দিবস দগ্ধ যুবা মলয় রায়চৌধুরী : রবীন্দ্র গুহ
প্রথম কথা
আমি তখন ভিলাই ইস্পাত নগরীতে । খোখলা জীবন, একাশ্রিত । সাতটি ব্লাস্ট ফার্নেস নির্মাণের দক্ষযজ্ঞ নিয়ে উপন্যাসের ছক্কাবাজি খেলছি । মাঝে-মাঝেই মনমেজাজ ধাঁধিয়ে উঠত । তখন সস্তায় দারুনারু খেতে চলে যেতাম রায়পুর, বিলাসপুর, রায়গড় । খুব মদটদ খাওয়া হলে, তেমন সঙ্গী-সাথি পেলে, দুধেলা বাছুরের মতন চলে আসতুম কলকাতায় । কলকাতা মহানগরীতে আমার বন্ধু ছিল হাত-ইশারায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মানস রায়চৌধুরী, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ বাগচী, আলোক সরকার, শংকর চট্টোপাধ্যায় । সাতটি ব্লাস্ট ফার্নেসের নির্মাণ বেত্তান্ত : “সূর্যের সাত ঘোড়া”, উপন্যাসের কথা বলতাম ওদের । ওরা পাত্তাই দিত না । এই সময়, একদিন হঠাৎ বিদ্যুতের চিকুর হানার মতো একখানি পোস্টকার্ড এলো...তাতে লেখা…”আপনার উঁচু-করা হাত দেখতে পেয়েছি । কলকাতা এলে জানাবেন ।” মলয় রায়চৌধুরী ।
সেই পোস্টকার্ডের কথা কি তোমার মনে আছে মলয় ? কত বছর হলো ?
তা, বছরের হিসেব নিয়ে হবে কী ? তখনকার অবস্হাটা ভাবো ? কলকাতা কাঁপছিল । তোমাকে নিয়ে কতরকম ষড়যন্ত্র এবং বদ-মতলব । তারা তো তোমারই সহযোদ্ধা ছিল ? বাংলা সাহিত্যে যার যতই দাপট থাক, আসলে তো উচ্চিংড়ে । তুমিই একদিন বলেছিলে, “বাঞ্চোৎ তোমাদের এতো তেল কেন ?” তাহলে আজ এতো সংকোচ কেন ? কারা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী ? বুড্ঢা বাফুন ? হি-ই দাঁত দেখিয়ে দিয়েছিল তারা ? ‘খাটুয়া’ বলেছিল কে ? ওই সুনীল. ওই শরৎ ? শংকর ছিল ? এবং শঙ্খ ঘোষ, এবং তারাপদ এবং অলোকরঞ্জন, অন্য বন্ধু প্রণবিন্দু ? আজ সবাই ভ্যানিশ । থাক, যানে দেও ইয়ে সব চুলবুলাপন বাতেঁ । যা ওদের অনুকূল নয় তা-ই খারাপ । আড়ালে সবাই সবার মস্তিষ্ক ছেদনে ব্যস্ত । আমাকে বলত ‘পাইকারি লেখক’ । কেননা, সব সময় আমার পকেটে গল্পকবিতার পাণ্ডুলিপি থাকত । সুবিমল বসাককে বলত -- “আসলে খোট্টা তো, বাংলা জানে না…!” শব্দের সংকরায়ণ তথা ডায়াসপোরিক সাহিত্য বিষয়ে কোনো ধারণাই ছিল না ওদের । শব্দের ভিতর শব্দ, অর্থের ভিতর নিহিত অর্থ থাকে, এসব আজও কজন জানে ? সবাই এরা ছাপোঢ়া - যে গলিতে জন্ম সেই গলি থেকেই স্কুল কলেজ চাকরি করতে যাওয়া -- তারপর একদিন ‘বলো হরি হরি বল’ বলে ফুসস । বিলাস-বিস্ময়, আচস্তা-দাপট, আঁতাত-হিংস্রতা, বুকময় অবিরাম সাঁ-সাঁ ধুনন --- এসব জানতে বুঝতে হলে নিজেকে দহন পীড়ন করতে হয় । নতুবা ‘ঘুণপোকা’, ‘যাও পাখি’, ‘কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট, ‘হলদে গোলাপ’ পুনঃ পুনঃ ভূমিষ্ঠ হয় । হবে । ওই যেমন চলে রাধার নাচ কৃষ্ণের বাঁশি । ‘নখদন্ত’, ‘শিকঞ্জের পাখি খামোশ’ কোথায় ? নতিন ‘হাংরি আন্দোলনের ব্যাকরণ, গণিত, মেধা-তরতানা -- কী মনে হয় ওরা ব্যারেরেলের ওপর থেকে প্রজাপতিটি উড়িয়ে দিতে পারবে ?
তোমার একটা কথা খুব মনে পড়ে, ‘সাহিত্যের আন্দোলন সাহিত্যেরই জন্য । তা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মরালিটি, দর্শন বা বিজ্ঞানের আন্দোলন নয়।’
হ্যাঁ, সেই শুরুর কথায় ফিরে যাওয়া যাক । কলকাতা এলাম । তুমি এসে আমার রাসবিহারী অ্যাভেনিউয়ের বাড়িতে, সঙ্গে ফালগুনী রায় -- এখনকার হাংরি আন্দোলনের ছেলেদের বয়সী বয়স । ওর দাদা তুষার রা্য়কে জানতুম । শ্যামবাজারের ঠেকে আসত । তোমরা ঘরে বসতে চাইলে না । বললে, “চলুন, ট্র্যাঙ্গুলার পার্কে গিয়ে বসি”। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা পেরোলেই ট্র্যাঙ্গুলার পার্ক । বাঁয়ে তাকালে বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা ভবন’ । ডাইনে সুতৃপ্তি রেস্তরাঁ । ঝাঁক-উচ্চিংড়ে কবিদের ভিড় । যাদের নাম শুনলেই তুমি থুতু ছেটাতে, বলতে ‘ছকের খেলুড়ে’ । যেমন পবিত্র মুখোপাধ্যায়, শংকর দে, রত্নেশ্বর হাজরা, কালীকৃষ্ণ গুহ । হাফলিটারেট বর্ণের ।
আমি বলতাম, এখনও বলি -- “মসীহস্তী” । উৎপল, শৈলেশ্র, সুবো, ফালগুনী, প্রদীপ তো কথাই বলত না । অলোক, অসিত মুখে কুলুপ এঁটে থাকত । আর এক ডেপুটি অলোকরঞ্জন তোমাকে দেখলেই হাসত আর হাসত -- “বাব বা, কী শান্তশিষ্টটিই না হয়ে গেছেন ।”
লেখালিখির জীবনটা তো কম বড়ো নয় । কতো খেলুড়ে, সীহস্তী, মাথা-উঁচু দোগলা লেখকের সঙ্গে মুলাকাত হল, শৌর্যবীর্যের ভয়ঙ্কর ক্ষিপ্ত বাতুলতা দেখলুম, কাউকে কি ঠিক ঠিক চিনতে পারতুম ? নাকি জানতে পারতুম ‘গাঙশালিক কাব্যস্কুলের’ সঠিক গয়রহ কী ! বাবু বুদ্ধদেবের রাসবিহারী অ্যাভেনিউর কবিতা ভবন কী ?
তাঁর কবিতা-জলসায় বনেদি অশ্লীল শিষ্টতা, ক্রোধ-আকাঙ্খা, আনন্দসুখ, উতলনির্জনতা কী ? দ্যাখো মলয়, এ প্রশ্ন আমার একার নয় । সমস্ত পোস্টমডার্ন ব্রুহাহা কবিদের । নতুন প্রজন্মের হাংরি কবিদের । বাংলা, বৃহৎবাংলা কবিতাপ্রেমীদের । কবিতা ভবনে তুমি তো গিয়েছিলে হাংরি ইশতাহার দিতে ? বুদ্ধবাবু ইশতাহারে চোখ বুলিয়ে ‘হুম’ শব্দ করে ছবি বিশ্বাসের স্টাইলে দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন মুখের ওপর । একইভাবে তোমাকে অপমানিত হতে হয়েছে অচিন্ত্য সেনগুপ্ত ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের বাড়িতে গিয়েও…? অনেকেই প্রশ্ন করেছিলেন, আন্দোলনের অর্থ কোথা থেকে আসছে ? আন্দোলনে যুবতীদের সংখ্যা কতোজন ? পদে-পদে আরও কতোরকম হেনস্হা সইতে হয়েছে ? নেতা-মন্ত্রীরা, অধ্যাপকরা অনবরত ভয় দেখাত, হুমকি দিত । এমনই তো দেখেছি ।
(চলবে )
দিবস দগ্ধ যুবা মলয় রায়চৌধুরী : রবীন্দ্র গুহ
দ্বিতীয় কথা
একথা মানতেই হবে তোমার লেখায় হাংরি এবং পোস্টমডার্ন চেতনার চিন্তাগুলি শুরু থেকেই বর্তমান । তুমিই তো শিখিয়েছ প্রান্তিক প্রাণময়তার কথা -- জ্ঞানের সমীকরণ -- হঠাৎ-হঠাৎ বিষয়ান্তরে চলে যাওয়া -- স্বপ্ন-দিবাস্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন কিছুই নয় -- আধুনিকতার বাবুয়ানি তোমার পছন্দ নয় -- চৈতন্যের ক্রন্দনকে বোঝা ও আত্মস্হ করা । পুরোনো কথায় ফেরা যাক । হ্যাঁ, সেই সময়ের কথা যখন লিটল ম্যাগাজিনের জগতে শতভিষা, কৃত্তিবাস, ময়ূখ, একক, ধ্রুপদি, শুকসারী, স্বরাপুর, স্বকাল, রবিপত্র, নতুন সাহিত্যিক ।
আমি, সমীর রায়চৌধুরী ও সুবিমল বসাক কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে হাংরির সেই সংখ্যাটি দিতে যাতে ছিল তোমার ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ । পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে দারুন আলোড়ন । পুলিশ অনেক দিন থেকেই ফাঁদ পঢেতে ছিল । কয়েক কপি সংগ্রহ করে দৌড়োল লালবাজার থানায় জমা দিতে । শুরু হল ধরপাকড় । লাথানি । হেনস্হা । অনেকেই কলকাতা থেকে পালাল । কেউ কেউ মুচলেকা দিয়ে ‘আজকাল’ এবং ‘আনন্দবাজারের’ তু-তু চাকর হয়ে গেল । যুদ্ধের ময়দানে দ্রোহপুরুষ মাত্র তুমি । অত হুজ্জোতের মধ্যেও আমি শুধিয়েছিলাম --- ‘কেমন লাগছে ?’
তুমি উল্লাস করে হেসেছিলে । বলেছিলে -- “এভারেস্টের চুড়োয় একটি মাত্র সিংহাসন, আমি মলয় রায়চৌধুরী, সেখানে বসে আছি ।”
বাকিটা ইতিহাস । জেরা, আইন-আদালত, জরিমানা, হাজতবাস । কবিতা লিখে হাজতবাস ?
দিবস দগ্ধ যুবা মলয় রায়চৌধুরী : রবীন্দ্র গুহ
তৃতীয় কথা
তোমার হুংকার শোনা গেল । হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বন্ধুরা সবাই মুক্ত । তুমি জরিমানা দিতে রাজি হলে না । রিভিশন পিটিশন করলে হাইকোর্টে । হাইকোর্টের উকিলদের তখন হাজার টাকা ফিস । আর্থিক অসুবিধে থাকলেও মানসিক জোর ছিল । জয় হলো তোমার । কিন্তু সাহিত্য থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিলে । এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন । মহাপ্রস্হানের পর হঠাৎই আগমন, আমাকে উৎসর্গ করলে “পোস্টমডার্ন কালখণ্ড ও বাঙালির পতন”, গ্রন্হটি পাঠালে । কবিতা সংকলন বেরোলো । তুলো ধোনার জন্য পাঠালে । আমি তখন ‘নিম সাহিত্য’ আন্দোলন করছি । তুমি জানালে “আত্মধ্বংসের সহস্রাব্দ” নামে আরেকটি কবিতা সংকলন বেরোবে ; আমাকে ভূমিকা লিখে দিতে হবে । খুব খুশির খবর । লেখা হলো ভূমিকা । একটি গ্রাফিত্তি প্রকাশন ।
দুটি গ্রন্হই নতুন করে হৈ-চৈ ফেলে দিল । পর পর আরও একাধিক গ্রন্হ প্রকাশিত হল । তুমি অকাদেমি পেলে, রিফিউজ করলে । কেন ? এসব কথা জানার আগ্রহ যেমন তোমার ভক্তদের আছে, শত্রুদেরও আছে -- কেউ কেউ মনে করেন এই দুটি ঘটনার সঙ্গে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর যোগাযোগ আছে । তাই কি ? কথার কথা হয়তো, তবু কথা তো, অজানা কথা -- আন্তর্জাতিক সাহিত্যের ঈশানখুঁটি মলয় রায়চৌধুরীর যাপনচিত্র । যার প্রাণনাশ সম্ভব কিন্তু যাকে পরাস্ত বা উচ্ছেদ করা অসম্ভব । এই দ্রোহপুরুষকে জানতে হবে তো -- তার ক্ষোভ, অভিমান, বিরক্তি, ব্যথা । তার প্রাইমারি কনসার্ন কি ? কবিতা ? উপন্যাস ? গল্প ? অর্থনীতি ? তুমি সরাসরি জানিয়ে দিলে । “আমার প্রাইমারি কনসার্ন কবিতা । কবিতার মাধ্যমেই আমি আমাকে জানাতে চাই। সুচক্রে ঢুকে অনেক কিছু পাওয়া যায় -- নাম, যশ, পদ্মশ্রী, নারী । কবিতা আসে না ।” কবিতা আত্মার কাঠামো ভাঙায় সফলতা পায় -- তথা প্রত্যাখ্যানে নৈরাশ্য, যৌনতাড়নায়, কান্নায়, সৌন্দর্যের বিরুদ্ধাচারণে ।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : লোভী, স্বার্থপর, ভীরু, চামচাটা, থুতুচাটা ( সুনীলের চিঠি সন্দীপনকে । সন্দীপনের চিঠি সমীরকে ) শুরুতেই “হুজুর” বলে মুচলেকা দিয়ে কুমড়োভুঁড়ি থলথলে একটা লোকের খাস আদমি হয়ে গেল । নাম গাংলিবাবু । আদালতের পেশকার । সর্বদা ঘর্মাক্ত, মুখে বদগন্ধ । শক্তিকে শপথবাক্য পড়িয়ে খাঁচায় তুললেন । তোমার মনে আছে মলয়, শক্তির উক্ত কথন শুনে সমীরদা ( সমীর রায়চৌধুরী ) মূর্ছিতপ্রায় । বললেন --”এ কী করলি শক্তি, চাইবাসায় আমার ঘাড়ে বসে দু-বছর ঘাণ্ডেপিণ্ডে খেলি, মদ্যপান করলি, আমার শালির সঙ্গে প্রেম করলি, আর আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলি ? আনন্দবাজারে মোটা চাকরি পেয়েছিস !”
“আজকাল বন্ধুত্বের চেয়ে খ্যাতি জরুরি” । বলেছিলেন সুবিমল বসাক ।
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডাক পড়ল । ল্যালপ্যাকে চেহারা । কিন ্তু কথা বলছিল ফটর ফটর । এক বর্ণও তোমার সপক্ষে গেল না । দেবী রায়, মধ্যবিত্ত সৎ মানুষ, চটে আগুন -- “শালা কী ঘোড়েল । বুলেটিনে লেখা ছাপানোর জন্য ক্যাতরামো করত, আর আজসব উল্টো বলছে।” আরও বলেছিল, “বুলেটিনের প্ল্যানিঙে প্রতিবার মিটিঙে অংশ নিত, আর এখন সাজছেন চড়কপূজার ফ্রিল্যান্স !”
দিবস দগ্ধ যুবা মলয় রায়চৌধুরী : রবীন্দ্র গুহ
চতুর্থ কথা
বুদ্ধদেব বসুর জামাই রাজা মীনাক্ষীর স্বামী জ্যোতির্ময় দত্ত । দেখেছি তোমাকে খুবই খাতির করত । লাল শালু মোড়া বইতে হাত রেখে সবটাই কনফিউজ করে দিল । পরে আবার হাইকোর্টের ব্যারিস্টারও খুঁজে দিল । কী চরিত্র ! পাশাপাশি তরুণ সান্যাল, অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, আলো মিত্র, ত্রিদিব মিত্রকে দ্যাখো । সুনীল গাঙ্গুলির অ্যাটিচুড পুরোপুরি আলাদা । আমেরিকা থেকে তোমাকে লেখা চিঠিটা রুখাতিখা ছিল । কিন্তু সাক্ষ্য দিতে এলো ভিন্ন রূপে । চিঠিটা ছিল এই রকম : “মলয়, তুমি কলকাতায় কী সব কাণ্ড করছ ? ...কলকাতা শহরটা আমার । আমি ওখানে গিয়ে রাজত্ব করব তোমাকে ভয় করতুম যদি তোমার মধ্যে একটুও জেল্লা দেখতে পেতুম ।” সুনীল আরও লিখেছিল, “চালিয়ে যাও ওসব আন্দোলন কিংবা জেনারেশনের ভণ্ডামি ।” মলয়, তুমি কি চিঠিটা পড়ে গোসা করেছিলে ? বড় কথা নয় । ( তোমার চিঠিটা ‘সুনীলকে লেখা চিঠি’ বইতে নেই কেন ? ) আমার প্রশ্ন ? কী ধরণের জেল্লা দেখতে চেয়েছিল সুনীল ? ‘সেই সময়ের’ জেল্লা ? ‘পুরবপচ্ছিম’-এর জেল্লা ? ‘কাকাবাবুর’ জেল্লা ?
ধ্যুস, মুখের জেল্লা আর সাহিত্যের জুলুস/ঔজ্বল্য এক জিনিস কি ? সুনীল কবিতাকে কমার্শিয়াল করতে চায়নি, কিন্তু বড়োবাজার পাওয়ার জন্য ঘন-ঘন অদলবদল করেছে ।ফলে জেল্লা দেখা দিয়েছে তার কবিতায় । এরকম একটি অধৈর্য শব্দ ব্যবহার কি সুনীলের ইচ্ছাকৃত ? দুজনেই তখন সম্ভাবনাপূর্ণ কবি । শুধু মলয় রায়চৌধুরীর ওপর অসন্তোষের কারণ কি ? উৎপলকুমার বসুও তো ছিল । সন্দীপন অধার্মিক ধড়িবাজ । সুনীল কাম্য বস্তুটি লাভের জন্য অত্যাসক্ত, যারপরনাই বদ্ধপরিকর । আমার ধারণা কি স্ববিরোধী মলয় ?
সন্দীপন অধার্মিক একারণে যে সে শত প্রতিশত দোহাতি । তোমাকে এই সময়ে সন্দীপন লিখেছিল মনে আছে : “মলয় কিছু একটা করো ; কৃত্তিবাস আমার দরোজা বন্ধ করে দিয়েছে ।” সুনীল কেন ক্ষুব্ধ হয়েছিল ? অধার্মিকতার জন্য ?
অনেক ভেবেচিন্তে আদালতে তোমার পক্ষে বয়ান দিয়েছে সুনীল । কবিতাটি যে কোনোমতেই অশ্লীল নয় -- সে কথা জোরালো কন্ঠে বলেছে । পরে সমীর রায়চৌধুরীকে লেখা চিঠিতে এও বলেছে, “এর কারণ, আমার কোনো মহত্ব নয় ।” একই চিঠিতে অশ্লীলতা, “অশ্লীলতা বলে আমি কিছু মানি না ।” দোসরা অক্টোবর সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষ মুচলেকা দিয়েছিল ‘হাংরি আন্দোলনের দর্শনে ওরা বিশ্বাস করে না । সুবিমল খুব হতাশ হয়েছিল । এই বাঁকবদলের পিছনে কার ইশারা ছিল ? এই প্রজন্ম এসব কথা জানতে চায় । ওরা কি বাস্তবিক সমকামী ছিল? আদালতে কতোরকম চমকপ্রদ ঘটনা । কতি বিচিত্র মানুষ । বাবু কালীকিঙ্কর, উকিল সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায় । আর সেই গির্জার পাদ্রিটি ? করুণার নিগ্রো প্রেমিকা ? হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সমকামীতার তথা যৌনতার বদনাম কে বা কারা রটিয়েছিল ? কেন ?
কাঠমাণ্ডুতে ঠমেল পাড়ায় প্রতিদিন একটাকা ভাড়ায় মাটির ঘর --পাশে শেয়ে থাকা মার্কিনী, জাপানি তরুণ-তরুণী -- গে লেসবিয়ান, হেট্রো । আর হ্যাঁ, খাগড়ায় মশারির চালে ফণা তোলা সেই গোখরো সাপটা ? মশারির ভেতরে তুমি আর সুবিমল বসাক । আরে বাপস । শরদ দেওড়ার গদির কথা বাদ চলে গেল যে । কি একটা হিন্দি পত্রিকার সম্পাদক ছিল না ? জ্ঞানোদয় ? শরদের পত্রিকার অফিস ঘরটাকে তুমি বলতে গদি । সন্ধ্যার পর সেখানে নানারকম পানাহার ও কবিতার আসর বসত । একবার কৃত্তিবাস-খ্যাত কবি দীপক মজুমদারপাঁচমারির ঘুঙুর পায়ে সেই আসরে নেচেছিল । বাংলা সাহিত্যে এতো গাদাগাদি ভিড় যে দীপকের দাঁড়াবার জায়গাটুকুও নেই । হায় বঙ্গের কবি, তুমি ক্যালেণ্ডার হয়ে থাকো । তুমি তো জানোই, এইরকম ক্যালেন্ডার হয়ে রইল আনন্দ বাগচি, বাবু বরেন গাঙ্গুলি, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, ফালগুনী রায়, উদয়ন ঘোষ ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন