বুধবার, ২৪ আগস্ট, ২০২২

What is Power : Malay Roychoudhury

 এক

ক্ষমতা কাকে বলে তা এই চিঠিটা পড়লে জানা যায় :

সাগরময় ঘােষ

প্রীতিভাজনেষু ,

মাস দেড়েক হল সাত আটটি কবিতা আপনাকে বাড়ির ঠিকানায় রেজেষ্ট্রি করে পাঠিয়েছিলাম ; সুযােগ মতাে 'দেশ'- এ ছাপাবার জন্য। আপনার কোনাে চিঠিপত্র পাইনি। কবিতাগুলাে পাঠিয়ে আপনাকে বিব্রত করা উচিত হয়নি — বােধ করছি।

আমার মনে হয় এখন কবিতাগুলাে কিছু কাল আমার কাছে থাকুক ; বিশেষত প্রেমের কবিতা তিনটি ( সে, তােমাকে ও তােমাকে ভালােবেসে ) ; কবিতা তিনটি নানা কারণে এখন আর ছাপাব না ভাবছি। আমার এই চিঠি পেয়ে সমস্ত কবিতাগুলাে আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলে খুশি হব। পরে 'দেশ' - এ ছাপাবার প্রয়ােজন হলে আবার পাঠানাে যাবে।

রেজেস্ট্রি করে পাঠাবার জন্য টিকিট এই সঙ্গে পাঠিয়ে দিলাম আশা করি ভালাে আছেন। শুভকামনা ও প্রীতিনমস্কার জানাচ্ছি।

ইতি

জীবনানন্দ দাশ ( ১৯৫৪ )

 

সাগরময় ঘোষের ‘ক্ষমতা’ ছিল কবিতা নির্বাচন করে প্রকাশ করার, কিন্তু তিনি কবিতার  বোদ্ধা ছিলেন না, তাই সম্পাদকের ক্ষমতা প্রয়োগ করে কবিতাগুলো প্রকাশ করেননি । ক্ষমতা বা শক্তির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Power , যা ফরাসি শব্দ Pouvoir  এবং লাতিন শব্দ Potestas থেকে এসেছে । এর অর্থ হলো সমক্ষমতা। এককথায় ক্ষমতা বলতে অন্যকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্যকে বোঝায় , যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণকারী নিজের ইচ্ছামতো কাজ করতে অন্যদের বাধ্য করে ।  আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো রাষ্ট্রের ক্ষমতা বা জাতীয় শক্তি । এককথায় এর সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে ভূমিকা পালন করতে পারে একটি ছোট রাষ্ট্র সে ভূমিকা পালন করতে পারে না । ভূমিকার  এই উৎসই  শক্তি । রাষ্ট্রের আসল হাতিয়ার শক্তি । শক্তির দ্বারাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো একটি দেশ নিজের জায়গা পাকা করে নেয় । 

 

ডুচাকেক এর মতানুসারে –––"ক্ষমতা হলো প্রত্যাশিত ফলাফল সৃষ্টির সামর্থ্য –– নিজের ইচ্ছানিযায়ী।”  হ্যান্স মরগেনথাউ এর মতে," ক্ষমতা হলো অন্যের মন আর কাজকর্মের ওপর একজন মানুষের নিয়ন্ত্রণ।”  জোসেফ ফ্র্যাঙ্কেল বলেছেন " অন্যের মন ও কার্যকে নিয়ন্ত্রণ করে কাঙ্ক্ষিত ফললাভের সামর্থ্যই হল ক্ষমতা"  বর্তমানে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হলো একটি দেশের অন্যতম মানদণ্ড । শিল্পের প্রসার, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি , বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনুকূল অবস্থা, প্রযুক্তির অগ্রগতি, আণবিক বিজ্ঞানে দখল ইত্যাদি হল একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সূচকসমূহ । জনসাধারণের কল্যাণ সাধন ও জীবনযাত্রার মান-উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হারের সম্পর্ককে স্বীকার না করে উপায় নেই ।  জাতীয় শক্তির অন্যতম উপাদান হলো নেতাদের ও জনগণের মনস্তত্ত্ব । একটি জাতির মধ্যে যখন আত্মবিশ্বাস থাকবে ,  তারা নিজেদের উন্নতিতে সার্বিকভাবে সচেষ্ট হবে, তখন তাদের সামগ্রিক উন্নতি ঘটবে । এই কারণে হিটলার জার্মানিকে একটা শ্রেষ্ঠ আর্য জাতি হিসেবে প্রচার করেছিলেন। 

 

একটা রাষ্ট্রকে তখনই শক্তিশালী বলা হবে যখন তার সামরিক শক্তির গোপন আর প্রচারিত সংবাদে অন্য দেশগুলো ভয় পাবে । এই ব্যাপারে শুধু সৈন্য সংখ্যা যথেষ্ট নয় , সামরিক বাহিনীকে জায়মান আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে তৈরি থাকতে হবে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোসিমা আর নাগাসাকির ওপর পারমাণবিক বোমা ফেলে ওই দুটো শহরকে  ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল আর অজস্র মানুষকে মেরে ফেলতে পেরেছিল।  জাতীয় ক্ষমতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ । পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ ও নির্ধারিত নীতির পক্ষে জনসমর্থন সংগ্রহ সরকারের দায়িত্ব।  কূটনীতির  গুণগত দিকটা হলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উপাদানগুলোর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। একটা দেশের সরকার যে পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ করে, তার বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া থাকে  কূটনীতিবিদদের ওপর। শান্তির সময়ে একটা রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রবিষয়ক আচরণের ওপর তার জাতীয় ক্ষমতার হ্রাসবৃদ্ধি যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভরশীল। বলাবাহুল্য , এই বিষয়টা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিদেশে যে রাষ্ট্রদূতরা রয়েছেন তাঁদের ওপর ।  জাতীয় ক্ষমতার বিভিন্ন উপাদান একটা রাষ্ট্রের সরকার  যথাযথ ব্যবহার করতে পারছে কিনা তার ওপর সেই দেশের জাতীয় শক্তি নির্ভর করে ।

 

ক্ষমতার রোষ দেখি প্রাচীন নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ঘটেছিল । ডক্টর অমর্ত্য সেন, নোবেল বিজয়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও দর্শনের অধ্যাপক এবং যিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তীকালীন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন, বলেছেন, নালন্দাকে ১১৯৩ সালে ধ্বংস করেছিল বখতিয়ার খিলজি । তা ছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি শুরুর কিছু পরে এবং কেমব্রিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কিছু আগে। বখতিয়ার খিলজি জ্ঞানের বোদ্ধা ছিল না ; দখলদার ছিল, ক্ষমতার আস্ফালনকারী, যার নির্দেশে বহু মানুষ সেসময়ে খুন হন বা যাঁদের জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয় । একইভাবে পর্তুগিজরা গোয়ায় ক্ষমতা প্রয়োগ করে স্হানীয়দের ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করেছিল ।  আওরংজেব ক্ষমতা প্রয়োগ করে নিজের ভাই দারা শুকোকে খুন করিয়ে তার শব লোপাট করে দিয়েছিল আর শিবাজীর ছেলে সম্ভাজীকে খুন করিয়ে টুকরোগুলো নিশ্চিহ্ণ করেছিল । আবু রিহান-আল-বিরুনী, পারস্যের ইতিহাসবিদ, যিনি ১০২২ খ্রিস্টাব্দে চান্দেলা রাজত্ব আক্রমণের সময়ে  গজনীর মাহমুদের সাথে ছিলেন, তিনি খাজুরাহো মন্দির এবং গজনীর মাহমুদের সেনাদের খাজুরাহো ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেছেন। তেরো শতকে, দিল্লির মুসলিম সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবকও চান্দেলা রাজ্য আক্রমণ ও দখল করেন আর বেশির ভাগ মন্দির ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। গুজরাতে ২০০২ সালে যে দাঙ্গা হয়েছিল তাতে শাকিলা নামে এক বধুকে গণধর্ষণ করেছিল একটা উগ্র হিন্দু দলের সদস্যরা  এবং আদালত তাদের  কারাদণ্ড দিয়েছিল ; যেহেতু মসনদের ক্ষমতা ছিল হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলের হাতে সেই গণধর্ষণকারীরা পরে ছাড়া পেয়ে যায় ।

 

জনসমর্থন থাকলে রাষ্ট্রের বাইরে বেরিয়ে একজন মানুষ যে ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারে তা আমরা দেখেছি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ব্রিটিশ সরকারকে ভারত থেকে উৎখাত করার কাজকর্মে, আই এন এ গঠনের মাধ্যমে । তাঁর ক্ষমতাকে ভয় পেয়ে ভারতের ব্রিটিশ সরকার আর সরকারের ভারতীয় অনুগ্রহভাজনরা তাঁকে এমনভাবে লোপাট করে দিলেন, বহুকাল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস থেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করলেন, যে ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি নতুন সংজ্ঞা গড়ে দিয়ে গেলেন তিনি । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একা বাঙালির গান, সাহিত্য-ভাষা আর সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছিলেন ।

 

সমাজশাস্ত্র আর রাজনীতিতে, ক্ষমতা হল  তড়পানির সামাজিক প্রভাব, যা বিশেষ লোকেরা বা প্রতিষ্ঠান প্রয়োগ করে আচরণের হুমকি খোলোশা করে । ক্ষমতা একচেটিয়াভাবে একজন  লোকের দ্বারা অন্যের ওপর জবরদস্তি নিজের মতামত চাপিয়ে দেয়ায় সীমিত নয় । ব্যক্তি এককও ক্ষমতা প্রয়োগ করার জন্য প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে ।  ক্ষমতা কাঠামোগত আদল-আদরা নিতে পারে, কেননা একজন লোক আরেকজনের ওপর দাদাগিরি ফলিয়ে ক্ষমতা প্রকাশ করতে পারে । যেমন রবিনসন ক্রুশো করতো ম্যান ফ্রাইডের ওপর । কিংবা অনুব্রত মণ্ডল করতো পুরো বীরভূম জেলার লোকেদের ওপর ।  কর্তৃত্ব অভিধা  ক্ষমতা শব্দের বদলে ব্যবহৃত হয়, যা সামাজিক কাঠামোর মাধ্যমে, হয়তো তা অবৈধ, তবু বৈধ বা সামাজিকভাবে অনুমোদিত বলে মনে করা হয়। ক্ষমতার ব্যবহার মন্দ বা অন্যায় হতে পারে, বা জনগণের ভালোর জন্য হতে পারে। ক্ষমতাকে ভালো আর  উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বা মানবতাবাদী উদ্দেশ্যপ্রাপ্তি  হিসাবেও দেখা যেতে পারে, যা অন্যদেরও সাহায্য করবে, এমনকী ক্ষমতায়ন করবে, যেমন ভোট দিয়ে বাছাই করার বা ছাঁটাই করার ক্ষমতা ।

 

সমাজশাস্ত্র আর বিজ্ঞানে ক্ষমতা শব্দটার একাধিক প্রতিশব্দ আছে, যেমন  শক্তি, পরাক্রম,  প্রভাব, শাসন,ঘাত, কুদরত, নিয়ন্ত্রণ, বল, প্রতিপত্তি, কর্মশক্তি, অগ্নি, গুণ, আয়ত্ত, অধিকারদানের দলিল, কর্মক্ষম অবস্থা,  অধিষি্ঠত ব্যক্তি,  প্রভাবশালী ব্যক্তি, কর্তৃত্ব, অধিষি্ঠত সংস্থা,  প্রভাবশালী সংস্থা, কর্মশক্তি, বর্ধনাঙ্ক, প্রাবল্য, প্রবলতা, ত্তজস্বিতা, প্রতাপ, দপদপা, অনুবল, কেরামত, কেরামতি, অধিকার, অধিকারদান, কার্যকরতা, মোক্তারনামা, জোর ইত্যাদি ।

Power বা ক্ষমতা অভিধাটি বিজ্ঞানেও ব্যবহার করা হয় । পদার্থবিজ্ঞানের পরিভাষায় একক সময়ে সম্পাদিত কাজের পরিমাণই ক্ষমতা। এস্‌আই একক পদ্ধতির পরিমাপে ক্ষমতার একক ওয়াট। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বৈজ্ঞানিক জেমস ওয়াটের নামানুসারে ক্ষমতার একক "ওয়াট" স্থির করা হয়েছে। এক সেকেণ্ড সময়ে  এক জুল পরিমাণ কাজ করার ক্ষমতা হলো এক ওয়াট। জেমস ওয়াট নিজে ক্ষমতার একক "অশ্ব শক্তি" স্থির করেছিলেন। প্রায়শঃ বিদ্যুৎ, যা কি-না এক প্রকার শক্তি, তা "কিলোওয়াট" হিসাবে পরিমাপ করা হয়। এক কিলোওয়াট=১০০০ ওয়াট। এর মানে হলো এক সেকেন্ডে ১০০০ ওয়াট বৈদ্যুতিক শক্তি আলোতে রূপান্তরিত হওয়া। প্রতি ঘণ্টায় এক কিলোওয়াট শক্তি ব্যবহার করা হলে তা "কিলোওয়াট-ঘণ্টা" দ্বারা প্রকাশ করা হয়। বৈদ্যুতিক মিটারে এক ইউনিট বলতে এক কিলোওয়াট ঘণ্টাকে বোঝায়। এক অশ্বক্ষমতা = ৭৪৬ ওয়াট। জেমস ওয়াটের সংজ্ঞা অনুযায়ী এক সেকেন্ডে একটি ঘোড়ার ৫০০ পাউন্ড পরিমাণের ওজন মাটি থেকে এক ফুট ওপরে উত্তোলনের ক্ষমতাই  এক অশ্বক্ষমতা।

বর্তমান জগতে যে দেশ প্রযুক্তি-বিজ্ঞানে যতো উন্নত এবং আণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পেরেছে, সেই দেশ ততো ক্ষমতাবান । পৃথিবীর মাট ৯টি দেশের হাতে এখন ৯ হাজার পরমাণু বোমা আছে - যদিও স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর এ সংখ্যা আগের চেয়ে কমে গেছে। পরমাণু বোমাগুলো অনেক ক্ষেত্রে বসানো আছে ক্ষেপণাস্ত্রের মাথায়। তা ছাড়া আছে বিভিন্ন সামরিক বিমান-ঘাঁটিতে বা অস্ত্রের গুদামে।

বিভিন্ন দেশে এখন শত শত পারমাণবিক বোমা বসানো-ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা আছে। আমেরিকান ক্ষেপণাস্ত্রগুলো বসানো আছে বেলজিয়াম, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, এবং তুরস্কে - সব মিলিয়ে এগুলোর সংখ্যা প্রায় ১৫০। অন্তত ১৮০০ পরমাণু বোমা আছে, যেগুলো খুব স্বল্প সময়ের আদেশে নিক্ষেপ করা যাবে। পারমাণবিক বোমা একইসঙ্গে ভয় দেখানো ও ভয় পাবার অস্ত্র হয়ে উঠেছে এবং পৃথিবীর কয়েকটি দেশকে অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান করেছে ।

 

দুই

 

জীববিজ্ঞানে,  আধিপত্যের শ্রেণিবিন্যাস থাকে, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘পেকিং অর্ডার’। তা হল এক ধরনের সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস, যাকে বিভিন্ন প্রাণীর সামাজিক গোষ্ঠীর সদস্যরা মান্যতা দেয় । এটা ক্ষমতার সিঁড়ি । সিঁড়ির একেবারে ওপরের প্রাণীটাকে, যেহেতু সে প্রভাবশালী আর বলশালী , তাকে কখনও কখনও ক্ষমতার ‘আলফা’ পুরুষ বা  ‘আলফা’ নারী বলা হয়, আর তার তলাকার প্রাণীরা, যারা  বশ্যতা স্বীকার করে সিঁড়ির তলাকার বিভিন্ন পাদানিতে থাকে, তাদের ‘বিটা’ পুরুষ না ‘বিটা’ নারী বলা হয়। বিভিন্ন ধরনের মিথস্ক্রিয়া, আগ্রাসন বা সরাসরি শারীরিক হিংস্রতার আনুষ্ঠানিক প্রদর্শন করে নিজের প্রজাতির ওপর যে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে সে ‘আলফা’ হয়ে ওঠে। পশুদের সামাজিক  গোষ্ঠীগুলোয়, সদস্যরা সীমিত সংস্থান আর সঙ্গমের অধিকার পাবার জন্য প্রতিযোগিতা করে । অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, প্রতিবার দেখা হলে, লড়াই করার বদলে, একই লিঙ্গের এককদের মধ্যে আপেক্ষিক পদমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়, সিঁড়ির উঁচু তলার এককরা প্রায়ই সংস্থান আর সঙ্গীদের সঙ্গে সম্পর্কের সুবিধা আরও বেশি করে পায়।  

 

পশুগোষ্ঠীতে পুনরাবৃত্তিমূলক মিথস্ক্রিয়াগুলোর ওপর ভিত্তি করে, একটা সামাজিক শৃঙ্খলা গড়ে ওঠে । এই  ক্ষমতাধর একককে একজন অধস্তন একক চ্যালেঞ্জ করে যদি হারিয়ে  জিতে যায় তাহলে নতুন একক হয়ে ওঠে গোষ্ঠীর ক্ষমতাধর আলফা আর পুরোনো আলফা চলে যায় নির্বাসনে । সিংহ ও অন্যান্য বলশালী প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায় যে নিজেরই পুরুষ সন্তান বড়ো হয়ে উঠলে তাকে গোষ্ঠী থেকে মারধর করে তাড়িয়ে দেয়া হয় যাতে বুড়ো বাপকে যুবক ছেলে না হারিয়ে দিতে পারে, অর্থাৎ তারাও রাজনীতি করে। তার মানে বন্য পশুদের গোষ্ঠীতে ক্ষমতা দখল করা আর দখলে রাখা হয় মারামারি, এমনকী খুনোখুনি করে। হয়তো গুহামানবদের সমাজে  এরকম কোনও সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের রীতি ছিল । ক্রমশ সভ্য হতে থাকার দরুন মানবসমাজে ক্ষমতার সংজ্ঞায়ন পালটাতে থেকেছে ; যা নির্ভর করেছে তাদের গোষ্ঠীবদ্ধতা আর অন্য গোষ্ঠিকে আক্রমণের অস্ত্র-শস্ত্র আবিষ্কারের ওপর । ভারতে কিন্তু লোকসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে বলশালীরা ক্ষমতা দেখায় পশুদের মতন খুনোখুনি করে, এলাকা-ছাড়া করে ।

 

মানবসমাজে অভিপ্রেত ফললাভের সামর্থ্য থেকে ক্ষমতার উৎসার। হ্যান্স জে মরগ্যানথাউ-এর মতে, ক্ষমতা হল অন্যের বা অন্যান্যদের মন ও কাজকর্মের উপর একজন বা বহু মানুষের নিয়ন্ত্রণ। মরগ্যানথাউ 'রাজনৈতিক ক্ষমতা' বলতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধিকারীদের নিজেদের মধ্যে এবং সাধারণভাবে তাদের সঙ্গে জনগণের পারস্পরিক নিয়ন্ত্রমূলক সম্পর্ককে বােঝাতে চেয়েছেন। আরেকজন সমাজতাত্বিক, অর্গানস্কির মতে, নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী অন্যের আচরণকে নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত করার সামর্থ্যকে ক্ষমতা বলে। জোসেফ ফ্রাঙ্কেল-এর মতে, অন্যের মন ও কাজ নিয়ন্ত্রণ করে কাঙ্ক্ষিত ফললাভের সামর্থ্যই হল ক্ষমতা।  সুতরাং বলা যায় যে, ক্ষমতা হল এক ধরনের সম্পর্ক, যার মাধ্যমে কোনাে ব্যক্তি বা রাষ্ট্র ইচ্ছামতাে অন্যদের কাজ করতে বাধ্য করে। তবে মনে রাখতে হবে ক্ষমতাকে অনেকসময় প্রভাবের সঙ্গে সমার্থক বলে মনে করা হয়, বাস্তবে কিন্তু ক্ষমতা ও প্রভাব এক নয়। প্রভাবের ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছানুযায়ী কোনাে কাজ করানাের মানসিকতাকে বােঝায়, কিন্তু ক্ষমতার সঙ্গে ভীতি প্রদর্শনের ব্যাপার জড়িয়ে আছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী শ্লেইচার-এর মতে, কাউকে ভয় দেখিয়ে বা প্রলােভনের দ্বারা পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে কোনাে কাজ করানাে বা তাকে নিজের মতে আনার সামর্থ্য হল ক্ষমতা। কলম্বাস এবং উল্ফে তাঁদের ‘অ্যান ইনট্রোডাকশান টু ইনটারন্যাশানাল রিলেশানস’ বইতে বলেছেন যে, অর্থনীতিতে সম্পদের যেমন গুরুত্ব, রাজনীতিতে ক্ষমতা বা শক্তির  গুরুত্ব সেরকম । অর্থাৎ ক্ষমতা বা শক্তি হল প্রভাব ও বলপ্রয়ােগের মিশেল ।

সোভিয়েত ইউনিয়ান ভেঙে যাওয়া, যুগোস্লাভিয়ার টুকরো-টুকরো হওয়া, আমেরিকার ভিয়েতনাম, ইরাক, লিবিয়া, সোমালিয়া, আফগানিস্তান আক্রমণ আর রাশিয়ার ইউক্রেণ আক্রমণ, রাশিয়ার ইউরোপকে খনিজ তেল দেয়া নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি থেকে স্পষ্ট যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতিতে ক্ষমতা বা শক্তি হল গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় ধারণা। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল  বিষয় হল ক্ষমতা বা শক্তি।  জাতীয় স্বার্থ ও নীতি অনুযায়ী অন্য রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন জাতীয় শক্তি বা ক্ষমতা। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অনেকাংশে ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুটি অনুমানের উপর ভিত্তি করে ক্ষমতার ধারণা গড়ে উঠেছে। প্রথমত, যুদ্ধ করার সামর্থ্যকে ক্ষমতা বােঝায় । দ্বিতীয়ত, ক্ষমতা কতোটা আছে। তবে আন্তর্জাতিক ক্ষমতার পরিমাপ করা সহজ নয়, কারণ বর্তমানে ক্ষমতার সঙ্গে বহু বােধগম্যহীন উপাদানও জড়িয়ে আছে । এখন  একটা রাষ্ট্র একলা নিজেকে ক্ষমতাধর হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে না, যেমন দেখা যাচ্ছে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ক্ষেত্রে । নানা দেশের নানারকম স্বার্থ জড়িয়ে থাকে ।  আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামরিক ক্ষমতার গুরুত্ব থাকলেও অর্থনৈতিক বিকাশ, প্রাকৃতিক সম্পর্ক, ভৌগােলিক অবস্থান, জনসংখ্যা, জাতীয় চরিত্র ও আত্মবিশ্বাস, কূটনীতি ইত্যাদি অসামরিক উপাদানগুলো শক্তি বা ক্ষমতার বিশ্লেষণে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

ক্ষমতার ধারণাটা  ব্যাপক। ক্ষমতা বলতে শুধু বলপ্রয়ােগ বা বলপ্রয়োগের সামরিক ভীতি প্রদর্শনকেই বােঝায় না, সেইসঙ্গে অর্থনৈতিক পুরস্কার, মতাদর্শগত ঐক্য, আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে নিজের বক্তব্যের সপক্ষে অন্যকে নিয়ে আসাকেও বােঝায়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাউকে কোনাে কাজ করতে বাধ্য করার সামর্থ্যকে ক্ষমতা বলা হয়। কিন্তু প্রভাব বলতে বলপ্রয়ােগ না করে অন্যকে দিয়ে কোনাে কাজ করানাে বা কাজ থেকে বিরত করাকে বােঝায়। অর্থাৎ ক্ষমতা ও প্রভাব সমার্থক নয়। ক্ষমতা হল বলপ্রয়োগ আর প্রভাবের মধ্যবর্তী সমন্বয়কারী ধারণা। এখন যেমন দেখা যাচ্ছে চীন ঋণের বোঝা চাপিয়ে ক্ষমতা আর প্রভাব দুটোই ব্যবহার করতে পারছে । 

ক্ষমতা বা শক্তি একটা কেন্দ্রীয় ধারণা হিসেবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রকে ক্ষমতা বা শক্তির ভিত্তিতে অতি-বৃহৎ শক্তি, বৃহৎ-শক্তি, মাঝারি-শক্তি, ক্ষুদ্র-শক্তি ইত্যাদি হিসেবে স্তরবিন্যাস করা হয়েছে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সােভিয়েত ইউনিয়ন অতিবৃহৎ শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল । কিন্তু সােভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বর্তমানে চীন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের দুটি মহাক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সিকিউরিটি কাউন্সিলে ভিটো প্রয়োগ করার অধিকার কয়েকটা রাষ্ট্রকে বিশেষ ক্ষমতাধর করে তুলেছে । তবে বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বিশ্ব-জনমতের গুরুত্ব আর তাৎপর্য বেড়েছে, কেননা অন্য দেশের বাজারে জিনিসপত্র বিক্রি করতে পারাও এখন ক্ষমতার উপাদান । ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষমতার ধারণার রদবদল ঘটেছে। এখন কোনো কমজোর দেশ আক্রান্ত হলে সেখানকার রাষ্ট্রযন্ত্র মানসিকভাবে হতাশ হয়ে পড়ে না; বরং অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমবেত হয়ে তারা  প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা দেয় । বর্তমান কালখণ্ডে একটি রাষ্ট্র শান্তি, নিরাপত্তা ও জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে।

একটা রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের ওপর দাদাগিরি ফলানোর মধ্যেই রাষ্ট্রটার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ নয় । রাষ্ট্রের বিভিন্ন সিঁড়িতে বসে থাকা লোকেরা একা, আর তারা একসঙ্গে মিলেমিশে, নাগরিকদের ওপর ক্ষমতা ফলায় । লুই আলথুজার তাঁর  ‘আইডিওলজি অ্যান্ড আইডিওলজিকাল স্টেট অ্যাপারেটাসেস’ প্রবন্ধে  রাষ্ট্র আর তার নাগরিকদের মধ্যে ক্ষমতা প্রয়োগের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন । অ্যালথুজার জিজ্ঞাসা করছেন কেন প্রজারা বাধ্য, কেন লোকেরা আইন মেনে চলে আর কেনইবা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা বিপ্লব হয় না। অ্যালথুজারের মতে রাষ্ট্র হল এক ধরনের সরকার গঠন যা পুঁজিবাদের সাথে উদ্ভূত হয়। একটি রাষ্ট্র, পাঠক এখানে 'জাতি' শব্দটা প্রতিস্থাপন করতে পারেন,  'রাষ্ট্র' ধারণাটাকে বোঝার জন্য, এটা পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির দরুন গড়ে ওঠে, আর তার স্বার্থ রক্ষা করে । উনি বলেছেন, এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য, আপনি একজন মার্কসবাদী হোন বা না হোন, বিচ্ছিন্ন একক হিসেবে জাতির ধারণা পুঁজিবাদের সাথে সাংঘর্ষিক। এটাও সম্ভব যে গণতন্ত্র, একটা মতাদর্শ এবং/অথবা একটি সরকারী রূপ হিসাবে পুঁজিবাদের সাথে মিলিত, কারণ গণতন্ত্র ভুল বুঝিয়ে বলে যে সকল মানুষ সমান, আর সবায়ের সমান ক্ষমতা রয়েছে আর তাই অর্থনৈতিক শোষণের সম্পর্কের মুখে একটা মুখোশ পরিয়ে দেয়।

অ্যালথুজার মনে করেন একটা রাষ্ট্রে বসবাসকারী লোকেরা যাতে সেই রাষ্ট্রের নিয়ম মেনে চলে তা নিশ্চিত করার জন্য দুটি প্রধান প্রক্রিয়া আছে, এমনকি যখন তা করা হয়, সেটা  তাদের শ্রেণী অবস্থানের ক্ষেত্রে তাদের সর্বোত্তম স্বার্থে মোটেই করা হয় না । প্রথমটা হল, যাকে অ্যালথুজার বলেছেন ‘দমনমূলক রাষ্ট্রীয় অ্যাপারেটাস’ , যা নাগরিকদের ওপর সরাসরি প্রয়োগ করা হয়, যেমন পুলিশ এবং ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা। এই 'অ্যাপারেটাসগুলোর' মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রয়োগ করে, যার দ্বারা নাগরিককে বা নাগরিকদের ওপর শারীরিক আর মানসিক অত্যাচার করা হয় । আলথুসার  দ্বিতীয় প্রক্রিয়াকে বলেছেন ‘মতাদর্শগত রাষ্ট্রীয় অ্যাপারেটাস’ । এগুলো এমন প্রাতিষ্ঠানিক ঘাঁটি যা মতাদর্শ তৈরি করে নাগরিকদের বিলোয়, যা  ব্যক্তি-একক (এবং গোষ্ঠী)  অনুসরণ করে, প্রকৃতপক্ষে মেনে নিতে বাধ্য হয়, আর সেই অনুযায়ী কাজ করে। এই অ্যাপারেটাসের মধ্যে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গুপ্তচর-ব্যবস্হা, ধর্ম, পরিবার, আইনি ব্যবস্থা, রাজনীতি, শিল্পকলা, সংবাদপত্র, খেলাধুলা - এমন সংগঠন যা ধারণা এবং মূল্যবোধের কাঠামো তৈরি করে, যা  ব্যক্তি হিসাবে নাগরিকদের বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ে। এটাই আলথুজারের প্রধান উদ্বেগ: কীভাবে আমরা রাষ্ট্র ও তার যন্ত্রের তৈরি করা মতাদর্শগুলোকে নিজের বলে মেনে নিই , বিশ্বাস করি আর  এইভাবে পুঁজিবাদকে নিজেদেরকে অপরিবর্তনীয় বনেদ হিসাবে ভুলভাবে চিনতে বা ভুলভাবে উপস্থাপন করতে আরম্ভ করি।

আলথুজারের বক্তব্য মতাদর্শ আর আদর্শের মধ্যে পার্থক্য দিয়ে শুরু হয়। মতাদর্শ নির্দিষ্ট, ঐতিহাসিক এবং ভিন্ন । মানুষ বিভিন্ন মতাদর্শ সম্পর্কে কথা বলতে পারে, যেমন ইসলামি মতাদর্শ, হিন্দু মতাদর্শ, গণতান্ত্রিক মতাদর্শ, নারীবাদী মতাদর্শ, মার্কসবাদী মতাদর্শ। মতাদর্শ ব্যাপারটা কাঠামোগত। আলথুসার বলেছেন যে মতাদর্শ একটা কাঠামো, যাকে লোকে 'শাশ্বত' বলে মনে করে ।  এই কারণেই আলথুসার মনে করেন যে আদর্শের কোনো ইতিহাস নেই। তিনি মার্কসবাদী ধারণা থেকে কাঠামো হিসাবে আদর্শের এই ধারণাটি গ্রহণ করেছেন, যে, আদর্শ হল ‘সুপারস্ট্রাকচারের অংশ’, তবে তিনি ফ্রয়েড এবং লাকাঁর কাছ থেকে নিয়ে মতাদর্শের কাঠামোকে অচেতনের ধারণার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। যেহেতু মতাদর্শ একটি কাঠামো, তার বিষয়বস্তু পরিবর্তিত হবে, লোকে এটা যে কোনও কিছু দিয়ে পূরণ করতে পারে - তবে এর আঙ্গিক, অচেতনের কাঠামোর মতো, সর্বদা একই থাকে।  মতাদর্শ 'অচেতনভাবে' কাজ করে। ভাষার মতো, মতাদর্শ হল একটি কাঠামো বা ব্যবস্থা, যার ঘেরাটোপে আমরা বাস করি, যা আমাদের কথা বলে, অথচ যা আমাদের এই বিভ্রম দেয়, যে, আমরা দায়িত্ববান, আর আমাদের দায়িত্ব, প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েছে । লোকেরা যে বিষয়গুলোতে বিশ্বাস করে তার বিষয়বস্তু তারা স্বাধীনভাবে বেছে নেয়, আর বিশ্বাস করার অনেক কারণ খুঁজে পেতে পারে, কেননা লোকেদের মাথায় ঘোল ঢেলে  এই ব্যাপারগুলোতে বিশ্বাস করানো হয় । যেমন ইসলামে বিশ্বাসকারী মতাদর্শ আল কায়দা, আল শবাব, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন, জামাত-ই-ইসলামি, হিজবুল মুজাহাদিন, তেহরিক-ই-ইসলামি, ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট, লস্কর-ই-তৈয়বা, জইশ-ই-মুহাম্মদ ইত্যাদি ।  যেমন হিন্দুদের অভিনব ভারত, অখিল ভারতীয় একহারা পরিষদ, ভাজপা, শিব সেনা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, হিন্দু মুনানি, পনুন কাশ্মীর, অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা, শ্রীরাম সেনা ইত্যাদি ।

অ্যালথুজারের তত্বের প্রথম বক্তব্য হল এই, যে, 'মতাদর্শ  ব্যক্তিদের তাদের অস্তিত্বের বাস্তব অবস্থার সাথে কাল্পনিক সম্পর্কের  "প্রতিনিধিত্ব" করে ।' উনি প্রশ্ন তোলেন যে  কেনই বা মানুষের অস্তিত্বের বাস্তব অবস্থার সাথে এই কাল্পনিক সম্পর্ক প্রয়োজন হয় । কেন লোকেরা  বুঝতে পারে না বাস্তব আসলে কী ? আলথুজারের মার্কসবাদী উত্তর হল যে, বাস্তব অবস্থার বস্তুগত বিচ্ছিন্নতা মানুষকে এমন পরিস্হিতি তৈরি করতে প্ররোচিত করে, যা তাদের এই বাস্তব অবস্থা থেকে  বিচ্ছিন্ন  করে রাখে। অন্য কথায়, পুঁজিবাদী উত্পাদনের বস্তুগত সম্পর্কগুলো নিজেরাই বিচ্ছিন্ন, কিন্তু মানুষ এর কঠোর বাস্তবতাকে মোকাবেলা করতে পারে না, তাই তারা যুক্তি দেয়, যে, উত্পাদন সম্পর্কগুলো এতটা খারাপ নয় । এই তর্ক বা উপস্থাপনা,  তাদের বিচ্ছিন্ন-বাস্তব  অবস্থা থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে। অবস্হাটা যেন একরকমের বেদনানাশক, ওষুধের ট্যাবলেটের মতো কাজ করে, যা তাদের বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা অনুভব করা থেকে বিরত রাখে । যদি তাদের কাছে এই গল্পগুলো না থাকত, তারা উত্পাদনের প্রকৃত সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা জানতে পারতো আর  সম্ভবত বিদ্রোহ করতো ।

আলথুজারের তত্বের দ্বিতীয় বক্তব্য হলো যে ‘মতাদর্শের একটা বস্তুগত অস্তিত্ব আছে।’ মার্কসবাদীদের জন্য সর্বদা বস্তুগত অনুশীলন, বস্তুগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের বিশ্লেষণের ভিত্তি রাখা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার । মার্কসবাদীদের ধারণা সম্পর্কে কথা বলার জন্য,  তাদের উপাদান হিসাবে কথা বলতে হবে। আলথুজার দৃঢ়ভাবে দাবি করেন, যে, মতাদর্শ সর্বদা দুটি জায়গায় বিদ্যমান  - একটা যন্ত্র বা অনুশীলনে (যেমন একটি আচার, বা নির্দিষ্ট আদর্শ দ্বারা নির্দেশিত আচরণের অন্যান্য রূপ) এবং একটা বিষয়ের মধ্যে, একজন ব্যক্তির মধ্যে - যিনি, সংজ্ঞা অনুযায়ী, একটা উপাদান । জাক লাকাঁ আর দেরিদার বক্তব্য ধার করে বলা যায়, যে, আলথুজার অন্যান্য পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্ট তাত্ত্বিকদের একজন মেলবন্ধনকারী ছিলেন। তিনি ফ্রয়েড দ্বারা মন্ত্রমুগ্ধ, আবার ল্যাকাঁ দ্বারা আরও বেশি  মন্ত্রমুগ্ধ; উনি মতাদর্শ সম্বন্ধে নিজের ধারণাগুলো সরাসরি লাকাঁ থেকে নিয়েছেন। 

আলথুজার মারা যান ১৯৯০ সালে । তাই দেখে যেতে পারেননি কেমন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল সোভিয়েত রাষ্ট্র এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট দেশগুলো, প্রধানত সমগ্র সমাজে আর ব্যক্তি-নাগরিকদের ওপর ক্ষমতার ভুল প্রয়োগের কারণে । একটিমাত্র দল হয়ে উঠেছিল সর্বেসর্বা । ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গড়ে ওঠে পনেরোটা স্বাধীন রাষ্ট্র। ফলে রাশিয়া আন্তর্জাতিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরাধিকারী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হয়।  ১১ই মার্চ ১৯৯০ সালে লিথুয়ানিয়া প্রথম নিজের স্বাধীনতা ঘোষণা করে, সঙ্গে ইস্তোনিয়া ও লাতভিয়াও ১৯৯১ সালের আগস্ট মাসে নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। বাদবাকি বারোটা প্রজাতন্ত্রও পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে, ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে  স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে  প্রতিষ্ঠিত  হয়। বর্তমানে বারোটা সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র এখন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে রাষ্ট্রমণ্ডলের সদস্য।

ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু হয়েছিল জোসেফ স্তালিনের মসনদে বসার সময় থেকে। ক্ষমতা কাকে বলে জিগ্যেস করলে বলতে হবে জোসেফ স্তালিন যা করতেন, তাকে । ১৯২২ সালে লেনিন এর প্রথম স্ট্রোকের পর স্তালিন পার্টির প্রায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন এবং লেনিনকে সোভিয়ের জগত থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। যার ফলে পার্টির সিনিয়র নেতারা বিরাগভাজন হন। লেনিনও ধীরে ধীরে স্তালিনের স্বেচ্ছাচারিতা, অভদ্র আচরণ, উচ্চাকাঙ্খায় ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে পরিশেষে পার্টির সর্বোচ্চ পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলার প্রস্তাব দেন। কিন্তু স্তালিনের কুটচালে তা আর কখনো সম্ভব হয়নি। জনসম্মুখে লেনিনের শেষ ইচ্ছাপত্র সম্পূনর্রূপে  কখনো প্রকাশ পায়নি। পার্টির অন্যান্য প্রভাবশালী যে নেতারা সেটা প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন- তাদের পার্টি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। ট্রটোস্কিকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেই থেকে শুরু হয়েছিল স্তালিনের ক্ষমতা প্রয়োগের স্বেচ্ছাচারিতা আর নিশ্বংসতা,  সেই সাথে গোপনীয়তা, যা বজায় ছিল তার ক্ষমতার শেষ দিন পর্যন্ত। স্তালিন যদি একনায়কতন্ত্রিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে মসনদে না বসাতেন, তাহলে মার্কসবাদী রাষ্ট্রগুলো হয়তো ভিন্নভাবে বিকশিত হতো ।

সোভিয়েত ক্ষমতা কাঠামো সম্পর্কে জর্জ অরওয়েল ‘১৯৮৪’ উপন্যাসে এই কথাগুলো লিখেছিলেন : “এখন আমি আপনাদের কথাটা বলব। ব্যাপারটা এই : পার্টি সম্পূর্ণভাবে নিজের স্বার্থে ক্ষমতা চায়। আমরা অন্যের ভালোর প্রতি আগ্রহী নই; আমরা শুধুমাত্র ক্ষমতা, বিশুদ্ধ ক্ষমতায় আগ্রহী. বিশুদ্ধ শক্তি বলতে কী বোঝায় আপনি এখনই বুঝতে পারবেন। আমরা অতীতের অলিগার্কি থেকে আলাদা কেননা আমরা জানি আমরা কী করছি। অন্য সবাই, এমনকি যারা আমাদের মতন ছিল, তারা ছিল কাপুরুষ ও ভন্ড। জার্মান নাৎসি আর রাশিয়ান কমিউনিস্টরা তাদের পদ্ধতিতে আমাদের খুব কাছাকাছি এসেছিল, কিন্তু তারা কখনই তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্যগুলোকে চিনতে সাহস পায়নি। তারা ভান করেছিল, সম্ভবত তারা বিশ্বাস করেছিল যে, তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে এবং সীমিত সময়ের জন্য ক্ষমতা দখল করেছে আর কোথাও একটা স্বর্গ রয়েছে যেখানে মানুষ স্বাধীন আর সমান হবে। আমরা এমন নই। আমরা জানি যে কেউ কখনও ক্ষমতা ত্যাগ করার ইচ্ছা নিয়ে তা দখল করে না। ক্ষমতা কোন মাধ্যম নয়; সেটা একটা সমাপ্তি । বিপ্লবকে রক্ষা করার জন্য কেউ স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করে না; একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লব ঘটায়। নিপীড়নের জন্যই নিপীড়ন। নির্যাতনের জন্য যাদের বেছে নেওয়া হয়েছে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়। ক্ষমতা হলো  শক্তি। এখন তুমি আমাকে বুঝতে পারছ তো !”

অভিধা হিসেবে, ক্ষমতায়ন শব্দটা আমেরিকান  সমাজ বিজ্ঞানী জুলিয়ান রাপাপোর্টের তৈরি। যদিও ক্ষমতায়ন তত্ত্বের শেকড় ইতিহাসে আরও প্রসারিত এবং মার্কসবাদী সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্বের সাথে যুক্ত। এই সমাজতাত্ত্বিক ধারণাগুলো নব্য-মার্কসবাদী তত্ত্বের মাধ্যমে বিকশিত এবং পরিমার্জিত হয়ে চলেছে। ক্ষমতায়ন হল মানুষ এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বায়ত্তশাসন এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের মাত্রা। এটা তাদের নিজস্ব কর্তৃত্বে সহায়ক একটা দায়িত্বশীল আর স্ব-নির্ধারিত উপায়ে তাদের স্বার্থের সুরক্ষা করতে সক্ষম করে তোলে । এটা আসলে শক্তিশালী আর আত্মবিশ্বাসী হওয়ার প্রক্রিয়া, বিশেষ করে নিজের জীবন নিয়ন্ত্রণ করা, আর নিজের অধিকার দাবি করার প্রক্রিয়া। কাজ হিসেবে ক্ষমতায়ন বলতে আত্ম-ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া আর জনগণের পেশাদার সমর্থন, দুটোই বোঝায়, যাতে তারা তাদের ক্ষমতাহীনতা এবং প্রভাবের অভাবকে কাটিয়ে উঠতে আর তাদের সংস্থানগুলোকে চিনতে এবং ব্যবহার করতে সক্ষম করে। ভারতে নিম্নবর্ণের লোকেদের ক্ষমতায়ন খুবই জরুরি আর তাই বিভিন্ন রাজ্যে দলিতেরা নিজেদের অধিকার চাইছে, আন্দোলন করছে । মায়াবতী একটা রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন দলিতদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য । ভারতের সংবিধানে দলিতদের ক্ষমতায়নের জন্য চাকুরির ও শিক্ষার কোটা দেয়া হয়েছে । মণ্ডল কমিশন অন্যান্য নিম্নবর্ণের জন্য বিশেষ কোটার দ্বারা ক্ষমতায়নের সুপারিশ করেছিলেন যাকে ভারত সরকার ও বিভিন্ন রাজ্য সরকার মান্যতা দিয়েছে । তবু, দলিতদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন সম্ভব হয়নি জাতিপ্রথার কারণে ।

তিন

সমাজে ক্ষমতার উৎস কী অথবা কীভাবে এই ক্ষমতা কাজ করে তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন তাত্ত্বিকরা মত দিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করেছে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রকে। ম্যাকিয়াভেলি তার 'দ্য প্রিন্স' বইয়ে সরকারের ইচ্ছানুযায়ী সর্বোচ্চ শক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতাকে ন্যায্যতা দিয়েছেন। অন্য দিকে থমাস হবস তার 'Leviathan' বইয়ে মানুষের খারাপ দিকগুলো ঠেকানোর জন্য একজন রাজার হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা তুলে দিতে বলেচিলেন। ইতিহাসে বেশিরভাগ  তাত্ত্বিক ক্ষমতার সাথে রাষ্ট্রের যোগসূত্র স্থাপন করেছেন। কেউ কেউ ক্ষমতাকে সামাজিক কাঠামোর একটা উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, এই চিন্তাধারায় ক্ষমতা হচ্ছে এমন ব্যাপার যা কেউ নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারে আর তা ব্যবহার করতে পারে। ষাটের দশক পর্যন্ত ক্ষমতা সম্পর্কীয় তত্ত্ব দু'ভাগে বিভক্ত ছিল । একটা হলো জনগণের ওপর সরকার বা রাষ্ট্রের ক্ষমতা, অন্যটা হলো বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েতের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের মার্কসীয় চিন্তাধারা। সেই তত্ত্বগুলো ছিল মূলত সামষ্টিক পর্যায়ের (Macro Level)।

মিশেল ফুকোর ক্ষমতাতত্ব আলোচনাকালে বিনায়ক সেন বলেছেন “ক্ষমতা অর্থাৎ Power বিষয়টিকে ফুকো যেভাবে দেখেছেন, যত বিভিন্ন উপায়ে তার বিশ্নেষণ করেছেন, সেভাবে তাঁর আগে কোনো দার্শনিকই ব্যাখ্যা করেননি। মার্কস যেমন পুঁজির রহস্য-উন্মোচনের জন্য পৃথিবীজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন, ফুকোও তেমনি ক্ষমতার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর সব কথা মানতেই হবে এমন নয়। এ নিয়ে আরেক ফরাসি দার্শনিক জাক দেরিদার সাথে তাঁর উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছে। জার্মান দার্শনিক জুরগেন হাবেরমাসের সাথেও বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু সবাই এ কথা স্বীকার করেছেন যে, তাঁকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।  ক্ষমতা বিষয়ে ফুকোর আলোচনাকে (যাকে তিনি বলেছেন 'ডিসকোর্স', এ শব্দটি তাঁরই উদ্ভাবন) কয়েকটি শিরোনামে ভাবা যায়। এর মধ্যে রয়েছে ম্যাক্রো ও মাইক্রো পাওয়ার, 'ডিসিপ্লিনারি' পাওয়ার, নরমালাইজিং পাওয়ার, 'বায়ো পাওয়ার' ইত্যাদি। এসব ধারণা ফুকোর বিভিন্ন পর্যায়ের লেখায় উঠে এসেছে। অর্থাৎ  ক্ষমতা প্রসঙ্গে ফুকো চিরকাল একই ভাবনা ভাবতেন না।  ক্ষমতার 'প্রাণভোমরা' ছড়িয়ে আছে নানা স্থানে, সমাজ-শরীরের সর্বত্র। বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল-ক্লিনিক, জেলখানা, বিচারালয়, পত্রিকার অফিস, টিভি চ্যানেল, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-এনজিও, উপাসনালয়, পাড়ার ক্লাব, মহল্লার সংগঠন, পরিবারের ভেতরে, এমনকি ব্যক্তিসত্তার মধ্যেও। এরকম অপ্রত্যাশিত স্থানে উৎকীর্ণ হয়ে আছে ক্ষমতার ছাপ । অর্থাৎ ফুকো এ কথা বোঝাতে চেয়েছেন, সর্বত্র অশুভ 'ক্ষমতা-চর্চা'র প্রতিবাদ-প্রতিরোধ না করতে পারলে শুধু রাষ্ট্র-ক্ষমতা বদলে সর্বাত্মক পরিবর্তন আসবে না, বা এলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না।

মিশেল ফুকোর ম্যাক্রো বনাম মাইক্রো পাওয়ার ব্যাখ্যা করে বিনায়ক সেন বলেছেন, “সাধারণত আমরা 'পাওয়ার’ বলতে রাষ্ট্র-ক্ষমতা বা রাজ-ক্ষমতাকে বুঝি । এই ক্ষমতা 'ওপর থেকে' প্রয়োগ করা হয় । এই ক্ষমতা যিনি 'রাষ্ট্রের প্রধান' (যেমন রাজা, প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী), তারই শুধু চর্চার বিষয় নয়, তার অধীনস্থ রাষ্ট্র-যন্ত্র (প্রশাসন, প্রতিষ্ঠান, বিধিমালা, আইন-কানুন) এই চর্চার অংশ। আধুনিক রাষ্ট্র-ক্ষমতার প্রয়োগ ও পরিধিকে ঘিরে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই এক আইনি আলোচনা গড়ে উঠতে থাকে। যাকে ফুকো বলেছেন 'লিগ্যাল-জুরিডিক্যাল ডিসকোর্স'। এই আলোচনার মূল মনোযোগ ছিল রাষ্ট্র-ক্ষমতার পরিধিকে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিরূপণ করা। রাজা সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন, কিন্তু নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে যেতে পারবেন না। তেমনি, প্রজারাও সকল অধিকার ভোগ করতে পারবেন, কিন্তু নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে বাড়তি কিছু প্রত্যাশা করতে পারবে না। এভাবে রাজা ও প্রজার মধ্যে যার যার অধিকার নির্দিষ্ট করে ক্ষমতা প্রয়োগের একটি সাংবিধানিক ও আনুষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার ও নাগরিকদের যার যার অধিকার রক্ষাপূর্বক ক্ষমতা-প্রয়োগের স্বীকৃত কাঠামোকে নানা ধরনের রক্ষাকবচ দিয়ে আরো যুক্তিসিদ্ধ করে তোলা হয়েছে। আমেরিকায় যেমন ট্রাম্পের শাসনকালে প্রেসিডেন্টের প্রভূত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, ট্রাম্প তাঁর ইচ্ছামতো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেননি । সেখানে কংগ্রেস-সেনেটের অনেক নিয়ম-নীতির রক্ষাকবচ তাঁকে আটকেছে। তার ওপরে স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং সর্বোপরি সুপ্রিম কোর্টের অলঙ্ঘনীয় ছায়া ছিল।

সাংবিধানিক বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যায় রাষ্ট্রের বিধিমালা ও আইন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তম্ভের (আইন-প্রণয়ন, বিচার ও প্রশাসন) মধ্যে দায়িত্ব-বণ্টন, সরকারের পরিচালনা পদ্ধতি, বিভিন্ন দপ্তর-মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির ক্ষমতার ব্যবহার ও অপব্যবহার নিয়ে মাঝে মাঝেই 'টেনশন' সৃষ্টি হয় এবং তা নিষ্পত্তির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। বলা দরকার, সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে গড়ে ওঠা 'অধিকারের ভাষায়' (Rights based discourse) নির্মিত ক্ষমতা-প্রয়োগের এই ডিসকোর্সকে ফুকো অস্বীকার করছেন না। এই ক্ষমতা-প্রয়োগের অংশ হিসেবে মার্কস, গ্রামসি বা আলথুজার যখন 'আইডিওলজিক্যাল অ্যাপারেটাস অব স্টেট'-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করছেন, সেটিকেও ফুকো অস্বীকার করছেন না। তিনি শুধু বলছেন, সুদূর প্রাচীন বা মধ্যযুগেও রাজশক্তি যে টিকে ছিল, তা শুধু কর্তৃত্ব প্রয়োগের মাধ্যমেই অর্জিত হয়নি। আধিপত্য বিস্তার (ডমিনেশন) যেমন তাতে ছিল, তেমনি ছিল আধিপত্য-প্রয়োগের ন্যায্যতা সম্পর্কে 'সত্যের প্রচার'।

 ফুকোর 'রেজিম অব ট্রুথ' এবং গ্রামসির 'হেজিমনি' ধারণার মধ্যে মিল আছে। তবে সব রেজিম অব ট্রুথ সর্বেশ্বরতা পায় না। অর্থাৎ হেজিমনিক স্তরে যেতে পারে না। তবে সব রাজাকেই ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে সত্যের প্রচার করতে হয়েছে কম-বেশি। ফুকো বলেছেন, Right in the west is the king’s Right ... [The] resurrection of Roman law [in the 12th century] was the major event around which, and on whose basis, the juridical edifice which had collapsed after the fall of the Roman Empire was reconstructed.’  রোমান ল-এর পুনর্জীবনের মধ্য দিয়ে আবার মধ্যযুগের রাজ-রাজড়াদের absolute power’  প্রয়োগের আইনি ও প্রশাসনিক দিকটির সুরাহা করা হয়েছিল। কিন্তু ফুকো বলছেন, তখনও সত্য-উৎপাদন ও তা পরিবেশনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। যেমন, 'মহাভারত'-এর যুগে অনুশাসন-পর্বের বিষয়বস্তু ছিল, আজকের পরিভাষায়, 'গভর্ন্যান্স' বা সুশাসনের প্রয়োগ-বিধির আলোচনা। অর্থাৎ রাজা বা রাজশক্তি কীভাবে যুক্তিসঙ্গতভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ করবেন, রাজার অধিকার কতটুকু, প্রজাদেরই বা অধিকার কতটুকু, তাকে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে সেখানে। 

কৌটিল্যর 'অর্থশাস্ত্র'তে অমন নির্দিষ্ট অধিকারকে বিধিমালা ও আইনের মাধ্যমে আরও সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। উদাহরণত, কৌটিল্য সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ৩২ রকমের দুর্নীতি শনাক্ত করেছেন এবং তার জন্য পৃথক দণ্ডের সুপারিশ করেছেন। সত্য-উৎপাদন ও তা পরিবেশনার তাগিদ না থাকলে আবুল ফজল আইন-ই-আকবরী লিখতেন না। একই কথা বলা যায় ইবনে খালদুনের রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তা বিষয়েও। আধুনিক যুগের রাষ্ট্রতাত্ত্বিকরা যথা হবস, লক, বেন্থাম, মিল প্রমুখ যখন সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক রাজশক্তির ক্ষমতার বৈধতা, গণ্ডি বা চৌহদ্দির সীমা নির্ণয় করতে কলম ধরেছেন, সেটাও সত্য-উৎপাদন ও তা পরিবেশনার প্রয়োজনেই। সার্বভৌম (Sovereignty) যিনি, তাঁর 'ন্যায়সঙ্গত' অধিকার কতটুকু ও কী কী, এটা যেমন তাদের আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল, তেমনি প্রজাদেরও 'আইনসম্মত' অধিকার কতটুকু, সেসব আলোচনায় স্থান পেয়েছে। ফুকো বলছেন, এসব আলোচনা, ডিসকোর্স তথা সত্য-উৎপাদনের মধ্য দিয়ে মূল উদ্দেশ্যটা খোলাসা করে বলা হয়নি। লিবারেল বা কনজারভেটিভ সব ধারারই রাজনৈতিক ভাবুকরা যার যার মতো 'অধিকারের ভাষা' নির্মাণ করেছেন। কিন্তু, তাঁরা এটা করতে গিয়ে আসলে 'ক্ষমতার সম্পর্ক'কেই আড়াল করেছেন।”

হাসনায়েন ইমতিয়াজ সাকিব, মিশেল ফুকোর ক্ষমতাতত্ব আলোচনাকালে বলেছেন, “ক্ষমতার বহুমুখী সম্পর্ক সমাজ তৈরি করে, চরিত্রায়িত করে, অতিক্রম করে অবিরত। সত্যের আলোচনার সাথে যেগুলোকে আলাদা করা যায় না, সেখানে সংগ্রহ, প্রচার ও প্রয়োগ ব্যতীত তাদের প্রতিষ্ঠিত বা কার্যকর করা সম্ভব নয়। সংগ্রহ, প্রচার ও প্রয়োগের ফলে একটা বিষয় সমগ্রভাবে সত্য হয়ে ওঠে, তাকে চেনা যায়। সত্যের আলোচনায় মিতব্যয়ীতা কাজে লাগাতে না পারলে ক্ষমতার সৌজন্যেই তাকে কাজে লাগানো যাবে না। সমাজে ক্ষমতা, অধিকার ও সত্যের ভেতরে এই সম্পর্ক বিদ্যমান এবং সুসংগঠিত।  ক্ষমতাকে আরোহী পদ্ধতিতে বিবেচনা করা উচিত, অর্থাৎ শুরু করতে হবে ক্ষমতার অসীম কলকব্জা থেকে, যাদের নিজস্ব ইতিহাস, নিজস্ব গতিপথ, নিজস্ব কৌশল আছে৷ 

নিজস্ব গুণে মোড়া যে ক্ষমতার কলকব্জা রয়েছে, সেই কলকব্জা নিজস্ব প্রযুক্তি দ্বারা সমাজের প্রতিটি স্তরে তাকে কাজে লাগানো হয়, স্থানচ্যুত করা হয়,  অন্যান্য নিয়ম থেকে, রূপান্তর ঘটানো হয় প্রয়োজন মতো এবং ব্যবহার করা হয় প্রতিটি পদক্ষেপে। এক্ষেত্রে নিচুস্তরে প্রয়োগ করা ক্ষমতার ঘটনা, কৌশল ও কাজকর্মের ধরনকে বিশ্লেষণ করা দরকার । এই বিশ্লেষনের ফলে দেখা যাবে ক্ষমতার কর্মপদ্ধতি মূলত স্থানচ্যুত, প্রসারিত ও পরিবর্ধিত এবং ঘটনা-পরম্পরা সৃষ্টি করে কাজে লাগানোর প্রক্রিয়ায় ডুবে থাকে।  এ ক্ষেত্রে ক্ষমতার প্রকার আর সীমারেখা নিয়ে ফুকোর আলোচনার প্রসঙ্গ ও ভাবনা-জালের বিস্তার শুরু। অধিকারের নিয়ম প্রতিষ্ঠা করাই শ্রেফ ক্ষমতার লক্ষণ, নাকি তা নতুনভাবে পুর্নগঠিতও হতে পারে নব্য উপনিবেশবাদী চরিত্রের মতো, যে চরিত্রের কাজই হলো নতুন উৎপাদিত তথ্য, পণ্য ও সামগ্রী দ্বারা গোটা গোষ্ঠীর একটি মনস্তাত্ত্বিক সম্মতি আদায় করার আপ্রাণ চেষ্টা। এই আদায় করার উপায়ে শারীরিক কসরতকে মাথায় না রেখে মানসিক দাসত্বে রূপান্তর করবার যে ক্ষমতা কিংবা নতুন ভাবে জ্ঞানের কাঠামো নির্মাণের যে শক্তিবলয় এবং স্বাভাবিক একটি জ্ঞান, তা কীভাবে পরে হয়ে ওঠে ‘শক্তি ও ক্ষমতার’ উৎস,  এসব ভাবনা নিয়ে মিশেল ফুকো শুরু করেছেন তাঁর যাত্রা । 

পার্লামেন্ট, মন্ত্রিসভা, পুলিশ, মিলিটারী, জেলখানা, আমলা ও প্রশাসক ইত্যাদি সব কিছুর দ্বারা ক্ষমতা তৈরি হতে পারে এবং এগুলোর মাধ্যমেই গণ-ইচ্ছার বাস্তবায়ন সম্ভব।কিন্তু একটা পর্যায়ে, তা যতোটা না সকল বর্গের জন্য হয়ে উঠতে পারে, তার চেয়ে বেশি তা বুর্জোয়া-পুঁজিপতি-উচ্চবর্ণ শ্রেণীর উদ্দেশ্যে হয়ে উঠে, ফলে সেখানে বুর্জোয়াদের ভ্রাতৃত্ব ও সাম্য ঘটে । সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়ন হয়না কেননা গণতন্ত্র রূপ নেয় ‘বুর্জোয়ার ভোটের যন্ত্র’ হিসেবে। মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ক্ষমতাকে দেখা হয় সর্বদা দমনের যন্ত্র হিসেবে, প্রকৃত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে অধিপতি শ্রেনির হাতে। তারা সেটাকে ব্যবহার করে নিজেদের আধিপত্য রক্ষা করে। মাও-সে-তুং  এই ধরনের শ্রেণীকে বলে গিয়েছেন উপরিকাঠামো শ্রেণী, এই একই কথা মার্ক্স ও গ্রামশির কাছ থেকেও এসেছিলো। এখান থেকে এবার বিস্তৃতির যাত্রা শুরু ফুকোর। বুর্জোয়া ভাবাদর্শ পরতে পরতে যেভাবে আঁট বেঁধে থাকে, তার আদর্শ বা ভাবাদর্শ স্রেফ একটা অবস্থানেই সীমাবদ্ধ নয়, তাকে প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে উৎযাপিতও করা হয়। যেখানে গ্রামসি বলছেন এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হেজিমনির প্রক্রিয়া, যার দ্বারা সামগ্রিক রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক ক্ষমতাকে বৈধকরণ করা যায়। 

উদারনীতিবাদী ও মার্ক্সবাদী উভয়চিন্তাধারা থেকে ফুকোর ক্ষমতা বিষয়ক চিন্তা আলাদা। ফুকো মনে করেন যেখানে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির কাছে ক্ষমতা হলো সার্বভৌমত্ব, সংবিধান, আইন-আদালত সেখানে মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে তা হলো নিছক রাষ্ট্রযন্ত্র। কিন্তু এর আগেও  অন্যান্য অনেক তত্ত্ব ক্ষমতার পুরো প্রক্রিয়াকে সঠিক ভাবে গড়ে তুলতে পারেনি, একটা সামগ্রিক ডিসকোর্সের মধ্যে গঠিত হয়ে সার্বিক সত্য ইতিহসের সংজ্ঞায় উপনীত হতে পারেনি , বরং তা ছিল খন্ডে খন্ডে বিভক্ত। সেখানে মিশেল ফুকো ধার করলেন ‘শৃঙ্খলা ও শান্তি’ অধ্যায়ের তত্ত্ব ও ইতিহাস। মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রের সময় শাস্তির মান এবং আধুনিক গণতান্ত্রিকযুগে শাস্তির মান এক নয়। এক সময় প্রভু বা রাজার নির্দেশ মোতাবেক সমগ্র শহরজুড়ে অনুষ্ঠান আয়োজন হতো, জনগণকে সরাসরি দেখানো হতো কাউকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। কাউকে গিলোটিনের নিচে রেখে মাথা কেটে ফেলা হতো কিংবা পুড়িয়ে মারা হতো। সউদি আরবে আর তালিবানি আফগানিস্তানে এখনও জনগণের সামনে কোতল করার প্রথা বজায় আছে । এটা হলো ক্ষমতার চরম আস্ফালন ।

প্রাচীন ভারতেও তখনকার দিনে রাজার নির্দেশের বাইরে যে-কোনো কাজই শাসনের বিরুদ্ধে বা বিপরীতে কাজ ছিল। ফলে অমান্যকারীকে শূলে চড়ানো হতো। ইউরোপে  ফরাসী বিপ্লব সংগঠিত হয় মানুষকে স্বাধীনতা দেবার উদ্দেশ্যে, মানবতাকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে। গণতন্ত্রকে মানুষ মানসম্মত ও আদর্শ হিসেবে ধরে নিলে গণতন্ত্রের যুগ প্রতিষ্ঠিত হওয়া শুরু হয় । ফুকো বলেছেন, এই আধুনিক গণতন্ত্রের যুগে দাঁড়িয়ে শাস্তি এখনও আছে কিন্তু তা রাজার ন্যায় হিসেবে নয়। রাজার ক্ষমতা ছিল সৈন্যসামন্ত ও অস্ত্রের বলে, আর এখন ক্ষমতার উৎস হচ্ছে রাষ্ট্র, আইন-আদালত ইত্যাদি। আর এখানে আনুষ্ঠানিক ভিত্তি হলো নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অভিমত ও ভোট। আধুনিক যুগের মূল্যবোধ  ‘ব্যক্তির সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী’। এই যুগে শাস্তির উদ্দেশ্য ও মানও ভিন্নতর। ফুকো একটি চমৎকার বাক্য এ-প্রসঙ্গে ব্যবহার করেছেন, এখনকার শাস্তির লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে অপরাধীর ‘আত্না’ এবং উদ্দেশ্য হচ্ছে “অপরাধীর চরিত্র সংশোধন”। আমাদের দেশেও কারাগারকে বলা হয় সংশোধনাগার ।

প্রশ্ন হলো আধুনিক গণতন্ত্রের যুগে শাস্তি তবে কি এবং কেমন? ফুকো এখানে ইতিহাসের পৃষ্ঠপটে বলেছেন যে, রাজতন্ত্রের আমলে শাস্তির  ভয়াবহতার ফলে প্রজাদের মধ্যে অসম্ভব রকমের ক্ষোভ ও বিদ্বেষ দেখা যেত , ফলে প্রজাবিদ্রোহ সংগঠিত হতো। মধ্যযুগীয় শাস্তিকে রোধ করার জন্যই মানুষ বিদ্রোহে অংশ নিতো । পণ্ডিতদের দাবী ছিল যে শাস্তির উপায় যথেষ্ঠ অন্যায়মূলক এবং বিতর্কিত। ফলে বিদ্রোহ সংগঠিত হতে থাকে আর রাষ্ট্রকাঠামোয় পরিবর্তন ঘটতে থাকে এবং সাম্রাজ্যের পতন ঘটা শুরু হয়। মানুষের দাবী ছিল মানুষের শাস্তির এই উপায় শেষ করা হোক এবং প্রতিষ্ঠিত হোক একটি আইনের আদলে গঠিত মানুষের জন্য সংবিধান। ফুকোর ভাষায় এই উপায়টি হলো “শাস্তির নম্র উপায়”। এভাবে সৃষ্টি হয় গণতান্ত্রিকযুগের ‘কারাগার’। 

ফুকোর ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’-এ  বলা হয়েছে যে, আধুনিক সমাজে হলো “শৃঙ্খলা বিধানকারী সমাজ”।  কিন্তু শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে শ্রম বিভাজনের সৃষ্টি করতে হবে, নয়তো ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটাতে পারবে না। এমনকি ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতারও সৃষ্টি করতে হবে। এভাবে শ্রমবিভাজন ও বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করে আধুনিক সমাজ কাজের ফল অনুযায়ী একজনকে তিরস্কার বা পুরস্কার প্রদান করবে, শ্রমের বিভাজনে নেতা, বা কোনো সামঞ্জস্য না থাকলে কিংবা ঘাটতি থাকলে, সেখানে উপরিকাঠামোর ব্যক্তিবর্গ সমন্বয়-সাধন ও নিয়ন্ত্রণ করবে এবং তাদের অবিরাম  তদারকি করবে। হাসপাতাল, কারাগার, বিদ্যালয়, ফ্যাক্টরী, সেনা ব্যারাক ইত্যাদিকে যে চরম ক্ষমতা দেয়া আছে তাকেই ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন ফুকো। যেমন ধরা যাক,  কারাগারের কাজকর্ম-হুকুম নিয়ন্ত্রিত হয় একজন প্রধান জেলারের দ্বারা। সে চব্বিশ ঘন্টা কর্মীদের মাধ্যমে কয়েদিদের উপর তদারকি করছে আর সেই সুপারিশ  করছে কার শাস্তির মাত্রা কতোটা হওয়া উচিত। 

তেমনই মানসিক রোগীর হাসপাতালে যখন ডাক্তার তার মনমতো পদক্ষেপ নিয়ে  রোগীদের চিকিৎসা করছেন তখন পাগলাগারদের  ভেতরে ডাক্তার হয়ে উঠেন একজন কর্তৃত্ববাদী শাসক , কারণ তার কথার ওপরে আর কেউ হুকুম দেয় না। কিন্তু শাস্তির মাত্রা শারীরিক নয়, আত্নাকে শাসন করাই হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রধান লক্ষণ। কারণ সেই শাসককে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হলে গণতন্ত্রের নির্দিষ্ট আদেশকে অন্তত টিকিয়ে রাখতে হবে। এ কারণে মিশেল ফুকো ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলছেন, সেগুলো পৃথক পৃথক ‘সমগ্র’ মাত্র, ডাক্তার বা ক্ষমতাধারী লোকটা মানসিকভাবে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চায়। ফুকোর বিশ্লেষণ অনুসারে, সমাজে প্রত্যেকে প্রত্যেককে পাহারা দিয়ে রাখছে।  উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তলাকার লোকেদের পাহারা দিচ্ছেন । যদিও এই নতুন যুগের পাহারাদারেরা আগের মতো বেত মেরে, কারাগারে বন্দী করে বা অর্থদন্ড দিয়ে শাস্তি দিচ্ছে না।  তাদের মর্জির উপর নির্ভর করছে একজন ব্যক্তির পদোন্নতি হওয়া উচিত নাকি  উচিত নয় । ‘উচিত কি উচিত নয়’ এই ডিসকোর্স  সাধারণের হাতে নেই, এর মালিক হলো উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এর মালিক হলো ওপরের কাঠামোর নিয়ন্ত্রণকারীরা। ফলে  নিজেরা যতোই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বাধীন নাগরিক বলে চিৎকার দিক না কেন, সাধারণ লোকেদের মাথার ওপরে সেই অদৃশ্য ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে যেখান থেকে জনগণের ওপর সবসময় নজর রাখা হচ্ছে। অর্থাৎ ফুকোর মতে , “ক্ষমতা শুধু বিচ্ছিন্ন করে, দমন করে, বিমূর্ত করে, ঢেকে রাখে, লুকিয়ে রাখে, তা মোটেই নয় বরং ক্ষমতা হলো তাই যা ‘উৎপাদন করে’। ক্ষমতা উৎপাদন করে বাস্তবতা,  নির্ধারণ করে বস্তুর বিচরণসীমা আর নির্মাণ করে সত্যের তন্ত্রসমূহ”। মানে ফুকোর ক্ষমতার  তিনটি প্রণালী রয়েছে : এক : শৃঙ্খলা, দুই : কর্মবিধি, তিন : নির্দিষ্ট মান স্থাপন। এভাবেই বুনে উঠছে  গঠনতন্ত্র, প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ক্ষমতার বেড়াজাল  সমগ্র বিশ্বজুড়ে।

চার

ক্ষমতা সম্পর্কে মিশেল ফুকোর বক্তব্যের সমালোচনা করে রায়হান শরিফ বলেছেন, “ক্ষমতা-প্রকৌশল, জ্ঞান, ক্ষমতা-প্রকৌশলের রুপান্তর কিংবা যৌনতার ইতিহাস — সব ক্ষেত্রেই ফুকোর তত্ত্ব বিকাশিত হয়েছে ইউরোপকে প্রেক্ষাপটে রেখে। ফুকোর এই ইউরোপকেন্দ্রিক চিন্তায়নের ধরনটা এমন যে প্রাচ্যের অভিজ্ঞতার  বিবরণ সেখানে একেবারে নেই । প্রাচ্যে কী ঘটেছে, কীভাবে ক্ষমতার ধারণাকে এক্ষেত্রে বুঝতে হবে, ক্ষমতা-প্রকৌশলের রূপান্তর, গতি-প্রকৃতি এখানে কীভাবে তত্ত্ব দিয়ে অনুধাবন করা যাবে, যৌনতার ইতিহাসের ক্ষেত্রেই বা প্রাচ্যের অভিজ্ঞতা কী,  অভিজ্ঞান কী — এসব বিষয়ে ফুকোর কাছ থেকে সরাসরি কোনও বক্তব্য  পাওয়া যায় না। 

ফুকো এশিয়া আর আফ্রিকার প্রাক্তন উপনিবেশগুলোতে ঘটতে থাকা জাতি ও ধর্মীয় দাঙ্গাগুলোর কোনও উল্লেখ করেননি । ইউরোপ থেকে দলে-দলে খ্রিস্টধর্মী যোদ্ধারা কেন ক্রুসেডের লড়াই লড়তে গিয়েছিল তার কারণ ব্যাখ্যা করেননি । ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লেগেই আছে । বাংলাদেশ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ফলে প্রায় হিন্দুশূন্য হয়ে গেছে । পাকিস্তান আর আফগানিস্তানে সুন্নিরা বোমা মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে শিয়াদের জমায়েত । গণহত্যা আর বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ছোটোখাটো লড়াই হবে চলেছে আফরিকার এই দেশগুলোতে : বুরুণ্ডি, রোয়াণ্ডা, কেনিয়া, দক্ষিণ সুদান, তানজানিয়া, উগাণ্ডা, ক্যামেরুন, সেন্ট্রাল আফরিকান রিপাবলিক, চাদ, রিপাবলিক অফ কঙ্গো, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো, জিবুতি, এরিট্রিয়া, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, ম্যাডাগাস্কার, লিবিয়া, মরোক্কো, সুদান, তিউনিশিয়া, লেসোথো, মালাউয়ি, জাম্বিয়া, বেনিন, বুরকিনা ফাসো, ঘানা, গিনি, গিনি-বিসাও, লাইবেরিয়া, নাইজেরিয়া, নিজের, মালি, সিয়েরা লিয়োন, পশ্চিম সাহারা ইত্যাদি । বন্দুক, গোলাগুলি, ট্যাঙ্ক, কামান ইত্যাদি বিক্রি করে প্রাক্তন সাম্রাজ্যবাদীরা । এসব ঘটনা ফুকোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি ।

এডওয়ার্ড সাঈদ দেখিয়েছেন পাশ্চাত্য কীভাবে প্রাচ্যকে নিন্মস্তর, অধস্তন, পশ্চাদপদ প্রতিপন্ন করতে ওরিয়েন্টালিজমকে নিজেদের মগজে-মননে গেঁথে নিয়েছিল । খুব স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন ওঠে যে ঔপনিবেশিকতার  মতন যে সাম্রাজ্যবাদী অনাচারটি প্রাচ্যের দেশে-দেশে কয়েকশো বছর ধরে চলেছে তাকে কি সার্বভৌম ক্ষমতা-প্রকৌশলের তত্ত্ব দিয়ে বোঝা সম্ভব ? উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যদি ইউরোপে ক্ষমতা-প্রকৌশল সার্বভৌম থেকে জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতা-প্রকৌশলে বাঁক নিয়ে থাকে,  ঠিক সেই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশসহ এশিয়া-আফ্রিকার নানা ভূখণ্ডে যে শোষণ-শাসনের বিদেশি রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল, সেসব ভূখণ্ডের কোটি কোটি মানুষের চিন্তা-চেতনার গড়াপেটার ধরন-ধারণ কী ছিল — সে বিষয়ে ফুকো নীরব। জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতা-প্রকৌশলের কোথাও এ কথা বলা নেই যে, অন্য জাতি-রাষ্ট্রকে উপনিবেশ বানাতে হবে। তবে অন্য জাতি-রাষ্ট্রকে আক্রমণের ধারণাটি সার্বভৌম ক্ষমতা-প্রকৌশলে অবশ্য উপস্থিত। তাহলে কি ধরে নিতে হবে উপনিবেশিত রাষ্ট্রগুলোতে দ্বিস্তরের ক্ষমতা-প্রকৌশল কার্যকর ছিল ? বাইরের, বা আন্তর-রাষ্ট্রের স্তরটি কি সার্বভৌম ক্ষমতা-প্রকৌশলের বলয় ? আর ভেতরের, জনগণকে গড়া-পেটার ক্ষেত্রটি জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতার বলয় ?  ফুকোর চিন্তাসূত্র ধরে এগোলে এরকম, বা এর কাছাকাছি কিছু ভাষ্য তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু এই ভাষ্যগুলো উপনিবেশিত অঞ্চলের মানুষের প্রকৃত অবস্থা, তাদের যাপিত-জীবনের অভিজ্ঞতার কতটা কাছাকাছি ? 

ফুকোর তত্ত্বের বাইরে গিয়ে যদি এই কথা  বলা হয় যে, ঔপনিবেশিকতা একটা জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসন, এই অর্থে যে উপনিবেশিত বিশাল জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা থেকে তাদের নিজেদের অনেকটাই উন্মূল করে দেয়া হয়েছে। আফরিকায় তাদের ভাষা নিশ্চিহ্ণ করে দেয়া হয়েছে । বহু মানুষকে দক্ষিণ আর উত্তর আমেরিকায় তুলে নিয়ে গিয়ে তাদের শেকড় থেকে কেটে ফেলা হয়েছে । শুধু তাই নয়, উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীকে, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক হেজেমোনির বলয়ে এমনভাবে গড়া-পেটা করা হয়েছে যে, উপনিবেশিত অঞ্চলের মানুষের ব্যক্তিমানসে পাশ্চাত্যের নানারকম প্রভাব দুর্লঙ্ঘভাবে বিরাজমান— যার  প্রকৃত ভাষ্য ফুকোর চিন্তা-প্রকল্পে অনুপস্থিত।  ইউরোপ বা আমেরিকার জনগণের অভিজ্ঞতার জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতা আর উপনিবেশিত মানুষের অভিজ্ঞতার জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতা এক নয়। উপনিবেশিত মানুষের মগজে-চেতনায় পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব আজও এমনভাবে কাজ করে যে পয়লা বৈশাখের বদলে নিউ ইয়ার গুরুত্ব পায়, শহরের মানুষ নিজেদের মধ্যে ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলে । দেশভাগের ফলে উচ্ছেদকৃত হয়েছেন বা বাস্তুহারা হয়েছেন বহু বাঙালি, পাঞ্জাবি আর সিন্ধি। তাঁদের সন্তানরা মাতৃভাষায় কথা বলতে পারেন না, পড়াশোনা করেন হিন্দি, ইংরেজি বা যে রাজ্যে আশ্রয় পেয়েছেন সেখানকার ভাষায়। একথা ঔপনিবেশিকতার নিগড়ের অভিজ্ঞতা আছে এমন সকল জাতি-রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য সত্য। এই মানুষেরা শুধু জৈব-রাজনৈতিক ক্ষমতার বলয়ে গড়া-পেটা নয়, বরং ঔপনিবেশিকতাজনিত বিস্মৃতিপরায়ণতা এবং পাশ্চাত্যের হেজিমোনির বলয়ে এক ভিন্ন এবং বিশিষ্ট গড়া-পেটার অভিজ্ঞতাকে সামষ্টিক ও সামগ্রিকভাবে ধারণ করছে। এ কারণেই উত্তরঔপনিবেশিকতা সম্পর্কিত ভাবুকদের অনেকেই বিউপনিবেশয়ানের ধারণাকে সামনে আনেন—একদা উপনিবেশ ছিলো কিন্তু পরে স্বাধীনতা অর্জন করেছে এমন জাতিরাষ্ট্রগুলোর প্রকৃত মুক্তি বিউপনিবেশায়ন ছাড়া সম্ভব নয়। আর বহু ভারতীয়ের জন্য বিউপনিবেশায়নও হয়ে গেছে অসম্ভব ।

রায়হান শরিফ আরও বলেছেন, যৌনতার ইতিহাস বিষয়ে ফুকোর ভাষ্য ইউরোপকেন্দ্রিক। এই ভাষ্যকে আবার দৃঢ় করেছে তাঁর বয়ান, ডিসিপ্লিনারি ক্ষমতা-প্রকৌশল, জিনিওলোজি ইত্যাদির ধারণা। এভাবে দেখলে ফুকোর যৌনতা বিষয়ক চিন্তা-প্রকল্পটিতে ইনফিনিটি রিগ্রেস (Infinity Regress) ফ্যালাসির উপস্থিতি উপলব্ধি করা যায়। তবে ফুকোর ধারণাগুলোর শক্তি হচ্ছে—এগুলোকে সন-তারিখ, কিংবা অকাট্য প্রমাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাসের নানা পরিবর্তন, রূপান্তরকে বেশ স্বচ্ছন্দ্যে ব্যাখ্যা করা চলে। 

প্রাচ্যের ইতিহাস, বিশেষ করে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সামাজিক, ধর্মীয় রদবদল ও বিকাশ ব্যাখা করার প্রশ্নে ফুকোর ধারণাগুলো সরাসরি সাহায্য করে না।  “ব্যক্তি”কে নিছক প্রভাব  হিসেবে দেখিয়ে ফুকো ব্যক্তির এজেন্সিকে ‘নিশ্চিহ্ণ’ করে দিলেন, প্রতিরোধের ধারণাকে নাকচ করলেন । হিন্দুর বর্ণবিভাজিত সমাজের ধারণা ছাড়া একজন ভারতীয় ব্যক্তির এজেন্সির ক্ষেত্রগুলো বা এজেন্সির প্রকৃতি, সামর্থ্য, প্রতিরোধের ধারণা ইত্যাদি মার্কসবাদী মডেলে একরকম; ফুকোর মডেলে  অন্যরকম। ভিন্ন ভিন্ন গুণাগুণ, বৈশিষ্ট্য নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্যারাডাইম শিফট ঘটতে ব্যাপক প্রস্তুতির এবং সেজন্যই সুদীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। এতে ব্যক্তির ভূমিকা থাকলেও ফুকো বলতে চান মূল নিয়ন্তা এক্ষেত্রে ব্যক্তি-পর্যায়ের বাইরে । 

রবার্ট অ্যাডামস 'ক্ষমতায়ন'-এর যে-কোনও একটিমাত্র সংজ্ঞার সীমাবদ্ধতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন, এবং বলেছেন যে এর বিপদ হলো বিদ্যায়তনিক বা বিশেষজ্ঞদের দেয়া সংজ্ঞাগুলো অভিধার এবং সংযুক্ত অনুশীলনগুলোকে সেই সমস্ত লোকেদের থেকে কেড়ে নিতে পারে, যাদের তারা এর অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করে। তবুও, তিনি শব্দটির একটি ন্যূনতম সংজ্ঞা তৈরি করেছেন : “ক্ষমতায়ন: ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং/অথবা সম্প্রদায়ের তাদের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ক্ষমতা, ক্ষমতা প্রয়োগ করা এবং তাদের নিজস্ব লক্ষ্য অর্জন করা এবং সেই প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে, ব্যক্তিগতভাবে এবং সমষ্টিগতভাবে, তারা নিজেদের এবং অন্যদের তাদের জীবনের মান সর্বোচ্চ করতে সাহায্য করতে সক্ষম।”

আরেকটা সংজ্ঞা হল "স্থানীয় সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে একটি ইচ্ছাকৃত, চলমান প্রক্রিয়া, যার মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সমালোচনামূলক প্রতিফলন, যত্ন নেওয়া এবং গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ জড়িত, যার মাধ্যমে সম্পদের সমান অংশের অভাবে পীড়িত লোকেরা সেই সম্পদগুলিতে আরও বেশি ভাগিদার হতে পারে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে" । র‌্যাপাপোর্ট-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী: "ক্ষমতায়নকে একটা প্রক্রিয়া হিসাবে দেখা উচিত: যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ, সংস্থা আর সম্প্রদায়গুলো তাদের জীবনের ওপর কর্তৃত্ব লাভ করে।" সমাজতাত্ত্বিক ক্ষমতায়ন প্রায়ই গোষ্ঠীর সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিপাদন করে যে সামাজিক বৈষম্যের প্রক্রিয়াগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া থেকে বাদ চলে যায় - যেমন অক্ষমতা, জাতি, ত্বকের রঙ, ধর্ম, জাত-পাত বা লিঙ্গের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বৈষম্য। মনে রাখা দরকার যে পদ্ধতি হিসাবে ক্ষমতায়ন নারীবাদের সাথে জড়িত।

ক্ষমতায়ন হল প্রান্তিক, বিশেষ করে দলিত, মানুষদের জন্য মৌলিক সুযোগ প্রাপ্তির প্রক্রিয়া, হয় সরাসরি সেই ব্যক্তিদের দ্বারা, অথবা অ-প্রান্তিক অন্যদের সাহায্যের মাধ্যমে, যারা এই সুযোগগুলোতে তাদের নিজস্ব অংশ ভাগ করে নেয়। ক্ষমতায়ন সেই সুযোগগুলোকে অস্বীকার করার সক্রিয়ভাবে ব্যর্থ প্রচেষ্টাও অন্তর্ভুক্ত করে। ক্ষমতায়নের মধ্যে গোষ্ঠীর ব্যক্তিদের মধ্যে দাতব্য বা কল্যাণের জন্য ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয়তা দূর করার ওপর গুরুত্ব দেয়াসুদ্ধ, স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য উত্সাহিত করা এবং দক্ষতা বিকাশ করা অন্তর্ভুক্ত, যদিও এই প্রক্রিয়াটা শুরু করা আর কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা কঠিন ।

পাঁচ

একজন লোক তো সব ক্ষমতা নিজেই প্রয়োগ করতে পারে না, তাই সে তার বিশাল ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেয় । একান্নবর্তী পরিবারে যেমন ছিলেন কর্তা । রাষ্ট্রে যেমন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী । তাঁদের তলায় আরও শাখা-প্রশাখা । কোনও প্রতিষ্ঠানকে যথাযথভাবে পরিচালনার ব্যাপারে ক্ষমতা অর্পণ বা ডেলিগেশন একটা উল্লেখযোগ্য বিষয়। প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী যত ব্যাপক হবে, ততই বেশি বেশি মাত্রায় ক্ষমতা অর্পণ এর প্রশ্ন দেখা দেবে । সুষ্ঠ প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক পরিচালনার প্রয়োজনে ক্ষমতা অর্পণ একটি প্রচলিত পদ্ধতি ।     জে. ডি . মুনি-র মতে ক্ষমতা অর্পণ হলো নিম্নতম কর্তৃপক্ষের হাতে ধাপে-ধাপে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অর্পণ । আসলে ক্ষমতা অর্পণ হল তত্ত্বাবধান আর নিয়ন্ত্রণের অধিকার সাপেক্ষে কোনও একজন পদস্থ ব্যক্তি তার অধিনস্হ ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর । অবশ্য     ক্ষমতা অর্পণ যে সবসময় উর্দ্ধতন থেকে নিম্নতনের দিকে নামবে এমন নয়, উল্টোটাও হতে পারে, আবার সমমর্যাদাসম্পন্ন ইউনিটসমূহের মধ্যেও ক্ষমতা অর্পণ ঘটতে পারে ।  ক্ষমতা অর্পণ হলো একজন প্রশাসক বা একটি সংগঠন থেকে অন্যজনের বা অন্য সংগঠনের হাতে কর্তৃত্বে হস্তান্তর । ক্ষমতা অর্পণ ওপর থেকে নিচে বা নিচ থেকে উপরে বা পাশাপাশি হতে পারে । বস্তুতপক্ষে ক্ষমতা অর্পণ এর প্রক্রিয়াকে  তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, যথা:  ক ) নিম্নমুখী খ ) ঊর্ধ্বাভিমুখী গ) পার্শ্বাভিমুখী।

     একজন সেলস ম্যানেজার কর্তৃক তার বিক্রয় কর্মীদের ওপর ক্ষমতা অর্পণ,  অংশীদারগণ কর্তৃক তাদের পরিচালক মন্ডলীর ওপর ক্ষমতা অর্পণ এবং কৃষি দপ্তরে, দপ্তরের আধিকারিকদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর ক্ষমতা অর্পণ এর উদাহরণ । ম্যানেজমেন্টের পণ্ডিতরা ক্ষমতা অর্পণ কে আবার চার ভাগে ভাগ করেছেন , যথা: ১) পূর্ণ বা আংশিক ,২) শর্তাধীন বা নিঃশর্ত,       ৩) আনুষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক,  ৪) প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ।

ক্ষমতা অর্পণ বলতে দায়িত্ব থেকে পুরোপুরি অব্যাহতি বা চূড়ান্ত ক্ষমতার হস্তান্তর নয় । যিনি ক্ষমতা অর্পণ করেন তিনি তাঁর সমস্ত দায়িত্ব তথা ক্ষমতা অর্পণ করেন না । পরিদর্শন , তত্ত্বাবধান,  নিয়ন্ত্রণ,  পর্যালোচনা প্রভৃতি ক্ষমতাগুলো তিনি কখনোই হাতছাড়া করেন না   তিনি ইচ্ছা করলে অর্পিত ক্ষমতা ফিরিয়ে নিতে পারেন । স্টুয়ার্ট মিলের মতে ক্ষমতা অর্পণ এর অর্থ শুধুমাত্র কিছু কাজের দায়িত্ব অর্পণ নয় । এর মূল অর্থ হলো অধঃস্তন কর্তৃপক্ষকে বিচার-বুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করতে দেওয়া,  বিশেষ বিশেষ সমস্যা মোকাবেলার প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত বা চিন্তাভাবনাকে সদ্ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া ।   ক্ষমতা অর্পণের মাধ্যমে সংগঠনের মুখ্য পরিচালকের কাজের চাপ অনেকটা কমানো যায় । বিশেষত, দৈনদিন কম গুরুত্বপূর্ণ কাজের বোঝা কর্মীদের ওপর অর্পণ করে প্রশাসক নিজে সংগঠনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে সময় ও শক্তি নিয়োগ করতে পারেন । আধুনিককালের জটিল সাংগঠনিক ব্যবস্থায় পরিচালকের পক্ষে সবদিকে নজর দেওয়া সম্ভব হয় না । তাই চূড়ান্ত দায়িত্ব  নিজের হাতে রেখে কিছু দায়িত্ব  নিম্নস্তরের কর্মীদের হাতে ছেড়ে দিতে হয় ।     ক্ষমতা অর্পণ এর ফলে প্রশাসনে একটা গতি আসে । কাজে বিলম্ব ঘটে না। সাধারণ মানুষ পরিচালকের কার্যালয় না এসে তলাকার স্তরে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই প্রয়োজনীয় কাজ মিটিয়ে নিতে পারে ।   ক্ষমতা অর্পণ এর ফলে নিচু স্তরের কর্মীদের দায়িত্ববোধ বাড়ে এবং সেই সঙ্গে তাদের কাজ করার উৎস বাড়ে । সংগঠনের সকল সিদ্ধান্ত ওপরতলায় গ্রহণ করা হলে নিচুস্তরের কর্মীরা তাদের কাজে উৎসাহ ও উদ্যম হারিয়ে ফেলবেন । ফলে তাদের কর্মদক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে । অন্যভাবে বললে প্রধান পরিচালক যদি তাঁর অধঃস্তনদের পরিচালন কুশলতা ও গুণাবলিকে বাড়াতে চান সেক্ষেত্রে ক্ষমতা অর্পণ একটি আবশ্যিক শর্ত ।   ক্ষমতা অর্পণ এর ফলে সংগঠনের যথেষ্ট সুবিধা হয় ।  সংগঠনের কাজকে যত ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে তত সেই সংগঠনের কাজ দক্ষতার সঙ্গে,  মিতব্যয়িতার সঙ্গে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারবে ।   যে স্তর থেকে সমস্যার উদ্ভব ঘটে সেই স্তরে তাকে মোকাবিলা করা সুস্থ প্রশাসনের পক্ষে খুবই আবশ্যক।  ক্ষমতা অর্পণ এর মাধ্যমে সংগঠনের প্রতিটি স্তরের কর্মীদের হাতে উপযুক্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করা হলে এটা সম্ভব। ক্ষমতা অর্পণ এর ফলে কোন কাজ কে করবে, কোন কাজের জন্য কতখানি সময় বরাদ্দ করা হয়েছে, এ সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করা যায় । ফলে সংগঠনের প্রতিটি স্তরের কাজকর্ম সম্পাদনকে উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে আনা যায়  ।           

ক্ষমতা অর্পণ এর সুবিধা বা প্রয়োজনীয়তা যাই হোক না কেন, অনেক সময় দেখা যায় উচ্চপদস্থ প্রশাসকরা ক্ষমতা অর্পণ এর ব্যাপারে হয় অনিচ্ছুক অথবা উদাসীন । তাঁরা সহজে কোনও দায়িত্ব ছাড়তে চান না । ক্ষমতা অর্পণ নেতৃত্বের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে যদি অধঃস্তনের আনুগত্যে শৈথিল্য আসে -- পরিচালকদের এই ধরনের মনোভাব ক্ষমতা অর্পণ এর ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে । আবার অন্যদিকে ক্ষমতা হাতে পেয়ে অধঃস্তন কর্তৃপক্ষ ঊর্ধ্বতনের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ উপেক্ষা করতে পারে । ক্ষমতা অর্পণ যদি উর্দ্ধতনের বিরুদ্ধে একটি চক্র বা দলাদলি সৃষ্টিতে সাহায্য করে, তবে তা নিঃসন্দেহে ক্ষতিকারক । যেমন ভারতে দেখা যায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সদাসর্বদা সাবধান থাকতে হয় যাতে অন্য মন্ত্রীরা তাকে ষড়যন্ত্র করে সরিয়ে না দেয় । এরকম ঘটনা আখছার ঘটে ভারতীয় রাজনীতিতে । আমরা দেখি শাসক দলের সদস্যদের কিনে ফেলে শাসক দলকে ক্ষমতাচ্যূত করা হচ্ছে ।  

ক্ষমতা অর্পণ এর প্রতিবন্ধকতা বা অসুবিধাকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে যেমন-- ২)  সাংগঠনিক এবং ২) ব্যক্তিগত। সাংগঠনিক প্রতিবন্ধকতা বিভিন্নভাবে সৃষ্টি হতে পারে। যেমন- ক) ক্ষমতা অর্পণ এর উপযোগী সুনির্দিষ্ট সাংগঠনিক পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া না থাকা ; খ ) সংগঠনের মধ্যে যথাযথ যোগাযোগ বা সমন্বয়ের অভাব ; গ ) ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সংজ্ঞা ও সুনির্দিষ্ট এলাকা না থাকা ; ঘ) সঙ্গঠনের আয়তন ও কাজের প্রকৃতি ইত্যাদি । সঙ্গঠনের ক্ষেত্রে ক্ষমতা অর্পণ এর তেমন একটা প্রয়োজন থাকে না ।   ব্যক্তিগত প্রতিবন্ধকতা বলতে মূলত পরিচালকদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টিকে বোঝানো হয় । পরিচালকদের একটা সাধারণ মনস্তত্ত্ব হলো এই যে, তিনি ছাড়া সঙ্গঠন অচল হয়ে যাবে , তিনি ছাড়া সঙ্গঠনের বাদবাকি সকলে অযোগ্য। ম্যানেজমেন্টের পণ্ডিতরা বলেন,  ব্যক্তিগত প্রতিবন্ধকতা বলতে বোঝায় :  পরিচালকের ১) অহংবোধ , ২) অন্যের প্রতি অনাস্থা , ৩)  কৃতিত্ব বা ক্ষমতা হারানোর ভয় , ৪) বিরোধী শক্তি সম্পর্কে আতঙ্ক , ৫)  প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হওয়ার ভয় , ৬) সঙ্গঠনের কর্তৃত্বের অংশীদার অন্যকে না করার ইচ্ছা , ৭) ধৈর্যহীনতা, ৮)  নেতৃত্ব চলে যাওয়ার আশঙ্কা , ৯) আবেগ সংবরণ করার অক্ষমতা, ১০)  ক্ষমতা অর্পণ কীভাবে করতে হবে সে সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব, ১১)  উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে, আইনসভার কাছে ও  জনগনের কাছে দায়িত্বশীলতা।    

ক্ষমতা অর্পণ এর ক্ষেত্রে উপরোক্ত প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হলে এমন একটা উপায় উদ্ভাবন করতে হবে যাতে ক্ষমতা অর্পণ করেও পরিচালক তার কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারেন। পরিচালকের সঙ্গে অধঃস্তন কর্মীদের নিয়মিত যোগাযোগ রাখার ব্যবস্থা সঙ্গঠনের পক্ষে একটি আবশ্যিক শর্ত । পরিচালকের সঙ্গে কর্মীদের যদি নিয়মিত যোগাযোগ থাকে, নির্দিষ্ট সময় অন্তর যদি কাজের রিপোর্ট ও মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকে,  প্রশাসক যদি সঙ্গঠনের প্রতিটি স্তরের কাজকর্ম সম্পর্কে তদারকি ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন , যদি প্রতিটি স্তরের হিসাবপত্র ও অন্যান্য পরিসংখ্যান সঠিকভাবে রাখার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে ক্ষমতা অর্পণ সফল হবে ।     ক্ষমতা অর্পণ লিখিতভাবে হওয়াই ভালো । কোন কোন ক্ষমতা অর্পণ করা হলো, পরিচালক কতখানি কৃতিত্ব নিজের হাতে রাখবেন,  কর্মীরা কতখানি স্বাধীনতা ভোগ করবেন , এগুলো লিখিত আকারে থাকা উচিত ।      ক্ষমতা যার বা যাদের ওপর অর্পণ করা হবে তাকে বা তাদের তার দায়-দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করার জন্য উপযুক্ত স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র দিতে হবে । অধস্তনের উদ্যম ও কর্মপদ্ধতিকে উৎসাহিত করার প্রয়োজনে ছোটখাট ভুলভ্রান্তিগুলিকে ততটা গুরুত্ব না দেওয়াই ভালো । অর্পিত ক্ষমতা সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা প্রশাসক সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন । ক্ষমতা অর্পণ এর সাফল্যের পক্ষে যেটা ভীষণ জরুরী সেটা হলো, যে কোনও মূল্যে সাংগঠনিক ঐক্য বজায় রাখা এবং পরিচালক ও কর্মীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগীতার পরিবেশ সৃষ্টি করা।

ছয়

ক্ষমতা যে কতো ভয়ানক তা টের পাওয়া যায় প্রাচীনকালের পুরুষ শিশু-কিশোরদের খোজা করার প্রক্রিয়া থেকে ।পুরুষদের খোজা করার যে প্রথা তুর্কি আর মোগলদের মধ্যে ছিল তা যৌনক্ষমতা কেড়ে নেবার প্রথা, একজন পুরুষের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে অকেজো করে তাকে হীনমন্যতায় সারাজীবন কয়েদ করে রাখার প্রথা । যারা ক্ষমতাবান তারাই পুরুষদের যৌনক্ষমতা কেড়ে নিতো আর তাদের কাজে লাগানো হতো হারেমের যুবতীদের পাহারা দেবার জন্য । নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কের জন্য যে অঙ্গটি জরুরি সেটাই কেড়ে নিয়ে পুরুষকে যৌনক্ষমতাহীন করে দেয়া হতো । মুঘল এবং অটোমান দুই জায়গার হারেমেরই খোজা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ  চরিত্র। তারা প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজকীয় হারেমে বা জেনানামহলের প্রহরী আর চাকর হিসেবে নিযুক্ত হতো। এদের কিশোর এবং শিশু অবস্থায় নিয়ে আসা হতো। তারপর তাদের ক্যাস্ট্রেশন অর্থাৎ অন্ডকোষসহ শুক্রথলি কেটে ফেলে  বিশেষ শ্রেণীর পুরুষ-প্রাণী বানানো হতো যাতে তাদের যৌনসম্পর্ক করার ক্ষমতা না থাকে। 

শুক্রাশয় কেটে ফেলার ফলে খোজাদের জৈবিক চাহিদা থাকতো না। ফলে হারেমের নারীদের পাহারাদার ও কর্মচারী হিসেবে এদের চেয়ে উপযুক্ত আর কেউ ছিল না। খোজা বা ইউনাখ [Eunuch] শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ [Eunuchus] থেকে যার অর্থ হচ্ছে শয়নকক্ষের পাহারাদার। গ্রীক শব্দ Eune অর্থ বিছানা এবং Ekhein অর্থ হচ্ছে পাহারা দেয়া। ঠিক একইরকমভাবে ল্যাটিন ভাষায় স্প্যাডো, ক্যাস্ট্রাটাস শব্দগুলোর মানেও খোজা। বাংলায়  ইউনাখদের বলা হয় ‘খোজা’। খোজা শব্দটা উর্দু, পুরো শব্দটা হল খোজা সারাহ। তবে ইউনাখ কিংবা খোজাকৃত পরুষরা কেবল মধ্যপ্রাচ্যে ছিল তা নয়। প্রাচীন চীনের অভিজাত সমাজেও এদের বিশেষ ভূমিকায় দেখা গেছে। চীনে শিশ্নচ্ছেদ (castration) বা ক্যাস্ট্রেশন ছিল একাধারে শাস্তি এবং ইউনাখ করার অন্যতম পদ্ধতি। 

 অতীত কাল থেকেই দাস শ্রেণির পুরুষ শিশুদের যত কম বয়সে সম্ভব তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্যাস্ট্রেশন করানো হত। এ ধারাই বহু-নারীর মালিকদের সমাজে প্রচলিত ছিল।  পুরুষের হারেমে নারীদের বন্দিত্ব পাকাপোক্ত করতেই খোজা নিযুক্ত করা হত।  খোজা বানাতে গিয়ে যখন বালকদের অণ্ডকোষ কিংবা পুরুষাঙ্গ কাটার সময় অথবা পরবর্তীতে জটিলতায় আক্রান্ত হতো, তখন অনেকেরই বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ঘটেছে। আর অণ্ডকোষ ও পুরুষাঙ্গ কর্তনের পর ক্ষত সারাতে ব্যবহার করা হতা মরুভূমির বালি। আবার অনেক সময় বালকদের মুরুভূমিতে গলা পর্যন্ত পুঁতে রাখা হতো যতদিন না ক্ষত ভালো হয়।

খোজারা সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকেই প্রভাবশালী ক্ষমতাধর পুরুষের দাসত্ব করত!  প্রাচীন গ্রিস ও রোমেও ইউনাখ ছিল। তবে প্রাচ্যের মতন এত প্রবলভাবে নয়। প্রাচীন মিশরেও পুরুষের অঙ্গচ্ছেদ করানোর রীতি ছিল। এক্ষেত্রে মিশরীয়রা তিনটি পদ্ধতি অবলম্বন করতো : (১) পুরুষ জননাঙ্গের অপসারন; (২) কেবল অন্ডকোষের অপসারন; এবং (৩) একত্রে পুরুষাঙ্গ ও অন্ডকোষের অপসারণ। প্রাচীন মিশরের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে পুরুষ বন্দিদের অঙ্গচ্ছেদ করে ফারাও-এর কাছে উপস্থাপন করা হত। যুগের পর যুগ ধরেই খোজারা ক্ষমতাবানদের সেবায়  নিযুক্ত থেকেছে।  কখনো কখনো ক্যাথলিক চার্চ সুরেলা কন্ঠের বালকদের দিয়ে পোপের কোরাস গাওয়ানোর জন্য  খোজা বানিয়ে রাখতো। হাজার হাজার বছর ধরেই খোজারা ক্ষমতাশীল মানুষের হয়ে দাস হিসেবে কাজ করে যেতো। শুধু হারেম পাহারা নয়,  খোজাদের  আরও অনেক কাজ করতে হতো। যেমন মালিকের বিছানা তৈরি, গোসল করানো, চুল কাটা, পালকি টানা, মলমূত্রের ডাবা বয়ে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি কাজ করানো হতো।

 

ঐতিহাসিক আর নৃতাত্ত্বিক  গবেষণা থেকে জানা যায় যে, বহুবিবাহ, বাঁদি, দাসী আর গণিমতের মাল হিসেবে লুঠ করে আনা নারীদের এক জায়গায় জড়ো করে রাখার হারেম ব্যবস্থা গড়ে ওঠার কারণেই মূলত খোজা ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। হারেমের নারীদের ওপর নজর রাখার জন্য খোজা-বানানো পুরুষ প্রহরী নিয়োগ করা হতো। প্রাচীন মিশরে রণাঙ্গণে বন্দি তরুণ সৈনিকদের ধরে-ধরে খোজা করে ফেলা হতো।  দাস ব্যবসায়ীরা দাস বাজার থেকে  স্বাস্থ্যবান  তরুণদের কিনে  খোজা করে,  প্রাথমিক  প্রশিক্ষণ দিয়ে রাজকীয় ও অভিজাতবর্গের হারেমে বিক্রি করত। তুর্কি-মুঘল শাসনামলের আগে বাংলায় খোজা প্রথার অস্তিত্ব সম্পর্কে তেমন  প্রমাণ পাওয়া যায় না।  এটা স্পষ্ট যে, তুর্কি-মুগলরাই ভারতীয় উপমহাদেশে এবং মধ্যযুগের বাংলায় খোজা প্রথার প্রবর্তন করেছিল । 

 

‘খোজাকরণ উদ্বেগ’ বা ক্যাস্ট্রেশন অ্যাঙজাইটি নামে একটা তত্ব উপস্হাপন করেছিলেন সিগমুণ্ড ফ্রয়েড, যার আক্ষরিক আর উপমা উভয় অর্থেই লিঙ্গ কেটে নেবার আতঙ্ক বা খোজাকরণের ভয়। এটা সিগমুন্ড ফ্রয়েডের প্রথম দিকের মনোসমীক্ষণ তত্ত্বসমূহের মধ্যে একটা । যদিও ফ্রয়েড খোজাকরণ উদ্বিগ্নতাকে সর্বজনীন মানব অভিজ্ঞতা বলে দাবী করেছেন, এই বিষয়ে খুব কম গবেষণাই  হয়েছে। এই তত্বের বেশিরভাগ গবেষণা ফ্রয়েডের সময়ে আর পরে হয়েছিল । মনোবিদদের কাছে আজকের দিনেও এটা প্রাসঙ্গিক। এই তত্ত্ব অনুসারে, একটি শিশু তার সমলিঙ্গের বাবা বা মায়ের দ্বারা ( ছেলে বাবাকে ভয় পায়) বিপরীত লিঙ্গের বাবা বা মায়ের প্রতি যৌন অনুভূতি বোধ করে ( ছেলে মায়ের প্রতি আর মেয়ে বাবার প্রতি আকর্ষিত হয়) ফলে, ছেলে তার বাবার দ্বারা  যৌনাঙ্গ নষ্ট হয়ে যাবার ভয় পায়। তত্ত্ব অনুসারে, খোজাকরণ উদ্বেগ তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে শুরু হয়, যা ফ্রয়েডের মতে ফ্যালিক স্টেজ বা লৈঙ্গিক পর্যায়। যদিও এটা পুরুষের সাথে সম্পর্কিত, তত্ত্ব অনুসারে খোজাকরণ উদ্বেগ নারী, পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই কাজ করে।

 

ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষায়, খোজাকরণ উদ্বেগের দ্বারা মনোযৌন বিকাশের লৈঙ্গিক পর্যায়ে লিঙ্গ হারাবার অচেতন ভয় নির্দেশ করা হয় এবং সারা জীবন ধরে থাকে। ফ্রয়েডের মতে, যখন একটি পুরুষ শিশু নারী ও পুরুষ যৌনাঙ্গের পার্থক্য সম্পর্কে অবগত হয়, সে ধরে নেয় যে নারীর পুরুষাঙ্গকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে এবং সেও এব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয় যে, মাকে কামনার জন্য তার পুরুষাঙ্গও তার প্রতিদ্বন্দ্বী পিতার দ্বারা কেটে ফেলা হবে। ১৯ শতক আর তার আগে ইউরোপে অসদাচরণ করা ছেলেদের বাবার দ্বারা খোজাকরন বা অন্য কোনও ভাবে যৌনাঙ্গে আঘাত দেবার হুমকি প্রচলিত ছিল। ফরাসী লেখক মাইকেল টুরনিয়ের এর গল্পসমগ্র লে কক ডি ব্রুয়েরে (১৯৭৮) এর একটি গল্প ‘টুপিক’-এ এই ব্যাপারটি দেখা যায়, আর ফ্রয়েডও এটা বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছেন। একই সময় ডঃ কেলগ এবং অন্যরা যুক্তরাষ্ট্র ও ইংরেজি ভাষাভাষী দেশসমূহের ভিক্টোরিয়ান বাবা-মায়ের দ্বারা সন্তানদের খৎনাকরণ এবং খুব প্রয়োজন পড়লে ছেলেমেয়েদের বিস্তৃত পরিসরের যৌন আচরণ বিশেষ করে হস্তমৈথুন বা পরিচারিকার সঙ্গে বেশি মেশামিশি দেখলে সেই ছেলের শাস্তিস্বরূপ খোজাকরণের ব্যবস্থা করতেন। সেইসময় অভিজাতবর্গে এটা বেশ প্রচলিত প্রথা ছিল।

 

এই সূত্রে ফ্রয়েড ‘ইডিপাস কমপ্লেক্স’-এর কথা বলেছেন । এই শব্দটি গ্রীক বিয়োগান্তক নাটক ইডিপাস রেক্স থেকে নিয়েছিলেন। এই বিয়োগান্তক নাটকে প্রধান চরিত্র ইডিপাস তার বাবাকে খুন করে আর নিজের অজান্তে তার মাকেও হত্যা করে। এই নাটকীয় ঘটনার কারণে ফ্রয়েড এই অবচেতন কামনাকে ইডিপাস কমপ্লেক্স বলে উল্লেখ করেছেন। ফ্রয়েডের মতে, ইডিপাস কমপ্লেক্স দ্বারা ছেলেদের সার্বজনীনভাবে মাকে পুরোপুরি নিজের করে পাওয়া এবং বাবাকে সরিয়ে দেবার ইচ্ছাকে বোঝায়। এই কমপ্লেক্স ফ্রয়েডের মতে মনোযৌন সম্পর্কিত বিকাশের পর্যায়ে ঘটে যা লৈঙ্গিক পর্যায় নামে পরিচিত।এটা সেই পর্যায় যখন শিশু শেখে যে তার একটি পুরুষাঙ্গ আছে এবং সেটা স্পর্শ করে সে আনন্দ পায়। সেই সাথে, শিশুটি তার বিপরীত লিঙ্গের, অর্থাৎ বাবা বা মায়ের ওপর যৌনাকাঙ্ক্ষার ব্যাপারেও সচেতন হয়। ফ্রয়েডের মতে, মায়ের প্রতি এই আকাঙ্ক্ষার অর্থ হচ্ছে সে তার সাথে যৌনসংসর্গ ঘটাতে ইচ্ছুক । এই আকাঙ্ক্ষার কারণে শিশুটি তার বাবাকে মায়ের মনোযোগ ও ভালবাসার কারণে প্রতিযোগী হিসেবে দেখে। এই প্রতিযোগিতার কারণে, বালকটি তার বাবাকে তার সাথে তার মায়ের মিলনের ক্ষেত্রে বাধা বলে মনে করে।ইডিপাস কমপ্লেক্স এর সাংঘর্ষিক ব্যাপারটা শিশুর ভেতর থেকেই তৈরি হয়। শিশু তার বাবাকে ভালবাসতে ও শ্রদ্ধা করতে জানে, তবুও মায়ের প্রতি ভালবাসার জন্য সে তার বাবাকে তার প্রতিযোগী বলে মনে করে। তাছাড়া শিশুটি এও জানে যে পরিবার থেকে বাবাকে সরিয়ে দেয়াটা ভুল। কিন্তু তবুও সে তার প্রতিযোগীকে সরিয়ে দিতে চায় যাতে সে পুরোপুরিভাবে তার মাকে পায়।  ফ্রয়েড বিশ্বাস করতেন, ইডিপাস কমপ্লেক্স কখনই পুরোপুরি নিঃশেষিত হয় না। তিনি বলেছেন, কামনার অনুভূতি অবশ্যই ছেলের ভেতরের সচেতনতার ফলে চাপা থাকে  । এই অবদমন হচ্ছে শিশুকে এই কমপ্লেক্স সম্পর্কিত বিরক্তিকর উদ্বেগ থেকে মুক্ত করার জন্য তার মনের কৌশল। ফ্রয়েড আরও বলেন, এই যৌনকামনা শিশুর মধ্যে তবুও থেকে যায় এবং প্রায়ই আরও পরোক্ষ এবং সঠিক আচরণের আকারে প্রকাশিত হয়। শিশুর স্বপ্নে এটা পাওয়া যায়, স্বপ্নে শিশুটি উদ্বেগহীন এবং সমাজ স্বীকৃত রীতিতেই তার অবদমিত কামনাকে নিরাপদে প্রকাশ করতে পারে।

 

সাত

নারীর ক্ষমতায়নকে বিভিন্ন উপায়ে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে, যার মধ্যে নারীর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা বা তাদের মতামত জানার চেষ্টা করা, শিক্ষা, সচেতনতা, সাক্ষরতা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি করা। নারীর ক্ষমতায়ন সমাজের বিভিন্ন সমস্যার মধ্য দিয়ে নারীদের জীবন-নির্ধারক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে ; তাদের লৈঙ্গিক ভূমিকা বা এই জাতীয় অন্যান্য ভূমিকাগুলিোকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করার সুযোগ দেয়ার প্রয়োজনীয়তা , যা তাদের পছন্দসই লক্ষ্যগুলো উপলব্ধি  করার জন্য আরও স্বাধীনতা দিতে পারে। নারীর  স্ব-মূল্যবোধ, তাদের নিজস্ব পছন্দ নির্ধারণ করার ক্ষমতা, এবং নিজের এবং অন্যদের জন্য সামাজিক পরিবর্তনকে প্রভাবিত করার অধিকারকে আর অবহেলা করা যাবে না। ক্ষমতায়নের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত  যে ব্যাপারটা তা হলো নারীর মৌলিক মানবাধিকার, যা আরও শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ে তোলার চাবিকাঠি। নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর অধিকারের প্রতিষ্ঠা একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক আন্দোলনের  অংশ হিসেবে জরুরি প্রতিপন্ন হয়েছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা নতুন-নতুন এলাকায় বিস্তার ঘটাতে  চলেছে। আন্তর্জাতিক নারী ক্ষমতায়ন দিবসের মতো দিনগুলোও গতি পাচ্ছে। কিন্তু অনেক অগ্রগতি সত্ত্বেও, নারী ও মেয়েরা বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে বৈষম্য ও হিংস্রতার সম্মুখীন হচ্ছে। নারী-পাচার আর দাসী করে জবরদস্তি যৌনকাজে লাগানো  বড়ো সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে সোভিয়েত রাষ্ট্র ভেঙে যাবার পর । নারীর ক্ষমতায়ন সাক্ষরতা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। অধিকন্তু, নারীর ক্ষমতায়ন বলতে নারীদের কৌশলগত জীবন বেছে নেবার ক্ষমতা বোঝায়, যা থেকে আগে তারা বঞ্চিত ছিল।

নারীর ক্ষমতায়ন তৈরির জন্য, নারীবাদীরা নারীর  সচেতনতা বৃদ্ধির  কথা বলেছেন । চেতনা উন্নত করার দরুন, মহিলারা কেবল তাদের ব্যক্তিগত সংগ্রাম সম্পর্কেই যে কেবল জানতে পারেন তা নয় । সচেতনতা বৃদ্ধি কীভাবে  রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলির সাথে সম্পর্কিত তা জানাও জরুরি। চেতনা উন্নত করার প্রসঙ্গে প্রান্তিক ব্যক্তিদের বৃহত্তর সামাজিক কাঠামোতে কোথায় রাখা হয়েছে তা পরীক্ষা করে দেখতে এবং তাদের নিপীড়নের মূল সমস্যা চিহ্নিত করার বিষয়টির পর্যবেক্ষণ জরুরি। তাদের সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা নিজের ও অন্যান্য নারীদের সম্পর্কে ভাবতে প্রোৎসাহিত  করবে যা  ক্ষমতায়ন গড়ে তুলবে । নারীর ক্ষমতায়নের জন্য পুরুষের সঙ্গে সমতা জরুরি । লিঙ্গসমতা শুধুমাত্র একটি মৌলিক মানবাধিকার নয়, বরং একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও টেকসই বিশ্বের  প্রয়োজনীয় ভিত্তি।এর মধ্যে রয়েছে আত্মশক্তি থেকে নারীর দক্ষতা বৃদ্ধি।  নারীর ক্ষমতায়ন সাধারণত পাঁচটি প্রধান অংশে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে : সামাজিক, শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক।

 

ভারতীয়, বিশেষ করে বাংলার নারীর ক্ষমতায়ন আরম্ভ হয়েছিল ইংরেজরা আসার পর। উনিশশতকে জন্ম হয় এক নতুন ব্যক্তিত্বের নারী, যার সাথে মিল ছিল না তার আগের প্রজন্মের নারীদের। ইংরেজ ও ব্রাহ্মদের  শিক্ষার ফলে হিন্দু বাঙালির সমাজে দেখা দেন নতুন নারীরা।  উনিশ শতকে সামান্য সংখ্যক নারী  আলো দেখতে পায়। তারা  ব্ৰাহ্ম, দেশি খ্রিস্টান, ও ধনী হিন্দু পরিবারের,  উঁচু বর্ণ ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর। ওই আলো, শিক্ষা, তাদের বদলে দিয়েছিল ; এমন নারী দেখা দিয়েছিল বাঙলায়, যা আগে কখনো দেখা যায় নি। তার আগে বাঙলার নারী  হাজার বছর ধরে ছিল সামাজিক ক্ষমতাহীন । তার নিজের কোনো সত্তা ছিলো না । স্বাধীনতার কথা সে কখনো শোনে নি, তার কোনও স্বপ্ন ছিলো কিনা তা কেউ জানে না। পুরুষ তাকে নিকৃষ্টরূপে বঁচিয়ে রেখেছিল, বিধবা হলে আগুনে পুড়িয়েছিল, ইচ্ছেমতো গ্ৰহণ করেছিল ও ছেড়েছিল, বুড়ো বয়স পর্যন্ত একাধিক যুবতীকে বিয়ে করেছিল কেননা ঋতুস্রাব আরম্ভ হলেই মেয়েদের বিয়ে দেবার চল ছিল।  পশুকেও মূল্যবান গণ্য করতো বাঙালি পুরুষ কিন্তু নারীকে কখনো তার প্রাপ্য মূল্য দেয়নি।  তার সাথে পুরুষ কালেভদ্রে আন্তরিক সম্পর্কে এসেছে, তার শরীরকে  পরিতৃপ্ত করার প্রয়োজন মনে করেনি।  বাংলার দুটি সম্প্রদায়, হিন্দু ও মুসলমান,  ইংরেজরা আসার আগে পর্যন্ত বাস করতো গভীর মধ্যযুগীয় সংস্কারে। নারীর ক্ষমতায়ন যে সমাজকে উন্নীত করবে তা ভেবে দেখেনি তখনকার পুরুষ কর্তারা । 

 

নারীর ক্ষমতায়নের স্লোগানটি সর্বপ্রথম উচ্চারিত হয় ১৯৭৫ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত নারী সম্মেলনে। এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল  নারীর ক্ষমতায়ন। বর্তমান শতাব্দীতে নারীর ক্ষমতায়ন একটা আন্তর্জাতিক বিষয়। ১৯৯৫ সালে চীনের বেইজিং এ অনুষ্ঠিত  নারী সম্মেলনে  নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে একটি বড় ধরনের রোড ম্যাপ তৈরি হয়। এটি পরবর্তীকালে নারীর ইতিবাচক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। নারী মানবসমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মানবীয় জীবনযাপন প্রণালীর সাক্ষী। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রগুলো হলো পারিবারিক, সামাজিক সক্ষমতায় রাজনৈতিক, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড, অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় পরিকল্পনা প্রণয়নে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে, শিক্ষা কর্মকাণ্ড, গবেষণা কর্মকাণ্ড, সৃজনশীল উদ্ভাবনী, সেবামূলক কর্ম ইত্যাদিতে।  প্রাকৃতিক, জৈবিক, সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ইতিবাচক রূপান্তরে বা বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় নারী জড়িয়ে আছে আবহমান কাল থেকেই। যে সমাজে মেয়েদের ক্ষমতায়ন যত বেশি হয়েছে, সে সমাজ তত বেশি উন্নত হয়েছে। 

সাংবিধানিকভাবে নারী পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে প্রায় প্রতিটি উন্নত দেশে।  ভারতে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অর্থাৎ মানবিক ও সামাজিক সূচকে শহরবাসী  নারীর অংশগ্রহণ, ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য হলেও গ্রামীণ নারীরা রয়ে গেছেন ক্ষমতা বৃত্তের বাইরে। নারীর ক্ষমতায়ন সুপ্রষ্ঠিত হলে নারী প্রতিটি ক্ষেত্রে অনাবিল সুখ সমৃদ্ধি বয়ে নিয়ে আসবে সমগ্র সমাজে।  সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছ্ তবু  নারীর ক্ষমতায়ন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি এখনও।পরিবার পরিকল্পনায় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ভারতীয় নারীর অধিকার নেই বললেই চলে। ভোটদানের ক্ষেত্রে বাড়ির পুরুষরা অথবা ক্ষমতাশীন দলের মাস্তানরা নারীদের প্রভাবিত করে । আইনগত চুক্তিতে অংশগ্রহণ, বিবাহ-ধর্মীয় অধিকারসমূহ, অন্যান্য সকল অধিকার প্রতিটি বর্ণে আর বর্গে বলবৎ হলে নারীর সুকুমার বৃত্তি প্রকাশ হতে পারবে। 

 

বর্তমান কালখণ্ডে, পশ্চিমবাংলায় নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে পার্থসারথি সেনগুপ্ত বলেছেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একজন মহিলা হলেও পঞ্চায়েত রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে৷ কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী , পঞ্চায়েত স্তরে মহিলাদের প্রতিনিধিত্বের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের থেকে এগিয়ে ঝাড়খণ্ড , রাজস্থান , উত্তরাখণ্ড , কর্নাটক , কেরালা বা অসমের মতো রাজ্য৷ কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী , পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান ১২ নম্বরে৷ এগিয়ে সিকিমও৷ পঞ্চায়েত মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী , পঞ্চায়েতে মহিলাদের সর্বভারতীয় হার ৪৫ .৯৯ %৷ রাজ্যের পঞ্চায়েতগুলিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে ৪৯ .৮৮ % মহিলা৷ এই হিসেবে নিজের নির্ধারিত সংরক্ষণ সূচকের নিরিখেই পিছিয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ৷ কারণ , এই রাজ্যে পঞ্চায়েতে ৫০ % আসনই মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত৷ সমাজকর্মী অনুরাধা তলোয়ারের মতে , ‘আইনগত মাপকাঠির নিরিখেও তো পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে ‘।

 

পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যে পঞ্চায়েতে মহিলাদের জন্য ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষিত৷ এর অন্যতম কারণ পঞ্চায়েত স্তরে রাজনীতি বা সংগঠন রাজনৈতিক দলগুলির কুক্ষিগত৷ হিংসারও প্রকোপ রয়েছে৷ যা মহিলাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পথে কাঁটা ৷ ইদানীং পঞ্চায়েতগুলোর স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে৷ বিডিও  অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাশালী৷ ‘অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষের কথায় , ‘সমাজের নানা ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রশ্ন করার অভ্যাসটা বরদাস্ত করা হয় না৷ নিঃসন্দেহে শিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েরা এই রাজ্যে অপেক্ষাকৃত এগিয়ে রয়েছেন৷ কিন্তু , রাজনীতিতে বহু ক্ষেত্রেই মেয়েরা আসেন পুরুষের হাত ধরে৷ সেটা ডান -বাম সব রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষেত্রেই খাটে৷ রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে মেয়েরা লালপাড় শাড়ি পরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবেন , গণ্যমান্যদের হাতে ফুলের গুচ্ছ তুলে দেবেন , অভ্যর্থনায় থাকবেন আর খাওয়াদাওয়ার সময়ে পরিবেশন করবেন --- এটাই যেন আশা করা হয়৷ ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী , এই রাজ্যে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের দুই তৃতীয়াংশই গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা৷ সব মিলিয়ে , মেয়েদের নিয়ে জড়তা রয়েই গিয়েছে৷

 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া চর্চা কেন্দ্রের বিভাগীয় প্রধান পলা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “মাত্র একটি সূচকের হিসেবে কখনোই নারীর ক্ষমতায়নের মূল্যায়ন সম্ভব নয়৷ যেমন , কেন্দ্রীয় এই পরিসংখ্যানে ত্রিপুরায় পঞ্চায়েতে মহিলাদের প্রতিনিধিদের হার দেখানো হয়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ৷ এটা কী করে সম্ভব ? ত্রিপুরা প্রথম মহিলাদের জন্য পঞ্চায়েতে ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করে৷ আরও দেখার , কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যানে বিজেপি -শাসিত রাজ্যগুলি কত নম্বরে৷ পশ্চিমবঙ্গ তো চষে বেড়াই৷ গ্রামেগঞ্জে দেখি সকালে কত মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে৷ আমরা যে অনেক দিক থেকে এগোচ্ছি , সেই সূচকগুলিও দেখা দরকার৷ ’ পঞ্চায়েতমন্ত্রী প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের যুক্তি দিয়েছিলেন , ‘এই হিসেব শুধু সংরক্ষিত আসনগুলির৷ আমরা মহিলাদের জন্য পঞ্চায়েতে আসন সংরক্ষণ করেছি৷ পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য রাজ্যগুলির তুলনায় মহিলারা রাজনীতির নানা ক্ষেত্রে অনেক স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশ নেন৷ এখানে পঞ্চায়েতে সংরক্ষিত আসনের বাইরেও সাধারণ আসনগুলিতে অনেক মহিলা প্রতিনিধিত্ব করেন৷ সেই সংখ্যা যোগ করলে আমরা ৫০ শতাংশ ছাপিয়ে যাব৷ ’ ঝাড়খণ্ড ৫৯ .১৮ % রাজস্থান ৫৮ .২৯ % উত্তরাখণ্ড ৫৭ .৮৩ % ছত্তিশগড় ৫৫ .১৪ % কর্নাটক ৫৩ .৪০ % কেরালা ৫১ . ৮৫ %বিহার ৫১ .৬৪ %হিমাচল ৫০ .১১ %মধ্যপ্রদেশ ৫০ %অসম ৫০ %অন্ধ্র ৫০ % সিকিম ৪৯ .৯৫ %মহারাষ্ট্র ৪৯ .৯৩ %পশ্চিমবঙ্গ ৪৯ .৯৮ % প্রতিনিধিত্বের হার ৷”

 

লিঙ্গ ক্ষমতায়ন প্রচলিতভাবে নারীর ক্ষমতায়নকে বোঝায়, যা আজকাল উন্নয়ন এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে আলোচনার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। এটা একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্যান্য প্রান্তিক লিঙ্গ সম্পর্কিত পদ্ধতির দিকেও নির্দেশ করে। ক্ষমতায়নের এই পদ্ধতিটা আংশিকভাবে নারীবাদীরা প্রতিষ্ঠা করেছেন আর আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের উপর ভিত্তি করে আইনি ক্ষমতায়নকে কাজে লাগানো হয়েছে। মানবাধিকার ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন একটা প্রধান পদ্ধতিগত উদ্বেগ। মানব উন্নয়ন এবং সক্ষমতার দৃষ্টিভঙ্গি, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, এবং অন্যান্য আন্দোলনগুলো ক্ষমতায়ন নারীর অংশগ্রহণকে একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসাবে মান্যতা দিয়েছে । 

 

লিঙ্গ ক্ষমতায়ন প্রচলিতভাবে নারীর ক্ষমতায়নকে বোঝায়, যা আজকাল উন্নয়ন এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে আলোচনার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। এটা একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্যান্য প্রান্তিক লিঙ্গ সম্পর্কিত পদ্ধতির দিকেও নির্দেশ করে। ক্ষমতায়নের এই পদ্ধতি আংশিকভাবে নারীবাদের দ্বারা অবহিত করা হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের উপর ভিত্তি করে আইনি ক্ষমতায়নকে কাজে লাগানো হয়েছে। মানবাধিকার ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন একটি প্রধান পদ্ধতিগত উদ্বেগ।  মানব উন্নয়ন এবং সক্ষমতার দৃষ্টিভঙ্গি, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, এবং অন্যান্য বিশ্বাসযোগ্য পন্থা/লক্ষ্যগুলি ক্ষমতায়ন এবং অংশগ্রহণকে একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসাবে নির্দেশ করে ।আমরা সবাই মিলে যখন কাউকে বা কোনো গোষ্ঠী বা বর্গকে ক্ষমতা দিই, তখন তাদের জীবনের নিয়ন্ত্রণে আরও বেশি অনুভব করতে সহায়তা করি - আমরা সবাই মিলে আক্ষরিক অর্থেই তাদের ক্ষমতা দিই। আমরা সাধারণত এমন কাউকে বা গোষ্ঠীকে বা বর্গকে ক্ষমতায়ন করার কথা বলি যিনি বা যাঁরা কোনো না কোনোভাবে সুবিধাবঞ্চিত ।

 

বহু দেশে, বিশেষ করে ক্যাথলিক খ্রিস্টান দেশগুলোতে, নারী গর্ভপাত করাবে কি না, তা নির্ণয়ের অধিকার দেয়া হয়নি । ভারতেও নারী কতো সপ্তাহের পর আর গর্ভপাত করাতে পারবে না তার আইন তৈরি হয়েছে । অর্থাৎ নারীর কাছ থেকে তার দেহের ওপরে তার অধিকারের ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে ।

 

 

আট

হেনরি কিসিঞ্জারকে ফোর্বস পত্রিকা অনুরোধ করেছিল মানবেতিহাসে সবচেয়ে ক্ষমতাবান সাতজন পুরুষের তালিকা তৈরি করতে । উনি তালিকা তৈরি সময়ে বলেছিলেন, “ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষমতাবান সাত ব্যক্তির তালিকা করতে হলে ক্ষমতা শব্দটি সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন। আমি এখানে এটাকে ভবিষ্যতের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং তা প্রভাবিত করার শক্তির অর্থে ব্যবহার করছি। শক্তি ছাড়া দৃষ্টি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন। দৃষ্টিবিহীন শক্তি ক্ষমতার জন্ম দেয় না। এই কারণে, আমি ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের বাদ দিয়েছি যাদের ক্ষমতা আধ্যাত্মিক, সামরিক নয়। এই যোগ্যতার সাথে, এখানে আমার তালিকা।”

এক : জুলিয়াস সিজার  ( ১০০ - ৪৪ বিসি ) : সম্রাট, রোমান সাম্রাজ্য

তিনি রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের জন্য সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছিলেন, এর প্রজাতন্ত্রী প্রতিষ্ঠানগুলিকে বিলুপ্ত করার ভিত্তি তৈরি করেছিলেন কিন্তু একই সময়ে, একটি রোমান সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, যা ইংল্যান্ড থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যা চার শতাব্দী স্থায়ী হয়েছিল।

দুই : কিন শি হুয়াং ( ২৫৯ - ২১০ বিসি ) : সম্রাট, একীভূত চীন

তিনি তার প্রতিযোগীদের জয় করে যুদ্ধরত রাজ্যের তথাকথিত সময়কালের অবসান ঘটিয়েছিলেন এবং ২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, চীনা রাষ্ট্র তৈরি করেছিলেন যা কিছু বাধার সাথে, আজ অবধি টিকে আছে।

তিন : পিটার দি গ্রেট ( ১৬৭২ - ১৭২৫ খ্রিস্টাব্দ ) : জার, রাশিয়ান সাম্রাজ্য

তিনি একটি পশ্চাৎপদ রাশিয়ান সমাজকে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং এক প্রজন্মের মধ্যে এটিকে এমন এক পর্যায়ে আধুনিক করে তোলেন যেখানে এটি তার সমস্ত প্রতিবেশীদের চ্যালেঞ্জ করতে পারে।

চার : মহাত্মা গান্ধি ( ১৮৬৯ - ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ ) : নেতা, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন

তার ভারতীয় নির্বাচনের আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি আবেদন জানিয়ে, গান্ধী তার স্বাধীনতার প্রতি ভারতের মনোযোগ সংগঠিত করেছিলেন, জাতি খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিলেন, যা বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।

পাঁচ : নেপোলিয়ান বোনাপার্ট ( ১৭৬৯ - ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দ ) : সম্রাট, ফরাসি সাম্রাজ্য

তিনি বেশিরভাগ ইউরোপ জয় করেন। যদিও বিজয়গুলি ক্ষণস্থায়ী ছিল, ফরাসি বিস্ফোরণের ফলে জাতিরাষ্ট্র ভিত্তিক ইউরোপ প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিস্তার ঘটে।

ছয় : থিয়োডোর রুজভেল্ট ( ১৮৫৮ - ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ ) : রাষ্ট্রপতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি ব্যবহার করেছিলেন আমেরিকাকে বাকি বিশ্বের সাথে যুক্ত করার জন্য এবং সফল হয়েছিলেন। তিনি রাশিয়া-জাপানি যুদ্ধের মধ্যস্থতা করেছিলেন, যা  স্থায়ী আমেরিকান প্রবেশ এবং এশিয়ার চূড়ান্ত লক্ষ্য চিহ্নিত করেছিল।

সাত : ১৯৪৫ থেকে মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা : আধুনিক রাষ্ট্রপতিদের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র এবং অর্থনৈতিক শক্তির অস্ত্রাগার রয়েছে যা আমেরিকাকে শান্তি এবং অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য উপাদান করে তোলে। সোভিয়েত রাষ্ট্রকে ভেঙে দুর্বল করে দিতে পেরেছে ।

কিসিঞ্জারের সাত নম্বরটা রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর ধোপে টেকে না । রাশিয়া আণবিক অস্ত্রের হুমকি দেবার পর আমরিকা আর ন্যাটো ভয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছে । এ থেকে টের পাওয়া যায় যে ক্ষমতা ব্যাপারটার কোনো নির্দিষ্ট অবয়ব নেই ; তা সময়ানুযায়ী পালটাতে থাকে, পালটে চলেছে ।

নয়

আরেকজন আছেন বা কতোজন আছেন তা জানা নেই কিন্তু পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ মনে করে অমন ক্ষমতা আর কারোর নেই । বিভিন্ন দেশে, ভাষায়, ধর্মে তাঁর নানা নাম আছে যেমন সৃষ্টিকর্তা, ভগবান, ঠাকুর, ঈশ্বর, গড, ইষ্টদেবতা, গোপাল, দেবতা, দেবী, যহওয়েহ, পরওয়রদিগার, অকাল পুরখ, আহুরা মাজদা, হা-শেম, এলোহিম এবং আরও আজস্র নামে পরিচিত ।

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন