম ব্যাপারটা সম্পর্কে ও কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি । সকলেই বলে, রাহু আর কেতু দুই পরস্পরবিরোধী চরিত্রের মানুষ । অথচ প্রেমের প্রস্তাব রাহুল অবিরাম পায়, এমনকী বিয়ের প্রস্তাব ।

—খোঁজ নে । জলখাবার খেয়ে নিচের তলায় দোকানে যাবার জন্যে চৌকাঠ ডিঙিয়েছিলেন বাবা, নিচের থেকেই  কাজের মেয়ে হাঁক পাড়ল, ভোজপুরিতে, ‘দুটো ডবকা মাই বের করে গুদের ফাঁক দেখিয়ে এই মেয়েটা ছবি তুলিয়ে গেছে নাকি মাইজি?’ বাবা চৌকাঠ ডিঙোলেন না, অপয়া হবে আঁচ করে ।

রাহুর মা চটে গিয়ে চেঁচালেন, ভোজপুরিতেই, ‘তুইও তোলাবি নাকি ?’

কাজের মেয়ে, ‘তোলাবো, তোলাবো, রাহুলবাবা তুলবে তো?’

বাবার দিকে তাকিয়ে মা বললেন, ‘ঢঙ দ্যাখো কাজের মেয়ের ! রাহু ওর ন্যাংটো ছবি তুলবে ! কেন যে রাহুল মেয়েদের চোখে ধরে বুঝতে পারি না । ডোমনি, চামারনি,  মেথরানি, নেড়েমেয়ে, ফিরিঙ্গিমেয়ে সকলেরই চোখে ধরে । কী কুক্ষণে সিংহরাশিতে জন্মেছিল । তার চেয়ে মীন রাশির অনিকেতকে দ্যাখো, কতো শীতল, ঠাণ্ডা স্বভাব, কাউকে লাই দেয় না ।

কাজের মেয়ের ভুল ভাঙাবার জন্য রাহু বলল, ‘ছবিটা একজন দেবী মাইয়ার । ফোটুবাবুর দাদা জাদুঘর থেকে ছবি তুলে এনেছেন, পাথরের তৈরি ।’ 

রাতভর বহমান জলের তলায় এনামেল ট্রেতে রাখা ছিল কেমিকাল ওয়াশ করার জন্য । সত্যিই বিশাল দুটো মাই আর ফাঁক করা যোনির ফোটো । শৈশব থেকে এই ধরণের ছবি দেখে আসছে রাহু । ছবি আর মূর্তি দেখে যৌনতার উদ্রেক হয় না ; সম্ভবত ওর যৌনতার বোধ সেকারণেই অন্য বাঙালিদের থেকে আলাদা।

নন্দার চায়ের ঠেক থেকে ওর লিভ-ইন বউয়ের ডাক শোনা গেল, রাহুলের মায়ের উদ্দেশে, ‘গধওয়া লেকে ধোবিয়া লৌটলই মাইজি ।’

রাহুল আর বাবা-মা তিনজনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলেন, গাধাটার পিঠে, যেদিকে আলকাৎরা দিয়ে উর্দু বা ফারসি কিংবা আরবি হরফে কিছু লেখা ছিল, তা মুছে দিতে না পেরে, সেদিকটায় আরও আলকাৎরার দাগ এঁকে হাফ-গাধা হাফ-জেব্রার আদল দেয়া হয়েছে । ধোপাটাকে দেখে মনে হচ্ছিল যে পুলিশ স্টেশনে ধোলাই খেয়েছে । মানুষ আর তার পোষা প্রাণীকে ঘিরে অশালীন হইচই বারান্দা পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিল, তাই মা আর বাবা ভেতরে চলে গেলেন । সবায়ের একই প্রশ্ন, ল্যাঙটো কাল্লু মস্তান কি ল্যাঙটোই রইলো, নাকি কোনো পরিধান পেলো, ল্যাঙটো পেয়ে ভ্যানের মধ্যে বা লকাপে কেউ পেছন মেরে দেয়নি তো !

ধোপা জানালো, থানেদার সাহেবের সামনে একটা টুলে ল্যাংটো বসে আছে কাল্লু মস্তান । থানেদার বলেছে, কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না, নিবারন আইনে  ধরে রাখা হয়েছে । সবাইকে এক-এক করে পোশাক খুলিয়ে ল্যাংটো করে বসিয়ে রাখবে থানায় ; মারামারি আর খুনোখুনির চেয়ে গায়ের পোশাক যে বেশি জরুরি তা বুঝুক ওরা । বাড়ির লোক পোশাক এনে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে ।

নন্দা ধোপাটাকে জানালো যে কাল্লু মস্তানের বউ ফোটুবাবুর লুঙ্গি নিয়ে গেছে ওকে ফেরত আনতে । সঙ্গে আওরংজেব পাংচারওয়ালার বিবি গেছে, কিন্তু সে তো কোনো পোশাক নিয়ে যায়নি ।

গাধাটা নিজের কালো হোসপাইপ লিঙ্গ খোপে ঢুকিয়ে নিয়েছে দেখে, রাহুল জিগ্যেস করল, তোর গাধাটার নাম কী ? 

ধোপার জবাব : সিকন্দর ।

রাহুল বলল, ভালো নাম দিয়েছিস, আলেকজাণ্ডারের । বেচারা দিগ্বিজয় করতে বেরিয়ে বিপদে পড়েছে । কটা মাদি গাধা আছে তোর ?

ধোপা : মাদি গাধা রাখিনি । একবার রেখেছিলুম একটা । মাঝরাতে মাদিটাকে দখলের জন্যে তিনটে গাধার মধ্যে সে কী লড়াই ! 

দেখা গেল আওরংজেব পাংচারওয়ালা একটা শায়া পরে ওর বিবির পাশে দাঁড়িয়ে, নন্দার দোকানের কাছে। ওর বিবি বলছিল, আমার শায়াটা খুলে ওকে পরিয়ে বাড়ি নিয়ে এলুম । ভাগ্যিস আজ শাড়ি পরেছিলুম। 

আওরংজেব পাংচারওয়ালার মুখে হাসি নেই । ফোঁপাচ্ছিল তাগড়া লোকটা । 

রাহু জিগ্যেস করলো, এই পাংচার, কাঁদছিস কেন ? বাড়ি যা, গিয়ে চানটান খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে নে। অকারণ দুঃখ আর অপমান শেষ পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে মারামারি-খুনোখুনিতে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে । তাই ওর বাড়ি যাওয়াই ভালো ।

আওরঙজেব পাংচারওয়ালার বদলে ওর বিবি ওপর দিকে তাকিয়ে বলল, বাজার আর গলির ভেতর দিয়ে আসার সময়ে লোকে ওকে খুব টিটকিরি মেরেছে, বলেছে যে পুলিশ ওকে ধরে নিয়ে গিয়ে হিজড়া করে দিয়েছে । আমি কী করব ? ওকে ছাড়িয়ে আনার জন্যে শায়া খুলে পরিয়ে দিয়েছি । এখন কানা কৌয়া বসে-বসে কাঁদছে, বেচারা, ওর তো কেউ নেই, কেউ ওকে বিয়ে করতে চায়নি, ওর মা আরেকজনকে বিয়ে করে কোথায় চলে গেছে, কেউ জানে না।

কানা কৌয়া ! রাহুল প্রথমবার নাম শুনে অবাক হয়েছিল । সত্যিই, মানুষের নাম । মহাবোদ্রোহের সময়ে লোকটার পূর্বপুরুষরা  নাকি দিল্লির ভাঙা কেল্লা থেকে আরও অনেকের সঙ্গে পিলপিল করে বেরিয়েছিল । ব্রিটিশ সেনারা ভাবতে পারেনি যে কানা কৌয়ার পূর্বপুরুষরা শেষ মোগল সম্রাটের কোনও বাঁদির বংশধর হতে পারে । গায়ের রঙ কালো কুচকুচে। কোনও বাঁদিকে পর্তুগিজরা আফ্রিকা থেকে পাকড়াও করে এনে বাদশাকে বেচেছিল বা উপহার দিয়েছিল । কানা কৌয়ার গায়ে সেই বাঁদির রক্ত আছে বলে মনে হয় । কানা কৌয়াকে দেখতে রাস্তার ধারে গরিব পাড়ার একজন ফুলুরিঅলার মতন, ওর চোখে সব সময়  ঘুমের ধূর্ততা আর ভুঁড়িদাস শরীরখানা কানা কৌয়া ওর ছোট- ছোট পায়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বয়ে নিয়ে যায়।

পাংচার, এবার বাড়ি যা, বলল রাহুল । বাবার একটা লুঙ্গি ফেলছি, কেউ একজন গিয়ে কানা কৌয়াকে পরিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আয় । লুঙ্গিটা লুফে নিল নন্দার বউ ; নন্দার ভাই হীরাকে বলল, নিয়ে যা, পরিয়ে ফিরিয়ে আন বেচারাকে । কী নিয়ে মারামারি আরম্ভ করেছিল, হয়তো নিজেই জানে না ।

ঠিকই, জীবনের স্হিরতা মানেই শান্তি নয় । মারামারিতে অংশ নেবার সময়ে উত্তেজনার আনন্দ হয়তো  কানা কৌয়ার পায়ের ব্যথাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল বা পায়ের ব্যথাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল ।

সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়ে বাবা বললেন, তোকে যা বললুম, অপুর সঙ্গে দেখা কর, ও-ই তো তোকে ভাগলপুরের কলেজে লেকচারারগিরির চাকরিটা নিতে বারণ করেছিল । অপূর্ব ব্যানার্জি বারণ করেননি, শুধু বলেছিলেন, ওই কলেজে তোমাকে হাফ মাইনে দেবে আর রসিদে পুরো মাইনের সই করাবে । বারণ করেছিলেন বাবা নিজে । বলেছিলেন, ওনাদের একা ফেলে অন্য কোথাও চাকরি করতে যাওয়া উচিত নয় । শিলঙে লেকচারারগিরি পেয়েছিল রাহু, তখন বাবা বলেছিলেন, যেতে হবে না, ওখানে বঙালখেদার গোলমাল লেগে থাকে । রাহুকে বাইরে যেতে দেননি অথচ অনিকেত বাইরে-বাইরে চাকরি করে চলেছে ।

মা মনে করেন, চাইবাসার জলবায়ু ভালো, অনিকেতের পেটের গোলমাল সেরে যাবে । অনিকেত যে বন্ধুদের নিয়ে জঙ্গলে বেড়াতে যায়, বন্ধুদের মহুয়ার মদ খেতে শিখিয়েছে, তা মা জানেন না, একবার পিসতুতো দাদা দুর্জয় আরেকটু হলেই ফাঁস করে ফেলতো । পিসতুতো ভাই দুর্জয়দা মহুয়ার লোভে আর অনিকেতের দেয়া পোশাকের লোভে মাঝে-মধ্যে চাইবাসায় যায় । গৌরীর সঙ্গে অনিকেতের সম্পর্কের কথা জানে । রাহুর মাকে অনিকেতের সম্পর্কের কথা ঘুরিয়ে জানাবার জন্য রক্তিম চ্যাটার্জির নিজের প্রেমকাহিনির উপন্যাসটা পড়তে দিয়েছিল । মা বুঝতেই পারেননি, চরিত্রগুলো আসলে অনিকেত আর ওর বন্ধুদের । 

বাবা নিচে চলে গিয়েছিলেন দোকান খুলতে । মা চান করতে চলে গিয়েছিলেন । চান করার ঘর আর পায়খানা দুটোই নীচের তলায় । কাজের মেয়ে ঘর পোঁছার জন্য পৌঁছে গিয়েছিল ওপরতলায় । রাহুর মা নিচেতলায়, তাই ফাঁকি দিয়ে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলবে মোছামুছি, রোজকার মতন । ঘর পুঁছতে-পুঁছতে আওয়াজ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলো মেয়েটা ।

 রাহুল বলল, ছিঃ, ওরকম আওয়াজ করছিস কেন ! বাড়িতে কিছু হয়েছে ?

কাজের মেয়ে পোঁছা থামিয়ে রাহুর দিকে সরাসরি তাকিয়ে, যেন ঘড়ির কাঁটাকে পেছন দিকে নিয়ে যাচ্ছে,  বলল, আমার একটা ফর্সা বাচ্চা চাই।

চাইলেই হয় না, বলল রাহুল, তুইও কালো, তোর বরও কালো । তোদের তেমন টাকাকড়িও নেই যে ডাক্তারের কাছে গিয়ে পেটের ভেতরে ফর্সা বাচ্চার বীজ নিবি । 

তুই তো জানিস রাহুলবাবা, আমার বর কালো, বহুরূপি, ভিককে করে বেড়ায়, কখনও কখনও তিনচার মাস পরে বাড়ি ফেরে, ও তো আজ পর্যন্ত একটা কালো বাচ্চাও দিতে পারেনি।ওই বহুরূপি বাড়ি ফিরলেও আমি তোর বাচ্চা চাই, তোর মতন ফর্সা, তোর মতন ঢ্যাঙা, তোর মতন কোঁকড়া চুল । মেয়েটার কন্ঠে বিশ্বস্ত হতাশা অনুভব করল রাহুল, যেন অন্ধকারে বসে কেউ নিজের সঙ্গে কথা বলছে । 

মেয়েটার বহুরূপি বরকে দেখেছে রাহুল, বছরখানেক আগে । নানা রঙিন কাপড়ের তাপ্পিমারা পোশাক, হাতে একটা বেঁকা লাঠি, পায়ে ঘুঙুর, মান্না দের গাওয়া গান গাইছিল তু প্যার কা সাগর হ্যায়, তেরি এক বুন্দ কে প্যাসে হম, লৌটা যো দিয়া তুনে, চলে যায়েঙ্গে জহাঁ সে হম, ঘায়ল মনকা পাগল পঞ্ছি উড়নে কো বেকরার, পংখ হ্যায় কোমল, আঁখ হ্যায় ধুঁধলি জানা হ্যায় সাগর পার, অব তু হি ইসে সমঝা, রাহ ভুলে থে কহাঁ সে হম, তু প্যার কা সাগর হ্যায়।

রাহুল বলল, তোর বর সারা পৃথিবীকে ভালোবাসে, শুধু তোকে ভালোবাসে না, দুনিয়ার সব্বাইকে ভালোবাসে। এরকম মানুষ কম হয় দুনিয়ায় । কেমন করে তোদের বিয়ে হলো রে ? তোকে আরেকবার বিয়ে করতে হবে । মুখের ভেতরে ভয়ের স্বাদ মেশানো কন্ঠে, আর নকল হাসি হেসে, বলল ও ।

কাজের মেয়ে, পোঁছা থামিয়ে, রাহুর দিকে স্পষ্ট তাকিয়ে, বলল, হয় হয়, ওই তো বুড়ো দাড়িঅলা লোকটা তোদের বাড়িতে একটা বাচ্চাকে নিয়ে আসে, ওটা তো ওর কালো নাতনির ছেলে, ওর বাপটা ছিল ফর্সা, ওদের বাড়িতে ভাড়া থাকতো, মেয়েটার সঙ্গে পেয়ার-মোহব্বত করেছিল, যেই পেটে বাচ্চা এসেছে শুনেছে, অমনি বিলেতে পালিয়েছে ডাক্তারি পড়তে । 

কার কথা বলছে বুঝতে পারলো রাহু । ভট্টাচার্য মশায়ের বিশাল বাড়িতে ভাড়া থাকতো একটা পরিবার, তাদের ছেলে বাবলু মিত্র, প্রেমে পড়েছিল মেয়েটার, কিন্তু বাবলুর বাবা-মা সম্পর্ক অস্বীকার করে ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন লণ্ডনে । ছেলেটা ডাক্তার হয়ে নিজের সন্তান আর প্রেমিকাকে নিতে এসেছিল । ভট্টাচার্যমশায়, বলেছিলেন, তুমি বিদেয় হও, এই ছেলে ভট্টাচার্য হিসেবে স্কুলে পড়ছে, মিত্র হিসেবে নয় ; ওর উপনয়ন দেয়া হয়েছে, ও এখন কায়স্হের সন্তান নয়, ব্রাহ্মণবাড়ির উত্তরপুরুষ।

রাহুলকে চিন্তামগ্ন দেখে কাজের মেয়ে বলল, চায়ের ঠেকের নন্দা অতো ফর্সা কেন ? দেখেছিস  তো ওর বাপ-মা দুজনেই কালো । নন্দা আসলে একজন রাজপুতের ছেলে । নন্দার মা রাজপুতটার বাড়িতে কাজ করতো, আমি যেমন তোদের বাড়িতে করি । 

রাহু বলল, তাহলে তুইও সেই রাজপুতটার কাছে যা । কাজের মেয়ে তখনও তাকিয়ে রাহুলের দিকে । কান খাড়া রেখেছে নিচের তলার কলঘরে জলপড়ার আওয়াজের দিকে । রাহুর মা ওপরে আসার আগেই নিজের বক্তব্য স্পষ্ট করে দিতে চায় ।

ও রাজপুতটা তো কবেই মরে গেছে, বলল কাজের মেয়ে, তারপর যোগ করল, আমি তো আর ওদের বাড়িতে কাজ করি না, তোদের বাড়িতে করি । তুই আমাকে একটা ফর্সা বাচ্চা দে । মেয়েটাকে দেখে মনে হয়, না হেসেও হাসতে পারে, না কেঁদেও কাঁদতে পারে, না বলেও ইশারা করতে পারে, এমনকী দাবি করতে পারে । আধিপত্য আকর্ষণ করে আবার ভয়ও দেখায় ।

—আমার সাহেব বন্ধুরা যখন এসেছিল, তখন বলতে পারতিস তো । একেবারে ধবধবে ফর্সা বাচ্চা পেতিস।ওরা তোর মতন মৎস্যগন্ধাকে পেয়ে বর্তে যেতো ।

—ওরা মেম আনে সঙ্গে করে । তুই তো মেমগুলোর সঙ্গে ঢলাঢলি করতিস, ওরা চুমু খেতো তোকে, তোর মা তো বকাঝকা করতেন । আমাকে একটা বাচ্চা দিতে তোর আপত্তি কেন রে ? উত্তেজনায় রুদ্ধশ্বাস, মেয়েটা এমনভাবে তাকিয়েছিল যেন ওর চোখ নিজের পলক ফেলতে ভুলে গেছে ।

বাচ্চা ? বাচ্চার জন্ম তো একরকমের সন্ত্রাস । রাহুলকে বলা হচ্ছে সেই সন্ত্রাসে অংশ নিতে । মেয়েটার  মুখের একমাত্র সুন্দর জিনিস হলো ওর চোখ দুটো, নাহ, বরং তাদের চাউনি, দ্রুত আর অনুসন্ধানী, বেপরোয়া,  অযত্ন আর  বিষণ্ণতার কোটরে ধ্যানমগ্ন। আত্মজ্ঞানের শোকাচ্ছন্ন ছায়া থেকে বাঁচার জন্য কোন মানুষই তার কৃত্রিম কৌশল বুঝতে পারে না, যেমনটা ঘটছিল রাহুলের মগজে । চর্বির পাতলা তবকে মোড়া মেয়েটা বসন্তঋতুর মতন ডগা থেকে মুকুল ফুসলিয়ে বের করে আনতে চাইছে ।

না, রাহুর মাথায় বজ্রপাত ঘটল না, বরং প্রস্তাবটা শুনে ওর শরীরে রহস্যময় রাসায়নিক ঢেউ উঠলো। অযাচিত আহ্লাদে হৃৎপিণ্ডের ভালভগুলোয় সংগীতের মূর্চ্ছনা বেহালার লিব্রেটোর মতন কাঁপুনি দিয়ে উঠলো । ওর মগজের প্রতিবর্তীক্রিয়া পারার মতন, টলটলে আর তাপ খেয়ে লাফিয়ে ওঠলো, স্মৃতিতে ঝলক দিয়ে উঠলো কুচকুচে কালোর মধ্যেকার  গোলাপি লাবিয়া ম্যাহোরা । সত্যকে হত্যা করার শক্তি রাহুর আছে বটে  কিন্তু তার মুখোমুখি হওয়ার সাহস  নেই। মেয়েটা কালো বলে ওর লাবিয়া ম্যাহোরা বেশি গোলাপি । যোনিওষ্ঠ ! 

ফিসফিস করে রাহু বলল, কেমন করে দেবো ? তার জন্যে তো জায়গা চাই, আড়াল চাই, দেখতে হবে বাবা-মা জানতে না পারে । দিনের বেলা কেমন করে সম্ভব ?

কাজের মেয়ে একইভাবে ফিসফিস করে বলল, রাত মানে তো  মাংস, প্রেম আর খুনোখুনি । আমি তো তা চাইছি না। আমি বীজ চাইছি, ফর্সা বাচ্চার বীজ ।  তোদের তিনতলায় জঞ্জাল রাখার ঘরে জায়গা আছে, মেঝেয় কিছু পেতে নেয়া যায়, আমি দেখে রেখেছি । তুই ঘাবড়াসনি । বেশিক্ষণ সময় লাগে না । পাঁচ-দশ মিনিটেই হয়ে যায় । আমি শায়া আর শাড়িটা বিছিয়ে দেবো, দুটো শায়া পরে আসবো, তাহলে তোর হাঁটুতে কষ্ট হবে না । কালকে এই সময়েই করব, মাইজি আর বাবুজি যখন নিচের তলায় থাকেন । আজকেই সাবান মেখে চান করে নেবো যাতে তুই আমার গায়ের গন্ধে গুটিয়ে না পড়িস । চুলে শাম্পু করে নেবো ।

কেকয়ির দুই ঠোঁটে হাসির মিচকেমারা ভুত । হৃদয়ের চারপাশে একটা শীতল আবরণ । 

গন্ধ ! বহুকাল চান না করার যে জংলি তিতকুটে সুগন্ধ হয়, তার টান জানে না মেয়েটা, রাহুল নিঃশব্দে বলল নিজেকে । আর চুল ? ওফ, কোনো নারীর আলুলায়িত চুল , ভাবা যায় না । চুল নিয়ে বোদলেয়ারের কবিতাটা উন্মাদ করে তোলে । রাহুলের মুখস্হ হয়ে গেছে, আমাকে তোমার চুলের দীর্ঘ, দীর্ঘ সুগন্ধ নিতে দাও, ঝর্ণার জলে পিপাসার্তের মতন আমার মুখকে সম্পূর্ণ ডুবে জেতে দাও, সুবাসিত রুমালের মতন হাতে নিয়ে খেলতে দাও, বাতাসে স্মৃতিকে উড়িয়ে দিতে দাও । আমি যাকিছু দেখি তা তুমি যদি জানতে — যাকিছু আমি অনুভব করি — তোমার চুলে যাকিছু আমি শুনতে পাই ! অন্য লোকেদের আত্মা সঙ্গীতের প্রভাবে যেমন ভ্রমণে বেরোয় তেমনই আমার আত্মা ভ্রমণে বেরোয় এই সুগন্ধে । তোমার চুলে রয়েছে একটি পুরো স্বপ্ন, পাল আর মাস্তুলসহ ; তাতে রয়েছে বিশাল সমুদ্র, যেখানে অগুনতি মৌসুমীবায়ু আমাকে বয়ে নিয়ে যায় মোহিনী আবহাওয়ায়, যেখানে আকাশ আরও নীল আর আরও নিগূঢ়, যেখানে বাতাবরণকে সুগন্ধিত করে তুলেছে ফল, পাতা, আর মানুষের ত্বক।তোমার চুলের সাগরে, আমি দেখতে পাই দুঃখী গানে সমাহিত বন্দর, সব কয়টি দেশের কর্মঠ মানুষ সেখানে, যতো রকম হতে পারে ততো ধরণের জাহাজ, বিশাল আকাশের অলস শাশ্বত তাপের পৃষ্ঠভূমিতে তাদের স্হাপত্য দিয়ে দিগন্তকে তনূকৃত ও জটিল করে তুলেছে।তোমার চুলের সোহাগস্পর্শে আমি কাউচে শুয়ে কাটানো দীর্ঘ ধীরুজ সময়কে ফিরে পাই, সুন্দর জাহাজের একটি ঘরে, বন্দরের অনির্ণেয় ঢেউয়ের দ্বারা ক্রমান্বয়ে দোল খাওয়া, তাজা জলের জালা আর ফুলের টবের মাঝে ।আগুনের পাশে রাখা কম্বলের মতন তোমার চুলে, আমি আফিম আর চিনির সঙ্গে মেশানো তামাকের শ্বাস নিই ; তোমার চুলের রাত্রিতে, আমি দেখতে পাই  অসীম ক্রান্তিবৃত্তের নীলাভ ঔজ্বল্য; তোমার চুলের ঢালের কিনারায়, আমি আলকাৎরা, মৃগনাভি আর নারিকেল তেলের গন্ধে মাতাল হয়ে যেতে থাকি ।আমাকে একটু-একটু করে খেয়ে ফেলতে থাকে তোমার তন্দ্রাতুর কালো বিনুনি । যখন তোমার স্হিতিস্হাপক, দ্রোহী চুল আমি চিবোতে থাকি, আমার মনে হয় আমি স্মৃতিগুলো খেয়ে ফেলছি।”

রাহু টের পেলো, কাজের মেয়ে বা কাজের বউ, যাই হোক, ওর ত্বকের তলা থেকে হালকা আলো পরিশ্রুত হয়ে ওকে জেল্লা দিয়েছে, বলতে চাইছে, এতোকাল যাবত ওর চালচলন, বন্ধুমহল লক্ষ্য করে, “রাহুলবাবা, তোর জীবনে বিবেকের কোন স্থান নেই ; তুই অসম্ভবকে সম্ভব দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারিস । মন্দ কাজ করার  জন্য তোর স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে আর সেই ঘুমন্ত মন্দকে নিজের মধ্যে জাগিয়ে তোলার  জন্য শুধুমাত্র উপযুক্ত পরিস্থিতি দরকার ।  প্রত্যাশার ভয়ের চেয়েও বেশি তোর আসল কাজের ভয় ; কই আমি তো ভয় পাচ্ছি না । 

ঘর পুঁছতে-পুঁছতে ওর এতো কাছে চলে এসেছিল মেয়েটা যে দারিদ্র্যের মধ্যে কাটিয়ে দেওয়া জীবনের গন্ধের ঝাপট এসে লাগল রাহুলের মুখময় । খুব কম লোকই বুঝতে পারে যে তাদের জীবন, তাদের চরিত্রের সারমর্ম, তাদের ক্ষমতা আর তাদের সাহসিকতা হল তাদের আশেপাশের নিরাপত্তার ঘেরাটোপের প্রকাশ মাত্র। আর এই মেয়েটা রাহুলের সেই ঘেরাটোপকে একটা প্রস্তাবে ফর্দাফাঁই করে দিয়েছে । জীবন সামাজিক পার্থক্য বা অর্থনৈতিক সংগ্রামের মধ্যে সীমিত নয়, বরং চিরকালের জন্য অস্থায়ী আকাঙ্ক্ষার মতো, অথবা অন্ধকারের বিরুদ্ধে চিরকাল জ্বলতে থাকা আলোর মতো, আর এই মেয়েটা সেই আলো চায় । বহু দূরের কিছু দেখতে পাবার দৃষ্টি দুই চোখে।

 গৌরী যখন অনিকেতকে বলেছিল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি কেতু”, তখন কি অনিকেতের ঘেরাটোপ বিদীর্ণ হয়েছিল ?  একজন বিবাহিতা নারীর ভবিষ্যৎ পেছন দিকে এগিয়ে বর্তমানকে গিলে খেয়ে ফেলছিল, যে বর্তমানে চিরকাল আটক থাকবে অনিকেত, একাকীত্বের বন্দী । ভুলে থাকার ভান করতে থাকবে । একজনের অস্তিত্বের, তা  যে  যুগেরই হোক, তার  জীবনবোধকে বোঝানো অসম্ভব । তা কি সত্যিই  তার ভেতরকার মানে আর  অনুপ্রবেশকারী সারমর্ম দিয়ে ফাঁস করে দিতে পারে ? হয়তো পারে । আবার নাও পারতে পারে ।

পাড়ার মারামারির সকালটা  ছিল বেশ গরম,  এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে তার আগে, ফলে আকাশ  উজ্জ্বল আর মেঘহীন। মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো এড়াতে রাহুল সিংহ নিজের ডায়েরির পাতা ওলটাতে লাগলো, আর হঠাৎই এই লেখাটা ওর চোখে পড়ল, তখন আঙুলে আরথ্রাইটিস হয়নি । সেও ছিল একটা বিপদের দিন, যেমন এখন, এই মুহূর্তে,  দোনামনায় পড়েছে । ডায়েরিতে সাধুভাষায় কেন যে লিখেছিল তা মনে করতে পারল না :

“বিশ্ববিদ্যালয় হইতে পথে নামিবার পরই, প্রথম যে চাকুরিটিতে যোগ দিয়াছিলাম তাহা, দশটা-পাঁচটা চক্র না হইলেও,  অত্যন্ত বিরক্তিকর ছিল বলিয়া অন্যপ্রকার একটি চাকুরির সুযোগ পাইতেই তাহাতে যোগ দিলাম কেননা আমি একই গৃহে একই পাড়ায় একই শহরে থাকিতে অভ্যস্ত নই ; ভালো লাগে না , অন্যত্র পলাইতে ইচ্ছা করে ।  একই মানুষদের দ্বারা পরিবৃত থাকিবার ফলে জীবন ও জীবনবীক্ষা মামুলি ও  ক্ষুদ্র হইয়া পড়ে । নতুন কিছু ঘটিবার সম্ভাবনা সীমিত বোধ হয় । যদিও আমি রেকলুজ প্রকৃতির, একা থাকিতে পছন্দ করি, কম কথা বলি, কিন্তু আমার চতুর্দিকের মানুষদিগের কথাবার্তা ও জীবনযাত্রায় আগ্রহের কারণে, ওই যে বলিলাম, একই গৃহ-পাড়া-শহরের বৃত্তে পাক খাইয়া সেই একই মানুষদিগের মুখ দেখিয়া ও কথাবার্তা শুনিয়া কিয়ৎকালের ভিতরই ক্লান্ত বোধ করি । হ্যাঁ, ঠিকই, অন্যের জীবনের ঘটনাহীনতা আমার জীবনকেও ঘটনাহীন করিয়া তুলিতে পারে , তোলেও

          প্রতিটি  ঘরের নিজস্ব উদাসীনতার যন্ত্রণাক্লিষ্ট সুবাস হয়, প্রতিটি গৃহের নিজস্ব নয়নসুখ আলো-বিচ্ছুরণ , প্রতিটি পাড়ার নিজস্ব গুঞ্জনমালা বাতাসকে ভারাক্রান্ত করিয়া ভাসে, প্রতিটি শহরের নিজস্ব কথাপ্রণালীর কাহিনিময় শব্দতরঙ্গ চতুর্দিক মথিত করে । সেকারণে চিরকাল নূতন সুবাস, আলো, গূঞ্জন ও শব্দতরঙ্গের অনুসন্ধানে ক্ষণিক-তীর্থের উদ্দেশ্য-সন্ধানী যাযাবরের ন্যায় চরিয়া বেড়াইবার প্রয়াস করিয়াছি। 

          প্রথম চাকুরিটি পাইতে অসুবিধা হয় নাই কেননা আমার পক্ককেশ ইনটারভিউ গ্রহণকারীগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল  পর্যাবেক্ষণান্তে  অর্থশাস্ত্রের কয়েকটি তাত্ত্বিক প্রশ্নের  উত্তরে সন্তুষ্ট বোধ করিয়া , যদিও সে-সকল তত্ত্ব বর্তমানে মানবচরিত্রের ব্যাখ্যাহীনতার কারণে খারিজ হ‌ইয়া গিয়াছে, তৎক্ষণাত চাকুরিটিতে যোগ দিতে বলেন । চাকুরিটি খারাপ ও ভালো লাগার কারণটিও একই । প্রতিনিয়ত ট্যুরের চাকুরি হইলেও, এবং ট্যুরজনিত রোজগার মনোরম হইলেও , চাকুরিটি ছিল অন্যের দোষ ও কারচুপি অন্বেষণ সংক্রান্ত । যেথায় যাইতাম, শহরতলি  হউক বা শহর, তথাকার কর্মচারীগণ তটস্হ হইয়া থাকিত। কেহই সন্নিকটে আসিতে চাহিত না । তাহাদের ও আমার বরাত এতই খারাপ যে হাতে কলম তুলিয়া লইতেই কারচুপি খুঁজিয়া পাইতাম । ফিরিয়া প্রতিবেদন জমা দিবার কয়েক মাস পরে শুনিতাম অমুকের চাকুরিটি আমি খাইয়া লইয়াছি অথবা তমুকের পদোন্নতি বিঘ্নিত করিয়াছি। প্রতিনিয়ত নূতন-নূতন স্হানে যাইতে ভালো লাগিত, নূতন জনপদ  ও শহরের জনগণকে শুনিবার , জানিবার , বুঝিবার সুযোগ হইত, নবনব খাদ্যবস্তুর স্বাদ পাইতাম । কিন্তু কাহারও চাকুরি খাইয়া লইতে বা পদোন্নতিতে বাধা সৃষ্টি করিতে একেবারেই ভালো লাগিত না । 

          অন্য চাকুরি খুঁজিতে ছিলাম । দরখাস্ত জমা দিবার পর যথারীতি ইনটারভিউয়ের ডাক পড়িল । এই চাকুরিটি ছিল কৃষি উন্নয়ন সংক্রান্ত । চাষবাস সম্পর্কে আমার কোনো অভিজ্ঞতা তৎপূর্বে  , ছাদের টবে মৌসুমি ফুলে  সীমিত ছিল ।  সুতরাং কৃষি বিষয়ক গ্রন্হাদি সংগ্রহ করিয়া রাত জাগিয়া পড়াশুনা করিলাম । তথ্যাদি মুখস্হ করিলাম । আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া পরামর্শ লইলাম । ইনটারভিউতে আমাকে কৃষি বিষয়ক  একটিও প্রশ্ন করা হইল না , কেবল সাধারণ জ্ঞান যাচাই করিবার নিমিত্ত কয়েকটি প্রশ্ন করা হইল যেগুলির সঠিক উত্তর দিতে অসুবিধা হইল না । ইনটারভিউ দিবার পর ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিয়ে যখন পিছন ফিরিয়াছি, ইনটারভিউ পরিষদের চেয়ারম্যান কহিলেন, একটু দাঁড়ান । পুনরায় তাঁহার মুখোমুখি হইতে, তিনি বলিলেন, ওই ফুলদানিটি দেখিতেছেন, উহাতে কয়েকটি শষ্যের শুকনো শিষ রহিয়াছে, আপনি উহার মধ্য হইতে ধানের শিষটি লইয়া আসুন ।

          নির্দেশ শুনিয়াই বিপদে পড়িলাম । একত্রে এতপ্রকার ফসলের শিষ বা ছড়া দেখি নাই । বস্তুত বাল্যকাল হইতে শহরের ঘিঞ্জি নিম্নবিত্ত পাড়ায়  জীবন যাপন করিবার কারণে, এবং প্রথম চাকুরিটি কেবল নথিপত্র যাচাই করিবার ছিল বলিয়া চাষবাস সম্পর্কে জ্ঞানান্বেষণের সুযোগ হয় নাই । খেতে গিয়া কোন ফসলের শিষ দেখিতে কীরকম তাহা জানিবার সুযোগ হয় নাই । চালের সহিত যে ধানগুলি মিশিয়া থাকে সেই ধান নিকট হইতে দেখিবার সুযোগও হইত না, কেননা ভাত রাঁধিবার পূর্বে মা-জেঠিমা চাল হইতে তাহা বাছিয়া ফেলিয়া দিতেন । সেসময়ে টিভি ইত্যাদি গণমাধ্যম থাকিলে কোনোও না কোনো চ্যানেলে ধানের ছড়ার  সহিত পরিচয় হইত নিশ্চয়, যেরূপ বর্তমানের শিশু-কিশোরদিগের হয় । 

          ফুলদানিটির নিকটে গিয়ে দুইটি অল্প-পরিচিত  শিষ পর্যবেক্ষণ  আঁচ করিলাম যে সেগুলি যব ও গমের । সরস্বতী পুজার পূর্বে আমাদের গৃহের ছাদে টবে গম পুঁতিয়া দিদিগণ পুজার  জন্য শিষ সংগ্রহ করিতেন ।         অন্য শিষগুলি বোতল পরিষ্কারের ব্রাশের ন্যায় দেখিতে এবং সেগুলিতে ধানের  দানা নজরে পড়িল না । কয়েকটি ছড়া দেখিয়া ঘাসের শিষের ন্যায় প্রতিভাত হইল । অগত্যা যে শিষটি অবশিষ্ট তদ্দর্শনে অনুমান করিলাম যে উহা  নিশ্চয়ই ধানের হইবে । সেইটি তুলিয়া আনিয়া চেয়ারম্যানের সন্মুখে রাখিলাম । এক মাসের ভিতর নূতন চাকুরির নিয়োগপত্র পাইলাম, লখনউতে যোগ দিবার নির্দেশসহ ।

          লখনউতে যোগ দিবার প্রথম দিনই আমাকে বলা হইল যে আমার জন্য বুন্দেলখণ্ড এলাকাটির কৃষি-উন্নয়ন পর্যালোচনার ও প্রতিবেদন তৈয়ারির কর্ম বরাদ্দ হইয়াছে এবং কল্যই আমি যেন ইটাওয়া-ললিতপুর-জালাউন ইত্যাদি অঞ্চল পরিদর্শনে যাত্রা করি । অধস্তন আধিকারিকগণের কথা শুনিয়া অনুমান করিলাম যে কার্যালয়ের রাজনীতির খেলায় নূতন অধিকারীদের এই প্রকার প্রত্যন্ত অঞ্চল, কৃষিজ্ঞানের পরীক্ষা লইবার জন্য ,নির্ধারিত হয় । অঞ্চলগুলিতে রাত্রিবাসের জন্য হোটেল , যানবাহন ও খাওয়া-দাওয়ার অভাব সহজেই কাবু করিয়ে তোলে ।   

          সৌভাগ্য যে ইটাওয়ার জেলা কৃষি আধিকারিক শার্দুল মীনাকে আমাদের অফিসের কেহ আগেভাগে, আমি যোগ দিবার পূর্বেই, যেহেতু বুন্দলেখণ্ড আমার জন্য চিহ্ণিত হইয়াছিল, আমার সম্পর্কে বিস্তারিত সংবাদ সরবরাহ করিয়া দিয়াছিল । কথাপ্রসঙ্গে জানিলাম, তিনি আমার স্নাতকস্তরের সহপাঠী অভিমন্যু মীনার অগ্রজ । তাঁহার সরকারি বদান্যতায় অতিথিভবনে রাত্রিবাসের ও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্হা হইয়া গেল । ক্ষেত্রসমীক্ষায় সহায়তা করিবার নিমিত্ত তিনি তাঁহার বিভাগের একজন বয়স্ক অফিসার, শ্রীসুগ্রীব নিমচকে আমার সঙ্গে দিলেন । ভালোই হইল । সরকারি জিপ ব্যবহারের সুযোগ পাইলাম ।

          তিন দিনের ক্ষেত্রসমীক্ষায় আমার কর্ডুরয় প্যান্ট , ডোরাকাটা শার্ট , চোখের পাতা, মাথার ও ভুরুর চুল গেরুয়া ধুলায় , এবং কাগজপত্র সংখ্যা ও তথ্যে ভরিয়ে উঠিল । গেঞ্জি ও আন্ডারওয়্যার কেবল পরিবর্তন করিতাম , কেননা মাত্র চার দিনের  ভ্রমণ বলিয়া দুইটি সেট শার্ট-প্যান্ট লইয়াছিলাম । 

          অঞ্চলটি বর্ণনাতীত । পথের দুইধারে গভীর ও সঙ্কীর্ণ গিরিখাতের শুষ্ক ও বিমূর্ত ভুলভুলাইয়ার প্রায় জনহীন বিস্তার ধূলা উড়াইয়া সতত  অধঃক্ষিপ্ত জলরাশির প্রত্যাশায় ভূতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যকে করিয়া তুলিয়াছে কৌতূহলোদ্দীপক ও দূরভিসন্ধিপূর্ণ । দ্বিপ্রহরের পূর্বেই দিগন্ত আবরিত হয় গেরুয়া কুয়াশায় । পুষ্পিকা ও প্রাণীকুল এতদঞ্চলে ছলনাময় । চতুর্দিকে থম মারিয়া আছে মায়াময় অস্হিরতা । একটিই নদী বহিয়া গেছে যাহা উটের পিঠে বসিয়া পারাপার করিয়া থাকে স্হানীয় গ্রামবাসীগণ ।

          চতুর্থ দিন কিয়দ্দূর রওনা হইবার পর শ্রীনিমচ একটি মন্দিরের নিকট জিপগাড়ি পার্ক করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলে বুঝিতে পারিলাম যে উহা একটি কালীমন্দির । অবাক লাগিল । সাধারণত কয়েকঘর বাঙালি যে অঞ্চলে বসবাস করেন সেখানেই কালীমন্দির গোচরে পড়ে । শ্রীনিমচকে প্রশ্ন করিতে উনি বলিলেন যে মন্দিরটি  শপ্তদশ শতকে প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন  আতেরের মহারাজা  বদন সিংহ। তিনি শক্তির উপাসক ছিলেন । এতদঞ্চলের শক্তি-উপাসকগণ সুকর্ম সমাপনান্তে মন্দিরে ছাগ-বলি দিয়া থাকেন । 

           পুরোহিত শ্রীনিমচকে কহিল, বাবাসাহেব নিকটের একটি গ্রামে আসিয়াছেন । প্রত্যুত্তরে নিমচ কহিল, বহুদিন পর বাবাসাহেব নদীর এই পারে আসিলেন ।  দেখা করিয়া লইব । সেই পরবের সময় আশীর্বাদ লইয়াছিলাম, আর তো দেখা হয় নাই ।

          --বাবাসাহেব ? সাধুসন্ত হ্যাঁয় কেয়া ? জিজ্ঞাসা করিলাম ।

          --জি হাঁ । পঁহুচে হুয়ে আদমি হ্যাঁয় । শ্রীনিমচ প্রত্যুত্তর করিল । অভিব্যক্তিটি অদ্ভুত লাগিল । পৌঁছে-যাওয়া মানুষ ! মহাকাশে, চাঁদে, সমুদ্রগর্ভে  সর্বত্র মানুষ পৌঁছাইয়া গিয়াছে । সাধুসন্তরাও সাধনালব্ধ ক্ষমতার  বলে পৌঁছাইয়া যান হয়তো তাঁদের অভীষ্ট  লক্ষ্যে ।

          কাঁচা রাস্তায় জিপগাড়ি ছুটিল আমার পোশাক ও ত্বকে গেরুয়া  মিহিন ধুলার আস্তরণ  সংগ্রহ করিতে-করিতে । কিছুটা যাইবার পর লালকাঁকরের পথের মাঝখানেই কয়েকজন গ্রামবাসী বসিয়াছিল বলিয়া চালক গাড়ি থামাইল; তাহারা চালককে বলিল যে এই রাস্তাটি খারাপ হইয়া গিয়াছে , আপনারা পাশ্ববর্তী গ্রামের ভিতরের পথ দিয়া চলিয়া যান। বাতাসকে আরও ধুলিধূসরিত করিয়া  সাত-আট কিলোমিটার  যাইবার পর দেখিলাম একটি বিশাল বটবৃক্ষের তলায় প্রায় কুড়ি-পঁচিশজন গ্রামবাসী একজন তামাটে পেটমোটা মোড়লের সন্মুখে বসিয়া, সম্ভবত তাঁহার বাণী শুনিতেছে। তদ্দর্শনে চালক সেই দিকে জিপগাড়িটি লইয়া গিয়া থামাইল । শ্রীনিমচ নামিল, আমিও তাঁহার সহিত নামিলাম । মোড়ল লোকটির বাবরিচুল উস্কোখুস্কো, উর্ধাঙ্গে পোশাক নাই, নিম্নাঙ্গে একটি চাককাটা লুঙ্গি। তিনি বসিয়া আছেন মাটির উঁচু বেদির উপরে ।

          শ্রীনিমচ মোড়লের নিকট গিয়া হাতজোড় করিতে তিনি কোঁচড় হইতে একমুষ্টি মুড়ি দিলেন এবং নিমচ তাহা তৎক্ষণাত ভক্ষণ করিয়া  লইল । মোড়ল আমাকে দেখিয়া শ্রীনিমচকে জিজ্ঞাসা করিল, সরকার বাহাদুর ?

          --জি হাঁ । শ্রীনিমচের বিনয়ী প্রত্যুত্তর ।

          মোড়ল আমাকে ডাকিয়া বলিল, সরকার বাহাদুর, তুম ভি লো । যত্রতত্র ভক্ষণ সম্পর্কে আমার পেট খারাপের  ভীতি আছে । আমি পকেট হইতে রুমাল লইয়া তাঁহার প্রদত্ত মুড়ি বাঁধিয়া লইলাম, পরে ফেলিয়া দিব । আমার আচরণে মোড়ল প্রীত হইলেন, বলিলেন, আও । আমি আরও নিকটে গেলে তিনি আমার মাথার উপর হাত রাখিয়া বলিলেন, জিতে রহো।

          আমরা জিপগাড়িতে  গিয়া বসিলাম । কিয়দ্দূর যাইবার পর শ্রীনিমচ বলিল, আপনি বুন্দেলখণ্ডের চম্বলঘাটিতে যেখানে ইচ্ছা যাইতে পারেন, কেহ আপনার কোনো ক্ষতি করিবে না, বাবার আশীর্বাদ পাইলেন । প্রশ্ন করিলাম, ইনি কি এতদঞ্চলের কোনো ধর্মগুরু ? পোশাক দেখিয়া তো মনে হইল বয়স্ক চাষি । শ্রীনিমচ কহিল, স্যার উনি  ডাকাত সর্দার বাবা মুস্তাকিম, সরকার ওনার মাথার দাম রাখিয়াছে এক লক্ষ টাকা । যাহারা ঘাসের উপর বসিয়াছিল তাহারা ওনার দলের ডাকাত ।”


রাহুল দেখলো কাজের মেয়েটা ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে, ঘর পোঁছা থামিয়ে। ও জিগ্যেস করল, তোর অমন নাম কেন, কেকয়ি ?


মেয়েটা বলল, রাজা দশরথের বউয়ের এই নামই ছিল বলে বাবা আদর করে কেকয়ি বলে ডাকতো। আমার দিদির নাম উরমিলিয়া । ওর বিয়ে হয়ে গেছে একজন খেতিহর মজদুরের সঙ্গে, দুজনে পাঞ্জাবে ফসল রোপনি আর কাটাইয়ের কাজ করে । দুটো বাচ্চা হবার পর বাচ্চাদানি কাটিয়ে ফেলেছে, যাতে মাহবারির চার-পাঁচদিন ছুটি না নিতে হয় ।


ওঃ, কৈকেয়ী । কৈকেয়ী হয়ে গেছে কেকয়ি ! রামায়ণে কৈকেয়ী কেকয়রাজ অশ্বপতির মেয়ে। অশ্বপতি পাখির ভাষা বোঝার বরপ্রাপ্ত ছিল কিন্তু  শর্ত ছিল সে কারো কাছে সেই ভাষার অর্থ বলতে পারবে না ; বললে তার মৃত্যু হবে। একদিন সে আর তার বউ বাগানে বেড়াবার সময়ে এক জোড়া রাজহাঁসের কথাবার্তা শুনে মুগ্ধ হয়ে হেসে ফেলে। রানি  এতে খুব কৌতূহলী হয়ে  কারণ জানতে চায় যদিও রানি জানতো তা করলে রাজা মারা যাবে । তখন রাজা বুঝতে পারলো তার বউ তাকে ভালোবাসে না  বললেই চলে। এজন্য রাজা তার বউকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয় । মাতৃহীন কৈকেয়ী চাকরানি মন্থরার কাছে বড়ো হয়েছিল।  স্বয়ম্বরে কৈকেয়ী দশরথকে বিয়ের মালা পরায়। কৈকেয়ী নাকি দশরথের সবচেয়ে প্রিয় বউ ছিল । যারা সবচেয়ে প্রিয়, তারাই বিপদ সঙ্গে করে নিয়ে আসে ।


রাহুল নিজেকে নিঃশব্দে বলতে শুনলো, এই কাজের মেয়ে ওকে মগজের স্বয়ম্বরে টানতে-টানতে নিয়ে গেছে, ঠিক যেমন সিকন্দর নামের গাধাটাকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল । গাধাটার মতনই রাহুলের হোসপাইপে সাড়া পড়ে গেছে । রাহুল ফিসফিসিয়ে বলল, তুই কি আমাকে ভালোবাসিস, যেমন সিনেমায় দেখায় ?


কেকয়ি ওর দিকে তাকিয়ে বলল, সিনেমা তো আমি আজও দেখিনি । তুই যদি দেখাতে নিয়ে যাস তাহলে যাবো। আবার আগের মতন যৌন দীর্ঘশ্বাসের আকর্ষণ মিশিয়ে বলল, আমার সিনেমা দেখার শখ নেই। আমি কালো, গরিব, বাড়ি-বাড়ি কাজ করে খাই বলে কি কাউকে পছন্দ করতে পারি না ? আমি তোকে জড়িয়ে ধরতে চাই । এখন ধরবো ? মাইজির আসবার সময় এখনও হয়নি !


মাইজি এসব জানতে পাারলে তোকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেবে, বলল রাহুল ।


ছাড়িয়ে দিলে তোরা কাজের লোক পাবি না । তিনতলা বাড়ির এতোগুলো ঘর ঝাড়ু দেয়া, পোঁছা, বাসন মাজা, মশলা পেশা কে করবে আমার মতন । আমার গা-গতর দেখছিস তো । পাড়ার আর কেউ এতো কাজ পারবে না রাহুলবাবা । কেন করি ? তোকে পছন্দ করি বলে । ঘর মোছা থামিয়ে, উঠে দাঁড়ালো কেকয়ি, আর নিজের সুঠাম শরীর মেলে ধরলো । হরপ্পা-মহেঞ্জোদরোর সেই মাটির তৈরি মেয়েটা, হাজার হাজার বছর পরও নিখুঁত।


মেয়েরা ওকে কতোরকমের দুর্দশায় ফেলেছে । কেকয়িকেও তো মেয়ে বলা যায় । পরিচারিকা বলে কি পরিচিত যূবতী বলা যাবে না ? অফিসের সেই ঘটনাটা মনে পড়ে গেল ওর, রাহুর। আলেয়া সান্যাল ফেলেছিল বিপদে। ভাগ্যিস নিশীথ এসে ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল । ডায়েরি খুলে পড়তে আরম্ভ করল :



আপনিই তো ওকে বলেছিলেন, ধ্যাড়ানির সময়ে করলে বিপদ নেই । বলেননি ? এই চিঠিটা দেখুন, শুধু দেখুন, ছোঁবেন না । এটা আপনার হাতের লেখা তো ?

ভাগ্যিস ধ্যাড়ানি শব্দটা ব্যবহার করেছিল । মাসিক বা মেন্স বললে বিহারি কর্মচারীগুলো টের পেয়ে যেতো। 

অরিন্দম অবশ্য টের পেয়ে গিয়েছিল ; তবু মাথা নামিয়ে কলম হাতে ব্যস্ত থাকার অভিনয় করছিল । পাগল হয়ে কয়েকমাস লুম্বিনী পার্কে ভর্তি ছিল । পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশি ট্যুরে গেলে তার বউকে চটকাবার জন্য লাঞ্চের সময়ে বাড়ি যাচ্ছি বলে কেটে পড়ত অরিন্দম । ওকেও ধ্যাড়ানির আইডিয়াটা দিয়েছিল রাহুল, কিন্তু বউটা অতোটা এগোতে দেয়নি ; বলেছিল, “শুধু ওপর-ওপর বোলাও” । ব্যাস পাগল হয়ে গেল। অফিসের নারী-নারকোটিক গ্যাঙ ওকে বলেছিল, “আরে অন্যের বউকে ছেড়ে আমাদের দলে এসো, ফি-হপ্তায় নতুন মাল।” 

যায়নি । প্রেমে ফেঁসে হালুয়া টাইট ।

চিঠিটা ছোঁ মেরে কেড়ে নেবার তালে ছিলুম, বুঝতে পেরে ভাঁজ করে বাঁ হাতে পাট করে রাখলো আলেয়া। বলল, “এটা আপনার মা-বাবাকে দেখাবো, ওনারা বিশ্বাস করবেন যে চিঠিটা আপনি আমাকে লিখেছেন, কেননা আপনার বিখ্যাত কবিতায় আমার নামও আছে । আপনার কবিতা ফটোকপি করে আপনার বন্ধু বিলি করেছিল অফিসে । সবাই পড়েছে।”

বাঞ্চোৎ নিশীথ ! আমি কলকাতায় মামলা লড়ছি, রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করছি । রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছি আর ও ব্যাটা আমার কবিতাটা যোগাড় করে ফটোকপি করে বিলিয়েছে । অফিসেই ফটোকপির মেশিন রয়েছে, তাই যতো ইচ্ছে কপি করে বাঙালি কর্মচারীদের মধ্যে বিলি করেছে । আর আমি ফিরে কাজে যোগ দিতেই আমাকে দিয়ে প্রেমিকাকে প্রেমপত্র লিখিয়েছে । আলেয়ার চিঠিটা আট পাতার ; একই সঙ্গে আত্মহত্যার হুমকি আর বিয়ে করার কাঁদো-কাঁদো প্রস্তাব ।

নিজের নিঃশব্দ সংলাপ গিলে ফেলরছিল রাহুল : “ইডিয়টটা আমার চিঠিটা কপি করার বদলে অরিজিনালটায় সই করে পাঠিয়ে দিয়েছে ; হিন্দি স্কুলে পড়ে দু’পাতা বাংলা লেখাও কপি করতে পারেনি । বলেছিলুম, কপি করে আমার চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দিও ।”

—আপনি আমাকে বিয়ে করুন । সক্কোলে বিশ্বাস করবে এই প্রেমপত্রটা আপনিই আমাকে লিখেছেন। আপনার বাবা-মা পাত্রী খুঁজছেন তো ? আমিই পাত্রী ।

বলে কী মেয়েটা !

—আপনি নিশীথের চেয়ে হাজারগুণ ভালো পাত্র । নিজেদের বাড়ি আছে । মাইনেও অনেক পান। আমাদের পরিবারের মতন আপনিও ঘটি । শুনেছি লর্ড সিনহা পরিবারের বংশধর ।

কন্ঠস্বরে ভারিক্কি অফিসারগিরি এনে রাহুল বলেছিল, “দ্যাখো আলেয়া, এটা তোমার আর নিশীথের ব্যাপার, আমাকে অযথা টেনে আনছো এর মধ্যে । হাতের লেখা আমার, স্বীকার করছি, কিন্তু চিঠিটা নিশীথ লিখেছে তোমাকে, তোমার আটপাতা চিঠির উত্তরে । ও তো বলেইছে যে তোমাকে বিয়ে করবে। তোমাদের বাড়িতে যাবেন ওর বাবা-মা।”

নিশীথ ব্যাটা সত্যিই কালো । বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে কথা বলে । ভাড়া বাড়িতে থাকে ।

—-না, আমি আপনাকেই বিয়ে করব । আপনার কবিতায় আমার নাম আছে । সেই আলেয়া কে তা আমার জানার দরকার নেই । আমি শিয়োর, আপনার বাবা-মা সেই আলেয়াকে চেনেন না, কিন্তু আমাকে চিনবেন । আমি আপনার অধস্তন কর্মচারী । ওনারা মেনে নেবেন যে আপনি আমাকে এক্সপ্লয়েট করেছেন ।

ওফ, ভাগ্যিস সেক্সুয়ালি এক্সপ্লয়েট করেছেন বলেনি । সবকটা বিহারী কর্মচারী আমাদের কথাবার্তা টের পেতে চাইছে ।

—আপনিই তো লিখেছেন,অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্থতা” । কী ? লেখেননি ? আপনার পুরো কবিতাটা আমার মুখস্হ । শুধু আমার কেন, অনেকেরই মুখস্হ । এখন আপনিই ঠিক করুন কী করবেন ।

অরিন্দম উঠে বাইরে চলে গেল । ভালো হলো । 

একটু পরে ফিরে এলো অরিন্দম ; সঙ্গে নিশীথ ।

আলেয়ার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো নিশীথ, “আরে কী করছ কি ! রাহুলদাকে ভড়কি দিচ্ছ কেন ? তুমি তো জানো আমি ভালোভাবে বাংলা লিখতে পারি না । রাহুলদাকে দিয়ে তোমার চিঠির উত্তর লিখিয়েছিলুম ।

লেয়ার হাত থেকে চিঠিটা কেড়ে নিয়ে রাহুলকে দিয়ে নিশীথ বলল, “নাও, নাও, আবার কোন বিপদে পড়বে।”

চিঠিটা নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ।

আলেয়ার হাত ধরে ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল নিশীথ ।

পেছন ফিরে আলেয়ার হাসি মনে আছে আজও ।

নারীর হাসিও আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে । কাজের মেয়ে কেকয়ি যেমন টয়লেটে বসে মুচকি হাসি দিয়েছিল ।

ডায়েরির পাতা ওল্টাবার সময়ে আরেকটা বেইজ্জতির ঘটনা নজরে পড়ল রাহুলের, ওর অফিসের ঘটনা : 

“সরকারি চাকরি আমি অনেক আগেই ছেড়েছিলুম । কতোবার বলেছি । তবু সাক্ষাৎকার নিতে বসে কেন যে অনেকে বলে ওঠে, আপনি তো সরকারি চাকরি করতেন । সরকারি চাকরি করলে আমার মাইনে প্রত্যেক ফাইনান্স কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী বাড়তো, পেনশন বাড়তো । সরকারি চাকুরের মাইনে আর পেনশান বাড়ে কিন্তু আমার বাড়ে না । ১৯৯৭ সালে রিটায়ার করার সময়ে যা ছিল তা-ই আছে।  আমার সময়ের পিওনদের পেনশনও আমার চেয়ে বেশি হয়ে গেছে । 


কবিতা লেখার দরুন গ্রেপ্তার হয়েছিলুম তা অফিসের পিওনরাও জানতো । পঁয়ত্রিশ মাস মামলা চলেছিল আর তখন কতো রকমের গালগল্প দপতরে ছড়িয়েছিল কে জানে । চাকরিটা আমি ছেড়েছিলুম পচা নোটের আবহে আমার অ্যালার্জি আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল । তার ওপর নোট পোড়াবার ফাঁক গলিয়ে একদল কর্মী পচা টাকাগুলোকে বদলাবার নিজেদের দল গড়ে ফেলেছিল । 


আগের  চাকরি ছাড়ার আরেকটা কারণ ছিল ভারতবর্ষের গ্রামগুলোয় ঘুরে বেড়াবার নতুন চাকরি । তার আগে চাষবাস সম্পর্কে কিছুই জানতুম না । কতো রকমের সেচ ব্যবস্হা হয়, ফসল হয়, কোন ফসলের গাছ কেমন দেখতে, কোন রাজ্যে কোন ফসল কেন বেশি হয় । পশুপালন সম্পর্কে জানতুম না, কতোরকমের পশু আছে ভারতে, বিদেশ থেকে কোন পশুদের আনা হচ্ছে– আকাট ছিলুম। তাই আমি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি লেখা আর সেসব বই পড়া বন্ধ করে নতুন চাকরির জন্য জরুরি বই পড়া আর্ম করলুম । 


বলা যেতে পারে জীবন পালটে গেল ভারতের গ্রামের মানুষদের সঙ্গে মিশে। আর গ্রামগুলোতে গিয়ে থাকার যে কষ্ট তা তো জানতুম না । শহরের জল খাওয়া পেটে গ্রামের জল সহ্য হতো না প্রথম দিকে ; পেট খারাপ হতো । পেট খারাপ হলে শহরের মতন পায়খানা পাওয়া যেতো না । আখের খেতে বা ধান খেতের আড়ালে বসে হাগার লজ্জা ছিল না, কেননা কলেজে ন্যাশানাল ক্যাডেট কোরে দল বেঁধে হাগতে যেতুম । বাবা বলেছিলেন একটা ফোলডিঙ ছাতা সঙ্গে রাখ । কতো জিনিস রাখব সঙ্গে ? নিজেকেই তো বইতে হতো । কতো নদীর ধার দিয়ে হেঁটেছি, নদী পেরিয়েছি ফুলপ্যাণ্ট ভিজিয়ে, দক্ষিণ ভারতে পাতায় তৈরি গোল নৌকোয় জলাশয় অতিক্রম করেছি । নানা যানবাহনে তো চেপেইছি, হাতি আর উটে চেপেও পার হয়েছি । 


যাকগে । আগের চাকরির প্রসঙ্গে ফিরি । কলকাতা হাইকোর্টে মামলা জিতে ফেরার পর যখন কাজে যোগ দিলুম তখন সবাই ধরে নিয়েছিল যে আমাদের দলটা লম্পটদের আর মেয়েদের নিয়ে আনন্দ করে । অমন একটা দল সত্যিই ছিল তখনকার অফিসে । বিয়ের জন্য তখন ঘটকরাও অফিসে আসা আরম্ভ করেছিল । কোনো-কোনো ঘটক তো পাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসতো আর আমার সামনের চেয়ারে বসিয়ে কেটে পড়তো।


একদিন এক অবসরপ্রাপ্ত পিওন এলো, সঙ্গের নাতনির বয়সী এক কচি মেয়েকে দেখিয়ে বলল, স্যার, আমি তো রিটায়ার করার পর এই মেয়েটাকে বিয়ে করেছি, কেননা আমার বউ অনেক কাল মারা গেছে, ছেলে-ছেলের বউ, নাতি-নাতবউরা যে যার সংসার করছে, আমাকে দেখাশোনার কেউ ছিল না, আমি পেনশনের টাকা দিয়ে এই মেয়েটাকে কিনে বিয়ে করেছি, ওর পেটে আমার বাচ্চাও এসে গেছে। আপনি একটা সুন্দর দেখে মেয়ে কিনে নিন, ইচ্ছে হলে বিয়ে করবেন । জানেন তো আমি বৈশালী জেলার লোক, সেই বৈশালী জেলা যেখানকার সুন্দরী আম্রপালীর নাম সবাই জানে । আমার সঙ্গে চলুন । নিজে পছন্দ করে নেবেন । যে জাতের মেয়ে চান সেই জাতের মেয়ে কিনতে পারবেন। আপনার যা মাইনে তাতে ফর্সা সুন্দরী গায়েগতরে কাজের মেয়ে পেয়ে যাবেন ।


কেকয়ি, শব্দহীন চোখের জল বইছে গাল বেয়ে, সামনেই দাঁড়িয়েছিল, বলল, আমাকে এড়িয়ে যাবার জন্য এখন বই পড়ছিস ? সারাদিন তো বই পড়িস । কী হয় পড়ে ? পড়িস নাকি চশমার মোটা কাচ দিয়ে পোকা বাছিস ?





রাহুর চরিত্র কেতুর উল্টো । এই যেমন সুজিত রায় , যে মারা যাবার বছর খানেক আগে, কেতুর বাড়ির কাছেই একটা ফ্ল্যাট কিনেছিল, সম্প্রতি মারা গেছে বউ আর মেয়ের দুর্ব্যবহারে, ওরা দুজনে মিলে সুজিতকে পিটতো, দুবেলা খেতে দিতো না, ওর শোবার ব্যবস্হা করেছিল নিচের তলায়, যেখানে সুজিতের মোটর সাইকেল থাকতো। বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিল বলে আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না । সুজিত রায় একবার এক বক্তৃতায় বলেছিল, রাহু সম্পর্কে, “রাহুল সিংহের কেসটা  আলাদা। এবং আপাত জটিল। বাংলা সংস্কৃতির পীঠস্থান হিশেবে বিজ্ঞাপিত কলকাতার ধুলো রাহুলের পায়ের চেটোয় সেভাবে লাগেনি। কলকাতার একটা পুশিদা ক্লোমযন্ত্র আছে যা বামুন আর চাঁড়ালকে শুঁকে চিনতে পারে। কলকাতা রাহুলকে নিজের দাঁত দেখিয়ে দিয়েছিল। কলকাতা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, তুমি আমাদের কেউ নও। তুমি একটা কৃষ্টিদোগলা। তোমার কলমে নিম্নবিত্ত রক্ত। তোমার টেক্সট আলাদা। আলাদা থিসরাস। তফাৎ হটো তুমি। এবং, কলকাতা রাহুলের সঙ্গে সমস্ত শরোকার ছিন্ন করে। কোনও সম্পাদক তাঁর কাছে আর লেখা চান না, বন্ধুবান্ধবদের চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায় এবং ক্রমশ সবাই স্লিক করে যায়।  এই বীভৎস যন্ত্রণা, অপমান আর তিরস্কার একমাত্র কলকাতাই দিতে পারে। এই যন্ত্রণা, এই অপমানই তাকে লেখার বাইরে ঠেলে বের করে দিয়েছিল।’ 

রাহুলের মনে পড়ল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়েছিল শরোকার-ছিন্ন করা বন্ধু অমরদেব দাশগুপ্তের । কেমন যেন অগোছালো চেহারা, মুখ থেকে সস্তা মদের গন্ধ বেরোচ্ছিল । বলল, আরে রাহুল, শালা বড়োলোক, ভাগ্যিস তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল । তুমি আমাকে কিছু টাকা দাও রাহুল । মুখময় অপরাধবোধ মাখানো কন্ঠস্বরে ।

—টাকা ? কেন ? তুমি তো শুনেছি সারাদিন টিউশানি করো, মাইনেও পাও ভালো ।

—না, আমি ভায়াগ্রা ট্যাবলেট কিনবো ।

—ভায়াগ্রা ? ইনডিয়ায় পাওয়া যায় নাকি ? তোমার এমন অবস্হা হয়েছে যে ভায়াগ্রা দরকার হয় ?

—দরকার, দরকার, ইনডিয়ায় যথেষ্ট পাওয়া যায় । এখন আমাকে হাজার খানেক টাকা দাও । বুড়ো আফগানরা চারটে বউ সামলাতে পারে না বলে আমেরিকানরা ওদের ভায়াগ্রা সাপলাই করে । ওদের এজেন্টরা ইনডিয়া আর পাকিস্তানে বিক্রি করে । তুমিই তো বেবি আর মীরার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলে আমাকে আর কামেশ্বর চোঙদারকে । ভুলে গেছো ? ওদের দুজনকে একই দিনে ভালোবাসতে হলে ভায়াগ্রার দরকার হয় । তুমিই শিখিয়েছিলে দুপুরে গেলে ফাঁকা থাকে। এখন টাকাটা দরকার । প্লিজ দাও ।

নিজেকে একটা  কণ্ঠস্বর হিসাবে উপস্থাপন করল অমরদেব । মনে হলো রাহুলের, অমরদেব আজকাল নিজের সঙ্গে নিজের বাড়িটাকে বয়ে বেড়ায়; ও নিজেই নিজের বাড়িতে রূপান্তরিত  । ভিড়ের ভেতরে কোনো লোককে দেখে একজন যৌনকর্মী টের পেয়ে যায় যে লোকটা মাগিবাজ, তেমনই একজন মাগিবাজও টের পেয়ে যায় কে যৌনকর্মী। অমরদেব প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে তেমন মাগিবাজ হয়ে গেছে । বাতিল কবরের মতন ওর মধ্যে টিকে আছে কেবল প্রতিধ্বনি, অন্যের মতাদর্শের প্রতিধ্বনি। রাহুল টের পাচ্ছিল অমরদেবের  ক্রমবর্ধমান অনুশোচনা, পালানোর আকাঙ্ক্ষা, শক্তিহীন বিতৃষ্ণা, আত্মসমর্পণ, ঘৃণায় ডুবে থাকা অস্তিত্ব । অমরদেব বুঝে গেছে, ফুরিয়ে-আসা ধাতুরস ওর  অস্তিত্বের উপপত্নী, যা এখন ওর  নিয়তির মতোই অস্পষ্ট ।

এই সেই অমরদেব দাশগুপ্ত, যে নিজের ভাগ্নির প্রেমে পড়েছিল । দুজনে একটা দুপুর একসঙ্গে কাটাবার জন্য শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে একটা হোটেলে ঘর বুক করেছিল । উত্তেজনায় ভাগ্নির জ্বর হয়ে গেল । একশো এক ডিগ্রি জ্বর । ডাক্তার কারণ বুঝতে পারল না । রক্ত আর পেচ্ছাপ টেস্টে কিছুই পাওয়া গেল না । অমরদেবের দুপুর ভেঙে চুরমার । এখন অমরদেব সেই পুরোনো প্রেমের স্মৃতি খুঁজে বেড়ায়  বিভিন্ন নারীর শরীরে ।

—আমি আজকাল আলোর দপদপানির ভেতর বসবাস করি, হ্যা হ্যা । বলল অমরদেব । তারপর যোগ করল, যৌনকর্মীরা নমঃশুদ্র হোক বা কৈবর্ত্য, বুঝলে রাহুল, জাতিপ্রথাকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছি । বাংলাদেশ থেকে তুলে আনা মুসলমান মেয়েও আছে কয়েকটা ঘরে ।

–টাকাকড়ি দরকার, অথচ প্রদীপন চাটুজ্যের বাড়ি যাবার জন্য ফালতু পয়সা খরচ করেছো ! কোনো মানে হয়?

সেই একইরকম হ্যাহ্যা হেসে অমরদেব বলল, প্রদীপন আর নীলোৎপলের ওপর আমার রাগ যায়নি, বুঝলে রাহুল, তুমি তো নিজের জগতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে, কিন্তু ওদের আমি ছাড়িনি ।  আজ পর্যন্ত আমার রাগ পড়েনি । রাগে কড়মড় করে ওঠে দাঁত । আমি আর লারেলাপ্পা একদিন রাত সাড়ে নয়টার সময় গিয়ে পৌঁছাই -- গিয়েই দেখি প্রদীপন বাড়ি নেই । ফিরে যাচ্ছিলাম, এমন সময় উনি নামলেন এক রিক্সা থেকে । আবার ঘরে এসে বসা হলো ।আমি বললাম -- 'এদিকেই এসেছিলাম । আপনার কাছে এলাম টাকাটা নিতে । পকেটে পয়সা নেই ।'ব্যাটা কিছু আন্দাজ করে --'বেশ করেছেন, খুব ভালো করেছেন...' বলতে বলতে হাওয়া হয়ে গেল । বসেই আছি দুজনে, ঘরে আর আসে না । তারপর এক সময় এসে প্রথমেই আমার দিকে তাকিয়ে --'আমি আপনাকে একটা বই দেব ঠিক করেছিলাম--- লিস্টে নাম ছিল---কিন্তু যেহেতু "ঘুমন্ত রাজীব" আপনার ভালো লাগেনি, সেজন্যে আর দেবো না' । আমি বললাম, সত্যচরণকে আপনি যে কপিটা দিয়েছিলেন, আমি সেটা পড়েছি -- 'কে রবীন্দ্রনাথ' ছাড়া আর কিসসু আমার ভালো লাগেনি'।প্রায় সঙ্গে সঙ্গে লারেলাপ্পা বলে উঠলো -- 'আপনার বইটা স্টলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ফেললাম । কিছুই হয়নি -- আপনি ফুরিয়ে গেছেন মনে হলো’।'সঙ্গে সঙ্গে প্রদীপন ফেটে পড়ল একেবারে ।  কী বলতে চাও, 'ফুরিয়ে গেছেন' ? অমরদেব বললে আমি সহ্য করবো । কিন্তু তুমি কী লিখেছ, কটা বই পড়েছ ? তারপর প্রদীপন চৌকি ছেড়ে লাফিয়ে ওঠে -- কে ? কে বলেছে ? আমি লারেলাপ্পাকে বলেছি ? কবে ? কোথায় ? এসব কী হচ্ছে...আপনারা কী চান স্পষ্ট করে বলুন...কী করতে চাইছেন আপনারা ? লারেলাপ্পা বলল, -'আমি পাঠক হিসেবে বলেছি, আর কটা বই পড়েছি, সে কৈফিয়ৎ আপনাকে দেবো কেন ?' প্রদীপন চেঁচিয়ে উঠলো, ‘'দেবো না মানে... ইয়ার্কি ! একি উত্তমকুমারের 'দেয়া নেয়া'...যে ফুরিয়ে গেছেন...তুমি কি মেয়েছেলে...ন্যাকা...দাঁত কেলিয়ে বললে 'ফুরিয়ে গেছেন'...মিচকের মতো তুমি হাসছিলে...একটা ফালতু মন্তব্য করলেই হলো ?' ওফ রাহুল, সে যে কী আনন্দ হচ্ছিল । ওর চিৎকারে ঘর ফেটে যাচ্ছিল প্রায় । ব্যাপার দেখে আমি গম্ভীর হয়ে ---'আপনি অযথা উত্তেজিত হচ্ছেন । ওকে  আপনি বলতে পারেন, তুমি বুঝতে পারোনি...আর তাছাড়া আমার অন্য একটা কথাaterial hছিল..না...'তারপর এইভাবে ঘটনা নিজপথে এগিয়ে চলে । মাঝখানে মনে হয়েছিল প্রদীপন কেঁদে ফেলবে । তখন আমিও একটু নরম হই, সঙ্গে লারেলাপ্পাও । প্রদীপন ওর বাড়িতে থাকার জন্য পীড়াপীড়ি করছিল ...রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত দুটাকা প্লাস ট্যাক্সি ভাড়া তিন টাকা দিয়ে দিয়েছিল । নীলোৎপলকেও আমি মনের সাধ মিটিয়ে খিস্তি দিয়ে এসেছি ।

–ধ্যুৎ, যত্তো সব সময় নষ্ট । যাকগে, কতো টাকা চাই ?

অমরদেব বলল, মেয়েগুলোর অবস্হা ভালো যাচ্ছে না হে, ওদের কিছু টাকা অ্যাডভান্স দিতে চাই ।

যৌনকর্মীদের অ্যাডভান্সে টাকা দিয়ে বুক করেছে, এই খালাস বয়সে । রাহুল এটিএম থেকে এক হাজার টাকা তুলে দিয়েছিল অমরদেব দাশগুপ্তকে । কেটে পড়তে চাইছিল পুরোনো বন্ধুর কাছ থেকে । সংস্রব এড়াতে চাইছিল । জিগ্যেস করল, মহাভারত নট্ট কোম্পানির অধিকারী মশায় কানচু ঘোষের ছাত্র কামেশ্বর চোঙদারের কী খবর । অমরদেব বলল, তুমি জানো না ? তুমিই তো ওকে গাঁজা ফুঁকতে শিখিয়েছিলে, তখন সরকারি দোকানে আসল গাঁজা পাওয়া যেতো ; আজকাল লুকিয়ে যেগুলো বিক্রি হয় সেগুলোতে আফ্রিকার বুনো-নেশার পাতা মেশানো থাকে । মহাভারত নট্ট কোম্পানির অধিকারী কানচু ঘোষের সুপারিশে চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল । কিন্তু সেই আফ্রিকান গাঁজা খেয়ে শরীর নড়বড়ে করে ফেলেছিল, তারপর  অপারেশান থিয়েটারে ছুরি চালাতেই  সারাটা হাসপাতাল গাঁজার ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার । ব্যাস, পটল ।

—-আফ্রিকার কাথা ইডুলিস পাতা ? লোকে বলে খাট । এর আসক্তি খুব ভয়ঙ্কর। খাটের কারণে অবসাদ, দৃষ্টিভ্রম, অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দাসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে৷। বেশি রস চিবিয়ে নেশা করলে বিপদও মারাত্মক। ডাক্তাররা বলে, দাঁত আর মাড়িতে ঘা হতে পারে। এ ছাড়াও, ইন্দ্রিয় শক্তি আর যৌনক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। খাট জীবনী শক্তিও কমিয়ে দেয়।তোমাদের সেটাই হয়েছে । তোমাকে দেখেও মনে হচ্ছে বেশি দিন বাঁচবে না ।

–-জানি ! হ্যা হ্যা । সেই টিপিকাল পুরোনো হাসি হাসলো অমরদেব।

—-আর প্রভাস চোঙদার ? ও তো গাঁজা ফুঁকতো না, বেবি-মীরাদের কাছেও যেতো না, কেননা একবার গিয়ে ওর অভিজ্ঞতা হয়েছিল ভয়াবহ । মীরার ঘর থেকে পাঁচ মিনিটেই বাইরে বেরিয়ে এসেছিল । মীরা ওর পেছন-পেছন, বেরিয়ে বলেছিল, আপনাদের এই বন্ধুর উত্তজনা বলে ব্যাপার নেই । আমরা যা-যা করে খদ্দেরদের দু-মিনিটে খালাস করিয়ে দিই, এনার তো কিছুই হলো না, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান । প্রভাস চোঙদার খালাসিটোলায় যেতো মাঝেমধ্যে, তবে ওর প্রিয় ছিল ব্যাগপাইপার হুইস্কি ।

—সিপিয়েম খতম হয়ে গেল আর প্রভাস চোঙদারও পৃথিবী থেকে বিদায় নিল । বাড়িতে পড়ে আছে দুশো ঝাণ্ডা, লোক নেই নিয়ে যাবার । দল বদলের ঋতু চলছে । ওর বউও মারা গেছে । তবে ওর ছেলে প্রভাসের টাঙানো নেতার ছবি ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে নিজের বাপের বিশাল ছবি টাঙিয়েছে ।

—কেন ? ওগুলো দিয়ে তো বাচ্চাদের রঙিন পোশাক তৈরি হতে পারে । ওর ছেলেকে বলো কোনো সংস্হাকে বিলিয়ে দেবে ।

একটা বাস এসে থামতে, তাতে উঠে পড়ল অমরদেব । বোধহয় রাহুর খোঁচা এড়াতে, কেননা বাসটা কোথায় যাচ্ছে তা তো দেখলো না ।

কেতুর চরিত্র রাহুর উল্টো । উজ্জ্বল ভট্ট, যদু ভট্টের বংশের সন্তান,  সজনীকান্ত সভাঘরে ওনার বক্তৃতায় বলেছিলেন : “অনিকেত সিংহকে  নিয়ে কেন ভাবছি ! আপনারা প্রশ্ন তুলবেন, কী লিখেছেন ভদ্রলোক? কী দাম আছে ওঁর কথাবার্তার? থান ইঁট মার্কা উপন্যাস আছে? ঝুলিতে মেডেল,আকাদেমী চেয়ার, পার্টি মেম্বরশিপ, এনি থিং? কেউ কেউ মুচকি হেসে বলবেন, ‘উনি তো জাস্ট রাহুল সিংহের দাদা ! আর কী আছে ওঁর? কখনো রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারী অসীম গাঙ্গুলির  শিবিরে কখনও মহাভারত নট্ট কোম্পানির অধিকারী কানচু ঘোষের চেলা কামেশ্বর চোঙদারের শিবিরে ব্যালেন্স করে চলেছেন.। না, তাদের বিস্ময় কিংবা ধ্যানধারণা আমাকে অবাক করেনি। এমন কী মন্তব্যগুলোও আহত করেনি। বরং স্বাভাবিকই মনে হয়েছিল। কেননা বছর বারো আগে আমি নিজেও তো ছিলাম ওই বিস্মিতের তালিকায়। ‘অনিকেত সিংহ’--নামটার সঙ্গে আমার পরিচয়ও তো শুধু মাত্র রাহু-রক্তিম-প্রদীপনদের আন্দোলনের ইতিহাস মারফতই হয়েছিল এবং যে পদ্ধতিতে হয়েছিল সেটাকে আদৌ পরিচয় বলা যায় কিনা সন্দেহ।পরিচয়ের সুযোগটা ঘটলো পরে। একটা পোস্টকার্ডে আচমকাই রাহুল সিংহ জানিয়েছিলেন,“ আমার দাদা কোলকাতায় থাকেন।  একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। যোগাযোগ কোরো।” বিশদ ঠিকানা থাকা সত্বেও তক্ষুনি যোগাযোগ করিনি। কিংবা বলা ভালো প্রয়োজন বোধ করিনি। কারণ তিনি রাহুল সিংহের দাদা। প্রথম আলাপেই রাহুল সিংহের অহঙের সুউচ্চ রেলিং টপকাতে পারিনি। নেহাৎ ওঁর কলমদক্ষতা এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বকে খর্ব করতে পারিনি তাই সম্পর্কটুকু বজায় রেখেছিলাম। তাবলে রাহুল সিংহের দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে কেন ! যিনি কিনা আবার উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মি ছিলেন, তাঁর অহঙ্কারও কি কম কিছু হবে? তাছাড়া কি এমন লিখেছেন ভদ্রলোক যে গাল বাড়িয়ে চড় খেয়ে আসতে হবে! কিন্তু সময়ের দাবীকে কে-ই পেরেছে অগ্রাহ্য করতে? মাস কয়েক পর কোলকাতা যাবার সুবাদে ঢুঁ মেরেই বসলাম অনিকেত সিংহের বাড়িতে। তাবলে আচমকা নয়। টেলিফোনে আগাম কথা বলে ওপারের কন্ঠস্বরকে রীতিমত স্ক্যান করে বুঝে নিতে চেয়েছিলাম, যাওয়াটা কতদূর সম্মানজনক হবে।সপরিবারে এসেছি শুনে আমন্ত্রণটাও পেয়েছিলাম সপরিবারে যাবার, কিন্তু ঝুঁকি নিতে পারিনি কেননা বিভিন্ন লেখক-দাদাদের সৌজন্যে জোটা পূর্ব-অভিজ্ঞতা খুবেকটা সম্মানজনক ছিল না। সুতরাং নিশ্চিন্ত হতে পারিনি টেলিফোন এবং আমার কানের বিশ্বস্ততা বিষয়ে। একা একা গিয়ে ঢুঁ মেওে আসাটাই শ্রেয় বোধ করেছিলাম।তখনও শহীদ ক্ষুদিরাম স্টেশান চালু হয়নি, মেট্রোর দৌড় টালিগঞ্জ অবধি। কোলকাতার অন্ধিসন্ধিও তেমন চেনা না থাকায় লাট খেতে খেতে হাজির হয়েছিলাম শ্রী অনিকেত  সিংহের  বাড়িতে। অনেক জমি এবং কিছু গাছপালাসহ দোতলা বাড়িটা দেখে মনে হয়েছিল ভদ্রলোক যথার্থই সিংহ পরিবারের উত্তরপুরুষ। গেট পেরিয়ে বেশ কিছুটা ভেতরে ঢুকে কলিং বেল বাজানোর পর যিনি বেরিয়ে এসেছিলেন তাঁকে দেখে আমার পূর্ব ধারণাটাই পাকাপোক্ত হয়েছিল। প্রায় ছ’ফুট, নির্মেদ,টকটকে চেহারা। গোঁফদাড়ি নিখুঁত কামানো। মাথা ভর্তি কালো চুলে এক চিলতে সাদার নিখুঁত আভিজাত্য।”

–ছিঃ, আবার ওরকম নোংরা দীর্ঘশ্বাস ফেলছিস । ওর দিকে তাকিয়ে থাকা কেকয়িকে বলল রাহুল । নিজেকে নিঃশব্দে বলল, পরিচারিকার সঙ্গে প্রেম ! অসীম গাঙ্গুলির বন্ধু মহালম্পট প্রদীপন চট্টোপাধ্যায়ের মতন সত্যের অপলোপকারী । মৃতদেহের ওপরে রাখা রজনীগন্ধার ফুৎকার ।  মিথ্যার মধ্যে মৃত্যুর স্বাদ আছে, মৃত্যুর কলঙ্ক আছে, তিমিরাচ্ছন্ন অনুভূতি । 

প্রদীপন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য রাহুলকে বলেছিল. আমার গল্প-উপন্যাস পড়ে তাতে আমার চরিত্র খুঁজো না । আমি লেচার নই । যৌনকর্মীদের বাড়ি না গেলে তাদের সম্পর্কে জানবো কেমন করে ? বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া লেখা যায় না । অসীম গাঙ্গুলির উপন্যাস পড়েছো তো ? বাস্তব জীবন থেকে ও কিছুই পায়নি । সব বই-পড়া বিদ্যে। এখন ইতিহাস খুঁটে-খুঁটে উপন্যাস লিখছে । মন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে, ওই বইগুলো ঢুকিয়ে দেবে সিলেবাসে।

রাহুল সিংহ একটা পত্রিকায় প্রদীপন চাটুজ্যের আলোচনা পড়তে দিলে প্রদীপন বলেন, ওসব পড়ে কী করব ? আমি যা লিখে যাচ্ছি তা ভবিষ্যতের জন্য । প্রদীপন চাটুজ্যে, অফিসে যাঁর নাম নৃপতি চাটুজ্যে, হঠাৎ সিট ছেড়ে উঠতে পারলেন না, বললেন, দেখছো অফিসের কাজ করছি, এখন তুমি এলে আমাকে আমার সমালোচনা শোনাতে । তা শোনাও । জানি, তুমি আসলে কথাগুলো এখানকার কলিগদের কানেও তুলতে চাও । তোমার মতনই, ওরাও আমাকে ফালতু লেখক বলে মনে করে । আনন্দসেবক নট্ট কোম্পানিতে যারা কাজ করে না তারা যে ফালতু তা তুমিও জানো আর আমিও জানি । তা আলোচনাটা কে করেছে শুনি ?

—এই যে এই যুবক । এর নাম আদিদেবতা কাশ্যপ ।

—আদিদেবতা ? তুমিই পড়ো বরং । সহকর্মীরাও শুনুক ।

আদিদেবতা পড়া আরম্ভ করল । রাহুর পড়া ছিল আগেই, ও দেখছিল কী প্রতিক্রিয়া হয়, বিশেষ করে কর্পোরেশানের ঘুষখোর সহকর্মীদের উপস্হিতিতে । রাহুল বলল, আরেকটু জোরে পড়ো আদিদেব । 

—হ্যাঁ, বিশ্লেষণটা এরকম, বলে, পড়া আরম্ভ করল আদিদেব:

এক : চরিত্র

যদি একটানা লক্ষ করি, লেখক প্রদীপন চট্টোপাধ্যায়ের প্রটাগনিস্টরা মোটামুটি একই রকম- আত্মসর্বস্ব দ্বিধাগ্রস্ত ভাঁড় ভীরু মধ্যবিত্ত মেল-ইগোয়িস্ট বিদ্রোহী চিন্তক – কিন্তু তাদের কিছু ভোল বদলাতেই থেকেছে। ‘বিজনের রক্তমাংস’ (১৯৬১) থেকে ‘ধ্বংসের মধ্য দিয়ে যাত্রা’ (২০০৫) অবধি চারটে-পাঁচটা পর্যায় তো শাদা চোখে আপনি দেখতে পাবেন : ডেকাডেন্ট, অ্যান্টি-হিরো হিসেবে আছে বিজন (‘ক্রীতদাস ক্রীতদাসী’ গ্রন্থের হেমাচুরিয়া-গ্রস্ত নায়ক, পঙ্গু/স্কিজো নায়কের বীজ এই চরিত্রে প্রথম পুঁতে দেওয়া হল, পরে লেখকের উপন্যাসে এরা পরিমার্জিত অবস্থায় ফিরে ফিরে আসবে), শশাঙ্ক (‘সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী’র নায়ক, তার মধ্যে টাইপ-অস্তিত্ববাদী, মেল-শভিনিস্ট, প্রেমহীন অ্যান্টি-হিরোর যাত্রা শুরু হল) এবং গোপাল (‘ঐ’, যুবক রক্তিম চট্টোপাধ্যায়ের পারসোনা বা সাহিত্যিক তরজমা- যাকে নের্ভাল-লোত্রোয়ামঁ-বোদলেয়ারের প্যারিসেই মানায় এবং আরো মানায় জীবনানন্দের ‘রাত্রি’ কবিতার কলকাতায়, কবি-বোহেমিয়ান-পাগলাটে-জিনিয়াস গোপালের ইকো/প্রতিধ্বনি আমরা ‘ধংসের মধ্য দিয়ে যাত্রা’র অচিন্ত্য/সোমনাথ চরিত্রের মধ্যে পেয়ে যাব।)

নলিনী (‘…শাটার নামিয়ে দেয়’), ‘আত্মক্রীড়া’ গল্পের অ্যানোনিমাস নায়ক এবং রাজমোহন (‘বিপ্লব ও রাজমোহন’ এবং ‘নিদ্রিত রাজমোহন’) সকলেই সুররিয়ালিস্ট কিংবা নিহিলিস্ট জগতের এনটিটি।… নলিনী উদ্ভট স্বপ্ন দেখে কিংবা স্বপ্নই তার ‘রিয়াল’, এরই মধ্যে সে হরবখত করে যায় নানা কেচ্ছাময় কাজ (‘শাটার নামানো’ বস্তুত এক ফ্রয়েডিয়ান স্লিপ – আসলে দু’হাতে পোশাক খুলে নামানো – গল্পে এরপরেই নলিনী নিশির শায়া তুলবে), রাজমোহনের বিপ্লব সাঙ্গ হয় আলমারিভর্তি বই পুড়িয়ে (এও লিঙ্গুইস্টিক স্লিপ- ‘বই’ আক্ষরিকভাবেই জ্বলে উঠছে এবং ‘বিপ্লব’ হচ্ছে), দেখা যাচ্ছে এরা ভাঁড়, অকর্মণ্য, চন্দ্রাহত (‘আত্মক্রীড়া’র নায়ক বাসের চলে যাওয়া চৌষট্টিবার না আউড়ে থামে না কিংবা তার বন্ধু বিক্রমকে সে দেখে পেট্রোল খেয়ে শিং গজিয়ে ফেলতে, কুণালের পিয়ানোর রিডে তার আঙুল ছোঁয় ‘সফট’ রিড –আসলে স্বপ্নে ভোল-পালটানো যৌনাঙ্গ)… এদের ‘শ্রদ্ধাবিশ্বাসভক্তি বলে কিছু নেই’, ‘আরো একতিরিশ বছর বাঁচতে হবে’ এরা ভাবতে পারে না… ‘হাত তুলে নিজেদের জয়ধ্বনি করতে করতে’ এরা ভয়ের মধ্যে ঢুকে পড়তে চায় (সূত্র: ‘কাউন্টার-পয়েন্ট’, যার ‘পঞ্চাশটি গল্প’ এডিশনে নাম হয়েছিল ‘একটি বিদেহী গল্প’)।

মিনিবুক রূপে প্রকাশিত ‘সোমেন পালিতের বৈবাহিক’ নামে লেখাটি প্রসঙ্গে অনেক পরে স্বপ্নদ্রষ্টা বিশ্বাসকে প্রদীপন বলবেন, ‘(এই ধরনের লেখা) একজন কমিউনিস্ট যা লিখতে পারে আর কি। … আমি সরাসরি পার্টি করেছি কলেজ জীবনে, পার্টি তখন ক্ল্যান্ডেনস্টাইন’- এই শেষ শব্দটির সূত্র ধরে বলা যাক, আত্মগোপনকারী বা ছুপা বিপ্লব-আকাঙ্ক্ষী চরিত্র তড়িৎ ও তার দাদা অংশুর মধ্যে ফুটেছে (‘অংশু সম্পর্কে…’), প্রথমজন নকশালপন্থী ও দ্বিতীয়জন কাওয়ার্ড, জলের ট্যাংকের পাশে ভাইয়ের রক্তের দানা-মুখে পিঁপড়েদের যে আবিষ্কার করছে, পটভূমি বরানগর ১৯৭১-এর রক্তঝরা রাত্রি। ‘বড় দুঃসময়’ গল্পের শেষে ভীতু মহেন্দ্র পরিচারিকা আশার সঙ্গে পলাতক পূরবীকে খুঁজতে বেরোয় (আশার হাতে মোমবাতি), এখানে পিকাসোর গোয়েরনিকা ছবিটিকে প্রদীপন উদ্ধৃত করেন, বস্তুত বোমাবিধ্বস্ত অন্ধকারে লম্ফ-হাতে নারীর সন্ত্রস্ত ডিটেলটিকেই… এখানেও পটভূমি বরানগর (এই জেনোসাইডের উল্লেখ বারেবারে প্রদীপনে এসেছে, লেখকের বিরাট অপরাধবোধ এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল, স্বপ্নদ্রষ্টা বিশ্বাস সম্পাদিত ‘ডায়েরি’র প্রথম এন্ট্রিগুলি প্রাসঙ্গিক)। ডেবিউ উপন্যাস ‘একক প্রদর্শনী’-তেও ডরপোক অরুণ চক্রবর্তী নিজেরই ইভিল-ইগো লাহিড়ীর মুখ থেঁতলে দিতে দিতে স্লোগান দেয়, ‘এই মূর্তি ধ্বংস করো!’ ‘ধ্বংস করো!’ স্লোগানের তালে তালে ঘুসি মেরে যায়। তার বয়ানে, “লাহিড়ী কে জানি না। কিন্তু সে এমন কেউ যাকে ধ্বংস করা দরকার।”

যৌনবিপ্লবী, আন্তর্জাতিক প্রেমিক –

হার্বার্ট মারকুইজের একটি উদ্ধৃতি (‘মুক্তযৌনতার ধারণা রাজনৈতিক মুক্তিরই প্রকাশ বা রকমফের’/ ‘ইরোস এন্ড সিভিলাইজেশন’) প্রদীপনকে সাংঘাতিক উশকে রেখেছিল। ১৯৭৬ সালে আনন্দসেবক ঘাঁটি থেকে ডাক এলে দ্বিতীয় উপন্যাস হিসেবে ‘এখন আমার কোনো অসুখ নেই’ তিনি লেখেন এবং নায়ক প্রতুলকে উপস্থিত করেন শহর কলকাতায় আন্তর্জাতিক প্রেমিক হিসেবে, যে গোরস্থানে গিয়ে এতগুলি কবরের মুখোমুখি প্রেম করে (এখানে দুটি খোঁচ আছে- বউ-মেয়েকে ‘ঠকিয়ে’ প্রেম এবং এক অষ্টাদশীর সঙ্গে চল্লিশ পেরোনো বয়সে যৌনতা)। এই সম্পর্ককে প্রায়ই এক্সপ্লয়টেশনের সঙ্গে গুলিয়ে দিতে দিতে লেখক একসময় প্রতুলকে মানসিকভাবে দেউলিয়া করে দিয়েছেন। এই টাইপ-ক্যারেক্টার ফেরত এসেছে ‘রুবির সঙ্গে হীরা বন্দরে’-তে, যাকে আরো বড়ো করে লেখা হয় ‘রুবি কখন আসবে’ আর ঈষৎ বদলে ‘জাগো মসৃণ ত্বক’। ‘কলেরার দিনগুলিতে প্রেম’ উপন্যাসে মমতা ও তার প্রেমিক সঙ্গম করেছিল অ্যাটলাস মানচিত্রের ওপরে- এই ইমেজে আন্তর্জাতিকতার রেফারেন্স ঢুকে এল… তাদেরই পেইন্টার বন্ধুর সিরিজ ‘কলেরার দিনগুলি’র কলকাতা লাল রঙে ও অসুখে ছত্রখান হয়ে থাকে, এই কাপল ঘুরে বেড়ায় অবিকল সেই শহরেরই বারে রেস্তোরাঁয় কবরখানায় থিয়েটারে মিউজিয়ামে গলিঘুঁজিতে ও ফাঁকা ফ্ল্যাট পেলে সেখানে। ‘রুবি কখন আসবে’-র নায়ক ‘সমাজ নামক কাকতাড়ুয়া’র মাথা ভাঙতে চায় (কিংবা দশতলা থেকে হেঁটমুণ্ডে লাফ দেয়) ‘আরেকবার তোমার সঙ্গে আমি সঙ্গম করতে চাই’ জানিয়ে –মুক্তযৌনতা সুতরাং এখানে রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত বিপ্লব/তছনছের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে যাওয়া।

পঙ্গু, অসুস্থ, কাকওল্ড, স্কিজো –

‘আরব গেরিলা…’ পর্ব থেকে প্রদীপন নায়ককে টার্মিনাল অসুখে ফেলে দেন (যা বিজনের ক্ষেত্রে প্রথম গল্পে হয়েছিল) – ‘রিক্তের যাত্রায় জাগো’ উপন্যাসে নায়কের পা কেটে বাদ যায় (কিছুটা যেন জোর করেই প্লটের মোচড়), ‘এখন জীবন অনেক বেশি…’ উপন্যাসে নায়ক ফুসফুসে ক্যান্সার নিয়ে শেষ দিনগুলো কাটাতে থাকে (বেকেটের ‘মালোন ডাইজ’ মনে পড়ছে?), ‘স্বর্গের নির্জন উপকূল’-এর নায়ক অ্যালঝাইমার্সে ভোগে এবং ‘ধ্বংসের মধ্যে…’ নায়ক স্কিজো। বাধ্যতামূলক একটি ক্লিশে: দার্শনিকতা তৈরির সুবিধা হয়ে যায় নায়ক/নায়িকাকে বিছানায় ফেলে রাখলে (বাংলা আর্ট সিনেমা এবং পুজোসংখ্যার উপন্যাসে ঘুরেফিরে এই ট্রিক এসেছে)। ‘ডাবলবেডে একা’-র নায়ককে শুরুতেই লেখক মেরে ফেলেন এবং তার দেহ-ছেড়ে-যাব দেহ-ছেড়ে-গেলাম আত্মার চোখ দিয়ে কাহিনী বর্ণনা করেন। ‘কোলাজ’ উপন্যাসে নায়ক নিজেকে খুন করেন প্রচুর ঘুমের ওষুধ খেয়ে।- কাকওল্ড? ‘ফুটবল খেলার শব্দ’ গল্পকে বড়ো করে ‘এখন জীবন অনেক বেশি…’ উপন্যাস দাঁড় করানো হয় (নিজেরই আরো তিনচারটে গল্প ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে) সেখানে শয্যাশায়ী কিংবা বসে-থাকা চরিত্র নিজের সফল সক্ষম বন্ধুর পাপাচরণ খুঁটিয়ে দেখে, কখনো উশকে ওঠে কখনো ঘৃণায় ভরে যায়। কিংবা ‘কলকাতা তুমি কার’-এও যে অ্যাসেসর-বাবুটি (লেখক নিজেই) সহকর্মী কিংবা উর্ধ্বতনের দুর্নীতিগুলি প্রায় ভয়েরিস্টিক চোখ দিয়ে দেখেন তাঁকেও ‘সামাজিক কাকওল্ড’ সহজেই বলা যায় (রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’-র নিখিলেশ বা ‘চতুরঙ্গ’-এর শ্রীবিলাসকে আমরা একই ছাপ্পা দিয়ে পড়বার/চিনবার সুবিধা করে নিতে পারি।)

দুই. জীবন

মধ্যবিত্ত বাকচতুর ভদ্রলোক, নষ্ট জিনিয়াস, অলস, সুগৃহিণীর সাথে অ্যাডজাস্ট-না-করে-নিতে-পারা স্বামী, মেয়ের স্নেহময় পিতা এই ক’টি পরিচয়, বন্ধুদের ইঁদুর-দৌড় ও দৌড়ে অর্জিত সাফল্য অবলোকন, নিজের ক্ষুৎকাতর ‘প্রেম’ ও নিস্তরঙ্গ চাকরি-জীবন (কলকাতা কর্পোরেশনের নিশ্চিন্ত, ঘুষ না-নেওয়া, অফিস-কামাই-করা ‘অ্যাসেসর’-এর পদ) মানুষ প্রদীপনকে ভেতরে ভেতরে একেবারে খেপিয়ে তুলেছিল। তাঁর লেখায় আসল যুযুধান লড়াই হচ্ছে বাজারচালু করাপশন ও ভিতরে-ক্ষয়প্রাপ্ত বিদ্রোহীর (‘বিপ্লবী’ থাকার মতো সংহতি-সুস্থতা-শিরদাঁড়া তার আর নেই)। এই টানাপোড়েন- আত্মধিক্কার ও অক্ষম ভায়োলেন্স চলতে থাকেই, ফলে কখনো কখনো মরালিস্টের অবস্থান নেওয়া – যেমন ‘অংশু…’, ‘জুপিটার ও থেটিস’ গল্পে এবং অবশ্যই ‘আমি ও বনবিহারী’তে (যেখানে মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে ডিং ও ডং – মতান্তরে লেনিন ও মাও – ধর্ষক/কম্যুনিস্ট বনবিহারীকে জ্যান্ত অবস্থায় ট্রে-তে বেঁধে চুল্লিতে ঢোকায়) এবং ‘এখন জীবন অনেক বেশি…’তে (অধস্তনের মেয়ে-বউকে একই খাটে বলাৎকার করতে চাওয়া কল্লোলকে বৃষণে, অণ্ডে, বিচিতে মারতে মারতে আধমরা করে ফেলে বামন)।

এই পর্যায়ের লেখালেখিতে একটি কমন থিম হচ্ছে অ্যাবর্শন, হয় প্রাক্তন প্রেমিকা নয় পরিচারিকার ভ্রূণ নষ্ট করা নিয়ে নায়কের গ্লানি তারই শমন হয়ে সামনে দাঁড়ায় (‘কোমরে হাত রেখে ও দু পা ফাঁক করে’), অন্য একটি থিম হচ্ছে অসুখী দাম্পত্য – জীবনানন্দের নবাবিষ্কৃত গদ্য নিয়ে যেমন উচ্ছ্বসিত তেমনই শঙ্কিত ছিলেন প্রদীপন, ‘প্রথম’ আধুনিক গদ্যলেখক তাহলে আমি নই! …এই ক্রাইসিস থেকে তাঁকে বারবার ‘মাল্যবান’-এর কাউন্টারপার্ট কিংবা প্যারোডি লিখে যেতে হয়েছে – ‘কুকুর সম্পর্কে…’, ‘রিক্তের যাত্রায়…’, ‘অস্তিত্ব, অতিথি তুমি’ –সবেতেই একই জিনিস। নিজের দাম্পত্য জীবন কেমন ছিল তা লেখকই শতমুখে বলেছেন ডায়েরি, ইন্টারভিউ ও অন্যত্রে – ‘বিবাহিত হয়েও আমরা আলাদা ঘরে শুই’, ‘আমি কিন্তু মাস্টারবেট করেই বেশি সুখ পেয়েছি…’ ইত্যাদি। এবং আছে ইন্সেস্ট – ‘কুকুর সম্পর্কে…’ উপন্যাসে তা আসে ইডিপাস-ইয়োকাস্তা উপাখ্যানের অবিনির্মাণ ঘটিয়ে এবং ‘ডাবলবেডে একা’-য় তুতো ভাইবোনের মধ্যে স্থাপিত যৌন সম্পর্কে। নাবালিকার প্রতি ধর্ষকামনা (‘মাঝখানের দরজা’ গল্পে যেমন এসেছে) কখনো একটু বদলে হয়ে গেছে বাবা-মেয়ের গূঢ়ৈষা (‘কালিম্পং-এর স্মৃতি’, ‘স্বর্গের নির্জন…’ ও এমনকি ‘এখন আমার…’-তেও আছে ‘ঝিমির বুক একটু বড়ো হলে… প্রতুলের অস্বস্তি’-প্রসঙ্গ)। পাশাপাশি ব্যর্থ লেখকের কথকতা প্রতুলের থেকেই শুরু হয়েছিল; ‘রুবি…’র নায়ককে ‘শারদীয়া দিগম্বরী’ (‘দেশ’ পত্রিকার প্যারোডি) লিখতে বললে সে সমস্যায় পড়ে যায়, প্লট নেই তাই নিজের মেয়ের কুষ্ঠ কামনা করে, অন্তত তাতে একটা জমাটি নাটক পাওয়া যাবে! ‘কোলাজ’-এ দেখি প্রায়-বিস্মৃত লেখক সুইসাইড করলে তাঁরই ডায়েরি ঘেঁটে এক কম্পোজিটার বর্তমান আখ্যানটি প্রস্তুত করছেন। এরই তুলনা করা যাক ব্যক্তি প্রদীপন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে, যিনি লিটল ম্যাগাজিনের একদা-প্রিন্স, গ্রেট গদ্যের লেখক ( অসীম গঙ্গোপাধ্যায় লেখেন ‘আপনি এবং তন্ময় দত্ত এই দুজনেই আমাদের জেনারেশনে সার্থক লেখা লিখেছেন, আর কেউ না’, নীলোৎপল বসু বলেন ‘কোনো লিংক পাওয়া যাচ্ছে না এই গদ্যের’, রূপক মজুমদার লেখেন, ‘ক্রুদ্ধ হয়েছি তার সিদ্ধি দেখে… সে ঢুকে পড়েছিল কবিদের সভায় শাবল হাতে সাঁওতালের মতো’, বসন্ত মুখোপাধ্যায় লেখেন, ‘নিজের শ্রেষ্ঠ গল্পগুলি সেই আড্ডায় মৃদু গলায় প্রদীপন পড়ে যেতেন’) তিনিই আশি দশকে আসনচ্যুত, তাঁর বই আর পাওয়া যায় না, বন্ধুদের সাফল্য দেখে তিনি ঈর্ষায় জর্জরিত হন (‘আমি পুরষ্কার পেলে সব বই কলেজ স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে পোড়াব’, বিরল গাঙ্গুলি শিরোমণি পুরষ্কার পাওয়ায় প্রদীপনের প্রতিক্রিয়া/ ডায়েরি-এণ্ট্রি)।

তিন: লিখনভঙ্গিমা

লেখকের প্রধান একটি পছন্দের বস্তু হচ্ছে কনট্রাস্ট/ বিষম উপদান-এর সংঘর্ষ। এরকম একটি ভয়াল-কমিক ইমেজ হল- সেলুনে দাড়ি কামাচ্ছে দাদা এবং গলায় শাড়ি জড়িয়ে ঝুলছে গৃহিণী, তাই অর্ধেক মুখে সাবান নিয়ে ছুটতে হচ্ছে বাড়িতে (‘যখন সবাই ছিল…’ )। এভাবেই বিষম-জোড় হিসেবে আসে দুর্নীতি ও প্রতিরক্ষা, লোভ ও গ্লানি, সেন্টিমেন্ট ও আইকনোক্লাজম (‘এমন মায়ের জন্য আমি মনেপ্রাণে গর্বিত’ এবং ‘মাকে আমার এই দ্বিতীয় ছিঃ’ – ‘যখন সবাই…’) মৃত্যু ও শাশ্বত-সময় (‘আমরা গলে খসে পড়ব। …কিন্তু রুবি বলেই চলেছে অন্য কথা। …আমরা সমুদ্রে সূর্যোদয় দেখতে যাব। দেখবে নিজেকে অন্য মানুষ মনে হবে’- ‘রুবি কখন আসবে’)। লেখকের বদলাতে থাকা অবসেশনগুলো এই জোড়গুলিকেও ক্রমশ পালটে ফেলেছে।

‘ক্রীতদাস…’ ও ‘সমবেত…’-র মৃত্যু নিয়ে অবসেশন পরে হচ্ছে ‘অংশু…’ ও ‘বড় দুঃসময়’ পর্বের রাজনৈতিক অবসেশন, তারপর তা বদলায় সেক্সুয়াল অবসেশনে (‘রুবির সঙ্গে…’) – মাঝখানে পারিবারিক বিচ্ছেদ/মৃত্যুগুলি একটি সেন্টিমেন্টাল মেলোড্রামার সংকট তৈরি ক’রে অবসিত হয়ে যায় (‘বন্ধের ১০ দিন’ ‘মাতৃস্তোত্র’, হিরোশিমা মাই লাভ’) – শেষ লেখাগুলোয় আবার মৃত্যু ফেরত আসে টার্মিনাল অসুখ ও উন্মাদনা’র মুখোশ পরে। রোগেরও আছে পর্যায়, প্রথম দিকের রোগগুলি হচ্ছে ক্ষরণ (হেমাচুরিয়া, সিরোসিস ও রক্তবমন) তারপর ক্ষত (কুষ্ঠ, পাথুরে ত্বক, গনোরিয়া), পঙ্গু-হওয়া (ফুসফুস কেটে বাদ কিংবা পায়ের গোড়ালি কেটে বাদ), সব শেষে মানসিক ভারসাম্যহীনতা (অ্যালঝাইমার্স ও স্কিজোফ্রেনিয়া)। পালটে গিয়েছে লিখনভঙ্গিমা – যাবতীয় কাব্যগুণ, গাম্ভীর্য ও সংযম ছেড়ে দিয়ে, ভুলে মেরে প্রদীপন হয়ে উঠেছেন চতুর, বাচাল ও নাস্তিক। ‘সমবেত…’র শশাঙ্ক যে চাইবাসা দেখে, তা ছিল গম্ভীর, জমাট, মিস্টিক, ‘ফরেস্টের দিনরাত্রি’তে প্রায় একই পটভূমিকা, কিন্তু সম্পূর্ণ লঘু ঢং-এ বর্ণিত। লেখক স্বীকার করে নেন তিনি স্মৃতি খুইয়ে ফেলা মানুষ (‘আজ কী শাস্তি দেবে দাও আমায় মন্মথ, আমি সব ভুলে গেছি’ – ‘কয়েকটি শিরোনামা’) – যে পুনরাবৃত্তির ভিত্তিতে শুধু জীবনই কাটায় না, তার লেখাও পুনরাবর্তন। নিজের মাংস (অভিজ্ঞতা) তুলে বারম্বার পরিবেশন (কসাই কাসেম আলির সঙ্গে মিল– জীবনটা ঝুলন্ত পাঁঠা এবং কলমটা চপার) –এজন্যেই বহু ব্যবহারে বস্তাপচা হয়ে যায় নানা অনুষঙ্গ- ‘শরাবিকা পতা/ শরাবিকা বাপকা পতা’ জোক (‘স্বপ্নের নিষিদ্ধ ডায়েরি’ ও ‘কোলাজ’ দুটি ডায়েরি-উপন্যাসেই উল্লেখ আছে), ‘জীবিতের চামড়া মৃত গ্রহণ করে না’ (‘জাগো মসৃণ ত্বক’ ও ‘হিরোশিমা…’), ‘ভেসে যা যাওয়ার গেছে, লোনানীল জলধোয়া যেটুকু থাকার রয়ে গেছে’ (‘ডাবলবেডে একা’, ‘স্বর্গের নির্জন…’, ‘ধ্বংসের…’) এবং বেশ খেলো লাগে ‘ইতিহাসসিদ্ধভাবে’, ‘বেশ ভুল বলা হয়ে যায়’, ‘যুগান্ত পেরিয়ে অব্যর্থভাবে মনে পড়ে’-র মতো স্মার্ট বাক্যনিচয়। তিনি কামনা করেন সেন্সুয়াস নাটক, কারণ পুজোসংখ্যার জন্য রেগুলার লেখা চাই- যেজন্যে অন্যের জীবনে ঢুকে পড়ার এত আকুল চেষ্টা (‘সোনালি ডানার ঈগল’ গল্পে তুলে দেন এক অ্যাংলো-সাহেবের মরবিড জীবনবৃত্তান্ত, পুরী বেড়াতে গিয়ে সেই সাহেবেরই মুখে শোনা), বিদেশি সাহিত্য থেকে এটা-ওটা তুলে নেওয়া (যেমন– ‘চটি’ গল্পটি, যাকে রিপুদমন  ঘোষ বাংলা ভাষার সেরা দশটি গল্পের মধ্যে রাখতে চান- যে লেখার আইডিয়াটিই চুরি করা ফন শামিসোর ‘পিটার শ্লেমিল’ ও কাফকার ‘অন আ জায়ান্ট মোল’ গল্প থেকে) কিংবা অন্যের টেক্সট ঈষৎ মুচড়ে অপূর্ব ফিউশন তৈরি করা (নিজের একটি সেরা গল্প ‘শেষ মেট্রো’-য় কানচু ঘোষের ‘সময়’ কবিতাটির লাইন লেখক ধুয়ো হিসেবে ব্যবহার করেছেন এবং গল্পের নামটি তুলে নিয়েছেন ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর বিখ্যাত ছবির নাম থেকে)। নিজের পুরো জীবন যখন অবিকল লেখা যাচ্ছে না (‘আমার কোনো ইমাজিনেশন নেই, না ঘটলে আমি লিখতে পারি না… এইজন্যে সব কিছু করে দেখতে হয়েছে’) তখন ‘রিয়াল’(যা ঘটেছে)-এর সঙ্গে ‘পসিবিলিটি’(যা ঘটলেও পারত) মিশিয়ে দেওয়া (‘কলকাতা তুমি কার’ ও ‘যখন সবাই…’র ভূমিকায় সাদাকালো স্মৃতিতে সম্ভাবনার রঙ চড়ানো/ছেটানোর কনফেশন দ্রষ্টব্য), যদি নিজের চর্বিতচর্বণ একঘেয়ে লাগে নিজের কাছেই তখন অনুজদের লেখা থেকেও শিক্ষা নেওয়া, সুবিশাল মিশ্রের মাল্টিলেয়ার্ড টেক্সট বা কাট-আপ-এর প্রভাব সন্দীপনে পড়েনি জোর দিয়ে বলা যায় কি? ( আমার বন্ধু কৌতুক সরকার এ ব্যাপারে ধন্যবাদার্হ থাকবেন।) ‘ইতিহাসের ধারা’ গল্পটিতে প্রাচ্য লোককথা এবং সমসময়ের স্ক্যান্ডাল দুইই পাশাপাশি রেখে দেওয়া হয় – এই টেকনিক পরে ‘ভারতবর্ষ’ ও ‘স্বর্গের নির্জন…’-এও আসবে।

‘দেখুন আপনি ছবি করেছেন, ভালো বা খারাপ সে অন্য কথা, আমার লেখাটাকে আমি যেভাবেই হোক ভালো করব’- মারমুখী ঋত্বিক ঘটক-সমীপে প্রদীপন শান্ত গলায় এই ডিফেন্সটি খেলেন – প্রসঙ্গ ‘যুক্তি-তক্কো-গপ্পো’ নিয়ে উচ্ছ্বসিত রিভিউ – সাক্ষাৎকারে যার উল্লেখ করেছেন নীলোৎপল বসু), এই একই যুক্তিতে ম্যাড়মেড়ে রিয়ালকে আক্ষরিক না রেখে একটু বদলে, বাড়িয়ে, চড়িয়ে ব্যবহার করা লেখকের পক্ষে অভ্যস্ত কারবার। প্রদীনের লেখা নিয়ে আরো অনেক কিছু বলার ছিল – বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি, লিঙ্গপরিচয় ও পর্নো-ফ্যান্টাসির সঙ্গে জড়িয়েমড়িয়ে, কিন্তু এখানেও দেখছি শেষ করা যায়। -শেষ করছি। জিল দেলুজ ও কমল মজুমদার পড়ে শিখেছি লেখককে না এনে লেখা বুঝবার চেষ্টা করা যথেষ্ট বোকামি – আর প্রদীপন-চরিত বাদ দিয়ে তো প্রদীপন-পাঠশালা চালানোই যায় না।…”

এতোটা শোনার পর প্রদীপন চাটুজ্যে চেয়ারে লটকানো ঝোলা কাঁধে চাপিয়ে কারোর দিকে না তাকিয়ে দপতর থেকে বেরিয়ে গেলো । 

রাহুল আদিদেবতাকে বলল, উনি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন । জানেন যে নন্দন চত্তরে ওনার শবদেহ, নাকে তুলো গোঁজা অবস্হায়, রাখা হবে না । ওনাকে দেখে শেক্সপিয়ার ইয়াগো চরিত্রটা গড়েছিলেন । ওথেলোর সম্বিত যখন ফিরে আসে তখন বুঝতে পারেন ডেডিমোনার প্রতি তাঁর সন্দেহ অমূলক এবং নিছক ষড়যন্ত্রমূলক। বুঝতে পারেন এই ষড়যন্ত্রের মূলে রয়েছে ইয়াগো। ইয়াগোকে হত্যা করতে উদ্যত হন। কিন্তু পারেন না। শয়তানকে কোনো কালেই নিশ্চিহ্ন করা যায় না। অপ্রকৃতিস্থ ওথেলো ইয়াগোকে আহত করলেও হত্যা করতে পারেন না। ইয়াগোর উক্তি ‘আই ব্লিড, স্যার, বাট নট কিল্ড’ আসলে প্রদীপনের উক্তি । 

 

কাজের মেয়ে বলল, দীর্ঘশ্বাস ফেলছি না, ভেতর থেকে উঠে আসছে । তুই আমাকে একটা ফর্সা ছেলে দে। আমার মাহওয়ারির পরের কয়েকদিন বীজ দিবি, তাতেই পেয়ে যাবো একটা ফর্সা বাচ্চা । 

এই মেয়েটা যদি মৎস্যকন্যা হতো, তাহলে বাজার থেকে মাছের মুড়ো কিনে এর দেহে পিটুইটারি গ্রন্হির রসের গুঁড়োর ইনজেকশান দিয়ে ওর আশ মেটাতে পারতো । ভাবলো রাহুল । মেয়েটার কালো বড়ো-বড়ো চোখ, পালিশ করা কালো ত্বক আর আত্মবিশ্বাসের হলকায় এমন ঘেরা যে ও নিজের শরীরকে ধরে রাখার উপায় হিসেবে  প্রাণবন্ত  স্বাচ্ছন্দ্যে নিজেকে প্রকাশ করছিল। হরপ্পা আর মহেঞ্জোদরো থেকে হয়তো এর পূর্বপুরুষরা হাজার বছর আগে চলে এসেছিল এই শহরের গঙ্গার ধারে বসত গড়ার জন্যে । 

রাহুলের মনে হলো, এর চেয়ে অনিকেতের প্রেম বরং সফল । বিবাহিতা নারী । চাইবাসায় যখন গিয়েছিল, অনিকেত নিয়ে গিয়েছিল ওনাদের বাড়ি । বলেছিল, চল, এক বাঙালি পরিবারে খাবার নেমন্তন্ন আছে, অপূর্ব ব্যানার্জির শশুরবাড়ি । রাহুলকে অপূর্ব ব্যানার্জি বলেছিলেন একবার, অনিকেত তো আমার শশুর-শাশুড়ি আর শালী-শালাদের রোজ টাটকা মাছ খাওয়াচ্ছে ; জিপগাড়ি ভরে-ভরে পৌঁছে দেয় । ওনাদের ফ্রিজ নেই, পড়শীদের বিলিয়ে দেন, বুঝলে হে, অনিকেত আমার শশুরবাড়ির সবাইকে আমার চেয়ে বেশি হাত করে নিয়েছে । ওনাদের বাড়িটা মধুটোলা নামে একটা পাড়ায় । অনিকেতের বাড়ি থেকে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাস্তা । কয়েকটা ঝোপের ওপরে সোনালী পরগাছা লতিয়ে লেস বোনার কাজ করে চলেছে । বড়ো গাছগুলোর গোড়ার কাছে শেকড়গুলো নিজেদের মধ্যে জড়াজড়ি খেলছে । এটাই তাহলে চাইবাসা আবিষ্কারের রাইজোম্যাটিক পথ, রাহুল নিঃশব্দে বলেছিল নিজেকে।

ওনাদের দুই-চালা উঁচু বাড়িতে ঢুকে রাহুলের প্রথম পরিচয় হলো নীলার দিদি গৌরীর সঙ্গে  । বাড়িটা থেকে উনিশ শতক তখনও ছেড়ে যেতে চায়নি । কোনও ব্রিটিশ কর্মচারী তৈরি করিয়েছিল বলে মনে হয় । বাড়ির সামনে টালির ছাদের তলায় ছেঁচতলা, হয়তো ড্রইঙরুমের কাজে দিতো, এখন একটা নেড়িকুকুর, ইংরেজি নামের, বাঁধা থাকে । ঢুকেই পাশাপাশি তিনটে ঘর, মাঝেরটা বড়ো, বাঁদিকেরটা পরিবারের কর্তার, ডানদিকের ঘরটা ছোটো, পড়ুয়াদের জন্য । পরিবারের মেয়েরা মাঝখানের ঘরে শোয় । তিনটে ঘরের সামনে টালির চালার তলায় বারান্দা । তার সামনে বেশ বড়ো উঠোন, যার এক কোনে গরু-বাছুর, কলতলা, স্নানঘর, খাটা পায়খানা । শেষ বয়সে পরিবারের কর্তা বছর তিনেক শয্যাশায়ী ছিলেন, বিছানার পাশে ঝোলানো পেচ্ছাপের ব্যাগ । খাটের তলায় বেড প্যান । এতোগুলো সন্তান পয়দা করার খেসারত । মেয়েদের মা কিন্তু সে তুলনায় স্বাস্হ্যবতী, ফর্সা, গোলগাল, বেঁটে, হাসিমুখ ।

গৌরীর বয়স তিরিশের কাছাকাছি, স্বাস্হ্যোজ্বল চেহারা, হাসিমাখানো চাউনি , তাছাড়া গলার স্বরে স্নেহ সুস্পষ্ট । দেখেই ভালো লেগে গেল রাহুলের , বুঝতে পারলো অনিকেত কেন আকর্ষিত হয়েছে ।  গৌরী মৃদু হেসে বললেন, তুমি তো বইপোকা মানুষ, সারাদিন গম্ভীর-গম্ভীর বই পড়ো ।অনিকেত বলেছে আমাকে, কলকাতার তাবড়ো কবি-লেখকদের প্রায় উপড়ে ফেলেছো, অনেককে চটিয়েছো, এমনকী অসীম গাঙ্গুলির মতন রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারীকে, আনন্দসেবকদের । আর কী কবিতা লিখেছো ভাই, একেবারে বিগ ব্যাঙ বিস্ফোরণ, অমন কবিতা ওই একবারই লেখা হয়ে গেল, বুঝলে । 

 শুনে, রাহুল নিজেকে আলোর দূত বলে মনে হলো, নিজেরই কাছে নিজে একজন অচেনা ফরিশ্তা । আমরা আমাদের উন্মাদনা ভেতরে বহন করি আর বাইরের ক্ষমতার শিকার হই । রাহুল বলল, অসীম গাঙ্গুলি কবিতাটা সম্পর্কে অনিকেতকে লেখা একটা চিঠিতে কিন্তু বলেছিলেন, “সাক্ষীর কাঠগড়ায় রাহুর কবিতা আমাকে পুরো পড়তে দেওয়া হয়। পড়ে আমার গা রি-রি করে। এমন বাজে কবিতা যে আমাকে পড়তে বাধ্য করা হল, সে জন্য আমি ক্ষুব্ধ বোধ করি— আমার সময় কম, কবিতা কম পড়ি, আমার রুচির সঙ্গে মেলে না — এমন কবিতা পড়ে আমি মাথাকে বিরক্ত করতে চাই না। রাহুর তিনপাতা রচনায় একটা লাইনেও কবিতার চিহ্ণ নেই। রাহু যদি আমার ছোট ভাই হতো, আমি ওকে কবিতা লিখতে বারণ করতাম অথবা গোড়ার অ-আ-ক-খ থেকে শুরু করতে বলতাম। যাই হোক, তবু আমি বেশ স্পষ্ট গলাতেই দুবার বলেছি ওর ঐ কবিতা আমার ভালো লেগেছে। এর কারণ, আমার কোনো মহত্ব নয়— আমার সাধারণ, স্বাভাবিক, সীমাবদ্ধ জীবন। যে-কারণে আমি আনন্দসেবকে সমালোচনায় কোনো বাজে বইকে ভালো লিখি — সেই কারণেই রাহুর লেখাকে ভালো বলেছি।”  

গৌরী বললেন, সামান্য বিদ্রুপের হাসির মিশেল দিয়ে, অসীম গাঙ্গুলি ভিন্ন জগতের মানুষ । শুনেছি যে সেই বাংলাদেশি লেখিকা, যিনি ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁর সঙ্গে অসীম গাঙ্গুলি ফস্টিনষ্টি করেছিলেন, আর সেই লেখিকা তাঁর বইতে ঘটনাটা ফাঁস করে দেয়ার দরুন উনি ভারতে বইটা নিষিদ্ধ করার পক্ষে ছিলেন। যাকগে, ওসব বিষয়ে ভেবো না । যা ভালো বোঝো তেমন লেখো । অনিকেত্কেও আমি একই পরামর্শ দিয়েছি। তবে ইতিহাস-দর্শন-রাজনীতির বই বেশি না পড়াই ভালো ।

রাহুল বলল, জানি,  খুব বেশি বই পড়া ক্ষতিকর, বুঝলেন গৌরী বউদি !  তারপর যোগ করল, লেখক বা কবি হতে চাইলে বেশি পড়াশুনা করা উচিত নয় । দাদা কেবল বাংলা ভাষায় কনসেনট্রেট করে ভালো করেছে। 

—বউদি বলছ কেন, আমি তো দিদি । বললেন গৌরী । তারপর যোগ করলেন, ও বুঝেছি, অনিকেতকে পছন্দ করি তা তোমার কানেও গেছে । যাকগে ওসব । এখন তোমার কথা বলো । অনিকেত বলছিল তুমি মনে করো গান্ধিকে মিথ করে গড়ে তোলা হয়েছে । তোমার মতে প্রকৃত কিংবদন্তি হলেন সুভাষচন্দ্র বসু ।

—হ্যাঁ । আপনার মনে আছে হয়তো  ১৯৪৭ সালের ১৬ই  আগস্ট,  লাল কেল্লা থেকে ভাষণ দেওয়ার সময়, জওহরলাল নেহেরু ঘোষণা করেছিলেন যে ভারত 'মহাত্মা গান্ধীর উজ্জ্বল নেতৃত্বে এবং নির্দেশনায় স্বাধীনতা অর্জন করেছে'। এ থেকে সুস্পষ্ট যে নেহেরুর এসট্যাবলিশমেন্ট জন্মলগ্ন থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদানকে নস্যাৎ করতে চেয়েছে । গান্ধির বিশাল মাহাত্ম্য সত্ত্বেও, বিবৃতিটি ছিল ভুল এবং  অতিসরলীকরণ দোষে দুষ্ট। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যে মিথ তৈরি করেছিলেন তা আজও ভারতের সরকারী মিথ হিসাবে রয়ে গেছে। ঘটনাটি হল যে একমাত্র গান্ধীবাদী আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলনের প্রায় এক দশক পরে, পরিকল্পনা পর্যায়ে তাকে মুছে ফেলা হয়েছিল এবং তারপরে আন্দোলনের যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তা গান্ধীবাদী বা অহিংস ছিল না। সেই সময়ে  ব্রিটিশ সরকারকে যা ব্যতিব্যস্ত করেছিল, তা হল আইএনএ বিচারের প্রতিক্রিয়া হিসাবে স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান, আর কংগ্রেস এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির দ্বারা এর পরিবর্ধন, যারা এটিকে একটি কার্যকর রাজনৈতিক অস্ত্র বলে মনে করেছিল। ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি রয়্যাল ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স আর রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভিতে বিদ্রোহ ঘটাতে পেরেছিল, তা ছিল  এমন এক ধারাবাহিক ঘটনা যা ব্রিটিশ রাজত্বের ভিতকে  নাড়া দিয়েছিল। ভেবে দেখুন, সেনারাই তো ছিল দেশকে পরাধীন রাখার প্রধান উপকরণ। ১৯৪৬ সালে ,  ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল , ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে বিদ্রোহের ভয়ে ভারতে আরও ব্রিটিশ সৈন্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। এই ঘটনাগুলো ১৯৪৬  সালের নির্বাচনের পরপরই ব্রিটেনের লেবার গভমেন্ট ভারতীয় নেতাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রায় অধৈর্য হয়ে পড়েছিল । তবুও, ভারতীয় এসট্যাবলিশমেন্টের ভাবনাচিন্তায়, অদ্ভুতভাবে কিন্তু অবর্ণনীয়ভাবে, আমরা একটি জাতি হিসাবে এখনও ভারতের স্বাধীনতার গান্ধীবাদী কিংবদন্তিতে আটকে আছি । 

–অনিকেত ঠিকই বলেছিল । তুমি বড্ডোবেশি সাহিত্যের বাইরে চলে যাও । 

–আমার কিন্তু প্রথম থেকেই অদ্ভুত লেগেছিল যে চাইবাসার মতন শহরে বসবাস করে আপনাদের পরিবার কেমন করে নিজেদের বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে । এমনকী এখনকার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, ফিল্ম সম্পর্কেও আপনারা বিশদ ওয়াকিবহাল । আপনাদের বাড়িটা একটা মিনি কলকাতা । আপনাদের বাড়িতে এসে অনিকেত চাইবাসা অবিষ্কার করল ।

–ঠিক বলেছ, চাইবাসা আবিষ্কার । এখানকার বাঙালিদের মধ্যে আগে সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহ ছিল । আমি তো একটা হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করতাম । আমার বোনেরা আর পরিচিতরা লিখতেন । অনিকেত এই শহরে আসার পর আমরা সত্যিকারের পাঠক হয়ে উঠতে পেরেছি । কলকাতা গেলে আমাদের জন্য বই আর পত্রিকা নিয়ে আসে অনিকেত ।

—হ্যাঁ । আমি যখন সবে বাংলা সাহিত্যে আগ্রহী হয়েছিলুম তখন দাদা আমার জন্য বইপত্র আনতো । দাদার কবিতায় আপনার উপস্হিতি আছে।

–জানি । 

—তবে, বন্ধুদের থেকে দাদা ক্রমশ নিজেকে পৃথক করে নিতে চাইছে , দাদার আগে মহানন্দ বাগচী নিজেকে আলাদা করে নিয়েছিলেন। প্রদীপন চাটুজ্যে বলেন যে মহানন্দ বাগচী আর রূপক মজুমদারকে ল্যাঙ মেরে বন্ধুর দল থেকে বের করে দিয়েছিলেন অসীম গাঙ্গুলি  । 

গৌরী বললেন, মহানন্দ বাগচীর কথা শুনেছি, খুব ভালো কবিতা লিখতেন । উনি কখনও চাইবাসায় আসেননি । 

—উনিই তো রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা । মহানন্দ বাগচী  সাহিত্যজগত থেকে হারিয়ে যাওয়া একজন কবির নাম। অথচ নিজের যৌবনের শুরুতে যিনি ছিলেন পঞ্চাশের দশকের উজ্জ্বলতম কবিদের একজন। সুশীল রায় এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘মহানন্দ বাগচীর ‘স্বগত-সন্ধ্যা যখন বের হয় তখন তিনি অসাধারণ খ্যাতি লাভ করেছেন। যে-কোনো সাহিত্যসভায় বা কবিসম্মেলনে তাঁকে  নিয়ে সব-প্রথম এবং সবচেয়ে বেশি আলোচনা হত।’ রামায়ণ নট্ট কোম্পানির মুখপত্র, যা কিনা সে-সময়ে তরুণ কবিদের আত্মপ্রকাশের প্রধান আশ্রয় হয়ে-উঠতে পেরেছিল, সেই পত্রিকার সঙ্গেও ছিল আনন্দ বাগচীর যুক্ততা। অসীম গাঙ্গুলি একবার রাহুকে বলেছিলেন,  আমি তখন থার্ড ইয়ারের ছাত্র, বয়েস উনিশ। কারাবাসের কারণে দুটি বছর নষ্ট হওয়ায় রূপক মজুমদার পড়ে ফার্স্ট ইয়ারে স্কটিশ চার্চ কলেজে; তাঁর সহপাঠী আনন্দ বাগচী, যাঁর কবিতা তখন সমস্ত পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়। ও-রকম খ্যাতিমান একজনকে সম্পাদকমণ্ডলীতে নিয়ে আমরা রামায়ণ নট্ট কোম্পানির গৌরব বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রথম তিনটি সংখ্যা প্রকাশের পরই দীপক মজুমদার যেমন কৃত্তিবাস থেকে সরে যান, তেমনি আনন্দ বাগচীকেও পত্রিকা প্রকাশের বাস্তব দিকে বিশেষ পাওয়া যায় নি। অসীম গাঙ্গুলির রাজনৈতিক প্যাঁচের ফলে মহানন্দ বাগচী টিকতে পারেননি । মহানন্দ বাগচী তাঁর সঙ্গে রূপক মজুমদারের পরিচয় সম্পর্কে লিখেছেন, স্কুলের গণ্ডী ছাড়িয়ে, কলেজে ঢুকেছি, কয়েকদিনের মধ্যেই আবিষ্কার করলাম বাংলার ক্লাসে আমার পাশে বসা ছেলেটি এক ডাকসাইটে কবি, বাংলা দেশের তা-বড় তা-বড় জ্ঞানী গুণী মানুষের কাছে তার ঘনিষ্ঠ যাতায়াত। প্রায় সন্ধি স্থাপনের ভঙ্গিতে বন্ধুত্ব করে ফেললাম। এই বিচিত্র চরিত্রের ব্যক্তিটির নাম রূপক মজুমদার।  তাঁদের ‘তিন মাথা এক হয়ে রামায়ণ নট্ট কোম্পানির মুখোপত্র’ বেরোনোর সঙ্গে-সঙ্গে কবি হিসেবে আমারও একাকীত্বের দিন শেষ হল। আমাদের হতো, প্রমাণ সাইজের আড্ডা। সাহিত্যের সেই আড্ডাখানায় প্রায় মিছিল করে কবিরা এল। বসন্ত, রক্তিম, নীলোৎপল,  তারপর আরও অনেকে। কলকাতার উত্তর-দক্ষিণ এক হয়ে গেল।’

—কেউ কেউ কেন যে হারিয়ে যান । অনিকেতকে হারিয়ে যেতে দেবো না । আজকাল দেখছ তো, অনিকেতের কবিতাতেও পরিবর্তন এসে পড়েছে, বিপুল পরিবর্তন । বললেন গৌরী । 

—সম্ভবত তাও আপনার প্রভাবে ।

—- অনিকেতের কবিতায় যে পরিবর্তন এসে পড়ল তা কিন্তু অন্য কারোর প্রভাবে নয় ; তা ওর বন্ধুদের হেসাডি কেলেঙ্কারির জন্য। অনিকেত নিজেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলতে চেয়েছে ওই বন্ধুদের থেকে । অনিকেত এই জেলার সরকারি কর্তাদের একজন আর অপমানিত হতে হলো আরেকজন জেলা সরকারি কর্তার কাছে।ডিস্ট্রিক্ট ফরেস্ট অফিসারের কাছে । চাইবাসা অনিকেতের জন্য অনেক ছোটো শহর । অবশ্য মহানগর তো আজকাল খ্যাতনামাদের শবদেহ রাখার জন্য । তবুও, কলকাতায় বসবাস অনিকেতের জন্য জরুরি। নিজের বীক্ষা প্রতিষ্ঠার জন্য ওর একটা মুখপত্র  হওয়া দরকার ।  অনিকেত ওর কবিতার খাতা আমাকে দিয়েছে ওর সাম্প্রতিক কবিতা পড়ার জন্য । কী অসাধারণ লিখেছে, একেবারে নতুন ভাবনা, ‘নদীর ধারে শুয়ে আছি’ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন । আমি পড়ছি, শোনো, কবিতাটার নাম ‘অন্তরলোক’ :

কেউ কি ভালোবাসতে পারে

ঐ স্বচ্ছ ঝর্ণার কিনারে ।

একাকিনী দেবদারুটির মতো ।

শীতের রোদ সারাগায়ে মাখবে বলে

পাতার রাশি ঝরিয়ে দিতে পারে?

আমি ভীরু শাল অশ্বখের শাখা

পাতায় পাতায় আমার ঢাকা শরীর;

কি জানি, কে জানে, সারা বছর কেন যে।

এমন পাতা ঝরে!

–জানি, রাহুল বলল, ঘটনাটা অন্যভাবে লিখেছেন অসীম গাঙ্গুলি । প্রদীপন চাটুজ্যের নোংরামি আড়াল করতে বুড়ি আদিবাসি মহিলার জায়গায় এনেছেন যুবতী । আপনাদের মধুটোলাকে নিয়ে গেছেন পালামৌতে । হেসাডিকে বেতলার জঙ্গলে । কেন ? প্রদীপন চাটুজ্যে অবশ্য দাদাকে চিঠি লিখে স্বীকার করেছেন যে অনিকেত যদি সেদিন সময়মতো টাকাকড়ি নিয়ে না পৌঁছোতো তাহলে ওদের পিটুনির একশেষ হতে হতো । 

—হ্যাঁ, সিমি গারেওয়াল, ম্যানেকুইনের মতন চিরযৌবনা ।

—আর আপনি তো শর্মিলা ঠাকুর । বলে, রাহুল বুঝতে পারলো, যাঁদের মুখময় আনন্দ ছেয়ে থাকে তাঁদের মধ্যে বাস করে আশা । 

—ধ্যাৎ, কী যে বলো । তুমিও অনিকেতের মতন মেয়েদের প্রশংসা করতে শিখেছ । সত্যজিৎ রায় অনিকেতকে বলেছিলেন যে উনি আমাদের পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হতে চান । অসীম গাঙ্গুলি ব্যাপারটা ভালোভাবে নেননি । আমাদের বাড়িতে যদি সত্যজিৎ রায় আসতেন, তাহলে সে এক ঐতিহাসিক ঘটনা হতো, কী বলো ? গৌরীর উচ্চারিত শব্দের গঠন এবং তার নিহিত প্রতিধ্বনি, মনে হলো কণ্ঠস্বরের রঙ মাখানো । কথার শেষে মুচকি হাসি  যেন চিঠি লিখে জিভ দিয়ে খাম বন্ধ করছেন । 

প্রসঙ্গ পালটাবার জন্য রাহু বলল, অনিকেত আজকাল যে ছোটোগল্প লিখছে, সেগুলো পড়েছেন ? ব্যক্তিকে গল্পের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিয়েছে । তাছাড়া অনিকেত গল্প লেখার একটা নতুন জঁর তৈরি করেছে, যাকে ও বলছে ঝুরোগল্প । অনিকেতের প্রশংসাও চোখে পড়ে, বিশেষ করে কেতুকে নিয়ে তরুণদের কথায় । এই যেমন অভিষেক প্রহরাজ লিখেছেন, “অনিকেতদার কথা বলছি, উনি ছিলেন এক নিঃশব্দ, এবং কেউ জানতে না পারা “ভিজিলান্তে” বা যারা নীরবে পাহারা দেয়, আছেন বলে বোঝা যায় না। বাংলা কবিতার জগৎ ওনার চেয়ে ভালো বোধহয় কেউ জানতো না। অথচ অনেক তরুণ কবি কল্পনাতেও রাখতে পারবেন না যে অনিকেত সিংহ তার প্রত্যেকটি লেখা শুধু মনে দিয়ে পড়া নয়, নোট নিয়ে পড়েছেন, ভেবেছেন, আলোচনা করেছেন। উনি জানতেন ঢক্কানিনাদ কি পরিমাণ ক্ষতিকর। একবার কোনো এক শীতের খুব সকালে, দুর্গাপুরে ঘুমোচ্ছি আমি, একটা ফোন আসে। ঘুমচোখে ধরতে শুনি “নমস্কার, আমার নাম অনিকেত সিংহ। আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করার আছে। অসুবিধে নেই তো?” বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে উঠে পড়ি।  সকালের ফোনটি ছিলো আমার দেয়া কবিতাগুলোর মধ্যে একটি কবিতা নিয়ে ওনার কিছু ধারণা ও কথা, আর সেগুলি সম্পর্কে আমার কি মতামত, এবং আমার কি মনে হয় উনি কবিতা নিয়ে যা বলছেন সেগুলি সঠিক বা অন্যরকম কোনো দেখা। এইসব। বাকি জীবনে আমার অনিকেত সিংহের সাথে দেখাও হয়নি, কথা বহুদূর। ওই একটা সকালে ছোট্টো ফোন।”

—হ্যাঁ, শুনেছি, তরুণদের কবিতা আর গল্পের অসাধারণ বিশ্লেষণ করছে অনিকেত । বয়স্করা তো তরুণদের নিজের কাজে ব্যবহার করেন । অনিকেত কিন্তু তা কখনও করেনি ।

—অনেকে আবার অনিকেতের ঘোর বিরোধী, এমনকী নিজের ছেলে-মেয়েদেরও তেমন ট্রেনিঙ দিয়ে গেছেন, যেমন এই চিঠিটা শ্রীজা চোঙদার লিখেছেন জনৈক সম্পাদককে । শ্রীজা চোঙদার হলেন কামেশ্বর চোঙদারের মেয়ে । এই চিঠিটা লেখার পরেই কয়েকদিনের মধ্যে মারা যান শ্রীজা ।     

মহাশয়,

   আমি, মিসেস শ্রীজা চোঙদার, স্বর্গীয় শ্রীকামেশ্বর চোঙদারের একমাত্র সন্তান, আপনার মুখপত্রে আমার বাবার কয়েকটি কবিতা, প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে আমার বা আমাদের পরিবারের অনুমতি ছাড়াই ।আপনি আমার বাবার মৃত্যুর পর আমার বা আমাদের পরিবারের অনুমতি ছাড়া বাবার রচনাগুলি আপনার পত্রিকা 'চন্দ্রগ্রহণ'-এ ছেপে ঘোরতর অন্যায় করেছেন ।    আমি জানি, এ কাজ আপনি শ্রীঅনিকেত সিংহর দ্বারা নির্দেশিত হয়েই করেছেন । আমার বাবাকে জীবিতথাকাকালীন যাঁরা কুৎসিতভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আক্রমণ করেছেন , তাঁদের সঙ্গে আমার বাবার কোনো সংকলনে কোনো লেখা থাক, এটা আমি বা আমার পরিবারের কেউ চাই না । আমার বাবা স্বর্গীয় শ্রীকামেশ্বর চোঙদারের এটাই ইচ্ছা ছিল । স্বাভাবিকভাবেই আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা আমার স্বর্গীয় বাবার ইচ্ছার সন্মান জানাতে চাই ।   আপনাকে আবারও বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি যে আমার বা আমাদের পরিবারের অনুমতি ছাড়া আমার বাবার কোনো রচনা -- কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি আর ছাপবেন না বা ছাপাবেন না । এর পরও যদি না শোনেন তবে আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা আপনার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্হা গ্রহণ করতে বাধ্য হব ।

   বিনীত নিবেদন

   শ্রীজা চোঙদার

—ও বাবা, এতো রীতিমত অপমানজনক হুমকি হে । বললেন গৌরী ।

রাহুল বলল,  কিছুই করার নেই, যার যেমন চিন্তা । ছাড়ুন ওসব । অনিকেত ছোটোগল্পে যে বিপুল পরিবর্তন এনেছে, তা লক্ষ্য করেছেন? 

—হ্যাঁ, পড়েছি । বললেন গৌরী । তারপর যোগ করলেন, কিন্তু বাংলায় লেখালিখি এমন পাল্প ফিকশানের স্তরে পৌঁছে গেছে যে অনিকেতের স্বীকৃতি পাওয়া কঠিন । যেমন এই গল্পটা, এর বিষয়বস্তু হলো অন্ধকার । গৌরী একটা পত্রিকা রাহুকে দিয়ে বললেন, এটা পড়ে দ্যাখো, গল্পটার নাম ‘মেথিশাকের গন্ধ’ :

“অনেক দিন পর আবার লোডশেডিং।

মুহূর্তে চারিদিক অন্ধকার। আলোয় অভ্যস্ত স্বভাব অস্বস্তিতে। যা-কিছু আমার বলার মতো বিষয়-সম্পদ জড়ো করেছি সব আড়াল হয়ে গেল।

টেবিল চেয়ার বেডরুম টিভি ফ্রিজ ওয়াশিং মেশিন শেফালি ঘরদোর বুকসেল্ফ সিলিং-ফ্যান কবিতার খাতা পাশবই…ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এ বাড়ির যা-কিছু দৃষ্টিগোচর, এই মধঊর্তে নিজের নিজের অবস্হান থেকে সেই উপস্হিতি এই অন্ধকারে নিভে গেছে। যে অবস্হানগুলো নিজের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে মহাবিশ্বে আমার জলজ্যান্ত থেকে যাওয়া।

ছোটোবেলায় মা অন্ধকার দিয়ে ভয় দেখিয়ে শাসনে রাখতেন…সে সময় ধারনা হয়েছিল…অন্ধকারে জুজুবুড়ি, রাক্ষস খোক্কোস শাঁকচুন্নি একানড়েরা থাকে…মা-র কথা না শুনলে খপ করে খেয়ে নেয়…তারপর মা যখন মামারবাড়ি পাণিহাটিতে নিয়ে যেতেন…রাঙাদিদু কাছে টেনে সবাইকে রাক্ষস খোক্কোস জয় করার রূপকথা শোনাতেন…আমরা নিজেরাই কেউ রাক্ষস খোক্কোস কেউ রাজপুত্র সেজে জয়ের খেলা খেলতাম…খেলতে খেলতে ভয় কেটে গেল…রাঙাদিদু স্বামীর ঘর করার আগেই বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যে বিধবা হয়েগিয়েছিলেন…ছোটোছোটো কদমছাঁট চুল…ফরসা রং…রোগা রোগা হাত পা…পরনে থান কাপড়…সবাই বলত নেড়ি পাগলি…আমাদের রাগদুঃখ বাড়ত…সেই রাঙাদিদু হঠাৎ মারা গেলেন…পরের বার পাণিহাটিতে গিয়ে আর দেখা হল না…মা বললেন…অন্ধকারের দেশে চলে গেছেন…সেই প্রথম অন্ধকারের মধ্যে প্রিয়জনের বাসা তৈরি হল…তারপর এক এক করে মা বাবা ছোড়দি মেজো জ্যাঠা ন-কাকা বন্ধুবান্ধব কত প্রিয়জন সেই অন্ধকারে চলে গেল…

আজ রামতনুর আসার কথা। রামতনু কবি। এলে, বেশ জম্পেশ আড্ডা হয়। তবে এখন আর কলিংবেল বাজবে না। বিদ্যুৎ নেই। গেট খোলার শব্দের দিকে একটা কান রাখতে হবে।

রান্নাঘরের দিক থেকে শেফালি চিৎকার করে উঠল: যে যেখানে আছো সেখানেই থাকো…মোমবাতি জ্বেলে নিয়ে আসছি…

শেফালির কন্ঠস্বর মিশে হঠাৎ আসা অন্ধকারের নিঃসঙ্গতা কাটল। কিন্তু শেফালি বহুবচনে সাবধান জানাল কেন ! আমি তো এঘরে একা !

আজ আবার কৃষ্ণপক্ষের দ্বাদশী। চাঁদ প্রায় নেই হয়ে দেরি করে উঠবে। দরজা জানলা খোলা থাকলে আশপাশ থেকে কিছু টুকরো আলো ঠিকরে আসে। কিন্তু মশার উপদ্রবের জন্য শেফালি বেকেল হওয়ার আগে থেকে ঘরদোর আঁটোসাঁটো বন্ধ রাখে। চুরির ভয়ের খিল ছিটকিনির চেয়ে এই বন্ধ আরও নিশ্ছিদ্র। আমাদের প্রতিবেশীরাও একই নিত্যের শামিল। এটা আবার মুখ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা তাই লোকে যাতে মনে না করে নিজের এরিয়ায় তিনি বেশি কাজ করছেন তাই খুব একটা পাবলিক ওয়ার্ক এলাকায় হয় না। আর যাই হোক পার্টির এই সব নির্ভীক সততা আছে।

এই ব্রহ্মপুর খালপারের এলাকা স্টেট ইলেকট্রিসিটির আওটায় : ওপারে সি,ই,এস.সি.। ওপারের চেয়ে এদিকে লোডশেডিং বেশি তবে আগের তুলনায় কমেছে। এইসব নিয়ে এই অঞ্চলে আলোচনা হয়, বটতলা বাজারে, চায়ের দোকানে আর মহিলামহলে। কত রকমের কথা আর কথাকাটাকাটি বেরিয়ে আসে।

তবে একটা ব্যাপার সুখের। নিয়মিত লোডশেডিং হওয়ার ফলে জেনারেটরের ব্যবসা, মশার রকমারি ওষুধপত্তরের বিক্রিবাটা, মোমবাতি আর ব্ল্যাকে কেরোসিন ইত্যাদির ব্যবসা বেড়েছে। কিছু বেকার ছেলের তবু যাহোক হিল্লে হয়েছে।

অবশ্য রিটায়ারমেন্টের পর আমাকে জেনারেটারের লাইন কাটিয়ে দিতে হয়েছে। বাড়তি খরচ কমিয়ে আনতে। যদিও পথেঘাটে তত আলোর ব্যবস্হানেই। একটা স্হায়ী অন্ধকার এলাকায় আছে।

কতকটা বাল্মীকির আশ্রমের মতো, তাঁর আশ্রম ছিল তমসা নদীতীরে। এই তমসা নদীর তীর পর্যন্ত সুমন্ত্র রামচন্দ্রকে অনুগমন করেছিলেন। যেখানে লবকুশকে সঙ্গে নিয়ে সীতা থাকতেন। কবিতার জন্ম হয়েছিল এই নদীতীরে, আরও সহজ করে বলা যায় মানুষ নামের প্রাণীর কবিত্বের জন্ম এই তমসা তীরে। যে কবিত্ব এই প্রজাতির চালিকাশক্তি। বিজ্ঞানীরা অবশ্য ব্যাপারটাকে বলেন, দ্য গ্রেট অ্যাবাউট টার্ন। গন্ধ শব্দ স্পর্শ এভাবে একটা মাত্র বৈশিষ্ট্যের পথ না বেছে নিয়ে সবদিকে সচেতন হওয়ার মন। আর এই মনের প্রশ্রয় তমসাকে ভর করে।

একটা কিছুর শব্দ হল; না, রামতনুর আসার শব্দ নয়। রান্নাঘরে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ। শেফালি চেঁচিয়ে উঠল: মেথিশাক আর বেগুন দিয়ে মেথিবেগুন চাপিয়েছিলুম…পুড়ে না যায়, সামলাতে গিয়ে তেলের শিশি অন্ধকারে হাত লেগে র‌্যাক থেকে পড়ে গেল…চারিদিকে তেল আর কাচের টুকরো ছড়িয়ে পড়েছে…সামলে আসছি…তুমি এদিকে এসো না…

সাবধান করে দিয়ে শেফালি ভালো করেছে…শেফালির দিকে এগোনোর রিস্ক নেব ভাবছিলাম। মেথিশাকের গন্ধ ভেসে এসে রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার হদিস দিয়ে গেছে। যদিও একেবারেই কিছু দেখা যাচ্ছে না। বেশ জমাট অন্ধকার। সবকিছু একাকার হয়ে গেছে। আকারের যে হট্টোগোল আমার আকারটুকু সায় দিয়ে রেখেছে সেইসব কিছু অন্ধকারের মধ্যে লোপাট হয়ে গেছে। এই অন্ধকারে আমার সম্বল ওই মেথিশাকের গন্ধ আর শেফালির কন্ঠস্বর। মেথিশাক দিয়ে বেগুন না মেথিশাক দিয়ে শেফালির কন্ঠস্বরের ব্যঞ্জন, এই মুহূর্তে ঠিক কী বলা যাবে ! মেথিশাকের গন্ধে মেথিশাকের শরীর ছাপিয়ে এই জীবনের আরও কত কি যে ক্রমশ সেঁধিয়ে গেছে। ছোড়দি ভালোবাসত মেথি শাক দিয়ে শুকনো শুকনো কইমাছ । মা মেথি পাতা শুকিয়ে রাখতেন, ফোড়ন দেওয়ার জন্য কিংবা মুগডালে দিতেন।

সাহস করে চেয়ার ছেড়ে উঠেছি। সামনে টেবিল আছে জানি, তার দু পাশ দিয়ে দুটো আলাদা স্পেসের বাইলান, বাঁদিক ধরে এগোলে এক হাতের মধ্যে করিডরের দরজা। অন্ধকারের ভিতর কত পরিসরের অলিগলি। অন্ধকারের মধ্যে এক ধরনের ফাটল।

বাঁধন বলত, অন্ধকারের স্হানিকতা। স্পেস যেভাবে সম্পর্ক গড়ে। এগোচ্ছি। টেবিল ছাড়িয়ে ঠিক বেরোতে পেরেছি মনে হচ্ছে। দরজা হাতড়াচ্ছি। এই তো দরজা। আলতো ভাব রেখেছি চলাফেরায়। তবু দরজায় হাত ঠেকে ঠুক করে শব্দ হল। যা ভেবেছি ঠিক তাই। শেফালি ওই ক্ষীণ শব্দটুকুও শুনতে পেয়েছে। সে প্রতিবাদ জানায়—

:তোমায় তোমার জায়গায় স্হির থাকতে বলেছি না…মনে হচ্ছে আমার দিকে আসার সেই চেষ্টা করে যাচ্ছ…এসো না…ওখানেই থাকো…

—সাবধানে একটু একটু করে এগোচ্ছি

:তুমি তো বেশির ভাগ দিন এই সময়ে বাড়িতে থাকো না…আমি থাকি তাই আমার অন্ধকারে চলাফেরার অভ্যাস হয়ে গেছে…আমি চিনি জানি…

দরজা পেরিয়ে গেছি। ডানদিকে করিডরের দেয়াল ডান হাতে ঠেকছে। এবার বাঁদিকে এগোতে হবে। বাঁদিকের দেয়াল ধরে এগোলে হদিস পেয়ে যাব। প্রথমে খাবার ঘরের জানলা পড়বে তারপর খাবার ঘরের দরজা। সেই দরজা দিয়ে ঢুকলে সামনে ডাইনিং টেবিল। ডান হাতের দেয়াল ঘেঁঢ়ে ক্রকারি রাখার আলমারি। সেই আলমারি ছাড়িয়ে একটু এগোলে রান্নাঘরার দরজা। রান্নাঘরে দুদিক দিয়ে যাওয়া যায়। করিডর দিয়ে এগোনো যেত। কিন্তু সেখানে এই অন্ধকারে সব গোলমাল হয়ে যেতে পারে। বুকসেল্ফগুলো আর আয়না রাখা আছে। তাছাড়া দেয়ালের দুদিকে বিস্তর ছবি টাঙানো। বেমক্কা হাত লেগে কোনোক্রমে যদি পড়ে যায়। টাঙানোর পেরেক লাগানো হয়েছিল ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে দিয়ে। চেনাজানা শিল্পীদের ছবি টাঙানো হয়েছে।

প্রথম ফ্রেম রুনুর, রুনু মানে অমিতাভ ধর। পেন্টার এইট্টিস-এর শিল্পী। ওর ছবিতে কালো রঙের চমৎকার কাজ প্রচুর। বিড়লা অ্যাকাদেমি পুরস্কার পেয়েছে। ছোটোবেলা থেকে ওর এই ছেচল্লিশ বছরের জীবনে তিনবার বাড়ি বদল হয়েছে। আমি যেমন বদলির চাকরির সূত্রে পাহাড় নদী পথঘাট প্রতিবেশী দখল করেছি বারবার। ওর স্মৃতির মধ্যে সেই সব বাড়ি বদল আর সেখানকার ঘটনার পরত থেকে গেছে। প্রথম বাড়ি ছিল খিদিরপুরে। তারপর চৌরঙ্গিতে নিউ ক্যাথের ওপারে।

প্রথম বাড়িতে প্রচুর পায়রা ছিল। খোলামেলা থাকত ছাদে। বেশ পোশ মেনেছিল। রুনুর সঙ্গে পায়রাদের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিন ছাদে গিয়ে তাদের সঙ্গে রুনু বহুক্ষণ সময় কাটাত। একদিন পাশের বাড়ির কাকিমা দুটো পায়রা চাইলেন। কেন যে…

মা বললেন,— কেউ কিছু চাইলে ভালো মনে দিতে হয়। বিশেষ করে যখন প্রতিবেশী চেয়েছে। মনে অসহ্য কষ্ট হল তবু মায়ের কথার জন্য —ম দিলাম।

হঠাৎ মা বললেন, — তোকেই কেটে দিতে হবে। কাকিমা পারবে না। তবে ছাল ছাড়িয়ে টুকরো করে নেবে।

— সে কী, কাকিমার পায়রা দেখে যেতে ইচ্ছে হয়েছে… আমি তো ওদের খাওয়াতে ভালোবাসি… ওড়াউড়ি দেখি… কোনো দিন কই খেতে ইচ্ছে হয়নিতো… ওদের সঙ্গে শুধু মিশতে ভালো লাগে…

মা বললেন, — গুরুজন, ইচ্ছে হয়েছে যখন… দিলে আশীর্বাদ পাবে…

গিয়ে এক ঝটকায় কেটে দিয়ে এলাম — মনে থেকে গেল তাদের বিহ্বল পাখা ঝাপটানো… শেষ সময়েও উড়ে চলে যেতে চেয়েছিল…

আমার যে স্পর্শ ছিল ভরসার সেখানে অবিশ্বাস আর নিষ্ঠুরতাও মিশে গেল…

রুনুর পেন্টিঙে কালো রঙের সূক্ষ্ম কাজের মধ্যে লাল রঙের রক্তের ইশারা। কালো রং টুকরো টুকরো হয়ে ডানা মেলতে চাইছে। অসংখ্য আলগা স্মৃতির পরত। রুনুর মেমোরেবিলিয়া মানে স্মৃতিমন্হন সিরিজের। আমার প্রিয় ছবি। একদিন রাতে ঝোঁকের মাথায় রুনু আমাকে এই পরিসরের একটা ছবি ভালোবেসে দিয়েছিল।  প্রত্যেক ছবিই এমনই সব নানা ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়েই এই করিডরের দেয়ালের পেরেক অবধি পৌঁছেচে।

যেমন প্রকাশের কালো রঙের কাজ একেবারে আলাদা। ওই দ্বিতীয় পেরেকে… আর তৃতীয় পেরেকে বাঁধন দাশের আঁকা ছবি।

বাঁধনের কথা বেশি করে মনে পড়ছে আজ। মাত্র দুদিন হল সে মারা গেছে। অথচ এই সেদিন শান্তিনিকেতনের কলোক্যুইয়ামে কত কথা হল। ঘুরে ফিরে সেই স্হানীয়-লোকাল এইসব কথা কত সহজভাবে বোঝাতে চেয়েছিল আমাকে। বিশ্বায়নে স্হানীয়টুকুর গুরুত্ব যেন থাকে। যা আছে তার ওই কালো রঙের স্পেসে। আজ বাঁধন নিজেই আমার এই ঘুটঘুটে অন্ধকারের কোনো এক অলিগলির পরতে। মাত্র আটান্ন বছর বয়সে বাঁধন চলে গেল। করিডরে রাখা তার পেন্টিং আজ আরও প্রিয়…

ফলে ওদিক দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। অন্য কোনো অঘটন যাতে না ঘটে। সাবধান হওয়াই ঠিক। তেলের শিশি ভেঙেছে, ঠিক আছে। ও তো পরিষ্কার করে নেবে শেফালি। আর সকালে তো কাজের মেয়ে আসবে। তাছাড়া মেথি শাকের গন্ধ খাবার ঘরের দিকেই বাড়ছে। যেভাবে গন্ধ ছড়িয়ে আছে সেপথ দিয়ে যাওয়াই সুবিধের হবে। রুনুর পেন্টিঙে যেভাবে কাকিমার মাংস রাঁধার আর পাখিদের উড়ে যাওয়ার গন্ধ মিশে আছে…

এখন আর আমার নিজেরই অন্ধকারের দেশে চলে যাওয়ার তত দ্বিধা নেই… সেখানে বাঁধন আছে শক্তি আছে… রাঙাদিদু মা বাবা ছোড়দি… সবাই তো সেখানেই… অন্ধকার এখন প্রিয়জনের সংসার…

তবু শেফালিকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি না বলেই অন্ধকারে… কালো রঙের ঘরোয়া স্পেসে এভাবে ঘুরতে খারাপ লাগে না…

রুনু কেন দেবারতিকে বিয়ে করছে না… কত দীর্ঘ দুজনের ভালোবাসা… ও কি এই পৃথিবীতে মায়া বাড়াতে চায় না… কালীকৃষ্ণ এসব নিয়ে কত কথা রুনুকে বোঝাতে চায়… রুনু একটা নীল রঙের ওয়াটার কালার পেন্টিং দিয়েছে কালীকৃষ্ণকে… ছবিতে ফাংগাস যাতে না লাগে তার টিপসগুলোও দিয়েছে সেই সঙ্গে… কত ধরনের ফাংগাস আছে যারা এক-একটা রং এক-একটা স্পেস খেয়ে ফেলতে ভালোইবাসে…

এক জাবগায় গিয়ে নিশ্চই মেথি শাকের গন্ধের সঙ্গে শেফালির উপস্হিতির জৈব গন্ধ মিশবে। যেখানে এই মুহূর্তে অন্ধকারের হদিস রেখে আমাকে পৌঁছতে হবে। এ বাড়ির আর সব কিছুর মতো, যেগুলো আলোর মধ্যেই পরিচিত তার বাইরে। এ বাড়িতে আশ্রিত অন্ধকার আর তার অলিগলি এবাড়িরই আরেকটা দিক। যা আমাদের দুজনের নিজস্ব অন্ধকার।

শীতের সকালের দিকে যেমন, ব্রেকফাস্টের সময় ডাইনিং টেবিলের ডান কোনে একচিলতে চেনাজানা এবাড়ির নিজস্ব রোদ আসে। একটু মনোযোগ দিলেই দেখা যাচ্ছে এই অন্ধকারও সমান চেনাজানাখ চলতে ফিরতে, সঙ্গ নিতে কোনো অসুবিধে নেই। এই অন্ধকার নিজস্ব বিষয়-সম্পদের বাইরে নয়।”

পড়ে, রাহুল নিজেকে বলল,  অন্ধকার ! এমন একটি সময় যখন ব্যক্তি  নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সৃজনশীল কার্যকলাপ থেকে কার্যত সরে-সরে যাচ্ছে ।

অনিকেত দাঁড়িয়েছিল, কিছুটা  অন্যমনস্ক । উপযুক্ত কথার খোঁজে অস্বস্তি রাহুলের দাদার মুখচোখ ছেয়ে ফেলেছে । তা ছিল  এক অদম্য শক্তির স্হিরতা যা চাপা অভিপ্রায়ে উদ্বিগ্ন । অনিকেত ভাবছিল,  ভালোবাসা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো নিয়মিত পথ নেই,  যেভাবে ভালোবাসায় অনায়াসে প্রবেশ করা যায় সেভাবে বেরোনো যায় না , কিছু মানুষ অবশ্য বিয়েকে প্রেম থেকে বেরিয়ে আসার শর্টকাট উপায় হিসেবে দেখেন, কিন্তু গৌরীকে বিয়ে করা যায় না, গৌরীকে বিয়ে করলে ভালোবাসা নোংরা হয়ে যাবে । অথচ গৌরীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য এই বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে । পলির পরের বোন শেফালীকে বিয়ে করে নিলে এই বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবে, নিজেকে এই ভাবনার মাধ্যমে স্তোক দিচ্ছিল অনিকেত।

রাহুল বলল, দাদা আপনার খুব সুখ্যাতি করে । নীলাও আপনার সম্পর্কে কতো গল্প করেছে আমার মায়ের সঙ্গে । 

—অনিকেতের কথা বলছো ? আসল ব্যাপার হল ও একজন প্রতিভাধর মানুষ আর ওর সমস্ত গুণের মধ্যে যেটি প্রধান, তা হলো ওর কথা বলার ক্ষমতা যা বাস্তব জগতের  অনুভূতি বহন করে । ওর মতামত  প্রকাশের একটা বিশেষ আলোকিত উপাদান আছে । কতো লেখক তো আমাদের বাড়িতে এসেছেন, কিন্তু অনিকেতের মতন উঁচু স্তরের মানুষ নন তাঁরা ।

—দুই বিটনিক কবিও এসেছিলেন শুনেছি । জাম খেয়ে ওনাদের ভয় ধরে গিয়েছিল, অনিকেত বলছিল ।

—হ্যাঁ, ওনাদের জাম খেতে দেয়া হয়েছিল । তারপর জিভের রঙ বেগুনি হয়ে যেতে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। মুখ ধোবার পর তক্ষুনি তো জিভের রঙ যায়নি । কন্ঠস্বর ঠিক আছে কিনা যাচাই করার জন্য ওর সেই বিখ্যাত কবিতাটা কয়েক লাইন আবৃত্তি করেছিল, লাইনটা মুখস্হ হয়ে গেছে আমার : “আই সঅ দি বেস্ট মাইন্ডস অফ মাই জেনারেশন ডেস্ট্রয়েড বাই ম্যাডনেস, স্টারভিং হিসটেরিকাল নেকেড, ড্র্যাগিঙ দেমসেভস থ্রু দি নিগ্রো স্ট্রিটস অ্যাট ডন লুকিঙ ফর অ্যাংরি ফিক্স, অ্যাঞ্জেলহেডেড হিপস্টার্স বার্নিং ফোর দি অ্যানশিয়েন্ট হেভেনলি কানেকশান টু দি স্টারি ডায়নামো ইন দি মেশিনারি অফ নাইট” । কী ? দ্যাখো কেমন মনে রেখেছি ।

–সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণের জন্যই দাদা আপনাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, বলল রাহুল । 

গৌরী বললেন,  সে তো জানিই ! তোমাকেও তাই বলে আমার গুণগান করতে  হবে না ।  কি জানো রাহু,   আমি অনিকেতকে ভালোবাসি।এমন স্পষ্ট স্বীকারোক্তি ভালো লাগলো রাহুলের  । সাহিত্যানুরাগী এক বিবাহিতা, আলোকিত পরিবারের বউ, স্বামী ছাড়াও আরেকজনের জন্যে স্নেহ-ভালোবাসার একটা জায়গা নিজের মনের ভেতরে তৈরি করে  রেখেছেন । কিছুক্ষণ থেমে, রাহুর দিকে তাকিয়ে, সম্ভবত অনিকেতের তুলনায় রাহু বেশ বেপরোয়া আর ঠোঁটকাটা অনুমান করে,  গৌরী আরও বললেন, ‘বুঝলে রাহু, তুমি আজই প্রথম এলে আর কথাটা বিনা দ্বিধায় পাড়লে, তাই বলছি তোমাকে,   আমি ছেলেমেয়ে স্বামী বিসর্জন দিয়ে অনিকেতের হাত ধরে বলতাম, চলো অনিকেত এবার নতুন রকমের জীবনে ঢুকি । এমন ঘটনা কি আর হয় না ? আখছার হচ্ছে আজকাল । তবে আমি বলবো, এ সবই হচ্ছে মোহ থেকে — ভালোবাসা থেকে নয় । আমি আমার স্বামী জ্যোতিকে অসম্ভব ভালোবাসি । তাঁর ছেলেমেয়েকেও । তিনিও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেন না, আমি জানি। আর  অনিকেতের কথা –হ্যাঁ, তাও তিনি জানেন । তাঁকে আমিই বলেছি । তিনিও অনিকেতকে ভালোবাসেন খুব । তিনি কারিগরি কাজের  মানুষ, ভেবেছেন হয়তো গৌরীর মধ্যে যে সূক্ষ্ম আবেগ-অনুভূতিগুলো রয়েছে সেগুলোর সাহচর্য দিতে যদি কেউ এগিয়ে আসেন, কেউ যদি ওনার বউয়ের মানসিক সহায় হন, তাতে আপত্তির কী আছে ? এর ফলেই না উভয়ত স্বাস্হ্য বজায় থাকবে । তাঁর কোনো আপত্তি নেই আমাদের এই বন্ধুত্বে । তিনিও, এখানে এলে আমাদের মধ্যে বসে থাকেন । নীলা কিন্তু এই সম্পর্ককে ভালো চোখে দ্যাখে না ।

–জানি, নীলা পাটনায় আমাকে বলেছে, যাতে বাবা-মার কানে না যায় । এমনিতেই দাদার বন্ধুরা এসে দিনের পর দিন নিমডির বাড়িতে পড়ে থাকে বলে ওনারা বিরক্ত । আপনাদের পরিবার কেন যে রক্তিম চাটুজ্যেকে অ্যাকসেপ্ট করলেন না, তা আমার কাছে রহস্য ।

—তোমার মা আমাদের বাড়ি এসেছিলেন, তখন আমি শশুরবাড়িতে ছিলাম । নীলা তোমার সম্পর্কে কী ভাবে জানো ? গরিব নিম্নবর্ণের বস্তিতে শৈশব আর কৈশোর কাটিয়ে কেমন মানুষ হয়েছো ? তেমন ।

 –কী ? কেমন অ্যাসেসমেন্ট ? 

—নীলা তোমার সম্পর্কে কী ভাবে বলো তো ? তুমি নিজের চারপাশের উপলব্ধি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলে, নিজের কল্পনায় গড়া অতীতে চলে গিয়েছিলে, বিস্ময় এবং গোপনতায় আক্রান্ত হয়েছিলে, যেমন বিবেকবান মানুষ কোনও উন্মাদনার উৎসাহে হয় । 

—নীলার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত কেন তাহলে   রক্তিমের বিচ্ছেদ ? আমি যতোদূর জানি, রক্তিম মনে করে, অনিকেত আর  মলি, আপনার ছোটো বোন, দুজনে মিলে ওর প্রেমকে ব্যর্থ করে দিয়েছে । অনিকেত আর মলি দুজনেই দুলাল নামে একজনের কথা রক্তিমকে বলেছিল , যে নাকি আপনাদের হাতের লেখা পত্রিকা সম্পাদনা করতো । আমার মনে হয়, দুলালের কোনো অস্তিত্ব আদপে ছিল না। তার নাম করে ওরা চিড় ধরিয়েছে রক্তিম আর নীলার সম্পর্কে । রক্তিমের সেসময়ে চালচুলো ছিল না, চাকরি করত না, মদ খেত, এই সব কারণেই হয়ত শেষ পর্যন্ত আপনার বাবা-মা সম্পর্কের অনুমোদন দেননি । প্রকৃত কী ঘটেছিল তা স্পষ্ট করে জানায়নি রক্তিম, নীলাকেই হয়তো তাহলে দায়ি করতে হতো । রক্তিমের কিন্তু বিষয়-আশয়ে আসক্তি অসীম গাঙ্গুলির চেয়ে কম নয় ।

—আমি তো পক্ষে ছিলাম ।

—নীলাকে পাটনায় পাঠানোটাও উচিত ছিল না । বলল রাহুল ।

ঘটনা হল যে স্নাতকোত্তর পড়াবার অজুহাতে নীলাকে রক্তিমের সংস্পর্শ থেকে দূরে পাটনায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল অনিকেত-রাহুলদের বাড়িতে । নীলার বাবা-মা ভুল করেছিলেন । রক্তিমের যথেষ্ট বিষয়বুদ্ধি ছিল, সে জমি কিনে রেখেছিল কলকাতায় অনিকেত আর কান্তি লাহিড়ির বাড়ির কাছে । নীলার মুখোমুখি হবার ভয়ে সেই জমি বিক্রি করে বেলেঘাটায় জমি কিনে বাড়ি করেছিল, বেশ বড়ো বাড়ি । ওর বিষয়-আশয় লেখাপত্রের আয় সামলাবার জন্য এনাক্ষী খৈতানকে বিয়ে করেছিল । অসীম গাঙ্গুলি রাহুলের পক্ষে সাক্ষ্য দিলেও আদালতে রাহুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছিল রক্তিম চাটুজ্যে । অথচ রক্তিমের ব্যর্থ প্রেমের জন্যে রাহুল মোটেই দায়ি ছিল না । রক্তিম চাটুজ্যের বিষয়বুদ্ধি নেই, এটা ভুল প্রচার । 

গৌরীকে আর ওনাদের পরিবারকে নিয়ে অনিকেতের বন্ধুরা উপন্যাস লিখেছে, অনিকেত মেনে নিয়েছে বন্ধুদের গড়ে তোলা সেইসব চরিত্র । প্রদীপন চট্টোপাধ্যায়ের একটা বিখ্যাত গল্প আছে " ধলভুমগড়ের কৌশিকবাবু " , সেই ধলভুমগড়ের কৌশিকবাবু চাইবাসার মধুটোলায় অপূর্ব ব্যানার্জির শশুরবাড়ি, কিন্তু ওনারা ব্যানার্জি নন, চক্রবর্তী, গল্পতে মেয়েদের চরিত্র কলঙ্কিত করতে চেয়েছিলেন প্রদীপন, অসীম গাঙ্গুলি টেক্কা মেরে দেয়ায় । সেটাই আবার প্রদীপন চট্টোপাধ্যায়ের " ফরেস্টের দিনরাত্রি " র ডেসটিনেশন ফ্যামিলি। রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারী অসীম গঙ্গোপাধ্যায়ের " পালামৌয়ের দিনরাত্রি " । উপন্যাসে চাইবাসার মধুটোলার সেই পরিবারই হয়ে গেল পালামৌয়ের এক ফ্যামিলি। এমন কি সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় প্রবাসী এনলাইটেণ্ড বাঙালি পরিবারের যে ছবি আছে, সেখানে বাবা পাহাড়ী সান্যাল, তিনি সেই চক্রবর্তীমশায়, আর এক বোন হন শর্মিলা ঠাকুর, সেই একই ঘটনার নানা স্থাননাম, নানা ভাষ্য গড়ে উঠেছে। লক্ষ্য সেই একটাই পরিবার, সেই পরিবারের মেয়েরা, আর ছেলেরা। মলির পর ছেলে হয়েছিল, তার নাম সন্তু, পাড়ার একজন জজসাহেবের বাড়ি গিয়ে গল্প শোনে সন্তু, জজসাহেবের আদালতের নানা মামলার ঘটনা । সেগুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অনিকেতের বন্ধুদের শোনায় সন্তু, যেন জজসাহেবের অভিযানগুলোতে সেও ছিল । সেগুলো নিয়ে অসীম গাঙ্গুলি ছোটোদের গল্প লিখে ফেলেছেন।

মধুটোলার চক্রবর্তী মশায়ের আট মেয়ে আর তিন ছেলে । রাহুল অবাক হয়েছে ভাবে যে এতো বড়ো একটা পরিবারকে কেমন করে সুশিক্ষিত আর সংস্কৃতিমান করে তুললেন তিনি । বঙ্গসংস্কৃতির প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বারা অবহেলিত, চাইবাসার মতন একটা জায়গায়।অনিকেতের অবদান আছে নিশ্চয়ই । কিছুটা অবদান রক্তিম চ্যাটার্জিরও আছে। কিন্তু এরা দুজন তো সেই সময়ে পরিবারটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছে যখন বড়ো আর মেজো মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে । অন্য মেয়েরা স্কুলে-কলেজে পড়ছে ।

প্রদীপন চট্টোপাধ্যায়ের ভাষ্যতে, অসীম গাঙ্গুলি হেসাডির মুল ঘটনার ভার্জিনিটি সবচেয়ে বেশি নষ্ট করেছে। তার ফলে  ইতিহাসের সত্যকে স্পর্শ করে দলিল হতে পারেনি ‘পালামৌয়ের দিনরাত্রি’, নানা ঘটনার মিশ্রণ হয়ে গেছে। অনিকেতের ডালটনগঞ্জের বাড়িতে গেছে তো অসীম গাঙ্গুলি বহুবার । বন্ধুদের ফিচলেমি তুলে নিয়ে গেছে চাইবাসা থেকে পালামৌ ।

অসীম গাঙ্গুলির একটা চিঠি রাহুলের হাতে দিয়ে অনিকেত বলেছিল, পড়ে দ্যাখ । আমি অফিসের জিপে করে অসীমকে ডেহরি অন সোন স্টেশানে পৌঁছে দিয়ে ট্রেনে তুলে সি অফ করে ফিরেছিলুম আর ও এই চিঠিটা এমনভাবে লিখেছে যেন আমি ছাড়তে যাইনি, ট্রেনে তুলে দিইনি । আসলে অসীম ভেবেছে রবীন্দ্রনাথের মতন সবাইকে গাদা গাদা চিঠি লিখবে আর ও পটল তোলার একশো বছর পরে চিঠিগুলো নিয়ে বইটই বেরোবে, গবেষণা হবে । রাহু পড়া আরম্ভ করল চিঠিটা ।

অসীম গঙ্গোপাধ্যায়

অনিকেত

       ডেরি-অন-সোনে আমার চোখের সামনে দিয়ে বম্বে মেল বেরিয়ে যায়। তখন আমাদের ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছোঁয়নি। পরবর্তী ট্রেন পাঠানকোট ভোর সাড়ে চারটের সময়। বসে বসে শীতে কাঁপবার বদলে একদল লোকের সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়ে দিলুম। একজন রেলকর্মীর নামে স্টেশন মাস্টারের কাছে কমপ্লেন ইত্যাদি করতে-করতেই বেশ সময় কেটে গেল।

       পাঠানকোট সারা রাস্তা লেট করতে লাগলো। একবার তো একটা বগি ছিঁড়ে বেরিয়েই গেল, পেছনের দিকে অবশ্য--- তাই নিয়ে হৈ চৈ মেরামত হলো--- আমার ট্রেন চলা--- অনবরত সাসপেন্স--- কখন ট্রেনটা কলকাতায় পৌঁছোবে। কারণ, আমি আগাগোড়াই ভাবছি--- সেদিন সন্ধের মধ্যে না পৌঁছুতে পারলে--- আমার আসাটাই ব্যর্থ; তাহলে তো আরো কয়েকদিন থেকে এলেই পারতুম। বর্ধমান এলো--- বিকেল পাঁচটায়--- আমি তখনও ছটফট করছি, ট্রেন তখনও থেমে থেমে চলছে, সাড়ে সাতটা আন্দাজ শিয়ালদা থেকে এক মাইল দূরে সিগনাল না পেয়ে ট্রেন নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তখন সুটকেস হাতে ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ে অন্ধকার রেল লাইন ধরে ধরে ছুটে, বাঁধ দিয়ে গড়িয়ে নেমে-- নারিকেলডাঙা রোডে এসে উপস্হিত। সেখান থেকে ট্যাক্সি ধরে সোজা আনন্দসেবকের দপতর । সে এক অ্যাডভেঞ্চার। ততক্ষণে আমাকে বিষম খোঁজাখুঁজি পড়ে গেছে।

       এসবে কিন্তু মাথার একটুও ক্ষতি হয়নি। কারণ মন-মেজাজ বেশ প্রখর হয়েছিল। ক্রমশ দেখছি শান্ত জীবনের প্রতি আমার দুর্নিবার লোভ দেখা দিচ্ছে। বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আমি কোনোদিন সুবিধে করতে পারিনি। কিন্তু তোর মেয়ের সঙ্গে খেলা করতে আমার এমন ভালো লেগে গেল। আগে ছিল, সৌন্দর্য বা প্রকৃতি দেখলেই--- তাকে ধ্বংস করার প্রবল ইচ্ছে। এখন ভালো লাগছে, শান্ত হয়ে চুপচাপ বসে থাকতে। বেতলার ডাকবাংলোয় যে গিয়েছিলাম--- দু'এক বছর আগে হলে কি ব্র্যান্ডির বোতল নিতে কোনক্রমে ভুলে যেতুম বা শেষ পর্যন্ত মহুয়া জোগাড় না করে ছাড়তুম ?  আরও কত কত গন্ডোগোলের সন্ধান করতুম কে জানে। এখন দেখছি, কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকার মধ্যেও একটা প্রবল উত্তেজনা আছে। নিজেকে পোষ মানানোও এক রকমের নেশা। এখন বেশ ভালো লাগছে কয়েকটা দিন। ঠিক করেছি, কলকাতার দলবলের সঙ্গে নয়, একা একা প্রায়ই দুচারদিনের জন্য কলকাতার বাইরে ঘুরে আসবো। তুই ওখানে অফিসের কাজকর্ম গুছিয়ে নিয়ে কিছুটা হাল্কা হলে--- পরে আবার একবার যাবো। মলি খুব ভালো মেয়ে--- বিয়ে করে প্রদীপনের মতো ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা তোর একটুও নেই। কলকাতার বিবাহিত বন্ধুদের দেখলে--- আমার বিয়ে করার শখ একেবারে উপে যায়।

       কলকাতার গুরুতর খবর--- বিনয় মজুমদার এখন জেলে। কয়েকদিন আগে বিনয়ের পাগলামি একটু বেড়ে যায়। যে হোটেলে থাকতো--- সেই হোটেলের ঠাকুরকে ঘুমন্ত অবস্হায় লাঠি মেরে খুন করতে যায়। প্রথমে আমি শুনেছিলাম--- লোকটা খুনই হয়ে গেছে। এখন জানলুম, না, আঘাত খুব মারাত্মক নয়, বেঁচে উঠবে লোকটা। ফেব্রূয়ারিতে বিনয়ের কেস উঠবে--- এখন বিনয়ের জন্য কেউ জামিন হয়ে ছাড়াতে রাজি নয়। কারণ ছাড়িয়ে কোথায় রাখা হবে ? বিনয়ের দাদা ওর ভার নিতে অস্বীকার করেছেন। হাজতে বিনয়কে কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখে খুব অদ্ভুত লাগলো। স্বাভাবিক হয়ে গেছে এখন। রামায়ণ নট্ট কোম্পানির মুখপত্রে একটা কবিতা ছাপার বিষয়ে কথা বললো। বিনয়ের তুলনায় আমরা কতো ছোটো। পৃথিবীতে দু'একজন মাত্রই থাকে -- যারা কবিতা ছাড়া আর সব কিছুই ভুলে যায়-- আর সব কিছুই তাদের কাছে অকিঞ্চিৎকর। রামায়ণ নট্ট কোম্পানির মুখপত্রের জন্য তোর লেখা তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিস।

                                                                                                                          অসীম

রাহু চিঠিটা দাদা অনিকেতকে ফেরত দিয়ে বলল, লোকটা অমর না হয়ে ছাড়বে না, একেবারে উঠে-পড়ে লেগেছে। অসীম গাঙ্গুলি হেসাডির ঘটনা তুলে নিয়ে গেল বেতলায় ।

 

 তাই প্রদীপন " ফরেস্টের দিনরাত্রি " লেখে। পরিবারের কর্তার বড়ো মেয়ে গৌরী, তার পরের বোন পলি, অপূর্বর স্ত্রী, তার পরের বোন মলি যাকে অনিকেত পরে বিয়ে করবে, গৌরীর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য । তার পরেও পাঁচ বোন, যাদের একজনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠবে রক্তিম চট্টোপাধ্যায়ের । রক্তিমের  সেই পর্যায়ের কবিতা নিয়ে প্রকাশিত  হবে তাঁর জীবনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ । সেটাই কনফেশন লাভ পোয়েট্রির একমাত্র বাংলা বই, " ফিরে এসো চাকা " নয়। রক্তিম চট্টোপাধ্যায়ের সেই প্রেম ব্যর্থ হয়ে গেল। পরে এনাক্ষী খৈতানের সঙ্গে বিয়ে। ফলে রক্তিমের প্রথম কাব্যগ্রন্হকে কে কারা যেন লুকোতে চেয়েছে। যদিও বাঙালির ইতিহাসে তার গুরুত্ব অসীম। কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গ লক্ষ্যণীয় : " প্রিয়তমা সুন্দরীতমারে, যে আমার উজ্জ্বল উদ্ধার। " এটাই যথেষ্ট। 

অসীম গাঙ্গুলি আর প্রদীপন চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে নানা ভেজাল মেশানো থাকলেও, রক্তিম চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘আমার কিন্নরী’ উপন্যাসে সত্য ঘটনার বয়ান দিয়েছেন । ফরেস্ট অফিসের ডাকবাংলোতে কেয়ারটেকারকে ঘুষ দিয়ে থাকার খবর পেয়ে ডিস্ট্রিক্ট ফরেস্ট অফিসার নিজের কর্মচারীদের নিয়ে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন আর ছ্যঁচড়া কপর্দকহীন যুবকদের বেলেল্লাপনার শাস্তি দেবার জন্য ভাড়া মেটাবার আদেশ দেন । ওদের অবস্হাও কল্লু মস্তানের মতন হতো যদি না একজন কর্মচারী গিয়ে অনিকেতকে খবর দিতো । অনিকেত গিয়ে  টাকাকড়ি মিটিয়ে বন্ধুদের ছাড়িয়ে এনেছিল । অনিকেতের ভূমিকা বেমালুম চেপে গেছে অসীম গাঙ্গুলি আর প্রদীপন চাটুজ্জে। গৌরীর ভূমিকায় শর্মিলা ঠাকুর ছিলেন । আদিবাসী বুড়ির ভূমিকায় সিমি গারেওয়াল ।

অসীম গাঙ্গুলী আর প্রদীপন চাটুজ্যে হেসাডির ঘটনা নিয়ে উপন্যাস লেখার পর, আর বিখ্যাত হবার পর, অনিকেতকে ভুলে গেলেও, রক্তিম চাটুজ্যে কিন্তু ভোলেনি কখনও । চাইবাসার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য অনিকেত যেমন মলির আশ্রয় নিয়েছিল, তেমনই রক্তিম আশ্রয় নিয়েছিল অনিকেতের বন্ধুত্বের । গৌরী আর নীলা একই নৌকার দুই যাত্রী, যাঁরা দুটি ভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছোতে চাইছিলেন । 

নীলার স্মৃতিতে রক্তিম চাটুজ্যে লিখেছিলেন ‘চাইবাসা পরব’

“একদা…

পঞ্চাশ দশকে পদ্যে এঁরই সঙ্গে ছিল বসবাস ।

আপনারা জানেন, জানি, কেউ কেউ, চাইবাসা পরবে

এঁরই মেঘ রৌদ্রছায়া পড়েছিল পর্যাপ্ত ভাষায়…

ভাষার আড়ালে এঁর চুম্বন কেড়েছি অন্ধকারে—

আমিও কি শুধু কবি ? চোর নই প্রবঞ্চক নই ?

আপনারা বলুন আর ভিক্ষা দিন সামান্য সময়—

কবিতার সঙ্গে নাট্য, অধিকন্তু, দোষের হবে না ।”

অনিকেত সিংহ যখন লাহেরিয়া সরাইতে পোস্টেড, গৌরীর বোন মলিকে বিয়ে করেছে, অনিকেতের দুই শ্যালিকা রয়েছে সেখানে, তখন রক্তিম চট্টোপাধ্যায় লাহেরিয়া সরাই গিয়েছিল । নীলা ছিল না, নীলার বিয়ে হয়নি তখনও, চাইবাসায় ছিল। রক্তিম চ্যাটার্জি নিজের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল কবি কান্তি লাহিড়িকে । নেপাল দেখার জন্য সবাই বাসে করে কাঠমাণ্ডু যাত্রা করে । অনিকেত দেখতে চাইছিল পুরোনো দিনের কাঠমাণ্ডুর ঠমেল পাড়ায় কতোটা বদল এসেছে । হিপিদের সময় তো আর নেই, যাদের সঙ্গে অনিকেত আর রাহুল মাঙ্কি টেম্পলে গাঁজা-চরস ফুঁকতো, মোষের কাঁচা মাংস খেতো । তখনকার ঠমেল পাড়ায় বাঁশের তৈরি চালাঘরের বিশাল এক প্রাসাদের ঘরে ওরা থাকতো, হিপিদের মতন মেঝেয় খড়ের ওপর চাদর পেতে শুতো । প্রায় একশো ভাড়াটে ছিল ; সিংদরোজা দিনেরাতে সব সময় খোলা, যার যখন ইচ্ছে ঢোকে আর বেরোয় । ওদের সঙ্গে সুকোমল রুদ্র, অনীক করঞ্জাই, নির্মল বাউলা গিয়েছিল । কেতু চলে এলেও রাহু ছিল প্রায় পাঁচ মাস ।

লাহেরিয়া সরাই থেকে কাঠমাণ্ডু যাবার বাসে আর কাঠমাণ্ডুতে থাকার সময়ে কান্তি লাহিড়ির সঙ্গে হৃদ্যতা হয় প্রীতির, মধুটোলার সবচেয়ে ছোটো বোন। মলির চেষ্টায় কান্তি লাহিড়ির সঙ্গে প্রীতির বিয়ে হয় । সেটা কান্তি লাহিড়ির দ্বিতীয় বিয়ে । প্রথম পক্ষের বউ সুন্দরী ছিল, ছেলেপুলেও হয়েছিল । তারা কান্তি লাহিড়ির সঙ্গে দেখা করতে গেলে বা একসঙ্গে ফোটো তোলাতে গেলে ভয়ংকর অশান্তি নেমে আসে কান্তি লাহিড়ির জীবনে। বাংলা কবিতা পাঠ আর আবৃত্তির প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড তৈরি করেছিল কান্তি লাহিড়ি – প্রখ্যাত কবি আর অভিনেতাদের আবৃত্তি ছিল তাতে । অশান্তি সামলাতে প্রতিদিন একপাতা সরব্রিট্রেট কিনে বাড়ি যাবার রিকশায় চাপতো, প্রতিদিন, রোজ, রোজ, রোজ । চৌরঙ্গি থেকে একই চার্টার্ড বাসে ফিরতো রাহুল সিংহ আর কান্তি লাহিড়ি, বাস থেকে নামতো একই জায়গায় । রাহু তখন কিছুদিনের জন্য অনিকেতের বাড়িতে ছিল, মুম্বাই থেকে বদলি হয়ে । অনিকেত বলতো কান্তি লাহিড়ির গায়ে গ্রিক রক্ত আছে, চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, ফর্সা, ঢ্যাঙা, আগামেমনন । মেগাসথিনিস এক হাজার গ্রিক যুবতি এনে মৌর্য সাম্রাজ্যের ভূপতিদের বিলিয়েছিল । কান্তি লাহিড়ি তাদের বংশধর হয়েও দুই যুবতীর টানাপড়েনে মারা গেল, সরবিট্রেট ওকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি । 

মৃত্যুশয্যা, মানে খাটের ওপরে চিৎ গ্রিক সেনাপতি আগামেমনন, দেখেছিল রাহুল । হেলেন আর সাম্রাজ্যের হারানো সম্মান ফিরে পাবার জন্য গ্রীস আর তার মিত্ররা সমুদ্রপাড়ি দিয়ে বিশাল সেনাবহর নিয়ে ট্রয় অভিযানে যাত্রা করে।ট্রয় তো এখনকার তুর্কি ।  নেতৃত্বে ছিলেন আগামেমনন । বাতাস নিয়ন্ত্রণকারী দেবী আর্টিমিস ছিলেন গ্রিকদের বিপক্ষে। তিনি সমুদ্রবায়ু থামিয়ে দেয়ায় জাহাজগুলো কার্যত অচল হয়ে যায়। গ্রীক সেনা ও ভবিষ্যৎবক্তা কালচাস পরামর্শ দেন ক্লাইমেনস্ট্রা-আগামেমনন কন্যা ইফিজিনিয়াকে দেবী আর্টিমিসের উদ্দেশ্যে বলি দিলে জাহাজগুলো আবার  সচল হবে। নয়তো দেবী সৈন্যসমেত জাহাজ ওখানেই ডুবিয়ে দেবেন। আগামেমনন মেয়ের বিয়ের কথা বলে মেয়েকে তার মায়ের কাছ থেকে এনে বলি দেন।জাহাজের পালে হাওয়া লাগে।  দশ-বছরব্যাপী যুদ্ধে ট্রয় পুড়ে ছারখার  হয়। কান্তি লাহিড়ির প্রথম পক্ষের বউ আর বাচ্চাদের তো কখনও দ্যাখেনি রাহু । তাই ক্রন্দনরত গ্রিকদের মধ্যে চিনতে পারলো না । আগামেমমননের মৃত্যুতে প্রায় সবাই কাঁদছিলেন ।

কান্তি লাহিড়ির প্রতিদিন সরবিট্রেট কিনে বাড়ি ফেরার কথা ওনার স্ত্রী প্রীতিকে বা প্রীতির দিদি মলিকে বলতে পারতো রাহু, যাতে ওনারা সময়মতো ব্যবস্হা নেন, ডাক্তার দেখান । রাহুল দেখলো স্ত্রী প্রীতির হৃদরোগ নিয়ে বেশি ব্যস্ত কান্তি লাহিড়ি । তাই আর কাউকে বলেনি । দেখলো যে অনিকেতও মলিকে বিয়ে করে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে । সম্ভবত ভেবেছিল গৌরীর সঙ্গে সম্পর্ক মেনে নেবে মলি । তা হয়নি । মলির চাপে কেতুই বদলে যেতে থাকলো । মধুটোলার মেয়ে আর ছেলেদের দায়িত্ব নিজের ওপর নিয়ে নিয়েছিল কেতু । পাটনার বাড়িতে বড়ো শালার থাকার ব্যবস্হা করেছিল, যাতে রঙিন মাছের আর চেতলার মাছের হাট থেকে আনা জিনিসের ব্যবসা করতে পারে, কেতুর দপতরে সাপলাই দিতে পারে । আরেক শালাকে পাটনায় একটা বাড়ি ভাড়া করে অন্য কাজের দায়িত্ব দিয়েছিল। মলির পরের বোনদের বিয়ের ব্যবস্হা করেছিল, এক এক করে । কান্তি লাহিড়ি আর কেতু মিলে নিজেদের বাড়ির কাছে তাদের জমিজমা কিনিয়ে বাড়ি তৈরিতে সাহায্য করেছিল । রক্তিম চাটুজ্যে নীলাকে বিয়ে করতে পারে অনুমান করে তাকে দিয়েও বাড়ির পাশে জমি কিনিয়েছিল কেতু । নীলার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর, নীলার সঙ্গে মাঝে-সাঝে দেখা হবার আশঙ্কায় রক্তিম বিক্রি করে দিয়েছিল জমিটা ।

কোনও এক বোনকে রাহুল বিয়ে করুক, এই পরিকল্পনা রূপায়িত হতে দেননি রাহুলের মা, যদিও একের পর এক বোনকে রাহুদের বাড়িতে পাঠানো হতো কিছুকালের জন্য । রাহুলের মা বলেছিলেন, একই বাড়ি থেকে দুটো বউ আনবো না । দেখছিস তো বড়োজেঠার মেয়ে সাবু আর ধাবু দুই ভাইকে বিয়ে করে কী অশান্তি ডেকে আনলো পরিবারে । রাহুরও পছন্দ হয়নি কাউকে । সহকর্মী অরিন্দমকে এনে এক বোনের সঙ্গে সম্পর্কের আঠা গড়ে দিয়েছিল রাহুল । অরিন্দম এককালে লুম্বিনী পার্কে ভর্তি ছিল, বিবাহিতা মহিলার প্রেমে গোলমাল পাকিয়ে। যে বোনকে বিয়ে করল, সে শুচিবায়ুগ্রস্ত, অতিথিদের খাওয়া বাসন দ্বিতীয়বার ব্যবহার করে না । ওদের মেয়ের সঙ্গে যে যুবকের বিয়ে হলো, বাড়িতে যা রান্না হতো সবই সে খেয়ে নিতো, স্ত্রীর জন্য রাখতো না কিছুই, তা সে যতোই ভাত, তরকারি, মাছ, মাংস রাঁধা হোক । ডিভোর্স হয়ে গেলো । অরিন্দম এখন সাধুসঙ্গ করে বেড়ায়। অরিন্দম বাড়ি করেছে সল্টলেকে, বাদবাকিদের মতন একই পাড়ায় নয় । বলে, আর বাসে চাপি না, শালা গণতন্ত্রের ঘামের দুর্গন্ধ বেরোয় বাসের মধ্যে । বলে, মিছিল-ফিছিল বেরোলে বাড়ি থেকে বেরোই না । কেন জানো ? ভাষণবাজির কথায় যে ফাঁকা আওয়াজ পোরা থাকে, তার ধুলোয় চাপা পড়ে যায় মিছিলের মুখগুলো। মনে হয় একই মুখের শয়েশয়ে মানুষ চলেছে ।

অপূর্ব ব্যানার্জি একই ভাড়াবাড়িতে বেশিদিন থাকতে পারেন না । তার কারণ যে বাড়িতে থাকেন তার আশেপাশের সমস্ত রাস্তা গলি বাজার দেখে বেড়ান উনি, সকালে উঠে স্নান করে জলখাবার খেয়ে, শার্ট-প্যান্ট পরে বেরিয়ে পড়েন । ওনাকে জিগ্যেস করলে বলে দিতে পারবেন কোন দোকান বা কোন দপতর কোথায় । পাটনায় থাকতে সারা শহরে বিভিন্ন এলাকার বাড়িতে ভাড়া থেকেছেন । পলিদি বলতেন, আমি কী করব বলো ? তোমার অপুদা ওই রকমই মানুষ । অপূর্ব ব্যানার্জি জামশেদপুরে ফ্ল্যাট কিনলেন, বেচলেন, আবার কিনলেন, বেচলেন । অবসর নিয়ে কলকাতায় নানা জায়গায় ফ্ল্যাটভাড়া নিয়ে শহর দেখা হয়ে গেলে, হাওড়ায় একটা বাড়ি কিনলেন, তারপর সেটা বেচে অনিকেতদের পাড়ায় ফ্ল্যাট কিনলেন । ওই পাড়ায় এতো ভায়রাভাই যে বিরক্ত হয়ে আরেকটু দূরে ফ্ল্যাট কিনলেন । সেই ছোট্ট ফ্ল্যাটেই মারা গেলেন । বলতেন, বুঝেছ রাহু, সময়ের ঘড়ি হয় না, কাঁটা নেই।

       —ছিঃ, আবার আজকে ওরকম নোংরা দীর্ঘশ্বাস ফেলছিস, কেকয়িকে বলল রাহুল । ওর হৃৎস্পন্দন রগে উঠে এসেছিল । এই মেয়েটার মগজে তাহলে স্বপ্ন তৈরি হয়, অথচ চোখগুলো দেখে মনে হয় স্বপ্নহীন । কিন্তু দেখে তো মনে হয় ভোর বেলাকার শিশির এর খালি পায়ের পাতা দিয়ে ঢুকে একে শীতলতা দেয় ।

—আমি কালকে তিনতলার ঘরে তোর জন্য অপেক্ষা করছিলুম, তুই এলি না তো ? আমি চান করে চুলে সাবান লাগিয়ে এসেছিলুম । ওই ঘরে তোর দাদার শালা শুতো, তার কাঁথা রাখা আছে, সেটা আমি পেতে রেখেছিলুম যাতে তোর হাঁটুতে কষ্ট না হয় । রাহুলের সহানুভূতির নিশ্চয়তায় নির্ভর করে কেকয়ি নিজের দুঃখের অবসান ঘটাবার প্রয়াস করল । পাগলামির ঢেউ এই মেয়েটাকে ডুবিয়ে মারবে ।

—তুই কি আমাকে ওই সিকন্দর গাধা পেয়েছিস ? মেয়েটা জানে, রাহুলের মনে হলো, পুরুষরা তাদের লিঙ্গ  আর পরিপাক যন্ত্রের নির্দেশে সাড়া দেয় । দেখে মনে হলো মেয়েটার  ঘাম ওর সারা শরীরকে দ্বিতীয় ত্বকের মতো ঠান্ডা করে তুলেছে ।

—না, আমি গাধার বাচ্চা চাইনি । তোর বাচ্চা চেয়েছি, তোর মতন ফর্সা, সুন্দর আর বুদ্ধিমান। যেন গ্রহণলাগা কন্ঠস্বর । রাহুলের মনে হলো, কেকয়ির দুঃখে আবেগের একটা চমকপ্রদ বাড়াবাড়ি রয়েছে৷  বিষণ্ণতা আর ঘৃণার মিশ্র অভিব্যক্তি ঝরিয়ে মেয়েটা জ্বলন্ত আকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল । ওর মুখময় ছড়িয়ে পড়েছিল বুনো দুঃখ আর  বোবা বেদনার  করুণ আর ভয়ঙ্কর ছায়া । মেয়েটার সারা জীবনের সংগ্রামী অর্ধ-আকৃতির প্রতিক্রিয়ায় ভয়ের সাথে মেশানো দুর্বলতা ।

—তাই তো সম্ভব নয় । তুই কি চাস আমার ছেলে বা মেয়ে তোর মতন হোক । পড়াশুনা না করে, স্কুল-কলেজে না গিয়ে, বস্তিতে সারা জীবন কাটাক ? আমি তো তা হতে দেবো না । 

—তোরা তাহলে নতুন কাজের লোক রেখে নে । তুই  তো চাস না তোর ছেলে কাজের লোক হোক। ইসকুলে পড়তে হয় জরিমানা দিয়ে, বড়ো হবার জরিমানা । তাহলে আমিই বা কেন তোদের কাজের লোক হয়ে মরি ! নিঃশব্দ দুঃখ ঝরছিল কেকয়ির কপালের ঘাম থেকে । রোদের আলো ওর কৌণিক বৈশিষ্ট্যকে পীতাভ বাদামি আর লালচে পাথরের অপ্সরা করে তুলছিল । আলোর স্পন্দিত আর্তনাদ বা দুর্ভেদ্য অন্ধকারের ভেতর থেকে প্রতারণাপূর্ণ প্রবাহ সবচেয়ে গাঢ় আর সবচেয়ে অবজ্ঞেয় হয়ে উঠলো কেকয়ির কথায় । প্রত্যাশার অনুশীলন থেকে মুক্ত এই মেয়েটা বোধহয়  হতাশ হতে জানে না ।

রাহুর চরিত্র কেতুর উল্টো । উজ্বল ভট্ট, যিনি যদু ভট্ট পরিবারের সন্তান, কলকাতা প্রেস ক্লাবে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন,, “ব্যক্তি রাহুল সিংহ সম্পর্কে কিছু কথা বলতেই পারি এবং সেই বলাটা আদৌ শিবগীতি হবে না। তারচেও বড় কথা হলো, ইতিহাসের স্বার্থেই ওসব কথা আমি বলতে বাধ্য। বর্তমান সময় থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আমাকে পিছিয়ে যেতেই হবে। জানাতেই হবে যে, কিভাবে কিভাবে একদা রাহুল সিংহের  সংস্পর্শে এসেছিলাম। তো রাহুল সিংহের কিরিয়া করমের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে  তিরাশি-চুরাশি নাগাদ, ‘গলির গল্প’ পত্রিকার পাতায়। পুনরাবির্ভাবেই ফের শোরগোল মাচিয়ে দিলেন রাহুল । নট্ট কোম্পানিদের ধুলিসাৎ করায় ওঁর ভূমিকার কথা সেই প্রথম জানলাম বটে কিন্তু সেই জানকারির পুরোটাই ছিল ভাসাভাসা। কারণ তথ্যের পরিবর্তে ওই সাক্ষাতকারের পুরোটাই ছিল প্রাক্তন সহঅভিনেতাদের বিরুদ্ধে  ব্যক্তিগত বিষোদ্গার এবং অহংসর্বস্ব রণহুঙ্কার, যে অভ্যেস রাহুল সিংহ আজও বজায় রেখেছেন। ভালোমন্দ কিম্বা ভদ্রতা-অভদ্রতার তোয়াক্কা না রেখে কারণে-অকারণে ছোঁড়া রাহুল সিংহের  ইগোয়িস্ট হুঙ্কার চোখে পড়েনি এমন দর্শক আজ বিরল। অবশ্য দৃষ্টি আকর্ষণের এই কৌশলটা যে পুরো বিফলে যায়নি তার প্রমাণ, এপার-ওপার বাংলা মিলিয়ে আজ রাহুল সিংহের গুণগ্রাহীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। সেদিন কিন্তু বিরক্তই হয়েছিলাম। শুধু আমি নই, বাংলা নট্ট জগতের অভিনেতা মাত্রেরই একই রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। রাহুল সিংহের  দ্বিতীয় উপস্থিতি সম্ভবত চোখে পড়েছিল ‘আয়না’ নট্ট কোম্পানির মুখপত্রে। সেই একই রকম খোট্টা পালোয়ান সুলভ আস্ফালন। যথারীতি সবার কাছে বিরক্তিকর।

রাহুল যেহেতু যৌনতা নিয়ে খোলামেলা কথা বলে, স্বপ্নদ্রষ্টা বিশ্বাস একদিন ওকে বললেন,আমি মুক্তযৌনতার পক্ষে। কারণ, আমি লক্ষ্য করছি, আমার কিছু ফেসবুকের বন্ধু ও পরিচিতরা এমন সব মন্তব্য করছেন যা থেকে বোঝা যাচ্ছে তারা সব মধ্যযুগীয়, তালিবান মানসিকতার। অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না, মধুসূদন সান্যাল কেন মঞ্জুশ্রী দাশকে নিয়ে দার্জিলিঙে গিয়ে হোটেলের দরজা বন্ধ করে ছিলেন!  কিংবা ওশো রজনীশ তো একটা ব্রথেল খুলে বসেছিলেন। আমি দুজনকেই তাঁদের এই কাজের জন্য শ্রদ্ধা করি। এবার বিস্তারিত বলি। আমি মনে করি, দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে যৌনতা হল তাদের ইচ্ছার ব্যাপার। এই ব্যাপারে আমরা কেউ জাতির জ্যাঠামশাই হয়ে নাক গলাতে পারি না। এটা অনৈতিক ও তালিবানি। কারণ, ওই দুজন মানুষ যদি রাজি না হতেন তাহলে কীভাবে সেটা চললো? যদি প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষরা এটা করেন এবং অবলা না হন, তাহলে এটাতে কেউ আপত্তি করতে পারেন না। সেটা অবশ্যই উদ্দেশ্যোপ্রণোদিত ও নিন্দনীয়। কারণ, এদেশে দ্রৌপদীর পাঁচ স্বামী, নিন্দা করছি না, উনবিংশ শতাব্দীতে বহুবিবাহের চল ছিল, নিন্দা করছি না, তাহলে দ্রৌপদীকে বাধা দিতে হয়। কিন্তু সতীদাহ নিন্দনীয়। এই বহুবিবাহ রোধ আইন করলো ব্রিটিশরা, বিদেশিরা, যাঁরা আমাদের দেশের সংস্কৃতি জানে না, পরম্পরা জানে না, তারা। তারা একবিবাহের আইন করলো। বিশেষ ভাবে ভিক্টোরিয়ান মানসিকতা বলতে আমরা এটাই বুঝি। এটা একদমই বিদেশি ধারণা। মিশেল ফুকো গবেষণা করে দেখিয়েছেন, যখন যৌন অবদমনের আইন থাকে তখন সবচেয়ে বেশি সাধারণ মানুষ তার উল্টো প্র্যাকটিস করে। তাই হয় এবং এই ব্যাপারে প্রাচ্য পাশ্চাত্য এক। ওদেশে শার্ল বোদলেয়ার ছদ্মনামে লিখলেন পর্নোগ্রাফি আর এদেশে গড়ে উঠলো বটতলা থেকে সোনাগাজি। ওই উনিশ শতকেই। এক বিবাহ তাহলে রক্ষা করলো না মানুষদের ইচ্ছা ও পরিতৃপ্তিকে। যদি দুজন মানুষ তাদের নিজেদের সম্মতিতে যৌনতা করে, সেটা আইনত নিন্দনীয় নয়। ধর্ষণ নিন্দনীয়। কারণ, সেটা মেয়েটার অসম্মতিতে হচ্ছে। তাহলে, মেয়েটাকে পরের দিন বা দিন পনেরোর মধ্যে গিয়ে সেটা আইনানুগ ভাবে কমপ্লেন করতে হবে। তখন তার বিচার হবে। কিন্তু ধর্ষণ হল, আর কেউ তার দশ বছর বাদে সেটা বললো, বুঝতে হবে, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। যদি অবলা মেয়ে হয় তাহলে অন্য কথা । যদি সচেতন, বাকস্বাধীন মেয়ে হয় তাহলে কিন্তু পরে বললে বুঝতে হবে মেয়েটার প্লেজার ছিল, এখন কমপ্লেন করছে। এটা হয় না। মিথ্যাচার, চালাকি। আমাদের দেশ কিন্তু মুক্তযৌনতার দেশ। আমি কোনো এমন মতামত রাখছি না, যা এই প্রথম ও তাতে হাতকড়া পরতে পারে। কারণ, তাহলে সেই দোষে রজনীশকে হাতকড়া পরতে হতো, সেটা কিন্তু হয়নি। সঙ্গে গণতান্ত্রিক বাকস্বাধীনতা। রজনীশের আশ্রমের শিষ্যরা কারা? মহেশ ভাট, বিনোদ খান্না, কবীর বেদী ও তাঁর বৌ, এমন সব ইন্টালেকচুয়ালরা। কেন টুপি পড়বেন এঁরা? কারণ, আমাদের দেশের পরম্পরায় আছে এই যৌনতাকে স্বীকৃতিদান। তাই মধ্যযুগে সংস্কৃত সাহিত্যে গণিকা ছিলেন বসন্তসেনা। তাকে কিন্তু চাবুক খেতে হচ্ছে না গণিকাবৃত্তির জন্য, তিনি সম্মান পাচ্ছেন। তারপর এদেশে গড়ে ওঠে বড় বড় গণিকালয়। যারা কাজের মতই যৌনতা সার্ভ করে। আর এখন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির যে দাবি, সেটা এই যুক্তি থেকেই, যৌনকর্মীদের কাজের স্বীকৃতি চাই। শব্দটা " যৌনকর্মী ", যার সঙ্গে " কর্মী " যুক্ত। তাদের কাজের স্বীকৃতি। কারণ, এটা বছরের পর বছর ধরে আমাদের দেশে ট্যাবুলেস ভাবে একটা মুক্তযৌনতার কাজ। তাই রামমোহন রায়ের হারেম ছিল। অরুণাচল, মিজোরামে এখনো মাতৃতান্ত্রিক সমাজে  প্রচুর দ্রৌপদীর উদাহরণ মেলে। অথবা পাহাড়ী আদিবাসীদের মধ্যে, দুটোই। তাহলে সর্বনাশটা করলো ভিক্টোরিয়ান শাসন, যার ভুল ভার টেনে চলেছি আমরা। আমাদের ছিল মুক্ততার যৌনতা। তাই রজনীশ বলেন, যেটা তোমার সবচেয়ে বেশি চাহিদা সেটাকে তুমি যদি রুদ্ধ করে যোগ সাধনা করো, তুমি সেটা লাভ করবে না। তুমি যদি কমলালেবু খেতে ভালবাসো আর সেটা না পাও, তাহলে তোমার মধ্যে বিদ্রোহ জন্ম নেবে। এবার যদি তোমায় কমলালেবু দেওয়া হয় প্রতিদিন, একদিন আসবে যেদিন তুমি আর কমলালেবু চাইবে না, অরুচি চলে আসবে। যৌনতাও তেমন। তোমার সেটা লাভ করতে করতে একসময় সেটা থেকে অরুচি বা মুক্তি আসবে। সেটাই " নির্বাণ " । কিন্তু রজনীশের মত, নির্বাণ সবার প্রাপ্ত হবে না। রজনীশ তাদের আশ্রম থেকে ছুটি দেন। মানে, আপনি যৌনতা আশ্রম ছাড়াও অন্যত্র বাইরের জীবনে প্র্যাকটিস করুন। আশ্রম হল সেই মেশিন যেখানে কেউ ফেল করলে তার থাকার দরকার নেই। ওঁর একটা বিখ্যাত বক্তৃতার শিরোনাম, " সম্ভোগ সে সমাধি তক "। এখন একে যদি কেউ বলেন, ব্রথেল এটা, আমি রাজি। আবার বুঝতে পারবো তিনি এদেশের যে যৌনতার নিজস্ব দর্শন সেটা জানেন না কিংবা কেউ যদি বলেন, তিনজনে বা চারজনে মিলে গ্রুপ সেক্স করছে, তাহলে বলবো ঠিক করছে, এটাও এই দেশের পরম্পরা। মনে রাখতে হবে এদেশেই " কামসূত্র " লেখা হয়েছিল। খাজুরাহোর মন্দির এদেশেরই সম্পদ। যেটা সারা পৃথিবীতে নেই। মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে যৌনতা, মুক্ত যৌনতা, গ্রুপ সেক্সের ভাস্কর্য আর ভেতরে দেবতা। এটাই আমারও দর্শন বিশ্বাস। ভারতীয়তা। যদি না বোঝেন মুর্খ ভাববো । কারণ, যে জাতি নিজের দেশের সম্পদ দর্শন ভাস্কর্য সাহিত্যকে, বিশ্বাসকে মূল্য দিতে জানে না, তার মতো অন্ধ আর কে, সে তালিবান। তারজন্য এবার দেশীয় কাঁচা খিস্তি বরাদ্দ।

কেন যে স্বপ্নদ্রষ্টা আত্মহত্যা করলো ! বউ যদি জ্বালাতন করছিল তো ছেড়ে দিলেই হতো । তা নয়, বউকে শাস্তি দেবার জন্য গলায় নাইলনের দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ল । রক্তিম-নীলার বিচ্ছেদের মতন এও তো বিচ্ছেদ, নিজের গড়া বিচ্ছেদ । স্বপ্নদ্রষ্টা বিশ্বাসের আত্মহত্যা নিয়ে মলয় রায়চৌধুরী একটা লেখা লিখেছিল, রাহুল সেটা প্রায়ই পড়ে নিজেকে শোনায় :

হৃৎপিণ্ডে ওঠেনি কি দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম

যখন আকাশের ইস্পাতে গিঁট বাঁধছিলে

দেখে নিচ্ছিলে গিঁট শক্ত হলো কিনা

পায়ের শিরাগুলো তাদের কুয়োর দড়ি দিয়ে রক্ত তো পাঠাচ্ছিল

তোমার হৃৎপিণ্ডের দিকে, ভালভ খুলে এবং বন্ধ করে

ওই দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম শুনে তাড়া পড়ে গিয়েছিল

তোমার শরীর জুড়ে, অথচ তুমি বরফের তৈরি মাথায়

জানি না কবে কোন দিন কখন নির্ণয় নিয়ে ফেলেছিলে

আকাশের হুক থেকে ঝুলে পড়ে, ঝুলে পড়ে আত্মহত্যা করে নেবে

শেষ প্রশ্বাসের সঙ্গে শেষ বীর্য ফোঁটা ঝরেও ঝরবে না

কিছুটা হদিশ কি পাইনিকো ? পেয়ে তো ছিলুম–

বলেও ছিলুম, এ কী করছো স্বপ্ন তুমি, উত্তর দিলে না

নারীও পুরুষের মতো জড়িয়ে ধরতে পারে, ধরে, জানাই ছিল না

আমি তো জানোই, নারীদেরই জড়িয়ে ধরেছি চিরকাল

পুরুষকে জড়িয়ে ধরার কথা ভাবলেই বিরক্তি ধরে, বমি পায়

মনে হয় রাস্তাছাপ রাজনীতি শরীরে আশ্রয় নিতে এলো

এও বলেছিলে তুমি, চিরকাল মুক্তযৌনতার পক্ষে

রজনীশ-আশ্রমের যৌনতার খেলা সমর্থন করো, সম্পর্কের ব্যাগাটেলি

তোমার যৌনজীবনের কথা জানতে চাইলে তবে লজ্জা পেয়েছিলে কেন

ইউরোপে গিয়ে বিদেশিনী প্রেম করেছিলে কিনা, রোমান হলিডে,

জুলিয়েট, জাঁ দুভাল, তার কোনো উত্তর দাওনি তো

তোমাকে বুঝতে পারা ক্রমশ জটিলতর করে দিয়ে তুমি

ফেলে গেলে বুদ্ধদেব বসুর উপহার দেয়া মিমিকে ১৯৬৫ সালে

লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি সম্পাদিত সিটি লাইটস জার্নালের দ্বিতীয় খণ্ডটি

যাতে হাংরিদের লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, হাওয়ার্ড ম্যাককর্ডের

বিদ্যায়তনিক ভূমিকাটিসহ, ফুটপাথ থেকে কেনার সময়ে

হৃৎপিণ্ডে ওঠেনি কি দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম

তোমার কাছেই জানলুম, জীবনানন্দের মেয়ে মঞ্জুশ্রীর চাকরি গিয়েছিল

সাউথ পয়েন্ট থেকে, মধুসূদন সান্যালের সাথে প্রেমের কারণে

বলেছিলে তুমি, যে বিদ্রোহী সে তো সমাজবিহীন, তার কেউ নেই

তার স্বপ্ন আছে, মলয়ের প্রথম সাক্ষাৎকার তুমি নিয়েছিলে

যখন কেউই পাত্তা দিতে চায়নি আমাকে, আমার প্রবন্ধগ্রন্হের

ভূমিকাও লিখে দিয়েছিলে, জানি না কখন কবে প্রৌঢ় হয়ে গেলে

সংবাদপত্রে পড়লুম, যখন আকাশের খুঁটি থেকে ঝুলছিলে, ঘরে ছিল

আলো, নাকি অন্ধকার ঘরে তুমি শ্লেষ হাসি ঠোঁটে নিয়ে

এনজয় করেছো প্রিয় একাকীত্ব ; তখনও কি নিজেকে নিজে নিঃশব্দে

বলছিলে : এই বাংলায় দুইটি জিনিস আর ফিরবে না কোনোদিন :

সুভাষচন্দ্র বসু আর সিপিএম । মার্কস বা লেনিন নয়, স্তালিনও নয়

মাও বা ফিদেল কাস্ত্রো নয়, কেবল সিপিএম ক্যাডারিত হাড়গিলে লোকেদের

ঘেন্না করে গেছো, তুমি তো প্যারিস রোম ফ্লোরেন্স ভেনিস ব্রিটেনে গিয়েছিলে

তবু তারা রাস্তায় তোমাকে ফেলে রায়গঞ্জে থেঁতো করেছিল

যাদবপুরের চারতলা বাড়ি থেকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে পাগলাগারদে

ইলেকট্রিক শক দিয়েছিল, অথচ তুমি তো নিজেই বিনয় মজুমদারকে

হাসপাতালে দেখাশোনার ভার নিয়েছিলে, বিনয় মজুমদারের বউ রাধা

আর ছেলে কেলোকে সোনাগাছি গিয়ে খুঁজে-খুঁজে ছবি তুলে এনেছিলে

অর্ঘ্য দত্তবক্সির বইয়ের মলাটেতে দেখেছি তাদের, সত্যি বলতে কি

কয় দিন কয় রাত ঝুলেছো নিজের ঘরে, তারপর পিস হেভেনের শীতাতপে নয়

কাটাপুকুর মর্গে তিন দিন পড়েছিলে, বুক চিরে ব্যবচ্ছেদ হয়েছিল ?

ডাক্তারেরা পেয়েছিল কিছু ? জমাট বেঁধে যাওয়া দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম

জানি না । শুনিনিকো । দেহেতে পোশাক ছিল ? কোন পোশাক ?

লাশকাটা ঘরে ? চোখ আর বন্ধ করোনিকো, সম্ভবই ছিল না

সবুজ প্লাস্টিকে মোড়া, ফুল নেই, রজনীগন্ধার রিদ নেই

সাজুগুজু সুন্দরীরা এসে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নিকো তোমার মরদেহ ঘিরে

কেওড়াতলায় উল্টো বন্দুক করে প্রতিষ্ঠানের সেলামি পাওনি তা জানি

নন্দন চত্বরে প্রতিষ্ঠানের মোসাহেবদের মতো শোয়ানো হয়নি দেহ

তোমার প্রিয় সন্দীপন ঘুরতো তো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পিছনে পিছনে

জিগ্যেস করোনি তাঁকে সিপিএম কেন তোমাকে টার্গেট করেছিল !

আশে পাশে আরও কয়েকজনের শব ছিল, ওঠেনি কি দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম

দাদা নকশাল বলে শ্রীরামপুরের বাড়িতে হামলা করেছিল, তোমার কথায়

সেই লোকগুলো যারা বাংলার রেনেসাঁকে ধ্বংস করে গড়িয়ার মোড়ে নেচেছিল

বটতলা ফিরিয়ে আনলে তুমি গবেষণা করে, ভিক্টোরিয় বিদেশিরা যাকে

অশ্লীল ছাপ দিয়ে আদিগঙ্গার পাঁকে ছুঁড়ে ফেলেছিল

আর কমলকুমারের রেডবুক, ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত প্রথম বাঙালি মহিলার

লেখা উপন্যাস ‘মনোত্তমা’ খুঁজে পেয়েছিল ব্রিটিশ লাইব্রেরির তাকে অযত্নে রাখা

তখন হৃৎপিণ্ডে ওঠেনি কি দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম

যেমন প্রথমবার প্রেসিডেন্সির প্রথম বছরে ঝালমুড়ি খেতে খেতে

প্রিন্সেপ ঘাটে, ভিক্টোরিয়ায়, ক্যানিঙের ট্রেনে, গঙ্গার খেয়া নিয়ে এপার-ওপার–

মা ‘লীলাবতী’কে নিয়ে বই লিখে হয়তো ভেবেছিলে পৃথিবীতে কাজ সাঙ্গ হলো

জানবো কেমন করে বলো, এই তো সেদিন ১৯৬৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর

জন্মেছিলে তুমি, মৃত্যুর দিনটাকে আকাশের খুূঁটিকে বলে চলে গেলে

কেবল এটুকু জানি ২০১৭ সালে ১৬ই জুন কেওড়াতলার শ্মশানে প্রাঙ্গনে

ডেডবডি ক্যারিয়ার সার্ভিস গাড়িতে গোপনে শুয়ে গন্তব্যে চলে গেলে

পাখিরা কোথায় গিয়ে মারা যায় জানতে চেয়েছেন অরুন্ধতী রায়

তিমিমাছ বুড়ো হয় মারা যায়, রুই ও কাৎলা বুড়ো হয়ে মারা যায়

মারা গেলে তাদের গল্পগুলো জলের তলায় চাপা পড়ে থাকে–

কতো কাজ বাকি রয়ে গেল, সেসব প্রজেক্টের কেউই কিচ্ছু জানে না

যাকিছু বহুদিন সযত্নে সংগ্রহ করেছিলে সবই ফালতু মনে হলো

যা জরুরি মনে হলো তা ওই এক ঝটকায় দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম

বন্ধ করে, নিঃশব্দে অট্টহাসি হেসে, আত্মনিধন করে ফেলা…

নীলার সঙ্গে কলেজ থেকে ফেরার সময় গাছের ডালগুলো রক্তিম চাইবাসার ছোটোঘরের সামনে উঠোনে ফেলে দিতো । নীলা সেগুলো পুঁতে দিতো বাড়ির সামনে রাস্তার অন্য পারে, নর্দমার ধারে । বর্ষায় সেই ডালগুলোর বেশ কয়েকটা শেকড় গজিয়ে পাঠিয়ে দিতে পেরেছিল মাটির গভীরে আর ক্রমশ দীর্ঘ হয়ে উঠেছিল নানা রকমের গাছ। ‘ছুটে কে তুলিলে শালবন, ঘন বন্ধন চারিধারে’, বারবার বলছিল রক্তিম, মদের ঘোরে মাতাল, শান্তিনিকেতনের ঘরে, শেষ শয্যায় বিড়বিড় করে, ছুটে কে তুলিলে শালবন ঘন বন্ধন চারিধারে, ছুটে কে তুলিলে শালবন ঘন বন্ধন চারিধারে, ছুটে কে তুলিলে শালবন ঘন বন্ধন চারিধারে, ছুটে কে তুলিলে শালবন ঘন বন্ধন চারিধারে, ছুটে কে তুলিলে শালবন ঘন বন্ধন চারিধারে, ছুটে কে তুলিলে শালবন ঘন বন্ধন চারিধারে, ছুটে কে তুলিলে শালবন ঘন বন্ধন চারিধারে, ছুটে কে তুলিলে শালবন ঘন বন্ধন চারিধারে, ছুটে কে তুলিলে শালবন ঘন বন্ধন চারিধারে, ছুটে কে তুলিলে শালবন ঘন বন্ধন চারিধারে, ছুটে কে তুলিলে শালবন ঘন বন্ধন চারিধারে……..। কেউ বুঝতে পারেনি কেন এই একই লাইন রক্তিমের গলায়, জীবনের শেষ মুহূর্তে ।

অনিকেত ভেবেছিল গৌরীর বোন মলিকে বিয়ে করে গৌরীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবে । কয়েক মাসেই টের পেলো মলি অমন সেতু হবার জন্য ওর সংসারে আসেনি । স্বামী আর সংসারের ভাগ কাউকে দিতে চায় না তা স্পষ্ট করে দিয়েছিল । এ থেকেই অনিকেতের কুন্ঠাকীটের জন্ম । কেতুর কলকাতার বাড়িতে গৌরীর আসা নিষিদ্ধ হয়ে গেল । রক্তিমকে আটকে নীলার দিকে এগোতে দেয়নি অনিকেত । মলি অনিকেতকে আটকে গৌরীর দিকে এগোনো বন্ধ করে দিল ।  অনিকেত বুঝতে পারলো যে মলি, কেতুর বাবা, মা, ভাইয়ের সঙ্গেও অনিকেতকে ভাগাভাগি করতে চায় না । পাটনার বাড়ি থেকে কেতুর বাবা, মা আর রাহুলের যাবতীয় আসবাব অনিকেতের কলকাতার বাড়িতে নিয়ে আসার প্রস্তাব বিনা দ্বিধায় মেনে নিয়েছিল অনিকেত।রাহুলের সংগ্রহের গ্রমোফোন রেকর্ডগুলো নিয়ে চলে এসেছিল । অনিকেতের বাবার দোকানঘরে টাঙানো ঠাকুমা, জেঠিমা, কাকিমাদের পেইনটিঙ বিসর্জন দিলো । বড়োজেঠার আঁকা পেইনটিঙগুলো, পুরোনো আমলের রোমান দেয়ালঘড়ি, কোথায় যে গেল কেউই জানতে পারেনি । রাহুলের ঘরে টাঙানো টলস্টয়ের আর রবীন্দ্রনাথের বিশাল ছবিগুলো ফ্রেমসুদ্ধ ভেঙে ফেলে দিয়েছিল । কেতুর মায়ের পুজোর চৌকি আর মূর্তি ফেলে দিয়েছিল । সব কাজের পেছনে গৌরীর অস্তিত্ব মুছে ফেলার বার্তা।অথচ গৌরী কখনও রাহুলদের পাটনার বাড়িতে আসেননি । 

কলকাতায় আশ্রয়ের জন্য রাহুল যখন অনিকেতকে বলল, তোমার ওপরতলাটা আমাকে ভাড়া দাও, তখন মলি তৎক্ষণাত বলে দিলে, তুমি কোথাও একতলা ভাড়া করে থাকগে যাও । অনিকেত এই ব্যাপারে স্ত্রীর সামনে মুখ খোলেনি, চুপ করে বাগানের নারকেল গাছের দিকে তাকিয়েছিল । এনাক্ষী খৈতানও একইভাবে রক্তিম চাটুজ্যে আর সংসারকে অন্য নারীর সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাননি ; রক্তিমের লেখালিখি থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছেন নীলাকে ।

রক্তিম লিখেছিল

“কোনোদিন তোমাকে বলিনি

কোথায় তোমার দোষ, কোথায় আমার ?

শুধু জানি — মধ্যে দোষ ছিল 

কিংবা তাকে অন্য নামে ডাকা যায়—--” 

অনিকেত সিংহ, কান্তি লাহিড়ি, রাহুল সিংহ, অমরদেব দাশগুপ্ত, নীলা চক্রবর্তী, কেকয়ি দুসাধ, গৌরী ব্যানার্জি, চপল চক্রবর্তী, মন্দার ভাদুড়ি, নন্দা কাহার, বাবুল মিত্র, বিরল গঙ্গোপাধ্যায়, সুশীল কোশল, গীতা হালদার, স্বপ্নদ্রষ্টা বিশ্বাস, সুজিত রায়, কাকদ্বীপের সামসুল হক, বরানগরেরে ভাস্কর চক্রবর্তী  — সকলেরই মধ্যে দোষ ছিল, ঠিকমতো অরিগামি সাজাতে না পারার দোষ । আর জীবনানন্দ দাশের  রণজিৎ-ঊষা, প্রমথ-সুমিত্রা, সুধীশ-কাঞ্চনমালা, অভয়-স্বর্ণ, অচ্যুত-জ্যোৎস্না, প্রবোধ-উর্মিলা, বিরাজ-কমলা, সুবোধ-মালতী ? কিছু মানুষের কাছে, যারা তাদের বর্তমান কালখণ্ডের কাছে দুর্বল, স্মৃতি একটা দায়বিশেষ ।

নিচে থেকে গাধার ডাক শোনা গেল । তার মানে ধোপাটা আবার গাধাটাকে নিয়ে এসেছে । কিছুক্ষণ পর শোনা গেল কোকিলের ডাক । এখানে আবার কোকিল কোথ্থেকে ! চাইবাসায়, নিমডির টিলায় চেয়ার পেতে, বসন্তঋতুতে, মহুয়াফুলের গন্ধ-ওড়ানো সকালবেলায়, শোনা যেতো কোকিলের ডাক । আরও কতো পাখির ডাক।রাহু তো সব পাখির নাম জানে না । অনিকেতও জানে না । দুই ভাই টিলায় চেয়ারে বসে শুমতো, মহুয়ার মদ খেতে-খেতে । রাহুলই বেশি খেতো । কুকুরের ডাক শোনা গেল, পাড়ার কুকুরটাকে কেউ লাথি মারলো বোধহয়, তেমনই কেঁউ-কেঁউ । নন্দার দোকানের ছায়ায় শুয়ে থাকে কুকুরটা, বিস্কুটের গুঁড়ো, রুটির টুকরো পাবার আশায় । 

নন্দার লিভ-ইন বউয়ের গলা,  অগে কেকয়ি, বহুরুপিয়া আ গইল বা, তোরে লগি বৈঠল হ্যায় ।

কেকয়ির মরিয়া কন্ঠস্বর শোনা গেল, আবিলা, আবিলা, আবিলা…

রাহু আর কেকয়ি দুজনেই বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো, পাশাপাশি । কেকয়ি রাহুলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো । তারপর দৌড়োলো নিচে । নিচে পৌঁছে, কাঁদতে-কাঁদতে, বহুরূপীর হাত ধরে নিয়ে চলল হিন্দু মহল্লায় নিজের ঝোপড়ির দিকে । পেছন ফিরে তাকিয়ে  দেখলো, রাহু বারান্দায় নেই ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন