মলয় রায়চৌধুরীর গল্প : উংলি
--ব্যাস ! দুমিনিটেই রোগি পরীক্ষা হয়ে গেল ?
--হ্যাঁ, উনি তো তবু নুনু আর পোঁদ ভালো করে দেখলেন, আগের ডাক্তার নিতিন ধাবালিয়া তো কিছুই এগজামিন করেনি ; ঘসঘস করে প্রেসক্রিপশান লিখে বলে দিল পেচ্ছাপের ফ্লো-চার্ট আনতে, রক্তের পিএসএ রিপোর্ট আনতে , আর ক্যানসারাস গ্রোথ হয়েছে কিনা জানার জন্য ডক্টর সুমন্ত ব্যানার্জির ক্লিনিকে গিয়ে একটা টেস্ট করিয়ে আনতে । ডক্টর ব্যানার্জি বললেন, নিডলটা আপনার অ্যানাসের ভেতর থেকে এলিমেন্ট আনার সময়ে ব্লিডিং হতে পারে, মেডিকাল ইনশিওরেন্স করিয়ে তারপর আসুন । তুমি তো জানোই, তোমার সামনেই তো ডক্টর ব্যানার্জি উপদেশ দিয়ে সাতশো টাকা ফিস নিয়ে নিলেন । ডোনেশান দিয়ে ডাক্তারি পড়েছে যত চুতিয়ার দল, এখন টাকাগুলো রিকভার করে চলেছে ।
--আস্তে বলো, শুনতে পাবে অন্য পেশেন্টরা ।
--শুনতে পেলে ওদের ভালোই লাগবে, মনে-মনে ওরাও এইসব কথাই আউড়ে চলেছে । মধ্যবিত্ত কুন্ঠায় মুখে আনতে পারে না, এই যা ।
--সেসব তো ঠিক আছে । ইনি কী করলেন ? দুঘণ্টা অপেক্ষা করে, তারপর নম্বর এলো, ব্যাস দুমিনিটে পরীক্ষা হয়ে গেল ! মহিলা ইউরোলজিস্ট তো এর আগে দেখিনি বাবা । মহিলাকে দেখাবার জন্যে বুড়োদের লাইন লেগে গেছে । বসার জায়গাও নেই ।
--নন্দিনী দেবরায়ের ভালো পশার ; ঠকান না, তাই রোগিদের লাইন ।
--ভালো হলেই ভালো । কী করে চেক করলেন, পর্দা টেনে দিলেন বলে দেখতে পেলুম না ।
--উনি সার্জিকাল গ্লোভস পরে তর্জনীতে কী একটা মলম লাগিয়ে পোঁদের মধ্যে ঢুকিয়ে ফিল নেবার জন্য আঙুলটা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখলেন, এমন ঘোরাচ্ছিলেন যে আরেকটু হলেই পেচ্ছাপ করে ফেলতুম । তারপর চিৎ হতে বলে নুনু বিচি উল্টেপাল্টে দেখলেন, তলপেট টেপাটিপি করলেন ; বললেন, ওকে, উঠে বসুন। আন্ডারউইয়ার দেখে বললেন, এটা তো রাজনৈতিক দলের পতাকা বলে মনে হচ্ছে ।
--শশশ, শুনতে পাবে লোকে । রাজনৈতিক দলের পতাকা আবার কোথায়, তোমার জামাই-ই তো এনে দিয়েছিল দুবাই বেড়াতে গিয়ে, রাজনৈতিক দলের পতাকার সঙ্গে রঙের মিল আছে, সে যাহোক ।
--আরে, শুনবে তো কী হয়েছে ? সবকটা বুড়োর পোঁদেই আঙুল করবেন আর তাদের নুনু-বিচি উল্টেপাল্টে দেখবেন । অনেকে তো বোধহয় সেকেন্ড টাইম এসেছে, দেখছ না প্লাসটিকের প্যাকেটে রিপোর্ট-টিপোর্ট নিয়ে বসে-বসে গোমড়ামুখে হাই তুলছে ।
--তোমাদের বুড়োদের অমন ছুঁড়ি ডাক্তার না হলে রোগ সারে না । তাও যেচে হাগার জায়গায় আঙুল করতে দেয়া । কী যে রোগ ধরিয়েছ । ডাক্তারগুলোও ভাবছে বুড়োগুলোর কাছে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা গচ্ছিত রয়েছে, তা থেকে দুয়ে নিই ।
--ছুঁড়ি আবার কোথায় । পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ বয়স হবে । চেহারা মেইনটেইন করছেন, বাড়িতে হয়তো জিম-টিম আছে ওনাদের ।
--কত ফিস নিল জানো ?
--কত ?
--এক হাজার টাকা ।
--এক হাজার ? বাপরে, আমাকে তো মিস্টার ঘোষ বলেছিলেন পাঁচশো টাকা ফিস ।
--পাঁচশো টাকা রিপিট ভিজিটের জন্য । রিসেপশানিস্ট বলল, রিপোর্ট দেখাবার সময়ে ফিস দিতে হবে না।
--যেচে পোঁদে আঙুল করাবার জন্য একহাজার টাকা !
--যেমন রোগ বাধিয়েছ । আচ্ছা, তোমাদের অঙ্গটা তো সামনে, তা পোঁদে আঙুল ঢোকাবার কী দরকার?
--পোঁদে আঙুল দিয়ে গ্ল্যাণ্ডটা টের পাওয়া যায় । গ্ল্যাণ্ডটা পেছনে ।
--আপাতত ওষুধ দিলে ভালো হতো । মিসেস বটব্যালের হাজবেন্ডকে প্রথমবার দেখেই ওষুধ চালু করে দিয়েছিলেন ।
--মিস্টার বটব্যালের গ্ল্যাণ্ড বড় হয়ে গেছে, নেগলেক্ট করেছেন, ডাক্তার পোঁদে আঙুল করবে এই দুশ্চিন্তায় লজ্জাও পেতেন । যাক, ইনি অন্তত পেচ্ছাপের ফ্লোচার্ট আনতে বলেননি, ক্যানসারের ভয়ও দেখাননি । বললেন যে আঙুল দিয়ে যা ফিল করতে পারলেন মনে হচ্ছে এখনও দশ আউন্সের মতন আছে, চল্লিশ আউন্সের মতন হলে তারপরে ওসব ফ্লোচার্ট এটসেটরার কথা ভাবা যাবে ।
--রিসেপশানিস্টকে জিগ্যেস করেছিলুম ফ্লোচার্টের ব্যাপারটা । এখানেও হয়, ওই দিকে, যেদিকে আইভিএফ সেন্টার । চারপাঁচ লিটার জল খেয়ে যখন পেচ্ছাপ পাবে তখন একটা ফানেলের ভেতরে পেচ্ছাপ করলে তা ইমিডিয়েটলি কমপিউটারাইজ হয়ে ঢেউয়ের একটা প্রিন্টআউট তৈরি করে দ্যায় ; যারা সুস্হ তাদের ঢেউটা পাহাড়ের মতন হয়, চূড়ায় উঠে গিয়ে নেমে যায় । যারা অসুস্হ তাদের একগাদা ছোটোছোটো ঢিবি গড়ে ওঠে কিংবা সমতলভূমি আর একটাআধটা ঢিবি আঁকা হয়ে যায়।
--আমার ওসব প্রবলেম নেই; যথেষ্ট ফ্লো আছে । কেবল এয়ার ট্র্যাভেল করলে ফ্লোটা ডিস্টার্ব হয়ে যায় । বলেছি ডাক্তারকে । উনি বললেন, এয়ারট্র্যাভেল করার সময়ে কমোডে বসে করবেন, বাড়িতেও দাঁড়িয়ে করা অ্যাভয়েড করুন ।
--তো ওষুধ দিলেন না যে ।
--বললেন, একটা সোনোগ্রাফি করিয়ে কুড়ি দিন পর আসুন ।
--পুরুষদেরও সোনোগ্রাফি হয় নাকি ?
--বললেন তো হয়, লিখে দিয়েছেন, ওনাদের এই ক্লিনিকেই হবে । পাশের ডিপার্টমেন্টে গিয়ে ডেট আর টাইম নিয়ে নিতে বলেছেন ।
--মেয়েরা পোয়াতি হলে তখন সোনোগ্রাফি করে । পুরুষদের আবার কী দেখবার আছে ?
--ব্লাডার, ব্লাডার । তিন লিটার জল খেয়ে সোনোগ্রাফি, ঠিক তারপরেই পেচ্ছাপ করে সোনোগ্রাফি, যাতে বোঝা যায় যে ব্লাডারে কতটা পেচ্ছাপ থেকে যাচ্ছে ।
--নন্দিনী দেবরায় ইউরোলজিস্ট, ওনার স্বামী অশেষ দেবরায় আইভিএফ বিশেষজ্ঞ, ছেলে আর ছেলের বউ গায়নাক, কতটাকা যে প্রতিদিন রোজগার করে ।
--পুরো পরিবারটা মানুষের যৌনাঙ্গসেনট্রিক ।
--এত বড়ো হাসপাতাল খুলে ফেলেছে ।
--প্রসংশা করতে হয় ওনাদের বাবা-মার । বাঙালিদের যৌনাঙ্গ যে সমাজে ক্রমশ রুগ্ন অথচ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে তা ছেলেমেয়েদের ডাক্তারি পড়াবার সময়েই আঁচ করে ফেলেছিলেন; ভবিষ্যৎদ্রষ্টা বলতে হবে । অত প্রেমের কোবতে লিখলে আর প্রেমের গান ভাঁজলে অঙ্গটা রুগ্ন হবেই, তা প্রেমিকের হোক বা প্রেমিকার হোক ।
--ওইদিকটায় গিয়েছিলুম, যেদিকে আইভিএফ বিভাগ । রিসেপশানিস্ট মেয়েটাকে চিনতে পারলুম, আমরা যখন বাগবাজারে থাকতুম তখন আমাদের ওপরের ফ্ল্যাটে থাকতেন দত্তগুপ্ত পরিবার, তাদেরই ছোটো মেয়ে অনিন্দিতা, ডাকনাম অনু। প্রতিবার আইভিএফ করতে কত টাকা লাগে জানো ? চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে।
--কত ?
--আড়াই লাখ টাকা মিনিমাম । তাও প্রথমবারেই যে সফল হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই ।
--এসব আমাদের সময়ে থাকলে তুমি প্রতিবার ওভাম বেচে পঞ্চাশ হাজার রোজগার করতে পারতে ।
--ছিঃ, অন্য কার স্পার্মের সঙ্গে মেশাতো । ভাবলেও ঘেন্না করে ।
--তাতে কি ! আমিও স্পার্ম বেচতুম । কারোর ওভামের সঙ্গে মেশাতো ।
--আমার ওভামের কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে । আর তোমার দুর্বল স্পার্ম আর নেবে না ওরা ।
--হ্যাঁ, ডাক্তার নন্দিনী দেবরায় জানতে চাইছিলেন যে এখনও সেক্স লাইফে অ্যাকটিভ আছি কিনা ।
--তুমি কি বললে ?
--বললুম যে না, আর মগজ কাজ করে না । সবই তো মগজের ব্যাপার । তা উনি বললেন, ভালো, ওষুধ চালু করে দেবার পর স্পার্ম তো যেমন তৈরি হয় তেমন তৈরি হতে থাকবে, কিন্তু তার জেট-ফাংশানের জন্য যে ফ্লুইড দরকার তা ব্লক হয়ে যাবে, কেননা গ্ল্যাণ্ডটার কাজ রেসট্রিক্ট করে দেবে ওষুধটা ।
--সেরে গেলেই ভালো, অন্তত আর যাতে গ্রোথ না হয় । সবাই এমন ক্যানসারের ভয় দেখাল ।
--অনেকে লজ্জায় দেখায় না আর শেষে ক্যানসারে আক্রান্ত হয় । কী আর এমন, না হয় পোঁদে আঙুল করবে। সারা জীবন তো প্রতীকিভাবে কতজন যে কত কাজে বাগড়া দিয়ে আঙুল করেছে তার ইয়ত্তা নেই , এখনও করে চলেছে।
২.
সোমেন দত্ত সমস্যাটা টের পেয়েছিলেন ফ্রাংকফার্ট থেকে ফেরার পথে, ফ্লাইটে, পেচ্ছাপ পাওয়া সত্ত্বেও, কয়েকবার টয়লেটে গিয়েও পেচ্ছাপ হল না । ক্রিউরা সন্দেহের চোখে দেখছিল ওনার টয়লেট যাওয়া-আসা ; হয়তো দাড়ি আছে বলে সন্ত্রাসবাদী ভেবে বসে আছে ।
অমন বারবার টয়লেটে যাচ্ছেন দেখে জনৈকা এয়ারহোস্টেস জানতে চাইলেন যে কোনো কিছু কি ভুলে গেছেন । সোমেন দত্ত সরাসরিই বললেন যে না, হারায়নি কিছু, কিন্তু এর আগে এয়ার ট্র্যাভেল করার সময়ে তাঁর এই সমস্যা হয়নি যা এখন হচ্ছে ।
--কী সমস্যা ?
--পেচ্ছাপ হচ্ছে না ; বেশ জোরেই পেয়েছে, অথচ হচ্ছে না । কতক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলুম তবু হল না।
--আপনি এক কাজ করুন । আরও কয়েক গ্লাস ঠান্ডা জল খেয়ে নিন । টয়লেটের কাছে এই সিটটা খালি আছে, এটায় বসুন । নিশ্চয়ই পাবে । টেনশান নেবেন না ।
ঠান্ডা জল খেয়ে কিছুক্ষণেই সোমেন দত্তর মনে হল যে এই বুঝি টপ-টপ করে আরম্ভ হয়ে গেল । আবার ঢুকলেন টয়লেটে । কিছুক্ষণ প্রয়াসের পর বেরিয়ে আসতে অন্য একজন এয়ার হোস্টেস বলল, কী স্যার, ইউরিনেট করতে পারলেন ?
--না, হল না ।
ওনার সমস্যা নিয়ে এয়ার হোস্টেসগুলো নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করেছে নাকি ! এই মেয়েটা কোথা থেকে জানতে পারল যে ওনার পেচ্ছাপ আটকে গেছে ।
মেয়েটি বলল, স্যার, আমার বাবারও একই সমস্যা, আপনি কমোডে বসুন, আমি এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল দিচ্ছি, আপনি ঢালুন আর কিছুক্ষণ ওয়েট করুন, দেখুন হবে, জোর দেবেন না, রিল্যাক্সড হয়ে ইউরিন পাস করার চেষ্টা করুন ।
--জল কোথায় ঢালব ?
--কেন, যেখান দিয়ে ইউরিনেট করবেন, কুল ডাউন হলে দেখবেন আপনা থেকেই নেমে আসছে । আপনি টয়লেট ডোর লক করবেন না ।
লিঙ্গের ডগায় ঠাণ্ডা জল ঢেলে মিনিট পাঁচেক চোখ বুজে বসে রইলেন সোমেন দত্ত । হল । অনেকক্ষণ ধরে হল । আহ, কী আরাম । বাইরে বেরোতেই তিনজন এয়ার হোস্টেস তাঁর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসির মাধ্যমে জানতে চাইলে সোমেন দত্ত তাদের ধন্যবাদ দিলেন সুপরামর্শের জন্য ।
--আপনি গিয়েই একজন ভালো ইউরোলজিস্টকে কনসাল্ট করবেন স্যার, বলল প্রথম এয়ার হোস্টেস ।
দ্বিতীয় এয়ারহোস্টেস বলল, আপনি ফ্লাইটে কয়েক পেগ হুইস্কি খেয়েছেন বলে সমস্যাটা দেখা দিয়ে থাকবে, ফ্লাইটে রক্তে অক্সিজেন কমে গিয়ে প্রবলেমটা হয়েছে । একজন ভালো ইউরোলজিস্টকে দেখাবেন, কোনো চিন্তার নেই ।
বিদেশিনী এয়ারহোস্টেসরা বেশ হেল্পফুল । ফ্রি অ্যান্ড ফ্র্যাংক । অবশ্য ইংরেজিতে কথাগুলো বলার সুবিধা আছে । বাংলায় হলে বলতে হতো ওইখানে জল ঢালুন , ওইখানে মানে কোনখানে, যেখান দিয়ে হিসি করেন ! হিসি বা পেচ্ছাপ কি বলতে পারতো বাংলায়, একজন যুবতী, ইতস্তত করত । নিজেকে মনে মনে বললেন সোমেন দত্ত।
পাড়ার অকিঞ্চন সান্যাল, যাঁর সঙ্গে প্রতি শনিবার হুইস্কি নিয়ে বসেন, তাঁকে জিগ্যেস করতে, তিনি বলেছিলেন, তাঁর তো এখনও সমস্যাটা দেখা দেয়নি । রাসবেহারিতে একজন ইউরোলজিস্টের বোর্ড দেখেছেন বটে, তার নাম ডক্টর নিতিন ধাবালিয়া । সোমেন দত্ত ধাবালিয়ার ফোন নম্বর ইনটারনেট ঘেঁটে যোগাড় করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছিলেন । ধাবালিয়ার বিরাট ক্লিনিক, সিসিটিভি লাগানো, চেম্বারে বসে দেখতে পান কতজন রোগি অপেক্ষা করছে । রোগি বেশি হলে প্রত্যেককে তাড়াতাড়ি দেখে ছেড়ে দেন । সোমেন দত্ত যেদিন দেখাতে গিয়েছিলেন সেদিন অমনই ভিড় ছিল । ডক্টর ধাবালিয়া নাম জিগ্যেস করলেন, সমস্যা জিগ্যেস করলেন, তারপর বললেন পেচ্ছাপের ফ্লোচার্ট, রক্তের পিএসএ রিপোর্ট আর ক্যানসারাস গ্রোথ হয়েছে কিনা তার জন্য ডক্টর ব্যানার্জির কাছে রেফার করে দিয়েছিলেন ।
সোমেন দত্তর স্ত্রী ধাবালিয়ার চেম্বার থেকে বেরিয়েই বললেন, নিকুচি করেছে এই ডাক্তারের, আগেই ভয় পাইয়ে দিচ্ছে ক্যানসারের । সবকটা কমিশনখোর মিলে নেটওয়র্কিং করে রেখেছে ; আমিই বরং ভালো ইউরোলজিস্টের খোঁজ নিচ্ছি । মিসেস ঘোষ, যাঁর স্বামী এমবিবিএস ডাক্তার, সকাল-সন্ধে গরিব রোগিদের দেখেন, তাঁর কাছে খোঁজ নিয়ে সোমেন দত্তর স্ত্রী আইভিএফ সেন্টারের ঠিকানা আর ফোন নম্বর পেয়েছিলেন ।
--আরে, আইভিএফ করার ডাক্তারকে দেখিয়ে কী করব ? তুমিও আর ডাক্তার পেলে না । স্ত্রীকে বলেছিলেন সোমেন দত্ত ।
--এটা শুধু আইভিএফ সেন্টার নয় । এটা একটা হাসপাতাল । স্বামী আইভিএফ করেন, স্ত্রী ইউরোলজিস্ট আর ওনাদের ছেলে-বউ গাইনাকলোজিস্ট ।
--মহিলা ইউরোলজিস্ট !
--হ্যাঁ, বেশ নামকরা, ডক্টর নন্দিনী দেবরায় । আমি ডেট নিয়ে রেখেছি । একমাস পরে ডেট দিয়েছেন ।
--দিনের বেলা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছ তো ? রাত্তিরে পথঘাট ঠিকিমতন দেখতে পাই না, গাড়ি চালাতে অসুবিধা হয় ।
--হ্যাঁ হ্যাঁ, পরের মাসে সাত তারিখে, সকাল দশটায় । এনার কাছে ধাবালিয়ার প্রসঙ্গ তোলার দরকার নেই, কী বল ?
--তা ঠিক ।
৩.
ডক্টর নন্দিনী দেবরায়ের হাসপাতালে দেখিয়ে পাশের আইভিএফ সেন্টারে সোনোগ্রাফির অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য ঢুকে অপেক্ষারতাদের সোফায় বসে-থাকা একজন পোয়াতি যুবতীর মুখটা মনে হল পরিচিত । এই বয়সে স্মৃতি কাজ করে না । স্ত্রীকে জিগ্যেস করলেন। স্ত্রীও মনে করতে পারলেন না ।
বাড়ি ফিরে মনে পড়ল সোমেন দত্তর । ঠিক, মেয়েটার নাম মধুবন্তি বণিক, ওনার ছাত্রী ছিল , ইংরেজিতে সান্মানিক স্নাতক পড়ত, কোর্স পুরো না করেই উধাও হয়ে গিয়েছিল, প্রেমে পড়ে। যে যুবকের সঙ্গে উধাও হয়ে গিয়েছিল সে, অরিজিৎ কর, ছাত্রদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিল, বিপ্লবের কথা বলত, সমাজবদলের কথা বলত, কলেজের সামনে দিয়ে যে মিছিল যেত তাতেও যুবকটিকে দেখেছেন কয়েকবার, মুঠি উঠিয়ে স্লোগান দিতে-দিতে যাচ্ছে, সঙ্গে মধুবন্তি । ছেলেটি নিশ্চয়ই নেতৃস্হানীয়, সামনে-সামনে যাচ্ছে যখন, মনে হয়েছিল সোমেন দত্তর ।
তা তো সাত-আট বছর আগের কথা । মধুবন্তি বণিক আইভিএফ সেন্টারে কেন ? অনিরুদ্ধ করই বা কোথায় গেল । বিপ্লবের ঘুটি ওলোটপালোট হয়ে যাবার দরুণ কি ওদের দুজনের জীবনেও ওলোটপালোট ঘটে গেছে ! মধুবন্তি কি বিয়ে করেছিল অনিরুদ্ধ করকে ? বিয়ে করে ছেড়ে দিয়েছে ? নতুন বরের স্পার্ম থেকে বাচ্চা হবার সম্ভাবনা নেই ?
মধুবন্তি বণিকের বাবা ধনী ছিলেন, ব্যবসা আছে, কয়েকটা মল-এ দোকানও আছে ওনাদের কারখানার জিনিসের । আড়াই লাখ টাকা করতেই পারেন খরচ । একবার কেন কয়েকবার খরচ করতে পারেন । অনিরুদ্ধ কর গরিব পরিবারের ছেলে ছিল । সে কি আর বিপ্লব করে অত টাকা করতে পেরেছে ? অনেক বিপ্লবী অবশ্য নানা ফন্দিফিকির চালিয়ে অঢেল টাকা করে ফেলেছে -- গাছ, মাছ, ঠিকেদারির পথে । অনিরুদ্ধও কি সেই পথে গেল শেষ পর্যন্ত ! মিছিলে-মিছিলে পুঁজিবাদ, আমেরিকা, সাম্রাজ্যবাদ, ওয়ালস্ট্রিট, কালো হাত, কায়েমি স্বার্থ, কত রকমের স্লোগান শোনা যেত ওর শিরা-ফোলানো গলায় ।
সোনোগ্রাফি করাতে গিয়েও বসে থাকতে হল বেশ কিছুক্ষণ, এক ঘণ্টার বেশি । প্রচুর জল খেয়ে সোমেন দত্তর হিসি পেয়ে গিয়েছিল বলে টয়লিটের দিকে পা বাড়িয়েছিলেন, রিসেপশানিস্ট মেয়েটি, অনিন্দিতা দত্তগুপ্ত বলল, আংকল যাবেন না যাবেন না, ব্লাডার ফাঁকা হয়ে গেলে চলবে না ।
--চেপা রাখা কঠিন হয়ে গেছে গো, বললেন সোমেন দত্ত ।
--আরেকটুক্ষণ আমাকে টাইম অ্যালাউ করুন, এর পরেই আপনাকে পাঠাবো, বলেছিল অনিন্দিতা ।
সোমেন দত্তর স্ত্রী সোনোগ্রাফি চেম্বারের দিকে নজর রেখেছিলেন । একজন পোয়াতি বউ বেরিয়ে আসতেই সোমেন দত্তকে ঠেলা দিয়ে বললেন, যাও যাও, বেরিয়েছে, নয়তো অন্য কাউকে পাঠিয়ে দেবে ।
সোমেন দত্ত সোনোগ্রাফির চেম্বারে ঢুকে দেখলেন, সেখানের ডাক্তারও মহিলা । এবার আর আন্ডারউইয়ার পরে আসেননি, জানতেন খুলতে বলবে, অহেতুক পরে এসো, আবার খোলো, এসব হ্যাঙ্গাম এড়াতে পরেননি । নিজেই ট্রাউজার খুলে শুয়ে পড়লেন । ডাক্তার তলপেটে আর পাশ ফিরিয়ে যন্ত্র চালিয়ে চলমান ফোটোতে দেখতে লাগলেন । হয়ে গেলে বললেন, যান ইউরিনেট করে আসুন, দাঁড়িয়ে নয়, কমোডে বসে, যতটা পারবেন ইউরিনেট করে নেবেন । টয়লেটে ঢুকে সোমেন দত্ত, ক্লিনিকের হাওয়াই চপ্পল পরে থাকা সত্ত্বেও, টের পেলেন যে পোয়াতিরা অনেকে কমোডেও বসতে পারেনি বলে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই সেরে ফেলেছে । পুরো ফ্লোর পেচ্ছাপে ভাসছে ।
আরেকবার সোনোগ্রাফি চেম্বারে ঢুকলে সোমেন দত্তর স্ত্রীও ঢুকেছিলেন । ডাক্তারকে জিগ্যেস করলেন, সব ঠিক আছে তো ? চিন্তার কিছু নেই তো ? ডাক্তার বললেন, এবিষয়ে ডক্টর নন্দিনী দেবরায় পরামর্শ দেবেন ।
সোমেন দত্ত আর ওনার স্ত্রী কাউন্টারে টাকা জমা করার সময়ে মধুবন্তি বণিককে দেখতে পেলেন, আইভিএফ সেন্টার থেকে বেরোচ্ছে, কোলে গোলগাল বাচ্চা, ফর্সা, ভালো দেখতে ।
--তুমি মধুবন্তি না ? জিগ্যেস করলেন সোমেন দত্ত ।
--হ্যাঁ, স্যার ; আপনি ভালো আছেন ?
--ভালো আর কই । ইউরোলজিস্ট নন্দিনী দেবরায়কে দেখাচ্ছি । তোমার বাচ্চাটা দেখতে-শুনতে বেশ ভালো হয়েছে । কি নাম রেখেছ ?
--ছেলে না মেয়ে । জানতে চাইলেন সোমেন দত্তর স্ত্রী ।
--থ্যাংকস স্যার । ছেলে মাসিমা । নাম রেখেছি অপূর্ব ।
--তা তুমি একা ? অরিজিৎকে দেখছি না । সে কোথায় ।
সোমেন দত্ত আর ওনার স্ত্রীকে স্তম্ভিত করে মধুবন্তি বলল, নরকে ।
দুজনেই ভুরু কুঁচকে রইলেন, ভ্যাবাচাকায় আক্রান্ত, এরপর প্রসঙ্গটা শেষ করবেন না অন্য প্রসঙ্গে যাবেন এমন দোটানা থেকে মধুবন্তিই ওনাদের মুক্তি দিল । বলল, বাচ্চাটা যদিও আমার, কিন্তু অনিরুদ্ধ এর বায়ালজিকাল বাবা নয়, এর বায়ালজিকাল বাবা যে কে তা আমিও জানি না, কেননা অপূর্ব আইভিএফ করে হয়েছে । অনিরুদ্ধ এর লিগাল বাবা ।
প্রসঙ্গটা গোলমেলে পথে চলে যাচ্ছে আঁচ করে সোমেন দত্ত বললেন, আচ্ছা চলি, অপূর্বকে ভালো করে মানুষ কোরো।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে বসে সোমেন দত্তর স্ত্রী বললেন, স্পার্মের জৌলুশ না থাকা একদিক থেকে ভালো । বুড়ো বয়সে অনিরুদ্ধর পোঁদে কোনো ডাক্তার তো আর আঙুল করবে না ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন