মলয় রায়চৌধুরীর ছোটগল্প :ভাগ্যলিখনে হরফ দরকার নেই
উঠোনে পড়ে রয়েছে টুনি বালবের অনুরাগী ক্ষুদেকীটদের নিঃশব্দ শোরগোলের লাশ । এখন সকাল আটটা । পশ্চিম বা উত্তরের প্রতি বাতাসের পক্ষপাতিত্ব নেই । গুলতানিরত কয়েকটা হলুদঠোঁট ময়না । গলিপথের প্রভাবশালী কেঁদোকুকুর । কাঁচারাস্তার দু’পাশে অভুভাভকহীন ঝোপঝাড় । ছইছাওয়া ষাটোর্ধ একচালার অনেক অনেক ওপরে খাঁ খাঁ আকাশে বহুদিন মেঘের আনাগোনা নেই । চালার পেছনে তিনবিঘে ধানখেতকে গতবর্ষায় অধিগ্রহণ করেছিল বানভাসি । চারিদিকে র্যাশন দপতরের কর্মচারীদের মতন অনীহাপ্রবণ গাছপালা । আম, জাম, কদম, ভাটাম, চটকা । ওদিকে এক বিঘে জমিতে দলে-দলে জমায়েত রোগা ঢ্যাঙা ইউকালিপটাস । মৃদু ক্ষোভ প্রকাশ করছিল অনেক উঁচুর ইউকালিপটাস পাতাগুলো । এক জোড়া টিয়াপাখি থাকে বাজ-পড়ে-ন্যাড়া তালঘাছটার ঘুলঘুলিতে , কিন্তু নাক উঁচু, নামে না এদিকে । কত মানুষ যেসব কথাবার্তা কতকাল যাবৎ বলেছে, সেগুলো বোলতা হয়ে উড়ছে । কয়েকজন রুপোলি সতীনকে নিয়ে জলকেলি করছিল অলসগতর রুইমাছ।
মাথায় টাইপরাইটার চাপিয়ে বৈকুন্ঠ নস্করকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল আমিনুল ।
–কত দেরি করে দিলে গো । সাড়ে দশটা থেকে পরীক্ষা ।
–চল ইস্টিশানে পৌঁছে দিই । বড্ড ভারি । আটটা ছয়ে ট্রেন, পৌঁছে যাবি ।
–না না আমায় দাও, তুমি পারবে না ।
–চ দিকিনি তুই । তিন কিলোমিটার বয়ে এনেচি আর এইটুকুন পারবনি ? হাওড়ায় নেবে তোকেই তো টঙস টঙস করে বইতে হবে । পারবি তো তুই, না যাব সঙ্গে ?
–না না, তোমায় যেতে হবে না । চাকরি পেলে তো আমাকেই করতে হবে ।
–ভালো করে টাইপ পরীক্ষাটা দে । চাকরি তো একটা পেতেই হবে তোকে । কবে যে পাবি !
আমিনুলের বাপ খালেদালি মণ্ডল, এলিজাবেথ জুটমিলের কুলি, চটকলটায় আচমকা সাসপেনশান অফ ওয়র্ক হতে, অন্য কোনো উপায়ে রোজগার করতে না পেরে, গান গেয়ে, হিন্দি সিনেমার, দূরপাল্লার ট্রেনগুলোয় আর বর্ধমান ব্যাণ্ডেল কলকাতার আশেপাশে, গান গেয়ে, ভিকখের মাধ্যমে পয়সা রোজগারের চেষ্টায় বাড়ি ছেড়েছিলেন, যখন আমিনুল মাধ্যমিক দিচ্ছিল । টালাপার্কের কাছে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে ক্লাবের বেকার ছোকরারা ভর্তি করে দিয়েছিল আর জি করে । মারা যেতে, খালেদালি চালান হয়েছিলেন এন আর এস মর্গে । মর্গ থেকে কালো পলিথিনে মোড়া শব এলে খালেদালির ছেলে ভাই চাচা প্রতিবেশীরা মোড়ক খুলে দ্যাখেন মৃতদেহ খালেদালির নয়, অন্য কারোর, একজন হিন্দুর । শবের পায়ে সাঁটা সাদা স্টিকিং প্লাসটারে ডটপেন দিয়ে লেখা ছিল দিবাকর যুগি ।
দিবাকর যুগির লাশ ওনারা ফেরত দিয়ে এসেছিলেন । কিন্তু তার বদলে ফেরত পাননি খালেদালির মৃতদেহ । খালেদালির মৃতদেহ উধাও । আর পাওয়া যায়নি । অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছিলেন খালেদালির ছেলে ভাই চাচা প্রতিবেশীরা ; ধরাধরি করেছিলেন সায়েবসুবোদের আর কমরেডবাবুদের । পাওয়া যায়নি । ওঁরা কানাঘুষা শুনেছিলেন যে ডায়মন্ড হারবারে একজন লাশের ব্যাপারী আছেন, যিনি বেওয়ারিশ লাশ বালিতে দাঁড় করিয়ে পুঁতে রেখে কঙ্কাল বানান, মেডিকাল কলেজের ছাত্রদের জন্যে, আর বিদেশেও রপ্তানি করেন । কত মানুষ, যারা কখনও বিদেশে যেত না তারা ওইভাবে অন্তত বিদেশে পাড়ি মেরেছে, সেখানের ভালো-ভালো ডাক্তার আর ছাত্রদের আদর-যত্ন পেয়েছে ।
খিদিরপুরে কয়েকটা দোকান আর ডকে খোঁজখবর নিয়ে ওনারা গিয়েছিলেন কঙ্কালের ব্যাপারী দুলাল দুলের কারখানায় । উনি বলেছিলেন, না না, এখেনে আসেনি, আমার ওয়ার্কাররা নেড়েদের ডেডবডিতে হাত দিতে চায় না, তাছাড়া এখন অনুর্দ্ধ তেরো বছরের কনসাইনমেন্টের কাজ চলছে ।
–আজ্ঞে জোয়ান-বুড়োদের কাজ কবে নাগাদ আরম্ভ হবে ? জানতে চেয়েছিলেন বৈকুন্ঠ নস্কর ।
–এই তো বর্ষাকাল আসছে, তারপর আন্ত্রিক ম্যালেরিয়া-টিয়া লাগবে, তখন মাল জোগাড় করতে কম খরচ হয়।
–তা আমি যদি নিজেকে আগাম বেচে দিই ।
–এ ব্যবসায় তা হয় না, তারচে তোমার কিডনি-ফিডনি বেচগা যাও না, অনেক ট্যাকা পাবে ।
খালেদালি ছিলেন বৈকুন্ঠ নস্করের সহমজুর । সেবার যখন ইউনিয়ান কত্তাদের, মজুররা, মানে শ্রমিকরা, দেপ্প্যাঁদানি দিয়েছিলেন, আর তাইতে পুলিশের গুলি চলেছিল, কুলি ব্যারাকের বাসা থেকে চটকল মজদুর কাংগাল চামারকে ফুসলিয়ে তুলে নিয়ে গিসলো ডাকমাস্টার বিপিন নামহাটা, কাংগাল চামার সেই থেকে হাপিশ । ওই কাংগাল চামারের কাজটাতেই ক্যাজুয়াল লেবার হয়ে ঢুকেছিলেন খালেদালি মণ্ডল আর বৈকুন্ঠ নস্কর । প্রথম পাঁচ ঘন্টার শিফটে খালেদালি আর দ্ধবিতীয় তিন ঘণ্টার শিফটে বৈকুন্ঠ । খালেদালির মৃতদেহ বেমালুম উবে যাওয়ায় ওঁর পাঁচ ঘণ্টার শিফটটা বৈকুন্ঠ পেয়েছেন । বৈকুন্ঠর তিন ঘণ্টার শিফটটা পেয়েছেন জীবন হাটুই । তার জন্যে দুজনেই চারশো টাকা করে দিয়েছেন দুটো ইউনিয়ানকে । লাল সেলাম, সবুজ সেলাম । অসসলাম হয়ে গেছে সেলাম ।
বৈকুন্ঠ নস্করের দাদামশায় ছিলেন কেষ্টচন্দ্র কর্মকার, অথচ কোনো ব্যাটা কুলি কেষ্টচন্দ্রের নামই শোনেনি । কোথ্থেকে শুনবে ! বেশির ভাগ তো খোট্টা । বললে কেউই পেত্যয় যায় না যে কেষ্টচন্দ্রের দাদু পঞ্চানন কর্মকার যদি কেরি সায়েবের জন্যে ছাপার হরফ তৈরি না করে দিতেন, তাহলে আমিনুল লেখাপড়ে শিখে বি এ পাস কী করে করত শুনি । অমন পরিবারে জন্মেও বৈকুন্ঠ পড়াশোনা করেননি । পরিবারটাই নেই । দেশচ স্বাধীন হতেই হাতের কাজের মান-ইজ্জত গেল । বৈকুন্ঠ তবু সুযোগ পেলে হাতের কাজটা করেন । ওঁর ছেলে মাধ্যমিকে বেরোতে না পেরে জিটি রোডের ওপর চায়ের ঠেক চালাচ্ছেন । আমিনুলটাও হাতের কাজ করবে না , চা করবে । মাথায় টাইপরাইটার চাপিয়ে যাচ্ছে বালিগঞ্জে পরীক্ষা দিতে । লেখার পরীক্ষায় পাশ করেছে । এখন টাইপ করায় উতরে গেলেই হল ।
কত ঘটনা ঘটে গেছে খালেদালির বদলে দিবাকর যুগির মৃতদেহ আনার আর ফিরিয়ে দেবার পর ।
ঘটনা এক
মোজ্জরা আনন্দপুর গ্রামের আমেদ মণ্ডলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল খালেদালির মেয়ে আমিনার । বুড়ো আমেদ মণ্ডল মরতে গাঁয়ের বউ-ঝিদের সঙ্গে চুমকি বসানোর কাজ করতেন আমিনা । মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল-কেশপুর ব্লকের কেশপুর, দাসপুর, কলমিজোর, কৃষ্ণনগর গ্রামের মেয়েরা চুমকি বসাবার কাজ করতেন মহাজনদের দেয়া কাপড়ের ওপর । চুমকি বসানো কাপড় থেকে তৈরি হতো ব্যাগ, খামরা, যাত্রাপালার পোশাক, ওড়না, বোরখা এইসব । মহাজনেরা কাজ করাতেন আট ঘন্টা আর তার বদলে মজুরি দিতেন ছোটোদের তিন ট্যকা, বড়দের পাঁচ ট্যাকা । চলে যাচ্ছিল কোনো রকমে । সিপিয়েম তৃণমূল যুদ্ধু শুরু করলে । মহাজনের গুদামে আগন লাগল । কালো-কালো পোড়া হাড়ের কোনটা যে আমিনা, জামিলা, লক্ষ্মী বারুই, তা হদিশ করতে পারল না পুলিশ ।
যত শ্রমিক আত্মহত্যা করেন বা খুন হন, সবাইকেই আত্মীয় মনে হয় বৈকুন্ঠর । মনে হয়, ঠিক, এই তো, এই না হলে পঞ্চানন কর্মকারের লাতিপুতি ।
ঘটনা দুই
মর্গের ডোম আর ওয়ার্ডমাস্টার মিলে খালেদালিকে আকাশে গোর দিয়ে দেবার পর বৈকুন্ঠ নস্করের স্বজনজ্ঞাতির সংখ্যা বেড়েই চলেছে ।
বন্ধ কারখানার নাম………………….কতজন আত্মহত্যা করেছেন
ওরিয়েন্টাল মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ…………..২
বঙ্গোদয় কটন মিল…………………২
অ্যালুমিনিয়াম ম্যানুফ্যাকচারিং কোং…….৩
ডানবার কটন মিল……………….৮
শ্রীদুর্গা কটন অ্যান্ড উইভিং মিল….৬
অরবিন্দ বেনেলি লিমিটেড…………..১
হিন্দুস্হান আয়রন অ্যান্ড স্টিল…..১
সুলেখা…………………………………১
ওপেক ইনোভেশান………………………১
জে কে স্টিল………………………..১
বজবজ জুট কোং…………………..১
হিন্দুস্তান পিলকিংটন গ্লাস কোং….১২
বেনি ইনজিনিয়ারিং……………………….৩
মেটাল বক্স…………………………৩
টিটাগড় পেপার মিল……………….১
ইস্টার্ন পেপার মিল…………………২
কোলে বিস্কুট……………………….১
ঘটনা তিন
দেয়ালে কী লেকা আচে রে ?
কোতায় ?
উই যে লাল কালি দে লিক্কে রেকেচে ।
জানি না, যাও ।
জানিসনে ? এত লেকাপড়া শিকলি । আর এইটুকুন পড়তে পারিসনে ?
না পারি না । ওই লোকটা আসচে, ওকে জিগ্যেস করো ।
তাই করি । ও বাবু, ওই মিলের দেয়ালে কী লেকেচে গো ?
লিখেছে, ‘কমরেড তুমি আর গাঁড় মারবে না ? এখনও অনেক… ইয়ে…রয়েছে বাকি ।’
হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ ।
ঘটনা চার
বহু বছর বন্ধ হয়ে গেছে বজবজ চটকল । চার হাজার মজুর, মানে মজদুর, মানে শ্রমিক, কাজ করতেন মিলটায় । কয়াল সড়ক গমগম করত । গমগম গমগম গমগম । মিলমাইনের কাঁচা ট্যাকা উড়ত চড়িয়াল বাজারে । ফুরফুর ফুরফুর ফুরফুর । কিছু মজুর, মানে মজদুর, মানে শ্রমিক, থাকতেন বাখরা আর বাওয়ালিতে । থাকতেন প্রতিমা আর প্রতিমার স্বামী, বজবজ চটকলের ফিল্ড ওয়ার্কার । মিল বন্ধ হতে জমানো ট্যাকা ফুইরে গেল । রোজগেরে দেওর থাগবে কেন ওখেনে, ওদের সঙ্গে । স্বামী লজেন্স বিক্রি শুরু করলেন ট্রেনের নিত্যযাত্রীদের গাদায় । পা কাটা গেল নাবতে গিয়ে ।
ভাগ্যিস বউটা জোয়ান থাকতে বন্ধ হল মিলটা । নইলে কী দুগ্গতি হতো বলো দিকিন ! জোয়ান আছে বলে সন্ধেবেলায় দুয়েকটা খদ্দের ধরে রোজগারপাতি কচ্চে কিছু । জীবনসংগ্রাম গো ।
ঘটনা পাঁচ
শচীন দেববর্মন গাইতাসেন :
বাঁশি শুনে আর কাজ নাই
ও যে ডাকাতিয়া বাঁশি
বছরের পর বছর পেরিয়ে গেছে গো । কারখানার বাঁশি আর বাজে না । জং পড়ে গেছে লোহার ফটকে । মিলের শপফ্লোরে জঙ্গল, দেয়ালে-দেয়ালে কত যে অশথ গাছ । রাত্তিরে তোলাবাজ আর মস্তানদের আঙ্গনওয়াড়ি । আলোর বালাই নেই । লাখ-লাখ ট্যাকার বিদ্যুৎ বিল বাকি । লাইন কাইট্টা দিসে । বাইরে দেয়ালে আর স্লোগান নাই । ঘুঁটের পর ঘুঁটের পর ঘুঁটে, তারপর ঘুঁটে, আবার ঘুঁটে । আমাগো ন্যাতা সাইনবোর্ড লয়্যা অননো মিলে গ্যাসেন গিয়া । চালু মিলে । হেই মিলে রোসগার নাই । কবে যে মিলের জমিডা বিক্রয় হইব । সরকার অখন দ্যাখতাসেন । সিন্তা নাই ।
আরেকটা ঘটনা যে এক্ষুনি ঘটতে চলেছে, বাড়তে চলেছে আরেকজন আত্মীয়, আঁচ করতে পারেননি বৈকুন্ঠ নস্কর । আমিনুল জানতে চান, জেঠু, ঝাড়ুদাররাও কি শ্রমিক ? বৈকুন্ঠ বললেন, হ্যাঁ, ঝাড়ুদাররা ঝাড়ুশ্রমিক ; আমি তো জাতে ছুতোর কিন্তু কাজে চটশ্রমিক, তোর বাপ ছিল জাতে চাষা, কাজে চটশ্রমিক । তা ঝাড়ুদারটার নাম কী ?
আনার গাজি ।
গাজি ? গাজি আবার কীরকম জাত ?
যোদ্ধা । অনেক কাফের মারলে একজন মুসলমান গাজি হয় ।
অ, তা তিনি এখন আরশোলা মারচেন ?
না, আনার গাজিকেই মেরে ফেলেছে বলে খবর বেরিয়েছে ।
ওই দোইনিক পোতিদিনে ? আমি টাইপরাইটারটা বইচি, তুই পড়ে শোনা । তাড়াতাড়ি পড়, ট্রেন আসার সময় হয়ে গেল । ওই তো তাসপেটাবাবুরা পৌঁছে গেচে ইসটিশানে ।
আমিনুল টাইপরাইটারটা বৈকুন্ঠের মাথায় চালান করে কাঁধের ঝোলা থেকে আজকের কাগজটা বের করেন, আর স্কুলের পাঠ পড়ার মতন করে পড়তে থাকেন । হাঁটতে-হাঁটতে হাঁপাতে-হাঁপাতে….
ঝাড়ুদারকে সাফ করা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক ।বনগাঁ । স্বরূপনগর থানার বিরুদ্ধে সেখানকার সাফাইকির্মী আনার গাজিকে পিটিয়ে মেরে ফেলার অভিযোগ আনলেন নিহতের স্ত্রী সুফিয়া বিবি । তাঁর অভিযোগ, “বৃহস্পতিবার ভোরে আনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে অন্যান্য দিনের মতোই থানায় গিয়েছিলেন । ওই সময় তাঁকে ওসির ঘর থেকে সোনার গয়না চুরির অভিযোগে মারধর করা হয় । তারপর আনারের অবস্হা খারাপ হয়ে যাওয়ায় সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করতে তাঁর মুখে বিষতেল ঢেলে দেয়া হয় ।”
এদিকে, থানার মধ্যে ওই সাফাইকর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনার পরে শনিবারও এলাকার বাসিন্দা এবং রাজনৈতিক দলগুলি দোষী পুলিশ কর্মীদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ দেখান । একটি রাজনৈতিক দলের সংখ্যালঘু সেল এই খুনের ব্যাপারে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে সিবিআই তদন্ত দাবি করেছে ।
থানার মধ্যেই ওই ঘটনার পরে স্হানীয় মানুষের বিক্ষোভ এড়াতে বৃহস্পতিবার পুলিশ তড়িঘড়ি বলেছিল, আনার নিজে বিষ খেয়ে থানায় এসেছিল । হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়েছে । কিন্তু বসিরহাট হাসপাতালের সুপার চন্দ্রশেখর রায় আনারের দেহ ময়নাতদন্তের পরে জানিয়েছেন, আনারের পাকস্হলিতে কোনো বিষ পাওয়া যায়নি । বরং প্রচণ্ড আঘাত অথবা শারীরিক উত্তেজনায় হৃদযন্ত্রে রক্ত জমে আনারের মৃত্যু হয়েছে ।
পুলিশের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই দিন ভোরে আনার থানায় যাওয়ার পরই চুরির অভিযোগে তাঁকে থানাতেই আটকে রাখা হয়েছিল । পাশাপাশি ওই এলাকায় কীটনাশকের একমাত্র দোকানের মালিক নিজেই আনারকে চেনেন । তিনি শনিবার বলেছেন, আনার ওই দোকান থেকে কিছুদিনের মধ্যে কোনো চাষকীটের বিষ কেনেননি । ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, আনার বিষ পাবেন কোথায় । আর অন্য কোথাও বিষ যদিবা পান, তাহলেও তিনি ওই অবস্হায় থানাতেই বা যাবেন কেন ? আনারকে ওই এলাকায় বেশিরভাগ মানুষ চিনতেন । হতদরিদ্র আনারের পরিবারে স্ত্রী-পুত্র মিলিয়ে মোট চারজন সদস্য । দুটি পুত্রই তিনি থানা থেকে কুড়িয়ে এনে মানুষ করছিলেন । তাঁর কাজ ছিল ভ্যান চালিয়ে ঘটনাস্হল থেকে বেওয়ারিশ মৃতদেহ বহন করে হাসপাতালে জমা দেয়া, থানা ধোয়ামোছা করা ইত্যাদি । সেই সুবাদে হাসপাতালে আনার বিশেষ পরিচিত ছিলেন । তিনি তো অসুস্হ বোধ করলে সোজা হাসপাতালেই যেতে পারতেন ।
কিন্তু ঠিক কী হয়েছিল সেদিন ? আনারের স্ত্রীর অভিযোগ, “ওই দিন ভোর চারটে নাগাদ আনার আর-পাঁচদিনের মতনই থানায় যান । যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে গয়না চুরির অপবাদ দিয়ে আমার স্বামীকে আটকে রেখে ওরা সবাই মিলে পেটাতে শুরু করে।” পুলিশ সূত্রেই জানা গিয়েছে, থানায় তাঁকে দফায়-দফায় মারধর করা হয় । তারপরে তাঁকে আটকে রাখতে বলে ওসি অরুণ হাজরা বেলা দশটা নাগাদ বিথারি বাজারে একটি গোলমাল ঠেকাতে বেরিয়ে যান । এরপরই থানায় উপস্হিত হন স্হানীয় চিকিৎসক রহমান মণ্ডল । তিনি বলেছেন, “আমি একটা কাজে থানায় গিয়েছিলাম । হঠাৎ দেখি, ওসির ঘরের পাশে কয়েদখানা থেকে আনার ‘আমায় বাঁচান বাঁচান’ বলে চিৎকার করে টলতে-টলতে ছুটে আসছে । আমি সঙ্গে-সঙ্গে পুলিশকর্মীদে৫র বলি আনারকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে । তারপর থানার গাড়ির চালক রবি কোলে কাঁধে করে আনারকে স্হানীয় শাঁড়াপুর স্হাস্হ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান ।”
স্হাস্হ্যকেন্দ্রের সূত্রের খবর, আনার সেখানকার চিকিৎসকদের বলেছেন, “আমি বিষ খাইনি । আমায় চোর বানিয়ে এই হাল করেছে । থানার মালখানায় রতনপুরে ধরা পড়া চুরির যে সোনা ছিল তা পুলিশের সবাই ভাগাভাগি করে নিয়েছে ; কালকে সেই কেসের ডেট, তাই আমাকে চুরির দায়ে ফাঁসানো হল ।” কিছুক্ষণ পরে সেখানেই আনারের মৃত্যু হয় । আনারের মৃত্যুর খবর পেয়ে ওসি স্বরূপনগর থানা থেকে বদলি নিয়ে চলে যান তাড়াতাড়ি । ওসির এই তড়িঘড়ি বদলি নিয়ে চলে যাওয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে ওপরতলার পুকিশকর্তারা বলেছেন, “ওই ওসির বদলির আদেশ এসে গিয়েছিল অনেকদিন আগেই । তাই চলে গিয়েছেন ।” প্রায় একমাস আগে যাঁর বদলির নির্দেশ এসেছিল, তিনি এরকম পরিস্হিতিতে কেন হঠাৎ করে চলে গেলেন, তার ব্যাখ্যা অবশ্য তাঁরা দেননি ।
খবরের কাগজটা ভাঁজ করে ঝোলায় পুরে বৈকুন্ঠর মাথা থেকে টাইপরাইটারটা নিজের মাথায় চাপিয়ে নিলেন আমিনুল । ট্রেন দেখা যাচ্ছে দূরে, আবছা ।
বৈকুন্ঠঃ ওহোহো, পিটিয়ে মেরে ফেললে একেবারে ? কাংগাল চামারটাকে এমনি করেই পিটিয়ে মেরে পাথর বেঁধে ফেলে দিয়েছিল গঙ্গায় । কত কেস-কাছারি হল কিন্তু আর পাওয়া যায়নি । ওহো হো হো, কি মারটাই মেরে থাগবে আনারটাকে ।
আমিনুলঃ দেম্মার দেম্মার । আপারকাট । লোয়ারকাট । গদাম ।
বৈকুন্ঠঃ ঢিশুম ঢিশুম হুমহুনা ।
আমিনুলঃ হুমহুনা ভাই হুমহুনা ।
বৈকুন্ঠঃ ল্যাংটা পোঁদে ।
আমিনুলঃ হুমহুনা ।
বৈকুন্ঠঃ এই ছুটেচে ।
আমিনুলঃ হুমহুনা ।
বৈকুন্ঠঃ হুমহুনা ভাই হুমহুনা ।
আমিনুলঃ হুমহুনা, হুমহুনা ।
বৈকুন্ঠঃ রক্তমুখে ।
আমিনুলঃ হুমহুনা ।
বৈকুন্ঠঃ হুমহুনা ভাই হুমহুনা ।
আমিনুলঃ হুমহুনা, হুমহুনা ।
বৈকুন্ঠঃ দেপ্পিটুনি ।
আমিনুলঃ হুমহুনা ।
বৈকুন্ঠঃ হুমহুনা, হুমহুনা । হুমহুনা ভাই হুমহুনা ।
ট্রেন এল । গাদাগাদি সত্ত্বেও টাইপরাইটার মাথায় ভিড়ের চাপে ভেতরে সেঁদিয়ে আমিনুল দেখলেন ওঁর বয়সী আরও দুজন টাইপরাইটারবাহী । ওঁকে সাহায্য করলেন তাকের ওপর আরও দুটো টাইপরাটারের পাশে ওঁরটা রাখতে । এঁরা তো একই চাকরির জন্য যাচ্ছেন । তবু স্বস্তি বিনিময় করলেন তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বী । ভূপাল চেল, আসছেন কাটোয়া থেকে । রাত্তিরটা বর্ধমানে জামাইবাবুর বাড়িতে ছিলেন । পীযুষ বটব্যা।, বর্ধমান থেকেই উঠেছেন । ওঁরা দুজনেই তিনশো টাকা দিয়ে ভাড়া নিয়েছেন টাইপরাইটার । আমিনুলেরটা এলিজাবেথ জুটমিলের । চটকল বন্ধ । ট্রেজারির কেরানিবাবু ব্যবস্হা করে দিয়েছেন । বদলে, ওনার রান্নাঘরের দরোজা মেরামত করে দিয়েছেন বৈকুন্ঠ নস্কর ।
ভূপাল চেল আর পীযুষ বটব্যালকে নিয়ে টাইপরাইটার-কেন্দ্রিক আলোচনা নিত্যযাত্রীদের ফুরিয়ে এসেছিল । আবার আরম্ভ হল আমিনুল মণ্ডলের প্রবেশে ।
ক বাবুঃ এ তো মাইরি দেকচি কাগের পেটখারাপ হবার গপপো, অ্যাঁ ! টাইপরাইটার মাতায় চাপিয়ে চাগরির পরীক্ষা ! নিজেরই টাইরাইটার বয়ে নিয়ে গিয়ে টাইপিং টেস্ট দাও ! অ্যাঁ ? বালের দেশ বটে একখানা ।
খ বাবুঃ কটা পোস্ধট আচে জানিস ? কুল্লে কুড়িটা । আর পরীক্ষা দিতে ডেকেচে কতজনকে জানিস ? এগারোশো ছেলে-মেয়েকে । মেয়েদের কামরায় দেকলুম, ব্যাণ্ডেলে একটি মেয়ে টাইপরাইটার মাতায় উডলো । ভদ্দরঘরের সব ছেলে-মেয়ে । চাগরির আগেই মুটেগিরি । চাগরি পেলে কি অকাজ-কুকাজ করবে, ভেবে দ্যাখ ।
গ বাবুঃ আমি তো শুনলুম পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও বিহার উড়িষ্যা উত্তরপ্রদেশ সিকিম শিলচর, দূর-দূর থেকে সব টেস্ট দিতে আসচে মাথায় টাইপরাইটার চাপিয়ে ।
ঘ বাবুঃ জানি জানি । বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের সেন্ট্রাল ছাউনির মধ্যে ।
ঙ বাবুঃ লণ্ডন প্যারিসে টাইপরাইওটার তো উঠে গেছে । কমপিউটারে টাইপ হয় ।
খ বাবুঃ আরে মশায় কমপিউটার বসালে তো টাইপিস্টের আর দরকার থাকবে না । কমপিউটার নিজে-নিজেই সব টাইপ করে ফ্যালে বলে শুনিচি । বোতাম টিপে দাও, ফটাফট পাতার পর পাতা টাইপ ।
ঙ বাবুঃ কমপিউটারে হাত দিয়ে দেখেছেন কখুনো ? যা পড়েন, যা শোনেন, সেটাই বিশ্বাস করে নেন দেখছি । খ্যাংরা কাঠির ওপর আলুর দম মার্কা এক নেতার জন্যেই পশ্চিমবঙ্গে তিরিশ বছর কমপিউটার ঢুকতে পারেনি । তাই আজ মাথায় করে টাইপরাইটার বয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে যেতে হচ্ছে ।
ঘ বাবুঃ এদিকে কী হয়েছে জানেন তো ? গলসি থানার কুলগড়িয়া চটির কাছে কালনা-আসানসোল রুটের সুপারবাসের ড্রাইভার বচন সিংকে পিটিয়ে যে-পুলিশ অফিসার ওর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল আর নিজেকে বলেছিল হুগলির পুলিশ সুপার গঙ্গেশ্বর সিং ? মানবাধিকার কমিশন এখন ধরে ফেলেছে যে লোকটা আসলে বর্ধমানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নীরজ সিং । নাম ভাঁড়িয়ে পিটিয়েছে । বাস ড্রাইভারটার দোষ নাকি বারবার এপিএসের গাড়িকে ওভারটেক করছিল । বচন সিং বেস্পতিবার কমিশানের সামনে নীরজ সিংকে আইডেনটিফাই করেছে । বচন সিংকে প্যাঁদাতে-প্যাঁদাতেই পুলিশ অফিসার নাকি বলেছিল, আমি গঙ্গেশ্বর সিং, হুগলির এস পি, কেউ আমার একটা বালও ওপড়াতে পারবে না । বাসযাত্রী আর হেল্পার কন্ডাক্টারও সাক্ষী দিয়েছে । কী কেলেঙ্কারি ।
ক বাবুঃ আরে মহাকরণ জু্যোতিবাবু-বুদ্ধবাবু চালালে কী হবে । পশ্চিমবঙ্গের আইন-শৃঙ্খলা চালায় লালু যাদব । পুলিশের বড় কত্তারা তো সবকটা দেখি খোট্টা । টিভি খুললেই দেখি বাংলাভাষার পেছন মাচ্চে খোট্টা অফিসার। বাঙালির ছেলে তো আই পি এস দেবে না । মায়ের কোলে খোকা হয়ে বিপ্লবের বাল ওপড়াবে । আর পদ্য লিকবে।
গ বাবুঃ আমাদের মেমারি থানার নিসংকো, বাজে কাশিপুর আর বারাকপুর গাঁয়ে রাস্তা সারাই, ইলেকট্রিক সাপলাই, টিউকল এইসব নিয়ে আমরা সবাই ভোট বয়কট করেছিলুম বলে বিপ্লবীরা তো মামলা ঠুকে দিয়েচে আমাদের নামে । নেতাদের অভিযোগ পেয়ে মেমারি থানার পুলিশ বারাকপুর গাঁয়ে রোববার রাত্তিরে রীতিমত তাণ্ডব চালিয়ে ন’জুনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেচে । বাড়ির দর্জা ভেঙে ঢুকে পিটিয়েচে, ভেঙেচে, লণ্ডভণ্ড করেচে । কার কাচে যে যাব জানি না । বিপ্লবীরা মসজিদে বিচারসভা বসিয়েছিল শুনেচি । বর্ধমান সদরের সার্কেল ইন্সপেক্টর চন্দ্রশেখর রায়চৌধুরীর কাচে গিসলুম আমরা । উনি বল্লেন, ‘ওই ঘটনার কতা আমার জানা নেই । তবে খোঁজ নিচ্চি ।’
অঃ হ্যাঃ হ্যাঃ, খোঁজ নিচ্চি ।
আঃ ব্যাপারটা তদন্ত করা হচ্ছে ।
ইঃ আইন তার নিজের পথেই চলবে ।
ঈঃ বিষয়টি বিচারাধীন । কিছু বলা যাবে না ।
উঃ প্রশাসন পুরো জিনিসটা সবদিক থেকে খতিয়ে দেখছে ।
ঊঃ আমরা নিয়মের নিগড়ে বাঁধা । তার বাইরে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় ।
ঙ বাবুঃ হ্যাঁঅ্যাঅ্যা । ওই সিস্টেম । আমাদের খিদিরপুর কলেজ প্রিন্সিপল আর এক প্রফেসরকে রিভালভার নিয়ে চড়াও হয়ে চড়চাপড় লাথি-থুতু কী হেনস্হাই না করলে ছাত্ররা । বাইরের লোক এসে হামলা চালিয়েছে । নিরাপত্তার দাবিতে সোমবার থেকে কলেজ বন্ধ রয়েছে । ওদের দাবি ওদের ক্যাণ্ডিডেটকে নিতে হবে । অথচ ওই পাঁচটা সিট খেলোয়াড় আর বাইরের ছাত্রীদের জন্যে রিজার্ভড । অধ্যক্ষ সামসুল আলম আর প্রফেসর শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায় মার খেতে আমরা ওয়াটগঞ্জ থানায় গিয়ে এফ আই আর করলুম । আসলে দীর্ঘদিন ধরে এস এফ আই আর ছাত্র ব্লকের লড়াই চলছে নিজেদের মধ্যে ; অথচ যখন-তখন মার খাচ্ছি আমরা । কলেজ পরিচালন কমিটির সদস্য সিপিয়েম নেতা ফৈয়জ আহমেদ খান আর ফরোয়ার্ড ব্লকের খাদ্যমন্ত্রী কলিমুদ্দিন শামসের ছেলে মৈনুদ্দিন এক সঙ্গে এসে আশ্বাস দিয়েছিলেন কলেজে আর হাঙ্গামা হবে না । কিন্তু যে কে সেই । এই সিস্টেমের অসুখ সারবে না । পশ্চিমবঙ্গের নাম পালটে বাংলা না করে করা উচিত রসাতল ।
চ বাবুঃ আপনি ওকথা বলছেন তো ? গতমাসে অপিসের কাজে বহরমপুর গিয়েছিলুম । যা শুনলুম জেনে থ হয়ে যাবেন আপনি । সুপদ হালদার নামে বহরমপুর মাতৃসদনের এক ডাক্তার সুভাষ কলোনির বাসিন্দা ঊর্মিলা প্রামাণিকের বাচ্চাকে মারা গেছে ঘোষণা করে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছিল । ওরা বাচ্চাটাকে জুলে ভাসাতে গিয়ে দ্যাখে সেটা দিব্বি নড়ছে । এই তো কারবার ।
ছ বাবুঃ আমার ছিলে বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজে পড়ে । ওর পরীক্ষার মার্কশিট আটকে রেখে দিয়েছে কলেজ । কলেজে বিচিত্রানুষ্ঠানের জন্য দুশো টাকা চাঁদা না দিলে মার্কশিট দেবে না । আমার ছেলে বলেছিল, কিছু কম করুন, একশো টাকা নিন, তা ওকে বলা হয়েছে বি কম পরীক্ষার ফর্ম ভরতে দেয়া হবে না । কয়েকজন গাঁইগুঁই করে দুশো টাকা দিলেও হুমকি দেয়া হয়েছে যে কলেজে ক্লাস করতে সমস্যা হবে । কলেজ অধ্যক্ষ পুষ্পিতারঞ্জন ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করেছিলাম । উনি বললেন, “আমরা কাউকে টাকা দিতে বাধ্য করিনি । টাকা তোলা হয়েছে এই কথা মাথায় রেখেই, যাতে সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের পর যে টাকা বাঁচবে, তা কলেজের উন্নয়নে লাগানো যায় । যাঁরা টাকা দিতে পারছেন না, তাঁদের মার্কশিট আটকাইনি, অন্য সমস্যাও সৃষ্টি করিনি ।” তারপর কলেজ সুপারিনটেনডেন্ট অমল বিশ্বাসের কাছে যেতে উনি বললেন, যাঁরা দিতে পারছেন না তাঁরা পুরপিতা বা বিধায়কদের দিয়ে লিখিয়ে আনবেন যে আর্থিক অবস্হার কারণেই তাঁরা টাকা দিতে পারছেন না । কী আর করি । অ্যাসেমব্লি কিংবা পুরসভার বাপের সঙ্গে আমার চেনাজানা নেই । যাচ্ছি টাকাটা দিয়ে দিতে । প্রেসিডেন্সিতে আবেদনপত্রের দাম দশ টাকা বেড়েছিল বলে কত ট্যানডাই-ম্যানডাই হল, আর এখানে যখন দুশো টাকার জন্যে হুমকি দেয়া হচ্ছে, তখন সবাই বোবা মেরে বসে আছে । রিফিউজিদের জন্যে খোলা হয়েছিল কলেজটা । পরিচালন সমিতির সভাপতি হলেন উদ্বাস্তু নেতা প্রশান্ত শূর । এখন অবস্হা দেখুন ।
লহরীতোলা ঝড়ের ঢঙে, রোদে পোড়া ছায়া মেখে হাওড়ার আউটারে দাঁড়ায় ট্রেনটা । বাতাসে ঘায়ের গন্ধ । তার মানে শহর । নির্বাসিতের চাউনির মতন আবছা হাওড়া ব্রিজ । মহানগর । চিরহরিৎ মরুভূমি । যত বড় মহানগর তত বড় চাকরি । যত বড় চাকরি তত য়য মহানগর । সবার বড় কাঙালরাও ওখানেই থাকেন । থাকেন স্বপ্নের আঁস্তাকুড়ে । আর আঁস্তাকুড়ের স্বর্গে । ভিজে ঢোলকের আওয়াজের মতন কন্ঠস্বরের লোকজন । নিজের ওপর নিজে নজর রাখছেন সবাই । ফুটপাতের গাছগুলো নিজেদের দেউলে ঘোষণা করে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ । একটু বৃষ্টিতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে রাস্তার নর্দমা । কারোর সঙ্গে কারো ঘড়ি ওখানে হুবহু মেলে না । সবসময় যেন শোকার্তদের উৎসব চলেছে । সবাই যেন লুকোবার জায়গা খুঁজে হয়রান । ঘড়ির পেন্ডুলাম মহানগরে কেবল এক দিকেই দোল খায় । এখানকার লোকগুলো ধাঁধা বানায়, কিন্তু সমাধান বাতলায় না ।
আমিনুল দেখলেন, রেল লাইনের মাঝে দাঁড়িয়ে একটা কুকুর নিজের গা থেকে ছায়া চেটে তুলছে । নব্বই ডেসিবেলে ডাকছে কি কুকুরটা ? ট্রেনের আওয়াজে শোনা গেল না । আওয়াজ না হলে শহর হয় না । শহর যদি রাত জাগা আরম্ভ করে তাহলে মহানগর হয়ে যায় । যত দেরি ওব্দি জাগে তত বড় মহানগর । কত আবর্জনা জড়ো হয় এখানকার আঁস্তাকুড়গুলোয় । আবর্জনার ডাঁই দেখে মনে হয় সবার প্রয়োজন মিটে গেছে । তা তো নয় । মহানগরের আবর্জনা থেকে টুকিটাকি খুঁজে লোকে নিজেদের প্রয়োজন মেটায় । মহানগর যত বাড়ে, তত বাড়ে প্রয়োজন । অথচ সেসব প্রয়োজনের দরকার হয় না । না হলেও চলে । পয়দা হয়েই চলেছে সেসব প্রয়োজনের জিনিস । চতখল মজুরের দরকারগুলো কেন মেটে না তাহলে ? কেন এত কটকচালি?
ঘটাং শব্দ তুলে ট্রেনটা এগোতে, আমিনুল নিশ্চিন্ত হলেন । নিজেদের গপপো নিয়ে নিত্যযাত্রীরা মেতে থাকায়, ওঁকে আর অযথা প্রশ্নের জালে আটকা পড়তে হয়নি । ভূপাল চেল আর পীযূষ বটব্যাল আগেই ওঁদের প্রশ্নের, অনুসন্ধিৎসার, কৌতূহলের খাঁই মিটিয়ে দিয়েছেন ।
টাইপরাইটারের মাধ্যমে গড়ে-ওঠা ওঁদের আত্মীয়তা ঘনিষ্ঠতা পায় প্ল্যাটফর্মে আরও দুজন টাইপরাইটারবাহীকে পেয়ে । একটি মেয়ে, ঊর্মিলা সাহা, আসছেন কালনা থেকে, অন্যজন অপূর্ব জানা, উঠেছেন শ্যাওড়াফুলিতে । পাঁচ-পাঁচটা টাইপরাইটার নামতে দেখে কুলিরা উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন । মাথায় তুলে পাস কাটালেন ওঁরা । গেটে আটকালেন না টিটি, বললেন, এ শালা কতজন ক্যাণ্ডিডেট যাচ্ছে টেস্ট দিতে । সকাল থেকে দেখছি প্রত্যেক ট্রেন থেকে টাইপরাইটার মাথায় প্যাসেনজার নাবছে । সবকটা তাইপরাইটার বোধহয় কলকাতায় জড়ো হয়ে গেল কলকাতায় ! টাইপরাইটারের মহামিছিল যাবে টাইপরাইটারের মহাসমাবেশে । কত কী যে মহা-মহা দেখলাম এই সাত বছরের চাকরিতে । সত্যি । মহাসত্যি ।
টিকিটচেকারবাবুর গল্পও আছে তাহলে । রোজগারপাতি না করতে পারলে গল্প হওয়া যায় না । কাংগাল চাচা চটকল মজুর ছিলেন বলেই তো বিপদে পড়লেন । সত্যিকার কাঙাল হলে ওনাকে কি আর পুলিশ ধরে নিয়ে যেতেন ? মোটেই না । কই, ভিকিরিদের তো অমন তুলে নিয়ে যান না । আব্বা চটকলে কাজ করতেন বলেই তো ওনার মরদেহ লোপাট হওয়া নিয়ে এত লেখালিখি হল কাগজে । আব্বার গল্পটাকে ঘাড় ধেকে নামাতে একটা চাকরি খুবই জরুরি । নিজের গল্প তাহলে শুরু করা যায় । ভিকিরিদের মতন গল্পহীন আর কতকাল থাকা যায় । আর, বেকার মানে তো ভিকিরির অধম । ভিকিরিরা অন্য লোকেদের রোজগার থেকে খুদকুঁড়ো চান । বেকারের তো চাইবারও যো নেই । যাঁরা রোজগার করেন, তাঁরা আরও পাবার জন্যে দাবিদাওয়া করেন, জুলুস-মিছিল করেন, গোঁসা কিংবা ঠ্যাকার দেখাবার ব্যাপার-স্যাপার করেন । বেকারের কিছু করবার নেই বলেই তো বেকার ।
মিনিবাস তুলতে চাইলেন না ওঁদের । কণ্ডাক্টার বললেন, না দাদা, সকালের তনটে ট্রিপে অনেক টাইপরাইটার পৌঁছে দিয়েছি । এখন অফিসটাইমে র্যালা করবে পাবলিক ।
ওঁরা, যুবক-যুবতীরা, ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে ফিরে, লাইন দিয়ে, টাইপরাইওটারগুলো ডিকিতে ঢুকিয়ে, রওনা দিলেন পরীক্ষাকেন্দ্রের পানে । যুবকরা সবাই ভাবছিলেন, মনে-মনে হয়ত রেষারেষিটা শুরু হয়ে গিয়েছিল স্টেশানে নেমেই, যে, মেয়েটির পাশে বসবেন, দেখতে সাদামাটা কালচে হলেও । উনি হিন্দু নয় জানতে পারলে মনোমালিন্যের সম্ভাবনা আঁচ করে, মেয়েটি, ঊর্মিলা সাহা, পেছনের সিটে বসলে, আমিনুল আর অপূর্ব জানা বসলেন ড্রাইভারের পাশে । মেয়েটিকে দেখে, আচমকা মনে পড়ল আমিনুলের, ওঁদের কোতলবেড়িয়া গ্রামের পদ্মপুকুরের ধারে, বৈঁচি ঝোপের কাছে ফি-বছে মনসা, শেতলা, বিশ্বকর্মার যেসব মূর্তি ঘটা করে এনে রেখে যায় পঞ্চায়েতের পুজো কমিটির লোকেরা, তার একটা মাটি-চটা খড়-বেরোনো মূর্তির চোখের মধ্যে বাসা বানিয়েছে একজোড়া দোয়েল পাখি । হাত ঢুকিয়ে দেখবেন ভেবেছিলেন উনি, মানে আমিনুল । কিন্তু যদি সাপ থাকে, দোয়েলের ডিম খেয়ে নেবার পর ? হাসপাতালে যাবেন, না গুণিনের কাছে যাবেন, বাড়ির লোকেরা সাপে-কাটা আমিনুলকে নিয়ে দোটানায় পড়ে যাবেন ।
মাছরাঙার বাচ্চা ধরতে গিয়ে কেউটে সাপে ফি-বছরই দু-চারজনকে কামড়ায় । হিঙ্গলগঞ্জ ঘোষপাড়ার ভদি সরকার, সেরেরাটির তাপসী সরকার, নেবুখালির সুরেন্দ্রনাথ মণ্ডল কিংবা মহিষপুকুরের বিমল মণ্ডলের ডাক পড়ে । কেউই ওনারা ডাক্তার নন । সবাই গুণিন । চাকরি-বাকরি না পেলে গুণিন হবার চেষ্টা করা বরং ভালো । চটকল মজুরের চেয়ে ংএর ভালো । চটের সুতলির কামড়ের বিষ থেকে কোনো জুটমিলের কুলিই বাঁচেন না । কত রকমের সাপ থাকে কলকাতায় । চটকলগুলোকে বিষে-বিষে জর্জরিত করে দিয়েছে । এরও গুণিন হয় ; সেসব গুণিনরাই তো বিষধর । তাঁরা যত বিষ ঝাড়েন তত বিষ বাড়ে । কত-কত বক্তৃতা আর ভাষণ ঝাড়েন সেসব গুণিনরা, গম্ভীর মুখে, নাক ফুলিয়ে, যন্তরের মতন বকরের পর বকরের পর বকর ।
–ন’টা তো এখানেই বেজে গেল, ঢুকতে দেবে তো ? ঊর্মিলা সাহা বললেন ।
–না দিলেও বাড়ি ফিরে বাবাকে বলব, টেস্ট দিয়েছি, টাইপরাইটারের জন্যে অনেক টাকা গচ্চা দিতে হয়েছে । অপূর্ব জানা বললেন ।
–বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডটা যে কোথায় আমি তো তা-ই জানি না । পীযূষ বটব্যাল ।
–আমি জানি, ওটা বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে । ভূপাল চেল ।
হাসলেন না কেউই । উদ্বেগে আক্রান্ত সবাই । পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছে ভাড়া মেটান মেয়েটি । অন্যেরা নিজেদের অংশ মেয়েটিকে দেবার পর ডিকি থেকে যে-যার টাইপরাঈতার বের করে মাথায় চাপিয়ে স্কুল কম্পাউণ্ডে অজস্র টাইপরাইটারবাহী তরুণ-তরুণীদের বিশাল আঁকাবাঁকা লাইন দেখে বিমূঢ়, থ । এগারোশো ক্যান্ডিডেট মানে এত লোক ! এ তো একটা মহাজনসভার ভিড় । সবাই এক-একটা ঘরে গিয়ে ব্যাচ হিসাবে বসে যাবে, তার বদলে কিউ কেন !
–আরে রিপোর্টিং টাইম ছিল ন’টা । সাড়ে ন’টা বাজতে চলল এখনও টেস্ট আরম্ভ হয়নি । সেনা ছাউনির ইসকুলেই ডিসিপ্লিনের এই হাল ।
–শুনছি পঁচিশজনের এক-একটা শিফটে পরীক্ষা হবে ।
–আমাদের চান্স আসতে-আসতে বিকেল হয়ে যাবে তাহলে ।
–আগে পরীক্ষা আরম্ভ হোক তারপরে তো চান্স ।
তরুণ-তরুণীরা মাথা থেকে টাইপরাইটার নামিয়ে বসে পড়েছিলেন মাটিতে । কায়িক শ্রমে ক্লান্ত । অভিভাবকরা এক-এক জায়গায় জটলা চালাচ্ছেন । মাথার ওপরে টাইপরাইটারের বদলে রোদ।
–কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় সংগঠনের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার এস পি বাউড়ি বসে রয়েছেন ভেতরে । ভদ্দরলোক কী বললেন, জানেন ? বললেন, একদিনে পরীক্ষা না নিলে প্রশ্ন ফাঁস হবার আশঙ্কা ছিল । বুঝুন ঠ্যালা । টাইপিং টেস্টে আবার প্রশ্ব ফাঁস কিসের রে ? একটা বইয়ের পৃষ্ঠা খোল আর টাইপ করতে দে । তা নয় । সেই আটটা থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি মশাই ।
–আমিও তো কথা বললুম বাউড়ির সঙ্গে । বললে, নিজের টাইপরাইটার নিয়ে এলে সুবিধা হয় । অভিযোগ ওঠে না । টাইপরাইটার ওব্দি ভাড়া করতে চায় না ব্যাটারা ।
রোদ বাড়ে । ক্রোধ বাড়ে ।
ক্রোধ বাড়ে । রোদ বাড়ে ।
রোদ বাড়ে । ক্লান্তি বাড়ে ।
ক্লান্তি বাড়ে । রোদ বাড়ে ।
রোদ বাড়ে । লাইন বাড়ে ।
দশটা দশ মিনিটে পরীক্ষা শুরু হল । প্রথমে পঁচিশ জনের ব্যাচ । আধ ঘণ্টা করে ।
রোদ বাড়ে । লাইন বিশেষ এগোয় না ।
দশটা চল্লিশ । দ্বিতীয় ব্যাচ ।
এগারোটা দশ । তৃতীয় ব্যাচে ঢোকার ঠেলাঠেলি ।
বারোটা । পরীক্ষা কেন্দ্রের কাঁচে ঢিল পড়ে । একটা । দুটো, চারটে । ভেতরে ঢোকার মারামারি । লাইন ছত্রভঙ্গ । আরও ঢিল পড়ে । ইটপাটকেল বৃষ্টির আদল পায় ।
পুলিশ আসেন । লাঠি চালান । সামলাতে পারেন না হাজারখানেক রাগি ছেলে-ছোকরাকে । নিজেকে নয়, টাইপরাইটার বাঁচাতে ব্যস্ত সবাই । ফলে মাথা ফাটে । রক্ত দেখে ক্রোধ আরও বাড়ে । চাকরির জন্যে পপরস্পরের রেষারেষি ভুলে তরুণ-তরুণীরা জোটবদ্ধ প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন । ভারতীয় সেনার প্রতিপক্ষ । ছাউনি থেকে আসেন সেনা জওয়ানরা । কাঁধে আর মাথায় টাইপরাইটার চাপিয়ে বাইরে রাস্তার দিকে দৌড়োন চাকুরিপ্রার্থীর ভিড় । টাইরাইটারসুদ্ধ পড়ে যান কেউ-কেউ । তাঁদের মাড়িয়েই দৌড়োন পরীক্ষার্থীরা আর তাদের অভিভাবকদল । মাথায় টাইওপরাইটার । পেছনে ভারতীয় সেনাজওয়ান । চিৎকার । চেঁচামেচি । গালমন্দ । কপালে রক্তমাখা রুমাল ।
আমিনুল পড়ে গিয়েছিলেন । পড়ে গিয়ে, পরীক্ষা ভণ্ডুল হওয়ায় উনি আহ্লাদিত । বৈকুন্ঠ জেঠুর কাছ থেকে টাইপরাইটারটা নিজের মাথায় চাপিয়ে নেবার সময়ে দেখে নে্য়া হয়নি । চটকলের মতনই চটকলের এই টাইরাইটার । রিজেক্টেড মাল । হরফের যে অর্ধবৃত্তাকার ইউনিট থাকে, সেটাই নেই টাইপরাইটারটায় । হরফহীন টাইপরাইটার ।
আমিনুল মণ্ডল চিৎকার করে ওঠেন : হেই সামালো, হেই সামালো, হেই সামালো, প্রাণ হো ।
দ্বিতীয় টাইপরাইটারবাহী : সাদা হাতির লাল মাহুত তুমিই না ?
তৃতীয় চতুর্থ পঞ্চম টাইপরাইটারবাহী : ঢের সয়েছি আর তো মোরা সইব না । হুমহুনা ভাই হুমহুনা ।
আমিনুল : হেই সামালো, হেই সামালো, হুমহুনা ভাই হুমহুনা ।
সমস্ত টাইপরাইটারবাহী : হুমহুনা, হুমহুনা । হুমহুনা ভাই হুমহুনা । হেই সামালো, হুমহুনা, হুমহুনা, হুমহুনা ভাই হুমহুনা…….
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন