রাহুকেতু : মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস
কলকাতার উত্তর-শহরতলিতে, রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারী অসীম গাঙ্গুলি মশায়ের ওঝাপুর বাড়ির নড়বড়ে কাঠের গেটের ভেতরে ঢুকে, সে-ই শেষবার, রাহুলের, তখন কত বয়স হবে, মমমমমমমমম, থাকগে, যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, মনে পড়ে গেল, কানপুরের অশোক নগর থানায় হাজতবাসের কথা । উত্তরবঙ্গের কোনো জোতদারের বাগানমহল ভেঙে তৈরি হয়েছিল অসীমবাবুর ওঝাপুরের সেই ভাড়া-করা ছয়-ফ্ল্যাটের কোঠাবাড়ি ।
হাজতের অন্ধকারে, রাতের মশাগুঞ্জনের বহুভাষি ঝাঁকের খেয়ালি ঘুর্ণির ভেতর দিয়ে মেঝেয় ছিটকে পড়ল, রাহুলের হাঁটুতে ধাক্কা খেয়ে, একজন মানুষ, যে, গন্ধ থেকে যেটুকু আঁচ করা গেল, কানপুরি-ঠররার নেশায় বস্তাপ্রতিম কেউ হাড়গিলে । ঘরের মধ্যে আগে থাকতে কতজন যে রয়েছে তা জানতে পারছে না রাহুল ; কেবল বুঝতে পারছে যে বেশ কয়েকজন মানুষ, যারা পুলিশ আইনপ্রণেতা আর যে বা যারা তাদের আইনের প্যাঁচে পাকিয়ে হাজতে ঢুকিয়ে দিয়েছে, তাদের সবাইকে হিন্দির বহুপ্রচলিত খিস্তিগুলো বিড়বিড়িয়ে চলেছে, একনাগাড়ে, সেই যখন থেকে রাহুলকে পোরা হয়েছে এই অচেনা দুর্গন্ধের ছোট্টো স্যাঁতসেতে লক-আপে ।
রাহুলকে, ওর বয়স তখন কত হবে, মমমমমমম, থাকগে, যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, অমনভাবে ছুঁড়ে ফেলা হয়নি ; পিঠে ঠেলা মেরে ঢোকানো হয়েছিল অন্ধকারে, আহ্লাদী মশাদের ঘুর্নিগুঞ্জনে, হাত থেকে হাতকড়া আর কোমরের দড়ি খুলে । কানপুর শহরের জুহি পরমপুরওয়া বস্তি, যেখানের নিচুজাতের কালচে-তাগড়াই হিন্দু কাঙালি আর হতদরিদ্র ডিগডিগে শিয়া মুসলমানদের অবাঙালি পাড়ায় ওর শৈশব কেটেছে, সেখানকার প্রতিদিনের কথোপকথনে ব্যবহৃত এই সমস্ত খিস্তির সঙ্গে রাহুল অতিপরিচিত , তাই ওর মধ্যবিত্ত সংবেদন, এখন অশোক নগরে চলে গেলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর হলেও, নাড়া খেল না।
পাশের জনানা হাজত থেকে নারীকন্ঠে শোনা গেল, “দারোগাজি, অব তো বত্তি জলাইয়ে, অন্ধেরে মেঁ মরদ ইয়া মেহরারু কওন ঘুসে যা রহা হ্যায় পতা নহিঁ ।”
কিছুক্ষণ পর, দুর্গন্ধকে আরও অসহ্য করে, আলো জ্বলল ।
টিমটিমে পঁচিশ ওয়াটের হলুদ-টুনির বিজলিবাতিতে চোখ সয়ে গেলে , ইংরেজ আমলের হলদেটে ঘরের, খুপরি-জানলার মরচেপড়া শিক ধরে, রাহুল দাঁড়িয়ে ছিল, দশ বাই দশ হবে চুনকামহীন ছ্যাদলাপড়া ঘরটা, ঔপনিবেশিক লোহার জংধরা বরগা, দেখল, হেটো-ধুতি আর ময়লা গেঞ্জি-পরা দুজন তামাটে মজবুত প্রৌঢ় উবু হয়ে বসে দেয়ালে ঠেসান-দেয়া একজন পাজামা-কুর্তায় চওড়াকাঁধ তাগড়া যুবকের পা টিপছে, দু’জন খালিগা চাক-কাটা লুঙ্গিতে রোগাটে প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে ফিসফিসোচ্ছে, কোনের দিকে একটা কোঁচাকাছা-ধুতি-হাফশার্ট যুবক বসে আছে বেঢপ ঢঙে, কেননা তার হাত থেকে হাতকড়া খুলে দেয়া হয়নি , রোগা শিড়িঙ্গে মাতালটা মেঝেয় আর ও, সব মিলিয়ে আটজন।
এক কোনে, যেখানে ঝাঁঝালো চটচটে-হলদে পেচ্ছাপ জমে আছে, সেখানে, যেহেতু লক-আপে পেচ্ছাপ করার কোনো ব্যবস্হা নেই, যার পা টেপা হচ্ছিল, তার নির্দেশে, মাতালটাকে টেনে বাঁধের কাজে লাগানো হল, যাতে পেচ্ছাপের স্রোত ঘরের ভেতর এসে অন্যান্যদের না ভেজায় ।
“ই বেওড়াকো ঠিক সময় পর ভেজিস ভগওয়ান”, বলল দাঁড়িয়ে থাকা ঢ্যাঙা কালো লোকটা ।
লোকগুলোর কথাবার্তা থেকে, পরের দিন ফৌজদারি আদালত-চত্তরের কাঁকরে বসে জিরোবার সময়, রাহুল জানতে পারবে, কাকে কোন আরোপে পোরা হয়েছে গারদে । যে পা টেপাচ্ছিল সে আর তার দুজন স্যাঙাত কাল বিকেল থেকে রয়েছে, ডাকাতি করতে গিয়ে পাবলিকের হাতে ধরা পড়ে পিটুনি খেয়েচে ; পুলিশ ওদের নেতার ঠ্যাঙে বাড়ি মেরে-মেরেও, ডাকাতির মালপত্তর কোথায় লুকিয়ে রাখে, তা তখনও পর্যন্ত জানতে পারেনি বলে, কোর্টে তোলেনি ; ওরা মুখ খোলেনি, যাতে সময় থাকতে বাদবাকি স্যাঙাতেরা সেগুলো অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলতে পারে । দাঁড়িয়ে যারা ফিসফিস করছিল, যে দু’জন, তাদের একজন বলল তাকে চুরি করার আরোপে বাড়ি থেকে তুলে আনা হয়েছে, যদিও সে বহুদিন চুরি করতে বেরোয়নি, অন্য ছোঁড়াটা আরেকজন চোর, যেদিন চুরি করে তার পরের দিন উনোনে আগুন জ্বলে, চুরি না করে উপায় নেই ; জামিন পায় ভালো, আবার চুরি করতে যাবে, না পেলে ওর বউ গঙ্গার ধারে অন্ধকারে খদ্দের ফাঁসিয়ে, একটাকা-দুটাকা যা পায়, দু’চার খেপ সাঁঝনি করে আসবে । যার হাতকড়া রাতের বেলাও খোলা হয়নি, সে, হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া বালিশ-পেট সেপাইয়ের তথ্য অনুযায়ী, তার কাকাকে খুন করার পর পরিবারের
লোকেদের জাপট ছাড়াতে পারেনি । অন্যজন পকেটমার, সাপ্তাহিক কোটায় তাকে তুলে আনা হয়েছে । চশমা-চোখ রাহুলের পোশাক আর গাম্ভীর্যের কারণে ওরা কেউ ওর কাছে ঘেঁষেনি । খৈনি ঠুকে সঙ্গের সেপাই অন্যদের জানিয়েছে যে সে, রাহুল, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো খতরনাক কেতাব লিখেছে ।
টিমটিমে ঝিমন্ত আলো আরেকবার নিভে গেলে, বা নিভিয়ে দেয়া হলে, খিস্তির ঝাড় পুলিশের তরফ থেকে এলো, হুমকিসহ, কথা বলা বন্ধ না করলে পিটিয়ে বেহোশ করে দেয়া হতে পারে । তবু, তাগড়া ডাকাতটা মা-বোনের গালমন্দে ফিসফিসিয়ে জানালো যে পাশের জনানা লকআপে বেশ্যাদের রাতের বেলায় ধরে এনে সিপাহিগুলো ধর্ষণ করছে, পারাপারি করে, কতবার আলো নিভলো তা গুনে বলা যায় যে কটা সিপাহি কবার কিরিয়াকরম করে বেরোল যা থেকে আন্দাজ করা যায় যে থানায় কতজন সেপাই আছে ।
রাহুল, ক্লান্ত, চুপচাপ, পানের পিক শুকনো গয়ের বমি-মাখা দেয়ালে ঠেসান দিয়ে, জানলার তলায়, এককোনে বসে পড়েছিল, অন্ধকারে মশাদের সঙ্গে ছারপোকারাও নতুন কুটুম পেয়ে তাদের উপস্হিতির মুফত-চুলকানি জানাতে শুরু করেছে, টের পেল । মাতালকে টেনে বাঁধের কাজে লাগালেও পেচ্ছাপের কিলবিলে স্রোত উঁকি মারতে-মারতে ওর দিকেও পৌঁছে গেছে । লকআপে ঢুকলে মানুষের বেশি পেচ্ছাপ পায় ।
দুপুরে, অফিস-প্রধানের তিন তলার সিনথেটিক কার্পেটপাতা ঘরে ডেকে-পাঠিয়ে রাহুলকে বলা হয়েছিল, এই দুজন কলকাতা থেকে এসেছেন, আপনার সঙ্গে কোনো ব্যাপারে কথা বলতে চান ; নিচে যান, যা আলোচনা করার অফিসের বাইরে গিয়ে করুন। অফিস-প্রধানের নির্দেশে অবাক রাহুল দুই আগন্তুকের সঙ্গে পথে গিয়ে নামার পর তারা দুদিক থেকে ওর জামা খামচে ধরে বলে ওঠে, পালাবার চেষ্টা করবেন না, আমরা বলপ্রয়োগ করতে বাধ্য হবো, আপনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে, আমরা লালবাজার পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ থেকে এসেছি ।
রাহুল বিমূঢ় হতবাক থ । বলল, ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না, অপরাধটা কী ? অনুমান করল যে এরা অফিস-প্রধানকে বিস্তারিত জানিয়ে থাকবে, তাই, রাহুল যাতে অফিস কর্মীদের সামনে অপদস্হ না হয়, আর ওর গ্রেপ্তারিতে অফিস যাতে জড়িয়ে না পড়ে, সেকারণে উনি অফিসের বাইরে গিয়ে কথাবার্তা চালাতে বললেন ।
–আপনার বাড়ি নিয়ে চলুন, সেখানেই জানতে পারবেন ।
একটা রিকশ ডেকে ওকে মাঝখানে বসিয়ে দুজনে দুদিক থেকে রাহুলের বাহু আঁকড়ে ধরে রইল । রিকশঅলা বলল, হুজুর তিনজন বসলে পুলিশ ধরবে আমায়, এখনও তেমন রোজগার হয়নি যে ছাড়াবার হাতখরচ দেবো । মোটা গোছের লোকটা রিকশঅলার মাথায় কশে চাঁটি মেরে বলল, আমরাই পুলিশ, তোকে বলা হচ্ছে, তুই চল, অশোক নগর । তাই না, মিস্টার রাহুল সিংহ ?
এরা ওর বাড়ির হদিশও জানে দেখছি, নিজেকে নিঃশব্দে বলল রাহুল ।
বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখল একটা পুলিশ জিপ দাঁড়িয়ে, স্হানীয় পুলিশের লাঠি আর বন্দুকধারীরা আগে থাকতেই ঘিরে রেখেছে পুরো বাড়ি । হ্যাঁ, পুরো বাড়ি, চারিদিক থেকে । এক সঙ্গে এত পুলিশকর্মীকে এ-পাড়ায় আগে দেখা যায়নি বলে অনুসন্ধিৎসু জনতার গুজগুজানি ভিড় । স্হানীয় পুলিশের টাকমাথা ইন্সপেক্টর আর কলকাতার দুই পুলিশ অফিসার রাহুলকে নিয়ে ঢুকল বাড়ির ভেতরে ।
রাহুলের বাবা দরোজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, বললেন, তোর কিছু লেখালিখির জন্যে এরা কলকাতা থেকে তোকে গ্রেপ্তার করতে এসেছে , আমি দিনুকে খবর পাঠিয়েছি, বসন্তবাবুকে জানাতে । তোর দুজন বন্ধু পরশু দিন অ্যারেস্ট হয়েছে, তাদের কাছ থেকে তোর অফিসের আর বাড়ির ঠিকানা যোগাড় করে এসেছে কলকাতার পুলিশ । দিনু বা দীননাথ রাহুলের জাঠতুতো দিদির স্বামী । বসন্তবাবু বা বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় দিনুর আত্মীয়, শহরের সবচেয়ে নামজাদা আর দামি অ্যাডভোকেট ।
ভাড়ার জন্য রিকশঅলাটা ঘ্যানর-ঘ্যানর করছিল দেখে রাহুলের বাবা ভাড়াটা মিটিয়ে দিলেন ।
রাহুলের বাবার কাচের আলমারিতে পেপারওয়েট মেরে কলকাতার রোগাটে পুলিশ অফিসার বলল, আমাদের কাছে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে, খানাতল্লাসি করা হবে । আলমারিগুলো খুলে দিন ।
–আমার আলমারির কাচ ভাঙছেন কেন, আশ্চর্য ? ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ তো ওর পড়ার ঘরে গিয়ে তল্লাসি চালান । বললেন, রাহুলের বাবা, বেশ উত্তেজিত, কাঁপছিলেন । প্রত্যুত্তরে সে বলল, পুরো বাড়ি তল্লাসি করা হবে, ষড়যন্ত্রের অভিযোগও আছে, একশো কুড়ি বি, জানেন তো, একশো কুড়ি বি আই পি সি ? রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ? ইতিহাস পড়া আছে নিশ্চয়ই ? রাজনারায়ণ বসু, অরবিন্দ ঘোষ, বলবন্ত ফাড়কে, দামোদর চাপেকর, ওনাদের ধরার
জন্য এই আইন পাশ হয়েছিল । আপনার তো গর্ব হওয়া উচিত । আপনার ছেলেকেও ধরা হচ্ছে সেই অভিযোগে । আমি কলকাতা পুলিশের এস আই মুখার্জি আর উনি এস আই বারোড়ি ; লোকাল থানার এই অফিসারকে চিনে রাখুন,
মাঝে-মাঝে রোঁদে বেরিয়ে আপনার বাড়িতে ঢুঁ মারতে পারেন, ইনি ইন্সপেক্টর আবদুল হালিম খান ।
ঘোড়েল সাবইন্সপেক্টর, পুলিশ ট্রেনিঙে শেখা বুলি আউড়ে গেল ।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে তিন অফিসার বিভিন্ন ঘরে চলে গেল । রাহুল শুনতে পেল ওর মায়ের প্রায়-কেঁদেফেলা কন্ঠস্বর, আপনারা যে কাজ করতে এসেছেন তা করুন, আমার বিয়ের তোরঙ্গ ভাঙছেন কেন ? বললে তো আমিই খুলে দিতুম । তোরঙ্গ হাঁটকাচ্ছেন কেন ? ওটা আমার বিয়ের বেনারসি, ছিঁড়ে যাবে, ছিঁড়ে যাবে, অনেক পুরোনো, ওভাবে হাতড়াবেন না, ওটা আমার শ্বশুরমশায়ের বিদেশে-পাওয়া ফোটোগ্রাফির পদক ।
তার মানে এদের উদ্দেশ্য কেবল ওকে গ্রেপ্তার আর ওর লেখা সংক্রান্ত নয়, স্পষ্ট হল রাহুলের কাছে । ওর বাবা-মাকে, অপমান করার মাধ্যমে, আঘাত দিয়ে, ওকে ঘিরে ফেলার, অবদমনের, দুমড়ে-ফেলার প্রয়াস । কোন লেখা, কোন বই, কিছুই ওকে বলা হল না, অথচ ব্রিটিশ আমলের লাল-পাগড়ির ঢঙে ভাঙচুর লণ্ডভণ্ড করতে নেমেছে । কী ধরণের ষড়যন্ত্র, কাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র, আঁচ করতে পারছিল না । মুখার্জি নামের সাব ইন্সপেক্টার ওর পড়ার ঘরে ঢুকে আলমারি থেকে বইপত্র ছুঁড়ে-ছুঁড়ে মেঝেয় ফেলতে থাকলে রাহল বলল, ‘’এগজ্যাক্টলি কি খুঁজছেন জানালে ভালো হয়, আপনি রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শেকসপিয়ার সবাইকেই হেনস্হা করছেন ওভাবে মাটিতে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ।’’
–হ্যা হ্যা, ওনাদের হাড়-পাঁজর ভেঙে গেল বোধহয়, হ্যা হ্যা । বলল সাব ইন্সপেক্টর ।
লোকটা বদল্যার, র্যাঁবো, টলস্টয়, কাফকা, ডস্টয়েভস্কিতে হাত দিল না, এমনকি ফ্যানি হিল, হ্যাভলক এলিস আর হেনরি মিলারেও, সম্ভবত সেগুলো পেপারব্যাক বলে ,বা নাম শোনেনি বলে ।
–আপনার কাছ থেকে আমরা জ্ঞান নিতে আসিনি, কোন বই কার লেখা তা জানা আছে । আপনার লেখার খাতা, ডায়রি, বন্ধুদের চিঠিপত্র, কোথায় রেখেছেন, সব বের করুন । রাহুল ওর পড়ার টেবিলের পাশের আলমারি খুলে দিয়ে জানাল, এখানেই সবকিছু পাবেন ।
খান সাহেব, একঠো কনোসটেবোলকো ওপর মেঁ বোলাইয়ে, বলল মুখার্জি । জনৈক কন্সটেবল এলে তার হাতে তুলে দিতে থাকল, সম্ভবত যা যা চাই ।
রাহুলের বাবা-মা’র ঘর লণ্ডভণ্ড করার পর সাব ইন্সপেক্টর বারোড়ি রাহুলের পড়ার ঘরে ঢুকে বলে উঠল, এই টাইপরাইটারটা তো টানা মাল মনে হচ্ছে, এটাও নিয়ে নে, কন্সপিরেসির চিঠিচাপাটি এতেই লেখা হয় নিশ্চই । রাহুল বলল না যে টাইপরাইটারটা একজন বিদেশি পত্রিকা-সম্পাদকের পাঠানো ।
টাইপরাইটারসহ রাহুলের টেবিলে রাখা পাণ্ডুলিপি, দুটো ডায়েরি, ওর আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত লিফলেটগুলো, অসীম গাঙ্গুলি, প্রদীপন চাটুজ্জে, রক্তিম চাটুজ্জে, হরিচরণ খাঁড়া, সুকোমল রুদ্র আর অন্য বন্ধুদের লেখা চিঠিপত্রের দুটো ফাইল, একটা ভারতীয়দের চিঠি আর অন্যটায় বিদেশি লেখকদের, দাদা অনিকেতের সদ্য প্রকাশিত বইয়ের সব কয়টি কপি, বিদেশি সাহিত্য পত্রিকা আর যা যা ওদের মনে হল মামলা সাজাতে কাজে দেবে, বা রাহুলের লেখালিখির প্রবাহকে নষ্ট করতে পারবে, বা ওর মগজকে ফাঁকা করে তুলতে পারবে,সবই জড়ো করে তালিকা তৈরি করতে বসল মুখার্জি । চিঠিপত্রের ফাইলের ভেতরে একটা খামে জনৈকা ফরাসি মহিলার ফোটো আছে যা অসীম গাঙ্গুলি বিদেশ থাকার সময়ে চিঠির সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন । বিদেশিনীর ফোটো দেখে এরা নোংরা রঙ্গ-তামাশা করতে পারে ভেবে রাহুল চেপে গেল।
বার্ধক্যে পৌঁছে রাহুলের আপশোষ হয় যে ফোটোগুলো নিতে বারণ করা উচিত ছিল । করেনি, কেননা এক সপ্তাহ আগে সিংহবাহিনী নামে কেউ একজন আমহার্স্ট স্ট্রিট পোস্ট অফিস থেকে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল, ‘’বি কেয়ারফুল। রামায়ণ নট্ট কোম্পানি’জ অধিকারী হ্যাজ কাম ব্যাক ।’’ কে যে টেলিগ্রামটা পাঠিয়েছিল, তা বহুকাল জানতে পারেনি রাহুল ; জানতে পারল যখন তখন ওর বয়স , মমমমমমমমমম, থাকগে, যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, আর ওর প্রথম উপন্যাসের প্রুফ দেখতে বসে বলে উঠেছিলেন গেঞ্জি-লুঙ্গিতে মল্লিকমশায়, ‘’আপনাকে তো আমি সতর্কতার টেলিগ্রাম করেছিলাম, যা ষড়যন্ত্রের আবহাওয়া কলকাতায় সেসময়ে তৈরি হয়েছিল, নানা কথা কানে আসছিল।’’
–ওঃ, আপনি করেছিলেন ? সিংহবাহিনী শব্দটার জন্য ঠাহর করতে পারিনি ।
–কেন ? কেতু তো কলেজে পড়ার সময় থেকে প্রতিবছর সিংহবাহিনীর পুজোয় আমার বাড়ি এসেছে ।
–আসলে জানা ছিল না ; তাছাড়া তখন তো আপনার সঙ্গে পরিচয় ছিল না ।
–ওহে, আমাকে এ-পাড়ায় এক ডাকে লোকে চেনে ; এক ডাকে মানে এক ডাকে, বুঝেছ ।
–কেয়ারফুল হয়েই বা কী করতুম বলুন । বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে তো আর যেতে পারতুম না । এক পুলিশ
কনস্টেবল অবশ্য লকআপ থেকেই পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দিয়েছিল । পালাইনি বলে আমায় বলেছিল বেবকুফ ।
–ওতো বিখ্যাত হে । তিনটে শব্দকে আলাদা আলাদা করে যদি পড়তে তাহলে বুঝতে পারতে । রামায়ণ, নট্ট আর কোম্পানি ।
–ভালো আইডিয়া দিলেন । কখনও যদি এই-সমস্ত ঘটনা নিয়ে লিখি তাহলে আপনার এই ফ্রেজটা প্রয়োগ করব।
মল্লিকমশায় মারা গেছেন । আজকে লিখতে বসে ওনার পাঠানো টেলিগ্রামটার কথা মনে পড়ল রাহুলের ।
আবদুল খান আর বারোড়ি তিনতলার ঘরে সংগ্রহযোগ্য এগজিবিট খুঁজতে যাবার নাম করে আরও কিছু জিনিসপত্র ভাঙচুর-লণ্ডভণ্ড করে এলো । ওই ঘরটায় বাবার সংগ্রহের উনিশ শতকের শেষে ঠাকুর্দার তোলা ফোটোর বহু নেগেটিভ প্লেট সযত্নে রাখার ব্যবস্হা। একটা তাকের সব প্লেটগুলো যে ভেঙে ফেলা হল, তা ভাঙা-কাঁচের ছেতরাবার আওয়াজ থেকে আঁচ করল রাহুল, যা, পরে, বাড়ি ফিরে সত্য বলে জানতে পেরেছিল । ওর লেখালিখির সঙ্গে যে এভাবে বহুমূল্য সংগ্রহ নষ্ট হয়ে যেতে পারে সে ধারণা ছিল না , আর, পরে, যখনই ও প্রাচীন ফোটোর কোনো প্রদর্শনীতে গেছে, বা সে-বিষয়ে কোনো বইয়ের পাতা উলটেছে, অপরাধবোধে ভুগেছে । বাবা মারা যাবার পর, তখন রাহুলের বয়স কত,মমমমমমমম,বাহান্ন, হতে পারে, যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, ওর থিতিয়ে-যাওয়া সেই অপরাধবোধ ফিরে এসে কাঁদিয়ে দিয়েছিল ওকে ।
বাবা মারা গিয়েছিলেন কানপুরে, আর রাহুল তখন ভূবনেশ্বরে ট্যুরে । দাদা অনিকেতের টেলিফোন পেয়েও তৎক্ষণাত ও কানপুর যায়নি ; কয়েকদিন পরে গিয়েছিল, স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে মুম্বাই থেকে তুলে নিয়ে ।
রাত নটা নাগাদ বাজেয়াপ্ত বইপত্র জিপগাড়িতে তুলে চলে গেল পুলিশের অফিসাররা । রাস্তা থেকে দু’জন লোককে, তারা কর্পোরেশনের ঝাড়ুদার, ডেকে এনেছিল, বাজেয়াপ্ত জিনিসের তালিকায় সই করার জন্য ।
রাহুলকে হাতে হাতকড়া পরালো একজন কনস্টেবল, কোমরে দড়ি বেঁধে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল । পাড়ার সকলে ওকে ছোটোবেলা থেকে চেনে । সরকারকে উৎখাত করার কী এমন বই লিখেছে, বই লিখলে সরকার উৎখাত হয় কিনা, একাধজন কাছে এসে জানতে চাইলেও, জবাব দেবার মতন মনস্হিতি ছিল না রাহুলের । নটা বেজে যাবার দরুণ দোকানপাট বন্ধ হয়ে রাস্তাঘাট প্রায় অন্ধকার ; তার মাঝখান দিয়ে বকলস-পরা কুকুরের মতন চলল ও, রশির এক প্রান্ত জনৈক ক্লান্ত-বিরক্ত কনস্টেবলের হাতে ।
একটা সাদা-কালো নেড়িকুকুর, পুলিশ দেখে, কিংবা ওকে ওভাবে দেখে, চেঁচিয়ে অন্য কুকুরদেরও খবর পাঠালো। ওভাবে একজন দর্শনীয় অপরাধী-মানুষ হিসাবে, হাঁটতে-হাঁটতে, দড়ির টানে হাঁটতে-হাঁটতে, রাহুল ক্রমশ টের পাচ্ছিল, যে, সমাজের ভেতরে থেকেও, কী ভাবে সে আলাদা হয়ে চলেছে, হেঁটে-হেঁটে বিচ্ছিন্ন হয়ে চলেছে, স্বয়ংসম্পূর্ণ একক হয়ে চলেছে, সবায়ের থেকে ক্রমশ পৃথক হয়ে চলেছে । ফুলশার্ট ট্রাউজার চশমা পরা একজন যুবককে, হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাবার ঘটনা, এই রাস্তায়, আগে কখনও ঘটেনি মনে হয় ; রাস্তার দু’পাশের জনতা, যারা নিজেদের দোকানপাতি গোটাতে ব্যস্ত, ওর দিকে তাকিয়ে ।
আলাদা হবার অভিজ্ঞতায় যে লুকোনো হর্ষ, গোপন আহ্লাদ, চাপা গর্ববোধ, আর অতিক্রমণের নিরাময় থাকতে পারে, তা ওর ভাবনায় স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, কোমরে দড়ি আর হাতে হাতকড়া পরা অবস্হায় । অথচ আলাদা তো হতে চায়নি ও, রাহুল ।
জীবনে এই অভিজ্ঞতা অত্যন্ত জরুরি ছিল । এই ঘটনার পর আর কোনো আক্রমণ, সমালোচনা, টিটকিরি, খোঁচা দিয়ে বলা কথা ওর অপ্রিয় লাগেনি, লাগে না, অপমানজনক মনে হয়নি, হয় না । অপ্রিয়, এই শব্দটাই অকর্মণ্য হয়ে গেছে রাহুলের ক্ষেত্রে, এক্কেবারে ফালতু ।
হাজত থেকে কানপুরের ফৌজদারি আদালতে যাবার দিন ভোরবেলা, থানায় এসেছিলেন সুমিতাদি, সুমিতা চক্রবর্তী, গায়ে কাশ্মিরি শাল চাপা দিয়ে, বেশ উদ্বিগ্ন, বলেছিলেন, আজকের ডেইলি পায়োনিয়ারের প্রথম পাতায় তোর গ্রেপ্তারির সংবাদ পড়ে নিজেকে সামলাতে পারলাম না, নাউ ইউ হ্যাভ ডান ইট, রাহুল, ইউ হ্যাভ ডান ইট,বৈঠকখানা থেকে পথে নামার ছাড়পত্র পেয়ে গেলি, কনগ্র্যাচুলেশান্স । অন্য কয়েদিদের অবাক করে, গরাদের ভেতর হাত বাড়িয়ে রাহুলের চুলে বিলি কেটে দিয়ে, বেবি অস্টিন চালিয়ে চলে গিয়েছিলেন ।
ওঝাপুরের পথে, রাহুলের বয়স তখন কত, বোধহয় সত্তর, মমমমমমমম, থাকগে, সে যা-ই হোক, কী-ই
বা এসে যায়, ফ্ল্যাট অনুসন্ধানকালে, একজন বিদেশিনীকে দেখে, পুলিশের বাজেয়াপ্ত-করা ফোটোগুলোর স্মৃতি উসকে ওঠায়, কয়েক দশক আগের ওই ঘটনাগুলো আচমকা মনে পড়ে গেল ।
‘আরে, আমি তো এ- জায়গায় এসেছি আগে, অনেক বছর আগে, বেশ কয়েকবার এসেছিলুম’, রাহুল সিংহ, যার গায়ের চামড়া হয়ে গেছে মরচেপড়া লোহা, বলল তিরিশোর্ধ ছেলে পার্থপ্রতিমকে । রাহুল আর ওর স্ত্রী সুমনা
দুজনেই সত্তর পেরিয়েছে, তাই পার্থপ্রতিম , নিজের বাসার কাছাকাছি সাংসারিক আসবাব সমেত একটা ফ্ল্যাট দেখাতে নিয়ে এসেছিল । যে ফ্ল্যাটের ভাড়া সে-সময়ে ছিল একশ টাকা, তা এখন কুড়ি হাজার ; যে ফ্ল্যাটের দাম ছিল এক লাখ টাকা, তা এখন এক কোটি । যে পথে ছিল সবুজ গাছগাছালি, সে পথ নিজেই নিজেকে খুঁজতে বেরিয়ে
চুন-বালি-ইঁট-সিমেন্টে-দেয়াল শ্লোগানে নিরুদ্দেশ । ধানখেত ছিল, ছিল ধানখেতের সবুজ বাতাস, ছিল চাষি ; ছিল পুকুর, পুকুরে হাঁস, হাঁসের ডাক, মাছের আচমকা ঘাই ; সেসব কোথ্থাও নেই ।
একই বাড়িতে একই পাড়ায় একই শহরে বেশিদিন থাকতে পারে না রাহুল , পারেনি, ফলে, এতদিন ছিল পশ্চিমবাংলার বাইরে একের পর এক প্রবাসে । ওর মনে হয়, একই মানুষের দ্বারা পরিবৃত থাকবার ফলে জীবন ও জীবনবীক্ষা মামুলি ও ক্ষুদ্র হয়ে পড়ে । নতুন কিছু ঘটার সম্ভাবনা সীমিত হয়ে যায় । যদিও রাহুল রেকলুজ প্রকৃতির, একা থাকতে পছন্দ করে, কম কথা বলে, কিন্তু ওর চারিদিকের মানুষদের কথাবার্তা ও জীবনযাত্রায় আগ্রহের কারণে, একই বাড়ি-পাড়া-শহরের ঘানিতে পাক খেয়ে, একই মানুষের মুখ অবিরাম দেখে-দেখে ও তাদের কথাবার্তা শুনে, কিছুদিনের মধ্যেই দমবন্ধ, ক্লান্ত ও হতাশ বোধ করে । হ্যাঁ, ঠিকই, অন্যের জীবনের রুটিনবদ্ধ-ঘটনাহীনতা, ওর জীবনকেও ঘটনাহীন করে তুলতে পারে এমন আশঙ্কায় পীড়িত হয় । যে-শহরেই থেকেছে, একা-একা রাস্তায়-রাস্তায় হেঁটেছে, চাকরি করার সময়ে ছুটির দিনে, অবসর নিয়ে প্রতিদিন ।
প্রতিটি ঘরের নিজস্ব উদাসীনতার যন্ত্রণাক্লিষ্ট বা আনন্দঘন সুবাস হয়, প্রতিটি বাড়ির নিজস্ব নয়নসুখ আলোবিচ্ছুরণ আর ঘনান্ধকারের রহস্য , প্রতিটি পাড়ার নিজস্ব বুলির গুঞ্জনমালা বাতাসকে ভারাক্রান্ত বা হালকা স্পর্শে ভাসায়, প্রতিটি শহরের নিজস্ব কথাপ্রণালীর কাহিনিময় শব্দতরঙ্গ চতুর্দিক মথিত করে । সে-কারণে চিরকাল নতুন সুবাস, আলো, গুঞ্জন ও শব্দতরঙ্গের অনুসন্ধানে ক্ষণিক-তীর্থের উদ্দেশ্য-সন্ধানী যাযাবরের মতন একা চরে বেড়াবার প্রয়াস করে গেছে রাহুল । তা করতে গিয়ে, ওর দেহের এমনই ক্ষতি হয়েছে যে সত্তরে পৌঁছে, এক-একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের হাতে এক-একটা অঙ্গ আর প্রত্যঙ্গ সোপর্দ করে দিতে হয়েছে ।
জীবনের বাঁকবদলগুলো অন্যের হাতে ছেড়ে দেয়নি। ওকে নিয়ে, সময়ের রঙের সঙ্গে তাল দিয়ে, এক জিভ থেকে আরেক জিভে, তা থেকে আরও-আরও জিভে, বহু গল্পের লাফালাফি হয়েছে, হয়ে চলেছে আজও, জানে ও । গল্প যারা তৈরি করেছিল, তারা প্রায় কেউই আর নেই ; নানা রকম রোগ তাদের দখল করে শ্মশানে বা কবরে তুলে নিয়ে গেছে । ও-ভাবে উঠে যাওয়ায়, অনেকের ক্ষেত্রে, রাহুলের মনে হয়েছে, গুড রিডেন্স অব ব্যাড রাবিশ, যা ও বলেওছে কাউকে-কাউকে, যারা কখনও-সখনও রাবিশের স্তুপ থেকে মুণ্ডু বের করে ওর দিকে পিটপিটিয়ে তাকিয়ে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছে ।
গোরখপুরে ট্যুরে গিয়ে, সেখানের কৃষি আধিকারিক হরিশচন্দ্র শর্মা, ওকে নিয়ে গিয়েছিল গোরখনাথ মন্দিরে, রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমম, বোধহয় চুয়াল্লিশ, থাকগে, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, এক সাধু হঠাৎ দৌড়ে এসে জটাপড়া দাড়ি ওর মুখে ঘষে দুর্গন্ধিত হাঁ-মুখ খুলে নোংরা দাঁতের হাসি ছড়িয়ে বলেছিল, ‘’দীকছা অওর আশির্বাদ দে রহা হুঁ তুমহে, জয় ভোলেনাথ, কোই ভি আদমি, যো তুমহারে সাথ দুশমনি করেগা, ও্য়হ তুমসে পহলে মর যায়গা ।’’ তখন রাহুলের ফালতু, বিরক্তিকর, লেগেছিল নোংরা-গেরুয়াল্যাঙোট সাধুর ছাইমাখানো বুকনিটা, কেননা ওর পৈতের সময় পুরুতমশায় তেরো বছর বয়সেই ওকে দীক্ষা দিয়েছিলেন, কানে-কানে গায়ত্রীমন্ত্র, যা এখন মোবাইলের কলার টিউন বা অ্যালার্মে বাজে । অনেক সময়ে নামজানা কেউ মারা গেলেই রাহুলের ঘুমন্ত আতঙ্ক চাগিয়ে ওঠে, আর মনে হয়, আরে, কি ভয়াবহ, এ লোকটা তো সত্যিই শঠতা করেছিল, পেছনে লেগেছিল ।
কাচের বাসন ভাঙার আওয়াজে বাবার দুশ্চিন্তিত মুখ ভেসে ওঠে । কোনো ফ্যক্ট্রিতে লোহা বা টিন পেটার ঠুংঠাং ধ্বনি উঠলে মায়ের বিয়ের তোরঙ্গের কথা মনে পড়ে ।
একদিন দুপুরে, তরুণ নট তীর্থংকর গুহরায় রাহুলকে ফোনে জানালো যে সুপ্রসিদ্ধ মাতাল এবং স্বল্প-পরিচিত নট প্রভাস চোঙদার মারা গেছে, ঠিক সেই সময়ে, প্রভাসেরই অপেরার একটা রচনাংশ, রাহুলকে উদ্দেশ্য করে লেখা,
পড়ছিল, এমনি-এমনি, ডাকে বহুদিন আগে পাঠিয়েছিল প্রভাসেরই বধিবিহার-নিবাসী জ্ঞাতি, “এই তো উনি
সকালবেলায় দাড়ি মুখ পয়পরিষ্কার করলেন — বেরোনোর আগে –, বৌয়ের হাত থেকে মায় চুন অবধি — কিন্তু আর ফিরে এলেন না — হয় এরকম — তাছাড়া আমাদের বাবারা আমাদের জন্য কোনো উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারেননি — রাখবার কথাও ছিল না অবশ্য–” । টেলিফোনটা রিসিভারে রেখে স্তম্ভিত রাহুল, নাকে এসে লাগল গোরখপুরের সাধুর জটার দুর্গন্ধ । কী করে প্রভাস নিজের মৃত্যুর কথা গোরখপুরের সাধুর কাছ থেকে আগাম জেনে ফেলেছিল ! প্রভাস যখন
লিখেছিল, তখন রাহুলের বয়স, মমমমমমমম, বোধহয় পঁয়ত্রিশ, থাকগে, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, অথচ এতকাল পড়েনি । পড়তে বসল কিনা প্রভাস চোঙদারের মৃত্যুর দিন, যেদিন থেকে ও আর ফিরবে না !
তিরিশ বছর পরে, কলকাতায় ফিরে, প্রভাস চোঙদারের মফসসলের বাড়িতে গিয়েছিল অনিকেত আর রাহুল, ওকে আগাম না জানিয়ে । লোকাল ট্রেন থেকে নেমে, রিকশ ধরবে বলে দাঁড়িয়েছিল, দেখল দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসক দলের
মিছিলে লাল ঝাণ্ডা নাড়িয়ে স্লোগান দিতে-দিতে চলেছে প্রৌঢ় প্রভাস । একদা-প্রতিষ্ঠানবিরোধী আজ কোন লোভে বা ভয়ে শাসকের দলে ভিড়ে গিয়ে তাদেরই ধ্বজা ওড়াচ্ছে ? ওরা অবাক । মিছিলে ঢুকে ওকে ডাক দিতেই, বোঝা গেল, রাহুলের চোখের আয়নায় নিজেকে দেখতে পেয়ে, আঁৎকে উঠল প্রভাস । আরেকজনের হাতে ঝাণ্ডা-পরানো ডান্ডা ধরিয়ে, ওর বাসায় নিয়ে গেল । বাসায় গিয়ে, প্রবেশ করেই, রাহুল দেখতে পেল, দেয়ালে ঝোলানো শাসক দলের মুখ্যমন্ত্রীর ফোটো, এক কোনে ডাঁই করে রাখা লাঠি আর দলের ঝাণ্ডার গোছা, থাকের পর থাক দলীয় সংবাদপত্র । দেখে থ হয়ে গেল ওরা, রাহুল আর রাহুলের দাদা অনিকেত ।
প্রভাস জানাল, উপায় নেই, ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা ভুলে যাও, মফসসলে থাকলে বুঝতে ।
–তাহলে মাঝে-মধ্যে আন্দোলনের নাম করে পত্রিকা প্রকাশ করছ কেন ?
–আন্দোলনকে এইভাবেই জিইয়ে রেখেছি ।
–শাসকের সঙ্গে যোগ দিয়ে ?
–শাসক বলছ কেন ? দ্রোহের মাধ্যমে সমাজকাঠামোয় উলটপালট করছি আমরা, সমাজকে দিচ্ছি বৈপ্লবিক অভিমুখ, গ্রামে গিয়ে দেখে এসো, ঔপনিবেশিক সামন্তকাঠামো আর খুঁজে পাবে না ।
রাহুল বলল, আমি তো পশ্চিমবাংলার গ্রামে-গ্রামে ঘুরে বেড়াবার চাকরিটাই করছি ; তোমরা হেঁসেল থেকে শোবার ঘর, খেত-খামার থেকে দপতর, এমন নজরদারি-জাল বিছিয়ে দিয়েছ, আর মগজ-দখলের নৃত্য চালিয়েছ, যে লোকে কথা বলতে ভয় পায় । দাড়ি-গোঁফ আছে আর হিন্দি-উর্দু জানি বলে অবাঙালির ভেক ধরে তাদের সঙ্গে কথা বলি আর প্রকৃত তথ্য আদায় করি । নতুন সামন্তকাঠামো গড়ে তুলেছ তোমরা প্রতিটি গ্রামে ।
প্রভাসের শরীরের ভাষা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে ওর কাছে প্রতিষ্ঠান শব্দটার মানে পালটে গেছে । ওর ভেতরে যে লড়াই চলছে, তা, ও, প্রভাস, লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে গেল ; প্রতিষ্ঠানের কাছে হেরে যেতে বাধ্য হয়েছে, মফসসলি সন্ত্রাসের চাপে পড়ে । রাহুলকে বলল, তোমার পশ্চিমবঙ্গ-বিশ্লেষণ পড়েছি, সব লেখাই পড়ি, সব নট্ট কোম্পানিতেই তো আজকাল দেখছি তোমার পায়ের ছাপ ।
–তোমার অপেরার অভিনয়ও তো দেখি, আমার আর রাহুল সম্পর্কে তরুণ নটদের যে গালগল্প শুনিয়েছ, তাও জানি, তাদের কেউ-কেউ বলে ফেলেছে । এমনকি নিজের স্ত্রীকেও একজন আন্দোলনকারী ঘোষণা করেছ । কামেশ্বর চোঙদারও তা-ই করেছে । ভালোই, কাউকে বাদ দেবার প্রকল্প তো আমাদের ছিল না, তাই স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সকলকেই অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা যেতে পারে । অনিকেত বলল ।
রাহুল বলল, আমার ছেলে আর মেয়েকে নির্দেশ দেয়া আছে যে তারা যেন কখনও কারোর বিরুদ্ধে আমার লেখালিখি নিয়ে নাক না গলায়, কেননা আমার লেখালিখি উত্তরাধিকারহীন ।
অনিকেত বলল, যাক, তোমার সঙ্গে আবার দেখা হল, তোমার বীশ্ববীক্ষার তারল্যের সঙ্গে পরিচয় হল ; কিন্তু মুচলেকা দিয়েছিলে, সে কথাটা অস্বীকার করো কেন ? প্রদীপন, রক্তিম, চঞ্চল, ওরাও তো পুলিশের সাক্ষী হয়েছিল, কিন্তু কেউই তোমার আর কামেশ্বরের মতন লুকোছাপা করেনি, গল্প বানিয়ে পরের প্রজন্মকে ভুল বোঝায়নি । ওরা কেউই অস্বীকার করে না ।
–হেঁঃ হেঁঃ ।
–আন্দোলনের ইতিহাসকে বিকৃত করার কি সত্যিই দরকার ছিল ? বলল রাহুল ।
প্রভাস চোঙদার কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ গম্ভীর করে, আরোপটা স্বীকার করে নিল । বেশ কিছুক্ষণ পরে বলল, “অসীম গাঙ্গুলি প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে যেভাবে বাইরে থেকে ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন সেভাবে মহাভারত নট্ট কোম্পানির বঙ্কু বোস ভিতর থেকে ভেঙে দিতে চেয়েছেন, কামেশ্বরের কাঁধে বন্দুক রেখে।”
রাহুল বলল, হ্যাঁ, জানি, কলকাতায় এসে তিন-চার বছর কাটিয়ে, অমন ধারণা আমারও হয়েছে ; রামায়ণ নট্ট কোম্পানি যেমন আন্দোলনকে বাইরে থেকে ভেঙে দিতে চাইছিল, তেমনই, মহাভারত নট্ট কোম্পানি ভেতর থেকে ভেঙে দেবার চেষ্টা করে গেছে, মূলত কামেশ্বর চোঙদারের মাধ্যমে । কিন্তু জেলি ফিশদের তো ভাঙা যায় না ।
শাসক-দলের সঙ্গে বেঁধে-বেঁধেই থাকো, বঙ্গকেজিবির ছত্রছায়ায়, বলে, ওর বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছিল অনিকেত।
তারপর তীর্থঙ্কর গুহরায়ের টেলিফোনে প্রভাসের মৃত্যু সংবাদ ; মৃত্যু দিয়ে প্রভাস প্রমাণ করে গেল যে মফসসলি সন্ত্রাসের চাপ আর ও নিতে পারছিল না, পাড়াতুতো নেতাদের এড়াবার জন্য সবসময় মাতাল থাকতে হচ্ছিল । মারা গেল রক্তচাপজনিত হার্ট অ্যাটাকে ।
ওইভাবেই, হঠাৎই, কোনো ভুলে-যাওয়া ঘটনা মনে পড়ে যায় রাহুলের , হয়তো সংবাদপত্রের পাতায় দাঙ্গার খবর পড়ে। রাহুলের বয়স তখন, মমমমমমমমম, বোধহয় বত্রিশ, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়। ফয়জাবাদের এক সংস্হার পরিচালন পরিষদের সদস্য হিসাবে প্রায়ই যেতে হত ওই ঘুমন্ত গঞ্জ শহরে, গ্রামীণ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসাবে । একদিন সংস্হার অধ্যক্ষ বললেন, চলুন আপনাকে অযোধ্যা দেখিয়ে আনি, রাম কোথায় জন্মেছিলেন দেখে যান। অবাক হল রাহুল । বাল্মিকীর মস্তিষ্কপ্রসূত অযোধ্যানগরী আর রাম, ওই মহাকাব্যের বাইরে, প্রচ্ছদ ফুটো করে, বাস্তব জগতে কী করে এলেন ! সত্যই আছে নাকি অযোধ্যানগরী ? অ্যামব্যাসাডরে চেপে গোলাপিফুল পোস্তখেত আর সবুজ ধানখেতের হাওয়া মেখে পৌঁছোল নোংরা ঘিঞ্জি এক জায়গায় ।
অধ্যক্ষ এক ফুলঅলাকে জিগ্যেস করতে, সে বললে, ও রামকোট খুঁজছেন ? ওই বাঁদিকের খোঁড়া রাস্তাটা দিয়ে যান।
এটা অযোধ্যা ? না এলেই তো ভালো হত । কল্পনার অযোধ্যার সঙ্গে তো কোনো মিল নেই, এতই নোংরা, এঁদো, পুজোর দোকানপাটে দমবন্ধ পথগুলোয় গাড়ি ঢোকা মুশকিল । অতএব নেমে হাঁটতে হল , বাঁদরের উৎপাত সামলে । শুকনো খাদের ধারে, আগাছায় ঘেরা, বৃষ্টি আর রোদে কালো , ফাঁকা চুনসুরকি-খসা ইঁটবেরোনো মসজিদকে দেখিয়ে অধ্যক্ষ বললেন, এই যে এইটিই রামের জন্মস্হান । প্রধান গম্বুজ আর তার দু’ধারে ছোটো গম্বুজ , দশরথের প্রাসাদ ।
সুর্যবংশের মহারাজা দশরথের প্রাসাদ !
এটা ? জনশূন্য, লোকজন নেই, একেবারে ফাঁকা, কেবল একজন পাহারাদার দড়ির চারপাই পেতে ঘুমোচ্ছিল প্রবেশপথের সামনে । সে বলল, স্যার আপনারা জুতো খুলে যান । রাহুলের অবিশ্বাস আরও দৃঢ় হল ; দশরথ রাজার বাড়িতে জুতো খুলে যেতে হয়, এরকম কথা বাল্মিকী লিখেছেন বলে তো মনে পড়ল না । সে রাজত্বের সিংহাসনে নির্বাসিত-বনবাসী রাজপুত্রের জুতো রাখা হতো । তখনকার দিনে হয়ত ঘাসের দড়ি দিয়ে বোনা জুতো হতো ; যদিও বাঙালি কবি বলেছেন খড়ম । খড়ম পরে সারা রাজ্যে চলাফেরা অসম্ভব ছিল নিশ্চই ।
ভেতরে, হলঘরসদৃশ এলাকায় ঢুকে আরও অবাক । লম্বাটে ঘরে বেঞ্চ ধরণের একটা বেদির ওপর গোটাকতক মূর্তি রাখা । বাঁদিকের একটা থাম কেবল কালো গ্র্যানিট পাথরের, যার গায়ের ভাস্কর্য দশরথের প্রাসাদের নয় বলেই তো মনে হল । এটা আঁতুড় ঘর? দেয়ালের চুনসুরকি খসে-খসে পড়েছে, দশরথের দাসদাসীরা প্রতিদিন পরিষ্কার করে বলে মনে হল না ।
অধ্যক্ষকে বলল, আপনি আমার কল্পনার মহাকাব্যকে নষ্ট করে দিলেন । তখনও পর্যন্ত, টিভি-জগতের রঙিন রাজা-রাজড়ারাদের জন্ম হয়নি, যারা পরে রোম বা গ্রিসের সৈন্যদের পোশাক পরে দেখা দেবে বিভিন্ন সোপ-অপেরায় । মন-খারাপ করে ফিরে এসেছিল রাহুল ।
বহুকাল পর, রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমমম, বাহান্ন বোধহয়, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, মুম্বাইতে পোস্টেড, শীতকালের কয়েকদিন লাগাতার সংবাদ বেরোচ্ছিল দশরথের সেই প্রাসাদ ধ্বংসের তোড়জোড় চলছে, শেষে টিভিতে দেখল, অজস্র লোকের গেরু্য়া কিলবিল উঠে পড়েছে গম্বুজের ওপর, ভাঙতে আরম্ভ করেছে, ধুলো উড়ছে । মন আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল । আজ আর দশরথের রাজপ্রাসাদকে কল্পনায় আনতে পারে না রাহুল, চোখ বুজলেই দেখতে পায় একজন পাহারাদার, জনশূন্য মসজিদে কয়েকটা মূর্তি, আর অজস্র লোক তাকে ভাঙবার জন্য ওপরে উঠে নাচছে । কল্পনা জবরদখলের নৃত্য।
তার কয়েকদিন পরে, নিজের ফিয়াট গাড়ি ড্রাইভ করে অফিস যাচ্ছিল রাহুল, দেখল, মাহিমের কাছে, রাজপথের
ওপর, মারামারি চলছে, জনগণের এই ধরণের মারামারি এর আগে কখনও দেখেনি ও, রাহুল । কারোর কারোর হাতে লাঠি, তরোয়াল, ছোরা এমনকি. মনে হয়েছিল, জনাকয় লোকের হাতে বন্দুক । তরোয়ালের কোপে, ওর আতঙ্কিত চোখের সামনে, স্বামী বিবেকানন্দ রোডে পড়ে গিয়েছিল দুজন লোক । প্রাচীনকালে যে যুদ্ধ খোলা মাঠে হতো, সৈন্য-সামন্তরা করত, তা করছে খ্যাংরাটে গরিব মানুষের দল । করছে একদল অন্যদলের কল্পনাজগতকে দখল করার
জন্য । মাহিম-ব্যান্ড্রার মোড়ে গাড়ি ঘুরিয়ে ওয়েস্টার্ন এক্সপ্রেস হাইওয়ে দিয়ে সান্টাক্রুজ কোয়ার্টারে ফিরে এসেছিল । পরের দিনের সংবাদপত্রের খবরে জানতে পারল যে অনেক গাড়ি পুড়েছে, কতজন মারা গেছে তা জানা যায়নি ।
টিভি দেখতে-দেখতে ওর মনে পড়ে যাচ্ছিল অনেককাল আগে দমদমের পথে রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারী-মশায়ের ঢিল ছুঁড়ে-ছুঁড়ে বায়বীয় অপেরার যুদ্ধক্ষেত্রে লাশ ফেলার প্রয়াস। সেও ছিল কল্পনা দখলের খেলা । দাদা অনিকেত দেখা করতে গেলে আরও বড়ো একখানা পাথর ছুঁড়েছিলেন নর্দমায়, যার পাঁক চলকে নোংরা করে দিয়েছিল দাদার ট্রাউজার ।
রাহুল, কোন মহাগ্রাসে আক্রান্ত হয়ে, জঙ্গম-সক্রিয় প্রেমের স্বনির্মিত কলুষে, যে দিকে ইচ্ছা সূর্যোদয় ঘটাবার ইন্দ্রিয়মন্হন চালিয়েছিল, অক্ষরের যুদ্ধক্ষেত্রে একক লড়াইয়ের সেইসব দিনগুলোয়, মাঝে-মধ্যে ভেবে ফ্যালে,
তাড়ণাতাপের বিচলনে চক্রব্যুহে প্রবেশ-ক্ষমতার দুঃসাহস তো সকলের থাকে না, ওর কেন হল, কী করেই বা হল, বর্ণোচ্ছল স্মৃতিতরঙ্গের ঈশ্বরহীন অভিনিবেশের জাদুময়তা, মরুভূমির চিরকালীন উজ্জ্বলতায় অভ্রান্তির নিমগ্ন অভিসার, উপাসনা-বর্জিত, একক উজ্জীবন !
ছেলেকে বলছিল রাহুল, অসীম গাঙ্গুলি নামে একজন নট থাকতেন ওঝাপুরের এই পাড়ায় ; তাঁর দোতলার ফ্ল্যাটে যেত ও, নিয়মিত না হলেও বার পাঁচ-ছয় গিয়েছিল । তার আগে ওনার নিমপুকুর স্ট্রিটের বাড়িতেও গিয়েছিল । শেষবার কথা কাটাকাটির পর আর মাত্র এক বারই । সামনে আধমরা ঘাসের উবড়ো-খাবড়া মেঠো শহুরেপনা নিয়ে দোতলা বাড়ি , চূনকামের অবহেলায় আর বৃষ্টির দাপটৈ ছাইরঙা , যার ওপর তলায়, ছটা ফ্ল্যাটের একটিতে ভাড়া থাকতেন উনি । ছড়ানো-ছেটানো জায়গা নিয়ে বাগান ; ফুল-ফলের গাছ, তারপর গেট দিয়ে ঢুকে, ওপরে উঠে গোলবারান্দা । দক্ষিণ দিকে সবুজ , এখনকার নাগরিকের চোখে প্রান্তর বলা চলে, শাকসব্জির চাষে ব্যস্ত ক্ষেতমজুর । আর বিশাল জলাশয় । এখন সে জায়গায় বহুতল আবাসন, চেনা কঠিন , যেমন আর চেনা যেত না ওনাকে, সর্ষের তেল বা কোষ্ঠকাঠিন্যের ওষুধের বিজ্ঞাপনে বা পেজ থ্রির খোকা-খুকুদের রঙিন গ্যানজামের চাককাটা বুশশার্টের লোলচর্ম ফোটোয় ।
টিভিতে অসীম গাঙ্গুলির বিশাল শবযাত্রা দেখেছিল রাহুল সিংহ ; ছুটকো-ছাটকা নট্ট কোম্পানির অভিনেতাদের হইচইময় শোকযাত্রা। রাহুলের বয়স তখন কত হবে, মমমমমমম, বোধহয় বাহাত্তর, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়। টিভিতে ওনাকে নিয়ে যে প্রোগ্রাম হয়েছিল, বিজ্ঞাপনের কাঁটাতার ডিঙিয়ে তা থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, যে , যৌবনের গোলালু স্বাস্হ্য শুষে উপঢৌকন দিয়েছেন জনপ্রিয়তার নেশাকে । রবীন্দ্রনাথও অনেক বয়স পর্যন্ত, প্রস্টেটের শারীরিক কষ্ট নিয়ে বেঁচেছিলেন, কিন্তু অসীম গাঙ্গুলির মতো অমন শুকিয়ে আমসি হয়ে যাননি তো ! যশ আর জনপ্রিয়তা তাহলে ভিন্ন । কুড়ি-তিরিশের কোঠায় রবীন্দ্রনাথের যে গোঁফ ছিল তাতে উনি তা দিতেন, ফোটো দেখে অনুমান করা যায়, আদর-খাওয়া গোঁফের প্রান্ত । অসীম গাঙ্গুলি কখনও গোঁফ রাখেননি, যতদূর মনে পড়ে, সেই যখন উনি কলেজে পড়তেন, ধুতির ওপর বাড়িতে-কাচা হাফ-হাতা শার্ট , তখনও ।
স্কুল-কলেজের সিলেবাসে ঢোকার আনন্দে কী দেহের স্নেহপদার্থকে অসীম গাঙ্গুলি গলিয়ে ফেলেছিলেন ? কিংবা হাপিত্যেশ করে বসে-থাকা প্রকাশকদের অগ্রিমের কড়ার রাখতে । অথবা তরুণ স্তাবকদের টাঙানো প্রশংসার মশারিতে ঢাকা গদিতে শোবার নেশায় । হবেও বা । ডটপেনের রিফিলে ভরা নীল কল্পনাপ্রবণ স্নেহপদার্থ !
শেষ বারের পর রাহুল ওনাকে, মানে অসীম গাঙ্গুলিকে, অ-দেখন বা নির্দেখা করে দিয়েছিল, কারণ উনি তখন বিখ্যাত, কোষ্ঠকাঠিন্য আর সর্ষের তেলের বিজ্ঞাপনের পোস্টারে, অপ্রতিরোধনীয়তার দুরমুশে বয়সের বানভাসি-খাওয়া ওনার ফুলকোফোলা মুখ ঝুলত লাইটপোস্টগুলোয়, টিভির পর্দায়, দুর্গা-প্রতিমাকে পুরস্কার দানকারী গ্লসি পত্রিকার পাতায়-পাতায় , ক্ষমতার মায়াময় চোখধাঁধানো নিখুঁত মানুষের অতিকথার হাসি, ঠোঁটের ইন্দ্রজালে মিশিয়ে হয়ে উঠেছেন মধ্যবিত্ত বাঙালির গন্ধমাদনের উদ্ভিদ, নটবণিক ।
রাহুলের দাদা অনিকেত সিংহের বাড়িতে, যখন যে শহরে পোস্টিং হয়েছে দাদা অনিকেতের, অসীম গাঙ্গুলি
গেছেন সেখানে বেড়াতে , ওনার নট্ট কোম্পানির বন্ধুদের দলবল নিয়ে । বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে । শিশুপুত্রকে নিয়ে ।
প্রিয় বন্ধু ছেলেকে নিয়ে আসছেন শুনে দুধেল গোরু কিনেছিল অনিকেত ; কলকাতায় তো আর খাঁটি দুধ খাওয়া হয় না, যদিও পাড়ায়-পাড়ায় দলীয় বলদের খাটাল । বিখ্যাত হবার পর, কোষ্ঠকাঠিন্য, সর্ষের তেল, দোল-দুর্গোৎসব, সভা-সন্মেলন, বিদেশ ভ্রমণ থেকে ফুরসত পেতেন না বলে অধিকারীমশায় যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন ; সাহিত্যসভায় প্রধান অতিথির আসনে বসে, প্রথমে প্রৌঢ়, পরে বৃদ্ধ, অনিকেতকে চিনতে পারতেন না । অনিকেতও ওনাকে অচেনা
করে দিয়েছিল । অসীম গাঙ্গুলি মারা যেতে, লিটল অপেরাদের নতুনগোঁফ অধিকারীদের বায়নার দরুন অচেনা থেকে চেনায় ফিরতে হয়েছে অনিকেতকে ; পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটে অসীমের কয়েক দিস্তা চিঠি, যেগুলোর কপিরাইট উইপোকারা দাবি করেনি, তাদের বিলিয়ে দিয়েছেন অনিকেত ।
অসীম গাঙ্গুলি মারা যাবার পর ওনার মানসীর ভাসিয়ে দেয়া নিঃশ্বাসগুলো মনে পড়ল রাহুলের—
‘’যেহেতু প্রতিশ্রুতি দিয়েছ, তাই অপেরা লিখতে তোমায় হবেই ?”
“পুজোয় তোমার অপেরা নাহলে কি-ই বা হত বলো তো ?”
“শরীর যদি বিদ্রোহ করে, তবুও কেন ! কেন তোমায় অপেরা লিখতে হবে ?”
“অপেরা যদি খুব খারাপ হয় তারচেয়ে না লেখাই কি ভালো ছিল না ?”
সে-সব বাতাস গায়ে এসে লাগায়, রাহুলের মনে হল, রবীন্দ্রনাথকে অমন করে বলার স্মৃতি-বিদেশিনী ওনার বোধজগতে ছিল না বলেই কি লেখালিখি বাদ দিয়ে ছবি আঁকতে আরম্ভ করলেন ? তোরা যে যা বলিস ভাই, লিখব না লিখব না ।
তা নয় । অসীম গাঙ্গুলীর জীবনে কোনো ব্যর্থতার বিষাদ ছিল না, লাৎ মেরে চলে যাবার সময়ে প্রেমিকার দেয়া পরাজয়ের ক্ষয়রোগ ছিল না, নিকটতমের উধাও হবার মানসিক অশান্তি ছিল না , অন্তরজগতে কখনও হাহাকার বাসা বাঁধেনি ।
আর ? আর হাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি-বাঁধা অবস্হায় ডাকাত-খুনি-চোর-পকেটমারদের সঙ্গে রাজপথ দিয়ে জনগণের চোখের সামনে হাঁটার অভিজ্ঞতা ছিল না ।
ওনার, মানে অধিকারীমশায়ের, বা আর কারোর, চিঠিফিটি রাখেনি রাহুল সিংহ । যেগুলো পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেনি, সেগুলো কুটিকুটি করে উড়িয়ে দিয়েছে । রাহুলের মা বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, সব্বাইকে ছিঁড়ে গুয়ের ডাবায় ফেলে দে, এখনও মেথরানিটার আসার সময় আছে ।’ রাহুলদের কানপুরের বাড়িতে, তখন খাটা পায়খানা ছিল । অবশ্য গুয়ের ডাবায় ফেলেনি ; তিন তলার ছাদে দাঁড়িয়ে ছিঁড়ে-ছিঁড়ে উড়িয়ে দিয়েছিল সাওনকে মহিনার ভিজে হাওয়ার উদ্দেশে ; রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমমম, থাকগে, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় ।
গুয়ের ডাবা ছেঁড়া চিঠির টুকরো-টাকরায় কবিত্বময় হয়ে উঠতে পারে, হয়ত এই আশঙ্কায়, রাহুলের অনুমান, পরের বছর থেকে, সরকারি হুকুমনামায়, খাটা পায়খানা বন্ধ হয়ে গেল ।
–কেতুর ঘাড়ে বসে দুবচ্ছর খেয়েচে-দেয়েচে ওই রক্তিমটা, কেতুকে যে তোশক দিয়েছিলুম তাতে কতগুলো সিগারেটের ছ্যাঁদা করেচে দেখেচি, মদের গেলাস ফেলে দাগ ধরিয়েছে, লজ্জা নেই, কেতুর বন্ধুদের রেঁধে-বেড়ে খাইয়েচি, ওদের বাসন মেজেচি, আর তার বদলে কিনা এই ? অকিতোগ্গো, অকিতোগ্গো । বলেছিলেন মা ।
–কেতুর রোলেক্স হাতঘড়িটা, যেটা ওর জ্যাঠা দিয়েছিল, সেটাও তো ওদের কেউ হাতিয়েছিল, তারপর থেকে কেতুটা হাতঘড়ি পরাই ছেড়ে দিলে । বলেছিলেন বাবা ।
স্মৃতি যদিও তার পর অজস্র ছবি গড়েছে আর মুছেচে, দুটো হুল ফুটিয়ে-ফুটিয়ে সময়কে বিষাক্ত করে দিয়েছে নানারকমের ঘড়ি, তবু মনে পড়ে যাচ্ছিল রাহুলের, সেই সব গোলমেলে আচরণের ইতিহাসে ছয়লাপ মানুষদের মুখমন্ডল । মাতাল জোচ্চোরদের তাপদগ্ধ বালখিল্যে থমথমে কুতূহলী কফিহাউসের, আর চপল শুঁড়িখানার মর্মভেদী ঝিলমিলে একাকীত্বের জবজবে টয়লেট । বাসে-ট্রামে স্যাঁতসেতে ঘেমো ভিড়ের ভেপো যাত্রীদের গা-ঘেঁষাঘেষি অভিজ্ঞতা। জীবন্ত রক্তমাংসে পুনরুথ্থান ঘটছিল মৃতদের । বদল ঘটেছে কি ? আসলে পরিবর্তন হল কল্পনা, ম্যাজিক, ইন্দ্রজাল ; কেননা বদল তো শাশ্বত, চিরন্তন, চিরস্হায়ী ।
আর রাহু-কেতু ? যারা কল্পনামন্হনে উঠে এসেছিল ? তারা পৃথকভাবে একক অনুপম অদ্বিতীয় সর্বগ্রাসী সর্বভূক সর্বাশী সর্বত্র-বিদ্যমান স্হিতধী বন্ধনহীন সীমাহীন অতিবাস্তবতার ভূমন্ডলের যাযাবর , আর তাই, উত্তরাধিকারহীন ।
আগের আর পরের মাঝে স্হিতিস্হাপকতাই বোধহয় ঐতিহ্য । কিন্তু যদি আগের আর পরের স্হিতিতে যারা
আছে তারা না মানে তাহলে আর কীই বা করা ।
তারপর, সেই যে ,তারপর ,অসীম গাঙ্গুলির ওঝাপুরের বাসায় ইলিশের বদলে আমেরিকান কই ।
–আমি, আমিই তোমাকে অপেরা-জগতে এনেছি ; তা তুমি ভুলে গেলে কী করে ? আমিই সর্বপ্রথম তোমার লেখা অপেরা নিয়মিত প্রকাশ করার ব্যবস্হা করে দিয়েছিলুম । তোমার দাদা করেনি । তোমার রক্তিমদাও কিছু করেননি ।
শাসাঘাতে ওপরনিচ ঘটিয়ে কথাগুলো বললেন অসীম , অসীম গাঙ্গুলি, রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারীমশায় । মরুভূমির হুহু হাওয়ায় বালিয়াড়ির ঢেউরা পালটিয়ে পালটিয়ে পালটিয়ে আদল বদল করে গেল অবিরাম । বালির ওপর দিয়ে হালকা পায়ে দৌড়ে উধাও হল হলদে অক্ষরের মাকড়সারা ।
ভাসিয়ে-দেয়া নিঃশ্বাস ভেঙে-ভেঙে তার ভেতরে পুরে দেওয়া এই বার্তাটা পেল রাহুল সিংহ, যার ডাক নাম রাহু : “অনুগত রেনিগেড কোথাকার ! ক’দিন আগের গুণমুগ্ধ আজ আততায়ীর রূপ ধরে উপস্হিত হয়েছে।”
রাহুল সিংহ , যার ডাক নাম রাহু , আর যার দাদার নাম কেতু, ওনার কথাগুলো শোনার চেয়ে ওনার মুখমন্ডল কেন গোলাকৃতি, আর গোলাকৃতি বলেই উনি অমন ব্যতিক্রম কিনা, তাই ভাবছিল । গালে দু’দিনের দাড়ির তলায় ভাতের নরম চর্বি ।
রাহুলের দাদা অনিকেত আর অসীম গাঙ্গুলির বন্ধু নৃপতি চাটুজ্যে ওরফে প্রদীপন বলেছিলেন, ‘লক্ষ্য করে
দেখো, ওর মুখমন্ডল পুরুষের মতো নয়, বিরল, বিরঅঅঅঅঅঅল ।’ সিঁড়ির ধাপে এক পা আর আরেক পা মাটিতে রেখে, ঠোঁটের কোনে চারমিনার । ‘আর রক্তিমের মুখটা আয়তাকার, বুঝলে, দাড়ির আড়ালে চাপা দিয়ে গোলাকৃতি দেখানোর চেষ্টা করে, টলস্টয়ের পারভারটেড সংস্করণ ; সেক্সলেস হলে যা হয় আরকি । এসব আবার কোথাও লিখে দিও না ; তোমাকে কোনো কথা বলাও বেশ রিসকি ।’
–না, ওনার সেফটি রেজার কেনার পয়সা নেই বলে দাড়ি রাখতে হয়েছে ।
–আর মাল খেতে বুঝি পয়সা লাগে না ?
–সে তো এর-তার ঘাড়ে ।
–ঘ এর জায়গায় যে গ-এ চন্দ্রবিন্দু হবে, এটুকু জ্ঞান নেই ? বাংলা ভাষায় অপেরা করছ, এটুকু জানো না ?
রাহুল যাতে কোথাও লেখে, তা-ই যে নৃপতি চাটুজ্যে ওরফে প্রদীপন চাইছেন, পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসির মাধ্যমে ওনার বক্তব্যের স্বীকৃতি দিল হরিচরণ খাঁড়া ।
লেখালিখির জন্য হরিচরণ খাঁড়া এফিডেভিট করে দুর্গা বর্মন নাম নিয়েছে । খাঁড়া পদবি তখনও, রাহুলের বয়স যখন, মমমমমমম, বোধহয় একুশ, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, লেখালিখিতে অচল ছিল, আর এখনও তাই, রাহুলের বয়স যখন, মমমমমমম, বোধহয় তিয়াত্তর । সমাজের সেবক হতে হলে খাঁড়া পদবি সচল, অথচ লেখালিখির ময়দানে নামতে চাইলে খাঁড়া অচল।
হরিচরণ খাঁড়াকে দুর্গা বর্মণ বলে না ডাকলে বুড়ো বয়সেও রাগ হয় হরিচরণের । খাঁড়া বিসর্জন দিতে গিয়ে, মায়ের দেয়া আদরের নাম, হরিচরণকেও বিসর্জন দিয়েছে । সারা জীবনে কেউই হরিচরণকে সিরিয়াসলি নেয়নি, তার কারণ নাম-বদল নয় ; তার কারণ হরিচরণ বুঝতে পারে না যে ওর দুলকি-কাঁধ খোকা-ঢেউ আচরণই ওকে খেলো করে তোলে ।
প্রদীপন চট্টো ওরফে নৃ্পতি চাটুজ্যে, হাসার সময়েও, যে মুখোশটা পরে থাকেন, সেটা দৌর্মনস্যের উইপোকারা কুরে-কুরে খেয়ে চলেছে । ওনার চোখ কুঁচকে তাকানোর নানারকম মানে হয় । যারা ডেসিফার করতে পারে তাদের অন্যতম রাহুল সিংহ ।
—ফিজিওনমি পড়ছেন নাকি প্রদীপনদা ?
–লেখক হতে চাইছ , মুখের আকৃতি বিচার করবে না ? আমার মুখ তোমার মুখ আমরা পিকাসোর কিউবিস্ট ক্যানভাস থেকে নেমেছি । আর অসীইইইইম ? তো, ওর মুখ দেখো ভালো করে , হেলেনিক, আগামেমননের তাপ্পিমারা কেঠো ঘোড়া থেকে যেন সদ্য নেমেছে, হাতে বর্শা, পিঠে ঢাল, ঢুকতে চলল বিগহাউসের দুর্গে । পেছন-পেছন, বুকে চামড়ার বডিস বাঁধা, যুবতী সৈন্যের দল । গ্রিসে কি ইটালিয়ান মার্বেল যেতো, হোমারের সময়ে ? অসীমের পাশে দাঁড়িয়ে খেয়াল করেছ কি, মার্বেলের ঠাণ্ডা গন্ধ ঘিরে থাকে ওকে । মেয়েদের, জানো তো, ঠাণ্ডা মার্বেলের ওপর শুতে ভাল্লাগে ?
–কীইইই যে বলেন, শীতকালের গ্রিসে মার্বেলের ঠাণ্ডা মেঝেয় হেলেন অব ট্রয়কে হোমার নিশ্চই শুতে বলতেন
না, বলল রাহুল । ইউলিসিসের গল্পতেও নেই ঠান্ডা মার্বেলের মেঝেয় শোবার ঘটনা ।
–রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারীমশায় নিজেও জানেন সেকথা । বিরল, একসেপশানাল, প্রগলভ, প্রলিফিক ।
সেদিন, ওনার ওঝাপুরের বাড়িতে, অসীম গাঙ্গুলির মুখের দিকে নজর ঘুরিয়ে নৃপতি চাটুজ্যে ওরফে প্রদীপন চট্টোর বিশ্লেষণ যাচাই করছিল রাহুল ।
হরিচরণ খাঁড়া ওরফে দুর্গা বর্মণ, যে , মরা চিঠির ডাক বিভাগে কাজ করে, জীবিত লেখক আর জীবিত প্রাপকের মাঝে মরা চিঠি পড়ে-পড়ে, তাদের জ্যান্ত করে তোলে দপতরের অন্ধকারে, লোডশেডিঙে বসে মুচকি হাসির স্টক তৈরি করে রাখে, আজকে সকালে একটা ব্যানাল-হাসি স্টেটমেন্ট দিয়েছিল । কাঁধ নাচিয়ে, ও বলেছিল, ‘ ভবিষ্যত কাউকে কবি হবার অভিশাপ দেয়, আর কাউকে আবার কবি হবার আশীর্বাদ দেয় । প্রদীপন চাটুজ্জেকে অভিশাপ দিয়েছে আর অসীম গাঙ্গুলিকে দিয়েছে আশীর্বাদ; অপেরা না লিখে ছোটোগল্পই লিখুন প্রদীপন ।’
নৃপতি চাটুজ্যে ওরফে প্রদীপন সাইকেলে শিবপুরের দিকে পাইডেল মারতেই ভবদেব মিত্র বলেছিল, ‘লক্ষ করেছ ? প্রদীপন চাটুজ্জে সক্রিয় হলে ঘাড়ের ওপর ওনার মাথাটা শকুনের মতন কেমন আগে-আগে যায়? জীবনের যাবতীয় নোংরামির ভেতরে মুকুটসুদ্দু মাথা ঢুকিয়ে পচাগলা মালগুলো তুলে আনেন কলমের ডগায় !’
‘তাই ওনার গদ্যের বিস্তার উড়ন্ত শকুনের বিশাল ডানার মতন ; অনেক ওপরে উঠে যাচ্ছেন , কেউ আর সহজে ধরতে পারবে না ওনাকে ; বিনা অনুমতিতে ইনসমনিয়া রুগির স্বপ্নেও দিব্বি ঢুকে পড়েন’, বলেছিল সুকোমল রূদ্র ।
তাই অসীম গাঙ্গুলির হিংসে । প্রদীপনের গদ্যকে হিংসে, রক্তিমের পদ্যকে হিংসে । হিংসায় পাহাড়প্রমাণ অপেরা লেখার টেবিল।
নৃপতি চাটুজ্জেকে, ওনার পৌরসভার ঝিমন্ত দপতরে, লোকে নৃপতি নামে চেনে ; প্রদীপন নামে খোঁজ করতে গেলে সহকর্মী, যদি নাদুসপেট কেউ উপস্হিত থাকে, যা কদাচিৎই, তিনি ভাতঘুম থেকে জেগে উঠে, বলেন, ‘ওঃ, নৃপতিকে খুঁজছেন ? ওই যে চেয়ারে ঝোলা ঝুলছে, ঘণ্টাতিনেক অপেক্ষা করুন, দুপুরের পর একবার পদার্পন করবেন, ঝোলা তুলতে ।’ লিখিয়ে বন্ধুরা কেউই নৃ্পতি নামে ডাকে না । তারাই আবার হরিচরণ খাঁড়াকে দুর্গা বর্মণ নামে ডাকতে চায় না, হরিচরণ খাঁড়া নামে ডেকে মর্ষকামী হর্ষ পায় । আসলে প্রদীপন নামে উল্লেখ না করলে উনি ওনার কোনো লেখায় জীবনভরের মতো ঐতিহাসিক বাঁশ দিয়ে রাখবেন, বা, হতে পারে, সম্পূর্ণ বাঁশঝাড় ।
অসীম-প্রদীপনের আরেক বন্ধু আছেন, যিনি ঝোলা টাঙিয়ে অফিস থেকে উধাও হয়ে যেতেন, হরিপদ রায় ; ওনাকে দেখলেই যে লোকের হাসি পায়, তা উনি জানতেন বলে, হাসির অপেরা দিয়ে শুরু করেছিলেন । পরে, একদিন, চেয়ারে বসে হাই তুলতে-তুলতে, চোয়াল আটকে যেতে, দেখতে পান আলমারির ওপর, লাল শালুতে, আর কয়েক দশকের ধুলোয় মোড়া, একটা বস্তা সেই কবে থেকে পড়ে আছে, যখন উনি লোয়ার ডিভিশান কেরানি হয়ে মহাকরণের অ্যানেক্সিতে টেবিলের তলায় ঠ্যাং দোলাতে ঢুকেছিলেন ।
ছুটির পর অফিস ফাঁকা হয়ে যেতে, বস্তাটা নামিয়ে দেখেন, আরেসসসসশালা, অতি-পুরানো ক্ষেত্রসমীক্ষার প্রতিবেদন । জমা দেবার পর, সরকার, যেমন হয় আরকি, ভুলে গেছে যে ক্ষেত্রসমীক্ষা করানো হয়েছিল, তার প্রতিবেদন জমা পড়েছে । হরিপদ রায় বাড়ি নিয়ে গিয়ে প্রতিবেদনের তথ্য আমকাঠের টেবিলের ওপর উপুড় করে, লুঙ্গি দিয়ে ধুলো ঝেড়ে, উপজাতিদের সম্পর্কে একখানা সিরিয়াস বই লিখে, হাসির অপেরা-লেখক পদবি থেকে হাঁফ ছেড়ে মুক্তি পেলেন, আর প্রকাশকের কাছ থেকে লাখখানেক টাকা । ওই গ্রন্হের জোরে উনি প্রথমে ডাবলু বি সি এস হলেন, ঠ্যাং দোলানো কিছুটা থামল, তারপর প্রোমোটি আই এ এস হয়ে ঠ্যাং দোলানো থেমে গেল এক লপ্তে । যখন হাসির অপেরা লিখতেন, তখন উনি ছিলেন প্রফুল্ল সেনের সেবক । প্রোমোটি আই এ এস হয়ে রূপ পালটে হয়ে গেলেন বামপন্হীদের দরবারি ; কেরানি-বিপ্লবে বড় একটা অংশ নিতেন না । হরিপদ রায়কে ওনার ঠ্যাংদুলুনি কেরানি অবতারে রাহুল দেখেছিল বটে, ওপরে ওঠার গল্পটা প্রদীপন চট্টোর কাছ থেকে পাওয়া।
রাহুল অনেকবার চটিয়েছে প্রদীপনকে ।
প্রদীপনের দপতরে গিয়ে, ওনার সহকর্মীদের সামনেই রাহুল জানতে চেয়েছে, সহকর্মীরাও একই নরকের নিবাসী যখন, ‘ আজকাল ঘুষের রেট কীরকম যাচ্ছে ?’ পৌরসভায় ওনার বিভাগে ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত সবাই ঘুষখোর, পিওনরাও । উনি নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে অপেরা লেখেন কিন্তু চারিপাশে ঘুষের মোচ্ছব নিয়ে লিখতে চান না । দাদা অনিকেতকে প্রশ্ন করতে অনিকেত বলেছিল, ‘ ছদ্মনামে লিখলেও সরকারি দপতরের নিয়ম ভাঙার দায়ে বিপদে
পড়বে। অবসর নিয়েও লিখবে না, দেখিস, পেনশন আটকে যাবার ভয়ে । ওনার প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা হল
বেডরুমসেন্ট্রিক, বিছানাই এসট্যাবলিশমেন্ট, আর ভাষাকে স্যাবোটাঝ করার কাজটা ক্লাসি নয়, মিডলক্লাসি।’
আরেকবার, তখনও গ্রামের শেয়ালরা রাজনৈতিক দলের কর্মীতে রূপান্তরিত হয়নি, হুক্কাহুয়াও পালটায়নি স্লোগানে, হ্যারিসন রোডের মোড়ে, এখন যার নাম মহাত্মা গান্ধি রোড, কয়েকজন হিজড়ে রাহুলদের ঘিরে হাততালি বাজিয়ে পয়সা চাইতে, ওই চিৎপুর ক্রসিংটায়, ওনার বিব্রত গ্রিক বায়ুদেবতা ঈওলাসের ঢঙে বিড়ম্বিত মুখের পানে
তাকিয়ে রাহুল বলে ফেলেছিল, ‘আপনার হেটেরোসেক্সুয়াল ছলাকলার দাম চাইতে এসেছে ।’ উনি ট্রামে চাপতেই, রঙীন নাইলন শাড়ি মোড়া হিজড়েগুলোও ওনার পেছন-পেছন লাফিয়ে উঠে গিয়েছিল ।
ট্রামের হাতল ধরে দরোজা দিয়ে মাথা বের করে, ঘুষিকে সমান্তরাল করে, রাহুলের উদ্দেশে কয়েকবার নাড়িয়ে, অদৃশ্য কাপড়ে সাবান ঘষে বাতাসকে পরিচ্ছন্ন করার প্রয়াস করছিলেন প্রদীপন ।
রাহুলের পিঠে আলতো করে ছুরি চালিয়েছিলেন প্রদীপন, লালবাজারে বসে, ওনার বিখ্যাত গদ্যকলমে, একখানা অস্বীকৃতির ঘোষণা , আর পরে, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে । তার আগে কখনও, মনে হয়নি রাহুলের যে প্রদীপন মনে-মনে এতটা ভিতু ; সবকিছুকেই ভয় পান । রাস্তায় টায়ার ফাটলেও অচেনা আশঙ্কায় ওনার মুখ পীড়িত হয়ে উঠত। এখন ওনার মুখটা মনে করলেই পীড়া শব্দটা বেজে ওঠে, কর্কটক্রান্তির পীড়া । অসীম গাঙ্গুলির ভয়ে, চিঠির ঠোকরানি খেয়ে-খেয়ে, উনি রাহুলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন কাঠগড়ায় । পরে যদিও লিখেছিলেন যে বউয়ের ভয়ে অমন অস্বীকৃতি দিতে হয়েছিল, যদিও বউ তখনও বউ হয়নি, হবো-হবো ।
হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে ধোঁয়া খেতে-খেতে ভবদেব মিত্র আর ওর বন্ধুনি রোশনিকে রাহুল বলেছিল,
‘একজনের স্মৃতি আরেকজনের মুখমন্ডলকে ততদিন দূষিত করে রাখে যতদিন না নতুন কোনো স্মৃতি এসে তোমার চেতনাকে বিষাক্ত করছে ।’ ব্রিজের তলা দিয়ে তখন বিকেলের ক্লান্ত ঢেউ । যে যার গোপন স্ক্যানডাল নিজের-নিজের সামুরাই ব্রহ্মচর্যে চাপা দিয়ে বাড়িমুখো বাসি-বিকেলের নিত্যযাত্রী ।
হরিচরণ খাঁড়া ওরফে দুর্গা বর্মণ রোজই একটা মরা চিঠি বাড়ি নিয়ে গিয়ে মাকে পড়ে শোনায় । মাকে চিঠি লেখার কেউ নেই অথচ বয়সকালে চিঠি পেতে ইচ্ছে করে তো । বাড়ি মানে বস্তির একটা চালাঘর , শ্যাওলা-সবুজ বারোয়ারি খাটা পায়খানা । রাহুল মাঝে-মাঝে রাত কাটায় ওর ওই ঘরে, কেননা কলকাতায় রাহুলের মাথা গোঁজার জায়গা নেই । চারিদিকে বইপত্র ছত্রখান, উনিশ শতকের গন্ধের, আলোর, ঝিমঝিমে হাওয়া । জানালায় কাঠের গরাদ, ক্ষয়াটে । বারোয়ারি পায়খানা, ওই একটাই, ভোর থেকেই রিজার্ভেসানের লাইন । ফলে, রাহুল ওর আস্তানায় রাত কাটাতে চায় না।
অসীম গাঙ্গুলির বাড়িতে কথা-কাটাকাটির সেই সূত্রপাত ।
–ক্রিয়েটিভ লেখালিখি ? জানি না, আপনি যাকে অপেরা বলে মনে করেন, আমিও ঠিক তাই করতে চাইছি কিনা। না, রাহুল যার ডাক নাম রাহু , আর যার দাদার নাম কেতু, সেকথা বলা প্রয়োজন মনে করল না অসীম গাঙ্গুলিকে, ওনার ওঝাপুরের ফ্ল্যাটের ঘরে দাঁড়িয়ে । দুজনে যে ক্রমশ মেরুপৃথক ভাবনাজগতের বাসিন্দা হয়ে চলেছে, তা দুজনেই খেপে-খেপে জেনে ফেলেছে ; প্রথম পরিচয়ের সময় থেকেই । উনি চাইছেন ওনার নামের প্রতিধ্বনি ওনাকে ঘিরে থাকুক ক্ষমতাবান অশরীরির মতন, যাতে উনি কথার হইচই গায়ে মেখে নিজের ইচ্ছেমতন আত্ম-অভিকর্ষ নিয়ে খেলতে পারেন, তরুণ-তরুণীরা সেই অভিকর্ষের টানে পাক খেয়ে চলুক । বন্ধুদের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, এসো, দেখাও, কার অভিকর্ষে কত জোর আছে , কার পালে কত ঝড় , কার পেছনে কতগুলো হ্যামেলিনের নংটি আর ধেড়ে ইঁদুর, কার হেফাজতে কত তোষাখানা !
প্রথম পরিচয় । রাহুল , যার ডাক নাম রাহু , আর যার দাদার নাম কেতু, তখন হাফপ্যান্ট পরত, বয়স, মমমমমমম, বোধহয় চোদ্দ, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । অসীম গাঙ্গুলি পরতেন ধুতির ওপর শহুরে ধোপার আদর-খাওয়া হাফশার্ট ।
আজকে, ওঝাপুরের দোতলায়, উনি ময়লা পায়জামার ওপর জলকাচা ফিকে নীল বুশশার্ট পরে আছেন। ওই পোশাকেই বাজার থেকে ফিরেছেন ।
আসার সময়ে রাহুল , রাহুল সিংহ, ডাক নাম রাহু , মনের ভেতরে বিড়বিড় করে এসেছিল যে অসীম গাঙ্গুলির সঙ্গে কোনো তর্ক করবে না, কথার ওপর কথা বলবে না, তবু সম্পূর্ণ অপ্রসঙ্গিক একটা কথা বলে ফেলল, পিরামিডের তলায় লুকোনো শবের সোনার মোড়ক খুলে হিরেবসানো তরোয়াল বের করার মতন করে, ‘আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্হ
তো আমার দাদা নিজের গ্যাঁটের কড়ি দিয়ে ছেপেছিলেন।’
নীরবতার অন্ধকার গোলকধাঁধায় ফেলে আসা একটা বাক্য কুড়িয়ে নিজেকে অবাক করে তুলল রাহুল । শ্বাসাঘাত হল, এঃ, হেএএএ ।
–মূল প্রসঙ্গে এসো , বললেন অসীম গাঙ্গুলি, কোনো চিঠিতেও তো তুমি জানাওনি যে তুমি কী করতে চলেছ ? কৃতজ্ঞতাবোধ নেই তোমার । অথচ আমিই তোমাকে অপেরা-জগতে এনেছিলুম । তুমি নিজের কী ক্ষতি করেছ তা আজ
বুঝতে পারবে না , তবে একদিন নিশ্চয় বুঝতে পারবে, তখন আমি অপেরাসম্রাট হয়ে রাজত্ব করব । তোমাকে আমি প্রায় দশ বছর চিনি-জানি । আমি তোমায় একজন রেকলুজ তরুণ বলেই তো জানতুম, ইউ ওয়্যার আ লোনার । নিজেকে ঘিরে সবাইকে জড়ো করলে কী ভাবে ! অমন অরগানাইজিং দক্ষতা আছে বলে তো জানতুম না ।
প্রবাসে, কানপুরে, যেদেশে রাহুল সিংহ , যার ডাক নাম রাহু , সে সময়ে থাকত, সেখানকার মণ্ডিরোডের চালগমের আড়তদারদের দেয়ালে সিঁদুর দিয়ে লেখা থাকত “শুভ লাভ।” হিসেবের লাল-মলাট হলুদ-কাগজের খেরোখাতায়, খাড়া লম্বা লাইনের একদিকে লাভের অঙ্ক, আরেকদিকে ক্ষতির । তার মানে, অসীম গাঙ্গুলির ওষধি-তর্কে, শুভ ক্ষতির দিকে পড়েছিল রাহুল , যার ডাক নাম রাহু, আর যার দাদার নাম কেতু ।
অশুভ লাভের চেয়ে শুভ ক্ষতি বরং শ্রেয়, নিজেকে নিঃশব্দে বলল রাহুল ।
ইংরেজরা কেন কলকাতা ছেড়ে দিল্লিতে পাট তুলে নিয়ে গিয়েছিল, আসার সময়ে সেকথা ভাবতে-ভাবতে রাহুল, যার ডাক নাম রাহু, আর যার দাদার নাম কেতু, টের পেয়েছিল যে ইতিহাসের ওই বাঁকবদলের কিছুই ওর মনে নেই । ইংরেজরা বোধ হয় বাঙালিদের বলতে চাইছিল, :”দাঁড়া, দেখাচ্চি মজা।” কিন্তু দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে রাজধানি তুলে
নিয়ে যাওয়া, অমন কাজ প্রতিভাবান শাসকই করতে পারেন ।
চামড়ার টাকাও টাকা । শাসক চাইলে চামড়ার টাকাকেও স্বর্ণমুদ্রার সমান মূল্য দিতে বাধ্য হয় শাসিত জনগণ ।
নিমপুকুর ছেড়ে অসীম গাঙ্গুলি অভিকর্ষের নাড়ি তুলে নিয়ে এসেছেন কলকাতার বাইরে, ওঝাপুরে ! চলে গেছেন, র্যাদার। রাহুল যেমন এক শহর থেকে অন্য শহরে নিজের চাকরি তুলে-তুলে নিয়ে গেছে সারা জীবন, তারপর চাকরিকে তুলে নিয়ে গেছে গ্রামে-শহরে-গঞ্জে-নদীতে, এমনকী গভীর জঙ্গলেও । জঙ্গলে বসে উপজাতি পরিবারের বউয়ের দেয়া বেগুনপোড়া খেয়েছে শালপাতায়, পোড়ানো কাঁঠালবিচি বা কাঁচকলা-পোড়া খেয়েছে , চাল-গম তাদের অনধিগম্য বলে।
তাই, মনে হয়েছে ওর, কোনো জীবনকাহিনীই ব্যক্তিগত নয়; একজনের জীবনের জিজ্ঞাসাচিহ্ণগুলো , সব চিহ্ণই, আরেকজনের জীবনে বেমালুম পাওয়া যায় । উত্তরগুলোর সদিচ্ছা চালিয়ে নিয়ে যায় ব্যক্তিগত থেকে কৌমের দিকে । সম্ভবত । তার কারণ কারোর-কারোর কাছে আলো মানেই অতীত ,আর ভবিষ্যৎ মানেই আতঙ্ক ।
একটু আগে ফালিকাগজটা অসীম গাঙ্গুলির বাঁহাতে শিহরন তুলেছিল । শিহরণের রিনরিন বাজনা শুনতে পেয়েছিল রাহুল ।
থেকে-থেকে কাঁপুনিটা ছড়িয়ে পড়েছে সারা ঘরে, উড়ছে ঘরময়, জাগরণকে স্বপ্নের নামে চালাবার মতন করে । ঠোঁট নিঙড়ে একফোঁটা শ্লেষ । অসীম গাঙ্গুলির শ্লেষে, হাসিও বেফাঁস । বললেন, “বাংলা অপেরাকে ওমুখো হতে দেব না।”
রাহুল, যার ডাক নাম রাহু , আর যার দাদার নাম কেতু, মহাশূন্য থেকে পৃথিবীতে নেমে আসা ভিনগ্রহী প্রানী, মগজের ভেতরে মা-বাবার তৈরি-করা রণক্ষেত্র বয়ে বেড়াবার, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া রণক্ষেত্র, দায়-দায়িত্ব থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে এনেছে স্কুলের গন্ডী পেরোবার আগেই । বঙ্গজীবনের সময়কে একটা মাত্র লাইন বরাবর চলার ধারণায় বসবাস করার এলেম পায়নি, যদিও প্রাইমারি স্তরে ক্যাথলিক স্কুলে পড়েছিল ।
ওমুখো ? লিনিয়ার ! তিরিশ চল্লিশ পঞ্চাশ বছর পর যারা লেখালিখি করবে, তারা বাংলা অপেরাকে, দশ দিকে হাজার মুখে চালিয়ে দেবে, তা বোধহয় উনি অনুমান করতে পারছেন না । এক কালে নিজে কেঠো ট্রোজান ঘোড়া থেকে নেমেছিলেন, আর কতগুলো ট্রোজান ঘোড়া ওনার সিংদরোজার দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে তা উনি অনুমান করতে পারছেন না ।
অসীম গাঙ্গুলির কাছে রাহুলের প্রথম অপেরার পাণ্ডলিপি জমা আছে মাস তিনেক । ওনার ‘রামায়ণ নট্ট কোম্পানি’ থেকে প্রকাশ করবেন । অথচ বলছেন লিনিয়ার থাকতে হবে। রামায়ণের বদলে মহাভারতের কথা মাথায় রাখলে হয়ত খেয়াল রাখতেন যে মানবজীবনের ন্যারেটিভগুলো একই রেখায় চলে না ।
পঞ্চাশ বছর পর যারা লেখালিখি করবে, তারা বলবে, ‘আমার অপেরার রাজপাট আমার নিজের, আমি কী করি
না করি তাতে কার বাপের কি ; তুমি পড়তে না চাও পোড়ো না, আরেকজন তো পড়বে । তোমার বেছানো লাইন ধরে চলুক তোমার পরাগিত সন্ততি, তোমার আই ভি এফ করা কচি-নটের দল ।’
তা ঠিক ; প্রচুর পরাগিত সন্তান-সন্ততি হাওয়ায় উড়িয়ে গেছেন উনি ।
আর বাংলা অপেরা ? যারা বাঙালি থেকে পাকিস্তানি হয়ে আবার বাংলাদেশি হয়ে বাংলা ভাষায় রাজত্ব করতে
আসবে, তারা খেপে খেপে নিজেদের উথালপাথাল দিয়ে কোন মুখে যে যাবে তা কে-ই বা জানত? বাংলা অপেরার ভাষাকেই কলকাতিয়া নাম দিয়ে ঘাড় থেকে নামিয়ে দিতে চাইবে, নিজেদের পৃথক প্রমাণ করতে চাইবে, তা-ই বা কে জানত !
রাহুল সিংহ , যার ডাক নাম রাহু, তার দাদা অনিকেত সিংহের কলেজ-জীবনের বন্ধু ছিলেন অসীম গাঙ্গুলি । তখন রাহুলের বয়স, মমমমমমমম, বোধহয়, থাকগে , ওনার সঙ্গে পরিচয় হয়নি, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । কলেজের দেয়াল পত্রিকায় অসীমের অপেরা পড়ে মনে ধরেছিল বলে দাদা অনিকেত যেচে আলাপ করেছিলেন নিজের পত্রিকায় ওনার অপেরা চাইবার জন্য । দাদা তখন হুগলির অশোক মৈত্রর সঙ্গে ‘লেখা’ নামে একটা লিটল অপেরার যোগাড়যন্তর করতেন । থাকতেন শ্যাওড়াফুলিতে দেশের বাড়ির দু’আড়াইশ বছরের পুরোনো খণ্ডহরের চিলেকোঠার সোঁদা ঘরে । কাঠের ঘর, আলকাৎরা লেপা, যাতে উইপোকারা না সংসার পাতে । রাতে লন্ঠনের প্রভা । দেয়ালে সেকালের বিশাল খাঁড়া, চোখ আঁকা , কোনের দিকে দশ ফিট উঁচু বর্শার গোছা, লোহার ভারি-ভারি ঢাল, শাদা চুলের চামর, যেগুলোয় একশ বছরেও হয়ত হাত দেয়নি কেউ । শীতের দুপুরে আসেপাশের ছাদে যুবতীরা তাদের দীর্ঘ চুল
পিঠের ওপর ফেলে জবাকুসুম তেলের সুগন্ধ পাঠায় অনিকেতের উদ্দেশে।
অসীম গাঙ্গুলি নিমপুকুর ছেড়ে চলে গিয়েছেন বেশ উত্তরে, শহরতলিতে । দোতলা বাড়িটা খুঁজতে কিছুটা হয়রান তো হয়েছে রাহুল । এর আগেও এসেছে কিন্তু মনে রাখতে পারে না ও । রাস্তাটা নিজের সময়মতন যেদিকে যখন ইচ্ছে বাঁক খেয়ে কাদায় কাঁকরে বালিতে খানাখোঁদলে অবয়বহীনতার আগাম খবরের ধাঁচে পৌঁছে দিয়েছে রাহুলকে, যার ডাক নাম রাহু, আর যার দাদার নাম কেতু । কলকাতার কেন্দ্র ছেড়ে এত দূরে কেন ? বাড়িভাড়া কম বলে , নাঃ, তা নয়, নিজের সঙ্গে অভিকর্ষ তুলে নিয়ে যাবার ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য। পরাগিত সন্ততিদের টেনে আনার গৌরব ।
কলকাতা শহরের কেন্দ্র বলে কিছু আছে কি ? কেন্দ্র ! না, এই শহরের কোনো কেন্দ্রস্হল নেই । ডালহাউসি স্কোয়ারকে বলা যাবে না কেন্দ্র — ওই জায়গাটা তো সন্ধ্যা হলেই ফাঁকা। দিনের বেলায় একের পর এক দেশভাগোত্তর উৎখাতদের রাগি মিছিল আছড়ে পড়ে, অথচ বিকেল হতেই, সারা দিনের গ্রীষ্মকে হাওয়ায় জড়িয়ে ভোঁ-ভাঁ । স্লোগানের শুকনো জিভগুলো ভেসে বেড়ায় ফাঁকা এলাকাটায় । খুঁজে মরে বিধান রায়কে । ওনারও তো অভিকর্ষে তোবড়ানো মানব-শরীর । চলে গেছেন । মিছিল সামলাতে হিমসিম প্রফুল্ল চন্দ্র সেন ।
রাগি জিভের ভুত-ভুতনিরা গ্রীষ্মের লুবাতাস হয়ে টিকে যাবে সরকারি পাড়াটায়, আর, পরে, পরে-পরে, ভলকে-ভলকে মুঠো-ওড়ানো রাগি, গরিব, দুস্হ, উৎখাত, মুখশুকনো শিড়িঙে মানুষের আদলে দেখা দেবে, যেদিন যখন ইচ্ছে । উনিশ শতকের হাওয়া মুছে ফেলে দেশোদ্ধারের নামে তিরিশ বছরের ঐতিহাসিক বিপ্লব করবে হয়ত ভেতো কেরানিদের টেকো বা তেল-চুকচুকে আধঘুমন্ত দল ।
কিছুকাল আগে এই পাড়াতেই ধোপদোরস্ত মানুষদের ভিড় ‘ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায়’ চেঁচাতে-চেঁচাতে যেত ; তারাই, পরে গিয়ে, —তখন তো প্রফুল্ল সেন প্রফুল্ল মনে সিংহাসন থেকে উধাও— বসল ডালহাউসির মসনদে, আর যতটা পারে প্রমাণ করার চেষ্টা করল যে স্বাধীনতার ফলটা পেড়ে খেতে হলে তাকে মিথ্যা বলে ঘোষণা দিতে হবে । ঝুঠা আজাদির নামে কত ট্রাম-বাস তারা পুড়িয়েছিল । পরে, বিধান রায়ের সময়েও কত ট্রাম বাস পুড়ল । তারপর থেকে পুড়েই চলেছে ট্রাম-বাস । সরকার ট্রাম তুলে দিতে পারছে না ; ট্রাম না থাকলে ছাইয়ের ভাইরা কীই বা পোড়াবে? বাসগুলো তো প্রায় সবই বেসরকারি । ক্রমশ সবই ঝুঠা হয়ে গেল, সবই, সবই, সবই, সবই ।
ধর্মোন্মাদদের তাড়ানো উৎখাত মানুষের পোড়ানো বাসের কঙ্কাল পথের একপাশে । রাহুল স্পষ্ট দেখল ধোঁয়ার আদল নিয়ে নানা আকার-প্রকারের ভুত আর ভুতনিরা উড়ে বেড়াচ্ছে । এই ভুতগুলোই হয়ত তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পর বাংলার উড়ন্ত জাজিমে বসে রাজত্ব করবে । ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ভুত-ভুতনি নয়, রঙীন । তাদের কন্ঠস্বরও শুনতে পাচ্ছিল, রক্ত খাঁবো, পোড়া মাংস খাঁবো, হাড়গোড় চেঁবাবোঁ, জ্যান্ত পুঁতে দেবোঁ মাটির তলায় । আকাশ জুড়ে উড়ছে মেঘলা-স্লোগানে ভেজা কাক, চিল, শকুনের গোলাপি উল্লাস। গুন্ডা-বদমায়েশ অধ্যুষিত সবুজ গ্রামাঞ্চলেও
উল্লসিত জিভগুলো পৌঁছে যাবে একদিন ।
সেন্ট্রাল ক্যালকাটা নামে জায়গাটাকেও বলা চলে না কেন্দ্র ; ওটা যেন ভাইভূক অক্টোপাসের মতন বাছবিচারহীন বিস্তারে আক্রান্ত, আত্মরক্ষার জন্য থুতুর রঙিন ধোঁয়ার আড়ালে ঢেকে রাখে নিজেকে । সামলে না হাঁটলে গায়ে একশ বছরের পুরোনো চুনবালির গয়ের খসে পড়ে । আসলে রাবণের মাথাগুলোর কথাই লোকে জানে ; শিরদাঁড়ার ওপর ওই ভারসাম্যহীন মাথাগুলোর চাপের কথা কাউকে বলতে শোনা যায় না । এক দিকে চারটে মাথা, মাঝখানে
একটা, আরেকদিকে পাঁচটা ; ভারসাম্য বজায় রাখা চাড্ডিখানি কথা নয় । আর দশটা মাথার সবকটা মগজ কি একই ভাবনা ভাবে ? হাজারমাথা শহরের খামখেয়ালি দেহরাজ্যে মূল মগজ বোধহয় মরিচিকা সেজে বসে আছে , আর মরিচিকা তো হল প্রতিশোধ । সবাই সেখানে আগন্তুক, বহিরাগত, অসংশ্লিষ্ট, সেখানে অলিগলির ফ্যাকাশে বা তরতাজা বাড়িগুলো নিজের-নিজের গোপনীয়তা খরচ করে টিকে আছে । বউবাজারও ।
একসঙ্গে কুড়িটা চোখ মেলে সীতার দিকে তাকিয়ে রাবণ !
চোখের প্রতিভা । প্রতিভা কি কেবল মাথার ? করতলের, বুকের, কাঁধের, উরুর, পায়ের পাতার, নাকের, কানের প্রতিভা কি নেই ?
বউবাজার ! সত্যিই বউয়েরা বাজার বসায় ; রাহুলের অভিজ্ঞতা আছে । কলকাতায় নয়, অন্য শহরের অভিজ্ঞতা । যে-হাত প্রেমের উচ্ছন্নে টেনে তোলে।
বন্ধুদের ডাকে রাহুল গিয়েছিল কাঠমাণ্ডুতে, যৌবনে । ওর বয়স তখন কত, মমমমমমম, হবে কিছু, কী-ই বা এসে যায় । স্পষ্ট মনে পড়ে যেতে লাগল ওর, রাহুলের ।
মাটিতে শাল বা শিশুকাঠের গুঁড়ি পুঁতে তাকে পাকিয়ে-পাকিয়ে চারতলা পর্যন্ত উঠে গেছে বাঁশের রেলিং আর
কঞ্চির ধাপ-দেওয়া সরু সিঁড়ি, এতই সরু যে, একজন যদি নামতে থাকে তাহলে তাকে জায়গা দেবার জন্য রেলিং-এ হেলে দাঁড়াতে হবে । তা সত্ত্বেও ছোঁয়া বাঁচানো ছিল কঠিন । স্হান সংকুলানের জন্য দুই পাক ওঠার পর একতলা, তারপর দুই পাক উঠে দুতলা, এইভাবে পাক খেয়ে চারতলা পর্যন্ত টালির চালে তৈরি কাঠের প্রাসাদ ; ওই প্রাসাদে অমন সিঁড়ি ছিল কুড়িটা । প্রতিটা সিঁড়ি কেবল সরু নয়, তা বেশ প্যাঁচালো । প্রতিটি তলায় সিঁড়ির মুখে বাঁ দিকে একটা ঘর আর ডান দিকে খোলা বারান্দা । বারান্দা থেকে ভেতরের উঠোন দেখতে পাওয়া যেত । ঘরের মেঝেও কাঠের । ঘরগুলোর দুটি জানালাই পেল্লাই মাপের, দরোজার সমান বলা যায়, জানালার শিকগুলোও কাঠের । ঘরগুলো বারো বাই আট হবে ।
গ্রাউন্ড ফ্লোর বা একতলা ছাড়া ওপরের তলাগুলোয় আসবাব কম ; প্যাঁচানো সিঁড়ি দিয়ে আসবাব ওপরে ওঠানো কঠিন । ওঠাতে হলে ভেতরে উঠোনে নিয়ে গিয়ে দড়ি বেঁধে বারান্দায় তুলতে হবে । বিছানা বলতে, মাটিতে খড়ের আঁটি বিছিয়ে তার ওপর চাদর পাতা । ঘর ভাড়া মাথা-প্রতি মাসে এক টাকা , যা সংগ্রহ করতে সামন্তের পেয়াদা আসত মাসে একবার । পাড়াটার নাম ছিল ঠমেল, এখনও আছে, তবে তার রূপ রস গন্ধ বর্ণ সম্পূর্ণ বদলে গেছে গত কয়েক দশকে — চিনের মার্কসবাদী উদারীকরণের সঙ্গে গরিবের মাওবাদের বিয়ে, ঘটকরা বেশিরভাগই ভারতীয় মারোয়াড়ি ।
অমন গুঁড়ি পুঁতে-পুঁতে, পঞ্চাশ মিটার বাই একশো মিটার জুড়ে আয়তাকার উঠোন ঘিরে কাঠের জনপ্রাসাদ ; টালির ছাউনি । সে-প্রাসাদের মূল দরোজা ছিল একটাই, আর তা চব্বিশ ঘন্টা খোলা ; এরকম দরোজাও হয়, সবসময় খোলা, আর এরকম দরোজাই সবচেয়ে জরুরি । দশ ফিট উঁচু, চার ফিট চওড়া কাঠের ফ্রেমে কাঠের ক্ষয়াটে জনপ্রাসাদের সিংদরোজা, তার পাল্লায় কে জানে কোন ধাতুর কারুকাজ করা তিব্বতি কলকা, ধুলো আর সময় জমে-জমে ধাতু নিজের ধাতুত্ব হারিয়ে ফেলেছে, মনে হত দেখে । কতজন থাকতেন ওই প্রাসাদের ফ্ল্যাটখাঁচাগুলোয় তা অনুমান করা যেত সকালবেলায়, যখন উঠোনে জড়ো হতেন অনেকে, প্রাতঃকৃত্য সারার জন্য, মাসান্তের বা পক্ষান্তের বা উৎসব-শুরুর স্নানের জন্য । ওই প্রাসাদের সবাই প্রতিদিন স্নান করতেন না বলে সুবিধা ছিল । প্রাতঃকৃত্য বলা হলেও, সবাই সকালে যেতেন না, অভ্যাসমতো বা আয়াসমতো বা আলস্যের ফাঁকে যেতেন । তাদের মতনই প্রতিদিন স্নান করার ব্যাপারটা রাহুল বাদ দিয়েছিল ; রাহুলের বন্ধুরাও তা-ই । দিনের পর দিন স্নানহীন, পোশাক পালটাবারও দরকার হতো না, তাই ।
সেই কুটিরপ্রাসাদে গরিব নেপালি আর নেওয়ারি পরিবার যেমন থাকতেন, তেমনই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন হিপি-হিপিনীর দল, নেপালি কবি-শিল্পী, আর আর ভারত থেকে আসা, রাহুলদের মতন, সীমাভাঙার উচ্চাকাঙ্খীরা । একতলায়, দুতিন ঘরের ফ্ল্যাটে থাকতেন মধ্যবিত্তরা । একজন নেপালি চিত্রাভিনেত্রীও
থাকতেন ; তখন তো নকল স্তন বাজারে আসেনি তরুণীদের বুক দখলের প্রতিযোগীতায় ; চিত্রাভিনেত্রীর স্তন অমন
মহাকাব্যিক ছিল কোন খোরাকের গুণে , জানতে চাইলে, সামন্তের ভাড়া নিতে আসা পেয়াদা মুচকি হাসি হাতে-ধরা নেপালি রুপিয়ায় মিশিয়ে বলত, মহাকবি কালিদাস নিজের মুখে নিয়ে ফুলিয়েছেন ।
ষাটের দশকের কথা তো । সে-সময়ে ফান ফুড ফ্রিডাম ফ্রিক-আউট আর ফাকিং এর উদ্দেশে দলে-দলে তরুণ-তরুণী আমেরিকা-ইউরোপ ,এমনকি জাপান থেকেও, নিজেদের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়তেন ; লন্ডন বা
অ্যামস্টারডাম হয়ে বাসে, ট্রেনে আর হিচহাইক করে তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্হান, পাকিস্তান, ভারত হয়ে শেষ গন্তব্য নেপাল । লন্ডন আর অ্যামস্টারডম ছিল স্বাধঃপতিতদের জড়ো হবার ঘাঁটি । ভারত-পাকিস্তানের যে-গেট দিয়ে তাঁরা আসতেন তার নাম ছিল গন্দাসিংওয়ালা । তখনও ওয়াগার কুচকাওয়াজি আকাশঠ্যাং ডিগবাজির গেট তৈরি হয়নি । পাকিস্তানের সঙ্গে এখনকার মতন ধর্মবাজ বোমাবুমির সম্পর্কও হয়নি, চিনের যুদ্ধ সত্ত্বেও । সম্পর্ক এই রকমই , গালাগালি মারামারি খুনোখুনি, কত রকমের সম্পর্ক যে হয়। অথচ তা তো সম্পর্কই । এখন দাড়িয়াল পাকিস্তানিরা সুন্নতকরা খোকাদের শিখিয়ে-পড়িয়ে মরতে আর মারতে পাঠায় ; যাতে মরে গিয়ে সেসব খোকারা স্বর্গের হাইপাররিয়াল হুরি-পরিদের সঙ্গে ল্যাংটো শুতে পারে, আর দাড়িয়ালরা মর্তে শুতে পারে রিয়াল নারী-মাংসের বিছানায় ।
হিপিদের সেই যাত্রাপথের নাম ছিল শামুক-গতির হিপি-ট্রেইল, যে যাত্রাপথ ছিল অমায়িক যথেচ্ছাচার আর মহানন্দে অলস সময় কাটাবার উত্তরণের তীর্থ । সে-সময়ে ইউরোপ-আমেরিকার যুবক যুবতীরা চাইলেই চাকরি পেতেন– এখনকার মতন জব্দ-জাবেদার কোঁকড়া সময় নয়– অথচ দলে-দলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়তেন । এখন চাকরি পাওয়া কঠিন, তবু কেউ বেরিয়ে পড়েন না ; কারণ পৃথিবীটা হয়ে গেছে ঝগড়াটে, খেঁকুরে, লোভী, জোচ্চোর, মতলববাজ । শান্তির কোনো ট্রেইল আর নেই । পৃথিবীর অত্যন্ত ধনী এলাকাগুলোই কেবল লোকদেখানে শান্তিতে রয়েছে। সায়েবদের দেশের যুবক-যুবতীরা বিদেশে যায় বটে, যখন তাদের পোঁদে লাথি মেরে রাষ্ট্র পাঠায় যুদ্ধ লড়তে । বেচারা ।
ফিবছর এত বোমাবারুদ জমে যায় যে তাদের গতি করার জন্যে যুদ্ধ লড়তে হয়, না লড়ে উপায় নেই । রাষ্ট্র বলেছিল, হিপি হওয়া খারাপ, পাতা ফোঁকা খারাপ, জীবন উপভোগ করা খারাপ । মরো লড়ে, লড়ে মরো। বাবরি চুল রেখো না, ন্যাড়া হয়ে যুদ্ধ লড়তে যাও , ট্রিগারে আঙুল রেখে বলো ফাক ইউ।
ফ্রিকিং আউট হবার জন্যই কাঠমাণ্ডুতে জড়ো হতেন হিপি-হিপিনীরা, নেপালে চরস গাঁজা ভাঙ আফিম পাওয়া যেত পথেঘাটে, অফুরন্ত, অফুরন্ত, অফুরন্ত, আর দামও নগণ্য, এমনকি অনেক সময়ে বিনে পয়সায় । তখন তা বেআইনি ছিল না । হিন্দু বা বৌদ্ধ যে কোনো মন্দিরচত্ত্বরে গেলে বুড়োদের জমঘটে বসে মাঙনায়ও ফুঁকে নেয়া যেত, হাতফেরতা দুচার টান, ভিজে ন্যাকড়ায় মোড়া ছিলিম।
হিপিরা বেরিয়ে পড়ার পথে আফগানিস্হান থেকে আনতেন উঁচুমানের চরস বা হ্যাশিশ আর পাকিস্তান থেকে গাঁজাফুলের গুঁড়ো যাকে পাকিস্তানিরা বলতেন গর্দা । নেপালি গাঁজার সঙ্গে হ্যাশিশ আর গরদা কিংবা ভারতীয় আফিম মিশিয়ে তৈরি হতো একরকমের মাদক, হিপিরা বলত ডেডলি-লাভার । নিজেদের দেশ থেকে ওরা আনত লাইসারজিক অ্যাসিডে চোবানো ব্লটিং-পেপার, বা আনতো এল এস ডি ক্যাপস্যুল, চব্বিশ ঘন্টা, আটচল্লিশ ঘন্টা, বাহাত্তর ঘণ্টার ক্যাপস্যুল । দোয়াত-কলম ছিল বলে ব্লটিং পেপারও ছিল । ভেজা-কোকেন মাখা ব্লটিং-পেপার, কিংবা যে-লেটার প্যাডের কাগজ কালি টেনে নিতে পারে, এমন লেটার প্যাডে গুঁড়ো কোকেন মাখানো । রাহুল আর ওর দুই ছবি-আঁকিয়ে বন্ধু , অনীক খাস্তগির আর নির্মল মিত্র বাউলা, বেনারসে হিপি-হিপিনীদের পথপ্রদর্শক হবার দৌলতে, বিনে পয়সায় পেতো ব্লটিং পেপার ।
দাদা অনিকেত, অকিঞ্চন ব্যানার্জি, সুকোমল রুদ্র ফিরে যাবার পর, কাঠমাণ্ডুর কুটিরপপাসাদে রাহুল বেশ একা হয়ে গিয়েছিল । চিত্রকর দুই বন্ধু অনীক আর নির্মল বাউলা, সকালবেলা উঠেই কোথাও চলে যেত, এমনকি এক-একরাতে ফিরত না ওরা । অমনই এক রাতে, যখন ও নিঃসঙ্গ বোধ করছে, প্রথম এক এক্সট্রা লার্জ স্লিপিং ব্যাগে ঢোকার আহ্বান পেয়েছিল রাহুল, ভেবেছিল, কাগজটা মুখ পোঁছার জন্য ।
হাতের কন্ঠস্বর নির্দেশ দিল, ‘ইউ ফাকিং অথর , চিউ অ্যান্ড সোয়ালো, অ্যান্ড ফরগেট এবাউট দ্য ওয়র্লড ফর দিস ডে।’
একটু চেটে, রাহুল আঁচ করল ব্লটিংটা মাদক মাখানো । মুখে ফেলে চিবিয়ে গিলে ফেলল । পুকুরে নামার মতন করে, প্রথমে বাঁ, তারপর ডান পা, আলতো নামিয়ে, নেমে গেল স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে ।
হিপি-হিপিনিরা ছিলই দরিয়াদিল, এমনকি দিলফেঁক, চাইলে নিজেদেরই বিলিয়ে দেবার জন্য তৈরি । স্বয়ম্ভূনাথ
মন্দিরকে হিপিরা বলত মাংকি টেমপল, আর এই মন্দির ঘিরেই ছিল তাদের জমায়েত, নেশা করে নির্বাণপ্রাপ্তির প্রাঙ্গণ ।
এক্সট্রা লার্জ স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে, পায়ের দিকে মাথা করে, রাহুল পৌঁছে গিয়েছিল এক এক্সট্রা লার্জ মাংসল জগতে, কাঁচা সোনার বিপুলা অনিশ্চয়তায়, উচিত-অনুচিতের দোটানা-কাটানো ব্লটিং পেপারের জ্যোতির্ময়ী বিভ্রমে । ব্লটিং পেপারের মায়াজাল ওর রক্তে ছড়িয়ে পড়া ঢেউয়ের ওপর ডুবসাঁতার দিতে-দিতে রাহুল নিজের মাংসল অভিজ্ঞতাকে প্রসারিত-সঙ্কুচিত করে সুযোগ-সন্ধানী সম্পর্কজাল বিছিয়ে ফেলেছিল, আর তা, মেয়েটি এক্সট্রা লার্জ বলেই, মেয়েটির
স্বীকৃতি অনুযায়ী, ওকে জড়িয়ে ওপরে তোলা যায় না, কোমরের বেড় প্রায় বুকের সমান, দেহের শক্তিও এমন যে ও-ই পুরুষদের কাবু করে ফ্যালে, হিপি পুরুষরা তার সঙ্গ একদিনের বেশি দিতে চায় না ।
মেয়েটির নাম এমিলিয়া বনিয়া । ঢলে পড়ার আগে রাহুলকে প্রস্তাব দিয়েছিল, চলো আমার সঙ্গে, নিউ ইয়র্কে ।
রাহুল হ্যাঁ-না কোনো জবাব দিতে চায়নি । কাঁচা সোনার কাদায় গড়া এমিলিয়া বনিয়াকে বেনারস যাবার প্রস্তাব দিতে, এমিলিয়া তক্ষুনি রাজি । বেনারসে সবকিছুই আছে, খাওয়ার, ফোঁকার, লুকোবার, সুযোগ আছে ।
রাহুলের আগ্রহ ছিল অভিজ্ঞতায়, নিউ ইয়র্কে নয়, ব্লটিং পেপারের সাইকেডেলিক প্রতিক্রিয়ায়, কল্পনাকে খেলিয়ে তোলায়, যার সুযোগ বেনারসেও পাওয়া যাবে । মগজের ভেতরের উড়ন্ত বিশাল ফড়িংদের পিঠে চেপে চান্ডেলা বধুদের দেশে চলে যাওয়ায়, নিজেকে কখনও ডানাঅলা মাছ, মাছ থেকে লাল রঙের পেঁচা, পেঁচা থেকে দু-পেয়ে গিরগিটি, গিরগিটি থেকে বাঘে রূপান্তরণে । সবুজ বাঘ, তিনতলা উঁচু পেঁচা, জাহাজের মাপের মাছ, ডায়নোসরের মাপের নীল গিরগিটি । হোক এক্সট্রা লার্জ, আহ্বান যতদিন আছে ততদিন সাড়া দিয়ে যাবে । তারপর, মন আর কল্পনা ভরে উঠলে, কেটে পড়বে চুপচাপ । কারোর সঙ্গে কোথাও ও পালাবে না । পালাতে হলে একাই পালাবে, যেমন ছোটোবেলায় বাড়ি থেকে পালাতো ।
এক্সট্রা-লার্জ অভিজ্ঞতা ধরা পড়ে গিয়েছিল অনীক খাস্তগিরের কাছে । ওকে মোটা তরুণীর সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখে বলেছিল, “ও, অনিকেত-সুকোমলরা ফিরে যেতেই নেমে পড়েছ মাংসের পাঁকে । ওই ব্লটিং পেপারের বেশি এগিও না,
ক্যাপসুল খেও না । খেলে হুঁশ থাকবে না, টের পাবে না তোমাকে নিয়ে কী করা হচ্ছে ।”
–এল এস ডি ক্যাপসুল ?
–হ্যাঁ, এস টি পি, বাহাত্তর ঘণ্টার ডোজ ।
–দিয়েছে ব্লটিংখানা, আমি কেন প্রেম দেব না !
অনীক আর নির্মল বাউলাদের এসব বিষয়ে অভিজ্ঞতা ওর চেয়ে বেশি, জানে রাহুল । ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণে বেনারস হিপি-হিপিনীতে ছয়লাপ । বৈভবশালী বাবা-মায়েরা ছেলে-মেয়েদের হিপি সাজিয়ে, ক্যালিফোর্নিয়া-নিউইয়র্কের হিপি-জগতে মিশে যেতে উৎসাহ দিয়ে, ওদের নামে প্রচুর ডলার ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে, পাতা-হ্যাশিশ টানার, চুল-দাড়ি বাড়িয়ে নোংরা থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন, যাতে সেনা বিভাগ ওদের প্রত্যাখ্যান করে, আর ওরা দেশের বাইরে কেটে পড়তে পারে, যতদিন না ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হয় । লয়োলা হিন্ডেনবার্গার নামে অমনই এক হিপিনী জুটেছিল অনীক খাস্তগিরের ছবি-আঁকার স্টুডিওয়, বেনারসে, যার সঙ্গে ও লিভ টুগেদার করত ; নাক-নকশা ভালো বলে হিপিরা অনীককে ডার্ক অ্যাডোনিস নাম দিয়েছে । ছবি এঁকে কতই বা আয় হয় । হিপিনীকে সঙ্গিনী হিসেবে পেলে যৌনতা, মাদক, আর অর্থাগমের দিক থেকে কত সুবিধা । লয়োলা চলে গেছে আরেকজনের সঙ্গে, অনীক তাই কাঠমাণ্ডুতে ।
নির্মল বাউলা অনীকের তুলনায় হিপিদের সম্পর্কে বেশি খোঁজখবর রাখে, ফাই-ফরমাস খাটে । থাকার জায়গা না পেলে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখে । ওর বউয়ের কোনো আপত্তি নেই, টাকাকড়ি আসলেই হল । কোনো ধনী হিপিনী আবদার করলে তার সঙ্গে গঙ্গার চড়ায় কুটির তৈরি করে আদম-ইভের ঢঙে উলঙ্গ জীবন যাপন করে, আর কাঠের আগুনে পাঁঠার ঠ্যাং পুড়িয়ে খায় ।
কাঠমাণ্ডুতে নির্মল বাউলা হিপিদলের সঙ্গে আস্তানা গাড়ার পর বাদবাকি সবাই ওর ডাকে এসে জড়ো হয়েছে । বেনারসের বাঙালি পাড়ার নির্মল বেলেল্লাপনার জন্য বেলেল্লা নামে খ্যাত ছিল ; সেই বেলেল্লা অবাঙালি-লোকমুখে হয়ে গেছে বাউলা । হাতে একতারার বদলে ছিলিম, কাঁধে সবসময়েই ঝোলা টাঙানো, মাথায় যখন-যেমন টুপি, নোংরা আলিগড়ি পাজামা, পাঞ্জাবির ওপর বন্ডি । অনীক সাধারণত কালো পাঞ্জাবিতে, ওর-ও কাঁধে তাপ্পিমারা ঝোলা, ঝোলায় ছবি আঁকার টুকিটাকি আর ছিলিম, পায়ে কোলহাপুরি ।
কাঠমাণ্ডুর নেপালি-নেওয়ারি তরুণ অপেরা-লেখকরা পছন্দ করতেন কানট্রি লিকার, বিশেষত রাকসি আর জাঁড়, যা রাহুলরা খেত মাংসের আচার দিয়ে । তার আগে জানত না যে হরিণের মাংসের, মোষের মাংসের, আচার হয় ।
অনেক সময়ে মোষের কাঁচা মাংস চটকে বানানো কাচিলা মন্ডের সঙ্গে চুকুস-চুকুস । রাহুলরা রাকসিকে বলত রাক্ষসী,
মহুয়ার চেয়েও কড়া মেজাজের, জিভে কামড় দিয়ে পেটে নেমে যেত রাক্ষসী ; পেটের ভেতরে নেমে সে-রাক্ষসী তার লাল-নীল-হলুদ-বেগুনি-সবুজ চুল উড়িয়ে দিত শিরা-উপশিরায়। রাকসির গন্ধ বেশ ঝাঁঝালো ; অনেক দূর পর্যন্ত যেত তার নিশিডাক । রাকসি তোদের ডাক দিয়েছে আয়রে সবাই আয় ।
নেপালের সংবাদপত্রে রাহুলদের উপস্হিতির সংবাদ সেখানকার তরুণ অপেরা-লেখকরা ফলাও করে ছড়িয়ে
দিয়েছিল বলে অনেক ব্যাপার আর জিনিসপত্র হয়ে গিয়েছিল সহজলভ্য, এমনকি বিনে পয়সায় । প্রায়ই ডাক আসত এ-দালান সে-দালান থেকে সারারাত রাকসিপান আড্ডায় অপেরার জন্য।
রাহুল আর অনিকেত দুজনেই গিয়েছিল, সঙ্গে সুকোমল রুদ্র আর অকিঞ্চন চক্রবর্তী । অনিকেত, সুকোমল, অকিঞ্চন দু-তিন সপ্তাহে ফিরে গেলেও রাহুল, চাকরি থেকে নিলম্বিত থাকায়, থেকে গিয়েছিল কয়েক মাস , ওই জনপ্রাসাদে, অনীক-নির্মল বাউলা, দুই চিত্রকর বন্ধুর সঙ্গে, যাদের সঙ্গে রাহুলের বন্ধুত্ব হয়েছিল বেনারসে । হিপিরা ভারতে এসে উঠত বেনারসে । সেই সুবাদে ওরা হয়ে উঠেছিল ওদের শহরপ্রদর্শক, বেনারসে ঘাঁতঘোঁতের গাইড, আর দরকার পড়লে বিছানায় শোবার-ঘুমোবার সঙ্গী ।
অচেনা তরুণীর সাথে শুয়ে পড়তে গেলে নিজেকে অতীত থেকে ভেঙে বিপজ্জনক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে হয় । কে জানে কার কোন রোগ, মনের, দেহের । রাহুল, যে চিরটাকাল একাকীত্বের বিষে ভুগেছে, বিপজ্জনক ভবিষ্যতের ফাঁদে পা দিতে ইতস্তত করেছে, আর উদ্বেগ-উৎকন্ঠার দোটানায় পড়েছে বারবার ; তবুও ওই আহ্লাদের খোঁজ থেকে বিরত হতে পারেনি। মাদকের আর যৌনতার বিভাময় হ্যালোতে আকৃষ্ট হয়েছে । যাপনকে করে তুলতে চেয়েছে অবাধ আর সীমালঙ্ঘনময় ।
রাহুলের, ওই জনপ্রাসাদে থাকার সময়ে, সবচেয়ে বেশি সমস্যা হতো মাদকের নেশা করে রাতের বেলায় সেই প্যাঁচালো সিঁড়ি বেয়ে নিজেদের ঘরে যাওয়া । নানা অপেরা-আড্ডায় সময় কাটিয়ে, ও ,রাতে ফিরে ,প্রায়ই গুলিয়ে
ফেলত। ওরা ছিল দোতলায় । কটা পাকের পর দোতলায় পৌঁছোবে তা খেয়াল রাখতে পারত না । প্রত্যেক দিন বাঁদিকের কারোর ঘরের কাছে পৌঁছে টের পেত যে, এটা নয়, নিচে বা ওপরে গিয়ে ডানদিকে যেতে হবে । কারও কারও দরোজায় ঝোলানো থাকত পরদা, বেশ নোংরা, মনে হতো যে পরদাতেই হাত পোঁছে ভাড়াটেরা । সে ঘর কোনো হিপি-হিপিনির হলে তাদের ঘরের খড়ের বিছানায় গিয়ে চিৎপটাং গা এলিয়ে দেবার বাধা ছিল না, সকাল পর্যন্ত, বা যতক্ষণ না ধোঁয়ার খোঁয়ারি কাটছে ততক্ষণ হাত-পা ছড়িয়ে ।
এমিলিয়া বনিয়া এক হ্যাঁচকায় তার স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে টান দিলে, হ্যাশিশের ঝিলমিলে নেশায়, পায়ের দিকে মাথা করে ঘুম । মদ খেলে লোকে টলতে থাকে । ভেষজের নেশায় যা হয় তাকে বোধহয় বলা উচিত ভাসতে থাকা বা উড়তে থাকা, নিজের গড়ে-নেয়া আকাশে-বাতাসে। ছাদ থেকে ফেলে দেয়া টিশ্যু পেপারের মতন । কত রকমের রঙের বিস্ফোরণ ঘটে নিঃশব্দে, উড়তে থাকে কমলালেবুর কোয়ার ডানা মেলে প্রজাপতির ঝাঁক ।
একদিন রাতে ফিরে, আজও স্পষ্ট মনে আছে রাহুলের, সিঁড়ির পাক গুলিয়ে ওপরে গেল, হদিশ করতে না পেরে নিচের পাকে নেমে এলো, আরও কয়েকবার ওঠা-নামা করার পর উঠছে, একটা বাঁদিকের ঘর থেকে নোংরা পরদার ফাঁক থেকে স্বাস্হ্যবতী নারীর ডান হাত বেরিয়ে এলো, সবুজ কাঁচের চুড়ি, লাল রঙের ব্লাউজের হাতা ; এক হ্যাঁচকায় ভেতরে টেনে মহিলা নেপালি-টানের হিন্দিতে বললেন, ‘রোজই দেখি দরোজা অব্দি আসো, ফিরে যাও কেন ?’
কাঠমাণ্ডুতে কয়েকমাস থেকে, বেনারস হয়ে, বেনারসে কুড়ি দিন আর একুশ রাত কাটিয়ে, রাহুল ফিরে গিয়েছিল শ্যাওড়াফুলির খণ্ডহরে । বেনারসে ঘর ভাড়া নিয়েছিল এমিলিয়া বনিয়া, তিন তলার ছাদে একলা একটা ঘর । জীবন হয়ে গিয়েছিল গুহামানবের, অনেক সময়ে চারপেয়ে পশুর । এমিলিয়া বনিয়াকে স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার উদ্দেশে, পরে, তার যাবতীয় কাণ্ড-কারখানা নিয়ে একখানা উপন্যাস লিখে ফেলেছে রাহুল, এমন কায়দায় যাতে পাঠক মনে করে ওটা বানানো গল্প ।
কলকাতা থেকে সুকোমল রুদ্রর তাড়া আসতে, যেতে হল ।
আদালত ওকে একমাসের জেলের সাজা দিতে, ও রিভিশন পিটিশনের দরখাস্ত দিল । তারপর হাতে অফুরন্ত সময়।
একদিন হঠাৎ নির্মল বাউলা এসে হাজির, দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে, কদমছাঁট চুলে, টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে । বলল, অনীক একজন হাফ-হিপিনীর সঙ্গে লিভ টুগেদার করছিল, তারপর ভয়ে চলে গেছে দিল্লি ।
–হাফ-হিপিনী ?
–হ্যাঁ, আমেরিকান এমব্যাসির অফিসারের মেয়ে, সে অফিসার দিল্লিতে পোস্টেড ।
–ভয়ে ? কার ভয়ে ?
–অকিঞ্চন ব্যানার্জি চারু মজুমদারের আন্দোলনে যোগ দিয়েছে বলে হাতে বেয়নেট নিয়ে পুলিশ ওদের সবায়ের পোঁদে লেগেছে ।
রাহুল বলল, পশ্চিমবঙ্গ তো আরো বিপজ্জনক, তুমি বরং কানপুর চলে যাও, জুহি পরমপুরওয়ার বস্তির লোকেদের সঙ্গে মিশে যাও । অনিকেতকে বলো কোনো একটা উপায় খুঁজে বের করতে । অনীক শেষে ফাঁদে পড়েনি তো ? কে যে কার ওপর নজর রাখার জন্য কাকে ব্যবহার করছে তা টের পাওয়া বেশ মুশকিল হয়ে গেছে হে ।
নির্মল বাউলা সপরিবারে কানপুর পৌঁছোলে, অনিকেতের উপদেশমত ও নাম পালটিয়ে ফেলল, নতুন নাম হল রামবহল প্রসাদ, কদমছাঁট চুল, চুল থেকে উঁকি মারছে টিকি । ধুতি আর শার্ট । অনিকেত ওকে রঙিন মাছের দোকান খুলে দিল । চারু মজুমদারের আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর নির্মল বাউলা আবার নিজের নামে ফিরে গেল । কিন্তু বেনারসে ফিরল না । বসত গাড়ল দিল্লিতে ।
ওরা তিনজনেই, অকিঞ্চন, অনীক আর নির্মল, বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজবদলের গোপন স্বপ্নে মজে রইল যতদিন বেঁচে ছিল । ততদিনে স্বপ্নভূমি শহর ছেড়ে এগিয়ে চলেছে গভীর জঙ্গলে ।
সুমিতাদি, মানে সুমিতা চক্রবর্তী, ভবিষ্যত টের পেয়ে বিপ্লবের স্বপ্ন থেকে চুপচাপ উঠে আলতো পায়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎবাণী করে গিয়েছিলেন ।
মার্কিন বন্ধুনি অনীক খাস্তগিরকে নিয়ে, পাড়ি মারল আমেরিকা । নির্মল নিজের নামে ফিরলে, অনীক আর অকিঞ্চন দেশে ফিরল । অনীক ওর মার্কিন বউকে না জানিয়ে ফিরে এসেছিল, এসে, ডাকে ডিভোর্সের কাগজ পাঠিয়ে দিয়েছিল, কেননা ততদিনে ওর এক আইরিশ বন্ধুনি দখল করে নিয়েছে ওর জীবন আর সময় ।
অকিঞ্চন ব্যানার্জিও বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল, নয়তো খুন হয়ে যেত ।
রাহুল অতীতে ফেরে ।
ঠাকুমা, সবাকসুন্দরী, তাঁর করা প্রশ্ন মনে আছে : ঘুমের মেয়ে না শোবার মেয়ে !
ঘুমের মেয়ে ? না, শোবার মেয়ে ?
ঘুমোবার বা শোবার কেন্দ্রে মেয়েরাই বা কেন ?
সারা জীবনে কোলবালিশ যে ভালোবাসা পায়, তা কি ভেবে দেখিছিস ? জিগ্যেস করেছিলেন সবাকসুন্দরী দেবী।
বালিগঞ্জ কি কেন্দ্র ? শৌখিন বাঙালিয়ানা সেদিকেই এগোচ্ছে । বুদ্ধদেব বসুর অপেরাভবন ওই এলাকাতেই । ওমুখো হতে চায়নি জীবনানন্দ দাশের গোপন বিপদসঙ্কুল অপেরা ; সবই ট্রাঙ্কে চলে গেছে, থাকের পর থাক খাতা, সযত্নে । বোধহয় জানতেন যে প্রতিটি ভবনই অবসানের দিনক্ষণ সঙ্গে করে আনে ।
জোড়াসাঁকোকে রবীন্দ্রনাথ তুলে নিয়ে গেছেন বোলপুরে । তিনি বিদায় নেবার পর সেখানে একজুট হয়েছে বিভ্রান্তি, রক্তহীনতা, অবরোধ, আপেক্ষিকতা, কলুষ, অলীকমায়া আর প্রবঞ্চনার এমন অভিকর্ষ যা শিকড়কে মাটিতে টানতে চায় না ; পারে না । ক্ষুদ্রদের কী ভাবে দৈত্যের মতন দেখায়, পোকামাকড়রা তার অনুশীলন করে ।
রবীন্দ্রনাথ ! সুমিতাদির হাত ধরে ব্রাহ্ম কবি-লেখকদের জগতে । সুশৃঙ্খল বিশৃঙ্খলার সেই শুরু ।
হাওড়া-শেয়ালদা-দমদমে পা দিয়েই যেখানকার মানুষ নিজের মধ্যে আত্মগোপন করতে চেষ্টা করে, সেখানে কী করেই বা গড়ে উঠবে কেন্দ্র ! ফলে দোষগুলোই হয়ে উঠেছে শহরটার বৈভব । গর্তনিবাসীরাও অকারণে ছদ্মবেশ ধরে । কেউই জানে না গর্তের মুখটা গোল না চৌকো না খাপছাড়া । মাঝে-মাঝে তাদের সুপ্ত সন্ত্রাসের আপতন, অমনোযোগী মজার ক্ষণস্হায়ী সম্ভাবনার ঝলকানি কখনও-সখনও চোখে পড়েছে রাহুলের, যার ডাক নাম রাহু ।
অসীম গাঙ্গুলি আঁচ করলেন, রাহুল, যার ডাক নাম রাহু, কী ভাবছে । উনি বললেন, বেশ শ্লেষ মেশানো কন্ঠস্বরে, ‘রক্তিমকে বই ছাপতে দিয়েছিলে শুনেছি, সে বইয়ের কী দশা হয়েছে তাও শুনেছি।’ তারপর যোগ করেছিলেন, ‘স্কুল-কলেজে ভালো ফলাফল করলেই মানুষ চেনার ক্ষমতা হয় না । তোমার দাদা তো রক্তিমকে ভালো করেই চিনতো ; ওর পাহাড়টিলার বাসায় ছিল দুবছর । ওর তো উচিত ছিল তোমাকে সতর্ক করে দেয়া । অনিকেতের শ্বশুর কেন নিজের মেয়ের সঙ্গে রক্তিমের বিয়ে দিতে চাননি তা জানো তো ? আমাকে বিশ্বাস করা প্রয়োজন মনে করোনি তুমি !’
রক্তিম চাটুজ্জের নামটা আন্দোলনের নেতা হিসাবে দেখানো হয়েছে বলে ঈর্ষা, নাকি রক্তিমের অননুকরণীয়
অপেরার জনপ্রিয়তার জন্য ? নাকি পথেঘাটে রক্তিম মদ না খেয়েও মাতাল সাজার অভিনয় করতে পারে বলে ? চাপা
ঈর্ষা মানুষকে কুঁদুলে করে ।
ঈর্ষা হওয়া উচিত সঘোষ ।
নীলকমল চৌধারী, চৌধুরী নয় চৌধুরী নয়, চৌধারী, চঔধাআআআরী, চঔধাআআআরী, হুম, কারেক্ট, যে মোটা-মোটা বাংলা পাল্প-অপেরা অনুবাদ করে দেশের বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে গণবিয়েতে পাওয়া বউকে খোশখেয়ালে
তরতাজা রাখে, কাল বিকেলে, ওর বড়বাজারি হিন্দি ট্যাবলয়েড দপতরে আড্ডা দেবার সময়ে বলেছিল, ‘আরে তুম ইন রংবদলু ফলানাদাদা ঢেকানাদাদা লোগোঁকো লেকর কেঁও চল রহে হো ! তুম তো হো রাহু ; সুরজকা আগ খা কর জিন্দা হো । চমকতে হুয়ে আঠ কালে ঘোড়ে পর সওয়ার হো । ছোড়ো উন বুডঢোঁকো ।’
নীলকমল চৌধারীর বাবা নীলকমলের মা মারা যাবার পর যে মেয়েটিকে বিয়ে করেন, তার বয়স ছিল নীলকমলের চেয়ে কম । বাপ-ছেলে একই যুবতীর প্রতি আকৃষ্ট ; যুবতী বাপের চেয়ে ছেলেতে বেশি । বাড়িতে অবস্হা বেগতিক হয়ে উঠছে দেখে নীলকমলের বাবা সৌরঠ সভার গণবিবাহের মাঠে, যেখানে মৈথিলি ব্রাহ্মণরা বছরে একবার নিজেদের ছেলেমেয়ের পাত্রপাত্রীর খোঁজে ঢুঁ মারে, সেখানে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন নীলকমলের । চার বছরের মাথায় বউয়ের ভাইঝির প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করে নিলে নীলকমল ; বিছানায় ডান পাশে পুরোনো বউ, বাঁ পাশে নতুন বউ । টিকল না , নতুন বউয়ের বোনের সঙ্গে আবার প্রেমে পড়ায় ।
বিয়ে করলেই প্রেম ফুরিয়ে যায় মনে করে ও, নীলকমল, আর তাই, বারবার প্রেমে পড়তে চায় । নিজের তৈরি ফাঁদ কাটিয়ে বেরোবার জন্য নীলকমল পালিয়ে এলো কলকাতায় । ব্যাস, কলকাতায় ওকে জাপটে ধরল চিনাদের হালুমবাঘ পাড়া । কাগজের ড্রাগনদের আড়ালে কত কী যে করা চলে, তাও জেনে ফেলল । গাঁজা চরস আফিম চিনা যৌনসেবিকা আর ওই পাড়া থেকে কয়েক চাউমিন-মোমো দোকান দূরে ওর হিন্দি ট্যাবলয়েডের দপতর । রাহুলকে বললে, ‘চলো, তুমকো চিন দেশকে নরক মে লে জাতা হুঁ , ডিভাইন কাম-এ-দুনিয়া মেঁ পহুঁচ কর তুমহারা মর্দানগি খিল উঠেগা, তুমহারে অওর মেরে তরহ চুতিয়োঁকা স্বর্গ হ্যায় ।’
–ডিভাইন কাম-এ-দুনিয়া ?
–হাঁ, তুম চাহে ভার্জিল বনো য়া দান্তে, জো মর্জি । নরক কো স্বর্গ মে বদলনা কোই মামুলি স্বার্থ নহিঁ হ্যায় ।
আবার সেই কল্পনা দখলের খেলা ; কারোরই জানা নেই স্বর্গ কীরকম, কিংবা, সকলেই জানে স্বর্গ কীরকম । এনার স্বর্গে বসিয়ে দাও ওনার স্বর্গ ; ওনার স্বর্গে বসিয়ে দাও তাঁর স্বর্গ । এভাবেই কল্পনা দখল করো ।
নীলকমলের বাড়ি ছিল সাহারসা জেলার মাহিষি গ্রামে, ছিন্নমস্তার মন্দিরের জন্য প্রতিবছর বর্ষায় মেলা হয় ওদের গ্রামে । গিয়েছিল রাহুল, ওর বয়স তখন কত, মমমমমমমম, যা-ই হোক না, কী-ই বা এসে যায় । মন্দিরে পুজোর রাতে মোষ বলি হয় আর মোষের মাংসের প্রসাদ পায় ভক্তরা । দিশি সোমরস মদের সঙ্গে প্রসাদ , খেয়েছিল রাহুল, অন্য ভক্তদের মতন । রাহুল তো প্যাগান, তহমিনা আপার দেগে দেয়া জাহিল আর কাফের , কুফ্র, কুফ্র, কুফ্র কহিঁকা । রোদ-আলো-বাতাস-জল-প্রকৃতি ওর কাছে ডিভাইন, ঠাকুরদেবতাদের ঘরসাকিন-আদল নিয়ে নিশ্চিত নয়, খালি গায়ে আর মুখে মোষের রক্ত মেখে নেচেছিল । ওর মনে হয়েছিল, আর এর জন্য ধন্যবাদ দিতে হয় গ্রামবাসীদের যুক্তিহীনতাকে, ভাগ্যিস ছিন্নমস্তার মন্দিরটা ছিল, নয়ত সারা গায়ে মোষের রক্ত মেখে যে রাতদুপুরে দুশো মানুষ-মানুষী মিলে নাচা যায়, সাময়িক হলেও, বেপরোয়া উন্মাদ হওয়া যায়, তা অজানা থেকে যেত । নিজের একাকীত্বকে এনজয় করার আরামদায়ক পাগলামি । ইউরোপের জ্ঞানগম্যি থেকে ছাড়ান পাবার সহজ সুযোগ এনে দিয়েছিল নীলকমল। ভিড়ের ভেতরে সেঁদিয়ে একাকীত্বের মতন আরাম নেই ।
তখন পর্যন্ত, আর এখনও, সত্তর পেরিয়ে, ‘ঈশ্বর’ ধারণাটা কোনো হিন্দু ধর্মবইতে পায়নি রাহুল । পেয়েছে কেবল দেবী-দেবতাদের কাহিনী । কোনো বইতে ‘ঈশ্বর’ নেই , অথচ আত্মীয়-স্বজন-জ্ঞাতিগুষ্টির সবাই সেই অবর্তমান ঈশ্বরের কথা বলে ; দেবী-দেবতাদের মনে করে ‘ভগবান । রাহুলের মাও গণেশ দুর্গা সরস্বতীর মূর্তি সাজিয়ে রেখেছেন ঘরের কোনে, আর তাদের সবাইকে বলেন ভগবান । মা-বাবা কেউই ঈশ্বর শব্দটা কখনও ব্যবহার করেননি কেন, অবাক লাগে রাহুলের । নীলকমলও বলত, ‘আরে ঈশ্বর নামকা কোই অস্তিত্ব নহি হ্যায়, যো তুমহারে ঘরকা দেওতা হ্যায় ওহি ভগওয়ান হ্যাঁয় সমঝলো, বিসওয়াস করনে কা জরুরত নহিঁ, সমঝনে সে মতলব হ্যায়, কোই রহে ইয়া না রহে, কেয়া ফর্ক পড়তা হ্যায় ।’
নেশা নীলকমলকে এমন নির্মোহ জাপটে ধরে ফেলেছিল, যে, প্রেমিকাদের ছাড়লেও, মগজের রাসায়নিক
ইন্দ্রজালের মোহকে ছাড়তে পারেনি । রাহুলরা ওকে ফেরত নিয়ে গিয়ে প্রথম বউয়ের কাছে সোপর্দ করলে, ওকে ভর্তি
করে দেয়া হল হাসপাতালে, লেখকদের কোটায়, একটা আলাদা ঘরে । ডাক্তার ওকে বলে দিয়েছিল যে ওর পেটের আর ফুসফুসের অবস্হা খুব খারাপ । শল্যচিকিৎসা করতে গেলে পুরো হাসপাতাল আফিম গাঁজা চরসের ধোঁয়ায় ভরে যাবে । মনের সুখে হাসিমুখে মরার অপেক্ষা করত ।
একদিন, ভিজিটিং আওয়ারে, রাহুলকে বললে, আমার জন্য কালকে একটা কনডোম এনে দিও ।
–কনডোম ?
–হ্যাঁ, একজন নার্স রাজি হয়েছে ।
কিছুক্ষণ পর একজন ময়লা মালায়ালি নার্স ঘরে ঢুকতে, নীলকমল বললে, এই যে, এই মেয়েটিই রাজি হয়েছে ; তুমি কাল একটা কনডোম নিয়ে এসো ।
নার্স রাহুলের দিকে তাকিয়ে জিভের ডগা দিয়ে ঠোঁটে হাসি বুলিয়ে শুধিয়েছিল, হ্যাঁ, আপনি একটা কনডোমের প্যাকেট কাল এনে দেবেন, আজকে বরং উনি ভালো করে ঘুমিয়ে প্রেম করার জন্য চাঙ্গা হয়ে নিন ।
পরের দিন রাহুল গিয়ে দ্যাখে ঘর ফাঁকা, রুগির বিছানায় ধবধবে সাদা চাদর, নতুন রুগির অপেক্ষায় । খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, কাল রাতেই মারা গেছে নীলকমল । ওর প্রথম বউ রাত থাকতেই নিয়ে গেছে ওর শবদেহ । প্রাক্তন প্রেমিকারাও শবদেহের মালিকানার প্রশ্ন তুলতে পারে ! কেন ? রাহুলরা ওর শবদেহ নিয়ে যখন দাহ করার জন্য বেরোল, বাড়ির সামনে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা সমস্বরে ওর বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানবিরোধী অপেরার লাইন আবৃত্তি করছিল । নীলকমলের অপেরায় একটা লাইনে যে ওর নাম রয়েছে, প্রথম শুনল রাহুল, শ্মশানের পথে । বইটা দিয়েছিল নীলকমল, কিন্তু আলস্যের দরুণ পড়া হয়ে ওঠেনি । আদরে পাওয়া কত বই যে অনাদরে চুপচাপ পড়ে থাকে, পড়ে থেকে-থেকে পড়েই থেকে যায়, পড়া হয়ে ওঠে না কোনো দিন । বইগুলো অপরাধবোধে ভুগে-ভুগে হলুদ-কালচে হয়ে যায় ।
সেই নীলকমল জানতে চেয়েছিল, ফলানাদাদা-ঢেকানাদাদাদের কেন সঙ্গে করে নিয়ে চলেছে ।
কেন চলে চলেছ ?
আমি কেন নিয়ে চলব ? ওনারা দমবন্ধ হয়ে বাধ্য হয়ে চলে চলেছেন । অসীম গাঙ্গুলি ওনাদের দমবন্ধ করে
দিয়েছেন।
কী করে জানতে পারলেন অসীম গাঙ্গুলি যে রক্তিম চাটুজ্জেকে বই ছাপাবার টাকা দিয়েছিল রাহুল ! দাদা অনিকেত , যাঁর ডাক নাম কেতু, বলেননি নিশ্চই । হয়তো মদের ঘোরে তন্দ্রামাতাল রক্তিম চাটুজ্জে নিজেই ফাঁস করে দিয়ে থাকবেন । ঠিকই, দার্শনিক অপেরা নিয়ে লেখা বইয়ের পাণ্ডুলিপি আর টাকা রক্তিম চাটুজ্জেকে দিয়েছিল রাহুল , যার ডাক নাম রাহু, আর যার দাদার নাম কেতু ; উনি অত্যন্ত বাজে কাগজে পঞ্চাশ কপি বই ছাপিয়ে দিয়েছিলেন, প্রুফ দেখার প্রয়োজন মনে করেননি ; নিজেই একটা প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন । সে বই জড়ো করে রক্তিম চাটুজ্জের উল্টোডাঙার বস্তিবাড়ির সামনেই, পেটরল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল রাহুল , যার ডাক নাম রাহু, আর যার দাদার নাম কেতু । বাকপটুতার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে জোরাজুরি করেছিলেন রক্তিম, যাঁর অপেরার নিশিডাকে মুগ্ধ ছিল রাহুল ; আর সে মুগ্ধতা কাটিয়ে ও কখনও, এমনকি আজও, যখন ওর বয়স, মমমমমমমমমমমম, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, বেরোতে পারেনি, রক্তিম চাটুজ্জের সঙ্গে সম্পর্ক বিগড়ে যাবার পরও । বিগড়ে যাবার কারণ কেবল টাকা নয়ছয় নয় । কাউকে-কাউকে এক-এক সময়ে ভালো লাগে, আবার হঠাৎ ভালো লাগে না, অকারণে ।
রাহুলের বেশ আহ্লাদ হয় যখন রক্তিম চাটুজ্জের গবেষকরা, থিসিস লিখতে বসে, রাহুলকে খোঁচান , যেন রক্তিম চাটুজ্জেই ওই যন্ত্রজীবদের বকলস খুলে দিয়ে থাকবেন । কত সেলিব্রিটি আজকাল মদের বিজ্ঞাপনের মডেল হন । রক্তিম চাটুজ্জেও হতে পারতেন । কোষ্ঠকাঠিন্য আর সর্ষের তেলের চেয়ে শ্রেয় হতো যখন লুপুংগুটুর ঝর্ণার পৃষ্ঠভূমিতে ঘাসের ওপর শুয়ে বলতেন, ‘কওন কমবখ্ত হ্যায় জো বরদাস্ত করনে কে লিয়ে পিতা হ্যায় ; ম্যায় তো পিতা হুঁ কি বস সাঁস লে সকুঁ’, মহুয়া মদের খালি বোতল জলেতে ভাসিয়ে দিয়ে ! পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে ছাতিম গাছের তিনটে হলুদ পাতার ডগা ।
রাহুল যখন বিভাগীয় প্রধান পদে কলকাতার দপতরে বদলি হয়ে এলো, তখন কে বা কারা রটিয়ে দিয়েছিল যে ওর মৃত্যু হয়েছে । দুচারটে পত্রিকা ওর মৃত্যু নিয়ে আহ্লাদমাখা সম্পাদকীয় লিখেছিল । রাহুল তখনও কোয়ার্টার পায়নি বলে অনিকেতের বাড়িতে ছিল । ওর মৃত্যুর খবরে, অনিকেতের বাড়িতে, ছুটে এসেছিলেন কিন্তু রক্তিমই । সেখানে রাহুলকে দেখে বলে উঠলেন, ‘আরে ! তোমার মরে যাবার আনন্দে খালাসিটোলায় তোমার বন্ধুরা চিয়ার্স করছে, আর
তুমি এখানে ইজিচেয়ারে বসে ঠ্যাং নাচাচ্ছ ! চলো, বেঁচে থাকার আনন্দে স্মিরনফ ভোদকা খাওয়াবে চলো ।’ রাহুল
বলেছিল, একদিন যাবো আপনার বাড়ি স্মিরনফের বোতল নিয়ে । আপনি, আপনার স্ত্রী, দাদা, আমরা সবাই মিলে খাবো । রক্তিম বলেছিলেন, কবে আসবে ফোনে জানিও, মাংস-ভাত আর স্মিরনফ । গিয়েছিল রাহুল । সবাই নানা মাপের কাচের গ্লাসে, রক্তিমের স্ত্রী ওনার উঁচু শ্যামপেন গ্লাসে । কোথা থেকে অমলেন্দু আতর্থী জুটে গিয়েছিল সে-মৌতাতে।
রাহুল , যার ডাক নাম রাহু , প্রথম কথা-কাটাকাটির দিন, অসীম গাঙ্গুলির অগোছালো ধূসরফুল তোশক পাতা খাটে , যা মনে হচ্ছিল ঘুমের আলস্য ঝেড়ে স্বপ্নে মুখরিত মজাহীন রাত কাটিয়ে তখনও বেরোতে পারেনি, আগাম ম্যারাথন লেখালিখির আঁতুড় ঘর, আর ছোট্টো টেবিলে রাখা পত্র-পত্রিকার গন্ধের উদাসীনতার মাঝে বসে , চিৎকারে লুকোনো অচেনা ভাষার মতো বক্তব্যে, প্রায়-ফাঁকা রেলস্টেশানে কোনো মহিলার অট্টহাসির আকর্ষণে ক্ষণিক স্তম্ভিত জনাকয় পাবলিকের মতন , হতবাক, থ ; যেন বহু বহু বহু বহু দুরের ছায়াপথ থেকে পাঠানো শীতে, অসীম গাঙ্গুলি মুড়ে ফেলতে চাইছেন নিজেকে। ওনার রয়েছে নির্ধারিত ছককাটা উদ্দেশ্য ,জীবনের মেপে-নেয়া গতিপথ ,আকাঙ্খার রৈখিক নকশা । গলার শিরা ফুলিয়ে বলেছিলেন, কাফকা, বালজাক, মার্সেল প্রুস্তের মতন গদ্য লিখে তাক লাগিয়ে দেবেন , বাংলা গদ্যকে এমন উচ্চতায় তুলে নিয়ে যাবেন যা প্রদীপন চট্টো কল্পনাও করতে পারবে না ।
তাহলে সেই কল্পনাই !
কল্পনা যদি তিন মাথার মোড়ে এসে দাঁড়ায় ?
ইহুদিদের পরমপুরুষ মোজেসের পায়ের কাছে ছড়িয়ে পড়েছিল টেন কমাণ্ডমেন্টসের পাথরের টুকরোগুলো , সারা ঘরময় । জড়োকরা গল্পের খাজাঞ্চিখানা । টুকরো-টুকরো আয়না ছড়িয়ে মেঝেতে টুকরো-টুকরো মুখ ।
অসীম গাঙ্গুলিকে, দেখা করার দিনক্ষণ জানিয়েই গিয়েছিল রাহুল , যার ডাক নাম রাহু, আর যার দাদার নাম কেতু । অপেরাগ্রন্হ প্রকাশ করা নিয়ে কথা বলবে বলে এসেছিল, কিন্তু রাহুল ওদের আন্দোলনের একটা লিফলেট ওনার দিকে এগিয়ে দেয়া মাত্র সারা ঘর গমগম করতে শুরু করেছে বিদারের চচ্চড় আওয়াজে ।
নেতৃত্ব ! একটা ফালিকাগজে ইংরেজিতে লেখা একটা শব্দ । তার আঘাত এতো গুরুতর ! লিডার ?
রাহুল যখন এসে পৌঁছেছিল ,বাড়ি ছিলেন না উনি । মাসিমা, ওনার মা , বললেন, বোসো বাবা, তোমার প্রিয়
ইলিশ মাছ কিনতেই গেছে ও ; ফিরবে এক্ষুনি ।
অসীম গাঙ্গুলির মা কী করে জানলেন রাহুল , যার ডাক নাম রাহু, আর যার দাদার নাম কেতু, ইলিশ মাছ খেতে ভালোবাসে ! ও তো বলেনি কখনও । এর আগে একবারই ভাত-ডাল-আলুভাজা খেয়েছিল অসীম গাঙ্গুলির নিমপুকুরের পুরোনো বাড়িতে । নিরামিষ ।
অসীম অবশ্য রাহুলদের কানপুরের বাড়িতে খেয়েছিলেন ইলিশ । মচ্ছিবাজার থেকে কিনে এনেছিল রাহুল, ঝিকমিকে রুপোলি ইলিশ।
ঘন্টাখানেক পরে বাজার করে ফিরেছিলেন অসীম গাঙ্গুলি । সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে রাহুলকে, যার ডাক নাম রাহু , আর যার দাদার নাম কেতু, এক নজর দেখে, শরীরে গাম্ভীর্য খেলিয়ে, ভেতরে চলে গিয়েছিলেন ।
অসীম গাঙ্গুলির কন্ঠ শুনতে পেল রাহুল , ‘ইলিশ পাওয়া যায়নি ; আমেরিকান কই এনেছি ।’
আমেরিকান কই ! আমেরিকাতে কইমাছ হয় নাকি ? স্ট্রেঞ্জ ! রাহুলের জানা নেই ।
ঘরে ঢুকে, রাহুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমেরিকান কই খাও তো ? নতুন এসেছে বাজারে। বিদেশে একে তেলাপিয়া বলে, খেতে ভালো, কাঁটা নেই । তোমাদের কানপুরে পাওয়া যায় ?’
কে জানে, হয়তো ইচ্ছে করেই ইলিশ আনেননি অসীম ; মাছের মাধ্যমে বার্তা পাঠাতে চাইছেন । খাবার জন্য তো আসেনি রাহুল , যার ডাক নাম রাহু । এসেছিল রামায়ণ নট্ট কোম্পানি থেকে ওর প্রকাশিতব্য বই নিয়ে কথা বলতে, আর ওদের আন্দোলনের একটা বুলেটিন দেবার জন্য ।
অসীম গাঙ্গুলির দিকে আন্দোলনের সাপ্তাহিক বুলেটিনের ফালিকাগজটা এগিয়ে দিতে, ছিনিয়ে নিয়ে, বলে উঠেছিলেন, ‘দেখেছি দেখেছি ; তোমার বন্ধু হরিচরণ খাঁড়া দিয়ে গিয়েছিল ।’
পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল রাহুল । ওনার মুখে, রাহুলের বড় জ্যাঠা যাকে বলতেন, রাগলে পরে সারা শরীরে পাথুরে জীবাশ্মর ঢেউ ছড়িয়ে ছড়িয়ে ঝির-ঝির ঝরে পড়তে থাকে, সেরকম আদল চোখে পড়ল রাহুলের ।
–লিডার ? লিডার আবার কী ? অপেরা মুভমেন্টের লিডার হয় নাকি ? হয়েছে কখনও ? কোন আন্দোলন
লিডারের নাম ঘোষণা করে আরম্ভ হয়েছিল ? সুররিয়ালিজম, সিমবলিজম, ডাডাইজম, কোনো অপেরা-আন্দোলনের
ম্যানিফেস্টোতে লিডারের নাম দেখেছ ? ম্যানিফেস্টোতে কি আঁদ্রে ব্রেতঁ লিখেছিলেন যে উনি পরাবাস্তববাদীদের নেতা ?’ মনে রাখা আর ভুলে যাওয়ার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে, একটানা প্রশ্ন করে গেলেন অসীম গাঙ্গুলি। তারপর বললেন, ‘ইংরেজিতে কেন ? আন্দোলন করতে চাইছ বাংলার অপেরাজগতে, ইংরেজিতে ম্যানিফেস্টো লিখে ? তোমার কানপুরের হিন্দি রসিকদের জানাতে চাও যে কলকাতায় আধুনিক অপেরার নেতৃত্ব এখন কার কন্ঠে ?’
শুনতে-শুনতে, রাহুলের মনে হল, যেন কন্ঠরোধী রসায়নের তোড় আটকে গেছে ফুসফুসে, যা ওগরাবার সুযোগ পেয়ে গেলেন উনি, রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারীমশায় ।
ওহ হো ; এবার স্পষ্ট হল রূপক মজুমদার কেন রামায়ণ নট্ট কোম্পানি ছেড়ে চলে গেছেন । রূপকের কোনো ধরে রাখার লোভ নেই । ছেড়ে দেবার ক্ষমতা অনেকটা মহাশূন্যের মহাবিস্ফোরনের ক্ষমতার মতন ; একের পর এক গ্রহ আর উপগ্রহ নিজের দেহ থেকে জোর করে তাড়িয়ে দিয়ে মহাকাশকে ভরে তুলেছে বিস্ময়ে । ধরে রাখাটা ক্ষমতা নয় ; ক্ষমতার অভাব । অন্যদের নিজের সঙ্গে বেঁধে রাখার প্রয়োজন কেনই বা হবে একজনের !
অনেককাল পরে, রাহুলের বয়স তখন কত, সে যা-ই হোক, কী-বা এসে যায়, ওই একই ফালিকাগজে ছাপা আরেকটা শব্দ আতঙ্কিত করেছিল কামেশ্বর চোঙদারকে, মহাভারত নট্ট কোম্পানির অধিকারীমশায়ের ওসকানিতে । সেই শব্দটা ছিল ক্রিয়েটার । কামেশ্বর চোঙদার সেই আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল প্রভাস চোঙদার, অমলেন্দু আতর্থী আর নবদেব সরখেলের রক্তে । বেচারা । রক্তদূষণে তারা ঢুকে গেল শাসকদলের ছত্রছায়ায় ।
সুমিতাদি : লিডার, ক্রিয়েটার এই সমস্ত ধারণাগুলো তো তুই বাইবেল থেকে পেয়েছিস ; লোকে তো বলবেই তোরা বিদেশি প্রভাবিত ।
রাহুল : খ্রিস্টধর্ম কি বিদেশি ?
সুমিতাদি : ধর্ম তো জাস্ট আইডিয়া, যে-আইডিয়ায় একটা সম্প্রদায় বিশ্বাস করে ।
রাহুল : তবে ?
সুমিতাদি : তুই নিজেই ভেবে দ্যাখ । গোঁফ-দাড়িতে ওই ভদ্রলোক, রক্তিম চট্টোপাধ্যায় না কি যেন নাম, তার মধ্যে তুই খুঁজে পেলি ওল্ড টেস্টামেন্টের মোজেসকে, আর মোজেস, সকলেই জানে, ছিলেন লিডার ; নিজের মধ্যে খুঁজে
পেলি জিশাস খ্রাইস্টকে, যিনি, সকলেই জানে, খ্রিস্টধর্মের ক্রিয়েটার ; আর হরিচরণ খাঁড়া নামের ভদ্রলোকটি হলেন সেইন্ট পিটার, খ্রিস্টধর্মের প্রচারক । অনিকেত, তোর দাদা, দাঁড়িয়ে আছেন আব্রাহামের মতন বা সেইন্ট জোসেফের মতন ।
রাহুল : না, আমার মাথায় তো অমন চিন্তা ছিল না ।
সুমিতাদি : অবচেতনে ছিল । সেইন্ট পিটার যোগাড় করতে লাগল সদস্যদের, কনভার্ট করার জন্য । কেউ-কেউ হল, কেউ-কেউ হল না, বা হয়েও পালিয়ে গেল ।
রাহুল : এটা ঠিক যে একাধজন জুডাসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল, ফর থার্টি পিসেস অব সিলভার ।
সুমিতাদি : ধর্ম নিয়ে যে ঝগড়াঝাঁটি হয় তা ওই লিডার-ক্রিয়েটার থেকে জন্মেছে । তোর লিডার অমুক, তার লিডার তমুক । লিডার-ক্রিয়েটারের কী-ই বা দরকার ছিল ! তোদের কাজিয়াটাও সাম্প্রদায়িক কাজিয়ার মতন ।
রাহুল : তোমার লেনিনও তো লিডার ; তোমার মার্কস তো ক্রিয়েটার । নয়কি ?
সুমিতাদি : আমি তো তোকে বলেছিলাম, যে যারা নিজেদের মার্কসবাদী বা লেনিনবাদী ঘোষণা করবে, সাম্যবাদী ঘোষণা করবে, তারা তোদের মতনই, বিশ্বাসের টুকরো-টাকরার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে কাজিয়ায় মাতবে । দ্যাখ না শেষ পর্যন্ত কী হল সোভিয়েট রাষ্ট্রের আর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে ।
রাহুল : আমার কোনো দাবি-দাওয়া নেই, ছিল না ।
সুমিতাদি : সর্বভূক বিষবৃক্ষটার জন্ম তো তুই-ই দিয়েছিস । কী করে বলছিস তোর দায় নেই ?
রাহুল : নেই, জাস্ট নেই । যারা মালিকানার রোগে ভুগতে চায় তারা ভুগুক, তাদের ছেলে-মেয়েরা ভুগুক, চ্যালা-চামুণ্ডারা ভুগুক । আমার কিছু করার নেই ।
সুমিতাদি : সে তুই এখন যে যুক্তিই দিস না কেন, তোর ওই ক্যাথলিক স্কুলের প্রভাব তুই যে ছাড়াতে পারিসনি তা তোকে স্বীকার করতে হবে । আর তোর ওই কনট্রোভার্শিয়াল কবিতাতেও, মেয়েটি কে জানিস ? মেরি ম্যাগডালেন।
রাহুল : অঞ্জলির কথা বলছ ?
সুমিতাদি : স্মৃতির কথা বলছি । ক্যাথলিক স্কুলের স্মৃতির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেছিস ব্যক্তিগত উত্তরণের স্মৃতি ।
উত্তরণ না বলে, আক্ষেপও বলতে পারিস । আক্ষেপের স্মৃতি ।
রাহুল : স্মৃতি থেকে তো আর আইরিশ নানদের মুছে ফেলতে পারি না । তোমাকে কি কোনো দিন স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারব ভেবেছ ? নেভার ।
বহুকাল পর, রাহুলের বয়স তখন কত, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, টিভির পর্দায় ঢাকার রাজপথে
নাস্তিক-আস্তিক লড়াই দেখে রাহুল ভাবছিল, কেনই বা আস্তিকরা আফগান স্যুট পরে খুনোখুনি করছে, যখন কিনা তারা বাঙালি । তখন ওর মনে পড়েছিল সুমিতাদির কথাগুলো ; বিশ্বাস মানুষকে পোশাক পালটে ফেলতে ওসকায় । বিশ্বাসকে মুছে ফেলতে হলে পালটা-বিশ্বাস দরকার হয়ে পড়ে ।
রূপক মজুমদার টুসকি বাজিয়ে মুছে ফেলতে পারতেন, পেরেছেন আজীবন । যা পেছনে তা অদৃশ্য । পালটা-বিশ্বাসের প্রয়োজন ছিল না ।
শ্যাওড়াফুলির খণ্ডহরের চিলেকোঠায় রূপক মজুমদারকে দাদার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে দেখলেও ওনার সঙ্গে রাহুলের প্রকৃত পরিচয় হয়েছিল পরে, রাহুলের বয়স তখন কত, কোন সালে, মমমমমমমম, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, বাগবাজারের মোড়ে, যখন রাহুল আর অনিকেত একটা অত্যন্ত নোংরা পাইস হোটেলে ভিজে কলাপাতার ওপর ভাত নিম-বেগুন ইলিশের ঝোল খেয়ে, পাণিহাটির পথে, শেয়ালদা স্টেশান যাবে বলে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে । সেসময়ে শেয়ালদা স্টেশানচত্তর সংসার-ভাঙা মানুষ-মানুষীতে গিজগিজে, যেতে হবে সেইসব ভাঙা সংসার ডিঙিয়ে-ডিঙিয়ে ।
–তুই অনিকেতের ভাই রাহুল ? কলকাতায় ভর্তি হতে এসেছিস ? অনিকেত পরিচয় করিয়ে দেবার আগেই সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন রূপক ।
–না, ও কানপুরেই পড়বে, অনিকেত জানিয়েছিল রূপককে ।
–ওর নাম রুপক মজুমদার, ও-ই রামায়ণ নট্ট কোম্পানিটা শুরু করেছে, এই কথা বলে, অখদ্দে প্রচ্ছদের অপেরা সুভেনিরের কপি দেখিয়েছিল অনিকেত । ওই নট্ট কোম্পানি সম্পর্কে রাহুলের আগ্রহ হয়নি, মিশনারি স্কুলে শিক্ষার কারণে ওর বিচরণের ক্ষেত্র ছিল ইংরেজি-ভাষার বইপত্র । কিন্তু এত কম বয়সের নট শুনে ওর ভীতিবিস্ময় হয়েছিল ।
দ্বিতীয়বার রূপকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল একটা নাটকের মহড়ায়, যাতে অনিকেতের কেবল একটা এক লাইনের সংলাপ ছিল । তৃতীয়বার ধানবাদে। অনিকেতের চাকুরিস্হলে প্রায়ই আসতেন রূপক । রাহুলের মনে হতো উনি কোনো না কোনো তাৎক্ষণিক ক্রাইসিস এড়াবার জন্য অনিকেতের পাহাড়ি আস্তানাগুলোয় পৌঁছে যান । অনাথ ছিলেন, আর হয়তো তাই, তাঁর মধ্যে অধিকারবোধ, স্বত্তাধিকার, মালিকানা, স্বামীত্ব ইত্যাদি অঙ্কুরিত হতে পারেনি, যে-গুণ বা দোষগুলো ছিল অসীম গাঙ্গুলির চরিত্রে কুঁদে-কুঁদে ঠাসা । যা নিজের মধ্যে সঞ্চিত করে আহ্লাদিত হওয়া যায়, মানে, যৌনতা আর প্রজ্ঞা, তা-ই রূপকের যাপন-অভিমুখের দিশা-নির্দেশ দিয়েছে । রামায়ণ নট্ট কোম্পানির সদস্যরা তাঁকে, ঈর্ষাবশত, র্যালা মজুমদার নামে ডাকত ।
রাহুলের মকদ্দমার সময়ে, ওকে সমর্থনের জন্য, একটা আবেদনের খসড়া লিখে রূপক সর্বত্র ছুটোছুটি করেছিলেন, অনেকের বাড়ি আর অফিসে গিয়েছিলেন, অনুনয়-বিনয় করেছিলেন, কিন্তু অর্নব বাগচী ছাড়া একজনেরও স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে পারেননি । তখনকার তরুণদের মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন অর্নব বাগচী, রামায়ণ নট্ট কোম্পানির আরেক প্রতিষ্ঠাতা । সে-সময়ে যাঁরা নিজেদের বাঙালি মূল্যবোধ ও ডিসকোর্সের অধিপতি ভেবে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ছড়ি ঘোরাতেন, দেহাতি কানপুরি রাহুল যে তাঁদের সেসব সংজ্ঞাবলী, বৈশিষ্ট্য ও মূল্যায়নের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে নান্দনিক স্তরে তাঁদের বেদখল করে দিতে চাইছে, তা অনুধাবন করতে দখলিস্বত্ত্ব-বিরোধী ও আস্তিত্বিক অনাথ রূপকের বিলম্ব হয়নি ।
রূপক মজুমদারের সঙ্গে, শেষবার দেখা হয়েছিল অনেককাল পরে, সেই যখন রাহুলের বয়স, মমমমমম, বোধহয় সাতচল্লিশ, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, কলকাতা বইমেলায় । ছোটো-ছোটো করে চুল ছাঁটা, হেটো ধুতিতে উনি ।
ইংরেজিতে ইশতাহার ছাপানো বলে অসীম গাঙ্গুলির ক্রোধের উৎসটা ঠিক কোথায়, অনুধাবনের চেষ্টা করল রাহুল । ইংরেজির অভিকর্ষটা ভিন্ন, নিঃসন্দেহে, অসীম গাঙ্গুলির আয়ত্বের বাইরে, আপাতত ।
কানপুর তো হিন্দিভাষী অঞ্চল , যেখানে থাকে রাহুল । ওর কলেজের অধ্যাপকরা, সহপাঠীরা, বন্ধুরা, বেশিরভাগই অবাঙালি । আন্দোলনের ইশতাহার নিয়ে তাদের কাছে কি যাবে না রাহুল ? ছোটোবেলার ক্যাথলিক
স্কুলের নানদের কাছে ?
আর রাণো নামের সেই নেপালি সহপাঠিনীর কাছে, প্রথমবার অপেরা-সংলাপ লিখে কাগজটা ভাঁজ করে যার হাতে দিয়ে প্রতিদানে চুমু পেয়েছিল ? সে রচনা তো, কয়েকদিন ঘষেমেজে, রাহুল ইংরেজিতেই লিখেছিল । মাথা ঠাণ্ডা না করে কোনো লেখাই লিখতে পারে না ও, লিখে ফেলে রাখে, উড়ন্ত শব্দ আর বাক্যদের কিছুকাল যাবত ধরে-ধরে খাতার ভাঁজে নিয়ে আসে, ঘষামাজা করে, পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পরও পরিবর্তন-পরিমার্জন করে, বইতে ঢোকার আগে
পর্যন্ত রদবদল করে ।
রাণোকে লেখা অপেরা-সংলাপের শিরোনাম ছিল ‘এক্সচেঞ্জ এ কিস’ । বোকামির চতুর কবিতাটাও আবছা মনে আছে রাহুলের :
লেট ইওর পারফিউমড হ্যালো
ফল ফর এ ফিউ সেকেন্ডস
টু এনাবল মি ইন পিকিং আপ
দি মেমরি অফ ইওর গ্ল্যান্সেস
ইউ লেফ্ট ইন দি নোটস আই লেন্ট ইউ
নট ফর নাথিং ! এট লিস্ট ইউ শুড
এক্সচেঞ্জ এ কিস, ইভন ফ্লাইং উইল ডু ।
একজন তরুণীর, যে কিনা গোঁড়া সামস্ত পরিবারের, বৈভবশালিনী, তার চুমুতে যে মদের গন্ধ থাকতে পারে, তাও হুইস্কি নয়, সম্ভবত কানট্রি লিকার, অনুমান করতে পারেনি রাহুল । চুমুর অভিজ্ঞতার চেয়ে মদের গন্ধ-মাখা ঠোঁটের অভিজ্ঞতা রয়ে গেছে স্মৃতিতে ।
–কানট্রি লিকার ?
–ইউ বুকিশ ফুল; ইট ইজ কলড কনিয়াক ।
–সত্যিই আমি শুনিনি আগে । হুইস্কি, রাম, ব্র্যানডি, ভোদকা, জিন, বিয়ার, এইগুলোই তো খেয়েছি । কানট্রি লিকার আর তাড়ি খেয়েছি ছোটোবেলা থেকে ।
–তাড়ি ? ইউ মিন টডি ? আই উড লাইক টু হ্যাভ ইট । কিন্তু তুমি যে বলেছিলে তুমি ক্যাথলিক কনভেন্টে
প্রাইমারি স্তরে পড়েছিলে ?
তাড়ির সঙ্গে কনভেন্ট স্কুলের বিরোধিতা কেন বুঝতে পারেনি রাহুল । বেথলেহেমে কি হুইস্কি, রাম, জিন, ব্র্যান্ডি, ভোদকা পাওয়া যেত ? কোন মদ খাওয়া হয়েছিল লাস্ট সাপারে ? ওয়াইন ? তখনকার দিনের ওয়াইন, বাড়িতে চোলাই করা । বেথলেহেমে কি আঙুর চাষ হতো ? কোথায় হয়েছিল লাস্ট সাপার ? বোকামি এড়াবার জন্য শিক্ষিত বোকামির আশ্রয় নিয়ে রাহুল বলল, আনব একদিন লুকিয়ে ক্লাসে, ওষুধের বোতলে ভরে, ফারমেন্ট হয়ে আরও কড়া হয়ে যেতে পারে, এলাচের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিও । কনিয়াকটা কী ?
–তুমি জানো নিশ্চয়ই । তুমি তাকে কগন্যাক বলে জানো, আমার মনে হয় ।
কগন্যাক যে কনিয়াক তা ফাঁস হতে না দিয়ে রাহুল বললে, না, শুনিনি আগে । বন্ধুনিদের যেভাবে মিথ্যা কথা বলতে পারে, সেভাবে পুরুষ বন্ধুদের পারে না কেন, সমান্তরাল আত্মসমীক্ষায় ভেবে অবাক হল ও ।
–ফ্রান্সে ওই নামের জায়গায় এক বিশেষ ধরণের আঙুর থেকে হয় । তা থেকে তৈরি হয় ব্র্যান্ডি । ওই বিশেষত্বের জন্য সেই ব্র্যান্ডিকে বলা হয় কনিয়াক ।
–আমি খেজুর-রসের তাড়ি আনবো ; তুমি কনিয়াক খাইও ।
–বটলে একটু বেঁচে আছে । কালকে ক্লাসের পর দেবো । তোমার বই নিয়ে বেড়াবার সেই থলেটা এনো ।
বই কিনতে প্রচুর টাকার ব্যাপার । রাহুল সান্মানিক স্নাতক পড়ার সময় থেকেই পোস্টগ্র্যাজুয়েট লাইব্রেরি গিয়ে, বা অন্য সূত্রে বই এনে, পাঠ্য চ্যাপটারগুলো লিখে নিতো, একবার নয়, এক-একটা চ্যাপটার অনেকবার করে লিখে নিতো; তা করতে গিয়ে প্রায় মুখস্হ হয়ে যেত প্রতিটি বিষয় । বই নিয়ে বেড়াবার জন্য একটা পিঠ-ব্যাগ ছিল ওর ।
গঙ্গার পাড়ে রাণোদের গথিক স্হাপত্যের বিশাল হসটেলের পাশ দিয়ে বয়ে-যাওয়া গঙ্গার সুনসান ঘাটে বসে থাকা যায় বহুক্ষণ, একা, চুপচাপ, জলের দিকে তাকিয়ে, হয়তো বহু দূরে, বিঠুর দুর্গের ধ্বংসাবশেষের কাছে, টিমটিম করে ভেসে চলেছে পালতোলা নৌকো । বিঠুর দুর্গে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নিজেদের সেনাকে জড়ো করেছিলেন নানা সাহেব,
তাতিয়া তোপে, রানি লক্ষ্মীবাই ; তাই ইংরেজরা কামান দেগে উড়িয়ে দিয়েছিল দুর্গের প্রাসাদ আর বিঠুরের ঘাট ।
একাকীত্বের এই স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিবেশ নিজের কল্পনায় আরেকজনকে তুলে আনতে শেখায়, অন্যকে কল্পনা বিলোতে শেখায়, জলের মতন সবাইকে কল্পনায় ডুবিয়ে বা ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় সমুদ্রের বিশাল একাকীত্বের দিকে, সুন্দরবনের মোহনায়, সুন্দরী গাছেদের আকাশমুখো শেকড়ের কিনার বরাবর বইতে-বইতে, বাঘেদের সাঁতারের আদর খেয়ে, হরিণ পরিবারের উড়ালের পাশ কাটিয়ে, জেলেদের নৌকোর ঘুম ভাঙিয়ে চলে যায় নিজের মনে ।
রাহুল গিয়েছিল, বাবার কিনে দেয়া সবুজ র্যালে সাইকেল চালিয়ে, মেয়েদের হসটেলে, ইশারামতন, সন্ধ্যায়, নির্দেশানুযায়ী সাইকেল ঘন্টির তিনটে ক্রিং ক্রিং ক্রিং ।
গঙ্গার ঘাটে, ডুবে যাওয়া সূর্যের অন্ধকারে রাণো বলেছিল, গায়ে হাত দেয়া চলবে না, কেবল ঠোঁটে ঠোঁট রেখেই তুলে নেবে ; কিপ অফ ইওর হ্যান্ডস, লিপস ওনলি । রাহুলের হাত দুটো আপনা থেকেই, ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে গিয়ে, ওর কোমর জড়িয়ে ধরেছিল । তারপর একটা চড় খেয়েছিল । চড়ের আঘাতের স্মৃতি গালেতে নেই, কেবল ঘটনাটা মনে আছে । চড় খেয়েও হাত সরায়নি । চড় মেরে চড়ের শব্দে ভয় পেয়ে গিয়েছিল রাণো, যদি কেউ শুনে ফ্যালে, জেনে ফ্যালে, তাহলে কেলেঙ্কারি— রা-স-টি-কে-শা-ন আর হি-উ-মি-লি-এ-শা-ন । রাহুলের আলিঙ্গন ওকে ভয় থেকে মুক্তি দিয়েছিল । ফিসফিস করে বলেছিল ‘ডোন্ট ক্লিং ডোন্ট ক্লিং ইউ ফিশ স্মেলিং ক্লিংগার’ ।
ঠিকই, রাহুল তার পর থেকে কাউকে ক্লিং করে থাকেনি । যারা করেছে তারাই ওকে ক্লিং করেছে । গঙ্গা নদীও আর শহরটাকে ক্লিং করে নেই । শহরের বেড় ভেঙে বেরিয়ে চলে গেছে । চামড়ার কারখানাদের তেলচিটা নোংরায় ডুবে, সমুদ্রে স্নান করতে চলে গেছে গঙ্গা ।
সে-গঙ্গার পাড় আর নেই । বহু দূরে চলে গেছে গঙ্গা, শহরকে ঘেন্না করে, শহর থেকে দূরে । বালির চড়া পড়ে গেছে । পঞ্চাশ বছর পর গিয়েছিল রাহুল, ওর বয়স তখন কত, মমমমমমম, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । নিজের একাকীত্ব হারিয়ে ফেলেছে নদী । চড়ার ওপর প্লাস্টিক ব্যাগ, ঠাণ্ডা পানীয়ের বোতল, বিয়ারের টিন, পুজোর ফুল। জলও অত্যন্ত নোংরা । পা ডুবিয়ে বসার ইচ্ছা হবে না । পায়ের ছোঁয়া বয়ে নিয়ে যাবে না সুন্দরবনের সুন্দরী গাছেদের কাছে ।
শহরের ভেতর দিয়ে নদীটা যায়নি ; শহরই লোভে পড়ে নদীর পাড়ে এসে ঘাটি গেড়েছে, নদীটাকে খেতে আরম্ভ করেছে শহরগুলো, যেভাবে কেঁচোকে মাঝখান থেকে কুরে-কুরে খেয়ে ফ্যালে পিঁপড়েরা । মানুষের আদল নিয়ে লক্ষ লক্ষ
পিঁপড়ের কাতার নোংরা করে চলেছে নদীকে, সে নদীর ঘোলা জল রাণোর প্রতিবিম্বখানা বুড়ি হবারও ঝিলমিল ধরে রাখার চরিত্র পায়নি । সে নদী আর নেই ।
রাণোর সঙ্গে প্রেমে পড়েনি রাহুল, রাণোও ওর সঙ্গে প্রেমে পড়েনি । চকিত-চুমু খাবার ইচ্ছেতে পড়েছিল,দুজনেই ।
–প্রথমবার ?
–না, খেয়েছি আগে । আবার মিথ্যা কথা বলল রাহুল । চেপে গেল অঞ্জলি দাশের বাড়ির ঘটনাগুলো ।
–প্রেমিকা ?
–না, বন্ধুর বোন, মাদুরের বেড়ার আড়ালে ফ্ল্যাশ কিস । তুমি ?
–অনেকবার । আমার ভালো লাগে, এই চুমু খাওয়া । এক ধরণের ক্রেজি তৃপ্তি নিয়ে আসে যা পড়াশুনায় একাগ্র হবার জন্য জরুরি ; ও তুমি বুঝবে না । আমি তোমাদের থেকে আলাদা দেশ, সমাজ, শ্রেণি, পরিবার-পরিবেশের মানুষ।
রাহুলের তো উল্টো, চুমুর ধান্দায় কদিন পড়াশোনায় মন বসেনি । আবার কবে আবার কবে আবার কবে সেই ফ্ল্যাশ কিসের সময় থেকেই ভুগেছে । রাণোর চুমু তাই জরুরি ছিল আগেরটা মুছে ফেলার জন্য । আবার কবে ভাবার দরকার নেই ।
অঞ্জলিকে তবু ঠোঁট থেকে মুছে ফেলতে পারেনি ।
স্কুলের সহপাঠী মোহন পালের বোনকে চুমু খেয়েছিল রাহুল , ওর বোন ঝুমা রাহুলের গালে একদিন দুপুরে টক করে ঠোঁট ঠেকিয়ে কলোনির বাইরে চলে গিয়েছিল। আচমকা । রাহুলের উচিত ছিল মোহনের বোনকে অনুসরণ করা। বোকা ছিল বলে বুঝতে পারেনি যে ওভাবেও সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করতে পারে কেউ । বই পড়ে-পড়ে চুমু বা ঠোঁটের আদরকে প্রেমের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার বোকামিতে ভুগত তখন রাহুল । তাই মোহনের বোনকে একা পেয়ে ওর ঠোঁটে চুমু খেয়েছিল, আর চাউনির রাগি ঝিলিক থেকে টের পেয়েছিল যে কাজটা ঠিক হয়নি ।
মোহনদের থাকার জায়গা ছিল ছোটো-ছোটো মাদুর-খুপরির ঘর । ওরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে রিফিউজি হয়ে এক
কাপড়ে এসেছিল । ওদের মাকে যারা লুঠ করে মুখে কাপড় বেঁধে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তখন তারা পাকিস্তানি বাঙালি
ছিল, বাংলাদেশি বাঙালি হয়নি । মোহন পালের বাবা পাগল হয়ে গিয়েছিলেন ; আত্মহত্যা করে্ছিলেন । তারপর ওর বোন আত্মহত্যা করল, বাবা মারা যাবার দুঃখে । তারপর মোহন আত্মহত্যা করল, পৃথিবীতে ওর আর কেউ রইল না বলে । ও মরে যেতে রাহুল টের পেয়েছিল যে ও মোহনদের কেউ নয় । ওদের কল্পনাজগতে ওর ঠাঁই হয়নি কখনও । কী করে যে কারোর কল্পনার নিবাসীরূপে গ্রাহ্য হওয়া যায় তা ও আজও জানে না ।
ঝুমার শ্বাসের পান্তাভাতের বেদনাময় গন্ধ রয়ে গেছে স্মৃতিতে । কারোর আত্মহত্যার সংবাদ পড়লে বা শুনলে রাহুলের স্মৃতি পান্তাভাতের ঠাণ্ডা সুবাসে আক্রান্ত হয় । যেচে পাওয়া গোপন ক্ষত নিঃসঙ্গতায় হয়ে ওঠে দগদগে ; চুলে পাক ধরার সাথে-সাথে সেই অসহায়তার বোধ ক্রমশ ছুঁচোলো হয়ে বিঁধতে থাকে আজীবন ।
লিপিংমুহূর্ত শেষ হলে রাণো আচমকা বলে উঠেছিল, আর ইউ ট্রাইং টু বি এনাদার ট্যাগোর ?
–ট্যাগোর ? না তো ; অমন মনে হচ্ছে কেন তোমার ? রাহুল নিজেকে শুনিয়ে নিঃশব্দে বলল, রবীন্দ্রনাথকে ওর কাছে নিয়ে এসেছিলেন সুমিতাদি, সুমিতা চক্রবর্তী । রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ও কারোর সঙ্গে আলোচনা করতে পারে না, ইডিয়টিক মনে হয় । রবীন্দ্রনাথ ওর স্মৃতিতে ব্যক্তিগত অঘটন । সুমিতাদি ব্রাহ্ম ছিলেন বলেই কি রাহুলের কাছে এনেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে, কেননা উনি যাঁদের বইপত্র পড়তে উৎসাহ দিতেন, পরে জানতে পেরেছে রাহুল, তাঁরা সকলেই ব্রাহ্ম । ব্রাহ্মদের দরকার ছিল একটি মাত্র ঈশ্বরের, যার দেখা চারটে বেদের কোনোটাতেই পাওয়া যায়নি, তাই যেতে হল উপনিষদে ।
পুজোর সময় কানপুরের কলকাতার দিল্লির জয়পুরের লখনউয়ের মুম্বাইয়ের প্যাণ্ডেলে ঘুরে-ঘুরে রাহুল খুঁজে ফিরেছে সুমিতাদির ঈশ্বরকে, যিনি লোপাট, উপনিষদের প্রভাবের সঙ্গেই লোপাট । তার জায়গায় ফিরে এসেছে বেদ আর পুরাণের নানা আকারের দেবী-দেবতা , যারা বছরের নির্ধারিত দিনে বা রাতে হইচইকারীদের কাঁধে চেপে দেখা দেন, যৎসামান্য অ্যাপিয়ারেন্স ফি নিয়ে । তারপর তাঁরা কেউ নদীতে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করেন, আর কেউ আত্মহত্যা করে সেই গাছের তলায় পড়ে থাকেন ।
–ট্যাগোরের কম বয়সে তোমার মতন সরু গোঁফ ছিল ।
–যৌবনে ট্যাগোরের সরু গোঁফ ছিল নাকি ? জানি না তো । আমি তো যতগুলো ফোটো দেখেছি সবকটাই বুড়ো বয়সের । বিষাদে ঝুলে পড়া গোঁফ ।
–ছিল । সরু । তোমার মতনই পাকাতেন । তবে উনি কুস্তি লড়তেন বলে পাকাতেন, কুস্তি লড়ার আগে উরুতে চাপড় মারতেন কুস্তিগিরদের ঢঙে ।
–রবীন্দ্রনাথ গোঁফ পাকাতেন, শুনিনি কখনও, ফোটোও দেখিনি ।
–রবীন্দ্রনাথ গোঁফ পাকাতেন, হয়তো তখন উনি বিশের কোঠায়, তোমার মতন । নাঃ, তুমি তো এখনও টিন এজার, সীমা পেরোওনি । ছাত্রীদের বয়স ছাত্রদের চেয়ে বেশি হয় । বুকে চুল গজিয়েছে ?
–না, গজাবে না হয়তো, বাবার নেই ; আমার বড়জ্যাঠার বড় মেয়ে, মানে, বড়দির অবশ্য পায়ের গোছেও লোম দেখা যায়, বোধহয় দাদুর ছিল ।
–তা না থাক, গোঁফ রেখো, আর পাকিও, বেশ ম্যানলি লাগে, আগেকার হলিউড নায়কদের মতন । যবে থেকে কিসিং সিনের বাড়বাড়ন্ত, তবে থেকে হলিউডের ফিলমে গোঁফ কামিয়ে ফেলছে নায়করা, ম্যানলিনেস দেখাবার জন্য গুলি চালাচ্ছে, ছুরিছোরা চালাচ্ছে, স্প্যাঘেটি ওয়েস্টার্নের ইডিয়সি ।
–সরু গোঁফ, রবীন্দ্রনাথ পাকাচ্ছেন, উরুতে চাপড় মারছেন, ছবিটা তো কল্পনা করাও বেশ আজগুবি । তুমি তো আমার চেয়ে বেশি জানো দেখছি । হলিউড ফিলম তো সপ্তাহে একবার আসে, দেখা হয় না । ওসব কিসিং-টিসিং রেগুলার দেখলে আমার পড়াশুনার বারোটা বেজে যাবে ।
–রবীন্দ্রনাথের ন্যাড়ামাথা ফোটো আছে আমাদের বাড়িতে ।
–রিয়্যালি ? ন্যাড়ামাথা রবীন্দ্রনাথ ? কেমন যেন অ্যাবসার্ড । ইমেজ বিগড়ে যায় । ন্যাড়ামাথা গায়ক দেখিনি যে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে ।
–উনি ছিলেন ব্রাহ্ম, কিন্তু ট্যাগোরের বাবা ওনার উপনয়ন করিয়েছিলেন, ব্রাহ্মণদের মতন । হাউ স্ট্রেঞ্জ । তারপরও ট্যাগোর নিজে ন্যাড়া হয়েছিলেন, ওনার বাবার শ্রাদ্ধের সময়ে, ব্রাহ্মণদের মতন । তখনও বোধহয় চতুর্বেদের আয়ত্বে ছিলেন, উপনিষদের জগতে প্রবেশ করেননি ।
–জানতুম না । তুমি বাড়ি গেলে আমাকে একটা ফোটোর কপি করিয়ে এনে দিও । নন-কনভেনশানাল
রবীন্দ্রনাথকে টাঙিয়ে রাখব পড়ার ঘরে । রাহুল আত্মসংবরণ করল, নয়তো ব্রাহ্ম পরিবারের সুন্দরী সুমিতাদির কথা ফাঁস করে ফেলত ; কে জানে, সুমিতাদির প্রসঙ্গে কেমন প্রতিক্রিয়া হবে রাণোর । পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য রাণোর নৈতিক সমর্থন জরুরি, মনে জোর পাওয়া যায় ।
–আমাদের বাড়ির ছেলে-মেয়েরা আগে সবাই কলকাতায় পড়তে যেত । কলকাতা থেকে আনা, বিদেশ থেকে
আনা, বইয়ের লাইব্রেরি আছে নেপালের পোখরায় । ওনার মাথায় মেয়েদের মতন চুল আর গোঁফে তা দিচ্ছেন । অন্যটা বাবা মারা যাবার পর ন্যাড়া মাথায় ।
–গোঁফটা তাহলে কামিয়ে ফেলব ।
–এখন কামিও না । তাতে অযথা সময় নষ্ট হবে, প্রতিদিন বা একদিন অন্তর কামাতে হবে, আর তাতে সময় চলে যাবে ; পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমার তো আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোও উচিত নয় । হংসকুমার যাদব আর শ্যামবিহারি শ্রীবাস্তব, দুজনেই তোমার চেয়ে ভালো ফলাফল করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে । তাছাড়া ওদের জাতপাতের জোর আছে । তোমার তো কেউই নেই । তুমি তো বা-ঙ-গা-লি-কা-ন-ছা । গডফাদার নেই । আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা হয়ে কানপুর বিশ্ববিদ্যালয় হবার কথাবার্তা শুরু হয়েছে, তখন জাতপাতের খেলা আরও বেড়ে যাবে ।
–তুমি আছ , দি হিমালয়ান গডেস।
–হা হা, গুড জোক । চুমুটা মনে রাখো, আর উঠে পড়ে লাগো । ওরা দিনে বারো থেকে সতেরো ঘন্টা পড়ছে বলে খবর । আমি তো হেসেখেলে বেরিয়েই যাবো , টোটাল নম্বর যতই হোক না কেন, বেরিয়ে গেলেই হল ।
অপেরা-সংলাপের চিরকুট ফেরত দিয়ে রাণো বলেছিল, নো নিড টু রাইট স্ক্রিবলার্স জাস্ট ফর এ কিস ; উই আর নট লাভার্স । রাহুল ভেবেছিল , আবার যদি নোটস চায়, তাহলে আরেকটা অপেরা-সংলাপ লিখবে, ‘লেট মি টাচ ইট’ নামে । তা আর লেখা হয়নি, নোটস চায়নি বলে । কিন্তু ওর উপদেশ কাজে দিয়েছিল । পড়াশুনায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, অতি-একাগ্র । তা সত্ত্বেও প্রথম হতে পারেনি রাহুল ; দ্বিতীয় হয়েছিল । রেজাল্ট বেরোলে রাণো বলেছিল, ‘অ্যাজ ইউজুয়াল, একিলিস শুড নো হি হ্যাজ এ হিইইইল ।’
রাণোকে, সাত-আট বছর বয়সের অভিজ্ঞতার কথা আরেকটু হলেই বলে ফেলেছিল রাহুল ; যে কিশোরী ওর
যৌনতার উন্মেষ ঘটিয়েছিল, তহমিনা আপা, বা তহমিনা বানুর কথা । তহমিনা আলি শাহ । কখনও ওরা অবধের নবাব বংশের সদস্য ছিল । তবু, তহমিনা আপা বেশ কালো, আর দুই গালে টোল পড়ত, টোলের ভেতরে রোদের, প্রদীপের, লন্ঠনের, চাঁদের আলো ধরে রাখত, ঝিকমিক করত তেল না মেখেও তেল-চুকচুকে গাল ।
তহমিনা আপাদের বাড়িতে ডিম কিনতে পাঠাত মা, হাঁসের ডিম শুধু ওদের পোড়ো বাড়িতেই পাওয়া যেত, বাজারে পাওয়া যেত না । রাহুলদের বাড়িতে তখন মুরগির ডিম আর মুরগির মাংস ঢোকেনি । একদিন দুপুরে যখন আপাদের বাড়িতে কেউ ছিল না, উনি রাহুলের হাত ধরে একটা অন্ধকার ঘরে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন, যে ঘরে ওদের হাঁস মুরগি ছাগল থাকত । খালি-গা রাহুলের হাফ প্যান্ট একটানে নামিয়ে দিয়ে নিজের চুড়িদারও নামিয়ে নিয়েছিলেন, আর তারপর জড়িয়ে ধরেছিলেন রাহুলকে । রাহুলের হাত নিয়ে নিজের কুঁচকির মাঝে চেপে ধরে নিজেই তাকে ব্যবহার করছিলেন ; তারপর রাহুলের যৌনাঙ্গ বাঁ হাতে নিয়ে খেলতে-খেলতে নিজের কুঁচকির ভেতরে ঘষা শুরু করেছিলেন । রাহুল জিগ্যেস করেছিল, এরকম করছেন কেন । আপা কোনো উত্তর না দিয়ে ঘামছিলেন, কেঁপে-কেঁপে উঠছিলেন । রাহুলের বেশ ভালো লেগেছিল খেলাটা । ডিম কেনার না থাকলেও, আরও কয়েকবার দুপুরে, যখন আপাদের বাড়ির সবাই কোনো কাজে বাইরে, গিয়েছিল রাহুল।
দ্বিতীয়বার তহমিনা আপা কবজি ধরে জানোয়ার-ঘরের অন্ধকারে রাহুলের হাফপ্যান্ট টেনে নামাতেই রাহুল বলেছিল, আমাকে তাহলে মুরগির ডিম খাওয়াতে হবে, খাইনি কখনও ; স্কুলের বন্ধুরা বলে মুরগির মাংসও ভালো খেতে। তোমাদের রান্নাঘর থেকে মাঝে-মাঝে মাংস রাঁধার কত ভালো গন্ধ বেরোয়, মাংস খাওয়াতে হবে, নইলে আর আসব না।
–তোর বাবা-মা যদি জানতে পারেন যে আমাদের বাড়িতে খেয়েছিস তাহলে তোকে আস্ত রাখবে না । গোবরজলে চান করাবে । ন্যাড়া করে টিকি রাখবে তোর ।
–তুমি আমার প্যান্টুল খুলে নাও জানতে পারলেও পিটুনি খাবো ।
–না না ককখনো বলিসনি কাউকে । আজকেই তোকে মাংস খাওয়াবো, অনেক ঝাল হয় কিন্তু ।
–আগে খাওয়াও ।
–তুই অপেক্ষা কর, এভাবেই দাঁড়িয়ে থাক, আমি এক্ষুনি আনছি ।
ছাগলদের খাবার দেবার সিমেন্টের ছোট্টো চৌবাচ্চার কিনারে বসে মাংস খাবার জন্য উৎসুক হয়ে বসেছিল রাহুল । ছাগলের বাচ্চাগুলো ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বোধহয় জানতে চাইছিল কেন ও ওদেরই মতন পোশাকহীন।
আপা অ্যালুমিনিয়ামের দোমড়ানো বাটি করে মাংস এনে রাহুলকে দিতে, রাহুল হাহ-হুহ করতে করতে খেয়ে নিয়েছিল ঝাল মাংস । আপা নিজের সবুজ চুন্নি দিয়ে পুঁছে দিয়েছিল রাহুলের হাত আর মুখ । বলেছিল, যাবার সময়ে রাস্তার মোড়ের কলে হাত আর মুখ ভালো করে ধুয়ে নিস ; মাংস খাবার গন্ধ মুখ থেকে বেরোলে আমিও বিপদে পড়ব । সেই প্রথম গোরুর মাংস খেয়েছিল রাহুল । আপার জড়িয়ে ধরার কাজ পুরো হয়ে গেলে নিজের জিভ দিয়েও পুঁছে দিয়েছিল রাহুলের ঠোঁট । রাহুল বলেছিল, তোমার গা কী গরম ; তুমি তো কুকুরদের মতন চেটে-চেটে পরিষ্কার করে দিলে । আপা বলেছিল, যখন বড়ো হবি তখন জানতে পারবি মানুষও নিজেদের এভাবেই পরিষ্কার করে ।
–বড়ো হবো না । বড়ো হলে তো তুমি আমার সঙ্গে আর খেলবে না, মাংস খাওয়াবে না ।
–তুই বড়ো হয়ে গেলেও খেলবো ; কিন্তু তুই তো আর খেলতে পারবি না । তোকে তখন আসতে দেবে না, আর আমার তো বিয়ে হয়ে যাবে । তুই হলি আমার নাজুক মজনু । তখন তো আর নাজুক থাকবি না ; নোংরা মরদ হয়ে যাবি, জাহিল হয়ে যাবি, কাফের, কুফ্র, কুফ্র, কুফ্র ।
শেষবার রাহুলের যৌনাঙ্গ নিয়ে আপা এত বেশি নিজেকে চেপে ধরছিলেন, বারবার, যে রাহুলের জ্বালা ধরে গিয়েছিল। ঠাকুমা সবাকসুন্দরী দেবীকে ছাড়া রাহুল কাউকে কখনও বলেনি জীবনের ওই ঘটনা, লজ্জা করেছে। রাণোকে বললেই বলত, তোমাকে রেপ করেছিল, মলেস্টেশান । বন্ধুদের বললেও নিশ্চয়ই ঠাট্টা করত যে ওকে রেপ করা হয়েছিল, ছি ছি।
কানপুরের বাড়ি থেকে দেশের বাড়ি, শ্যাওড়াফুলিতে, ঠাকুমাকে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল রাহুলকে, ট্রেনে করে হাওড়া। ক্লাস নাইনের গণ্ডি সবে তখন পেরিয়েছে রাহুল । জীবনের ওই ঘটনা জানিয়ে নিজেকে হালকা করার এটাই সুযোগ ভেবে ঠাকুমাকে সব বলে ফেলেছিল । বলেনি ওর যৌনাঙ্গ ছড়ে যাওয়ার কথা, মাংস আর মুরগির ডিম খাওয়ার কথা । ঠাকুমা ট্রেনে বসে কেবল শুনেছিলেন, এমন মুখ করে যেন কিছুই হয়নি।
রাহুলের কানপুর ফিরে যাবার দিন উনি বলেছিলেন, যা করেছিস তা আর কখনও কাউকে বলিসনে, আমাকে বলার বলেছিস ; অমন লুকোনো পিরিতের খেলা তো ব্যাটাছেলেরা করে । এখেনে তুই হয়ে গেলি মেয়ে, আর ছুঁড়িটা হয়ে গেল ছেলে । বুড়ো মিনসেরা আগেকার দিনে কচি মেয়েদের বিয়ে করে বেধবা করে সগগে চলে গেলে সেসব বেধবারা তাদের দেওর, ভাসুরের ছেলে-টেলেদের দিয়ে অমন পিরিতের খেলা খেলত, বুঝলি । কচি খোকাদের সঙ্গে অমন পিরিত করলে তো আর পোয়াতি হবে না, আশও মিটবে । তোকে দিয়ে মোচরমান ছুঁড়িটা আশ মিটিয়ে নিলে । জীবনে ওসব কথা আর মুখে আনবি না । সবাকসুন্দরী দিয়েছিলেন নির্বাক থাকার আদেশ । আজকে, লিখতে বসে, রাহুলের মনে হল, এই চাপটা পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলি সবাইকে জানিয়ে দিয়ে ।
মুখে নয়, তহমিনা আপাকে, ঘুমের ভেতরে নিয়ে আসে রাহুল ।
চোখ বুজলে রাহুল তহমিনা আপার ডিমপল অব ভিনাসও স্পষ্ট দেখতে পায় । ডিমপল অব ভিনাস, যা পাছার ওপরের বাঁকে থাকে কারোর কারোর, গ্রিক দেবীর মতন । সে-সময়ে যে খেলা খেলবার মতন শরীর ওর ছিল না বলে খেলতে পারেনি তা যৌবনে কতবার স্বপ্নের ভেতরে খেলেছে রাহুল ।
পঞ্চাশ বছর পর , রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমমম, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, ওই পাড়ায় গিয়ে তহমিনা আপাদের পোড়ো বাড়ির জায়গায় দেখেছিল পাকা বাড়ি উঠেছে । ফ্ল্যাটবাড়ি । কয়েকজন মহিলা বাড়ির ভেতর থেকে বোরখা পরে বেরিয়ে কোথাও গেল । আপার ভাই নাজিমের নাম করে পাড়ায় খোঁজ নিয়ে জেনেছিল যে ওদের পরিবারের কেউ আর থাকে না শহরে । তহমিনা আপা বিয়ে হয়ে দুবাই চলে গেছে । আপার ভাইও চলে গেছে কোনো আরব দেশে ।
একসময় ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল যাতে আপার সংস্রব থেকে দূরে থাকা যায়, যাতে আর কেটে-ছড়ে না যায় কুঁচকির কাছে । পঞ্চাশ বছর পর আবার কেন দেখার ইচ্ছে হল । বুড়ি আপা প্রৌঢ় রাহুলকে দেখে কী বলতেন ? মনে করতেন কি ওনার সেই ঘেমো উত্তেজিত দুপুরগুলো ? “কাফের কহিঁকা, জাহিল কহিঁকা, বদজাত কহিঁকা, দিখা তেরা
মজনুকা দুম ।”
পাড়ায় এত চেঁচামেচি হতো যা পড়াশুনায় যাতে ব্যাঘাত না হয় তাই পড়ার সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনত রাহুল ; সুমিতাদির দেয়া ছোঁয়াচে রোগ । স্কুলের পর থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত । এমনই বদভ্যাস হয়ে গিয়েছিল যে এই বার্ধক্যে পৌঁছে কিছুদিন আগে পর্যন্ত সংবাদপত্র পড়ার সময়ে কোনো মৃদু সঙ্গীতের অভাব বোধ করত ও, তাই কেবল-টিভির কোনো গানের চ্যানেল বা এফ এম রেডিও চালিয়ে বই-পত্রিকা পড়ে । সংবাদপত্র আর পড়ে না, ভালো লাগে না অন্যের
ক্ষতগুলো নিজের চামড়ায় তুলে এনে ভুগতে । নিজেরই কত গোপন ক্ষত রয়ে গেছে যা কখনও সারবে বলে মনে হয় না।
বাইরের জগত আর নিজের জগতের মাঝে রবীন্দ্রসঙ্গীত আড়ালের কাজ করত, পাঁচিলের । গানের প্রতি আগ্রহ ছিল না ; গানের আবহ দিয়ে বইয়ের জটিল তত্বগুলোকে আয়ত্ব করার উপায় বের করে ফেলেছিল । কী গান, কী কথা, কার গাওয়া, তা নিয়ে ও চিন্তা করেনি । লঙ প্লেইং রেকর্ড কলের গানে চাপিয়ে মন দিত পড়ায় । রাহুলের মা জানতেন ; গান থেমে গেলে রেকর্ডের উল্টোপিঠে বা ওই পিঠেই আবার বা অন্য রেকর্ডে পিন বসিয়ে দিতেন । রবীন্দ্রনাথকে এভাবেই ব্যবহার করেছে রাহুল, চিরকাল । হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছে ও, রাহুল । ওনার প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস পড়েছে বাইরের জগতের সঙ্গে আড়াল তোলার কাজে লাগাবার জন্য ।
রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বন্ধুদের আলোচনা শুরু হলে, ও চুপ করে থেকেছে, বা ওনার গোঁফ, নখ কাটা, কোন সাবান মাখতেন, কখন চুল আঁচড়াতেন, মাঝখানের সিঁথে কাটা কবে ব্যাকব্রাশ হল, কবে নাগাদ পৈতে ফেলে দিয়েছিলেন, পৈতে হবার পর ন্যাড়া মাথায় কি দাদারা চাঁটি মারতেন, বাবা মারা যাবার পর চুল-দাড়ি কামিয়ে ন্যাড়া হয়েছিলেন তার ফোটো কোথায় পাওয়া যাবে, কোন হুইস্কি খেতে পছন্দ করতেন, ইত্যাদি নিয়ে উৎসাহ দেখিয়েছে ।
স্নাতকোত্তরের পর রাণোর সঙ্গে আর দেখা হয়নি, ন্যাড়া-মাথা রবীন্দ্রনাথকে তাই পায়নি ও, রাহুল ।
বলেছিল রাণো কখনও একবার, ওর পূর্বপুরুষ হলেন জং বাহাদুর কুঁঅর । কিন্তু বলেনি যে সেই জং বাহাদুর লোকটির ষড়যন্ত্রের ফলে রাজ দরবারের ছত্রিশ জন লোক খুন হয়েছিল, আর প্রধান মন্ত্রীকে খুন করে সিংহাসন দখল করে রেখেছিল তার বংশধর, মানে, রাণোর পূর্বপুরুষ । রাণোর শিরায় সেই লোকটার রক্ত, ভাবা যায়, সেই রক্তের চুমু ওর ঠোঁটের স্মৃতিতে ! তার শেষ বংশধর পালিয়ে এসেছিল , ফিল্ড মার্শাল মোহন শমশের জং বাহাদুর রাণা নেপালের রাজাকে সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছিল ভারতে । সে রাজার ছেলে রাজা হল ,খুন হল, তার ভাই রাজা হল, উৎখাত হয়ে দেশ ছেড়ে পালালো ।
রাণো কি এখন বুড়ি ? আশি বছরের বুড়ি !
রাহুল বলেছিল, জানি, তোমাদের নামের আগে তিনটে শ্রী বসানো হয় আর নতুন রাজার নামের আগে পাঁচটা । আমি আমার নামের ডগায় একটাও শ্রী জুড়তে দেবো না, কারণ আমি কাউকে তো খুন করিনি । এও জানি যে তোমাদের বংশে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি, সেই খুন হয়ে-যাওয়া প্রধান মন্ত্রীর স্ত্রীর অভিশাপে । কারেক্ট ?
–হানড্রেড পার্সেন্ট । তবে, ভেবে দ্যাখো, রয়াল ব্লাডের চুমু পেলে । ওয়ান্স ইন এ লাইফটাইম অভিজ্ঞতা । রক্ত দূষিত হয়ে গিয়ে থাকবে তোমার, যতই হ্যারল্ড ল্যাসকি, বুকানিন, প্রুধঁ আর মার্কস পড়ো ।
–আর তুমি প্লেবিয়ান । তফাত এই যে তুমি এই অভিজ্ঞতা রিপিট করার অজস্র সুযোগ পাবে ।
–তা পাবো ; সেরকম সুযোগ পেলে নেবোও । নেপালে বা ইনডিয়ায় থাকতে চাই না ; বিদেশে চলে যেতে চাই ।
রাণোর বাঁ গালে টোলের জন্য আকৃষ্ট হয়েছিল রাহুল । যে তরুণীদের গালে টোল পড়ে তারা ওকে আকৃষ্ট করেছে, সুশ্রী না হলেও । বাংলা গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড়তে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন যিনি, স্কুলের সেই উঁচু ক্লাসের ছাত্রী, ধনী ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়ে সুমিতাদিরও দুই গালে টোল পড়ত । সুমিতাদির গালে যদি টোল না থাকত তাহলে কি সিরিয়াস বই পড়ার, আর লেখালিখির প্রতি আগ্রহ হতো ওর? সুমিতাদি যে মন্দিরে গান গাইতে যেতেন, ব্রাহ্মমন্দির, তা এখন বিরাট একটা শপিং মল । নিজেকে বলতেন ব্রাহ্ম-বাঙাল-বামপন্হী-বামা ।
–তোমার কাছে এসে তাই সবাই ব্যা-ব্যা-ব্যা-ব্যা করে ।
–চুপ । কানমুলে ম্যা-ম্যা-ম্যা-ম্যা করাবো ।
রাহুলের স্ত্রী, বুড়ি হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও টোল পড়ে । অনেকে সাক্ষাৎকার নিতে এসে যখন প্রশ্ন করে, কোথা থেকে প্রেরণা পেলেন, তখন বলা উচিত যে তরুণীদের গালে টোল পড়া থেকে প্রেরণা পেয়েছি । সাইক্লোনের চোখের মতো ওই টোলগুলো, পাকিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে যেতে চায়, তছনছ করে দিয়ে চলে যেতে চায়, আবার প্রথম থেকে জীবন শুরু করে পরের ঘুর্ণিঝড়ের অপেক্ষায় । গালের টোলের কোনো ধর্ম, সম্প্রদায়, ভাষা, দেশ, জাতি হয় কি ?
কলেজে ঢোকার পর, সুমিতাদি রাহুলকে পথে দেখতে পেয়ে, বেবি অস্টিন গাড়ি থামিয়ে, ওনার বাড়িতে নিয়ে
গিয়েছিলেন । রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমমম, বোধহয় মমমমম, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । তারপর ওনার গালের টোলের আলোয় শোনালেন ওনার প্রেমিকের বিপ্লবগাথা ; সে পুং-বিপ্লবী নাকি তখন কোথাও লুকিয়ে বেড়াচ্ছে । ওনার প্রেমিক যে কে তা রাহুল তখন পর্যন্ত জানতে পারেনি , সুমিতাদির কাছে তার ফোটোও নেই ।
সুমিতাদির বাড়ি কয়েকদিন যাবার পর উনি ওনার বিপ্লবের স্বপ্নে টানতে চাইলেন রাহুলকে, সোভিয়েট রাষ্ট্রে
প্রকাশিত অদ্ভুতগন্ধী বই পড়তে দিয়ে। ক্রমে, লোকমুখে জেনেছিল, বিপ্লবের স্বপ্নটা ওনারই, এবং উনিই তাতে টেনে এনেছিলেন ওনার বর নামের অদৃশ্য লোকটিকে, যাকে রাহুল কখনও দেখার সুযোগ পায়নি । রাহুলের বয়সী আরও ছেলে-মেয়ে আসত, যাদের এড়িয়ে যেত রাহুল, তারাও ওনার বিপ্লবী প্রেমিককে দ্যাখেনি কখনও ; সে যাকগে, ওর, রাহুলের, আগ্রহ তো সুমিতাদি । ওনার দেয়া বইগুলো রাহুল বাড়ি এনে পড়ত, বিভ্রান্ত হতো, কিন্তু গালের টোলের আলোর আকর্ষণে আবার গিয়ে আবার বই আনত, আরও বেশি করে বিভ্রান্ত হবার জন্য ।
বিপ্লব ? রাহুলের বড়-জ্যাঠামশায় একবার বলেছিলেন, যে-মেয়েরা বাপের অবাধ্য হয় তারা, আর যে-ছেলেরা মায়ের অবাধ্য হয় তারা , বড় হয়ে বিপ্লবী হয় ।
রাহুল আর অনিকেত দু’জনেই তো কখনও বাবার আর কখনও মায়ের অবাধ্য হয়েছে । ওরা তাহলে কী ?
কয়েকটা মোটা বই দিয়ে সুমিতাদি একবার বললেন, স্কুলে তুমি একবার একটি মেয়ের জন্য মারামারি করেছিলে, মনে আছে ? আমি তো কল্পনাও করতে পারি না তুমি মারামারি করছ, অ্যান্ড ফর এ গার্ল । এরকম ডেলিকেট চেহারা তোমার, যে মারামারি খাপ খায় না, অন্তর্মুখি তরুণ, সে কিনা মারামারি করছে । আর মারামারি করেছ কোনও মেয়ের জন্য ? কোনও যুবতী এসেছে জীবনে ?
মারামারি করেনি রাহুল, করে ফেলেছিল , অঞ্জলি দাশ নামে একজন সহপাঠিনীর ওসকানিতে । অঞ্জলি বলেছিল, কেমন মরদ রে তুই, তোর সামনেই আমাকে টিটকিরি মারছে আর তুই রেসপণ্ড করছিস না । ইন্সট্রুমেন্ট বক্স থেকে কমপাস বের করে এগিয়ে গিয়েছিল রাহুল । তার জন্য স্কুলের অফিসরুমে, কেরানিবাবুর নির্বিকার চাউনির সামনে, ওকে সারাদিন একঠায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল ।
অঞ্জলি অপেক্ষা করেছিল ওর শাস্তি শেষ না হওয়া পর্যন্ত । তারপর নিয়ে গিয়েছিল ওদের বাড়ি । বিশাল তিনতলা বাড়ি, প্রতি বছর হলুদ চুনকাম করানো হয় । থাকেন ওর মা আর ও, ব্যাস আর কেউ নেই । অত বড় বাড়ি রাখার কী দরকার জানতে চাইলে অঞ্জলি বলেছিল, বা রে, আমার দাদুর বাড়ি, বড় হলেই বা । রাহুলের মনে হয়েছিল
যে অমন বৈভবশালী পরিবারের মেয়ে জানা থাকলে হয়ত মারামারি করত না ও । মারামারিটা তার মানে রাহুল নিজের জন্যই করেছিল, মারামারির জন্য মারামারি, উদ্দেশ্যহীন ।
সুমিতাদি কি তা বুঝবেন ? বুঝবেন নিশ্চয়ই । কেন কিছু তরুণ সব ছেড়ে-ছুড়ে বিপ্লবী দলে নাম লেখায়, ওনার অদৃশ্য প্রেমিকের মতন !
–না, কোনো যুবতীর জন্য করিনি । পুলিশের সঙ্গে করেছিলুম, ছাত্র আন্দোলনের সময়ে, সেই যেবার নেহেরু এসে কানপুর-ময়দানে লেকচার দিয়ে গিয়েছিলেন, অথচ আমাদের কলেজে আসা দরকার মনে করলেন না । পুলিশের গুলিতে একজন সহপাঠী মারা গিয়েছিল ।
–জানি, কাগজে পড়েছিলাম, বলেছিলেন সুমিতাদি ।
অঞ্জলি কোনো জিনিস ছুঁতে দেয়নি ওদের বাড়িতে । সোফার পাশের টেবিলে এমিলি ডিকিনসনের একটা বই ছিল , রাহুল হাতে তুলে নেবার আগেই চেঁচিয়ে উঠেছিল অঞ্জলি, ছুঁসনি, ছুঁসনি, বাবা যে জিনিস যেখানে যেমন রেখে গেছে তা সেরকমই থাকবে ।
মানে ? কখন ফিরবেন তোর বাবা ?
বাবা তো আমার যখন এক বছর বয়স তখনই মারা গিয়েছিলেন ।
অঞ্জলির মা বললেন, হ্যাঁ বাবা, আমি কাউকে কোনো জিনিসে হাত দিতে দিইনি । ঝি-চাকররা ঝাড়পোঁছ করে যেখানকার যা সেখানেই রেখে দ্যায় ।
রাহুল অঞ্জলিকে বলেছিল, তোর বাবা তোর গালে টোল দিয়ে যাননি কেন জানিস ? ছোঁয়া বারণ বলে ।
অঞ্জলি যা করল তা রাহুলের জীবনে প্রথম ক্লিংগিং, স্বতঃস্ফূর্ত, সংক্রামক । বলল, জিনিস, বুঝলি, ইডিয়ট, জিনিস, যাতে প্রাণ নেই, গাড়ল, আমি তো আর জিনিস নয়, আমি রক্তমাংস দিয়ে গড়া, শোঁক, আমার নিঃশ্বাস শোঁক ।
রাহুলও রক্তমাংস দিয়ে গড়া প্রমাণ করবার জন্য জড়িয়ে নিয়ে কার্পেটের ওপর শুয়ে পড়ল । মেয়েদের নিঃশ্বাস কী দিয়ে
গড়া ? বরফের মরুভূমি দিয়ে হয়তো । জামাকাপড়, আকর্ষণের অংশটুকুতে নিজেদের মেলে ধরার খাতিরে যতটুকু, খুলে ফেলল, একজন আরেকজনের । দুজনেই একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হল আর, এতদিন পর রাহুলের মনে হয়, তা ছিল প্রথম প্রেম, উন্মাদ, মোহময়, নেশার মতন ।
স্কুলের পর,অঞ্জলির ঘরের ইরানি কার্পেটের ওপর শ্বাস-প্রশ্বাসের ঝড়, আর ওর মা বাড়িতে না থাকলে স্নানঘরে,
শাওয়ার চালিয়ে। অঞ্জলির ঘরে গিয়ে বিছানায় । অন্ধকারে বা আলো জ্বেলে । হাফছুটির দুপুরে বা স্কুল শেষের সন্ধ্যায় । নারী শরীরের গোপন রহস্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে রাহুল, যা তহমিনা আপা স্পষ্ট করে মেলে ধরেননি, বা যা বুঝতে পারার মতন প্রতিক্রিয়া তখনও গড়ে ওঠার বয়স হয়নি সেসময় ।
পরস্পরের গোপন নাম হয়ে গিয়েছিল ক্লিংগার । আকর্ষণের নাম অঞ্জলি দিয়েছিল পাশাখেলা । পাশাখেলার সময়ে দ্রৌপদীর শাড়ি খুলে ফেলতে চেয়েছিল কৌরবরা আর দ্রৌপদীর তখন মাসিক, যোনিতে কানি বাঁধা ।
মনে রাখবি, শরীরের কিছু এলাকা ছোঁয়া চলবে না ।
নিষেধ ! এটাই বোধহয় আকর্ষণবোধের সূত্র ! ছোঁবো বললেই হয় না, রাহুলের তো সাহস চাই । ও তো ডরপোক।
একদিন অঞ্জলি স্কুলে আসেনি বলে ফেরার পথে খোঁজ নিতে গিয়ে ওদের বাড়ির কেয়ারটেকারের কাছে রাহুল শুনল, অঞ্জলিকে নিয়ে ওর মা চলে গেছেন পণ্ডিচেরিতে । রাহুল তো জানতো ওরা বৈষ্ণব ; তারাও যায় নাকি অরবিন্দ আশ্রমে ? বৈষ্ণব !
সুমিতাদি ব্রা্হ্ম । অঞ্জলিরা বৈষ্ণব । তহমিনা আপা শিয়া মুসলমান । আইরিশ নানরা ক্যাথলিক খ্রিস্টান । আকর্ষণের বনেদ তো একই । জাস্ট আকর্ষণ । তার কোনো কার্যকারণ ছিল না । নাকি অভিকর্ষ ? হয়তো বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ থাকতে পারে, যেভাবে নিউটনের আপেলকে টেনেছিল অভিকর্ষ । সে অভিকর্ষ কি নিউটনের নিজস্ব ছিল না ? কেননা আপেল তো তার আগে থেকেই পড়ত । পৃথিবীর অভিকর্ষ তো ছিল, কিন্তু নিউটন নিজের অভিকর্ষ আবিষ্কার করলেন ।
রাহুলও নিজের অভিকর্ষ আবিষ্কার করে, আর অবাক হয় । আপেলকে চায় পৃথিবী, পৃথিবীকে চায় সূর্য, সূর্যকে চায় আগুন, আগুনকে চায় মহাশূন্য । জাস্ট চায় । একজন আরেকজনকে চায়, এর কোনো ব্যাখ্যা নেই ।
তোকে আবার কে চিঠি দিল, বলে একটা খাম রাহুলের হাতে দিয়েছিলেন রাহুলের মা, ‘দেখিস, আবার প্রেম-ট্রেম করিসনি যেন, করার হলে পরীক্ষার পর করিস’, কথা কটা বলে ।
ডাকে অঞ্জলির চিঠি, নীল রঙের কাগজে লেখা, আঁকাবাঁকা হাতের লেখায়, পেয়ে, রাহুল জানতে পারল যে ওদের কর্মকাণ্ড দেখে ফেলেছিলেন অঞ্জলির মা । অঞ্জলির সঙ্গে তর্কবিতর্ক ক্রমে ঝগড়ার চেহারা নিয়ে ফেলতে, উনি সেদিন সন্ধ্যাতেই ট্রেনের প্রথম শ্রেণির টিকিট কেটে রওনা দিলেন হাওড়া । অঞ্জলি লেখেওছে, প্রথম শ্রেণি, যে শ্রেণিতে রাহুল চাপেনি কখনও । ঠাকুমাকে নিয়ে বা মা-বাবার সঙ্গে দেশের বাড়িতে গেলেও রাহুলকে থার্ড ক্লাসে চেপে যেতে হয়েছে ।
নিজের কাঁধ, বাহু, শুঁকলেও অঞ্জলির গায়ের কোমল গন্ধ পায় রাহুল । ওদের বাড়ির রাস্তা দিয়ে গেলে গাছের পাতারা হাওয়াকে বলতে থাকে এখানে হাত দেয়া নিষেধ, ওখানে মুখ দেয়া নিষেধ ।
চিঠিটা রাখেনি ; চায়ের ঠেকে বসে, পড়ে, চায়ের দোকানের উনোনে ফেলে দিয়েছিল ছিঁড়ে , কুটিকুটি । চিঠি জুড়ে তেতাল্লিশবার লিখেছিল “ভালোবাসি তোকে”, বারো বার লিখেছিল “তোকে ছাড়া বাঁচব না”, আর কুড়ি বার লিখেছিল “তোর জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করব” ।
রাসবেহারির ফ্যাঁকড়া গলিতে, এক মহিলা কবি-অধ্যাপকের বাড়ি গিয়েছিল রাহুল, এমনিই, হাটতে-হাঁটতে, হঠাৎ দেখা করার ইচ্ছা হল, তাই ; কখনও সামনা-সামনি পরিচয় হয়নি । রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমম, বোধহয় তেইশ, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । উনি নিচের তলায় বসিয়ে রাখলেন বেশ কিছুক্ষণ, তারপর খবর পাঠালেন, অসুস্হ, শুয়ে আছেন, রাহুল দেখা করতে পারে, তবে অবিরাম কথা বলা যাবে না ।
আমাকে সবাই এত ভয় পায় কেন, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে ভাবছিল রাহুল । সিঁড়ির দেয়ালে ওনার বিখ্যাত বাবা-মায়ের সেপিয়া ফোটো । গিয়ে দেখল, কবি-অধ্যাপক শুয়ে আছেন । ওঃ, ভয় নয়, একটু মেক-আপ করার সময় নিয়েছেন । অসুস্হ হলেও পাটভাঙা তাঁতের শাড়িতে, কপালে টিপ, যৎসামান্য পাউডার বোলানো গাল । টিপ দেখে
ভালো লাগল । রোগিদের টিপ পরলে কত সুন্দর দেখায়, হাসপাতালগুলোয় অমন ব্যবস্হা থাকলে ভালো হতো।
পরিবেশ পালটে যায় । পরে, একবার ও, মানব রায়, ভবদেব মিত্র আর ভবদেবের বন্ধুনি রোশনি, কয়েক প্যাকেট টিপ কিনে আর জি কর, এস এস কে এম, মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে নার্সদের অনুরোধ করে রোগিনীদের মেরুন টিপ বিলি করেছিল । প্রায় সব রোগিনী পরে নিয়েছিল টিপ, হাসি ফুটেছিল আত্মীয়দের মুখে । নিউজপ্রিন্টের কালোবাজারি এক ট্যাবলয়েডের সাংবাদিক ঘটনাটা জানতে পেরে টিপ বিলোনোকেও ওদের আন্দোলনের কর্মকাণ্ডের
অন্তর্ভুক্ত করে রসগদ্য লিখেছিল।
অগ্রজ মহিলা কবির কোনো অপেরা-সংলাপ মনে নেই রাহুলের, অপেরা বইয়ের নামও মনে নেই, কিন্তু ওনার চুমু-ডাক ফিকে-লাল ঠোঁট, আর টিপ-পরা সরু কপাল মনে আছে ।
মহিলা কবির বাড়ি থেকে বেরিয়ে, কতদিন পর, গড়িয়াহাটের মোড়ে, আচমকাই অঞ্জলির সঙ্গে দেখা, স্লিভলেস লাল ব্লাউজে, কাঁথা-স্টিচ শাড়িতে, সোনালি রিস্ট ওয়াচ, কানে হিরের ফুল ঝিকমিক ।
সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড এক পলকের জন্য থেমে গেল, আর রক্ত চলকে উঠে এলো রাহুলের শিরা-উপশিরা বেয়ে, দ্রুত, নিঃশব্দ আওয়াজ তুলে । রাহুলের মুখ থেকে আপনা থেকেই, এত বছরের সময়ের দূরত্বকে ঝটিতি মুছে ফেলে, এই গরমশ্বাস কথাগুলো বেরোল, যা শুনে নিজেই অপ্রস্তুত বোধ করল ও, ‘কি রে ? ক্লিংগার? এখানে ? কলকাতায় থাকিস?’
অঞ্জলি বলল, এখন আমি ক্লিংগার নই, ক্লাইম্বার । চিনতে পেরেছিস দেখছি । আঁচ করেছিলাম, নির্ঘাত এড়িয়ে যাবি, চোখ থেকে চোখ সরাচ্ছিস না দেখে বুঝতে পারলাম এখনও বাসি রহস্যে বাঁধা আছিস । কিন্তু তুই কি করছিস কলকাতায় ? তুই তো কানপুরের জুহি পরমপুরওয়া পাড়া ছেড়ে অশোকনগরের বাড়িতেই আছিস বলে শুনেছি ; সব খবর রাখি ।
হ্যাঁ, বলল রাহুল, ফিসফিস করে, মাই গড, তোর গালে টোল পড়ছে । পারফিউম থেকেই তো বুঝতে পারছি, তুই কোথাও ক্লাইম্ব করে উঠে পড়েছিস, করকরে নোটের জগতে, আর আমি পচা-ছাতাপড়া নোটের আড়তে । অরবিন্দ আশ্রম থেকে এই মায়াবাজারে ? একটু থেমে, প্রাক-তারুণ্যের প্রাচীন ব্যর্থতাবোধ আর মনখারাপের ধুলোপড়া স্মৃতিকে সরিয়ে, হৃৎপিণ্ডকে গলা থেকে আবার বুকের ভেতরে নামিয়ে, রাহুল বলল, তোর হাত ধরব ? আমার কবজির শিরার আওয়াজ তোকে দেখেই যে লাফিয়ে উঠল তা ফিল করতে পারবি । সিঁদুর নোয়া-টোয়া বা হুকড-অফ চিহ্ণ তো দেখছি না । ধরব ? তোর ত্বক আরও মসৃণ হয়ে গেছে ।
অঞ্জলি রাহুলের কবজি আঁকড়ে চাপা গলায় বলল, চল, তোকে আমার টেমপোরারি আস্তানায় নিয়ে যাই, কাছেই, যাদবপুরে। আমার বর, ওই যার সঙ্গে ঘর করি আরকি, সে একজন স্মাগলার । রাহুলের উদ্বিগ্ন অবিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে যোগ করল, সত্যি রে । ও এখন বাইরে কাজে গেছে । কাছাড় শুনেছিস ? সিলেটি ।
স্মাগলার শব্দটা শোনামাত্র রাহুলের ভীতিময় আত্মদন্দ্ব ওকে গা-বাঁচিয়ে পরিস্হিতি যাচাই করতে নির্দেশ দিল ।
প্রসঙ্গের বাঁকবদল ঘটিয়ে রাহুল বলল, সিলেট ? শ্রীহট্ট ? ও তো পাকিস্তানে । সিলেটিদের তো বাঙালরাও স্বীকৃতি
দ্যায় না, কালচারাল ডিফারেনসেসের জন্য । শুনেছি সিলেটিরাই একমাত্র পিওর ব্রিড বাঙালি । পেডিগ্রি বজায় আছে আজও, দেশভাগের এই কয়েক বছর পরও ।
কাছাড়ে ওদের বাঙাল বলে না ; সেখানকার মুসলমানদের হিন্দু সিলেটিরা বলে বাঙাল । সিলেটিরা সিলেটিই, পেডিগ্রি ছাড়তে চায় না । মাটিতে পুঁটি মাছ পুঁতে রেখে বহুকাল পর তারিয়ে-তারিয়ে খায় । বিয়ে-টিয়ের রীতি-রেওয়াজ একেবারে আলাদা, বেশ ইনটারেসটিং । পাকিস্তানে ওরা সিলেটিদের বলে আবুইদ্যা, কে জানে তার কী মানে ।
–চল, তার আগে কোথাও খেয়ে নিই । সকালে ট্রেনি হসটেলে কেবল ব্রেড-বাটার-কলা খেয়ে বেরিয়েছিলুম ।
–আমার বাসাতেই চল না, ভাত-টাত রাঁধাই আছে । যা আছে দুজনে খেয়ে নেব । তোর কথা শুনতে পাই এর-তার মুখে । কী সব আন্দোলন-টান্দোলন করছিস । চল , শুনবো । কলকাতায় কেন ? পোস্টেড ?
–না, ট্রেনিঙে পাঠিয়েছে অফিস । এর-তার ? হু আর দে ?
–তোদেরই জ্ঞাতি-গুষ্টি, যারা তোদের হিংসে করে । অপেরা লিখিস বলেও হিংসে করে । বোধহয় তোর অপেরার মাংসময় ডিভিনিটিকে হিংসে করে । কিসের ট্রেনিং রে ? তোর আবার ট্রেনিঙের দরকার আছে নাকি !
–নোট পোড়াবার ট্রেনিঙ । আশ্চর্য লাগছে ? যে শোনে সে-ই অবাক হয় ।
–টাকা পোড়াবার ? তার ট্রেনিঙের কী দরকার ? এক জায়গায় জড়ো করে পেটরল ঢালো আর আগুন ধরিয়ে
দাও ।
–প্রতিটি নোট পোড়াবার হিসেব রাখতে হয় । পচা-গলা-ছাতাপড়ে সবুজ হয়ে-যাওয়া নোটগুলো শেষ পর্যন্ত কী হয় ভেবে দেখেছিস কখনও ?
–না ভাবিনি । ডেসট্রয় করা হয় জানতাম ।
–নোটের পাহাড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে চাকরি করি । প্রায় পনেরো ফিট উঁচু-উঁচু পচা নোটের পাহাড় । তা থেকে
র্যানডাম স্যামপ্লিং করে, গুণে, তার পর বস্তায় ভরে, চুল্লিতে পোড়াতে নিয়ে যেতে হয় । বিটকেল গন্ধ, প্রথম দিকে জ্বর হতো, নাক দিয়ে জল পড়ত, গলা বন্ধ থাকতো মাঝে-মাঝে, এখন সব সয়ে গেছে ।
–হ্যাঁ, সব সয়ে যায়, সব সয়ে যায় ।
–জ্ঞাতিগুষ্টির কথা বলছিলিস, তারা কারা ?
–কলকাতার, কানপুরের, গঙ্গার এপার-ওপারের । তোদের গুষ্টিটাই হিংসুটে ।
–এটা শুনতে আমার বেশ ভালো লাগে, এই যে কেউ-কেউ আমাকে হিংসে করে ; কেমন এক ধরণের স্ট্রেঞ্জ রাসায়নিক আরাম পাই । মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক ট্রাইবাল যুগে ফিরে গেছি ।
–তা না হলে আর মানব বলেছে কেন ! মানুষ তো বেসিকালি ক্যানিবাল ।
–আমি তো তোর ব্যাপারটা শুনতে চাই । তোর মা কোথায় ? স্মাগলার বলে অবজেকশান নেননি, সত্যিই যদি সে স্মাগলার হয় ? আমি তো বেটার অপশান ছিলুম । স্মাগলর শব্দটা ব্যবহার না করতে চাইলেও, তক্ষুনি প্রতিশব্দ না পাওয়ায়, প্রয়োগ করতে হল ওকে ।
তখন ছিলিস না ; তখন ছিলিস স্কুল কিড, নাইভ, ইররেসপনসিবল, কী করে কী করতে হয় তাই জানতিস না, ভুলে যাচ্ছিস কেন, থেমে-থেমে কথাগুলো বলে, একটা ট্যাক্সিকে হাত দেখিয়ে থামতে ইশারা করে, বলল অঞ্জলি । তারপর ট্যাক্সিতে বসে, রাহুল দূরত্ব রেখে বসতে যাচ্ছিল, কাছে ঘেঁষে থপ করে বসে, পারফিউমের সুগন্ধ রাহুলের দিকে উড়িয়ে, অঞ্জলি বলল, মা তো পণ্ডিচেরি যাবার কয়েক বছরের মাথায় মারা গিয়েছিলেন । আশ্রমই আমাকে স্কুলের শেষ ধাপ পর্যন্ত পড়িয়েছিল ; তারপর কলকাতা চলে এলাম রিসেপশানিস্টের চাকরি নিয়ে । আশ্রমে তো সায়েবে গিজগিজ, হোটেলে রিসেপশানিস্টের চাকরি পেতে অসুবিধা হয়নি, দেখতেই পাচ্ছিস আমার স্মার্টনেস । সেখানেই গেঁথে তুললাম আমার বরকে, এত টাকাকড়ির গোমর দেখাত যে না ফাঁসিয়ে থাকতে পারলাম না । পরে ক্রমেক্রমে জানলাম যে ও স্মাগলার । ভাল্লাগে না স্কাউন্ড্রেলটাকে, কিন্তু কি করি, উপায় নেই, পয়সাখরচের বদভ্যাস করে দিয়েছে ; আমার অ্যাম্বিশান ছিলই পয়সাঅলা বর । তাছাড়া, এত ব্যাপার জেনে ফেলেছি যে বেগতিক দেখলে হয়তো খুন করে ফেলে দেবে আসামের সবুজ চা-বাগানে নিয়ে গিয়ে । কিন্তু কী জানিস, ও জড়িয়ে ধরলেও আমি চোখ বুজে তখন তোর কথাই ভাবি, যেন তুই চুমু খাচ্ছিস, বুকে মুখ ঘসছিস, প্রবেশ করছিস ।
প্রবেশ ? সেই পাশাখেলার দিনে তো প্রবেশ নট অ্যালাউড বলেছিলিস ! ছোঁয়াও বারণ ছিল । স্মাগলারদের তো অঢেল টাকা । তাহলে যাদবপুরের রিফিউজি পাড়ায় থাকিস কেন ?
যাদবপুরেরটা মাল রাখার জায়গা ; পুলিশ বড়ো একটা ওমুখো হয় না । তোকে সোজা আলিপুরের ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতে পারতাম । কন্ঠস্বরকে, ট্যাক্সিঅলা যাতে শুনতে না পায়, ফিসফিসানিতে নামিয়ে, বলল অঞ্জলি ।
কালো-হলুদ ট্যাক্সিটা এইটবি বাস স্ট্যাণ্ডের কাছে গতি কমাতে, অঞ্জলি ড্রাইভারকে হুকুম দিলে, এখানে থামতে হবে না, তুমি ঘুরে আলিপুরেই চলো । রাহুলের অনুসন্ধিৎসু ঘর্মাক্ত উদ্বিগ্ন মুখের পানে তাকিয়ে বলল, ‘আমি আজও তোর মুখ দেখে বলে দিতে পারি কী চলছে তোর মনের মধ্যে । তুই আমাকে দেখে একই সঙ্গে ভয় আর আনন্দের মাঝে, সত্যি আর মিথ্যের মাঝে, ভালো মেয়ে আর নষ্ট মেয়ের মাঝে, দোল খাচ্ছিস । তারপর জিগ্যেস করল, ভুরু কুঁচকে, তোর মুখ থেকে কথাগুলোর সঙ্গে কিসের যেন একটা স্ট্রেঞ্জ গন্ধ বেরোচ্ছে, কি খেয়ে বেরিয়েছিস ?
–হ্যাশিশ । শব্দটা লিখে, স্মৃতিতে ফিরে, সত্তরোর্ধ রাহুল নিজের সম্পর্কে একটা ব্যাপার আবিষ্কার করল । কোনো মাদকই ওকে নেশার অভ্যাসে আটকাতে পারেনি । ছোটোবেলায়, ছ’সাত বছর বয়সে, পাড়ার স্হানীয় পার্বণে বা বিয়েশাদিতে তাড়ি খেয়েছে, ভালো লেগেছে, পরে বন্ধুদের সঙ্গে খেয়েছে, হিন্দি লেখকদের বাড়িতে খেয়েছে, তারপর কখন যেন আর খায়নি । ছোটোবেলায় এগারো-বারো বছর বয়সে দিশি মদ বা ঠররা বা সোমরস খেয়েছে, জিভে ভালো লাগেনি, মগজে ভালো লেগেছে, তারপরেও খেয়েছে, বন্ধুদের সঙ্গে খালাসিটোলায়, পিসতুতো দাদার সঙ্গে হাওড়া ব্রিজের তলায়, দাদা অনিকেতের সঙ্গে চাইবাসা, লাহেরিয়াসরায়, ডালটনগঞ্জ, ধানবাদ, দুমকায় মহুয়ার মদ আর ভাত পচানো
হাড়িয়া খেয়েছে, দাদার বন্ধুদের সঙ্গে খেয়েছে, ভালো লেগেছে, তারপর আর খায়নি । কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে গাঁজা ভাঙ
চরস আফিম খেয়েছে, কবিবন্ধুদের সঙ্গে খেয়েছে, হিপি-হিপিনীদের সঙ্গে ফুঁকেছে, একা ফুঁকেছে, তারপর কখন যেন আর খায়নি । চিত্রকর বন্ধুদের সঙ্গে বেনারসে, হিপি-হিপিনীদের সঙ্গে নেপালে, লাইসারজিক অ্যাসিডে চোবানো ব্লটিং পেপার, কোকেনগুঁড়ো মাখানো ব্লটিং পেপার গিলে ফেলেছে, নেশায় ডুবে থেকেছে, ভালো লেগেছে, তারপর কখন যেন আর গেলেনি । প্রথমে চারমিনার খেতো, তারপর পানামা খেতো, তারপর পাকানো রাইস পেপারে ক্যাপস্ট্যান বা উইলস
টোব্যাকো ভরে খেয়েছে, কখন যে ছেড়ে দিয়েছে, ওর মনে নেই । চুরুট ফুঁকেছে, ছেড়ে দিয়েছে । পাইপ টেনেছে, ছেড়ে দিয়েছে । পান-জর্দা খেয়েছে, ছেড়ে দিয়েছে । রাম, হুইস্কি, ভোদকা খেয়েছে, সহপাঠীদের সঙ্গে, বন্ধুদের সঙ্গে, স্ত্রীর সঙ্গে, ছেলে-মেয়ের সঙ্গে, অধস্তন অফিসারদের সঙ্গে মদ খেয়ে হুল্লোড় করেছে, তারপর ছেড়ে দিয়েছে । দেহ টলমল করেছে, কিন্তু চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পায়নি, মাতাল হয়নি, বাজে বকেনি, বা উল্টোপাল্টা আচরণ করেনি কখনও ।
ইচ্ছে করলেই ও, রাহুল, ছেড়ে দিতে পারে, দিয়েওছে, একের পর এক, পেছনে পড়ে থেকেছে স্বজনজ্ঞাতি, শ্যাওড়াফুলির খন্ডহর, কলকাতার ফ্ল্যাট, পরিচিত মানুষ-মানুষী, মাদক, বই, বন্ধু, বন্ধুনি, আসবাবপত্র, পোশাক , কোনো কিছুতে অভ্যস্ত হয়নি ।
যা ওকে ছাড়েনি তা হল হঠাৎ চাগিয়ে ওঠা মন-খারাপ, আচমকা উঁকি-দেয়া ব্যর্থতাবোধের গ্লানি, অকস্মাৎ মনে পড়ে-যাওয়া বিশ্বাসঘাতকতা আর নিম্নরুচির ব্যবহার, গ্রামীণ উন্নয়নের পরিকল্পনা রূপায়নে নিষ্ফলতাজনিত দুঃখ— এমন কোনো পঞ্চায়েত বা গ্রাম পায়নি যেখানে পরস্পরবিরোধী দুদল মানুষ প্রতিটি কর্মকাণ্ডকে ভণ্ডুল করার জন্য সব সময় মুখিয়ে নেই—, স্বজন আর স্বজন করে নিতে-চাওয়া মানুষের থেকে বিচ্ছেদের বেদনা, সুচিকিৎসা না পাওয়ায় মায়ের মৃত্যুর দায় ।
–নেশা ? নেশা করিস ? ছিঃ , ওটা তো ছোটোলোকদের নেশা । তোর ছোটোবেলাকার জুহি পরমপুরওয়ার হ্যাবিট ছাড়তে পারলি না । ড্রিংক করলেই তো পারিস । বলল অঞ্জলি ।
–নীলকমলের ট্যাবলয়েডের অফিসে গিয়েছিলুম, ও-ই ফুঁকতে দিল । তুই চিনবি না নীলকমলকে ; ও আমাদের ব্রাহ্ম স্কুলের প্রডাক্ট নয় । যদি না ফুঁকতুম তাহলে বোধহয় তোকে দেখে বিব্রত আর আড়ষ্ট বোধ করতুম । এড়িয়ে গিয়ে কেটে পড়তুম । ছোটোবেলায় কোন পাড়ায় থাকতুম জানিস তো ? ছেলেবেলার বন্ধুদের সঙ্গে এখনও দেখা হয় মাঝে-সাঝে ।
–যত্তো সব চোর-ছ্যাঁচোড়ের পাড়া ছিল তোর সেই জুহি পরমপুরওয়া স্লাম, কানপুরের সবচেয়ে কুখ্যাত স্লাম।
–তাহলে, ভেবে দ্যাখ, স্মাগলিং ব্যাপারটাকে খারাপ মনে হচ্ছে না তোর ; ছোটোলোকদের খারাপ মনে করছিস ।
রাহুলের মগজে বিভিন্ন রসায়ন কাজ করছিল, যেগুলোর ভেতর প্রধান হল সুপ্ত আতঙ্ক । ও এর আগে কখনও এমন কোনো মানুষের সান্নিধ্যে আসেনি যে স্মাগলিং করে, কিংবা যার পরিবারের লোকেরা স্মাগলার । স্মাগলিং শব্দটাই ভীতিকর, যারা করে তারা আরও খতরনাক , অন্ধকার অচেনা জগতের বাসিন্দা । একজন যুবতী, যাকে ও তখনও পর্যন্ত ভুলতে পারেনি, যে গোপন হাহাকারে ওকে ফেলে উধাও হয়ে গিয়েছিল, যাকে মুছে ফেলতে পারেনি ইন্দ্রিয়গুলো
থেকে, তাকে ও আবিষ্কার করছে, হঠাৎই, সেই যুবতীরই স্বীকৃতি অনুযায়ী, সে কিনা অচেনা অন্ধকার জগতের নিবাসী । অযথা টানাহেঁচড়ায় পড়বে না তো ! পুলিশের লোকেরা নিশ্চয়ই নজর রাখে ওর বাসায় । কারা আসছে যাচ্ছে সেদিকে নজর রাখে । রাহুলের কেমন যেন শীত-শীত করতে লাগল, টের পাচ্ছিল যে ভেতর থেকে ও কাঁপছে ।
নিজেকে অভয় দেবার জন্য অঞ্জলিকে বলল, না, ভয় পাবো কেন ? পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ছে । সন্ধ্যার ফিকে আলোয় সবুজ রঙের তোশকে একজন কিশোরী । বাকিটা ফিসফিস করে, যাতে ট্যাক্সিচালক শুনতে না পায়, উদ্দীপনায় রিমঝিম, সবে উঁকি-দেয়া রোম, বুকের ওপর ঢেউ উঠতে শুরু করেছে । ভুলতে পারি না । কত দিন হয়ে গেল কিচ্ছু ভুলিনি । তোর সেই হেস্তনেস্তকারি বৈশাখী চিঠি । লজ্জা করে, বলে, তুই কমলারঙের নেটের মশারি ফেলে দিলি ; বললি বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি । শাওয়ারের ফোয়ারাকে বললি তোর তিন লক্ষ উড়ন্ত শিশু আমার কোল থেকে তোর বুকে উড়ে যাচ্ছে । তোর নাভি থেকে আলোছায়ার কাঁচা মায়াবি গন্ধ বেরুতো । আমার জিভে রয়ে গেছে তোর বুকের গমগমে স্মৃতি । এটাই প্যাশন । কাকে প্যাশন বলে জানিস না বোধহয়, যিশুখ্রিস্ট জেদ ধরেছিলেন কাঁধে করে বধ্যভূমি পর্যন্ত ক্রস বয়ে নিয়ে যাবেন, ওই জেদই প্যাশান ।
–জেদ ? নাঃ, জেদ নয় ; যিশু তো ছিল ছুতোর, অভ্যাস ছিল । তুই কত কিলো কাঠ কাঁধে বইতে পারিস ? জিগ্যেস করল অঞ্জলি ।
–তোকে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলুম, তোর পড়ার ঘর থেকে বাথরুম পর্যন্ত, কাঁধে চাপিয়ে, ভুলে গেছিস নাকি !
রাহুলের জবাব ।
অঞ্জলি কথার মোড় ঘোরালো, জানিস, আমি আমার মায়ের লাভারের মেয়ে । বাবা মারা যাননি । আমার জন্মের পর কী করে জানতে পেরে সংসার ছেড়ে চলে গেছেন । আমার মনে হয় একদিন উনি হঠাৎই এসে দরোজায় উপস্হিত হবেন, স্বামী বিবেকানন্দের গেরুয়া পোশাকে ।
–স্বামী বিবেকানন্দ ! আর কাউকে পেলি না তুলনা করার জন্য ! বলে, রাহুলের সন্দেহ হল, অঞ্জলি বোধ হয় সব কথাই বানিয়ে বলছে । যে কারণেই হোক, গুল মারছে ; বলেছিল যাদবপুর, কিন্তু চলল আলিপুর ।
–বিবেকানন্দের ফিলোজফির জন্য বলছি না, জানিও না সেসব । প্রেম নিবেদন করার মতন পারফেক্ট পুরুষ বলে মনে হয়, যখনই ওনার ফোটো কোথাও দেখতে পাই । এসব আবার কোথাও লিখে দিসনি যেন । মঠের লোকেরা জানতে পারলে ব্রেন ওয়াশ করার ডাক দেবে ।
–লাভার ? তিনি কে জানতে পেরেছিস ? কী করেই বা জানলি ? রাহুলের মনে হল, নিজেকে নিয়ে কল্পনার ধোঁয়া তৈরি করছে অঞ্জলি ।
–মা নিজেই বলেছিল । তখনকার দিনের রোমান্টিক গল্পে যেমন হতো । লাভার ছিল পেইনটার, কলকাতায় থাকত, যক্ষ্মায় মারা গিয়েছিল । আমার ঘরের বাঁ-দিকের দেয়ালে যে ল্যাণ্ডস্কেপ পেইনটিং ছিল, সেটা নাকি ওই লাভারের, মানে আমার বায়ালজিকাল বাবার । কী আশ্চর্য দ্যাখ ! বায়ালজিকাল বাবা, অথচ তাকেই ঘেন্না করি ।
–তোর কতদিন হল বিয়ে হয়েছে ? বলে, রাহুলের কানে ফিকে রবীন্দ্রসঙ্গীত টোকা দিতে লাগল । মনে করতে পারল না কোন গান ।
–চার বছর ।
–চার বছর হয়ে গেল, তোর তো একটা কিড হয়ে যাওয়া উচিত ছিল ।
–না হলে আর কী করব । কতরকম ভাবে তো কতকিছু করা হল । আমার হাজবেন্ডের কিউ ক্রমোজোম থেকে বাইশ কিউ এগারো ডিলিশান আছে ।
রাহুল বুঝতে পারল যে ও ভুল প্রসঙ্গ তুলে ফেলেছে । অঞ্জলির হাতের ওপর হাত রেখে বলল, আই স্টিল মিস ইউ । ছেড়ে দে তোর বরকে । ডিভোর্স দিয়ে দে ।
অঞ্জলি সরাসরি রাহুলের মুখের দিকে তাকাল । চোখে চোখ । হ্যাঁ, আমিও তোকে মিস করি । লোকে বলে চোখের আড়াল হলেই ভুলে যায়, তা কিন্তু নয় । ওই বয়সের মাংসের বিস্ময় চিরকাল টিকে থাকে, তাকে কেন যে প্রেম বলা হয় তা জানি না ।
ট্যাক্সি থেকে নেমে রাহুল বলল, আমার কাছে শিভালরি দেখাবার মতো টাকাকড়ি নেই, তুই-ই ভাড়া মেটা । অঞ্জলি বলল, জানি, শুনেছি, ফালতু চাকরি করিস আর পুরো মাইনে উড়িয়ে দিস বন্ধুদের নিয়ে লেখালিখির পেছনে ; এখন বুঝতে পারছি তা নয়, আসলে গাঁজা-আফিম-চরসের পেছনে । কে জানে, হয়তো রেড লাইট এরিয়াতেও যাস, যা
তোর সেক্সুয়াল অ্যাপেটাইট ওই বয়সেই ছিল, আর এখন তো ফুল ব্লাডেড স্টাড-বাইসন । অন্য চাকরি খুঁজছিস না কেন? ছাত্র তো ভালোই ছিলিস, রেজাল্টও ভালোই করেছিলি ।
–ঠিক জানি না, বোধহয় আমি বড়োই অলস ; কোনো অ্যাম্বিশান নেই । নিজের মগজের ভেতরে বাসা বানিয়ে বাবুই পাখির মতন কুনো। ওই যে ডাকনাম রাহু, বছরে একবার সূর্য খাই আর তাইতেই তিনশ চৌষট্টি দিন চলে যায় । কলেজে পড়াবার চাকরি পেয়েছিলুম, বাড়ির আরাম ছেড়ে যাবার মতন রেডি করতে পারলুম না নিজেকে । তুই যদি রাজি হোস তাহলে অমন কোনো চাকরি খুঁজবো ।
–হাঃ, এককালে তো দুজনে মিলে পালাবার প্রস্তাব দিয়েছিলিস ।
–তুইও তো তোর চিঠিতে কতকিছু লিখেছিলিস ।
–আমি ছিলাম কচি-হরমোন-খুকি আর তুই ছিলিস কচি-হরমোন-খোকা । দ্যাটস দ্যাট ।
আমি এরকমই, রাহুল গোপনে নিজেকে বলছিল, এর কোনো কারণ নেই । এই যে দুপাশ দিয়ে পথ চলে যাচ্ছে, তাদের কোনো আগ্রহ তো নেই রাহুল সম্পর্কে, রাস্তার বাঁকে ভিড়, সরকার-বিরোধী মিছিলের ক্লান্ত মানুষ-মানুষী, ততোধিক ক্লান্ত তাদের কাঁধের ওপর রাখা পতাকা । সকালে ও বিশেষ উদ্দেশে বেরিয়েছিল । এখন ট্যাক্সির ভেতরে বসে অঞ্জলির নির্দেশে যাচ্ছে কোথাও ; যাবার ছিল যাদবপুর, পরিবর্তে এখন চলেছে আলিপুর– একে কি পরিভ্রমণ বলবে ?
আকাশ মেঘলা হতে পারত । মার্চ মাস মানে তো বসন্তকাল, তার রেশ গড়ে তুলছে অঞ্জলিকে ঘিরে, ওরই কারসাজিতে
রোমাঞ্চ খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে, অথচ সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরোবার সময়ে যাবার কথা ছিল সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে এক বন্ধুর দপতরে, যে ওরই প্রবাসের কানপুর শহর থেকে এসেছে, সুকোমল রুদ্র , অপেরা-সংলাপের মুক্তাঙ্গনে নতুন ঘটনা ঘটাবার জন্য শলা-পরামর্শ করার উদ্দেশে । তার বদলে ঢুঁ মারল নীলকমলের ট্যাবলয়েডের দপতরে । অথচ স্মাগলার-বধুর সংসর্গের ভীতিময় আকর্ষণ কাটিয়ে উঠতে পারছে না ।
সুকোমল রুদ্র সাইক্লোস্টাইল-করা বুলেটনগুলো বের করে, স্টেনসিল দিয়ে হাতে এঁকে বা লিখে । রাহুল একটা চার্ট তৈরি করে ওকে দিয়েছিল ; কবিয়ালদের বংশলতিকায় এখনকার নটদের নাম । রক্তিম চাটুজ্জের নামও ছিল বলে পুরো রামায়ণ নট্ট কোম্পানির লেঠেলরা সুকোমলকে ঘিরে ধরেছিল কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসের সামনে । চওড়াকাঁধ, কোঁকড়াচুল, কালোত্বক কাঠ-বাঙাল সুকোমল যে একাই কানপুরি রুদ্র-হুঙ্কার দিয়ে লড়তে আহ্বান জানাবে, তা ওর প্রতিপক্ষের কেউই আঁচ করেনি। সবাই কলেজ স্ট্রিট, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট ধরে দে পিট্টান । সুকোমলের সঙ্গে সেদিন কামেশ্বর চোঙদার, নবদেব সরখেল আর প্রভাস চোঙদারও ছিল ; ওরা তো সুকোমলকে ঘিরে ফেলা হচ্ছে দেখে আগেভাগেই পালিয়েছিল।
ওল্ড কোর্ট হাউসের ট্রেনি হসটেল থেকে বেরিয়ে, ডালহাউসি স্কোয়ারে ট্রাম দেখতে পেয়ে উঠে পড়েছিল রাহুল, পরিভ্রমণ অভিযানে, চলমান ঘটমান সময়ের সঙ্গী হবার খাতিরে, একাকীত্ব উপভোগ করবে, শহুরে রোদের ফিকে অনুভব চারিয়ে দেবে অস্তিত্বে । নীলকমলের অন্ধকার দপতরের শীতশীতে চেয়ারে বসে হ্যাশিশ ফুঁকে, বাসে চাপল, আর সে বাস ওকে পৌঁছে দিল রাসবেহারি ।
অঞ্জলিকে দেখেই মন অশান্ত হতে চাইল, শিকড় থেকে ঝাঁকিয়ে তুলতে চাইল আলস্যের নিয়মানুবর্তীকে, অপ্রত্যাশার লোভনীয় বিস্ময়কে ফাঁদ পেতে ধরে ফেলতে চাইল । ওর সেই বৈশাখী চিঠির তীব্র আঘাতের বিদায়সঙ্গীত বাজতে লাগল দপদপে রগের শিরায় ।
ফ্ল্যাটের চাবি খুলে ভেতরে ঢুকে দরোজা বন্ধ করেই অঞ্জলি পেছন ফিরে রাহুলকে জড়িয়ে, ওর কাঁধে মাথা রেখে কেঁপে-কেঁপে ফোঁপাতে আরম্ভ করল । গালে গড়িয়ে আসা চোখের জল যদিও জিভ দিয়ে চেটে নিল রাহুল, কিন্তু ও টের পাচ্ছিল যে ভয়ে ওর হাতের চেটো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে আর সামান্য কাঁপুনি ঘটছে শরীর জুড়ে । বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই দাড়িয়েছিল দুজনে । কাঁপুনি থেমে আত্মস্হ হলে, রাহুল, মিথ্যা কথা বলার সাহস কন্ঠে এনে, যেসব কথা স্কুলের শেষ বছরে বলবে বলে নিজেকে তৈরি করেছিল, সেগুলো বলতে আরম্ভ করল, বলল, আই স্টিল মিস ইউ, ভুলতে পারি না তোকে, তোর শ্বাসের গন্ধ ভুলতে পারি না । বলে, রাহুল নিজেকে বোঝালো, জড়াজড়ি আর চুমু সত্তেও তো ওর দেহ সাড়া দিচ্ছে না, অচেনা ভয়ে ওর যৌনতা জাগল না । এরকম কেন হচ্ছে ? কতদিন পর একজন যুবতীর তপ্ত দেহ জড়িয়ে ধরে আছে, কিন্তু ওর মনে বা দেহে, তার প্রতিক্রিয়া ঘটছে না !
অঞ্জলিকে চিনতে না পেরে কাটিয়ে দিলেই হতো ।
তুই আমাকে মিস করিস বা না করিস, তুই আমার লাভার হ, আমার মায়ের লাভারের মতন , কাঁধ থেকে মাথা তুলে বলল অঞ্জলি, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে । চল, চল, প্রমাণ কর যে তুই আমার লাভার হবার যোগ্য । যাদবপুরে না গিয়ে তাই এখানে এলাম । পাশাখেলি চল, আগেকার দিনের মতন, শাওয়ারের জলে, তোর তিন লক্ষ শিশু উড়ে আমার বুকে এসে বসুক, চল ।
–স্কুলের সময়ে তুই তো লাভার হতে দিসনি, অবসাদগ্রস্ত গলায় বলল রাহুল, বলেছিলি, সবকিছু করা চলবে না, ওনলি ড্রাই লাভ ।
–হ্যাঁ বলেছিলাম । এখন হ । এখন সবকিছু কর । আজকে থেকে যা । সারারাত মাংসামাংসি করব । জীবনের
সেই বোকা দিনগুলোয় যা পাওয়া হয়নি তা আশ মিটিয়ে পুরো করে নিতে চাই আজ ।
–তুই ওই স্মাগলারকে ছেড়ে দে, ডিভোর্স দিয়ে দে ; আমার সঙ্গে চল । প্রস্তাবটা যে অবাস্তব, তা জেনেই বলল রাহুল । পরপর মিথ্যা বলার দরুণ বেশ হালকা লাগছিল ।
–আর হয় না রে । একসঙ্গে শোয়া যায়, কিন্তু ঘর করা আর যায় না । স্মাগলারের সঙ্গে ঘর করা যায়, কবি-টাইপদের সঙ্গে, উচ্চাকাঙ্খাহীন পুরুষের সঙ্গে, যারা নিজের সম্পর্কেই সন্দেহে ভোগে, তাদের সঙ্গে ঘর করা যায় না, সে স্টাড-বাইসন হলেও । তাছাড়া মনের দিক থেকে আমরা অনেক দূরে চলে গেছি, নর্থ পোল সাউথ পোল । আমি তোকে সেরকমই ফ্লেশ অ্যান্ড ব্লাড চাই, যেরকম ছোটোবেলায় চাইতাম; ফ্লেশ অ্যান্ড ব্লাড, ফিলমি ভালগার প্ল্যাটনিক
প্রেম নয় । তোর সঙ্গে এখন প্রতিদিন শুতে পারি, অবাধ যৌনতার খেলা খেলতে পারি সারা ফ্ল্যাটে
দৌড়ে-লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে । কিন্তু ঘর করা সম্ভব নয় । ঘর করার ব্যাপারটা রুটিন । আর দুজন মানুষের রুটিন যদি খাপে-খাপে না মেলে তাহলে মনের ডিফারেনসেস মেটানো কঠিন ।
অঞ্জলির বরের ড্রেসিংগাউন পরে, পারফিউম মেখে, লাঞ্চ করল রাহুল । হুইস্কি খেল দুজনে । ব্ল্যাক ডগ, নিশ্চয়ই স্মাগলিং করা হুইস্কি । তারপর বেডরুমে গিয়ে সেই যে বিছানায় আশ্রয় নিল, আচমকা একে আরেকজনকে টেনে নিয়ে আদর করল স্কুলের দিনগুলোর ঢঙে । রাহুলের দেহ তবু সাড়া দিল না ।
–কী হয়েছে তোর ? রেসপন্ড করছিস না, একেবারে ফ্রিজিড ।
–জানি না । রাহুল ভাবছিল মোক্ষম কথাটা বলবে, যে ,একজন মেয়ে ওর মনের মতন নয় , এই ধারণা মগজে একবার ঢুকে গেলে ও ফ্রিজিড হয়ে যায় , সেকারণে ও যৌনকর্মীদের বাড়ি যায় না।
অঞ্জলি ওর স্মাগলার বরের গ্রামের বাড়ি আর সেখানে সঙ্গমের আলোচনা আরম্ভ করল, রাহুলকে ঈর্ষার মাধ্যমে যদি উত্তেজিত করা যায় । ওদের বাড়িটা বাঁশের তৈরি, জমি থেকে বেশ উঁচুতে, বাঁশ পুঁতে-পুঁতে তার ওপর দুতলা টালির চালার বাড়ি । বর্ষায় বাসার তলায় জল জমে থাকে, মাছ ধরা যায়, ডিঙি করে যেতে হয় রাস্তা পর্যন্ত । পাতা বাঁশের ওপর মাদুর পেতে সঙ্গম করার সময়ে পুরো বাড়িটা সঙ্গীতময় হয়ে ওঠে, বাঁশের ক্যাঁকোর-ক্যাঁকোর শব্দে। স্মাগল-করা জিনিস লুকোবার জন্য বাঁশের দেয়ালে খোপোর গড়া আছে, পুলিশ রেইড করলেও মাল খুঁজে পাবে না, যদিও ওই গ্রামে যেতে হলে ট্রেন তারপর বাস তারপর কাঁচাপথে মোটর সাইকেল তারপর কয়েক কিলোমিটার হাঁটা, কিংবা বর্ষায় ডিঙি-নৌকো ।
গল্প শুনতে-শুনতে রাহুল ঘুমিয়ে পড়েছিল ।
সকালে রাহুল যখন জামা-ট্রাউজার-জুতো পরে তৈরি, অঞ্জলি বলল, তুই বেসিকালি কাওয়ার্ড, তাই এড়িয়ে গেলি । তোর পকেটে যে কাগজটা ছিল তাতে যাদবপুরের ঠিকানা লিখে দিয়েছি ; আর এই বাড়িটা তো তুই চিনেই গেলি। ফোন নম্বরও লিখে দিয়েছি । আমি তুললে রেসপণ্ড করিস, নয়তো করিস না । যদি তোর কাওয়ার্ডনেসকে কাবু করতে পারিস তাহলে চলে আসিস ।
তুই চল না আমার সঙ্গে । পালিয়ে চল । আমার নাম-ধাম তো আর তোর বর জানে না । কার সঙ্গে ইলোপ করলি কি করেই বা জানবে । আমার আস্তানা থেকে ডিভোর্স নোটিস পাঠিয়ে দিস । আবার অবাস্তব প্রস্তাব দিল রাহুল । দিয়ে ভয়ও করল, কে জানে, যদি অঞ্জলি প্রস্তাবটা মেনে নিয়ে বলে ওঠে, ঠিক আছে, চল ।
যাক, তা বলল না অঞ্জলি । বলল, তুই মাংসের সম্পর্ককে ডিবেস করে ফেলছিস । আমি তো আছিই, তোর বাড়িতে না গিয়ে অন্যের বাড়িতে আছি, তাতে কী এলো-গেলো ।
দাঁড়া, বলে, অঞ্জলি ড্রইংরুমের একটা আলমারি থেকে রাহুলকে চামড়ার পার্স দিয়ে, যোগ করল, এই নে, তোর ট্রাউজারের পকেটে তো দেখলাম পার্সটার্স নেই, পকেটে টাকা গুঁজে রাখিস । হিসাব রাখিস কী করে ?
–হিসাব ? আমি তো কোনোকালে কোনো কিছুর হিসেব রাখিনি । বন্ধুবান্ধবরা অভাবের কথা বললেই সাহায্য করি ; সময়কে লাগাতার খরচ করতে থাকি ।
–এত দিনে কিছু একটা হয়ে ওঠা উচিত ছিল তোর ।
‘হয়ে ওঠা’ ! কতবার শুনেছে কথাটা রাহুল । এই হয়ে ওঠা ব্যাপারটা ঠিক কী, ভেবে কুলকিনারা পায়নি । মানুষ তো মানুষই , তার আবার হওয়াহয়ির কী আছে ! মানুষ কী ভাবে ধাপে ধাপে বিবর্তনের সিঁড়ি বেয়ে জেলি-প্রাণ থেকে মানুষ হল তা তো ডারউইন বলে গেছেন । তারপর আবার কী হয়ে উঠবে মানুষ ? বাইবেলের গল্প থেকে ইউরোপের লোকেরা বেরুতে পারছে না বলে আমরাও কেন আটকে পড়ব সেসব গল্পে ? বিজ্ঞান বাদ দিয়ে হয়ে ওঠার গল্প । কেউ কি অপেরা-গায়ক বা অপেরা-লেখক হয়ে ওঠে ? রবীন্দ্রনাথ কি হয়ে ওঠার কথা চিন্তা করেছিলেন ? হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কি চেয়েছিলেন শব্দকোষের ভাঁড়ার আবিষ্কারক হয়ে উঠবেন ? ইউরোপ গিলিয়েছে, আরও নানা রকমের গল্পের সঙ্গে এই হয়ে ওঠার গল্প । হাতে কলম এলেই আরম্ভ হয়ে যায় হয়ে ওঠার কৌম-নিরপেক্ষ আনুই বিষাদ দুঃখ অশান্তি ।
বিষাদ দুঃখ অশান্তি ! রাহুলের বয়স তখন কত হবে, মমমমমমমম, যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । লেক মার্কেটের সামনের হোটেল ভেঙ্কটেশ থেকে বেরিয়ে দাদা অনিকেতের বাড়ি যাবে বলে স্ত্রী সুমনার সঙ্গে টালিগঞ্জমুখো ট্রামে চাপতে যাচ্ছিল। কলকাতার ফ্ল্যাট বেচে দেবার পর, কলকাতায় গেলে,ওই হোটেলেই উঠত সেসময়ে । রাসবিহারি
ক্রসিঙে একজন পেটমোটা মোদো-গাল প্রৌঢ় সামনে এসে বলল, ‘স্যার চিনতে পারছেন ?’ অনেককেই চিনতে পারে না
রাহুল আজকাল, এমনকি মুখ দেখে চেনা মনে হলেও, নাম মনে পড়ে না । স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে চোখে চাউনি-প্রশ্ন তুলতে, সুমনাও মাথা নাড়ল, উঁহু ।
–স্যার, আমি অনির্বাণ মৌলিক ।
রাহুল, তবু মনে করতে পারল না ।
–আপনার আন্ডারে জুনিয়ার অফিসার ছিলাম, কলকাতাতেই, আপনি ইনচার্জ ছিলেন, আপনি আমার অ্যাপলিকেশান ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, মনে পড়ছে ?
–না না, আমি কখনও কারো কোনো দরখাস্ত ছিঁড়ে ফেলে দিইনি, প্রতিটি অ্যাপলিকেশান রেকমেণ্ড করেছি, তা সে যোগ্য হোক বা না হোক ।
–আমি অন্য অ্যাপলিকেশানের কথা বলছি স্যার । আমি গ্রেপ্তার হয়ে হাজতে একরাত ছিলাম, চাকরি নিয়ে টানাটানি হতে পারত, আপনি বাঁচিয়েছিলেন ।
মনে পড়ল সেই যুবক অনির্বাণ মৌলিককে । বলল, কিন্তু এরকম কুৎসিত হয়ে গেলে কী করে ? তোমার তো ফিল্মস্টারের মতন চেহারা ছিল, তোমার স্মার্টনেস তোমার সহকর্মীদের ঈর্ষার কারণ ছিল । সেসব মিটে গেছে ? বললেও, ভেঙেপড়া আদল দেখে, রাহুল বুঝতে পারল যে সেই যুবকটি নিজেকে ধ্বংস করে, জন্ম দিয়েছে এই মোটা ভ্যাদকা লোকটাকে ।
অনির্বাণ মৌলিক বিয়ে করেছিল । ছেলে হয়েছিল একটা । তারপর ওর বদলি হয়ে গেল মিজোরাম । ওর স্ত্রী যেতে চাইল না । অনির্বাণ জোরাজুরি করেনি, মিজোরামে ছেলের স্কুলের সুবিধা নেই, স্ত্রীকেও আত্মীয়স্বজনহীন একা থাকতে হবে, কেননা ওকে তো সারা রাজ্যে ট্যুর করে বেড়াতে হবে । দেড় বছর মিজোরামে কাটিয়ে, টিএ-ডিএর যথেষ্ট টাকাকড়ি জমিয়ে ফিরে এলো । ফিরে, জানতে পারল, ওর স্ত্রী প্রেগন্যান্ট । অনির্বাণ তো ওর স্ত্রীর সঙ্গে দেড় বছরের একদিনও শোয়নি, তো বউ অন্তঃস্বত্তা হল কী করে ! স্ত্রীকে অনুরোধ করল, অ্যাবর্ট করিয়ে ফেলতে । স্ত্রী রাজি না হওয়ায়, শ্বশুর-শাশুড়িকে জানালো ঘটনাটা । শ্বশুর, শাশুড়ি আর স্ত্রী ওর বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ দায়ের করল থানায় । অনির্বাণ মৌলিক গ্রেপ্তার হয়ে চালান হয়ে গেল ।
ছাড়া পেয়ে পরের দিন একটা দরখাস্তে বিস্তারিত লিখে রাহুলের কাছে জমা দিয়েছিল । ওটা ফরোয়ার্ড করলেই যুবকটি চাকরি থেকে সাসপেন্ড হয়ে যাবে । রেস্তহীন মকদ্দমা যে কী ব্যাপার, তা ভালোই জানা ছিল রাহুলের । ফৌজদারি আদালতে দিনের পর দিন একা-একা দাগিদের মাঝে কপর্দকহীন সময় কাটানো ! অ্যাপলিকেশান ছিঁড়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দিয়ে রাহুল ওকে বলল, চেপে যাও, কেস-ফেস লড়তে হয় চুপচাপ লড়ো, কাউকে কিচ্ছু বলার দরকার নেই ; আর যদি তোমার স্ত্রীকে তুমি ওভাবেই অ্যাকসেপ্ট করে নিতে পারো, তাহলেও কাউকে কিছু বলার দরকার নেই ; পুরো ব্যাপারটা তোমার ব্যক্তিগত নির্ণয়ের ওপর নির্ভর করছে, তুমি ছাড়া আর কেউ তো কিছুই জানে না । আমিও তোমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিচ্ছু জানি না ; আমার কাছে ঘটনাটা ঘটেনি ।
–আপনি যেমন বলেছিলেন, ঘটনাটা ঘটেনি, আমিও সেভাবেই অ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছিলাম । কিন্তু একসঙ্গে থাকতে পারিনি, সেই থেকে আলাদা । বোঝাপড়া করে নিয়েছি । মাইনে পাই, এক তৃতীয়াংশ রেখে সবটা দিয়ে দিই, তবু আজ পর্যন্ত ছেলেদের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে দেয় নি, সামনে দাঁড়িয়ে থাকে । এই ভাবেই চলছে । মদ খাই, খালাসিটোলায় গিয়ে কাঁদি, বমি করি…
–ডিভোর্স দিয়ে আবার বিয়ে করলে না কেন ?
–তাহলে তো সবই জানাজানি হয়ে যেত স্যার । লোকে কী ভাবত ওর সম্পর্কে, ভেবে দেখুন, আমার কথা না হয় বাদ দিন, ছেলেগুলো বড়ো হয়ে সমাজের নোংরা লাথির মুখে পড়ত । প্রথম বাচ্চাটাও আমার নয় স্যার।
–তুমি তো বলেছিলে..
–বলেছিলাম । ডিএনএ টেস্ট করিয়ে জানতে পেরেছি । সুমনার দিকে তাকিয়ে অনির্বাণ বলল, স্যার জানেন
আমার ব্যাপারটা ।
–অযথা টেনশান এড়াতে, ও তো অন্য কারোর ব্যক্তিগত ব্যাপার সাধারণত বাড়িতে আনে না । বলল সুমনা ।
অনির্বাণ মৌলিক টালিগঞ্জমুখো অটোয় উঠে যাবার পর, ঘটনাটা সুমনাকে জানিয়ে রাহুল বলল, আমি এই লোকটার জীবন নষ্ট করে ফেলেছি; এর দরখাস্ত গ্রহণ করে সাসপেন্ড করে দিলে সবাই জেনে ফেলত, আর এ বাধ্য হতো
নিজের সঙ্গে নিজে লড়তে ; ফালতু পড়ে গেল এমন বউ-বাচ্চার রুলেট খেলায় যে খেলাটা প্রকৃতপক্ষে ও খেলছেই না ।
বোকার মতন কেঁদে মরছে । এ নিজেকে মেলে ধরলে প্রেমে পড়ার মতো তরুণী পেয়ে যেতো, অফিসেই ছিল কয়েকটি মেয়ে যারা এর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করত । নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা চাপিয়ে দিয়ে ধ্বংস করে ফেললুম আরেকজন মানুষের জীবন ।
–তুমি তো সুরিন্দরের বাবার চিঠিও ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে ; কতবার বলেছিলুম খোঁজ করো কার চিঠি, যাদের কথা উনি লিখেছেন তারা কারা, শুনলে না । চিঠি পড়েই ছিঁড়ে ফেলে দেবার এমন বদভ্যাস করে ফেলেছো যে ওর জীবনটাও নষ্ট হয়ে গেল । অনির্বাণ চলে যাবার পর বলল সুমনা ।
রাহুলের সহকর্মী সুরিন্দর ওবেরয়ের প্রসঙ্গে কথাটা তুলেছিল সুমনা । রাহুলের বয়স তখন কত হবে, মমমমমমম, বোধহয় পঁয়ত্রিশ, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । অফিসে ডাকে যে চিঠিপত্র আসে তা থেকে বাছাই করে যার চিঠি তার কাছে পৌঁছে দ্যায় পিওন । পরপর তিনদিন যে চিঠি ওর টেবিলে পিওন রেখে গেল, তাতে কেবল পদবির মিল ছিল, নামের জায়গায় কেবল শ্রীমান লেখা । ওর পদবির অন্য কেউ অফিসে নেই বলে চিঠিগুলো ওকেই পৌঁছে দিয়েছিল পিওন।
চিঠিতে একজন বাবা তাঁর ছেলের সংসারে কোনো গোলমাল চলছে কিনা তা জানতে চেয়েছিলেন । ওর সহকর্মীদের কয়েকজনকে চিঠিগুলো পড়তে দিয়েছিল রাহুল, কিন্তু কেউই চিহ্ণিত করতে পারল না যে প্রেরক লোকটি কে, কেননা তিনি প্রাপককে ‘বেটা’ সম্বোধন করেছিলেন আর নিজেকে ‘পিতাসমান’। চিঠিতে পিতাসমান লোকটি বেটার কাছে জানতে চেয়েছেন যে তাঁর ছেলের স্ত্রীর সঙ্গে অবনিবনার মিটমাট হয়েছে কিনা ; ছেলের বড় ছেলেকে শিখ করবে ভেবেছিল, তা করেছে কিনা ; রান্না করতে গিয়ে ওনার নাতনির হাত পুড়ে গিয়েছিল, সে কেমন আছে ;ছোটো ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করেছে কিনা, ইত্যাদি ।
ওর, রাহুলের, অফিসের ড্রয়ার মাস তিনেকে একবার পরিষ্কার করার জন্য জমে ওঠা চিঠিগুলো ছিঁড়ে বাজে কাগজের বিনে ফেলার পর ওর নজরে পড়ল রহস্যময় চিঠিগুলোর একটা খামে পোস্টঅফিসের ছাপটা আবছাভাবে যেন হিন্দিতে ‘রোপড়’ মনে হচ্ছে।
রোপড় ? রোপড়ের একটা গ্রামে তো ও হনিমুন করার জন্য গিয়েছিল, সহকর্মী সুরিন্দর ওবেরয়দের আখ-সর্ষে-গমের খেত-খামার ঘেরা বাড়িতে, সাটলেজ বা শতদ্রু নদীর তীরে । অপরিচিত পাঞ্জাবি গ্রামে হনিমুনের প্রস্তাবে সুমনাও রাজি হয়েছিল । দেশভাগের আগে মুসলমানদের গ্রাম ছিল ; দখল করে নেয়া বাড়িগুলোর সদর দরোজাও জানলার মাপের, হেঁট হয়ে ঢুকতে হতো, এঘর-সেঘর করতে হলেও অমনই ছোটো-ছোটো দরোজা । জানলার বদলে ছাদের কাছে ভেনটিলেটর । গ্রামের মহিলাদের সঙ্গে লোটা হাতে সুমনাও কাকভোরে গিয়েছিল আখ খেতে । পরে, বেলায়, রাহুলও গিয়েছিল, উলঙ্গ হওয়া নিয়ে রাহুলের কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না, আজও নেই, কলেজ থেকে এক্সকার্সানে গিয়ে দল বেঁধে হাগতে যেতো, হাগবার সময় গালগল্প হতো, পাদবার প্রতিযোগীতা হতো ।
সুরিন্দরদের বাড়িতে প্রতিদিন সকালে পেতলের এক ফুট উঁচু গেলাসে লস্সি, ঘিয়ে চোবানো বেসনের আর ভুট্টার আটার রুটি, পেতলের হাঁড়িতে কাঠের মুগুর দিয়ে পেষা ঘিয়ে ভাজা পালংশাক খেয়ে-খেয়ে কয়েক সপ্তাহেই চেহারার খোলতাই হয়ে গিয়েছিল ।
সুরিন্দরকে তো চিঠিগুলো দেখিয়েছিল, কিন্তু ও বেশ হাসিমুখে বলেছিল যে ওগুলোতে তোলা প্রসঙ্গে থেকে মনে হয় অন্য কারোর।
রোপড়ের ছাপ রয়েছে যখন, সন্দেহ থেকে বেরোতে না পেরে, সুমনা আর রাহুল একদিন রাতে আটটা নাগাদ ঢুঁ মারল সুরিন্দরের বাড়ি । সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়েই শুনতে পেল প্রচণ্ড ঝগড়া চলছে ওর আর ওর স্ত্রীর । ফিরে যাবে কিনা, শোনা উচিত হবে কিনা, ইত্যাদি চিন্তার মাঝে দোটানায় ওরা শুনতে পেল এই কথাগুলো :
–তোমার তো বাচ্চাদের জন্য সময় নেই ; সব সময় বাইরে থাকো, কোথায় যাও আমি জানি, ওই বয়ফ্রেন্ডের কাছে যাও দুপুরবেলা, যখন আমি অফিসে থাকি । মেয়ের ওপর রান্নার ভার দিয়ে তুমি সেজেগুজে বেরিয়ে যাও । রান্না করতে গিয়ে ওর হাত পুড়ে গেল, তবু তুমি ভ্রুক্ষেপ করলে না । দয়ামায়া খুইয়ে বসে আছো ।
–যাই তো যাই । কেমন করে ভালো বাসতে হয় তুমি তার কিছুই জানো না । অফিস থেকে ফিরলে, অফিসের কাজ নিয়ে বসে গেলে, ব্যাস খেলে-দেলে, তারপর রুটিন মতো নিজের কর্মটি করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লে । আমার দিকে ভালো করে তাকাবারও ফুরসত নেই তোমার ; আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কেয়ার তো কোনোদিনই করলে না ।
–বাচ্চাদের সামনে এসব আলোচনা কোরো না ।
–মিন্টুকে শিখ করার সময়ে আমার সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন মনে করোনি । তোমার সংসারে আমার কোনো দাম আছে নাকি ? আমি কেবল জড়িয়ে ঘুমোবার পুতুল ।
–মাইনের পুরো টাকাটা তোমার হাতে তুলে দিই ।
–তুমি যে মাইনের টাকা দাও তা থেকে অনেক বেশি হাতখরচ খান্না আমাকে দ্যায় । তোমার সঙ্গে কেনই বা থাকবো!
–থেকো না, কে বলেছে থাকতে ।
–চলেই যাবো । দাঁড়াও না তোমায় দেখাচ্ছি মজা । আমি চলে গেলে তখন বুঝবে ।
ঝগড়ার মাঝে ঢুকে পড়তে রাহুল-সুমনার মধ্যবিত্ত চেতনা বাধা দিল । সুরিন্দরের ফ্ল্যাটে না ঢুকে ফিরে গেল ওরা। রাহুল পরের দিন অফিসে গিয়ে দেখল ওর ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট সুইপাররা খালি করে দিয়েছে, নয়তো, যে চিঠিগুলো ভালো করে পড়া হয়নি, ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, ছেঁড়া টুকরোগুলো সাজিয়ে, আবার পড়ে পরিস্হিতি বোঝার চেষ্টা করত, বোঝাপড়া সম্ভব কিনা তা খতিয়ে দেখত । সুরিন্দরের বাবাকে টেলিগ্রাম করতে পারত, বা রোপড়ের গ্রামে গিয়ে নিয়ে আসতে পারত ওনাকে । অন্যের সংসারে মাথা গলানো অনুচিত হবে মনে করে হাত গুটিয়ে বসে রইলো ।
দিনকতক পরে শুনলো যে সুরিন্দরের বউ ছোটো ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে একজন লোকের সঙ্গে পালিয়ে গেছে ।
পরে , রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমমমম, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । রাহুলের চণ্ডীগড়ের কোয়ার্টারে মদ খাবার সান্ধ্য আড্ডায় সুরিন্দর ওবেরয় বলে ফেলল, যে ওর বউ সত্যিই একজনের সঙ্গে চলে গেছে, কোথায় গেছে জানে না, জানতে চায় না, ছোটো ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে গেছে, কেননা ওই বাচ্চাটা নিশ্চয়ই খান্নার।
তারপর, রাহুলের বয়স যখন, মমমমমমমম, বোধহয় পঁয়তাল্লিশ, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, ও চলে এসেছে গ্রামীণ উন্নয়নের চাকরিতে, সুরিন্দর নোট পোড়াবার স্তর থেকে ওপরে উঠে-উঠে সেই অফিসেই জাঁদরেল অফিসার হয়েছে, মুম্বাইতে রাষ্ট্রীয়স্তরের এক মিটিঙে পরস্পরের সাক্ষাৎ । সৌজন্য বিনিময়ের পর সুরিন্দর ওর অফিস কোয়ার্টারে খেতে ডাকল সুমনা-রাহুলকে । ওরা গিয়ে দ্যাখে সুরিন্দরের বউও রয়েছে । ওর বউ ফিরে এসেছে দেখে সুমনা-রাহুল ঠিকমতো সন্ধ্যাটা কাটাতে পারল না, ভেবে পেল না কী নিয়ে কথা বলবে । সুরিন্দরই বলল, ওর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে নিউইয়র্কের এক যুবকের সঙ্গে । বড় ছেলের পড়াশোনা তেমন হয়নি, নানা কারণে, তাই ভালো চাকরি পায়নি, চণ্ডিগড়ে থাকে । ছোটো ছেলের প্রসঙ্গ তুলল না ; তাকে ওরা ওর ফ্ল্যাটে দেখতেও পেল না ।
অবসর নেবার পর একদিন হঠাৎ চণ্ডিগড় থেকে সুরিন্দরের বড় ছেলের ফোন পেয়ে জানতে পারল যে লিভারে ক্যানসার হয়েছিল সুরিন্দরের ; অপারেশন করাতে গিয়ে মারা গিয়েছে ; ও জানতে পেরেছে অন্ত্যেষ্টির পর । দিল্লিতে একা থাকত, চব্বিশ ঘণ্টার এক চাকর ছিল দেখাশোনার জন্য, গাড়ি চালাবার জন্য, সে-ই শেষকৃত্য করেছে । প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের পুরো টাকা চিকিৎসা করাতে খরচ হয়ে গেছে ।
–মা কোথায় ?
–মায়ের সঙ্গে ফর্মাল ডিভোর্স তো হয়নি ।
–মুম্বাইতে তোমাদের কোয়ার্টারে ওনাকে যে দেখেছিলুম ?
–বাবা মারা গেলে যাতে ফ্যামিলি পেনশন পান তা নিশ্চিত করতে এসেছিলেন ।
–তোমার ছোটো ভাই কোথায় ?
–জানি না । মা-ও কোথায় থাকে জানি না ।
সুরিন্দর মারা যাবার পর ওর বাবার পাঠানো চিঠিগুলোর উদ্বেগের জের থেকে গেছে রাহুলের সঙ্গে, ফিকে বেদনাময় অপরাধবোধের মতন । ছিঁড়ে না ফেলে সুরিন্দরের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে ওর বাবাকে বিস্তারিত জানালে উনি আর দুই পরিবারের সদস্যরা হস্তক্ষেপ করে কিছু একটা বিহিত করতে পারতেন, সম্পর্কে ভেঙে পড়ার আগে এসে মধ্যস্হতা করতে পারতেন, ফরম্যাল ডিভোর্স করিয়ে পরিস্হিতিকে জটিলতা থেকে বাঁচাতে পারতেন। রাহুলকে অন্তত অপরাধবোধ থেকে মুক্তি দিতেন ।
সুরিন্দর কি জীবনে কিছু হয়ে উঠতে পেরেছিল ? হেরে যাওয়াটাও, বোধহয়, অনির্বাণ মৌলিকের মতনই, হয়ে
ওঠা। সুরিন্দরের বউই বা কি হয়ে উঠেছিল ? খান্না সাহেবের সঙ্গিনী ! অনির্বাণ মৌলিকের বউ কী হয়ে উঠেছিল ? গোপন প্রেমিকের মানসী ।
হয়ে ওঠা’ ! রাহুলের হয়ে ওঠা !
কী ? না, নোটের মুদ্দোফরাস ! মুদ্দোফরাস হিসাবে পার্সোনালিটি নির্মাণ । শ্মশানের ডোম লাশ পোড়ায়, আর রাহুল পোড়ায় টাকার লাশ, একটা-দুটো নয় শ্মশানের চেয়ে অনেক বেশি, লক্ষ-লক্ষ, দিনের পর দিন ।
সুযোগ পেতেই, মুদ্দোফরাসের চাকরি ছেড়ে পালিয়েছিল রাহুল । গ্রামীণ উন্নয়নের নতুন চাকরিতে, সারা ভারত চষে বেড়িয়েছে, সরকারি খরচে । তার আগে তো ও জানতোই না জোয়ার গাছ আর বাজরা গাছের তফাত, মুসুর ডাল লতা আর অড়রডাল ঝোপের তফাত, ওংগোল গরুর সঙ্গে থারাপারকর গরুর তফাত, কেন কিছু ছাগলের গলা লম্বা আবার কিছু ছাগলের গলা ব্যাপারটাই নেই, কত কি জানতো না ।
চাকরিটার জন্য, যারা ওর ইনটারভিউ নিয়েছিল, তারা বিশেষ কিছুই জিগ্যেস করেনি । কিন্তু ও যখন উঠে থ্যাংকস জানিয়ে পেছন ফিরেছে, ইনটারভিউ বোর্ডের চেয়ারম্যান ওকে বললেন, মিস্টার সিংহ, ওই কোনে যে ফুলদানি রাখা রয়েছে তা থেকে ধানের শিষটা তুলে এনে আমায় দিন । শুনেই, যাতে ওর মুখ যে শুকিয়ে গেল, তা ওনারা টের না পান, রাহুল দ্রুত পেছন ফিরে, এলিমিনেশান মেথড প্রয়োগ করল । বাড়িতে সরস্বতী পুজোয় যবের শিষ দরকার হতো, সেটা ও চেনে, গমের শিষ যে যবের শিষের মতন তা ও জানে, বাদবাকি শিষের মধ্যে দুটো বটল ক্লিনারের মতন দেখতে, অতএব সেদুটো জোয়ার-বাজরা-নাচনি হবে, ঘাসের চোরকাঁটা চেনে, কাশফুল চেনে । বাঁচল যেটা, সেটাই তাহলে ধানের । শিষটা তুলে ওনাদের দেবার এক মাসের ভেতর ওর চাকরির আর পোস্টিঙের চিঠি পেয়ে গিয়েছিল ।
পোস্টিঙের পরই, তখন রাহুলের বয়স, মমমমমমম, বোধহয় মমমম, থাকগে , সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, রাহুলকে বুন্দেলখন্ড অঞ্চল পর্যবেক্ষণ-ক্ষেত্রসমীক্ষা করে প্রতিবেদন লেখার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হল ইটাওয়া-জালাউন-ললিতপুর ইত্যাদি জেলাগুলো পরিদর্শনের জন্য । অফিসের রাজনীতির খেলায় নতুন, তাই প্রত্যন্ত অঞ্চলে, কৃষিজ্ঞান পরীক্ষা নেবার জন্য এবং সেই সঙ্গে অভিজ্ঞতা জড়ো করার জন্য পাঠানো হল ওকে, কেননা ওই অঞ্চলগুলোতে রাতে থাকার হোটেল, যানবাহন আর খাওয়া-দাওয়ার অভাব সহজেই কাবু করে ফ্যালে বাইরের লোকেদের।
ওর সৌভাগ্য যে ইটাওয়ার জেলা কৃষি আধিকারিক শার্দুল মীনাকে রাহুলের কোনো শুভানুধ্যায়ী, হবু অধস্তন অফিসার, ওর সম্পর্কে বিস্তারিত খবর পাঠিয়ে দিয়েছিল । কথা প্রসঙ্গে জানতে পারল কৃষি আধিকারিক রাহুলের স্নাতকোত্তর সহপাঠী অভিমন্যু মীনার বড় ভাই । কৃষি আধিকারিকের সরকারি বদান্যতায় জেলা সদরের আর ব্লকস্তরের অতিথিভবনগুলোয় রাতে থাকার, খাওয়ার, ব্যবস্হা হয়ে গেল । ঘোরাঘুরির সুবিধার জন্য উনি ওঁর বিভাগের বয়স্ক অভিজ্ঞ অফিসার সুগ্রিব নিমচকে সঙ্গে দিলেন । সরকারি জিপ ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে গেল রাহুল ।
তিনদিনের ক্ষেত্রসমীক্ষায় রাহুলের কর্ডুরয় প্যান্ট — পরে এই প্যান্ট ওর গুডলাক ট্রাউজার খেতাব পেয়েছিল –, ডোরাকাটা শার্ট, চোখের পাতা, মাথার আর ভুরুর চুল গেরুয়া ধুলোয়, এবং কাগজপত্র সংখ্যা ও তথ্যে ভরে উঠল । শুধু গেঞ্জি আর আণ্ডারওয়্যার বদলাতো, কেননা মাত্র চার দিনের ট্যুর বলে দুটো সেট শার্ট-প্যান্ট সঙ্গে নিয়েছিল ।
অঞ্চলটা, যেখানে ওর সহকর্মীরা আসতে চায় না, ওর মনে হল বর্ণনাতীত । পথের দুধারে গভীর ও সঙ্কীর্ণ গিরিখাতের শুকনো ও বিমূর্ত ভুলভুলাইয়ার প্রায় জনহীন বিস্তার ধুলো উড়িয়ে অধঃক্ষিপ্ত জলরাশির প্রত্যাশায় ভূতাত্বিক বৈচিত্র্যকে করে তুলেছে কূতূহলোদ্দীপক আর দূরভিসন্ধিপূর্ণ । দুপুরের আগেই দিগন্ত ঢেকে যায় গেরুয়া কুয়াশায় । এখানকার ফুল-ফল ও প্রাণীরা ছলনাময় । চারিদিকে থম মেরে মায়াময় অস্হিরতা । একটাই নদী বয়ে গেছে অঞ্চলে, যা উটের পিঠে বসে পারাপার করছে গ্রামবাসীরা ।
চতুর্থ দিন কিছুটা যাবার পর নিমচ একটা মন্দিরের কাছে জিপগাড়ি পার্ক করতে আদেশ দিয়ে ভেতরে ঢুকতে, রাহুলও নিমচের পিছু-পিছু ঢুকে কালী মন্দির দেখে অবাক হল । সাধারণত কয়েক ঘর বাঙালি যে জায়গায় থাকে সেখানে কালী মন্দির নজরে পড়ে । নিমচকে জিগ্যেস করতে সে জানালো যে মন্দিরটা সতেরো শতকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আতেরের মহারাজা বদন সিংহ, হয়তো আপনার পূর্বপুরুষ, আপনিও তো সিংহ ! রাহুল মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিল বায়বীয় আত্মীয়তা ।
নিমচ বলল, তিনি শক্তির উপাসক ছিলেন । এখানকার শক্তি-উপাসকরা, তা সে যে জাতেরই হোক না কেন, জরুরি কাজে যাবার আগে কালীমাকে প্রণাম করে যায়, আর সফল হলে পাঁঠা বলি দেয় । হাড়িকাঠে শুকনো রক্তের দাগ দেখে বিশ্বাস হল রাহুলের । কে জানে এরা নীলকমলের গ্রামের ছিন্নমস্তার মন্দিরে মোষ বলির পর রক্তমাখা নাচ নাচে কিনা ।
খালি-গায়ে পৈতে ঝোলানো পুরুত নিমচকে বলল, বাবাসাহেব কাছের এক গ্রামে এসেছেন । উত্তরে নিমচ বলল,
বহুদিন পর বাবাসাহেব নদীর এই পারে এলেন ।
রাহুল গলা নামিয়ে জানতে চাইল, বাবাসাহেব কি কোনো সাধুসন্ত ?
–জি হাঁ, পহুঁচে হুয়ে আদমি হ্যাঁয়, বলল নিমচ ।
অভিব্যক্তিটা বেশ মনের মতন মনে হল রাহুলের, ‘পৌঁছে-যাওয়া মানুষ’ । মানুষ তো মহাশূন্যে, চাঁদে, সমুদ্রের মেঝেয়, সর্বত্র পৌঁছে গেছে । সাধুরাও মেডিটেট করে পৌঁছে যায় হয়তো অভিষ্ট্য লক্ষ্যে । ওদের আন্দোলনের এক অপেরা-গায়ক , অবিনাশ ভট্টশালি, মামলা-মকদ্দমার সময়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল । পরে রাহুল জানতে পারে যে অবিনাশ কোনো ধর্মগুরুর দর্শনে প্রভাবিত হয়ে পৌঁছে গেছে আত্ম-উত্তরণের তৃপ্তিতে । সকলেই কোথাও না কোথাও পৌঁছে যায়, রাহুলের পৌঁছোনো হয় না । যাযাবার রয়ে গেল । চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়, অথচ পৌঁছোয় না ।
কাঁচা রাস্তায় জিপগাড়ি ছুটল, রাহুলের পোশাক ও ত্বকের রোমে ধুলোর আস্তরন সংগ্রহ করতে-করতে । কিছুটা যাবার পর লাল কাঁকরের পথের মাঝখানেই কয়েকজন গ্রামবাসী বসেছিল বলে ড্রাইভার জিপ থামাতে, তাদের একজন চালককে বলল, এই রাস্তাটা আগে গিয়ে খারাপ হয়ে গেছে, আপনারা পাশের গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে যান ।
বাতাসকে আরও ধূসর করে সাত-আট কিলোমিটার যাবার পর রাহুল দেখল একটা বিশাল বটগাছের তলায় প্রায় কুড়ি-পঁচিশজন গ্রামবাসী একজন তামাটে পেটমোটা মোড়লের সামনে বসে, সম্ভবত তার বাণী শুনছে । ‘আরে, বাবাসাহেব’ বলে, চালক সেই দিকে গাড়ি নিয়ে গিয়ে থামাল । নিমচকে নামতে দেখে রাহুলও নামল । উস্কোখুস্কো বাবরিচুল মোড়লের উর্ধাঙ্গে জামা বা গেঞ্জি নেই, কোমরে চাক-কাটা লুঙ্গি, কোঁচড়ে রাখা মুড়ি খাচ্ছে । মোড়ল বসে আছে গোবরলেপা মাটির উঁচু বেদির ওপর ।
মোড়লের কাছে গিয়ে নিমচ হাতজোড় করতে সে ওর হাতে একমুঠো মুড়ি নিজের কোঁচড় থেকে তুলে দিল । নিমচ তা হাতে নিয়ে এক গ্রাসে খেয়ে ফেলল । রাহুলকে ইঙ্গিত করে মোড়ল নিমচকে জিগ্যেস করল, ‘সরকার বাহাদুর?’
–জি হাঁ, নিমচের বিনয়ী প্রত্যুত্তর ।
মোড়ল রাহুলকে ডেকে বলল, সরকার বাহাদুর, তুম ভি লো, খাও । যেখানে-সেখানে যা পাওয়া যায় তা সাধারণত খায় না রাহুল, পেট খারাপ হবার ভয়ে । ও পকেট থেকে রুমাল বের করে মুড়িগুলো বেঁধে নিল, পরে সুযোগ বুঝে ফেলে দিতে পারবে । রাহুলের আচরণে প্রীত হয়ে মোড়ল ওকে আরও কাছে ডাকল । কাছে গেলে, মাথার ওপর হাত রেখে বলল, জিতে রহো ।
ওরা জিপগাড়িতে গিয়ে বসল । কিছুদূর যাবার পর নিমচ বলল, আপনি বুন্দেলখণ্ডের চম্বলঘাটিতে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারেন, কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করবে না, বাবার আশীর্বাদ পেলেন ।
রাহুল জানতে চাইল, ইনি কি এখানকার ধর্মগুরু ? পোশাক দেখে তো মনে হল বয়স্ক চাষি ।
নিমচ বলল, স্যার, উনি ডাকাত সরদার বাবা মুস্তাকিম ; সরকার ওনার মাথার দাম রেখেছে এক লক্ষ টাকা । যারা ওনার সামনে বসেছিল তারা ওনার দলের ডাকাত ।
ভাগ্যিস গুডলাক প্যান্টটা পরে এসেছিলুম, রাহুল নিজেকে নিঃশব্দে বলে আস্বস্ত বোধ করল । কতরকমের মানুষের আশীর্বাদ যে পেয়েছে জীবনে, যাদের আশীর্বাদ পাওয়া সহজ নয় । কিছুকাল পরে কাগজে পড়েছিল, উত্তরপ্রদেশের পুলিশ বাবা মুস্তকিমকে মেরে, রটিয়ে দিয়েছে যে ওর দলের লোকেরাই মেরেছে ওকে ; ওরা খবর পেয়েছিল যে বাবার কোঁচড়ে সবসময় শুধু মুড়ি থাকে না, তার তলায় থাকে লুকোনো টাকা । মেরে, কোঁচড়ের কয়েক লাখ টাকা মেরে দিয়ে, সরকার থেকে মুস্তকিমের মরা মাথার দামও গুনে নিয়েছে ।
এই প্যান্টটা পরেই অতগুলো শিষ থেকে ধানের শিষ বেছে ইনটারভিউতে সফল হয়েছিল ; ওর প্রতিযোগী তো কয়েক হাজার যুবক ছিল , তাদের অনেকেরই যোগ্যতা আর পড়াশুনা ওর চেয়ে ভালো, অথচ ওকে বেছে নেয়া হল ।
এই প্যান্টটা পরেই অঞ্জলির আলিঙ্গনে ঢুকেও বেরিয়ে আসতে পেরেছিল, নয়তো স্মাগলারের বউকে ধর্ষণ করার গ্লানিতে ভুগত সারাজীবন । স্মাগলারের বোষ্টুমি !
এই প্যান্টটা পরেই মুম্বাইয়ের সেনচুরি বাজারের কাছে দাউদ ইব্রাহিমের স্যাঙাতদের ফাটানো বোমা থেকে একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছিল রাহুল আর ওর স্ত্রী সুমনা ; অফিস থেকে ছেলের স্কুলে যাবার জন্য তাড়াতাড়ি বেরিয়েছিল, সেনচুরি বাজার পেরোবার পরই শুনতে পেল পেছনে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ, সেই সঙ্গে চিৎকার চেঁচামেচি । সেই বিস্ফোরণে সুমনাদের ‘লেডিজ ট্র্যাঙ্গল’ নামের গোষ্ঠী, যাতে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান মহিলারা ছিল, তা ভেঙে গিয়েছিল ।
ওদের গোষ্ঠীর সদস্যারা মুম্বাইয়ের তিনটি ধর্মস্হানে যেত প্রতি মাসে একবার । মঙ্গলবার প্রভাদেবীর সিদ্ধি বিনায়ক
মন্দিরে, বুধবারে মাহিম চার্চের নোভেনায় আর শুক্রবারে ভাটার সময়ে হাজি আলির মাজারে । বিস্ফোরণের পর, যে যার আবার জন্মসূত্রে-পাওয়া নিজের-নিজের সম্প্রদায়ের খোলশে ঢুকে পড়েছিল । সুমনার বন্ধুমহলও বদলে যেতে লাগল তার পর থেকে । তারা ওকে টেনে নিয়ে গেল রামকৃষ্ণ মঠে, দীক্ষা নেবার জন্য । দীক্ষা নিয়ে, দুবছর বেশ জপ-তপ করল, তারপর ছেড়ে দিল, উড়ু-উড়ু মন আর একঘেয়ে বসে থাকার ক্লান্তিতে । ধর্ম থেকে, ততদিনে রঙিন টিভির জগতে যে বিস্তার ঘটল, তাতে রওনা দিল । কল্পনার জগতে । ধর্মের কল্পনা জগতের চেয়ে টিভির কল্পনা জগত অনেক রঙিন ।
সুমনার দীক্ষা সমারোহ দেখার জন্য গিয়েছিল রাহুল । দেখল, যিনি ওকে দীক্ষা দিলেন, বেশ বুড়ো একজন গেরুয়াপোশাক, তিনি ওর মাথায় একজোড়া কাপড়ে-মোড়া বালা, যা নাকি সারদা দেবীর, তা ছোঁয়ালেন । রাহুলের মনে পড়ে গিয়েছিল ওর মকদ্দমার সময়ে পেশকারবাবুর টেবিলে রাখা লাল শালুতে আগাপাশতলা মোড়া একটা মোটা বই, যার ওপর হাত রেখে সাক্ষীরা সবাই সত্য কথা বলার শপথ নিত । সেই দুজন পুলিশ ইনফরমার, লিটল অপেরা সম্পাদক, যাদের ও সাক্ষ্যদানের আগে কোনো দিন দ্যাখেনি, তারাও বইটায় হাত রেখে শপথ নিয়েছিল । ওর বিরুদ্ধ-পক্ষের সাক্ষী প্রভাস চোঙদার, কামেশ্বর চোঙদার, প্রদীপন চাটুজ্জে, রক্তিম চাটুজ্জে, চঞ্চলকুমারও শপথ নিয়েছিল বইটায় হাত রেখে । যেদিন ওর মকদ্দমা শেষ হল, রাহুল জিগ্যেস করেছিল পেশকারবাবুকে যে লালশালুতে মোড়া ওটা কী বই ? পেশকারবাবু কেবল একখানা রহস্যময় হাসি একান থেকে ওকান ছড়িয়ে ওনার কয়েকটা সোনালি দাঁত দেখিয়েছিলেন ।
রাহুলের সেই কর্ডুরয় প্যান্টটা এখনও আছে, কখনও সেলাই বাড়িয়ে, কখনও সেলাই কমিয়ে, কোমরের চরিত্র যেমন-যেমন বদলেছে ।
এখন, সত্তরে পৌঁছে, স্মৃতি খুঁটে, যখন এমিলিয়া বনিয়ার মুখ, রাণোর মুখ, তহমিনা আপার মুখ, অঞ্জলির মুখ, সুরেখা রেড্ডির মুখ, মীরা ব্যানার্জির মুখ, ও, রাহুল, হুবহু মনে করতে পারেনা, এক-একটা ভাসা-ভাসা মুহূর্ত কেবল ভেসে ওঠে, এত কিছু পড়ে ফেলেছে, এত অভিজ্ঞতা জমিয়ে ফেলেছে, অতীতকে বানিয়ে ফেলা সহজ । বানিয়ে ফেলতে হয়, টুকরো টুকরো দিয়ে গড়ে, খাপচা-খাপচা । সুমিতাদি বলেছিলেন, তোর জীবনের সবকটা মেয়েকে এক নামে লীন করে ফ্যাল, আর সেই নামকে নিয়ে নতুন-নতুন অপেরা লেখ, আর হ্যাঁ, তাতে তোর সুমিতাদিকেও রাখিস কিন্তু, ভুলে যাসনি যেন । রাহুল নতুন নাম পেয়ে গেল, আচমকা, ভিলে পারলের মাছের বাজারে, যখন এক বাঙালি যুবতী ওকে বলে উঠল, স্যার, আপনিই তো রাহুল সিংহ, আমি আপনার লেখা পড়ি, বেশ ভালো লাগে আপনার প্রিডেটর ডটপেন ।
–প্রিডেটর ? হিমালয়ের তরাইয়ের সেই বাঘিনীকে মনে পড়ল রাহুলের ; তার পারফিউমে ঢাকা গন্ধ ।
–হ্যাঁ স্যার, বাংলায় তো প্রিডেটর অপেরা-লেখক আর কেউ নেই ।
–থ্যাংকস । তোমার নাম কি ?
–অবন্তিকা ।
যুবতীটি চলে যাবার পর বাড়ি ফিরে অবন্তিকাকে নিয়ে অপেরা লেখা আরম্ভ করেছিল রাহুল । প্রথম যে অপেরা লিখেছিল, ‘ব্লাড লিরিক’ শিরোনামে, মনে আছে আজও :
অবন্তিকা, তোর খোঁজে মাঝরাতে বাড়ি সার্চ হল
এর মতো ওর মতো তার মতো কারো মতো নয়
যেন এমন যেন অমন যেন তেমন নয়
কী করেছি কবিতার জন্য আগ্নেয়গিরিতে নেমে ?
একি একি ! কী বেরোচ্ছে বাড়ি সার্চ করে
কবিতায় ? বাবার আলমারি ভেঙে ব্রোমাইড সেপিয়া খুকিরা
কবিতায় । হাতুড়ির বাড়ি মেরে মায়ের তোরঙ্গে ছেঁড়া বিয়ের সুগন্ধী বেনারসি
কবিতায় । সিজার লিস্টে শ্বাস নথি করা আছে
কবিতায় । কী বেরোলো ? কী বেরোলো ? দেখান দেখান
কবিতায় । ছি ছি ছি ছি, যুবতীর আধচাটা যুবা ! মরো তুমি মরো
কবিতায় । সমুদ্রের নীলগোছা ঢেউ চিরে হাড়মাস চিবোচ্ছে হাঙর
কবিতায় । পাকানো ক্ষুদ্রান্ত্র খুলে এবি নেগেটিভ সূর্য
কবিতায় । অস্হিরতা ধরে রাখা পদচিহ্ণে দমবন্ধ গতি
কবিতায় । লকআপে পেচ্ছাপে ভাসছে কচি বেশ্যা-দেখা আলো
কবিতায় । বোলতার কাঁটাপায়ে সরিষা-ফুলের বীর্যরেণু
কবিতায় । নুনে-সাদা ফাটা মাঠে মেটেল ল্যাঙোট ভুখা চাষি
কবিতায় । লাশভূক শকুনের পচারক্ত কিংখাবি গলার পালকে
কবিতায় । কুঁদুলে গুমোট ভিড়ে চটা-ওঠা ভ্যাপসা শতক
কবিতায় । হাড়িকাঠে ধী-সত্তার কালো-কালো মড়া চিৎকার
কবিতায় । মরো তুমি মরো তুমি মরলে না কেন
কবিতায় । মুখে আগুন মুখে আগুন মুখে আগুন হোক
কবিতায় । মরো তুমি মরো তুমি মরো তুমি মরো তুমি মরো
কবিতায় । এর মতো ওর মতো তার মতো কারো মতো নয়
কবিতায় । যেন এমন যেন অমন যেন তেমন নয়
কবিতায় , অবন্তিকা তোর খোঁজে সার্চ হল, তোকে কই নিয়ে গেল না তো !!
একজন মানুষকে, নিজেকে যে কিছু-একটা হয়ে উঠতে হয়, সে যে একজন সাবজেক্ট, সাবজেক্টের বিপরীতে যে অবজেক্ট জগৎসংসার, এ-সমস্ত ভাবনাচিন্তা, রাহুল যে পরিবারে, পাড়ায় আর পরিবেশে ছোটোবেলায় কাটিয়েছে, সেখানকার লোকেদের ছিল না । ছোটোবেলায়, আর তার পরেও অনেককাল পর্যন্ত ও জানত যে একজন মানুষের নানারকম প্রয়োজন মেটাবার দরকার হয়, আর সে-সব প্রয়োজন মেটাবার জন্য তাকে নানা উপায়-ফন্দিফিকির খুঁজতে হয় । এই কাজটা তার জীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ । এর বাইরে, লোকটাকে নিজেকেই কিছু একটা হয়ে উঠতে হবে, সেরকম ধ্যানধারণা বা শিক্ষা, রাহুলের বাবা-জ্যাঠামশায়ের বা প্রতিবেশীদের কারোর কাছ থেকে পায়নি । কিছু জিনিসপত্র পেলে ভালো হয়, অমুক কাজটা বড়ো হয়ে করতে পারলে ভালো হয়, এমন ইচ্ছে পেয়ে বসত বটে পারিবারিক টানাপোড়েনের কারণে ।
চেতনা একটা নির্মিত ব্যাপার, একটা কন্সট্রাক্ট । কেউ যদি জীবনে কিছু একটা হবার আকাঙ্খা পোষণ করে তো ওটা নির্মিত, ওটা কন্সট্রাক্টেড ; অবজেকটিভ জগতটি দ্বারা নির্মিত । কিন্তু যে বাস্তবতাকে একজন লোক প্রত্যক্ষ করছে, রাহুল করছে, সেটিও কোনো না কোনো মাধ্যম আশ্রয় করেই পৌঁছোচ্ছে । ভাষার মাধ্যমে, অবধারণার মাধ্যমে, বস্তুনামের মাধ্যমে, চিহ্ণ বা ছবির মাধ্যমে । মাধ্যমের দ্বারা নির্মিত, কন্সট্রাক্টেড । রাহুলের হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা, তার মানে, মাধ্যম ছাড়া সম্ভব নয় । যেহেতু নির্মিত, তাই অবিরাম নির্মিত হতে থাকে । যা অবিরাম পরিবর্তিত হয়ে চলেছে, তার আবার হয়ে ওঠে কেমনতরো ! কেউ কি প্রিডেটর হয়ে ওঠে ?
অঞ্জলির গল্পের মতন । অশান্তি সৃষ্টি করে উধাও হয়ে যাবার কাহিনি । রাহুল বলল, তোর বর কি স্মাগলার হয়ে উঠেছে ? তুই কি স্মাগলারের বোষ্টুমি হয়ে উঠেছিস ?
পার্স দেবার জন্য আলমারি খোলার সময় রাহুলকে তিনটে সোনার বিস্কুট দেখিয়েছিল অঞ্জলি, বেশ ভারি ; বলেছিল সাত ভরির হয় এগুলো । সোনা ! সোনার বিস্কুট দেখে গলায় শ্লেষ্মা জমে গিয়েছিল রাহুলের । হাতে তুলে নিলেও, তাড়াতাড়ি ফেরত দিয়েছিল । হয়ত গিলে ফেলে, পরে গু থেকে বের করেছে এরা । ধুলেও, গু-এর মাইক্রোবস কি সহজে যায়, তাও স্মাগলারের গু । কিংবা অঞ্জলির গু-ও হতে পারে । গু থেকে বের করা সোনা দিয়ে হয়তো কারোর বিয়ের আংটি তৈরি হবে । প্রাক্তন প্রেমিকার গু থেকে পাওয়া সোনা গলিয়ে বিয়ের আংটি !
–আঙুলের ছাপের ভয় পাচ্ছিস ? কানপুরের বাড়িতে, বাথরুমে, শাওয়ারের তলায় তো তিন লক্ষ শিশু আমার স্তনমণ্ডলির দিকে উড়িয়ে যাবি বলেছিলি, অথচ আজ ওড়াতে পারলি না, তাদের কয়েকটার স্বপ্ন কি আর আমার নাইটি
ধরে ঝুলছে না ভাবছিস ! তুই সেরকমই থেকে গেলি, নাইভ, ইররেসপনসিবল, উচ্চাকাঙ্খাহীন, ম্যাদামারা, লক্ষ্মীটি-মার্কা, বেসিকালি কাওয়ার্ড । হয়ে উঠতে চাস না ।
— রাতটা থেকে যাব ? এখান থেকেই ট্রেনিং সেন্টারে চলে যাব সকালে ? তোর সঙ্গে জাস্ট একটু সময় কাটিয়ে
নেয়া । নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য কয়েকটা মিথ্যা কথা বলে ফেলল রাহুল ।
জড়াজড়ি করতে চেয়েছিলিস, পেয়েছিস । আমি চেয়েছিলাম, পেলাম না । বারবার চাইবার কী আছে ? লোকে ঘরকুনো হয়, তুই মনকুনো । কুঁকড়ে ল্যাজ গুটিয়ে পিছিয়ে গিয়ে, আবার চাই চাই চাই চাই করাটা বাচ্চাদের মানায় ; তুই তো এখন একটা লোক । ইম্যাজিন ? লোক ! এ কাওয়ার্ড জেনটলম্যান, প্রোব্যাবলি উইথ ডিসফাংকশানাল সেক্স ।
–তুই কিন্তু আমায় একজন নতুন নারীকে পাইয়ে দিলি ।
–নতুন নারী ? নারী ? কীরকম শুনি । নারী শব্দটা কেমন যেন নোংরা মনে হয় । নারী শুনলেই চোখের সামনে একজন উলঙ্গ পেটমোটা ভারিবুক ভারিপাছা মাগির ছবি ভেসে ওঠে । এনিওয়ে, বল..
–জীবনানন্দ দাশের নাম শুনেছিস তো ?
–ওই বনলতা সেনের কবি ? পড়িনি, শুনেছি ।
–হ্যাঁ । বনলতা সেন কেবল জীবনানন্দেরই ছিল । সতীসাধ্বী, টাচ-মি-নট, ওয়ান-ম্যান-উওম্যান ।
–আমার লেখার নারী…..
–জানি, শি ইজ আ বিচ ! ইয়েস, আই নো হু আই অ্যাম ।
–হ্যাঁ, আমার লেখার নারী সতীসাধ্বী নয়, ওয়ান-ম্যান-উওম্যান নয়, সে পাঠকের সঙ্গেও শুতে পারে, আলোচকের সঙ্গেও ওয়ান নাইট স্ট্যান্ডে রাত কাটাতে পারে, সে স্মাগলারের বোষ্টুমি হতে পারে, নিজের শরীরকে নিয়ে যা ইচ্ছে করতে পারে, সে সম্পূর্ণ স্বাধীন ।
–কারেক্ট, আমি এরকমই । প্রশ্ন হল যে তুই সেরকম নারী চাস কিনা ।
–কে বলল তুই আমার অপেরার নারী ? আমার কল্পনাকে জবরদখল করার চেষ্টা করছিস তুই । আমি আমার অক্ষরের নারীকে বলব না, ওইখানে যেওনাকো তুমি, বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে ।
–সেটাই তো হওয়া উচিত । জীবনানন্দের বনলতা সেন কি ওনার স্লেভগার্ল ছিলেন ? কবিরা নিজেদের কবিতায় এরকম স্লেভগার্ল পুষতে চায় কেন বলতো ? হিংসুটে ছিল লোকটা । প্রেমের কবিগুলো এরকম হিংসুটে হয় কেন ? প্যাট্রিয়ার্কাল? শেকসপিয়ার তাই ওনার বয়ফ্রেণ্ডকে নিয়ে সনেট লিখেছেন । পণ্ডিচেরিতে, আই মিন আশ্রমের গেস্টহাউসে, একটা কাপল ছিল, পুরুষ কাপল ।
–তোকে খুঁজে পেয়ে আমি রিডিফাইন করতে পারলুম আমার অক্ষরের নারীকে । আমার পাঠকদের, যে পাঠকই পড়বে, , তার বিছানায় আমার কল্পনার নারীকে ছেড়ে দেব ।
–নো প্রবলেম, এনি ডে । লেখিকাদেরও উচিত তাদের কল্পনার পুরুষদের অমন স্বাধীনতা দেয়া । অবশ্য পুরুষগুলোকে স্বাধীনতা দেবার দরকার হয় না, ওরা জন্মগতভাবে লেচার, তোর মতন ।
অঞ্জলির এই সান্নিধ্যের রেশ রাহুলের কলমে সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছিল, বিশেষ করে একটা লেখায়, আর সেই রচনাটার জন্যই ওকে নিয়ে টানাটানি হয়েছিল ; ওর কয়েকজন বন্ধুও বিপদে পড়েছিল, এমনকি দাদা অনিকেত, যিনি প্রকাশক ছিলেন, তিনিও । লেখাটা কিন্তু ছিল অত্যন্ত কুল ক্যালকুলেটেড একটা রচনা , সাপের ঠান্ডা রক্ত কলমে ভরে লেখা, আদ্যন্ত নিরীক্ষামূলক । প্রায় একমাস ধরে শব্দ খুঁজে, বাক্য গঠন করে, লিখেছিল । চেয়েছিল বাংলা ভাষায় ভিন্ন সংবেদের প্রসারণ, চেয়েছিল তৈরি-কথার ছবিতে স্পিড বা গতি আনতে, একটা লাইন থেকে আরেকটা লাইনকে, এই সমাজের মানুষগুলোর মতনই, আলাদা ব্যক্তিত্বের ছবি পরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিল।
অঞ্জলির বাড়ি থেকে রাহুল ট্রেনি হোস্টেলে ফিরতে পারেনি, ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটে পুলিশ ব্যারিকেডের জন্য । মিছিল থামাবার জন্য ব্যারিকেড । ডালহাউসি চার ধার থেকে বন্ধ । বাস পোড়ানো হয়েছে, শুনল । অমর বসু, রাম চ্যাটার্জি, চিত্ত বসু, মাখন পাল, মোহিত মৈত্রদের নাকি লাঠিপেটা করা হয়েছে । পেছনের স্ট্র্যান্ড রোড দিয়ে হাওড়ায় পৌঁছে শেওড়াফুলির লোকাল ট্রেন ধরল, ঠাকুমার আশ্রয়ে রাতটা কাটাবার জন্য । প্রচুর গল্প আছে সবাকসুন্দরীর স্টকে, সেকালের কলকাতার বাবু-বিবিদের কেচ্ছা ।
বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে ক্রিয়েটিভ লেখালিখি । ব্যাপারটা অদ্ভুত । লেখালিখি নিয়ে ব্যবসা করলে তা হয়ত হয় না, ব্যবসাদার-ব্যবসাদার ভাই-ভাই পরিবেশ থাকে, ব্যবসাদারি লাভের প্রতিযোগীতা থাকে ।
ক্রিয়েটিভ লেখালিখি, এমনকি অমন লেখালিখির পত্রিকা সম্পাদনা করলেও, বন্ধুদের শত্রু করে তুলতে পারে । ওর লেখালিখির জন্য যাদের বিরুদ্ধে গ্রেপতারি পরোয়ানা বেরিয়েছিল, তারা সকলেই ওর শত্রুতে রূপান্তরিত ,
কেউ-কেউ তখনই, কেউ আবার পরে, কেউ অনেক পরে যখন চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে ।
লালবাজারে অনিল ব্যানার্জি নামের ইন্সপেক্টার, যে পরে নকশাল খতমকারী হিসাবে সরকারি যশ পেয়েছিল, তার জেরায়, রাহুলের সামনেই, কেঁদে ফেলেছিল প্রভাস চোঙদার বা জুনিয়ার চোঙদার আর কামেশ্বর চোঙদার বা সিনিয়র চোঙদার। দু’জনে চুপচাপ যে মুচলেকা লিখে দিয়েছে, আন্দোলনের বিরুদ্ধতা করেছে , আন্দোলনের মতের বিরোধী , তা লিখে জানিয়েছে, তা তো বহুকাল পরে, ওকে যখন চার্জশিট দেয়া হল, তখন জানতে পেরেছিল রাহুল । রাহুলের উষ্মার বিষে ওরা রূপান্তরিত হল যদুবংশের মিথ্যাবাদি চোঙদারে ।
রাহুলের যে আগাম সন্দেহ হয়নি তা নয় ; একদিন লালবাজার থেকে, ভবদেব মিত্র আর ওর বন্ধুনি রোশনির সঙ্গে হাওড়া স্টেশানে গিয়ে সিনিয়ার চোঙদারকে দেখতে পেয়ে হাত তুলে নামধরে চেঁচিয়েছিল ; ওকে দেখতে পেয়ে কামেশ্বর চোঙদার দৌড়ে গিয়ে, উঠে পড়ল, প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যাচ্ছে যে ট্রেনটা, তাতে । ভবদেব আর রোশনির আগ্রহে রাহুল সেদিন তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চের ওপর দাড়িয়ে সেই লেখাটাই পড়েছিল, যেটা নিয়ে মকদ্দমা চলছিল । কত লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিল, কী ঘটছে দেখার জন্য, কেউ-কেউ হয়তো বক্তৃতা শোনার জন্য । তার আগে ভবদেব ঘড়ির তলায় দাঁড়িয়ে নিজের ‘হত্যাকাণ্ড’ নামের লেখাটা পড়েছিল । এখন, প্রায় পাঁচ দশক পর, হাওড়া স্টেশানে পা ফেলার জায়গা নেই, কারোর সময় নেই অন্যদিকে তাকাবার, সকলেই দৌড়োচ্ছে, যাচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে । কত ফাঁকা থাকত তখনকার দিনের হাওড়া স্টেশান ।
শেয়ালদা ফাঁকা থাকত না ; সেখানে তখন অসহায় রিফিউজিদের ক্রুদ্ধ সংসারের ধ্বংসাবশেষ ।
যদুবংশের চোঙদার শুনে হরিচরণ খাঁড়ার, না, সেসময়ে নয়, প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে, রাহুলের ওপর গোঁসা উথলে উঠেছিল । সেসময়ে তো ও চোঙদারদের ওপর খাপ্পা, ওদের অপেরায় ওকে কোনো ভূমিকা দেয়া হয়নি বলে।
রাহুলদের আন্দোলনকে টিটকিরি মেরে, একটা ফিলমে, নামকরা পরিচালক, আন্দোলনের অপেরা-নটের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ; সেই ফিলমে কয়েকজন আন্দোলনকারীর নাম নায়ক উচ্চারণ করলেও, হরিচরণের নামটা করেনি , ফিলমের লেখক নির্ণয় নিতে পারেননি যে তিনি হরিচরণ খাঁড়ার নাম উল্লেখ করবেন না কি দুর্গা বর্মণের । হরিচরণের ধারণা দেড় হাজার মাইল দূর থেকে রাহুলের কলকাঠি নাড়ায় ওর নাম বাদ গেছে । রাহুল তো একে-তাকে বাদ দেবার যে প্রথা আগেকার নট্ট কোম্পানিরা পত্তন করেছিল সেই প্রথাকেই বর্জন করতে চেয়েছিল।
যখন রাহুলের লেখাটা নিয়ে বিচার চলছিল, আর রাহুলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে কাঠগড়ায় উঠেছিল জুনিয়ার চোঙদার, রাহুলের পেছনের গরাদের খাঁচার ভেতর থেকে একজন বিপজ্জনক আসামি ওকে বলেছিল, ‘তুমহারে ধন্দে কা আদমি তুমহারে খিলাফ গবাহি দে রহা হ্যায় ? ছোড়না মত । ভুন দেনা সালোঁকো । কাহাঁসে পকড়কে লায়ে থে ইন চুতিয়োঁকো তুমহারে ধন্দে মেঁ !’
জামিনে ছাড়া ছিল বলে রাহুল দাঁড়াত লোহার গরাদের খাঁচায় পিঠ ঠেকিয়ে, আর পেছনের দরোজা দিয়ে ঢুকত বিপজ্জনক আসামিরা, যারা জামিন পায়নি, ডাকাতি খুন ইত্যাদির অপরাধে আটক । ওর মামলা নিয়ে প্রায়ই মন্তব্য শুনত খাঁচার ভেতর থেকে, কর্কশ কোনো উত্তেজিত কন্ঠের । রাহুলের উদাসীনতার ব্যাখ্যা বোধহয় খুঁজে পেতো না তারা ।
ধান্দা !
লেখালিখি, শেষ পর্যন্ত, সত্যিই ধান্দা হয়ে গেল ! পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এরকম সন্দেহে আক্রান্ত হয়েছে রাহুল সিংহ। ক্রিয়েটিভিটি কি ধান্দাবাজি ? তাহলে দূরত্ব তৈরি করে তা বজায় রাখাটাই এখন প্রধান কাজ । ধান্দা থেকে দূরে। সম্বর্ধনা পুরস্কার ইত্যাদি যাবতীয় জমঘট থেকে ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে, একক অস্তিত্ব নিয়ে, নিজের নির্জনতাকে আগলে ।
কানপুরের ফৌজদারি আদালত জামিন দিয়ে হুকুম দিয়েছিল কলকাতায় গিয়ে ম্যাজিসট্রেটের সামনে সারেনডার করতে । সারেনডার মানে যে ফৌজদারি আদালতের প্রথম ম্যাজিস্ট্রেটের ঘরে উকিল-মুহুরি-অপরাধীদের গিজগজে, পা রাখার জায়গা নেই এমন ঠাসাঠাসি ঘেমো ভিড়, সে ধারণা ছিল না রাহুলের ; উকিল দরকার ।
পিসেমশায় ওনার বড় ছেলে দুর্জয়, মানে ,ঝন্টুর মাধ্যমে খবর পাঠিয়েছেন যে ওনার একজন পরিচিত উকিল আছে । ফৌজদারি আদালত-বাড়িটা যে এরকম ভুলভুলাইয়া, বাড়িটার বিভিন্ন ঘরে ছড়ানো তেরো-চোদ্দোটা এজলাস, তা এক নম্বর এজলাসের প্রধান বিচারক রাহুল-অনিকেতকে জামিন দিয়ে, বিচার প্রার্থনার জন্য নয় নম্বর এজলাসের
চশমাচোখ বিচারকের কাছে না পাঠালে, পোড়ো হাভেলির ভাঙা দরোজাগুলো মেলাতে পারত না রাহুল । পরে, বামপন্হীরা মসনদে বসার পর যখন ওনাদের এদিক-ওদিকে তাকাবার ফুরসত হল, বাড়িটার হাল ফিরিয়েছে ।
সে-সময়ে, যখন রাহুলের বিচার চলছিল, বাড়িটা ছিল নরকের কলকাতিয়া ভার্সান । বহু বামপন্হী নেতাকে আসতে
হতো আদালতটায়, যখন তারা বিরোধী পক্ষে ছিল । মসনদে বসার পর সারিয়ে , ওপরতলাটা তাদের প্রিয় লালরঙে রাঙিয়ে, পুরো না হলেও, অনেকটা ভোল পালটিয়ে দিয়েছে ।
কলকাতায় মাথা গোঁজবার ঠাঁই বলতে পিসেমশায়ের বাড়ি । তিন মেয়ে আর ছয় ছেলে নিয়ে একটা ছোট্টো ঘরে থাকেন উনি, খাটের তলাতে শুতে হয় ওনার বাড়ি গেলে, সকাল থেকে হাগবার লাইন লাগে, গামছা পরে স্নান করতে হয় চৌবাচ্চার ধারে দুতিনজন মিলে । অবিরাম জল পড়ে-পড়ে চৌবাচ্চার চারপাশ এমনই পেছলা যে এক হাতে চৌবাচ্চার পাড় আঁকড়ে, আরেক হাতে ঘটি নিয়ে স্নান ।
পিসেমশায় অনিকেত-রাহুলের গ্রেপ্তার হবার খবর পেতেই জানিয়ে এসেছিলেন নিজের শাশুড়িকে, মানে, রাহু-কেতুর ঠাকুমা সবাকসুন্দরী দেবীকে । তাঁর প্রিয় নাতি কেতুর গ্রেপ্তারের সংবাদে ঠাকুমা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হলেন । কলেজে পড়ার সময়ে কেতু তাঁর সঙ্গেই থাকত, শ্যাওড়াফুলির ভেঙে-পড়া জমিদারবাড়িতে, চিলেকোঠার ঘরে । হার্ট অ্যাটাকের তৃতীয় দিনে মারা গেলেন । উনি মারা যেতে কানপুর থেকে বাবা-জ্যাঠা-কাকারা সবাই জড়ো হলেন শেওড়াফুলির খণ্ডহরে ।
ভাগ্যিস ঠাকুমাকে আগেই লেখাটা পড়ে শুনিয়ে ছিল রাহুল । খালি গায়ে, কোমরে গামছা ঝুলিয়ে, মুখময় ফিকফিকে হাসি মাখিয়ে, শুনেছিলেন ঠাকুমা । শুনে জানতে চেয়েছিলেন, এটা তোর মোচরমান মেয়েটা তো নয়, এ আবার কারা-কারা, বলিসনিতো ; অমন শক্ত-শক্ত কথা লিখিছিস, তা লোকে পড়ে বুঝতে পারবে তো ?
–লোকে বলেছে অশ্লীল ।
–তার মানে ?
–নোংরা-নোংরা ।
–তা নোংরা ব্যাপারটা কি ব্যাটাছেলেদের একচেটিয়া ?
অনিকেত আর ও গ্রেপ্তার হতে, বাবা-কাকা-জ্যাঠা আর মা-কাকিমা-জেঠিমা সবাইকে শোনাতে হয়েছে । সকলেই জানতে চেয়েছেন এরা কারা-কারা, কখন ভাব-ভালোবাসা করলি এতজনের সঙ্গে, ইশকুলের না কলেজের, না ওই সুমিতার দলের ? ঠিক জানি সুমিতাই লেলিয়ে দিয়েছে ওর দলের কয়েকটাকে, না রে ? একে নিজে সুন্দুরি, তায় আবার সুন্দুরি মেয়েদের মোচ্ছোব । সবকটা মেয়েই কি বেমমো ?
বড়-জ্যাঠা বললেন, মা মারা গেল বলে তোরা নিজেদের দায়ি করিসনি । আমাদের পরিবারে সেই সুলতানি আমল থেকে প্রত্যেকটা প্রজন্মে কেউ না কেউ গ্রেপ্তার হয়, মামলা হয়, ভোগান্তি হয় ; আমি গ্রেপ্তার হয়েছিলুম, আমার কাকা গ্রেপ্তার হয়েছিল, আমার দাদুর ভাই গ্রেপ্তার হয়েছিল । বড়-জ্যাঠার কথাগুলো, অনেককাল পর, যখন ওর ভাইপো, অনিকেতের বড় ছেলে গ্রেপ্তার হল, তখন মনে পড়ে গিয়েছিল । বংশের রক্তেই তো শাসক-বিরোধিতা ।
ন্যাড়া শুধু বড় জ্যাঠা হয়েছিলেন । অন্য ভাইদের বলেছিলেন, তোদের আর বুড়ো বয়সে খোট্টাদের মতন সবাই মিলে ন্যাড়া হবার দরকার নেই ; রাহু-কেতুর মামলায় কোর্টে কি ন্যাড়ার দল যাবে ?
সবাকসুন্দরী দেবী আগাম না জানিয়ে মারা যাওয়ায়, রাহুলের বাবার মুখ গোমড়া । হেস্তনেস্ত করা হল না । খণ্ডহরের ট্যাক্স, দাদু মারা যাবার পর থেকে দিয়ে এসেছেন বাবা । ঠাকুমা মারা যেতে, ঘোষণা করে দিলেন, শোকসভাতেই, যে, আর উনি ট্যাক্স দেবেন না, এই পোড়ো-বাড়ি সম্পর্কে ওনার কোনো আগ্রহ নেই । ‘’যে জমিটা কোতরঙে মার নামে কিনেছিলুম, মা না জানিয়ে ওটা বিশেকে লিখে দিলে, ভেবেছিলুম বুড়ো বয়সে দেশে ফিরে থাকব, তা আর হল না ।’’ বিশে সবচেয়ে ছোটো ভাইয়ের নাম । নিঃসন্তান বিশে, পরে, সে জমি লিখে দিয়েছিল নিজের শালার মেয়ের নামে । শালার মেয়ে সে জমি বেচে দিয়ে, বিশে আর বিশের বউকে নিয়ে চলে গেছে কোন্নোগর।
শোকসভায় বিশে আর বিশের বউ অনুপস্হিত । ছোটোকাকা বিশেখুড়ো, ছেলেপুলে হয়নি বলে, শালার মেয়েকে পুষ্যি নিয়েছিলেন । যৌবনে বেশ যৌনরোমান্টিক ছিলেন রাহু-কেতুর বিশেখুড়ো । সবাকসুন্দরী দেবীকে দিয়ে জমি লিখিয়ে নেবার পর, যখন কানপুর ছেড়ে হঠাৎ কোতরঙে চলে গেলেন, তখন ওনার বাক্স-প্যাঁটরা সবই পড়েছিল ওনার কানপুরের ঘরে, বহু বছর, হয়তো কখনও আসবেন, এই আশায় তাতে কেউ হাত দেয়নি । কলকাতার পুলিশ রাহুকেতুর মা-বাবার আলমারি-তোরঙ্গ ভাঙার সময় ভাগ্যিস বিশেখুড়োর বন্ধ ঘরে রাখা ওনার জিনিসপত্রে হাত দেয়নি । দিলে,
ওনার তোরঙ্গের তালা ভাঙলে, যা বেরোতো তা ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়ত ।
কানপুরের বাড়ির পুরোনো জিনিসপত্র বিক্রি করার নির্নয় নেয়া হলে, বিশেখুড়োর জঙধরা তোরঙ্গ ভাঙার পর,
পুরোনো জামা-কাপড়ের তলায় পাওয়া গিয়েছিল একটা পেটমোটা ফোটো-অ্যালবাম । অজস্র শাদা-কালো ফোটো, সবই
বিশেখুড়োর বউয়ের, নানা আঙ্গিকে, সম্পূর্ণ নগ্ন । আদর্শ নগরের বাড়ি যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন, বিশেখুড়ো আর ওনার বউ ঝিমলিকাকিমা, থাকত নির্মীয়মান বাড়িতে, দুজনে মিলে রাজমিস্ত্রি-ছুতোরদের কাজ তদারক করার জন্য । রাতে, ফ্ল্যাশলাইটে, সেই বাড়িতে, পঁচিশ বছর বয়সী ঝিমলি-বউয়ের ফোটো তুলত বিশেখুড়ো । বিশেখুড়োর কল্পনার অপ্সরাদের নগ্ন প্রতিমা বিশেখুড়োর বউয়ের নানা আঙ্গিকে ধরে রাখা । গ্রিক দেবীদের মতন, বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা তেলরঙা নিউডের মতন অ্যান্টিক সোফায় আধ-শোয়া, গায়ে রবারের কালো সাপ জড়ানো ইভ বাঁহাতে আপেল ধরে আছে । কল্পনাকে যতটা অবাস্তব করে তোলা যায় ।
দুর্জয় ওরফে ঝন্টুদা ফোটোগুলো দেখতে পেয়ে, বলেছিল, চল বাইরে নিয়ে গিয়ে জ্বালিয়ে ফেলতে হবে । বাড়ির লোকেরা জানলে কেলেঙ্কারি ; বাইরের লোকেরা টুকরো-টাকরা দেখলেও টের পাবেনা ।
—জ্বালাবে তো ছিঁড়ে জ্বালিয়ে ফেলো, একটা-একটা করে অতক্ষণ কী দেখছ ?
–দেখছি, অমন সুন্দরী ছিল তো বাচ্চা হল না কেন । তুই রাজকাপুর-নার্গিসের ফিলিম দেখেছিস ?
–বরসাত দেখেছি ।
–ঝিমলিমামি হুবহু নার্গিস ।
–দেখা তো হয়ে গেছে, এবার ছিঁড়ে জ্বালিয়ে ফেল ।
–শালা, আগে যদি এগুলো পেতুম তো বিশেমামাকে ব্ল্যাকমেল করে দিদিমার জমিটা আমার নামে লিখিয়ে নিতুম।
–যাকগে, এবার নষ্ট করে ফেল ।
–করছি, করছি, একটা রেখে নিলুম, যদি কখনও ব্ল্যাকমেল করার চান্স পাই, বলা তো যায় না ।
ঝণ্টুদা একটা রেখে বাকিগুলো ছিঁড়ে জ্বালিয়ে নষ্ট করে ফেলেছিল ।
পিসেমশায় ওনার বড় ছেলে দুর্জয় ওরফে ঝন্টুকে নিয়ে অনিকেত-রাহুলদের সঙ্গে গেলেন ওনার পরিচিত ফৌজদারি উকিলের বাড়ি । উকিলের বাবাও উকিল ছিলেন, তাঁর বাবাও উকিল ছিলেন । বাড়িতেই ওনার বিশাল অফিসঘর, চারিদিকে কাচের আলমারিতে ঠাসা মোটা-মোটা আইনের বই, সোনালি আর রুপোলি অক্ষরের কোমরবন্ধ-পরা । উকিলবাবুর পশার নিশ্চয়ই ভালো । চেয়ারে, বেঞ্চে, নানা কিসিমের মানুষ-মানুষী । মেঝেতেও দেয়ালে ঠেসান-দিয়ে বসে আছে বেশ কয়েকজন ওথলাবুক-যুবতী আর ক্লান্ত পৌঢ়া, যাদের পোশাক দেখে গরিব বলে মনে হল রাহুলের ।
উকিলমশায়ের চশমাচোখ নির্দেশে ওরা বসল ওনার বিশাল টেবিলের ডানধারে । কনুইয়ের খোঁচা মেরে ঝন্টুদা রাহুলকে ইশারা করছিল জানালার বাইরে কারোর দিকে । রাহুল বিরক্ত হচ্ছিল তাতে । অনিকেত গম্ভীর ।
পিসেমশায়কে মুখ তুলে দেখতে পেলেন উকিলমশায়, বললেন, কী হল পাঁচকড়ি, আবার তোমার ছেলে কুকম্ম করতে গিয়ে ধরা পড়েছে ? আগেই বলেছিলাম যে বিয়ের বয়স হতে চলল, দিয়ে দাও, এই বয়সে শরীর ছোঁক-ছোঁক করবেই ।
পিসেমশায় কোনো চটপট জবাব দিচ্ছেন না দেখে উকিলমশায় বললেন, কী হল, তোমায় ধরেছে নাকি ? তোমাকে তো সব্বাই চেনে এ-পাড়ায় ; আমি তো বলেও দিয়েছি যাতে তোমাকে অযথা হেনস্হা না করে ।
ঝন্টু বলল, জেঠু, কেসটা আমার মামাতো ভাইদের । ওরা ওই অপেরা-টপেরা লেখালিখি করে তো, লালবাজারে আলিপুর-বালিগঞ্জের বড়োবড়ো-বাঙালিরা নালিশ ঠুকেছে ওদের লেখার বিরুদ্ধে । ওরা অ্যারেস্ট হয়েছিল, জামিনে ছাড়া পেয়ে কলকাতার ফৌজদারি আদালতে সারেনডার করতে এয়েচে ।
–আরে সরকারের বিরুদ্ধে আর লেখা কেন ? দেশ তো স্বাধীন হয়ে গেছে । প্রফুল্ল সেন এমনিতেই সেমসাইড গোল দিয়ে চলেছে ; ফাইল পড়ার সময় নেই, গপ্পের বই পড়বে কি পায়খানায় হাগতে বসে ?
–না, ওদের একশো কুড়ি বি আর দুশো বিরানব্বুইতে ধরেছে । ওরা মুখ্যমন্ত্রীর অফিসে গিয়ে খামে ভরে পিচবোর্ডের মুখোশ দিয়ে এসেছিল, রাক্ষসের মুখোশ, তাতে ছাপিয়েছিল ‘দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন’ । অনিকেতের পিসেমশায় বললেন ।
–পুলিশ কমিশনারকেও জোকারের মুখোশ পাঠিয়েছিল, বলে, ঝন্টু অনিকেতকে জিগ্যেস করল, আর কাকে-কাকে পাঠিয়েছিলিস রে ?
–সবাইকে, বলল রাহুল, একশো মুখোশ কিনে তার পেছনে স্লোগানটা ছাপানো হয়েছিল । তারপর যোগ করল,
সংবাদপত্র মালিক আর বুদ্ধিজীবীদেরও দেয়া হয়েছিল, কয়েকজন জেলা ম্যাজিসট্রেটকেও ।
–তাতে কী ! ও তো বেশ মজার খেলা বলতে গেলে । ইনটারেসটিং অ্যাক্টিভিটি । তাই বলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ? তার ওপর অশ্লীল ভাষায় রাষ্ট্রকে আক্রমণ ? দেখছ যে প্রফুল্ল সেন চালের যোগান দিতে, আলুর যোগান দিতে কুলিয়ে উঠছে না, রাজ্যপাট চালাতে পারছে না, কাঁচকলা খেতে বলছে । কারা কমপ্লেন করেছে কিছু জানা গেছে ? বড়োবড়ো-বাঙালি, বলেছ বেশ ।
–না, ওরা আজকেই এসেছে । আগে ওদের দিয়ে সারেনডারটা করিয়ে দিন । দুর্জয় ওরফে ঝন্টু বলল ।
–ওরা একটা আন্দোলন শুরু করেছে আর নানা বিষয়ে ইংরিজি-বাংলায় ইশতাহার ছেপেছে ; পলিটিশিয়ানদের বলেছে, বেশ্যার ডেড বডি আর গাধার ল্যাজের মিক্সচার । বলে, মুচকি হেসে, পাঁচকড়ি তাকালেন অনিকেতের দিকে ।
–পলিটিকাল ম্যানিফেস্টোতে আরও আটটা পয়েন্ট আছে, বলল অনিকেত ।
–রিলিজিয়ান নিয়েও একটা ইশ্তাহার বের করেছে, পাঁচকড়ি জানালেন উকিলকে ।
–এত কাণ্ড-কারখানা চলছে কলকাতায়, খবর পাইনি তো ! আমি কি বড়ো-বাঙালি নই নাকি ! অ্যাডভোকেট রুমেও কেউ তোলেনি ব্যাপারটা । মনে হচ্ছে গভীর পাঁকের জীবদের চটিয়েছ তোমরা । দলে তোমরা দুই ভাই না আরও সাঙ্গ-পাঙ্গ আছে ?
–আমরা তিরিশ-চল্লিশজন হবো ।
–তিইইইরিশ-চল্লিশ জন ? দলটার নাম কি ?
–সর্বভূক ।
–ভূক ? সর্ব ? ওব-বাবা । তাহলে প্রফুল্ল সেনের স্যাঙাতরা তো চটবেই । আঁতে ঘা দিয়েছ দেখছি । একে তো রিফিউজি পাবলিক রোজই ডালহাউসি অভিযান চালাচ্ছে, শহরে-শহরে মিছিল-মিটিং হচ্ছে, বাস-টাস পুড়ছে, তার ওপর তোমরা যদি ওনার গোদের ওপর কাঁইবিচি হয়ে উদয় হও, কেলেঙ্কারি কেস । গাধার ল্যাজ এবং বেশ্যার ডেড বডি, কারেক্টলি অ্যান্টিসিপেটেড ইম্যাজিনেশান বলতে হবে, তাদের কপুলেশান থেকে যদি পলিটিশিয়ানদের জন্ম দিতে হয় । আমার বাপ-ঠাকুদ্দাও এমন কেস লড়েনি ।
উকিলমশায় ওনার মুহুরিকে বললেন অনিকেত আর রাহুলের সই নিয়ে নিতে, ওকালতনামায় । অনিকেতকে বললেন, ওসব ইশ্তাহার-টিসতাহার, মুখোশ, লেখাপত্তর আর যা-যা করেছ, তার একখানা করে কপি আমার মুহুরির কাছে জমা দিও । কালকে সকাল নটায় ব্যাংকশাল কোর্টে পৌঁছৈ যেও । কোর্টটা কোথায় জানো তো ?
ঝন্টু বলল, আজ্ঞে আমি নিয়ে যাবো । জামিনদার হবার জন্য বাবাকে কী-কী নিয়ে যেতে হবে ?
–বাড়ির দলিল থাকে তো ভালো, তা নইলে ইনকাম সার্টিফিকেট এনো । দুজন আসামী তো, তাই আরেকজন জামিনদার যোগাড় করে এনো ।
ওকালতনামা সই করা হয়ে গেলে পিসেমশায় চলে গেলেন । ঝন্টু থেকে গেল অনিকেতদের সঙ্গে, ও অনিকেতের সমবয়সী আর ছোটোবেলাকার বন্ধু, এক সঙ্গে সাঁতরে গঙ্গা পারাপর করত । পিসেমশায় চলে যাবার পর, উকিলবাবুর চেম্বার থেকে বেরিয়ে, পথে নেমে, ঝন্টু বলল, ওই যে দেখছিস সামনের গলিটা , তোকে ওদিকে তাকাতে বলছিলুম, ওটাই সোনাগাছি ; যে মেয়েগুলো উকিলবাবুর চেম্বারে মেঝেয় বসে আছে, তারা সোনাগাছির, ওদের সঙ্গের লোকগুলো ফড়েবা ভেড়ুয়া , ওই যাদের বলে পিম্প, কোনো না কোনো মামলায় পুলিশ এদের ঝুলিয়ে দিয়েছে , টাকা খসাতে পারেনি, কতই বা রোজগার ওদের, বল ।
অনিকেত ঝন্টুকে বলল, শালা তুইও সোনাগাছি ট্রিপ মারিস , ধরাও পড়েছিস পুলিশের হাতে । বলিসনিতো ?
–বলব আবার কী ? বাবাও তো যায়, বাবা কি মামাদের কখনও বলেছে । মামারা জানে, আমার মাও জানে, তোদের ঠাকুমাও জানত । তোর রামায়ণ কোম্পানির বন্ধুদেরও চিনিয়ে দিয়েছি । আজ তো শনিবার, অপেক্ষা কর একটু, দেখতে পাবি কাউকে-কাউকে ।
কলকাতার আদালতের অভিজ্ঞতা ছিল না । কোথায় যে তা-ই জানত না রাহুল-অনিকেত । ফেকলু উকিলরা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ‘সাক্ষী চাই ? সাক্ষী চাই ? এফিডেভিট করাবেন ?’ বলে চেঁচায় মক্কেল ফাঁসাবার ধান্দায় । একতলার সারাটা আদালত চত্ত্বর জুড়ে, যেখানে যে চিলতে মতন জায়গা পেয়েছে, টুলের ওপর রংচটা টাইপরাইটার রেখে ফটর-ফটর ট্যারা-বেঁকা টাইপ করে চলেছে রোগাটে খ্যাংরা বা ভেতো-পেট টাইপিস্টের কাতার । তাদের ঘিরে
চোপসানো-মুখ, আতঙ্কিত, উদ্বিগ্ন লিটিগ্যান্টের গ্যাঞ্জাম । নিচেতলার আদালত চত্তর জুড়ে তেলেভাজা, কাগজ-কলম,
অমলেট, ভাত-রুটির খুপরি-ঠেক । কোর্ট পেপার কেনার দীর্ঘ কিউ । ইংরেজরা যেসব বিহারিদের চাপরাসি-ঝাড়ুদার-আরদালির কাজ দিয়েছিল, তারা নিচেতলার প্রতিটি খাঁজখোঁদোল আর ফাঁকা পরিসর জবরদখল করে ছেলেপুলে নিয়ে সংসার পেতে ফেলেছে । আদালত-বাড়ির পেছন দিকে শুকোয় তাদের শাড়ি শায়া ব্লাউজ বডিস জাঙিয়া ট্রাউজার স্কুলের ইউনিফর্ম শিশুর জামা । জেল থেকে জামিন না-পাওয়া খতরনাক দাগিরা পুলিশের বন্ধ গাড়িতে এলে, পানাপুকুরে ঢিল পড়ার মতন ক্ষণিকের জন্য ভিড়টা সরে গিয়ে নিজের জমঘটে ফিরে আসে ।
বড় জ্যাঠা, নিজের ন্যাড়া মাথায় হাত বুলিয়ে, কেতু-রাহুলের পিসেমশায়কে বলেছিলেন, পাঁচু, তুমি আর ফৌজদারি উকিল পেলে না ? রাঁঢ়-বাড়ির উকিল ধরালে ?
জবাবে কেতু-রাহুলের পিসেমশায় বলেছিলেন, ও উকিল আজ ওব্দি কোনো কেস হারেনি, ঠিক জিতিয়ে নিয়ে আসবে । চোখের সামনে খুন করল যে গুণ্ডা, তাকেই ছাড়িয়ে নিয়ে এলো, আর এ তো কোন ছার, দুচার-পাতা লেখা। আমার বিয়ের সময় তোমরা তুলতুলে কাগজে বিয়ের যেরকম পদ্য ছাপিয়েছিলে, এ সেরকমধারাই ব্যাপার ।
রাহুল-অনিকেতের জন্য বিচার্য নয় নম্বর এজলাসটা ওপরতলায়, সিঁড়ির প্রথম পাকের পর দ্বিতীয় । মুচলেকা দিয়ে রাজসাক্ষী হবার আগে পর্যন্ত প্রভাস চোঙদার আর কামেশ্বর চোঙদারও নিজেদের উকিল নিয়ে এই এজলাসে হাজিরা দিয়েছে । সবাই যে-গাড্ডায় ও-ও সেই গাড্ডায় যুক্তিতে হরিচরণ খাঁড়া কোনো আলাদা উকিল করেনি । বাদবাকি যাদের বিরুদ্ধে গ্রেপতারি পরোয়ানা ছিল, তারা আপাতত গা ঢাকা দিয়েছে, অশোকনগর, আগরতলা, বিষ্ণুপুরে। বিচারকের মাথার ওপরের হলুদ টুনিটা ছাড়া জানলাহীন এজলাসে আলো ঢুকতে ভয় পায় । দুই-ব্লেডের বিশাল ছাদপাখা, যার অবিরাম ঔপনিবেশিক কাতরানি অবসর নেবার অনুরোধ জানাতে থাকে উত্তরঔপনিবেশিক কর্ণধারদের ।
এজলাসের পেশকারকে সবাই গাংলিবাবু বলে ডাকে, যিনি চাকুরিতে যোগ দেবার সময় ছিলেন বলাই গঙ্গোপাধ্যায় নামের যুবক । রাহুলের বিচারের সন-তারিখে পৌঁছে উনি তেলচিটে কালো, মুষকো, সারাদিন বসে থাকার কুমড়োভুঁড়ি থলথলে আদল, চকচকে টাক, মোটা কালো ফ্রেমের বাইফোকাল, আর মেটে-ময়লাটে ধুতি-পাঞ্জাবিতে সেই যুবকটির ধ্বংসাবশেষে রূপান্তরিত । কখনও হাসেন না । সারা কলকাতার রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ-শব্দ নয় নম্বর এজলাসে বছরের পর বছর জমে-জমে ওনাকে চুবিয়ে রেখেছে তার সংমিশ্রণের দিনগত-পাপক্ষয়ী আরকে ।
পুলিশ কেবল রাহুলকে চার্জশিট দিয়ে, বাদবাকি সবাইকে ছেড়ে দেবার পর, জানা গেল, চোঙদারভাইরা মুচলেকা দিয়ে রাজসাক্ষী হয়েছে বলে ওদের বিরুদ্ধে কেস তুলে নিয়েছে সরকার । ছাড়া পাবার আগে চোঙদাররা সরকারকে বলত প্রতিষ্ঠান ; ছাড়া পাবার পর খবরের কাগজ কোম্পানির সরকার ফ্যামিলিকে বলে প্রতিষ্ঠান । শুধু রাহুলকেই মামলায় ফাঁসানো হয়েছে দেখে ওর বলিয়ে-কইয়ে বন্ধুরা শিস দিতে-দিতে হাওয়া । রাহুল-অনিকেতকে অবাক করে চার্জশিটের সঙ্গে রাহুলের বিরুদ্ধে যে সরকারি সাক্ষীর তালিকে দেয়া হয়েছে, তাতে কেতুর কলেজ-বন্ধু প্রদীপন চাটুজ্জে, রক্তিম চাটুজ্জে আর চঞ্চলকুমারের নামও লেখা ।
অনিকেতকে রাহুল বলল, দেখলে তো, অসীম গাঙ্গুলি বিদেশ থেকে ফিরলেন, আমরা গ্রেপতার হলুম, আর এনারা ডিগবাজি খেলেন ।
–জানি, ব্যাপারটা কাকতালিয় নয়, বলল কেতু ।
চার্জশিট পাবার আগে পর্যন্ত রাহুল-অনিকেতকে জেরা করার নামে প্রায় প্রতি সপ্তাহে ডাকা হতো লালবাজারের প্রেস সেকশানের ইনটারোগেশান রুমে । ডেকে বসিয়ে রাখা হতো আর শোনানো হতো পাশের ঘরে যাদের প্যাঁদানি দেয়া হচ্ছে তাদের কান্নাকাটি-কাতরানি-চিল চিৎকার । তদন্তকারী ইন্সপেক্টর আদালতকে জানাতো যে তদন্ত চলছে, অনুসন্ধান পুরো হয়নি । রাহুল-অনিকেতের বন্ধুরা যে ওই প্যাঁদানির প্রতিধ্বনিতে ভুগে-ভুগে, কেঁদে-ককিয়ে মুচলেকা লিখে, দে-পিটটান দিয়েছে, তাতে রাহুল-অনিকেতের সন্দেহ নেই ।
তদন্তকারী ইন্সপেক্টর একদিন সন্ধ্যায় অনিকেতকে জানাল যে কালকে ঠিক সকাল দশটায় পুলিশ কমিশনার আপনাদের সঙ্গে দেখা করবেন, ওনার ঘরটা জানেন তো । স্বাভাবিক যে জানত না ওরা । ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের বাইরে অন্য বিভাগে যাবার প্রয়োজন হয়নি । ঘুরে-ঘুরে লালবাজার দেখার একটা ইচ্ছে অবশ্য ছিল, ট্যুরিস্টদের মতন ।
পরের দিন পৌঁছে গেল । কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর, কমিশনারের ঘরে নয়, ওনার পাশের ঘরে, কনফারেন্স রুমে যেতে বলা হল । ওরা ঘরে ঢুকে দ্যাখে একটা লম্বা টেবিলের চারিধারে বসে আছেন, বলা যায় প্রায় সকলেই পেটমোটা,
গম্ভীরমুখো লোক । কমিশনার যে কে তা বোঝা গেল, ওনার নামও পি. সি. সেন, বসবার চেয়ারও উঁচু ।
অনিকেত-রাহুলের জন্য দুটি চেয়ার ফাঁকা ছিল, তাতে ওদের বসতে বলা হল । থ্যাংকস জানিয়ে বসল । তদন্তকারী ইন্সপেক্টরের মাধ্যমে ওদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হল উপস্হিত কেদারানশীনদের সঙ্গে, লিগ্যাল রিমেমব্র্যান্সার, হোম ডিপার্টমেন্টের সচিব, সেনা বিভাগের কর্নেল, ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার, চব্বিশ পরগণা আর হাওড়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, প্রমুখ । পুলিশ কমিশনারের সামনে দুটো ঢাউস ফাইল রাখা ।
অনিকেত-রাহুল এতদিনে টের পেল যে কলকাতার, দুর্জয়ের ভাষায় বড়-বাঙালি কেউকেটারা, ওদের দুজনের সম্পর্কে যে-ধরণের নালিশ ঠুকেছেন, তা এই কর্মকর্তারা সাধারণত পান না ; এখন ওঁদের মুশকিল হয়েছে এতজনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দায়ের করে তা থেকে বেরোবার উপায় বের করা । পুলিশ কমিশনারই প্রথমে মুখ খুললেন, আপনারা দাঁতের মাজনের বিজ্ঞাপনের মতন হ্যাণ্ডবিলে আর্ট মুভমেন্ট করছেন ? এভাবে ক্রিয়েটিভ আর্ট হয় ?
রাহুল বলল, এভাবে দ্রুত পাঠকের কাছে যাওয়া যায়, সে হাতে পেয়ে চোখ বোলাতে বাধ্য হয়, দাঁতের মাজনের বিজ্ঞাপনের মতন । পত্রিকা হলে তার সময় ও ইচ্ছার ওপর নির্ভর করতে হতো, তাকে কিনতে হতো । হ্যাণ্ডবিলের মাধ্যমে তার সময়ে হস্তক্ষেপ করে, তার ইচ্ছা না থাকলেও, তাকে বাধ্য করা হচ্ছে একবার পড়ে নিতে । কেবলমাত্র আগ্রহীদেরই বিলোনো হয় । দাঁতের মাজনের মতো সাধারণ পাবলিককে বিলি করা হয় না, অত ছাপাবার মত টাকাকড়িও নেই আমাদের ।
–আপনাদের লজিস্টিক্স, আই মিন ফিলজফি, একটু বুঝিয়ে বলুন তো । সেনা বাহিনীর কর্নেল জানতে চাইলেন ।
অনিকেত-রাহুল এবার নিজেদের বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়ে গেল । মগজে জমে থাকা চিন্তাভাবনার খোলা হাওয়ায় উড়াল । অনিকেত জিওফ্রে চসার থেকে টেনে নিয়ে গেল সময়ের ক্ষুধায়, বর্তমান সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ে । রাহুল টেনে নিয়ে গেল অসওয়াল্ড স্পেংলারের ইতিহাস দর্শনে । কথা বলতে-বলতে ওদের কন্ঠস্বর ক্রমশ বিদ্যায়তনিক হয়ে উঠছিল । দুজনের লেকচার শুনতে বসে, বুঝতে পারছিল ওরা দুজন, একেবারে অজানা চিন্তার দিকে নিয়ে চলেছে অফিসারদের ।
–আপনারা এলিট নাগরিকদের আক্রমণ করছেন কেন ? হোম ডিপার্টমেন্টের সচিবের প্রশ্ন ।
অনিকেত বলল, আমরা তো কাউকে আক্রমণ করিনি, ওনারা আক্রান্ত বোধ করছেন, ইতিপূর্বে এই ধরণের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না ।
–শুধু টেবিলের তলায় পা দুলিয়েছেন তাঁরা । মানে, ওনাদের মনোদৃষ্টিবান মানুষ বলা যায় না ।
–মুখোশ বিলি করার আইডিয়াটা কার ? জানতে চাইলেন লিগাল রিমেমব্রান্সার ।
রাহুল বলল, আমার ।
–মুখ্যমন্ত্রীকেও পাঠিয়েছেন ? কতজনকে পাঠিয়েছেন ?
–হ্যাঁ, বলল রাহুল । প্রায় একশোজনকে ।
–আমার অফিসে এসেছে, বললেন চব্বিশ পরগণার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ।
–লালবাজারে আমার দপতরেও এসেছে । ওনার সামনের একটা ফাইল ওলটাতে-ওলটাতে বললেন পুলিশ কমিশনার । অনিকেত দেখলো, ওদের বুলেটিন, পত্রিকা সবই রয়েছে ফাইলটায় ।
–টাকা-পয়সা কোথা থেকে আসে । জানতে চাইলেন হাওড়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট । ওনার লোকেরা সম্ভবত হরিচরণ খাঁড়ার বাড়িতে নজরদারি করে খরচের সমস্যা সমাধান করতে পারেননি ।
অনিকেত বলল, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা দুই ভাই-ই করি, অন্যেরাও কখনও সখনও করে । হ্যান্ডবিলে বিশেষ খরচ হয় না ।
–টপলেস প্রদর্শনী করাবার কথা ছিল, ইনভিটেশান কার্ড পেয়েছিলেন অনেকে, তা হল না কেন ? প্রশ্ন করলেন হোম ডিপার্টমেন্টের সচিব ।
রাহুল ঠোঁটে সামান্য হাসি খেলিয়ে বলল, যারা ভেবেছিলেন যে টপলেস বলতে বুক-খোলা মেয়েমানুষ বোঝায়, তাদের ঘাড়ের ওপর মাথাটা, বা টপটা নেই । ওটাই টপলেস, নিজেরা যে প্রকৃতপক্ষে বোকা, মগজহীন, তা যাতে ওনারা বুঝতে পারেন আর আত্মধিক্কারে ভুগতে পারেন, তাই ।
–নামগুলো তো দুই ভাইয়ের খাসা ; সিংহকে রাহু আর কেতুর মুখোশ পরিয়ে রেখেছ নিজেরাই, চেয়ার ছেড়ে
ওঠার সময় বললেন পুলিশ কমিশনার ।
ঘন্টা দুয়েক দুজনকে এভাবে জেরা করার পর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল ।
তার পরের সপ্তাহে সবাইকে রেহাই দিয়ে কেবল রাহুলের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল হল । জেরার রকমফের দেখে রাহুল আঁচ করেছিল যে যারা নালিশ ঠুকেছে তাদের মূল লক্ষ্য ও-ই । চার্জশিটের দিন অনিকেত রাহুলকে বলেছিল, অসীমের মূল লক্ষ্য তুই, আর যারা নালিশ ঠুকেছে তাদের মূল লক্ষ্যও তুই, কিরকম মিলে যাচ্ছে ব্যাপারটা । বিশ্বাস করতে মন চাইছে না যে এটা কাকতালীয়, না কি সুতোর খেই খুঁজলে শেষটা ওঝাপুরের চৌকাঠেই পৌঁছোবে । ও তো ফিরেছে, একদিন যাবো ওর বাড়ি । পাকাবুদ্ধির চাল চেলেছে ।
রাহুল বলেছিল, প্রকৃত সূত্র প্রতিষ্ঠান, তা সে লোকটা অ-আ-ক-খ যেই হোক না কেন । অসীম গাঙ্গুলি রূপকারের কর্মী মাত্র ।
মামলা আরম্ভ হতে, কলকাতায় যাওয়া আর ফিরে আসার ঝামেলা এড়াতে রাহুল এক-একদিন এক-এক জায়গায় রাতের আশ্রয় নিতো । সুকোমল রুদ্রের জ্যাঠামশায়ের স্যাকরার দোকানে, হরিচরণ খাঁড়ার বাসায়, বড়োবাজারে হিন্দি পত্রিকার মারোয়াড়ি সম্পাদকের ব্যবসার গদিতে ; যেখানে পারে সেখানেই রাতটা কাটিয়ে দিত । চোঙদার-ভাইরা মুচলেকা দেয়ার পর থেকে ওকে এড়িয়ে যেত; শুরুতে ওদের টালার ভাড়াবাড়িতে, পরে ওদের মেসবাড়িতে, রাহুলের জন্য ‘প্রবেশ নিষেধ’ বোর্ড লটকিয়ে দিয়েছিল ।
চার্জশিটের সঙ্গে পুলিশের সাক্ষীদের নাম দেখে উকিল মশায় গম্ভীর । বললেন, ও হে, ফৌজদারি মামলা হয় অবজেকটিভ এভিডেন্স দিয়ে । তোমার বিরুদ্ধে তো দেখছি বেশ কয়েকজন নট সাক্ষী হয়েছে, তোমার দলের লোকেদেরও নাম রয়েছে । কেসটাকে ওরা সাবজেকটিভ করে দিয়েছে। তোমাকেও তো কয়েকজন নট-নটী যোগাড় করতে হবে ।
শুনে, রাহুলের পিসেমশায় বললেন, এই তোমার পশার ? এখন সাবজেকটিভ-অবজেকটিভ কাজিয়ার হ্যাঙ্গাম দেখাচ্ছ ! জানতুম আমি, আগেই জানতুম, লেখালিখির কেস খুনের কেসের চেয়ে কঠিন, তা তুমি শুনলে না । শালাদের কাছে আমার মাথা কাটা গেল । একে তো এই মামলার জন্যে শাশুড়ি গত হলেন ।
উকিলমশায় চোখ থেকে চশমা বাঁহাতে নামিয়ে বললেন, কেউ খুন হলে সাক্ষীরা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলে না যে খুন করতে কেমন লাগে, ভালো না খারাপ, বুঝেছ ? রেপ কেস হলে সাক্ষীকে কি জিগ্যেস করা হয় যে রেপ করতে কেমন লাগে ? এই কেস সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে । জজসায়েব হয়তো নিজেই পড়তে বসবেন, তখন ? খুনের মামলায় কি জজসায়েব নিজে খুন করে দেখে নেন যে খুন করা কেমন ?
রাহুলের কিছু করার নেই, কেননা কোর্ট-কাছারির মারপ্যাঁচ ওর জানা নেই, আদালতের প্রতিদিনের কচকচি বিরক্তিকর আর গা-বেঁধানো হয়ে উঠেছে ।
একটা ডেট থেকে আরেকটা ডেটের মাঝে সপ্তাহের বেশি সময় থাকলে রাহুল চলে যেত শ্যাওড়াফুলির ঠাকুমাহীন খণ্ডহরে । ভবদেব মিত্র, মানব রায়, আর বেনারস থেকে দুই চিত্রকর বন্ধু, নির্মল মিত্র বাউলা আর অনীক খাস্তগীর এসে, খণ্ডহর গুলজার করে তুলত । ওদের গাঁজা-টানা দমকা হাসিতে উড়তে আরম্ভ করত অবহেলিত পায়রার ঝাঁক । সবাকসুন্দরী দেবী মারা যাবার পর বারোঘরের বিশাল খন্ডহরে একা থাকতে ভালো লাগত না চাপা-বেদনাবোধে আক্রান্ত রাহুলের । পুরো খণ্ডহরটাই যেন বিষাদে ভুগে নোনা ইঁটের আর্তি ঝরিয়ে চলেছে, অবিরাম । ঠাকুমা যখন ছিলেন ওনার রাঁধা হবিষ্যান্ন খেয়ে চলে যেত । বন্ধুদের কাছে খণ্ডহর প্রিয় ছিল স্বাধীনভাবে আড্ডা, মাদক ফোঁকা, ইত্যাদির স্বাধীনতার জন্য । ঠাকুমা মারা যাবার পর বাড়ির সিংদরোজার পাল্লা দুটো আর পায়খানা দুটো, যেগুলো ছিল সিংদরোজার বাইরে, সেগুলোর কপাটও চুরি হয়ে গিয়েছিল । বন্ধুদের বলে দিতে হতো যে পায়খানায় গেলে বাইরেই মগ রেখে দিতে, যাতে বোঝা যায় যে ভেতরে কেউ বসে ধ্যান করছে । রাহুল কানপুরমুখো হলে ওরাও কানপুর চলে আসত।
একবার অনীক আর নির্মল বাউলা আন্দোলনের পোস্টার আঁকতে খণ্ডহরে এলো ; ভবদেব আর মানবও পৌঁছে গেল কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে । সকালে মুড়ি-লাঁচা লঙ্কা খেয়ে-খেয়ে চোঁয়া ঢেঁকুর মারায় ভুগতে থাকলে, ভবদেব প্রস্তাব দিল যে রূপদর্শীর বাড়ি যাওয়া যাক রবিবারের সকালে , উনি তো একদিন রাধাবল্লভি আর আলুর দম খাবার ব্রেকফাস্টের নেমন্তন্ন দিয়ে রেখেছেন ।
রূপদর্শীর মালিকানায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড ‘আয়না’তে রাহুলদের টিটকিরি মেরে চুটকি আর কার্টুন
প্রকাশিত হতো, যার মূল সুর ছিল সর্বভূকদের লেখা বিদেশি প্রভাবিত । ওরা গিয়েছিল সম্পাদকের খোঁজে । একজন
ছেঁড়া গেঞ্জি পরা লোক হদিশ দিলে যে রূপদর্শী হলেন পত্রিকাটির মালিক । রাহুলরা ওনার ট্যাবলয়েড দপতরে গিয়ে হাঙ্গামা করেছে শুনে রূপদর্শী এক সাংবাদিকের মাধ্যমে খবর পাঠালেন যে ওরা যেদিন ইচ্ছে ওনার বরানগরের বাড়িতে রাধাবল্লভি-আলুর দম সহযোগে ব্রেকফাস্ট করতে পারে ।
সেই মত রাহুল ভবদেব অনীক নির্মল গিয়ে হাজির হল ওনার বাসায় । দরোজার বাইরে থেকেই হাঁক পাড়ছিল সবাই মিলে, “আমি দাসু রায়, আমি দাসু রায়, হামি দাসু রায়।”
উনি দরোজা খুলেই, যদিও ওদের কাউকে দেখেননি কখনও, বললেন, দাসু রায় নাম শুনেই বুঝেছি, কাদের আগমন হল ।
তর্কাতর্কি শুরু করে উনি বললেন, ওয়াল্ট হুইটম্যানের প্রভাবের কথা । ভবদেব প্রসঙ্গ তুলল বাংলা ভাষায় সনেটের আঙ্গিক, জীবনানন্দে ইয়েটস, মানব প্রসঙ্গ তুলল তিরিশের লেখায় ঔপনিবেশিক প্রভাব যা প্রাকঔপনিবেশিক বাংলা সাহিত্যে দেখা মেলে না । অনীক-নির্মল তুলল রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকায় ফরাসি প্রভাব ।
রাহুল কোনো আলোচনা না করে কেবল আলুর দমের গুণগান করছিল, কত নরম আলু, কী স্বাদ, এত বড়-বড় করে কেটে ভাজার পরেও ভেতরে মশলা ঢুকতে পেরেছে ।
রূপদর্শী বুঝতে পারলেন যে রাহুল সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে তর্কটা চালিয়ে নিয়ে চলেছে । উনি বললেন, ও, রূপদর্শীকে গুলগল্পের টেক্কা দিচ্ছ !
রাহুল বলল, হ্যাঁ দাদা, আলু জিনিসটা আমাদের দেশের নয়, বেশি দিন হল আসেওনি । এই কন্দমূল পোর্তুগিজরা প্রথম জাহাঙ্গিরের দরবারে উপহার দিয়েছিল । ইনকাদের ধ্বংস করে লাতিন আমেরিকা থেকে স্পেন লাল আলু নিয়ে গিয়েছিল ইউরোপে । সেখান থেকে ইউরোপের উপনিবেশগুলোয় পৌঁছোয় আলু । পোর্তুগিজরা পেরু-বলিভিয়া থেকে শাদা আলু এনেছিল ভারতবর্ষে । আমাদের দেশে ওয়ারেন হেস্টিংস দেহরাদুনে আলু চাষের ব্যবস্হা করেন, তাই শাদা আলুকে অনেকে বলে নৈনিতাল আলু । চন্দ্রমুখি আলু, যাকে আপনি মনে করছেন বাংলার মাটি থেকে জন্মেছে তা ওই নইনিতাল আলু । ওই আলুর জন্যই প্রফুল্ল সেন হিমসিম খাচ্ছেন, কেননা বাঙালির পাতে আজ আর আলু না হলে চলে না।
–দাসু রায় আর কাঁচকলা, রাধাবল্লভীতে কামড় দিয়ে বলল ভবদেব মিত্র ।
রূপদর্শী রাহুলের পিঠ চাপড়ে বললেন, মক্কেল দেখছি ব্রিফ তৈরি করেই কেস লড়তে এসেছে ; ঠিক আছে নিমন্ত্রণ রইল, পরের বার ফুল কোর্স লাঞ্চ খাওয়াবো । লাঞ্চ খাবার আর সুযোগ হয়নি, কেসের অবিরাম হয়রানির জন্য, আদালতের খরচের দরুণ, পকেটে ছ্যাঁদা হয়ে যাবার যোগাড় তখন ।
রাহুল যখন, মমমমমমম, কত বছরে পড়েছে, মমমমমমম, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, শরিকরা সবাই বাড়িটা বেচে দেবার তোড়জোড় করায়, অনিকেত আর ও শ্যাওড়াফুলির খণ্ডহর বিক্রিতে রাজি হয়ে গেল । মকদ্দমার পর রাহুল ওই বাড়িতে যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিল ; ওর খুড়তুতো বোন, তার নকশাল আন্দোলনকারী প্রেমিক পুলিশের গুলিতে খুন হয়ে গেলে, বড়ঘরের বরগায় ঝুলে আত্মহত্যা করেছিল । ওই বাড়িতে গেলেই রাহুল ছোড়দা ডাকের প্রতিধ্বনির গুঞ্জন শুনতে পেত । সবাকসুন্দরী দেবীর হাসির প্রতিধ্বনি শুনতে পেত ।
আদালতে, যে এজলাসে ওর মকদ্দমা চলত, সেখানেই একজন বৃদ্ধের আত্মহত্যার মামলাও চলত । অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল লোকটা । বোধহয় মামলাটা লড়ে জেতার মধ্যে দিয়েই অবসাদ থেকে ছাড়ান পেয়েছিল । জানা হয়নি রাহুলের ।
এজলাসে, বিচারকের টেবিলের বাইরে, ডানদিকে দেয়াল-ঘেঁষে, জালঘেরা লোহার শিকের খাঁচা, জামিন-না-পাওয়া বা অন্য মামলায় দণ্ড-পাওয়া দাগি আসামিদের জন্য, যারা জেল থেকে পুলিশভ্যানে এসে ওই খাঁচার পেছনের দরোজা দিয়ে ঢোকে । খাঁচার জাল আর মেঝে নোংরা হয়ে আছে গয়ের থুতু কফ বমি খইনি পিকের ছোপে । রাহুল বা ওর মতন যারা জামিনে-ছাড়া তারা ওই জালের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়ায়, পায়ে ব্যথা করলে খাঁচায় ঠেসান দিয়ে । খাঁচার দাগিরা নানা মন্তব্য করতে থাকে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাহুলের সমর্থনে, কেননা লেখার বা শায়রি করার জন্য মামলার কথা তারা শোনেনি আগে ।
বিচারকের টানা টেবিল, ওনার বসার চেয়ারের বাঁদিকে, যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেখানে আর্চ-দেয়া
দরোজার খাদির নোংরা পর্দা সরিয়ে উনি এজলাসে আসেন আর যান । এলে, সবাই উঠে দাঁড়ায়, নিশ্চিন্ত হয়, কেননা
কে কখন থেকে, কবে থেকে, তার স্বজনজ্ঞাতির ডেটের আর শুনানির জন্য অপেক্ষা করছে, তা, তাদের মুখ দেখে মনে
হয়, একশো বছর, হাজার বছর, বা তারও বেশি । এত মকদ্দমা জমে আছে যে বেশিরভাগ শুনানি হয় দশ-পনেরো মিনিটের, বড়োজোর আধঘন্টা ।
এজলাসের মেট্রপলিটান ঘর্মাক্ত গ্যাঞ্জামে আর চেয়ার-বেঞ্চে স্বাস্হ্যবতী ছারপোকাদের প্রেমনিবেদনের মাঝে বেশিক্ষণ বসতে পারেনা রাহুল । এ-এজলাস সে-এজলাস ফ্যা-ফ্যা করে, মশলাদার সওয়াল-জবাব হলে দাঁড়িয়ে শোনে, কী ভাবে খুন-ধর্ষণ-ডাকাতি-ছিনতাই-চুরি-মারপিট-পকেটমারি-লুটপাট-দখল-বেদখল-চুল্লুবিক্রি-আত্মহত্যা-বউভাগানো ইত্যাদি গল্পের জট খুলছে আর পাকাচ্ছে । ওর কেস ওঠার সময় হলে মুহুরিবাবু রাহুলকে খুঁজে-পেতে ডেকে নিয়ে যান, খাঁচায় পিঠ দিয়ে দাঁড়াবার জন্য । অমন দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া ওর আর কোনো ভূমিকা নেই । প্রথম থেকে শেষ দিন পর্যন্ত আদালতে রাহুলকে মুখ খুলতে হয়নি । মামলায় ‘আমি’ বলতে অপরাধীকে বোঝায় না, ‘আমি’ মানে অপরাধীর উকিল । উকিলই বলে, “আমি দোষী নই।”
উকিলবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনের লাইটপোস্টের তলায় দাঁড়িয়ে ছিল ওরা তিন জন ; ঝন্টু বিড়ি ফুঁকতে আর অনিকেত-রাহুল একটা সিগারেট ভাগাভাগি করে ফুঁকতে ব্যস্ত ।
সিগারেট ফুঁকে অনিকেত চলে যাবে, ওর হাতে আড্ডা দেবার সময় নেই । তিন বছর হল ওর বিয়ে হয়েছে, মেয়ের বয়স মোটে দু’বছর, তার ওপর এই হ্যাঙ্গাম । বলল, এ নিশ্চয়ই অসীমের কাজ ; বিদেশ থেকে ফিরেই পোঁদে লেগেছে, অতুল্য ঘোষের কাগজে কাজ করত, অনেক চেনা-জানা করে ফেলেছিল, তাদের ধরাধরি করে বাঁশ দিতে নেমেছে , প্রদীপন বলেছিল যে বিদেশ থেকে কড়া চিঠি লিখতো সবাইকে, যাতে আমাদের আন্দোলনকে ভেঙে দেয়া হয়, রাহুলকেও হুমকি দিয়ে লিখেছিল, ফিরুক, তারপর দেখে নেবে, ওর গায়ে পদ্মাপাড়ের রক্ত আছে ।
–হ্যাঃ হ্যাঃ, আমি মাইরি কোনো নদীর পাড়ে হাগবার সুযোগ পাইনি আজও । হরিদ্বারে গঙ্গার পাড়ে হাগলে আর তার ঠাণ্ডা কনকনে জলে ছোঁচালে নাকি ছাঁৎ করে সোজা স্বর্গে যাওয়া যায়, বলল ঝন্টু ।
তিনজনে চুপচাপ বিড়ি-সিগারেট ফোঁকায় ব্যস্ত । ফোঁকা হয়ে গেলে, ফুটপাতে পা দিয়ে ঘষে নেভালো ।
ঝন্টু ফিসফিস করে বলে উঠল, ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ, পুরো রামায়ণ কোম্পানি চলেছে, ওরা গলিতে ঢুকুক তারপর তোদের দেখাবো কোন বাড়িতে ঢুকল ।
–বুদ্ধদেব বসুর বদল্যার পড়ার এই ফল । তবে বদল্যার তো দল বেঁধে যেত না । বলল অনিকেত ।
–বুঝলিনে, বেঁধে-বেঁধে থাকলে খরচ কম, হোলসেল রেট । বলল ঝন্টু ।
–তিরিশের সময় থেকে বিদেশি কবিরা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষ । নিজের দেশের কবিয়ালদের পাত্তা দেয়া হয় না । উইলিয়াম ব্লেক ছিল ছুতোর, ফ্লবেয়ার আর র্যাঁবো ছিল জাতচাষা, ওদের দেশের মণ্ডল বা ধাড়া বা বেরা, তাদের পুর্বপুরুষ ভাবতে বাঙালি কবিরা লজ্জা পায় না , যত লজ্জা নিজের বাপ-চোদ্দোপুরুষকে স্বীকৃতি দেয়ায় । গত বছর যে সাইক্লোস্টাইল করা বুলেটিন বেরিয়েছিল, তাও মোটে পঁচিশ কপি, যেটা বিলি করা হয়েছিল সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ কফিহাউসে, ভূমিকম্প ঘটিয়ে দিয়েছিল কলকাতায় । অথচ একটা আপাত ইনোসেন্ট ছক ছিল তাতে, দেখলেই বুঝতে পারতে । ভোলা ময়রা, গোঁজলা গুঁই, লালু, নন্দলাল, রামজি, রঘু, কেষ্টা মুচি, নিতাই বৈরাগী, ভবানী বেনে, হরু ঠাকুর– এনাদের পূর্বপুরুষ হিসাবে দেখানো হয়েছিল, এখনকার ব্রাহ্মণ, কায়স্হ, বদ্যি কবিদের । ব্যাস, কলকাতা তেলে-বেগুনে । সুকোমল রুদ্রকে ঘিরে ধরেছিল কফিহাউসের সামনে ।
–অনেকে আবার নিজেদের দেবীদেবতার জায়গায় গ্রিস-রোমের অ্যাডোনিস, আফ্রদিতি, লেডা, ভেনাস, ইউলিসিস ইত্যাদিকে এনে গৌরব বোধ করে ।
–দাঁড়াকবি নাম দিয়ে কবিয়ালদের অপমান করেছে, এমনকি বাংলা ভাষার নামকরা অধ্যাপকরাও করেছে ; ওরা বুঝতেই পারেনি, শেষ লড়াইটার জন্য সেইসব ভূমিজ কবিরা নিজের দু’পায়ে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিল । চতুষ্পদ থেকে প্রাণীরা কেন আর কী-কী কারণে হাত দুটোকে ফ্রি করতে চাইল, করে জীবজগতে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলল, তা খতিয়ে দেখেননি । আসলে ওনারা জীবনের সমস্তকিছু সাহিত্যের মালমশলা প্রয়োগ করে ব্যাখ্যা করতে চাইতেন ।
–এখন বদল্যারি ফাঁদে পড়েছে ।
–চ না, আমরাও ফাঁদে পড়ি, ঝন্টুর প্রস্তাব ।
–না না, আমরা কোনো বেশ্যার ঘরে যাবো না , বলে, চলন্ত বাসে উঠে পড়ল অনিকেত ।
–তুই চল, ঝন্টু বলল রাহুলকে, ওরা কোন বাড়িটায় ঢুকবে আমি জানি, আমিই তো রূপক মজুমদার আর প্রদীপন
চাটুজ্জেকে বাড়িটা দেখিয়েছিলুম । ওই বাড়ির মাসিটা পয়সাঅলা, দেখতে-শুনতে ভালো মেয়েদের তোলে । ওই বাড়ির সামনে যে বাড়িটা তার বারান্দা থেকে সেসব খদ্দেরদের দেখা যায় । রামায়ণ কোম্পানির শেয়ার হোলডারদের দেখতে পাবি ।
ঝন্টুর সঙ্গে রামায়ণ নট্ট কোম্পানির সদস্যদের পেছু নিল রাহুল । গলিটা বোধহয় ইচ্ছাকৃতভাবে অন্ধকার । বিটকেল গন্ধ, বেলিফুল, বিড়ি-সিগারেট আর মদের সংমিশ্রণে উড়ছে । হয়তো হরমোনে বাড়বাড়ন্ত মাংসবাজারের গন্ধ এরকম তিতকুটে হয় । ঝন্টুর পেছন-পেছন সিমেন্ট-ঝরা, ফিকে হলুদ সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলো রাহুল । বারান্দায় এক কোনে মোটামতন এক প্রৌঢ়া, পানের বাটা নিয়ে বসে । ঝন্টুকে দেখে বললে, আজকে তোর মাগির হপ্তাবাবুর রাত, তুই অন্য কাউকে চাস তো দ্যাখ । বারান্দার তিন দিকে ছোটো-ছোটো ঘর, কয়েকটার দরোজা বন্ধ । কয়েকটায় সাজগোজ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে যুবতীরা, বড্ডো বেশি সাজুগুজু, টকটকে লাল ঠোঁট, গালে লালচে পাউডার, ব্লাউজ থেকে উথলে সবই দেখা যাচ্ছে, বোঁটা ছাড়া । এদের জড়িয়ে ধরলেও সহজে লিঙ্গোথ্থান হবে বলে মনে হয় না ।
–শশশ, ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ ।
রাহুল দেখল সামনের বাড়িটার একটা ঘরের সামনে একজন যুবতীর সঙ্গে কথা বলছে প্রদীপন চাটুজ্জে, মস্করা করছে নিশ্চয়ই, যে-ভাবে হাসি খেলছে যুবতীর শরীর জুড়ে । কথা বলতে উনি ওস্তাদ । আন্দোলনের বুলেটিনে একবার লিখেছিলেন, বেশ্যার ঘরে আয়না থাকবেই, খাদ্যদ্রব্য কদাচিৎ দেখেছি, তবে বাসন থাকে, কাঁচের কলাইয়ের কাঁসা বা পিতলের বাসন ; বেশ্যা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় কটি তথ্য এই হতে পারে যে এক সে উপহার পেতে ভালোবাসে দুই তার আত্মা আছে তিন তার লজ্জাহীনতা সত্যের মতো চার সে মৌলিক নির্বোধ পাঁচ সামনে কোনো সময় নেই এমন মানুষ যদি ভাবা যায় সে সেই রকম ; তার সম্পর্কে একটি কথাই গভীরতরভাবে ভেবে জানার, তার শরীর যখন একজন ভোগ করে, কী মানসিক অবস্হায় সে থাকে, লোক এলে সে সুখী হয়, বিরক্ত হয়, ঘৃণাও করে, লোককে হিংসে সে কখনও করে না, যখন লোক তাকে উলঙ্গ করে, সে বিরক্ত হয়, একবার উলঙ্গ হলে স্বস্তিবোধ করে, তার সহজ লাগে, কিন্তু বেশিরভাগ লোক একসঙ্গে উলঙ্গ হয় না, আলো নিভবার আগে অন্তত আণ্ডারওয়ার বা গেঞ্জি পরে থাকে, বেশ্যার নগ্নতা সে দ্যাখে, তাকে দেখতে দ্যায় না, তারপর কতকগুলি নিয়মকানুন তারা মানে, বেশ্যারা, সে-সময় শয়তান তাদের সাহায্য করে বা ঈশ্বর, যে-জন্য তারা কদাচিৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।
–তুমি প্রদীপন চাটুজ্জের লেখাটা পড়েছিলে, বেশ্যাদের নিয়ে লেখা ? ঝন্টুকে জিগ্যেস করল রাহুল ।
–পড়েছি, পড়েছি, তুই দিয়ে গিসলি । ও নিজের কথা লিখেছে, কী করে ও জানল অন্যরা কী-কী করে ? বেশ্যারা নিজেরাই জামাকাপড় তাড়াতাড়ি খুলে ফ্যালে, যাতে কাজ সেরে পরের খদ্দেরের জন্যে ধুয়েটুয়ে রেডি হতে পারে । তাছাড়া কোনো-কোনো কচি খদ্দেরের তর সয় না, তাড়াতাড়ি শাড়ি-ব্লাউজ খুলে সরিয়ে না রাখলে তড়িঘড়ি জড়িয়ে ধরে লিকুইড ফেলে নোংরা করে দেবে । তখন ? প্রদীপন চাটুজ্জে তো হাড়গিলে, পাঁজরা গোনা যায়, তাই ঘর অন্ধকার হলে গেঞ্জি-আণ্ডারওয়ার খোলে । তোকে একদিন দিনের বেলা নিয়ে আসব, তখন রেট অনেক কম থাকে, ওসব রঙচঙ মেখে কুচ্ছিত হয়ে সাজে না , দেখতে পাবি, একদম নর্মাল, যেন পাড়ার মেয়ে । দিনের আলোয় তোর সামনে শাড়ি-ব্লাউজ খুলে দাঁড়ালে সারা ঘর আলোয় আলো হয়ে যাবে, ভালো না বেসে পারবি না ।
–ভালোবাসা, বলেছো ভালো । আমার এক বন্ধু বলে মাংসামাংসি ।
–ওই দ্যাখ, রামায়ণের অন্য ক্যারেকটারদের, একটার কাছে সবাই যাবে নাকি রে ? হোলসেল রেট পাবে মনে হচ্ছে। রূপক মজুমদারকে দেখতে পাচ্ছিস । তোর মনে আছে ? কেতুর পড়ার ঘরে ডিং হেঁকেছিল যে বেপাড়ার মেয়েদের ওইতে হাত দেবে না, এখন তো রসে-রসে টইটুম্বুর, ওইতে ওই দিতে চলেছেন । ওই দ্যাখ বসন্ত বাঁড়ুজ্জে না মুকুজ্জে, আর ওটা সাবর্ণীচরণ, লেকালিকি করে না, রামায়ণের স্যাঙাত হয়ে ঘোরে । ওই ঘাড়ে-গর্দানেটা কে রে ?
–উনি মিস্টার রায় । আর অন্যজন অর্ণব মুখোপাধ্যায় ।
–উঁচু মক্কেল । খড়মের পাহারাদার ! শরৎ চাটুজ্জের পর আবার চাটুজ্জে বাঁড়ুজ্জে মুকুজ্জে গাঙ্গুলিরা এসব পাড়াকে আলো বিলোতে এয়েচে ।
–আসল লোককে দেখছি না ? সীতাকে তো ইউরোপের নন্দনকাননে ফেলে চলে এসেছেন ।
–ওই তো, হ্যাঃ, ধুতি-পাঞ্জাবিতে, হাতে আবার গোড়ের মালা, শরৎ চাটুজ্জের গদির তালে আছে । আর ওটাও কে একজন চাটুজ্জে, ওই যে, কালো শার্ট কালো প্যান্ট, রামায়ণের আরেকটা ক্যারেকটার, ওদের সঙ্গেই আসে । আরে,
রাজপুত্তুরই তো নন্দনপালঙ্কে প্রথমে ঢুকে গেল রে । চল, কেটে পড়ি, বারান্দায় গুলতানি করবে ওরা, সিগারেট-মিগারেট
ফুঁকবে, তখন এদিকে চোখ পড়লেই তোকে দেখে ফেলবে । আমার তো বদনামের ভয়ডর নেই, তোরই মুশকিল । কফিহাউস থেকে ছড়াবে ।
–বদনাম ? কী বলছ কি, হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি বেঁধে রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল গোটাকতক চোর-ডাকাত-খুনির সঙ্গে ।
–যা বলেছিস, আমার বাপটাই তো বদনাম, বদনামের বাপ ।
ঝন্টুর বাবা পাঁচকড়ি যৌবনে ছিলেন হেদোর কর্মকর্তা, অবিভক্ত বাংলার বিখ্যাত অ্যামেচার সাঁতারু । কলকাতার মাংসামাংসি জগতে ঢুকেছিলেন চাকরির উপরি খরচ করতে । ম্যানেজিং এজেন্সিতে তাঁর কাজ ছিল মাল কেনা-বিক্রি করার দরপত্র আহ্বান, খোলা, অর্ডার দেয়া বা নেয়া । লক্ষ-লক্ষ টাকার ব্যাপার, টন-টন মালপত্রের লেনদেন, জাহাজভরা সাপ্লাই। ঘুষের টাকা অঢেল । সোনাগাছির বাঁধা খদ্দের । ঘোড়দৌড়ের মাঠের জুয়াড়ি । সাঁতার কাটার সুবিধার জন্য এক-আধ ঢোঁক দিশি মদ গিলতেন, যাকে উনি বলতেন ধান্যেশ্বরী । খাঁটি স্কচ বা সিংগল মল্ট উপঢৌকন পেলেও নিতেন না । বলতেন, ধান্যেশ্বরী তো মাকালীর আরেক রূপ, নিজের মাকে ছেড়ে কেন বিদিশির পেচন-পেচন ঘুরব । মারোয়াড়ি ব্যাবসাদারদের অবদান হিসেবে পাঁচকড়িবাবুর পরিচয় হল থিয়েটারের ব্যাকস্টেজ এক্সট্রা যুবতীদের সঙ্গে । তাদের সূত্রে সোনাগাছি-বৌবাজারে উত্তরণ । ওনার যৌবনে সোনাগাছির এক-একটা বাড়ি এক-একজন যৌনকর্মীর নামে খ্যাত ছিল, রাধারানির বাড়ি, চারুমতির বাড়ি, সুখময়ীর বাড়ি, যে বাড়িগুলো ঝণ্টুর সময়ে পৌঁছে অমুক-মাসি তমুক-মাসির বাড়ি হয়ে গেছে ।
–ওটা কার বাড়ি ঝন্টুদা ? জিগ্যেস করল রাহুল । রাধারানি, চারুমতি…
ঝন্টু বলল, ফিসফিসিয়ে, ওরা যেটায় গেছে সেটার নাম পাকিস্তানি মাসির বাড়ি ।
–পাকিস্তানি ? কী বলছ কি ? এখানে আবার পাকিস্তান এলো কোথ্থেকে । দেখছ তো যারা পাকিস্তান থেকে এসেছে তাদের বাঁচার লড়াইতে প্রফুল্ল সেন নাজেহাল ।
–ওই জন্যেই তো বলছি । পাকিস্তানিরা রেপ করে কচি-কচি হিন্দু মেয়েদের নষ্ট করার পর তারা এপারে পালিয়ে এসে আড়কআঠিদের খপ্পরে পড়ে । আড়কাঠিদের থেকে এই মাসি ভালো দেখতে ফর্সা মেয়েগুলোকে কিনে নিচ্ছে । জমানো পয়সা আছে কাঁড়ি-কাঁড়ি, দুবার তো খুন হতে-হতে বেঁচেছে, ভেড়ুয়াগুলোর জন্যে বেঁচে গেছে । তোকে একদিন দুপুরে নিয়ে যাব । আমার বাবা ওর বাবু ছিল এককালে । ওর ঘরে ফোটো দেখলে মনে হবে খুকি বয়সের সন্ধ্যারানি দেবী, অ্যাঃ ।
–তোমাকে দেখাতে হবে না । আমরা জর্জ ফ্রেজার নামে এক বিটনিককে নিয়ে ওদিকের একটা বাড়িতে গিয়েছিলুম। জর্জের শখ হয়েছিল বাঙালি মেয়ের সঙ্গে শোবার । এক-দু দিনের জন্যে ভারতে এসে তো আর প্রেম হয় না, তাই ।
–ও, তুইও তাহলে এদের বিছানায় শুয়েছিস ?
–না, শুইনি । এখানের বিছানায় শুলে আমার লিঙ্গ দাঁড়াবে না । কোনো মেয়ের সম্পর্কে আমার ধারণা ভালো না হলে আমার লিঙ্গ দাঁড়ায় না ।
–তোর আবার লিঙ্গ হবার বয়স হয়েছে নাকি ; এখনও তুই খোকানুনুর বয়সে আছিস। একটু বয়স হোক, তারপর দেখিস ; ফেলবি কড়ি আর মাখাবি তেল, মাখবি নয়, মাখাবি ।
সত্তরোর্ধ রাহুলের মনে পড়ল, পাকিস্তান হবার সময়ে যেমন রেপের শিকার মেয়েরা প্রাণ বাঁচাবার জন্য এপারে পালিয়ে আসত, ঠিক তেমনই, যখন পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হবার লড়াই আরম্ভ হল, তখনও, রেপ-করা মেয়েরা পালিয়ে এসেছে প্রাণ বাঁচাবার জন্য । পাকিস্তান হবার সময়ে হিন্দু বাড়ির মেয়েরা এসেছিল । পাকিস্তান ভাঙার সময়ে হিন্দু-মুসলমান দু’ধর্মের মেয়েরা এসেছিল । তাহলে, পাকিস্তানি মাসির জায়গায় কি কোনো বাংলাদেশি মাসি বসতে আরম্ভ করেছিল ? কে জানে ! ঝন্টুদা তো চলে গেছেন লাহেরিয়াসরায়ের শ্মশানে ; পাকিস্তানি মাসিও চলে গিয়ে থাকবেন নিমতলায় ।
ঝন্টুদার কথা শুনে রাহুল বলল, না, আমার এই পাড়াগুলো পর্যটকদের মতন ঘুরে-ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করে, কারোর সঙ্গে শোবার ইচ্ছে হয় না । পরে, বিদেশে গিয়ে, বিশেষ করে অ্যামস্টারডমে, রাহুল গিয়েছিল অমন এক পাড়ায় পরিক্রমণ-পর্যটনে। ওর বয়স তখন কত, মমমমমমম, কত হবে, থাকগে,, যা-ই হোক না কেন, কী-ই বা এসে যায় । পাড়াটার নাম ‘দ্য ওয়ালেন’ বা খালপাড় : খালে সাঁতরে বেড়াচ্ছে রাঁজহাঁস । পর্যটনের জন্য একটা সংস্হা আছে ওই
পাড়ায় । পর্যটকরা, মহিলা গাইডের, যিনি নিজে এককালে পাড়াটিতে যৌনকর্মী ছিলেন, তাঁর পেছন-পেছন, সেই খালের নৌকো থেকে নেমে,পাড়ার এগলি-সেগলি ঘুরতে-ঘুরতে ওপর দিকে তাকিয়ে, একতলায় চোখ বুলিয়ে, এটা-ওটা হাতে নিয়ে, দেখে বেড়ান চারিদিক ।
পথের দুপাশে, নীল-লাল-হলুদ ঝিলমিলে আলোয়, নিচে তলায়, সরকার অনুমোদিত গাঁজার দোকান, একা-একা যৌনকর্মের টুকিটাকি সাজ-সরঞ্জামের দোকান, অহরহ-চালু যৌনকর্ম দেখার দোকান, সবুজ বা ফিকে-সবুজ আবসাঁথ যা র্যাঁবো-বদল্যারের প্রিয় ছিল তা পান করার দোকান, যৌনকর্মের ফিল্ম-ডিভিডি-সিডির দোকান, কিনে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য ফোলানো যায় এরকম রবারের যুবতী বা রবারের যুবকের দোকান । ওপরতলায় বিশাল জানালায়, ফিকে লাল আলোয়, প্রৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ থেকে আনা, প্রায়-নগ্ন যুবতীরা, বসে আছে খদ্দের আকৃষ্ট করার জন্য । রেস্তরাঁর মেনুর মতন, যেমন যৌনকর্ম, তার তেমন দাম বাঁধা, সময়ও নির্দিষ্ট । ওরা যখন মহিলা গাইডের পেছন-পেছন যাচ্ছিল, আরেকটু হলেই এক যুবক গাইডের গায়ের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ত । গাইড সেই যুবকটির হাত ধরে গ্র্যানাইট-বেছানো পথে বসানো একটা ভাস্কর্য দেখালেন, যেটিতে যুবক হোঁচট খেয়েছিল ।
ব্রোঞ্জের তৈরি ভাস্কর্য, মাই টিপতে উদ্যত পুরুষের হাত । হাজার হাজার আদেখলা পুরুষ তার ওপর দিয়ে হেঁটে, তাকে ঝকঝকে করে তুলেছে ।
আরেকবার পর্যটনে গিয়েছিল থাইল্যাণ্ডে । সেখানের হট জোন নামের এলাকায়, সারি-সারি কাচের শোকেসে দাঁড়িয়ে আছে, নগ্নবুক, সরু জাঙিয়া পরা তরুণী-কিশোরীর দল, আলু-পটল বাছাই করার মতন তাদের মধ্যে যাকে চাই বেছে নাও । অ্যামস্টারডমের মতন অমন দোকানপত্তর নেই, আছে রেস্তরাঁ আর বার । রেস্তরাঁয় পাওয়া যায় সব রকমের মাংস, কুমির, তিমি, অক্টোপাস, সাপ, হাঙর, কাঙ্গারু, আরও অজানা জীবজন্তুর ।
ঝণ্টুদা সেদিন বলেছিল, ওঃ, জানিস তাহলে , আমি ভেবেছিলুম এখনও ন্যালাক্যাবলা বোকা হাঁদা গঙ্গারাম থেকে গেছিস ।
অঞ্জলি রাহুলকে সেই স্কুলের দিন থেকে বোকা, ক্যাবলা, আনস্মার্ট বলে এসেছে বটে ।
ফোনে কোনো সাড়া না পেয়ে অঞ্জলির যাদবপুরের ঠিকানায় গিয়েছিল রাহুল । অমন কোনো বাড়িই পেল না খুঁজে, ওই নামের রাস্তা নেই, বাস ডিপোর আশে-পাশের গলিতে বর্ণনা দেয়া সত্ত্বেও, হদিশ দিতে পারল না কেউ, অঞ্জলির মতো কোনো যুবতীর ।”সরু কোমরের যুবতী এ-পাড়ায় নেই, আপনি যে বলছেন, কোমর সরু আর বুক-পাছার মাপ ভারি, অমন মেয়ে এদিকে পাবেন না”, বলে, স্মিত হাসি বিলিয়েছিল একজন টাকমাথা পথচারী ।
আলিপুরের সেই ফ্ল্যাটেও গিয়েছিল রাহুল । পেটের ওপর গেঞ্জি ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলেন এক মারোয়াড়ি, আর কয়েকটা গোলগাল কিশোর-কিশোরী ; জানালেন যে যারা ভাড়া নিয়েছিল তারা উঠে গেছে, কোথায় গেছে তা জানেন না। রাহুল স্তম্ভিত । ঘটনাটা সত্যিই ঘটেছিল তো, নাকি হ্যাশিশের নেশা দিয়ে গড়ে তুলেছিল অঞ্জলিকে ! কী করেই বা সম্ভব । অঞ্জলির উপহার দেয়া চামড়ার পার্সটা তো ওর হিপ পকেটে রাখা ।
অঞ্জলির আরেকবার অন্তর্ধানের সংবাদে রাহুলের যা ঘটল, তা হয়ত চিত্তবিক্ষোভ ।
যেখানেই পোস্টেড থাকুক না কেন, বছরে এক দিন, ১৬ই মার্চ দুপুর দেড়টার সময় গড়িয়াহাটের মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে থেকেছে রাহুল সিংহ, বিয়ে করার আগে পর্যন্ত , যদি, যদি, যদি, যদি, যদি, যদি, অঞ্জলির দেখা মেলে ।
মেলেনি ।
গড়িয়াহাট মোড়ের চেহারা পালটে গেছে, ফ্লাইওভার হয়েছে, ফুটপাতে আর হাঁটা যায় না, রাসবেহারির দোকানগুলো চলে গেছে অবাঙালিদের কবজায়, অঞ্জলির দেখা মেলেনি ।
অথচ যে মেয়েটি রাহুলকে চেয়েছিল, দিল্লি অফিসে ওর অধস্তন অফিসার সুরেখা রেড্ডি, মমমমমমম, রাহুলের বয়স তখন কত, যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায়, রাহুলের চেয়ে উনিশ বছরের ছোটো, রাহুলকে পাবার জন্য উন্মাদ, তাকে তো রাহুল প্রশ্রয় দেয়নি, তাহলে কেন ও নিজে চেয়েছে অঞ্জলি দাশ ওকে প্রশ্রয় দিক । সুরেখা রেড্ডি প্রতিদিন বাংলা তাঁতের শাড়ি পরে আসত অফিসে, একদিন শাঁখা-রুলি পরেও এসেছিল, সহকর্মীদের টিটকিরি সইত, তা যে রাহুলকে ইমপ্রেস করার জন্য, পরে জেনেছিল ও । ঢ্যাঙা, ময়লা, দীর্ঘ চুল, চুলে সুগন্ধী ফুল, ইংরেজি স্কুলের দ্রুত কথা বলার অভ্যাসে রপ্ত ।
একদিন, ট্যুরে আজমের যাবার জন্য আইটিবিপি বাস স্ট্যান্ডে টিকিট কাটবে বলে নির্দিষ্ট খিড়কির কাছে পৌঁছে দ্যাখে সুরেখা রেড্ডি দাঁড়িয়ে । ডেনিমের ট্রাউজারে, পিঠে রাকস্যাক, সিনথেটিক জ্যাকেট । রাহুলের কবজি ধরে,
পরিষ্কার বাংলায় বলল, স্যার, আমি দুটো টিকিট কেটে রেখেছি, সামনের সিট, চলুন, ওই যে আমাদের বাস ।
রাহুল হতবাক । কোনো তরুণী ওর হাত ধরলে যে আচমকা ক্রোধে আক্রান্ত হতে পারে, তা নিজের মধ্যে আবিষ্কার করল । রাগে ওর কানের দু’পাশ দপদপ করতে লাগল ।
–তুমি বাংলা জানো ? বলল রাহুল । ভাবল, এরকম কেন হয়, এই অন্তরঙ্গ অর্জন যা চাই না, বিষাদের আত্মময়তা, অতীতের অপসৃয়মান শঙ্খধ্বনির আহ্বান, যা শুনতে চাই না, গন্তব্যহীনতার ছকে রাখা পথ, যে রাস্তায়
হাঁটার মতন ফুরসত অবশিষ্ট নেই, হিসেবনিকেশহীনতা, যা অপরিচিত হয়ে গেছে, স্পন্দিত দ্যুতির সর্বস্বতা-বিস্তারী টান, যার চুম্বকত্ব ও ফেলে দিয়েছে, সময়কে অসময়ে রূপান্তরণ, যে ক্ষমতা কবেই বিসর্জিত ।
হঠাৎ, কোথা থেকে এই যুবতী, এবং কেনই বা ! উল্লসিত দেহ-জাগরণের এ কোন নিমন্ত্রণ ! ও তো চুলে কলপও লাগায় না, পোশাক সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ নেই, পারফিউম-পাউডার লাগায় না— অভীপ্সাহীন দিনানুদৈনিকের অনতিক্রম্য প্রকৃতিজগতে চলে গেছে বহুকাল, লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছে প্রায় দেড় দশক । সর্বোপরি, প্রায় প্রায় প্রায় ভুলে গেছে অঞ্জলিকে দাশ নামের মেয়েটিকে । এখন অঞ্জলি ওর সামনে এসে দাঁড়ালেও পরস্পরকে চিনতে পারবে না । অভিকর্ষহীন হয়ে গেছে, বুঝতে পারবে দুজনে দুজনকে দেখে ।
এই মেয়েটি, সুরেখা রেড্ডি, ওর, রাহুলের, কেবিনে এসে কোনে রাখা চেয়ারে বসে থাকত কখনও-কখনও । ইয়েস মিস, জিগ্যেস করলে বলত, নাথিং ইমপরট্যান্ট স্যার, আই শ্যাল কাম আফটারওয়র্ডস । রাহুল সেসময়ে বুঝতে পারেনি যে ওর কেবিনে অফিসারদের অবিরাম আসা-যাওয়ার সুযোগ নিয়ে মেয়েটি ওর দিকে তাকিয়ে বসে থাকে । কেবিনের দরোজা খোলা রেখে তাহলে উচিত কাজই করত রাহুল । নয়ত বন্ধ কেবিনে হাত চেপে ধরে কী করে ফেলত কে জানে ।
রাহুল, বিপদ থেকে কী করে বেরোবে, তা সমান্তরাল চিন্তায় বিশ্লেষণ করে, নির্ণয় নেবার সময়টুকু হাতে পাবার জন্য, একই প্রসঙ্গ আবার তুলল, ইংরেজিতে জিগ্যেস করল, তুমি বাংলা শিখলে কোথায় ?
আমার মা বাঙালি স্যার । চলুন না , যাবার পথে গল্প করব ।
রাহুল বেকায়দায় । আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, নিশ্চিত হবার জন্য, পরিচিত কেউ নেই তো । বলল, ইংরেজিতেই, আমি তো ট্যুরে যাচ্ছি, তুমি কী করবে সঙ্গে গিয়ে ? অফিস তো কোনো অ্যাসিসট্যান্ট দেয়নি, আমি সহায়ক নিয়ে কাজ করতে পারি না ।
মেয়েটি চাপা গলায়, রাহুল টের পেল যে কন্ঠস্বর আবেগে ক্রুদ্ধ, বলল, আই লাভ ইউ, ইয়েস, আমি আপনাকে ভালোবাসি। ইফ ইউ ফিল লাইক, ইউ মে কল ইট লাস্ট ; আমি আপনাকে চাই ।
হাত ছাড়ো, ট্যুরে যাচ্ছি না । ‘কেউ দেখে ফেলতে পারে’, কথাগুলো বলা উচিত হবে না মনে করে চেপে গেল । বলল, ইংরেজিতেই, বাংলায় কথা বলছ, এখানে বাংলাদেশিরাও রয়েছেন, আজমের শরিফে তীর্থ করতে যাবার জন্য ।
নারীসঙ্গ থেকে যতটা সম্ভব নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসে সফল হবার অলস গোমানুষ আনন্দে ছিল এতকাল । কোথা থেকে এই মেয়েটা উদয় হয়ে ওর শান্ত একাকীত্বকে নড়বড়ে করে দিতে চাইছে । ট্যুরে-ট্যুরে ভারতবর্ষের প্রেমে এমনই মশগুল যে অন্য কোনো কিছু আর ওকে আকৃষ্ট করে না । বাউলদের বোধহয় এরকমই হয়, পথে-পথে ঘোরাঘুরি করে, নানা ধরণের মানুষদের সঙ্গে মিশতে-মিশতে — একাকীত্বের পরিসরে আত্মলীন ।
ট্যুরে না যেতে চান যাবেন না, ছুটি নিন, আমি বললাম না আপনাকে, যে আমি আপনাকে ভালোবাসি । আমি আপনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেবো । আপনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমার সঙ্গে থাকবেন, যদি বলেন তাহলে এখনই আমরা কোথাও চলে যেতে পারি । উধাও হয়ে যাবো । আমি আপনাকে চাই ।
কী করবে বুঝে উঠতে পারল না রাহুল , এ কি পাগল, কোনো রোগ নেই তো এর, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে, হয়তো কাউকে কিছু না বলে । প্রেমে পড়ার রসদ রাহুলের মনে হল, সবই ও খরচ করে ফেলেছে । এই যুবতীর, যার স্মাগলিং বা অঞ্জলি-জাতীয় কোনো গোপনতার সঙ্গে সংস্রব নেই বলে মনে হচ্ছে, তার প্রস্তাব আরও কুড়ি বছর আগে পেলে হয়তো ও পিছলে যেতে পারত । এখন তো মগজ একেবারে ফাঁকা — উত্তেজনার গ্রন্হিগুলো অকেজো । স্কুলের শিক্ষকরা ওকে বলতেন অ্যাম্বিশানহীন ; ও এখনও তা-ই রয়ে গেছে, উচ্চাকাঙ্খাহীন । নারীর কোনো জায়গা ওর জীবনে আর নেই। ইজিচেয়ারে ঠ্যাং তুলে, চোখ বুজে, ও এখন বাড়ির বাগানে একা বসে থাকতে ভালোবাসে, প্রজাপতিদের ডানাগুঞ্জন শুনতে পায়, ভেঙেপড়া সোভিয়েত দেশ থেকে ভরতপুরের দিকে উড়ন্ত সারসদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালোবাসে, ও চায় যে কেউ যেন ডিস্টার্ব না করে ।
সুরেখা বলল, আমি আজমের গেছি স্যার, আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না, অনেক ভালো-ভালো লজ আছে,
আমরা আজমের শরিফে গিয়ে চাদরও চড়াতে পারব । চলুন, চলুন, কন্ডাক্টার যাত্রীদের ডাক দিচ্ছে, ওই যে, হর্ন বাজাচ্ছে।
রাহুলের কানে পৃথিবীর কোনো শব্দ প্রবেশ করছিল না । রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমম, বোধহয় কত হবে, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । কি করে এই পাগল অফিসারকে কাটাবে দ্রুত ভাবার চেষ্টা করছিল । ব্রিফকেস বাঁ হাতের ওপর রেখে ডালা খুলে বলল, ইংরেজিতেই, আরে, আমি তো রিপোর্টের ফরম্যাট আনতে ভুলে গেছি ।
তুমি যাবে বলে মনস্হ করেছিলে তো একটা ডুপলিকেট ফরম্যাট রেখে নিতে পারতে । যাকগে, আজকে ট্যুরটা ড্রপ করে দিই, আবার অ্যাপ্রুভাল নিয়ে পরে যাবো । রিপোর্টের কোনো ফরম্যাট হয় না, সুরেখা ধরতে পারল না, ওর স্তরে এই সমস্ত গুরুগম্ভীর ব্যাপার পৌঁছোয় না ।
–টিকিট তো কাটাই আছে স্যার, চলুন না জাস্ট বেড়িয়ে আসি, দুজনে এক সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাবো ।
–একে তো ট্যুরে যাচ্ছি না, তার ওপর যদি ছুটি নিয়ে বেড়াতে যাই, জানতে পারলে ডায়রেকটার পারফাংকটারি ডিউটির অভিযোগে চার্জশিট করে দেবেন ; তুমি তো বেঁচে যাবে, আমি দায়িত্বজ্ঞানহীনতার দায়ে পড়ব । আর, সুস্পষ্ট বলল রাহুল, স্ক্যান্ডাল ক্রিয়েট হবে, হাত ছেড়ে দাও, কী করছ কি । জানো না কি আমার ছেলে আর মেয়ে স্কুলে পড়ে ?
–জানি, আমি আপনার স্ত্রীকেও একদিন বলেছি যে আমি আপনাকে পছন্দ করি ।
কী বিপদ । এই মেয়েটা ওর জীবনপ্রবাহে বাঁধ তোলার চেষ্টা করেছে তলে-তলে, আর ও কিচ্ছু টের পায়নি । প্রত্যেকদিন নজর রেখেছে হয়তো, চেয়ে-চেয়ে দেখেছে ও কী করছে, কবে কোথায় ট্যুরে যাচ্ছে, একা যাচ্ছে না কারোকে সঙ্গে নিয়ে ।
–তুমি বাড়ি যাও । আমি জোর করে হাত ছাড়িয়ে সিন ক্রিয়েট করতে চাই না । আমার স্ত্রীকে বিপন্ন করার চেষ্টা করে ভালো করোনি ।
–তাতে কি স্যার ? আমি পুরো রেসপনসিবিলিটি নেবো । আমার বাবার জমিজমা আছে প্রচুর, আমিও চাকরি করছি । কোনো প্রবলেম হবে না ।
‘হাত ছাড়ো’, কন্ঠস্বরে অধস্তনকে বকুনি-মেশানো চাউনি মেলে বলল রাহুল ।
সুরেখা হাত ছেড়ে দিয়েছিল । ওর হাত থেকে টিকিট দুটো নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিল রাহুল, আর সোজা গিয়ে একটা অটোয় বসে বাড়ি চলে গিয়েছিল ।
সুরেখা পরের দিন অফিসে আসেনি; দুপুর নাগাদ ওর বাড়ি থেকে সংবাদ এলো যে টয়লেটের অ্যাসিড খেয়ে আত্মহত্যা করেছে সুরেখা রেড্ডি ।
কোনো সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে কি, জানতে চেয়েছিল আতঙ্কিত রাহুল ।
না, পাওয়া যায়নি । ওর মা-বাবাও জানেন না কেন অমন কাজ করতে গেল ।
ভাগ্যিস সুরেখার হাত থেকে বাসের টিকিট দুটো নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল । পুলিশ নির্ঘাত সুরেখার আজমেরের সঙ্গে রাহুলের আজমেরের মিল খুঁজে পেত ।
বেশ কয়েকদিন পরে সুরেখার লেখা দীর্ঘ প্রেমপত্র, যা ও সম্ভবত কয়েকমাস ধরে লিখেছে, ডাকে পেয়েছিল রাহুল। বাংলা অক্ষর, কিন্তু তেলুগু টানে পাকানো হাতের লেখা । চিঠি আর রাখে না রাহুল, সমস্ত চিঠিই পড়ার পর ছিঁড়ে ফেলে দ্যায় ও । সুরেখার চিঠি সংস্কৃত অভিধানের ভেতরে লুকিয়ে রেখে দিয়েছিল, বহুকাল, ভুগেছে দুশ্চিন্তায়, আমিই কি দায়ি, আমিই কি দায়ি, আমিই কি সুরেখার মৃত্যুর জন্য দায়ি ? এই অপরাধবোধ থেকে মুক্তির উপায় কি হতে পারে ভেবেছে, ভেবেছে, তারপর একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখেছে সুরেখাকে কল্পনা করে, সেই উপন্যাসে নিজেকে পিঁপড়ে আর কুকুর দিয়ে খাইয়েছে রাহুল, আর, আর হ্যাঁ, অদ্ভুত, ওর মনের ভেতরে যে পিঁপড়ে আর কুকুররা ওকে খেয়ে ফেলছিল এতকাল, তা থেকে মুক্তি পেয়েছে । অনেকদিন ধরে ও পিঁপড়ে আর পিট বুল কুকুরের সামনে নিজেকে মনে-মনে ছেড়ে দিয়েছিল ; শেষ পর্যন্ত লিখে ফেলল, কাউকে কিছু জানতে না দিয়ে ।
ডিটেকটিভ উপন্যাসটা প্রকাশিত হবার পর সুরেখার চিঠি, শেষবার পড়ে, যা রাহুলের প্রায় মুখস্হ হয়ে গিয়েছিল, ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল জুহুর সমুদ্রে । কত তফাত সুরেখার প্রাণবন্ত চিঠির সঙ্গে অঞ্জলির মেকি চিঠির ।
সুরেখার আত্মহত্যার পরই রাহুলের মাও মারা গেলেন । ভেঙে-পড়া কাকে বলে তার আগে ও জানত না । অঞ্জলি স্মাগলারকে বিয়ে করেছে জেনেও ভেঙে পড়েনি । রাস্তা দিয়ে হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি বেঁধে যখন নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখনও ও ভেঙে পড়েনি। মামলায় বন্ধুরা বিশ্বাসঘাতকতা করলেও ভেঙে পড়েনি । মায়ের মৃত্যুতে ভেঙে
পড়ল । কেঁদে নেবার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল রাস্তার একপাশে ।
মায়ের মৃত্যু আর সুরেখার আত্মহত্যার পর থেকেই আবার লেখেলিখি ফিরে এলো রাহুলের কলমে, ভাঙা-ভাঙা ছন্দে, কোনো নারীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেবার রচনা, নিজেকে স্বাধীনতা দেবার রচনা, ট্যুরে পাওয়া দুর্বিষহ ঘটনা থেকে চাগিয়ে ওঠা রচনা । বাংলা ভাষায় কেমনতর অপেরা লেখালিখি সেসময়ে হচ্ছে তার কোনো হদিশ ওর ছিল না, কেননা পত্রপত্রিকা পড়া ছেড়ে দিয়েছিল বহুকাল ।
ঢাকার এক সম্পাদক, মাহমুদ রহমান, কোথা থেকে ওর ঠিকানা যোগাড় করে অবিরাম অনুরোধ করছিলেন লেখা পাঠাবার জন্য । কয়েকমাসে কয়েকটা অপেরাপ্রতিম লেখা লিখে রাহুল পাঠিয়ে দিয়েছিল , আর ভুলে গিয়েছিল । অনুমান করতে পারেনি যে সেগুলো ঢাকায় প্রকাশিত হবার পর সেখানকার অন্যান্য লিটল ম্যগাজিন সম্পাদকরা ওকে অবিরাম চিঠি লিখতে থাকবেন লেখা পাঠাবার অনুরোধ জানিয়ে ; স্মৃতিকথা লেখার অনুরোধ জানাবেন এক বৃদ্ধ সম্পাদক ।
উৎসাহিত রাহুল নেমে পড়ল নিজের একাকীত্বের কুয়োর ভেতরে, টের পেল যে ওর লেখার ধারা পালটে গেছে, তাতে আন্দোলনের তাপস্নিগ্ধ আত্মস্বীকৃতির রেশ আর নেই । তার বদলে উঠে এসেছে ট্যুরে পাওয়া, অন্যের জীবনের বা শহর-গ্রামের কারোর অঘটন-দুর্ঘটনার বিপর্যয় ।
আবার লিখতে আরম্ভ করে, রাহুল তখন জয়পুরে, ওর অজান্তে, হিন্দি ভাষার পত্রপত্রিকায় ওর ফোটো আর আন্দোলনের সংবাদ পুনঃপ্রকাশিত হতে থাকায় , ও তখন বিভাগীয় প্রধান, আকর্ষণ গড়ে ফেলেছিল অপরূপা হিন্দি-ভাষী এক তরুণী কর্মীর দৃষ্টিতে । ওর লেখালিখি বারবার গোলমাল সৃষ্টি করেছে, ওর জীবনে তো বটেই, অন্যের জীবনেও । সেই তরুণীর নাম সঙ্গীতা মনসুখানি ।
অফিস টাইম শেষ হবার পরও ঘণ্টা দেড়েক বসেছিল রাহুল ; বেসমেন্ট থেকে গাড়ি বের করতে ওর অধস্তন কর্মচারী, যার গাড়িতে ও বাসায় ফেরে, হায়দার হুসেইনের সময় লাগবে, অবসর নেবার বয়সে পৌঁছে গেছে লোকটা । স্লোপে রিভার্স করে সহজে গাড়ি তুলতে পারে না ওপরে । কেবিনে বসে গাড়িটার বেগড়বাঁই শুনতে পায় । হায়দার হুসেইনের হর্ণ না বাজা পর্যন্ত আরও কয়েকটা ফাইল ক্লিয়ার করে নিতে পারে, অনায়াসে । হঠাৎ ফুঁপিয়ে কান্নার মেয়েলি আওয়াজ । উইনডো এসিটা শব্দ করে বলে, বন্ধ করে উৎকর্ণ হল রাহুল । হ্যাঁ, ঠিক তাই, চাপা কান্না ।
কেবিন থেকে হলঘরে বেরিয়ে রাহুল দেখল সব আলো জ্বলছে, ফ্যানগুলো চলছে, সানমাইকার অত্যুজ্বল কিউবিকলগুলো ফাঁকা । বিভাগীয় প্রধান হবার দরুন প্রতিদিন ও মাথা ঘুরিয়ে একবার চারিদিকে না তাকিয়ে পারে না, অভ্যাসমতো চাউনি যেতেই, দেখল সঙ্গীতা মনসুখানি, বিষন্ন সুন্দরী, ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে । চোখ তুলে রাহুলের দিকে তাকাতেই ছাঁৎ-করার বোধে আক্রান্ত হল ও । বিভাগের প্রধান হিসাবে দূরত্ব বজায় রাখতে হয় বলে কখনও কথা বলেনি। সুমিতাদির পর, এত সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ওর হয়নি আজও । কান্নাটা বেশ সিরিয়াস । কী করবে ও । মোবাইলে হায়দার হুসেইনকে দ্রুত ওপরে আসতে বলল ; মেয়েটির ডেস্কের উল্টো দিকে দাঁড়াল গিয়ে, আর কাঁপা কন্ঠস্বরে জিগ্যেস করল, ‘কী হল মিস মনসুখানি, কাঁদছেন কেন ? বাড়ি যাননি কেন ? কী হয়েছে কী ? কমপ্লেন করলেই তো পারতেন । সামথিং পার্সোনাল ? অসুবিধা না থাকলে আমায় বলুন । দেখি কী করতে পারি ।
মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে, সুমিতাদির পর আরেকবার, অপরূপ শব্দটার মানে স্পষ্ট হয়েছিল রাহুলের । কী ফর্সা । টকটকে লিপ্সটিক । গভীর চোখ। ছোট্টো কপাল । কোঁকড়া চুলে মেক্সিকান বিনুনি । ম্যানিকিওর করা নখে টকটকে নেলপালিশ । কানে পান্নার দুল । গলায় সোনার হারে বড়ো মাপের পান্নার লকেট । ছোট্টো হাতঘড়ি । বাঁ হাতের সব আঙুলেই আজকালকার আংটি, বুড়ো আঙুলেও । ঝিরিঝিরি বিদেশি পারফিউম । তার মানে মাইনের অনেকটা সাজগোজে যায় । গলা-খোলা সবুজ ডিজাইনার পোশাকটারই যথেষ্ট দাম হবে ।
হায়দার হুসেইন হন্তদন্ত এসে হাঁপাতে-হাঁপাতে মেয়েটিকে জিগ্যেস করল, ‘আয়া কোথায় ? আয়া আসেনি এখনও?’
হায়দারকে দেখে আত্মস্হ মেয়েটি বলল, আয়া তিনটের সময় এক্ষুনি আসছি বলে এখনও আসেনি, মাকে ফোন করেছিলাম, বাড়িতেও যায়নি । কথা শেষে আলতো ফুঁপিয়ে ওঠে তরুণী ।
কেঁদো না, কেঁদো না, আমি তোমার হুইলচেয়ার আনছি । বলে, রাহুলের হাত ধরে লিফটের দরোজার কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে হায়দার হুসেইন বলেছিল, সঙ্গীতা মনসুখানি কোমরের তলা থেকে বিকলাঙ্গ , পা দুটো নেই বললেই চলে, চাকরি পেয়েছে প্রতিবন্ধি কোটায়, প্রাইভেটে পড়ে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর, একাডেমিক রেকর্ড ভালো, চব্বিশ ঘণ্টার আয়া আছে, সে-ই ওকে অফিসে আনে আর নিয়ে যায়, অফিসে বাড়িতে বাথরুম করায়, বাবা নেই, মা স্কুল টিচার
ছিলেন, ওর হুইলচেয়ার বা প্রতিবন্ধি পুশকার্টটা বেসমেন্টে রেখে যায় আয়া, হয়তো কোথাও গিয়ে আটকে পড়েছে, এরকম ব্যাপার তো ঘটেনি কখনও আগে, এমনিতে তো ও সকলের আগে সাড়ে চারটের সময়েই চলে যায়, আমি ওর পুশকার্টটা আনছি ।
বোকা-বোকা, অসহায়, কর্তত্বের অনুপযুক্ত মনে হয়েছিল নিজেকে, রাহুল সিংহের, হায়দার হুসেইনকে নিয়ে লিফট নিচে নেমে যাবার পর । অধস্তন স্টাফদের ব্যক্তিগত সমস্যাকে আমল দেয়নি । দৃশ্যমান অর্ধেকটুকু দেখে, মেয়েটি সম্পর্কে রঙিন ছবি এঁকে ফেলেছিল মগজে, অথচ জীবনের নিষ্পত্তি হচ্ছে বাকি অর্ধেকটা দিয়ে, যা টেবিলের আড়ালে
থেকে গেছে ।
অর্ধেক সুমিতাদি ! বাকি অর্ধেক খেয়ে ফেলেছে বিপ্লবের স্বপ্ন !
বিকলাঙ্গের ঠেলাগাড়ি, বিশেষভাবে তৈরি, পেরাম্বুলেটারের আকারে, নিয়ে ঘর্মাক্ত হায়দার পৌঁছোলে, দুজনে মুখ চাওয়া-চায়ি করে যে অনুচ্চারিত কথাগুলো বলল, মেয়েটিকে তুলে ওর গাড়িতে বসাতে হবে, তা তো ভাবিনি, কে তুলবে, কী ভাবে ?
হায়দার বলেছিল, স্যার, আমি গতবছর বাইপাস করিয়েছি, তাছাড়া এখনও হিন্দু-মুসলমান রাজনৈতিক গোলমালের রেশ মেটেনি, কী থেকে যে কী ঘটে যায় আজকাল তার ঠিক নেই, তখন মেয়েটি বলেছিল, স্যার, আমি আরেকটু অপেক্ষা করছি, আয়া এসে যাবে নিশ্চয়ই ।
রাহুল ভাবল কী ভাবে তুলবে, যেভাবেই তুলুক না কেন, জড়িয়ে তুলে ধরা ছাড়া উপায় নেই । এত সুন্দরী তরুণীকে জীবনে কখনও জড়িয়ে ধরার অভিজ্ঞতা ওর হয়নি, সুযোগ হয়নি কখনও । যাকে ও চেয়েছিল, যে ওকে না-পেয়ে আত্মহত্যা করেছে, তহমিনা আপা, কাউকেই সুন্দরী বলা যায় না, গালে টোল পড়লেও, সুমিতাদি ছাড়া । সুমিতাদি স্কুলে রাহুলের চেয়ে তিন ক্লাস উঁচুতে পড়তেন, কতদিন ওনার বৈঠকখানা ঘরে গিয়ে কোমর জড়িয়ে ওপরে তোলার ইচ্ছে হয়েছে, তুলে, চেঁচাতে ইচ্ছে করেছে, কমরেড সুমিতা জিন্দাবাদ ।
সুমিতাদিকে কল্পনা করে, সঙ্গীতাকে জড়িয়ে ধরার তীব্র ইচ্ছা হল, আর রাহুল একটু ঝুঁকতেই, দু’হাত ওপরে তুলল যুবতী, যেভাবে কোলে ওঠার জন্য শিশুরা তোলে, হয়ত ছোটোবেলা থেকে যান্ত্রিক অভ্যাস ।
বুকে জড়িয়ে রাহুল তুলে নিয়েছিল সঙ্গীতা মনসুখানিকে, আর যা ও ভাবতেও পারেনি ঘটতে পারে, মেয়েটি ওর গলা জাপটে দুদিক থেকে আঁকড়ে কাঁধে মাথা রেখে প্রায় গালের কাছে নিজের ঠোঁট চেপে রাখল, ভিজে-ভিজে শ্বাসের গরম ভাপ, মনে হল রাহুলের । স্পর্শের নেকট্যে সম্পূর্ণ সঙ্গীতাকে অনুভব করতে পারছিল রাহুল, সে বিকলাঙ্গ হলেও, কোমরের তলায় শীর্ণ উরু আর বিকৃত পা হলেও । একজন সুন্দরী, সুসজ্জিতা, সুগন্ধমাখা যুবতীর তাজাগরম দেহ, নিম্নাঙ্গ তার সম্পূর্ণ না থাকলেও, জড়িয়ে ধরার রসায়ন শুরু হয়ে গিয়েছিল রাহুলের আগাপাশতলা । ওর পুশকার্টে নামিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে দেবার সময় বুকে হাত ঠেকল । বুকে হাত ঠেকতেই মনে পড়ল, অঞ্জলি বলেছিল, পুরুষগুলো লেচার হয় ।
সুমিতাদির কোমর জড়িয়ে ওপরে তুললে কী বলতেন উনি ?
কত আর ব্যা-ব্যা-ব্যা-ব্যা করবি !
রাহুল বলত, কী করি, রামছাগলরা এরকমই হয়, ব্যা-ব্যা-ব্যা-ব্যা…
বেসমেন্টে গিয়ে হায়দার হুসাইনের গাড়িতে তোলার সময়ে আরেকবার জড়িয়ে ধরার সুযোগ পেল রাহুল, কিন্তু এবার সঙ্গীতা মনসুখানি নিজেই ওর কোমর আঁকড়ে ধরল, যাতে ও তুলে নিয়ে গাড়ির ব্যাক সিটে বসিয়ে দিতে পারে । আলিঙ্গনের মধ্যেই খুলে দিল মেয়েটির সিট বেল্ট, বুকে কয়েকবার হাত লাগা ছাড়া উপায় ছিল না ; হৃৎস্পন্দনের পারস্পরিক আলতো দামামার আদান-প্রদানের মাধ্যমে দুদিক থেকে পাছার তলায় হাত দিয়ে এক লপ্তে তুলে নিয়েছিল মেয়েটিকে, আর টের পেয়েছিল খাপে-খাপে বসে গেল নিজেদের চনমনে প্রত্যঙ্গ । রাহুলের মনে হয়েছিল, মিস মনসুখানি যেন বিকল অংশটা ঠেসে ধরেছে ওর সচল অংশে । সম্ভবত ও-ই এই মেয়েটির প্রথম পুরুষ, পুরো অবয়ব কেঁপে-কেঁপে উঠেছিল মেয়েটির । সঙ্গীতার বাড়িতে পৌঁছেও একই কাজ আরেকবার ধাপে-ধাপে করতে হল রাহুলকে । মেয়েটি ওর হাত ধরে বার-বার থ্যাংকস জানিয়েছিল । পরে, রাহুলের মনে হয়েছে, আয়ার না আসা কী ইচ্ছাকৃত, কেননা থ্যাংকস জানাবার পরও সঙ্গীতা ওর হাত ছাড়তে চায়নি কেন ।
রাহুলের রগ দপদপ করে বলছিল, লেচার লেচার লেচার লেচার….
কেন, সুমিতাদি ?
ঘটনাটা স্মৃতিতে যখনই ভেসে উঠেছে, রাহুলের ভেতরের কুকুর ওকে ঘেউ-ঘেউ করে মনে করিয়ে দিয়েছে যে ওই একটি ঘণ্টায় সে একজনকে আকর্ষণের তীব্র মাতলামিতে টেনে নিয়েছিল, যে ধরণের আকর্ষণ তহমিনা আপা, অঞ্জলি, এমিলিয়া বনিয়া, মীরা, সুরেখার কাছ থেকে পায়নি । একজন মেয়ের ভালোবাসা আরেকজনের থেকে একেবারে পৃথক হয়, তার কারণ ব্যক্তি হিসাবে একটি মেয়ে আরেকটি মেয়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ।
মীরা ব্যানার্জি । সুরেখার মতনই আরেক নারী যে প্রথম পরিচয়ের দিনই রাহুলকে স্তম্ভিত করে, জানিয়েছিল, ওর ইউটেরাস নেই । রাহুলের বয়স তখন কত হবে, মমমমমমম, বোধহয় কত , সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । প্রথম পরিচয়ের দিনই একজন যুবতী কেন এরকম একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার তাকে জানাল, তা ওর দুশ্চিন্তা হয়ে
উঠেছিল। তার পর মীরা একদিন বলল, সুরেখার ঢঙেই, আপনার স্ত্রীকে আমি বলেছি, আপনাকে আমি পছন্দ করি । যে ইঁটগুলো দিয়ে রাহুল নামের বাড়িটা গড়া, সেটাকে ভাঙার প্রয়াস কেন করেছে সুরেখা আর মীরা, তার কুলকিনারা সেদিন পায়নি রাহুল । ওকে দেখতে তো স্মার্ট নয়, শরীর থেকে যৌনগ্রন্হির গন্ধও ওড়ায় না, সাদামাটা আটপৌরে চেহারা, মহিলাদের সঙ্গে কথা বলতে কুন্ঠিত বোধ করে, রেকলুজ, কম কথা বলে, তবু কেন ও কাউকে-কাউকে আকর্ষণ করে ফ্যালে ।
একদিন, অফিসে নিজের কেবিনে কাজে মশগুল ছিল, তবু প্রচণ্ড একটা আওয়াজ শুনতে পেয়ে, রাহুল অনুমান করল, অ্যানি বেসান্ত রোডে গাড়িতে-গাড়িতে ধাক্কা লাগল ;বৈভবশালীদের শহর, অঢেল টাকা, ডজনখানেক গাড়ি, ধাক্কা লাগলেও গায়ে মাখে না । একটা গাড়ি আচমকা থামলে, তার পেছনের সব গাড়িগুলো একটার পর একটার পেছনে ধাক্কা মারতে থাকে । আরেকবার অমন আওয়াজ হতেই, রাহুল দেখল যে মীরা ব্যানার্জি ওর হাত ধরে টান দিয়ে বলছে, চলুন, চলুন, বেরোন, শিগগির বেরোন, ভূমিকম্প হচ্ছে ।
মীরা ওকে টেনে কেবিনের বাইরে নিয়ে যেতে, রাহুল দেখল, সত্যিই, অফিসার আর কর্মীরা সবাই দৌড়োচ্ছে হলের বাইরে , সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে ওপরতলার কর্মিরা । মীরা ওর হাত ধরে টানতে-টানতে বাইরে ভিড়ের মধ্যে এনে দাঁড় করিয়ে দেবার পর, সমবেত সবাই দেখল, ভূমিকম্প নয়, ওদের অফিস বিল্ডিংটাই, ওপরতলা থেকে একেরপর এক ফ্লোর নিয়ে শব্দ করে, সিমেন্টের ধুলো উড়িয়ে, পড়ছে । রাহুলের চোখের সামনে, কয়েক মিনিটের ভেতর, পড়ে গেল বিশাল দশতলা বাড়িটা ।
মীরাকে ধন্যবাদ জানাতে, ও বললে, বলেছিলাম তো আপনাকে যে আমার ইউটেরাস জন্ম থেকে নেই । যাকে পছন্দ হয়, তাকে ইন্সটিংক্টিভলি পছন্দ হয় ; ওই পছন্দের পরিবর্তে তাকে কিছু উপহার দিই । আমি এভাবেই, আজ পর্যন্ত, আপনাকে নিয়ে, সাতজনকে বাঁচিয়েছি । আজকে আপনাকে আরও বেশি করে বাঁচবার জন্য সময় উপহার দিলাম। মনে রাখবেন ।
ব্যাস, স্মৃতিতে তুলে রেখেছে রাহুল । অজস্র স্মৃতি-ছবির একটা । ওর বিভাগের কেবল একজন মারা গিয়েছিল, বিল্ডিংটা চাপা পড়ে । যে মারা গিয়েছিল, তার অভ্যাস ছিল জুতো খুলে খালি পায়ে বসে কাজ করা । হল ছেড়ে পালাবার চেঁচামেচি শুনে জুতো পরবার জন্য টেবিলের তলায় মাথা ঝুঁকিয়েছিল, তাতে যেটুকু দেরি হয়েছে, বাইরে বেরোবার সময় পায়নি । রাহুলকে অমন সময়টুকু পাইয়ে দিয়েছিল মীরা ।
ওপরতলা থেকে চোদ্দজন সময়মতো নামতে পারেনি । তাদের থ্যাঁতলানো দেহ সিমেন্টের চাঁই সরিয়ে কয়েকদিন পর পাওয়া গিয়েছিল ।
যে মেয়েটিকে রাহুল বিয়ে করল, সুমনা সেন, তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল এক তামিলভাষী তরুণী । রাহুলের বয়স তখন কত, বোধহয় আঠাশ, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় । সেবারও ট্রেনিং নিতে গিয়েছিল চেন্নাইয়ে।
এত রকমের ট্রেনিং ওকে দিয়েছে ওর গ্রামীন উন্নয়ন অফিস যে চাকুরির এক চতুর্থাংশ সময় ওর কেটে গেছে ট্রেনিং নিতেই। কী ট্রেনিং যে নেয়নি ! বিদ্যুৎ প্রসারণ, তাঁতের কাজ, চাষের কাজ, খাল তৈরি, জমিতে নিয়ে যাবার পিভিসি পাইপ, ঘাসের রকমফের, হরটিকালচার, প্ল্যান্টেশান, ছোটোএলাচ, ঋণখেলাপির কার্যকারণ, সহযোগীতা, আরটেজিয়ান কুপ, শ্যালো বনাম ডিপ, মৎস্যচাষ, দুধ-কোঅপারেটিভ, গোপালন, মাংসের প্রক্রিয়াকরণ, নদীর বাঁধ, কোল্ড স্টোরেজ, আলু চাষ, চাষের যন্ত্রের ব্যবহার, ক্ষুদ্র সেচ, গ্রামের বউদের জন্য কমপিউটার, একই ট্রেনিঙের রিফ্রেশার কোর্স ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি । এরকমই একটা ট্রেনিং নিতে গিয়ে সুমনার সঙ্গে ওর আলাপ । বাংলা তাঁতের শাড়ির সঙ্গে হাই হিলে পেখমতোলা সুমনাকে, পরিচয়ের পরমুহূর্তেই সরাসরি বলেছিল, ‘আপনাকে বিয়ে করতে হলে
আপনাদের বাড়িতে কার সঙ্গে কথা বলতে হবে ?’
–বড় মামার সঙ্গে, আমার বাবা-মা ছোটোবেলায় মারা যান, আমি মামার বাড়িতে মানুষ ।
চেন্নাইয়ের মাউন্ট রোডে ওদের বাংলোবাড়িতে গিয়ে রাহুল দ্যাখে, ড্রইংরুমে সাজানো নানা মাপের কাপ আর শিল্ড, দুটো কুকুর, বারান্দায় বেতের চেয়ার, টুপি টাঙাবার আর ওভারকোট ঝোলাবার আয়নালাগানো র্যাক ; একটা আলমারিতে গোটা দশেক রাইফেল আর বন্দুক । লাল ড্রাগেট বেছানো ঘরে অজস্র ইংরেজি পেপারব্যাক, এত পুরানো যে পাতা ওলাটানো গেল না সহজে, দেয়াল-ঘেঁষা তাকগুলোয়, বোঝা যায় যে কুড়ি-পঁচিশ বছরের ওপর কেউ হাত দেয়নি ওগুলোয়, পৃষ্ঠাগুলো কালচে । রাহুলের প্রথম প্রতিক্রিয়া, যাকে বলা যায় স্টান্ড । কোথায় চেন্নাইয়ের এই অভিজাত পরিবার আর কোথায় ওর নিম্নবিত্ত দিন-আনি-দিন-খাই পরিবার ।
সুমনার বড়মামা চন্দ্রনাথ গুপ্ত, রাহুল জেনে নিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ধাপে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত, বাড়ি ছিলেন না । মেজমামা, সূর্যনাথ গুপ্ত, স্যুটপরা, ঢুকলেন ড্রইংরুমে, নিজেই আগাগোড়া কথা বলে গেলেন, ওনাদের বিখ্যাত হিন্দি-ইংরেজি-তামিলে চোবানো বাংলায় । ওনার ঠাকুর্দা রহড়ার, যেখানে উনি, যাননি কখনও, রাহুলও যায়নি । বাবা ছিলেন ইন্সিওরেন্স কোম্পানির মালিক । ইন্সিওরেন্স ন্যাশানালাইজেশান হবার পর ওনাদের আর্থিক অবস্হা পড়ন্ত ।
পড়ন্ত শুনে আস্বস্ত হয়েছিল রাহুল । সে-কারণেই সুমনাকে চাকুরি করতে পাঠানো হয়েছে । এ-কথা শুনে আবার দমে গিয়েছিল রাহুল । সুমনার নিজের বোন সুচরিতা আর মামাতো বোন বসুধা ক্যাথলিক স্কুলে পড়ায়, বাড়িতে টিউশানির কোচিং ক্লাস নেয় ওরা ।
কাচের আলমারি থেকে দু’তিনটে বন্দুক আর রাইফেল বের করে তাদের ক্যারদানি দেখালেন মেজমামা । সুমনা ওর মামাতো বোনেদের বলে থাকবে যে রাহুল বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে : পরিচয়মাত্রই প্রস্তাব, এরকম পাত্র ওরা দেখেনি আগে, রাহুলও দেখেনি । এক-একজন করে এসে দেখে যাচ্ছিল ওকে । রাহুলের মনে হল, প্রত্যেকেই, বিয়ে করার উপযুক্ত । সবাইকে একসঙ্গে বিয়ে করে নিয়ে গেলে মন্দ হয় না, এক-এক ঋতুতে এক-একজন ।
রাহুলকে কথা বলার, প্রস্তাবটা পাড়ার সুযোগ না দিয়ে, মেজমামা এমন অবিরাম কথা বলতে থাকলেন যে রাহুলের সন্দেহ হল, সম্ভবত ইনি চাকুরে ভাগ্নিকে হাতছাড়া করতে রাজি নন । মেজমামা বললেন, ওনারা তিন ভাই দু’বোন । ছোটো বোন পনেরো বছর বয়সে মারা গেছে । সুমনার মা মারা গিয়েছিলেন সুচরিতা যখন এক মাসের । ওনাদের দুটো গাড়ি ছিল, শেভ্রলে, দুটোই জেড-ব্ল্যাক । এখন আছে ফাঁকা গ্যারাজ, যেটা সার্ভেন্ট কোয়ার্টার হিসেবে কাজে লাগে । ছোটোভাই থাকে ভুসাওয়ালে । ওনার বাবার আরও দু’জন ভাই, দু’জনেই বিয়ে করেননি, একজন জীবিত । বাবা গ্রীষ্মকালে লণ্ডনে গিয়ে থাকতেন । আলমারিতে লণ্ডনের কাটলারি, নীল ফিনফিনে ।
বিলেতফেরত হবার ছাপ ওদের টয়লেটে দেখেছিল রাহুল, টয়লেটে পায়খানার জন্য চেয়ার রাখা, যে চেয়ারের বসার জায়গায় গোল করে কেটে এনামেলের ডেকচি বসানো, ওই ডেকচিতে হাগতে-মুততে হবে, কাজ হয়ে গেলে কবজা-লাগানো কাঠের পিঠটা ফেলে ঢাকা দিতে হবে, পরিষ্কার করার জন্য দুপুরে আর রাতে মেথর আসে । কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে হাগতে বসে টুং-টাং শব্দ উঠবে থাতব ডেকচি থেকে ।
বিয়ের প্রস্তাব দিতে গিয়ে, দু’বার শরবত খেয়ে, রাহুলের পক্ষে পেচ্ছাপ চেপে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না বলে বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছিল, নয়তো অন্যের বাড়ি গিয়ে টয়লেটে, যাকে সবাই এখন ওয়াশরুম বলে, যাওয়া এড়িয়ে যায় রাহুল । এখন, ওর বয়স সত্তর, তাই কারোর বাড়ি একেবারেই যেতে চায় না, প্রস্টেটের দরুন টয়লেটে বার কয়েক ঢোকবার আশঙ্কায় ; গেলেও, সেদিন জল আর তরল খাওয়া নিয়ন্ত্রণে রাখে ।
মেজমামার বক্তৃতার জন্য সেদিন রাহুলের প্রস্তাব জানাবার সুযোগ হয়নি । পরের দিন যেতেই বহু প্লেট এসে গেল রাহুলের সামনের সেন্টার টেবিলে, নানা রকম খাবার সাজানো, যাকে বলে থরে-থরে । পেটুক রাহুলের কাছে আটপৌরে বাঙালি রান্নার বাইরে অন্যধরণের রান্না বেশ গুরুত্বপূর্ণ । ও জানতে চাইলে, ওকে যখন জানানো হল যে যাবতীয় রান্না সুমনা করেছে, বিশেষভাবে রাহুলের জন্য, তখন ওর পেটের আনন্দ মুখময় ছড়িয়ে পড়েছিল ।
সুমনার বড়-মাইমা ড্রইংরুমে ঢুকে রাহুলের ইন্টারভিউ নিতে বসলেন । রাহুলের বহু গুরুত্বপূর্ণ ইনটারভিউ, যেগুলো ছাপা হয়নি, অথচ যেগুলো প্রকাশিত হওয়া সবচেয়ে জরুরি ছিল, এই ইনটারভিউ তার অন্যতম । রক্তিম চাটুজ্জে ওনার প্রেমিকার বাবার নেয়া এই ধরণের ইনটারভিউতে ফেল করে রাহুল-বিরোধী, অনিকেত-বিরোধী হয়ে গিয়েছিলেন । ইনটারভিউতে রাহুল সফল হলেও, ও শুনতে পেল ভেতরে গিয়ে বড়মাইমা সুমনাকে বলছেন, তোর চেয়ে বয়সে ছোটো মনে হচ্ছে, যা, রাহুলের মনে হল, সম্ভবত পারিবারিক রাজনীতির মারপ্যাঁচ ।
একটু পরে সুমনার বড়মামা ফিরলে, গ্রুপ ডিসকাশান হল, যার আলোচ্য বিষয় ছিল রাহুলের জন্মসন, অনিকেতের জন্মসন, রাহুলের বাবার জন্মসন, বাবা-মা স্কুলের মুখ দ্যাখেননি বলে ওর আর অনিকেতের জন্মসন স্কুলে ভর্তির দিন পাঁজি দেখে শুভ দিন খুঁজে রাখা হয়েছিল শুনে অবাক হলেন না, কেবল ঘাড় নাড়লেন, যার মানে হয়তো ‘কোথ্থেকে এই ছোটোলোকটাকে ধরে আনল সুমনা’, কিংবা ‘ও আচ্ছা, চলবে, এরকম পরিবার ইউপি সাইডে আছে বটে।’
চাকুরির বয়স, কত মাইনে ইত্যাদি জানতে চেয়ে উপরি নেই শুনে উপস্হিত সবাইকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল, কিন্তু ট্যুরের টিএ-ডিএ থেকে টাকা বাঁচে শুনে আস্বস্ত হলেন, যে টাকা রাহুল এতকাল উড়িয়ে আনন্দ পেতো । প্রাথমিকভাবে রাহুল সেলেকটেড হল, কিন্তু, হ্যাঁ, ওনাদের একটা কিন্তু আছে, আর তা হল, আগামি মাসের চার তারিখে মেজমামার বড় মেয়ের বিয়ে, পাত্র কাস্টমসে কাজ করে, অনেক উপরি, ক্যাশ এবং কাইন্ড দুইই।
রাহুল বিয়ে করছে জানিয়ে কানপুরে বাবাকে, আর অনিকেতকে ওর অফিসের ঠিকানায় সিংভূমে টেলিগ্রাম করে দিয়েছিল, সুমনার মামাদের অনুমতি পাবার আগেই । তার কারণ রাহুলের প্রচারিত চরিত্রদূষণের কারণে রাহুলের মা, যাকে বলে প্রকাশ্যে, ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, যে, রাহুল যে-কোনো যুবতীকে সিঁদুর পরিয়ে বাড়িতে আনলে তাকে
তৎক্ষণাত বাড়ির ছোটো বউএর স্বীকৃতি দেয়া হবে, জাত-ধর্মের ক্রাইটেরিয়া প্রযোজ্য হবে না, যেহেতু ওগুলো রাহুল আগেই খুইয়ে বসে আছে ।
মামা-মামিদের ইতস্তত উসখুসভাব দেখে রাহুল আবার দুটো টেলিগ্রাম করে দিয়েছিল, বাবাকে আর অনিকেতকে, ‘ম্যারেজ ক্যানসেল্ড’ । রাহুল আঁচ করল যে সংসারে সুমনার আর্থিক অবদান এতই জরুরি যে ওকে এখনই ছাড়া যাবে না । সুমনার দাদামশায় যা রোজগার করতেন তার পুরোটাই ইংরেজিয়ানায় খরচ করে দিতেন, ফলে সঞ্চয় নামের কোনো পুঁজি নেই । সেই লোকদেখানো আভিজাত্য টিকিয়ে রাখতে গিয়ে তথৈবচ হালচাল । অফুরন্ত রোজগার করতেন বলে বেঁচে থাকতে ছেলেদের চাকরি করতে দেননি, ভাড়া নেয়া বাংলোয় বসবাস করে নিজের বাড়ি কেনার কথা চিন্তা করেননি । তিনি মারা যাবার পর, ছোটো ছেলে, যার তখনও চাকরিতে ঢোকার বয়স ছিল, সুমনাদের চেন্নাই এসট্যাবলিশমেন্ট থেকে কেটে পড়ে, রেলের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন, রেলের জনৈক কেউকেটা কর্তার চিঠির জোরে, যিনি, সেই কেউকেটা কর্তার শর্ত ছিল যে তাঁর একাধিক মেয়ের একটিকে, যাকে পছন্দ, বিয়ে করতে হবে ।
গল্প-উপন্যাসের মামা-মামির সংসারে যেমন হয়, ততটা না হলেও, সুমনা আর ওর বোনকে মামাতো বোনেদের চেয়ে বেশি শ্রম দিতে হতো, বিশেষ করে প্রতিদিন সবায়ের জন্য রুটি বেলা আর সাঁকায় ।
–কতগুলো রুটি ? জানতে চেয়েছিল রাহুল ।
–ছেচল্লিশটা !
–আমাদের কানপুরের বাড়িতে কাজের মাসি আছে, যে রুটি বেলে-সেঁকে দিয়ে যায় ।
–গিয়ে ছাড়িয়ে দেব ।
–এখনও তো মামারা ফাইনাল করে উঠতে পারছেন না ।
–করবেন ।
ক্যানসেল টেলিগ্রামের পরের দিন সুমনা রাহুলের ট্রেনিং সেন্টারে এসে হাজির, বড় মাইমা ডেকে পাঠিয়েছেন । গেল রাহুল । ওনারা রাতভর শলা-পরামর্শ করে নির্ণয় নিয়েছিলেন যে চাকুরি করে না এমন এক মামাতো বোন, যাকে রাহুলের পছন্দ, বিয়ের প্রস্তাব দেবেন । কিন্তু সুমনার ছোটোবোন সুচরিতার প্রস্তাবে ওনারা বিপদে পড়লেন । সুচরিতা জানালো যে রাহুলকে দেখে ওর ভালো লেগেছে, তাই ও-ই রাহুলকে বিয়ে করবে, কারোর কোনো চিন্তার প্রয়োজন নেই । শুনে, বেশ লেগেছিল রাহুলের, ও-ই যেন স্বয়ম্বর সভায় বসে আছে, আর রাজকুমারীরা প্রতিযোগীতায় নেমেছেন।
পরিবারে একাধিক বিয়ের বয়সী মেয়ে থাকায় দুই মামার মতবিরোধের মাঝে পড়ে গিয়ে সুমনাকে ওনারা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন, নয়তো পরে ওর জন্য পাত্র তো ওনাদেরই খুঁজতে হবে, টাকাকড়ি খরচ করতে হবে, আর তখন যদি না পাওয়া যায় ! মেজমামা রাহুলকে হুকুম করলেন, ওনাদের টেলিফোন থেকে কানপুরে বাবাকে টেলিফোন করতে , ওনারা কথা বলতে চান । রাহুলদের কানপুরের বাড়িতে টেলিফোন ছিল না । বাবাকে আর অনিকেতকে ওনাদের টেলিফোন থেকে ফোনোগ্রাম করে দিল ।
ফোনোগ্রাম করার পর, কার্ড ছাপাবার জন্য, মেজমামা তথ্য নিলেন ইংরেজিতে, কেননা বাংলা ভাষায় ওনার
অনুপ্রবেশ ঘটেনি । মেজমামাকে তথ্য দিচ্ছিল রাহুল, দেখল সুমনা আর ওর ছোটো বোন ইংরেজিতে তর্কাতর্কি চেঁচামেচি করতে-করতে বাংলোর ঘেট খুলে দৌড়োলো, বাইরে মাউন্ট রোডে, তখন সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকার । রাহুলের দিকে তাকিয়ে সুমনা বলল, ‘ও-ই আপনাকে বিয়ে করতে চাইছে, অ্যাডামান্ট’ । ওদের পিছনে ছুটে দুজনকে দুহাতে ধরে, ঝাঁকিয়ে রাহুল বললে, ‘কি করছেন কী, আমি যে-কোনো কাউকে বিয়ে করার জন্য কানপুর থেকে চেন্নাই আসিনি, চলুন, ফেরত চলুন’। দুজনের কবজি ধরে, প্রায় ফিলমি ঢঙে শিভালরি দেখিয়ে, ফেরত আনতে মেজমামা ওদের বাড়ির ভেতরে যাবার নির্দেশ দিয়ে কার্ডের খসড়া রচনায় মন দিলেন ।
কার্ডের খসড়ায়, সুমনার বাবা সুরঞ্জন সেনের নামের আগায় এমন কোনো ইঙ্গিত পেল না রাহুল যা থেকে টের পাওয়া যায় যে উনি জীবিত না মৃত । ফলে প্রশ্নটা তুলতে, সুমনার বড় মামা বললেন, ‘ইট ইজ এ লঅঅঅঅং স্টোরি’ । কিন্তু স্টোরিটা যে কী তা বলতে চাইলেন না । পরে, রাহুল তখন কানপুরে, পাঁচ-ছয় বছর বয়সের স্মৃতি রিকালেক্ট করে সুমনা বলেছিল, বাবা এসেছিল আমাদের নিতে, সঙ্গে ঘোমটায় মুখ-ঢাকা কমবয়সী সৎ-মা, কোলে বছরখানেকের বাচ্চা। দেখলেই বেশ বোঝা যায় বাবার আর্থিক অবস্হা খুবই খারাপ । বড়দাদু বকুনি দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন ।
তারপর ওর বাবা ওর অফিসে কয়েকবার গিয়ে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন, সম্পর্ক নবীকরণের উদ্দেশ্যে ।
মামারা আর দাদুরা বাবা সম্পর্কে এমন আতঙ্ক ওর মনে গেঁথে দিয়েছিলেন শৈশব থেকে যে ও দ্রুত এড়িয়ে গিয়ে বাবার সামনে থেকে পালিয়েছিল ।
বড়দাদু নামক বৃক্ষটিকে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য ছোটোদাদু আর মেজদাদুর সংসার পাতা হয়নি । পারিবারিক গল্পগাছা অনুযায়ী, বার্ধক্যে মারা যাবার সময় দুজনেই ভার্জিন ছিলেন । যৌবনের কী অপচয়, মনে হয়েছে রাহুলের । সুরঞ্জন সেন ছিলেন অনুশীলন বা যুগান্তর সমিতির সদস্য, জেনেছিল রাহুল, সুমনার দিদির কাছ থেকে । কলকাতায় বিএ পড়ার সময় পুলিশ সুরঞ্জনদের ডেরায় হানা দিলে তিনি বেনারস পালান । সেখানে শচীন্দ্রনাথ সান্যালের শিষ্যদের আস্তানায় লুকিয়ে থাকার পর পালিয়ে যান লাহোর । আমিরচাঁদ, বালমুকুন্দ, অবোধবিহারী প্রমুখের গড়া বৈপ্লবিক পরিকাঠামোয় ঢুকে পড়েন । ভালো ইংরেজি বলতে পারতেন বলে ইংরেজদের মন্টেগোমারি ক্লাবে নাম ভাঁড়িয়ে স্যুট-টাই পরে ম্যানেজারের চাকরিতে যোগ দেন । মন্টেগোমারি ক্লাবের জনৈক সদস্য, ইন্সিওরেন্স কোম্পানির মালিক, চেন্নাইয়ের এক বিলাতপ্রেমী বাঙালির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, যিনি তাঁর বড়ো মেয়ের সঙ্গে সুরঞ্জনের বিয়ের প্রস্তাব দ্যান ।
সমাজে ঢুকে এভাবে লুকিয়ে থাকার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি সুরঞ্জন সেন । বিয়ের পর তাঁর প্রকৃত কাজকারবার ফাঁস হয়ে যায় তাঁর শ্বশুরের কাছে, এবং ব্রিটিশ-শাসকের স্নেহধন্য শ্বশুরমশায় দুই নাতনি আর মেয়েকে নিয়ে ফিরে যান চেন্নাই । সুমনার সন্দেহ যে বড়দাদু পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন বাবাকে । সুমনার অন্তসত্ত্বা মা হয়ত স্বামী আর বাবার মূল্যবোধের সংঘর্ষের উদ্বেগজনিত সংক্রামে মারা গিয়েছিলেন তৃতীয় মেয়ের জন্মের সময়ে । একদিকে বিলেত ফেরত নব্যপ্রবাসীর অতিসাহেবিয়ানা, আরেকদিকে বিপ্লবীর স্বপ্নালু বাঙালিয়ানার ঘাত-প্রতিঘাত । সুরঞ্জন সেনের দ্বিতীয় স্ত্রী আর ছেলের কী হল, জানার ইচ্ছা হয় সুমনার । কানাঘুষা শুনেছে যে সুরঞ্জন সেন ভবঘুরে হয়ে গেছেন ।
সুমনার ছোটোমামার ছেলের বিয়েতে বরযাত্রী হয়ে ভুসাওয়াল থেকে ট্রেনে মুম্বাই যাচ্ছিল ওরা সবাই, একটা তৃতীয় শ্রেনির সাধারণ কামরা সম্পূর্ণ দখল করে । দাদারে সকাল সাতটায় ট্রেন পৌঁছাবে, কন্যাপক্ষের লোকেরা– সবাই মারাঠি, কেননা ছেলেটি বিয়ে করছে প্রদেশের রাজস্ব সচিবের মেয়েকে– নিতে আসবে, মহিলারা তাই সাজগোজ করে নিচ্ছিলেন । হঠাৎ টয়লেটের কাছ থেকে সুমনার ‘বাবা-বাবা’ চিৎকারে রাহুল আর ছোটোমামা দৌড়ল কী হয়েছে দেখতে। দেখল, প্রায় ভিকিরির জামাকাপড়ে, এক দীর্ঘদেহী বৃদ্ধ, কদমছাঁট চুল । সুমনা বলল, আমার ডাকে চাদরে মুখ লুকিয়ে নিয়েছে । ছোটোমামা মুখ থেকে চাদর সরাবার চেষ্টা করে ‘জামাইবাবু-জামাইবাবু’ বলে বারকয়েক ডাকলেন, আর সাড়া না পেয়ে নিশ্চিত হবার জন্য নিজের দাদা-বৌদিকে ডাকতে গেলেন । ওনার পেছন-পেছন রাহুল আর সুমনাও গেল বড়মামা মেজমামা আর মাইমাদের ডেকে আনতে কামরার কিউবিকলগুলো থেকে ।
রাহুল হতভম্ব, বাকরহিত।
সবাই দল বেঁধে ফিরল টয়লেটের কাছে । কুড়িজনের ঠেলাঠেলি । রাহুলরা ফিরে দ্যাখে সুরঞ্জন সেন নেই । দাদার স্টেশান এসে পড়ায়, উত্তেজনায় খেয়াল করেনি কেউই, ট্রেনের গতি স্তিমিত হয়ে এসেছিল, আর সেই সুযোগে নেমে পড়েছেন রাহুলের শ্বশুরমশায় । প্ল্যাটফর্মে ছুটোছুটি করে, স্টেশানের বাইরে খোঁজাখুঁজি করেও, তাঁর দেখা মিলল না। আর কখনও তিনি এলেন না রাহুলের সামনে । নিজের শ্বশুরের সঙ্গে পরিচয় হল না রাহুলের । শাশুড়ির ব্যবহারিক
স্নেহ থেকেও বঞ্চিত থেকে গেল । রাহুলের বয়স তখন কত হবে, মমমমমমম, বোধহয়, মমমমমম, কতইবা, সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় ।
পরে, কলকাতায় থাকার সময়ে, জামাইষষ্ঠীর বাজার করতে-আসা প্রতিটি প্রৌঢ়াকেই রাহুলের মনে হত ওর শাশুড়ি ।
–এত ভারি দু-দুটো থলে বইবেন কী করে ? আমাকে দিন আপনাকে রিকশয় তুলে দিচ্ছি ।
–হ্যাঁ বাবা, বয়স হয়ে আসছে তো, আর বইতে পারিনে, মেয়ে-জামাই-নাতি কাল সকাল-সকাল আসবে বলেছে; তাই বাজারটা আজকেই করে রাখলাম, মাছের অর্ডার দিয়ে দিয়েছি, কালকে ভোরবেলা এসে কাটিয়ে নিয়ে যাবো ।
–আমার গাড়ি আছে, বলেন তো আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেবো ; গাড়িতে আমার স্ত্রী বসে আছে । আসলে আমার তো শাশুড়ি ছিলেন না ।
–তাহলে তুমি আর তোমার বউও চলে এসো কালকে, ভালোই হবে ।
–না মাসিমা, আরও কয়েকজন শাশুড়ির নেমন্তন্ন গত কয়েকবছর যাবত তোলা আছে । আপনারটাও তোলা থাক । সেনচুরির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি । জীবনে কত-কিছু যে তুলে-তুলে রাখছে !
–আজকাল আর তোমাদের মতন মানুষ বড় একটা হয় না । রিকশয় উঠে বললেন রাহুলের, হয়তো, নব্বুইতম শাশুড়ি ।
রাহুল নিজেকে বলল, আমি তো ভাবছিলুম আমি মানবেতর মানুষ, কত যে অমন ‘তুলে রাখা’ তুলে রেখেছি ।
সুরঞ্জন সেনের অন্তরজগতে যি বিপ্লবী বাসা বেঁধেছিল, তা রাহুলের মতনই, রাহুলের মনে হয়েছে, মানবেতর কোনো প্রাণী ।
ওর, রাহুলের ভেতরে, মানুষ আছে না জানোয়ার, তা নিয়ে নিজেকে ঝালাতে গিয়ে ওর সন্দেহ কাটেনি । একবার ট্যুরে গিয়ে, রাহুলের চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে, অবিরাম ট্যুরের চাকরিতে, মরা বাঘিনীকে যখন চিৎ করে শোয়ানো হয়েছিল, তার রক্তাক্ত যোনির দিকে তাকিয়ে নিজেকে বাঘ মনে হয়েছিল ওর, এমনই ছিল তার অপ্রতিরোধ্য ইরটিক আকর্ষণ । উত্তর প্রদেশের, তখনও উত্তরাখণ্ড রাজ্য হয়নি, নেপালের ঘন-সবুজ সীমান্তে দু’সপ্তাহ যাবত জঙ্গলঘেঁষা গ্রামগুলোয় ক্ষেত্রসমীক্ষা করে বেড়াচ্ছিল রাহুল আর ওর সহায়ক ভেটেরিনারি ডাক্তার উমাপ্রসাদ রাও । পিলিভিত জেলার উত্তরাঞ্চলের টনকপুর পর্যন্ত নেপাল সীমান্ত কভার করে, নানপারাতে বেস ক্যাম্প বানিয়ে নেপালগঞ্জ রোড, ভনঘা, ধর্মনপুর, কুমভের, হাটারিয়ান ঘাট, সিঙ্গাহি, নিঘাসন অঞ্চলের পাহাড়তলির গ্রামগুলো ঘুরে তারপর মৈলানিকে কেন্দ্র করে সোনারিপু, ধনগড়হি, কৈলাটি, চন্দনচৌকি পর্যন্ত গ্রামগুলোয় সেরে ফেলেছিল ক্ষেত্রসমীক্ষা ।
রাহুলের ক্ষেত্রসমীক্ষার বিষয় ছিল বিশুদ্ধ ভারতীয় গরু নামে আর কোনো প্রাণী এদেশে টিকে আছে, নাকি স্বদেশি-বিদেশী সংমিশ্রণে এদেশি গরু আর একটিও নেই । ক্যালেণ্ডারে শ্রীকৃষ্ণের সাথে যে গরুগুলোর দেখা মেলে, সেগুলো নিউ জার্সি বা হলস্টিন ফ্রিজিয়ান । রবি বর্মা শ্রীকৃষ্ণের পেছনে যদি কয়েকটা গোরু এঁকে যেতেন তাহলে সমস্যা হয়ত কম হতো ।
বাজারের বিশ্বায়নের বহু আগে থাকতে, গৃহপালিত জন্তুজানোয়ার আর হাঁস-মুর্গির সংকরায়ন হয়ে চলেছে । হিমালয়ের সমতলের জঙ্গলে রাহুল খুঁজে পেয়েছিল স্বদেশি গোরু, গাধার মাপের ছোটো-ছোটো গোরু, সামনে ছুঁচালো শিং, জঙ্গলে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য । দুধ তেমন দেয় না বলে কেউ পোষে না, এত ছোটো যে চাষের কাজেও লাগে না । কখনও কখনও অবশ্য মারোয়াড়িদের ছেড়ে-দেয়া অন্য জাতের বা বিদেশি-সংকর ষাঁড় হেলতে-দুলতে পৌঁছে যায় জংলি গোরুর পালে, আর তাদের ধর্ষণের পর , বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে মারা পড়ে কিছু-কিছু গোরু ।
গোরু খাবার লোভে একটা বাঘিনি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে নেমে এসেছিল কোথাও, তারপর জলভরা খালে পড়ে উঠতে পারেনি, খালের দু-ধার সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো । পিছলে-পিছলে বার-বার পড়ে গেছে জলে । সুন্দরবনের বাঘেদের মতন জলে অনেকক্ষণ সাঁতরাতে পারেনি । জল খেয়ে-খেয়ে, মরে ভেসে উঠেছিল । গ্রামবাসীরা বাঘিনীর লাশ জল থেকে তুলে বিডিওকে খবর দিতে, বিডিও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জানায় । বিডিওর মাধ্যমে তিনি রাহুলকে অনুরোধ করেন যাতে রাহুলের সহায়ক ভেটেরিনারি ডাক্তার পোস্ট মর্টেম করে একটা রিপোর্ট লিখে জেলাসদরে পাঠায়, কেননা জেলা সদর থেকে জানোয়ারের, তাও বাঘের, পোস্টমর্টেম করায় দক্ষ ভেটেরিনারি সার্জেনকে পাঠাতে কয়েকদিন লেগে যাবে ।
পোস্টমর্টেমের জন্য গ্রামবাসীরা বাঘিনীটাকে চিৎ করে শুইয়ে রাখতে, বাঘিনীর রক্তাক্ত যোনির দিকে নজর
পড়েছিল রাহুলের । বাঘিনীর লাশ তখনও শক্ত হয়নি । তার মানে বেশিক্ষণ হল মারা যায়নি । নিজের ভেতরের
বাঘটাকে, যে বাঘিনীর যোনিতে আকৃষ্ট হয়ে ওর দেহকে একটু-একটু করে জাগিয়ে তুলছিল, আবিষ্কার করে রাহুল অবাক হল না । বুঝতে পারল ও, রাহুল, যে, ডারউইনের সব কয়টা জীব-ধাপের প্রাণী রয়ে গেছে ওর ভেতরে, যারা, অঞ্জলির বিশ্লেষণে, লেচার ।
শার্ট-প্যান্ট খুলে, উদোম উলঙ্গ হয়ে, বাঘিনীর ফর্সা গোলাপি বুকের ওপর শুয়ে বোঁটাগুলোয় মুখ ঘষার ইচ্ছে করছিল । ভেটেরিনারি অফিসারকে প্রস্তাবটা দিতে সে বলল, কোনো প্রবলেম নেই স্যার, এরা চিৎ করে ধরে থাকুক, আপনা থেকেই বডি শক্ত হয়ে যাবে ; ভেটেরিনারি সায়েন্সে পড়ানো হয় যে মানুষদের মধ্যে এরকম কারনাল ডিজায়ার জেগে ওঠা স্বাভাবিক; তবে সেসব পশুরা তো গৃহপালিত, বাঘিনীর প্রতি আকর্ষণের কথা পড়িনি । তবে, ম্যাকলের লেখা ইনডিয়ান পিনাল কোড অনুযায়ী, নন-হিউমানদের সাথে ইনটারকোর্স করা ক্রিমিনাল অ্যাক্ট । আপনি তো শুধু শুতে চাইছেন , ক্রিমিনাল অ্যাক্ট আর সম্ভব হবে না স্যার, কেননা বডি শক্ত হয়ে গেছে ।
–হ্যাঁ, বাঘিনীর বুকে শুয়ে ওর ভালোবাসা চাই ।
পোস্টমর্টেম হবার পর সরকার কেবল চামড়াটা নেবে, মাংস-হাড়টাড় ফেলে দেবে জানতে পেরে পাহাড়ি গ্রামগুলো থেকে বহু পুরুষ-মহিলা-বাচ্চা বাঘিনীকে ঘিরে জড়ো হয়েছিল, তাদের হাতে নানা মাপের, আকারের, পাত্র ; আকাশেও জড়ো হয়েছিল উড়ন্ত শকুন আর চিল ।
গ্রামের পাহাড়ি লোকেরা বাঘের মাংস খায়, হাড় শুকিয়ে গুঁড়িয়ে রেখে দ্যায়, ওষুধ হিসাবে । পাহাড় ডিঙিয়ে
চিনেতেও পাচার হয়ে যায় । রাহুলের নির্দেশে, বাঘিনীর পিছনের দুটি পায়ে আর সামনের দুটি পায়ে সমান্তরাল করে বাঁশ বাঁধা হল, যাতে বাঘিনী ওভাবেই চিৎ শুয়ে থাকে, আর কোথাও রাতভরের জন্য বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় । বাঘিনীকে, গ্রামবাসীদের কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে গিয়ে, রাখা হল জনৈক পাঞ্জাবি সরদারের ফাঁকা গ্যারাজে । দেশভাগের পর প্রচুর জাঠ পাঞ্জাবির বসত গড়ে উঠেছে হিমালয়ের সমতলভূমিতে । সবাইকে জানিয়ে দেয়া হল যে কাল সকালে পোস্টমর্টেম হবে ।
সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলে, ভেটেরিনারি অফিসার পারফিউম ছিটিয়ে বাঘিনীর দেহের গন্ধকে কিছুটা দমন করে রাহুলকে বললে, স্যার আপনি যান, আমি বাইরে পাহারা দিচ্ছি । ও, রাহুল, অনেকটা রাম টেনে নিজেকে মাতাল করে নিয়েছিল ।
রাহুল জামাকাপড় খুলে শুয়ে পড়ল বাঘিনীর ঠান্ডা বুকের ওপরে । অন্ধকারে বাঘিনীর স্তনের বোঁটায় মুখ ঘষতে-ঘষতে, ওর, আশ্চর্য, কান্না পেতে লাগল, সুরেখা রেড্ডির জন্য । মদের নেশায়, সুরেখা রেড্ডির বুকে মুখ রেখে, প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল । সহায়ক অফিসার টর্চ জ্বেলে গ্যারাজে ঢুকে টেনে তুলল ওকে, আর, হাত ধরে টানবার সময়ে রাহুলের মনে হল ও এমিলিয়া বনিয়ার স্লিপিং ব্যাগ থেকে অনীক খাস্তগীরের টানে উঠে পড়েছে ।
ডাক্তার রাও রাহুলকে র্যাপার মুড়ি দিয়ে বলল, স্যার, পোস্টমর্টেমের সময় আপনি থাকবেন না, বুকের মাঝখান থেকে চেরা সহ্য হবে না আপনার, তাছাড়া গ্রামবাসীরা মাংসের জন্য কাড়াকাড়ি করবে ।
ওফ, আত্মহত্যা করেছিল বলে সুরেখারও বুক চিরে পোস্টমর্টেম হয়েছিল নিশ্চয়ই ।
একজন যুবতীর বুকের মাঝখান থেকে চিরে সেলাই করে দেয়া ! বাঘিনীকে অন্তত সেলাই করা হবে না ।
রাতেই ও, রাহুল, জিপে চেপে ফিরে গেল ক্যাম্প-স্টেশানে । মাংস খাবার জন্য কাড়াকাড়ি হবে শুনে অসুস্হ বোধ করছিল।
সুরেখাও প্রত্যাখ্যাত হয়ে অসুস্হ বোধ করেছিল কি ? গুমরে কেঁদেছিল হয়তো । কে জানে ।
সুরেখার চিঠির ভাঁজে আরেকটা চিঠি ছিল, বহুদিন, বাসি-পোস্টকার্ড, সময় তাকে হলুদ করে দিয়েছিল । প্রদীপন চাটুজ্জের চিঠি । রাহুলের কেস হাইকোর্টে শেষ হবার পর লিখেছিলেন : “প্রিয় রাহুল, হাইকোর্টের রায় পড়ে তোমাকে মনে মনে তৎক্ষণাৎ কনগ্র্যাচুলেট করেছি । একটা মামলা হওয়া দরকার ছিল, কাউকে না কাউকে এরকম মামলার আসামী হতেই হত । সীমাবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এর ফলাফল আধুনিক সত্য-সাহিত্যের পক্ষে যথেষ্ট ভালো হবে, মনে হয় । কৃতিত্ব সবটাই তোমার একার, তবু, লেখক নামের যোগ্য সকলেই একে পুরস্কার বলে মনে করবে ও ভাগ করে নিতে চাইবে । ব্যক্তিগতভাবে আমি পুরস্কৃত হওয়ার আনন্দ পেয়েছি । প্রীতিসহ, প্রদীপন চট্টোপাধ্যায় ।” ওই একই দিনে এই চিঠিটাও ছিঁড়ে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল রাহুল ।
বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজ থেকে ওই একটি চিঠিই ও, রাহুল, পেয়েছিল, মামলা জিতে যাবার পর ; তার কারণ
প্রদীপন ছাড়া বাকি ৯৯৯ জন চাননি যে ও মামলা জিতে যাক । অসীম, যিনি রাহুলের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তাঁর কাছ থেকেও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি, যদিও দাদা অনিকেতের সঙ্গে উনি তখনও চিঠির মাধ্যমে পত্রঅপেরা চালিয়ে যাচ্ছিলেন । প্রদীপন রাহুলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ; তার কারণ অসীম বিদেশ থেকে ওনাকে তাতাচ্ছিলেন, রাহুলের বিরুদ্ধে ; ওনাকে, রক্তিমকে, চঞ্চলকুমার বসুকে, যাঁরা ওনার বঁড়শির কেঁচো খেতে গিয়ে, এমন আটকে পড়েছিলেন, যে ,রাহুলের বিরুদ্ধে যাওয়াটাই আখেরের পক্ষে সুবিধাজনক মনে করেছিলেন ওনারা । অসীম তা-ই চাইছিলেন । ওনারা রাহুলের বিরুদ্ধে পুলিশের সাক্ষী হয়ে যেতেই অসীম তুরুপের তাসটি খেললেন রাহুলের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে, আর অপেরার ইতিহাসে চিরকালের জন্য বিশ্বাসঘাতক হিসাবে বদনাম করে দিলেন নিজের বন্ধুদেরই ।
কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে, সেদিন সন্ধ্যায়, যখন প্রদীপন, রক্তিম, চঞ্চলকুমার বসু ঘিরে ধরেন অসীমকে, তখন অসীম একখানা ডিগবাজিপত্র লেখেন অনিকেতকে, অদ্ভুত ডিগবাজি, যা সচরাচর সিরিয়াস লেখকেরা খেতে চাইবে না ।
প্রদীপন আর রক্তিমের আস্হা ফিরে পাবার জন্য ততটা নয়, যতটা ছিল, যে সংবাদপত্রে অসীম গাঙ্গুলি যোগ দিয়েছিলেন, তার মালিকদের প্রীত করার জন্য, নিজের রামায়ণ নট্ট কোম্পানির সুভেনিরে সম্পাদকীয় লিখলেন রাহু-কেতুদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে । তখনও রাহুলের মকদ্দমা শেষ হয়নি, সাব জুডিস ছিল, আদালতের দৃষ্টি আকর্ষন করে কনটেম্পট অব কোর্টের মামলা ঠুকে দিতে পারত । প্রদীপন পরামর্শ দিয়েছিলেন, দাও না ঠুকে, দেখোই না খেলাটা কেমন জমে যায় । দেয়নি রাহুল , কেননা অসীম তার আগে ওর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ।
রাহুল আবার লেখালিখিতে ফিরে আসার আনন্দে, অনিকেত বললে, তোর বিরুদ্ধে লেখা অসীমের পত্র-অপেরার চিঠিটা এবার প্রকাশ করার সময় হয়েছে, ও বেঁচে থাকতেই বেরিয়ে যাওয়া উচিত, যদিও ওর তাতে একটা মুথাঘাসও ছিঁড়বে না, তবু, লিটল অপেরাদের জগতে এটা গিয়ে পড়ুক ।
ঘাস আর আছে কি ? মহীরুহের তলায় তো ঘাস গজায় না । বলেছিল রাহুল ।
সাক্ষ্য দেবার চার দিনের মাথায় অসীম অনিকেতকে লিখেছিলেন, আরও অনেক কথার পর, “সাক্ষীর কাঠগড়ায় রাহুলের রচনা আমাকে পুরো পড়তে দেয়া হয় । পড়ে আমার গা রি রি করে । এমন বাজে লেখা যে আমাকে পড়তে বাধ্য করা হল, সে জন্য আমি ক্ষুব্ধ বোধ করি— আমার সময় কম, ছাপা-লেখালিখি কম পড়ি, আমার রুচির সঙ্গে মেলে না — এমন লেখা পড়ে আমি মাথাকে বিরক্ত করতে চাই না । রাহুলের তিনপাতা রচনায় একটা লাইনেও অপেরার চিহ্ণ নেই । রাহুল যদি আমার ছোটো ভাই হতো, আমি ওকে অপেরা লিখতে বারণ করতাম অথবা গোড়ার অ-আ-ক-খ থেকে শুরু করতে বলতাম । যাই হোক, তবু আমি বেশ স্পষ্ট গলাতেই দুবার বলেছি ওর ঐ অপেরা আমার ভালো লেগেছে । এর কারণ, আমার কোনো মহত্ব নয়– আমার সাধারণ, স্বাভাবিক, সীমাবদ্ধ জীবন । যে-কারণে আমি আনন্দবাজারে সমালোচনায় কোনো বাজে বইকে ভালো লিখি— সেই কারণেই রাহুলের লেখাকে ভালো বলেছি ।”
অসীম গাঙ্গুলির চিঠিটা পড়ে, রাহুল বলল, তাহলে একটা জুতোর বাক্স দিয়ে আসি রিভিউ করার জন্য, বাচ্চাদের চটির বাক্স তো মোটা বইয়ের মতন দেখায় ।
কলকাতায় ফেরার পর একদিন, সুকৃতি রেস্তরাঁয় মুর্গির কাটলেট খেতে-খেতে প্রদীপন চাটুজ্জে বললে, রাহুল যে তৈরি হয়েই যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেছিল তা বোধহয় অসীম অনুমান করতে পারেনি । তুমি যে আবার ফিরে আসবে, ফিরে এসে এত রকমের কথা বলবে, প্রশ্ন তুলবে, দার্শনিকদের দাড়ি চটকাবে, কেউই আঁচ করতে পারেনি । অনিকেত ওটা সময়মতন ছেড়েছে । হাঃ হাঃ, বাজে বইকে ভালো বলে-বলেই তো কত রাঘব বোয়ালকে জালে তুলল ; বাজে বই কেন, ওর চারপাশে যে মালগুলো পাক খাচ্ছে তা কে-ই বা না জানে । ভোঁদাদের সন্ধ্যায় একবার ঘুরে এসো । এক-একখানা ওই তোমরা যাকে বলো ইয়ে, মানে, বাল, বাঙালি লেখকের অ্যাবরিভিয়েশান ।
প্যারানয়েড ছিলেন রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারীমশায় । বিদেশে গিয়েও অপপ্রচার করতে ছাড়েন নি, বলেছিল রাহুল । ওনার পর ওই একই অপেরা-শিক্ষার স্কুলের খরচে হরিপদ রায় গিয়েছিল, সে লোক তো নিউ ইয়র্কে সেইন্ট মার্কস চার্চে নিজের লেখার অনুবাদ পড়তে গিয়ে ঘোষণা করেছিল যে সেও সর্বভূক আন্দোলনের সদস্য ; এদিকে কলকাতায় রাহু-কেতুদের বাঁশ দেবার জন্য লাগাতার দৌড়ঝাঁপ চালিয়েছে ।
প্রদীপনের উক্তি : যাক, জীবনে একটা প্যারানয়া তো আছে ; সেটার কনট্রিবিউটার হিসাবে তোমার প্রাউড হওয়া উচিত । কজন মানুষই বা পারে আরেকজনের জীবনে একখানা পার্মানেন্ট ঘা তৈরি করে দিতে, সিক্রেট উন্ড ! সে-ক্ষত চাপা দেবার জন্য পাতার পর পাতা, হাজার-হাজার পাতা, সারা জীবন লিখে যেতে হয়েছে, যাতে ধারে না কাটুক, ভারে তো কাটবে। অসীমের সমস্যা কী জানো ? এম এতে ফলাফল খুব বাজে হয়েছিল ; বাংলায় এম এ, সে
কিনা একেবারে তালিকার শেষে !
প্রাউড ? প্রাইড ? ব্যাপারটা আদপে কী ? জিগ্যেস করার পর, রাহুলের মনে পড়ল, থানার লক আপে সকালে ওর হাগা পেয়ে গিয়েছিল । একটা কনস্টেবল ওর কোমরে দড়ি বেঁধে বলল যাও, ওদিকে গোসল করে এসো ; দড়িটা আনেক লম্বা, আমি এখানে বসেই পাহারা দিচ্ছি দড়ি ধরে, তুমি সেরে এসো।
কোমরে দড়ি বাঁধা অবস্হায় হাগতে গিয়েছিল রাহুল । অত্যন্ত নোংরা পায়খানা, দরোজার বালাই নেই, কবেকার বড়ি-বড়ি বড়া-বড়া গু শুকিয়ে আছে, অনেক কয়েদি পায়খানায় না হেগে তার আসেপাশে বাইরেই ঘাসের ওপর হেগে রেখেছে । রাহুলও ফাঁকা দেখে, কাঁধের ওপর ট্রাউজার ফেলে, ঘাসের ওপর সেরে নিয়েছিল, ছোঁচাবার মগ-টগ ছিল না, যে কল থেকে অবিরাম জল পড়ে চলেছে সেখানে পেছন ফিরে ছুঁচিয়ে নিয়েছিল ।
যখন ফিরল, কনস্টেবলটা বলল, আরে বেবকুফ, ভাগনা চাহিয়ে থা ; তুমকো হমনে ইসিলিয়ে অকেলে ভেজা কি উধর সে ভাগ যাও । তুমহারা কেস সমঝা হ্যায় হমনে । ভাগ যাতে তো ইয়ে কলকত্তাওয়ালে পুলিস ফির আতে কেয়া তুমহারা ঝাঁট উখাড়নেকে লিয়ে ? বেবকুফ কহিঁকা । ফালতু কেস ঠোক দিহিস হ্যায় । লিখালিখি করকে সরকারকা দুশমন কোই নহিঁ বনতা হ্যায় । সরকার কওন হ্যায় ? হম । তব ? হমারে খিলাফ যেতনা চাহিয়ে লিখতে রহো, কেয়া ফরক পড়তা হ্যায় ! সরকারকা ঝাঁট উখাড়নেকে লিয়ে চাহিয়ে বব্বর শের মারনেওয়ালে পহলওয়ানোঁ কা বন্দুকধারি ঝুণ্ড ।
একজন খইনিখোর সেপাইয়ের অব্যর্থ ভবিষ্যবার্তা । পাঁচ-ছয় বছর পরেই দেখা দিল শহর-দাপানো নকশাল কিশোর আর যুবকেরা । তারপর, অবিরাম, নানা প্রদেশের জঙ্গলে দেখা দিতে লাগল বন্দুকধারী বিপ্লবীর দল ।
পালাবার জন্য তো আর লেখালিখির যুদ্ধক্ষেত্রে নামেনি রাহুল ।
সকাল দশটা নাগাদ সবাইকে হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে, একসঙ্গে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল কানপুরের
ফৌজদারি আদালতে । কি ভিড়, কি ভিড়, নানা থানা থেকে আসা কোমরে দড়ি আসামিতে আদালত চত্ত্বর গিজগিজ । রাহুলের বাবা আর দিনুদা ওকে দেখতে পেয়ে বলে গেলেন, চিন্তার কিছু নেই, বসন্তবাবুকে কোর্টে দেখলে হাইকোর্টের জজরাও ভয় পায়, আর এ তো মামুলি ম্যাজিস্ট্রেট , জামিন হয়ে যাবে, তারপর তোকে কলকাতায় উকিল ঠিক করে ব্যাংকশাল কোর্টে সারেণ্ডার করতে হবে । কলকাতার পুলিশগুলো তোকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যাবার তালে আছে, যাতে কলকাতা যাবার পথে ট্রেনের কামরায় তোকে দুচারঘা দিতে পারে, সেরকম হুকুমই ওদের দেয়া হয়েছে, ইন্সপেক্টর খান বলছিল ।
একটার সময় রাহুলের নম্বর এলো । পায়ে ব্যথা ধরে গিয়েছিল বলে অন্য আসামিদের সঙ্গে ও-ও মাটিতে বসে পড়েছিল । রাতে থানায় বাড়ি থেকে টিফিনকৌটোয় রুটি তরকারি দিয়ে গিয়েছিল বাবার কর্মচারী রাম খেলাওন । তারপর সকাল থেকে খাওয়া হয়নি, খিদে পেয়ে গিয়েছিল, ক্লান্তও বোধ করছিল, ঘুম হয়নি, লকআপে একটু গড়িয়েছিল বটে কিন্তু গড়িয়ে-আসা পেচ্ছাপ গায়ে লাগতে উঠে পড়েছিল । গা থেকে ঘাম আর পেচ্ছাপের গন্ধ বেরোচ্ছে । এজলাসে ওকে যেতে হল না । আসামীদের কোনো ভূমিকা থাকে না ফৌজদারি মামলায়, হেনস্হা আর জেল-জরিমানা ছাড়া । বাকি কাজগুলো করে উকিল মোক্তার পেশকার সাক্ষী ম্যাজিস্ট্রেটরা । আসামি কেবল নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবার শোপিস।
অসীম গাঙ্গুলির বাড়ি থেকে অঞ্জলির সঙ্গে দেখা করতে যাবে রাহুল । ওর আন্দোলনের ফালি-কাগজটার পেছনে অঞ্জলির যাদবপুরের ঠিকানা লেখা । যে যুবকের সঙ্গে অঞ্জলি থাকে সে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে ভারতে আর ভারত থেকে পূর্ব-পাকিস্তানে নানা জিনিসের স্মাগলিং করে । চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সোনা আনে সিলেটে, সে সোনা চলে আসে কলকাতায়, শিলচর বা আগরতলা হয়ে ।
সুমিতাদিকে কি সাম্যবাদের স্মাগলার বলবে রাহুল ?
পরে যখন দেখা হয়েছে, সুমিতাদির মুখের দিকে তাকালেই মনে হয়েছে, ডাক্তার বোধহয় ওনাকে বলে দিয়েছে যে ওনার কখনও বাচ্চা হবে না। ডাক্তারের ওই অমোঘ ঘোষণা কী ভাবে গ্রহণ করে একজন নারী ? কোনো পুরুষের পক্ষে সে অভিজ্ঞতার গভীরে প্রবেশ করা অসম্ভব । একজন নারীর মনে সারা জীবন বাজতে থাকে ওই ঘোষণা । হবে না, হবে না, হবে না । হবে না, হবে না, হবে না । সকালে উঠে, রান্নাঘরে, কাজে যাবার সময় পথে, অফিসে বা স্কুলে পড়াতে গিয়ে কাজের সময়, ফেরার পথে, বিকালে, সন্ধ্যায়, ব্রাহ্মমন্দিরে প্রার্থনার সময়ে, রাতে শোবার সময়, ঘুমের ভেতর স্বপ্নে ।
অঞ্জলি তাই রাহুলকে ধরেছিল, বীজ স্মাগলিং করে গর্ভে লুকিয়ে নেবার জন্য । কাউকে না কাউকে ও পাকড়াও করবেই ।
সুমিতাদির সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল, সান্মানিক স্নাতক হবার পর, রাহুলের কাকিমা যে স্কুলে পড়াতেন সেখানেই শিক্ষকতা করতেন সুমিতাদি, গালের টোল অটুট । নিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ি, বেবি অস্টিনে পাশে বসিয়ে । তারপর সযত্নে রাখা ভাঁজকরা একটা চিরকুট বের করে রাহুলকে বলেছিলেন, তোর লেখা, যখন স্কুলে পড়তিস, লাইব্রেরিতে আমার টেবিলের পেপারওয়েটের তলায় গুঁজে, হঠাৎ এসে হঠাৎ চলে গিয়েছিলি, রেখে দিয়েছি, কেন বলতো। তুই আমার নির্ভেজাল রসিক নাগর । তখন তো তোর প্রেমপত্র লেখার বয়স হয়নি ; শরীরে টেসটোসটেরন না জন্মালে যতই চিঠি লেখো না কেন, তাকে প্রেমপত্র বলা যায় না । সুমিতাদির কথা শুনে, ওনার প্রৌঢ় গালের টোলে ঠোঁট ঠেকাবার ইচ্ছে সংবরণ করেছিল রাহুল । চিরকুটে লেখা ছিল, ‘ভালোবাসি আপনাকে।’ সুমিতাদি চিরকুটটা মুড়ে বইয়ের ভেতরে ঢুকিয়ে আলমারিতে রাখতে-রাখতে জানতে চেয়েছিলেন, ‘কাদের অপেরা পড়ছিস আজকাল ? কেতু নাকি কলকাতা থেকে দু-আলমারি বই দিয়ে গেছে তোকে ।
–আপনি পড়বেন ? আমার পড়া হয়ে গেছে ; আমি বোধহয় ওই ধরণের রচনার জগতে বিচরণ করতে চাই না। বইগুলো এবার বিলি করে দিতে হবে । দেখি আর অস্বস্তি হয় । আপনি বললেন না একটু আগে, টেসটোসটেরন । ওই জিনিসটা বিশেষ নেই ।
–না রে , অপেরা পড়ার মতো সময় আর নেই, স্কুলের পর তো টিউশানিতে কেটে যায় সেই রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত । তুইও নাকি লেখালিখি করছিস লুকিয়ে-লুকিয়ে । তা ইংরেজিতে লিখিসনি বাবা, তোর ওই ক্যাথলিক স্কুলের পিছুটান এবার ছাড় । রবীন্দ্রসঙ্গীত থাকতে তোর কেন যে জন নিউটন নামের সেই নোংরা ক্রীতদাসটার গান পছন্দ তা জানি না ।
আয়ারল্যান্ডের নানদের চোখ ভেসে ওঠে রাহুলের স্মৃতিতে ; গির্জার প্রায়ান্ধকারে রাহুল আর ওর সহপাঠীরা, ওর বয়স তখন কত, মমমমমমমম, তিন কি চার, হাতজোড় করে গাইবার চেষ্টা করছে ইংরেজি ভাষায় গান, যে ভাষা তখনও পর্যন্ত ও বিশেষ জানে না, আর যে গান ওর মগজে থেকে যাবে মস্তিষ্করোগের মতন :
অ্যামেজিং গ্রেস ! হাউ সুইট দি সাউন্ড
দ্যাট সেভড এ রেচ লাইক মি
আই ওয়ান্স ওয়াজ লস্ট, বাট নাউ অ্যাম ফাউন্ড
ওয়াজ ব্লাইন্ড বাট নাউ আই সি
শাউট, শাউট, ফর গ্লোরি
শাউট, শাউট অ্যালাউড ফর গ্লোরি ;
ব্রাদার, সিসটার, অ্যান্ড মোরনার
অল শাউট গ্লোরি হ্যালেলুয়া..
রাহুল কেবল হ্যালেলুয়া শব্দটা সবায়ের সঙ্গে চেঁচাত । তারপর সিসটারদের সঙ্গে গাইতে-গাইতে মুখস্হ হল যখন, তখন সেই স্কুল ছেড়ে ব্রাহ্ম স্কুলে চলে যেতে হল, বাড়ির অভিভাবকদের মতে ওর, রাহুলের, স্বভাবচরিত্র কেরেস্তানদের মতন হয়ে যাচ্ছিল বলে ।
পরে, রাহুল জেনেছে যে গানটা জন নিউটন নামে একজন খালাসির লেখা, যে কৈশোরে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল, প্রেমিকা পলির সঙ্গে বিচ্ছেদের কারণে ; তারপর জাহাজের ক্যাপ্টেন সম্পর্কে নোংরা-নোংরা গান লিখে গাইবার অপরাধে ক্রিতদাসরূপে চালান হয়ে গিয়েছিল সিয়েরা লিওনের খেত-খামারে চাষবাসের কাজে । সেখানে তাকে দিন-রাত খাটতে হতো । বেশ কয়েক বছর পর, যৌবন শেষ হতে চলেছে, তার বাবা খবর পেয়ে, তাকে কিনে বাড়ি ফিরিয়ে আনেন । অ্যামেজিং গ্রেস গানটা বাড়ি ফিরে লেখা, ক্রমশ মুখে-মুখে লোকগীতি হয়ে ওঠে, আর উপনিবেশের নেটিভদের জন্য সেখানকার গির্জায়, খ্রিস্টানদের স্কুলে, প্রার্থনাসঙ্গীতের মতন হয়ে ওঠে ।
–হ্যালেলুয়াআআআআ..
–আঃ অমন বিটকেলভাবে চেঁচাসনি, কী যা হালুয়া-হালুয়া মাথামুন্ডু মানে, তাই জানি না । ওসব ছাড় দিকিনি ।
–কি করে ছাড়ি ! টেসটোসটেরন তো আইরিশ নানরা দিয়ে গেছেন ।
–ছিঃ, কী যে বলিস, ওনারা তোর প্রথম শিক্ষক ছিলেন । শ্রদ্ধা করবি তো ।
–শ্রদ্ধায় কি টেসটোসটেরন থাকতে নেই ! আপনি তো আমার উন্মাদ ক্রাশ, যখন টেসটোসটেরন তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে । আইরিশ নানরা ছিলেন প্রথম ক্রাশ । আপনাকে স্কুলে দেখার আগে কুলসুম আপা নামে এক কিশোরীর হাতে পড়েছিলুম, জানেন ।
–না না, ওসব আমায় বলিসনি, আঁৎকে উঠেছিলেন সুমিতাদি, অনুমান করে ফেলেছিলেন বোধহয় কী ঘটে থাকবে।
–আপনি যে বইগুলো দিয়েছিলেন, আর দাদা মামার বাড়ি থেকে যে দাড়িওয়ালা বইগুলো এনেছিল, সেগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছে যে রাজনীতির তত্ত্ব যতই আকর্ষক হোক না কেন, সবকিছু নির্ভর করে লোকগুলোর ওপর, বুঝলেন, যে লোকগুলো ওই তত্ত্বকে ভালো বাসতে-বাসতে কোনো এক ফাঁকে নিজেকে ভালো বাসতে আরম্ভ করে । ব্যাস , তত্ত্ব একেবারে গুবলেট । ভালোবাসা, অন্যকে বাসলেও, আসলে নিজেকেই ভালোবাসবার মাধ্যম, নয়তো মানুষ কেনই বা বারবার প্রেমে পড়বে ? একজন প্রেমিক বা প্রেমিকাকে ছেড়ে আরেকজনের দিকে এগিয়ে যাবে ?
–ঠিক ধরেছিস । বই লিখে ফ্যাল না ।
–লিখতে আরম্ভ করেছি । খসড়াটা দাদা দিয়েছে বিমানবিহারী মজুমদারের ছেলেকে ,প্রতিক্রিয়া জানাবার জন্য ।
–যা লিখছিস, যা ভাবছিস তাই লেখ । অন্য কারোর মতামতের ওপর নির্ভর করিসনি ।
খসড়াটা দাদা আর বুজলুদা অনুমোদন করে দিলে, রাহুল ওটা দিয়েছিল রক্তিমকে, কলকাতায় কোনো ছাপাখানায় ছাপিয়ে প্রুফ পাঠাতে ।
রক্তিমকে টাকা দিয়েছিল ছাপাবার জন্য ।
তুমি আর লোক পেলে না ? ঘটনাটা শুনে বলেছিলেন প্রদীপন চাটুজ্জে, ও টাকা চলে গেছে শুঁড়ির বাড়ি ।
সুমিতাদি চা তৈরি করার জন্য রান্নাঘরে গেলে, রাহুল চিরকুটটা বই থেকে বের করে ‘ভালোবাসি আপনাকে’ লেখার তলায় লিখে দিয়েছিল, ‘ইতি ভ্লাদিমির ইলিচ’ । তারপর বইটা যেখানে ছিল, গুঁজে দিয়েছিল সেখানে ।
দেয়ালে টাঙানো, ফ্রেম-বাঁধানো, ওনার ক্রচেটের কাজে ধুলো জমে ছিল । কালো আর লাল সুতোয় একটা কাজ আজও মনে আছে রাহুলের । ‘’এনিওয়ান হু নোজ এনিথিং অফ হিসট্রি নোজ দ্যাট গ্রেট সোশাল চেনজেস আর ইমপসিবল উইদাউট ফিমেল আপহিভল । সোশাল প্রগ্রেস ক্যান বি মেজার্ড এগজ্যাক্টলি বাই দি সোশাল পোজিশান অফ দি ফেয়ার সেক্স, দি আগলি ওয়ানস ইনক্লুডেড।’’ দি আগলি ওয়ানস ইনক্লুডেড, এইটুকু ছিল লাল রঙে, বাকিটা কালো সুতোয় ।
–ওইটুকু লাল সুতোয় কেন ?
–ওটা আমার জন্য । আমি তো আগলি, নয়তো আমার প্রেমিক ছেড়ে চলে যাবে কেন, বল । বিপ্লবী মাত্রেই আগলি, সে নারী হোক বা পুরুষ ।
প্রেমিক ? আমি জানতুম সে সুমিতাদির বর ! সে তো ছাড়েনি ; সুমিতাদিই তাকে বের করে দিয়েছেন বাড়ি আর জীবন থেকে, কানপুরের ব্রাহ্মমহলে সেরকমই গুজব ।
সুমিতাদির ডিভোর্সের গুজবও শুনেছিল রাহুল, কিন্তু বর যে কে, তার নাম কী, কেমন দেখতে, কিছুই জানতে পারেনি কখনও । কথা বাড়ালে অন্যের জটিলতায় অযথা জড়িয়ে পড়তে পারে আশঙ্কায়, আচ্ছা চলি বলে কেটে পড়েছিল রাহুল ।
রাহুলের এখন মনে হয়, সুমিতাদি বোধহয় অনুমান করে ফেলেছিলেন যে শেষ পর্যন্ত কী হবে সোভিয়েত রাষ্ট্রের ; দলের হয়ে মসকো ইউক্রেন লেনিনগ্রাড কোথায়-কোথায় বেড়িয়ে এসেছিলেন । সম্ভবত নিজের বৈবাহিক জীবন আর দলীয় সোভিয়েত বৈবাহিক জীবনের রমরমার দিনে। আর কোনোদিন বাচ্চা হবে না, হয়ত এই ভাবনার সঙ্গে গর্বাচভ-ইয়েল্তসিনের কাজ-কারবারকে মিশিয়ে এক ভিন্ন জগতে চলে গিয়েছিলেন সুমিতাদি । নিজেই যে-বিপ্লবীকে যেচে বিয়ে করেছিলেন বলে গুজব, তাকে যে জীবন থেকে লাথিয়ে বের করে দিয়েছিলেন, তাও গুজব, যেন সেই অপদার্থ সোভিয়েত নেতাদের লাথাচ্ছেন, যাদের গুমখুন আর অত্যাচারের জন্য বিপ্লবের স্বপ্ন ঘুচে গিয়েছিল ওনার ।
সুমিতাদি কিন্তু পশ্চিমবাংলার বামপন্হীদের ব্যাপারেও ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, “এরা আরও নৃশংস, দেখে নিস তুই, কালে-কালে নরক গুলজার করে ফেলবে, নেমে যাবে আত্মধ্বংসের গলিঘুঁজিতে ।’’
ওনার গালের টোলের লালচে রঙ যে কমে যাচ্ছে তা উনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টের পেতেন । গালের টোলে দেখতে পেতেন মানব সমাজের ভবিষ্যৎ । পচে যাচ্ছে, পচে যাচ্ছে, পচে যাচ্ছে ।
–দাদা যে সমস্ত পত্রিকা এনেছিলেন, তাতে একটা নাম পেয়েছি, বেশ আকর্ষক, হরিচরণ খাঁড়া ।
–স্কুলে তো একটা মেয়ে ছিল, জানিস না, সারদা খাঁড়া, তোর চেয়ে দু’বছর জুনিয়ার ? ম্যাথসে হানড্রেড পার্সেন্ট মার্কস পেতো । খাঁড়া পদবি হয়, হবে না কেন !
–না, ওনার ঠিকানাও দেয়া আছে পত্রিকাটায় । আপনি কখনও বুদ্ধদেব বসুর পত্রিকায় এই ধরণের পদবি দেখেছেন ? হরিচরণবাবুকে বলেছি আমাদের বাড়িতে আসতে, উনি সালকিয়াতে থাকেন । ওই সময়ে দাদা রক্তিমকেও সঙ্গে আনবেন । আমরা যে আন্দোলন আরম্ভ করতে চলেছি তার জন্য প্ল্যানিং করতে চাই ।
–তোর কাকিমা বলছিলেন বটে; রক্তিম ছেলেটাকে ওনার ভাল্লাগেনি, বদগন্ধে নাকি ভুরভুর করে ।
–হরিচরণবাবু আর রক্তিম চাটুজ্জে এলে নিয়ে আসব আপনার বাড়ি ।
–না না । আমার বাড়িতে আর বিপ্লবীদের পায়ের ধুলো চাই না । তুই ওড়াগে যা বিপ্লবের ধুলোর ঝড় । গালের টোলে আলোর সমুদ্রের ঢেউ তুলে বলেছিলেন সুমিতাদি ।
সুমিতাদির কোমর জড়িয়ে ওপরে তুলে, কমরেড সুমিতাদি জিন্দাবাদ, স্লোগান দেবার, পুরো ইচ্ছেটা, আবার চেপে গেল রাহুল ।
আশ্চর্য যে মোহন পালের বোনের গালেও, দুই গালে, টোল পড়ত । নিজেই নিজের সাইক্লোনের ঘুর্ণিপাকে জড়িয়ে চলে গেছে আত্মহত্যার পথ ধরে ।
অসীম গাঙ্গুলিও চুপচাপ সাইক্লোনের পাক বাঁধছিলেন সেদিন , তা এখন, এই এতকাল পরে জানতে পারছে রাহুল সিংহ।
কানপুরের ছাপাখানার বাংলা হরফ কেবল বিয়ে-পৈতে-শ্রাদ্ধর ম্যাটারে সীমিত, সে খবর রাখে না অনেকেই। অসীম গাঙ্গুলির কথা শুনে একটা আইডিয়া এলো রাহুলের । ঠিক, বিয়ের কার্ড । বিয়ের কার্ডকেও কাজে লাগাতে হবে ।
প্রাপক কার্ড পেয়ে ভাববে বিয়ের নেমন্তন্ন । খুলে দেখবে ক্ষমতার তীব্র আকস্মিকতার মেজাজে ভেতর থেকে
বেরোল শ্বদাঁতের ঝিলিক নিয়ে সাহিত্যের দানবের ঔজ্জ্বল্যের ভ্রুকুটি । যারা বসন্ত ঋতুকে পছন্দ করে না, তাদের একাধটা কালো-গ্রীষ্মের ঘেয়ো স্মৃতি থাকা উচিত । যাদের মাথা ঘাড়ের ওপর নেই তারা জানে না যে তারা টপলেস ।
হরিচরণ খাঁড়া ওরফে দুর্গা বর্মণকে আইডিয়াটা দিতে ও বলেছিল, ‘সব শালারা মুখোশ পরে বসে আছে । একএক জন ভাম, বুঝলে, বর্ষার বাচাল বাঞ্চোত ।’
হরিচরণ খাঁড়া ওরফে দুর্গা বর্মণের কথা শুনে রাহুলের আরেকটা আইডিয়া এল । ঠিক । মুখোশ । জানোয়ার দানব রাক্ষস জোকার ইত্যাদির কাগজের মুখোশ, যার ওপর ছাপানো থাকবে, ‘দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন ।’ পেয়ে কী ভাববেন প্রফুল্লচন্দ্র সেন ?
ইইইইইনটেএএএলেকচুলরা ! চুলগুলোই দেশটাকে ডোবালো, বলবেন মন্ত্রীসভার সদস্যদের ।
প্রদীপন চাটুজ্যে একদিন সাহিত্যিক অমল ধরের বাড়ি গিয়েছিল, জানোতো ? ওই যে হে অমল ধর, বিগব্যানার সাপ্তাহিকের জন্য ছোটোগল্প ছাঁটেন। ওনার বাড়িতে সামনের ঘর থেকে আরম্ভ করে মায় সিঁড়িতেও চারিদিকে নিজের ফোটো টাঙিয়ে রেখেছেন, কয়েকটা বেশ পেল্লাই মাপের ।
প্রদীপনকে বলেছেন ,আপনাদের আন্দোলন আত্মপ্রচারমুখী হয়ে উঠেছে । কথাটা বলে, হাওয়া থেকে একটা অদৃশ্য চুল উপড়ে ফুঁ দিয়ে নাকি উড়িয়েছিলেন ।
বিষের নিঃশব্দ বিকীরণ । লোকে বুঝুক যে তথ্যের মধ্যে বসবাস করে অম্বলের চোঁয়াঢেঁকুর মাখানো সংলাপে ভেজা সময়কে ইতিহাস বলে চালানো যায় না ।
বাগড়ি মার্কেটে চলো, ওখানে হোলসেল দরে মুখোশ পাওয়া যায় । জব প্রেসও আছে কাছাকাছি ।
আরে, ও তো এখন অসীম গাঙ্গুলির ঘরে, খেয়াল হল রাহুলের ।
ওনার পরের কথায় অবস্হান স্পষ্ট হল রাহুলের, ‘নেতার নাম যদি একান্তই দেবার ছিল, নিজের নাম দিলে না কেন ! তুমিই যখন সব করছ তখন নেতা হিসেবে নিজের নাম দিলে না কেন ? আর হরিচরণ খাঁড়া ওরফে দুর্গা বর্মণ নামের সম্পাদকের ভূমিকাই বা তাহলে কী ?‘
যাক , বাঁধাধরা ধারণায় জবর চোট দেয়া গেছে তাহলে । রাহুল চুপ করে রইল ; শোনা যাক ওনার মনের
ভেতরের লুকোনো ইউরেকা চিৎকারগুলো, যা গমগম করতে চাইছে ক্ষোভ আর ক্রোধের ভুলভুলাইয়ায় ।
–এখন বোধহয় এসেছ তোমাদের সঙ্গে যোগদানের প্রস্তাব নিয়ে ! একটা কথা তুমি ভুলে গিয়েছিলে রাহুল ; আমিই তরুণ কবিদের নেতা । তুমি কেন আমার সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন মনে করোনি ? কারা বাধা দিয়েছিল তোমায় ? তুমি কি বুঝতে পারোনি যে আমাকে বাদ দিয়ে আমার বিরুদ্ধে একটা কিছু করার চেষ্টা হচ্ছে? রামায়ণ নট্ট কোম্পানিকে এলেবেলে করে দেবার চেষ্টা হচ্ছে ? অথচ আমিই তোমাকে সাহিত্যে এনেছিলুম ।
আমিই তোমাকে সাহিত্যে এনেছিলুম ।
আমিই তোমাকে এনেছিলুম ।
আমিই তোমাকে….
আমিই….
আমি….
আমি, আই অ্যাম দি এমপেরর ।
তার পরের কথায় রাহুলের মাথার ওপর বোমা ফাটিয়ে দিলেন অসীম গাঙ্গুলি, ‘আমি কি রক্তিমের থুতু চাটব ?’
অসীম গাঙ্গুলি এভাবে ক্ষেপে গেলেন কেন, তাও আচমকা, এতক্ষণে ঠাহর করতে পারল রাহুল , যার ডাক নাম রাহু, আর যার দাদার ডাক নাম কেতু । ওর , রাহুলের বা রাহুর, মনে হল, নেতিপ্রধান আলো আর ইতিপ্রধান অন্ধকারের পাঁচিল তুলে দূরত্বের ইঙ্গিত দিতে চাইছেন উনি, মানে অসীম ঘাঙ্গুলি, রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারীমশায় । ও যতটা পরিচিত ততটাই আগন্তুক হয়ে উঠছিল ওনার দোতলার ঘরে বসে । হয়ত, হয়ত কেন, বোধহয়, বা বোধহয়ও নয়, ওনার হৈতুকবাদী উষ্মা কাটিয়ে ভেসে আসছিল নিয়মনিষ্ঠ রক্ষণশিলতার সীসকবর্ণ অদৃশ্য গোমরের মেঘ।
এই বাড়িটায় ঢোকার মুখে গেট থেকে অনেকটা জায়গা ফাঁকা । পাঁচিলের ধারে-ধারে রক্তকরবী । দীর্ঘ পলাশ গাছ, রক্তকরবীদের জেঠামশায়, ছেয়ে আছে লালচে গোলাপিতে । কিন্তু সে যাই হোক, তার ডালে বসে কয়েকটা কাক, কে জানে কোন ভাষায়, ঝগড়া করছিল, হয়ত দুর্গন্ধের নান্দনিকতা নিয়ে ।
অসীম গাঙ্গুলির কথাটা , যা শুনে রাহুলের মনে হচ্ছিল ,স্মৃতির আগের শৈশবে পাওয়া কোনো তথ্য মেলে ধরতে চাইছেন উনি, তা মিথ্যা নয় । রাহুলের দাদা অনিকেতের সহপাঠী ছিলেন অসীম । সেই সূত্রে রাহুলদের শ্যাওড়াফুলি বাড়ির খণ্ডহরের আলকাৎরা মাখা কেঠো চিলেকোঠায় নিকোটিনের কুণ্ডলী-পাকানো নিঃশব্দ বিকিরণের আওতায় আড্ডাধারী দাদার বন্ধুদের মাঝে বসে, ছায়া গড়তে পারে না এমন দুর্বল রোদের মতন কন্ঠে ওনার গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেছিল রাহুল :-
অনেক দিনের আমার যে গান আমার কাছে ফিরে আসে
তারে আমি শুধাই, তুমি ঘুরে বেড়াও কোন বাতাসে ।।
যেফুল গেছে সকল ফেলে গন্ধ তাহার কোথায় পেলে,
যার আসা আজ শূন্য হল কী সুর জাগাও তাহার আশে ।।
সকল গৃহ হারাল যার তোমার তানে তারি বাসা,
যার বিরহের নাই অবসান তার মিলনের আনে ভাষা ।
শুকালো যেই নয়নবারি তোমার সুরে কাঁদন তারি,
ভোলা দিনের বাহন তুমি স্বপন ভাসাও দূর আকাশে ।।
এই গানের দরুন আবহাওয়া কিছুটা বুড়োটে হয়ে উঠেছিল বলে অশোক মিত্র গমগমে গলায় গেয়ে উঠেছিলেন:-
নাই ভয় নাই ভয় নাই রে ।
থাক পড়ে থাক ভয় বাইরে ।।
জাগো মৃত্যুঞ্জয় চিত্তে, থৈ থৈ নর্তননৃত্যে ।
ওরে মন বন্ধনছিন্ন
দাও তালি তাই তাই তাইরে ।।
রূপক মজুমদার ওই গানটাই আরও উঁচু গলায় গাইতে, দাদা অনিকেত রূপকদাকে বলেছিলেন, ‘চুপ চুপ, ঠাকুমার কানে গেলে চেঁচাবেন, জানিস না রবীন্দ্রনাথ আমাদের বাড়িতে নিষিদ্ধ, বেম্মো বলে ; অন্য গান ধর’ ।
রূপকদা, যিনি হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের মাপজোকের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, গেয়ে উঠেছিলেন :-
হম দর্দকে মারোঁ কা, ইতনাহি ফসানা হ্যায়
পিনেকো শরাবে ঘম, দিল ঘম কা নিশানা হ্যায়
তকদির কে হাথোঁ মেঁ মরনে কি তমন্না হ্যায়
হম দর্দকে মারোঁ কা ইতনাহি ফসানা হ্যায়…
কোনো মানুষকে দেখলেই বা তার সঙ্গে পরিচিত হলেই তার জীবনের গল্প জানার আগ্রহের অভ্যাস না থাকায়, চিলেকোঠায় বেশিক্ষণ বসেনি রাহুল , গানও পুরোটা শোনেনি । তাছাড়া দাদা অনিকেত আর দাদার বন্ধু রূপক মজুমদারও ইশারার মাধ্যমে জানিয়েছিলেন যে এটা বড়োদের জমায়েত, তুই এখন যা । রূপকদাকে একবার ওর পিসতুতো দাদার সঙ্গে হিন্দি ফিলমের নায়িকা রেহানা, সুরাইয়াকে নিয়ে তর্ক করতে শুনেছিল রাহুল । বিষয় ছিল যৌনতা।
পিসতুতো দাদা ঝণ্টু, ভালো নাম দুর্জয় চক্রবর্তী , কান নাড়তে পারেন ইচ্ছামতো, হাসির নিঃশ্বাস নাক দিয়ে বের করার অভ্যাস, কলকাতার আদি বনেদি পরিবারের কিনা , তাই কথা বলার সময়ে বহু অক্ষর উহ্য থেকে যায়, ওনার দাবি ছিল যে সুরাইয়ার যৌনতা রেহানার চেয়ে বেশি ।
রূপক মজুমদার দাবি করছিলেন রেহানার বেশি ; সানডে কে সানডে আনা মেরি জান শুনেছেন ?
পরনোগ্রাফিক ফিনকির লালচে চোখ কুঁচকিয়ে ঝণ্টুদা, দিশি মদ খেয়ে-খেয়ে যাঁর দাঁতে কালচে ছোপ পড়ে গেছে, চটে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ রেহানা তো বিশ্বাসঘাতক , পাবলিকের ভালোবাসা পেয়েও পাকিস্তানে পালিয়েছে।’
–পাকিস্তানে চলে গেলেই কি তার যৌনতা নষ্ট হয়ে যায় ?
–আপনি রেহানার ওখানে হাত দিয়ে দেখেছেন নাকি ?
–হাত দিয়ে যদি দেখেন তাহলে একজন রূপসীর থেকে আরেকজনের পার্থক্য অনুভব করতে পারবেন না ।
–অনুভব আবার কী ?
–রক্তমাংসকে অনুভব করতে হয় । আপনি যখন চুমু খান তখন তার অনুভূতিকে স্পর্শ করেন , তার স্বাদ গ্রহণ করেন ।
–আরে মশায় আমাকে শেখাবেন না । আমি স্কুলের সময় থেকে সোনাগাছি যাচ্ছি ।
–তাহলে তো একেবারেই বুঝতে পারবেন না । প্রেম করেছেন কখনও ?
–প্রেম তো অযথা সময় নষ্ট । মজনু যদি লায়লাকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করত, তাহলে তার পরে আরও তিনটে মেয়েকে বিয়ে করত, বুঝলেন, প্রেমের শুধু গপ্পো হয় । মার্ক করেছেন কি যে যারা প্রেম করে তারা লম্পট ? আপনার লেখক বন্ধুদেরই দেখুন না ; উইকেন্ডে সোনাগাছি-হাড়কাটা-খিদিরপুর করে বেড়ায় । আমিই সেসব ঘোঁতঘাতের হদিশ দিয়েছি। ওরা কেউই জানত না কোথায় ইমাম বক্স লেন আর কোথায় অবিনাশ কবিরাজ লেন ।
–আপনার সঙ্গে বিতর্কে গিয়ে আমারও সময় নষ্ট, আপনি বরং হাত দিয়েই অন্যের আকর্ষণের মনোহারিত্বে বসবাস করুন । তবে আপনার আঙুলে স্পর্শের আকুলতা নেই বলেই মনে হয় । লজ্জাবোধের রক্ত আপনার দু’গালে হৃদয় থেকে উঠে আসে না । আপনার মতো লোকদের চাউনির চাহিদা মেটাতে গিয়েই অধিকাংশ যুবতীকে ক্লান্ত দেখায় ।
রাহুলের মনে হল, প্রেমিকও হতে হবে, অপ্রেমিকও হতে হবে, নয়তো নিজের মধ্যে ঝড়ের হ্যাঙ্গামের মজা কোনো দিনই টের পাবে না । দুটোর একটা অধরা থেকে যাবে ; ঝড় চলে যাবে পাশ কাটিয়ে ।
রূপকদা সারাটা জীবন ওই ঝড়ের চোখের ভেতরে পাক খেয়ে কাটিয়েছেন ।
রূপকদার কতরকমের যে রূপ ! দাদা অনিকেত যখন ধানবাদে চাকরি করত, রাহুল একবার গিয়ে দেখেছিল যে রুপকদা বাসন মাজছেন । সেই রূপকদা পরে বাউলদের সঙ্গে নিয়ে এদেশ-সেদেশ করে বেড়ালেন, কত রেহানার সঙ্গ পেলেন, ওখানে-সেখানে হাত দিলেন, তারপর ফিরে এলেন রূপসী বাংলার হাতছানিতে ; ওখানে হাত দিয়ে দেখতে ।
দেশের বাড়ির খণ্ডহরে গেলে, রাহুলের প্রধান আকর্ষণ ছিল ঠাকুমা সবাকসুন্দরী দেবীর সঙ্গে সময় কাটানো, ওনার মুখে ওনার ছোটোবেলার গল্প শোনা, ওনার বিয়ের পর জড়ো করা পারিবারিক কেচ্ছা । রাহুলের মনে হতো ঠাকুমা সবাকসুন্দরী দেবী কন্ঠ দিয়ে চিন্তা করেন । সারাদিন খালি গায়ে থাকেন, বুকের ওপর শুকিয়ে যাওয়া মাই ঝুলিয়ে, কোমরে গামছা বেঁধে, আর নিজের সঙ্গে অনর্গল নিজে কথা বলেন, অনর্গল । রাহুল ওনাকে খন্ডহরে চিরকাল এই পোশাকেই দেখেছে, শীতেও । কোন বয়সে পৌঁছে নারী অমন যৌনতার বোধ হারিয়ে ফেলে, ভেবেছে রাহুল । মেয়েরা তো নিজেদের দেহ নিয়ে কত সচেতন । ঠাকুমার অনেককিছু সহ্য হয় না।
গরম আমি সহ্য করতে পারি না ।
গান-বাজনা আমি সহ্য করতে পারি না ।
খবরের কাগজ আমি সহ্য করতে পারি না ।
বউ-ঝিদের হাসাহাসি আমি একেবারে সহ্য করতে পারি না ।
বিউলির ডালের গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না ।
বাজি ফাটানো আমি সহ্য করতে পারি না ।
দোল-খেলা আমি সহ্য করতে পারি না ।
রাহুলের জন্মের আগেই ঠাকুরদা মারা গিয়েছিলেন ; দাদা অনিকেতের স্মৃতিও আবছা । দাদুর যাকিছু ভালো লাগত তা আর ঠাকুমার সহ্য হয় না । অনিকেতের সংগ্রহের সাহিত্যের বইগুলোকে উনি মনে করতেন সময় নষ্ট । অনিকেত স্নাতকের পরীক্ষা দিয়ে সবকটা বই কয়েকটা বস্তায় বেঁধে দেশের বাড়ি থেকে কানপুরের বাড়িতে এনে রাহুলের সোপর্দ করে দিয়েছিল । বেশির ভাব নটের নামই অচেনা । কোথায় বিক্রি হয় এসব বই !
রাহুল সিংহের সমবয়সী সাহিত্যিকরা কেউ গান গায় না ; গানে তেমন আগ্রহ নেই কারোর । নবদেব দাশগুপ্ত বাংলা-হিন্দি সিনেমার এঁটুলি , প্রথম পরিচয়ের দিনই হিন্দি ফিল্ম এর গান গেয়ে শুনিয়েছিল অথচ বামপন্হীরা গদিতে বসতেই , গান গাইতে হলে কমিউনিস্ট ইনটারন্যাশানাল, ব্যাস । সিনেমার গান গাইতে লজ্জা করে অথচ অ্যান্টিএসট্যাবলিশমেন্ট ।
রাহুলের স্কুল-কলেজের বন্ধুরা, যে তিনজন জিগরি-দোস্ত ছিল, তারা তো অবশ্যই, গলা ছেড়ে রাস্তাঘাটেও গান গাইত । নবীন গুপ্ত তো শচীনদেব বর্মনের ভক্ত । ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে বিঠুর দুর্গের ধারে গঙ্গা নদীর পাড়ে তালগাছের তলায় বসে সদ্য-নামানো দুপুরের গ্যাঁজানো তাড়ি টেনে চেঁচিয়ে অতুলপ্রসাদ গাইত । তাড়ির মাটির হাঁড়িতে পৈতের আংটি-পরা আঙুলে তবলা বাজাত অর্ণব উপাধ্যায় । তাড়ি টেনে বাঙালিয়ানার ইনফিডেল ভান্ডাফোড় :-
জল বলে চল, মোর সাথে চল
তোর আঁখিজল, হবে না বিফল, কখনো হবে না বিফল ।
চেয়ে দেখ মোর নীল জলে শত চাঁদ করে টলমল
জল বলে চল মোর সাথে চল ।
বধূরে আন ত্বরা করি, বধূরে আন ত্বরা করি,
কূলে এসে মধু হেসে ভরবে গাগরি
ভরবে প্রেমের হৃদকলসি, করবে ছলছল ।
জল বলে চল, মোর সাথে চল ।
মোরা বাহিরে চঞ্চল, মোরা অন্তরে অতল,
সে অতলে সদা জ্বলে রতন উজ্বল ।
এই বুকে, ফোটে সুখে,হাসিমুখে শতদল
নহে তীরে, এই নীরে, গভীরে শীতল ।
জল বলে চল, মোর সাথে চল ।
–তাড়ি টানলে অতুলপ্রসাদ গাইতে ইচ্ছে করে কেন রে ?
–মগজে ঢুকে কেউ কাঁদতে থাকে, ‘শূন্য এ-বুকে পাখি মোর…’
–গীতবিতান হাত থেকে পড়ে গেলে তাড়ির হাঁড়ি ভাঙার আওয়াজ হয়, মার্ক করেছিস ?
কলেজে ঢুকে, ফার্স্ট ইয়ারে, গঙ্গার ঘাটে, বিঠুর দুর্গের ভাঙা পাথরের পাঁজার ওপর বসে, গাঁজা টেনে, রাহুল, নবীন, অর্ণব আর বরুণ ধর চারজনে মিলে জসিমউদ্দিন-শচীনদেব বর্মণ :-
নিশিতে যাইও ফুলবনে
–রে ভোমরা
নিশিতে যাইও ফুলবনে ।।
জ্বালায়ে চান্দের বাতি
আমি জেগে রব সারা রাতি গোওওওওওও ;
আমি কব কথা শিশিরের সনে
–রে ভোমরা ।
নিশিতে যাইও ফুলবনে ।।
তুমি নীরব চরণে যাইও
–রে ভোমরা ।
নিশিতে যাইও ফুলবনেএএএএএএ…
ওদের আচরণে একজন অধ্যাপক আরেকজনকে বললেন, স্পষ্ট শুনতে পেল রাহুল, ‘ফার্স্ট ইয়ার মেঁ হি নশে মেঁ ধুত হ্যায় পাগল সব । ‘
আশ্চর্য, নিজে নিজের মালিক হবে, তাতেও ব্যাগড়া ।
গাঁজা টেনে বাড়ি ফিরে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল বরুণ । ওর মা ওকে রাহুলদের সঙ্গে মিশতে বারণ করতেন । যত্তোসব দলিদ্দর বাড়ির ছেলে । চোপোর দিন গাঁজা ভাঙ খেয়ে স্বাস্হ্যের দফারফা । তাড়ি খেতে নিষেধ করতেন না ।
তাড়ি খেলে মোটা হয় মনে করে ওনারা ভাবতেন বরুণের চেহারার খোলতাই হচ্ছে। কয়েকদিন জ্বরে ভোগার পর সারছিল না বলে কলকাতায় নিয়ে গেলেন ওর বাবা । তখন ধরা পড়ে গেল ওর লিউকেমিয়া রোগ ।
কানপুর শহরে সে-সময়ে, কেমোথেরাপির, বোন ম্যারো ট্র্যান্সপ্ল্যান্টৈর, কোনো চিকিৎসা ব্যবস্হা ছিল না । চিকিৎসার জন্য বারবার কলকাতা যেতে হতো । একবার কলকাতা থেকে ফিরে, টাকমাথা তখন বরুণের, বললে, কেমোথেরাপিও এক টাইপের অপেরা রে, তুই কলমে লিখিস, নবীন গায়, অর্ণব আবৃত্তি করে, এই যা । জাস্ট সহ্য করার ক্ষমতা চাই, কলকাতায় না গেলে তোদের রোগ সারা কঠিন ।
বরুণের সঙ্গে কতবার বাড়ি থেকে পালিয়েছে রাহুল , বাড়িতে বাবা-মাকে না বলে, এক কাপড়ে, একটা গামছা নিয়ে বরুণের সঙ্গে উধাও হয়ে গেছে । বাড়ি ফেরার পর বাবা-মা কখনও কোনো জবাবদিহি চাননি, বা কোথায় গিয়েছিল তা জানতে চাননি । বরুণের আত্মীয়ের ট্রাকে চেপে নানা শহরে চলে যেত । পথের ধারে ঢাবায় ড্রাইভারদের সঙ্গে চারপাইয়ে বসে তড়কা-রুটি আর ঠররা বা আধপোড়া মুর্গীর সঙ্গে রাম । ধানকাটা খোড়ো-খেতে, সন্ধ্যাবেলায়, সেই যে-মাঠে অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধ লড়েছিল, তেরপল পেতে গন্ধকগন্ধা শাড়িখোলা যুবতী, যার বয়স, অন্ধকারের আদরা দেখে আঁচ করল, ওদের চেয়ে বেশি ; তার মুখ থেকেও দিশি মদের ভুরভুর। কেননা ,ড্রাইভার জ্ঞান দিয়েছিল, মদ না খেলে যুবতীদের মুখের দুর্গন্ধে খদ্দের পালিয়ে যায় । রোজই তো আর গাবভেরেন্ডার দাঁতন করা হয়ে ওঠে না ।
ড্রাইভার বলেছিল, যাও, মালিক, সঙ্গত করে এসো, ওই খড়ের আঁটির ঢিপির ওদিকে । রাহুল আর বরুণ গিয়ে দেখে, পাতা তেরপলের ওপর একজন বউ । ওদের দেখতে পেয়ে বউটা শাড়ি খুলে ফেলল । ওরা দুজনে একসঙ্গে বলে উঠল, ব্যাস ব্যাস । বউটা তখন, সময়ের রঙে রাঙানো ওই অন্ধকারে, যেন ছায়ার মাংস দিয়ে গড়া ডানা নাচিয়ে, আকাশ থেকে নেমে আসা নক্ষত্রগুলোকে, যেগুলো জোনাকির আদলে ওকে ঘিরে উড়ছিল, তাদের শুনিয়ে গাইতে লাগল, ‘জাদুগরো সাঁইয়া ছোড়ু মোরু বাঁইয়া হো গোয়ি আধিরাতো, আবো ঘরো জানো দো ।’ ওইটুকুই বেশ বারকয়েক গাইবার পর, বরুণ মেয়েটাকে বললে, ‘হো হো আবো ঘরো যাও, আর পাকা ধানের গন্ধের স্ট্রিপটিজ দেখাতে হবে না ।’ রাহুলকে বলেছিল, ড্রাইভারগুলো অন্ধকারে কেন জানিস ফাকাফাকি করে ? নিজেই তার উত্তর দিয়েছিল, ‘তাহলে মন দিয়ে রাতভর গাড়ি চালাতে পারে ।’
বরুণ টর্চ জ্বালাতেই চেঁচিয়ে বসে পড়েছিল বউটা ।
সম্রাট অশোক এই মাঠে যুদ্ধ করেছিল ; সৈন্যরা কি তখনকার দিনে ফাকাফাকি করত ! পরের দিন আবার লড়তে হবে বলে রাতভর ঝাঁপিয়ে পড়ে এর-তার সঙ্গে ? রাহুলরা সেইসব সৈন্যদের রক্ত-সম্পর্কের যোদ্ধাভুত হয়ে সেই মাঠে নেমেছে । সিংহ খেতাব তো গৌড়ের রাজার দেয়া ; কোনো যুদ্ধ লড়ে জেতার ঘুষ , সেটাই বয়ে বেড়াচ্ছে রাহুল ।
বরুণের মামা ট্রাক ড্রাইভারদের যে বাড়তি টাকা দেন তাতে, বরুণ বললে, ফাক করার খরচও অন্তর্ভুক্ত । বরুণ অন্ধকারে পার্স বের করে দুটো টাকা বউটাকে দিতে চাইলে ; নিল না ।
ফিরে দড়ির খাটে গিয়ে বসতে, ড্রাইভারকে সেকথা জানাতে , পাগড়ি খুলে কাঁধে চুল-নামানো পাঞ্জাবি ট্রাকচালক বললে, আরে মালিক ,আমি টাকা ওর মরদকে দিয়ে দিয়েছি, ওই যে, ওর মরদ, বাসনগুলো তুলে নিয়ে মাজতে বসেছে । সকলে ওর মরদকেই টাকা দিয়ে দ্যায় । মরদকে দেখে রাহুলের মনে হয়েছিল তেমন গরিব তো নয়, যে এভাবে বাড়তি আয় করতে হবে । বাড়তি আয় ব্যাপারটা বোধহয় একরকমের সুযোগ ; লোকটা তার , যাকে বলে সদ্ব্যবহার, তা-ই করে নিচ্ছে । ও ওর বউকে ভালোবাসে নিশ্চয়ই , তার ব্যাখ্যা যেমনই হোক না কেন । তার মানে ভালোবাসা হল অবস্হানবিশেষ, নর-নারীর নির্দিষ্ট হাল !
–তাহলে তেরপলটা তুলে আনো, যা কাজ করার তা তো হয়ে গেছে ?
–তেরপলটাও ওদেরই মালিক ।
চিকিৎসার জন্য বরুণ এতবার কলকাতা যেত যে কবে ফিরল কবে গেল তার খবর পেত না ওরা। মন খারাপের ভয়ে আর ওদের পাল্লায় পড়ে বরুণ রোগটা ধরিয়েছে শুনে-শুনে ওর বাড়ি মুখো হয়নি । ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল বলা যায় ।
মারা যাবার বেশ কিছুকাল পরে রাহুল ওর মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিল। সংবাদটা যেদিন পেল, সেদিন বাড়ি ফিরে অন্ধকার ঘরে চুপচাপ বসেছিল । অন্য দিন অফিস থেকে ফিরে ওর চার বছরের মেয়ের সঙ্গে খেলা করত । লক্ষ্য করল ওর মেয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে, পেছনে দুটি হাত । রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, তুমি দাদু-ঠাকুমাকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালাতে ।
চারজনের মধ্যে বরুণই প্রথম খসে গিয়েছিল । নবীন ছেড়ে দিলে গান গাওয়া ; অর্ণব ছেড়ে দিলে আবৃত্তি । রাহুলের ক্ষেত্রে ফল হল বিপরীত । লেখালিখি আর একাকীত্ব ওকে পেয়ে বসল। ক্রমশ, যাকে বলে রেকলুজ, তাই হয়ে গেল রাহুল । আলফা সিংহের মতন রেকলুজ । তিনজনেই বরুণের মৃত্যুর দায়টা স্বীকার করে নিয়েছিল , রাহুল বেশি করে, আর সেই অকারণ অপরাধবোধ ওকে ছেড়ে যায়নি আজও, সত্তর পেরিয়ে যাবার পরও ।
কানপুরে বরুণের স্মৃতি থেকে বেরোনো অসম্ভব হয়ে উঠছিল বলে নোট পোড়াবার চাকরি ছেড়ে গ্রামীণ উন্নয়নের চাকরি পেয়ে রাহুল অন্য শহরে চলে গেল, কলকাতায় গেলে সেখানেও বরুণের অনুপস্হিত উপস্হিতি এড়ানো যাবে না, তাই কলকাতায় গেল না । বরুণের স্মৃতি থেকে বেরোবার জন্য একের পর এক শহর বদলেছে, একই শহরে বারবার বাড়ি পালটিয়েছে । বরুণ যায়নি স্মৃতি থেকে ।
কলকাতায় বারকয়েক গিয়ে, পিসেমশায়ের বাসায় থাকার সময়ে, দাদার প্রায় সব বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল রাহুলের । রূপক মজুমদার আর দাদার সঙ্গে গিয়েছিল নাটকের মহড়ায় ।
তার বেশ কিছুকাল পর দাদার সঙ্গে রাহুলদের কানপুরের আধখ্যাঁচড়া চূনকামহীন বাড়িতে , তখনও পুরো তৈরি হয়নি, শীতকালে এসেছিলেন অসীম গাঙ্গুলি । দাদা আর অসীম গাঙ্গুলি দুজনেই তখন ধুতি আর হাফশার্ট পরতেন । গন্ধ থেকে টের পেয়েছিল রাহুল , স্হানীয় দিশি মদ ঠররা খেয়েছিলেন নিশ্চয়ই, দোতলার আলসের নর্দমার কাছে বসে অসীম গাঙ্গুলি বমি করতে লাগলেন রাত এগারোটা নাগাদ, ওয়াক-ওয়াক-ওয়াক-ওয়াক অপেরা । রাহু-কেতু, বা রাহুল-অনিকেতের মা তখন রান্নাঘর পরিষ্কার করছিলেন । ওনার উষ্মা মনে আছে রাহুলের, ‘এই রাহু-কেতুর বন্ধুরা মদ খেয়ে সামলাতে পারে না যখন তখন যতটা পারে ততটা খেলেই তো হয় ‘। তারপর উনি রাহুলকে ডেকে দুটো লেবু নেঙড়ানো জল পাঠিয়েছিলেন, অসীমদার জন্য ।
গামছা এগিয়ে দিলে, মুখ পুঁছে লেবুজল চোঁচোঁ খেয়ে, অসীম গাঙ্গুলি বলেছিলেন, অনেকটা স্বগতসংলাপের ভঙ্গীতে, যেন হাতির দাঁতের তৈরি ব্যাবেল-মিনারের চূড়া থেকে, ‘ও তুমিই রাহুল, রাহু ? তুমি তো সূর্যকে কালো রঙে রাঙিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখো । কাল সকালে কথা হবে’ । স্বগতসংলাপের অতিরেকে ছিল স্বর্গোদ্যানের আপেলে কামড় দেবার অভিজ্ঞতা।
সকালবেলা, দাদা আর ওনার বন্ধুকে চা বিস্কুট দিতে গেলে, অসীম গাঙ্গুলি বলেছিলেন, ‘বাড়ি থেকে হাত খরচ পাও?’‘
–না, পাই না, তার জন্য দুজন ছাত্রীকে পড়াই ।
–বাংলায় গল্প কবিতা প্রবন্ধ লেখো না কেন ?
রাহুলের দাদা অনিকেত বলেছিলেন, ও গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ লিখছে আজকাল, ফাইলটা দিয়েছি বিমানবিহারী মজুমদারের ছেলেকে, আমার সঙ্গে স্কুলে পড়ত ; ক্রিয়েটিভ লেখাও কয়েকটা লিখেছে ওর ডায়েরিতে ।
— ভালো তো । যা লিখছ সবই আমায় পাঠাতে পারো ; আমি প্রকাশের ব্যবস্হা করে দেব । তার জন্য হাত খরচের টাকা পেয়ে যাবে । টিউশানি করে অযথা সময় নষ্ট করতে হবে না । নিজের নামে যদি লিখতে অস্বস্তি হয় তাহলে ছদ্মনামে লিখতে পারো । ছাত্রীদের কেউ প্রেমিকা নয় তো ?
–টাকা !
— যে কোনো বিষয়ে লিখতে পারো । পাণ্ডুলিপি কী ভাবে তৈরি করতে হয় জানোতো ? পরীক্ষার খাতার মতো ।
অনুপ্রবেশ্য আভার একাকীত্বের জেলগারদে তখন নিজেকে ঘিরে রাখত রাহুল ; অহংকারের তরল আলকাৎরার বিছানায় শুয়ে আমুদে গড়াগড়ি খেত । টাকায় কি অপেরা থাকে ? স্বর্ণমুদ্রার স্বকীয়মূল্য হিসাবে ভাবা যায় কি ক্রিয়েটিভ লেখাকে ? তা তো অবৈধ গুপ্তপ্রণয়ের মতন, বা নিজের সঙ্গে নিজে গুপ্তচক্রান্তের মতন, ইনট্র্যানসিজেন্ট । পশু-পাখিদের অপেরা নেই কেননা তারা চমকে উঠতে পারে, কিন্তু তাদের বিস্মিত হবার চেতনা নেই, চমৎকারে মোহিত হয় না । অপেরাকাররা তাই অবজ্ঞাপূর্ণ অনিশ্চয়তার পীড়ায় ভুগতে পছন্দ করে, প্রশংসনীয় দুঃসাহসের সপ্রতিভ প্রদর্শনী জাহির করে বেড়ায় ।
স্নাতকোত্তরের ফল বেরোতেই অধ্যাপকের চাকরি পেয়েছিল, দুদুটো, একটা ত্রিপুরায় আর একটা আসামে । গেলনা । নিজে রান্না করে, বা হোটেলে খেতে হবে, ঠররা খাবার ভুরভুরে অসুবিধা, পাতা ফোঁকার পথে নকল গাম্ভীর্যের অসুবিধে, এইসব ভেবে, গেল না । কানপুর শহরেই চাকরি পেয়ে গেল । বাবা বললেন আমাকে টাকা দিতে হবে না, নিজের জামা-জুতো বইপত্তর এবার নিজের খরচে চালাও । মা বললেন, মুরগির মাংস কিনে আনিস, আমি রেঁধে দেব, তোর তো খেতে ইচ্ছে করে জানি । তবে সিগারেট বেশি খাসনি । জানি, সুমিতার আড্ডায় গিয়ে বিড়ি-সিগারেট খাস ।
রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমমম, বোধহয় কত, থাকগে,সে যা-ই হোক, কী-ই বা এসে যায় !
রাহুল লেখালিখির টেবল কিনল, বইপত্রের আলমারি তৈরি করাল, ট্রানজিসটার কিনল, রাজপথের ওপরে বইয়ের বড়ো দোকানটায় অর্ডার দিয়ে রাখত বইয়ের, ইংরেজি বইয়ের । বাংলা বই অনিকেত নিয়ে আসত কলকাতা থেকে ।
বইয়ের পোকা রাহুল একা ছিল না । আলমারিতে অনাকাঙ্খিত কীটরাও বই ফুটো করার শ্রমদান করত । কোনো-কোনো উদগ্রীব পোকা একটা বইতে ঢুকে একের পর এক বইয়ের ভেতর দিয়ে টানেল তৈরি করে জ্ঞান-কোষাগারের খোঁজে বেরিয়ে, মনে করিয়ে দিত যে বইগুলো রাহুল কেনই বা কিনেছিল, স্রেফ সাজিয়ে রাখার জন্য ? হ্যাঁ, কতো বই স্রেফ সাজাবার জন্যই হয়, বাড়ির লোকেরা পড়ে না, যে কিনেছে সেও পড়া হয়ে যাবার পরও কেন যে বইটাকে আলমারিতে গুছিয়ে বা গুঁজে রাখে, তার উত্তর সে নিজেই হয়ত বলতে পারবে না ।
দাদা অনিকেত যে বইগুলো কলকাতা থেকে পাত্তাড়ি গুটিয়ে চলে আসার সময়ে এনেছিল, সেগুলো, ওই যখন এনেছিল, তখনই পড়ে ফেলেছিল রাহুল; তবু পড়ে আছে বইগুলো, পড়ে-পড়ে বলদের মতো তাকিয়ে থাকে, কখন তাদের ল্যাজে মোচড় দিয়ে কাজে লাগানো হবে। কোনো খেতমজুর-পাঠক পেলে রাহুল তার মুখে হাসি ফোটাতে দিয়ে দিত । সেই ফাঁকে উই আর সিলভার মথরা বইগুলোর ভেতরে হরপ্পা-মহেঞ্জোদরো বানাতে থাকে । অবশ্য কিছু বই পোকাদের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল, সেই যখন রাহুল কলকাতায় মামলা লড়তে ব্যস্ত, তখন বেশ কয়েকজন বইচোর, কী মাসিমা, কেমন আছেন, রাহুলের মামলা এখনও চলছে নাকি, হ্যাঁ কাগজে দেখেছি, বুলির ঘুমের ওষুধ ছড়িয়ে, ভারতে দুষ্প্রাপ্য বই ঝোলায় পুরে, মাসিমার পায়ে গদগদ প্রণাম জানিয়ে, কেটে পড়ত।
অসীম গাঙ্গুলিকে বাদ দেবার কথা, আন্দোলন শুরু করার সময়ে, কই, ভাবেনি তো রাহুল । আন্দোলনে নেয়া বা বাদ দেয়া ইত্যাদি গালভারী প্যাঁচপয়জারগুলো আসেনি মগজে । আর বাদই বা দেয়া হবে কেন ! বাদ দেবার ক্ষমতা মানুষ কোথা থেকে পায় ? একে বাদ দাও, তাকে বাদ দাও, অসহিষ্ণুতার চূড়ান্ত ! মনুস্মৃতি পড়ে তো আর রাহুলরা জাত্যাভিমানের পিরামিড গড়েনি ; ইংরেজদের দেখাদেখি কালা আদমিদের বাদ দেবার আধুনিকতাবাদী থিম সংও
বাঁধেনি । বাদ দেয়া হচ্ছে না, হবে না, ঘোষণা করার জন্যই তো হরিচরণ খাঁড়াকে দায় নিতে অনুরোধ করা হয়েছে । দাদার বন্ধু, রক্তিম চাটুজ্জে তখন বলেছিলেন, অসীমকেও আমি আনব, রোসো ; আওয়াজটা আগে তুলে দেওয়া যাক ।
ডাক নাম যেহেতু রাহু, সেকারণে দেবতাদের মোহিনী ষড়যন্ত্রের আঁচ পায়নি । বুঝতে পারেনি যে অসীমকে না জানিয়ে আওয়াজ তুলতে চাইছেন রক্তিম । পরে প্রদীপন চাটুজ্জে, যাঁর আসল নাম নৃপতি, তিনিও, মানে প্রদীপনও, পরামর্শ দিয়েছিলেন যে সবাইকে অমন জানিয়ে কী করবে ! দেখোই না কী ঘটে । তুমি তো আর ফুটবল টিম তৈরি করছ না যে ক্যাপ্টেন দরকার। সময় তোমাকে দিয়ে যা করিয়ে নিচ্ছে তা সময়ের ব্যাপার, বুঝলে, তোমার এতে কোনো অবদান নেই ; তুমি জাস্ট ওয়ার ক্রাই বজায় রাখো । গিভ এ ড্যাম টু ওয়ান অ্যান্ড অল ।
ফলে, রাহুলের কন্ঠ থেকে : হ্যালেলুয়াআআআআ….
ফুটবল টিম ! প্রকারান্তরে উনিও, মানে প্রদীপন চাটুজ্জেও, বলেছিলেন, ফুটবল টিমের মতো কাউকে ক্যাপ্টেন রাখার প্রয়োজন নেই । রক্তিমের নামে নেতা যোগ করায় উনিও অখুশি । উনিও বাদ দিতে চাইলেন অসীম গাঙ্গুলিকে ।
এতক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন অসীম গাঙ্গুলি । খাটে বসলেন ।
–তুমি উপলক্ষ্য মাত্র । তোমার কি মনে হয় না যে তুমি দায়িত্ববোধহীন কাজ করছ ?
–পুরো ব্যাপারটা আমার পরিকল্পিত, বলল রাহুল, যার ডাক নাম রাহু । বিছানা থেকে লিফলেটটা , যার পিঠে জরুরি ঠিকানা লিখে রেখেছিল, তুলে ,ভাঁজ করে ,পকেটে রেখে যোগ করল, এটা আমারই লেখা, আর আপনি বলছেন যে আমি উপলক্ষ্য , আসল লক্ষ্য আপনি ! রাহুল, যার ডাক নাম রাহু , মগজের রসায়ন চেপে রাখার চেষ্টা করেও পারল না । বলল, আসলে দায়িত্ববোধহীনতাই তো গতি , নিজস্ব দায়িত্বহীনতার আক্রমণাত্মক বোধ, আমার কাছে ক্রিয়েটিভিটি অন্তত তা-ই, আমি আমিই ।’
রাহুলের বর্ণময় কন্ঠস্বর ঘেউ-ঘেউ স্তরে চলে গিয়ে থাকবে । মাসিমা, মানে অসীম গাঙ্গুলির মা, ঘরে ঢুকে বললেন, এত চেঁচামেচি শুনছি তখন থেকে ; ছেলেটা কখন থেকে এসে বসে আছে তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য , ওর তো খিদে পেয়ে গিয়েছে ।
রাহুল , যার ডাক নাম রাহু , উঠে প্রণাম করল অসীম গাঙ্গুলির মাকে । যখন এসেছিল, তখনও করেছিল। অসীম বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন ।
ওনার দিকে তাকিয়ে, অসীম গাঙ্গুলিকে রাহুল বলল, ‘’তোলা থাক।’’ বলার পর, রাহুলের মনে হল যে অসীম গাঙ্গুলির বাড়ি আসা জরুরি ছিল । লেখালিখি ব্যাপারটাই তো অ্যান্টিএসট্যাবলিশমেন্ট কাজ, একধরণের দ্রোহ, সীমালঙ্ঘন– বাস্তবতার, ভাষার, অভিধার, বাক্যের, ব্যকরণের, শব্দার্থের, ব্যানালিটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ।
মাসিমা বললেন, কী হয়েছে বাবা, প্রণামও তুলে রাখছ ? অসীমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, যা স্নান করে আয় ।
আজ আর স্নান করব না ; এঘরেই দিয়ে দাও, বললেন অসীম ।
রাহুল সিংহ , যার ডাক নাম রাহু , টের পেল যে তাকে তাড়াতাড়ি বিদেয় করে দিতে চাইছেন অসীম গাঙ্গুলি।
প্রণাম মুলতুবি রাখার জন্য ততটা নয় , যতটা ওর বুকপকেটে রাখা হ্যণ্ডবিলটার জন্য । নিয়মিত জায়গার বদলে ওনার শোবার বা লেখালিখির ঘরেই পাত পাড়তে বললেন ।
–হ্যণ্ডবিল ? একটা এক ফালি কাগজ ছাপিয়ে সৃজনশীলতা ? ভালো প্রেসও পাওনি দেখছি, হরফগুলো সবই ভাঙা-ভাঙা । সৃজনশীলতা হবে রবীন্দ্রনাথের মতন পুরুষ্টু বই লিখে, বা যেমন বঙ্কিমের উপন্যাস । আঁদ্রে ব্রেতঁ, ত্রিস্তান জারা, এজরা পাউন্ড কেউ কি হ্যাণ্ডবিল ছাপিয়ে আন্দোলন করেছেন ? পরাবাস্তববাদী ম্যানিফেস্টোতে কি আঁদ্রেঁ ব্রেতঁ লিখেছিলেন যে তিনি লিডার, নেতা ? তিনি ক্রিয়েটর যখন তিনিই তো নেতা ! তিনি ক্রিয়েটর হয়েও তা তোমাদের মতো প্রচার করে বেড়াননি ।
–সব ঝড়ই মাঠে নামার আগে একটা পাতাকে ছুঁয়ে আগমন-বার্তা পাঠায়, বলল রাহুল ।
অসীমদার বোন ঘরে ঢুকলেন । স্পষ্ট যে রাহুল নামের জীবটিকে ভালো করে দেখে নিতে চান । ‘দাদা, আমি একটু বেরোচ্ছি’ বলে বেরিয়ে গেলেন ।
ফিরতে বেলা করিসনি , বললেন অসীম গাঙ্গুলি । বোনের মুখের দিকে তাকায়নি রাহুল । হাতের দিকে তাকিয়ে হালকা রোম দেখতে পেল । রাহুলের বড়দির হাতে-পায়ে অমন রোম ।
বোন আবার ঢুকলেন, হাতে দুটো আসন নিয়ে । মেঝেতে পাশাপাশি আসন দুটো পেতে, কাঁসার গেলাসে জল রেখে চলে গেলেন । আবার ঢুকে ভাতের থালা রেখে চলে গেলেন ।
পাশাপাশি খেতে বসেছিল ওরা । রাহুল,ইচ্ছাকৃতভাবে, গণ্ডুষের আচরণ করল । ওর পদবি যে আসলে জাস্ট খেতাব, তা জানেন অসীম । দেখে উনি বললেন, বামুনগিরি চালিয়ে যাচ্ছ দেখছি । হেসে উঠলেন, যাকে বলা যায় , মনের সুখে । শ্লেষ প্রয়োগ করলেন, গণ্ডুষের মন্ত্র জানো তো, না হাত ঘোরানোই সার ?
রাহুল বলল, জানি, মুখস্হ, তারপর গম্ভির ভাবে মন্ত্রোচ্চারণের ঢঙে বলল, ‘জিংগল বেল জিংগল বেল জিংগল অল দ্য ওয়ে… ।’
পাশের ঘর থেকে চাপা খিলখিলের রেশ ভেসে এল ।
অসীম কি বুঝতে পারলেন যে রাহুল তাঁকে শ্রদ্ধার আসন থেকে নামিয়ে দিতে পারে । উনি জানেন যে যাদের ঈশ্বর নেই উনি তাদের পয়গম্বর ।
–সুররিয়্যালিস্ট শব্দের জনক হলেন গিয়ম অ্যাপলিনার । উনি আন্দোলনে ছিলেন না । ওনাকে ক্রিয়েটর হিসাবে বা লিডার হিসাবে প্রচার করা হয়নি পরাবাস্তব ম্যানিফেস্টোতে । তোমার সঙ্গে যারা গেছে তারা লোভি । কেউ তো তোমার সমবয়সী নয় , ভেবে দ্যাখো । তুমি কি ভাবছ তোমার দাদার জন্য রক্তিম আর প্রদীপন তোমার সঙ্গে যোগ দিল ? আমাকে না জানিয়ে ? ভাতের ওপর মুগের ডালের বাটি উপুড় করে মাখতে-মাখতে বললেন অসীম গাঙ্গুলি ।
রাহুল তেলাপিয়ার পিঠ থেকে পুরো মাংস খুবলে নিয়ে বলল, গিলতে গিলতে, আপনি আমাকে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেন না, ফেকলু মনে করছেন । যেটুকু তোলপাড় ঘটিয়েছি, তা থেকেই তো আমার ভূমিকা স্পষ্ট । আমি আপনাকে জানাবার জন্যই এসেছিলুম । আপনার বন্ধুরা যাঁরা আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের আহ্বান করে আনিনি আমি । রক্তিম চট্টোপাধ্যায়ের মনে ধরেছিল আমার বক্তব্য । তাঁরা কেউই এই সমস্ত প্রশ্ন তোলেননি । রক্তিম আমায় বলেননি যে উনি নেতা হতে চান । প্রদীপন, মৃণ্ময় মজুমদার, চঞ্চলকুমার বসু, যাঁরা আপনার বন্ধু, তাঁরা নিজেরাই যোগ দিয়েছেন।
–হুঃ, মৃণ্ময়, ওকে যে রক্তিম নিয়ে গেছে, তুমি উদ্যোক্তা হয়ে নিজেই জানো না । লেখালিখির বাইরে , লেখকদের কার্যকলাপ নিয়ে মৃণ্ময়ের কোনো উৎসাহ নেই , ও হয়ত বুঝতেও পারেনি যে রক্তিম ওকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে’ , বললেন উনি ।
চুপ করেই ছিল রাহুল । কে কাকে এনেছেন আর আনছেন এগুলোর কোনো গুরুত্ব নেই আর, আন্দোলন নিজস্ব গতি ধরে নেবার পর । হরিচরণ খাঁড়া ওরফে দুর্গা বর্মণকে বেশ কয়েকজন অচেনা তরুণ অনুরোধ করেছে তাদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য । এমনকী শান্তিনিকেতনের পাঠভবন থেকে অমলেন্দু আতর্থী নামে একজন ছাত্র ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। হরিচরণ খাঁড়া ওরফে দুর্গা বর্মণের মতে, ক্রিয়েটিভ লেখকরা কমবেশি হিংসুটে হয়, আর বাজে ব্যাপার হল, প্রক্রিয়াটা আত্মবর্ণনার রূপক ।
–আমার রামায়ণ নট্ট কোম্পানি তো ছিলই । তুমি আলাদা করে আন্দোলন আরম্ভ করে ভালো করোনি । ভালো যে করোনি তা তুমি কিছুদিনেই জানতে পারবে । যারা লোভি তারা কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই তোমার ওই সোকলড
আন্দোলনে গেছে । আলুভাজা খেতে-খেতে বললেন অসীম গাঙ্গুলি ।
ইলিশ পাওয়া যায়নি নাকি অসীম গাঙ্গুলির এখন টানাটানি চলছে, তেলাপিয়া শেষ করে খেয়াল হল রাহুলের, যার ডাক নাম রাহু । অতুল্য ঘোষের সংবাদপত্রের চাকরি অতুল্য ঘোষের সঙ্গেই উধাও । আসানসোলে গিয়ে ভোটের মাঠে বীজ ছড়াচ্ছেন অতুল্য ঘোষ ; কম বয়সে উনি স্বামী বিবেকানন্দের ভাইয়ের প্রভাবে সাম্যবাদী ছিলেন । অসীম গাঙ্গুলি এখন কংগ্রেসি ; বয়স বাড়লে হয়ত সাম্যবাদী হবেন । সাম্যবাদীদের ঘোর সমালোচনা করেন । বয়স হলে হয়ত গুণগান করবেন । তারা মসনদে বসার সুযোগ পেলে হয়ত নিজেকে, আর সেই সঙ্গে রামায়ণ নট্ট কোম্পানিকে আমূল বদলে ফেলবেন । হয়ত রামায়ণ-মহাভারত ভাই-ভাই হবে ।
খাওয়া শেষ হলে অসীম গাঙ্গুলি বললেন, ভোজনান্তেও তো বোধহয় গণ্ডুষের প্রক্রিয়া কমপ্লিট করতে হয়। রাহুল ওনার মুখের পানে তাকিয়ে, উঠে পড়ে বলল, ‘’তোলা থাক ।’’
চাকরি-বাকরি যদি না-ই থাকে, তাহলে বন্ধুদের সঙ্গে হইহই করে খালাসিটোলা, অলিমপিয়া, এটসেটরা যান কার টাকায় ? টিমটিমে নিয়ন পাড়ার আলোয় রইরই করেন কার খরচে ? বোধহয় শিল্প সমালোচক সাবর্ণীচরণ মুকুজ্জের টাকায় বা হিসাবরক্ষক বন্ধু বসন্ত বাঁড়ুজ্জের টাকায় । যদিও বাংলা চকচকে ফিল্ম পত্রিকাগুলোতেও লিখে চলেছেন, শচীন ভৌমিকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে । ওই করে শচীন ভৌমিক বম্বে পাড়ি দিয়েছেন । অসীম গাঙ্গুলিও হয়তো কোথাও পাড়ি মারবার তালে আছেন । একটা বড় খবরের কাগজে চাকরির জন্য ওনার নাম সুপারিশ করে মালিককে
চিঠি দিয়েছেন আগের কাগজের মালিক । অসীম গাঙ্গুলির এই এলেমের সঙ্গে কেউ টেক্কা দিতে পারবে না । তাঁর পাবলিক রিলেশানের কাজ খুব উন্নত । নেটওয়রকিং, নেটওয়র্কিং, নেটওয়র্কিং। যোগাযোগ যোগাযোগ যোগাযোগ যোগাযোগ, আর সংলাপ রোমন্হনের ক্ষমতা । কলকাতার কেউকেটাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন রূপক মজুমদার ; রূপকদার সঙ্গে সবায়ের বাসায় গিয়ে পরিচয় করে নিয়েছেন অসীম।
রূপক সবাইকে খেই ধরিয়ে দিয়ে নিজে উধাও ।
উধাও হবার আগে, বড়োবাজারে মারোয়াড়ির গদিতে, মামলার সময়ে, যেখানে কোনো-কোনো দিন রাতে রাহুল আশ্রয় নিতো, আর সান্ধ্য জমায়েতে দেয়ালে ঠেসান দিয়ে মাদকে বুঁদ থাকত, সেখানে হঠাৎ উপস্হিত হয়ে, কোনো কথা না বলে, পকেট থেকে বের করলেন একজোড়া মধ্যপ্রদেশী পাঁচমারি ঘুঙুর, নিজের পায়ে বাঁধলেন, আর নাচতে-নাচতে গাইতে লাগলেন :
চোখ মেরো না বেদানা চুল বেঁধো না
তোমার ঐ হলুদ জানালায়
তুমি ঝুলিয়ে রেখো না বেদানা
ঝুলিয়ে রেখো না
নীল কাঁচুলি ঝুলিয়ে রেখো না
আমো যখন আসব ঘরে
তুমি নাইতে যেও না বেদানা নাইতে যেও না…
উপস্হিত সবাইকে এমন মাতিয়ে দিলেন যে সকলেই উঠে নাচতে লাগলেন, যেন নাচিয়েদের ঘুর্ণাবর্ত শুরু হল, পাকের পর পাক পাকের পর পাক কোমর থেকে কাঁটাতারের ঘের নামিয়ে দিতে লাগল রাহুল ।
বহুকাল আর বহুবিবাহের পর রূপকদার সঙ্গে বইমেলায় দেখা হয়েছিল রাহুলের । রাহুলের বয়স তখন কত, মমমমমমম, যা-ই হোক না, কী-ই বা এসে যায় !
রাহুলকেও ইতিহাসের দর্শন পড়ার খেই ধরিয়েছিলেন দীপক ; সেই তখন, যখন দাদা অনিকেত ধানবাদে পোস্টেড । বাসন মাজার সঙ্গে ইতিহাসের দর্শনকে দিব্বি মিলিয়ে দিয়েছিলেন রূপকদা ।
রাহুলের দাদা অনিকেতের বিয়ের সময়ে দাদার বন্ধুরা সবাই বরযাত্রী ছিলেন । সিংভূমের পাহাড়ি জেলাসদরে । কেবল রক্তিম চাটুজ্জে আসেননি, কেননা ওই বাড়িতে রক্তিম চাটুজ্জের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল । একটি যুবতীর প্রেমে প্রায় উন্মাদ রক্তিম কী করে সম্পর্ক নাকচ করে চলে গেলেন ! জাস্ট হাওয়া ।যুবতীর বাবা অনুমোদন করেনি বলে মেয়েটকে স্মৃতির কারাগারে ফেলে রেখে পালালেন। যে তরুণীর জন্য টানা দুবছর পড়ে রইলেন , শরৎ চাটুজ্জের দেবদাসের মতন অষ্টপ্রহর মহুয়ায় মাতাল, তার কী হবে চিন্তা করলেন না । তাকে নিয়ে লেখা রচনাগুলোকে তার চেয়ে বেশি ভালোবেসেছেন । প্রেমিকরা তাঁদের প্রেমের কবিতায় যে ভালোবাসার কথা বলেন, তা কোন ভালোবাসা !
দাদা অনিকেতের বিয়েতে রূপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় ছাড়া সবাই এসেছিলেন সিল্কের ধুতি পাঞ্জাবি পরে । অসীম গাঙ্গুলি তো বটেই ,এমনকি রূপকও । অনুপস্হিতির মাধ্যমে উপস্হিত ছিলেন রক্তিম, গালের ভাঁজে গোপন ট্র্যাজেডির ব্যক্তিগত ইতিহাস দাড়ির তলায় লুকিয়ে , কোথাও, কোনো মাতাল-জমায়েতে। পরে একজনকে ছুঁয়ে আরেকজনকে স্পর্শের স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখবেন হয়ত ।
এসব ব্যাপারে রাহুলের যা হয় তাকে বলা চলে প্রতিক্ষিপ্ত হওয়া । এনসিসিতে থ্রি-নট-থ্রির গুলি চালানো শেখার সময়ে বন্দুকের বাঁটের ধাক্কায় যেমনটা হতো । নড়ে উঠত বহু দূরের টার্গেট ।
অসীম গাঙ্গুলির ঘরে, আঁচিয়ে এসে, রাহুল ভাবল বলবে, কিন্তু বলল না, যে, আপনার বন্ধুরা খোঁয়াড়বদ্ধ হবার দরুণ বেড়া ভেঙে ভিনমুখো হয়েছেন । কয়েক বছর পরে প্রদীপন একটা পোস্টকার্ডে লিখেছিলেন রাহুলকে,’অসীম আমার ধোপা-নাপিত বন্ধ করে দিয়েছে হে, তুমি তাড়াতাড়ি এর বিহিত করো ।’
ফালিকাগজ তো রয়েছেই, এক ফর্মার করে দেয়া যেতে পারে । হ্যালেলুয়াআআআ….
রাহুল বলল, তেলাপিয়া মাছটা ভালো খেতে ; বাজার দখল করে নেবে মনে হয় । ইলিশ ক্রমশ লোপাট হয়ে যাবে। এই মাছের কথা জানি ; পুকুরে ছাড়লে অন্য মাছের চারা খেয়ে সাবাড় করে দ্যায়, আর নিজেদের বংশ বাড়াতে থাকে । তারপর তেলাপিয়াদের একচ্ছত্র ।
–তোমার মতলব জানি । তোমাকে কেই বা কলকাতায় চেনে ! একটা বই বেরোবার পরও অনিকেতকেই লোকে
তেমন চেনে না । ওদের ব্যবহার করে তুমি নিজের ফিল্ড গড়ে নিয়েছ ।
রাহুল অপেক্ষা করছিল অসীম গাঙ্গুলির পরের সংলাপের জন্য ।
–এখন আর ওদের প্রয়োজন নেই তোমার । তুমি জানো যে তরুণ কবিদের নেতা আমি, অসীম গঙ্গোপাধ্যায়, রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারী । তাই আমাকেও ব্যাবহার করে নিতে চাও । তার আর প্রয়োজন নেই । এবার নিজে করে দেখাও । আমিও দেখব, হ্যাণ্ডবিলে কেমন করে নট্ট কোম্পানি চালাও ।
–দেখাদেখির কিছু নেই । আমার কাজ কেবল বাক্য-খরচে আর শব্দ সাজানোয় সীমিত থাকবে না । বাঙালি সমাজকে নাড়িয়ে দেবার, ডিরোজিওর মতন পরিকল্পনা আছে আমার । ডিরোজিওর সামনে এসট্যাবলিশমেন্ট ছিল প্রাগাধুনিক বঙ্গসমাজ । আমার সামনে এসট্যাবলিশমেন্ট এই সময়, উত্তরঔপনিবেশিক সমাজ । ডিরোজিও ছিলেন সোফিসটিকেটেড। আর আমার মিলিউ বা হরিচরণ খাঁড়ার মিলিউ তো আপনি জানেনই, ছোটোলোকেদের । আমি আপনাকে আন্দোলনে যোগ দেবার আহ্বান নিয়ে আসিনি । যদি তা করবার থাকত তাহলে আপনার বন্ধু অনিকেতই করতেন । আমি ভেবেছিলুম আপনি আনন্দিত হবেন ।
–তোমার ওই হিলহিলে হ্যাণ্ডবিল বিলি করে ! দেখব । হ্যাণ্ডবিলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ! প্রতিষ্ঠানকে ভাঙতে হলে তার ভেতরে ঢুকে ভাঙতে হয় । বুলেটিন ছাপিয়ে হয় না ।
রাহুলের মনে হল দাদা অনিকেত অসীম গাঙ্গুলি সম্পর্কে যা বলতেন তা সঠিক । অসীম গাঙ্গুলি প্রতিষ্ঠান বলতে বোঝেন কোনো ইন্সটিটিউশান, বিশেষ সংবাদপত্র দপতর, কিংবা ঝন্টুদা যাকে বলেন কলকাতার বড়-বাঙালিরা । প্রতিষ্ঠান যে ক্ষমতা আস্ফালনের বিমূর্ত অবয়ব, তা কি উনি টের পান না ? সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলেই হয়ত কাগজঅলাদের মনে করেছেন প্রতিষ্ঠান । বাঙালি সংস্কৃতির সামগ্রিক ছবি হয় ওনার সামনে ভেসে উঠছেনা বা উনি নিজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছেন । পাঁচের দশক থেকে কলকাতার রাজপথে উদ্বাস্তুদের লড়াই ওনার চোখে পড়ছে না । তারা কার বিরুদ্ধে লড়ছে ? অনেকের বিরুদ্ধে । ক্ষমতা-প্রতাপের ছড়ানো-ছেটানো আস্ফালনঘাঁটিগুলোর বিরুদ্ধে। ইংরেজরা চলে যাবার সময়ে যে খোস-পাঁচড়া চামড়ার ওপর, আর ক্ষয়রোগ শরীরের ভেতর, দিয়ে গেছে, তা থেকে কত রকমের কায়েমিস্বার্থের প্রতাপী আস্ফালন জন্মেছে, তা উনি দেখতে পাচ্ছেন না, বা দেখতে চাইছেন না ।
–শুধু বুলেটিন লিখে নয় । আরও অনেক পরিকল্পনা আছে । মর্ত্যে বিশৃঙ্খলাও তো দরকার । আধুনিকতার প্রকল্প আর ঘাঁটিগুলো আক্রান্ত হবে, একের পর এক, লক্ষ রাখবেন । আপনার পছন্দ হবে না । বাঙালি মধ্যবিত্তের আত্মাভিমানের দানবটাকে আমরা খুঁচিয়ে বের করে আনব । তারপর যা হবার তা হবে ।
কথাগুলো বলার সময়ে রাহুল নিজেকে শুধিয়ে নিঃশব্দে বলতে শুনল, যে সমস্ত লেখকরা ‘এ আজাদি ঝুটা হ্যায়’ বা এই স্বাধীনতা মিথ্যা আওয়াজ তুলে একসময় ট্রামে বোমা মেরে বাসে পেটরল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল, অজস্র বাঙালিকে আহত-নিহত করেছিল, তারা এখন অসীম গাঙ্গুলির শ্রদ্ধার আরামকুর্সিতে বসে দোল খাচ্ছেন ; তাদের ওই অপরাধ উনি বেমালুম ভুলে গেছেন ; আমি তো তাদের মতন তথাকথিত বিপ্লব করতে যাচ্ছি না ।
–ও, তুমি বিশৃঙ্খলার দেবদূত । অ্যানজেল অব কেয়স ! দেখব দেখব । চালিয়ে যাও যতদিন পারো । জুতোর ফোস্কাও বেশ কিছুদিন একাগ্র আর একগুঁয়ে থাকে । তবে যিশুখ্রিস্ট হবার চেষ্টা কোরো না ।
–আসার সময় আপনার গলির মোড়ে দেখলুম একটা ঘোড়ার খুরে লোহার নাল বসানো হচ্ছে । ঘোড়াটার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল হাসছে ।
অসীম গাঙ্গুলি বললেন, হুঁ । তারপর, জল খাওয়া শেষ করে বললেন, চ্যালেঞ্জ কোরো না । জানো তো আমি লাঠিচালানো শিখেছিলুম । জলে ডোবার সম্ভাবনা তোমার ; তুমি তো আমার মতো সাঁতার জানো না, এপার-ওপার করতে পারবে না, পাড়েই ডুবে মরবে ।
–জানি । প্রদীপন চাটুজ্জেকে আর রক্তিম চাটুজ্জেকে আপনি বলেছেন, আন্দোলন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে ।
প্রদীপন কেন যোগ দিয়েছেন জানেন ? উনি আমায় বলেছেন যে ‘এটা মিস করেছিলুম হে, এই রিলেন্টলেস বমবারডিং অব দি হেডকোয়ার্টার, প্রতি সপ্তাহে একটা করে গ্রেনেড’ । উনি একে বলেছেন, ‘গৌরবের এথিকাল ঝিলমিল।’ বলেছেন, যত পারো আনন্দের হেঁচকি তুলে নাও এই সুযোগে ।
প্রদীপন আরেকটা কথা বলেছিলেন, যা রাহুল বলল না অসীম গাঙ্গুলিকে, ‘’এর পর লক্ষ্মণের ট্যালকাম-পাউডার লাইনটা কারা টানছে সেদিকে খেয়াল রেখো।’’ অসীমদার কথা মাথায় রেখেই বলেছেন, সন্দেহ নেই ।
–দ্যাখো কে কতদিন টেকে । এসট্যাবলিশমেন্টের সঙ্গে লড়ে জেতা যায় না । এসট্যাবলিশমেন্টে প্রবেশ করে
অন্তর্ঘাত ঘটাতে হয় । ‘মোজেকের ওপর পা আর হাওয়ায় চোলাই-করা মেঘেতে মাথা গলিয়ে বললেন অসীম গাঙ্গুলি , যেন পিঠে করে নদী বয়ে বেড়াচ্ছেন ।
–স্ট্রেঞ্জ । রাহুলের ব্যারিটোন গলার স্বরে ধ্বনিত হয়েছিল ওর হতভম্ব হওয়া । আর মগজের ভেতর ফিসফিস হয়েছিল , মার্ক অ্যান্টনির সংলাপ । তার মানে, হুশিয়ারি দিয়ে রাখলেন অসীম গাঙ্গুলি ।
পরজন্ম দেখতে-পাবার ক্ষমতাসম্পন্ন কন্ঠে অসীম বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক শুনেছ ।’ উনি যেন নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেন ।
–আপনি হাওয়াইজাহাজের পাইলট হয়েই থাকুন ; আমি প্যারাশুট পিঠে প্যারাট্রুপারের ভূমিকায় থাকতে চাই । আপনার চোখে প্যারাট্রুপারের দেখা ব্রহ্মাণ্ডটা বিমূর্ত । বোধহয় সেকারণেই আপনি বিষ্ণু দেকে নাকচ করেছেন ।
–না, আমি বিষ্ণু দেকে বিমূর্ত বলে নাকচ করিনি ; উনি আমার কবিতা থেকে অংশবিশেষ বাদ দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন ।
–তার মানে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে একজন কবি আরেকজনকে নাকচ করতে পারেন ! একে-তাকে বাদ দেয়া, এর-তার লেখা থেকে অংশ ছাঁটাই, এগুলো তো ইংরেজদের শিখিয়ে যাওয়া ঔপনিবেশিক রোগ ।
–পারবে না কেন ? আমার যাকে পছন্দ নয় তাকে আমি নাকচ করে দিই । কথাটা মনে রেখো ।
জিতে যাওয়া হেরে যাওয়া , সৃজনশীলতা তাহলে রণক্ষেত্র ; ক্ষমতার মাদকতন্দ্রা দেয় । দেয় নিশ্চয়ই । একে সাব-এডিটারের চাকরি থেকে বের করে দাও । ওকে এই পুরস্কার, তাকে সেই পুরস্কার দিয়ে পোড়া বাসের ভুত-ভুতনিতে পালটে দাও । দরবার বসাও । যত ক্ষমতা তত সন্দেহ তত স্তাবক তত পীড়া ।
গেট খুলে বেরিয়ে বাঁদিকে এগোবার পর রাহুল দেখল আস্তাকুঁড়ে পড়ে আছে কারোর উদযাপিত জন্মদিনের গোলাপতোড়া । ও এখন যাবে যাদবপুর, বান্ধবীর বাসায় ।
খুরে নতুন নাল-বসানো কালো চকচকে ঘোড়াটা উঠে দাঁড়িয়েছে ।
তা ছিল প্রথমবারের কথা কাটাকাটি ।
শেষবার, অসীম গাঙ্গুলির ওঝাপুরের বাড়ির গেটের ভেতরে ঢুকে, রাহুলের মনে পড়ে গেল প্রথমবারের কথাকাটাকাটি ।
ওকে ঢুকতে দেখে, অসীম গাঙ্গুলি, যে ভাবে দৌড়ে নিচে চলে এলেন, বোঝা গেল, রাহুলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন । বিদেশ থেকে ফিরে ধুতি বাতিল করে দিয়েছেন । চেককাটা শার্ট আর ট্রাউজার, চুলে শ্যাম্পু । শ্লেষাত্মক চাউনি মেলে, বললেন, তাহলে, যাকে নেতার আসনে বসিয়েছিলে, সে-ই পিঠে ছুরি মারল তোমার ? মনে করে দ্যাখো, আমি সতর্ক করেছিলুম তোমায়, আন্দোলনের নেতৃত্ব সকলের দ্বারা হয় না, নেতা সাজিয়ে কাউকে বসিয়ে দিলেই সে নেতা হয়ে যাবে, অমন চিন্তাকরাটাই তো ভুল, বলেছিলুম তোমায় সেবার ।
রাহুল নিজেকে নিঃশব্দে বলতে শুনল, এশিয়া সোসাইটির বনি ক্রাউন তো আন্দোলনের নেতা হিসাবে রক্তিম চাটুজ্জের জন্যে স্কলারশিপের সুপারিশ করেছিলেন, তা ওলোট-পালট কী ভাবেই বা হয়ে গিয়েছিল !
–আমার কেসের ব্যাপারে সব খবর রেখেছেন । থ্যাংকস । হ্যাঁ, লিডার-ক্রিয়েটার চিহ্ণিত করে প্রথম ইশতাহারেই নামের দরকার ছিল না , ওটা আমারই ব্লান্ডার । আর, রাহুল একটু থেমে, বলবে কি না ভেবে নিয়ে বলে ফেলল, রক্তিম চট্টোপাধ্যায় মনে করেন যে তাঁর প্রেমিকাকে বিয়ে করার পথে আমি এবং দাদা অনিকেত বাগড়া দিয়েছি । আসল ব্যাপার আপনিও জানেন । রক্তিম চাটুজ্জে এত মদ খেয়ে প্রতিদিন ওনাদের বাড়ি যেতেন যে ওদের বৈঠকখানা থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত চলে যেত মহুয়ার গন্ধ ; উনি পুরো দু’আড়াই বছর দাদার বাসায় কাটালেন, বেকার, কী করে একজন বাবা তার মেয়ের বিয়ে দেবার কথা ভাববে অমন পাত্রের সঙ্গে ?
–ওর প্রেমিকা তোমাদের কানপুরের বাড়িতে রয়েছে, শুনেছি ।
–রয়েছে নয়, উনি স্নাতকোত্তর পড়তে গেছেন ; আমি আর অনিকেত দুজনেই বাইরে, আমাদের বাড়িতে ওনার পড়াশুনার সুবিধা হবে বলে আছেন । কলকাতায় এই ধরণের গুজব ছড়ানোর দরুণই রক্তিম চাটুজ্জে আরো অফেনডেড হয়েছেন ।
–তোমাকে তাহলে মারতে গিয়েছিল কেন , কফিহাউসের সামনে, দলবল নিয়ে ?
–আমাকে নয়, সুকোমল রুদ্রকে ; আপনার পরিচিত এক সংবাদপত্র মালিককে জানাবার জন্য, যে উনি তাদের জন্য কতটা নামতে পারেন। চাকরি তো অলরেডি পেয়ে গেছেন বলে শুনেছি । মারকুটে সেই লেখকদলের সদস্য কারা
ছিল সে-খবরও হয়ত আপনি পেয়ে গিয়ে থাকবেন ।
–তোমার আন্দোলনের লোকেরা শেষ পর্যন্ত তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে, রাজসাক্ষী হয়েছে, তোমার তো অপমানিত বোধ করা উচিত । মনে হচ্ছে না, তুমি ডিফিটেড ?
— না, তা হবে কেন, আমি তো কোনো রাজ্য জয় করতে বেরোইনি । তবে, আমি এক্সপেক্ট করিনি যে প্রদীপন, রক্তিম আর চঞ্চলকুমার বসু আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী হবেন, সরকার পক্ষের সাক্ষী ।
–চোঙদার ভাইরা তো তোমার বিরুদ্ধে, তোমার আন্দোলনের বিরুদ্ধে, মুচলেকা সই করে দিয়েছে ; আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করেছে, লিখেছে নাকি যে ওরা তোমার আন্দোলনের মটোতে বিশ্বাস করে না । তোমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছে ।
–বারবার তোমার তোমার বলছেন কেন ? এই আন্দোলন তো কারোর ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা প্রায়ভেট প্রপার্টি নয়। আমরা কি ওই গাছের তলায় গিয়ে আলোচনা করতে পারি ? অনেকটা হেঁটে এসেছি । হাঁটতে-হাঁটতে রাহুল বলল, চোঙদার ভাইদের সমস্যা হল আত্মবিশ্বাসের অভাব, মূলত চাকরি চলে যাবার ভয় ।
অসীম গাঙ্গুলি এগোলেন গেটের বাইরে অর্জুন গাছের ছায়ার তলায়, উত্তেজনা বা ক্রোধ চাপা দিতে রাস্তা থেকে কয়েকটা পাথরটুকরো তুলে দূরের কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে ছুঁড়তে থাকলেন । রাহুলকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন না । ভালোই হল, ভাবল রাহুল, অসীম গাঙ্গুলির মা শুনতে পেতেন ওদের তর্কাতর্কি । রাহুল যে গ্রেপতার হয়েছে, মামলা চলছে ওর বিরুদ্ধে, বন্ধুরা ওর বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়েছে, হয়ত ওনার কানে গিয়ে থাকবে, এবং উনি অসীম-বিরোধী অবস্হান নিয়ে ফেলতে পারেন অনুমান করে অসীম গঙ্গোপাধ্যায় রাহুলকে নিয়ে গেছেন বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে ।
–আপনি বিদেশ থেকে ফিরতেই আমাদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হল, আন্দোলন তো চলছে সেই একষট্টি থেকে, অনেকেরই কিছু কর্মকাণ্ড পছন্দ হয়নি । তখন কিন্তু পুলিশ অ্যাকশানের গুজব রটেনি । আপনি ফিরতেই এ-সব হল । এ-ও শোনা যাচ্ছে যে লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেণ্টের ডেপুটি কমিশনার আপনার রামায়ণ নট্ট কোম্পানির একজন নটের নিকটাত্মীয় ।
–কী বলতে চাইছ কি, স্পষ্ট করে বলো । তুমি বলতে চাইছ আমি ফোন তুলে প্রফুল্ল সেনকে এবং পুলিশ কমিশনার পি. সি. সেনকে বললুম যে এদের এগেইনস্টে কড়া অ্যাকশান নাও, আর তারা আমার কথা শুনে হুকুম দিলে যে যাও, রাহুলকে দড়ি বেঁধে রাস্তায়-রাস্তায় ঘোরাও ; শিশুসুলভ ভাবনা । এখনও একটা ভালো চাকরি জোটাতে পারলুম না, আর তুমি এসেছো দোষারোপ করতে ।
–দোষারোপ করতে আসিনি । আপনার জোর গলায় বলা সত্ত্বেও আমার সন্দেহ থেকে যাচ্ছে যে আমার আর দাদার বিরুদ্ধে মামলায় আপনার হাত আছে ।
–কী করে এসব কথা বলতে পারছ ? রামায়ণ নট্ট কোম্পানি থেকে তোমার অপেরার বই প্রকাশ করেছি ।
–আপনি করেছেন ?
–আমার অনুমোদন আর নির্দেশেই প্রকাশিত হয়েছে ।
–খরচ তো আমাকে করতে হয়েছে । আপনার নট্ট কোম্পানির ছোকরারা এখানের প্রেসগুলোতে গিয়ে হুমকি দিয়ে বইটা ছাপতে দেয়নি। বসন্তবাবুও সাহায্য করেননি ছাপার ব্যাপারে । আমি বইটা বহরমপুর থেকে ছাপিয়ে এনেছি ।
–তোমার বই, তোমাকেই তো আগ্রহ দেখাতে হবে । কে-ই বা চেনে তোমাকে যে এগিয়ে এসে তোমার বই নিজের
আগ্রহে প্রকাশ করবে ?
–সে যাক, আমি এসেছি জানতে যে আপনি আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে রাজি কিনা । মায়াময় দত্ত আপনাকে অনুরোধ করে থাকবেন, উনি আর বরুণ সান্যাল স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছেন, যুধাজিৎ দত্তও দিচ্ছেন ।
–কে যুধাজিৎ ?
–তিরিশের একজন কবির ছেলে, লুম্বিনি পার্কে সাইকোলজিস্ট । মনোবৈজ্ঞানিক হিসাবে বিশেষজ্ঞের মতামত দেবেন ।
–আমি দেবো না বলিনি তো । আমাকে ভেবে দেখতে হবে । তোমার সম্পর্কে আমার যতই স্নেহ থাক, তুমি আমাকে না জানিয়ে হঠাৎ করে আন্দোলন আরম্ভ করতে গেলে কেন, তার কোনো কুলকিনারা পাইনি এখনও । রামায়ণ নট্ট কোম্পানি তো ছিলই । তোমার অপেরাগ্রন্হও আমার কোম্পানি থেকে বেরোচ্ছিল, আমার সুভেনিরে তোমার বইয়ের বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলুম । আমার চিন্তা করার সময় দরকার ।
–জানি । প্রদীপন চাটুজ্জে আপনার চিঠিটা, যেটা আমার বিরুদ্ধে লিখেছিলেন বিদেশ থেকে, সেটার একটা অংশ পড়ে শুনিয়েছিলেন । আপনি বিদেশে যাবার আগেই প্রদীপন আমায় বলেছিলেন যে আপনি ওনার ধোপা-নাপিত বন্ধ করে দিয়েছেন । চঞ্চল বসুরও ধোপা-নাপিত বন্ধ করে দিয়ে থাকবেন, যে-জন্য উনি ইংল্যন্ডে বসবাস করতে চলে যাচ্ছেন । চঞ্চল বসু আর রক্তিমকেও অমন চিঠি লিখেছিলেন । বসন্তবাবু আর হরিপদ রায়কেও লিখে থাকবেন ; কখনও হয়তো জানা যাবে, ওনাদের কাগজপত্র প্রকাশিত হলে । মূল সুর ছিল যে আপনি আমাদের আন্দোলন ভেঙে দেবেন ।
–বাজে বকছ । আমি ভেঙে দেব বলিনি । বলেছিলুম, ভেঙে দেবার ক্ষমতা রাখি ।
–আপনি প্রদীপন চাটুজ্জেকে লিখেছিলেন, মনে করে দেখুন, যে আমরা আন্দোলন করছি রামায়ণ নট্ট কোম্পানি অর্থাৎ অসীমের প্রতিপক্ষ হিসেবে । লিখেছিলেন যে আপনি প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ্যে আমাদের আন্দোলনের বিরোধিতা করেননি ; এর অর্থ কী ? গোপনে আপনি অনেক কিছু করতে পারেন, আপনার চেনাজানা প্রচুর, অতুল্য ঘোষের মাধ্যমে আপনি প্রফুল্ল সেনের কাছে আপনার ভাবনা সহজেই পৌঁছে দিতে পারেন । আমি বা অনিকেত পরি না । আমাদের মামলা চলছে, আর কলকাতায় আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, আমরা চাকরি থেকে সাসপেণ্ডেড । দেখছেন তো, আপনি কতোবার আমাদের বাড়িতে, দাদার বাড়িতে গিয়ে থেকেছেন, কিন্তু দাদা আপনার কাছে এখনও একবারও আসেননি ।
–তোমাদের আন্দোলন আমি একেবারে পছন্দ করি না । বিদেশ থেকে ফিরে এসে শুনলুম তোমার আন্দোলনের কে একজন অমলেন্দু আতর্থী, শান্তিনিকেতনের পাঠভবনের ছাত্র, রাসটিকেট হয়েছে । সে একটি ছাত্রী সম্পর্কে তার পত্রিকায় অকথা-কুকথা লিখেছিল ।
–হরিচরণ খাঁড়াকে অমলেন্দু আতর্থী জানিয়েছে যে আমাদের আন্দোলনে যোগ দেবার অপরাধে তাকে পাঠভবন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে ।
–তবে ? ভেবে দ্যাখো ! পাঠভবনের মতন শিক্ষণসংস্হাও তোমাদের অপাংক্তেয় মনে করছে । সুতরাং আমার পক্ষে অপছন্দ করার যথেষ্ট কারণ আছে । আমার সোজা কথা, তোমাদের আন্দোলনকে পছন্দ করি না ।
–করেন না তার কারণ আপনি একে মনে করেছেন এই আন্দোলন রামায়ণ নট্ট কোম্পানি-বিরোধী বা অসীম-বিরোধী । আপনি সবাইকে যে চিঠিগুলো লিখেছেন, সেগুলো তো আমার বিরুদ্ধে । আমি তো আপনার বিরুদ্ধে এক লাইনও কোথাও লিখিনি, কাউকে লিখিনি , মানে, এখনও লিখিনি ।
–বিষ্ণু দে সম্পর্কে আমার বক্তব্য ছাপিয়েছ । ওটা আমার ব্যক্তিগত মতামত ।
প্রতিটি কথার পর একটা করে ঢিল ছুঁড়ছিলেন অসীম গাঙ্গুলি । হাত ব্যথা হয়ে গিয়ে থাকবে বলে থামলেন, আসে-পাশে যত ঢিল ছিল, রাহুল এক পলক চেয়ে দেখল, খরচ করে ফেলেছেন উনি । প্রচুর কৃষ্ণচূড়া ফুল ঝরাতে পেরেছেন ; অদৃশ্য শত্রুদের রক্তাক্ত করতে পেরেছেন ।
–তাতে কী এসে যায় ? বিষ্ণু দেকে বলেছেন অশিক্ষিত ; খোলাখুলি বললেই তো পারতেন । আপনি প্রদীপনকে লিখেছিলেন, “রাহুলকে এত পছন্দ করছেন কেন ; ওর মধ্যে সত্যিকারের কোনো লেখকের ব্যাপার আছে আপনি নিশ্চই মনে-মনে বিশ্বাস করেন না”, এটসেটরা । আপনি তাহলে আমার অপেরাগ্রন্হ রামায়ণ নট্ট কোম্পানি থেকে বের করতে রাজি হলেন কেন, আমাকে লিখতে উৎসাহিত করতেন কেন, প্রথমবার যখন আপনি আমাদের বাড়ি এসেছিলেন তখন কেন বলেছিলেন আপনাকে লেখা পাঠাতে ; আপনি ছাপাবার আর টাকা রোজগারের ব্যবস্হা করে দেবেন ? আসলে আমি আপনার দরবারে যোগ দিতে চাইনি , সেকারণেই আপনার রাগ । যাকগে, তাহলে ধরে নিচ্ছি যে আপনি সাক্ষ্য দেবেন না । যদি সাক্ষ্য দেন তাহলে এ-কথা মনে রাখতে হবে যে আদালতের কাঠগড়াটা সমালোচনার জায়গা নয়,
আমার লেখাটার বিরুদ্ধে যদি কোর্টে মতামত দেন, তাহলে সাক্ষ্য দেবার প্রয়োজন নেই ।
–দেবো না, বলিনি তো । তুমি আমাকে আক্রমণ করছ, সেই সঙ্গে সাক্ষ্যও দিতে বলছ ।
–তার কারণ আপনার সম্পর্কে আমার সেই আগেকার দৃষ্টিভঙ্গী বেশ ঘা খেয়েছে । পছন্দ করেন না বলছেন যখন, তার মানে তো কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করবেন হয়ত । আপনি ফিরে এসে চারিদিক থেকে আমার সঙ্গে শত্রুতা করছেন , অন্য সবাইকে আমার বিরুদ্ধতা করতে বলছেন, আমার এরকম একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে আরম্ভ করেছে । আপনি প্যারানয়ায় ভুগছেন ।
–তোমাদের আন্দোলনকে যেমন পছন্দ করি না, তেমন বিষ্ণু দের কবিতা পছন্দ করি না । অনেকের লেখাই আমি পছন্দ করি না, আমার ভালো লাগে না । জেমস জয়েস, এজরা পাউন্ড পড়ে আমার ভালো লাগেনি, আমার রুচির সঙ্গে
মেলে না । যাদের ভালো লাগে তাদের আমি তাদের পছন্দ করি । তুমি যদি একে সাবজেকটিভ বলে উড়িয়ে দিতে চাও, সেটা তোমার সমস্যা । যাদের পছন্দ করি তাদের বাজে বইকেও ভালো বলি, আনন্দবাজারে-দেশে দেখে থাকবে ।
–আমাদের আন্দোলনকে অপছন্দের কারণটা কী ?
–কারণটা তুমি জানো । অনিকেতকেও বলেছি । প্রদীপনকে, রক্তিমকে, চঞ্চলকে, বসন্তবাবুকে আমি সেসব কথা বিদেশ থেকে লিখেছিলুম, ওরা তোমায় বলেছে হয়ত । আমার বক্তব্য সোজামাটা, যে-যে বন্ধু হতে চাও, কাছে এসো, সঙ্গে থাকো, আমিও সঙ্গে থাকব, সাহায্য করব ; যে-যে বন্ধু হতে চাও না, কাছে আসতে চাও না, আলাদা হয়ে যেতে চাও,দূর হয়ে যাও চোখের সামনে থেকে ।
–তার মানে সাক্ষ্য দিচ্ছেন না
–দেবো না বলিনি তো । অনিকেতকে বোলো দেখা করতে ।
–আপনি বিদেশে গিয়ে ভারত-ফেরত একজন বিটনিক কবিকে বলে এসেছেন যে আমি নাকি রক্তিমকে দিয়ে ওনার কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করতে প্ররোচনা দিয়ে রক্তিমের বহুমূল্য সময় নষ্ট করে চলেছি । ইংরেজিতে রক্তিম চট্টোপাধ্যায়ের যতগুলো অনুবাদ এখন পর্যন্ত বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছে, সবই আমি করেছিলুম ।
–ও, জানতুম না । কই, রক্তিম বলেনি তো ।
রাহুল সিংহ আর অসীম গাঙ্গুলি দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ সংলাপহীন ।
–চলো, খেয়ে যেও । রাহুলের দিকে মুখ করে বললেন অসীম ।
রাহুল বলল, তোলা থাক । একটা ফাঁকা বাস যাচ্ছিল, যেখানেই যাক, আস্তানা তো নেই কোথাও, হাত দেখিয়ে উঠে পড়ল ।
একেবারে ফাঁকা প্রাইভেট বাস ; কেবলমাত্র একজন মহিলা বসেছিলেন লেডিজ সিটে, যাঁকে দেখে, রাহুল প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, আরে, সুমিতাদি, তুমি, এখানে, কলকাতায় !
মহিলা বললেন, তোর খোঁজেই তো সেই সকাল থেকে বেরিয়েছি ; শুনলাম রাহুকেতু নামে কি একটা বই ছাপিয়েছিস, আর তাতে পাঠকদের কাছে আসল কথাটাই চেপে গেছিস ।
–কী কথা ?
–যে তুই-ই ছিলিস আমার একমাত্র তুই…
_________________________________________+++++++_____________________________
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন