হারুকি মুরাকামি : মলয় রায়চৌধুরী
হারুকি মুরাকামির মতো প্রচার আর প্রশংসা বোধহয় অন্য কোনও জাপানি ঔপন্যাসিক পাননি ; তাঁর আগে যাঁদের বই আমরা পড়েছি, যেমন মুরাসাকি শিকিবু’র ‘দি টেল অফ জেনজি’, য়ুকিও মিশিমা’র ‘দি সাউন্ড অফ ওয়েভস, রিউ মুরাকামির’ ইন দি মিসো স্যুপ’, নাৎসুমে সোসেকি’র ‘কোকোরো’, জুনিচিরো তানিজাকির ‘দি মাকিওকা সিসটার্স’, য়োকো ওগাওয়া’র ‘দি ডাইভিঙ পুল’, বানানা য়োশিমোতো’র ‘কিচেন’, ফুমিকো এনচি’র ‘দি ওয়েটিঙ ইয়ার্স’ নাতুসো কিরিনো’র ‘আউট’ ইত্যাদি, এনাদের বই ইউরোপ-আমেরিকায় এবং এশিয়া-আফরিকায়, হারুকি মুরাকামির মতন লক্ষ-লক্ষ কপি বিক্রি হয়নি, তাঁরা তেমন আলোচিতও হননি এবং কেউই মুরাকামির মতন আন্তর্জাতিক স্তরে বেস্টসেলার হননি, পৃথিবীর পঞ্চাশটি ভাষায় অনুদিত হননি। তার অন্যতম কারণ ওনারা জাপানি সাহিত্যের ‘ঐতিহ্য’ বলতে যা বোঝায় তা অস্বীকার করে নতুন পথে হাঁটতে চাননি, যখন কিনা হারুকি মুরাকামি অনুসরণ করতে চেয়েছেন ফ্রানৎস কাফকা, ফিয়োদোর দস্তেভস্কি, বোরিস ভিয়ান, কুর্ট ভনেগাট, রিচার্ড ব্রটিগান, রেমণ্ড থর্টন চ্যাণ্ডলার প্রমুখ লেখকদের । তিনি অনুবাদ করেছেন রেমণ্ড কারভার, ট্রুম্যান কাপোটে, গ্রেস প্যালি, জন শেভার, জন ইরভিঙ, পল থোরো আর জে ডি স্যালিঞ্জার । জাপানের সাহিত্যিক এসটাবলিশমেন্টের কর্তারা তাঁর সমালোচনা করে বলেন যে তাঁর লেখাগুলো অ-জাপানীয় । আবার সরকারি এসটাবলিশমেন্ট তাঁর কটু আলোচনা করেন কেননা তিনি বারবার বলেছেন যে জাপানের উচিত দুই কোরিয়া আর চীনের কাছে ক্ষমা চাওয়া, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ন্যক্কারজনক ভূমিকার জন্য, নারীদের যৌন-ক্রীতদাসী হিসেবে বন্দী করে রাখার জন্য । ‘দি গার্জিয়ান’-এ রেমণ্ড পুল লিখেছিলেন যে বর্তমান পথিবীতে শ্রেষ্ঠ জীবিত ঔপন্যাসিকদের মধ্যে হারুকি মুরাকামি অন্যতম । যবে থেকে জাপানের সাহিত্যিক আর রাজনৈতিক এসটাবলিশমেন্ট হদিশ পেয়েছে যে হারুকি মুরাকামি নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন, তাঁর প্রতি আক্রমণটা কমে গেছে ।
বাংলা ভাষাতেও দেখি তথাকথিত ঐতিহ্যের বাইরে বেরোলেই লেখকদের আক্রমণ করা আরম্ভ হয়ে যায় । যাঁরা এসটাবলিশমেন্টের ঔপন্যাসিক, রাইটার্স অফ ফরচুন, তাঁদের বই সেই কারণেই সচরাচর অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ হয় না ; হলেও ইউরোপ-আমেরিকায় তার তেমন আলোচনা হয় না । তাছাড়া ইংরেজি শিক্ষা তুলে দিয়ে আর পশ্চিমবাংলায় ঠিক সময়ে কমপিউটার ঢুকতে না দিয়ে সরকার একটা প্রজন্মকে নষ্ট করে দিয়েছে । বিদেশি বইয়ের আলোচনা ও অনুবাদ ঢাকার তুলনায় কলকাতায় তাই কম হয়। পশ্চিমবাংলার স্কুলগুলোয় ইংরেজির কমরেড-শিক্ষকরা বেশিরভাগই ইংরেজিতে দুর্বল ; বিদেশি সাহিত্যের হালআমলের খবর রাখেন না । তার ওপর ‘আশাবাদ’বা ‘আলোর দিশারি’ ইত্যাদি নিয়ে এতো চেঁচামেচি হয়েছে যে লেখকরা পরাবাস্তব, কাফকায়েস্ক-জগত, এলিয়েনেশান, একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা, নেতিবাচক মনোভঙ্গী, পরাজয়, ফ্যাটালিজম ইত্যাদি এলাকায় উপন্যাস বা গল্পকে নিয়ে যেতে চান না এবং বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলো এই সমস্ত থিমকে প্রশ্রয় দিতে চায় না, পাঠকের অভাবে । পাঠকরা তো বাংলা সিরিয়াল-দর্শকের বৌদ্ধিক স্তরে । কারা যে সিরিয়ালের কাহিনি লেখেন ও পরিচালনা করেন আঁচ করা কঠিন । কিছুকাল আগে সিরাজ-উদ-দউলাকে নিয়ে ‘আনারকলি’ টাইপের একটা সিরিয়াল হয়েছিল, অথচ সিরাজের খুড়তুতো ভাই লিখে গেছেন যে সিরাজ পিডোফাইল ছিল, দু’বেলা কচি মেয়ে আর ছেলে ছাড়া তার চলত না, হুগলি নদীতে যাত্রীবোঝাই নৌকো ডুবিয়ে দিয়ে মজা দেখত ।
মুরাকামি তাঁর সফলতার বিশ্লেষণ করে বলেছেন, যে-দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, তাঁর বইয়ের বিক্রি সেই দেশে সেই সময়ে বেড়ে যায় । মার্কিন লিটেরারি এজেন্সির দপতরে এক প্রশ্নের উত্তরে উনি বলেছিলেন, “ আমি ১৯৯০ দশকে রাশিয়ায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলুম যখন দেশটা সোভিয়েট ইউনিয়ন থেকে পালটে যাচ্ছিল -- বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত ছিল জনসমাজ আর বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত লোকেরা আমার বই পড়তে ভালোবাসে । জার্মানিতে যখন বার্লিনের দেয়াল ভাঙা হচ্ছিল আর জনগণ বিভ্রান্তিকর অবস্হায় ভ্যাবাচাকা খাচ্ছিল তখন জার্মানিতে প্রচুর বই বিক্রি হচ্ছিল ।” তাঁর বক্তব্যকে সত্যি প্রমাণ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকায় আর ব্রেক্সিটের ব্রিটেনে বৈচিত্র্য, অলৌকিকতা, অপার্থিবতা, দুর্বোধ্যতা, রহস্যময়তায় ভরপুর তাঁর চতুর্দশতম উপন্যাস (৬৭৪ পৃষ্ঠার বই ) ‘কিলিঙ কমেণ্ডাটোরে’ ভালোই বিক্রি হয়েছে । এই উপন্যাসের অনামা বর্ণনাকারী একজন সান্ত্বনার অসাধ্য পোরট্রেট চিত্রশিল্পী, সম্প্রতি যার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে আর এই সমস্তকিছু এড়াবার জন্য সে পূর্ব জাপানের পর্বতমালায় চলে যায় ; সেখানে সে একজন রহস্যময় প্রযুক্তি উদ্যোক্তার অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়ে ; মাটির তলায় এক মন্দিরে রাতের বেলায় একটা ঘণ্টা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবিরাম বাজতে থাকে -- কুয়ো এবং অন্যান্য ভূগর্ভস্থ কক্ষগুলি, হারিয়ে যাওয়া বিড়ালগুলো, যা একটি মুরাকামি ট্রেডমার্ক -- আর বর্ণনাকারী একটা পেইনটিঙ সেখানের চিলেকোঠায় খুঁজে পায় যার ক্যানভাস থেকে অতিবাচাল দু'ফুট উঁচু সামুরাই সৈনিক বেরিয়ে আসে ( হারুকি মুরাকামি, কৈশোর থেকে কথাসাহিত্যিক এফ. স্কট. ফিৎজেরাল্ডের অনুরাগি-পাঠক , ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’র এই উপাদানগুলো নিয়ে নতুন উপন্যাসটি এগিয়ে যায় । )
রাজনৈতিক উদ্বেগের সময়ে তাঁর কাজ জনপ্রিয় হয়: সেই উদ্দেশ্যটি পাঠকদের মনে প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহার করে, হারুকি মুরাকামি পাঠকের ফুসলিয়ে আনার একটা উপায় খুঁজে বের করেছেন, প্লট বিবর্তনের অবিশ্বাস্য জগতে পাঠক বাস্তব জগত থেকে বেরিয়ে এক আরামদায়ক আশ্রয় আবিষ্কার করে । মুরাকামি একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তিনি বেসবল খেলাটা পছন্দ করেছেন "কারণ এটি বিরক্তিকর" । ২০০৭ সালে প্রকাশিত তাঁর স্মৃতিচারণ ‘হোয়াট আই টক অ্যাবাউট হোয়েন আই টক অ্যাবাউট রানিং’ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “দৌড়োনোর আনন্দ আমি উপভোগ করি - যদি এটি সঠিক শব্দ হয় - খুব বেশি অনুভূতি থেকে বেরোবার অবকাশ পাওয়া যায় দৌড়োনোতে।”
তবে, মুরাকামিকে প্রশ্ন করা চলবে না যে তাঁর গল্প-উপন্যাসের বিস্ময়কর ও অবিশ্বাস্য বিষয়বস্তুগুলোর মানে ঠিক কী । তিনি তাঁর অবচেতনকে বিশ্বাসের ভিত্তি করে কাজ করেন: যদি কোনও তাঁর অভ্যন্তরের কুয়ো থেকে কোনও ছবি আচমকা উঠে আসে, তবে তিনি তা ধরে রাখবেন আর ব্যবহার করবেন । তাঁর মতে, যেহেতু অবচেতন থেকে উঠে এসেছে তাই অবশ্যই অর্থপূর্ণ হতে পারে - এবং তিনি তাঁর অবেচেতনকে বিশ্লেষণ করার বদলে যা ঘটেছিল তা রেকর্ড করতে থাকেন ( “বিচার-বিশ্লেষণ করার কাজ বুদ্ধিমান লোকদের এবং লেখকদের বুদ্ধিমান হবার দরকার নেই") । যেমন ধরা যাক , ২০০২ সালে লেখা তাঁর ‘কাফকা অন শোর’ উপন্যাসে একটি দৃশ্য রয়েছে যেখানে আকাশ থেকে শিলাবৃষ্টির মতো মাছ পড়তে শুরু করে। মুরাকামি বলেছেন, “লোকেরা আমাকে জিজ্ঞেস করে,‘ মাছ কেন? এবং কেন তারা আকাশ থেকে পড়ছে? ’তাদের দেবার মতো আমার কাছে কোনও উত্তর নেই। আমার মাথায় এসেছিল যে আকাশ থেকে কোনও কিছু পড়তে থাকবে । তখন আমি ভাবলাম: আকাশ থেকে কী পড়বে? আমি নিজেকে বললুম: ‘মাছ! মাছ ভাল হবে। তাছাড়া জানেন, আমার মাথায় যদি কোনো কিছু আসে তবে তাকে সঠিক বলে ধরে নিতে হবে কেননা তা গভীর অবচেতন থেকে উঠে আসছে আর ব্যাপারটা পাঠকের সঙ্গে অনুরণিত হয় । অবচেতন তো একটা গোপন জায়গা । মাটির তলায় সেই গোপন জায়গায় পাঠকদের সঙ্গে আমি মিলিত হই আর সেই জায়গায় আকাশ থেকে মাছেদের ঝরে পড়া উচিত।
প্রতীকবাদ বা এ জাতীয় কোনোরকম বিশ্লেষণ না করে ধরে নিতে হবে ওটা একত্রিত হবার জায়গা । বিশ্লেষণের কাজটা আমি বুদ্ধিজীবীদের ওপর ছেড়ে দেব।”
মুরাকামির অবচেতনা আর তাঁর পাঠকদের মধ্যে যোগাযোগের তিনি একটি পাইপলাইন - তিনি বলেন যে তিনি গল্প-বলিয়ে নন, তিনি একজন গল্প-দর্শক । যে স্বপ্ন দ্যাখে তার সঙ্গে যেমন স্বপ্নের সম্পর্কে, তেমনই তাঁর কাহিনিগুলোর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ।তাই তিনি কখনও দাবি করেন না যে তিনি রাতের বেলায় কোনো স্বপ্ন দেখেছেন আর তা গল্পগুলোতে ব্যবহার করেছেন । “সম্ভবত মাসে একবার আমি স্বপ্ন দেখি," বলেছেন মুরাকামি। “তবে আমি সাধারণত স্বপ্ন দেখি না। কারণ আমি যখন জেগে থাকি তখন স্বপ্ন দেখতে পাই, তাই আমি যখন ঘুমোই তখন আমাকে স্বপ্ন দেখতে হয় না।
মুরাকামি মনে করেন যে একজন লেখক হিসাবে আসরে নামার মূল মুহূর্তগুলো তাঁর সচেতন নিয়ন্ত্রণের বাইরে কোথাও থেকে উদ্ভূত হয়েছে । ১৯৪৯ সালে কিয়োটোতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন , জাপান তখন যুদ্ধের পর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রর দখলে, মুরাকামি তাঁর পোষা বেড়ালের নামানুসারে টোকিওতে ‘পিটার ক্যাট’ নামের একটি জাজ সঙ্গীত ক্লাব খোলার তোড়জোড় আরম্ভ করেন । কর্পোরেট কেরিয়ার প্রত্যাখ্যান করার দরুন বাবা-মাকে হতাশ করেছিলেন। তিনি একমাত্র সন্তান । তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন বৌদ্ধ পুরোহিত । কয়েক বছর পরে মুরাকামি একটা বেসবল স্টেডিয়ামের স্ট্যান্ডে বসে খেলা দেখছিলেন ; ডেভ হিল্টন নামে একজন আমেরিকান খেলোয়াড়ের এমনভাবে ব্যাট দিয়ে বলটাকে পেটালেন যে তা উড়ে চলে গেল । বলের সেই উড়ালের মুহূর্তে তাঁর মনে হল যে তিনি একটা উপন্যাস লিখতে পারেন । একে হয়তো ইপিফ্যানি বলা যায় । তিনি লেখা আরম্ভ করলেন ‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিঙ’, প্রকাশিত হল ১৯৭৯ সালে । তার পরেপরেই, যখন জাপানের সাহিত্যে পত্রিকা গুঞ্জো তাঁকে ফোনে জানালো যে উপন্যাসটিকে তারা নতুন লেখকদের পুরষ্কারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে । শুনে, তখন তিনি বেশ বিস্মিত ।
বই বেরোবার পর স্ত্রী ইয়োকোর সাথে বেড়াতে যান। পর্যটনে তাঁরা একটা আহত পায়রা পেয়েছিলেন, যেটিকে তাঁরা স্থানীয় থানায় নিয়ে যান। "সেই রবিবারের দিন বেশ উজ্জ্বল আর স্পষ্ট ছিল, গাছপালা , বাড়ি আর দোকানের জানালাগুলো বসন্তের সূর্যের আলোতে খুব সুন্দরভাবে ঝিকমিক করছিল," তিনি বহু বছর পরে লিখেছিলেন। "তখনই আমার মাথায় ঘটনাটা বাসা বাঁধে । আমি পুরস্কার নিতে যাচ্ছিলাম। আর আমি এমন একজন ঔপন্যাসিক হয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম যে কিঞ্চিদধিক সাফল্য উপভোগ করতে চলেছে । ধারণাতে বারফট্টাই ছিল বটে, তবে আমি নিশ্চিত ছিলুম যে তা অবশ্যই ঘটবে। সম্পূর্ণ নিশ্চিত। তাত্ত্বিক স্তরে নয়; সরাসরি আর স্বজ্ঞাতভাবে। "
“আমরা ষাটের দশকে বিশ্বাস করতুম যে আমরা চেষ্টা করলে বিশ্ব উন্নত হবে। লোকেরা আজ তা বিশ্বাস করে না । ব্যাপারটা অত্যন্ত দুঃখজনক” বলেছেন মুরাকামি। জাপানে সমালোচকদের প্রশংসা প্রথমদিকে তিনি পাননি । "আমি জাপানি সাহিত্যেজগতের কালো ভেড়া ছিলাম," মুরাকামি বলেছেন - তাঁর বইগুলোয় জাপানি জীবনযাত্রা ও সমাজের শিকড় না থাকায় আর বড়ো বেশি মার্কিন সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ থাকায় " আমেরিকান লেখকদের মতন " তকমা দেগে দেয়া হত । "যুদ্ধের ঠিক পরে জন্মগ্রহণ করেছিলুম, ফলে আমরা আমেরিকান সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠি: আমি জ্যাজ সঙ্গীত আর আমেরিকান পপ সঙ্গীত শুনতুম, আমেরিকান টিভি শো দেখতুম - তা ছিল আমার কাছে বিশ্বের আরেকটা জানালা । যৌবনে তিনি যাঁদের বই মনোযোগ দিয়ে পড়তেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য হলেন ফ্রানৎস কাফকা, গুস্তাভ ফ্লবেয়ার, চার্লস ডিকেন্স, বরিস ভিয়ান, কুর্ট ভনেগাট, ফিয়োদোর দস্তয়েভস্কি, রিচার্ড ব্রটিগান, জ্যাক কেরুয়াক প্রমুখ। ফলে পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাব মুরাকামিকে অন্যান্য জাপানি লেখকদের থেকে আলাদা করে দেয় । সমালোচনা হলেই মুরাকামি বলেন, ক্রমশ আমি আমার নিজের শৈলী আবিষ্কার করে ফেলেছি যা জাপানি বা আমেরিকান কোনো শৈলীই নয় - তা আমার নিজস্ব শৈলী।
সমালোচকেরা তাঁকে পাত্তা না দিলেও , তাঁর বই বিক্রির সাফল্য অবিরাম বেড়েছে। ১৯৮৭ সালে ‘নরওয়েজিয়ান উড’ বইটি, তরুণ প্রেমের মনকেমনের দুঃখের গল্প, যা প্রকাশের এক বছরের মধ্যে চল্লিশ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল। এটি একটি বাস্তববাদী শৈলীতে লেখা হয়েছিল যে-শৈলীতে মুরাকামির পরের উপন্যাসগুলো আর ফিরবে না - যদিও তিনি এই ধারণাকে মানেন না যে আকাশ থেকে পড়তে থাকা মাছ কিংবা অতিপ্রাকৃতভাবে নারীদের অন্তঃসত্বা হবার গল্প বাস্তববাদী নয়। "এগুলো আমার বাস্তববাদ," তিনি বলেছেন। “আমি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ-এর উপন্যাস খুব পছন্দ করি, তবে আমি মনে করি না যে তিনি ম্যাজিক রিয়্যালিজম হিসাবে যা লিখেছেন তা তিনি ভেবেছিলেন। এটি ছিল কেবল তাঁর বাস্তববাদ। আমার শৈলী আমার চশমার মতো: এই লেন্সগুলির মাধ্যমে বিশ্ব আমার সামনে তার মর্মার্থ উপস্হাপন করে। "
তাঁর খ্যাতিবৃদ্ধির সাথে সাথে তিনি দৈনিক লেখার রুটিনও বেঁধে ফেলা আরম্ভ করেছিলেন যার জন্য তিনি এখন কোনও একটা উপন্যাস লেখার রুটিনের জন্য বিখ্যাত। ভোর চারটেতে উঠে পাঁচ বা ছয় ঘন্টা লেখেন , অন্তত দশ পৃষ্ঠা, তার পর ছয় মাইল জগিং করেন কিংবা, সাঁতার কাটেন। মুরাকামি বলেছেন, “যখন জাজ ক্লাবের মালিক ছিলুম, জীবন অত্যন্ত বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তিকর ছিল - সকাল তিনটে বা চারটের সময়ে শুতে যাওয়া ছিল বড়োই কষ্টকর । তাই যখন আমি লেখক হলুম, আমি নিয়মনিষ্ঠ জীবনযাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলুম: তাড়াতাড়ি উঠে পড়ি, তাড়াতাড়ি শুতে যাই, প্রতিদিন ব্যায়াম করি। আমার বিশ্বাস ভালো কিছু লেখার জন্য আমার স্বাস্হ্য ভালো হওয়া উচিত" । তিনি নিছক পাইপলাইন হতে পারেন, তবে পাইপলাইনটিকে কার্যকরী রাখা তাঁর কর্তব্য। জীবনের একটা ছন্দ মুরাকামি খুঁজে পেয়েছেন আর সেই ছন্দটি তাঁর গভীর সুখের উৎস, যেকারণে তিনি প্রচুর লিখতে পারেন, দ্রুত বই প্রকাশ করতে পারেন । "সেই দিনগুলো আনন্দদায়ক দিন, তাই আরও অমন দিন চাই, আরও মজা এবং আরও পৃষ্ঠাসংখ্যা , আমি সত্যিই জানি না কেন লোকেরা আমার মোটা-মোটা বইগুলো পড়তে চায় । তবে মানতে হবে যে আমি খুব জনপ্রিয়।”
হারুকি মুরাকামির খ্যাতি আর আয় তাঁকে সময় ও ক্ষমতাও দিয়েছে , যা তিনি ছোট গল্পগুলো লেখার জন্য ব্যবহার করেন; সাহিত্যের বাইরে অন্যান্য আগ্রহে প্রয়োগ করেন । তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ । ১৯৯৫ সালে টোকিওতে পাতাল রেল পথের আউম শিন্রিকিয়ো সারিন গ্যাস আক্রমণে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাথে একাধিক সাক্ষাত্কার নিয়ে বইটি লিখেছেন , এবং ইংরেজী অনুবাদে এর জন্য দায়ী ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্য আউমের সদস্যদের সাক্ষাত্কারও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । মুরাকামি বলেছিলেন যে এই সাক্ষাত্কারগুলির মাধ্যমে তিনি ঘটনার ভিন্ন একটি দিক তুলে ধরতে চেয়েছিলেন যা জাপানি সংবাদমাধ্যমগুলি উপেক্ষা করেছিল - যেভাবে এটি গড় নাগরিকদের ক্ষতি করেছিল, তার একটি দিক ধরতে চেষ্টা করেছিলেন। সাক্ষাত্কারগুলো প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নেয়া হয়েছিল, যা জানুয়ারি ১৯৯৬ সালে শুরু হয়েছিল এবং একই বছরের ডিসেম্বরে শেষ হয়েছিল। তিনি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর পাঠকদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য সময় দেন, কেবল তাঁর বই সম্পর্কেই নয়, যন্ত্রণা লাঘবকারীর ভূমিকাও পালন করেন ।
ইংরেজি অনুবাদে নিজের বই পড়া উপভোগ করেন মুরাকামি , কারণ তা একেবারে নতুন উপন্যাস পড়ার মতো, মনে হয় তাঁর । "এই বড় বইগুলির অনুবাদ করতে এক বা দুই বছর সময় লাগে," তিনি বলেন । "সুতরাং অনুবাদটি পড়ার সময় আমি কিছুই মনে পড়ে না” তিনি পৃষ্ঠাগুলোর পাতা ওলটান :" কী হতে চলেছে? আর তারপরে অনুবাদক আমাকে ডেকে জিগ্যেস করেন: ‘হাই, হারুকি, আমার অনুবাদ কেমন লাগলো আপনার?’ আমি জবাব দিই: ‘এটা তো দুর্দান্ত গল্প! আমার খুব ভালো লেগেছে! লোকেরা বলে আমার বইগুলোর বিষয়বস্তু অদ্ভুত, তবে এর বাইরে, আরও ভাল একটি পৃথিবী হওয়া উচিত। এটি আমার গল্পগুলির মৌলিক কাঠামো: আলোতে ওঠার আগে আপনাকে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে, ভূগর্ভের মধ্য দিয়ে নামতে হবে। " তাঁর মতে, আমরা সাবজেক্ট ও অবজেক্টকে আলাদা করতে পারি না । সার্বজনীন কিছু-কিছু ব্যাপার বস্তু, ঘটনা ও প্রতিস্বকে ছাপিয়ে যায় ।
জীবনের অর্থহীনতা পৃথিবীতে যে একইরকম, তা পাওয়া যায় ফ্রানৎস কাফকা, বোরিস ভিয়ান এবং মুরাকামি হারুকির সাহিত্যকর্মে । অস্তিত্ব এবং অর্থহীনতা সংশ্লিষ্ট, কারণ তারা শুভ এবং অশুভের মধ্যে পরিবর্তনশীল চৌহদ্দির সঙ্গে যেমন সম্পর্কিত, তেমনই ব্যক্তি-প্রতিস্বের অজানা এলাকা । অস্তিত্ব এবং তার অর্থহীনতা ব্যাখ্যা করা যায় না অস্তিত্বের অস্তিত্বের বিভিন্ন এলকা বাদ দিয়ে, যেমন দুর্ভোগ, স্বাধীনতা, সাময়িকতা, মৃত্যু, আশা এবং হতাশা, বিষাদ, পারক্য ইত্যাদি । কাফকা মূলত অস্তিত্বের মর্মার্থকে না বুঝতে পাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি হবসিয়ান উপায়ে বিশ্বকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন ( ব্যক্তির নিজস্ব স্বার্থ সম্পর্কে আগ্রহ এবং ক্ষমতার সন্ধান )। তবে সর্বোপরি, কাফকাকে বিশ্লেষণ করে আলোচকরা বলেছেন যে মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছা চূড়ান্ত শক্তি হিসাবে রয়ে গেছে অস্তিত্বের নিরর্থকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। পক্ষান্তরে বোরিস ভায়ান বরং ভাল-মন্দের অজ্ঞাত অর্থের প্রতি মনোনিবেশ করেছিলেন এবং তা নিৎশীয় মূল্যবোধের রূপান্তরণের সমান্তরাল ছিল । হারুকি মুরাকামি বাস্তব এবং অবাস্তবের মধ্যে জঙ্গম সীমান্তের সমালোচনা করেছেন । তিনি উন্মোচন করতে চেয়েছেন ভালো-খারাপের মধ্যেকার অজ্ঞাত সম্পর্ক, আত্ম-প্রতিস্ব এবং অস্তিত্বের অজ্ঞাত অর্থ । কাফকা, ভিয়ান এবং মুরাকামি এইভাবে অজ্ঞাতকে জানার সুযোগ পাঠকের সামনে মেলে ধরতে চেয়েছেন ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন