শুক্রবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

রান্নাঘর

শৈশব থেকে এখন পর্যন্ত কতরকমের রান্নাঘরের অভিজ্ঞতা হল। পাটনায় ইমলিতলা পাড়ায়, কুড়ি জনের একান্নবর্তী পরিবারে, রান্নাঘর ছিল বেশ বড়; ১৪ বাই ১৪ হবে। মা, জেঠিমা আর কাকিমারা একসঙ্গে বসতে পারতেন। স্কুলে যাবার আগে আমরা ওখানে বসেই খেয়ে নিতুম।

তারপর রান্নাঘর দরিয়াপুরের বাড়িতে। এই বাড়িটা বাবা করিয়েছিলেন দোকান এবং ফোটো-স্টুডিওর কথা মাথায় রেখে; তাই রান্নাঘরের প্ল্যান ছিল না। দোতলায় যে ঘরটাকে ডার্করুম করার কথা ছিল, সেটিই রান্নাঘর হয়ে উঠল। এই বাড়িতে বাবা উঠে গিয়েছিলেন একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাবার কারণে। রান্নাঘরটি খুবই ছোট ছিল; ৩ বাই ৪, যেখানে কেবল উনোন ধরানো হত, গ্যাস আসার আগে। মা রান্না করতেন তার সংলগ্ন ঘরটায়, যে ঘরে আমাদের প্রথম ডাইনিং টেবিল আর ফ্রিজ ছিল। বাবা কিন্তু মাটিতে বসেই খেতেন, আসন পেতে।

এর পারের রান্নাঘর লখনউতে। লখনউতে বাংলো-বাড়ি পেয়েছিলুম বটে, কিন্তু রান্নাঘরটা তেমন বড় ছিল না; তবে আধুনিক ছিল, অর্থাৎ দাঁড়িয়ে রান্না করার জন্য প্ল্যাটফর্ম, গ্যাস রাখার জায়গা, বাসন ধোবার সিংক ইত্যাদি। রান্নাঘরের ভেতরই ভাঁড়ার, যা ইমলিতলা আর দরিয়েপুরে ছিল না।লাগোয়া ড্রইং-ডাইনিং।

পরবর্তী রান্নাঘর মুম্বাইতে, ঘাটকোপারে, একরুমের ফ্ল্যাটে, যাকে অফিস নাম দিয়েছিল ট্র্যানজিট ফ্ল্যাট।ঘাটকোপারে রান্নাঘরটা অন্যঘরটার সমান ছিল।সেখানেই ডাইনিং টেবল ; ইচ্ছা হলে শোয়া যেত, শুতুমও, কেননা অন্য ঘরটায় লখনউ থেকা আনা বহু জিনিসে ঠাসা ছিল।

তার পরের রান্নাঘর মুম্বাইয়ের বোরিভিলিতে, যেখানে অফিস দিয়েছিল লিজড ফ্ল্যাট।মাঝারি মাপের রান্নাঘর, তাতে অধুনিক যাবতীয় মুম্বাইয়া ব্যাপার। দুদিকে জানালা; লখনউ থেকে এসে প্রথম কোকিল ডাকতে শুনেছিলুম।এখন অবশ্য মুম্বাইতে কাক আর পায়রা ছাড়া অন্য পাখি নজরে পড়ে না।ফ্ল্যাটটা ছিল দু'তলায়, তিনদিকে ব্যালকনি।অফিস আর ছেলে-মেয়ের স্কুল কলেজ থেকে দূরে ছিল বলে বোরিভিলি ছাড়তে হল।

বোরিভিলির পর সান্টাক্রুজ, অফিসের কোয়ার্টার, সিনিয়র অফিসারদের জন্যে। সুতরাং রান্নাঘরের মাপও তদনুযায়ী।আমরা চারজনেই দিনের বেলায় বাড়ির বাইরে থাকার কারণে রান্না করা ছাড়া জীবনের দ্রুততায় এই রান্নাঘরের আনন্দ তেমন নেয়া হয়ে ওঠেনি। ছুটির দিনে রেস্তরাঁতে খেতে বেরোনোর রুটিন গড়ে ওঠার ফলে রান্নাঘরের উৎসবমুখরতা কমে গিয়েছিল। গাড়িও কিনে ফেলেছিলুম সান্টাক্রুজে থাকতে ।

সান্টাক্রুজের পর কলকাতা, নাকতলার ফ্ল্যাটে। এটাই ছিল সবচেয়ে ছোট রান্নাঘর। রান্নাঘরকে কেন যে গুরুত্ব দেহা হত না জানি না। অথচ আমার মামার বাড়িতে রান্নাঘরটাই ছিল সবচেয়ে বড়, হল-ঘর বলা যায়।নাকতলার রান্নাঘরে কাজের মেয়ে ঢুকলে আর কারোর দাঁড়ানোর জায়গা থাকত না।ফ্ল্যাটটা কেনার পর ওইটুকু জায়গায় যতটা পারা যায় কাজ চালাবার মতন সুবিধা তৈরি করে নেয়া হয়েছিল, তা সত্ত্বেও রান্নাঘরের কারণে যেনি প্ল্যান এঁকেছিলেন তাঁকে আমার স্ত্রী কখনও ক্ষমা করতে পারেনি।

নাকতলা থেকে শেষ ঠাঁই কান্ডিভিলির, মুম্বাইতে, রান্নাঘর।এখন মুম্বাইতে প্রতিটি ফ্ল্যাটে রান্নাঘরকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় বিল্ডাররা। কান্ডিভিলির রান্নাঘরও বেশ বড়, যদিও এটা এক বেডরুমের ফ্ল্যাট।এখন যখন খাওয়া-দাওয়া ডাক্তারের পরামর্শে চলে, তখন, এই শেষ বয়সে রান্নাঘর পেলুম মনের মতন।

আমি নিজেও রান্না করি। তাই রান্নাঘরটা মনের মতন না হলে সেই ফ্ল্যাট একেবারে ফালতু মনে হয়। রান্নাঘরটাই তো একটা ফ্ল্যাটের বা বাড়ির প্রাণকেন্দ্র।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন