মঙ্গলবার, ২৫ মে, ২০২১

মলয় রায়চৌধুরীর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা : পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়

 মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা’ : পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়

     মলয় রায়চৌধুরীর প্রধান দৃষ্টিকোণ ছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার । আর সেই সঙ্গে মলয় ‘সাহিত্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন । মলয় রায়চৌধুরী মনে করেন, ‘প্রতিষ্ঠান একটা প্রক্রিয়া । প্রতিষ্ঠান কোনো অরগানাইজেশান নয় । তা চাগিয়ে ওঠে শাসনের মূল্যবোধ থেকে । মলয় আরও বলেছেন, এই ইনট্রিনজিক ফ্যাসিজমই এসট্যাবলিশমেন্ট ।’ সব মিলিয়ে এটাই দাঁড়ায়, , মলয়ের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা আসলে সামাজিক দায়বদ্ধতা । আর প্রতিষ্ঠান মানে শাসকের, শাসনের মূল্যবোধ । মলয় প্রতিষ্ঠান বলতে কোনও দল, আমলাতন্ত্র, চার্চ-মসজিদ, হিন্দুধর্মকেন্দ্র, শিক্ষাব্যবস্হা ইত্যাদিকে পৃথকভাবে নির্দিষ্ট করেন না ; করেন মূল্যবোধকে । শাসনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমাজ ও জনসমাজ যে-মূল্যবোধ, তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যে দমননীতি-সম্মতির বিভিন্ন হাতিয়ারকে ব্যবহার করে, তাকেই মলয় প্রতিষ্ঠান ভাবেন, এবং তা একটি প্রক্রিয়া । প্রতিষ্ঠান এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে  সে তার কর্ষিকাগুলি ছড়িয়ে দেয় । রাষ্ট্র থাকলে যেমন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থাকবে, সমাজ -- সে রাষ্ট্রীয় বা জন যাই হোক, থাকলেই প্রতিষ্ঠান থাকবে । আর প্রতিষ্ঠান থাকলেই তার কর্তৃত্ব থাকবে , যে-সমাজে প্রতিষ্ঠানটি শিকড় গাড়ে, শাঁসে-জলে বাড়ে, তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য হিংস্র ও অহিংস্র নানা উপায় সে অবলম্বন করে । এর বিরুদ্ধে লড়াই তাই মূল্যবোধের, চৈতন্যের । আর এ লড়াই সার্বিক ; ব্যক্তিগত ও বৃহত্তর মাত্রা উভয় স্তরেই ।

          মলয়ের জীবনকাহিনির যেটুকু অংশ তাঁর লেখাতেই প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এই লড়াইয়ের একটা ছবি পাই । অবশ্য এ বৃত্তান্ত পরবর্তী সময়ের, ১৯৬১-১৯৬৫-এর মধ্যে তিনি তরতাজা যুবক হিসাবে কী ভাবতেন, তা জানা যায় না । সেই সময়ের দিনপঞ্জিকাটি থাকলে আরও বোঝা যেত । কারণ ওই যে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠান একটা প্রক্রিয়া, একটি মূল্যবোধ, তাতেই স্পষ্ট ১৯৬১-৬৫-এর মলয় রায়চৌধুরী আর ২০০০ খ্রিস্টাব্দের মলয় রায়চৌধুরী যেমন এক নন, তেমনি সেই সময়ের প্রতিষ্ঠান আর এখনকার প্রতিষ্ঠান, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে হুবহু এক নয় । ১৯৬৫ থেকে ২০০০-এর মধ্যে এখানে সময় খুব দ্রুত এগিয়েছে-পিছিয়েছে, একটা অপরিবর্তনীয় গতিতত্বে যেন নানা ওলটপালটের মধ্যে আবার আগের স্হিতাবস্হায় ফিরে গেছে, কিন্তু আরও চরিত্রহীন, আরও নপুংসক হয়ে । আমরা যারা মলয়ের সমবয়সী প্রায়, তাদের কাছে ১৯৬১-১৯৬৫-এর মলয়ের নৈরাজ্যিক প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা, ওই সময়ে নঞর্থক মনে হয়েছিল, মনে হয়েছিল সামাজিক দায়হীন । কিন্তু আজকের অবসন্নতায় ওই বিদ্রোহকে সদর্থক মনে হয় । বিশেষ সময়ে অ্যানার্কিও তো সদর্থক বৈপ্লবিক হতে পারে ।

          মলয় রায়চৌথুরীর ১৯৬০র দশকে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ও তারপরে নীরব থেকে ১৯৮০র দশকে অন্যভাবে দেখা দেওয়া, আমাদের মধ্যবিত্ত বিদ্রোহের এক প্রতীকি চিত্র । সেই ১৮২০-৩০এর দশকের ডিরোজিয়ানদের সময় থেকেই এই পরম্পরা আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেনিতে আছে । ওই বিদ্রোহটাও যেমন সত্যি আবার প্রতিষ্ঠানে ঢুকে যাওয়াও তেমনি সত্যি । উপনিবেশ ও ১৯৪৭-এর পরের অব-উপনিবেশের বাস্তবে ক্রিয়াশীল উৎপাদন সম্পর্কশূন্য বৃহত্তর জনসমাজ ও জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগত ও ব্যক্তিগত এই বিদ্রোহ , এই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাকে তুচ্ছ করা অনৈতিহাসিক, কারণ মধ্যশ্রেনির ইতিহাসের নিরন্ধ্র অবসন্নতা ও করুণ আত্মসমর্পণে, ট্র্যাজেডি নয় ফার্সে, এই ক্ষণস্ফূলিঙ্গগুলিই একমাত্র বাঁচবার ইঙ্গিত । এদের ব্যক্তিক ও গোষ্ঠীগত ব্যর্থতা প্রায় অনিবার্যই ছিল । তবু, তারা যে কম্পন নিয়ে এসেছে, তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকতে হয় ।

          মলয় রায়চৌধুরীর নিজের সাক্ষেই বোঝা যায়, একটা টানবাপোড়েন গোড়া থেকেই ছিল । মলয় দেখাতে চেয়েছেন তিনি প্রায় স্কুলে পড়াশুনা ন-করার ভূমি থেকে এসেছেন । তাঁর দাদা সমীরই তাঁদের বাড়ির প্রথম স্কুলে-পড়া, কলেজে-পড়া । অর্থাৎ যে ঔপনিবেশিক শিক্ষায় বাঙালি মধ্যবিত্ত জারিত, তার শেকড় তাঁদের পরিবারে ছড়ায়নি, তাঁর প্রজন্মেই এর সূত্রপাত । কিন্তু ওই প্রথম প্রজন্মেই এই শিক্ষার ধার তীক্ষ্ণ হয় ; ‘এদিকে মলয় আমার ছোটোভাই তখন অর্থনীতির স্নাতকোত্তর ক্লাসের শেষ বছরের ছাত্র । সারাদিন ঘাড় গুঁজে বিস্তর বই পড়ে ; সমাজ নিয়ে, পৃথিবী নিয়ে অনেক ভাবনা, কথায়-কথায় এঙ্গেলস, কিয়ের্কেগার্দ, মার্কস, স্পেঙ্গলার ইত্যাদি থেকে উদ্ধৃতি দেয় । পাটনায় গেলে আমাকে কেবলই বলে, “সাহিত্য এইভাবে এলোমেলো হয় না ; একটা পরিকল্পনা মতো এগোনো উচিত । কী বলতে চাও, করতে চাও, সবার আগে সেটা ঠিক করো, আন্দোলন চালাও । আন্দোলন দরকার।”...’

         সমীরের এই ছবিতে কোনও নৈরাজ্যবাদী মলয়কে পাই না । বরঞ্চ ইয়োরোপমুখী এক যুবককে, যে পরিকল্পনা চায় । এই যুবক অব-উপনিবেশের যুদ্ধ-দাঙ্গে-দুর্ভিক্ষ-দেশভাগ ধর্ষিত কলকাতায় এসে পালটায়, কলকাতা তাঁকে পালটায় । তাঁর অ-নাগরিক অভ্যাস কলকাতায় বেমানান -- কিন্তু ওই মধ্যবিত্ত অ-নাগরিক অভ্যাসকে তিনি প্রলেতারিয় ভাবছিলেন । নিজেকে শ্রেনিচ্যূত করতে চাইছিলেন । আর এই জন্যই একটা জীবনযাপন বেছে নিয়েছিলেন যা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের পক্ষে দুঃসহনীয় । ঠিক যেমন একদা ডিরোজিয়ানরা বেছেছিলেন -- তখন মদ্যপান, গোমাংসভক্ষণ ছিল হিন্দু ভদ্রলোকের পক্ষে ক্রোধের কারণ, যদিও অনেক ভদ্রলোকই আড়ালে মদ্যপায়ী, বেশ্যাগমনে অভ্যস্ত ।  । কিন্তু ডিরোজিয়ানরা এসব করছিলেন প্রকাশ্যে, একটা বিদ্রোহের আদলে। মলয় নিজেদের অবস্হাকে বলেছেন ‘ষাট দশকীয় ফাটিচার’ । কলকাতার সাহিত্য মহলে আর্টেমিস-ক্রেসিডা-ইউলিসিস এসব নামে অস্বস্তিবোধ করতেন তিনি, কিন্তু “আমাদের মগজে রেজিস দেবরে, আরনেসতো চে গ্বেভারা, ফিদেল কাসত্রো নামগুলো বরঞ্চ মিহিন ঘণ্টাধ্বনি শোনাচ্ছে ।” এঁরাও সকলেই বিদেশের -- তবে অন্য ভূবনের । ষাট দশকের কলকাতার বিপরীত টানেই পাটনার সিরিয়াস যুবক মলয় রায়চৌধুরী তাঁর প্রতিষ্ঠাবিরোধিতার নৈরাজ্যিক আকাশে মুক্তি চাইলেন । এই কলকাতাই তাঁকে বুঝিয়েছিল, ‘ষাটের দশকে সুস্হতা সত্যিই অবাস্তব ছিল।’ মলয়ের এই সিদ্ধান্ত ইতিহাস-বোধে উজ্বল।

          ষাটের দশকে যে সুস্হভাবে বাঁচা অবাস্তব ছিল, তার প্রমাণ সেই দশক জুড়ে নানা ধরনের বিদ্রোহ যার শীর্ষবিন্দু নকশাল অভ্যূথ্থান । মলয়দের আন্দোলন, নকশাল আন্দোলনের একদিকের পূর্বাভাস । তিনি দেবরে, গ্বেভারা, কাসত্রোর কথা বলেছেন, তাতে বোঝা যায় তাঁর অন্তরে তিনি, ব্যক্তিগত নানা ট্যাবু ভাঙার মধ্যেই, একটা রাজনৈতিক বীক্ষা বহন করতেন । ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ নামে বইও লিখেছিলেন । এই বীক্ষা তাঁর বিদ্রোহে  সেইভাবে উপরিস্তরে আসেনি, কিন্তু অনেক হাংরি যে পরে নকশাল হয়েছিল, তার কারণ কিন্তু ওই মধ্যবিত্ত কারাগার ভেঙে ফেলার আগ্রহ । মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন, তিনিও গুণ্ডা-মাস্তান হয়ে যেতেন, কবিতা না-লিখলে । নিজেকে কবিতা লেখার ক্রিমিনাল বলেও অভিহিত করেছেন । আর এক -এক করে সেই কবিদের নাম করেছেন যাঁদের জেলে বা জেলের বাইরে খুন করা হয় । মলয় নকশাল প্রসঙ্গ আনেন তাঁর ‘হাংরি কিংবদন্তি’ বইতে । ঠিকই করেন । মলয়ের বিদ্রোহ ছিল দক্ষিণ ও বাম দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই -- অন্তত মলয় তাঁর পঠন-পাঠন থেকে, বুদ্ধিগত জগৎ জগৎ কোনও সময়েই রাজনৈতিক বীক্ষার অন্তঃসলিলা স্রোতকে ফেলে দিতে পারেননি । জীবনযাপনের নৈরাজ্যের মধ্যেই একটা বুদ্ধিগত, মননগত স্তর তাঁর থেকেই গিয়েছিল । কবিতা ও সাহিত্যকে কেন্দ্রবিন্দু রাখায় ব্যক্তিক জীবনযাপনের তীব্র নেশাগ্রস্ত নৈরাজ্যই তাঁর কাছে বিদ্রোহের মূল ধরণ হয়ে ওঠে । এটাকে মেলাতে চান কবিতায় । কিন্তু হাংরি প্রজন্মের সাহিত্যগত কীর্তি কবিতায় নয়, গদ্যে । ওই কিংবদন্তি, ওই ছাপ থেকে বেরিয়ে এসে তাঁদের মূল্যায়ন করলে, গদ্যই থাকবে ; অন্তত আমার মতো পাঠকের কাছে, যার চিন্তাভাবনাকে, নকশাল অভ্যূথ্থান, ব্যর্থ হলেও ওলোটপালট করে দিয়েছিল। ওই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা অবশ্যই স্পষ্ট, তবুও । তেমনি ষাটের দশকে একদল যুবকের ব্যক্তিক জীবনের নিরুদ্দেশযাত্রী হওয়ার তাৎপর্য এখন ধরা পড়ে । এই নিরুদ্দেশযাত্রার মূল্য অবশ্যই তাদের দিতে হয়েছে । তবে যেহেতু নকশাল বিদ্রোহ রাষ্ট্রকে খানিকটা ভীত করে তুলেছিল, তাই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস জনসমাজের সমর্থনে এ-বিদ্রোহের ওপর ভয়াবহভাবে নেমে আসে । ওই বাস্তব অসহ্য-লাগা যুবকদের হত্যা করে, অনেককেই সারা জীবনের মতো পঙ্গু করে দেয় । এই বঙ্গে এ-আন্দোলন নির্মমভাবে দমিত হলেও, ওই প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ সম্পর্কে একটা প্রশ্ন, সংশয় ও আন্দোলন রেখে গেছে । তার আগের মলয়দের হাংরি আন্দোলন জেল-মামলাতেই শেষ হয় । মলয়ও সেই নকশালদের মতো, যাঁরা শেষ পর্যন্ত এই সমাজে, প্রতিষ্ঠানে নানাভাবে আত্মস্হ হয়ে যান ; এমনকি ওই অতীতকে কাজে লাগিয়ে, পুঁজি করেন । এ সত্ত্বেও মলয় রায়চৌধুরীর ষাটের দশকের বিদ্রোহ মিথ্যা হয়ে যায় না, অন্তত তিনি তাকে তাঁর অন্যান্য বন্ধুদের মতো ( সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত প্রমুখ ) প্রকাশ্যে পুঁজিও করেননি ।

          এ-প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, মলয় রায়চৌধুরীর প্রতিষ্ঠানবিরোধি বিদ্রোহ যে পুলিশ-আদালত-জেল-মামলার দিকে ঠেলে দিয়েছিল, তার নিষ্পত্তি কিন্তু প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপেই হয় । তাঁর বন্ধুরা তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য ও মুচলেকা দিয়ে মুক্তিলাভ করেন । মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন, “লালবাজারে পুলিশ কমিশনার বললেন, তিনি আমাকে সাব ইন্সপেক্টরের চাকরি দিতে চান, কারণ সাজা হবার ফলে ( দুশো টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড ) আর কোথাও চাকরি হওয়া মুশকিল । পরে জেনেছি অ্যালেন গিন্সবার্গ পুপুল জয়াকরকে চিঠি লেখার পর জয়াকর তা ইন্দিরা গান্ধিকে জানান ; দিল্লির নির্দেশে কলকাতার বাঙালি পুলিশ তখন ফাঁপরে।” মলয় রায়চৌধুরীর পাশে এসে দিল্লির প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়েছিল, অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক স্তরভেদ আছে । আর লক্ষণীয় গিন্সবার্গের ভূমিকা । তিনি কিন্তু ‘কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রীডাম’-এর পাণ্ডাদের সাহায্য চেয়েছিলেন -- আবু সয়ীদ আইয়ুব প্রত্যাখ্যান করেন এ সাহায্যের আবেদন । প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলনের নেতার এরকম আশ্রয় থেকে বোঝা যায় মলয়দের নিয়ে এসট্যাবলিশমেন্ট খেলছিল । নকশাল-আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে এই বঙ্গেও ওই খেলা নানাভাবে দেখা যায় । তার আগে সন্ত্রস্ত প্রতিষ্ঠান তাদের একের পর এক হত্যা করেছে -- আর সেই হত্যার এ-বঙ্গের প্রতিষ্ঠানের নায়করা পরবর্তী বাম-রাজত্বে থেকেছেন ; শুধু তা-ই নয়, উন্নতি করেছেন । যেমন, যে সোমেন চন্দকে নিয়ে আজ বামপন্হী মহল উচ্ছ্বসিত, যাঁর হত্যার বিরুদ্ধে ধিক্কার বারবার উচ্চারিত, তাঁর হত্যার ‘প্রকৃত ঘটনা হল এই যে, সোমেন চন্দ রেলওয়ে শ্রমিকদের নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে শুধু ফ্যাসিবিরোধী সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন । ঢাকার নারিন্দাপুল পার হয়ে বটঘাছের কাছেই আর. এস. পির ঘাতকবাহিনী ঘিরে ফ্যালে সোমেন চন্দকে । তারপর নির্মমভাবে হত্যা করে।’ এই আর.এস.পি এখন বামফ্রণ্টের শরিক ও মন্ত্রী । এরাই ফ্যাসিস্ট বাহিনীর মদতদাতা ছিল । প্রতিষ্ঠান কতো খেলাই খেলে, কতো রঙই বদলায় । মলয় রায়চৌধুরীও ওই খেলার পুতুল হয়ে ছিলেন । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায় তিনি মামলা-আদালত জেল-জরিমানার যে ফাঁদে জড়িয়ে পড়েন, প্রতিষ্ঠানই তার থেকে তাঁকে বাইরে নিয়ে আসে । 

          অবশ্য মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে এসব কথা এখন অবান্তর। কারণ তাঁর সম্পর্কে এখন আমি যে লিখছি তা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন বা আদালত-মামলা জেল-জরিমানার বৃত্তান্তের জন্য নয় । মলয় নামক একজন কবি ও ঔপন্যাসিকই আমার আগ্রহের মূলে । তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার তাৎপর্যই এই সূত্রে বিবেচ্য । এক একজন পাঠক এক একজন লেখক ও আন্দোলনকে নিজের নিজের মতন করে দেখেন । আমার কাছে শুধু মলয়ই নয়, গোটা হাংরি জেনারেশনের লেখকদেরই গদ্য যতো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, কবিতাকে তেমন মনে হয়নি । যে-কোনও কারণেই হোক, কবিরা, বোধহয় ইয়োরোপ আমেরিকা কবিদের জীবনকাহিনি শুনে পঞ্চাশের দশক থেকে ব্যক্তিজীবনের হুল্লোড় ও নানারকম কাজ কারবারকে গুরুত্ব দিতে থাকেন, ফল হয় কবিতার অধঃপতন, যা এখনও চলছে । মলয়ও তাই করেছিলেন । কিন্তু গদ্যে একেবারে বিপরীত । হাংরি আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে মলয় লিখেছেন, ‘স্হিতাবস্হা ভাঙার ভাষাই নয় কেবল, ভাষার স্হিতাবস্হা ভাঙার চেষ্টাই চালিয়েছেন ।’ গদ্যে এটাই প্রকৃত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা । সুবিমল বসাকের ‘ছাতামাথা’ এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ । বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধনশালার’ নামও করতে পারি । কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে এটা আদৌ হয়নি। ভাষার স্হিতাবস্হা ভাঙার কোনও লক্ষণই নেই । আর যেহেতু জীবনযাপন কবিতাকে চিৎ করে ফেলছিল, সেহেতু ওই জীবনযাপনের তাৎক্ষণিক অনুভূতি কবিতায় এমনভাবে অন্তত মলয়ের কবিতায় আসতে চাইছিল, যাতে কবিতার থেকে ওই অনুভূতিই বড়ো হয়ে ওঠে । জীবন কবিতাকে খেয়ে ফেললে মুশকিল, জীবনের ক্ষুধাকে কবিতার রসায়নে দাঁড়াতে হয় । আজ এই ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ভাবতে অবাক লাগে মলয়ের বেশ কাঁচা কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ অতো হৈ-চৈ, অতো শিরঃপীড়ার কারণ কেন হয়েছিল । একেবারে মধ্যবিত্ত ভাষা জর্জরিত মধ্যবিত্ত কবিতা এটি :-


“অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্হতা

যোনিকেশরে কাচের টুকরোর মতো ঘামের সুস্হতা

আজ আমি মগজের শরণাপন্ন বিপর্যয়ের দিকে চলে এলুম

আমি বুঝতে পারছি না কি জন্যে আমি বেঁচে থাকতে চাইছি

শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমায়

কবিতার জন্য আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই

শুভা আমাকে তোমার লাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ করতে দাও

দুঃখহীন আয়াসের অসম্ভাব্যতায় যেতে দাও

বেসামাল হৃদয়বেত্তার স্বর্ণসবুজে”


          যে-নিম্নবর্গীয় ভাষার আক্রমণে ভাষার স্হিতিস্হাপকতাকে বিপন্ন করার ভাবনা মলয়ের, এই উদ্ধৃতিতে তার কি কোনও চিহ্ণ আছে ? যোনি, স্তন, বীর্য -- এসবই সংস্কৃত শব্দ । এদের নিম্নবর্গীয় শব্দ মলয় ব্যবহার করেননি । এসব শব্দ এলিট পরম্পরায় বহু ব্যহৃত । আর ‘অশ্লীল’ এই ধারণাটির স্হান-কাল-পাত্র আছে । এখন আর তথাকথিত অশ্লীল দিয়ে প্রতিষ্ঠানের ঘুম কাড়া যায় না, কারণ সামগ্রিক প্রতিষ্ঠানই তো অশ্লীল --- অশ্লীল অর্থনীতি, অশ্লীল রাজনীতি, অশ্লীল সমাজ, রাস্তায় ঘাটে একেবারে মধ্যবিত্ত ছোকরাই দু-তিন-চার অক্ষরের শব্দ প্রকাশ্যে বলে । নিম্নবর্গীয়দের অশ্লীল শব্দের যে পেশলতা, যে চিত্রকল্প, যে জোর, তা এই অশ্লীলতায় নেই -- মলয়ের কবিতায় ‘পাজামায় শুকিয়ে যাওয়া বীর্যের’ মতোই সৃষ্টিহীন, অসুস্হ । আসলে ষাটের দশকে মলয় রায়চৌধুরী এক ধরনের আরোপিত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায় মেতেছিলেন, অথচ তাঁর চৈতন্যে গভীর বোধ ছিল । সেই বোধ জীবনযাপনের তীব্রতায় হারিয়ে যেতে থাকে । তাঁর মনে হয়, অশ্লীলতা বুঝি শুধু যৌনতাবাচক শুধু কতকগুলি শব্দ ।  এটা যে সামগ্রিক মূল্যবোধ-জনিত, আর প্রতিষ্ঠান যে অশ্লীল হয়ে উঠেছে সব দিক দিয়ে, বাইরের পোশাকের আড়ালে অশ্লীল, সেটা হয়তো বুঝতে পারেননি । ১৯৬৫ সালের পর মলয় এর থেকে বেরিয়ে আসেন ।

          মলয় তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার, প্রত্যাখ্যানের যথার্ধ পরিচয় রাখেন তখন, যখন তিনি ওই ষাটের দশকের জীবনযাপনের গণ্ডি থেকে সরে এসেছেন, আপাতদৃষ্টিতে যেন প্রচলিত মধ্যবিত্ত জীবনের মধ্যে এসেছেন । ‘তারপর দেড় দশক আমার লেখালিখি ছেড়ে যায় । জীবন কাটানোর ভাবনায় বন্ধুবান্ধবে আত্মপ্রকাশে আর্থিক অবস্হায় এই দেড় দশকে আমূল পরবর্তন ঘটে যায় আমার মগজে ও শরীরে, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ইতিহাসে ।’ ‘এখন তো আমার সেই সময়ের জীবনটাকে ভয়াবহ মনে হয় । এখন ভালো চাকরির পাতি-বুর্জোয়া আরামে প্রতিবাদ প্রতিরোধের লেখালিখি অনেক আরামদায়ক আর সহজ।’ ‘ক্রমশ একলা থাকার মধ্যেই নিজের আরাম আনন্দ শান্তি টের পাই ।’ অর্থাৎ এখন জীবনযাপন মলয়ের লেখাকে ছাপিয়ে যায় না । 

          প্রতিবাদ-প্রতিরোধের লেখাই তো ষাটের দশকে মলয় লিখতে চেয়েছিলেন, তাতে পুলিশ, আদালত, অশ্লীলতার অভিযোগ, জেল-জরিমানা, লকাপে রাতকাটানো । এখন সেটা অনেক আরামদায়ক ও সহজ । কেন ? তবে কি প্রতিষ্ঠান তার মূল্যবোধ পালটেছে ? নাকি তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান, ও তাঁর সহযোগীরা ( এমনকি হাংরি আন্দোলনকারীরা ) খড়্গহস্ত হয়েছিল, লেখার জন্য নয়, জীবনযাপনের জন্য । তুলনা করছি না, ডিরোজিয়ানদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল, তারাও ঔপনিবেশিক সরকারি উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন, এমনকি ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়নের অন্যতম উদ্যোক্তার  জীবনীও তাঁরা পরবর্তীকালে লিখেছেন । সেই সময়ের জীবনটাকে ভয়াবহ মনে হয় -- এখানেও জীবনের ওপরই গুরুত্ব দেওয়া ।

          শিল্পের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া বোধহয় এটাই যে ওই জীবনযাপন থেকে সরে আসার পর, পাতি-বুর্জোয়া জীবনে লগ্ন হওয়ার মধ্যেই মলয় যথার্থ প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখা লিখলেন । আমার মতে কবিতায় নয়, গদ্যে । মলয় তাঁর শেষ জীবনে এখনও কোনও সরকারি-বেসরকারি শক্তিকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হননি, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সে-অর্থে হাত মেলাননি । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা আসলে একটা প্রত্যাখ্যান ( তিনি অকাদেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন ) । আমাদের অব-ঔপনিবেশিক বাস্তবে এখন এই প্রত্যাখ্যান বিশেষ জরুরি । মলয়ও জানেন, কোনও সামূহিকের সঙ্গে মেলা যায় না ; একলা হওয়া অনিবার্য । মলয় ওই নিঃসঙ্গ প্রত্যাখ্যানের স্বপ্নে এখনও স্হির । দেড় দশক পরে যে কবিতা লেখেন, তাতে ওই প্রত্যাখ্যানের চেতনা, যা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার চেয়ে অনেক গভীরতলের :-


ওগো স্তন্যপায়ী ভাষা পিপীলিকাভূক মুখচোরা

শব্দগহ্বর খেয়ে নোকরশাহির রাজয় এনেছি এদেশে


তথাকথিত অশ্লীলতা নেই, কিন্তু আছে নোকরশাহির চেতনা, আছে ভাষার প্রতিষ্ঠানকে ভাঙার ‘মুখচোরা’ সংকল্প ।

          হাতের কাছেই রয়েছে মলয়ের উপন্যাস ‘নামগন্ধ’ । প্রকাশিত ১৯৯৯ সালে । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার, প্রাতিষ্ঠানিক স্হিতাবস্হার মূল্যবোধের বিরুদ্ধের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ উপন্যাস । স্হিতাবস্হা ও ভাষার স্হিতাবস্হা ভাঙার মূল্যবোধের এই উপন্যাসটি পড়তে পড়তে বোঝা যায় মলয় রায়চৌধুরী এখন কোথায় দাঁড়িয়ে ।


“ভোটবাগানের ভুলভুলাইয়ায়, গলির তলপেটের ঘিঞ্জি গলির ছমছমে অজানায় হনহনিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, বড়ো রাস্তায় পৌঁছোবার পথ খুঁজে পায় না ওরা, আদিত্য আর অরিন্দম, খুঁজে পায় না শহরের নির্লিপ্ত নাগরিকতায় গিয়ে মিশে যাবার দরোজাটাকে । টাকরা শুকিয়ে গেছে অনভ্যস্ত অরিন্দমের । পা চালানোর ফাঁকে ফাঁকে ডানদিকে, এস.কে.চ্যাটার্জি লেন লেখা রাস্তাটায়, গোটা তিরিশেক লোকের মাথা-গিজগিজে ভিড়, চলছে ঝাড়পিটের তুমুল।”


একটি খুনের পটভূমিতে এই ভাষা বাঙময়, স্হিতাবস্হাকে টলিয়ে দেয় : ভোটবাগানের ভুলভুলাইয়া, এই সময়ের রাজনীতির ছবি হয়ে ওঠে । ‘গলির তলপেট’ চিত্রকল্পটি ছমছমে, হনহনিয়ে শব্দ অর্থময় ; ‘চলছে ঝাড়পিটের তুমুল’ -- প্রায় কবিতার মতো ভাষা ধরিয়ে দেয় বাস্তবকে । মলয় শুরু করেন ওই রাস্তায় হত্যা ও উঁচু চাকরি-করা অরিন্দম ও পুলিশে চাকরি-করা আদিত্যকে দিয়ে, যাকে ‘ক্রনোটপ’ বলে, সেদিক থেকেও এই রাস্তা তাৎপর্যপূর্ণ । ‘নামগন্ধ’ গত কয়েক দশকের এই বঙ্গের সার্বিক চরিত্রহীন হয়ে যাওয়ার বৃত্তান্ত । এ বৃত্তান্তে অরিন্দম ও যিশু বিশ্বাস দুটি দিক । এই চরিত্রহীনতার মধ্যে এর সাক্ষী হয়েও তারা স্হিতাবস্হার বাইরে যেতে চেয়েছিল দুই নারীকে নিয়ে । বস্তুত ওই দুটি নারী মধ্যবিত্ত ও সামাজিক অধঃপতনের বিরুদ্ধে যেন চিত্রকল্প । মধ্য চল্লিশের যিশু বিশ্বাস পঞ্চাশ বছরের খুশিদিকে নিয়ে চলে আসতে চেয়েছিল । খুশি তার ‘দাদা’ ভবেশ মণ্ডলের হাতে যেন বন্দিনী । ভবেশ মণ্ডল পঞ্চাশ দশক থেকে নব্বি দশক পর্যন্ত সময়ের যেন বিবর্তনের প্রতিমূর্তি । বিদ্রোহ, অভ্যূথ্থানকারী ভবেশের পরিণতি তো এই সময়ের সাম্যবাদী দলেরই পরিণতি । এই পরিণতিতে খুশি বন্দী হয়ে যায় । যিশু যেন ওই বন্দিনীকে উদ্ধার করতে চায় । দীঘদিন পরে উধাও হয়ে যাওয়া ভবেশকাকে যিশু আবিষ্কার করে । পালটে যাওয়া ভবেশকাকা । আর তার হাতে বন্দি সেই খুশিদি, যে হয়তো শেষ বাঙালিনী । যিশু এই খুশির শরীরেই বাঁচতে চায়, এ কোনও শারীরিক টান নয়, এ যেন এক ঐতিহাসিক বাঁচবার আবেগ -- ভবেশকাকাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে । যিশুর হাত ধরে পাঠক পৌঁছে যায় এখনকার গ্রামীণ বাস্তবে --- আলু চাষ, হিমঘর, কিছুটা তাঁত, এসবের রাজনীতি-অর্থনীতিতে ধরা পড়ে এই সময়।

          আদিত্য নামক পুলিশ কর্মচারীর সূত্রে এই সময়ের শাসন, আমলা, এই বাস্তবের স্তরটি আসে । আদিত্যর ব্যক্তিগত বৃত্তান্তও দেখায় সময়ের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে । অন্য দিকে প্রমে পড়ার বাতিকগ্রস্ত উচ্চপদের অরিন্দম মধ্যবিত্ত পচনকে সরাসরিভাবে দেখায় । এই পচনের নানাছবির মধ্যে শেওড়াফুলিতে পিসিমার বাড়ির যে-ছবি আঁকা হয়, তাতে এই শ্রেনির পচে যাওয়ার কদর্য রূপ প্রকট হয়ে ওঠে ।


“স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বড়ো বউদি, এমেবিয়েড, হাতে টলমলে গেলাস, ফর্সা, ভারিক্কি গতরকে একত্রিত করে পাছ-ঘেঁষটে উঠে বসে আর বাঁহাতে অরিন্দমের গলা আঁকড়ে, নিজের কানা ভরা গেলাস দাঁতে দাঁত অরিন্দমের ঠোঁটের ওপর উলটে দিলে । খাবিনে মানে, তোর গুষ্টি খাবে, জানিস আজ আমার জন্মের সুবর্ণজয়ন্তী । বিশাল বুকের মধ্যে অরিন্দমের মাথা ঠাশা ।”


          তারপর শুরু হয় অশ্লীল গল্প বলার পর্ব । লেখকের মন্তব্য : ‘আমরা সবাই মিথ্যাগ্রস্ত মাতাল। বাঙালি মধ্যবিত্তের এ এক অদ্ভুত যাযাবর হামাগুড়ি।’ এই হামাগুড়ির প্রাক ইতিহাসও বলা হয় : এখন নোংরা নোংরা মোদো চুটকিতে মধ্যবিত্তের খোঁয়ারি উঠছে । অধ্যাপিকা ছুটকিও মাতাল, কোকা-কোলার সঙ্গে রাম ভালোবাসে । অরিন্দমের কোলে পা, অরিন্দম আলতা পরায় । সমগ্র মধ্যবিত্ত ল্যাংটো হয়ে যায় বিবরণে ।

          ‘নামগন্ধ’ এই বিবিধ পচনের প্রতিবাদ -- যিশুর খুশিদি আর অরিন্দমের কেটলিউলি সেই প্রতিবাদের, মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের, গত চার-পাঁচ দশকের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নারী । এরা মধ্যবিত্ত সীমার বাইরের । দু-জন এদের মধ্যেই মধ্যবিত্ত প্রতিষ্ঠানেরই মূল্যবোধের কারাগার ভাঙতে চেয়েছিল । এই দুই নারীকে অবলম্বন করে এরা পেরিয়ে যেতে চেয়েছিল তাদের শ্রেনিকে, ওই ভবেশকাকা তথা এই সমাজের ক্রিয়াকে । ওই শেওড়াফুলিতে প্রতিবিম্বিত মধ্যবিত্ত বাস্তবকে । কিন্তু পারল না । আকস্মিক দুর্ঘটনায় অরিন্দম-কেটলিউলি আর ডাকাত-ডাকাত চিৎকারে যিশু বিশ্বাসের মৃত্যু হয় । আপাত আকস্মিক এই ঘটনা দুটি  এই সময়ের গর্ভে স্বাভাবিক । যেমন স্বাভাবিক উপন্যাসের শুরুর হত্যাটি । আর শেষে আরেক ইতিহাসের স্তর আবিষ্কৃত । খুশি ভবেশ কাকার বোন নয় । যিশুর মৃত্যুর সময় একটা পুরোনো হলদে কাগজের পাতা উড়তে থাকে, সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের খবরের কাগজ । এক নাতনির হারিয়ে যাবার বিজ্ঞাপন, দিয়েছেন দাদু মিনহাজুদ্দিন । মেয়েটির নাম খুশবু । ডাক নাম খুশি । ভয়ংকর শব্দে ইতিহাস ফেটে পড়ে -- ইতিহাসের গন্ধ, ‘নামগন্ধ’ ছড়ায় -- খুশি, পঞ্চাশ বছরের খুশি হয়ে ওঠে অর্ধশতাব্দীর সময়, ইতিহাস, আবেগ, শরীর । তাকে আমরা পাই না -- সময়ের আকস্মিক মোচড় হত্যা করে নানাভাবে । প্রতিষ্ঠান খেয়ে ফেলে তাদের । আর এর বিরুদ্ধে কবি মলয় রায়চৌধুরী দাঁড়ান এই গদ্যেই । কী অনবদ্য কবিতা উঠে আসে যিশুর আবিষ্কারে :-


 “খালি পায়ে, বাগানের ঘাসপথ বেয়ে পুকুরপাড়ে দাঁড়ায় যিশু । আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে গেছে বাতাস । বাতাসের ডাঁটো স্ট্যাচু যেন । সব স্হির । ডানপাড়ের বিশাল গাছে তেঁতুলপাতাও কাঁপ০ছে না । বাঁধানো ঘাটে বয়ঃসন্ধির বালিকার মতন একধাপ ওপরে তো একধাপ নীচে খেলা করবার পর ক্লান্ত হয়ে গেছে টলমলে পুকুর।”


কিংবা :-


“জনশ্রুতির মতন বাতাস বইছে।...মদগর্বিত ষাঁড়। মদিরেক্ষণা মৌমাছি । ভিজে চিলের মতন ডানা ঝুলিয়ে রয়েছে ঝিমন্ত কলাগাছগুলোর ছেঁড়া পাতা। কঞ্জুস হাওয়ার তাপে বাবলাগাছগুলোর গায়ে কাঁটা দিয়েছে । পথিপার্শ্বে উইপোকাদের বিজয়স্তম্ভ । মার্জিত চেহারার খেজুর গাছ, গলায় খেজুর ছড়ার মালা।”


অথবা :- 


“চাঁদ ঢাকা পড়ে গেছে কালবৈশাখির ছেতরানো মেঘে, কিন্তু পূর্ণিমার আগাম আভায় নির্জন বধির অন্ধকারকে মনে হয় হাস্যোজ্বল । নিরলস সাধনায় মগ্ন স্হির সন্ধ্যাবাতাস আচমকা হাওয়ার জন্য অপেক্ষমান । নেশাগ্রস্তের মতন মাথা ঝুঁকিয়ে আছে গাছগুলো । বুনো সুগন্ধ ছড়াচ্ছে সিসলকাঁটার গুড়িসুড়ি ঝোপ।”


          এই উদ্ধৃতিগুলিতে, উপমা-চিত্রকল্পে, ভাষার স্বাতন্ত্র্যে, যে-কবিতাময়তা, তাতে থাকে ভাষার স্হিতিস্হাপকতাকে আক্রমণ, অথবা নতুন স্হিতিস্হাপকতা গড়া । খুশি ও কেটলিউলি হিন্দু অরিন্দম আর খ্রিস্টান যিশুর, মধ্যবিত্তের বাঁচবার পথ, কেটলিউলি-মেয়েটার শরীর জুড়ে প্রাচীন নিষাদকুলের নাচ লুকিয়ে আছে যেন । এর চাউনি রৌদ্রোজ্জ্বল । চিরপ্রদোষ-মাখা শ্যামাঙ্গিনী । আর খুশিদিকে দেখে যিশুর মনে হয়, চাষি মেয়ের শ্রমসোহাগী পেশল বাহু ঝুলে আছে । ওই প্রাচীন নিষাদকুল, ওই শ্যামলিনী, চাষি মেয়ের পেশল বাহুই আমাদের প্রতিষ্ঠানের, কবন্ধ মূল্যবোধের বাইরে আনতে পারে । এ সম্ভাবনার দরোজা কি খুলবে ? মলয় রায়চৌধুরীর এ-প্রশ্নকেই রেখে দেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার তাৎপর্য এখানেই । মলয় এভাবেই ষাটের দশক থেকে পালটেছেন -- যেতে চাইছেন সময়ের গভীরে, তার নাভিকেন্দ্রে ।


          




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন