সোমবার, ৩১ জুলাই, ২০২৩

অঁতনা আতো'র "বেঁচে থাকার নতুন প্রতিভাস"-এর অংশ

 

অঁতনা আতোর "বেঁচে থাকার নতুন প্রতিভাস" এর অংশ



অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী


আমি যা দেখেছি এবং বিশ্বাস করেছি সেকথাই বলি; আর কেউ যদি বলে যে আমি যা দেখেছি তা আমি দেখিনি, আমি সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দেব।

কারণ আমি একজন ক্ষমার অযোগ্য পাশবিক মানুষ আর ‘সময়’ যখন আর ‘সময়’ থাকবে না তখন পর্যন্ত থাকব।

স্বর্গ বা মর্ত্য কেউই, যদি তারা সত্যি থাকে তবে তারা আমার ওপর চাপিয়ে দেয়া এই বর্বরতার বিরুদ্ধে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে, সম্ভবত আমি তাদের সেবা করেছি বলে ... কে জানে?

যে কোনো অবস্থাতেই তাদের কাছ থেকে নিজেকে ছিঁড়ে আলাদা হবে।


আমি যা দেখি তা নিশ্চিত আছে বলে দেখি। দরকার হলে যা নেই তা তৈরি করব।

অনেক দিন ধরে আমি শূন্যতা অনুভব করেছি, কিন্তু নিজেকে শূন্যে ছুঁড়ে ফেলতে অস্বীকার করেছি।

আমি  ততটাই কাপুরুষ ছিলুম যতোটা কাপুরুষত্ব আমি দেখছি।

যখন আমি বিশ্বাস করতুম যে আমি মর্ত্যকে প্রত্যাখ্যান করছি, তখন আমি জানতুম আমি শূন্যতা প্রত্যাখ্যান করছিলাম।

কারণ আমি জানি পৃথিবীর অস্তিত্ব নেই এবং আমি জানি কীভাবে এর অস্তিত্ব নেই।

এখন অবধি, আমার যন্ত্রণা ছিল শূন্যতা প্রত্যাখ্যান করার।

শূন্যতা আমার মধ্যে আগে থেকেই ছিল।

আমি জানি আমি চেয়েছিলুম  শূন্যতা আমাকে আলোকিত করুক, আর আমি নিজেকে আলোকিত হতে দিতে অস্বীকার করেছি।

যদি আমাকে শ্মশানের চিতা বানানো হয়, তবে তা হবে এই পৃথিবীতে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় আমার সুস্থতা।

আর আমার যা ছিল তা পৃথিবী নিয়ে নিয়েছে।

আমি টিকে থাকার জন্য লড়াই করেছি , সেই আঙ্গিকগুলোকে (সমস্ত রূপের ) সম্মতি দেওয়ার চেষ্টা করেছি  যা দিয়ে এই পৃথিবীতে থাকার বিভ্রমের খোঁয়ারি সমস্ত বাস্তবতাকে আবৃত করেছিল।

আমি আর বিভ্রম দ্বারা আবিষ্ট হতে চাই না.

পৃথিবীর কাছে মরে গেছি; পৃথিবীর অন্য সবায়ের কাছে কি মরে গেছি, অধঃপতিত, শেষকালে অধঃপতিত, অধঃপতিত, শূন্যে উঠে আমি একবার প্রত্যাখ্যান করেছিলুম, আমার এমন এক  দেহ আছে যা বিশ্বের দুর্ভোগ পোয়ায় আর বাস্তবতাকে অস্বীকার করে।

আমি এই উন্মাদ আন্দোলন যথেষ্ট পরিমাণে সহ্য করেছি যা আমাকে নামকরণ করতে বলে আর যার নামকরণ আমি করেছি আর বাতিল করেছি।


আমাকে এটা শেষ করতেই হবে। আমাকে এই জগতের সাথে, যা আমার বেঁচে থাকার প্রতিভাস,  শেষ বারের মতন   বিচ্ছিন্ন  করতে হবে , এই সত্তার আমি আর নামকরণ করতে  পারি না কারণ যদি সে ফিরে আসে তবে আমি মহাশূন্যে পড়ে যাব, এই সত্তা আমাকে চিরকাল বাতিল করেছে।

এটা ঘটে । আমি সত্যিই শূন্যের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম, কেননা সবকিছু - এই পৃথিবীর তৈরি করা - আমাকে হতাশ করার লক্ষ্য পূরণ করেছে ।

শুধুমাত্র যখন তুমি দেখবে  যে এই পৃথিবী তোমাকে সত্যিই ছেড়ে গেছে তখন  তুমি জানবে যে তুমি আর এই পৃথিবীতে নেই। 

মরে গেছো, অন্যরা বিচ্ছিন্ন হয় নি: তারা এখনও তাদের মৃতদেহের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে।

আর আমি জানি কীভাবে মৃতরা তাদের শবের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে ঠিক তেত্রিশ শতাব্দী ধরে আমার নকলটা অবিরাম এপাশ-ওপাশ করছে।


সুতরাং, আর তো বেঁচে নেই, যা আছে তা আমি  দেখতে পাই

আমি সত্যিই এই সত্তার সাথে নিজেকে সনাক্ত করেছি, এই সত্তা যা আর টিকে নেই।

এবং এই সত্তা আমার কাছে সবকিছু মেলে ধরেছে।

আমি এটা জানতুম, কিন্তু বলতে পারিনি, কিন্তু এখন আমি  তা বলতে শুরু করতে পারি, কারণ আমি বাস্তবতাকে পিছনে ফেলে এসেছি।

সত্যিকারের একজন বেপরোয়া মানুষ তোমার সাথে কথা বলছে, যে লোকটা কখনও এই পৃথিবীতে বাঁচার সুখের কথা জানত না যতক্ষণ না সে এটা ছেড়ে চলে গেছে আর এটা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

বাকিরা যদিও মারা গেছে কিন্তু তাদের আলাদা করা হয়নি। তারা এখনও তাদের শবের চারপাশে ঘোরাফেরা করে।

আমি মৃত নই, কিন্তু আমি বিচ্ছিন্ন।













মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই, ২০২৩

মলয় রায়চৌধুরীর উত্তরাধুনিক গল্প : তমে কেবি ছে ? সরস !

 


       “দ্যাখো, দ্যাখো, ওই তো টিভিতে শাহেনশাহের ঘোষণা পড়ে শোনাচ্ছে মোটোভাই । ক’দিন ধরে খবরের কাগজেও দিচ্ছে, সুযোগটা আমাদের নেয়া দরকার, সংসারের যা অবস্হা, তোমার চাকরি চলে গিয়ে”। স্বামী যতীনকে বলল অমৃতা ।

        “আরে শাহেনশাহ আর মোটোভাইয়ের কথা বাদ দাও তো, সকলের অ্যাকাউন্টে আপনা থেকে টাকা আসবে বলেছিল শাহেনশাহ, উলটে আমাদের ব্যাঙ্কটাই লাটে উঠে গেল।” বলল যতীন।

        “ফোন করে দ্যাখোই না, পাড়ার নিতাইরা তো বাড়ির সবাইকে নিয়ে ট্রাই করতে গেছে, নিশ্চয়ই পুরস্কার নিয়ে ফিরবে, দলে দলে লোক যাচ্ছে, সারা রাজত্বে সাড়া পড়ে গেছে।” বলল অমৃতা ।

        “তুমিই ফোন করো, আমার তো মেজাজ খিঁচিয়ে থাকে, মুখ ফসকে যা-তা বলে ফেলবো, আর মোটাভাই চটে যাবে, ওর স্যাঙাতরা চটে গেলে আরও বিপদ ।” বলল যতীন ।

        টিভিতে, খবরের কাগজে ফোন নম্বর দেয়া ছিল । মোবাইলে নম্বর আগেই সেভ করে রেখেছিল অমৃতা। ফোন করতেই ওদেক থেকে গম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে এলো, “আরে আম্রুতবেন, কেম ছে ?”

       অমৃতা মোটা ভাইয়ের গলার আওয়াজ টিভিতে অনেকবার শুনেছে, টেলিফোনে ওনার কন্ঠস্বর শুনে ভাবল বোধহয় আনসারিঙ মেশিনে রেকর্ড করা ; কিন্তু তাই যদি হবে তাহলে মোটাভাই ওর নাম জানল কেমন করে। অমৃতার ভাবনার মাঝেই মোটাভাইয়ের প্রশ্ন শোনা গেল, “যতিনভাই কেবা ছে ?” মানে, যতীনভাই কেমন আছেন ? আরও অবাক হল অমৃতা, ভয়ও পেল । মোটাভাই যদিও মোটা কিন্তু মোটাভাইয়ের ভাষায় মোটাভাই মানে বড়দা ; ওনার একটা আসল নাম আছে বটে কিন্তু উনি শাহেনশাহের এতো কাছের লোক, এতো বেশি কাছের যে উনি চান লোকে শাহেনশাহের জয়ধ্বনি করুক, ওনার নয় ।

      “তমে আপনে ভায়ো ছো ?” আপনি আমাদের চেনেন ? অবাক হল অমৃতা । শাহেনশাহের রাজত্বে কোটি কোটি লোক অথচ বেছে বেছে শুধু ওদেরই চেনেন ? শাহেনশাহের লোকেরা ওদের দুজনের ওপর লক্ষ্য রাখে নাকি ?

      “হু বদানে জানুঁ ছুঁ”, বলল মোটাভাই । 

      “আরে উনি আমাদের চেনেন, আমার নাম জানেন, তোমার নাম জানেন, জিগ্যেস করছিলেন তুমি কেমন আছো, উনি এমনকি বললেন শাহেনশাহের রাজত্বে সবাইকে চেনেন উনি ।” অমৃতা উত্তেজিত হয়ে যতীনকে বলল। তারপর বলল, “তুমি ওনার সঙ্গে কথা বলে দ্যাখো, বলো যে আমরাও শাহেনশাহের প্রশংসা-রচনায় অংশ নিতে চাই, নয়তো উনি ভাববেন, স্বামী কথা বলছে না কেন, বউকে দিয়ে বলাচ্ছে।”

      রাগ হল যতীনের, বলল, “আরে রচনা লেখা নিয়ে তো কথা, দুজনেই যাবো, তুমিও যাবে, তাতে স্বামী-স্ত্রীর কে কথা বলল বা বলল না, তা নিয়ে শাহেনশাহ নিজে বা মোটাভাই কেউই চিন্তা করেন না। যাকগে, বলছ যখন, দেখি কথা বলে।”

      “প্রণাম মোটোভাই ছে”, বলল যতীন, বউয়ের কাছ থেকে যেটুকু শিখতে পেরেছে দুচারটে কাজ চালানো বাক্য । তারপর জিগ্যেস করল, “মোটোভাই, হুঁ মাত্রভাসামাম লাখি সাকুন ছুঁ?” 

      এই কথাটা বলতে শুনে অমৃতা বলল, “এটা জিগ্যেস করে ভালো করলে, আমাদের ইংরেজি তো সেই ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সময়কার, আর মোটাভাইয়ের ভাষাতেও তেমন করে লিখতে পারবো না, মাতৃভাষায় তো তুমি ফাটিয়ে দিতে পারবে, কতো পুরস্কার আর সম্বর্ধনা পেয়েছো এতোকাল, এবার কিছু রোজগারপাতি হোক।” মুচকি হাসি দিয়ে অমৃতার কথা অনুমোদন করল যতীন ।

    “তমারে কয়ারে আভাভুঁ ছে ? তারিখা আপো ।” বলল মোটোভাই, মানে, তোমরা কবে আসবে, তারিখ জানিয়ে দিও।

    “আপানে আজই যাইসুঁ”, বলল যতীন, যতো তাড়াতাড়ি যোগ দিয়ে পুরস্কার জিতে নেয়া যায় ততোই সুবিধে। শেষে সোনার ভাঁড়ার ফুরিয়ে গিয়ে শুধু রুপোর আর লোহার ভাঁড়ার থেকে যাবে ।

     “ঠিক ছে, আজে আভো, ত্যায়ে ঘানুম সোনুঁ আনে চাঁদি ছে।” আশ্বস্ত করলেন মোটোভাই, সোনারুপোর অনেক স্টক আছে ।

      পুরস্কারের তালিকা বেশ লোভনীয় । শাহেনশাহের পছন্দ হলে তিরিশ কিলো করে সোনা দেয়া হবে, যার প্রশংসা সামান্য ভালো লাগবে তাকে দেয়া হবে তিরিশ কিলো করে রুপো, আর যার প্রশংসা খারাপ লাগবে তাকে দেয়া হবে কুড়ি কিলো করে লোহা ।

      আগে একজন বাঙালি পুরস্কার জিতেছে, তার নাম প্রকাশ করা হয়নি, কিন্তু তার রচনাটা খবরের কাগজে, পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, সুন্দরী পাঠিকা তা টিভিতে পড়েছে, সুকন্ঠী পাঠিকা তা রেডিওতে শুনিয়েছে । 

     অমৃতা কাগজের কাটিঙটা নিয়ে এলো, যাতে ধারণা করে নেয়া যায়, কেমন প্রশংসা-রচনা লিখতে হবে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই রিভাইজ করে নিল গদ্যটা, যদিও এর আগে উচ্চমাধ্যমিকের মতন বার বার পড়েছে । অমৃতা রচনাটা জোরে-জোরে পড়তে লাগল আর যতীন চোখ বুজে শুনতে লাগল প্রথম পুরস্কার পাওয়া রচনা, মগজে ঝকমক করতে লাগলো পনেরো কিলোর এক-একটা সোনার ফুটবল :


ভাবসো আমি কিছু বুজিনা? আমি খুব মিউমিউ কইরা কইলাম, ভাবি গো ছয় দিন হইলো বিছনায় পইড়া আছি। ওষুধ চলে, খুব ঘুম আসে, ঘুম আইলেই ভাইঙ্গা যায় পাখপাখালির আওয়াজে।তুই আর নেই!!!!ভাবতেই পারছি না, কি থেকে কি হল রে, অভিমান ছিল জানি। এই তো সেদিনও কথা হোলো, বাড়ি করবি বলছিলি, তাই বলে এমন জায়গায় বাড়ি করলি রে দীপান্বিতা… সবসময় হাসিমুখটা খুব মনে পড়ছে রে, মন তোর জন্য ভালো নেই।বেসিক্যালি আপনার কোনো বন্ধু নেই। আপনি পেঁচার মতো মুখ করে থাকলেও কেউ বিশ্রীরকম জোক করে আপনাকে জ্বালাতন করার নেই। স্কুলের বন্ধুদের যারা নাগালে আছে তাদের ফোন রিঙ হয়ে যাবে। পকেটে তিরিশটাকা পড়ে থাকবে যা দিয়ে একটা নিপও হয় না। অনেক ভেবে পুরোনো এক নেশাখোরকে ফোন করলে দেখবেন সে অসুস্থ এবং তার মা ফোন রিসিভ করে আপনার কুশল সংবাদ নিচ্ছে। পৃথিবীর যাবতীয় বন্ধু ভাবাপন্ন সম্পর্কগুলো সময়ের সাপেক্ষে বদলে গেছে। এবং আপনার একমাত্র বন্ধু, আপনার প্রেমিক ড্যাং ড্যাং করে অনুমতির তোয়াক্কা না করেই মরে গেছে। এবং আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না আপনি ঠিক কী কেশোৎপাটিত করছেন। তাকে বলে বাঁশ। সবকা বাপ। এই সময়ে ঘরে কিচ্ছু নেই। না মদ, না তামাক, না ওষুধ ;যেখানে থাকিস ভালো থাকিস রে....দীপু.. বেশি না খালি সালাউদ্দিনরে সরায়া আর ৪০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ কইরা (স্টেডিয়াম ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ, কোচ প্রশিক্ষন, বিজ্ঞাপন আর বিপনন ) খেলাটারে বিলিয়ন ডলার ব্যবসার জায়গা বানানো যায়। তাও মাত্র পাঁচ বছরে। পরিমান মত রান্নায় স্বাদ হয় বেশ, মহাকাব্যে আছে অতিদর্পে শেষ। ক্লাব ফুটবলে চল্লিশটা দলকে অনুদান (স্বল্প সুদে ঋণ, শেয়ার বিক্রি) দেন। হিড়িম্বা মন্দির ।ভালো লাগলো,হিড়িম্বা অর্থাৎ মহাভারতের ভীমসেনের ঘরনির নামে মন্দির আছে।অন্য কাস্টের হওয়ার দরুণ মা কুন্তী তাঁকে পরিবারে ঠাঁই দেননি, ঘটৎকচ যুদ্ধে প্রাণ দিলেন, বংশের পুত্র।নিঃসঙ্গ হিড়িম্বার স্মৃতি চিহ্ণ দেখে সত্যি ভালো লাগলো। কড়া অডিটের ব্যবস্থা করেন যাতে টাকা মাইরা যাইতে না পারে।

      “দারুন লিখেছে”, চোখ খুলে বলল যতীন। মিটিমিটি হেসে অমৃতা বলল, আমি তো লিখে অনেকবার প্র্যাকটিস করে নিয়েছি ।

           রচনাকেন্দ্রে দুজনে পৌঁছে দেখলো প্রচুর ভিড়, নামের তালিকা দেখে ওরা নিজের-নিজের সিটে গিয়ে বসল। দুজনে গুডলাক বলে হাই ফাইভ করে নিলো । সবায়ের টেবিলের ওপরে কমপিউটার । অমৃতা আর যতীন চেক করে নিশ্চিন্ত হয়ে নিল যে বাংলা ফণ্ট আছে । ওদের দুজনের মগজেই রচনার খসড়া কিরকির করছিল । বাঁশি বাজতেই ঝটাপট লিখে ফেলল । মোটোভাইয়ের স্যাঙাতরা এসে বলে গেল দশ  মিনিটেই রেজাল্ট ঘোষণা করা হবে কেননা গ্রেডিঙ ব্যাপারটা শাহেনশাহের পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী আরটিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের মাপকাঠি দিয়ে তৈরি । 

           যে চব্বিশজন তিরিশ কিলো করে সোনা পাবে তাতে অমৃতা আর যতীনের নাম ছিল । শুনে ওরা দুজনে আহ্লাদে আটখানা । যারা রুপোর ফুটবল পেলো, তাদের মুখেও হাসি । গোমড়ামুখে বসে রইলো লোহার ফুটবল পাওয়া জনগণ ।

             অমৃতা এই রচনাটা লিখেছিল :

ওদের কান নেই, শোনেনি আমার ডাক। এঁর এককালে টিউশনের রমরমা বাজার ছিল আমাদের স্কুলে। কানিং এবং বাতেলাবাজ হিসেবেই পরিচিতি ছিল। মুশকিল হচ্ছে, বাতেলাবাজ টিচারদের ছাত্ররা খুউব পছন্দ করে। কারণ বাকিরা নেসেসারিলি শুধু ভয়ই দেখান। সমব্যথী বোতল নিজেই এগিয়ে এসেছে, কম্পনরত হাত তবু খুলতে পারেনি ছিপি ;এই যে এক ফোঁটা ঘর। বাড়ি জানালা যমুনামায়ের দু'ফোঁটা বালক। এই তো নিরীহ বালিকা দরজা। ভোর হয়ে এলো দুগগাপুজার হুল্লোড়।একটু ঘিয়ে ভাজা মুরগি, একটু ঘিয়ে ভাজা আলু, একটু ঘিয়ে ভাজা অ্যাস্পারাগাস ;গরিবের লাঞ্চ ;ঠিক এইখানেই তোমার বাড়ি। এখানে ঘুম ডাকো তুমি। জাগো প্রাণায়াম থেকে। তারাদের উচ্চারণে কথা বলো। এখানেই নদীটির সিঁথি। সিঁদুরখেলার প্রতিমা।আরো ভাল লাগল, সোজাসাপ্টা বললেন, নিজেদের কেরিয়ার পড়াশুনা নিয়ে থাকতেন, ছেলে নিজের কত পড়াশুনা বা অন্যান্য কাজ করেছে। মায়েরও যে নিজস্ব জগত, আইডেন্টিটি থাকতে পারে, আর সেটা যে রেঁধেবেড়ে সংসারকে খাওয়ানোর বাইরেও অন্য কিছু করার আছে, সেটা এত স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। দু:খ, এসব বোঝাতে হল সেই সাংবাদিককে যিনি আবার কিনা মহিলাই। স্টিরিওটাইপিং, তোমার শেষ যে না পাই!! তো আমি জানি ঘটনা, পাশে থাকার সুবাদে উনার কিন্নর কণ্ঠের বজ্রনিনাদ আমি কী দিনে, কী রাতে শুনি ডেইলি। এই তো গেল ভাবি, ভাইয়ের ভাষা শুনলে আগে ছাদের তালা ভাঙতে মন চায়, তারপর উপ্রেত্থেকে লাফ দিয়া পইড়া মইরা যাইতে মন চায়।

         আর যতীন লিখেছিল এই রচনাটা :

যতই ভাবি, বলি তোমরা সবাই স্বাধীন এখন। ভোগ কর স্বাধীনতা যে যার মত। গুছিয়ে নাও যে যার সংসার । তবুও কেন জানি তা মানতে চায় না কেউ।তবে কি এই পরাধীনতাটুকুতেই শান্তি সবার ! নাই ভাইদের স্নেহ, লেখবার অবসর। শুধু অবনত শ্রাবণ-গারদ; ভাঁড়েদের উল্লাস, মোহরের ঝনঝন।যাউকগা, আজ সন্ধ্যায় মিসেস চ্যাটার্জী কষাইয়া কষাইয়া মাটন রান্না করিবেন বলিয়া মনস্থির করিয়াছেন। কারণ, তাহার ডাক্তারবাবু খুব সম্প্রতি উহাতে নিষেধাজ্ঞা বসাইয়াছেন। বারবার গৃহত্যাগ বারবার ঘরে ফিরে আসা। সারা দুনিয়া জেনে গেছে আমার দ্বারায় প্রেম - ভালোবাসাটা হবেই না ;আমিও হার মেনে নিয়েছি কারণ সত্যি ওটা আমার টপিক নয়।কারণ গুলো এই যে - ন্যাকামি করবে প্রেমিক, যেটা আমার সবচেয়ে অপচ্ছন্দের, ঠাস করে দুমদাম চড়িয়ে দেবো, তারপর ছেলের মা এসে বলবে, তুমি আমার বাবুকে মেরেছো? লে হালুয়া এসব ঝামেলায় আমি নেই বস। ঝোলাগুড়ে চিতইপিঠার নাহাল এ কলিজা খাবি খায়। বলছিলা ঘরের গল্প একখান, বলছিলা জোনাকি সাজানো ঘর। বাবুইয়ের বাসা লাট খায়। কী দিবা, কাকে দিবা, আমি বলতেছি শোনো, নদীপাড়ে শোক জমা হয়। তুমি বলো শোক নয়, পলিমাটি, চর। ঐ চরটুকু দিবা, ঐ পলিটুকু? দেহ দিছি, প্রাণ দিছি, রইয়া গ্যাছে সংসারখান, তুমার বিধায় লাগে আগুনের খাপরা লাহান ; চিকখইর পাইড়া তাই ছুটসি তুমার পাছ পাছ, এ জনমে, তুমি সাঁই, যত দূর লইয়া যাও,... যাই...সারারাত শরীরে কালাজ্বর। মনে হয়েছে কেউ আমাকে বাক্স বন্দি জোঁকের ভিতর আঁটকে রেখেছে। গলা শুকিয়ে গেছল, একঢোঁক জল চেয়েছি জোঁকের কাছে। খুইট্যা টেঙর ; কিছু সত্যি কথা, কিছু ভয়ের কথা, কিছু অপমানের কথা, কিছু গ্লানির কথা বলছি আজ। আমার বিয়ে হয়েছিল মাত্র এক বছর, তারপর ডিভোর্স, আমি ওর সাথে কোনোদিনই শারীরিক হতে পারিনি সে অর্থে, আমি ওকে ঘেন্না করতাম।না তেমন কোনো কারণ নেই ঘেন্না করার, জানেন তো ও খুব ভালো রান্না করতে পারতো, ওর হাতের খাসি মাংসের ঝোল আমার ফেভারিট ছিল।

           সোনার তালের ঘর, রুপোর তালের ঘর আর লোহার তালের ঘরগুলো আলাদা-আলাদা জায়গায় । সোনার বারো জোড়া দম্পতিকে নিয়ে যাওয়া হল সোনার ঘরে । পনেরো কিলোর ফুটবলে সোনার শেকল লাগানো। অমৃতা-যতীনের মুখে  অন্যদের মতন হাসি খেলছিল । 

             “যাক শেকলে বাঁধা ফুটবলগুলো টেনে নিয়ে যেতে সুবিধা হবে।” বলল যতীন ।

           ওদের সবাইকে চেয়ারে বসতে বলা হলো । তারপর পুরুষদের প্রত্যেকের পায়ে পনেরো কিলো করে সোনার নিরেট বলগুলো শেকলসুদ্ধ তালা লাগিয়ে দেয়া হল । মহিলাদের হাতে পনেরো কিলো করে সোনার সলিড বলগুলো শেকলসুদ্ধ তালা দিয়ে দেয়া হল ।

               স্পিকারে শাহেনশাহের ঘোষণা শোনা গেল, “ আপনারা খুশি তো ? তিরিশ কিলো করে সোনা মানে প্রত্যেক দম্পতি পেলেন ষাট কিলো সোনা । আপনারা এবার বাড়ি যেতে পারেন ।”












 


সোমবার, ১৭ জুলাই, ২০২৩

মলয় রায়চৌধুরীর ঝুরোগল্প : হাসিনার নাতির জন্মদিন

 হাসিনার নাতির জন্মদিন



হল্যাণ্ড থেকে  মেয়ে আমার দুই নাতনিকে নিয়ে কলকাতা আসছিল, নাকতলার বাড়িতে। বড় নাতনিকে নিয়ে তার আগেও এসেছিল। ছোট নাতনি জন্মেছিল হল্যাণ্ডে, ওকে আমরা তখনও দেখিনি। ছোট বাচ্চাকে কতদিন আদর করিনি। বড় নাতনি ইংরেজি শিখে ফেলায়, তাও মার্কিন স্কুলের ইংরেজি, ওর সঙ্গে কথা বলা একটু কঠিন হয়ে গিয়েছিল। ও যে কী বলছে বুঝতে পারতুম না আমরা,  ও-ও আমাদের ইংরেজি ঠিক মতন বুঝতো না।  ছোট নাতনি মোটে এক বছরের, তখনও মার্কিনি স্কুলে ঢোকার সময় হয়নি।

মেয়ে স্কাইপে জানালো যে, বড় নাতনি আমাদের কমোড ব্যবহার করতে পারবে, ওর অসুবিধা হবে না, কেননা নাকতলার কমোড বড় নাতনি আগের বার ব্যবহার করে গেছে। কিন্তু ছোট নাতনি ওই কমোডে বসতে পারবে না, তাই ওর জন্য একটা প্লাসটিকের কমোড কিনে রাখতে, যাতে চেয়ারের মতন হাতল আছে।  

নাকতলার দোকানগুলোয় পাওয়া গেল না। কয়েকজন দোকানদার বেশ অবাকও হলো শুনে। যাইহোক রাসবিহারিতে কয়েকটা দোকানে ঢুঁ মারার পর গোলপার্কের   বাজারের ভেতরে একটা দোকানে পাওয়া গেল। আমরা রঙচঙে দেখে ভালো কোয়ালিটির একটা বেবি-কমোড কিনে আনলুম, যেমনটা আমার মেয়ে বলেছিল।

কয়েকদিন পরে মেয়ে জানালো যে, ওরা আসতে পারবে না, আমাদের পাসপোর্ট  একজন ট্র্যাভেল এজেন্টকে পাঠিয়ে দিতে, সে আমাদের শেনজেন ভিসার ব্যবস্হা করে দেবে, আমরাই যেন হল্যাণ্ডে যাই, ওরা টিকিট পাঠিয়ে দেবে।

কমোডটার কী হবে তাহলে? ওরা তো তিন বছরে একবার আসে। এর পরে যখন আসবে তখন তো ছোট নাতনি আর বেবি কমোড ব্যবহার করতে পারবে না, আমাদের টয়লেটের কমোডই ব্যবহার করবে। কাকেই বা দেওয়া যায়? কারোর বাড়িতে এত ছোটো বাচ্চা নেই।

স্ত্রী বলল, আমাদের কাজের বউ হাসিনার নাতির কালকে একবছর পুরো হবে, বাচ্চাটার জন্য গিফ্ট হিসেবে বেবি-কমোডটাই খবরের কাগজে ভালো করে প্যাক করে দিয়ে দেওয়া যাক। সেই মতো দিয়ে দেওয়া হলো হাসিনাকে। বেবি-কমোড পেয়ে ওরও বেজায় আনন্দ।

পরের দিনটা ছুটি নিয়েছিল হাসিনা, নাতির জন্মদিনে ভালো খাওয়া দাওয়ার জন্য।

তারপরের দিন এলো। থলে থেকে বের করে দেখালো বেবি-কমোডের কয়েকটা ভাঙা টুকরো।

হাসিনা বলল, ক্যানিঙের ট্রেনে এসব শৌখিন জিনিস নিয়ে যাওয়া যায় না গো !  এত দমবন্ধ ভিড় যে কামরায় ঢোকার পরই বউদের ধাক্কাধাক্কিতে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে বেবি-কমোড।


মলয় রায়চৌধুরীর ছোটগল্প : অর্ধাঙ্গিনী

 অর্ধাঙ্গিনী



পাটনায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নোট পোড়াবার চাকরি ছেড়ে অ্যাগ্রিকালচারাল রিফাইনান্স অ্যাণ্ড ডেভেলাপমেন্ট কর্পোপরেশনের লখনউ শাখায় যোগ দিলুম । অফিসে ঢুকে, প্রথম দিনেই, একজন সুন্দরী যুবতীর দিকে দৃষ্টি চলে গেল । অপরূপা বলতে যা বোঝায় । পাটনা অফিসেও বহু তরুণী কাজ করতেন । স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু কিশোরী, তরুণী, যুবতী সহপাঠি ছিল, কিন্তু এই মেয়েটির মতন সুন্দরী ছিল না কেউ । 

আমাকে যে বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হলো, সে কী আনন্দ, মেয়েটি সেই বিভাগের কেরানি । এমন সুন্দরী মেয়েকে কেরানি ভাবতে কেমন যেন বাধো-বাধো লাগতো । আমার আন্ডারে যারা কাজ করতো তারা কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে ফাইল নিয়ে আসতো, পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে । রোজ চাইতুম সুন্দরী যুবতিটিও আসুক, সামনে বসিয়ে কথা বলি, ভালো করে দেখি তাকে, বাড়ির লোকজনদের বিষয়ে জিগ্যেস করি । আসতো না কখনও ।

যে পাড়ায় অফিস আমাকে বাড়ি দিয়েছিল, তার পাশে থাকতো বয়স্ক একজন অধস্তন কর্মচারী, আমারই অফিসের, নবাব পরিবারের, হায়দর আলি, বেশ লম্বা চওড়া । আমার স্কুটার মেরামতের জন্য গেলে হায়দর আলির গাড়ি করে অফিস যেতুম । হায়দারকে একদিন জিগ্যেস করলুম ওই তরুণীর ব্যাপারে । গাড়ি চালাতে-চালাতে হায়দার বলল, হ্যাঁ, মেয়েটি পাঞ্জাবি, ফিল্মে নামার মতো সুন্দরী, রোজ সেজেও আসে ফিল্মস্টারদের মতন, প্রতিদিন নতুন পোশাক, পারফিউম, ঠোঁটে লিপ্সটিক, বড়ো-বড়ো নখে নেলপালিশ। নেলপালিশ আর লিপ্সটিকের রঙও পালটায় ইচ্ছেমতন । 

—আপনার বিভাগেই কাজ করে  মেয়েটি অথচ আপনি তার সম্পর্কে এখনও কিছু জানেন না ? কর্মীদের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখবেন তো ! বললে হায়দর ।

—না, জানি না, জানতে চাই, এরকম সুন্দরী কর্মী আমি আগে দেখিনি । সব কর্মী ফাইল নিয়ে আমার কাছে আসে, এই মেয়েটা কখনও আসেনি । আমার মনে হয় সুন্দরী বলে গর্ববোধ করে, ফিল্মস্টারদের মতন ।

—না স্যার, শুনলে আপনার মন খারাপ হয়ে যাবে । মেয়েটির পা দুটো বিকলাঙ্গ ; আমরা কেবল ওর ওপরের অঙ্গ দেখতে পাই । টেবিলের ওই পাশে আড়ালে থাকা বিকলাঙ্গ অংশটা দেখতে পাই না । ওর একজন আয়া রোজ স্পেশাল হুইল চেয়ারে বসিয়ে আনে, হুইল চেয়ারটা গ্যারেজে রেখে চলে যায়, মাঝে দুপুরে এসে মেয়েটাকে টয়লেটে নিয়ে যায় । অফিস ছুটির সময়ে এসে হুইল চেয়ারে বসিয়ে, বুকে বেল্ট বেঁধে বাড়ি নিয়ে যায় । আমাদের অফিস থেকে বেশি দূরে নয় ওদের বাড়ি । যদিও ওর স্কুল-কলেজের রেজাল্ট খুব ভালো, বিকলাঙ্গের স্পেশাল কোটায় চাকরি পেয়েছে ।

এসব শোনার পর অফিসে ঢুকেই তাকাতুম মেয়েটির দিকে । ওর মানসিক যন্ত্রণা বা মনোব্যথার রেশ খোঁজার প্রয়াস করতুম । একদিন অফিস ছুটির পর বেরোবার সময়  দেখলুম মেয়েটি একা বসে আছে । কেমন যেন কাঁদো-কাঁদো গম্ভীর । হায়দরের গাড়িতে আমার ফেরার কথা । ওকে বললুম, এইভাবে একজন সুন্দরীকে একা ফেলে তো চলে যেতে পারি না, তায় আবার বিকলাঙ্গ । শালা স্টাফগুলোও কেমন, বিকলাঙ্গ বলে একা ফেলে পালিয়েছে; মেয়েটা যদি বিকলাঙ্গ না হতো তাহলে দশবারোজন ওর চারপাশে ঘুরঘুর করতো । কয়েকজন নির্ঘাৎ প্রেমে পড়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতো ।

হায়দর জানালো, মেয়েটির আয়া এখনও আসেনি । 

তখনকার দিনে মোবাইল ছিল না যে ওর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করব । ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পরও ওর বাড়ির কাউকে আসতে দেখলুম না । হায়দর আলিকে বললুম, তোমার গাড়ি করে পৌঁছে দাও, তুমি ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে তোমার গাড়িতে বসাতে পারবে, এরকম পালোয়ানি চেহারার নবাব তুমি । 

—আপনি পাগল হয়েছেন স্যার, বলল হায়দর, আমি মুসলমান, নবাব বাড়ির হলেও, মুসলমান। একজন হিন্দু যুবতীকে জড়িয়ে ধরে তুলেছি জানলে কালকে দাঙ্গা বেঁধে যাবে । আপনি বরং মেয়েটাকে গিয়ে আশ্বাস দিন যাতে ও মনে না করে যে ওকে বিপদে ফেলে আপনি পালাচ্ছেন ।

আমি তাই করলুম । মেয়েটাকে বললুম যে হায়দরের গাড়ি করে তোমাকে পৌঁছে দেবো আমরা । তোমার হুইলচেয়ার ওর গাড়ির ডিকিতে রেখে নিয়ে যাবো । ফিকে হাসি ফুটলো মেয়েটার মুখে ।

হায়দর আলি গ্যারেজ থেকে স্পেশাল হুইল চেয়ারটা নিয়ে এলো । অফিসের যে চেয়ারে মেয়েটা বসেছিল সেটা আমি আর হায়দর দুজনে মিলে নিজেদের দিকে ঘোরালুম । দেখলুম চেয়ারে একটা বিশেষ ধরণের গদি পাতা । গদিটা হুইলচেয়ারে রাখলুম ।

সামনে দিক থেকে মেয়েটার পাছার তলায় দুদিক থেকে দুহাতের জোরে তুলে নিলুম । মেয়েটা আমার গলা দুহাতে জড়িয়ে ধরল, আঃ কী সুগন্ধ । মনে হলো আমার ঘাড়ে ঠোঁট চেপে রেখেছে ; লিপ্সটিকের দাগ বসে গিয়ে থাকবে । আঁচ করতে পারলুম, মেয়েটা আমার লিঙ্গের সঙ্গে নিজেকে চেপে ধরতে চাইছে । ফলে আমার শরীরে পুরুষের আদেখলা প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হয়ে গেল । আলতো করে হুইলচেয়ারে নামিয়ে বেল্ট বেঁধে দিলুম বুকের ওপর দিয়ে । 

হায়দর আলি হুইলচেয়ার টেনে লিফ্টে করে নিয়ে গেল গ্যারেজে । আমি প্যাণ্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে নিজেকে সামলালুম । টয়লেটে গিয়ে টিশ্যুপেপার দিয়ে লিপ্সটিক মুছলুম । মুখময় ঘাম দেখা দিয়েছিল, তা পুঁছলুম আরেকটা টিশ্যুপেপারে।

লিফ্ট দিয়ে নেমে দেখলুম মেয়েটি তখনও হুইলচেয়ারে বসে, স্ট্র্যাপ বাঁধা, হায়দর গাড়ির পেছনের দরোজা খুলে দাঁড়িয়ে । আবার একই ব্যাপার ঘটল, স্ট্র্যাপ খুলে গাড়ির পেছনের সিটে বসাবার সময়ে । মেয়েটি আমার হাত ধরেছিল, যাতে আমি ওর পাশে বসি । অন্য দরোজা খুলে বসলুম ওর পাশে । আড়চোখে দেখলুম, পাদুটো একেবারে সরুসরু । 

এক অচেনা ভয় আর উত্তেজনা চেপে রেখে চললুম ওকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিতে ।

বাড়িতে গাড়ি পৌঁছোলে, মেয়েটি বলল, ‘স্যার ওয়ান্স মোর, প্লিজ হেল্প মি টু গেট ডাউন’ ।

যা ভাবলুম তা ঠিক কিনা জানি না । এর আগে যুবতিটি কোনো পুরুষকে বুকে জড়িয়ে ধরেনি।



রবিবার, ১৬ জুলাই, ২০২৩

মলয় রায়চৌধুরীর অনুগল্প : জবাবদিহি

 মলয় রায়চৌধুরীর অনুগল্প : জবাবদিহি



স্কুলের পর্ব শেষ হইবার পর আমি স্বগৃহ হইতে কয়েকবার পলায়ন করিয়াছিলাম। কলেজে প্রবেশ করিয়াও পলাইয়াছি বারকয়েক। একা নয়, আমার পলায়নের সঙ্গী হইত সহপাঠী তরুণ শূর। তরুণ আমার নিকটতম বন্ধু ছিল। তাহার প্রধান কারণ আমরা দুইজনই একাকীত্ব ভালোবাসিতাম এবং একত্র হইলেও পরস্পরের সহিত কথাবার্তা বিশেষ বলিতাম না। পাশাপাশি হাঁটিতাম, ট্রাকে অথবা ট্রেনে চাপিয়া দূরদেশে যাইতাম, ধাবায় বসিয়া দ্বিপ্রহরের তড়কারুটি বা ভাত-মাংস খাইতাম। একান্ত প্রয়োজনীয় কথাবার্তা ছাড়া বিশেষ বাক্যালাপ হইত না।

গৃহ হইতে পলায়ন করিতে হইলে বাবা-মাকে অগ্রিম সংবাদটি জানাইয়া তো আর যাওয়া যায় না। হঠাৎই একদিন একবস্ত্রে দুইজনে পলাইতাম। তরুণ ছিল সচ্ছল পরিবারের। টাকাকড়ি সে-ই খরচ করিত। 

গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর বাবা বা মা কেহই কোনো প্রশ্ন তুলিতেন না। কখনও তোলেন নাই। এমন ব্যবহার করিতেন যেন ব্যাপারটি স্বাভাবিক।

একবার পরপর বেশ কয়েকদিন তরুণ আমাদের গৃহে আসিল না। উহার পিতার সহিত যোগাযোগ করিতে উনি জানাইলেন যে, তরুণের লিউকেমিয়া হইয়াছে, চিকিৎসার জন্য পাটনা হইতে কলিকাতা লইয়া যাইতেছেন। 

তরুণ শূরের সহিত  গৃহ হইতে পলায়ন করার ব্যাপারটি সুখস্মৃতি হিসাবে মস্তিষ্কে পালন করিতাম ।  প্রথমবার তরুণের মামার ট্রাকে করিয়া পাটনা হইতে কলিকাতা গিয়াছিলাম।  ড্রাইভারটি  ঠররা নামক দিশি মদ পান করিতে বলিলেও, করি নাই , প্রেস্টিজের ব্যাপার । সন্ধেবেলা ধানক্ষেতে ট্রাকের তেরপল পাতিয়া বেশ্যাকে সঙ্গম করিতে বলিলেও করি নাই। তরুণ বলিয়াছিল উহাদের মুখে নর্দমার গন্ধ ; জড়াইয়া ধরিলে বমন অবধারিত । প্রকৃতপ্রস্তাবে আমার সাহসে কুলায়নি। তরুণ উপদেশ দিয়াছিল, “অণ্ডকোষের ব্যাঙাচিদের গিটার যতোদিন পারিস নিজেই বাজাতে থাক, অর্থাৎ স্বমেহন । সিগারেটের আগুনকে শ্বাস ধার দিতে থাক—-  পানামা সিজার্স বার্কলে ক্যাপ্সট্যান ।”

তাহার পরেও আটবার পলাইয়াছি । একবার নৌকোয় এলাহাবাদ, এক্ষণে যাহার প্রয়াগরাজ নামকরণ করা হইয়াছে। 

গৃহ হইতে পলায়নের পর্বে ছেদ পড়িল। স্নাতকোত্তরের পর আমি চাকুরিতে প্রবেশ করিলাম। চাকুরিতে প্রবেশের কয়েক বৎসর পর বিবাহ করিলাম। আমার একটি কন্যা সন্তান হইল। অফিস হইতে ফিরিয়া কন্যার সহিত খেলিতাম।

একদিন অফিসেই এক সহকর্মীর মুখে শুনিলাম যে তরুণের মৃত্যু হইয়াছে। স্কুল এবং কলেজের সহপাঠী, শৈশবের বন্ধু তরুণ শূর বত্রিশ বছর বয়সে বিদায় লইল, ব্লাড ক্যানসারে ।  আমার মনে পড়িল, কলেজে সেকেণ্ড ইয়ারে  তরুণ বলিয়াছিল, “জানিস, আমি জেমস জয়েসের ‘ফিনেগ্যানস ওয়েক’ দুবার পড়েছি, আর গল্পটা বুঝে গেছি ।” তরুণ এবং  আমার জন্মের বৎসরে, ১৯৩৯ সালে, বইটি প্রকাশিত হইয়াছিল । বইটি পড়ার কোনো প্রয়োজন  ছিল না তরুণের, তবুও জেদ করিয়া পড়িয়াছিল । উহার তুলনায় বাঁচিবার  আরও বেশি আনন্দ উপভোগ করা উচিত ছিল । যাহারা লালু যাদব এবং তাহার অগুন্তি সন্তানের ন্যায় হাফ লিটারেট, কোনো বইপত্র পড়ার প্রয়োজন মনে করে না, নিজদিগের তত্ব নিজেরাই বানায়, তাহারাই বেশি আনন্দে থাকে। চারু মজুমদার, চে গ্বেভারা হইয়া কী লাভ হইল! 

 মৃত্যুসংবাদটি শুনিয়া, গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া সোফায় হেলান দিয়া চুপচাপ বসিয়াছিলাম।

সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছিল।

আমার চার বৎসরের কন্যা ঘরে ঢুকিয়া আমার সন্মুখে দাঁড়াইল, তাহার ছোটো-ছোটো দুটি হাত পিছনে। তিরস্কারের সুরে কহিল, “তুমি দাদু-ঠাকুমাকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালাতে?”



মলয় রায়চৌধুরীর ছোটগল্প : জিরো নম্বর মানুষ

 মলয় রায়চৌধুরীর ছোটগল্প : জিরো নম্বর মানুষ



ইংরেজগুলো আসার আগে চট আর পাট তো একই জিনিস ছিল না । শনের সুতোর মোটা কাপড় ছিল চট, এখন যা দিয়ে গানিব্যাগ তৈরি হয় মিলগুলোয় । বিদ্যাপতি লিখেচিলেন, ‘চটের চান্দয়া খসায় চটের মসারি।’ চট কথাটার মধ্যেই কেমন একটা ছ্যাঁচড়ামি লুকিয়ে । চটকলের সাইনবোর্ড-সর্বস্ব ট্রেড ইউনিয়ানগুলো কথাটায় নিজেদের পাঁয়তাড়া ঢুকিয়ে আরও নোংরা করে দিয়েছে, একেবারে ভ্রষ্ট, পতিত, উদ্ধারের অযোগ্য । সাইনবোর্ড হল ক্ষমতার উৎস । তাতে থাকে মসনদের ছাপ্পা, তাই । বোর্ড ঝুলিয়ে, চেয়ার-টেবিল পেতে ফ্যালো, মসনদি রঙের ঝাণ্ডা ওড়াও, ব্যাস, যত ইচ্ছে অন্যদের বুকনি ঝাড়ো, মাইকচোঙে বকমবকম বকে যাও ।

পাটের জন্নত থেকে চটের জাহান্নমে পৌঁছে দেবার জন্যে কাকে যে দায়ি করবেন, জানেননি খালেদালি মণ্ডল । বিলেতের মেম-সায়েবগুলোকে ? যাঁরা লাটবাহাদুরের পেছন-পেছন স্কটল্যাণ্ডের ড্যাণ্ডি থেকে এসেছিলেন চটের ব্যবসা করতে ? জর্জ অকল্যাণ্ড নামে লোকটাকে, যেনি ১৮৫৫ সালে হুগলি জেলার রিষড়েতে প্রথম চটকলটা পত্তন করেছিলেন ? খালেদালির দাদুর আব্বা ঢুকেছিলেন মিলটায় কুলি হয়ে । হেল্পার হয়েছিলেন । দাদু তো হয়েছিলেন সরদার । সরদার ওঁদের পদবি নয়, তবু দাদুর নাম হয়ে গিয়েছিল হেদায়েত সরদার ।

হেদায়েত সরদারের বাপ পাটতাঁতি ছিলেন । পাটের তাঁত । বিশ্বাসই করতে চান না খালেদালির ছেলে-মেয়েরা যে, পাটের তাঁত ছিল এককালে । সে তাঁতে চটকাপড় বোনা হত না । বোনা হতো পাটের শাড়ি । যিনি পরতেন তিনিই তো ছিলেন রাজার পাটরানি । বিলেতি সায়েবরা আসার আগে আমাদের তো আর চেয়ার ছিল না ; ছিল গদি, চটের গদি, রাজার জন্য পাটের রেশমের ওপর সিংহের চামড়া, সিংহাসন । শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল পালায় আছে তো, ‘পাটে কংস নরবর’। সে কবেকার লেখা গান । আরেকটা পালাগান আছে দুর্গাপঞ্চরাত্রির, ‘রামচন্দ্র পাটে রাজা হইলা।’ কিংবা শূন্যপুরাণ পালায়, সুনার পাটেত বেসাতির বৈসয়ে হাট।’

এখন আর গাও না ক্যানে ?

গলায় চটের ফেঁসো ঢুকে জাম হয়ে গেচে । ও সব গান আর গলা দে বেরুবেনি । খালেদালির বউ আফরোজা জানান, তবলিগ পার্টি বলে গেচে, হিঁদুর গান গাইবিনি । বাপ আর মেয়ের কথাবার্তার মাঝে মাথা গলান তিনি, ছেলেমেয়ের নিকাশাদি আছে, সমাজে থাকতি হয় । আরে, ওদের কথা ছাড়ো, তবলিগ করছেন আবার সিপিএম করছেন । না, এখন তো তৃণমূল । এখানেও সেই সাইনবোর্ড । চটকলের সাইনবোর্ড-নেতাদের দায়ে তো মিলগুলো ডুবল । ডুববেনি ? প্রথম পোয়াতির বুক আর পাটের পোয়াতির মুখ ।

বলেচো ভালো । পাটের পোয়াতি, মানে যার ছেলেপুলে অনেক । আমাদের মিলে তো আঠারোটা ইউনিয়ান । আরও বিয়োবে শুনচি, ব্যালটের বিল পাস হবার আগে । সংস্হান নেই সংস্হা আছে ।

তোমাদের তো সিটু, ইনটাক, আইটাক, এলএস, এইচ এম এস, বি এম এস, এন এফ আই টি উ, এম এল ও সি আরও কী কী যেন ?

মিল গেচে বি আই এফ আর-এ, কিন্তু সাইনবোর্ড ব্যবসা চলচে পুরোদমে ।

ওঁরাই আবার চুক্তি তদারকির মনিটারিং কমিটিতে । আমেদালিটা মাধ্যমিক পাস করলে ছেড়ে দেব এই জিরো নম্বর ওয়ার্কার কুলিগিরি ।

চটকলের রেকর্ডে যে শ্রমিকের অস্তিত্ব নেই, তাঁরা জিরো নম্বর ওয়ার্কার । যতবার ধর্মঘত, লকআউট, সাসপেনশান অব ওয়র্ক হয়ে কারখানা বন্ধ হয়েছে, ততবার মিল খুলেছে মালিক বদল হবার পর । আর প্রতিবার স্হায়ী মজুর ছাঁটাই হয়েছেন । বেড়েছেন জিরো নম্বর ওয়ার্কার । জিরো ন্ম্বর ওয়ার্কারকে পুরো মজুরি দিতে হয় না । তাঁর জন্য পি এফ, গ্র্যাচুইটি, ই এস আই, ঝক্কি-ঝামেলা পোয়াতে হয় না । একটা পোস্টের জন্য দুটো করে শূন্য নম্বর কর্মী । কাংগাল চামার নামে মজুরটা পুলিশি হামলার পরে নিখোঁজ হয়ে গেলে, মিল যখন আবার খুলেছিল, তখন বদলি মজুরের কাজ থেকে ছাঁটাই হবে, ওই কাংগাল চামারের জায়গা ভরাট করতে ঢুকেছিলেন খালেদালি আর বৈকুন্ঠ নস্কর ।

এক জনের জায়গায় দুজনের কাজ । ‘দুই জনারে কাম পাইয়া দিসি কমরেড’ , বলেছিলেন এক ট্রেড ইউনিয়ানের নেতা । কী বারফট্টাই ভাটিয়া বাবুলোগদের । অন্য শ্রমিকরা তবু স্হায়ী, বদলি, স্পেশাল বদলি, ক্যাজুয়াল, কনট্র্যাক্ট হন । খালেদালি-বৈকুন্ঠরা কিছুই হন না । ওঁরা আছেন, কিন্তু নেই । খালেদালিও স্হায়ী ছিলেন । তারপর বদলি, স্পেশাল বদলি, ক্যাজুয়াল হয়ে জিরো নম্বরে নেবেছেন ।

১৯৭০ সালে কুড়ি দিনের ধর্মঘট হয়েছিল, সাত থেকে ছাব্বিশ ডিসেম্বর । ১৯৭৪ সালে ১৫ই জানুয়ারি থেকে ১৫ই ফেব্রূয়ারি, ৩১ দিন । ১৯৭৯ন সালে টানা পঞ্চাশ দিন, পাঁচ জানুয়ারি থেকে তেইশ ফেব্রূয়ারি । ১৯৮৪ সালে ষোলো জানুয়ারি থেকে সাত এপ্রিল, চুরাশি দিন । ১৯৯২ সালে জানুয়ারি মাসে । ১৯৯৫ সালে নভেম্বরে । প্রায় একই সময়ে দু-হাজার সালে । বাজারে কাঁচা পাট আসে জুন-জুলাইতে । প্রতি মাসে দাম বাড়ে । ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে দ্বিগুণ হয়ে যায় । ওই সময়ে ধর্মঘট হলে মালিকের সুবিধে । যাঁরা কাঁচা পাট খরচ করে ফেলেছেন, তাঁদের আর কিনতে হবেনি । দাম আক্রা । যাঁদের বেনামি গুদামে মাল আছে তাঁরা বিদেশে বেচে ডলার কামাবেন । কাঁচা পাটের গুদামগুলো মিল কমপাউণ্ডে নয়, তাই টের পাবার উপায় নেই । মালিকরা মিল চালান এক নামে, কাঁচা পাট কিনে গুদামে ঢোকান আরেক নামে । একই লোক, অথচ গুদাম থেকে মিলকে বেশিদামে কাঁচা পাট বিক্রি করেন যাতে মিলটা লোকসানে চলছে দেখান যায় ।

বৈকুন্ঠ নস্কর বলেছিলেন, খালেদ, তুই এত জানিস, সব ফাঁস করে দিস না কেন ?

ফাঁস ? কার কাছে ফাঁস ? সরকার জানেন, বিধায়ক জানেন, শ্রমমন্ত্রী জানেন, লোকাল ইউনিয়ান নেতা, কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ান নেতা, পার্টিগুলো, কাগজের লোকেরা জানেন । সব্বাই সবকিছু জানেন ।

ভগবান শুধু জানতে পারেন না ।

না, আল্লা জানবেননি, তা কখুনো হয় !

জানেন বলে খালেদালি আজ জিরো নম্বর। চটকলে আট ঘণ্টার কাজ শ্রমিকরা করেন দুটো শিফটে । চটের উড়ন্ত ফেঁসো আর ধুলোয় টানা আট ঘণ্টা কাজ করা অসম্ভব । প্রথম খেপে পাঁচ ঘণ্টা, তারপর কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে দ্বিতিয় খেপে তিন ঘণ্টা । কাংগাল চামার, থাকতেন কুলি ব্যারাকে, মিলের লাগোয়া, দুটো খেপ নিজেই করতেন । এখন পাঁচ ঘণ্টার খেপটা করেন খালেদালি আর তিন ঘণ্টার খেপটা বৈকুন্ঠ । ভাউচারে টিপছাপ দিয়ে মজুরির টুকরো-টাকরা পান । একজন টুকরো, অন্যজন টাকরা ।

হেদায়েত সরদার, খালেদালির দাদু, কুলি ব্যারাকে ঘর পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু খালেদের বাপ সেটা ভাড়া দিয়ে দ্যান এক প্রাইমারি স্কুল শিক্ষককে । শিক্ষকের বড় ছেলে ছাত্র ইউনিয়ানের নেতা, তাই ভাড়া পাওয়া যায় না । তাছাড়া, তিনটে জিনিস খুবই দিষ্প্রাপ্য, হাওয়া, জল আর আলো । আর নোংরা কুলি ব্যারাক, তাই থাকা যায় না অমন বাসায় । খালেদের বাপ নেয়ামতালি সাত কাঠা জমি কিনে দু-মাইল দূরে কোতলবেড়িয়ায় থাকতেন দুই বউ আর সাত ছেলে-মেয়ে নিয়ে । খালেদের ভাগে দেড় কাঠার ওপর কুঁড়েঘর । বিজলিবাতি হুকিং করে পাওয়া । কেরোসিন এত আক্রা যে হুকিং ছাড়া উপায় নেই ।

পাঁচ ঘণ্টার মজুরিতে চারজনের ছিয়ানব্বই ঘণ্টার পেট । বাকি সময়টা গান গেয়ে রোজগারের চেষ্টা । বলতে গেলে ভিকখে । কেউ যদি দ্যান তো দিলেন । বৈকুন্ঠ অন্তত ছুতোরের কাজটা ছাড়েনি । কাজের ফাঁকে, যদি পান ছুতোর মিস্ত্রির করার মতন কিছু, তিন ঘণ্টার খেপটা মেরে চলে যান । তাঁতির কাজটা খালেদালির শেখা থাকলে বাড়িতে সবাই মিলে গামছা-মোটাকাপড় তো বোনা যেত । যাঁরা স্হায়ী শ্রমিক তাঁদেরই, ১৮২৯ টাকা ন্যূনতম মজুরিতে, কাটৌতি বাদ দিলে, তো কথাই নেই, চলে না । একই কাজের জন্য, একই মজুরি পান না সবাই । শ্রমিক মানে তো শ্রমের দাস । অসুখ-বিসুখে পড়লে পাঁচ ঘণ্টার কাজটাই চলে যাবে । আঠারোজন ইউনিয়ান কত্তা তক্কে-তক্কে থাকেন সবসময় । কাউকে কাজ পাইয়ে দিলেই ভাগা দিতে হয় কত্তাদের ।

তিমি মাছ মারা বেশি করে আরম্ভ হল বলে পাট তাঁতিদের মরণ হয়েছিল দেড়শ বছর আগে । তিমির তেল দিয়ে চটের কাপড় ব্লিচ করা আবিষ্কার হতেই তো সুতির কাপড় বোনার কলে একটু অদল-বদল করে সায়েবরা তড়িঘড়ি চটকল বসাতে লাগলেন । ১৮৭০ সালে ওব্দি পাঁচটা চটকল বসে গিয়েছিল এ-তল্লাটে । একশ একটা চটকল ছিল দেশভাগের সময় ।

দেশভাগ ! কোনো মানে হয় ! কার কেমন নুনু সেই অনুযায়ী দেশভাগ । যাঁদের নুনুর খোসা ছাড়ানো, তাঁদের জন্য একটা দেশ । যাঁদের আস্ত তাঁদের জন্য আরেকটা দেশ । বাপ নেয়ামতের কাছে সেসব গল্পগাছা শুনেছেন খালেদ । উনি নিজে তো জন্মেছেন দেশভাগের দশ বছর পর । নেয়ামত ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে চাননি । পাগল নাকি । জানি না, চিনি না, দেখিনি, সেখানকার জনমনিষির কথা বুঝিনে, কেন ছুটব সেখানে ? নুনুর খোসা ছাড়ানো বলে ? সে তো সারা দুনিয়া জুড়ে দেশে-দেশে অমন । সবাই উদিকে ছুটচে নাকি ? মারামারি কাটাকাটি অমন হয়ই । নিজেরাই সামাল দাও । বর্গিরা যখন আসত ত্যাখন তো নিজেরাই সামলিচি । তবে ?

সদামাল দিতে নেয়ামতের অসুবিধা ছিল না । গর্দা সাফাই কুলি ছিলেন নেয়ামতের দুই বউ । চটকলের গর্দায় যক্ষ্মা হয়ে মরেছিলেন বড়টি । ছোটটির চাকরি গেল ১৯৭৪ সালের ধর্মঘটের পর । সারা পশ্চিমবাংলায় চল্লিশ হাজার জেনানা শ্রমিককে খেপে-খেপে ১৯৭০ সালের ধর্মঘটের পর ছাঁটাই করে দিয়েছেন চটকল মালিকরা । বাঙালিরা যত আধুনিক হয়েছেন ততই কমেছেন নারী শ্রমিক । এখন উনষাটটা রুগ্ন মিলে হাতে গোনা কজন । ফুলটাইম চটকল শ্রমিক মা-বাপের ছেলে কিনা জিরো নম্বর কর্মী ।

চাকরি গিয়ে বেঁচে গিসলেন আম্মি । যেখানটায় সাফাই করার কাজ বরাদ্দ ছিল, সেখানেই ১৯৯৩ সালের ফেবরারিতে কারখানার ভেতর পায়খানার চেম্বার ফেটে মারা গিসলেন তিনজন কুলি । ইংরেজরা যাবার পর আর পোষ্কার হয়নি । মালিকের লোক বলেছিলেন, মিল তো চলে লোকসানে, পোষ্কার করবার ট্যাকা কোথায় । ইউনিয়ানের লোক বলেছিল, ‘আমরা কী করুম কন কমরেড, সটকলের হাল ভালো না, দ্যাখতাসেন তো থুঁকতাসে।’

ধুঁকতাসেন তো সবাই । কুলি লাইনে বর্ষাকালে যে পাঁক জমে, তাতে ফি-বছর আন্ত্রিকে মরে বাচ্চারা । দিনের বেলায় ডাঁশ ওড়ে । গতবছর ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় মরেছেন তিনজন উড়িয়া মজুর । জিরো নম্বর নয়, স্হায়ী ছিলেন তাঁরা । যাঁরা টিকে আছেন তাঁরাও ধুঁকতাসেন । রোজই ভয়ে-ভয়ে কাজে যান । গিয়ে হয়ত দেখবেন, গেটে কারখানা বন্ধের নোটিশ ঝোলানো । ইউনিয়ান নেতারা অফিস বন্ধ করে হাওয়া । খালেদালি অনেকবার দেখেছেন অমন কাণ্ড । মিল বন্ধ হলে যাদব, কুর্মি আর বিহারি মুসলমানরা লালু যাদবের রাজ্যে আলু চাষের কাজে চলে যান কিংবা কোনো ধান্দাবাজির ফিকিরে । খালেদালি আর কোথায় যাবেন । ব্যাণ্ডেল বর্ধমান শ্রীরামপুর হাওড়া কলকাতায় গান গেয়ে ভিককে করতে বেরোন । শহরের তুলনায় শহরতলীতে রোজগার বেশি । কুলিগিরি ছেড়ে ভিকিরি হবার লোভ পেয়ে বসে অনেক সময়ে ।

মিল বন্ধ হয়, আবার খোলে । আবার খুলবে, এই উদ্বেগে, আর হয়ত খুলবে না, এই আতঙ্কের মাঝে, দোল খান ওঁরা । সিধো কানহো ডহরে মজুরের কাঁচাপাকা চুল আর শিড়িঙ্গে মুখ আবিরে লাল-সবুজ হয় । নানা কিসিমের নেতা ভাষণ দেন সংগ্রামী সাফল্যের । তারপর আবার যে-কে সেই । বছর ঘুরতেই চুক্তি আঁস্তাকুড়ে । সব কর্মীকে জিরো নম্বর না করলে মিলের হাল ফিরবেনি । যে মিলে যত জিরো নম্বর সে চটকল তত ভালো চলে । তাঁরা ডিভিডেণ্ড বিলি করেন, মিল বন্ধ করতে চান না । ওই তো চাঁপদানি, ডেল্টা, একতা, বিড়লা, ল্যাডলো, কত ভালো চলছে, বিদেশে মাল যাচ্ছে, বাজারে শেয়ার ছেড়েচে ।

বৈকুন্ঠ নস্কর বলেছিলেন, আর কোনো কাজে জিরো নম্বর কর্মী নেই কেন বলো দিকিন ।

সত্যি তো, জিরো নম্বর প্রথানমন্ত্রী হন না কেন ? জিরো নম্বর সাংসদ ? বিধায়ক জিরো নম্বর ? জেলাধিপতি ? পঞ্চায়েত প্রধান ? মিলমালিক ?

আরে মিলমালিক তো জিরোর চেয়ে অধম, বলেছিলেন বৈকুন্ঠ ।

তা একখানা জবর বলেচ বটে । মিলটা তো বসিয়েছিল টমাস ডাফ । তারপর কিনলে হেনরি ব্রাউন । তারপর ব্রেইলি । সেই থেকে ভাড়ায় খাটছে মিলটা । মালিক বলে কিছু নেই ।

কখনো মেহতা, কখনো দুগার, বাজোরিয়া, সারদা, পাসারি । আসল বাচ্চা যে কার, কেউ জানে না । রাঁঢ়ের বাচ্চা ।

ফলে আবার ক্লোজার । খালেদালি মণ্ডল বেরিয়ে পড়েছিলেন ভিককের পর্যটনে । অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন টালা পার্কের কাছে, কলকাতায় । পেটে দানা পড়েনি কদিন । পাবলিক চ্যাংদোলা করে আর জি কর হাসপাতালে সোপর্দ করেছিলেন । কুড়ি দিন পর মারা যেতে তদন্তের জন্য গিয়েছিলেন পুলিশ মর্গে । ময়না তদন্তের কাটাছেঁড়ার পর কালো পলিথিন প্লাসটিকে মোড়া অন্ধকারে আবদ্ধ ছিলেন । খালেদের ছেলে আর কোতলবেড়িয়ার গ্রামবাসীরা সেই প্লাসটিক পুঁটলি নিয়ে ফিরেছিলেন গাঁয়ে । একটাই বডি ছিল, তাও ওনারা দ্যাখেননি প্লাসটিক খুলে । খুলতে সাহসও হয়নে । কেমনধারা কাটাছেঁড়া কে জানে । প্লাসটিকের গায়ে লেবেলে খালেদালি মণ্ডল নাম লেখা ছিল ।

কোতলবেড়িয়া পৌঁছে, শবকে পবিত্রকরণের জন্য বের করতে গিয়ে সবাই থ । কান্নাকাটি স্তব্ধ । এ তো খালেদালি মণ্ডল নয় । এর পায়ে তো দিবাকর যুগির লেবেল সাঁটা । ম্যাটাডর ভ্যানে শব চাপিয়ে আবার ফেরত পুলিশ মর্গে, কলকাতায় ।

নিয়ে যাবার সময় দ্যাখেন নাই কেন ?

স্যার, একটাই বডি ছেল । পলিথিনের ঢাকনায় আব্বার নামের লেবেল ছেল ।

ময়না তদন্তের পর থানা থেকে ডিসপোজাল অর্ডার বা দেহ নিয়ে যাবার আদেশের কাগজ দেখে তবেই মর্গ থেকে মৃতদেহ নিয়ে যেতে দ্যান ওয়ার্ডমাস্টার । ডিসপোজাল অর্ডার দেয়ার পরে তা নিয়ে ওয়ার্ডমাস্টার কিংবা ডোমেরা কী করছেন তা দেখার কাজ আমাদের নয়, বললেন পুলিশ ইন্সপেক্টর কালীশঙ্কর জানা । যান, ডাক্তারবাবুকে জিগেস করুন গিয়ে ।

ডাক্তার পার্থসারথি গুপ্ত, যিনি ময়নাতদন্ত করেছেন, জানালেন, আপনারা শোকে মূহ্যমান বলে হদিশ করতে পাংরছেন না । দেহটা আপনার বাবা খালেদালি মণ্ডলেরই । দিবাকর যুগির হলে তো সে দেহ ফেরত চলে আসত আগেই ।

স্যার এটা মুসলমান পুরুষের দেহ নয় ।

ডেড বডির আবার ধর্ম হয় নাকি ? আমাকে জ্ঞান দেবেন না । মৃতদেহ শনাক্ত করার পরেই তো মর্গের রেজিস্টারে সই করে নিয়ে গেছেন ।

কিন্তু এই দেহ তো আমাদের পক্ষে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় ডাক্তারবাবু । মুসলিম সম্প্রদায়ে মৃতকে বাড়িতে নিয়ে যাবার পর স্হানীয় মানুষ তাঁর মুখ দ্যাখেন । দেহকে চান করানো হয় । তারপর জানাজা বেরোয় ।

আমি আর কি করতে পারি !

কোতলবেড়িয়ার লোকজন পুলিশের বড়কর্তার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন । আহা, উনি তো আর ফিরবেন না, বিষয়টা মিটিয়ে ফেলুন না ।

মিটমাট ? কী বলছেন স্যার !

আচ্ছা আমরা দেখছি । দিবাকর যুগির ভেরিফিকেশানের জন্য ওয়ারলেস করা হয়েছে । কাল আসবেন । বডি মর্গে ফেরত দিয়েছেন ?

হ্যাঁ স্যার ।

অসুস্হ লোককে বাড়ি থেকে বেরোতে দেন কেন ? ওনার পকেটে এলিজাবেথ জুট মিলের কাগজ না থাকলে তো লাশ বেওয়ারিশ হয়ে যেত । তার ওপর আবার আমাদের কাছে জুট মিলের যে লিস্ট আছে তাতে তো দেখছি এলিজাবেথ মিলের কোনো উল্লেখ নেই । ডিসি সদর কথাগুলো বলার সময়ে সৎ ভাবেই বিরক্তি জানালেন ।

খালেদালির ছেলে আর ওনার কাকারা একযোগে আঁৎকে ওঠেন, কী বলছেন কী সায়েব, ওই চটকলেই তো কাংগাল চামারের নিখোঁজ হবার কেস হয়েছিল । সিবিআই এনকোয়ারি হয়েছিল । আদালতে মামলা চলছে আজ ক’বছর ।

টেবিলের ওপর থেকে পুস্তিকাটা তুলে পাতা ওলটান আমিনুল । উনিই একমাত্র ইংরিজি জানেন, শার্ট ফুলপ্যান্ট পরেন । বাকি সবাই লুঙ্গি-গেঞ্জি বা কুর্তা । আমিনুল, খালেদালির ছেলে ঘিরে, রুদ্ধশ্বাস ।

তালিকাটায়, পশ্চিমবঙ্গে চালু চটকলগুলোর লিস্টটায়, বারবার চোখ বোলান খালেদালির ছেলে, ওপর থেকে নিচে আর নিচে থেকে ওপরে । সত্যি এলিজাবেথ চটকলের নাম নেই । কাংগাল চামারের লাশের সঙ্গে মিলটাকেও হাপিশ করে দিয়েছে ।

সাদা ধুতি-পাঞ্জাবিতে এক চশমাচোখ টেকো কালো হোঁৎকা বসেছিলেন চুপচাপ । পুস্তিকাটা মৃতের ছেলের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মন্তব্য করলেন, ‘ইংরেজগুনো বিদেয় হতেই চটকলগুনো বন্ধ করে দেয়া উচিত ছিল । যত্তোসব ক্রিমিনালের ডেন । কী উবগার হয়েছে শুনি বাঙালিদের ? মজুরগুনো তো সব উড়ে-খোট্টা-তেলেঙ্গি, আর মালিকগুনো মেড়ো কিংবা গুজু ।’

সিঁড়ি দিয়ে নাবতে-নাবতে মৃতের সৎভাই বললে, শালা বোধহয় নবোজাগড়নঅলা ।

মৃতের আত্মীয় জ্ঞাতি-প্রতিবেশিদের মগজ থেকে সে মুহূর্তে মৃতের উবে যাবার বদলে এলিজাবেথ জুটমিলের উবে যাওয়াটাই দুশ্চিন্তা হয়ে ঘিরে ধরেছে ।

মৃতের চাচা : মিলটাই কি না জিরো নম্বর করে দিয়েচে ।

মৃতের বড়ভাই : প্রথমে কাংগাল চামারের কোর্ট কেসকে জিরো নম্বর করেছেল ।

মৃতের ছোটোভাই : আলামোহন দাসের পর চটকলে তো বাঙালিরাই জিরো নম্বর ।

মৃতের সৎভাই : এবার পাট হতে চলল জিরো নম্বর ।

মৃতের ছেলে : লিজ কাকে বলে ?

মৃতের সহকর্মী : মাসে মাসে ভাড়া না দিয়ে একলপ্তে কিছুকালের জন্যে ।

মৃতের ছেলে : আর টেকওভার ?

মৃতের আরেক সহকর্মী : কাঁচা পাটের দাম অনেক বকেয়া পড়লে মহাজনের হাতবদল ।

মৃতের ছেলে : মালিকানা তো দেখলুম সিনেমা প্রযোজক আরন বিল্ডিং প্রোমোটারের ।

মৃতের চাচা : সব কাঁচা পাটের দালাল, শেয়ার মার্কেটে চটকলের টাকা খাটায় ।

মৃতের ছেলে : এরাই কি ক্রিকেট বুকি ? ইস্টবেঙ্গল – মোহনবাগান গড়াপেটায় খরচ যোগায় ?

মৃতের বড়ভাই : সল্টলেক আলিপুরের বাড়িগুনোও তো টেকওভার করেচে ।

মৃতের চাচা : কী টেকওভার করতে বাকি রেকেচে ?

মৃতের বড়ভাই : আমাদের কথাবার্তাও তো টেকওভার করে নিচ্চে ওরা ।

মৃতের সহকর্মী : ট্রেড ইউনিয়ানগুলোকে নিয়েচে ।

মৃতের ছেলে : পার্টিগুলোকে নিয়েচে ।

মৃতের সহকর্মী : পুরো দেশটাকেই জিরো নম্বর করে দিল ।

দিবাকর যুগি ছিলেন খেতমজুর । বৈদ্যনাথ পাল যে জমিটা পার্টিকে বলে-কয়ে বর্গা পেয়েছিলেন, তার নাবাল অংশটা ফি-বছর পাঁচ মাসের জন্যে পেতেন । বৈদ্যনাথবাবুর অন্য অংশে সারা বছর মাঙনায় কাজ করার মজুরি হিসেবে । মে মাসেও জল জমে থাকত বলে, শুকনো পাটকাঠি চুবিয়ে রাখার আর ফেঁসো বের করার সুবিধে । ফেবরারি থেকে মে কিংবা জুন । ধারকর্জ পালবাবুই দিতেন । উনি আরও অনেক চাষির পাট কিনে ব্যাপারিকে বেচেন । ব্যাপারি বেচেন আড়তদারকে । আড়তদারের মাল তোলেন পাটের দালালের লোক । তাঁরা চটকলের পাটমজুতদারকে বেচেন । মিল কেনে মজুতদারের কাছ থেকে । এত উঁচু সিঁড়ি থেকে পাটের দাম নাবতে-নাবতে দিবাকরের জন্যে বাঁচত না লাভ করার মতন কিছু । তারপর চটকলে ধর্মঘট ক্লোজার লকআউট সাসপেনশান অব ওয়র্ক তো আর দিবাকরকে আগাম জানিয়ে হয় না । তখন কাঁচা পাট যে দামে পারা যায় বেচে দিতে হয় দিবাকরকে । অথচ তখনই আড়তদারের কেনার ধুম । ঘন ঘন ট্রাক বোঝাই হয় । ধর্মকাঁটায় ওজন হয়ে চলে যায় ।

বদ্যিনাথবাবু জেনে নিতে পারেন ব্যাপারির কাছে, তোষা-তেইশি নাকি সাদা পাটের বীজ বুনলে লাভ । তোষা-তেইশির টিভি-তিন বীজ আর সাদার ডাবলু-তিন বীজের পাট বেশি দামে বিকোয় । আষাড় থেকে আশ্বিন ওব্দি হপ্তায়-হপ্তায় দাম বাড়ে । ব্যাপারি পরশুরাম সাহার গুদাম আছে তুফান গঞ্জে আর মাথাভাঙায় । আড়তদার চাপ না দিলে মাল ধরে রাখেন । বড় একটা পারেন না ধরে রাখতে । ফরোড ব্লক ছেড়ে সিপিয়েম করতে গিয়ে হ্যাঙ্গামে ফেঁসেছেন কমরেড বদ্যিনাথ । যে তল্লাটে যারা বেশি তাদের সঙ্গেই থাগগি যা না বাপু । তবে টিভি-তিন আর ডাবলু-তিনের একর প্রতি ফলনটা কম, বড্ড খেয়াল রাখতে হয় । তার চেয়ে টিভি-পাঁচ কিংবা ডাবলু-ছয়ের ফলন বেশি, আর প্যাঁকাটি পচতে ঝক্কি-ঝামেলা কম । কোমরজল ডোবাগুলোয় থাকতে-থাকতে পচা প্যাঁকাটি থেকে বাড়িসুদ্দু সবাই হপ্তা দুয়েকে পাট বের করে নাও । ভাদ্দর মাসের রোদে শুকুতে পারলে ডাবলু-তিন কি চারের পাট তো ঐ্যাকেবারে সোনার জল-চড়ানো রুপো, চোখ জুড়িয়ে যায় দেখে।

পাটের ভালোমন্দ ছাঁটাই করে বেল বানিয়ে ব্যাপারিই পাঠায় আড়তদারকে । সে ব্যাটা মারোয়াড়ি ব্যাবসাদার, প্রতিটি বেল ওজন করে দেখে নেয় পাক্কা আশি কিলো আছে কি না । বছর বিশেক আগে তো এক হেক্টরে পাঁচ-ছ বেল তৈরি মাল বেরোত । এখন সার আর কীটনাশক দিয়ে দশ-এগারো বেল মাল ওঠে । অথচ চাষির অবস্হা বছর-বছর খারাপ হয়ে চলেছে ।

জুট কর্পোরেশান এ-বছর থেকে পাট কেনা বন্ধ করে দিলে । বদ্যিনাথবাবু এর আগে বার দুয়েক জুট কর্পোরেশানকে মাল বেচার চেষ্টাচরিত্তির করেছিলেন । ব্যাপারি আরআর আড়তদার এমন ধাতানি দিয়েছেন যে বাপের জমমে ওমুখো হবেন না । দিবাকর তো বর্গাদারের খেতমজুর, ওসব উঁচু মনিষ্যিদের কাজে নাক গলাবেন কেন । কলকাতার পার্টির র‌্যালিতে যাবার জন্যে বাড়ির সবাইকে মাথাপিছু একশ টাকা দেন বদ্যিনাথবাবু, তা কি চাড্ডিখানি কথা ! তাছাড়া জুট কর্পোরেশান তো নিজেই অসুখে ভুগছে ।

–বুঝলে দিবাকর, কেন্দ্রীয় সরকার কাঁচা পাটের সহায়ক মূল্য কুইন্টাল প্রতি ন’শো টাকা বেঁধেছে এ-বছর ।

–আজ্ঞা হ্যাঁ ।

–পশ্চিমবঙ্গের দুশো আটটা জুট কর্পোরেশান আপিসের বেশিই তো আগে থাকতে বন্ধ । ওদের পাট দিয়েই এন জে এম সির পাঁচটা মিল চলত ধিকিয়ে-ধিকিয়ে ।

–আজ্ঞা হ্যাঁ ।

–ওই পাঁচটা চতখলও তার মানে বছর কয়েকে বন্ধ হয়ে যাবে । আকাশে শকুন উড়তে লেগেছে । কাঁচা পাটের ফাটকাবাজার জমবে । বাবুরা তিরিশ বছরেই ঝাঁঝরা করে দিলে জেসিকে ।

–আজ্ঞা হ্যাঁ । কই শকুন দেখতাছি না ।

–মাস দুয়েক পাটটা ধরে রাখতে হবে আমাদের । পঁচানব্বুই সনে টিভি-পাঁচের দাম দেড় হাজার টাকা কুইন্টাল উঠেছিল । মনে আছে ? মাসে দুই-এক বেলা মুড়ি খেয়ে থেকো ।

–আজ্ঞা হ্যাঁ ।

–তাছাড়া কলকাতায় ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে র‌্যালি আছে একটা, আসছে সোমবার । যাবার সময় টাকা আর ঝাণ্ডা নিয়ে যেও ।

–আজ্ঞা হ্যাঁ । কুন ঝাণ্ডা এবার ?

–এখনও খবর আসেনি । সে তোমায় ভাবতে হবে না । ন’টন করা পাট নিয়ে আড়তদারের লরি যাচ্ছে ফাটকার জন্যে । ওতে চেপেই দশজন করে লোক চলে যাও । গুদোমগুলো দেখে রেখো ।

কলকাতায় র‌্যালি-সমাবেশে গেলে অনেক খবর পান দিবাকর । গতবার বজবজ জুট মিলের দিনমজুর মদনবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়েছেল, এখন চাগরি গিয়ে আইসক্রিম বেচেন, হানিফভাই রিকশা চালান, গৌরবাবু রাস্তায় গামছা বেচেন । ওই মিলের বারোজন মজুর আত্মহত্যা করেছেন । ওখানকার কয়াল সড়ক আর চড়িয়াল বাজারে গিয়েছিলেন দিবাকর । আত্মহত্যা করা কেন ! কোনো উপায়ই কি নেই ?

–উপায় আর কই দাদা ? ছমাস র‌্যাশান তুলতে পারিনি বলে কার্ড বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে । আগে জানলে কার্ডটা কিছু দিনের জন্যে বেচে দিতুম বা বন্ধক দিতুম কাউকে ।

–ধার দিয়ে-দিয়ে তো আমার কাপড়ের দোকান উটে গেল । কেউ শোধ দিতে পারেনি ।

লাউডস্পিকারে কে একজন, অত দূরে ডেঁওপিঁপড়ের মতন দেখাচ্ছিল, বললেন, বেশ মনে ধরেছিল দিবাকরের, ‘শ্রমিক সাথিগণ ! এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যে ১৮৮৪ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণির দুরবস্হা হ্রাস পায়নি।’

–১৮৪৮ কেন গা ?

–বুড়ো, তোমার দাদুন জন্মেছিল সে বছর, হ্যাঃ হ্যাঃ ।

শুনে, দিবাকরের প্রথমবার খেয়াল হল, সত্যইই বুড়ো হয়ে গেছেন, ষাট-পঁয়ষট্টি হবে । এসব সমাবেশে হাজিরা দেয়াটা স্বাস্হ্যে কুলোয় না ।

সঠিকই ভেবেছিলেন দিবাকর । সভা ভাঙলে ভিড়ের চাপে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন ছেলে আর ছেলের বোউ থেকে । অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন গরমে । হাসপাতালে জনগণ চ্যাংদোলা করে বাসে চাপিয়ে নিয়ে গেলে ডাক্তার বললে, রেনাল ফেলিয়র হয়ে মারা গেছেন । বদ্যিনাথবাবুর দৌড়ঝাঁপে দিবাকর যুগির মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেল পুলিশ মর্গে ।

ভাগ্যিস বদ্যিনাথবাবু ছিলেন । নইলে লাশ খালাসের পাঁচশো টাকা মর্গের ডোমকে দেবার মতন রেস্ত দিবাকরের সঙ্গে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের কারোরই ছিল না । মৃতদেহ ছিলেন কালো পলিথিনে মোড়া । ডোম বললেন, এইটে আবনাদের, ওইটে একটা নেড়ের, খালেদালি মণ্ডলের ।

–ভালো যে তুমি বলে দিলে । শেষে মুসুলমানের মড়া ছুঁয়ে জাতধম্ম যেত ।

–হুজুর আমরা হলুম ডোম । আমাদের কাজই সেবা করা । লোকে মরে গেলেও আমরা তার সেবা করি ।

আড়তদারের যে-লরি মজুতদারের গুদামে কাঁচা পাট নাবিয়ে ফিরে যাচ্ছিল, তাতেই তোলা হল দিবাকরকে । কলকাতায় মকড়া পোড়াতে অনেক খরচ আর হাজার হ্যাঙ্গাম । পলিথিনটা বর্ষাকালে কাজে দেবে ।

মৃতদেহ নিয়ে মাথাভাঙায় পৌঁছোবার পরেই বরং আরম্ভ হল হ্যাঙ্গাম । লোকাল থানায় আগেই কলকাতা থেকে ওয়ারলেস এসে গিয়েছিল যে, ওই সব আসলে খালেদালি মণ্ডল নামে এক চটকল মজুরের । পৌঁছোনো মাত্র যেন কলকাতায় ফেরত পাঠানো হয় । ডেড বডি বদলা-বদলি হয়ে গেছে । পুলিশমন্ত্রী ও স্বাস্হ্যমন্ত্রী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ।

ওসি ভক্তিভূষণ কুণ্ডু ওয়ারলেসের কপি হাতে পাবার আগেই দুপুরে টিভিতে খাসখবর প্রোগ্রামে স্বস্হ্যমন্ত্রীকে বলতে শুনেছেন, ‘হাসপাতালে কোনো রোগী যতক্ষণ বেঁচে থাকেন, ততক্ষণই দায়িত্বটা বর্তায় স্বস্হ্য দফতরের উপরে । রোগীর মৃত্যুর পরে মৃতদেহ পুলিশ মর্গে চলে গেলে পুরো দায়িত্ব গিয়ে পড়ে পুলিশের উপরে ।’ আবার লালবাজারে গোয়েন্দা প্রধানকে ওসি বলতে শুনেছেন, ‘হাসপাতালের মর্গ থেকে মৃতদেহ উধাওয়ের যে-ঘটনা ঘটেছে, তার দায়িত্ব কোনোমতেই পুলিশের নয় । হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই পুরো বিষয়টি দেখেন ।’

অবস্হা বেগতিক বুঝে ওয়ারলেস বার্তা পাওয়া মাত্র দিবাকর যুগির চালাঘরে পৌঁছেছিলেন ওসি ভক্তিভূষণ কুণ্ডু । সঙ্গে এ এস আই নারায়ন সান্যাল । জিপ থেকে নেবে তাঁরা দেখলেন শবকে পলিথিন মোড়ক থেকে খুলে কাঁচা বাঁশের খাটে শোয়ানো হয়েছে ।

–এই যে বদ্যিনাথবাবু রয়েছেন দেখছি । কলকাতা থেকে অর্ডার এসেছে এই ডেড বডি ইমিডিয়েটলি ফেরত পাঠাবার । বডিটা খালেদালি মণ্ডলের ।

–কী বলছেন কী ! কুড়ি বছর আমার খেতের কাজ দেখছে দিবাকর আর আমি চিনব না ? ওর বাড়ির লোকেদেরই জিগ্যেস করুন ।

–হ্যাঁ, ইনি আমার বাবা দিবাকর যুগি ।

–প্রমাণ কী ?

–প্রমাণ আবার কিসের ? বাবাকে আমি চিনব না ? বললেই হল খালেদালি মণ্ডল !

–কী বিপত্তি বলো দিকিন ! কলকাতা থেকে জেলা সদরে হুকুম এসেছে যে ডেডবডিটা সিজ করে ফেরত পাঠাতে হবে । জেলা শাসকের আদেশে একটা ম্যাটাডর ভ্যান সিজ করা হয়েছে, বরফের ফ্যাকট্রিকে ছ’স্ল্যাব আইস দেবার আদেশ হয়ে গেছে, অথচ আপনারা বলছেন ইনি হলেন দিবাকর যুগি । কাকে ঠিক বলে মানব ? আমার ওপরঅলাদের না আপনাদের ?

আচ্ছা, আপনারা একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়ান, আমরা একটু চেক করেনিই, বললেন ওসি ।

বদ্যিনাথ পাল, এই তল্লাটের ডাকসাইটে রাজনৈতিক ফোড়ন, কলকাতার হুকুমের চেয়ে স্হানীয় হুকুমের আধিপত্য যে বেশি, তা দেখাবার চেষ্টায় বললেন, মরা লোকের আবার চেক করাকরির কী আছে ? বডি তো কাটাছেড়াঁ করায় আগেই দোরমা হয়ে গেছে । তাড়াতাড়ি দাহসংস্কসর করে ফেলা দরকার । তা আপনি যখন জোরাজুরি করতে চাইছেন, তখন দেখে নিন কী-কী চেক করার আছে, আমরা বাইরে গিয়ে অপিক্ষে কচ্চি । ভোটাত আইডেনটিটি কার্ডটা করিয়ে দিলুম, সেটাও হারিয়ে ফেলেচে দিবাকর ।

–তা হলেও হয় । বডির বদলে বডির কাগজ সিজ করলেই চলে যাবে ।

–অ্যাই দ্যাখো না, আইডেনটিটি কার্ডটা খুঁজে ।

আত্মীয়স্বজনের কান্নাকাটি, ওসি ভক্তিভূষণ কুণ্ডু আর তাঁর বাপের বয়সী এ এস আই নারায়ণ সান্যালকে দেখে থেমে গিয়েছিল আগেই । ওনাদের গাঁয়ে ঢুকতে দেখে দিবাকরের আঙনায় ইতিমধ্যে প্রায় তাবৎ ভোটার আর হবু ভোটার জড়ো হয়েগিয়েছিলেন নতুন আহ্লাদের খোঁজে । গাঁয়ে রাজনীতিহীন আহ্লাদ এখন খাওয়া-পরার চেয়েও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ।

ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে যেতেই, বার-ভেতরের আড়কপাট বন্ধ করে ওসি গলা নাবিয়ে ্ধে এস আইকে বললেন, শশ শশ চেক করে নিন, চেক করে নিন ।

–কী ভেরিফাই করব, আমি তখন থেকে সেটাই ভাবছি স্যার । গাঁয়ের এত লোকজন, বাড়ির লোকেরা, সবাই মেনে নিয়েছে যে এই লোকটাই খেতমজুর দিবাকর যুগি । দেখুন না, পায়ে সাঁটা স্টিকিং প্লাস্টারেও লেখা রয়েচে দিবাকর যুগি । সরকারি কাজে বাংলা আরম্ভ হয়েচে বলে এই দেখুন না, দেখুন, বাংলায় লেখা দিবাকর যুগি । বাংলায় লেখা আমাদের জেলার প্রথম ডেড বডি । বডি বদলা-বদলি কি আর আজকে হবেছে স্যার, সেসব দেড়শো বছর আগেই হয়ে গেছে । জাতে পাটতাঁতি দিবাকর হয়ে গেছে চাষা, আর জাতে চাচা খালেদালি মণ্ডল হয়ে গেল চটকলের তাঁতি ।

আরে টাইম ওয়েস্ট করবেন না, তাড়াতাড়ি চেক করে নিন ।

–কী স্যার ? চেক তো হয়েই গেল । আমরা যা দেখলুম, আর একটা পাঁচনামা দিয়ে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেব ।

–শশ, তা বলছি না । শিওর হয়ে নিন । ওইটে চেক করুন, ওইটে ।

–ওইটে ?

–হ্যাঁ হ্যাঁ, নুনুটা চেক করুন, রিপোর্ট লিখতে হবে তো ?

–নুনু ? কী বলছেন স্যার ?

–কেন ? বামুন বলে তাঁতির নুনুতে হাত দিতে অসুবিধে ?

–না স্যার, যদি সত্যই অন্য হয় ? মুসুলমান বেরোয় ? তবে ? নিজেই তো নিশ্চিত নন, আর আমায় বলছেন !

দিবাকরকে ঢাকা দেয়া ওঁরই মেটে ধুতিটা ওপর থেকে সরান দুই সরকারি প্রতিনিধি । কোমরে লুঙ্গির মতন পরানো ছেঁড়া ধুতিটা তোলেন এবং একযোগে আশ্বস্ত হন দুজনেই । নাঃ, এ সত্যই দিবাকর যুগি, এর খোসা ছাড়ানো নয় । বদলা-বদলি হয়নি ।

খালেদালি মণ্ডলের দেহ গেল কোথায় স্যার ? এই দিবাকর যুগি লোকটার দেহ আর আইডেনটিটি দুই আছে । কলকাতার মর্গে যে-লোকটার দেহ আছে তার কিন্তু আইডেনটিটি নেই । আর খালেদালি মণ্ডলের দেহও নেই, আইডেনটিটিও নেই । জিরো ? অ্যাঁ !