নাগাল্যাণ্ডের কবি টেমসুলা আও-এর কবিতা
অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
সেই বুড়ো গল্পকথক
আমি জীবন কাটিয়েছি এই ভেবে
গল্প বলা আমার গর্বের উত্তরাধিকার ।
যেগুলো আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি
আমার দাদুর কাছ থেকে তা হয়ে উঠল
আমার প্রথম ঐশ্বর্য
আর যেগুলো আমি অন্য কথকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি
তা যোগ হল জাতিগত ঐতিহ্যের সঙ্গে ।
যখন আমার সময় এলো আমি গল্প বলতুম
যেন সেগুলো আমার রক্তে বই্ছে
কেননা প্রতিবার বলার ফলে তা আমার
জীবনের তেজকে পুনরুজ্জীবিত করে দিতো
আর প্রতিটি গল্প চাঙ্গা করে তুলতো
আমার জাতিগত পূর্বস্মৃতি।
গল্পগুলো সেই মুহূর্তের কথা বলতো
যখন আমরা ফেটে বেরোলুম
ছয়টা পাথর থেকে আর
কেমন করে প্রথমপিতারা প্রতিষ্ঠা করলেন
আমাদের প্রাচীন গ্রামগুলো আর
প্রকৃতির শক্তিমত্তাকে পুজো করতে লাগলেন ।
যোদ্ধারা আর যারা ছিল বাঘ
গল্পের মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে উঠতেন
যেমন হয়ে উঠতো অন্য প্রাণীরা
যারা একসময়ে আমাদের ভাই ছিল
যতোদিন না আমরা মানুষের ভাষা আবিষ্কার করলুম
আর তাদের বদনাম দিলুম হিংস্র হিসেবে ।
দাদু অবিরাম সতর্ক করতেন
যে গল্পগুলো ভুলে যাওয়া হবে
সবায়ের সর্বনাশ :
আমরা আমাদের ইতিহাস হারিয়ে ফেলবো,
এলাকা, আর নিশ্চিতভাবে
আমাদের অপরিহার্য আত্মপরিচয় ।
তাই আমি গল্প বলতুম
যা ছিল আমার জাতিগত দায়িত্ব
যাতে কমবয়সীদের মনে যোগাতে পারি
আবহমানকালের শিল্প
অস্তিত্বের ইতিহাস আর জরুরি ঐতিহ্য
পরের প্রজন্মে পৌঁছে দেবার জন্য।
কিন্তু এখন আরম্ভ হয়েছে নতুন যুগ ।
বুড়োদের সরিয়ে দেয়া হচ্ছে কপটতার আশ্রয়ে ।
আমার নিজের নাতিরা বাতিল করে দ্যায়
আমাদের গল্পগুলোকে প্রাচীন বকবকানি হিসাবে
অন্ধকার যুগের, ফালতু হয়ে যাওয়া
এই বর্তমানকালে আর জিগ্যেস করে
কেই বা চায় এইসব অসংলগ্ন গল্পগাছা
যখন বই থেকে বেশি জানা যায় ?
আমার নিজেদের লোকেদের প্রত্যাখ্যান
উৎসার নষ্ট করে দিয়েছে
আর গল্পগুলোকে মনে হয় পশ্চাদগমন
এমন গর্তে যেখানে পৌঁছোনো যাবে না
যে মন একসময়ে গল্পে স্পন্দিত ছিল
এখন পর্যবসিত হয়েছে অকল্পনীয় স্হবিরতায় ।
তাই যখন আমার স্মৃতি হারিয়ে যায় আর কথায় গোলমাল হয়
আমি পশুসূলভ এক চাহিদার কাছে পরাস্ত বোধ করি
মনে হয় ছিঁড়ে বের করে আনি চুরিকরা নাড়িভুঁড়ি
সেই আদিম কুকুরটা থেকে
আমার আমার সব গল্প ঢুকিয়ে দিই
তার প্রাচীন অন্ত্রের মূল দলিলে ।
একটি একশিলা-মূর্তির প্রার্থনা
আমি গ্রামের সিংদরোজায় দাঁড়িয়ে থাকি
আমার আগের অবস্হার ইয়ার্কি হিসাবে ।
এক সময়ে আমি গভীর জঙ্গলে দাঁড়িয়ে থাকতুম
গর্বে আর সন্তুষ্ট
আমার টোলপড়া হাসিমুখ প্রেমিকা
দাঁড়িয়ে থাকতো আমার পাশে ।
তারপর একদিন কিছু বাইরের লোক
খোঁচা দিতে-দিতে আর উঁকিঝুঁকি মেরে
এখানের টিলাটায় ছোরা ঢোকালো
আরেক জায়গায় পাথর যাচাই করল ।
হঠাৎ ওদের বুড়ো লোকটা
আমাকে দেখতে পেলো আর চেঁচালো,
‘আহা, এইটাই চাই
এতেই কাজ হবে ।’
অন্যরা আমার প্রেমিকাকে দেখে
মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘কিন্তু এটা নয়
নোংরা ফাটলটা দ্যাখো।’
আমি প্রতিবাদ করলুম আর অনুরোধ করলুম,
‘দয়া করে ওকে ছেড়ে যাবেন না
ওটা গালের টোল
এক বিদ্যুৎ যাবার পথে দিয়ে গেছে।’
কিন্তু তারা আমার অনুরোধকে আমল দিলো না
আর নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করল ।
আমাকে বেদি থেকে উপড়ে তুললো
প্রেমিকার পাশ থেকে কেটে আলাদা করল
বাটালি দিয়ে চাঁছলো আমাকে
অন্যরকম চেহারা দিলো।
ওরা আমাকে গ্রামে টেনে নিওয়ে গেলো
একটা চলনসই ঠেলাগাড়িতে বেঁধে ফেলল
আর পুঁতে দিল পালটে-দেয়া আমায়
তাদের নতুন পাওয়া ট্রফি হিসাবে ।
দলটা যখন গ্রামে পৌঁছোলো
বাচ্চারা হইচই করে বেরিয়ে এলো,
উলু দিল রঙিন-পোশাক মহিলারা
আর মাতাল পুরুষরা নাচতে লাগল
আম,আর নতুন পোঁতা
দুর্দশা ঘিরে ।
এমনকি গ্রামের কুকুররা
দৌড়ে এসে নিজেদের ঠ্যাঙ তুলে ধরল
বাটালি-চাঁছা আমার চেহারায়
তাদের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য
সার্বজনিক গর্বে
আর আমি লজ্জায় দাঁড়িয়ে রইলুম
অন্য কারো খ্যাতির খাতিরে ।
এইভাবেই আমি গ্রামের সিংদরোজায় দাঁড়িয়ে থাকি
আমার পুরোনো অবস্হার ইয়ার্কি হিসেবে।
হে প্রকৃতির শক্তি,
যখন তুমি জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাবে
আর আমার প্রেমিকা জানতে চাইবে
তাকে বোলো
আমি আমার গরিমায় অবতীর্ণ হয়েছি
কিন্তু কখনও, দয়া করে, দয়া করে, বোলো না
আমার অবমাননার কাহিনি ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন