মলয় রায়চৌধুরীর কবিতায় অরূপের নৈরাজ্য-নির্মাণ
অভিজিৎ পাল
মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা নিয়ে যে আলোচনাগুলি হয়েছে এবং হয় তা মূলত তাঁর পার্সোনায় কেন্দ্রিত । বাংলা কবিতার আধুনিক ও আধুনিকতা পরবর্তী ধারা থেকে তাঁর কবিতার ধারা এতোই পৃথক যে বহু আলোচক তাঁকে কবির মান্যতা দিতে অস্বীকার করেন। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের স্রষ্টারূপে এবং ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার রচয়িতারূপে তাঁর পার্সোনাকে বিগত দশকগুলিতে গড়ে তোলা হয়েছে । ফলস্বরূপ তাঁর অন্যান্য কবিতা এবং কবিতা নিয়ে তাঁর নিরীক্ষা আপামর পাঠকের সন্মুখে আসেনি । স্বীকার করা ভালো যে আলোচক-সমাজে তিনি নিজের শত্রুসংখ্যা নিজেই বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছেন । সুবিমল মিশ্র, নবারুণ ভট্টাচার্য, সুভাষ ঘোষ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মতো তিনি অনুগত শিষ্যমণ্ডল গড়ে তুলতে পারেননি, যা কবি হিসাবে তাঁর প্রভূত ক্ষতি করেছে । কৃত্রিম পার্সোনাটি মলয় রায়চৌধুরীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সক্রিয় থেকেছে, কেননা তিনি বাঙালির প্রতিসংস্কৃতি জগতের একজন সিরিয়াস কবি, বাঙলাভাষীদের নতুনতর কন্ঠস্বর যোগাতে চেয়েছেন এমন একজন কবি । বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর কবিতা স্নাতকোত্তর সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, এটি একটি উৎসাহব্যঞ্জক সংবাদ । প্রশ্ন হল, ছাত্ররা মলয় রায়চৌধুরীর বিশাল ও বৈভিন্নময় কবিতাজগতের সঙ্গে নিজেদের কীভাবে একাত্ম করবেন। মলয় রায়চৌধুরীর কবিতায় রূপতত্ত্বের অ্যানার্কি কবির নিজেরই সৃষ্ট শিল্পশৈলী-উপজাত।
মলয় রায়চৌধুরী তাঁর ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ থেকে আরম্ভ করে বহু স্মৃতিমূলক গদ্যে আত্মবিশ্লেষণ করেছেন এবং সেই সকল গদ্যে তিনি নিজের কন্ঠস্বর গড়ে তোলার কথাও বিস্তারে বলেছেন । তাঁকে সম্ভবত স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তা করতে হয়েছে, তার কারণ তিনি অন্যান্য হাংরি কবি-লেখকদের মতো শিষ্যবাহিনী গড়তে পারেননি এবং তিনি স্বীকার করেছেন যে তিনি নিঃসঙ্গ থাকতে ভালোবাসেন ; বিট আন্দোলনের কবিরা কেউই নিঃসঙ্গতা পছন্দ করতেন না । মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা অন্যান্য কবিদের থেকে পৃথক হবার প্রধান কারণ তিনি অবিরাম আত্মবিশ্লেষণ করেছেন এবং কবিতাকে প্রখরতর অ্যানার্কির খাতে প্রবাহিত করেছেন । এই আত্মবিশ্লেষণ থেকে গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতার বৈভিন্নময় ধারা ।
তাঁর স্মৃতিকথা পড়ে জানতে পারি যে, হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের সময়ে তিনি, মলয় রায়চৌধুরী, মেডিটেশানের জন্য মাদক সেবন করতেন, শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে নিরীক্ষা করতেন এবং তাঁর মননকেন্দ্র থাকতো মেলোপিয়া, লোগোপোয়েইয়া এবং ফ্যানোপোয়িয়ার প্রতি সমর্পিত ; তিনি নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসকে ছন্দে ব্যবহার করেননি, করেছেন কবিতার বাকধারা নির্মাণে, রূপকে অরূপে ভেঙে ফেলার লক্ষে তিনি তাঁর কবিতায় অবিরাম চেতনার বিরুদ্ধে অবচেতনাকে প্রতিষ্ঠা দেবার প্রয়াস করেছেন । এবিষয়ে সন্দেহ নেই যে মলয় রায়চৌধুরী, যিনি প্রচুর পড়াশুনা করেছেন, তিনি ইমেজিস্ট কবিতা ও চেতনার মধ্যকার অবয়ব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার মামলা-মকদ্দমার পর মলয় রায়চৌধুরীর কবিতায় বিপুল পরিবর্তন এসেছে, এবং তিনি তা পরিকল্পিত ভাবে করেছেন । সোনালী মিত্র প্রশ্ন তুলেছিলেন যে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর মতো আর কোনো কবিতা কেন লিখলেন না মলয় রায়চৌধুরী । লেখা সম্ভব ছিল না । যেমন ‘বনলতা সেন’ বা ‘গায়ত্রীকে’ লেখার পর জীবনানন্দ দাশ ও বিনয় মজুমদারের পক্ষে অমন কবিতা লেখা সম্ভব ছিল না ।
মলয় রায়চৌধুরীকে কেবল একটিমাত্র কবিতা, ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা অন্যায় ; এই ধরণের ঘটনা ঘটেছে বিট আন্দোলনের কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের ক্ষেত্রে, তাঁর ‘হাউল’ কবিতার বিশ্বব্যাপী খ্যাতির জন্য । মলয়ের কবিতাটি একটি সময়ের সংজ্ঞা, ষাটের দশকের বৈপ্লবিক যুববিপ্লবের, কিন্তু তাতেই মলয় রায়চৌধুরীকে সীমাবদ্ধ রাখা অন্যায় । আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে মলয় রায়চৌধুরীর ডুপলিকেট সম্ভব নয় । তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁর শত্রুদের প্রচার ও পত্রিকা প্রকাশ সত্বেও । মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা উন্মুক্ত আঙ্গিকের, সমসময়ের বিষয়ের ছন্নছাড়া জীবনের, অন্যের জীবনকে উন্নীত করে তোলার, চেতনার বিস্তার ঘটানোর । তিনি কবিতার আঙ্গিক ভেঙে মানুষের মননকেন্দ্রে পৌঁছোতে চেয়েছেন । অনেকে সেকারণে মলয় রায়চৌধুরীর কবিতাকে বুঝে উঠতে পারেননি । তাঁরা কেবল তাঁকে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের নেতা হিসাবে সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছেন । কেবল ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতায় আটক রাখতে চেয়েছেন । অথচ পরবর্তীকালে মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা, বিশেষ করে তাঁর প্রেমের কবিতাগুলি, যেগুলি ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো’ গ্রন্হের অন্তর্ভুক্ত, সেগুলিকে তেমন গুরুত্ব দেননি, অথচ মলয় রায়চৌধুরী, ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার সময় থেকে, ১৯৬৩ থেকে, মূলত একজন প্রেমের কবি, যে প্রেমিক অরূপের অর্চক, যে প্রেমের সঙ্গে তিনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তাঁর ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ উপন্যাসে ।
অরূপতত্ত্বের অবিনির্মাণের কারণে মলয় রায়চৌধুরীকে তাঁর আধুনিক অগ্রজ কবি এবং সমসাময়িক কবিদের সঙ্গে তুলনা করতে হিমশিম খান আলোচকগণ, এমনকী পরবর্তী কনফেশানাল কবিতা রচয়িতা এবং উত্তরাধুনিক কবিদের সঙ্গে তাঁর কবিতা তুলনা করার মাপকাঠি খুঁজে পাননা তাঁরা । সমালোচনামূলক মন্তব্যগুলি বাংলা কবিতার টেকনিকে, কন্ঠস্বরে, চেতনায় ও গ্রন্হনে তাঁর নিজস্ব শৈলীকে অবহেলা করে গুরুত্ব দিয়েছে তাঁর সমাজদর্শন ও প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায় । একথা স্বীকার্য যে হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা রূপে তিনি প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জনক । মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা সম্পর্কিত দর্শন, কাব্য-প্রক্রিয়া, টেকনিক সম্পর্কে কবিতা-পাঠক ও আলোচকরা ততোটা আগহী নন যতোটা তাঁর পার্সোনার প্রতি । হাংরি জেনারেশনের পরে ফিরে এসে তিনি যে কবিতাগুলো রচনা করা আরম্ভ করলেন, ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ পর্ব থেকে, সেই কবিতাধারার জটিলতা ও স্বকৃত নৈরাজ্যের সঙ্গে পাঠকের দূরত্ব গড়ে ওঠার কারণ তাঁর রূপতত্ত্বে ভাঙন ধরাবার অক্লান্ত চেষ্টা । তাঁকে পপুলার কালচারের দিকে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টাও চোখে পড়ে, প্রধানত তাঁর পাঠিকাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে ; তাঁকে নিয়ে যাঁরা প্রবন্ধ লিখেছেন তাতে মহিলা-কবিদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি, হয়তো তাঁর কবিতায় নারীকে রূপ থেকে অরূপে মুগ্ধ করে রাখার কারণে ।
মলয় রায়চৌধুরী নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, জীবনী লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন, তাঁর গ্রন্হের সংখ্যা শতাধিক ইত্যাদি মনে রাখার পরও তিনি যে কবিতা দিয়েই আরম্ভ করেছিলেন, হাংরি জেনারেশনের কারণে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বিদগ্ধ লেখকের ক্রোধ উদ্রেক করে থাকলেও, সুনীল যে তাঁর কাব্যপ্রতিভায় আকৃষ্ট হয়ে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় ১৯৫৯ সালে কয়েকটি কবিতা প্রকাশ করেছিলেন, ১৯৬৩ সালে ‘কৃত্তিবাস প্রকাশনী’ থেকে মলয় রায়চৌধুরীর কাব্যগ্রন্হ ‘শয়তানের মুখ’ প্রকাশ করেছিলেন, তা মলয়ের জীবনে নিঃসন্দেহে উল্লৈকযোগ্য ঘটনা । হাংরি জেনারেশনের বিশ্বব্যাপী প্রচারের কারণে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৬৪ সাল থেকে মলয় সম্পর্কে ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন, তাও সত্য ঘটনা, এবং সুনীলের ‘অর্ধেক জীবন’ পড়লে আমরা জানতে পারি তাঁর দ্বিচারিতার কথা। সুনীল যে মলয়কে একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন তা তাঁর সংগ্রহে মলয়ের চিঠিগুলির সংরক্ষণ থেকে জানতে পারি, কয়েকটি চিঠি একটি সংকলনে তিনি প্রকাশের জন্যে দিয়েছিলেন, মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্বে । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দ্বিচারিতা মলয়ের প্রভূত ক্ষতি করেছে ; অনুজ আলোচক ও কবিরা মলয়ের কবিতা আলোচনা করতে চাননি, তাঁদের কেরিয়ারের ক্ষতির কথা স্মরণে রেখে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে হাংরি আন্দোলনে আনা মলয়ের উচিত হয়নি ; হাংরি আন্দোলনে শক্তি, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসুর কোনও অবদান নেই । হাংরি আন্দোলনের খ্যাতি মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায় ও সুবিমল বসাকের কর্মকাণ্ডের কারণে, বিশেষত হাংরি বুলেটিনগুলির নতুনত্বের কারণে ।
মলয় চেয়েছেন, কবি হিসাবেই তাঁকে মনে রাখা হোক, কবিতা হোক তাঁর উত্তরাধিকার। সেকারণে প্রয়োজন মলয়ের কবিতার সাধনপ্রণালী ও কাব্যধর্মীতা সম্পর্কে বিদ্যায়তনিক চর্চা । তাঁর কবিতা নিয়ে ডক্টর বিষ্ণুচন্দ্র দে পিএইচডি করেছেন, কিন্তু সেই আলোচনার পরিসর মলয়ের হাংরি আন্দোলনকালীন কবিতায় সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন গবেষক । কয়েকজন এম ফিল করেছেন । ইংরেজিতে রচিত আলোচনায় জুলিয়েট রেনোল্ডস, রিমা ভট্টাচার্য, সঞ্চারী ভট্টাচার্য, ড্যানিয়েলা ক্যাপেলো প্রমুখ গবেষক একটি বিশেষ দিকে আলোকপাত করেছেন, তাঁদের নিজস্ব আগ্রহ অনুযায়ী । তাঁরা মলয় কীভাবে বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের সঙ্গে আভাঁগার্দ টেকনিককে মেলাবার প্রয়াসে আলোকপাত করেননি, জানাননি কীভাবে মলয়ের উত্তরাধিকারকে সংজ্ঞায়িত করা উচিত । সঞ্চারী ভট্টাচার্য মলয়ের হাংরি আন্দোলনকালীন কবিতায় ‘অলটারিটি’ আলোচনা করেছেন, পরবর্তী কবিতায় সেই ‘অলটারিটির’ বাঁকবদল আলোচনা করেননি । আমাদের মনে রাখা উচিত যে মলয়ের কবিতা অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের কবিতা হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন, মলয় পাঠকের চেতনায় পরিবর্তন আনতে চেয়েছেন, প্রয়োগ করেছেন রূপকল্পের পরাবাস্তববাদী পরস্পরবিরোধিতা, এক নতুন বাংলা আঙ্গিক ।
মলয় রায়চৌধুরী সারাজীবন কবিতায় কী করলেন, এই প্রশ্ন তাঁর পাঠকদের করলে তাঁরা ফিরে যান তাঁর পার্সোনায় এবং উল্লেখ করেন চেতনার সম্প্রসারণকারী, মননগুণিন, শহুরে বাউল, দেহতত্বের অরূপসন্ধানী, সামাজিক উচ্ছৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, স্বপ্নদ্রষ্টা, নগরক্ষ্যাপা, অর্থাৎ একজন জটিলতার কবি, কেঅসের কবি, যিনি ঠাণ্ডা মাথায় নিজেরই গড়া পার্সোনাকে অবিরাম ভেঙে চলেছেন । তিনি যে জটিল থেকে জতিলতর হয়ে উঠেছেন তা তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি ; সাক্ষাৎকারগুলি পড়লে হৃদয়ঙ্গম হয় । তিনি ‘অপর’-এর প্রতিমূর্তি, যেমন সঞ্চারী ভট্টাচার্য বলেছেন, তিনি পাশ্চাত্য রূপতত্বকে ভেঙে নিজের রচনায় ব্যবহার করেছেন, যেমন সঞ্চারী ভট্টাচার্য বলেছেন । বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের জটিল অস্তিত্বের প্রসঙ্গ তুলেছেন ; তিনি বলেছেন যে নিজের মস্তিষ্কে নিজের বিরোধিতা করা উচ্চতর জীবনের কথা বলে এবং যাঁরা স্ববিরোধিতা স্বীকার করেন না তাঁরা ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের প্রাণী । মলয় রায়চৌধুরী নিজের অবগতি সম্পর্কে অবগত, জগৎসংসার সম্পর্কে অবগত, আক্রমণাত্মক হয়ে লিখলেও সুবোধ সরকার বলেছেন যে মলয় রায়চৌধুরী একাধারে মস্তান ও সন্ন্যাসী । মলয় নিজের গভীরে প্রবেশ করে বহির্জগতের ভিশান সম্ভব করে তুলতে পারেন । নিজের ধূসরতা সম্পর্কে তিনি অবগত, এই অবগতি তাঁর স্মৃতিকথা ‘ছোটোলোকের যুববেলা’-তেও পাওয়া যায় । মলয়ের কোনো গ্রন্হে, তিনি সম্পূর্ণ কালো বা সম্পূর্ণ সাদা নন, এবং এই বৈশিষ্ট্য থেকে জন্ম নিয়েছে তাঁর অরূপের নৈরাজ্য-নির্মাণের প্রকল্প, চেতনে বা অবচেতনে ; জগতসংসার এতো বিশাল যে আমাদের সীমিত মস্তিষ্ক দিয়ে তার ব্যাপ্তি যাচাই করা সম্ভব নয় মনে করেন মলয়।
আমরা মলয় রায়চৌধুরীকে কেন ও কোন কারণে মনে রাখব ? তাঁর আকর্ষণীয় চিন্তাপ্রক্রিয়া প্রসারিত হয়েছে বিভিন্ন দিকে, পশ্চিমের চার দিকে কেবল নয়, প্রাচ্যের দশ দিকে । তাঁর সাহিত্যকর্ম সেই ভাবেই স্পর্শক তৈরি করে বিভিন্ন দিকে প্রতিবার ছড়িয়ে পড়েছে । তাঁকে কি আমরা তাঁর সমবেদনাবোধের জন্য ( গ্রামীণ উন্নয়নের কাজে চাষিদের জীবনানুসন্ধান, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে গরিবদের গৃহের ভিতরের অবস্হার তথ্যসংগ্রহ ), তাঁর মানবিকতা ( ডুবজলে, নামগন্ধ উপন্যাসে ও নখদন্ত ন্যারেটিভে ) এবং প্রেমের প্রতি তাঁর দায়িত্ব, প্রতিশ্রুতি, শপথ ( প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার, অবন্তিকা সিরিজ, মাথা কেটে পাঠাচ্ছি কবিতায় ও জলাঞ্জলী উপন্যাস এবং অলৌকিক প্রেম রহস্যোপন্যাস ) মনে রাখব ? পশ্চিমবঙ্গকে যে রাজনীতি ধ্বংস করেছে এবং যে আধুনিকতা বিশ শতকের আত্মাকে কলুষিত করেছে তাকে আক্রমণ করার জন্য মনে রাখব ? নাকি মনে রাখব তাঁর সাহিত্যকৃতির জন্য, হাংরি আন্দোলনের মাধ্যমে আধুনিকতার বিস্তার ঘটিয়ে ও কবিতার ঐতিহ্যে পরিবর্তন এনে উত্তরাধুনিকতায় পৌঁছোনোর ভাবনার সততার জন্য ? প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতাটিকে পাঠক মনে রেখেছেন কেন ? কেবল যৌনতার জন্য নয়, কবিতাটির সন্মোহিনী ক্ষমতার জন্য । এই কবিতাটির মতো তাঁর পরবর্তী কবিতাগুলিতেও, নিরীক্ষা সত্ত্বেও, পাওয়া যাবে ছবির মাধ্যমে চিন্তা, ছবির কার্যকরীতা, ধ্বনির লয়, অবিমিশ্রিত পর্যবেক্ষণ । অর্থাৎ অতিবিমূর্ত, আধ্যাত্মিক ও অস্পষ্ট ছবির পরিবর্তে তিনি যা প্রয়োগ করতে চেয়েছেন তাকে মলয় নিজেই বলেছেন বাকপ্রতিমার কাইনেটিক এবং ফ্লাক্স চরিত্র। যে ছবিশব্দ তিনি নিজের মস্তিষ্কে আলোকিত করেন তাকে বাইরে কবিতায় এনে আর রোমন্হনের সময় নেন না । চিন্তার পরিসর থেকে সরাসরি বহির্জগতে চলে আসেন মলয় ।
মলয় রায়চৌধুরী যখন কবিতা লেখা আরম্ভ করেন তখন তাঁর কোনো মেনটর ছিল না । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হয়তো তাঁর মেনটর হতে চেয়েছিলেন, ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার জন্য মলয়ের কবিতা নির্বাচন ও মলয়ের কাব্যগ্রন্হ প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে তা-ই অনুমান হয়, সুনীলকে লেখা মলয়ের চিঠিগুলি থেকেও তেমনই ইশারা মেলে । মলয় কোনো মেনটর যে চাননি তা তাঁর একক প্রচেষ্টায় হাংরি আন্দোলনের সফলতা থেকে স্পষ্ট হয় ; সুনীলকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে তিনি সুনীলকে পূর্বাহ্ণেই জানিয়ে রাখতেন তাঁর আন্দোলনের কথা -- তাঁদের সারা জীবনের দ্বেষদ্বন্দ্বের সূত্রপাত হতো না হয়তো ; সুনীলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় মলয়ের ক্ষতি করেছে বলে আমি মনে করি। মলয় তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরীকেও মেনটরের স্বীকৃতি দেননি। বরঞ্চ ‘হাওয়া৪৯” সম্পাদনার সময়ে মলয়ের পরামর্শমতো সমীর রায়চৌধুরী পরিকল্পনা করতেন। পূর্ব প্রজন্মে কোনো মেনটর না থাকার দরুণ মলয় ছন্দের ঐতিহ্যকে বিশেষ সন্মান জানাননি । বরং কবিতায় দ্রুতি এনে তিনি আগের প্রজন্মের ধীর গতির কবিতাকে নস্যাৎ করতে চেয়েছেন । দ্রুতি যে শ্বাসের মাধ্যমে বাক্যকে প্রান দিতে পারে তা তিনি প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার পরবর্তী কবিতাগুলিতে স্পষ্ট করে দিয়েছেন । শ্বাস কখনও অতিদ্রুত হয়েছে, কখনওবা দ্রুত ; ধর্মে সমর্পিত না হয়েও বাক্যগুলি মন্ত্রোচ্চারণের প্রতিশ্রূতি নিয়ে উদ্গত হয়েছে ; উচ্চস্বর উচ্চারণের পর শান্ত হয়েছে শ্বাস । পাঠকের মনে তিনি এই প্রক্রিয়ার দ্বারা শ্রাব্য ও মানসচিত্র সঞ্চারিত করতে পেরেছেন ।
পাঠকের হয়তো মনে আছে, মলয়ের কবিতার অন্তর্জগতে প্রবেশ করতে অসুবিধা হচ্ছে জানতে পেরে তিনি কয়েকটি কবিতার উৎসপ্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে ‘অ’ নামে একটি গ্রন্হ প্রকাশ করেছিলেন । “অ” বইটিতে মলয়ের দৃষ্টিপ্রতিভার সঙ্গে আমরা পরিচিত হই ; কীভাবে তিনি শাশ্বতের সঙ্গে তাঁর অভিজ্ঞতাকে মিশিয়ে অরূপের নৈরাজ্য নির্মাণ করেন, কীভাবে তাঁর সামনে ঘটিত বিভিন্ন ঘটনা থেকে মস্তিষ্কে আহরণ করেন, তা দাঙ্গা হোক, বা খুন হোক, বা জনগণের অসহায়তাকে নিজের অস্তিত্বে আত্তীকরণ করা হোক । মলয় বলেছেন যে হাংরি আন্দোলনের পর তিনি ভেষজ ও রাসায়নিক মাদক নেয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন । আমরা বুঝতে পারি যে ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ কাব্যগ্রন্হ থেকে তাঁর অরূপের নৈরাজ্য-নির্মাণ একটি সুচিন্তিত কাব্যপ্রয়াস । এই কাব্যগ্রন্হ থেকে তাঁর ভিশনারি হ্যালুশিনেশানগুলি আর মাদক-প্রভাবিত নয় । নিজের চেতনা সম্পর্কে মলয়ের মধ্যে একটা অবশেসন সক্রিয় থেকেছে, চেতনাকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাবার প্রচেষ্টা তিনি করেছেন, যাতে বুনিয়াদি ভাবে পাঠকের চেতনাকেও একটি কবিতা উচ্চতর চেতনায় নিয়ে যেতে পারে, পাঠকের মধ্যে ইপিফ্যানির মুহূর্ত সৃষ্টি করতে পারে, তাদের দিবাস্বপ্ন থেকে টেনে তুলতে পারে ।
হুগলি জেলার আদিনিবাসী মলয় চেয়েছেন আঙ্গিকের বাঙালিয়ানা, তিনি এই ব্যাপারে সতত সচেতন থেকেছেন কেননা তিনি শৈশব অতিবাহিত করেছিলেন ইমলিতলা নামক একটি বিহারি দলিত ও মুসলমান পাড়ায় । এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে মলয়কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন যে তিনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী নন, প্রতিষ্ঠান তাঁর বিরোধিতা করে, অর্থাৎ তিনি নিজের অস্তিত্বে জনগণের নিবাস গড়ে তোলেন । সুবিমল বসাক সরকারি পুরস্কার নিয়েছেন, শৈলেশ্বর ঘোষ সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে ফোটো তুলিয়েছেন, প্রদীপ চৌধুরী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বানে কবিতাপাঠে অংশ নিয়েছেন । মলয়, গর্বোদ্ধত মলয় রায়চৌধুরী, এই ধরণের কোনো অবমাননাকর কাজ করেননি, যা হাংরি আন্দোলনের স্খলন হিসাবে প্রতিভাত হবে । তাঁর পিতামহ ছিলেন ফোটোগ্রাফার এবং সারা ভারতের মহারাজা ও নবাব পরিবারের সদস্যদের ফোটো তুলে পেইনটিঙ আঁকতেন ; তাঁর পিতা ছিলেন পাটনা শহরের একমাত্র পেশাদার ফোটোগ্রাফার ; খদ্দেরের প্রাচীন ছবিকে নবীন রূপ দেবার জন্য তাঁর মা বা জেঠিমাকে মডেলের মতো ফোটো তোলাতে হতো ; তাঁর জাঠতুতো দিদিরা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পারঙ্গম ছিলেন। মলয় নিজেও বেশ কিছুকাল বেহালা অনুশীলন করেছিলেন । অর্থাৎ তাঁর একটি প্রপঞ্চময় কৈশোর-যৌবন ছিল । বলাবাহুল্য, তাঁর অনুপ্রেরণার অধিষ্ঠাত্রীদেবিদের অভাব ছিল না ।
মলয় তাঁর প্রণয়জীবনের কথা সুস্পষ্টভাবে পাঠকদের জানতে দেননি । ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা থেকে এটুকু জানা যায় যে শুভা নাম্নী কোনো তরুণী তাঁর কলেজ জীবনে প্রবেশ করেছিলেন এবং প্রত্যাখ্যাত হয়ে মলয় নন্দিতা ও আলেয়া নাম্নী দুই তরুণীর সমবেদনার আশ্রয় নিয়েছিলেন । মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরীর লেখা ‘দি হাংরিয়ালিস্টস’ গ্রন্হ থেকে আমরা এই তথ্য পাই । হাংরি আন্দোলনের সময়ে তিনি করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে আসার পর হিপি বিদেশিনীদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যার কিঞ্চিদধিক চিত্র আমরা পাই তাঁর ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ উপন্যাসে । মলয় কি তারপর অযাচারের আত্মগগ্লানিতে ভোগা আরম্ভ করেন ? এই প্রশ্ন উথ্থাপনের কারণ মলয় তাঁর হিপিজীবনের পরেই হকি খেলোয়াড় সলিলা মুখোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন । সলিলা মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে তাঁর একটি অসাধারণ কবিতা আছে, ‘বুড়ি’ শিরোনামে । সম্ভবত সলিলা মুখোপাধ্যায়ের প্রভাবে মলব ফিরে যান স্বাভাবিক বাঙালিয়ানায় ; তিনি রান্না করতেও শেখেন এই সময়ে, অবশ্য তাঁরা দুই ভাই, সমীর ও মলয় কৈশোর থেকে মাকে রান্নায় সাহায্য করতেন । মলয় জানিয়েছিলেন যে তিনি রান্নার রেসিপির একটা বইও লিখতে চান ।
মলয়ের বহু শৈল্পিক মানসদেবতার মাঝে মনে হয় তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রতি সবচেয়ে বেশি অনুগত । পঞ্চাশ দশকের কবিদের মতো তিনি রবীন্দ্ররচনাবলীকে লাথি মেরে ফেলে দেননি । তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নৃত্যে যোগ দিয়েছেন তাঁর অসাধারণ ‘কী বিষয় কী বিষয়’ কবিতায়, তাঁর প্রেমিকা অবন্তিকাকে রবীন্দ্রনাথ ফুসলিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন বলে অভিযোগ করেছেন, বার্ধক্যে পৌঁছে মলয় রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করছেন কে তাঁর নখ কেটে দিত । কবিতাগুলি অসাধারণ ; পবিত্র সরকারও বলেছেন যে মলয় অতি সাধারণ ব্যাপারকে কবিতার বিষয়বস্তু করে তুলতে পারেন । রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবিগুলি মলয়ের কাছে অব্যাখ্যাত, রহস্যময় । পিতাকে প্রশ্ন করে মলয় উত্তর পেয়েছিলেন যে রবীন্দ্রনাথের আঁকে যে ছবিগুলো তিনি দেখেছেন তা থেকে মনে হয় তা মনের ভেতরের স্বাধীনতাকে বের করে দেবার প্রয়াস । রবীন্দ্রনাথ, ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান ছিলেন, মলয় রায়চৌধুরী একটি প্রবন্ধে বলেছেন, তাঁদের ইমলিতলার বাড়িতে সেকারণে নিষিদ্ধ ছিলেন ; দরিয়াপুরের বাড়িতে যাবার পর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রকৃত পরিচয় হয়েছিল । নিজের জীবনের কাহিনি ‘ছোটোলোকের জীবন’-এ মলয় বলেছেন যে ব্রাহ্ম কবি ও লেখকদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন নমিতা চক্রবর্তী নামে এক তরুণী, যাঁর প্রতি মলয় আকৃষ্ট হয়েছিলেন ।
অনেকে মলয়ের কবিতায় বিদেশী প্রভাবের কথা বলেন । কিন্তু মলয় মনে করেন যে তাঁর কবিতার পারদময় জটিলতা, অযুত মননপ্রসার, অন্তরজগতের আরণ্যকতাকে বশে আনার চেষ্টা, ক্ষ্যাপাটে অশান্ত রূঢ় অনুভূতি তিনি পেয়েছেন ইমলিতলা ও দরিয়াপুরের পাটনাই ভোজপুরি পরিবেশ থেকে, যা কলকাতানিবাসী আলোচকদের অভিজ্ঞতায় নেই । কিন্তু মলয় যে চিরকাল, তাঁর কবিতা গল্প উপন্যাস নাটকে বাঙালি-সমাজ, সাধারণ মানুষ ও মানবাস্তিত্ব সম্পর্কে মঙ্গলাকাঙ্খী ছিলেন তা সন্দেহের উর্ধ্বে । শৈশবে তিনি বড়োজেঠার সঙ্গে স্কুলছুটিতে পাটনা মিউজিয়ামের ঘরে-ঘরে ঘুরে বেড়াতেন, তা তিনি লিখেছেন তাঁর বাল্যস্মৃতিতে, এবং একজন বালকের মনে বিশাল একটি প্রত্নপৃথিবীর প্রভাব যে প্রগাঢ় হবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে না । আর কোনও কবির জীবনে এই ধরণের অভিজ্ঞতার কথা আমাদের জানা নেই ।
.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন