রবিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০২০

যুবতীদের লেখালিখি


তীব্র প্রতিবাদ


ভালো মেয়ে - খারাপ মেয়ে


দেশে-বিদেশে


শনিবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০২০

আমার মা অমিতা রায়চৌধুরী

আমার মা অমিতা রায়চৌধুরী
---------------------------------------------
মলয় রায়চৌধুরী
          আমার মায়ের জন্ম ১৯১৬ সালে,   পানিহাটিতে । মায়ের ডাক নাম ভুল্টি ।  মায়ের বাবা, কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, পানিহাটির  রামচাঁদ ঘাট রোডে ‘নিলামবাটী’ নামে এক একান্নবর্তি পরিবারের সদস্য ছিলেন ।  কিশোরীমোহন ছিলেন, কলকাতা ও সেকেন্দ্রাবাদে, ম্যালেরিয়া রোগের কারণ নির্ণয়কারী  ও ১৯০২ সালে সেকালে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ডাক্তার রোনাল্ড রস-এর সহকারী । তাঁর অবদানের জন্য ১৯০৩ সালে দিল্লি দরবারের সময়ে কিশোরীমোহনকে সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের স্বর্ণপদক দেয়া হয়েছিল । ২০১৩ সালে প্রকাশিত তাঁদের ‘দি ফ্লাইং পাবলিক হেল্হ টুল : জেনেটিকালি মডিফায়েড মসকিটোজ অ্যান্ড ম্যালেরিয়া কন্ট্রোল’ ( সায়েন্স অ্যাজ কালচার, ল্যাংকাস্টার, ইউ কে ) গবেষণাপত্রে উলি বিজেল এবং ক্রিস্টোফ বোয়েট অধ্যাপকদ্বয় জানিয়েছেন যে উপনিবেশের নেটিভ হবার কারণে কিশোরীমোহনের নাম রোনাল্ড রসের সঙ্গে সুপারিশ করা হয়নি ।    সমাজ সেবার কাজে স্ত্রীর গয়না এবং পৈতৃক সম্পত্তি বেচে, আর সঞ্চয়ের পুঁজি খরচ করে তিনি দেউলিয়া হয়ে যান, আর মায়ের বিয়ের কয়েক বছর পরই মারা যান ।
          দেউলিয়া অথচ খ্যাতিপ্রাপ্ত  অমন একটি বাংলা-ইংরেজি পড়া আধুনিক পরিবার থেকে মা আমাদের সংস্কৃত-ফারসি পড়া গঙ্গার অপর পাড়ের উত্তরপাড়া নিবাসী পরিবারে এসেছিলেন । উত্তরপাড়ার জমিদারবাড়ি তখন খণ্ডহরে রূপান্তরিত হওয়া আরম্ভ হয়েছে ।  আমার ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ ছিলেন কিশোরীমোহনের বন্ধু । ম্যালেরিয়া রোগ সম্পর্কে প্রচারের জন্য পেইন্টার-ফোটোগ্রাফার ঠাকুর্দা কিশোরীমোহনকে ম্যাজিক লন্ঠনের জন্য স্লাইড তৈরি করে দিতেন । বিয়ের সময় মায়ের বয়স ছিল ১৪ বছর আর বাবার ১৮ বছর । বাবা, রঞ্জিত, জন্মেছিলেন লাহোরে ।  ভ্রাম্যমান ফোটোগ্রাফার ঠাকুর্দা বহুকাল আফগানিস্তানের কাবুল-কান্দাহার আর বর্তমান পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে ছিলেন । অর্থাৎ মা এসে পড়েছিলেন এমন একটি পরিবারে যার সদস্যদের সাংস্কৃতিক চরিত্রগঠন ভিন্নভাবে গড়ে উঠেছিল । 
          ছয় ভাই আর এক বোনের  সেজভাই ছিলেন আমার বাবা । বড়জেঠিমা নন্দরানি নয় বছর বয়সে বিয়ে হয়ে এসেছিলেন । মেজজেঠিমা এসেছিলেন তেরো বছর বয়সে । কাকিমারা এসেছিলেন তাঁদের বয়স যখন সতেরো ।  দাদু তাঁর ছেলে আর তাদের স্ত্রীদের নিয়ে বিভিন্ন রাজপরিবারের অতিথি হয়ে তার সদস্যদের ফোটো তুলে পেইনটিঙ তৈরি করে দিতেন । পাটনায় দ্বারভাঙ্গা মহারাজের পরিবারের সদস্যদের ছবি আঁকার সময়ে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান । দাদু মারা যাবার পর বড়জেঠা পাটনা মিউজিয়ামে চতুর্থ শ্রেনির কাজ পান ; কিন্তু ওইটুকু মাইনেতে এতজনের পরিবারের খরচ সামলানো কঠিন হয়ে গিয়েছিল । বছর দশেক পরে অবশ্য উনি পদোন্নতি পেয়ে কিপার অফ পেইন্টিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচাসর হন । ভাই আর তাদের পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে বাবা ফোটোগ্রাফির স্হায়ী দোকান খোলেন পাটনায় । এই সময় থেকে আমাদের পরিবারে মায়ের গুরুত্ব বেড়ে যায় ।  দারিদ্র্য সামলাতে না পেরে ঠাকুমা মায়ের হাতে সংসারের দায়িত্ব দিয়ে চলে যান উত্তরপাড়ার খণ্ডহরে একা থাকতে । ভূমিকম্পের পর ইমলিতলার অন্ত্যজ পাড়ায় বিহারি কাঠামোর একটি বাড়ি কিনে পুরো পরিবার সেখানে চলে আসেন । দলিত বিহারি এবং অতিদরিদ্র শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত ইমলিতলা পাড়ার মাগধি আর ভোজপুরি ইথসকে সহজেই মা আ্ত্তীকরণ করে নিতে পেরেছিলেন ।          
        সংসারের ক্ষমতা মায়ের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাবার পর মায়ের চরিত্রে লুকোনো কিশোরীমোহন বেরিয়ে আসে । প্রায়ই দেখতুম ইমলিতলার প্রতিবেশিরা  এসে মায়ের কাছে নিজেদের আর্থিক দৈন্য আর পারিবারিক দুর্দশার গল্প করছে, আর মা তাদের সাহায্য করছেন, পয়সাকড়ি দিয়ে তো বটেই, চাল-ডাল, পুরোনো বাসনপত্র আর ব্যবহৃত জামাকাপড়, পুরোনো হয়ে আসা জুতো ইত্যাদি দিয়ে দিয়ে । মায়ের বোনেদের বিয়ে আরও গরিব পরিবারে হয়েছিল বলে পুজোয় পাওয়া শাড়ি-চটি ইত্যাদি নিজে না পরে বোনেদের বা নিলামবাটীর দুস্হ জ্ঞাতিদের পাঠিয়ে দিতেন বা যখন নিজে যেতেন তখন নিয়ে যেতেন ।  যদিও মা পরিবারের ডি ফ্যাক্টো কর্ত্রী ছিলেন, কিন্তু ইমলিতলার বাড়িতে মা-বাবা-দাদা-আমি থাকতুম সবচেয়ে ছোটো ঘরটায় । লন্ঠনের আলোয় পড়াশোনা, রাস্তার কল থেকে জল ভরে আনা । দাদার এক ভায়রাভাই অত্যন্ত গরিব ছিলেন, চাকরি পাননি, তাঁদের পরিবারকেও মা নিয়মিত র‌্যাশান দিয়ে আসতেন, আমার মেয়ের ফ্রক আর জুতোও অনেক সময়ে লুকিয়ে দিয়ে এসেছেন যা আমরা এতোদিন পর জানতে পারছি সেই ভায়রাভাইয়ের মেয়ের কাছ থেকে ।        
          সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকার চারিত্রবৈশিষ্ট্যের দরুণ বড়জেঠা সংসারের সমস্ত ব্যাপারে মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করতেন । আমার মনে আছে, ১৯৫১ সালে যে বছর প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল, কোন দলকে ভোট দেয়া হবে তা নিয়ে আলোচনার শেষে মায়ের নির্ণয় সবাই মেনে নিয়ে ছিলেন, অর্থাৎ যার যে দলকে ইচ্ছে ভোট দেবে ।  কলকাতায় নাকতলায় থাকতে অবাক লাগত দেখে যে বাড়ির কর্তা যে দলের সমর্থক, পরিবারের সকলেই সেই দলকে ভোট দ্যায়, অথচ তারাই আবার ডাইন্যাস্টিক পলিটিক্সের তর্ক তোলে !
          স্কুলে ভর্তি হয়ে টের পাই যে মা শুদ্ধ হিন্দি জানেন না, ইমলিতলার ‘ছোটোলোকি’ বুলি দখল করে ফেলেছেন, আর তার বহু শব্দ যে শুদ্ধ হিন্দিতে অশোভন, এমনকি অশ্লীল, তা উনি অনেক পরে জানতে পারেন, যখন আমরা ইমলিতলা ছেড়ে দরিয়াপুরে সুন্নি মুসলমান পাড়ায় চলে যাই । পানিহাটিতে মেয়েদের স্কুল তখনও ছিল না বলে মা নিরক্ষর হয়েই এসেছিলেন ; নিজেকে শিক্ষিত করে তোলেন দাদা স্কুলে ভর্তি হবার পর । নভেল আর বাংলা সংবাদপত্র পড়া অভ্যাস করেন । একটা হিসাবের খাতা লেখা আরম্ভ করেন । 
          ইমলিতলার বাড়িতে হিন্দুত্ব সামলাবার কাজ ছিল পুজারী বাড়ি থেকে আসা বড়-জেঠিমার । সেকারণে মা এবং কাকিমারা প্রতিদিনের ধর্মাচরণ থেকে নিজেদের আর আমাদের মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন । জনৈক পাদরির আর্থিক সৌজন্যে প্রাইমারি স্তরে আমি ক্যাথলিক স্কুলে পড়েছিলুম ; মা ঘটিতে গরম জল ভরে আমার শার্ট-প্যান্ট আয়রন করে রাখতেন। আমার বাংলা বনেদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল বলে মায়ের নির্দেশে আমাকে ব্রাহ্ম স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করা হয়েছিল । 
          দরিয়াপুরের বাড়িতে আমি একা থাকতুম বলে, এবং এর-তার কাছে শুনে, আমার চরিত্রদূষণ আটকাতে বাবা আর মা প্রতি রাতে ইমলিতলার বাড়িতে খাওয়া দাওয়া সেরে, দরিয়াপুরে থাকা আরম্ভ করেন । দাদা ১৯৪৯ সালে কলকাতার সিটি কলেজে পড়তে চলে গিয়েছিলেন, দরিয়াপুরের বাড়িতে দাদা ফেরেন চাকরির শেষ বছরে, তখন আমি মা-বাবাকে নিয়ে লখনউ চলে গেছি  । ইমলিতলার বাড়ি থেকে মা প্রতিদিন রাতে টিফিন ক্যরিয়ারে করে আমার আর বাবার খাবার নিয়ে দরিয়াপুরে আসতেন, প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে।  
          দরিয়াপুরে পাকাপাকি চলে আসার পরও ইমলিতলার সদস্যদের দায়িত্ব মা ছাড়েননি ; সপ্তাহে এক দিন গিয়ে টাকাকড়ি আর চাল-ডাল-আনাজের ব্যাপারটা সামাল দিয়ে আসতেন । গোলা রোডের এক বানিয়ার দোকানে তালিকা দিলে সে যাবতীয় জিনিস ইমলিতলা আর দরিয়াপুরে পাঠিয়ে দিত । পুজোর সময়ে পোশাকের ভেদাভেদ মেটাতে সবায়ের জন্য ছিল একই কাপড়ের শার্ট আর ফ্রক, এমনকি জেঠা-কাকারাও সেই কাপড়ের শার্ট পরতেন ।
          স্কুলের পর্ব শেষ করে যেটুকু সময় ছিল আর ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়ে আমি আমার বন্ধু তরুণ শুরের মামার ট্রাকে করে নানা জায়গায় চলে যেতুম, বাড়িতে বলে যেতুম না, বললে বাবা-মা যেতে দেবেন না অনুমান করে । বলা যায় বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতুম । ফিরে আসার পর মা কিছুই বলতেন না । পরে আমার মেয়েকে উনি বলেছিলেন যে ওনাদের না জানিয়ে আমি বাড়ি থেকে পালাতুম ।
          দাদা চাকরি পাবার পর দাদার চাকুরিস্হলে গিয়ে মা মাঝেমধ্যে সপ্তাহখানেকের ছুটি কাটিয়ে আসতেন । দরিয়াপুরের বাড়িতে কাজের মাসি রান্না করে দিত । নিম্নবর্ণের হাতে রাঁধা ভাত বাবা খেতেন না বলে ভাতটা আমিই বসিয়ে দিতুম । রান্নায় মাকে সাহায্য করতে হতো বলে ডাল-তরকারিও রাঁধতে শিখে গিয়েছিলুম ।  এখনও মাঝে-মাঝে স্ত্রীকে রান্নাঘরের কাজে সাহায্য করি । মা বলতেন, ডাল আমি ভালো রাঁধতে পারি ।
          হাংরি আন্দোলনের সময়ে দাদার আর আমার বন্ধুরা কোর্টে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে গেছেন শুনে মা, যিনি ছিলেন অত্যন্ত চাপা প্রকৃতির, নিজের ক্রোধ সামলাতে পারেননি । আমি তাদের চিঠি ইত্যাদি ছিঁড়ে ফেলছি দেখে বলেছিলেন, ‘সব নিয়ে গিয়ে গুয়ের ডাবায় ফ্যাল ; সব কটাই আহাম্মক, অকৃতজ্ঞ ।’  আমার আর দাদার লেখালিখি সম্পর্কে উনিই ছিলেন প্রধান উৎসাহদাত্রী । ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ নামে যে কবিতাটা নিয়ে মকদ্দমা হয়েছিল সেটা মা-বাবা-ঠাকুমা সকলেই পড়েছিলেন ।                
          নাগপুরে অফিসের কাজে গিয়ে রাজ্যস্তরের হকি প্লেয়ার ও সহকর্মী সলিলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই বিয়ে করতে চাই জানিয়ে পাটনায় খবর পাঠালে মা চিঠি লিখে পাঠান যে ‘সিঁদুর পরিয়ে নিয়ে আসলেই হবে ।’ তার কারণ আমার বন্ধুনিদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বেশ চিন্তিত থাকতেন উনি । আমার সম্পর্কে নানা গালগল্প শুনে বেশ উদ্বেগে থাকতেন । এমনকি আমার পেছনে কয়েকজন ঘটককে লাগিয়ে দিয়েছিলেন যারা প্রায়ই আমার অফিসে একজন তরুণীকে নিয়ে হাজির হতো । বাড়িতে এসে মায়ের কাছে এই বিষয়ে অভিযোগ করলে উনি বলতেন, এছাড়া আমার অন্য উপায় নেই, কোনো একজনকে তো পছন্দ কর । 
         লখনউ বদলি হয়ে আমরা চলে গেলে মা একা হয়ে গিয়েছিলেন, রান্নার মাসি রাখা হয়েছিল ওনার দায়িত্ব কমাবার জন্য । আসলে উনি আমার মেয়ে আর ছেলের সঙ্গে সময় কাটানোয় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন, তাদের অভাব বোধ করতেন । একাকীত্ব কাটাবার জন্য পাটনার বিভিন্ন বাঙালি পরিবারের মহিলাদের সঙ্গে গল্প করতে চলে যেতেন প্রতি সন্ধ্যায় । দাদা পাটনায় চলে আসার পর মা আর বাবাকে আমি লখনউ নিয়ে চলে আসি । লখনউতে মায়ের হৃদরোগ আর আরথ্রাইটিস ধরা পড়ে ।          
         হৃদরোগের লক্ষণগুলোর সঙ্গে তখন আমরা ততটা পরিচিত ছিলুম না, মাও তাঁর কষ্টের কথা বলতেন না। লখনউতে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৮ই নভেম্বর ১৯৮২  মারা যান । মা মারা যেতে আমি লখনউয়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেঁদেছিলুম । 
    
         

আমার বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী

আমার বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী
--------------------------------------------
মলয় রায়চৌধুরী
       মহারাজা রঞ্জিত সিংহের গালগল্পে প্রভাবিত হয়ে ঠাকুমা, যাঁর নাম ছিল অপূর্বময়ী, বাবার অমন নাম রেখেছিলেন । আমার বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী জন্মেছিলেন বর্তমান পাকিস্তানের লাহোর শহরে, ১৯১২ সালে । পাঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিংহ জন্মেছিলেন ১৩ই নভেম্বর ১৭৮০ । বাবাও জন্মেছিলেন ১৩ই নভেম্বর । ছয় ভাই আর এক বোনের মধ্যে বাবা ছিলেন তৃতীয় বা সেজ ভাই । অন্যান্য ভাইদের পোশাকি আর ডাক নাম দুটিই থাকলেও, বাবার ওই একটি নামই ছিল, রঞ্জিত । ঠাকুর্দার আদি নিবাস ছিল হুগলি জেলার উত্তরপাড়ায় । ১৭০৯ সালে উত্তরপাড়া শহরটির পত্তন করেছিলেন দাদুর পূর্বপুরুষ রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী ।
         ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী, পোরট্রেট আঁকতে পারতেন, এবং সেই সূত্রে তিনি বিভিন্ন রাজপরিবারের ডাকে সপরিবারে ভারতের এক রাজ দরবার থেকে আরেক রাজ দরবারে চলে যেতেন । লাহোরে গিয়ে তিনি ড্যাগেরোটাইপ ক্যামেরায় ফোটো তুলতে শেখেন, যাতে ফোটো তুলে তা থেকে ছবি আঁকতে সুবিধা হয় এবং রাজ পরিবারের মহিলাদের এক নাগাড়ে বসে থাকতে না হয় । সেসময়ে মেয়ো স্কুল অফ আর্টসের অধ্যক্ষ এবং লাহোর মিউজিয়ামের কিউরেটার ছিলেন রাডিয়ার্ড কিপলিঙের বাবা জন লকউড কিপলিঙ, যাঁর সঙ্গে পরিচয়ের ও তাঁর অধীনে কাজ করার সূত্রে তাঁর কাছ থেকেই তিনি ফোটো তোলা শেখেন । ফোটো তোলা হতো সরাসরি ব্রোমাইড পেপারে । পরে, কাচের প্লেটে নেগেটিভ ফিল্ম তোলা হতো, সেই নেগেটিভকে রসায়নে চুবিয়ে রেখে ফোটো গড়ে উঠত; তারপর সেই প্লেটের ওপর ফোটোর কাগজ রেখে, প্রয়োজনীয় আলো দেখিয়ে ফোটো প্রিন্ট করা হতো, আর সেই প্রিন্টকে রসায়নে চুবিয়ে, শুকিয়ে, স্হায়ীত্ব দেয়া হতো ।  
          ড্যাগেরোটাইপ ক্যামেরা ছিল বেশ ভারি ; বাইরে গিয়ে ফোটো তুলতে হলে তাকে বয়ে নিয়ে যাবার লোক দরকার হতো । বাইরে তোলা হচ্ছে বলে একসঙ্গে অনেকগুলো তুলে যেটা ভালো হল সেটা থেকে ফোটো তৈরি করা হতো । ফোটো তোলা হতো ক্যামেরা স্ট্যাণ্ডের ওপরে ক্যামেরা রেখে । ফোটো তোলার সময়ে হাত দিয়ে লেন্সের ঢাকনা খুলে, ‘স্মাইল প্লিজ’ বলে দু’এক সেকেণ্ডে আবার লেন্স পরিয়ে দেয়া হতো । স্টুডিওতে ফোটো তুলতে হলে প্রথম দিকে কুঁজোর মাপের হাজার-দুহাজার ওয়াটের বাল্বের আলোয় ফোটো তুলতে হতো, পরে অবশ্য বাল্বের মাপ ছোটো হয় । এখন প্রযুক্তির এত উন্নতি হয়েছে যে ড্যাগেরোটাইপের ঝঞ্ঝাটকে মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক । বাবা এই প্রযুক্তি দেখে যেতে পারলেন না । শৈশবে তাঁকে দেখতুম শহরের বাইরে ফোটো তুলতে যাচ্ছেন কাজের লোক রামখেলাওন সিংহের কাঁধে ক্যামেরার বাক্স চাপিয়ে, নিজে ক্যামেরা তিন-ঠেঙে স্ট্যান্ড আর মাথায় চাপা দেবার কালো মোটা কাপড় । বাবা মারা যাবার পর যখন পাটনার বাড়ি ছেড়ে চলে আসলুম, দেখেছিলুম তিনতলার একটা ঘরে থাক-থাক কাচের প্লেট, কড়িকাঠ থেকে র‌্যাকে সাজানো । ইতিহাসবোধ না থাকলে যা হয়, আমি বা দাদা আমরা কেউই সেগুলো সংরক্ষণের প্রয়াস করিনি ।
          দাদুর ছেলেরাও ফোটো তোলা আর ছবি আঁকায় সড়গড় হলে দাদু ১৮৮৬ সালে ফোটোগ্রাফির ভ্রাম্যমান ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন, এবং সংস্হাটির তিনি নাম দেন ‘রায়চৌধুরী অ্যাণ্ড কোং’ । হুগলি জেলায় গঙ্গা নদীর ধারে উত্তরপাড়ার পাশে এখন যেখানে বালি ব্রিজের সংলগ্ন ফ্লাইওভার, তখন একটা রাস্তা ছিল, সেখানে একটা দপতর খুলে নকাকাকে চালাতে বলেছিলেন । কিন্তু নকাকা তা সামলাতে পারেননি, হঠাৎ বৈরাগ্যে আক্রান্ত হবার কারণে । 
          দাদুর অমন ঘোরাঘুরির কারণে বড়জেঠা, মেজজেঠা, বাবা, পিসিমা আর নকাকার স্কুলে পড়া হয়ে ওঠেনি । দাদু হঠাৎ মারা যাবার পর তাঁর ছেলেরা পাটনায় থিতু হতে বাধ্য হন এবং তখন নতুনকাকা আর ছোটোকাকাকে স্কুলে ভর্তি করা হয় । নতুনকাকা নিয়মিত স্কুল করলেও ছোটোকাকার আগ্রহ না থাকায় তিনি পড়াশোনা ত্যাগ করেন । জেঠাকাকাদের যেটুকু পড়াশোনা হয়েছিল তা রাজদরবারগুলোর শিক্ষকদের অবদান । দাদু সংস্কৃত আর ফারসি লিখতে-পড়তে পারতেন । বাবা ইংরেজি ভাষা আয়ত্ব করে ফেলেছিলেন ।
          দাদু বিভিন্ন সময়ে আফগানিস্তানের কাবুল-কান্দাহার এবং পাকিস্তানের বাহাওলপুর, চিত্রাল, হুনজা, ফুলরা, মাকরান ও লাহোরে  ছিলেন। আফগানিস্তানে ব্রিটিশদের যুদ্ধ আরম্ভ হবার পর লাহোরে চলে যান । বড়জেঠার মুখে শুনেছি যে বাহাওলপুরের সেই সময়ের ডাকটিকিটে আমিরের পোরট্রেট ছিল দাদুর আঁকা । ওই অঞ্চলের ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদির মাংস আর শুঁটকিমাংস খাওয়ার সঙ্গে বাবার ভাইরা নিজেদের মানিয়ে নিলেও বাবা পারেননি, এবং তিনি সারা জীবন শাকাহারী হয়ে যান । বাবার মুখে শুনেছি যে বাজারে ঝোলানো গোরু, মোষ, ইয়াক আর কাটা উটের মাংস দেখার পর উনি আর মাংস খেতে পারতেন না, তাই নিরামিশাষী হয়ে যান । দুম্বা  একরকমের ভেড়া যার ল্যজের জায়গায় বাড়তি মাংস গজায়, আর বাড়তি লেজের মাংস, বড়জেঠার বক্তব্য অনুযায়ী, ছিল খুবই সুস্বাদু । 
          ফোটোগ্রাফির সূত্রেই দাদুর সঙ্গে উত্তর চব্বিশ পরগণার পাণিহাটি-নিবাসী আমার দাদামশায় কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচয় হয়েছিল । কিশোরীমোহন ছিলেন ম্যালেরিয়া রোগের উৎস আবিষ্কারক রোনাল্ড রসের সহগবেষক । রোনাল্ড রস স্বদেশে ফিরে যাবার পর কিশোরীমোহন ম্যালেরিয়া রোগের কারন ও তা প্রতিরোধ করার জন্য গ্রামে-গঞ্জে ম্যাজিক লন্ঠনে স্লাইড দেখিয়ে প্রচার করতেন । এই স্লাইডগুলো তৈরি করে দিয়েছিলেন দাদু । কিশোরীমোহন তাঁর বড় মেয়ে অমিতার সঙ্গে বাবার বিয়ে দেন । বিয়ের সময়ে মায়ের বয়স ছিল ১৪ বছর আর বাবার ১৮ বছর । কিশোরীমোহন সম্পর্কে উইকিপেডিয়া আর নেটে অন্যত্র তথ্য আছে । বাবা নিজে শাকাহারী হলেও মাকে বাধ্য করেননি তাঁর আহারের রুচি অনুসরণ করতে ; আমি আর দাদা দুজনেই আমিষাশী । দাদু প্রতি বছর দুর্গা পুজোর সময়ে উত্তরপাড়া ফিরে যেতেন ; ছেলেদের বিয়ে দেয়ার কাজটাও সেরে নিতেন সেই সময়টুকুর মধ্যে । 
          দ্বারভাঙ্গা মহারাজের পরিবারের সদস্যদের ছবি আঁকার জন্য ডাক পড়লে দাদু সপরিবারে পাটনায় যান, আর সেখানেই হৃদরোগে মারা যান । পুরো পরিবার নির্ভরশীল ছিল দাদুর ওপর ; তিনি মারা যেতে ঠাকুমা বিপদে পড়েন । তাঁরা একটি মাটির দেয়ালের ওপর টালির চালার বাসা ভাড়া করে বিভিন্ন উপায়ে টাকা রোজগারের চেষ্টা করেন, কিন্তু কিছুতেই সফল না হতে পারায় বাবা দাদুর প্রতিষ্ঠিত সংস্হা ‘রায়চৌধুরী অ্যাণ্ড কোং’ এর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ছবি আঁকা আর ফোটো তোলার একটি স্হায়ী দোকান চালাবাড়ির কাছেই, বিহার ন্যাশানাল কলেজের সামনে, খোলেন । ঠাকুমার জাঠতুতো ভাই কলকাতা মিউজিয়ামের সহকিউরেটার লেখক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুপারিশে বড়জেঠা  পাটনা মিউজিয়ামে চতুর্থ বর্গের একটি চাকরি পান । পরে অবশ্য তিনি নিজের যোগ্যতার দরুন পদোন্নতি পেয়ে পাটনা মিউজিয়ামের ‘কিপার অব পেইনটিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচার’ হয়েছিলেন। বড়জেঠা মাটির মূর্তি তৈরি করায় আর অয়েল-পেইন্টিং আঁকায় দক্ষ ছিলেন । ছোটোবেলায় ছুটির দিনে আমি মিউজিয়ামের এক থেকে আরেক প্রান্ত ঘুরে বেড়াতুম, চৌকাঠ ডিঙোতেই প্রাগৈতিহাসিক থেকে মহেঞ্জোদরোয়, সেখান থেকে অশোকের রাজত্বে !
          দাদু মারা যেতে, ঠাকুমা উত্তরপাড়ার বসতবাড়িতে, যা অবহেলায় খণ্ডহরের চেহারা নিয়ে ফেলেছিল,  থাকতে চলে গেলে, পরিবারের আর্থিক ভার পুরোপুরি এসে পড়েছিল বাবার কাঁধে । ঠাকুমা ছেলেদের আর তাদের বোউদের বলে দিয়ে যান যে আমার মা সংসারটাকে সামলাবেন । যেকোনো কারণেই হোক মেজজেঠা, নকাকা আর কাকাবাবুর স্বভাব আর আচরণ এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে আমরা শৈশবে শুনতুম যে এঁরা কিছুটা অপ্রকৃতিস্হ । দোকানের কাজে তাঁদের তেমন আগ্রহ ছিল না ; তাঁরা প্রকৃতই শিল্পীচরিত্রের বিপন্ন বিস্ময়ে আক্রান্ত অস্বাভাবিকতা পেয়েছিলেন । মেজজেঠা ঘুম থেকে উঠতেন দুপুরবেলা, তারপর জলখাবার খেতেন কোনো দোকান থেকে লুচি আলুর তরকারি কিনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কখনও চুল আঁচড়াতেন না, বাড়ি ফিরে দাঁত মেজে স্নান করে বিকেলের দিকে দোকানে পৌঁছোতেন, এবং একটি ফোটোর সামনে বসে তাকে মাসখানেকে আঁকা অপূর্ব  ছবিতে দাঁড় করাতেন । নকাকা অনেক ভোরে উঠতেন, সবাইকে, শিশুদেরও ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন, স্ত্রীর সঙ্গে বিশেষ কথা বলতেন না, জুতো পরার অভ্যাস ছিল না, কোরা ধুতি পরতেন, নিজের ধুতি-শার্ট নিজেই কাচতেন, কোনো এক ফাঁকে দোকানে গিয়ে বাড়িতে করার জন্য বাবার কাছ থেকে ‘কাজ’ চেয়ে আনতেন । ছোটোকাকা মাঝরাতে নিজের ঘরে ছোটোকাকিমার নানা আঙ্গিকের পোশাকহীন ফোটো তুলতেন আর দোকানে গিয়ে বাবাকে সাহায্য করার নাম করে ডার্করুমে ঢুকে সেই ‘অপ্সরা’ ফোটোগুলো প্রিন্ট করে নিতেন । উনি যখন উত্তরপাড়ায় পাকাপাকি চলে গেলেন তখন তাড়াহুড়োয় অ্যালবামগুলো নিয়ে যেতে ভুলে যান । ছোটোকাকা ৯০ বছর বয়সে মারা যান, নিঃসন্তান ; উত্তরপাড়ার বাড়ির অংশ ছোটো শালার প্রথম পক্ষের মেয়েকে দিয়ে গেছেন । 
          বিহারের ভূমিকম্পে চালাবাড়ি ধ্বসে পড়ার পর বড়জেঠা ঠাকুমার আর বড়জেঠিমার গয়নাগাটি বেচে ইমলিতলা নামে একটি নিম্নবর্গ ও গরিব শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত পাড়ায় বাড়ি কেনেন । তখন নিম্নবর্গের লোকেদের বলা হতো অস্পৃশ্য, আর সেকারণেই দুসাধ-মুসহর-কাহার-ডোম-চামার পরিবার অধ্যুষিত ঘিঞ্জি নিচুচালা-বস্তির সস্তা এলাকায় বাড়ি কেনা সহজ হয়। তেঁতুলগাছটা দাদার জন্মের সময়ে ছিল, আমি দেখিনি, কেননা তেঁতুলগাছটা কেটে সেই জায়গায় জলের কল আর গ্যাসবাতির থাম বসিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার । পাটনার অন্যান্য বাঙালিরা ইমলিতলাকে বলতেন ছোটোলোকদের পাড়া । সেকারণে আমাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর ওই ছোটোলোক ছাপ্পা পড়ে গিয়েছিল । পাটনার শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান বাঙালিরা ওই সরু গলির ভেতরে ঢুকে দিনের বেলাতেও আমাদের বাড়ি আসতেন না । বড়জেঠা যেতেন তাদের বাড়ি, সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য । আমি যখন স্কুলে ঢুকলুম তখন স্কুলের বন্ধুরাও ইমলিতলা শুনে আমাদের বাড়ি আসতে চাইত না ; অনেকে নাম শুনেই ভয় পেত, অঞ্চলের কুখ্যাত নিবাসীদের কাজকর্মের দরুন । মেজদা, যাকে শিশু অবস্হায় এক বেশ্যার কাছ থেকে বড়জেঠা কিনেছিলেন, পাড়ার চাপ এড়াতে না পেরে পুলিশের নথিতে গুণ্ডা হয়ে গিয়েছিল, মাদকের দরুন কম বয়সে মারা গিয়েছিল ।
          বাবা ভোরবেলা বেরিয়ে যেতেন আর ফিরতেন বেশ রাত করে । ফোটো তোলা, জিনিসপত্র বিক্রি আর ডার্করুমের কাজ তাঁকে একা করতে হত বলে ভোরবেলা জলখাবার খেয়ে সোজা গিয়ে ডার্করুমে ঢুকতেন, তারপর রাতে দোকান বন্ধ করার পর আবার ঢুকতেন ডার্করুমে । বিহারে সেসময় তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না, তাই কাজ পেতে অসুবিধা হতো না । মা আর বাবা দুজনের চরিত্রেই যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তা হল সবায়ের সঙ্গে মানিয়ে চলা । বাবা বাড়ির প্রধান রোজগেরে হলেও নিজের ভাইদের আর তাদের ছেলে-মেয়েদের, মানে আমাদের জাঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোনদের, সমান চোখে দেখতেন। বড়জেঠা ইমলিতলা বাড়ির ট্যাক্স আর সবজি কিনতেন, বাবা বাদবাকি সমস্ত খরচ করতেন, ঠাকুমাকে টাকা পাঠাতেন, উত্তরপাড়ার বাড়ির ট্যাক্স দিতেন । চালগমের দোকানদারকে মাসে একবার, মায়ের তৈরি ফিরিস্তির কাগজ, দোকানে যাবার পথে বাবা দিয়ে যেতেন আর সে ইমলিতলার বাড়িতে পাঠিয়ে দিত । পরিবারের সদস্যদের পোশাকের জন্য বাবা দর্জিকে বলে রেখেছিলেন, তার দোকানে গিয়ে মাপ দিয়ে দিতে হতো, সে তৈরি করে বাড়ি পাঠিয়ে দিত । একইভাবে ছিল জুতোর দোকানের সঙ্গে বন্দোবস্ত । চুল কাটার জন্য মাসে একবার নাপিত আসত, পরে বাবার কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে নিত । 
          ইমলিতলার বাড়িতে বাবা-মা-দাদা-আমি যে ঘরটায় থাকতুম সেটাই ছিল বাড়ির সবচেয়ে ছোটো ঘর । লন্ঠনের আলোয় পড়াশুনা করতে হতো । চেয়ার-টেবিল ছিল না, দোকানের মালপত্র যে প্যাকিংবাক্সতে আসত তার ওপর চাদর পেতে বই রাখার ব্যবস্হা ছিল । পাড়ার কুসঙ্গ-কুখ্যাতির প্রভাব দাদার ওপর পড়তে পারে অনুমান করে ম্যাট্রিক পাশের পর ১৯৪৯ সালে দাদাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল পাণিহাটিতে থেকে কলকাতায় পড়াশোনা করার জন্য । কলকাতায় দাদা সিটি কলেজে ভর্তি হন । কলেজে বন্ধু হিসেবে পান সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার, আনন্দ বাগচী প্রমুখ তরুণ কবিদের । দাদা বিহার সরকারের মৎস্য বিভাগে চাকরি পেলে তাঁর পোস্টিঙের জায়গায় বন্ধুরা একা বা দলবল নিয়ে পৌঁছোতেন । ছোটোবেলায় আমি একবার তাড়ি খেয়েছিলুম, মানে পাড়ার এক সর্বজনীন দাদু খাইয়ে দিয়েছিল । মুখে তাড়ির গন্ধ পেয়ে মা আমায় আমাদের ঘরে শেকল তুলে বন্ধ করে দিয়েছিলেন ; বাবা রাতে বাড়ি ফিরলে শেকল খোলা হয় । মায়ের সব সময় আশঙ্কা ছিল যে আমরা দুই ভাইও মেজদার মতন অসামাজিক চরিত্রের মানুষ হয়ে যেতে পারি । পাড়ায় মেলামেশায় কোনো নিষেধাজ্ঞা কিন্তু ছিল না । ছোটোবেলায় চোর-পুলিশ খেলতে গিয়ে অনেকের শোবার ঘরে ঢুকে খাটের তলায় লুকোবার স্মৃতি আছে ।
          ইমলিতলার বাড়িতে জলের কল ছিল না ; বড়জেঠা তো অফিস চলে যেতেন, জল ভরে এনে দেবার লোক না এলে দুপুরে বাবা যখন দোকান থেকে আসতেন, অনেক সময়ে নিজের স্নান করার জল নিজেই কল থেকে ভরে আনতেন। শীতকালেও ঠাণ্ডা জলে স্নান করতেন । দাদা আর আমি ইমলিতলায় রাস্তার কল থেকে জল ভরে এনেছি, রাস্তার কলে স্নান করেছি । বাবার নির্দেশ ছিল যে বাড়ির সব কাজ আমাদেরও করতে হবে, প্রয়োজনে কয়লা ভাঙা আর উনোন পরিষ্কার, জঞ্জাল ফেলে আসাও । বাবা রাস্তার কলে স্নান করতে লজ্জা পেতেন । ২০০৫ - ২০০৮ নাগাদ আমি কলকাতার রাস্তা থেকেও খাবার জল ভরে আনতুম পেপসির বোতলে করে, কেননা তিন তলায় কোনো ভারি জলের টিন নিয়ে বা মিনারাল ওয়াটারের বড়ো বোতল নিয়ে রিকশাঅলা উঠতে চাইত না । মাঝে-মাঝে দাদার বাড়ি গিয়ে দুটো থলেতে পেপসির বোতলে জল ভরে আমি আর আমার স্ত্রী সলিলা রিকশা করে নিয়ে আসতুম নাকতলার বাড়িতে। এই সমস্ত অসুবিধার জন্যেই নাকতলার ফ্ল্যাটটা বেচে মুম্বাইতে একরুমের ফ্ল্যাটে চলে আসতে হয়েছে ।
          বাবা চিরকাল শাদা পাঞ্জাবি, ধুতি আর পায়ে পামশু পরতেন । তাঁর ভাইয়েরা শাদা ছাড়া অন্যান্য রঙের শার্ট বা পাঞ্জাবি পরলেও বাবার পোশাকের অন্যথা হতো না, শীতকাল ছাড়া, যখন উনি নস্যি রঙের শাল গায়ে দিতেন, বা ওই রঙের উলের পাঞ্জাবি পরতেন । দোকানে যাবার তাড়ায় বাবার দ্রুত হাঁটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল । ইমলিতলায় থাকতে দুবার ওনার পা দোকানে যাবার পথে  ভেঙে গিয়েছিল ; বাবার পা ভাঙা মানে আর্থিক দিক থেকে বেশ বিপজ্জনক অবস্হা ; দাদাকে গিয়ে দোকানে বসতে হত । উত্তরপাড়া থেকে চাকুরিহীন কোনো জ্ঞাতির ছেলেকে নিয়ে এলেও তাদের অবাঙালি পরিবেশে মানিয়ে নিতে এতই অসুবিধা হত যে কয়েক দিনেই তারা ফেরত চলে যেত । পরে দরিয়াপুরে গিয়ে বাবার যখন আরেকবার পা ভেঙেছিল তখন আমি দোকানদারি করেছি । গরিব হলে যা হয়, গতি কেবল সরকারি হাসপাতাল, সেখানে কিউ, কেননা প্রায়ভেটে কোনো নার্সিং হোম ছিল না সেসময়ে ; এখন তো প্রতিটি রাস্তায় একজন করে হাড়ের ডাক্তার । বড়জেঠির এক বান্ধবীর স্বামী ছিল ছুতোর ; ওনার পা ভেঙে যেতে, জেঠিমার বান্ধবীর  কথামতো বাবার পায়ে বসাবার জন্য ছুতোরকে দিয়ে কাঠের খাপ তৈরি করিয়ে পায়ে বেঁধে রাখার ব্যবস্হা হয়েছিল । প্রথমবার বানিয়ে দেয়া খাপটা দ্বিতীয়বার কাজে লেগে গিয়েছিল । 
          বিহার ন্যাশানাল কলেজের সামনে যে দোকান ছিল সেই বাড়ির মালিক উঠে যাবার নোটিস দিলে বাবা পড়েন মহাবিপদে । বিকল্পের সন্ধানে বেরিয়ে তিনি তখনকার বারি রোডে দরিয়াপুরে একটা চালাবাড়ি কেনেন ; সেটা ছিল একজন কামারের হাপর-বসানো ঘর, পেছনে আর পাশে সামান্য জমিতে ঝোপ । এই এলাকাটাও সেসময়ে গরিবদের পাড়া ছিল, ধারণার অতীত দুস্হ সুন্নি মুসলমানদের পাড়া । বিহার ন্যাশানাল কলেজের সামনে যে দোকান ছিল তার মালিকের বিরুদ্ধে মামলা চলে বেশ কয়েকবছর ; সেই সুযোগে দরিয়াপুরে দোকানঘর তৈরি করে ফেলা হয় । তৈরি হয়ে গেলে পুরোনো দোকানের পাট গুটিয়ে বাবা চলে আসেন দরিয়াপুরে । ‘রায়চৌধুরী অ্যাণ্ড কোং’-এর খ্যাতির কারণে পুরোনো খদ্দেররা দরিয়াপুরে আসত । এখন এই সংস্হা চালায় দাদার বড় ছেলে হৃদয়েশ ।
          দরিয়াপুরে যখন দোকান তৈরি হচ্ছিল তখন আমি ওই বাড়িতে একা থাকতুম, কেননা ইমলিতলার প্রাত্যহিক মাতালদের চেঁচামেচি আর ঝগড়াঝাঁটির দরুন পড়তে বসে বেশ অসুবিধা হত । তাছাড়া দরিয়াপুরে ইলেকট্রিসিটি ছিল, কলের জল ছিল। ছোটোদের হাতখরচের জন্য বাবা টাকা দিতেন না ; বলতেন যার যা চাই জানিয়ে দাও, কিনে এনে দেব । স্কুলের বাৎসরিক ফলাফলের রিপোর্টে বাবা কখনও কাউকে ‘গুড’ দিতেন না । নব্বুইয়ের কোঠায় মার্কস পেলেও দিতেন না ; বলতেন আরও বেশি পেতে হবে । দরিয়াপুরের বাড়িতে একা থাকলে আমার চরিত্রদূষণ ঘটতে পারে অনুমান করে বছরখানেক পরে মা আর বাবা রাতে শুতে আসতেন । মা টিফিন ক্যারিয়ারে করে রাতের খাবার আনতেন । দিনের বেলা ইমলিতলায় গিয়ে খেতে হতো । দরিয়াপুরের বাড়িতে একা থাকার সময়ে বন্ধুদের নিয়ে কিঞ্চিদধিক চরিত্রদূষণ যে ঘটত না তা বলা যাবে না ।
          বাবা আর মা দুজনেই মন্দিরে গিয়ে পুজো দেয়া বা তীর্থকর্ম করা ইত্যাদিতে আগ্রহী ছিলেন না ; আমার মনে হয় কাজের চাপে উনি সংস্কারমুক্ত করে ফেলেছিলেন নিজেকে । । আমি কখনও তাঁদের তীর্থক্ষেত্রে বেড়াতে যেতে দেখিনি ।   জেঠা-কাকারাও কেউ আগ্রহী ছিলেন না ; পাটনার বাইরে যেতে হলে তাঁরা যেতেন কেবল দেশের বাড়ি, অর্থাৎ উত্তরপাড়ায় । তবে বাবা নিয়মিত পৈতে বদলাতেন, একাদশীর দিন লুচি খেতেন । কালীঘাটের কালী আমাদের পারিবারিক দেবতা, যেহেতু তা আমাদের কোনো পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠিত, সেকারণে বাড়িতে পারিবারিক দেবতা আর তার সেবাযত্ন করার প্রয়োজন হতো না । পৈতে পরতেন বড়জেঠা আর ছোটোকাকা, যদিও খাওয়ার কোনো নিষেধ মানতেন না, মেজজেঠা কখনও পৈতে পরতেন আবার কখনও কুলুঙ্গিতে তুলে রেখে দিতেন ।  দাদার আর আমার ছোটোবেলায় পৈতে হয়েছিল বটে কিন্তু আমরা স্বরূপে এসে জলাঞ্জলি দিয়েছিলুম । পৈতেহীন হবার কারণে বাবা ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন বলে মনে হয় না ; এই প্রসঙ্গে কখনও কোনো কথা তোলেননি ।
         মা, বাবা এবং শিক্ষক, যে তিনজন মানুষ ব্যক্তিজীবনের অভিমুখ গড়ে দেয়, আমার জীবনে মা আর বাবার ভূমিকাই প্রধান । প্রকৃত অর্থে আমি কোনো শিক্ষক সেই সময়ে পাইনি যখন তা জরুরি ছিল । প্রাইমারি স্তরে ক্যাথলিক কনভেন্টে পেয়েছিলুম সিসটার আইরিনকে আর যাযক ফাদার হিলম্যানকে । শৈশবের বইতে বর্ণিত সমস্ত জিনিস যাতে নিজের চোখে দেখে যাচাই করতে পারি তার দিকে খেয়াল রাখতেন সিসটার আইরিন আর স্বদেশ আয়ারল্যাণ্ডে গেলে অনেককিছু সংগ্রহ করে আনতেন, স্কুল সংল্গন ফার্মে নিয়ে গিয়ে ফল, ফুল, গাছ, জন্তুতের চাক্ষুষ করাতেন । ফাদার হিলম্যানের সৌজন্যে আমি কনভেন্টে ভর্তি হয়েছিলুম ; উনি ফোটো তুলতে ভালোবাসতেন আর বাবার সঙ্গে ওনার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল, আমাকে দোকানে দেখতে পেয়ে সাড়ে তিন বছর বয়সে নিয়ে গিয়ে ট্রানজিশান ক্লাসে ভর্তি করে দেন; সপ্তাহে একদিন চার্চে বাইবেল ক্লাসে নিয়ে গিয়ে ওল্ড আর নিউ টেস্টামেন্টের কাহিনি শোনাতেন । পরে যখন ব্রাহ্ম স্কুল রামমোহন সেমিনারিতে ক্লাস সিক্সে গিয়ে ভর্তি হলুম, কোনো শিক্ষকের সঙ্গে নৈকট্য গড়ে উঠল না ; এই স্কুলে যিনি আমাকে বাংলা সাহিত্যে আগ্রহী করলেন, তিনি গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তী , আমার ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসের সুমিতাদি।
          মা আর বাবার কাছ থেকে যা পেয়েছি তা হল সততা, নিজের বিশ্বাসের সমর্থনে একক লড়াই করার চারিত্র্য । বাবা দোকানদার হয়েও সৎ ছিলেন, যা আজকের দিনে অকল্পনীয় । কেবল সৎ নয়, তাঁর ছিল সৎসাহস । হাংরি আন্দোলনের সময়ে আদালতের মামলায় বন্ধুরা যখন আমার বিরুদ্ধে মুচলেকা লিখে রাজসাক্ষী হয়ে গেল, আর লড়াইটা আমার একক হয়ে দাঁড়াল, তখন আমি আমার চরিত্রগঠনে মা আর বাবার অবদানের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলুম । বাবা কলকাতায় লালবাজারে গিয়ে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন যে অমন মকদ্দমা কেন করা হয়েছে আর তখনই জানা যায় যে কলকাতার কয়েকজন সমাজকর্তা-বুদ্ধিজীবীর নালিশ কাজ করেছে এর পেছনে, যাদের বলা হয় এসট্যাবলিশমেন্টের ধারক-বাহক । মকদ্দমা চলার সময়ে বাবা কয়েকবার পাটনা থেকে দুএক দিনের জন্য দোকান বন্ধ করে কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে আসতেন । যারা আমার সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিল আর চামড়া বাঁচাবার জন্য রাজসাক্ষী বা সরকার পক্ষের সাক্ষী হয়ে গেল তাদের পরিবারের কাউকে কোনো দিন আসতে দেখিনি কোর্টে ; অর্থাৎ তাঁরা তাঁদের ছেলের সাহিত্যকর্মকে সমর্থন করতে পারেননি। 
          বাবা আমাদের বাড়ির ক্ষমতাকেন্দ্র হলেও ছোটোদের কাউকে শাসন করতেন না । তাঁর কাছে অভিযোগ জানালে তিনি বলতেন, “অ, ও শুধরে নেবে ।” তারপর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকে বলতেন, “কী, শুধরে নিবি তো ? বড় হয়েছিস, শুধরে নিতে শেখ।” বড়জেঠা শাসন করতেন, নিজে থেকে নয়, জেঠিমা-কাকিমারা অভিযোগ করলে, কিন্তু অভিযোগ করলে তিনি বিরক্ত হতেন । বড়জেঠার দুই মেয়ের বিয়ে আমার শৈশবেই হয়ে গিয়েছিল । মেজজেঠা আর কাকাদের মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্হা করেন বাবা, তাঁদের শৈল্পিক উদাসীনতায় ওদের বয়স বেড়ে যাচ্ছিল ; তাছাড়া বিয়ের খরচের ব্যাপারটাও ছিল । মেজজেঠার এক মেয়ে মীনাক্ষী একজন বিহারি ছেলেকে বিয়ে করতে চাইলে মেজজেঠা অমত জানান ; মেজজেঠার অমত হওয়ায় বাবা তাঁকে বোঝালেও তিনি রাজি হননি । বাবা তাঁর বিরুদ্ধতা করে মেজজেঠাকে অপমানিত করতে চাননি । শেষে আমাকে টাকাকড়ি দিয়ে বলেন যে ওরা কোথায় গিয়ে বিয়ে করতে চাইছে সেখানে গিয়ে সম্প্রদান করে আয় । আমার ছোটোশালী এক যুবককে বিয়ে করতে চাইলে নাগপুরে অভিভাবকরা রাজি হলেন না, তখন তার বিয়েও দরিয়াপুরের বাড়ি থেকে হল ।
         দাদা যখন চাইবাসায় পোস্টেড ছিলেন সেখানে সুধীর চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে বেলার সঙ্গে পরিচয় হয়, আর দাদা পাটনায় গিয়ে বাবাকে বিয়ের কথা জানাতে তিনি তক্ষুনি রাজি হয়ে যান । আমি অফিসের কাজে নাগপুরে গিয়ে কয়েকদিনের পরিচয়ের পরই রাজ্যস্তরের হকি খেলোয়াড় আর সহকর্মী সলিলা মুখোপাধ্যায়কে বিয়ের প্রস্তাব দিতে ওর অভিভাবকরা সেদিনেই সায় দেন । বাবাও টেলিগ্রামে অনুমোদন জানিয়ে দেন । কয়েকদিনের পরিচয়ের পরই এই বিয়েকে মা আর বাবা বলতেন, “তোদেরটা বৈপ্লবিক বিয়ে, পরিবারদের মাথা গলাতে হল না, হপ্তার পর হপ্তা রোদ-বৃষ্টি ঠেঙিয়ে প্রেম করতে হল না, ব্যাস, একজন আরেকজনকে বললি বিয়ে করব, করে ফেললি ।” 
        আমি লেখালিখির চেষ্টা করছি, মায়ের কাছে সেকথা জানতে পেরে ১৯৫৮ সালে বাবা আগফা-গেভার্ট কোম্পানির একটা দামি ডায়েরি দিয়েছিলেন, আর তাতেই আমি কবিতা মকসো করা শুরু করেছিলুম । বাড়িতে ইংরেজি ভাষার পছন্দের বইয়ের সংগ্রহ গড়তে চাই জানতে পেরে বাবা বলতেন বইয়ের তালিকা তৈরি করে দিতে । বইয়ের দোকানে গিয়ে বই পছন্দ করে নিতুম আর পেয়ে যেতুম । বাংলা বই, বিশেষ করে কবিতার বই দাদা কলকাতা থেকে নিয়ে আসতেন । পরে বিদেশি বন্ধুদের কাছ থেকেও প্রচুর বই আর পত্রিকা পেতুম । হাংরি আন্দোলনের সময়ে কলকাতার পুলিশ আমায় গ্রেপ্তার করতে এসে আমার বইগুলো নিয়ে সারা ঘরে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলেছিল । বাবার দোকানের কাচের আলমারি ভেঙে দিয়েছিল । মায়ের বিয়ের তোরঙ্গ ভেঙে লণ্ডভণ্ড করার সময়ে ওনার বিয়ের পুরোনো বেনারসি ভাঁজ থেকে ছিঁড়ে গিয়েছিল । কিন্তু আমাকে যখন কোমরে দড়ি বেঁধে, হাতে হাতকড়া পরিয়ে রাস্তা দিয়ে হাটিয়ে নিয়ে গেল পুলিশ তখন বাবাকে বেশ বিচলিত দেখেছিলুম, যা উনি সচরাচর হতেন না । ছোটোবেলায় আমি বাড়ি থেকে বেশ কয়েকবার পালিয়েছি ; ফিরে এসে মনে হয়নি যে বাবা বিচলিত ; উনি আমাকে এই প্রসঙ্গে কোনো কথা জিজ্ঞাসাও করতেন না । পরে, আমার মেয়ের কাছে গল্প করেছিলেন যে আমি ওনাদের না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালাতুম ।
          অ্যালেন গিন্সবার্গ আমাদের দরিয়াপুরের বাড়িতে এসে ছিলেন কয়েক দিন । তিনি নানা শহরে ঘুরে বেশ কিছু ফিল্মে ফোটোম তুলেছিলেন আর সেগুলো বাবাকে দেন ডেভেলাপ করার জন্য । বাবা ডেভেলাপ করে দ্যাখেন গিন্সবার্গ কেবল নুলো, ভিখারি, দুস্হ, পথের পাশে অসুস্হ লোক, কুষ্ঠরোগি-- এদের ফোটো তুলেছে । তখন গিন্সবার্গের সঙ্গে ওনার একচোট ঝগড়া হয়েছিল । বাবা গিন্সবার্গকে বলেছিলেন, “তোমরা যতই বড় কবি-লেখক হওনা কেন, আমাদের দেশটাকে এইভাবেই দেখাতে চাইবে ; কেন ? ফোটো তোলার আর কোনো বিষয় কি নেই !” গিন্সবার্গ সম্পর্কে যে গবেষকরা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন তাঁদের সবাইকে এই ঘটনার কথা জানালেও, কেউই নিজেদের লেখায় এই বিতর্কটা অন্তর্ভুক্ত করেননি । পরে , পাটনার বাড়িতে বা কলকাতায়, বিদেশিরা এলে আমি তাঁদের বলতুম যে ফোটো তুলে থাকলে দেশে ফিরে ডেভেলাপ আর প্রিন্ট করিও । 
          আমি প্রথম চাকরিটা পাই পাটনাতেই । তারপর ১৯৭৯ নাগাদ গ্রামোন্নয়নের চাকরি পেয়ে স্ত্রী আর ছেলে-মেয়েকে নিয়ে চলে যাই লখনউ । দাদা সপরিবারে পাটনা ফেরার পর মা আর বাবা আমার কাছে লখনউ চলে আসেন । লখনউতে ১৯৮২ সালের ১৮ই নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মা মারা যান । মা মারা যেতে বাবা বেশ একা বোধ করতেন, কেননা আমি আর সলিলা দুজনেই অফিসে চলে যেতুম আর ছেলে-মেয়ে চলে যেতে স্কুলে । দাদা তাই বাবাকে পাটনায় নিয়ে যান । লখনউ থেকে আমি ১৯৮৭ সালে বদলি হয়ে মুম্বাই চলে যাই । বাবাকে তখন মুম্বাই নিয়ে গেলে ভালো হতো ; মুম্বাইতে চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা পাটনার চেয়ে উন্নত । ১৯৯১ সালের ৮ই অক্টোবর বাবা পাটনায় মারা যান ।

সোমবার, ২০ জানুয়ারী, ২০২০

শরশয্যায় শেষ দুশ্চিন্তা

“শরশয্যায় শেষ দুশ্চিন্তা”
আমি তোমাদের পিতামহ ভীষ্ম
তোমরা নিজেরা লড়বে থামাতে পারব না
আমি আমার জন্মদিন জানি না, বাবা-মার জন্মদিন জানি না
যাদের দলে আছি তারা একশোজন একই সঙ্গে একই তারিখে জন্মেছিল নাকি
ওরাও নিজেদের জন্মের তারিখ জানে না কেননা কয়েকজন
পরের সূর্যোদয়ে জন্মেছিল, হয়তো প্রথম পঞ্চাশজন আফগানিস্তানে
যাদের সঙ্গে লড়ছে তারাও পাঁচ ভাই জানে না কে কবে জন্মেছিল
তাদের আসল বাবার জন্মদিন কেউই জানে না
নকল বাবা কি নথিপত্রে মান্যতা পাবে ?
আরেকটা ভাই আছে কানের ভেতরে আইভিএফ করে পয়দা হয়েছিল
সেও জানে না তার জন্মদিন কবে ! কী তার বাবার সাকিন, জন্মদিন ? বিগ ব্যাং ?
আমার মা গঙ্গা  জন্মেছিলেন কবে জুরাসিক, ক্রিটেশিয়াস, প্যালিওজিন যুগে
আমার বাবার চেয়ে কতো কোটি বছরের বড়ো সুন্দরী যুবতী ছিলেন?
যাই হোক আমার পূর্বপুরুষদের ও উত্তরপুরুষের পরিবারের লোকেদের
জন্মের তারিখ আর আঁতুড়ের ভূমি নথিতে লেখেননি গণেশ ।
আমি ঠিক কোন রাজ্যে জন্মেছিলুম ? উত্তরাখণ্ডে, উত্তরপ্রদেশে, বিহারে, বাংলায় ?
তীরের বিছানায় শুয়ে ভাবছি এই ফালতু পাঁচসাত
তৃষ্ণা মেটাবার জন্য মাটিতে একের পর এক তীর চালিয়েও
জলের ফোয়ারা তুলতে পারেনি অর্জুন ; মাটির তলার জল শুকিয়ে গিয়েছে !
প্রতিটি তীরে শুধু উঠে আসছে টাটকা রক্তের ঝর্ণা, বিভিন্ন ধর্মের, জাতির, বর্ণের, ত্বকের, জঙ্গলের, পাহাড়ের মানুষের দানবের রাক্ষসের 
আমার হাঁ-মুখে  আছড়ে পড়ছে অনন্তকাল জুড়ে উষ্ণ প্রস্রবন
এই রক্তস্রোত থামবে না কোনোদিন ; লড়াই চলতে থাকবে অবিরাম
আমিও তৃষ্ণার্ত থেকে যাবো আণবিক যুদ্ধ না-হওয়া পর্যন্ত

শনিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২০

মলয় রায়চৌধুরীর কিছু উক্তি

মলয় রায়চৌধুরীর কিছু উক্তি ( ২০১০ )
কবিতা লিখলে গালমন্দ খেতেই হবে ।
***
যারা ছবি আঁকে তারা নিজেদের বলে চিত্রশিল্পী । কেউ নিজেকে ভুলেও কবিশিল্পী বলে না । যারা পাঁঠা কাটে তাদের কসাইশিল্পী বলা হবে না কেন ? কসাই তো কেমন তুলি চালাবার মতন করে চপার চালায় ।
***
শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা রচনার প্রথম শর্ত।
***
এককালে বাংলাভাষায় বাণিজ্য হতো ; এখন বাংলাভাষায় কেবল পদ্য লেখা যায় কিংবা সংবাদপত্রের গুলগল্প।
***
মৃত্যুকে আবিষ্কারই প্রেম ; প্রেম আবিষ্কারই কবিতা ; কবিতা আবিষ্কারই মৃত্যু
***
যৌনতা হল মেটাফর । প্রেম হলো ক্যাটাসট্রফি ।
***
শাঁখের আওয়াজকেও গোঙানিতে বদলে ফেলতে পারা যায় । সেই গোঙানিটা মৃত শাঁখের ।
***
ভাষা তো অবলা নয় যা নারীকে অবলা বলব ।
***
কবিতা প্লুরাল, তাই একটা কবিতার অনেক মানে হতে পারে । আবার কোনো মানে নাও হতে পারে ।
***
ভাষা ফ্যাসিবাদের সহায়ক ।
***
কোনো-কোনো কুষ্ঠরোগি ভিক্ষা চাইবার সময়ে ছুঁয়ে দিয়ে ভয় দেখাতে চায় ।
***
আমি ২৯ নভেম্বর বিয়ের প্রস্তাব দিই আর চৌঠা ডিসেম্বর বিয়ে করি, যাতে প্রেমের হলকার মধ্যেই পরস্পরকে খুঁজে নিতে পারি ।
***
মানুষ ভাষাকে প্রতিক্রিয়াশীল করে তুলেছে ।
***
সবচেয়ে মিষ্টি বৃষ্টি হলো যা তাড়া করেও ধরতে পারে না ।
***
মালার্মে আর রিলকের যতো উল্লেখ তিরিশের দশকে হতো তা আর লিটল ম্যাগাজিনে দেখা যায় না । ওনাদের কবিতার বিশেষ অনুবাদও হয় না । আসলে বাংলা কবিতার পৃথিবীতে ওনাদের কবিতা খাপ খায় না ।
***
যতোও তর্কাতর্কি হোক, কবিতাপাঠ অনুষ্ঠান হোক, কবিতা আর মেইনস্ট্রিম বৌদ্ধিক ব্যাপার নয় । এটা এখন বিশেষজ্ঞদের জগত ; এই জগতে ভূমিকম্প হলেও তা এর বাইরের লোকেরা জানতে পারে না । তবে এই জগতের পুরুতদেরও সাংস্কৃতিক মর্যাদা আছে । কেউ দুর্গাপুজোর পুরুত, আবার কেউ মনসা, শেতলা, শনিঠাকুরের পুরুত ।
***
নেপালে যখন ছিলুম, হাত দিয়ে চটকে মশলা মিশিয়ে তৈরি মোষের কাঁচা মাংস ‘কচিলা’ আর তার সঙ্গে ‘রাকসি’ মদ খেতুম । খেড় বেছানো অন্ধকার ঘরে ফিরে গুহাবাসীদের আনন্দে ফিরে যেতুম, পঁচিশ হাজার বছর পেছনে । মাওবাদীরা হয়তো সেই জন্য দুটোই বেআইনি করে দিয়েছে ; মানুষকে এগিয়ে যেতে হবে । কিন্তু কোথায় ? ইউরোপের ‘এনলাইটেনমেন্টে’ !
***
ইটভাটার বধুয়া মজুরদের যখন ছাড়িয়ে স্বাধীনতা দেয়া হল, তখন তাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল, “হুজুর, আমাদের খাওয়াবে কে?”
***
যুবতী শোকাতুরাকে জড়িয়ে মৃতকে ভুলে জীবিতার দেহতাপ পাওয়াও বেঁচে থাকার রসদ ।
***
তাকিয়ে পাথরপ্রতিমা করে দেবার সৌন্দর্যবোধ কেবল কবিদের থাকে ।
***
প্রাচীন গ্রিসের দেবতাদের মূর্তির লিঙ্গ ছোটো আর ন্যাতানো হতো । রাক্ষসদের লিঙ্গ বড়ো আর দাঁড়ানো গড়া হতো । ওনাদের দেবতাদের মূর্তির প্রশংসা করার বদলে আমরা রাক্ষসদের ঈর্ষা করার নান্দনিক যুগে পৌঁছে গেছি ।
***
আয়নাও পারা ঝরিয়ে নতুন বউয়ের স্মৃতি ভুলে যায় ।
***
গন্তব্য আর তীর্থ দুটো আলাদা পথবিন্দু ।
***
বসন্তঋতুর সঙ্গে একাত্ম হবার প্রয়াস সম্পর্ককে অনৈতিক করে তুলতে পারে ।
***
প্রতিটি মৃত্যুদণ্ডের নিজস্ব রূপকথা হয় ।
***
লিখনভঙ্গিমা সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন হয়ে পানাপুকুরে গোসাপের সাঁতার ।
***
স্কুল বালকেরা পরীক্ষার খাতায় কলমের নার্ভাস নাচের প্র্যাকটিস দেখতে পায় ।
***
শত্রুতা শেখা দরকার মাকড়সাদের থেকে ; ওইটুকু মাকড়সা অথচ শত্রুদের মুখে থুতু ছিটিয়ে কি বিশাল জালের ফাঁদ পেতে রাখে ।
***
রাতে পেচ্ছাপ করতে উঠলে আলো জ্বালি না, ঘুমের ট্যাবলেটের রেশ যাতে ফুরিয়ে না যায় । কিনউ পেচ্ছাপ পড়ার আওয়াজে কান রাখতে গিয়ে ঘুমটা চটে যায় । তার ওপর বাইরে পড়লে সকালে উঠে ধুতে হবে, কেননা আমিই প্রথম উঠি । প্রাকঔপনিবেশিক আর উত্তরঔপনিবেশিকের খিচুড়িজীবন ।
***
মধ্যবিত্ত বাঙালির বিড়ি খাওয়ায় কি এলিটিজম নেই ?
***
খালাসিটোলা থেকে বেরিয়ে গোরুর মাংসের গরম-গরম শিক-কাবাব খাবার প্রস্তাব দিলেই সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষ পালিয়ে উধাও হয়ে যেতো । তার আগে পর্যন্ত মাতাল ।
***
হিন্দি ভাষার কবি রাজকমল চৌধুরীর সঙ্গে ওর গ্রাম মাহিষীতে গিয়েছিলুম, ছিন্নমস্তার পুজোয় ; সেদিন একের পর এক মোষ বলি চলছে, আর আমরা দিশিমদ ঠররা খেয়ে রক্ত মেখে বেহেড, মাংস খাওয়া আর নাচানাচি হবে রাতে । সেই রাতেই মনে হয়েছিল ‘অস্তিত্ববাদ’ দর্শনটা এক্কেবারে অভারতীয়, কলোনিয়াল ; লোকে কি করে যে কামু-সার্ত্রের নাম জপ করে বেড়ায় !
***
যিনি নিজেকে ঈশ্বরবিশ্বাসী বলে বিজ্ঞাপিত করেন, তিনি যখন ঈশ্বরের সমর্থনে বাগাড়ম্বর ফাঁদেন, তখন  আঁচ করতে পারি যে তাঁর ঈশ্বরবিশ্বাস ভুয়ো ।
***
কাউকে ভালোবাসার সময়ে কেউ কি ভাবে যে, “আমি অমুককে ভালোবাসি ?” অথচ ছাড়াছাড়ির পর ভাবে, “আমি অমুককে ভালোবাসতুম ।”
***
সংবাদপত্র পড়া আর টিভিতে সংবাদ দেখার পজিটিভ দিক হলো যে, আমরা স্বস্তি পাই, আমাদের চারিপাশে হাজার-হাজার মূর্খ এই সমাজের বিভিন্ন স্তরে বাস করে ।
***
টিভির অ্যাঙ্কর ( অ্যাঙ্করিণী ? ) তরুণীরা বুড়ো দর্শকদেরও বলে, “সঙ্গে থাকুন” । কেমন অশ্লীল ডাক ।
***
ফৌজদারি আদালতে, হাজতে, জেলের পাল্লায় না পড়লে দেশকে, দেশের মানুষদের, জানা যায় না ।
***
নর্দমায়, মাঠে, নদীর ধারে না হাগলে শিক্ষিত মানুষের জীবনবোধ হবার সম্ভাবনা কম ।
***
প্রথম সঙ্গমের আগে পর্যন্ত যে রহস্যময়ী অচেনা, সে চেনা রহস্যময়ী হয়ে ওঠে প্রতিবারের রুটিনে ।
***
বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য বলে আলাদা কিছু হয় না । বেঁচে থাকাটাই বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য ।
***
যতোই চেষ্টা করা হোক, দুঃখকে অতিক্রম করা অসম্ভব ।
***
শৈশব থেকে দেখছি, লাউডস্পিকারের ডেসিবল বেড়েই চলেছে ; অথচ সব আওয়াজই মানেহীন ।
***
ফোন করে স্বপ্নে আসতে চাইছেন এক যুবতী-কবি । তিনি কবি । মাতাল ।
***
স্বপ্ন মাত্রেই পোস্টমডার্ন, তাদের অরৈখিক রাইজোম্যাটিক প্লটের কারণে ।
***
দেবীরা সবাই রোগের ( শীতলা, মনসা, পর্ণশর্বরী, ধূমাবতী ) আর দেবতারা সবাই চিকিৎসক ( ধন্বন্তরী, ধাত্রী, অশ্বিনীভাইরা ) । কেন ?
***
যদি না চোখে-চোখে রাখা হয়, তাহলে পুলিশ স্টেট হয়ে ওঠার জন্য গণতন্ত্রের মাটি সবচেয়ে নরম ।
***
এখন কবির নাম দেখে আঁচ করা যায় নামের নিচে কবিতাটা কেমন হবে। বছর শেষেও কোনো বিশেষ বাঁকবদল পাওয়া যায় না । যেন কবিতা আর কবির চাকরিতে পার্থক্য নেই ।
***
সঙ্গমের চেয়ে যোনির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার আনন্দ বেশি ।
***
জলাতঙ্ক রোগটা কুকুরেরা মানুষের কাছ থেকে পেয়েছে ।
***
বয়স হয়ে গেলেও বাসুদেব দাশগুপ্ত সোনাগাছির বেবি-দীপ্তি-মীরাদের মাংসের আকর্ষণ ছাড়তে পারেনি। দাদার কাছে এসে ভায়াগ্রা যোগাড় করে দিতে বলতো ।
***
সুভাষ ঘোষ মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ থেকে বেরোতে পারেনি, হাংরি আন্দোলনের সময়েও। সোনাগাছিতে গিয়ে কারোর ঘরে ঢুকে তক্ষুনি বেরিয়ে এসে বলতো. লিঙ্গ দাঁড়াচ্ছে না ।
***
“আমি ও বনবিহারী” ( ২০০০ ) বইটার জন্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় । উৎসর্গ করেছিলেন, “কবি, নাট্যকার ও মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে” । আসলে উৎসর্গ করেছিলেন কবি নাট্যকার ও বনবিহারীকে, ভবিষ্যতে অবস্হা কী হতে চলেছে তা আগাম আঁচ করে ।
***
ক্যাথলিক মূল্যবোধে বেড়ে-ওঠা লেখকের টেক্সটের গভীরে কতোটা যেতে পারেন এমন সমালোচক যিনি হিন্দু পরিবারে জন্মেছেন, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে বসবাস করেছেন ?
***
সিপিএম-এর দমবন্ধ-করা কালখণ্ডে, কাফকাকে নিয়ে লিখেছেন মূলত বামপন্হীরা, যখন কিনা যাঁদের দম বন্ধ হয়ে আসছিল, কাফকা সম্পর্কে লেখা উচিত ছিল তাঁদের ।
***
প্রলেতারিয়েতের সঙ্গে একাত্ম বোধ করার জন্য বের্তোল্ত ব্রেখত দিনের পর দিন স্নান করতেন না, দাঁত মাজতেন না, পোশাক পালটাতেন না । পশ্চিমবঙ্গে তো কেউই বোধহয় প্রলেতারিয়েতের সঙ্গে কখনও একাত্ম বোধ করেনি ।
***
আমার কখনও ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’ হয়নি ; প্রতিবার ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট টাচ’ হয়েছে ।
***
কবিতার জন্য নিয়তিকে বশে আনতে হয় ।
***
প্রতিশোধের ষড়যন্ত্রকে জিইয়ে রাখা জরুরি কেননা তা জখমকে তাজা রাখে ।
***
দেশভাগের পর, পশ্চিমবাংলাকে যাঁরা বদলাতে চেয়েছেন, সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবি রাজনীতিক সমাজবেত্তা, তাঁরা কেউই নিজেকে বদলাতে চাননি ।
***
দেবী রায়কে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “হাংরি আন্দোলনের একটা সিমবল তৈরি করে নিতে এবং পাঁচ পয়সা দাম রাখতে ।” যেই পুলিশের ধরপাকড় আরম্ভ হল উনি সরকারি সাক্ষী হয়ে লিখে দিলেন যে হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে ওনার কোনো সম্পর্ক নেই ।
***
আমার যে কুষ্ঠি-ঠিকুজি মা তৈরি করিয়েছিলেন, তার সমস্ত ভবিষ্যবাণীকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছি ।
***
যে যুবতী নিজেকে কুৎসিত বলে মনে করেন, তাঁর আত্মচিন্তা সম্পর্কে ধারণা করা অসম্ভব ।
***
প্রচণ্ড বৃষ্টিতে সবুজ ঘাসের ওপরে সঙ্গমের তুলনা হয় না । যেমন শরৎকালের জ্যোৎস্নায় ফাঁকা মাঠে জোনাকিদের মাঝে উলঙ্গ প্রেমিক-প্রেমিকার নাচ ।
***
প্রেম তখনই সফল যখন তা প্রেমিক আর প্রেমিকা দুজনকেই একযোগে ধ্বংস করে দ্যায় ।
***
কবির প্রতিষ্ঠা অন্য কবিদের ঈর্ষায় লুকিয়ে । অগ্রজ লেখকেরা ঈর্ষা করার মাধ্যমে অনুজ লেখকদের স্বীকৃতি দেন
***
তুমি যাকে ঘৃণা করছ সে যদি তা জানতে না পারে তাহলে ঘৃণা করার কোনো মানে হয় না ।
***
পরস্পরের ভাষা না জানলে, সঙ্গমের রহস্য আরও গভীর হয়ে ওঠে ।
***
প্রকৃত সুন্দরীর দিকে দ্বিতীয়বার তাকালে সৌন্দর্যের পরিভাষা যৌনতায় পালটে যায় ।
***
মানুষ পৃথিবীর প্রতি অপার বিরক্তি নিয়ে জন্মায় ; তাই সে জন্মেই কাঁদতে আরম্ভ করে ।
***
নাগরিকদের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা দেবার জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ।
***
অপবাদ আকর্ষণ করার ক্ষমতা না থাকলে জীবদ্দশায় একজন কবির খ্যাতি বৃথা ।
***
যেকোনো ব্যাপার তোমাকে নষ্ট করে দিতে পারে, তা অসাধারণ কবিতা হোক বা অপরূপা প্রেমিকা ।
***
বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন বিভাগে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্যাঙাত হয়ে পেছন-পেছন হাঁটছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় । আমায় দেখে হাত তুললেন, অর্থাৎ দ্যাখো, আমি কোথায় পৌঁছেছি । দেখলুম । জানি না ওনার মৃতদেহ নন্দন চত্ত্বরে রাখা হয়েছিল কিনা, একুশ বন্দুকের সেলামি দেয়া হয়েছিল কিনা । ওনার প্রতিদ্বন্দ্বী সুনীলের মৃতদেহ রাখা হয়েছিল, আর শক্তিকে শ্মশানে সেলামি দেয়া হয়েছিল ।
***
কখনও সাহিত্য-আলোচকদের মনের মতন লেখার চেষ্টা করা উচিত নয় । নিজের মনের মতন লিখতে গেলে রিস্ক নিতেই হবে ।
***
সৌরমণ্ডলের বাইরের মানুষদের কথা যখনই চিন্তা করা হয়, তখন তাদের কুৎসিত দেখানো হয় কেন ? তারা হয়তো ঐশ্বর্য রায় বচ্চন আর ঋতিক রোশনের চেয়ে ভালো দেখতে ।
***
পৃথিবীতে বসবাস করার মতো জায়গা আর রইলো না । এরকম জায়গা মগজে আসতে থাকলে, বুঝতে হবে মৃত্যু বেশ কাছাকাছি
***
কতোগুলো অঘটন মগজে পূঞ্জিভূত হলে একটা কবিতা চিন্তায় খেলতে আরম্ভ করে ?
***
কোনো-কোনো কবিতা মধু খেয়ে, ফেলে চলে যাওয়া, মৌমাছির চাকের মতন । মধুর খোঁজে মোম প্রাপ্তি ।
***
তোমার লিঙ্গও সঠিক সময়ে তোমার নির্দেশ মানতে অস্বীকার করতে পারে ।
***
ক্ষমা করার আগে গভীর ভাবে খতিয়ে দেখা উচিত ।
***
এই বয়সে কোনো যুবতী ভালোবাসার প্রস্তাব জানালে অমঙ্গলের আশঙ্কায় আক্রান্ত হই ।
***
জীবন সম্পর্কে কথা বলা প্রায় অসম্ভব কেননা বাংলা ভাষায় তার জন্য সঠিক অভিব্যক্তি এখনও পাওয়া যায় না ।
***
আমি ভাগ্যবান যে আয়নাকে ঘৃণা করার দরকার হয় না । আমার টাক পড়েনি ; কখনও পড়বেও না ।
***
মানব সম্প্রদায়ের মুক্তির তাত্বিকরা শেষ পর্যন্ত গণহত্যাকারীতে রূপান্তরিত হয় ।
***
সবচেয়ে বাজে আবিষ্কার হল লাউডস্পিকার, বিশেষ করে যখন তা সাম্প্রদায়িক বিশ্বাসের দানব হয়ে ওঠে ।
***
কবিতা মনের বিশৃঙ্খলাকে কয়েদ করে ।
***
প্রতিটি শব্দেই যদি ক্রিয়া লুকিয়ে থাকে, তাহলে একটিমাত্র সত্য বলে কিছু হয় না ; যা হয় তা হল কর্ম । ক্রিয়াপদে নিহিত থাকে কর্মশক্তি ।
***
সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষ মারা যাবার আগে অনেক চেলা তৈরি করে গেছে দেখছি । ওরা দুজনে মুচলেকা দিয়ে রাজসাক্ষী হয়েছিল বললেই চেলারা রাস্তার ঘেয়ো কুকুরের হাঁমুখ খুলে কামড়াতে আসে ।
***
এখনকার কবিতা অর্থবহ ‘পাবলিক ইডিয়ম’ গড়ে তুলতে পারেনি ।
***
আদালতের জজরাই যখন সন্দেহের ঊর্দ্ধে নন বলে বিধায়করা দাবি করছেন, তখন সাহিত্যের বিচারকরা কোন যুক্তিতে সন্দেহের ঊর্দ্ধে ?
***
ব্যর্থ বিপ্লবী বিদেশে গিয়ে মার্ক্সের কবর দেখতে যান । ব্যর্থ কবি বিদেশে গিয়ে বদল্যারের কবর দেখতে যান।
***
“কোথায়” জায়গাটা ঠিক কোথায় ?
***
দাদাকে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠির অংশ, “যে কারণে আমি আনন্দবাজারে সমালোচনায় বাজে বইকে ভালো লিখি -- সেই কারণেই মলয়ের লেখাকে ভালো বলেছি”।
***
এককালে যারা অবক্ষয়বিরোধী ছিল তারাই বঙ্গসমাজে অবক্ষয় নিয়ে এলো ।
***
বক্সিং ম্যাচ যারা দেখতে যায় তারা হার-জিতের মাধ্যমে জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধান খোঁজে ।
***
“পবিত্র বই” আর “অপবিত্র বই”-এর পার্থক্য হল যে “অপবিত্র বই” কেবলমাত্র কবিরাই লিখতে পারেন ।
***
গ্ল্যামারের আকর্ষণ হল ক্যাটওয়াকের শেষে যুবতীদের সমবেত ঘামের গন্ধ, যা অত্যন্ত দামি পারফিউম দিয়েও চাপা পড়ে না ।
***
সকলেই ভাবে ‘পৌঁছে গেছি’ । পেছন ফিরে তাকিয়ে টের পায় যেখানে সে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।
***
কেউ আমাকে ঘৃণা করলে তা উপভোগ করি ।
***
পশুরা জানতেই পারল না যে মানুষ সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী ।
***
ধর্ম যে উদ্দেশ্যহীন এবং ভাঁওতা তা সবচেয়ে ভালো করে জানে সেই বুড়োগুলো যারা নারী ও কিশোরদের মানববোমা তৈরি করে পাঠায় ।
***
প্রগতির একরৈখিক ধারণা  প্রিমিটিভ ।
***
বাজার-করা আর ভোট-দেওয়া ছাড়া নাগরিকের কোনো সম্পর্ক আছে কি সমাজ আর রাষ্ট্রের সঙ্গে ?
***
দেশভাগের আগে পূর্ববঙ্গের যে সাম্যবাদীরা দেশভাগ সমর্থন করেছিল, তারাই ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭-এর অনেক আগে ভারতে পালিয়ে এসেছিল । তাদের কি তকমা দেয়া উচিত ? বিশ্বাসঘাতক !
***
“প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” কবিতাটি হল  Confessions of pain ; যে কবিরা এই কবিতাটিকে হিংসে করেন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে আমার যন্ত্রণাবোধকে হিংসে করেন ।
***
লেসবিয়ানরা  পুরুষাঙ্গের মুখমেহন করতে পান না বলে কি ‘পেনিস এনভি’ পুষে রাখেন ? 
***
প্রতিশোধস্পৃহা জন্মায় উন্মদের মস্তিষ্কে, অথচ উন্মাদনা ছাড়া কবিতা লেখা যায় না ।
***
তুমি যদি নার্সিসিস্ট না হও, তাহলে তুমি আধুনিক কবি নও ।
***
বাঙালির ‘মধ্যমেধা’ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের অনেকে চেঁচামেচি করেন । যদি সকলেই ‘মধ্যমেধা’ হতো তাহলে বিদেশে কারা পালিয়ে গিয়ে বসবাস করছে ?
***
ভালো মানুষের পক্ষে ভালো বন্ধু পাওয়া অত্যন্ত কঠিন ।
***
আশাবাদ : লক্ষ বছর আগে মরে গিয়েছে যে নক্ষত্র তার আলো এখন এসে পৌঁছেচে পৃথিবীতে ।
***
মরে গেলে আত্মার সদ্গতির জন্য শোকপ্রকাশ করবেন না ; আমার আত্মা নেই । আমার গ্রন্হগুলোর আত্মা আছে ।
***
কবিতার উৎস কোনো-না-কোনো রহস্য যার উন্মোচন অন্য উপায়ে সম্ভব নয় ।
***
গাঙচিল নামে এক প্রকাশনা সংস্হার কর্ণধার বললেন যে, “আপনার বই তো  বুদ্ধদেব গুহর মতন বিকোয় না, তাই প্রকাশ করতে পারব না ।”
***
যার নির্বাণ কিংবা মহানির্বাণ ঘটে সে তা জানতে পারে না । তাহলে নির্বাণ বলতে কী বোঝায় ?
***
যোনিকে ফর্সা করে তোলার বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেখি টিভিতে । যোনি কালো হোক বা ফর্সা তাতে প্রেমিকের কীই বা এসে যায় !
***
জোয়ার, ভাটা, এল নিনো, নিম্নচাপ, ঘূর্ণাবর্ত, বন্যা ! জলের অসুখ হল প্রকৃতির জলাতঙ্ক ।
***
সব ধর্মের পুরোহিতরাই নানা রকমের আচরণ করেন । দেখে মনে হয় বাচ্চাদের খেলা । তাই বোধহয় ধর্মগুলোয় নানা খোকোনপ্রিয় গাঁজাখুরি গল্প গড়ে ওঠে ।
***
ভারতে অনেক পরিবার হাজার বছর ধরে গরিব । তবু তারা হাতে অস্ত্র তুলে নেয় না কেন ? জাতপাতের বর্ণবিভাজনের কারণে !
***
অন্ধকারে বিছানাকে আরণ্যক বধ্যভূমি করে তোলাই ফুলশয্যা ।
***
রাস্তায় অচেনা মানুষদের ভিড়ে গা-ঘেঁষাঘেষি করে হাঁটার সময়ে একাকীত্বকে যেভাবে উপভোগ করি, সেভাবে একা ঘরের কোনে বসে হয় না ।
***
পাশা খেলায়, মানে জুয়ায়, যুধিষ্ঠির কখনও জিততে পারেননি, তবু কেন শকুনি চরিত্রের প্রয়োজন ?
***
যে লোকটা ভয়ে কখনও কোনো মাদক নেয়নি সে গাঁজাটানার বিরোধীতা করবেই ।
***
এক-একজন মানুষকে একবার দেখলেই টের পাওয়া যায় তার মগজে সাভানার কোন জন্তুদের উৎপাত চলছে ।
***
জীবনে একবার অন্তত আকুল কামলালসায় আক্রান্ত হবার অভিজ্ঞতা জরুরি ।
***
পরস্পরবিরোধিতা আর অনিশ্চয়তার সম্ভাবনাকে একযোগে ধরে ফেলতে পারে কবিতা ।
***
কেউ যদি জানতে চায় যে লিফ্টে আমি কার সঙ্গে আটক হতে চাইব ? আমার উত্তর হবে কোনো নেয়ানডারথাল তরুণীর সঙ্গে, তার কারণ সে জানে না যে প্রেম কাকে বলে ।
***
প্রেম শেষপর্যন্ত অনীহা, উদাসীনতা, গতানুগতিকতা, অমনোযোগ, একঘেয়েমিতে পৌঁছে ফুরিয়ে যায় ।
***
বিশ্বাসঘাতকরা মরবার আগে আত্মসন্মানহীন শিষ্যদের তৈরি করে যায়, যারা মৃতের গোলামি করে বেঁচে থাকে ।
***
যে লোক তোমার সঙ্গে ছলনা করেছে সে চিরকাল তোমার বিরুদ্ধে কথা বলবে, এবং সে যদি লেখক হয় তাহলে তোমার বিরুদ্ধে লিখবে ।
***
জীবনে একবার কেউ-না-কেউ পিঠে ছুরি মারবেই, আর সে-আঘাত কখনও সারবে না ।
***
বিশুদ্ধ ক্ষমতার লোভ থেকে গুণ্ডা এবং রাজনেতাদের জন্ম ।
***
মেয়েদের ভগাঙ্কুর কেটে ফেলার প্রধান উদ্দেশ্য তাদের যৌনসুখ থেকে বঞ্চিত করা । সউদি আরবে এই প্রথা তুলে দেয়া হয়েছে কেননা আব্রাহামিক ধর্মগ্রন্হে কেবল পুরুষের খতনা সম্পর্কে নির্দেশ আছে ।
***
বিষয়-সম্পত্তির জন্য মানুষ-মানুষীর এতো লোভ হয় কেন ? ভবিষ্যতের জন্য নয় । যখন মানুষ গুহাবাসী ছিল তখন গুহার দখলিসত্ত্ব নিয়ে লড়াই করতে হতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য । সেই প্রাগেতিহাসিক মানুষ ঘাপটি মেরে থাকে বেশির ভাগ মানুষের চরিত্রে ।
***
বুড়ো বয়সের একটা ফোটো পোস্ট করেছিলুম ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে, একথা জানিয়ে যে পেনশনে টিকে আছি এবং মুম্বাইতে থাকি । বহু তরুণী প্রোপোজাল পাঠিয়েছেন ! কী কারণ হতে পারে ? বাবা-প্রেমিক চাই ? মুম্বাইতে ছাদ চাই ? 
***
অনেক পরিচিত মানুষ-মানুষী স্বপ্নে বারবার আসেন, অথচ আমি চাই না তাঁরা আসুন । বোঝা যায় যে প্রতিটি ব্যাপারে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হতে পারে না ।
***
আমি লিখি গল্পহীন গল্প ; অনেকে তাকেও ছোটোগল্প বলে মনে করেন ।
***
সৃজনশীল মানুষের অধঃপতনের অভিজ্ঞতা হওয়া জরুরি, কেননা তা জ্যোতিষ্কদের হয়, পশুদের হয় না ।
***
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ১৫ জুন ১৯৬৪-এর চিঠি থেকে : “সন্দীপন, আপনি অনেকদিন কিছু লেখেননি, প্রায় বছর তিনেক । তার বদলে আপনি কুচোকাচা গদ্য ছাপিয়ে চলেছেন এখানে-সেখানে । সেই স্বভাবই আপনাকে টেনে নিয়ে যায় হাংরির হাঙ্গামায় । আমি বারণ করেছিলাম । আপনি কখনও আমাকে বিশ্বাস করেননি । ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিলেন । আমি শক্তিকে কখনও বারণ করিনি, কারণ আর যত গুণই থাক --- শক্তি লোভী । শেষ পর্যন্ত উৎপলও ওই কারণে যায়।”
***
স্বমেহন আর কবিতার একটা যোগসূত্র আছে । দুটোই একই বয়সে আরম্ভ হয় ।
***
টাক ঢেকে রাখার জন্য জুলিয়াস সিজার সব সময় অলিভ পাতার মুকুট পরে থাকতেন, ঘুমোবার সময় ছাড়া । তাঁকে যখন সেনেটররা ছোরা মারছিলেন, তখনও তিনি মুকুট সামলাচ্ছিলেন ।
***
দে’জ থেকে একটা “হাংরি জেনারেশন সংকলন” প্রকাশিত হয়েছে, তাতে শঙ্খ ঘোষের লেখাও অন্তর্ভুক্ত ! এই সংকলনে এমন অনেকের লেখা আছে যারা হাংরি আন্দোলনের সময়ে মায়ের কোলে ছিল ।
***
চে গ্বেভারার কবর খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, তাতে ওনার কেটে নেয়া হাত দুটো ছিল না ; হাত দুটো সংরক্ষণের জন্য কিউবায় পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু সেখান থেকেও হারিয়ে গিয়েছে ।
***
যাদের বাড়ির ভেতরেই পায়খানা থাকে তাদের প্রলেতারিয়েত বলা চলে কি ?
***
বাতাসের ঘ্রাণশক্তি ঝড়কে আমিষাশী করে তোলে ।
***
দীর্ঘশ্বাস হলো রাতের উড়ন্ত একাকী দাঁড়কাক ।
***
চাষিকে খেতছাড়া, মজুরকে কারখানা-ছাড়া, গেরস্হকে ঘরছাড়া করার মাধ্যমে যারা বিপ্লব করতে চায় তারা সময়ের ল্যাঙ খেয়ে কুপোকাৎ হবেই ।
***
বাল বা ঝাঁট অনেকের কানেও হয় । তারা বেশ সন্দেহজনক ।
***
যোনির সঙ্গে প্রসববেদনার সম্পর্ক । কিন্তু বহু তরুণী প্রসবযন্ত্রণা ভোগের সুযোগ পান না ।
***
আইভিএফ করে বউ-এর বাচ্চা হয়েছে । কবির শুক্রসংখ্যা কম । উনি আর প্রেমের কবিতা লেখেন না ।
***
জার্মানির মতন ভারতেও বেশ্যাবৃত্তিকে আইনের স্বীকৃতি দেয়া দরকার । তাদের নিয়মিত ডাক্তারি পরীক্ষাও দরকার । তাহলে রেপের সংখ্যা কমবে বলে অনুমান করা যেতে পারে ।
***
ভারতে খৃষ্টধর্মীরা শবে ফরম্যালিন মাখিয়ে তিনচার বছর রেখে দিচ্ছেন, গোরস্তান পাবার আশায় । ইউরোপে কিন্তু ইনসিনারেটার প্রয়োগের সংখ্যা বেড়ে গেছে ।
***
মারাঠি কবি অরুণ কোলটকার একজন পার্সি তরুণীকে বিয়ে করেছিলেন । পার্সি সমাজ সেই বিয়েকে স্বীকৃতি দেয়নি । দুই ধর্মের বিয়েতে ব্যাগড়া দেয় দুটো সমাজ, আর এটা ভারতেই সবচেয়ে বেশি ।
***
রামকৃষ্ণ পরমহংসকে নিয়মিত চুল আর দাড়ি ছাঁটাতে হতো । চৈতন্যদেবকে নিয়মিত দাড়ি আর মাথা কামাতে হতো । 
***
রাজকমল চৌধুরীর মাহিষী গ্রামে মোষ বলি দিয়ে তার রক্ত মেখে সবাইকে নাচতে দেখে আমিও তাই করেছিলুম । পরে ব্যাপারটা যখনই মনে পড়েছে, ভেবেছি যে কেমন করে আমিও ওই পাল্লায় পড়েছিলুম ।
***
গাঁজা আর চরস ফুঁকে তার নেশায় যারা আটকে পড়ে তারা মূর্খ । ওগুলো ইচ্ছেমতো ছেড়ে দেয়া যায় । মদের নেশা ধরে ফেললে ছাড়ানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ।
***
বাবা প্রতিটি চিঠিতে লিখতেন, “ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখবি, তাহলে কেউ তোর কিছু করতে পারবে না।” মা কিন্তু কোনো চিঠিতে ঈশ্বরের উল্লেখ করতেন না । 
***
আমার মেয়ে আর নাতনিরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, গরু-শুয়োরের মাংস খায়, আফ্রিকার বুশমিট খায় । 
***
আমার ছেলে হিন্দুর যাবতীয় দেবী-দেবতায় বিশ্বাস করে, যদিও সে আর তার বউও গরু-শুয়োরের মাংস খায় ।
***
আমার স্ত্রী ভগবানে বিশ্বাস করে কিন্তু ভগবান বলতে যে কী বোঝায় তার ব্যাখ্যা করতে পারে না । গরুর মাংস খায় । খাবার পর বলতে থাকে, গরুর মাংস কেন যে খেলুম ।
***
অতিরাজসিক রাজ্যে, কী হবে চামউকুনে থিকথিকে অলিভমুকুটে ?
***
বোবার গুষ্টি ছাড়া আর কেই হলপ করে না ।
***
পাঁকে হাঁটতে যে ঘেন্না হয় তা পায়ের নয় ; তা মগজের ।
***
বুড়ো হলে মুখে জমে থাকে পরতের পর পরত বয়স, তাই তা আর রহস্যময় থাকে না ।
***
সধবার শব সাজাবার বিউটিশিয়ানরা বউ সাজাবার চেয়ে বেশি চার্জ করে মূলত দেহতাপের পার্থক্যের দরুন ।