মঙ্গলবার, ২৫ মে, ২০২১

যখন ফালগুনী রায়ের সঙ্গে আকাশে উড়তুম : মলয় রায়চৌধুরী

 যখন ফালগুনী রায়ের সঙ্গে আকাশে উড়তুম

মলয় রায়চৌধুরী

          যখনই ফালগুনী পাটনায় এসেছে, বলেছে, চলুন আকাশভ্রমণে যাওয়া যাক । 

          নীল তুলোয় গড়া আকাশ আমাদের দখলে,  আমরা দুজনে ডানা মেলে যথেচ্ছ উড়তুম, পালকের রঙ আর মাপ ইচ্ছানুযায়ী বদলে নিতে পারতুম, উড়তে-উড়তে বা ওড়ার আগে । 

          পুনপুন নদীর ওই পারে, গণ্ডক নদী যেখানে বাঁক নিয়ে গঙ্গায় ঢুঁ মেরেছে, তার ওপরের আকাশে, শোনের বালিয়াড়ির ওপরের সোনালি আকাশে, কোইলওয়ারের ওপরের নীইইইইইল আকাশে, উড়েছি, উড়েছি, উড়েছি, এনতার, অপরিসীম টলারেন্স লেভেল গড়ে উঠল আকাশে গিয়ে ।

          ডানা, ঠোঁট, পা, পায়ের পাতা, যখন যে পাখির চাই, সেই পাখিদের কাছ থেকে পেয়ে যেতুম । সেই পাখির আকার পেয়ে যেতুম, আর দুজনে উড়তুম পাশাপাশি, কথা বলতে-বলতে বা ঠোঁট বুজে ।

          চাকরি থেকে সাসপেন্ড, মানে অফিসে যাবার বালাই নেই, ব্যাঙ্কশাল কোর্টে সাজা হয়ে গেছে, হাইকোর্টে রিভিশান পিটিশান করেছি, কবে ডেট উঠবে তার ঠিক নেই । হাইকোর্টের উকিল পেয়েছি সদ্য ইংল্যাণ্ড-ফেরত কিরণশঙ্কর রায়ের সহযোগীতায়, উনি যার আন্ডারে জুনিয়ার, সেই মৃগেন সেন, ক্রিমিনাল লইয়ার, লড়বেন মামলাটা, আরও চারজন অ্যাসিস্ট্যান্টের সাহায্যে ; বলেছেন, চিন্তা নেই । 

         সুবিমল বসাক যোগাযোগ রেখেছে ওনাদের সঙ্গে, ডেট উঠলে জানাবে ।

          চিন্তা যখন নেই, তখন আকাশেই উড়ি । চিন্তা কেবল টাকার । 

          ফালগুনী পাটনায় ওর দিদির বাড়িতে, যাঁর প্রতিবেশী ফালগুনীর প্রেমিকার স্বামী ।

          ফালগুনী সকাল-সকাল পৌঁছে গেছে আমাদের বাড়ি, দরিয়াপুরে । ইমলিতলা পাড়া ছেড়ে দরিয়াপুরে চলে এসেছি ; হিপি-হিপিনীরা নেপালে যাবার পথে দরিয়াপুরে হল্ট করে স্টিমারে বা নৌকোয় গঙ্গা পার হয়ে হিচহাইক করে চলে যায় কাঠমাণ্ডু । 

         ফালগুনী কাঠমাণ্ডু যেতে চায় না, পাটনায় দিদির বাড়ি আসার উদ্দেশ্য তো প্রেমিকার সঙ্গে চাউনি বিনিময়, যদি সুযোগ পাওয়া যায় । 

        চাউনি বিনিময় হয়ে গেলে,  সেদিন আকাশে ওড়ার অফুরন্ত নীল, সারসদের পাশাপাশি, সাগর-ঈগলদের সঙ্গে, বেগুনি কালেমের ফিকে বেগুনি-নীল পালক আর গোলাপি ঠ্যাঙের, কালো চকচকে ফিঙের, শাদা-গোবকের ঝাঁকের, ভুবনচিলের সঙ্গে শীতের ফিনফিনে দুপুরের ওড়াউড়ি ।

          আকাশে ওড়ার অনেকরকম সরকারি হাওয়াইজাহাজ ছিল তখন, বোর্ডিং পাসও বেশ সস্তা, দু-আনা পুরিয়া, চার-আনা পুরিয়া, আট-আনা পুরিয়া, পৌয়া বাটলি আট আনা, ছটাক বাটলি চার আনা, সোমরস খুচরা দু আনা, ঠররা খুচরা চার আনা, লমনি তাড়ি পাতার দোনায় এক-আনা, মাটির ভাঁড়ে চার আনা ।

          হিপি-হিপিনিদের দেয়া লাইসারজিক অ্যাসিডে ভিজিয়ে শোকানো ব্লটিং পেপারের এক ঘন ইঞ্চের টুকরো আর পিসিপি বা অ্যাঞ্জেল ডাস্টের গুঁড়ো ফ্রি, পেইনটার করুণানিধান মুখোপাধ্যায় আর অনিল করঞ্জাইয়ের সৌজন্যে, স্টকে অবশ্য বেশি নেই ।

         একাধদিন ফালগুনী বলত, আজকে কাঁদতে-কাঁদতে উড়ব, ভুবনচিলেরা কাঁদে, চলুন চিলেদের পাশাপাশি উড়ি ; আপনি খেয়াল রাখবেন যাতে চোখের জল মাটিতে ঝরে না পড়ে, যেখানে পড়বে সেখানে হয়তো দৈত্যরা জন্ম নেবে, সে দৈত্যরা ধোঁয়ায় গড়া, আমি চাইনা ওই ধোঁয়া লোহানিপুর পাড়ায় দিদি-জামাইবাবুর বাড়ির দিকে ভেসে যাক ; আমার ভিতর এক কুকুর কেঁদে চলে অবিরাম ।

         আমি ওকে বলি, আমিও চাই না হে, তোমার জামাইবাবু সেই কলেজে পড়ার সময় থেকে আমার ওপর চটা । ওনার ক্লাসে সিটে বসে হিসি করেছিল কানাইলাল সাহা, আর উনি ভাবলেন কাজটা আমার, কেননা উনি যখন রিকশায় চাপছিলেন তখন আমি হেসে ফেলেছিলুম । উনি এতো মোটা যে রিকশঅলা বলেছিল, হুজুর আপনার ওজন তো দুজনের, আপনি একজনের ভাড়ায় কি করে যেতে চাইছেন ! রিকশয় চাপার আগে উনি প্রতিবার হুড ঝাঁকিয়ে পরখ করে নিতেন বইতে পারবে কি না ।

        ফালগুনী বললে, জানি, যেদিন থেকে শুনেছেন আপনি আমার বন্ধু , সেদিন থেকেই উনি আমাকে সাবধান করেছেন যে আপনি আমাকে উচ্ছন্নে নিয়ে যাবেন, দিদিকেও বলেছেন যাতে আপনার সঙ্গে না মিশি । আপনার গ্রেপ্তারির খবরটা ইনডিয়ান এক্সপ্রেস বেশ নোংরাভাবে প্রকাশ করেছিল ।

        তোমার দিদি আমাদের বাড়ি এসে মাকে বলে গেছেন যে আমি তোমাকে নষ্ট করে দিচ্ছি ।

        ফালগুনী বললে, ওনাদের তো পাখিদের সঙ্গে আকাশে ওড়ার, নদীর তলায় হাঙর, তিমি, সিলমাছ, ইলিশঝাঁকের সঙ্গে সাঁতার কাটার, মাটির নিচে ঢুকে ডাকিনি-প্রেতিনিদের সঙ্গে আগুনের হল্কার ভেতরে নাচবার অভিজ্ঞতা নেই, তাই ।

 

        আজকে গুলফি ঘাটের শ্মশানে গিয়ে ওড়া যাক, হাথুয়া মার্কেটের পানের দোকান থেকে দুখিলি গিলোরি পান কিনে খেতে-খেতে বললে ফালগুনী । তালশাঁসের মতন পানের ভেতরে ভাঙের মশলা ভরা, একটু সময় লাগে উড়তে, যতক্ষণে আমাদের ডানা আকাশ পাবে ততক্ষণে গান্ধি ময়দানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাবো শ্মশানে ।

        তীরে বালি জমে-জমে গঙ্গা নদীর সঙ্গে শ্মশানও এগিয়ে চলেছে ; যাদের শব পুড়ছে তাদের দাদু-দিদা যেখানে পুড়েছিল, সেখানে ঘাস গজিয়েছে । শবদাহ চলছে দূরে । ভালই, আমাদের জন্য বসার জায়গা, শবাযাত্রীদের সঙ্গে, তারা একে-একে ন্যাড়া হচ্ছে, আর আমরা একটু-একটু করে উড়ছি, যেন লম্বাগলা বগিবক, ক্ষনিকেই ডানা মেলব দুজনে ।

         ফালগুনী বললে, ওই দেখুন, সময় ; আঘাত লুকিয়ে রাখাও শিল্প, বুঝেছেন ।

          বললুম হ্যাঁ, সময়কে দেখছি ।

         শবকে শোয়াবার আগে তার দেহ থেকে আঙটি ইত্যাদি খুলে নিচ্ছিল শ্মশানডোম । শবের ছেলে বললে, বাবার হাতের ঘড়িটা থাকতে দাও, ওটা ওনার প্রিয় রোলেক্স ঘড়ি, উনি বলেছিলেন  যে মারা গেলে যেন ঘড়িটা খোলা না হয় ।

         সময়কে দেখলুম, পুড়ছে ।

         ফালগুনী বললে, নীল আকাশে পৌঁচেছেন কি ?

         নাহ, এখনও মাটির কাছাকাছিই উড়ছি, চড়ুই-শালিখদের মতন ।

         তাহলে চলুন, ওই সাধুদের জমায়েতটায়, ছিলিম ফুঁকছে ।

         দুজনে বসলুম গিয়ে, কিছুই বলতে হল না, ছিলিম এগিয়ে দেয়া হল আমাদের দিকে; সাধুরা কাপড় ভিজিয়ে ছিলিমে মুড়ে ফোঁকে না, আমি রুমাল বের করে মুড়ে নিলুম ।

        দুজনেই দু-ফুঁক করে মারলুম । ফিরে গিয়ে বসলুম আগের জায়গায় । হাতঘড়ি পুড়তে আরম্ভ করেছে শবের সঙ্গে ।

        পোড়া ঘড়িটা আমাকে কনফিডেন্স দিচ্ছে, মড়াটাকে ধন্যবাদ ; একটু থেমে, ফালগুনী  বললে, সবই আছে, আমার জন্য নয় ।

        তুমি তার মানে ওড়া আরম্ভ করে দিয়েছ ! দাঁড়াও ওই আইসক্রিমের ঠেলা থেকে দুটো কাঠিবরফ কিনে আনি ।

        হ্যাঁ, আনুন, আমারও গলা শুকিয়ে গেছে, কাশতে চাই না, কাশতে ভয় করে, আমাদের পরিবারে কাশি ব্যাপারটা নিষিদ্ধ ।

        নিয়েলুম দুটো আইসক্রিম । চুষতে চুষতে মনে হচ্ছে সবকিছু নতুন, ন্যাড়ালোকগুলোর মাথা ঘিরে রুপোলি জ্যোতি, শবের আগুনে কমলা আর সবুজ রঙের পরিরা নাচছে, গঙ্গা আর নেই, সবুজের পর সবুজ ।

       ফালগুনী বললে, ভাঙের সঙ্গে পানের ভেতরে অন্যকিছুও ছিল, বুঝলেন, ওইপারের গাছগুলোও দেখতে পাচ্ছি, গাছেদের লালরঙের পাতাগুলো দেখতে পাচ্ছি, আগে এরকম গাছ দেখিনি, নৌকো দেখছেন, মাঝিদের গান শুনতে পাচ্ছেন, সালারা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে বোধহয় ।

        কোন গান ?

        আপনি রবীন্দ্রসঙ্গীত জানেন ? ওই গানটা, কেন যামিনী না যেতে জাগালে না ।

        জানি, চলো ওই দিকে, জলে গিয়ে বসি, এখানে বুড়ো শবযাত্রীরাও কাঁদতে আরম্ভ করেছে, বুড়োরা এরকম ভেউ-ভেউ করে কাঁদছে, আগে দেখিনি ।

        চলুন, ফিরতে ফিরতে শুকিয়ে যাবে , সব কান্নাই শুকিয়ে যায়।

        নদীর কিনারায় গিয়ে বসি দুজনে, জলের খুদে ঢেউ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে । স্টিমার গেলে তখন ঢেউগুলো জোর পাবে ।

        আমি শুরু করি, গলা ছেড়ে, বেসুরো হলেও কিছু এসে যায় না, জানি, শ্রোতা বলতে গঙ্গা নদী আর ফালগুনী রায় । আমার স্কুলের বন্ধু বারীন গুপ্ত আর সুবর্ণ উপাধ্যায় থাকলে তিনজনে মিলে গাইতুম, বারীন গুপ্ত তাড়ির হাঁড়িতে তবলা বাজাত গাইতে গাইতে । 


কেন যামিনী না যেতে জাগালে না, বেলা হল মরি লাজে

শরমে জড়িত চরণে কেমনে চলিব পথের মাঝে

আলোকপরশে মরমে মরিয়া হেরো গো শেফালি পড়িছে ঝরিয়া

কোনোমতে আছে পরান ধরিয়া কামিনী শিথিল সাজে


         বললুম, ব্যাস এইটুকুই মনে আছে ।

         ফালগুনী বলল, ওই কটা লাইনই গাইতে থাকুন । 

         আরেকবার গাইবার পর দেখলুম ফালগুনীর চোখে জল । কয়েক ফোঁটা পড়ল নদীর ঢেউয়ে । স্মৃতির টর্চারের কাছে পুলিশের থার্ড ডিগ্রিও পালকের সুড়সুড়ি । কিংবা হয়তো ওই বৃদ্ধদের কান্নার শোক নিজেও নিণে নিয়েছে কিছুটা । 

         এই শ্মশানে আমার বড়োজ্যাঠার মুখাগ্নি করেছিলুম ; তখন পুরুতমশায় সতীশ ঘোষাল বলেছিলেন, শ্মশানে এলে একধরণের বৈরাগ্য হয় ।

         দুজনে চুপচাপ বসে রইলুম সন্ধ্যা পর্যন্ত । আমরা সেই স্হিতিতে, যাকে হিপি-হিপিনীরা বলে ‘স্টোনড’ ।

         ফেরার সময়ে, রূপক সিনেমার কাছে ঘুগনি খেলুম । ফালগুনী বললে, আমি কিন্তু ইনসেন নই, কেবল অযাচিত ঘটনার সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলছি । আর আপনি যেচে লাৎ খাচ্ছেন ।

        বললুম, আমার টলারেন্স লেভেল এখন অমেয় ।


          আরেক দিন ফালগুনী । সেই একই পোশাকে, ঝোলা কোট আর ধুতি, দুটোই নোংরা, কখনও কাচা হয় না, দেখলেই বোঝা যায়, কোটটা ওর বাবা বা কাকার কারোর, বা তারও আগের, ওদের জমিদারির অবশেষের চিহ্ণ । মাঝখানে সিঁথিকাটা, কাঁধ পর্যন্ত চুল, স্নান করা হয়ে ওঠেনি বেশ কয়েকদিন, নখ বড় হয়ে উঠেছে । ওর আঙুলগুলো চিত্রকরদের মতন । পায়ে চটি ।

          আমার ঘরে গিয়ে বসবে চলো । ঘরে বসে ওড়ার সুবিধা হল অযথা হাঁটতে হয় না, বাইরে বেরোলে দুপুরের রোদে ডানার পালক শুকিয়ে ঝরঝরে হয়ে যায় ।

          ধোঁয়ার গন্ধে আপনার মা জেনে ফেলবেন, বলবেন না তো কিছু ?

         ফুঁকব না, গিলব । তাছাড়া হিপি-হিপিনীরা আমাদের বাড়িকে হলটিং স্টেশান করে মা আর বাবাকে কবি-আঁকিয়েদের জগতের সঙ্গে সম্যক পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, ছোটোলোক পাড়ায় বসবাস করার এই সুবিধা ।

         কী আছে ? 

         অ্যাঞ্জেল ডাস্ট । করুণা-অনিল নেপাল থেকে ফেরার সময়ে একটু দিয়ে গিয়েছিল, বেশ মজার, নিজেকে হারিয়ে না ফেলেও ওড়া যায় । জলে গুলে খেয়ে নিলেই হল । ঘণ্টাখানেক পরে উড়তে থাকো ।

        অরেঞ্জজুসের সঙ্গে অ্যাঞ্জেল ডাস্ট বা পিসিপি গুলে খেলুম দুজনে  ; অতিথিকে অরেঞ্জজুস খাওয়ানো যেতেই পারে । 

        ফালগুনী বললে রেকর্ড প্লেয়ারটা লাগান, রবীন্দ্রসঙ্গীত নয় । 

        মোৎসার্ট ছিল, লাগিয়ে দিলুম ।প্রথম-প্রথম মোৎসার্ট শুনে বুঝতে পারতুম না, রেকর্ডের লেবেল দেখে বুঝতুম । বারবার শুনে আইডিয়া হয়ে গেছে ।

        সোফায় রুপোলি মেঘের ওপর শুয়ে ফালগুনী বলল, আমিই সঙ্গীত হয়ে গেছি, সঙ্গীত শুনছি না, সঙ্গীত হয়ে গেছি, দেখুন গায়ে হাত দিয়ে, মিউজিকের ফ্রিকোয়েন্সি অনুভব করবেন । সবকিছু বেশ ভালো লাগছে, মনে হচ্ছে কল্পনাশক্তি আঙুলের ডগায় চলে এসেছে, জলের ফোঁটা টেবিলের ওপর পড়েছে, দেখুন, দেখতে পাচ্ছেন, প্রিজমের মতো দেখাচ্ছে, প্রিজমের সাতরঙা লাইট ছড়িয়ে পড়ছে, মোৎসার্ট বললেন তো ? মোৎসার্টকে বুঝতে পারছি, অনেকদিন পর রিল্যাক্সড ফিল করছি, সবায়ের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু কেউ তো আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না । 

         তুমি ওড়া আরম্ভ করে দিয়েছ ; উড়তে থাকো, মেঘের ওপর দিয়ে ওড়ো, বেশি কথা বোলো না, আরও ওপরে ওঠার পর কথা বোলো। 

         কথা বলতে ভালো লাগছে, বারান্দার দরোজা  দিয়ে দেখুন, আকাশের রঙ, বেগুনি হয়ে গেছে । সত্যিই কি বেগুনি ?

         বেগুনি রঙটা মোৎসার্টের সঙ্গীতের প্রতিধ্বনি, অবাস্তব নয় ।

       ধ্বনি শুনছি না কিন্তু, কেবল প্রতিধ্বনি শুনছি, কান পেতে শুনুন, রাস্তার লোকজন আর যানবাহন চলারও প্রতিধ্বনি শুনছি আয়নার দিকে তাকান, আয়নার দিকে তাকান, টান দিচ্ছে, আয়নাটাই আমাকে টান দিচ্ছে । রাস্তায় তাকান, রাস্তায় তাকান, রিকশটা ভাসছে, রিকশঅলা কই, ট্রাকটাও উড়তে উড়তে চলে গেল ।

        তুমি বললে, তুমিই সঙ্গীত হয়ে গেছ, নেশা করলে কি তুমি তোমার কবিতা হয়ে যাও ?

        সোফায় সটান মেঘের ওপর শুয়ে ফালগুনী বললে, এক্ষুনি বলতে পারব না, নেশা  ছেড়ে গেলে বলতে পারব । এখন আমি ওই পিঁপড়েটার সঙ্গে কথা বলতে পারি, পিঁপড়েটা আমার কথা ঠিক বুঝতে পারবে ।

        দুপুরে মাংস-ভাত খাবার পর ফালগুনীকে আরেকবার প্রশ্নটা করলুম ।

        ফালগুনী বলল, জিজ্ঞাসা করেছিলেন নাকি ? তখনই বলতে পারতাম, এখন পারব না, এখন কবিতা নিয়ে ভাবতে চাই না ; বাড়ি গিয়ে ঘুমাতে চাই । কেমন একটা চাপ-দেয়া পীড়া ছিল যখন এসেছিলাম, কানে অস্পষ্ট কোলাহল ছিল, অ্যাঞ্জেল ডাস্টে পীড়া লাঘব হল মনে হয় । বাকি যেটুকু আছে, নিজে খাবেন না, আরেকদিন বসব ।  রিকশা ভাড়াটা প্লিজ দিয়ে দিন ।


        আজকে কনভেন্ট স্কুলের মোড়ের দোকান থেকে চরস কিনে খাওয়া যাক, কী বল ? ফালগুনীকে বললুম ।

        খাবার কথা বলছেন কেন ? ফুঁকলে বেশি আনন্দ হবে ।

        আনন্দের জন্য ফোঁকো ?

        দৈনিক ব্যানালিটি থেকে বেরিয়ে শান্তি পাই ! আমি কি বোদলেয়ার নাকি যে কবিতা লেখার জন্য নেশা করব !

        বোদলেয়ার, থিওফেল গতিয়ে আর ওনাদের আগে ডি কুইনসি, এই নেশাগুলোর কথা কিন্তু বলেছেন সৃজনশীল হয়ে ওঠার জন্য ।

        ধ্যুৎ । বোদলেয়ার হ্যাশিস, আফিম আর মারিহুয়ানার তুলনায় ওয়াইনকে গুরুত্ব দিয়েছেন ওনার আর্টিফিশিয়াল প্যারাডাইস বইতে । 

        তার কারণ হল রোমান্টিকরা প্রাচ্যের নেশাকে মনে করত জংলিদের সংস্কৃতি । তাইতো দেখা যায় এমিল জোলার বইতে  মদ খাওয়া আর বৈভবের তোল্লাই ; উল্টো দিকে আমাদের দেশে ওনাদের ঢঙে মদ খাওয়াটা অধঃপতনের লক্ষণ । আসলে উপনিবেশবাদ ওইভাবে প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের আর ওনাদের সংস্কৃতিতে। বোদলেয়ার আফিম আর হ্যাশিশের বিরুদ্ধে লিখে গেছেন ; আফিমের ব্যবসা ইউরোপই চালু করেছিল, ভারতে আফিম চাষ করে চিনে রপ্তানি করত । আফিম বিক্রির টাকায় তৈরি হয়েছিল রোমান্টিক যুগের বনেদ । বোদলেয়ারও আফিম খেতেন সিফিলিসের যন্ত্রণা উপশমের জন্য ; অথচ পরে গিয়ে আর্টিফিশিয়াল প্যারাডাইস লিখলেন প্রচ্ছন্নভাবে ওয়াইনের গুণগান করে ।

       ফালগুনী বললে, আমি কবিতা লেখার জন্য নেশা করি না, নেশা করি দৈনন্দিন ব্যানালিটি থেকে বেরোনোর জন্য, আপনি যদি আমাদের বাড়ির সদস্য হতেন তাহলে বুঝতে পারতেন, কলকাতায় সময় কাটানোটাও ব্যানাল হয়ে দাঁড়িয়েছে । মেঝে থেকে মার্বেলপাথর তুলে বিক্রি করে দিচ্ছে কেউ-কেউ । প্রেম নেই, প্রেমে না-থাকার ব্যাখ্যাহীনতা আছে । 

       তুমি তো তোমার বাড়ির বিষয়ে বলো না কিছু, জিগ্যেস করতেও কুন্ঠিত হই, তোমার দাদা তুষারের সঙ্গে মারামারি করেছিলে শুনেছি ।

        আমি করিনি, তুষারই দাদাগিরি ফলিয়ে মেরেছিল আমাকে ; হাংরি আন্দোলনে যোগ দেয়া ও পছন্দ করেনি, বলছিলো এই আন্দোলনের ভবিষ্যত নেই, তার ওপর মামলা-মোকদ্দমা ।

        তোমার চেয়ে দশ বছরের বড়ো, তাই হয়তো । আমার দাদা আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো, কিন্তু আমাদের সম্পর্ক তো বন্ধুত্বের ।

        আপনি বুঝবেন না, আপনাদের কথা আলাদা । আপনাকে বলেছিলাম চাইবাসায় নিয়ে চলুন, নিয়ে গেলেন না, শালপাতায় হাড়িয়া খাওয়া হল না, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছি, হাড়িয়া আর মহুয়ার কথা, টাটকা গরম-গরম মহুয়া । উনিও কবিতা লেখার জন্য নেশা করতেন না, নেশাগ্রস্ত থাকতে ওনার ভালো লাগত। 

       ভাবলুম বলি যে তোমার মতনই প্রেমে চোট খেয়েছেন শক্তিদা, কিন্তু বললুম না । তার বদলে বললুম, যাকগে, চলো, দোকান খোলাই রয়েছে, ভিড়ের ভেতর দিয়ে হাত ঢোকাতে হবে । শিক্ষিত চেহারা দেখলে গাঁজা-চরসের দোকানের ভিড়টা আপনা থেকে জায়গা করে দ্যায়, মদের দোকানে কিন্তু করে না । বোদলেয়ার যে কেন মদের পক্ষে আর গাঁজা-চরসের বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছেন তা এই ব্যাপারটা থেকে স্পষ্ট হয় । আমার সেজমামার শশুরের গনোরিয়া ছিল, উনি ব্যথা উপশমের জন্য আফিম খেতেন । শশুরের জন্য কিনে নিয়ে যেতেন সেজমামা, তখনকার দিনে সরকারি দোকানে যৌনরোগের জন্য চাই বললে, আফিম সহজেই কিনতে পাওয়া যেত ।

         এনাদের থেকে, এই ভিড়ের মানুষদের থেকে আমাদের কোনো পার্থক্য নেই মলয়, দেখতে কি আমি একই রকম নই, চুল আঁচড়াইনি কতদিন, দাড়িও বেড়ে চলেছে, স্নান করা হয়ে ওঠেনি বেশ কয়েক দিন ; আপনি তবু ডেইলি স্নান করেন, কিন্তু দাড়ি বাড়িয়ে চলেছেন, পোশাকেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন, এই একটা কর্ডুরয় ফুলপ্যান্ট আছে ?

        এটা নোংরা হয় না, কাচাকাচি করতে হয়না । একটাকার কয়েনটা ওদের কোমরের মাঝখান দিয়ে জানলার ভেতরে ঢুকিয়ে বলো দো পুরিয়া চাটনি ।

        মূর্খকুৎসিতদরিদ্র মানুষ-মানুষীর মিছিলে আমি ভেসে চলে ভুলে যাই সে সময়ে আমি বেটাছেলে না মেয়েছেলে ।

        ঠিকই বলেছ তুমি, এই ভিড়ে ঢুকে বোঝা গেল যে বোদলেয়ার, র‌্যাঁবো, করবিয়ের, লাফোর্গ, আঁতোয়া আর্তোর উদ্দেশ্যময় নেশা করা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা আমাদের উদ্দেশ্যহীনতা এই মূর্খ কুৎসিত দরিদ্র লোকগুলোর সঙ্গেই তুলনীয় ; তুমি এলে আমি নেশা করি, করুণা-অনিল এলে নেশা করি, রাজকমল চৌধুরী এলে করি, ফণীশ্বরনাথ রেণু বাড়িতে ডাকলে গিয়ে নেশা করি । নিজে একা-একা গাঁজা-চরসের নেশা করি না । 

        একদিন নিয়ে চলুন না ফণীশ্বরনাথ রেণুর বাড়িতে ।

        হাজিপুরের একজন বিডিও ডেকেছে আমাদের, রাজকমল, রেণুও যাবেন, তুমিও চোলো সঙ্গে, স্টিমারে করে ওপারে, পাকা কলার কাঁদি ঝোলা বাগানে সাহিত্যসভার আয়োজন করেছে বিডিও ।      

        যাবো । বোর হয়ে গেছি এখানে । সুভাষরা পত্রিকা বের করবে বলছে । কবিতা লিখে রেখেছি কিন্তু এখনও চায়নি আমার কাছ থেকে । কেউই আমার কবিতা প্রকাশ করতে চায় না ।

        সুবিমল বসাকের কাছে দিয়ে রাখো কয়েকটা । সুভাষ পত্রিকা বের করছে চিঠিতে জানিয়েছে ত্রিদিব । আমি, দেবী, সুবিমল, ত্রিদিব বাদ যাচ্ছি । দ্যাখো তোমাকে ইনক্লুড করে কি না । 

        সুবিমলবাবুকে দিয়েছি ; বললেন বুলেটিন বেরোনো অনিশ্চিত ।

        হ্যাঁ, আমার মাইনে এখনও আটকে আছে, উকিলের কাছেও বকেয়া রেখেছি ।


         ফালগুনী বললে, গিলে তো নিলাম, ইউফরিয়া আরম্ভ হল না তো ! ফুঁকলে বরং এতক্ষণে শুরু হয়ে যেত । চলুন সবজিবাগের সামনের জাহাজঘাটায় গিয়ে বসা যাক, স্টিমার যাতায়াত দেখব চাতালটায় বসে । এখানে আন্টাঘাটে সবজিঅলাদের বড্ডো কিচাইন । এটা অ্যাফ্রোডিজিয়াক নয়তো ? বোদলেয়ার নাকি অ্যাফ্রোডিজিয়াক হিসাবে গিলতেন ।

        কম বয়স থেকে বেশ্যালয়ে ঢুঁ মারতেন, তারপর জাঁ দুভালকে সামলানো, দরকার পড়ত হয়ত অ্যাফ্রোডিজিয়াক হিসাবে । 

       হাঃ হাঃ, পা দুটো ক্রমশ মাখনের তৈরি মনে হচ্ছে, মাতালের মতন হাঁটছি না তো ? আপনিও লিকুইড হয়ে উঠছেন । চেয়ে দেখুন, চেয়ে দেখুন, ছায়ার খাপে-খাপে শরীর বসছে না ।

       এক্ষুণি উড়ো না, আরেকটু সামলে চলো, এই রাস্তাটার দু-পাশে ভিকিরি । গিন্সবার্গ যখন এসেছিল, এই ভিকিরিগুলোর ফোটো তুলে নিয়ে গেছে ।

        বিট-ফিটদের কথা বাদ দিন, শালারা প্রচুর টাকা কামাচ্ছে কবিতার বই বেচে, পৃথিবী ঘুরছে ; ওনাদের কবিতা ততো ফিল করতে পারি না । আমার ব্যক্তিগত-সত্য কি বিট কবিদের পক্ষে অনুভব করা সম্ভব ? আমার সত্যাবস্হা  আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, আমি তা নিজে অনুভব করতে পারি, অবিরাম তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে । এক ঘণ্টার বেশি হয়ে গেল এখনও জাহাজঘাটায় পৌঁছোলাম না তো । 

        ঘড়ি তো পরে আসিনি, দাঁড়াও এই লোকটাকে জিগ্যেস করি । ভাইসাব কিতনা বজা হ্যায় ?

        ইগারা বজকে পঁয়তিস মিনট ।

        কেবল পাঁচ মিনিট হয়েছে, মনে হচ্ছিল একঘণ্টা ; কারো ঘড়িতে কটা বেজেছে জেনে কীই বা হবে । সময় জিনিসটা আনরিলায়বল । সেদিন দেখলেন পুড়তে, পুড়েই চলেছে । আপনি আমার হাতটা থরে থাকুন, হাওয়া যা দিচ্ছে, উড়ে না যাই , নাকি পৃথিবী অভিকর্ষহীন হয়ে গেল ।

         তুমি পৃথিবীকে অভিকর্ষহীন করে ফেলেছ । ইউফোরিয়া চাইছিলে !

        ব্যাপারটা কী বলুন তো ? টেম্পল অফ ইনফিনিটি খুলে যাচ্ছে চোখের সামনে । এটাই হ্যালুসিনেশান বুঝেছেন, স্বপ্ন থেকে আলাদা । 

        তোমার তো দেখছি কনশাসনেস দিব্বি রয়েছে । চলো ওখানটায় বসা যাক, স্টিমারযাত্রীদের ভিড় কম ওই জায়গাটায় । লোকগুলোর এতো চেঁচামেচির কী আছে বুঝিনা ।

        হ্যাঁ, আমার কোনো কিছুতেই আর তেমন নেশা হয় না । খালাসিটোলাতে গিয়েও মাতাল হইনি কোনোদিন। আপনার কি এরকম হয়েছে যে কবিতার লাইন চলে আসছে মনের মধ্যে অথচ লিখতে ইচ্ছা করছে না ।  

        আমি মনে রাখতে পারি না, যদি কাগজ কলম কাছাকাছি থাকে তাহলে লিখে রাখার চেষ্টা করি । 

        জলে উড়ছি, জলে উড়ছি, মানুষগুলো মাছের মতন সাঁতার কেটে স্টিমারে উঠছে, দেখুন দেখুন । আবার কাশি পাচ্ছে, লেমোনেড খাওয়ান না, হাফ-হাফ ।

       দাঁড়াও, কেশো না, আনছি লেমোনেড, খসখসের গন্ধ থাকে সবুজ লেমোনেডে, কাশি কমাবে তোমার ।

       সুধীন দত্ত বেঁচে থাকলে ওনার বাড়ি যেতাম একবার, শুনেছি এক্কেবারে সাহেব মানুষ ছিলেন, মদ খাবার কেতা ছিল । পাতা ফুঁকে যেতাম কবিতা শোনাতে , ওনার প্রতিক্রিয়া এনজয় করতাম । 

       গলা ধাক্কা খেতে, ওনার অর্ডারলিকে ডেকে বলতেন, থ্রো হিম আউট । আমি বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ভবনে গিয়েছিলুম । নাম শুনেই মুখের ওপর দড়াম করে দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন । প্রথমটা খারাপ লেগেছিল, তারপর পথে নেমে এই ভেবে আনন্দ হল যে আমার দুর্নাম ওনার কাছে আগেই পৌঁছে গেছে ।

       মানুষ কেন মানুষকে অপছন্দ করে বলুন তো ? আমি তো কাউকে অপছন্দ করি না । সময় যেখানে পুড়ে নষ্ট হয়ে চলেছে, সেখানে কাউকে আঘাত দেবার কোনো মানে হয় না । এই যে সকলের সঙ্গে থাকি, থাকাটুকুই সার । আমাদের নাম নিউজপেপারের নোংরা পৃষ্ঠায় ছাপা হয়, তবু স্বর্গে যাবো, দেখে নেবেন । 


৬      

          সোফার ওপর মেঘে শুয়ে যাকে বলে ‘স্টোনড’ সেই তুরীয় অবস্হায় ফালগুনী, এলএসডিতে ভিজিয়ে শোকানো এক ঘন ইঞ্চের ব্লটিং চিবিয়ে । 

         আমি খাইনি ; ফালগুনীকে লক্ষ্য রাখার জন্য । দুজনে তুরীয় অবস্হায় থাকলে মা এসে দেখবেন আর বিরক্তি প্রকাশ করবেন । ফালগুনীর দিদি অলরেডি এসে কথা শুনিয়ে গেছেন ।

        ওর দিকে তাকিয়ে ভাবি, কিসে আক্রান্ত ফালগুনী ? রবীন্দ্রনাথের বৌঠান, জীবনানন্দ দাশের লাবণ্য, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শীলা--- ফালগুনী কি সেভাবেই আক্রান্ত ? ওনারা কবিতায় নিয়ে গেছেন আত্মস্হিতিকে ; ফালগুনী সেইভাবে কবিতায় নিয়ে যেতে চাইছে না, অত্যন্ত গোপন রাখতে চাইছে, শেয়ার করতে চাইছে না আমার সঙ্গে, এমনকী নিজের কবিতার সঙ্গেও ! কেন ? কী বলব ওর আত্মস্হিতিকে ? দৌর্মনস্য ? লুগিয়াউব্রিয়াসনেস ? গোপন ঐকান্তিকতা ? অতৃপ্তি ? উদ্দেশ্যহীনতা ?

          গ্রিক ভাবুকরা মনে করতেন পিত্ত কালো হতে থাকলে দৌর্মনস্য দেখা দেয়, আর তা যদি সারতে বহুদিন লেগে যায় তাহলে বুঝতে হবে কোনো অপদেবতা ভর করেছে । ফালগুনীকে কথাটা বলেছিলুম একদিন । ও বললে, আমি তো চাই ডাকিনী-পিশাচিনী ভর করুক, ক্যাথারসিসের অদৃষ্ট করে তো আসিনি ।

          জ্যোতিষীরা মনে করেন শনির প্রকোপে পিত্তদোষ হয়, এবং তার দরুন দৌর্মনস্য । ফালগুনী বলেছিল একবার, ওর নাকি এখন শনির সাড়ে-সাতি চলছে, যা পারা যায় এই সাড়ে-সাতি পিরিয়ডেই লিখে ফেলতে হবে । অথচ লেখালিখি তো তেমন করছে না । ওয়েটিং ফর গোডোর মতন সদাসর্বদা যেন অপেক্ষা করে আছে, কিসের অপেক্ষা তার অনুসন্ধান করে চলেছে, প্রত্যাদেশের, অনুপ্রাণনার ।

        শুয়ে-থাকা ফালগুনীকে দেখে সুফি সন্তদের কথা মনে এলো । আরবরা ‘হুজুন’ বা ‘হুজ্ন’ বলে একটা শব্দ প্রয়োগ করে, নিজের ভেতরে নিজে প্রবেশ করে যাওয়া ব্যাখ্যা করার জন্য । ইরানের দার্শনিক-ডাক্তার বলেছিলেন ‘হুজ্ন’ হল এমনই এক স্হিতি যখন প্রেমিকার নাম শুনলেই ব্যর্থ প্রেমিকের নাড়ি-স্পন্দন তীব্র হয়ে ওঠে । আমি ফালগুনীর প্রেমিকার নাম জানতুম, কিন্তু এই নিরীক্ষা করে দেখিনি কখনও, কেননা জানতুম না ঠিক কী ধরণের ইনট্রিগ ওকে ছেঁকে ধরেছিল যে এই ক্যাটাসট্রফিক পরিস্হিতিতে ফালগুনী পৌঁছেচে । রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠভূমি জানি, অথচ নিকটবন্ধুর ব্যাপারই জানা হয়ে উঠল না । দাঁতে ঈশ্বরকে প্রেমিক কল্পনা করে বলেছিলেন যে, একজন মানুষ যদি হৃদয় দিয়ে, মন দিয়ে, আত্মা দিয়ে ঈশ্বরে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পিত না হয়, তা হলে সেই লোকটি এমনই এক গোপনতায় আক্রান্ত হয় যা সে কাউকে বলতে পারে না, সে একাই ওই ভার বইতে বাধ্য হয়  ।

       জার্মান লেখক জিন পল ‘ওয়েলৎশমের্তস’ অভিধাটি কবি-লেখকদের এই বিশ্ববীক্ষার প্রেক্ষিতে তৈরি করেছিলেন : “বাস্তব জগতটি মনের জগতকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না” । পাশ্চাত্য সাহিত্যে এই আত্মস্হিতি নিয়ে যাঁরা কাজ করে গেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য হলেন চার্লস অগাস্টিন, সাঁৎ ব্যভ, শাতুব্রিয়ঁ, আলফ্রেদ দি ভিনি, আলেকজান্ডার পুশকিন, মিখাইল লেরমেনতোভ, ন্যাথানিয়েল হথর্ন, হার্মান হেস, হাইনরিখ হাইনে প্রমুখ ।

        বাংলা সাহিত্যে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ( ১৮৩৮ - ১৯০৩ ) এই ভাবনার ওপর ভিত্তি করে ‘চিন্তা-তরঙ্গিনী’ নামে একটি কাব্য লিখেছিলেন ; বাহুল্য বলা যে তখনকার সমালোচকরা ‘চিন্তা-তরঙ্গিণী’ কাব্যের আধুনিকতাকে উপলব্ধি করতে পারেননি । অক্ষয়চন্দ্র সরকার লিখেছিলেন, ‘হেমবাবু কালস্রোতের যেভাগে প্রথম দেখা দেন, সেই ভাগ অতি বিষম ; কালস্রোত তখন কেবলই ভাঙ্গিতে ছিল ; ভাঙ্গিব বলিয়াই ভাঙ্গিতে ছিল, গড়িব বলিয়া ভাঙ্গিতেছিল । হেমবাবুর জন্মসময়ে কোনও কিছু ভাঙ্গিতে পারিলেই কৃতবিদ্য আপনাকে গৌরবান্বিত মনে করিতেন । সমাজ ভাঙ্গিতে হইবে, ধর্ম ভাঙ্গিতে হইবে । এমনকী, অনাচারে অত্যাচারে স্বাস্হ্য ভঙ্গ করিয়া, অকালে কালগ্রাসে ডুবিতে থাকাও যেন সেই সময়ে গৌরবের বিষয় বলিয়া ধারণা হইত । আর এখন হেমবাবুর মৃত্যু সময়ে বোধ হয়, যেন সিকস্তির পর একটু পয়স্তি হইতেছে।’ 

      পড়ে মনে হবে অক্ষয়চন্দ্র সরকার যেন ফালগুনী রায়ের সমালোচকদের নকল করছেন ।

      আত্মস্হিতির এই অবস্হাটি বৌদ্ধধর্মে বহুকাল আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছিল, যখন বুদ্ধ ‘দুঃখসত্য’-এর কথা বলেছিলেন, যে-সত্যটি  চারটি সত্যের অন্যতম । বৌদ্ধধর্মে অবস্হাটি আশাবাদ বা নিরাশাবাদের নয়, তা বাস্তববাদের ।



        তুমি স্বর্গে চলে গেছো ফালগুনী, ১৯৮১ সালের মে মাসে, সাড়ে তিন দশক আগে । 

        তোমাকে বলেছিলুম গোলঘরের ভেতরে গিয়ে তোমার কবিতাপাঠ শুনব, তোমার কন্ঠস্বর একুশবার প্রতিধ্বনিত হবে, তা আর শোনা হল না, যেদিন আমরা গোলঘরে গিয়েছিলুম সেদিন বন্ধ ছিল, তাই একশো চুয়াল্লিশটা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে তোমার কবিতা শুনেছিলুম, সম্পূর্ণ নয়, অর্ধেক, কেননা তুমি কাশতে আরম্ভ করেছিলে, আমরা সঙ্গে করে জল বা পিপারমেন্ট লজেন্স নিয়ে যাইনি । 

       তোমাকে বলেছিলুম চাইবাসায় রোরো নদী আর লুপুংগুটু ঝর্ণা দেখাতে, শালপাতায় হাড়িয়া আর মাটির ভাঁড়ে মহুয়া খাওয়াতে নিয়ে যাব ; তা আর হতে পারেনি ।

      এই বাংলা আর দুই বাংলার বহু সংকলন প্রকাশিত হয়েছে । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, পবিত্র মুখোপাধভায়, শান্তনু দাশ যেমন তোমাকে বাদ দিয়েছেন, তেমনই মণীন্দ্র গুপ্ত । অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত আর দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় তোমাকে বাদ দিয়েছেন ‘আধুনিক কবিতার ইতিহাস’ আর ‘ষাটের দশকের কবিতা’ সন্দর্ভে । প্রদ্যোত সেনগুপ্ত তাঁর ‘অন্য দিগন্ত : ষাটের কবিতা’ রচনাটিতে । আশিস সান্যাল তাঁর ‘ষাটের কবিতা’ গ্রন্হে । আরও বহু গ্রন্হে,  যার হদিশ রাখিনি আমি, কী-ই বা হবে বলো ।

      তোমার ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিসান’, বাসুদেব দাশগুপ্ত প্রথম প্রকাশ করার পর বারবার ছাপা হয়ে চলেছে । অলোক গোস্বামী, শুভঙ্কর দাশ, আলোক সরকার, মনফকিরা, সমীর রায়চৌধুরী পুনর্মুদ্রণ করেছেন, তোমার অপ্রকাশিত কবিতা যেগুলো সুবিমল বসাকের কাছে ছিল অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । 

     বইটি ছাপা হবার পরই ফুরিয়ে যাচ্ছে ।

     দুই বাংলায় তোমার পাঠকসংখ্যা অগুণিত ; তোমার সময়ে ইনটারনেট ছিল না । এখন ইনটারনেটে তোমার কবিতা খুঁজলেই পাওয়া যায়, সম্পূর্ণ বইটির কবিতা পাওয়া যায়, তোমার সম্পর্কে প্রবন্ধ-নিবন্ধ পাওয়া যায় ।

     তোমাকে আবার পাঠকদের সামনে আনছেন ‘চন্দ্রগহণ’ পত্রিকা । 

    জানি,  সুফিসন্তদের মতো তুমি আগ্রহহীন ।

      

     

      


    

    

    

      


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন