রং ও রংবাজি : মলয় রায়চৌধুরী
কার্ল ইয়ুঙ : “রং হল অবচেতনের মাতৃভাষা”
এক
রং বা রঙ শব্দের মানে হলো বর্ণ । কিন্তু রঙ শব্দের আরও প্রয়োগ আছে, যেমন রঙ চড়ানো অর্থাৎ বাড়িয়ে বলা; রঙচঙে বা রঙচঙা অর্থাৎ জাঁকালো ; রঙমহল অর্থাৎ হারেম, পরে এর মানে হয় বিলাসভবন, তা থেকে রঙ্গালয় বা থিয়েটার । হারেম বা বিলাসভবনে সম্রাট, রাজপুত্র, নবাবদের আচরণ থেকে রঙবাজ শব্দের উৎপত্তি যা আধুনিক কালখণ্ডে ভিন্নার্থে ব্যবহার করা আরম্ভ হয় । জাহাঙ্গীর ছিলেন প্রথম পরিচিত রঙবাজ ; অনেক ভাল গুণ থাকা সত্ত্বেও, মদ্যপান ও নারী ( মাগিবাজ ) এই দুই আসক্তির জন্য জাহাঙ্গীর রংবাজ হিসেবে সমালোচিত হতেন । রাজপুত্র থাকাকালীন তিনি বহু যুবতীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করলেও, নাদিরা বেগম বা শরীফুন্নেসা নামের একজন নর্তকীর প্রেমে পড়েন । এই নর্তকী আনারকলি নামে পরিচিত। তিনি ফারসি রানি নুর জাহান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাঁর সাম্রাজ্য জুড়ে ফার্সি সংস্কৃতি প্রচার করেন। রংবাজ-এর ফারসি ‘বাজ’ শব্দটি তাঁর সময়ে প্রথমে হিন্দভি ও উর্দু ভাষায় প্রবেশ করেছিল । উর্দু ভাষার প্রাথমিক রূপটি “হিন্দভি” বা “দেহলভি” নামে পরিচিত ছিল, যা হিন্দি, আরবি, ফার্সি এবং তুর্কি ভাষার মিশ্রণ । এটি ছিল সাধারণ মানুষের ভাষা এবং দিল্লির মিনা-বাজার ও চাঁদনি চৌকের রাস্তায় এই বুলিতে কথা বলা হত ।
রং বা বর্ণ হল মানুষের দৃষ্টি-সংক্রান্ত একটি চিরন্তন ধর্ম। দৃশ্যমান আলোর কম্পাঙ্ক থেকে রং উৎপত্তি হয়। বিভিন্ন কারণে মানুষের কাছে রঙের পার্থক্য হয় । বলা হয় যে মৌলিক রং তিনটে : লাল,নীল আর সবুজ। সত্যি বলতে সূর্যের আলো হতে পাওয়া প্রতিটি তরঙ্গের রঙই মৌলিক। আলোক রশ্মির কম্পনের ভিন্নতা আমাদের মস্তিষ্কে ভিন্ন ভিন্ন রঙের জন্ম দেয়। সেই অর্থে সূর্যালোকের লাল রঙের সীমানার ভেতর অসংখ্য লাল রঙ লুকিয়ে আছে যাদের সবগুলোকে এখনো নামকরণ করা হয়নি।
রঙ দেখা সম্পূর্ণই আমাদের মস্তিষ্কের কল্পনা। আমাদের চোখের সংবেদনশীলতা লাল, সবুজ ও নীল রঙের প্রতি বেশি। সেইজন্য বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা এই তিনটি রঙকে প্রাথমিকভাবে মৌলিক রঙ বলি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে হলুদ রঙ সৃষ্টিকারী আলোক তরঙ্গগুলো মৌলিক নয়। তড়িৎচৌম্বক বর্ণালীর প্রতিটা দৃশ্যমান তরঙ্গই মৌলিক। বিজ্ঞানে সাধারণত লাল, সবুজ কিংবা নীল রঙ তিনটিকে মৌলিক রঙ বলা হয় মূলত আমাদের চোখ এবং মস্তিষ্কের কোষগুলোর সংবেদনশীলতার উপর ভিত্তি করেই। সাধারণত রঙধনুতে আমরা নানান রকম রঙের উপস্থিতি দেখতে পাই। তবে রঙধনুতে সবগুলো রঙ উপস্থিত থাকে না। এমনকি ভিন্ন ভিন্ন দিনের রঙধনুতে উপস্থিত রঙের সংখ্যাতেও ভিন্নতা দেখা দিতে পারে।
প্রকৃতিতে রঙের সংখ্যা অসীম এবং সূর্যের বিকিরণ থেকে আসা অসংখ্য আলোক তরঙ্গের প্রতিটা রঙই মৌলিক। আমাদের মস্তিস্কের কল্পনা ও দৃষ্টিশক্তির সীমাবদ্ধতা মৌলিক রঙ এবং এর সংখ্যা দিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করে। পদার্থবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানকে সমন্বয় করে বলা যায়, বাস্তবে আমাদের ভৌত জগতে রঙের কোনো অস্তিত্ব নেই। আলো থেকে আসা কোনো তরঙ্গই আসলে কোনো রঙকে ধারণ করে না। আলোক রশ্মিগুলো ধারণ করে শুধু নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আর কম্পাঙ্ক। আলোক তরঙ্গের দৈর্ঘ্য বা কম্পাঙ্কের ভিন্নতা আমাদের মস্তিষ্ককে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় উদ্দীপ্ত করে প্রকৃতিকে ভিন্ন ভিন্ন রঙের মিশ্রণে রাঙিয়ে তোলে। তার মানে, প্রকৃতির প্রতিটা রঙই অবাস্তব এবং কাল্পনিক। শুধু চোখ দিয়ে রঙ বা বর্ণ দেখা যায় না, দেখতে প্রয়োজন হয় মস্তিষ্কেরও। চোখ এবং মস্তিষ্কের গঠনের উপর নির্ভর করে কোন প্রাণী কতগুলি রঙ চিনতে পারবে বা দেখতে পারবে। এই সব কিছুর প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা করেন স্যার আইজ্যাক নিউটন।
এটি এখন প্রমাণিত যে রঙগুলি মেজাজ, অনুভূতি এবং আবেগকে নাটকীয়ভাবে প্রভাবিত করতে পারে। বিপাক বৃদ্ধি, রক্তচাপ বাড়াতে এবং এমনকি চোখের চাপ সৃষ্টি করতে পারে। লাল, কমলা এবং হলুদ উষ্ণ রং হিসাবে পরিচিত যা উষ্ণতা এবং স্বাচ্ছন্দ্যের অনুভূতি জাগায়, তবে আবেগ, রাগ এবং শত্রুতারও উদ্রেক করে। অন্যদিকে, নীল, বেগুনি এবং সবুজ শীতল রং যা শান্তির পাশাপাশি দুঃখের অনুভূতি নিয়ে আসে।
দুই
প্রাণীদের সনাক্তকরণ এবং তাদের নিজেদের মধ্যে সংকেত আদান প্রদান থেকে শুরু করে পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য নানান জৈবিক প্রক্রিয়ায় রঙ যেন জীয়ন কাঠি। প্রাণীজগতে রঙ চেনার ব্যাপারেও অনেক বৈষম্যতা আছে। যেমন মানবকুল অনেক রঙ দেখতে পারলেও বেশকিছু প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীরা কিন্ত লাল রঙ দেখতে পায়না। অনেক প্রাণী আমাদের মতন অনেক রঙ দেখতেই পারেনা যেমন, ঠিক তেমনি তারা দেখতে পায় এমন অনেক রঙ আমরা দেখতে পাই না।
প্রাণীজগতে রঙ-এর খেলার বিশাল গুরুত্ব আছে। রঙ প্রাণীদের মধ্যে বিভিন্ন সংকেতের আদানপ্রদান এবং পরিবেশে অভিযোজনের জন্যও অপরিহার্য। রঙ একদিকে কিছু প্রাণীদের পরিবেশে মিলেমিশে শিকার ধরতে যেমন সাহায্য করে তেমনি অন্য দিকে কোন কোন প্রাণীর শিকারি প্রাণীর চোখে ধুলো দিতে সাহায্য করে। অনেক প্রাণীর বেঁচে থাকা অনুকারিতা ছাড়া সম্ভব নয়। প্রাণীর দেহের বর্ণ যেমন ভয় দেখায় তেমনি পরিবেশের সাথে মিশিয়ে জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে। কোনও বস্তুর উপর আলো পড়ে তার থেকে প্রতিফলিত বর্ণগুলিকে চেনার জন্য একেক প্রাণীর চোখ একেক ভাবে তৈরি। যার চোখ যে তরঙ্গদৈর্ঘ্য কে ধরতে পারে তার কাছে বস্তুটি সেই বর্ণেরই মনে হয়। আমরা হলুদ ফুল কে হলুদ দেখলেও মৌমাছি হলুদ কে হলদে-সবুজ দেখে। লাল-হলুদ ফুল কে আমরা দেখি লাল আর হলুদ রঙের। ঠিক তাকেই মৌমাছি দেখে অতিবেগুনী, নীল এবং সবুজ রঙের। তারা আবার লাল-বর্ণ দেখতে পায়না কিন্তু যা আমরা দেখতে পাইনা যেমন অতিবেগুনী বর্ণ সেই বর্ণ কে মৌমাছিরা দেখতে পায়। প্রজাপতিরা সেই ফুলকেই দেখে অতিবেগুনী, নীল, সবুজ এবং লাল রঙের। তাই আমরা যা কিছু যে রঙের দেখি অন্য প্রাণী তা সে রঙের নাও দেখতে পারে। কালো ময়নাকে আমরা কালো দেখলেও তার সঙ্গী তাকে নীল-সবুজ-লাল-হলুদের বর্ণীল হিসাবেই দেখে। পাখিদের চোখেও চতুর্থ ধরনের কোণ-কোষ থাকে যা দিয়ে তারা ম্রিয়মান অতিবেগুনী রশ্মিকে দেখতে পায়। যা আমরা পারিনা।
সাপদের দৃষ্টি শক্তি খুব দুর্বল। অনেক সাপের চোখের সামনে তাপ-সংবেদনশীল ইন্দ্রিয় থাকে যাকে বলা হয় লরিয়েল পিট । যা দিয়ে শিকারের অস্তিত্ব সাপ টের পায়। শিকারের গায়ের তাপমাত্রার অতি সামান্য তারতম্য থেকে সাপ তার মস্তিষ্কে বর্ণের ছাপ বানিয়ে নেয়। যেমন একটি ইঁদুরের দেহের মাঝ অংশে বেশি তাপমাত্রার অংশটিকে সাপ দেখে লাল বর্ণের এবং দেহের বাইরের দিকের অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রার অঞ্চলটিকে দেখে নীল বর্ণের। এই সবটাই দেখে চোখ ছাড়া। শুধু ওই তাপ-সংবেদনশীল ইন্দ্রিয় এবং মস্তিষ্ক দিয়ে। এই ক্ষমতাও সে, আলোতেই থাকুক আর অন্ধকারে, তার শিকার কে ঠিক দেখে নেয়। প্রাণীজগতে বিভ্রান্তিজনক রঙ বিশেষ ভূমিকা পালন করে । দেহের বিভ্রান্তিজনক রঙ প্রাণীদের শিকার হওয়া থেকে অথবা শিকার করতে সাহায্য করে। একটি হচ্ছে ক্যামোফ্লেজ এবং আরেকটি হচ্ছে অনুকারিতা বা মিমিক্রি।
কিছু প্রাণী বা উদ্ভিদ অন্য কারোর বা বস্তুর মতো রঙ ধরে। অর্থাত্ একজন আরেকজনকে নকল করে। এই অনুকারিতায় তিনটি ধরনে আছে। যাকে নকল করা হয় তাকে বলা হয় মডেল। যে নকল করে অন্যের রূপ নেয় তাকে বলা হয় মিমিক। তা দেখে যে ধোকা খায় তাদের বলা হয় ডুপ। অনুকারিতা আবার দুই ভাগে বিভক্ত- বেটসিয়ান অনুকারিতা এবং মুলেরিয়ান অনুকারিতা। যেমন, যে প্রাণী বিষাক্ত তাকে সবাই ভয় পায়। তাকে যদি অন্য আরেকটি বিষহীন প্রাণী নকল করে অন্যদের ভয় দেখায় তখন তাদের বেটসিয়ান অনুকারিতা বলা হয়। প্রাণীজগতে প্রচ্ছন্ন রঞ্জন বা ক্রিপটিক কালারেশন-এর সেরা উদাহরণ হচ্ছে গিরগিটি। তাদের ত্বকে বা স্নায়ুতন্ত্রের যে ক্ষমতা আছে তার মাধ্যমে রঙ পালটে ফেলতে পারে। গিরগিটিদের ত্বকের ভিতরের স্তরে থাকে মেলানিন। ত্বকের যে যে কোষগুলি রঞ্জক বহন করে তাদের সংকুচন প্রসারণ বা চালনা করে মস্তিষ্ক দিয়ে। চাহিদা অনুযায়ী দেহের বর্ণ পরিবর্তন করে তারা শত্রুর হাত থেকে বাঁচা বা শিকারের কাছে চলে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকা সব অনায়াসে করে ফেলে। তার সাথে সঙ্গীর কাছে নিজেকে মোহিনী করে তোলে। গিরগিটি দেহের তাপমাত্রার তারতম্য বজায় রাখার জন্যও দেহের রঙ পালটে ফেলতে পারে।
অক্টোপাস খুব দ্রুত সাঁতার কেটে পটভূমির সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিজের বর্ণ পরিবর্তন করতে পারে। তাদের দেহের বহিঃত্বকের রঙের থলিতে থাকে লাল, হলুদ এবং বাদামী রঞ্জক। অনেক প্রজাতির অক্টোপাসের আবার পাঁচ ধরনের রঞ্জকও থাকে। দেহের পেশীর সংকোচন ও প্রসারনের দ্বারা তারা রঞ্জকভর্তি থলির নাড়াচাড়া করে দেহের বর্ণ নিজের ইচ্ছা মতো করে নেয়। ভয় পেলে বাঁচার জন্য আশেপাশের জলকে ঘোলা করে দেওয়ার জন্য কালি ছুড়ে মারে। কিছু প্রাণী তাদের দেহের সূক্ষ্ম গঠন আলোর রশ্মি কে এমনভাবে প্রতিফলিত করে যার দরুন দেহের ঐ জায়গাটি বেশ রঙ বেরঙের হয়ে যায়। যেমন ময়ূরের পালক। ময়ূরের পালকে বাদামি রঞ্জক থাকলেও সেটাকে বেশ রঙ বেরঙ্গের দেখায়। ঠিক এমনই ঘটনা দেখা যায় বিভিন্ন পাখিদের পালকে – সুক্ষ গঠনের জন্য পাখিটি রঙ্গিন হয়ে উঠে। তে দেখা যায় প্রজাপতির ডানাতেও। রঙ্গীন প্রজাপতির ডানায় সুক্ষ সুক্ষ আঁশগুলো বিভিন্ন রঙের বর্ণচ্ছটা ছড়িয়ে রঙের বাহার দেখায়। এইভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদে প্রাণীদের দেহের বর্ণের এক অপরিসীম গুরুত্ব রয়ে গেছে।
তিন
বর্ণান্ধতা বা বর্ণান্ধত্ব বা বর্ণবৈকল্য হলো মানুষের, কতিপয় রঙ দেখার, শনাক্ত করার বা তাদের মধ্যে পার্থক্য করার অক্ষমতাজনিত এক প্রকার শারীরিক বৈকল্য। সাধারণত প্রতি দশজন পুরুষে একজনের এই সমস্যা দেখা যায়। প্রটানোপিয়া, ডিউটারনোপিয়া, প্রোটানোমালি, এবং ডিউটারনোমালিটি সাধারণভাবে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া লাল-সবুজ রঙের বর্ণান্ধত্ব যা জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে প্রভাবিত করে। যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত তাঁদের রেটিনার লাল ও সবুজ রঙের আলোক সংবেদী কোষের(photoreceptor) অনুপস্থিতি বা পরিবর্তনের কারণে লাল সবুজ বর্ণের মধ্যে পৃথকীকরণে সমস্যা থাকে। এটি বংশগত। জন্মসূত্রে লাল-সবুজ রঙের অন্ধত্ব নারীদের তুলনায়, পুরুষকে প্রভাবিত করে অনেক বেশি। কারণ লাল ও সবুজ রং আলোক সংবেদীগুলোর জন্য জিনগুলি এক্স ক্রোমোজোমের মধ্যে উপস্থিত থাকে, যা পুরুষের মাত্র একটি এবং নারীর দুটি থাকে।
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, টিন্টোরেটো, রে চার্লস, ভিনসেন্ট ভ্যান গগ, ভিনসেন্ট মিনেলি, ক্লড মনেট, আলেকজান্ডার ক্যাল্ডার, অ্যান্ডি ওয়ারহল, বিল কসবি, মাইকেলেঞ্জেলো, জর্জিয়া ও’কিফ, জিমি হেন্ডরিক্স, স্টিভেন স্পিলবার্গ, পল সেজান, লিওপোল্ড স্টোকোস্কি, কনস্টেবল, পিকাসো এবং ভ্যান গগের মতো কয়েকজন বিখ্যাত শিল্পীকে বর্ণান্ধ বলে মনে করা হয় তবু তাঁরা সফল শিল্পী ছিলেন। রঙের পার্থক্য করতে না পারা ব্যাপারটা একজন খ্যাতিমান শিল্পী হওয়ার ক্ষমতাকে বাধা দেয় না।বিশ শতকের অভিব্যক্তিবাদী চিত্রশিল্পী ক্লিফটন পুগকে, তিনবার অস্ট্রেলিয়ার আর্চিবল্ড পুরস্কার বিজয়ী, জিন উত্তরাধিকার এবং অন্যান্য ভিত্তিতে প্রোটানোপ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উনিশ শতকের ফরাসি শিল্পী চার্লস মেরিয়ন লাল-সবুজ ঘাটতি ধরা পড়ার পর চিত্রকলার পরিবর্তে এচিংয়ে মনোনিবেশ করে সফল হন। জিন কিমের লাল-সবুজ রঙের অন্ধত্ব তাঁকে প্রথমে অ্যানিমেটর এবং পরে ওয়াল্ট ডিজনি অ্যানিমেশন স্টুডিওর চরিত্র ডিজাইনার হতে বাধা দেয়নি।
ইউরোপের বেশ কয়েকজন কবি-লেখক বর্ণান্ধ ছিলেন । তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য চার্লস ডিকেন্স, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জোসেফ কনরাড, মার্ক টোয়েন, পিটার সেলার্স, টমাস হার্ডি, আলফ্রেড লর্ড টেনিসন, স্টিফেন কিং, এডগার অ্যালান পো, জেমস জয়েস, ভ্লাদিমির নবোকভ প্রমুখ ।
চার
কেতকী কুশারী ডাইসন ও সুশোভন অধিকারীর লেখা ‘রঙের রবীন্দ্রনাথ’ ও শোভন সোমের ‘শিল্পী শিল্প ও সমাজ’ বইদুটিতে কবির আঁকা ছবিতে রঙের ব্যবহারিক বৈশিষ্ট্য দেখে বলা হয়েছে তিনি আংশিক বর্ণান্ধ বা প্রোটানোপ ছিলেন। সবচেয়ে প্রথমে কবির বর্ণান্ধতা নিয়ে আলোকপাত করেছিলেন অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান চিত্রসমালোচিকা স্টেলা ক্রামরিশ, ১৯৬১ সালে। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব মত পাওয়া যায় ছিন্নপত্রাবলীতে ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠিতে। রাণী চন্দ এবং নির্মলকুমারী মহলানবিশের বইতেও এ বিষয়ে সাক্ষ্য লেখা আছে। রবীন্দ্রনাথ আংশিক বর্ণান্ধ ছিলেন, অর্থাৎ ‘কালার ব্লাইন্ড’। রবীন্দ্রনাথের মূল অসুবিধা ছিল লাল রঙটি নিয়ে। তিনি এই রঙ খুব ভাল করে দেখতে পেতেন না। লাল এবং সবুজকে অনেক সময়ই আলাদা করতে পারতেন না। ডাক্তারি শাস্ত্রে এ বিশেষ অবস্থাকে বলে ‘প্রোটানোপ’। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘প্রোটানোপিয়া’য় আক্রান্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এটা একটা বংশগত রোগ। রোগটির কোন চিকিৎসা নেই। এটি এমনি কোন শারীরিক সমস্যা করে না, কেবল এরা লাল রং দেখতে পায় না আর কয়েকটি রঙকে স্বাভাবিকের চেয়ে ঝাপসা দেখে।
রবীন্দ্রনাথের বর্ণান্ধতা বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন আমেরিকান লেখক এবং ইতিহাসবিদ স্টেলা ক্রামরিশ, সেই ১৯৬১ সালে। তিনি রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে প্রকাশিত ‘ড্রইংস এন্ড পেইন্টিংস অব রবীন্দ্রনাথ টেগোর’ এ আলোচনাসূত্রে লিখেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বলতেন তিনি রং কানা, লাল আর সবুজ তিনি একইরকম দেখতেন। তথাপি তার ছবিতে লাল এবং সবুজ পাশাপাশি এসেছে এবং মাত্রা বা ঘনত্ব আলাদা থেকেছে’। তবে স্টেলা ক্রামরিশ সেই ষাটের দশকে উল্লেখ করলেও ব্যাপারটা বহুদিন চিত্রকরদের জানা ছিল না।
কিন্তু কেতকী কুশারী ডাইসন এবং সুশোভন অধিকারী তাদের ‘রঙের রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ে বেশকিছু উদাহরণ হাজির করে দেখিয়েছেন এই রোগের ব্যাপারটা সঠিক হবার সম্ভাবনাই বেশি। তারপরে রবীন্দ্রনাথের এই বর্ণান্ধতা কিছু মানুষের গোচরীভূত হয়। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মের উপর গণ্ডায় গণ্ডায় বই পত্র এবং প্রবন্ধ লেখা হয়েছে বটে, কিন্তু তার বর্ণান্ধতার বিষয়টি এবং তার চিত্রকর্মের উপর এর প্রভাব নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ লেখা আজও পাওয়া যায় নি। কিন্তু ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ । রবীন্দ্রনাথের বর্ণান্ধতা নিঃসন্দেহে তার কাজকে দিয়েছে খানিকটা ভিন্নতা এবং স্বাতন্ত্র্য। ছবি আঁকার যেভাবে তিনি রঙের ব্যবহার করেছেন, দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক থাকলে হয়তো সেভাবে ব্যবহার করতেন না। বহু ছবিতে লাল রঙের পাশে সরাসরি কালো বা কোন গাঢ় অন্ধকার রঙ ব্যবহার করতে তিনি মানসিক দোলাচলের মধ্যে পড়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের বর্ণান্ধতার সরাসরি সাক্ষ্য পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের একজন মানুষ, তাঁর গুণমুগ্ধা নির্মলকুমারী মহলানবিশের দেওয়া একটি তথ্য থেকে। নির্মলকুমারী লিখেছেন– ‘পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল যে উনি রঙকানা ছিলেন। লাল রঙটা চোখে পড়তো না, মানে লাল আর সবুজের বেশী পার্থক্য বুঝতে পারতেন না। কিন্তু কোন জায়গায় নীলের একটু আভাসমাত্র থাকলেও সেটি তার দৃষ্টি এড়াতো না। তিনি বলতেন, আমি তোমার লাল ফুল ভাল দেখতে পাইনে বলে আমাকে ঠাট্টা করো। নীল রঙটা যে পৃথিবীর রঙ, আকাশের শান্তির রঙ, তাই ওটার মধ্যে আমার চোখ ডুবে যায়; আর লাল রঙটা হল রক্তের রঙ, আগুনে রঙ অতএব প্রলয়ের রঙ, মৃত্যুর রঙ – কাজেই বেশী না দেখতে পেলে দোষ কি?’
কেবল নির্মলকুমারী নয়, বিচ্ছিন্নভাবে রোমা রঁল্যা, স্টেলা ক্রামরিশ, জগদীশচন্দ্র, রাণী চন্দ সহ অনেকের ভাষ্যেই রবীন্দ্রনাথের এই বর্ণান্ধতার ব্যাপারটা ধরা পড়ে। যেমন রাণী চন্দ তার ‘আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ’-এর ভূমিকায় লিখেছেন–
‘গুরুদেব প্রায়ই বলতেন তিনি রঙকানা, বিশেষ করে লাল রঙটা নাকি তার চোখেই পড়ে না। অথচ দেখেছি অতি হাল্কা নীল রঙও তার চোখ এড়ায় না।‘
কেবল তৃতীয়পক্ষের জবানবন্দিতে নয়, রবীন্দ্রনাথের সরাসরি ভাষ্যেও তার বর্ণান্ধতার কিছুটা প্রমাণ আমরা পাই। তিনি প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে কিছুটা হলেও যে অবহিত ছিলেন তার উদাহরণ পাওয়া যায় তাঁর লেখা অন্ততঃ চিঠি থেকে। আঠারোশো চুরানব্বই সালে তিনি ইন্দিরা দেবীকে লিখেছিলেন ‘কত রকমেরই যে রঙ চতুর্দ্দিকে ফুটে উঠেছিল সে আমার মতো সুবিখ্যাত রঙকানা লোকের পক্ষে বর্ণনা করা ধৃষ্টতামাত্র‘।
কেবল চিঠিপত্রে নয়, রবীন্দ্র সাহিত্যে চোখ রাখলেও দেখা যাবে, রবীন্দ্রনাথ লালের বদলে বেশির ভাগ সময় ‘রাঙা’ আর সবুজের বদলে ‘শ্যামল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আর নিজের ‘রঙকানা’ দুর্বলতা বিষয়ে সচেতন ছিলেন বলেই হয়তো ছবি আঁকার ব্যাপারে ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ এবং গগনেন্দ্রনাথকে সারা জীবন ধরে উৎসাহ দিলেও নিজে প্রথাগত অঙ্কন শিক্ষায় কোনদিন ঢোকেননি রবীন্দ্রনাথ।
আংশিক বর্ণান্ধতার ব্যাপারে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, আমাদের এই মানব প্রজাতির জনপুঞ্জে পুরুষদের মধ্যে শতকরা ৮ ভাগ লোক রঙ কানা। নৃতত্ত্ববিদ হেলেন ফিশারের বেশ কিছু গবেষনা আছে বর্ণান্ধতার ওপরে। বৈজ্ঞানিকভাবে এ রোগটির নাম ‘এক্সলিঙ্কড রিসেসিভ ডিসঅর্ডার’। যেহেতু এটা এক্সলিঙ্কড ডিসঅর্ডার রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত এই জন্মগত রোগটি মায়ের দিক থেকে পেয়েছিলেন।
যারা রবীন্দ্রনাথের ছবির সঙ্গে পরিচিত তারা অনেকেই জানেন তার ছবিতে গাঢ় রঙের আধিক্য অনেক চোখে পড়ে। এটার কারণও সম্ভবত তার বর্ণান্ধতা। প্রোটানোপদের ছবিতে নাকি এটা দেখা যায়। বিশেষ করে খয়েরি এবং কালো রঙের উগ্র ব্যবহার প্রোটানোপদের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথের বহু ছবিতেই তার হদিস মেলে। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলায় খয়েরির প্রাধান্য অনেক বেশি বলেই দর্শকদের কাছে প্রতীয়মান হয়। লালচে খয়েরি, কালচে খয়েরি, নীলচে খয়েরি, বেগুনি-খয়েরি প্রভৃতির অনেক শেড রবীন্দ্রচিত্রকলাকে আচ্ছন্ন করে আছে, এবং এর প্রধান কারণ রবীন্দ্রনাথের বর্ণান্ধতা।
তাঁর প্রতিভা আমাদের মনে করিয়ে দেয় লাডউইক ভ্যান বিথোফেনকে, যিনি জীবনের দীর্ঘ সময়টুকু কানে খাটো ছিলেন, কিন্তু তিনিই ছিলেন আবার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কম্পোজারদের শিরোমণি। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এত গবেষনা হয়েছে, কয়েক হাজার মানুষ ডক্টরেট করে ফেলেছেন কিন্তু তার বর্ণান্ধতার বিষয়টি এবং তার চিত্রকর্মের উপর এর প্রভাব নিয়ে এখনো কোন গবেষনামূলক বই বাজারে আসে নি। কারন সেজন্যে একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ চিত্রশিল্পী প্রয়োজন। আছেন কি কেউ?
একজন প্রোটানোপিক শিল্পীর কাছ থেকে যা আশা করা যায় তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাঁর চিত্রকর্মে রঙের পরিসর সীমিত। সংগ্রহালয়ে রাখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রঙের বাক্সের প্রায় অর্ধেক বোতল লাল বা সবুজ রঙের, যদিও তিনি খুব কমই লাল-সবুজ বৈপরীত্য ব্যবহার করেছেন।
পাঁচ
রঙের ব্যবহার এবং সংস্কৃতির মধ্যে এবং এমনকি একই সংস্কৃতির মধ্যে বিভিন্ন সময়ের মধ্যে তাদের সংযোগের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈচিত্র্য রয়েছে। একই রঙের যে কোনো সময়ে একই সংস্কৃতির মধ্যে খুব ভিন্ন সম্পর্ক থাকতে পারে। রঙের প্রতীকে বৈচিত্র্য ঘটে কারণ রঙের অর্থ এবং প্রতীক একজন লোকের, সাংস্কৃতিক এবং সর্বজনীন ভিত্তিতে ঘটে। রঙের প্রতীকও প্রসঙ্গ-নির্ভর এবং সময়ের পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত।
বিভিন্ন ধর্মে রঙকে বিশেষ প্রতীক হিসেবে চিহ্ণিত করা হয়েছে । হিন্দুধর্মে, রঙগুলি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং গভীর তাৎপর্য রাখে, বিশুদ্ধরূপে আলংকারিক মান অতিক্রম করে। হিন্দু শিল্পী দেব দেবীর গায়ে বিভিন্ন রং ব্যবহার করে এবং তাঁদের পোশাকের রঙ তাঁদের গুণাবলী নির্দেশ করে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত কিছু প্রধান রঙ হল লাল, হলুদ (হলুদ), পাতা থেকে সবুজ, চালের গুঁড়ো থেকে সাদা ইত্যাদি ।
হিন্দু ধর্মে, লাল রঙের অত্যন্ত তাৎপর্য রয়েছে এবং যে রঙগুলি বিবাহ, সন্তানের জন্ম, উত্সব ইত্যাদির মতো শুভ অনুষ্ঠানের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। অনুষ্ঠান এবং গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের সময় কপালে একটি লাল চিহ্ন দেওয়া হয় । বিবাহের লক্ষণ হিসাবে, মহিলারা চুল বিভাজনে লাল পাউডার লাগান। বিয়ের সময়ও তারা লাল শাড়ি পরেন। লাল পাউডার সাধারণত প্রার্থনার সময় দেবতাদের মূর্তি এবং ফ্যালিক প্রতীকের উপর নিক্ষেপ করা হয়। এটাও শক্তির রং। দানশীল, সাহসী, সুরক্ষাকারী এবং মন্দকে ধ্বংস করার ক্ষমতা এমন দেবতাদের উপরে লাল রঙের পোশাক পরানো হয়। দক্ষিণ ভারতে একজন মহিলার মৃত্যুতে তার মৃতদেহ লাল কাপড়ে মুড়ে দাহ করার প্রথা ছিল । স্মরণাতীত কাল থেকে লাল রং হচ্ছে অগ্নির,প্যাসন বা আবেগ,আসন্ন বিপদ, ধ্বংসের প্রতীক বা চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। রোমানরা যুদ্ধের বা মিলিটারি ক্ষেত্রে লাল পতাকা ব্যবহার করতো, দেহের এন্ডোক্রাইন গ্ল্যান্ডকে জাগাতে বা স্টিমুলেট করতে। এরফলে এড্রিনাল হরমোনের ক্ষরণ বৃদ্ধি পাওয়াতে তারা বাড়তি শক্তি অনুভব করতো। স্পারটারাও ঐ একই কারণে লাল ফ্ল্যাগ ব্যাবহার করতো। গ্রীকদের যুদ্ধের দেবতা মার্স লাল রঙের রথ ব্যাবহার করত। জ্যোতিষ মতে চূনী ব্যাবহার করা হয় লাল রঙের জন্য। খ্রিস্টধর্মে লাল, রক্ত এবং আগুনের রঙ, এবং পেন্টেকস্টের জন্য এবং শহীদ সাধুদের স্মরণে লিটারজিকাল রঙ।
হিন্দুধর্মে হলুদ হল জ্ঞান ও শিক্ষার রং। এটি সুখ, শান্তি, ধ্যান, যোগ্যতা এবং মানসিক বিকাশের প্রতীক। এটি বসন্তের রঙ এবং মনকে সক্রিয় করে। ভগবান বিষ্ণুর পোশাক হলুদ তার জ্ঞানের প্রতিনিধিত্বের প্রতীক। ভগবান কৃষ্ণ এবং গণেশও হলুদ পোশাক পরেন। বসন্ত উৎসবে হলুদ কাপড় পরা হয় এবং হলুদ খাবার খাওয়া হয়। অবিবাহিত মেয়েরা সঙ্গীকে আকৃষ্ট করতে এবং মন্দ আত্মাকে দূরে রাখতে হলুদ পরিধান করে। এই রং বুদ্ধি বা অনুভবের প্রতীক। সেই অর্থে ততটা যুক্তির প্রতীক নয়। হলুদের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকলে একটা বিরক্তিকর ভাব আসে। সেই অর্থে এই রঙের সঙ্গে যুক্ত বিশ্বাসঘাতকতা, দুর্বলতা, প্রতারণা ইত্যাদি। লোকে হয়ত এই কারণে বলে “ইয়লো জার্নালিজম”। আবার চিনে এই রং মহৎ-এর প্রতীক। জ্যোতিষে প্রবাল বা লাল পলা ব্যাবহার হয় হলুদ জ্যোতি পেতে।পলা ব্যাবহার করলে এনিম্যাল ইন্সটিঙ্কট বৃদ্ধি পায়।
হিন্দুদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র রঙ হল জাফরান। এটি আগুনের প্রতিনিধিত্ব করে এবং যেহেতু অমেধ্য আগুনে পুড়ে যায়, এই রঙটি বিশুদ্ধতার প্রতীক। এটি ধর্মীয় বর্জনকেও প্রতিনিধিত্ব করে। এই রঙের অর্থ হিন্দুদের জন্য একটি পবিত্র অর্থ রয়েছে। এটি পবিত্র পুরুষ এবং তপস্বীদের রং যারা পৃথিবী ত্যাগ করেছেন। এক সময়ে এটা রাজপুতদের যুদ্ধের রঙ ছিল । কমলা হচ্ছে তাপ বা হিট-এর প্রতীক, উন্নতির প্রতীক। তাই জ্বর হলে শরীরে মুক্ত ধারন করা থাকলে খুলে রাখতে বলা হয়। কারণ, মুক্ত থেকে কমলা রং বিচ্ছুরণ হয় যা উষ্ণ বা তাপ বর্দ্ধক।
সবুজ রং আশার প্রতীক, নতুন জীবনের প্রতীক ও শক্তি, উর্বরতার এবং বৃদ্ধির প্রতীক। সবুজ শান্তির ও বিশ্রামের রং। এই রং ক্লান্তি হরণ করে আমদের তরতাজা করে। আবার ঘন গাঢ় সবুজ হলো ঈর্ষা, কুসংস্কার ও হিংসার প্রতীক। জ্যোতিষে পান্না ব্যাবহার করা হয় বিচ্ছুরিত সবুজ আলো পাওয়ার জন্য। সবুজ একটি উৎসবের রঙ। মহারাষ্ট্রে, এটি জীবন এবং সুখের প্রতিনিধিত্ব করে। শান্তি ও সুখের প্রতীক, সবুজ মনকে স্থির করে; রঙটি হ্যাঁ থেকে শীতল এবং প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব করে।
সবুজ রঙ ইসলামের বেশ কিছু ঐতিহ্যের সাথেও সম্পর্কিত এবং ইসলামে এর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। দ্বাদশ শতাব্দীতে শিয়া ফাতিমীরা সবুজ রঙকে রাজবংশের প্রতীক হিসাবে বেছে নিয়েছিল। এতে তারা সুন্নি আব্বাসীদের ব্যবহৃত কালো রঙের বিরোধীতা প্রকাশ করে। তাদের পরেও শিয়া আইকনোগ্রাফিতে সবুজ রঙের জনপ্রিয় রয়ে গিয়েছে। তবে সবুজ কেবল শিয়াদের প্রতীক নয়; বরং এটি ইসলামে তাৎপর্যপূণ রঙ। তাই সুন্নি দেশেও এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। যেমন: সৌদি আরব, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পতাকায় সবুজ রঙ আছে। সবুজ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? কেউ কেউ বলেন যে সবুজ ছিল মুহাম্মদের প্রিয় রঙ এবং তিনি সবুজ পোশাক এবং পাগড়ি পরতেন। কোরানে লেখা আছে জান্নাতবাসীরা সূক্ষ্ম রেশমের সবুজ পোশাক পরবে। সবুজ রঙটি ইসলামের সাথে এতটাই দৃঢ়ভাবে জড়িত যে এটি অনেক মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় অস্ত্রে অনুপস্থিত ছিল। ক্রুসেডের সময়, সবুজ ছিল ইসলামিক সৈন্যদের দ্বারা ব্যবহৃত রঙ, তাই খ্রিস্টান সৈন্যরা সাধারণত এটি এড়িয়ে চলত।
খ্রিস্টধর্মে সবুজ উদ্ভিদের জীবন এবং বসন্তের রঙ এবং এইভাবে মৃত্যুর উপর জীবনের বিজয়ের প্রতিনিধিত্ব করে। এটি কিছু সম্প্রদায়ের ট্রিনিটি ঋতুর জন্য লিটারজিকাল রঙ এবং এপিফ্যানির সময়ও ব্যবহৃত হয়।
প্রকৃতিতে আকাশ, সাগর, নদী ও হ্রদ এর রঙ নীল । যে দেবতার সাহসিকতা, পুরুষত্ব, সংকল্প, কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষমতা, স্থির মন এবং চরিত্রের গভীরতার গুণাবলী রয়েছে তাকে নীল রঙের শরীরে উপস্থাপন করা হয়। মনে করা হয় রাম এবং কৃষ্ণ তাদের জীবন মানবতার রক্ষা এবং মন্দকে ধ্বংস করার জন্য ব্যয় করেছিলেন, তাই তাঁদের রঙ নীল।এই রঙ অনুভবের । উচ্চ মনের প্রতীক। আমেরিকার পতাকায় নীল রং আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার প্রতীক। জ্যোতিষে মুন স্টোন বা পোখরাজ বা টোপাজ ব্যাবহার করা হয় নীল আলো পাবার জন্য।
নীল প্রায়শই ইহুদি বিশ্বাসের সাথে যুক্ত কারণ এটি হ্যানুক্কা সজ্জার জন্য ব্যবহৃত রঙ। ইস্রায়েলীয়রা পোশাক, চাদর এবং পর্দা রঙ করার জন্য তেখেলেট নামে একটি নীল রঙের রঞ্জক ব্যবহার করত। তাওরাতে, ইসরায়েলীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে তারা তাদের প্রার্থনার শালের একটি সুতোকে তেখেলেট দিয়ে রঙ করবে যাতে তারা যখন এটি দেখবে তখন তারা স্বর্গ, নীল আকাশ এবং ঈশ্বরের কথা ভাববে। নীল রঙ টেন কমাণ্ডমেন্টসের সাথেও যুক্ত। মোজেস যখন সিনাই পর্বতে উঠেছিলেন, তখন তাঁরা দেখতে পান যে ঈশ্বর একটি নীলকান্তমণির পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন এবং কমাণ্ডমেন্টসগুলো নীলকান্তমণির পাথরে খোদাই করা।
খ্রিস্টধর্মে নীল, আকাশের রঙ স্বর্গ এবং সত্যের প্রতীক এবং এটিকে লেন্ট থেকে আলাদা করার জন্য আবির্ভাবের রঙ হিসাবে অনুগ্রহ লাভ করছে।
পশ্চিমবাংলায় এখন সবকিছুর রং নীলে রাঙিয়ে দেয়া হচ্ছে । বিজেপি রাঙিয়ে দিচ্ছে গেরুয়া রঙে।
বেগুনি বা ময়ূরপঙ্খী রঙ হলো মর্যাদা, আভিজাত্য, রাজকীয় সন্মানের প্রতীক। পারপেল আবার উন্মাদনারও প্রতীক। খ্রিস্টধর্মে বেগুনি, অনুশোচনা এবং শোকের রঙ, আবির্ভাব এবং লেন্টের ঋতুগুলির জন্য ঐতিহ্যবাহী রঙ।
কালো রঙ মানে ডেভিল বা শয়তান–এ তত্ব বিভিন্ন ধর্ম মানে। কালো যা আলো নয়। কালো হলো মৃত্যুর, বিশ্বাসঘাতকতার ও ভয়ের প্রতীক। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে, এটি একটি নেতিবাচক রঙ হিসাবে বিবেচিত হয় এবং সাধারণত মৃত্যু, শোক বা মন্দের প্রতীক কিন্তু বিষণ্ণতারও প্রতীক। লোকেরা প্রায়ই শোকের জন্য কালো পরিধান করে, যদিও এই প্রথাটি অতীতের মতো ব্যাপক নয়।খ্রিস্টধর্মে ব্ল্যাক, যা মৃত্যুর প্রতিনিধিত্ব করে, গুড ফ্রাইডের জন্য লিটারজিকাল রঙ। এটি পাপেরও প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, যার ফলে মৃত্যু হয়।
সাদা রঙ শুদ্ধতার ও পবিত্রতার প্রতীক। সাদা মানেই প্রজ্ঞান। খ্রীষ্টের বা শ্রীকৃষ্ণের প্রভা। সাদা সাতটি ভিন্ন রঙের মিশ্রণ তাই এটি প্রতিটির রঙের প্রতীক। এটি বিশুদ্ধতা, পরিচ্ছন্নতা, শান্তি এবং জ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করে। জ্ঞানের দেবী, সরস্বতীকে সর্বদা একটি সাদা পোষাক পরিহিত, একটি সাদা পদ্মের উপর উপবিষ্ট হিসাবে দেখানো হয়। ব্রাহ্মণ শ্বেতাঙ্গের সাথে যুক্ত। হিন্দু ধর্মীয় নেতারা তাদের আধ্যাত্মিক পুনর্জন্মের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নিজেদের সাদা ছাই দিয়ে ঢেকে দেন। সাদা শোকেরও রং। আগেকার দিনে একজন হিন্দু বিধবা শোকে সাদা পোশাক পরতেন।
বৌদ্ধধর্মে মে মাসের শেষের দিকে, চন্দ্র মাসের পূর্ণিমায়, বৌদ্ধরা ভেশাখা পালন করে – যে দিনটি বুদ্ধের জন্ম ও জ্ঞানার্জনকে চিহ্নিত করে। ধর্মপ্রাণ উপাসকরা প্রার্থনার জন্য সাদা পোশাক পরিধান করে অনুষ্ঠানটিকে সম্মান করে।
খ্রিস্টান ধর্মে সাদা, পবিত্রতা, নির্দোষতা এবং পবিত্রতার প্রতীক, ক্রিসমাস এবং ইস্টারের সময় ব্যবহৃত হয় এবং কখনও কখনও রূপা দ্বারা প্রতিনিধিত্ব করা হয়।
ছয়
কার্ল ইয়ুঙ রঙ সম্পর্কিত মনোবিজ্ঞানের সবচেয়ে বিশিষ্টভাবে যুক্ত। ইয়ুঙ রঙের বৈশিষ্ট্য এবং অর্থের পাশাপাশি সাইকোথেরাপির একটি হাতিয়ার হিসেবে রঙের সম্ভাবনার প্রতি সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন। রঙের প্রতীকবাদের উপর তাঁর লেখাগুলো বিভিন্ন বিষয়ের বিস্তৃত পরিসরে আলোচিত। তার কাজ ঐতিহাসিকভাবে রঙ মনোবিজ্ঞানের আধুনিক ক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছে। রঙের মনোবিজ্ঞান হল মানুষের আচরণের নির্ধারক হিসাবে রঙের অধ্যয়ন। রঙ সেই উপলব্ধিকে প্রভাবিত করে যা স্পষ্ট নয়, যেমন খাবারের স্বাদ। রঙের এমন গুণাবলী রয়েছে যা মানুষের মধ্যে নির্দিষ্ট আবেগের কারণ হতে পারে৷ বয়স, লিঙ্গ এবং সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে রঙ কীভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে৷ যদিও রঙের সম্পর্কগুলি সংস্কৃতির মধ্যে প্রাসঙ্গিকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, তবে লিঙ্গ এবং জাতিভেদে রঙের পছন্দ তুলনামূলকভাবে অভিন্ন বলে মনে করা হয়৷ প্রাচীন মিশরীয়রা থেরাপি হিসাবে আঁকা ঘর বা ক্রিস্টালের মাধ্যমে উজ্জ্বল সূর্যালোক ব্যবহার করে রঙকে “নিরাময়” হিসাবে প্রয়োগ করতো। ১৮১০ সালে, জার্মান কবি জোহান উলফগ্যাং ভন গোয়েটে রঙের তত্ত্ব প্রকাশ করে একটি বই লিখেছিলেন, যা রঙের মনস্তাত্ত্বিক প্রকৃতির উপর তার বিশ্বাস ব্যাখ্যা করে। গোয়েটে তার বইয়ে হলুদ রঙকে “শান্ত” এবং নীলকে “উত্তেজনা এবং বিশ্রাম” এর মিশ্রণ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
রাজনৈতিক রং হল রাজনৈতিক মতাদর্শ, আন্দোলন বা দলের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যবহৃত রঙ । একই মতাদর্শের বিভিন্ন দেশের দল গুলো কখনও কখনও একই রঙ ব্যবহার করে। উদাহরণ হিসেবে লাল রঙটি অনেক দেশে বামপন্থী মতাদর্শের প্রতীক (যার ফলে “রেড আর্মি” এবং “রেড স্কয়ার”-এর মতো পরিভাষা তৈরি হয়), যখন নীল রঙটি প্রায়শই রক্ষণশীলতার জন্য ব্যবহৃত হয়, হলুদ রঙটি সাধারণত উদারবাদের সাথে যুক্ত। এবং ডান-স্বাধীনতাবাদ, এবং সবুজ রাজনীতি মতাদর্শের রাজনৈতিক রঙের নামে নামকরণ করা হয়েছে। একটি প্রদত্ত রঙের রাজনৈতিক মর্মার্থ দেশ থেকে দেশে আলাদা হতে পারে। লাল ঐতিহাসিকভাবে রাজতন্ত্র বা চার্চের সাথে যুক্ত ছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছে, অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশের থেকে আলাদা যে রক্ষণশীলতা, তার রঙ লাল এবং উদারতাবাদ নীলের সাথে যুক্ত।
কালো মূলত নৈরাজ্যবাদী রাজ্নীতির সাথে যুক্ত; কালো হল রঙের অভাব, আর নৈরাজ্যবাদ হল রাষ্ট্রের অভাব। এটি জাতীয় পতাকার বিপরীতে ব্যবহার করা হয়, পরিবর্তে সর্বজনীন নৈরাজ্যবাদের প্রতিনিধিত্ব করে। বর্ণালীর বিপরীত প্রান্তে মতাদর্শের প্রতিনিধিত্ব করতেও কালো ব্যবহার করা হয় যেমন ফ্যাসিবাদ এবং জিহাদিবাদ।হাদিস (ভবিষ্যদ্বাণীমূলক ঐতিহ্য বা প্রতিবেদন) অনুসারে , কালো পতাকাটি ছিল নবী মুহাম্মদের যুদ্ধের পতাকা এবং এটি তাঁর অনেক সঙ্গী যুদ্ধে নিয়ে গিয়েছিলেন। কালো পতাকার ছবি ধর্মীয় বিদ্রোহ এবং যুদ্ধে (অর্থাৎ, জিহাদ) নিযুক্তির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সমসাময়িক ইসলামী আন্দোলনে, কালো পতাকা জিহাদের ধারণা এবং ইসলামী খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবহার করা হয়। ব্ল্যাকবিয়ার্ড এবং ক্যালিকো জ্যাকের মতো জলদস্যুদের কালো পতাকা জলদস্যুতার জনপ্রিয় প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
সাত
পারস্য সাম্রাজ্যে ১৫০১ থেকে ১৭২২ সাল পর্যন্ত ‘সাফাভি’ শাসন ক্ষমতায় ছিল এবং ক্ষমতার সর্বোচ্চ সীমায় তারা অধুনা ইরান, আজারবাইজান, বাহরাইন, আর্মেনিয়া, পূর্ব জর্জিয়া, রাশিয়াসহ উত্তর ককেশাসের কিছু অংশ, ইরাক, কুয়েত এবং আফগানিস্তানের পাশাপাশি তুরস্ক, সিরিয়া, পাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং উজবেকিস্তানের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করেছিল। ১৭৩৬ সালে পতন সত্ত্বেও তারা যে উত্তরাধিকার রেখে গিয়েছিল তা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক দুর্গ হিসাবে ইরানের পুনরুত্থান ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে একটি দক্ষ রাষ্ট্র ও আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, স্থাপত্য উদ্ভাবন এবং সাফাভী শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতায় অবদান রেখেছিল। সাফাভীরা ইরানের পাশাপাশি ককেশাস, আনাতোলিয়া এবং মেসোপটেমিয়ার প্রধান অংশ জুড়ে শিয়া ইসলাম ছড়িয়ে দিয়েছিল যার ছাপ আজও টিকে আছে। ‘বাজ’ শব্দ এই সমস্ত অঞ্চলের ভাষায় স্বাভাবিকভাবে প্রবেশ করেছিল । এই সময়েই উদ্ভব হয় বাজপাখি দিয়ে অন্য পাখি ( ফাকতা ) শিকার করার বিলাসিতা । পারস্যের এই ফুলবাবুরাই প্রকৃতপক্ষে ‘ফাকতাবাজ’ বা রঙবাজ । ক্রমশ এই বিলাসিতা ছড়িয়ে পড়েছে পেট্রোডলারের লাটুবাবু-ছাতুবাবুদের সমাজে।
রং-এর সাথে কারচিহ্ন যুক্ত হলে অনুস্বরের জায়গায় ঙ হয়। যেমন রং, কিন্তু রঙের । উর্দু রেখতা অভিধান অনুযায়ী ‘বাজ’ শব্দটা প্রাচীন ফারসি, ইংরেজি Zএর মতো উচ্চারণ, এই বাজের মানে বাজপাখি, পুনঃপুনঃ, আবার । অন্যান্য ভাষাতেও আছে । প্রাচীন আর্মেনিয় ভাষায়, ‘বাজে’, জর্জিয়ান ভাষায় ‘বাজি’, প্রাচীন সিরীয় ভাষায় ‘বাজা’ আর হিব্রুতে ‘বাজ; । ফারসিতে, যদি ইংরেজি J-এর মতন উচ্চারণ হয় তাহলে তার মানে ট্যাক্স, শুল্ক, সেস, ট্রিবিউট । যদি ‘বা-আজ’ উচ্চারণ হয় তাহলে তার মানে দ্বারা, থেকে । যদি ‘বাআ-জ’ উচ্চারণ হয় তাহলে তার মানে কিছু, কয়েকজন । বাংলায় এসেছে ফারসি বাজ ; আর চতুর, ধূর্ত, দক্ষ, মুনাফাখোরদের বিশেষণরূপে ফন্দিবাজ, ধড়িবাজ, মামলাবাজ, রংবাজ, চালবাজ, ধোকাবাজ, কলমবাজ, ফাটকাবাজ, রেণ্ডিবাজ, মাগিবাজ ইত্যাদি অর্থবাচক প্রত্যয়বিশেষ । বাংলায় বজ্রপাতকেও আমরা বাজ বলি ।
রংবাজ শব্দটা উপমহাদেশের তিনটি রাষ্ট্রেই ব্যবহার হয় । “রংবাজ” পাঞ্জাবি শব্দ হিসেবে লাহোর এবং পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে ব্যবহৃত হয়।পাকিস্তানে “রংবাজ” বা “রঙ্গিন বাজপাখি” সাধারণত এমন কাউকে বলা হয় যাকে সাহসী বলে মনে করা হয়। কিছু লোক এটাকে “যোদ্ধা” বা “চ্যাম্পিয়ন” এর মতো স্নেহের শব্দ হিসাবে ব্যবহার করে। কিছু ক্ষেত্রে, এটা এমন কাউকে বর্ণনা করতেও ব্যবহৃত হয় যিনি তাদের রঙিন ব্যক্তিত্ব বা অনন্য শৈলীর জন্য পরিচিত। এটা লাহোরি পাঞ্জাবির একটি স্ল্যাং শব্দ, এর মানে প্রতারক, জোচ্চোর, মাস্তান, ঠগ ইত্যাদি ।
পাকিস্তানে আর উত্তরভারতে যারা ঘুড়ি ওড়াতে ভালোবাসে তাদের বলা হয় পতঙ্গবাজ, কিন্তু বাংলায় ঘুড়িবাজ শব্দ ব্যবহার হয় না । ফেসবুকে অনেকে প্রোফাইল খুলেছেন ‘রংবাজ রোমিও’ নামে । বাংলা হিন্দুস্তান টাইমসের সংবাদ শিরোনাম : “প্রকাশ্যে এল ‘শেহজাদা’র টিজার, ‘বান্টু’ কার্তিক আরিয়ানের রঙবাজি কেমন লাগল দর্শকদের ।” কলেজ জীবনে ‘রংবাজি’কে মাস্তানি হিসেবেই জানতাম যেটা বোধহয় আজকাল দাদাগিরি হিসেবে ব্যবহৃত। হিতাহিত জ্ঞান বিবর্জিত ব্যক্তি, ছিনতাইকারী, চরিত্রহীন, ভীতিপ্রদর্শন দ্বারা উদ্দেশ্য সিদ্ধকারী, মহিলাদের উত্ত্যক্তকারী, উপদ্রবকারী, মদ্যপ, গুণ্ডা, বদমাশ, মস্তান।মানে ক্রমশ পালটে গিয়ে এখন অসামাজিক লোকেদের বোঝায় ।মাস্তানি (বিশেষ্য) ১ মস্তানের কাজ; ডাকাতি; হত্যা; জুলুম; ছিনতাই; ধর্ষণ; নারীনির্যাতন; উৎপীড়ন দ্বারা বিরক্তি উৎপাদন বা উত্ত্যক্ত করা প্রভৃতি অসামাজিক কার্য।
উত্তর ভারতে রংবাজ মানে এমন একজন লোক যে গিরগিটির মতন রঙ পালটায়, সে অনেক ধূর্ত । তাছাড়া এমন একজন লোককেও বোঝায় যে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য নাটুকেপনা করে । আক্ষরিক অর্থে শব্দটা ‘রঙের বিশেষজ্ঞ’ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু শব্দটি রঙের আক্ষরিক অর্থ বোঝায় না, বরং একটি রূপক , যেমন রংবাজ এমন একজন ব্যক্তি যিনি তার ব্যক্তিত্বের রঙ পরিবর্তন করেন। তাই রংবাজ এক অর্থে ধূর্ত কারো জন্য ব্যবহৃত হয়, কেউ তার মেজাজ, উপায় বা তার সম্পূর্ণ আচরণ পরিবর্তনে বিশেষজ্ঞ। ডাকাত, লুণ্ঠনকারী, দস্যু, দুর্বৃত্ত, বহিরাগত, গুন্ডা, দস্যু, উৎপীড়ক, ধোঁকাবাজ, বদমাশ, , জুয়াড়ি, তোলাবাজ আর অসামাজিক দেখনদারি, হিন্দি ফিল্মের প্রভাবে উৎকট পোশাকে । এই ধরণের চরিত্র নিয়ে দুই বাংলা আর হিন্দিতে ফিল্ম হয়েছে : রংবাজ (১৯৭৩-এর বাংলাদেশী চলচ্চিত্র ) রংবাজ (১৯৯৬-এর ভারতীয় হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্র )।রংবাজ (২০১৩-এর ভারতীয় বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র) ।রংবাজ (২০১৭- – বাংলাদেশী চলচ্চিত্র) । রংবাজ বাদশা ( ২০১৮ বাংলাদেশি চলচিত্র ) । রংবাজি – দ্য লাফাঙ্গা ( ২০২১ বাংলাদেশি চলচিত্র) । এই সমস্ত ফিল্মের নায়কদের দেখলে টের পাওয়া যায় বর্তমানে রংবাজ কাকে বলা হয়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন