শনিবার, ২২ মে, ২০২১

মলয় রায়চৌধুরী : শার্ল বোদলেয়ার-এর "বিষণ্ণ প্যারিস" কেন অনুবাদ করলুম

 শার্ল বোদলেয়ারের ‘বিষণ্ণ প্যারিস” কেন অনুবাদ করলুম

মলয় রায়চৌধুরী

          বোদলেয়ার আমার ‘নোঙোর-কবি’দের একজন । মানে,  কবিতা লেখা আরম্ভ করে যে বন্দরগুলোতে আমার জাহাজ নোঙোর ফেলতো, তাদের মধ্যে বোদলেয়ার অন্যতম । ইংরেজি, স্প্যানিশ, জার্মাান, পোর্তুগিজ ইত্যাদি ভাষায় বোদলেয়ারের বইগুলো বিভিন্ন  সময়ে অনেকে অনুবাদ করেছেন এবং তাদের মধ্যে যে পার্থক্য নেই তা বলা যাবে না । তার কারণ ভাষা অবিরাম পালটাতে থাকে আর অনুবাদক নিজের সময়ের ভাষায় পাঠবস্তুটিকে অনুবাদ করার চেষ্টা করেন । বাংলায় এই ব্যাপারটা বিশেষ ঘটতে দেখা যায়  না । বুদ্ধদেব বসু ‘ফ্লাওয়ার্স অব ইভিল’ এর অধিকাংশ কবিতা এবং ‘প্যারিস স্প্লিন’-এর প্রথম কবিতাটি অনুবাদ করার পর তাঁর পরের প্রজন্মগুলো, বোদলেয়ারে আগ্রহ সত্বেও, সম্পূর্ণ বই অনুবাদ করার আগ্রহ দেখাননি । ‘ইভিল’ শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ বুদ্ধদেব বসু করেছিলেন ‘ক্লেদ’, সুরভি বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘শার্ল বোদলেয়ার : অনন্য দ্রষ্টা’ বইতে করেছেন ‘পাপ’ । 

          বাংলাদেশে কয়েকজন তাঁর কিছু কবিতা নির্বাচন করে অনুবাদ করেছেন । এপারে করেছেন উদয়শঙ্কর বর্মা আর অরূপ দত্ত । বোদলেয়ার সম্পর্কে  বাঙালি পাঠকের যে আগ্রহ আছে তা তাঁর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে আমার ‘শার্ল বোদলেয়ার’ বইটির দুবার মুদ্রণে প্রমাণিত হয় । আলোচকদের মতে ‘ফ্লাওয়ার্স অব ইভিল’ হলো সাহিত্যে আধুনিকতার প্রথম ধাপ এবং ‘প্যারিস স্প্লিন’ হলো উত্তরাধুনিকতার প্রথম ধাপ । সেকারণে গদ্যগুলোকে ভিনিয়েট-ও বলা হয়েছে। ‘প্যারিস স্প্লিন’ পড়ার সুযোগ আর্তুর র‌্যাঁবোর হয়নি, তাই র‌্যাঁবো সমালোচনা করেছিলেন অ্যালেকজ্যাণ্ড্রাইন বাঁধন থেকে  বোদলেয়ারের নিজেকে নিষ্কৃতি দিচ্ছেন না বলে । নির্ধারিত আঙ্গিকের বিরুদ্ধে বোদলেয়ারের দ্রোহ ও উচ্চাকাঙ্খা দেখে যেতে পারেননি র‌্যাঁবো ।

          বোদলেয়ার প্যারিসের রাস্তায় একা ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন ; ভিড়ের মাংসে তিনি একটি মাংসল অঙ্গ হয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখতেন । আমি নিজে একা থাকতে ভালোবাসি আর যে শহরেই যাই একা পথচর হিসাবে ঘুরে বেড়িয়েছি ; অন্য কেউ সঙ্গে থাকলে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে পথচলায় বিঘ্ন ঘটতে থাকে । বোদলেয়ার ‘ফ্লাওয়ার্স অব ইভিল’ বইয়ের কবিতায় এনেছিলেন প্যারিস শহরের কলুষ, কল্মশ, দারিদ্র্য ও অসাম্য, সময় ও নশ্বরতার চাপ এবং শিল্প, নারী ও মাদকের ভোগবাসনায় পাওয়া মুক্তির বোধ । 

          ‘প্যারিস স্প্লিন’ বা ‘বিষণ্ণ প্যারিস’ গ্রন্হে তিনি কবিতার অ্যালেকজ্যাণ্ড্রাইন বাঁধন থেকে বেরিয়ে নতুন ধরণের টেক্সট লিখতে চাইলেন, গদ্য-কবিতার ফরম্যাটে,  এবং বইটির উৎসর্গপত্রে বললেনও সেকথা । ‘স্প্লিন’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ যে ‘বিষণ্ণ’ তা বুদ্ধদেব বসু বহু আগে বলে গেছেন । বোদলেয়ারের মনে হয়েছিল পথচরের চোখে দেখা অনিশ্চয়তা, অনির্ণেয়তা, বহুমতবাদের পরিসর, ক্রমান্বয়হীনতা, সাংস্কৃতিক জটিলতা, এবং  কাঠিন্য সত্বেও যে স্বাধীনতাবোধ শহুরে মানুষরা সে-সময়ে উদযাপন করা আরম্ভ করেছিলেন, তা অ্যালেকজ্যাণ্ড্রাইন কবিতার বাঁধনে লেখা যাবে না । তাঁর জীবনীকার এনিড স্টার্কি বলেছেন যে ‘ফ্লাওয়ার্স অব ইভিল’ এর তুলনায় ‘প্যারিস স্প্লিন’ অধিকতর পরিণত। বইটি যেখান থেকে ইচ্ছে পড়া যায়, যেখানে ইচ্ছা থামা যায়, অথচ প্রতিটি গদ্য একটি সমগ্রের অংশ,  উইলিয়াম বারোজের ‘নেকেড লাঞ্চ’-এর মতন -- উত্তরাধুনিকতার মুক্ত সূচনা আর মুক্ত সমাপ্তি উপাদান দুটি এইভাবে ভবিষ্যতের জন্য দিয়ে গেছেন বোদলেয়ার । প্রতিটি গদ্যের শব্দভাঁড়ার সমৃদ্ধ, বাক্যগঠন মার্জিত, কিন্তু গভীর উদ্বেগের লুকোনো কাঁটা আছে ।

          ‘বিষণ্ণ প্যারিস’ প্রকাশ করেছিলেন বোদলেয়ারের বোন ১৮৬৯ সালে, বোদলেয়ারের মৃত্যুর দু’বছর পর । সিফিলিসে আক্রান্ত দুস্হ শরীরে ১৮৫৭ থেকে দশ বছর ধরে ‘বিষণ্ণ প্যারিস’-এর গদ্যগুলো লিখেছিলেন তিনি, একটি তালিকা তৈরি করে, শহরের দৈনন্দিন জীবন থেকে মামুলি ঘটনা নির্বাচন করে ভাষার মাধ্যমে কেমন করে প্রতিটি রচনাকে বিস্ময়কর করে তোলা যায় তা চিন্তা করার পর হাত দেন গদ্যগুলো রচনায়। চিন্তানিমগ্ন গদ্যগুলো ধরতে চেয়েছে ১৮৪৮ সালের নির্দয়ভাবে দমন করা উথালপাথাল, যখন সাহিত্যকে সেনসর করা হতো, ১৮৫১ সালে তৃতীয় লুই বোনাপার্টের ক্যু-এর প্রভাব । তাঁর সময়ের সক্রিয় সামাজিক বিরোধগুলো, বিভিন্ন থিমের মাধ্যমে, মানবিকতার অন্ধকার অতল থেকে তুলে এনেছেন,  অস্হির মনঃস্হিতি-পীড়িত ছোটো-ছোটো মুদ্রিত চিন্তায় ; কুন্ঠাহীন অনিরুদ্ধতায়, সুপরিকল্পিতভাবে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জারিত, যা পবিত্র তার কন্দরের অশুচি, অত্যয়, কলঙ্ক, আপজাত্য, অবক্ষয়, ইন্দ্রিয়পরবশতা ইত্যাদিকে মুড়ে দিয়েছেন অসহ্য সৌন্দর্যে ।

          ‘বিষণ্ণ প্যারিস’ নামকরণ এইজন্যই যে গদ্যগুলোকে উনিশ শতকের শেষ দিকে শহরটির পরিবর্তনরত মনমেজাজকে সামাজিক আর্থিক ও স্হাপত্য থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না । বইটিতে শহরের পথগুলোর রয়েছে অপরিহার্য ভূমিকা, কেননা সেখানেই চেনা-অচেনা সকলের সঙ্গে লক্ষণীয় দেখা-সাক্ষাৎ হয়, সমাবস্হার শ্রেষ্ঠত্বের জায়গা : শ্রেনি নির্বিশেষে সবাই যাতায়াত করেন, সেটাই বৈভিন্ন্যের মিলনক্ষেত্র । পথে বোদলেয়ার একজন পর্যটক, ঈক্ষণকামী ও অলোকদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি। প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য থেকে নয় ; ‘বিষণ্ণ প্যারিস’-এ বোদলেয়ারের অণুপ্রেরণা হলো চিত্তাকর্ষক, অনুস্হ ও ন্যক্কারজনক শহর, এমন এক জায়গা যার অমিতাচার ও এলোমেলো ঘোরাঘুরি থেকে বের করে আনা যায় সৌন্দর্য, বিস্তার ঘটায় অন্তরতম অভিজ্ঞতার, নিগূঢ়তার রহস্যে । একই সঙ্গে অসূয়া, সূক্ষ্মদৃষ্টি ও ব্যঙ্গকৌতুকে ভরপুর ; অনৈক্য, অসঙ্গতি, নিকৃতিকে তিনি প্রতিটি গদ্যে দিতে চেয়েছেন ব্যঙ্গাত্মক সম্প্রীতির আবরণ । তাঁর নির্ভীক পর্যবেক্ষণগুলো নিরাশ্বাস ও নির্মম কিন্তু বরণীয় ।

          ‘বিষণ্ণ প্যারিস’ পাতা উল্টে যাবার মতন বই নয় । কোনো-কোনো গদ্য ফিরে ফিরে পড়তে হবে । আর আমি সেই কারণেই অনুবাদ করতে আরও বেশি আগ্রহী হয়েছি । দারিদ্র্য আর  নারীবিদ্বেষের ফেটিশ থেকে মুক্ত নন তিনি ; তাকে কালবৈষম্যের পক্ষপাতদুষ্ট বলা যেতে পারে । তবে, বিষাদ, নৈরাশ্য, পারক্য, অবসাদবোধ এমনকি মনুষ্যদ্বেষ বোদলেয়ারের চরিত্রে এসেছে শৈশবের সময় থেকেই ।

          অনুবাদটিকে আমি ফুটনোট কণ্টকিত করে পাঠককে পাঠবস্তুর বাইরে টেনে নিয়ে যাইনি।  বোদলেয়ারের ব্যবহার করা পুরাকল্পীয় প্রসঙ্গগুলো সরাসরি পাঠবস্তুতে এনেছি যাতে অনুবাদটা বিদ্যায়তনিক না হয়ে ওঠে । যাঁরা কবিতা এড়িয়ে যান, তাঁরাও ‘বিষণ্ণ প্যারিস’ পড়তে চাইবেন।

















কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন