বুধবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

কৌশিক সরকার-এর কথামৃত

 বিষয় মলয় রায়চৌধুরী : কৌশিক সরকার-এর কথামৃত


তোমাদের কাছে কবুল করতে লজ্জা নেই, আমি না লোকটা খুব -- যতই পাঙ্গা নিই না কেন -- আদতে, ষেনটিমেনটাল। আজ মলয়দার একটা পোস্ট দেখে চোখে জল এসে গেল। একা আমার নয়, আশা করি,  আরো অনেকেরই। মলয়দা এটা চাইছিলেন এমন নয়। হিড়িক দেবার মতো, পাবলিককে, খামখা, বয়স তাঁর নেই। বাপকেলে অই একজনই বুজ়উর্গ আদমি টিঁকে আছেন এই ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো, সমাজ দুনিয়ায়। কাশ এভাবে যদি সন্দীপন সুনীল শৈলেশ্বর সুবিমলদাকে পেতাম ফেসবুকে নট টু সে অ্যাবাউট কমল মজুমদার। ওঁরা অন্য এরার লোক। মলয়দা একটা অদ্ভুত কথা লিখলেন। "কত বই পড়া হয়নি। আর পড়ার সময়ও নেই।" আমি বিশ্ব ন্যাকা একটা লোক। আমোদগেঁড়ে। চোখ ফেটে জল এল। ষিনেমা দেখতে গেলেও আমার বুক ভেসে যায় চোখের জলে। চোখের জলে না বীর্যের জলে! সন্দীপনদা বলত। পিচকিরি দিয়ে জোকারের মতো কাঁদি। কমলবাবু বলতেন আমার কান্নায় যেন বাজ না পড়ে। গাছ শুকিয়ে যাক তিনি চাননি। এ হল গিয়ে রামকৃষ্ণ লাইন, উচ্চাঙ্গের নওটঙ্কি। আমি বলব, বই পড়ে সময় নষ্ট করবেন না মলয়দা। আর বই পড়াটা শুধু টেমপোরাল ব্যাপার নয়। ওটা অ্যাট দা সেম টাইম একটা টেকনিকাল কারসাজি, গ্যাঁড়াকল, উইজ়ডম। বাঙালিরা হিজিবিজি বই পড়বে। যে এখনো আরো পঞ্চাশ বছর বাঁচবে সে-ও অগ্রিম বঞ্চিত। এ শুধু অশিতিপর মানুষের দুঃখ নয়। কী পড়তে হবে সেটা কি একজন জানে! পড়তে অনেক সাহস লাগে। এখানে নিটশের পাঠকই নেই তো দেরিদা হাইডেগার। বাঙালি জাতটা স্কলারলি নয়। নট অ্যাটঅল। কোথায় এলান ভিতাল। কোথায় আমোর ফাতি। সন্দীপন তো মালদোরর বগলে নিয়ে ঘুরত। কেউ চাইলে তাকে আবার মুরগি করত। হেব্বি বৈঠকবাজি। আমি নিজের চোখে দেখেছি, সেনট্রাল অ্যাভিনউ কফিহাউসে। একাধিক লেখককে ধুর বানাতে। এমনকি শৈবাল মিত্রকে যেভাবে খোরাক করলেন। আমি মনে মনে খুব হাততালি দিয়েছি। সুবো আচার্য আরেক ধুর, লোত্রেমো চেয়েছিল। সেটা কথা নয়। অথচ সন্দীপনদা শন দো মালদোরর নিয়ে কোনোদিন কিছু লিখলো না। আসলে পড়াশোনা জারি রাখেনি। সারাজীবন শুধু আউটসাইডার নিয়েই কপচে গেল। কামু তো ছেলে ভোলানো ছড়া। তাও যদি দা ফলটা পড়ত। অথচ, উৎপল বসু ছিল এই সন্দীপনেরই ধামাধরা। মানে বইটই না পড়া ব্যাপারে। ক্ষুধার্তদেরও ঐ একই দশা। কবে শৈলেশ্বর আর্তো পড়েছে, সুভাষ ঘোষ হেনরি মিলার, বাসুদেব সেলিন কোনো চিহ্ন এমনকি সিনডার্স পর্যন্ত পাওয়া যায় না টেক্সটুয়ালিটির ভেতর। আমি মলয়দাকে বললাম, ফেসবুকে লাইভ করুন। মুখে বকে যান অনর্গল। কথাই থাকবে। ইউটিউবে আপলোড দেওয়ার লোক আছে। টকিং কিওর। ভাষা চিকিৎসা। ডাজ়াইন তো বাই ডেফিনিশন জন্ম-মরিজ। অস্তিত্বই বিমারি: নিরাময়। বকে যান। যে কথা বলে সে-ই জয়েসের কাছাকাছি। কথাই সাহিত্য। ভয়েস-বহেস। স্বর সংগ্রহ। পাখির নীড়ের থেকে খড়। হাঁসের নীড়ের থেকে খড়। স্বরই এফিজি: খোড়ো কাঠামো। জাতীয় গ্রন্থাগারে দেখা হলে যখন তাঁকে জিগেস করতাম সুবিমলদা আফসোস করে বলতেন লেখা হচ্ছে না হাতে ব্যথা। আমি বললাম, ডিকটেশন দিন। কত লোক বোর্হেসের কথা টুকে নিত। লেখক অরিজিনালি ধৃতরাষ্ট্র, পর্নস্টার, জন্মান্ধ, হোমার, একশো ছেলের বাবা, অথচ স্ত্রীযোনিই দর্শন করেনি, একেই বলে শব্দভেদী বাণ, অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ। কথাই স্কাল্পচার। সুবিমলদা বলল হাতে না লিখলে পুরোটা নিজেকে প্রকাশ করা যায় না। এসব ভুল ধারণা। টেপরেকর্ডার এক্সপেরিমেন্ট। লেখা একটা বোরিং প্রক্রিয়া। তুমি কি ওস্তাগর। ঠায় বসে ঐ নিজামের গায়ে নাচনেওয়ালির ঘাঘরায় চুমকি বসাবে! তুমি শালা শিল্পী সামুরাই। লেখা একটা মুভিং কারবার। ছবি আঁকার মতো। দূরে বসে সিগারেট টানো আর দ্যাখো, নিজের অর্ধসমাপ্ত ক্যানভাস। আর্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছাড়াও অব্যবহিত দূরত্ব দরকার। লেখা মাইওপিক। সক্রিটিস তাই কখনো লেখেনি। আপনি দরকার হলে আত্মজীবনী লিখুন। আবারও। রুশো তো চারবার লিখেছিল। এগজহসট করা যায় না আত্মঅটোপসি। সুনীলের জন্য তাই আমার বড় দুঃখ হয়। গর্ব করত ওর লেখা নাকি স্বীকারোক্তিমূলক। সব কথা কি লিখে গ্যাছে! লিখতে হবে। দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। আসুরিক টাস্ক। মানুষ সিসিফাস। সব কিছু ফাঁস করতে এসেছে। তুমি প্রমিথিউস। সুনীল আগে প্রমিথিউয়ান ছিল। তাই লিখতে পেরেছিল: গভীর রাত্তিরে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি  দেশলাই জ্বেলে, ও গাঁয়ে আমার কোনো ঘরবাড়ি নেই। কবিতা এভাবেই মিথ্যে কথা বলে যা সত্যের চেয়েও সেনসেসনাল। সব কথা বলে দিতে হবে। নিজেকে ধ্বংস করে। লেখকের কোনো মা বাপ থাকে না। সে অনাথ, বেজন্মা। তার পিছুটান কী আছে। যা কেউ করেনি আপনি তাই করুন। সব বলে দিন। পৃথিবীর শেষ বইটা আপনাকেই লিখে যেতে হবে।


শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

সৌমাল্য মুখার্জী বলেছেন

 সৌমাল্য মুখার্জী

কাব্যধর্মী গদ্য ও মলয় রায়চৌধুরীর লেখায় যা শেষ দেখেছি

______________________________________________

আমার ধারণা (যা ঠিক, বা ভুল-ও হতে পারে) :

কাব্যধর্মী গদ্য মানেই কি নিরতিশয় বিনয়, বিমূর্ত বায়বীয় তরলতা, হাওয়ার মতো নেশার মতো ভেসে যাওয়া? জোলো, খারাপ গদ্য-কে কবিতাধর্মী বলে চালানো আর কতদিন চলবে? উপর্যুপরি কবিতা (যদিও তা কবিতা নয়, অকারণ স্বপ্নাবেশ, তরল রোম্যান্টিকতা) মিশিয়ে দিলে গদ্য কবিতাময় হয়ে ওঠে না | গদ্যের ফর্ম, বিষয়বস্তু, ভিশন্, থিম, ন্যারেটিভ থেকে যদি কবিতা-টা উঠে আসে তখনই তা মিশ্রণযোগ্য | অর্থাৎ গদ্যের শরীর ও মন যদি জন্ম দেয় কবিতার, কাটা-সেলাইয়ের দাগ উবে যাবে | এবং কবিতা গদ্য-কে তরল করে না, বরং সলিড করে, নীরন্ধ্র করে, গদ্য-কে এক গাঢ়, নিরবচ্ছিন্ন শরীর দেয় | কাব্যভাষা যে গদ্য-কে ধারণ করছে তা অতনু নয়, ভীষণভাবে শরীরী। দেখেছি কেউ-কেউ কোনো উপন্যাস পড়ে বলে ওঠেন, আহা, ঠিক যেন কবিতা ! বেশিরভাগ সময়ে পড়ে দেখি উপন্যাসটা অত্যন্ত খারাপ, জোলো। কবিতা-ও নয়, গদ্য-ও নয়! কাব্যধর্মী গদ্য শেষ সম্ভবত লিখতে পেরেছেন মলয় রায়চৌধুরী। মলয় এখনো লিখে চলেছেন, ইনএভিটেবলি। যে নানাবিধ ভাঙা-গড়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে মলয় নিয়ে গেছেন নিজের গদ্যশৈলী-কে তা পাঠক দেখেছেন, দেখছেন । বঙ্কিমের 'কপালকুণ্ডলা' থেকে নবারুণের 'কাঙাল মালসাট', ন্যারেটিভে কমেন্টরির ভূমিকা নতুন নয় । কিন্তু যেভাবে মলয় ব্যবহার করেছেন কমেন্টরি-কে তাঁর সাহিত্যে, উপন্যাসে (অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা) বা গল্পে (জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা) তা নিজেকে নির্দ্বিধায় অন্য ভঙ্গি থেকে পৃথক করেছে। কমেন্টরি কথনক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেনি, তার স্থান অধ্যায়ের অন্তে নয়, ন্যারেটিভের ভিতর, কখনো সংলাপের-ও ভিতর। কাব্যধর্মী গদ্যের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মলয়ের একটা গল্প, অনেক আগে লেখা, ১৩৯১ বঙ্গাব্দে, 'বাতাসের ঘ্রাণশক্তি ঝড়কে আমিষাশী করে'। ভাষা কাব্যধর্মী। আত্মজৈবনিক কথনে লেখা। এরকম গল্প বাংলা ভাষায় আর ক'টা লেখা হয়েছে জানি না। গদ্যের কাব্যময়তা কোনো এলিয়েন এলিমেন্ট নয়। তার জন্ম হয়েছে বায়োলজিকালি। গদ্যের হাত-পা-চোখ, ভিতরে কাব্যময় স্পন্দন্দের অস্তিত্ব স্পষ্ট ঠাহর করা যায়। এবং এই গল্পের ভাষা, যে মুণ্ডহীন ভাষা-কে এখন এদিকে-ওদিকে পোস্টমডার্ন বলে চালানো হয়ে থাকে, তার প্রতি কটাক্ষ নয়, থাপ্পড় নয়, উপেক্ষা ! কে না-জানে 'আমি ও বনবিহারী' উপন্যাসে কবিতা ও গদ্যের মধ্যবর্তী স্পেস আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন সন্দীপন, মলয়ের এই স্পেস মধ্যবর্তী নয়, গদ্যের দেহ থেকে, নাভি থেকে জন্ম নেয় কবিতার ব্রহ্মভ্রূণ ।