প্রস্তাবনা
তুমি ভাবলে,
স্যাঁতসেতে এক মগজের কল্পনায়,
এক তেলচিটে খাটে হাত-পা-ছড়ানো পেট-মোটা চাকরের মতন,--
আমার হৃদয়ের রক্তাক্ত ছেঁড়া টুকরো নিয়ে, আমি আবার ঠাট্টা করব ।
যতক্ষণ না আমি উপেক্ষিত নই, আমি হবো নিষ্ঠুর আর পীড়াদায়ক ।
আমার চিত্তে আর দাদুসুলভ স্নেহশীলতা নেই,
আমার আত্মায় আর ধূসর চুল নেই !
আমার কন্ঠস্বর দিয়ে জগতকে ঝাঁকিয়ে আর কাষ্ঠহাসি হেসে,
আমি তোমাদের পাশ দিয়ে চলে যাই, -- সৌম্যকান্তি,
বাইশ বছর বয়সী ।
সুশীল ভদ্রমহোদয়গণ !
তোমরা বেহালায় তোমাদের ভালোবাসা বাজাও ।
অমার্জিতরা তা ঢোলোকে তারস্বরে বাজায় ।
কিন্তু তোমরা কি নিজেদের অন্তরজগতকে বাইরে আনতে পারো, আমার মতন
আর কেবল দুটো ঠোঁট হয়ে যেতে পারো পুরোপুরি ?
এসো আর শেখো--
তোমরা, দেবদূত-বাহিনীর ফুলবাবু আমলার দল !
মিহি কাপড়ের বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে এসো
আর তোমরা, যারা তোমাদের ঠোঁট পেতে দিতে পারো
সেই রাঁধুনীর মতন যে নিজের রান্নার বইয়ের পাতা ওলটায় ।
যদি তোমরা চাও--
আমি কাঁচা মাংসের ওপরে চারুশিল্পের শত্রুর মতন লালসিত হবো
কিংবা সূর্যোদয় যে উদ্রেক ঘটায় তার রঙে পালটে দেবো,
যদি তোমরা চাও---
আমি হতে পারি অনিন্দনীয় সুশীল,
মানুষ নয় -- কিন্তু ট্রাউজার-পরা এক মেঘ।
আমি সুন্দর অঙ্কুরোদ্গমে বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করি !
তা সত্ত্বেও আমি তোমাদের প্রশংসা করব, ---
পুরুষের দল, হাসপাতালের বিছানার চাদরের মতন কোঁচকানো,
আর নারীরা, অতিব্যবহৃত প্রবাদের মতন নির্যাতিত ।
প্রথম পর্ব
তোমরা কি ভাবছ আমি ম্যালেরিয়ায় ভুল বকছি ?
তা ঘটেছিল ।
ওডেসায়, তা ঘটেছিল ।
“আমি চারটের সময় আসব,” কথা দিয়েছিল মারিয়া ।
আটটা…
নয়টা…
দশটা…
তারপর তাড়াতাড়ি,
সন্ধ্যা,
বিরাগ দেখানো,
আর ডিসেম্বরসুলভ,
জানালাগুলো ছেড়ে
আর ঘন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ।
আমার পেছন থেকে, আমি শুনতে পাই হ্রেষা আর হাসি
ঝাড়বাতিগুলোর ।
তোমরা আমায় চিনতে পারতে না যদি আগে থেকে পরিচিত হতে :
পেশীতন্তুর স্তুপ
গোঙানি,
স্নায়বিক অস্হিরতা ।
এরকম একজন বোকাটে কি চাইতে পারে ?
কিন্তু একজন বোকাটে অনেক কিছু চায় ।
কেননা নিজের জন্য তা অর্থহীন
তা তোমরা তামায় গড়া হও
কিংবা হৃদয় হোক শীতল ধাতুর ।
রাতের বেলায়, তোমাদের দাবিকে জড়িয়ে নিতে চাইবে
মেয়েলি কোনোকিছু দিয়ে,
কোমল ।
আর এইভাবে,
বিশাল,
আমি কাঠামোর ভেতরে প্রতিষ্ঠিত হই.
আর আমার কপাল দিয়ে, গলিয়ে ফেলি জানালার কাচ ।
এই ভালোবাসা কি অসাধারণ হবে নাকি গতানুগতিক ?
তা কি বজায় থাকবে নাকি উপেক্ষিত হবে ?
বিরাট কেউ এরকম দেহে আঁটবে না :
একটু ভালোবাসা জরুরি, -- একটা শিশু, হয়তো,
যখন মোটরগাড়ি হর্ন বাজায় আর আওয়াজ করে তখন এ ভয় পায়,
কিন্তু ঘোড়ায়-টানা ট্র্যামের ঘণ্টি পছন্দ করে ।
আমি মুখোমুখি হলুম
তরঙ্গায়িত বৃষ্টির সঙ্গে,
তবু আরেকবার,
আচ্ছা অপেক্ষা করো
শহুরে ফেনার বজ্রপাতের গর্জনে ভিজে গেলুম ।
ছুরি নিয়ে পাগলের মতন বাইরে বেরিয়ে,
রাত ওকে ধরে ফেললো
আর ছুরি মেরে দিলো,
কেউ দেখেনি ।
ঠিক মধ্যরাতে
গিলোটিন থেকে খসা মুণ্ডুর মতন পড়ে গেলো।
জানালার কাচে রুপোর বৃষ্টিফোঁটা
জমিয়ে তুলছিল মুখবিকৃতি
আর চেঁচাচ্ছিল ।
যেন নত্রে দামের পশুমুখো নর্দমাগুলো
চেল্লানো আরম্ভ করে দিলো ।
ধিক্কার তোমাদের !
যা ঘটেছে তাতে কি তোমরা এখনও সন্তুষ্ট নও ?
কান্না এবার চারিধার থেকে আমার গলা কাটবে।
আমি শুনতে পেলুম:
আস্তে,
বিছানার বাইরে রোগীর মতন,
একটা স্নায়ু লাফালো
নীচে ।
প্রথমে,
পুরুষটা সরে যায়নি, প্রায় ।
তারপর, সন্দিগ্ধ
আর সুস্পষ্ট,
ও লাফাতে আরম্ভ করলো।
আর এখন, ও আর আরও দুই জন,
এদিক-ওদিক লাফাতে লাগলো, তিড়িঙ নাচ ।
একতলায়, পলেস্তারা তাড়াতাড়ি খসে পড়ছিল ।
স্নায়ুরা,
বড়োগুলো
ছোটোগুলো,--
নানান ! --
পাগলের মতন টগবগাতে আরম্ভ করলো
যতক্ষণ না, শেষে,
ওদের পা ওদের টানতে অক্ষম হলো ।
ঘর থেকে রাত টপটপ করে বেরিয়ে এলো আর ডুবে গেলো।
চটচটে মাটিতে আটকে গিয়ে, চোখ তা থেকে পিছলে বের করতে পারলো না।
হঠাৎ দরোজাগুলো দুমদাম করতে লাগলো
যেন হোটেলের দাঁতগুলো কিড়মিড় করতে শুরু করেছে ।
তুমি প্রবেশ করলে,
আচমকা যেন “এই নাও !”
সোয়েড চামড়ার মোচড়ানো দস্তানা পরে, তুমি অপেক্ষা করলে,
আর বললে,
“তুমি জানো,--
আমার শিগগির বিয়ে হবে।”
তাহলে যাও বিয়ে করো ।
ঠিকই আছে,
আমি সামলে নিতে পারবো ।
দেখতেই পাচ্ছো -- আমি শান্ত, নিঃসন্দেহে !
কোনো শবের
নাড়ির স্পন্দনের মতন ।
মনে আছে ?
তুমি বলতে :
“জ্যাক লণ্ডন,
টাকাকড়ি,
ভালোবাসা আর আকুলতা,”--
আমি কেবল একটা ব্যাপারই দেখেছি :
তুমি ছিলে মোনালিসা,
যাকে চুরি করা জরুরি ছিল !
আর কেউ তোমায় চুরি করে নিলো ।
ভালোবাসায় আবার, আমি জুয়া খেলা আরম্ভ করব,
আমার ভ্রুর তোরণ আগুনে উদ্ভাসিত ।
আর কেনই বা নয় ?
অনেক সময়ে গৃহহীন ভবঘুরেরা
পোড়া বাড়িতেও আশ্রয় খোঁজে !
তুমি আমাকে ঠাট্টা করছো ?
“উন্মাদনার কেবল গুটিকয় চুনী আছে তোমার
ভিখারির কয়েক পয়সার তুলনায়, একে ভুল প্রমাণ করা যাবে না !”
কিন্তু মনে রেখো
এইভাবেই পম্পেইয়ের শেষ হয়েছিল
যখন কেউ ভিসুভিয়াসের সঙ্গে ইয়ার্কি করেছিল !
ওহে !
ভদ্রমহোদয়গণ !
তোমরা অশুচি
নিয়ে চিন্তা করো,
অপরাধ
আর যুদ্ধ ।
কিন্তু তোমরা কি দেখেছো
ভয়ঙ্কর সন্ত্রস্ত
আমার মুখ
যখন
তা
নিখুঁত শান্তিময়তায় থাকে ?
আর আমি অনুভব করি
“আমি”
আমাকে ধরে রাখার জন্য খুবই ক্ষুদ্র ।
আমার অন্তরে কেউ কন্ঠরুদ্ধ হচ্ছে ।
হ্যালো !
কে কথা বলছে ?
মা ?
মা !
তোমার ছেলের হয়েছে এক অত্যাশ্চর্য অসুখ !
মা !
ওর হৃদয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে !
তার বোন, লিডিয়া আর ওলগাকে বোলো
যে আর কোথাও কোনো লুকোবার জায়গা নেই ।
প্রতিটি শব্দ,
মজার হোক বা অভদ্র,
যা ও নিজের জ্বলন্ত মুখ থেকে ওগরায়,
উলঙ্গ বেশ্যার মতন ঝাঁপিয়ে পড়ে
জ্বলন্ত বেশ্যালয় থেকে ।
লোকেরা গন্ধ শোঁকে--
কোনো কিছু পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে ।
ওরা দমকলকে ডাকে ।
ঝলমলে হেলমেট পরে
তারা অবহেলাভরে ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে ।
ওহে, দমকলের লোকদের বলো :
বুটজুতো পরে ঢোকার অনুমতি নেই !
গনগনে হৃদয় নিয়ে একজনকে বিচক্ষণ হতে হবে ।
আমিই তা করব !
আমি আমার জলভরা চোখ ঢেলে দেবো চৌবাচ্চায় ।
আমাকে কেবল আমার পাঁজরকে ঠেলতে দাও আর আমি আরম্ভ করে দেবো।
আমি লাফিয়ে পড়বো ! তোমরা আমাকে বাধা দিতে পারবে না !
তারা বিদ্ধস্ত ।
তোমরা হৃদয় থেকে লাফিয়ে পড়তে পারবে না !
ঠোঁটের ফাটল থেকে,
এক অঙ্গার-আস্তৃত চুমু উৎসারিত হয়,
জ্বলন্ত মুখাবয়ব থেকে পালিয়ে যায় ।
মা !
আমি গান গাইতে পারি না ।
হৃদয়ের প্রার্থনাঘরে, আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল গায়কদের গায়ে !
শব্দাবলী আর সংখ্যাসমূহের প্রতিমাদের
খুলির ভেতর থেকে,
জ্বলন্ত বাড়ি থেকে শিশুদের মতন, পালাতে থাকে ।
এইভাবে ভয়,
আকাশে পৌঁছে, ডাক দেয়
আর তুলে ধরে
লুসিতানিয়ার আগুনে-বাহু আর উদ্বেগ ।
শত-চোখ আগুন শান্তির দিকে তাকালো
ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে, যেখানে লোকেরা ঘামছিল ।
এক শেষতম চিৎকারে,
তুমি কি গোঙাবে, অন্তত,
শতাব্দীগুলোকে প্রতিবেদন দেবার জন্য যে আমি অগ্নিদগ্ধ ?
দ্বিতীয় পর্ব
আমার মহিমাকীর্তন করো !
প্রসিদ্ধরা কেউ আমার সমকক্ষ নয় !
যাকিছু এপর্যন্ত করা হয়েছে তার ওপরে
আমি ছাপ মেরে দিই “নস্যাৎ।”
আপাতত, আমার পড়ার ইচ্ছে নেই।
উপন্যাস ?
তাতে কি !
বইপত্র এইভাবে তৈরি হয়,
আমি ভাবতুম :--
একজন কবির আগমন হয়,
আর নিজের ঠোঁট অনায়াসে খোলে।
অনুপ্রাণিত, মূর্খটা বেমালুম গাইতে আরম্ভ করে--
ওহ ক্ষান্তি দাও !
দেখা গেলো :
উৎসাহে গাইবার আগে,
নিজেদের কড়া-পড়া পায়ে ওরা কিছুক্ষণ তাল ঠোকে,
যখন কিনা কল্পনার ঘিলুহীন মাছেরা
হৃদয়ের পাঁকে কাদা ছেটায় আর মাখামাখি করে ।
আর যখন, ছন্দে হিসহিসোচ্ছে, ওরা গরম জলে সেদ্ধ করে
যাবতীয় ভালোবাসা আর পাপিয়া-পাখিদের ক্বাথের মতন ঝোলে,
জিভহীন পথ কেবল কিলবিল করে আর কুণ্ডলী পাকায়---
তাতে আর্তনাদ করার বা এমনকি বলার মতো কিছুই থাকে না ।
আমরা নিজের গর্ববশে, সারাদিন সৎমেজাজে কাজ করি
আর ব্যাবেলের শহর-মিনারগুলোর আবার পুনরানয়ন হয় ।
কিন্তু ঈশ্বর
গুঁড়িয়ে
এই শহরগুলোকে ফাঁকা মাঠে পালটে ফ্যালেন,
শব্দকে মন্হন করে ।
নৈঃশব্দে, রাস্তাকে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় দুর্দশায়।
গ্রাসনলিকার পথে এক চিৎকার ঋজু দাঁড়িয়ে পড়ে।
যখন মোটাসোটা ট্যাক্সি আর মোটরগাড়ি অন্তরায়ে স্হির,
গলার ভেতরে আটকে থাকে ।
যেন ক্ষয়রোগের কারণে,
নিষ্পিষ্ট বুক শ্বাস নেবার জন্য খাবি খাচ্ছিল ।
শহর, বিষাদে আক্রান্ত, তাড়াতাড়ি রাস্তা বন্ধ করে দিলো ।
আর তখন--
তা সত্ত্বেও !--
রাস্তাটা চৌমাথার মোড়ে নিজের ধকল উগরে দিলো কেশে
আর গলা থেকে বারান্দাকে ঠেলে বের করে দিলো, শেষ পর্যন্ত,
মনে হলো যেন,
শ্রেষ্ঠশ্রেনির দেবদূতের গায়কদলের ধুয়ায় যোগ দিয়ে,
সাম্প্রতিককালে লুন্ঠিত, ঈশ্বর তার তাপ আমাদের দেখাবে !
কিন্তু রাস্তাটা উবু হয়ে বসে কর্কশকন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো :
“খেতে যেতে দাও !”
শিল্পপতি ক্রুপ আর তার আণ্ডাবাচ্চারা ঘিরে ধরে
শহরে চোখরাঙানো ভ্রু আঁকার জন্য,
যখন কিনা সঙ্কীর্ণ প্রবেশপথে
শব্দাবলীর লাশ এদিক-ওদিক ছড়ানো পড়ে থাকে,--
দুটো বেঁচে থাকে আর মাথাচাড়া দ্যায়,--
“শুয়োর”
আর অন্যটা,--
আমার মনে হয় “খাবার সুপ” ।
আর কবির দল, ফোঁপানি আর নালিশে ভিজে সপসপে,
রাস্তা থেকে দৌড় লাগায়, বিরক্ত আর খিটখিটে :
“ওই দুটো শব্দ দিয়ে এখন আর ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়
এক সুন্দরী রমণী
কিংবা ভালোবাসা
কিংবা শিশির-ঢাকা ফুল।”
আর কবিদের পর,
অন্যান্য হাজার লোকের হুড়োহুড়ি আরম্ভ হলো :
ছাত্রছাত্রীর দল,
বেশ্যার দল,
বিক্রেতার দল ।
ভদ্রমহোদয়গণ,
থামুন !
আপনারা তো অভাবগ্রস্ত নন ;
তাহলে ভদ্রমহোদয়গণ কেন আপনারা ওগুলো চাইছেন !
প্রতিটি পদক্ষেপে দালান অতিক্রম করে,
আমরা স্বাস্হ্যবান আর অত্যুৎসাহী !
ওদের কথা শুনবেন না, বরং ওদের পিটুনি দিন !
ওদের,
যারা মাঙনার বাড়তি হিসাবে সেঁটে রয়েছে
প্রতিটি রাজন্য-বিছানায় !
আমাদের কি নম্রভাবে ওদের জিগ্যেস করতে হবে :
“সাহায্য করো, দয়া করে !”
স্তবগানের জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করতে হবে
আর বাগ্মীতার জন্য ?
আমরা জ্বলন্ত স্তবগানের সৃষ্টিকারী
কলমিল আর রসায়ানাগারের গুনগুনানির পাশাপাশি ।
আমি কেন ফাউস্তের কথা ভাবতে যাবো ?
আতশবাজির লুন্ঠনে পরীদের প্রদর্শন করে
ও মেফিসটোফিলিসের সঙ্গে নক্ষত্রপূঞ্জের নকশাকাটা পাটাতনে পিছলে চলেছে !
আমি জানি --
আমার বুটজুতোয় একটা পেরেক
গ্যেটের কল্পনার চেয়ে বেশি ভয়াবহ !
আমি
সবচেয়ে সোনালী-হাঁমুখের
প্রতিটি শব্দের সঙ্গে আমি দিচ্ছি
দেহের এক নামদিবস,
আর আত্মাকে এক পূনর্জন্ম,
আমি তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি :
জীবজগতের কণাও
আমি এই পৃথিবীতে যা কিছু করব তার চেয়ে অনেক বেশি !
শোনো !
বর্তমান যুগের জরাথুষ্ট্র,
ঘামে ভিজে,
তোমাদের চারিপাশে দৌড়োচ্ছে আর এখানে ধর্মপ্রচার করছে ।
আমরা,
বিছানার কোঁচকানো চাদরের মতন মুখ নিয়ে,
ঝাড়লন্ঠনের মতন ঝোলা ঠোঁটে,
আমরা,
কুষ্ঠরোগীর জন্য নির্দিষ্ট শহরে বন্দী,
যেখানে, জঞ্জাল আর সোনা থেকে, কুষ্ঠরোগীদের ঘা দেখা দিয়েছিল,
আমরা ভেনিসের নীলাভ সমুদ্রের চেয়ে পবিত্র,
রোদ্দুরের মলম-রশ্মিতে ধোয়া ।
আমি সেই তথ্যে থুতু ফেলি
যে হোমার আর ওভিদ সৃষ্টি করেননি
গুটিবসন্তে ঢাকা ঝুল,
আমাদের মতন সব মানুষদের,
কিন্তু সেই সঙ্গে, আমি জানি যে
সূর্য ফ্যাকাশে হয়ে যাবে
যদি তা আমাদের আত্মার সোনালি খেতের দিকে তাকায়।
প্রার্থনার তুলনায় পেশী আমাদের কাছে নির্বিকল্প !
আমরা আর ভরতুকির জন্য প্রার্থনা করব না !
আমরা--
আমরা প্রত্যেকে--
নিজেদের মুঠোয় ধরে রাখি
জগতকে চালনা করার লাগাম !
এ-থেকেই সভাস্হলগুলোয় গোলগোথার সূত্রপাত
পেট্রোগ্রাড, মসকো, কিয়েভ, ওডেসায়,
আর তোমাদের একজনও সেখানে ছিলে না যারা
এইভাবে হাঁক পাড়ছিল না :
“ওকে ক্রুসবিদ্ধ করো !
ওকে উচিত শিক্ষা দাও !”
কিন্তু আমার কাছে,--
জনগণ,
এমনকি তোমরা যারা জঘন্য ব্যবহার করেছ,--
আমার কাছে, তোমরা প্রিয় আর আমি গভীরভাবে তোমাদের কদর করি।
দেখোনি কি
যে হাত তাকে পেটাচ্ছে সেই হাতকেই কুকুরটা চাটছে ?
আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে
আজকালকার দলবল ।
তারা তৈরি করেছে
আমাকে নিয়ে
একটা নোংরা পরিহাস ।
কিন্তু আমি সময়ের পাহাড়কে ডিঙিয়ে দেখতে পাই,
ওনাকে, যাঁকে কেউ দেখতে পায় না ।
যেখানে মানুষের দৃষ্টিশক্তি পৌঁছোয় না,
বিপ্লবের কাঁটার মুকুট পরে,
ক্ষুধার্ত মানুষদের নেতৃত্ব দিয়ে,
১৯১৬ সাল ফিরে আসছে ।
তোমাদের মধ্যে, ওনার অগ্রদূত,
যেখানেই দুঃখকষ্ট থাকবে, আমি থাকবো কাছাকাছি ।
আমি সেখানে নিজেকে ক্রুশবিদ্ধ করেছি,
প্রতিটি অশ্রুফোঁটার ওপরে ।
ক্ষমা করার মতন এখন আর কিছু নেই !
যে আত্মারা সমবেদনার অঙ্কুরের জন্ম দেয়, আমি পুড়িয়ে দিয়েছি তার ক্ষেত ।
তা অনেক কঠিন
হাজার হাজার ব্যাষ্টিল আক্রমণের তুলনায় ।
আর যখন
তাঁর আবির্ভাব ঘোষিত হয়,
আনন্দে আর গর্বে,
তোমরা এগিয়ে যাবে উদ্ধারককে অভ্যর্থনা জানাতে--
আমি টেনে নিয়ে যাবে
বাইরে আমার আত্মাকে,
আর পায়ে পিষবো
যতক্ষণ না তা ছড়িয়ে পড়ছে !
আর তোমাদের হাতে তুলে দেবো, রক্তে লাল, পতাকা হিসাবে ।
তৃতীয় পর্ব
আহ, কেমন করে আর কোথা থেকে
ব্যাপারটা এই পরিণতিতে পৌঁছেছে যে
উন্মাদনার নোংরা মুঠোগুলো
আলোকময় আনন্দের বিরুদ্ধে বাতাসে তুলে ধরা হয়েছিল ?
মেয়েটি এলো,--
পাগলাগারদের চিন্তায়
আর আমার মাথা ঢেকে দিলো বিষণ্ণতায় ।
আর যেমন ড্রেডনট যুদ্ধজাহাজের ধ্বংসের বেলায়
কন্ঠরুদ্ধ অঙ্গবিক্ষেপে
সেনারা আধখোলা দরোজার ভেতরে লাফিয়ে পড়েছিল, জাহাজডুবির আগে,
ভবিষ্যবাদী কবি বারলিয়ুক হামাগুড়ি দিয়ে এগোল, পেরিয়ে গেল
তাঁর চোখের চিৎকাররত ফাঁক দিয়ে ।
তাঁর চোখের পাতাকে প্রায় রক্তাক্ত করে,
উনি দেখা দিলেন হাঁটু গেড়ে,
উঠে দাঁড়ালেন আর হাঁটতে লাগলেন
আর উত্তেজিত মেজাজে,
কোমলভাবে, অমন মোটা একজনের কাছে অপ্রত্যাশিত,
উনি কেবল বললেন :
“ভালো !”
ব্যাপারটা ভালোই যখন পর্যবেক্ষণে এক হলুদ সোয়েটার
আত্মাকে লুকিয়ে রাখে !
ব্যাপারটা ভালোই যখন
ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে, আতঙ্কের মুখোমুখি,
তুমি চেঁচিয়ে বলো :
“কোকো খাও -- ভ্যান হুটেন কোম্পানির !”
এই মুহূর্ত,
বাংলার আলোর মতন,
বিস্ফোরণে ঝলসে,
আমি কিছুর সঙ্গেই অদলবদল করব না,
কোনো টাকাকড়ির জন্যও নয় ।
চুরুটের ধোঁয়ায় মেঘাচ্ছন্ন,
আর মদের গেলাসের মতন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত,
যে কেউ কবি সেভেরিয়ানিন-এর মতো মাতাল-মুখো হতে পারে ।
কোন সাহসে তুমি নিজেকে কবি বলো
আর ধূসর, তিতির-পাখির মতন, নিজের আত্মাকে কিচিরমিচিরে ডুবিয়ে দাও !
তখন
পেতলের বাঘনখ দিয়ে
ঠিক এই মুহূর্তে
জগতের খুলিকে তোমায় চিরে ফেলতে হবে !
তুমি,
মাথায় শুধু একটিমাত্র ভাবনা নিয়ে,
“আমি কি শৈলী অনুযায়ী নাচছি ?”
দ্যাখো আমি কতো আনন্দিত
তার বদলে,
আমি,--
সদাসর্বদা একজন ভেড়ুয়া আর জোচ্চোর ।
তোমাদের সবার কাছ থেকে,
যারা মামুলি মজার জন্য ভালোবাসায় ভিজেছো,
যারা ছিটিয়েছো
শতকগুলোতে অশ্রুজল, যখন তোমরা কাঁদছিলে,
আমি বেরিয়ে চলে যাবো
আর সূর্যের একচোখ চশমাকে বসাবো
আমার বড়ো করে খোলা, একদৃষ্ট চোখে ।
আমি রঙিন পোশাক পরব, সবচেয়ে অস্বাভাবিক
আর পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াবো
জনগণকে খুশি দিতে আর তাতিয়ে তুলতে,
আর আমার সামনে
এক ধাতব দড়িতে গলাবাঁধা,
ছোটো কুকুরবাচ্চার মতন দৌড়োবে নেপোলিয়ান ।
একজন নারীর মতন, শিহরিত, পৃথিবী শুয়ে পড়বে,
আত্মসমর্পণ করতে চেয়ে, মেয়েটি ধীরে-ধীরে অবনত হবে ।
জীবন্ত হয়ে উঠবে সবকিছু
আর চারিদিক থেকে,
ওদের ঠোঁট তোতলা কথা বলবে :
“য়াম-য়াম-য়াম-য়াম !”
হঠাৎ,
মেঘের দল
আর বাতাসে অন্যান্য ব্যাপার
আশ্চর্য কোনো উত্তেজনায় আলোড়িত,
যেন শাদা-পোশাকে শ্রমিকদল, ওপরে ওইখানে,
হরতাল ঘোষণা করেছে, সবাই তিক্ত আর আবেগে আক্রান্ত ।
বর্বর বজ্র মেঘের ফাটল থেকে উঁকি দিলো, ক্রুদ্ধ ।
নাকের বিশাল ফুটো থেকে ঘোড়ার ডাক দিয়ে, গর্জন করলো
আর এক মুহূর্তের জন্যে, আকাশের মুখ তেবড়ে বেঁকে গেলো,
লৌহ বিসমার্কের ভেঙচির মতন ।
আর কেউ একজন,
মেঘের গোলকধাঁধায় জড়িয়ে,
কফিপানের রেস্তরাঁর দিকে, হাত বাড়িয়ে দিলো এখন :
দুটিই, কোমলতর,
আর নারীমুখ নিয়ে
আর একই সঙ্গে, কামান দাগার মতন ।
তুমি কি ভাবছো
ওটা চিলেকোঠার ওপরে সূর্য
কফিপানের রেস্তরারাঁকে আলতো আদর করতে চাইছে ?
না, আবার এগিয়ে আসছে সংস্কারকামীদের কচুকাটা করতে
উনি জেনেরাল গালিফেৎ !
ভবঘুরের দল, পকেট থেকে হাত বের করে নাও--
বোমা তুলে নাও, ছুরি কিংবা একটা পাথর
আর কেউ যদি লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে ছুঁড়তে না পারে
তাহলে সে চলে আসুক কেবল নিজের কপাল দিয়ে লড়তে !
এগিয়ে যাও, ক্ষুধার্ত,
গোলামের দল,
আর নির্যাতিতরা,
এই মাছি ভনভনে জঞ্জালে, পোচো না !
এগিয়ে যাও !
আমরা সোমবারগুলো আর মঙ্গলবারগুলোকে
ছুটির দিনে পালটে দেবো, তাদের রাঙিয়ে দেবো রক্তে !
পৃথিবীকে মনে করিয়া দাও তাকে আমি হীন প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলুম !
রূঢ় হও !
পৃথিবী
রক্ষিতার মুখের মতন ফুলে উঠেছে,
যাকে রথসচাইল্ড বেশি-বেশি ভালোবেসেছিল !
গুলির আগুনের বরাবর পতাকাগুলো উড়ুক
যেমন ওরা ছুটির দিনে করে, জাঁকজমকসহ !
ওহে, রাস্তার লন্ঠনেরা, পণ্যজীবীদের আরও ওপরে তোলো,
ওদের মড়াগুলোকে হাওয়ায় ঝুলতে দাও ।
আমি অভিশাপ দিলুম,
ছুরি মারলুম
আর মুখে ঘুষি মারলুম,
কারোর পেছনে হামাগুড়ি দিলুম,
তাদের পাঁজর কামড়ে ধরে ।
আকাশে, লা মারসেইলিজ-এর মতন লাল,
সূর্যাস্ত তার কম্পিত ঠোঁটে মরণশ্বাস তুলছিল ।
এটা মানসিক বিকার !
যুদ্ধ থেকে কোনো কিছুই বাঁচবে না ।
রাত এসে পড়বে,
কামড়ে ধরবে তোমাকে
আর বাসিই গিলে ফেলবে তোমাকে ।
দ্যাখো--
আকাশ আরেকবার জুডাস-এর ভূমিকায়,
একমুঠো নক্ষত্র নিয়ে কাদের বিশ্বাসঘাতকতায় চোবানো হয়েছিল?
এই রাত
তাতার যুদ্ধবাজ মামাই-এর মতন, আহ্লাদে পানোৎসব করে,
উত্তাপে দগ্ধ করে দিলো শহরকে ।
আমাদের চোখ এই রাতকে ভেদ করতে পারবে না,
দুই পক্ষের চর আজেফ-এর মতন কালো !
শুঁড়ির আসরে চুপচাপ এক কোণে হেলান দিয়ে, আমি বসে থাকি,
আমার আত্মায় আর মেঝেতে মদ চলকে পড়ে,
আর আমি দেখি :
কোনের দিকে, গোল চোখের প্রভা
আর তাদের সঙ্গে, ম্যাডোনা চেবাচ্ছে হৃদয়ের কেন্দ্র ।
এরকম মাতাল ভিড়ে অমন আনন্দবিচ্ছুরণ প্রদান করা কেন ?
ওদের কিই বা দেবার আছে ?
তোমরা দেখতে পাচ্ছ -- আরেকবার,
ওরা কেন বারাব্বাসকে পছন্দ করে
গোলগোথার মানুষটির তুলনায় ?
হয়তো, ভেবেচিন্তে,
মানবিক ভানে, কেবল একবার নয়
আমি কি তরতাজা মুখ পরে থাকবো ।
আমি, হয়তো,
তোমার ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে সৌম্যকান্তি
সম্পূর্ণ মানবজাতিতে ।
ওদের দিয়ে দাও,
যারা আহ্লাদে ডগমগ,
এক দ্রুত মৃত্যু,
যাতে ওদের ছেলেপুলেরা ভালোভাবে গড়ে ওঠে ;
ছেলেরা -- পিতা হিসাবে
মেয়েরা -- গর্ভবতী নারী হিসাবে ।
সেই জ্ঞানী মানুষদের মতন, নব্যপ্রসূতদের
অন্তর্দৃষ্টি আর ভাবনাচিন্তায় ধূসর হয়ে উঠতে দাও
আর ওরা আসবে
শিশুদের নামকরণের অনুষ্ঠানে
যে কবিতাগুলো আমি লিখেছি, তাদের।
আমি যন্ত্রপাতি আর ব্রিটেনের শিল্পের গুণগান করি ।
কোনো মামুলি, সার্বজনিক ধর্মোপদেশে,
হয়তো লেখা হয়ে থাকতে পারে
যে আমিই ত্রয়োদশতম দূত ।
আর যখন আমার কন্ঠস্বর তারস্বরে ঘোষণা করবে,
প্রতি সন্ধ্যায়,
ঘণ্টার পর ঘণ্টা,
আমার আহ্বানের অপেক্ষায়
যিশুখ্রিস্ট, নিজে, হয়তো ঘ্রাণ নেবেন
আমার আত্মার ফরগেট-মি-নট গুল্মের ।
চতুর্থ পর্ব
মারিয়া ! মারিয়া !
ভেতরে আসতে দাও, মারিয়া !
আমাকে রাস্তায় ফেলে যেও না !
তুমি অমন করতে পারো ?
আমার গাল চুপসে গেছে,
অথচ তুমি নিষ্ঠুরভাবে অপেক্ষা করাও ।
তাড়াতাড়ি, সবায়ের দ্বারা পরীক্ষিত,
বাসি আর বিবর্ণ,
আমি চলে আসবো
আর বিনা দাঁতে তোতলাবো
যে আজকে আমি
“সাতিশয় অকপট।”
মারিয়া,
চেয়ে দ্যাখো--
আমার কাঁধ দুটো আবার ঝুলে পড়ছে ।
রাস্তায়, লোকেরা
তাদের চার-তলা পেটের চর্বিতে আঙুল বোলায়।
ওরা চোখ দেখায়,
চল্লিশ বছরের অবসাদে ক্ষয়িত, আর অস্হির---
ওরা চাপা হাসি হাসে কেননা
আমার দাঁতে,
আবারও,
আমি গত রাতের আদরগুলোর শক্ত-হয়ে-যাওয়া ধৃষ্টতা কামড়ে ধরে রেখেছি ।
বৃষ্টি ফুটপাথের ওপরে কেঁদে ফেললো,--
ও তো জমা-জলে কারারুদ্ধ জোচ্চোর ।
রাস্তার লাশ, পাথরবাঁধানো পাথরের পিটুনি খেয়ে, নিজের কান্নায় ভিজে গেলো।
কিন্তু ধূসর চোখের পাতাগুলো--
হ্যাঁ !--
ঝুলন্ত বরফের চোখের পাতা হয়ে উঠলো জমাট
তাদের চোখ থেকে ঝরা অশ্রুজলে--
হ্যাঁ !--
ড্রেনপাইপগুলোর বিষাদভারাতুর চোখ থেকে ।
প্রতিটি পথচারীকে চাটছিল বৃষ্টির শুঁড় :
পথের গাড়িগুলোয় ঝিকমিক করছিল খেলোয়াড়ের দল ।
ফেটে পড়ছিল জনগণ
গাদাগাদি ভরা,
আর তাদের চর্বি উথলে উঠছিল ।
ঘোলাটে এক নদীর মতন, মাটিতে স্রোত গড়ে উঠেছিল,
তাতে মিশেছিল
বাসি মাংসের রস ।
মারিয়া !
কেমন করে আমি কোমল শব্দকে স্ফীত কানে আঁটাবো ?
একটা পাখি
ভিক্ষার জন্য গান গায়
ক্ষুধার্ত কন্ঠস্বরে
বরং ভালো,
কিন্তু আমি একজন মানুষ,
মারিয়া,
আমি তো প্রেসনিয়ার নোংরা তালুতে অসুস্হ রাতের কাশি ।
মারিয়া, তুমি কি আমাকে চাও ?
মারিয়া, আমাকে গ্রহণ করো, দয়া করো ।
কাঁপা আঙুলে আমি গির্জার ঘণ্টার লোহার গলা টিপে ধরবো !
মারিয়া !
রাস্তার চারণভূমিগুলো বুনো আর দর্শনীয় হয়ে গেছে !
ওরা আমার গলা টিপে ধরেছে আর আমি প্রায় অজ্ঞান হতে চলেছি।
খোলো !
আমি আহত !
দ্যাখো -- আমার চোখ খুবলে নেয়া হয়েছে
মেয়েদের টুপির আলপিন দিয়ে !
তুমি দরোজা খুলে দিলে ।
আমার খুকি !
ওহ, ভয় পেও না !
এই মহিলাদের দেখছো,
আমার গলায় পাহাড়ের মতন ঝুলে রয়েছে,--
জীবনভর, নিজের সঙ্গে টেনে নিয়ে যাই
কয়েক কোটি, প্রচুর, বিশাল, বিশুদ্ধ ভালোবাসাদের
আর কোটি কোটি নোংরা, বিদকুটে ভাড়াপ্রেমিকাদের ।
ভয় পেও না
যদি সততার
প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হয়,
হাজার সুন্দরী মুখ দেখে, আমি নিজেকে তাদের দিকে ছুঁড়ে দেবো--
“ওরা, যারা মায়াকভস্কিকে ভালোবাসে !”
দয়া করে বোঝো যে ওটাও হল
রানিদের বংশ, যারা একজন উন্মাদ মানুষের হৃদয়ে সওয়ার হয়েছে ।
মারিয়া, কাছে এসো !
নগ্ন আর লজ্জাহীন হও,
কিংবা আতঙ্কে শিহরিত,
তোমার ঠোঁটের বিস্ময়কে সমর্পণ করো, কতো নরম :
আমার হৃদয় আর আমি কখনও মে মাসের আগে পর্যন্ত থাকিনি,
কিন্তু অতীতে,
শত শত এপ্রিল মাস জড়ো হয়েছে ।
মারিয়া !
একজন কবি সারা দিন কল্পিত সুন্দরীর বন্দনায় গান গায়,
কিন্তু আমি--
আমি রক্তমাংসে গড়া,
আমি একজন মানুষ --
আমি তোমার দেহ চাই,
খ্রিস্টধর্মীরা যেমন প্রার্থনা করে :
“এই দিনটা আমাকে দাও
আমাদের প্রতিদিনের রুটি।”
মারিয়া, আমাকে দাও !
মারিয়া !
আমি ভয় পাই তোমার নাম ভুলে যাবো
চাপে পড়ে কবি যেমন শব্দ ভুলে যায়
একটি শব্দ
সে অস্হির রাতে কল্পনা করেছিল,
ঈশ্বরের সমান যার প্রভাব ।
তোমার দেহকে
আমি ভালোবেসে যাবো আর তত্বাবধান করবো
যেমন একজন সৈনিক
যুদ্ধে যার পা কাটা গেছে,
একা
আর-কেউ তাকে চায় না,
অন্য পা-কে সে সস্নেহে যত্ন করে ।
মারিয়া,--
তুমি কি আমাকে নেবে না ?
নেবে না তুমি !
হাঃ !
তাহলে অন্ধকারময় আর বেদনাদায়ক,
আরেকবার,
আমি বয়ে নিয়ে যাবো
আমার অশ্রু-কলঙ্কিত হৃদয়
এগোবো,
কুকুরের মতন,
খোঁড়াতে খোঁড়াতে,
থাবা বইতে থাকে সে
যার ওপর দিয়ে দ্রুতগতি রেলগাড়ি চলে গেছে।
হৃদয় থেকে রক্ত ঝরিয়ে আমি যে রাস্তায় ঘুরে বেড়াই তাকে উৎসাহ দেবো,
আমার জ্যাকেটে ফুলের গুচ্ছ ঝুলে থাকে, ধূসরিত করে,
সূর্য পৃথিবীর চারিধারে হাজার বার নাচবে,
স্যালোম-এর মতন
ব্যাপটিস্টের মুণ্ডু ঘিরে যে নেচে ছিল ।
আর যখন আমার বছরগুলো, একেবারে শেষে,
তাদের নাচ শেষ করবে আর বলিরেখা আঁকবে
কোটি কোটি রক্ত-কলঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে
আমার পিতার রাজত্বের পথ
আমি চড়ে বেরিয়ে আসবো
নোংরা ( রাতের বেলায় গলিতে ঘুমিয়ে ),
আর কানেতে ফিসফিস করে বলব
যখন আমি দাঁড়িয়ে
ওনার দিকে :
শ্রীমান ঈশ্বর, শোনো !
এটা কি ক্লান্তিকর নয়
তোমার মহানুভব চোখদুটো মেঘেতে ডুবিয়ে দাও
প্রতিদিন, প্রতি সন্ধ্যায় ?
তার বদলে, এসো,
বৃত্তাকারে পাক খাবার উৎসব আরম্ভ করা যাক
শুভ আর অশুভের জ্ঞানবৃক্ষ ঘিরে !
সর্বশক্তিমান, তুমি চিরকাল আমাদের পাশে থাকবে !
মদ থেকে, মজাগুলো আরম্ভ হবে
আর প্রেরিত দূত পিটার, যিনি সব সময়ে ভ্রুকুটি করেন,
দ্রুত-লয়ের নাচ নাচবেন--- কি-কা-পু ।
আমরা সব কয়জন ইভকে ইডেন স্বর্গোদ্যানে ফিরিয়ে আনবো :
আমাকে আদেশ করো
আর আমি যাবো --
বীথিকাগুলো থেকে, প্রয়োজনের সুন্দরী মেয়েদের বেছে নেবো
আর তাদের তোমার কাছে আনবো !
আনবো তো আমি ?
না ?
তুমি তোমার কোঁকড়াচুল মাথা কেন অভব্যভাবে নাড়াচ্ছো ?
কেন তুমি তোমার ভ্রুতে গিঁট ফেলছো যেন তুমি রুক্ষ ?
তুমি কি মনে করো
যে এই
যার ডানা আছে, সে কাছেই,
ভালোবাসার মানে জানে ?
আমিও একজন দেবদূত ; আগেও ছিলুম--
শর্করায় তৈরি মেশশাবকের চোখ নিয়ে, আমি তোমার মুখগুলোর দিকে তাকালুম,
কিন্তু আমি ঘোটকিদের আর উপহার দিতে চাই না, --
সেভরে-পাড়ার সমস্ত অত্যাচারকে ফুলদানির রূপ দেয়া হয়েছে ।
সর্বশক্তিমান, তুমি দুটো হাত তৈরি করে দিয়েছো,
আর তা সযত্নে,
একটা মাথা গড়ে দিয়েছো, আর তালিকায় অনেককিছু রয়েছে--
কিন্তু কেন তুমি তা করলে
কেননা ব্যথা করে
যখন কেউ চুমু খায়, চুমু, চুমু ?!
আমি ভেবেছিলুম তুমিই মহান ঈশ্বর, সর্বশক্তিমান
কিন্তু তুমি একজন ক্ষুদে মূর্তি, -- স্যুট-পরা একজন নির্বোধ,
ঝুঁকে, আমি ইতিমধ্যে আয়ত্বে পেয়েছি
সেই ছুরি যা আমি লুকিয়ে রেখেছি
আমার বুটজুতোর ফাঁকে ।
তোমরা, ডানাসুদ্ধ জোচ্চোরের দল
ভয়ে জড়োসড়ো হও !
নিজেদের কাঁপতে-থাকা পালকগুলো ঝাঁকাও, রাসকেলের দল !
তুমি, গা থেকে ধুপের গন্ধ বেরোচ্ছে, তোমাকে চিরে ফালাফালা করব,
এখান থেকে আলাস্কা পর্যন্ত ধাওয়া করে।
আমাকে যেতে দাও !
তুমি আমাকে থামাতে পারবে না !
আমি ঠিক হই বা ভুল
তাতে কোনো তফাত হয় না,
আমি শান্ত হবো না ।
দ্যাখো,--
সারা রাত নক্ষত্রদের মাথা কাটা হয়েছে
আর আকাশ আবার কোতলে রক্তবর্ণ ।
ওহে তুমি,
স্বর্গ !
মাথা থেকে টুপি খোলো,
যখনই আমাকে কাছে দেখতে পাবে !
স্তব্ধতা ।
ব্রহ্মাণ্ড ঘুমোচ্ছে ।
কালো, নক্ষত্রে- কানের তলায়
থাবা রেখে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন