শুক্রবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১

Allen Ginsberg's poem HOWL translated in Bengali and recited by Hungryal...

হাংরি আন্দোলন কেমনভাবে আরম্ভ হল সে কথা বলছেন মলয় রায়চৌধুরী

Malay Roychoudhury, the Hungryalist Legend, speaks about his movement at...

Malay Roychoudhury being interviewed by Abu Jubayer of Paris Zanala.

Love poem for Tagore's wife Mrinalini written by Malay Roychoudhury, rec...

মলয় রায়চৌধুরীর প্রেমের কবিতা "কাতুকুতু" মাহবুবা করিম-এর কন্ঠে

মাহবুবা করিম-এর কন্ঠে মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা "মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে ...

শনিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১

মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা সম্পর্কে রাজর্ষি দে

 নিজের পায়ে কুড়ুল মারার একটা বদভ্যাস আমার চিরকালের। আর তাই নিতান্ত গাড়লের মতন কথা দিয়ে বসেছি মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা নিয়ে একটা লেখা লিখব। মলয়্দাকেই কথা দিয়েছি আবার। সম্ভবত Notebook-এর প্রথম সংখ্যায়। কতটা অপরিণামদর্শী হলে এটা করা যায়? মানে যার কবিতা নিয়ে লিখতে বাঘা বাঘা পণ্ডিতদের শুকিয়ে যায় তাঁর কবিতা নিয়ে লিখবে আমার মতন এক অর্বাচীন “ফেসবুক কবি”। যাই হোক কথা যখন দিয়েছি লিখব তো বটেই, কিন্তু আপাতত তাঁর “যা লাগবে বলবেন” কাব্যগ্রন্থ পড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখব। মূল কাজে হাত দেওয়ার আগে হাতমকশো আর কি!
মলয়্দার কবিতা প্রথম পড়ার এক বিপদ আছে। বিপদ হোলো তরতর করে পড়ে ফেলা যায় না, কেমন যেন দরজায় ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়। অথচ তাঁর কবিতা কিন্তু সম্পূর্ণ “কাব্যময়তা” রহিত। আসলে তাঁর কবিতার শব্দগুলো পরপর যৌক্তিক কাঠামো মেনে চলতে চায় না অনেকসময়েই। “নীল চামড়ার বাঁধানো আকাশ সেখানে ধিকিধিকি ধ্বংসস্তূপ/ আগুনের ব্যারিকেড ভেঙে ঝাঁপিয়ে পড়ল তিনতলা বাড়ি”- ঘটনার সহজাত সরলরৈখিক বিন্যাস ভেঙে গেছে। কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা শেষ হচ্ছে এভাবে- “কোনো কারণ নেই, স্রেফ/ চিৎকারের জন্যে চিৎকার/ চিৎকারের ভেতরে চিৎকার”। এই যে কারণহীনতা, কার্যকারণ সম্পর্কের ভেঙে পড়া তা ছড়িয়ে আছে এই কবিতাগুলোর ছত্রে ছত্রে। যেন কবিতাগুলো হঠাৎ করে সৃষ্টি হচ্ছে কবির কলমে, আবার হঠাৎ করে লয় হয়ে যাচ্ছে। কবিতার কোনো “বক্তব্য” নেই, নৈতিক অবস্থান নেই, শুধু কিছু অভিজ্ঞতা আছে। “আমি এরকম নারীকে সঙ্গম করিনি কখনো/ স্তব্ধতা-ফাটানো চিৎকারে দুর্গন্ধের শতচ্ছিন্ন নারী জড়িয়ে ধরে”। কবিরা নাকি যে কোনো একটা সাধারণ আটপৌরে জিনিষের সূত্র ধরেই কবিতাকে খুঁজে পান। তখন আর পাঠকের কাছে সেই সূত্র সাধারণ দৈনন্দিন থাকে না। এবার এই জিনিষটাকে একটু ঘেঁটে নিন। মলয়্দার এই কবিতাগুলোয় এইভাবে কোনো দৈনন্দিন বিষয়ের সূত্র ধরে অসীম বা অরূপকে ধরার প্রচেষ্টা নেই। তিনি যেন “শিল্প”-এর কবর খুঁড়ে রেখেছেন তাঁর কবিতায়। তাঁর দৈনন্দিনতাই তাঁর কবিতা। প্রতিমুহূর্তের অতিসাধারণ বেঁচে থাকাই তো তাঁর কবিতা। যেমন হাসপাতালের আনাস্থেসিয়া- “তবু আয়েশে উপভোগ করতে থাকি অজ্ঞানতার দিকে এগোনো।” কবিতাগুলোয় বারবার ফিরে এসেছে একটাই কথা বেঁচে থাকা, প্রবলভাবে বেঁচে থাকা- “মরে যাবার কথা মোটেই ভাবি না/ যৌনক্ষমতা শেষ হয়ে যাবার ভয়ের কথা ভাবি”। বেঁচে থাকার চিৎকার, খিদের চিৎকার- এর থেকে বড় কবিতা আর কী আছে?

বুধবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২১

Malay Roychoudhury, The Stud Bull of Bengali Poetry, drawn by Kausik Sarkar


 

Malay Roychoudhury drawn by Mad Maximus of Dhaka


 

সমীর সেনগুপ্ত


 

অজিত রায়


 

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়


 

অনুপম মুখোপাধ্যায়


 

শনিবার, ৬ নভেম্বর, ২০২১

মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস সম্পর্কে সুরজিৎ সেন-এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গৌতম সেনগুপ্ত

 

মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস সম্পর্কে সুরজিৎ সেন-এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গৌতম সেনগুপ্ত গৌতম সেনগুপ্ত: মলয় কী এমন লেখক যে ওঁর লেখা পড়তে হবে ? মানে কেন পড়ব ? সুরজিৎ সেন: কী পড়ব, কেন পড়ব বা পড়ব না --- এটা পাঠকের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর অমুক জিনিস পড়তেই হবে, না পড়লে চলবে না --- এটা মডার্নিজমের সমস্যা। ইচ্ছে হলে পড়বেন, না হলে পড়বেন না।আর তাছাড়া আমি তো বাংলা সাহিত্যের জেলা-কমিটির মেম্বার নই যে গাইডলাইন অনুযায়ী ভালো-খারাপ বলতে না পারলে, আমায় কন্ট্রোল কমিশানের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তার চেয়ে একটা গল্প বলি শুনুন, দীপকদা, মানে দীপক মজুমদার, সমাজের প্রান্তবাসী অর্থাৎ মার্জিনালদের কথা বলতে গিয়ে আমায় গল্পটা বলেন। গল্পটা উনি শুনেছিলেন প্যারিসের এক ভবঘুরের কাছ থেকে। গল্পটা এরকম। দেবদূত কাথকাদ একদিন আকাশের গলিঘুঁজি পেরিয়ে, টাল খেয়ে, টপকে একটা আকাশছোঁয়া বাড়ির চুড়োয় গিয়ে দাঁড়াল। তারপর লাফ দিল নিচের অস্পষ্ট পৃথিবীর দিকে। নিচের পৃথিবী থেকে ভেসে এল অসংখ্য হাততালি, সেই সব দর্শকদের যারা ভেবেছিল এটা আত্মহত্যা। কাথকাদ ওই হাততালিকে অভিনন্দন বলে ভুল ভেবেছিল। এর পর সে আকাশচুড়ো থেকে লাফ দেয়াটাকে রীতিমত অভ্যাসে পরিণত করে ফেলল। ব্যাপারটা বুঝে শহরের মেয়র আঁতকে উঠলেন। এ-ধরণের জিনিস যদি শিশুরা নকল করতে শুরু করে ? কাথকাদকে গ্রেপ্তার করা হল। একটা দমবন্ধ-করা ঘরে রিসেপশানিস্টরা তাকে সেই চেয়ার এগিয়ে দিল, যেটা তার ডানা দুটো রাখার পক্ষে উপযুক্ত নকশায় তৈরি নয়। ইতিমধ্যে মেয়র ও শহরের অন্যান্য কর্তাবাবারা বিচার করে রায় দিল যে, কাথকাদ এক মহা চালিয়াত, তার ডানা দুটো আসলে তার পঙ্গুতারই নিদর্শন। সেই আত্মধিক্কার থেকেই লোকের নজর কাড়ার জন্যে সে এইসব কসরৎ দেখায়। সদ্ধান্ত হল: কাথকাদের গন্ডগোল আছে। ছয়ের দশকের শুরুতে মলয় কাথকাদের মতই লাফ মারেন বাংলা সাহিত্যের পৃথিবীর দিকে। ওই দশকের মাঝামাঝি বাংলা সাহিত্যের মেয়র ও অন্যান্য কর্তাবাবাদের কলকাঙিতে 'অশ্লীল' কবিতা লেখার দায়ে গ্রেপ্তার হন। এবং সিদ্ধান্ত হয় মলয়ের গন্ডগোল আছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যে. ছয়ের দশকের মাঝামাঝি, বাংলা সাহিত্য তখন যথেষ্ট সমৃদ্ধ [ অবশ্য জীবনানন্দের উপন্যাসের কথা তখনও জানি না, কমলবাবুর উপন্যাস বা আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস তখনও লেখা হয়নি], বামপন্হী আন্দোলন তখন আন্তর্জাতিক তত্ত্বের কচকচিতে ভর্তি, শিল্প-সাহিত্য তখন ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদের নিত্যনতুন থিয়রির চর্বিতচর্বণ। সব মিলিয়ে ভাবখানা এরকম, যে, পশ্চিমবাংলা মননের দিক দিয়ে ভারতের সবচেয়ে আধুনিক রাজ্য, ওদিকে সত্যজিৎবাবুরও রমরমা। কিন্তু মলয়ের গ্রেপ্তারের মধ্যে দিয়ে বোঝা গেল সমস্ত ব্যাপারটা কী সাংঘাতিক ভিকটোরিয়ান ছিল। আধুনিকতা-ফতা সব ফালতু। অনেকদিন আগে মলয়ের একটা কথা পড়েছিলাম যে, "আধুনিকতা এক ধ্রুপদী জোচ্চোর"। এর মানে আজ বুঝতে পারি। এ হল ইউরোপিয় এনলাইটেনমেন্ট প্রসূত আধুনিকতা--- যা দিয়ে শাসকপ্রভূদের কলোনিমনন তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। যাতে প্রভূদের শিখিয়ে দেয়া গাইডলাইনের বাইরে কেউ কিছু না ভাবে। মলয় বাংলা ভাষায় লেখালিখির মধ্য দিয়ে ব্যাপারটায় একটা টোকা দেন। তাতেই হৈ হৈ ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত নকশালরা এই ব্যাপারটিকে ধাক্কা দেয়। পরে অবশ্য তারা আরেক ধরণের ভিকটোরিয়ানিজমের জন্ম দেয়। যা হোক, মলয় যে তখন থেকেই মেইনস্ট্রিমের বাইরেই রয়ে গেছেন --- মানে বুঝতেই পারছেন ছয়ের দশকের মেইনস্ট্রিম আর নয়ের দশকের মেইনস্ট্রিম --- এক নয়। এই জন্যেই মলয়ের লেখা পড়া দরকার। গৌতম সেনগুপ্ত: এত মেটাফরে কথা বললে তো খুব মুশকিল। মলয়ের গল্প-উপন্যাসের বৈশিষ্টটা কী ? যেখান থেকে ওই লাফ-টাফ বা কাথকাদের কথা আসছে। সুরজিৎ সেন: মেটাফরেই তো কথা বলতে হবে। জানেন না কোথায় বাস করছি ? যাকগে, যা বলছিলুম, শাসকপ্রভূরা আমাদের জন্য তৈরি করে দিয়ে গেছেন ভাষা-কাঙামো, পদ্ধতি, বিন্যাস। এই দিয়েই যাবতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি। মলয় গল্প-উপন্যাসে শুরু থেকেই ওই মাস্টারদের তৈরি ল্যাঙ্গোয়েজ-জেল ব্রেক করে বেরোবার চেষ্টা করেছেন। কারণ লেখালিখির শুরুতেই যে ভাবেই হোক না কেন, বুঝতে পেরেছিলেন মলয়, যে, নেহেরুভিয়ান সরকারি খরচে যে বিশাল কেরানি-আমলা সমাজটির বাড়বাড়ন্ত, তাদের জন্যে উপনিবেশের ডিমটি ফেটে বেরিয়ে পড়েছেন কমার্শিয়াল কথাসাহিত্যিকরা, আধুনিকতার দুরারোগ্য ব্যাধি হিসেবে।এই মানচিত্রের বাইরে মলয় চলে যেতে পেরেছেন। অবশ্য তার মানে এই নয় যে মলয় কোনও নবদিগন্ত উন্মোচন করেছেন। কিন্তু কতকগুলো ব্যাপার আছে। লেখার ব্যাপারে মলয় কাউকে পরোয়া করেন না, এমনকি নিজেকেও নয়। লেখার মধ্যে দিয়ে তত্ত্ব বিক্রি করেন না, আর প্রগতিশীল বামপন্হী হবার লোভ কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। মলয় বোধহয় বাংলা ভাষার একমাত্র লেখক যাঁর বইয়ের কোনো কপিরাইট থাকে না। এটা উনি করতে পেরেছেন তার কারণ গল্প-কবিতা-উপন্যাস লিখে কোনওদিন কোনও লেখক-প্রতিষ্ঠা চাননি--- মানে লেখক নিজেই একটি ব্র্যান্ড নেম, তাঁর লেখার প্যাকেজিং, রিভিউ ডিজাইন, সেলেবিলিটি, মিডিয়া হাইপ--- মলয় এসব চাননি। সোজা কথায়, লিখে বাড়ি গাড়ি বউ রাঁঢ় ট্রাকটর এসব করতে চাননি। এরপর প্রশ্ন উঠবে, চাইলেই কি পেতেন ? জানি না। খুব বড় সরকারি চাকরি করতেন --- এসব নিয়ে যাতে ভাবতে না হয়। সেই মেধা, যোগ্যতা ওঁর ছিল। আর এই দুহাজার সালেও তো বাংলা গল্প-উপন্যাসের পাঠক হিসেবে ৬০ পেরিয়ে-যাওয়া মলয়ের উপরউ ভরসা করে আছি। অথচ আমি চাই আমার বয়সের (৩৮/৩৯) কোনও লেখকের উপর ভরসা করতে। পারছি কই ? কেউ তো নজরে পড়ছে না। গৌতম সেনগুপ্ত: এ তো গেল মলয়ের গদ্য ইন জেনারাল, কিন্তু 'নামগন্ধ'টা নিয়ে আলাদা করে… সুরজিৎ সেন: মলয়ের প্রথম উপন্যাস 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস', দ্বিতীয় উপন্যাস 'জলাঞ্জলি', তৃতীয় 'নামগন্ধ'--- একটা জার্নি 'ডুবজলে' শুরু হয়ে ভায়া 'জলাঞ্জলি' শেষ হচ্ছে 'নামগন্ধ'-এ। কিসের জার্নি ? না, অরিন্দম বলে একটি ছেলে খুব বড় সরকারি চাকরি করে পাটনায়, পাটনা থেকে বদলি হয়ে আসছে কলকাতায়। অবশ্য এর মানে এই নয় যে উপন্যাসগুলো আলাদা করে পড়া যাবে না। পড়া তো যাবেই; কারণ প্রতিটি উপন্যাসই স্বয়ংসম্পূর্ণ। অরিন্দম কলকাতায় আসার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের কথকতা শুরু হয়ে যায়। বালির ভোটবাগানে বজরং মার্কেটের (এশিয়ার বৃহত্তম স্ক্র্যাপ আয়রনের বাজার ) দখলদারির জন্যে একটা খুন দিয়ে উপন্যাসের শুরু। আর যা দলটি খুন করছে তাদের একজনের সবুজ টিশার্টে সাদা হরফে লাখা 'ভ্রূপল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে'। মলয় কিন্তু আমাদের চারপাশের ভায়োলেন্সটাকে সব সময় লিখছেন। আর এই উপন্যাসে রিয়েলিটি আর প্রতীকের একটা নকশা তৈরি করেছেন। রিয়েলিটি হল, আদিত্য বারিক, যে, পুলিশের এ এস আই-এর চাকরি পেয়েছে, 'ওর আদর্শ হল রুণু গুহনিয়োগী নামে একজন প্রাক্তন অফিসার, যদিও তার সঙ্গে আদিত্যর পরিচয় নেই, কিংবদন্তি শুনেছে, কাগজে পড়েছে, আদালতে গিয়ে দেখেছে সহকর্মীদের সঙ্গে, জয়ধ্বনি করেছে, যখন অযথা বিচার চলছিল লোকটার। জ্যোতি বসুর মতন কর্মজীবী মুখ্যমন্ত্রী ওব্দি রুণু স্যারের কদর করে পদোন্নতির ধাপ একের পর এক এগিয়ে দিয়েছিলেন ওনার দিকে'। ( নামগন্ধ পৃ ৫ )। আপনি তো জানেন রুণু গুহনিয়োগী কে ? কী ব্যাপার ? আর প্রতীকটা হল ওই 'ভ্রূপল্লবে...', আশা করি বুঝেছেন। এখনকার পশ্চিমবঙ্গের সার সত্যটি মলয় জানিয়েছেন এই ভাবে, 'এ এস আই-এর চাকরি পেয়ে নিজেকে সুসজ্জিত করে তোলার অভ্যাসে কিছুটা রদবদল করেছে ও, আদিত্য। এখন ও জনসনের বেবি পাউডার, বাচ্চাদের সাবান, শ্যাম্পু, শিশুদের ক্রিম আর অলিভ অয়েল ব্যবহার করে। আগেকার এক আই জি, এখন দুটো কারখানার মালিক, শিখিয়ে ছিলেন জীবনদর্শনটা। নিষ্পাপ থাকার নিজস্ব গন্ধ আছে, বুঝলে হে, পুলিশ অফিসারের উচিত সেই গন্ধটাকে সবচেয়ে আগে দখল করা। ফি বছর পুজোয় অধস্তন অফিসারদের জন্য শিশুদের ব্যবহার্য সাবান-পাউডার-ক্রিম-শ্যাম্পুর সারা বছরের কোটা উপহার পাবার ব্যবস্হা করে দিতেন উনি...। আদিত্যর এখনকার চাকরিটা মাঙনায় হয়নি। দেড় লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছিল। বাড়ি বয়ে একজন প্যাংলা ডাকমাস্টার জানিয়ে গিয়েছিল কার সঙ্গে কখন দেখা করলে চাকরিটা হবে। ডাকমাস্টারহীন বাঙালিসমাজ ভাবা যায় না। এরা থানার জন্য টাকা তোলার অঞ্চলভিত্তিক ঠিকেদারি নেয়।পুলিশে ঢোকার আগে আদিত্য জানতোই না যা তথ্য আর সংস্কৃতির এরা বাঙালিজীবনে চাবিকাঠি' (নামগন্ধ পৃ ৭)। উপন্যাসের অন্যতম মহিলা চরিত্র খুশি, ভারতের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে যার বয়স পঞ্চাশ। খুশি তার নিজের দাদার বাড়ি চাকরানী হয়ে বন্দি। দাদা ভবেশ এখন গ্রামের রাজনীতির দন্ডমুন্ডের কর্তা। খুশির আজও বিয়ে হয়নি। প্রথম বিয়ের সম্বন্ধ হয় ১৯৭১ সালে, হবু বরের মুণ্ডহীন ধড় পাওয়া যায়--- সে নাকি নকশাল ছিল। দ্বিতীয় হবু বর সফল আড়তদার হঠাৎ পুড়ে মারা যায়। শেষ অবধি পূর্ব পরিচিত যিশু বিশ্বাস খুশির প্রেমে পড়ে তাকে দাদার হাত থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে ডাকাত সন্দেহে গণপ্রহারে মারা যায় গ্রামবাসীদের হাতে। খুশি যেন আমাদের ভারতবর্ষ। যারাই তাকে উদ্ধার করতে যায় তাদের কপালে বোধহয় অপঘাতে মৃত্যুই লেখা আছে। অরিন্দম বর্ণহিন্দু, আদিত্য নমশূদ্র, যিশু খ্রিস্টান । উপন্যাসের শুরুর খুনের পরেই আমরা দেখি ১৮/১৯ বছরের একটা ছেলেকে একদল লোক পিটিয়ে মেরে ফেলছে এবং তারপর 'ছেলেটা মরে গেছে নিশ্চয়। তবু ওকে পিটিয়ে যাচ্ছে লোকগুলো। মৃতদেহ পিটিয়ে তার জীবন্ত অতীতের সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা খুঁজছে লোকগুলো। অরিন্দম পড়ে গেছে সেই ভাষাসন্ত্রাসের খপ্পরে'।(নামগন্ধ পৃ ৭)।আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসীরাও কিন্তু এই ভাষাসন্ত্রাসের খপ্পরে পড়ে গেছি। ইংরেজরা লুটে-পুটে খেয়ে, ভাষার কিছু প্রণালিবদ্ধ কাঠামো অন্যান্য উচ্ছিষ্টের সঙ্গে আমাদের জন্য রেখে যায়।যেমন ইংরেজি Bitter Experience শব্দটির বাংলা হল 'তিক্ত অভিঞ্জতা' । মানে খুব খারাপ কিছু প্রত্যক্ষ বা অনুভব করা। অথচ আমাদের বাঙালি জিভে উচ্ছে নিম করলা সুক্তো--- এই সব তিক্ত স্বাদ বা অভিঞ্জতা খুবই উপাদেয়। যেহেতু সাহেবরা Bitter Experience বলতে খারাপ কিছু বোঝায়, তাই আমাদের ভাষাবিদরাও খারাপ কিছু বলতে 'তিক্ত অভিঞ্জতা'ই বুঝেছেন। ছোটগল্প-উপন্যাস বলতে কী বোঝায়, অক্সব্রিজসরবনের সাহেবরা যেমন-যেমন বলে গেছেন, আমাদের শিক্ষকরা বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছেন। আজ সেই মৃত ভাষাটিকে হাজার পিটিয়েও তার জীবন্ত অতীতের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ তৈরি হচ্ছে না। মলয় তাঁর লেখালিখির শুরু থেকেই এটা ধরতে পেরে সেটাকে ফাঁসিয়ে দেবার চেষ্টা করে গেছেন বরাবর। 'নামগন্ধ'ও তার ব্যতিক্রম নয়। আর রসবোধ--- যেটা বাংলা লেখালিখিতে ক্রমশ বিরল হয়ে এসেছে, সেটার একটা চমৎকার সূক্ষ্ম ব্যবহার মলয় করেছেন তাঁর উপন্যাসগুলোয়। এমনিতে মলয়ের লেখার কোনো মডেল নেই। চরিত্ররা নিজেরা নিজেদের গুরুত্বহীনতায় ভোগে, ভঙ্গুর, টাল-খাওয়া, পোস্টকলোনোয়াল মতদ্বন্দ্বের, জটিলতার, আলাপচারিতা--- এই হল মলয়ের লেখা। এই ভঙ্গীটা আমাদের ভাষায় নেই বললেই হয়। আর এই জায়গা থেকেই জমে যায় মলয়ের উপন্যাস। 'হিমঘরের পিওনটাও চড়া দামে বন্ড কেটেছে ইউনিট ম্যানেজারের চোখের সামনে। পিওনটা গ্রুপ থিয়েটার করে। ওদের নাটক দলটার নাম প্রতিবাদী সভা। একাডেমিতে নীলদর্পণে ভালো অভিনয় করেছিল'--- ( নামগন্ধ পৃ ৯৫ ) ক্লাস।এই হিমঘর---আলু চাষির দুর্দশা---আলু পচে যাওয়া---বামপন্হীদের বদমাইসি--- এই সব পাবেন 'নামগন্ধ' উপন্যাসে। সত্যিই একটা নিষিদ্ধ পশ্চিমবঙ্গের ছবি। আম কেমন খেতে সেটা শোনার চেয়ে খেয়ে দেখা ভালো--- সোজা কথা, উপন্যাসটা পড়ে ফেলুন।

শনিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২১

বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায় : মলয় রায়চৌধুরীর পৌরুষ

 

বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায় : মলয় রায়চৌধুরীর পৌরুষ ----------------------------------------- মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে হঠাৎ লিখছি কেন? এইজন্যে নয় যে আমার বই বেরোচ্ছে, আর বইএর ব্লার্বে তিনি যাচ্ছেতাই রকমের ভালো লিখে দিয়েছেন। সে তিনি অমনিও লিখতেন। (কাজ আদায় হয়েই গিয়েছে ) আমায় স্নেহ করেন, ভালোবাসেন একটু। আমি তাঁর বেশ-বয়সের অবন্তিকাদের মধ্যে একজন। ডিট্যাচড, পড়ুয়া, চোখে চশমা আঁটা, উচ্চাশী অবন্তিকা। তিনি আমার পিতৃপ্রতিম। জাগতিকে তাঁকে তেমনই ভালোবাসি। আর অন্য এক জায়গায় তাঁকে ভালোবাসি, যেমন ক’রে তাঁর অসাধারণ উপন্যাস “ডিটেকটিভ নোংরা পরীর কঙ্কাল প্রেমিকে”, অনেক আগে মরে যাওয়া কঙ্কালকে, এক বৃদ্ধের কংকালকে, তার জীবনের কনসেপ্টকে ভালোবেসে ফেলেছিল ইন্সপেক্টর রিমা খান। কেন? সেই গণিতবিদ, উৎশৃংক্ষল কংকালের পৌরুষের জন্য। আমি এই অদ্ভুত আখ্যানটি লিখছি কারণ, কবে এই কিংবদন্তীস্বরূপ বৃদ্ধ ফট ক’রে মরে যাবেন। এখনো দেখা করিনি। ফোন করিনি। যদি মরে যান, একা ফ্ল্যাটে ছটফট করবো শোকে। সেই ভয়ে, এখন কিছু দিয়ে রাখা। টিকে যেতেও পারেন অনেকদিন আরো। ভীষণ জীবনীশক্তি। জীবনকে ভালোবেসে চুষে খাবার ইচ্ছে। মলয় রচৌকে দাদা বলার দূরভিলাষ হয় নি কখনো আমার। এই গ্যালিভার কেন যে লিলিপুটের সংসারে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টায় সারা শরীরে তাদের মই বেয়ে উঠতে দেন, সেই নিয়ে আমার এক চাপা ক্ষোভ ছিল। ইনি ভীষন পণ্ডিত। বাকি বড় বড় কবিদের মতো দূর থেকে কিছু কিছু জ্ঞানের কথা লিখলেই লোকে আশেপাশে ঘুরতো বেশী বলে আমার বিশ্বাস। তাও আমাদের মতো নতুন শিঙওলাদের, এবং আমাদের চাইতেও আরো আরো খাজা জনগণকে উনি প্রশ্রয় দেন। এই মার্কেটিঙের স্টাইলটা আমার পছন্দ নয়। কিন্তু পুরুষালী কড়া মদের মতো তীব্র আত্মবিশ্বাসে উনি যে এটা ক’রে যান, প্রচণ্ড টেক-স্যাভি, সরাসরি, আড়ালহীন প্রচার, এটাও আমার আজকাল ভালই লাগে। তাঁর হাত দিয়ে যে কবিতা বেরিয়েছিল, (“প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ১৯৬৩ সালে ভারতীয় কবি মলয় রায়চৌধুরী রচিত ৯০ লাইনের একটি জলবিভাজক কবিতা। কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে হাংরি বুলেটিনে।প্রকাশের পর সাহিত্যে অশ্লীলতার অভিযোগে কবিতাটি নিষিদ্ধ করা হয়। ভারতীয় আদালতে হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তিনটি ধারায় মামলা হয় এবং মলয় রায়চৌধুরীসহ অন্যান্য আন্দোলনকারী গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে মামলাটি নাকচ হয়ে যায়। মামলা চলাকালীন সময়ে আমেরিকা ও ইউরোপে মলয় রায়চৌধুরীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে, এবং বিভিন্ন ভাষায় কবিতাটি অনুদিত হয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত 'মর্ডান অ্যান্ড পোস্টমর্ডান পোয়েট্রি অফ দ্য মিলেনিয়াম" সংকলনে দক্ষিণ এশিয়া থেকে একমাত্র কবিতা হিসেবে এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।” (উইকিপিডিয়া থেকে)), সেই কবিতা কারোর হাত থেকে বেরোনো শক্ত। সারা পৃথিবীর কবিতাপ্রেমী তা জানে। আমি আর তা নিয়ে বলি কেন। ওরকম একটা কোনদিন নামাতে পারলে বুঝতাম, হুঁ, কিছু করা গেলো। হবে না। সে আধার নেই আমার। তাই বলে ওনার এখনকার অনেক কেমন-যেন কবিতাকে লাইক টাইক দিতে পারি না। প্রয়োজনও নেই। যার এত উপন্যাস আছে, তাকে কেবা কবিতায় যাচে? মলয় রচৌএর উপন্যাসগুলি ভীষণ ভীষণ আণ্ডাররেটেড। বাংলা সাহিত্যে ঠিক ওরকম উপন্যাস বেশি লেখা হয় নি। ভালোয় মন্দে শুধু না, অদ্ভুত অন্য ধারার জন্য। কেন লেখা হয় নি তার বড় কারণ আমার মতে এই যে, ওরকম টেস্টোস্টেরন সম্বলিত প্রেমিক পুরুষ খুব বেশী নেই মনে হয় বাংলা সাহিত্যজগতে। এই জগতের ক্যাচাল আমি তেমন জানি না। কিন্তু মলয় রচৌ, মাঝে মাঝেই কাজের মেয়ে না এলে স্ত্রীএর সঙ্গে মন দিয়ে রান্নাবান্না বাসনমাজা, কাপড় কাচা ইত্যাদি করে ফেলেন। করার তো কথাই। জানি না তিনি জীবনে কতটা বিশ্বাসী অবিশ্বাসী ছিলেন সামাজিক অর্থে। খালি জানি, ইনবক্সে যখন কোন প্রশ্নের উত্তরে বলেন “বলে ফ্যাল । আজকে কাজের বউ আসেনি । বুড়ো-বুড়িকে অনেক কাজ করতে হবে । লাঞ্চে খিচুড়ি । ডিনারে প্যাটিস।”, কি ভালো যে লাগে! এই বুড়ি, যাঁকে আমি খালি ছবিতে দেখেছি, একসময়ের দাপুটে হকি খেলোয়াড়, তাঁকে এই “অ-কংকাল প্রেমিক” ভীষণ দাপটে ভালোবেসে গেছেন, এমন একটা ছবি বেশ মনে মনে আঁকতে পারি, এঁকে ভালো লাগে। মলয় রচৌএর উপন্যাসের পুরুষদের মতো প্রেমিক আমি বাংলা উপন্যাসে কম দেখেছি। তাঁর “ডিটেকটিভ নোংরা পরির কংকাল প্রেমিক” উপন্যাসে, এক গণিতবিদ, বহুগামী অবিবাহিত পুরুষ, হঠাৎ এক স্বল্পপরিচিত সহকর্মী মহিলার “চলুন পালাই” ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গিয়েছিলেন বিন্ধ্যপর্বতের অন্য দিকে, তামিল দেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। নাগরিক সভ্যতার থেকে পালাতে চেয়েছিলেন এই উচ্চশিক্ষিতা তরুণী মায়া, আর মায়ার ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকে গেছিলেন সেই গণিতবিদ। এই উপন্যাসটি ছোট্ট, গোগ্রাসে গেলার মতো, নানান ভাবে রগরগে, আর নানান ভাবে ভীষণ ভীষণ সেরিব্রাল, মস্তিষ্কপ্রবণ। এই উপন্যাসে, জঙ্গুলে জীবনে ফিরতে চাওয়া মায়ার ঋতুস্রাবকালে, তাকে নিজ হাতে ধুইয়ে দিয়েছে তার প্রেমিক। অথচ দুজনে দুজনকে ডেকেছে “আপনির” দূরত্বের পবিত্রতায়, নিজেদের স্বত্ত্বাকে আলাদা বোঝাতে, “পবিত্রতার মতো অস্পষ্ট” শব্দকে ধূলিসাৎ করেও। এই উপন্যাসটির একটি রিভিউ আমি আগেও করেছি। বিশদে যাবো না। শুধু, এই প্রেমিকের প্রতি আমার গভীর মায়া যে বলে “চাল-পোড়া তো খাওয়া যাবে না , তাই মায়া চাল দাতাকে অনুরোধ করেছিল যে আমাদের একমুঠো ভাত দিলেই চলবে, কাঁচকলা পোড়া বা কাঁঠালবিচি পোড়া দিয়ে খেয়ে নেয়া যাবে, লঙ্কার টাকনা দিয়ে । প্রায় প্রতিদিনই ভাত পেতে লাগলুম , যদিও কলকাতায় যা খেতুম তার চেয়ে অনেক কমই, কিন্তু কম খেয়ে আর রাতে না খেয়ে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছিল কম খাবার । আমি চাইতুম মায়া বেশি খাক, মায়া চাইত আমি বেশি খাই । আমি একদিন বলেই ফেললুম, প্রকৃত ভালোবাসা কাকে বলে জানি না, কেবল যৌনতাই জেনে এসেছি এতকাল, আপনি ভালোবাসতে শেখালেন। জবাবে মায়া বলেছিল, অতীতকে আনবেন না প্লিজ, আপনি কী ছিলেন, কী করেছিলেন, সব ভুলে যান, সমস্তকিছু মুছে ফেলুন, আমি কি কোনো স্মৃতিচারণ করেছি?”। বা যে বলে “জীবনের বাঁকবদলগুলো, যতবার ঘটেছে বাঁকবদল, সব সব সব সব নারীকেন্দ্রিক ; নারীর ইচ্ছার, নির্দেশের, দেহের, আকর্ষণের, রহস্যের মোহে । স্কুলের শেষ পরীক্ষায় ভাল, সান্মানিক স্নাতকে খুব-ভাল , স্নাতকোত্তরে অত্যন্ত ভাল, তাদেরই কারণে , প্রভাবে, চাপে, আদরে । চাকরিতে যোগ নারীর জন্যে উন্নতি নারীর জন্যে, চাকরি ছাড়া নারীর জন্যে , ভাসমান জীবিকা নারীর জন্যে , অবসরে পৈতৃক বৈভবে পরগাছাবৃত্তি নারীর কারণে । কে জানে, হয়তো মৃত্যুও নারীর হাতেই হবে । জীবনে নারীদের আসা-যাওয়া, সেনসেক্স ওঠা-পড়ার মতন, না ঘটলে, আমার ব্যর্থতা, ব্যথা, পরাজয়, গ্লানি, অপরাধবোধ, এ-সবের জন্যে কাকেই বা দায়ি করতুম ! কাকেই বা দোষ দিতুম আমার অধঃপতনের জন্যে ? লোভি লম্পট মাগিবাজ প্রেমিক ফেরারি হয়ে ওঠার জন্যে ? হবার, নাকি হয়ে ওঠার ? আসলে আমি একটা কুকুর । আগের সিডিতে লিখেছি, তবু রিপিট করছি শেষনির খাতিরে । যে-মালকিনির হাতে পড়েছি , সে য-রকম চেয়েছে, যে-রকম গড়েছে , তা-ই হয়েছি । সেবার কুকুর, কাজের কুকুর, প্রজননের কুকুর, গুপ্তচর কুকুর, ধাঙড় কুকুর, কুরিয়ার কুকুর, প্রেডাটার কুকুর, পাহারাদার কুকুর, মানসিক থেরাপি কুকুর, শোনার কুকুর, শোঁকার কুকুর, চাটার কুকুর, রক্ষক কুকুর, গাড়িটানার কুকুর, কোলের কুকুর, আদরের কুকুর, এই কুকুর, ওই কুকুর, সেই কুকুর ইত্যাদি । কিন্তু একমাত্র কুকুর যেটাকে আমি ভালবেসেছি, তা হল মালকিনিকে উন্মাদের মতন ভালবাসার কুকুর । কিন্তু আমার লেজটা জন্মের সময়ে যেমন আকাশমুখো ছিল , চিরকাল তেমনই থেকে গেছে।”। আমি নিশ্চিত যে, মলয় রচৌও এরকমই আকাশমুখো লেজের কুকুর। তিনি প্রবলভাবে, ভিতর থেকে, লিঙ্গসাম্যে বিশ্বাসী। “অরূপ, তোমার এঁটো কাঁটা” উপন্যাসে তিনি যে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মহিলা চরিত্র বানিয়েছেন, যে লোভে লালসায়, ভালোবাসায়, প্রতিশোধে, ভীষণ রকম জীবন্ত ও অসহায়, মেয়েদের সবটুকু নিয়ে সবটুকু দিয়ে ভালো না বাসতে পারলে, রূপের মধ্যে ওরকম অরূপ, আর তার এঁটো কাঁটাসহ মচ্ছগন্ধ ধরে রাখা যায় না। এখানেই মলয় রচৌএর পৌরুষ। যে রকম পৌরুষ “দেহি পদপল্লবম উদারম” এর মতো উদাত্ত হাঁক দিতে পারতো জয়দেবের কালে, পারে একালেও। তাঁর “ছোটোলোকের ছোটোবেলা” আর “ছোটোলোকের যুববেলা” তেমনই অকপট, দাপুটে, উজ্জীবিত, ভিগরস। নিজেকে বিশ্রেণীকরণ করেছেন শুধু জোর করে নয়। তিনি সেরকম হয়েও উঠেছেন। তাঁর মেজদার জন্মরহস্য পড়ে এক একবার মনে হয়েছে, সবটা বলে দেওয়া কি তাঁর ঠিক কাজ হয়েছে পরিবারের প্রতি? আবার এক একবার মনে হয়েছে, বেশ করেছেন, ঠিক করেছেন। বিহারের প্রান্তিক মানুষের জীবন, তাঁর লেখায় দারুণ উঠে এসেছে। “ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস” উপন্যাস যেমন লিরিক্যাল কোথাও কোথাও, তেমনই, গভীর রাজনৈতিক চেতনায় প্রোথিত। তাঁর অনেক উপন্যাসই তাই। খুব কাটাকাটা, খুব ন্যাকামোহীন, নির্মোহ, নিজের প্রতিও, নিজের নায়কদের প্রতিও, অনেকটা নায়িকাদের প্রতিও। এরকম ধারাবিবরণী বাংলায় লেখা কম উপন্যাসেই আছে। খানিকটা সমরেশ বসুর “যুগযুগ জীয়ে”তে কাছাকাছি কিছু স্বাদ পাই। তাও, এই উপন্যাসগুলি লেখার ধরণে অনেক আলাদা। আর এই সবের পরেও রচৌকে জিগালে, তাঁর সব জীবনদর্শনের মধ্যে, সব ছাপিয়ে, হয়তো কৈশোরের ভুবনমোহিনী রাণা উঠে আসবে, প্রথম চুমুর টেণ্ডারনেস নিয়ে। কিশোর পুরুষে। এই লেখাটা আবেগতাড়িত। খাপছাড়া। কর্মক্লান্ত দিনের শেষে রাত দেড়টা থেকে তিনটের মধ্যে আজ লিখবোই, বলে লিখে ফেলা। পরে হয়তো সংশোধন করবো আরো। উপন্যাসগুলোর, প্রবন্ধগুলোর, কবিতাগুলোর, ইদানীং লেখা ওনার কিছু কেমন-যেন-ভাল-না কবিতাগুলোও আলোচনা করা যাবে আরো কিছু। তবে এই লেখা অনেকাংশে ব্যক্তিগত ভাবের লেখা। তাই এভাবেই অকপটে লিখছি। আমার গবেষণাপত্রটি যখন শেষও হয় নি, রচৌ আমাকে তখনই খুব উতসাহ দিতেন। আমাকে নিয়ে তাঁর যে অবন্তিকা, তা তখনই লেখা। পরে যখন গবেষণাপত্রটি বেরোলো, আমার ক্ষীণ অনুরোধ থাকা সত্ত্বেও, ফেসবুকে প্রায় সাতশোবার শেয়ার হওয়া এই লেখা, এবং আরো অনেকবার শেয়ার হওয়া লেখার নানান রেফারেন্স কিছুতেই টুইটারের মুখ দেখলো না বাঙ্গালি সমাজে। অথচ টুইটার কাউণ্টই জার্নাল মেট্রিক গ্রাহ্য করে। এই অশীতিপর বৃদ্ধ তখন, না বলতেই, বহুবার, চুপচাপ, এন্তার লোককে, সংস্থাকে ট্যাগ করে, টুইট করেছেন আমার গবেষণার লিংক, বহুদিন। ভালোবাসি কি সাধে? আমি যখন ভুলভাল কবিতা লিখতাম, একেবারে বাজে লিখতাম, একবার ওনাকে বলেছিলাম, “এই ছাপোষা জীবন! কোথাও যাই না। চাকরি, ছেলে, আর পড়াশুনো। কবিতায় প্রেমের, পৃথিবীর, মানুষের হাওয়া লাগবে কী করে?”। উনি দুকথায় বলেছিলেন “এটা কোন কাজের কথা না। লিখে যাও। হবে”। তারপর বলেছিলাম, “এখন চাকরি, গবেষণা (গবেষণা না ছাই)। সাহিত্য বাকি পরে পড়বো”। উনি বলেছিলেন, “এটা কোন কাজের কথা না। কমবয়সে না পড়লে রেসেপটিভিটি থাকে না, এখনই পড়তে হবে”। এই দুটো আপাতঃসাধারণ কথা, ওনার গম্ভীর পৌরুষের জোরেই, আমায় পালটে দিয়েছিল অনেকটা। এখন হাবিজাবি যা একটু লিখি, মনের দরজা খুলে গেছে তাই। মলয় রচৌরা বাংলাভাষাকে স্পর্ধা আর সাহস এনে দিয়েছিলেন। আমাকে, আমাদের এখনো সেই সাহস ভাঙ্গিয়েই খেতে হয়। আমাকে নিয়ে লেখা সেই কবিতাটা- বহতা অংশুমালী, তোর ওই মহেঞ্জোদারোর লিপি উদ্ধার কী গণিত কী গণিত মাথা ঝাঁঝা করে তোকে দেখে ঝুঁকে আছিস টেবিলের ওপরে আলফা গামা পাই ফাই কস থিটা জেড মাইনাস এক্স ইনটু আর কিছু নাই অনন্তে রয়েছে বটে ধূমকেতুর জলে তোর আলোময় মুখ প্রতিবিম্ব ঠিকরে এসে ঝরে যাচ্ছে রকেটের ফুলঝুরি জ্বেলে কী জ্যামিতি কী জ্যামিতি ওরে ওরে ইউক্লিডিনি কবি নিঃশ্বাসের ভাপ দিয়ে লিখছিস মঙ্গল থেকে অমঙ্গল মোটেই আলাদা নয় কী রে বাবা ত্রিকোণমিতির জটিলতা মারো গুলি প্রেম-ফেম, নাঃ, ফেমকে গুলি নয়, ওটার জন্যই ঘামের ফসফরাস ওড়াচ্ছিস ব্রহ্মাণ্ড নিখিলে গুণ ভাগ যোগ আর নিশ্ছিদ্র বিয়োগে প্রবলেম বলে কিছু নেই সবই সমাধান জাস্ট তুমি পিক-আপ করে নাও কোন প্রবলেমটাকে সবচেয়ে কঠিন আর সমস্যাতীত বলে মনে হয়, ব্যাস ঝুঁকে পড়ো খোলা চুল লিপ্সটিকহীন হাসি কপালেতে ভাঁজ গ্যাজেটের গর্ভ চিরে তুলে নিবি হরপ্পা-সিলের সেই বার্তাখানা হাজার বছর আগে তোর সে-পুরুষ প্রেমপত্র লিখে রেখে গেছে মহেঞ্জোদারোর লিপি দিয়ে ; এখন উদ্ধার তোকে করতে হবেই বহতা অংশুমালী, পড় পড়, পড়ে বল ঠিক কী লিখেছিলুম তোকে– অমরত্ব অমরত্ব ! বহতা অংশুমালী, বাদবাকি সবকিছু ভুলে গিয়ে আমার চিঠির বার্তা তাড়াতাড়ি উদ্ধার করে তুই আমাকে জানাস ------------------------------------------------------ লেখায় বানান ভুল আছে নিশ্চই। কাল ঠিক করবো। কত কথা বাদ গেলো। পরে ঢোকাবো। কিন্তু অনেক সন্তানের বৃদ্ধ পিতাকে প্রস্টেটের ওষুধ খাওয়াতে খাওয়াতে সবচে’ ছোট মেয়েটা যেমন পৌরুষের বেঞ্চমার্ক তৈরি ক’রে মনের মধ্যে সেই বেঞ্চমার্কের উপরের রাজকুমার খোঁজে, তেমনই এই অশীতিপর পিতৃপ্রতিমকে দেখি। আর যেমন ক’রে রিমা খান কঙ্কাল প্রেমিককে ভালোবাসে, ভালোবাসি এঁকে। স্বধর্মে স্থিত, অতি প্রচারমুখী, ঝপঝপ কমেণ্ট ক’রে মুশকিলে ফেলে দেওয়া স্নেহার্দ্র, প্রবাদপ্রতিম পুরুষ। আমাদের খুব কাছে আছেন বলে, বড় বেশি ছোঁওয়া লেগে গেলো। দূরে চলে গেলে, মানুষ বুঝবে, গেলো কেউ। আর আমরা কেউ কেউ, একা ফ্ল্যাটে হাপসে কাঁদবো।

শনিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২১

Six Haikus by Malay Roychoudhury translated by Arunava Sinha

 Translated by Arunava Sinha

Six haikus: 
 
Spring in netherland
Swarms of bees knock at the door
The girl's floating corpse
~
Leaning out to see
The sky spread across the wind
Taillights just like blood
~
Her hands on her hips
Emperor Ashoka weeps
Black and freezing rocks
~
Crematorium
Coils of smoke and darting shrimps
The Buddha walks by
~
Someone's dead body
Hanging from the ceiling fan
There's a male spider
~
Memories of thieves
Tagore's slippers on the shelf
Much too large in size

শুক্রবার, ২৭ আগস্ট, ২০২১

"নামগন্ধ" উপন্যাস বিশ্লেষণ করেছেন অজিত রায়

 

“নামগন্ধ” উপন্যাস বিশ্লেষণ করেছেন অজিত রায়
মলয় রায়চোধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় পঁয়ত্রিশ বছর আগে। সামান্য অভূয়িষ্ট পড়াশোনা থেকে ক্ষুধিত প্রজন্মের কবি ও কবিতা নিয়ে একটা আচাভূয়া লেখা লিখেছিলাম ১৯৮২ সনে, এক মফস্বলী কাগজে, সেই তখন। এবং, সেই শুরু। সেদিনের সেই সব্রীড় আত্মপ্রতর্ক থেকে প্ররোচিত হই মলয়-সিসৃক্ষার কলিন অধ্যয়নে। ততদিনে, তার বিশ বছর আগেই হাংরি আন্দোলনের অন্যতম এই স্রষ্টার নখদন্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের শরীরে কিছু পিরেনিয়্যাল আঁচড় কেটে ধাবাড় মেরে গেছিল। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫-কেই বলা যায় হাংরি আন্দোলনের সবচেয়ে উত্তেজনাকর আর ঘনাবহুল অস্তিত্বকাল। যদিও জেব্রা উপদ্রুত ক্ষুধার্থ ফুঃ প্রতিদ্বন্দ্বী স্বকাল চিহ্ন উম্মার্গ ব্লুজ প্রভৃতি কাগজকে ঘিরে পাশাপাশি দেবী রায়, ফালগুনী রায়, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, সুভাষ ঘোষ, শম্ভু রক্ষিত, সুবো আচার্য, ত্রিদিব মিত্র প্রমুখেরা গড়ে তুলেছিলেন হাংরি সিসৃক্ষার আরেকটি চক্র। এবং আন্দোলনের উত্তেজনা থম মেরে গেলেও, তারপরেও সেই সব সেরকশ আর গেঁতো মৌমাছি, প্রাগুক্ত পত্রিকাগুলিকে আঁকড়ে ধরে কিছু কাল শর্করীবাজি চালিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু আসর আর জমেনি।
এহেন বিশাল ব্যবধানে, এই প্রেক্ষিতে কুড়ি-বাইশ বছর আগে বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত সংস্কারের বিরুদ্ধে, তার পচা ভিত্তিকে উৎখাত করার একান্ত অভীপ্সায় দুর্বিনীত আসব যিনি করেছিলেন, সেই মলয় রায়চোধুরী বিশ বছর বাদে লেখালেখির জগতে প্রত্যাবর্তন করতে চাইলে তাঁর কাছে প্রধান সমস্যাটা কী হতে পারে? এমনিতে পঞ্চাশের কবিরা যাঁরা হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন, আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর নিজেদের চরিত্র মোতাবিক লিখে আসছিলেন। শক্তির এতোলবেতোল জীবন শুরু হয়ে যায় আর তিনি রূপচাঁদ পক্ষী হয়ে যান, সন্দীপন একটা নির্দিষ্ট গদ্যে রেওয়াজ করতে করতে নিজস্ব শৈলীতে থিতু হন। বিদেশ থেকে ফিরে উৎপল বসুও কাব্যচর্চার নবাঞ্চল অব্যাহত রাখেন। ষাটের কবি হিশেবে অশোক চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, অরনি বসু, শম্ভু রক্ষিত, প্রদীপ চোধুরী প্রমুখের লেখালেখি থেমে থাকেনি এবং দেখা গেছে বয়স, অভিজ্ঞতা ও সিরিয়াসনেসের দরুন এঁদের কেউ কেউ খুঁজে পেয়েছেন নিজস্ব ফর্ম, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে একজন আলাদা হয়ে উঠেছেন অন্যজনের থেকে।
মলয়ের কেসটা এঁদের চেয়ে আলাদা। এবং আপাত জটিল। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির পীঠস্থান হিশেবে বিজ্ঞাপিত কলকাতার ধুলো মলয়ের পায়ের চেটোয় সেভাবে লাগেনি। কলকাতার একটা পুশিদা ক্লোমযন্ত্র আছে যা বামুন আর চাঁড়ালকে শুঁকে চিনতে পারে। কলকাতা মলয়কে নিজের দাঁত দেখিয়ে দিয়েছিল। কলকাতা তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, তুমি আমাদের কেউ নও। তুমি একটা কৃষ্টিদোগলা। তোমার কলমে নিম্নবিত্ত রক্ত। তোমার টেক্সট আলাদা। আলাদা থিসরাস। তফাৎ হটো তুমি। এবং, কলকাতা মলয়ের সঙ্গে সমস্ত শরোকার ছিন্ন করে। কোনও সম্পাদক তাঁর কাছে আর লেখা চান না, বন্ধুবান্ধবদের চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায় এবং ক্রমশ সবাই স্লিক করে যায়। লেখা ছাপানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই বীভৎস যন্ত্রণা, অপমান আর তিরস্কার একমাত্র কলকাতাই দিতে পারে। এই যন্ত্রণা, এই অপমানই লেখালেখি থেকে নির্বাসন ভোগের আরেক অব্যক্ত যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দিয়েছিল মলয়কে। ২৭ জুলাই ১৯৬৭, মানে, হাইকোর্টের রায়ে বেকসুর খালাস পাওয়ার পরদিন থেকে মলয় কবিতা লেখা ছেড়ে দেন। সবায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়, আর ক্রমশ নিজেকে অসীম একাকীত্বে ঘিরে ফেলেন। প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানের দুর্গদ্বার থেকে অপরিগৃহীত হয়ে লেখার জগৎ থেকে একান্তে অপসৃত হয়ে স্বরচিত নির্জনতার এক সুচারু এরিনায় নিজেকে বন্দী রেখে, রাইটার্স ব্লকের অখল জ্বালা ভোগ করা ---- হাংরিদের মধ্যে এটা একমাত্র মলয়ের ক্ষেত্রেই ঘটেছে।
আত্মবিবাসনের সেই বিবিক্ত দিনে, ১৯৬৮-র ডিসেম্বরে শলিলা মুখার্জির সঙ্গে উদ্বাহ সাময়িক স্বস্তি ফিরিয়ে আনে তাঁর জীবনে। জীবন নামক ভেলকিবাজ বারে-বারে মানুষকে ষাঁড়ের গোবর করে। চটকায়। ঘুঁটে বানিয়ে শুকোতে দেয়। আবার, পেড়েও আনে। জীবন লিখেওছে এমন এক ফিচেল কেলিকিন, যে কবিতা বোঝে না। মন বোঝে না। আদর্শ বোঝে না। আলোপিছল প্রতিষ্ঠানের মসৃণ করিডর দিয়ে হাঁটিয়ে সটান তুলে দেয় আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য আর কর্তৃত্বের সুনিপুণ এলিভেটারে। অর্থাৎ 'একদা আপোষহীন' পরে 'অংশভাক' এই ঐতিহাসিক গল্পের পুনরাবৃত্তি মলয়ের জীবনে ঘটাল সেই নর্মদ। এই ট্রাজেডির জন্যে আমরা ইতিহাস আর সময়কে বাদ দিয়ে বরাবর ব্যক্তিকে দায়ী করি, তাকে ব্যক্তির

 ট্রাজেডি হিশেবে চিহ্নিত করে সৌমনস্য উপভোগ করি, সে আমাদের প্রবলেম।
কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এক অনৈতিহাসিক তত্ত্ব। এ-খবর সত্যি যে বিবাহোত্তর প্রবাসে কিছুদিনের জন্যে এলিট সংসারী হয়ে উঠেছিলেন মলয়। সৃজন, সাহিত্য, বইপড়া, বাংলা ভাষা ইত্যাদি থেকে আরও দূরে সরে 

থাকবার মতো সরঞ্জাম তখন মজুত। মৎসরী বন্ধুরা হয়তো এই জেনে 

কিঞ্চিৎ আরামও উপভোগ করেছিলেন যে গার্হস্থ্য দায়িত্ব নির্বাহ করা ছাড়া মলয় 'আর কিছুই করছেন না'। ..... কিন্তু তাঁদের গুড়ে বালি নিক্ষেপ করে আশির দশকের গোড়ার দিকে বারদিগর লেখালেখির জগতে তুমুল বেগে ফিরে এলেন মলয় রায়চোধুরী।
প্রত্যাবর্তিত মলয়ের মধ্যে অনেক মাল, অনেক ময়ুজ। মানে, দারুণ-একটা রায়বেঁশে, হৈ হল্লা, তারপর নর্তকের আর কোমর-তোমার রইল না, মলয়ের কেসটা সের'ম নয়। তিনি যে হাত-পা ছুঁড়েছিলেন, বেশ-কিছু জ্যামিতিক পারফরম্যান্স দেখিয়েছিলেন ----- বিশ বছর বাদেও দেখছি, সেই কোরিওগ্রাফিটা থেকে গেছে। দেখেশুনে তো মনেই হচ্ছিল গুঁতো দেবার তালেই ছিলেন যেন। আর, গুঁতোবার আগে যেমন মাথা নিচু করে কয়েক পা পিছিয়ে যায় অগ্নিবাহন, তেমনি করে হয়তো-বা আবার করে অঙ্গহার দেখাবেন বলে খানিক জিরিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। কিম্বা, লেখা ছাপানো বন্ধ রেখে পরখ করে নিচ্ছিলেন তিনি টিঁকে আছেন, না উবে গেছেন।
১৯৮০-৮২ নাগাদ, বিশ বছর বাদে ফিরে-আসা সেই হৈচৈ-হীন নিরুত্তেজ উদ্দান্ত-যমিত শান্ত অব্যস্ত নিরুদ্বেগ ঠাণ্ডামাথা মলয় রায়চোধুরীর মধ্যে সে দিনের সেই উত্তপ্ত অস্থির আন্দোলিত প্রবহস্রোতের মাঝে অবগাহনরত মলয় রায়চোধুরীকে খুঁজতে যাওয়া গোঁয়ার্তুমি মাত্র। তবে, বুকের মধ্যে ঢেউয়ের সেই দাপানিটা আর নেই বটে, কিন্তু পানখ সাপের ফণাটা এখনও উদ্যত। সেই কর্কশ আর গতলজ্জ ভাষা, নিলাজ শব্দানুক্ৰমণের ফলাটা এখনো তেমনি পিশুন। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন করে বেড়ে-ওঠা অদম্য উৎসাহ, জেদ আর সামর্থ্য। যেন পুরনো দখলতি হাসিল করতেই তাঁর ফিরে আসা।
মলয়ের প্রাইম কনসার্ন হলো কবিতা। কবিতার মধ্যেই যা-কিছু দেখা ও দেখানো। ছয়ের দশকের মলয়ের চেয়ে অনেক বেশি লিখেছেন আটের দশকের প্রত্যাবর্তিত মলয়। পূর্বাপরের সঙ্গে স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় একটা সীমারেখা তিনি গড়ে ফেলেছেন অনেক দিন আগেই। কী কবিতায় কী গদ্যে পুনরুত্থিত মলয় খুব সচেতনভাবে নিজের একটা জায়গা বানিয়ে নিয়েছেন, এটা অবম বা ঊন কথা নয়। বাংলা সাহিত্যে প্রথা ভেঙে যেখানে কিছুই হয় না, মলয় রায়চোধুরী সেখানে একটা তাক-লাগানো মিশাল। পুনরুত্থিত মলয় গদ্যকার হিশেবেও অভিনিবেশযোগ্য। একটা খুবই সাদামাটা, ঝরঝরে, গতিশীল আর মেদবর্জিত গদ্যের কারিগর তিনি। আন্দোলনের সময়ে লেখা বিভিন্ন ইস্তেহার, প্রবন্ধ, পরবর্তী বা আটের দশক থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার জন্য লেখা হাংরি বিষয়ক আলোচনা, স্মৃতিচারনা, সাহিত্য বিষয়ক নিবন্ধ, তাঁর 'হাংরি কিংবদন্তী' (১৯৯৪) এবং হওয়া ৪৯ প্রকাশনীর 'পোস্টমর্ডানিজম' (১৯৯৫) গ্রন্থদ্বয়ে বাহন হয়েছে এই আকর্ষণীয় ও মূল্যবান গদ্য। অন্যদিকে আর একটি গদ্য আছে তাঁর, যা এখনো নিরীক্ষার পর্যায়ে, যাতে অনিবার নতুন আর আপাত-জটিল শব্দের তোড়, তাকে আশ্রয় করে মলয় তাঁর এখনকার মৌলিক গল্প-উপন্যাসগুলি লিখছেন। দারুন মডার্ন প্রোজ। দারুণ-দারুণ সব কৌণিময়তা, যে-মুহূর্তে ক্লিক করেন, মলয় আমাদের কাছে এ-সময়ের একজন মেজর গদ্যকার হিশেবে ফুটে ওঠেন। কিন্তু, এখানে তিনি শর্ট ডিস্টান্স রানার। বেশিক্ষণ নাগাড়ে ছুটতে পারেন না। এক-একটা প্যারাগ্রাফের দারুণ স্পিড, কিন্তু প্যারা ফুরোতেই যে দমও ফুরিয়ে আসে। মলয়ের বেশির ভাগ গল্প-উপন্যাস এই শ্রেণীর গদ্যে লেখা। যে, কারণে, শুধুমাত্র গদ্যের এই রেসের কারণেই তাঁর 'নামগন্ধ' বাদে অন্য কোনো উপন্যাস আমায় টানেনি। এটা আমার ব্যক্তিগত গদ্যকার হবার কুফলের দরুনও হতে পারে।
কবিতার মতো গদ্যেও মলয় খুব শব্দ-সচেতন। কোনো কোনো কখনওএতে যেন অতিরিক্ত সচেতন। প্রায় প্রত্যেকটা শব্দেই অনেক বেশি করে কলেজা-রক্ত, কিন্তু নুনের পরিমাণ একটু বেশি। শব্দ-ব্যাপারে মলয়ের ঢালাইঘরে অনবরত হিট ট্রিটমেন্ট। দারুণ মেদবিহীন গতিশীল গদ্যের তিনি প্রাকৃত-ভাণ্ডার। কিন্তু যেইমাত্র সচেতন হয়ে ওঠেন যে তিনি গল্প বা উপন্যাস লিখছেন, সেইমাত্র একরাশ আগুন-হলকা তাঁর হাত দিয়ে চাঁদির চন্দোত্তরি করে ফেলেন। ফলত স্ক্র্যাপ আয়রন আর স্টেইনলেস হয় না। ক্র্যাক হয়ে যায়। তিনি ভালোভাবেই জানেন, ধরো তক্তা মারো পেরেক গোছের লেখক তিনি নন। তবু মারা তিনি থামাতে পারেন না। যার ফলে পেরেকের পর পেরেক ভোঁতা হয়ে-হয়ে বেঁকে বেঁকে যায়। এর ফলে।কী হয়, কোনও কোনও অনুচ্ছেদ খুব দারুণ লাগলেও খুব কনট্রাইভড, গদ্য বানাবার দাগগুলো চোখে পড়ে যায়। এটাকে মলয়-গদ্যের দুর্বলতা বলুন, বা বৈশিষ্ট্য।
এই অবক্ষ্যমান গদ্যেই আমি মলয়ের 'দাফন শিল্প' পড়ি ১৯৮৪সালে, 'এবং' পত্রিকায়, যা পরে তাঁর প্রথম গল্পসংগ্ৰহ 'ভেন্নগল্প'-র অন্যতম ভূমিকা হিশেবে পুনর্মুদ্রিত। আবার সেই একই গদ্যে, সামান্য আলগা-ভাবে লেখা তাঁর প্রথম নভেলা 'ঘোঘ' পড়ি ১৯৯২ সনে এবং সেই গদ্যের উত্তরণ দেখি তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাসে' (১৯৯১-৯৩ সালে লেখা, এবং ১৯৯৪-এ প্রকাশিত)। তাঁর পরবর্তী উপন্যাস 'জলাঞ্জলি'ও এই গদ্যে লেখা। এমনকি আমার-পড়া তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস 'নামগন্ধ'ও সেই একই গদ্যে লেখা। ভেন্নগল্পের এক ডজন ছোটগল্প আর এই তিনটি উপন্যাস পড়ে বুঝেছি, তাত্ত্বিক মলয় আর লেখক মলয়ের মধ্যে একটা দারুণ প্রত্যাসত্তি রয়েছে। কিছু সর্ব-অস্তিত্বময় বর্তিষ্ণু চরিত্রকে ঘিরে লেখকের নিজস্ব চাকরিজীবন থেকে হাসিল অভিজ্ঞতা, নানা অন্তর্দেশীয় চেতনা আর আচার-আচরণের সঙ্গে সমকালীন রাজনীতির জটিল প্রভাব, তত্ত্ব ও তথ্যের প্রাচুর্যের সঙ্গে বোধ ও বুদ্ধির বিচিত্র জটিলতার এক-একটি ছবি ফুটে উঠেছে এইসব গল্প-উপন্যাসে। কলকাতার পাতি কাগজগুলোতে বিশেষত 'ডুবজলে'র উচ্চকিত প্রশংসা পড়ে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে বাঙালি পাঠকরা তাঁদের প্রোডরম্যান ফেজ কাটিয়ে উঠেছেন। আসলে আলোচক-পাঠকদের একটা গ্রূপ যে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তার মূলে বাংলা সাহিত্যের অনেক অচ্ছুৎ-অব্যবহৃত শব্দ আর ছবি একটা বিল্টি কেটে পাঠানো হয় সেই প্রথম। সতীনাথ ভাদুড়ী, প্রফুল্ল রায়, সুবিমল বসাককে মনে রেখেও বলা যায়, আবহমান বাংলা আখ্যান-সাহিত্যের ট্রাডিশনে যা আগে কখনো এভাবে খাপ খায়নি। মোটামুটি সবই এসেছে হিন্দি বলয় থেকে। খাস করে বিহারের দেশয়ালি আর সড়কছাপ জং-মরচে লাগা শব্দগুলোকে সামান্য ঝেড়েঝুড়ে তোলা হয়েছে এই ফিকশানে। ঐ ষাট-সত্তর দশক থেকেই বিহারি-ঝাড়খন্ডি বঙ্গকৃষ্টি দারুণ-দারুণ ঝাপটা মেরে বাংলা সাহিত্যের ঘাটে এসে লাগতে শুরু করেছিল। একটা সফল ঝাপটা ছিল ন'য়ের দশকের 'ডুবজলে'। বিহারের আর্থ-সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির এমন ভিতর-বার গুলিয়ে ফেলা ফিকশান আর কোথাওটি পাননি কলকাতার কূপব্যাঙ আলোচক-পাঠকরা। আর তাতেই তাঁরা দারুণ অমায়িক হোস্টেস হয়ে পড়েছিলেন 'ডুবজলে'র। কিন্তু, এটা, মলয়ও জানতেন, রানওয়ে মাত্র--- তিনি উড়ান দেখাবেন পরবর্তীতে। সেই উড়ান-ই হলো মলয়-ট্রিলজির শেষ পর্দাফাঁস উপন্যাস 'নামগন্ধ'।
মলয় জনান্তিকে বলেছেন, এ-উপন্যাস পশ্চিমবঙ্গের কোনো সম্পাদক ছাপতে সাহস পাননি, যে কারণে ঢাকার লালমাটিয়া থেকে বেরিয়েছিল আগে, পরে হওয়া ৪৯ থেকে বেরোয়। গোড়াতেই ফাঁস হয়ে গেল নামগন্ধে কী মাল তিনি দিয়েছেন এবং যা অবধার্য হয়ে উঠেছে এসময়ে, মলয়ের পাঠকৃতি সেই আধুনিক ঝোঁকে স্বতঃউৎসারিত। স্বীয় আয় করা দৃঠি ও অভিজ্ঞতাকে ছিঁড়ে পাঠবস্তুর টুকরো পাত্রে স্বত্বহীনভাবে বিলিয়ে দিচ্ছেন বহুরৈখিক আয়ামে। তাঁর অন্যান্য রচনার মতো এ উপন্যাসও দামাল ঝাপটা মারে ঝাদানভ-প্লেখানভদের বাঙালি ভাবশিষ্যদের এতদিনকার নির্বিঘ্নে মেলে রাখা অরজ্ঞানডির ভুলভুলইয়াপনায়। নামগন্ধেও কাহিনী পরিণাহটি ন্যূন, বক্তব্যেই মূলত মাটাম ধার্য করেছেন মলয়। তিনি সঠিক কষে ফেলেছেন যে বর্তমান কালখণ্ডে ভারতবর্ষীয় হিন্দু-বাঙালির তথাকথিত সংস্কৃতি মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রের ও তার চারপাশের সংস্কৃতি। মানে, ঐ কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী হাওড়া-হুগলি-চব্বিশ পরগণার সংস্কৃতি। সুতরাং গুনসুঁচ নিয়ে ধেয়েছেন ওই ক্ষমতাকেন্দ্রটিকে বেঁধবার জন্য।

একদিন মলয়দা, জায়মান কিংবদন্তী মলয় রায়চৌধুরী বেমক্কা একটা প্রশ্ন হেনে বসলেন ---- "অজিত, একটা কথা জানবার ছিল । নারীর যৌনতা নিয়ে লেখার সময়ে তুমি কি তার প্রেমে পড়ো ? এমন হয়েছে কি, যে লিঙ্গ দাঁড়িয়ে গেছে?"
প্রশ্নটা আমার কাছে মোটেই অস্বস্তিকর ছিল না। জবাবে লিখেছিলাম, মলয়দা, তুমি ভদ্দরলোকদের মতো 'লিঙ্গ' লিখেছো কেন? 'বাণ্ড' বললে কিচাইন হবার চান্স বলে আমি সরাসরি নিজের ভাষায় নামি। 'বাঁড়া' সহজবোধ্য, স্বয়ংসিদ্ধ ও সর্বত্রগামী শব্দ। আধুনিক বিশ্বকোষ প্রণেতা বাঁড়ার নামকরণ করেছেন 'আনন্দদণ্ড'। নামটা খাসা। তবে, অনেকে বলবেন 'মদনদণ্ড'। 'সাধনদণ্ড' বলেও সুখ। কিংবা 'কানাই বাঁশি'। কলকাতার রকফেলার আর হাফ-লিটারেট গবেষকরাও এই যন্তরটিকে নিয়ে কম মেহনত করেননি। 'কলা' 'ডাণ্ডা' 'রড' 'কেউটে' 'ঢোঁড়সাপ' 'পিস্তল' 'যন্তর' 'ল্যাওড়া' 'ল্যাও' 'লাঁড়' 'লন্ড' 'মেশিন গান' 'মটনরোল' 'ঘন্টা' 'ঢেন্ঢেন্পাদ' 'খোকা' 'খোকার বাপ' 'ধন' ' নঙ্কু' 'পাইপ' 'তবিল' 'পেনসিল' 'ফাউন্টেন পেন' 'মেন পয়েন্ট' ---- আরও কী কী সব নাম দিয়েছেন ওই প্রতাপী মহাপ্রাণীকে সদা উজ্জীবিত রাখতে! বিহার-ঝাড়খণ্ড-ইউপিতে 'ল্ওড়া' আর 'লন্ড' সুপার কোয়ালিটির স্ল্যাং, যা পূর্ব ভারতের সর্বত্র একই কিংবা খানিক বিকৃত উচ্চারণে ব্যবহার হয়ে থাকে। বাঙালি জবানে সেটা হয়েছে মিনমিনে 'ল্যাওড়া' 'ল্যাউড়া' 'ল্যাও' আর 'লাঁড়'। কিন্তু বাংলার নিখাদ 'বাঁড়া' বিহারে বোঝে না, পাত্তাও পায় না। ওপার বাঙলায়ও সর্বত্র বোঝে কি? ডাউট আছে। খোদ বর্ধমান আর বীরভূমেই বাঁড়াকে বলে 'বানা'। কুমিল্লায় ধনকে বলে 'দন'। কুমিল্লা, ঢাকা আর খুলনায় 'চ্যাট' শব্দটাও চলে। ময়মনসিংহে যেটা হয়েছে 'চ্যাম'। সিলেটেও 'চ্যাম'। সিলেটে আবার 'বটই'ও বলে। বাকরগঞ্জে 'চ্যাড' 'ভোচা'। বাকরগঞ্জের মোক্ষম স্ল্যাং হলো 'মদন কল'। 'ভোঁচান' আর 'ভুন' বলে রাজশাহীতে। এছাড়া রয়েছে 'ভুন্দু' 'ভুচা'। 'বিচা' বলে ঢাকা, কুমিল্লায়। কুমিল্লায় ফের 'শোল'ও বলে। বলে, 'নসকা'। 'সাঁও' বলে ফরিদপুরে, ময়মনসিংহে। 'প্যাল' আর 'বগা' চলে ময়মনসিংহ, রাজশাহী আর সিলেটে। চাঁটগেঁয়েরা বলে 'ফোডা'। যশোরের 'পাউন্ড' এসেছে খুবসম্ভব 'পিণ্ড' থেকে। 'বাচ্চা' বলে পাবনায়। 'পক্কি' চলে খুলনা, ফরিদপুর আর ময়মনসিংহে। 'পক্কু' শিশুদের শিশ্ন, এ-বঙ্গে যেটা 'নোঙ্কু' ব 'চেনকু' কিংবা ঝুটমুট 'পক'। ময়মনসিংহে বাঁড়ার অপর নাম 'থুরি'। আরেকটা প্রতিশব্দ 'শুনা' কুমিল্লায় চল আছে। চট্টগ্রাম আর নোয়াখালিতে বলে 'সনা'। আসলে, 'সোনা'। কেউ কেউ বলে সোনা, সোনামণি। মদনার বউটা ভোরবেলা আদর করে টুলস দিত, --- ও জামাই, ওঠো, জাগো। শ্বশুরবাড়ি যাবা না? শ্বশুরবাড়ি ছিল ওর ওইটে, আর জামাই ছিল মদনের এইটে। শ্বশুরবাড়ি ভোগে গ্যাচে, ফলে এ ব্যাটা হামানচোদা জামাই এখন ঢোঁড়সাপ হয়ে স্রেফ জাবর কেটেই খালাস। 'জাবর কাটা' বোজো তো? একষট্টি-বাষট্টি। মানে, খুচরো গোনা।। মানে, হাতলেত্তি। মানে হ্যান্ডেল করা। সকলেই নাকি করে। মদনাই বলছিল, 'মেয়েরা আঙুল করে, শুনিচি বেগুনও করে।' সত্তিমিত্তে জানিনে বাপু।
ভালো কথা। আরও একটা শব্দ যোগ করি। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা মলয়দার এই 'লিঙ্গ'কে বলে 'লিকাম'।
তো খালিপিলি এই লিকাম লইয়া পুরুষ কী করিবে? লিখিবেই বা কেন, আঁকিবেই বা কোন আহ্লাদে! ব্যাংক তাহার অচল যদি তার বাঁড়ার উপযুক্ত একটি পার্স না থাকে। বলছি, যেহেতু, বলছি আমাদের চালুচরকি সমাজের দিকে একপাক ঘুরে তাকাও, হালিতেই চোখে পড়বে যৌনতা। এ সমাজে যৌনতা মানে কিন্তু নারীক্ষেত্র। পুরুষ গৌণ। বেচছে ছাতু, দেখাচ্ছে নারীর বক্ষপট। পটকা, টিভি, মোবাইল, ভটভটির কথা না-হয় ছেড়েই দাও, ----- অপথ্যপথটি বাদে সেখানে নারীদেহের সব পার্টসই হাজির। বলে রাখি তোমায়, তুমি জানো, আমার সমস্ত উপন্যাসেই 'নারী' পুরুষের ইন্টেলেক্ট থেকে আঁকা। কিন্তু একজন বখাটে খানাখারাব হলে কি নারীদেহের মহার্ঘ পার্টসগুলোকে আমি অন্য চোখে দেখতাম? হয়ত, একদমই না। এ ব্যাপারে ভদ্দরলোক বলো, ছোটলোকই বলো, সব মিনসের এক রা। মাথার শিরোজ থেকে গোড়ের পদরজ, একটা হোলদামড়ি নারীর কী-ই না ভাল্লাগতো কালিদাসের! তবে আমার-মতো উনি কতখানি সাধুলোক ছিলেন, খটকা আছে। সাধুমণ্ডলে নারীর অষ্টোত্তর শতনাম। শঙ্খিনী, পদ্মিনী, চিত্রিণী, হস্তিনী ----- এসব তো মানুষের নিজস্ব এলেমে হয়নি, খোদ বিশ্বকর্তা নিজের হাতে গড়ে দিয়েছেন। ফের এদের মধ্যে শঙ্খিনী আর পদ্মিনী হলো 'আইটেম' বিশেষ। তেনার 'অন্তিমের মার'ও বলতে পারো। একা তুমি কেন, বাইবেলেও বলেছে, নারীই বিধাতার শেষ সৃষ্টি। 'হে শুভদর্শনা', অশোক ফরেস্টে সীতাকে দেখে রাবণ কেলিয়ে গিয়ে বলছেন, 'আমার মনে হয় রূপকর্তা বিশ্বনির্মাতা তোমায় রচনা করেই নিবৃত্ত হয়েছেন, তাই তোমার রূপের আর উপমা নেই।' অথবা, ঈভার প্রতি মিল্টন : 'ও ফেয়ারেস্ট অফ ক্রিয়েশন, লাস্ট অ্যান্ড বেস্ট / অফ অল গড'স ওয়র্কস'।
বাংলা সাহিত্যেও নারীর উপমা যে একেবারেই নেই, সেটা বললে বাওয়াল হবে। তবে আমি আমার কথাই বলব। 'যোজন ভাইরাসে' কমল রানীর বুকে কান পেতে শুনেছে সমুদ্রের কলকল। নারী সমুদ্র ছাড়া আর কী, বলো! হোক নোনা। কিন্তু নোনা থেকেই লোনা। লোনা থেকে লবণ। লবণ থেকে লাবণ্য। কত নুন খেয়েছো রানী! সব নুন কি তোমার দেহে? আর খেয়ো না। এতে সৌন্দর্য হারায়। অবিকগুলি খসে-খসে সহসা খোয়ায়।
সত্যি, এক বিশাল মহাযোনি পয়োধি এই নারী। আর পুরুষ কেসটা হলো, অই উষ্ণু মাংসল অলীক পাথার-কিনারে বাল্বের ছেঁড়া ফিলামেন্টের মতো অধীর কাঁপুনি সহ দাঁড়িয়ে থাকা পৌনে ছ'ফুট লম্বা একটা হাইটেন্ডেড ও ব্যবায়ী পুরুষাঙ্গ মাত্র। মাইরি একটা কথা কী জানো, খুব কৈশোর থেকে একজন পুরুষ তার যৌন-অহংকার নিয়ে তিল-তিল করে গড়ে ওঠে, স্রেফ, একজন নারীকে জয় করবে বলে। কিন্তু সে কি সেই কাঙ্খিত নারীকে পায়! পরিবর্তে যাকে পায়, তারও তল পায় না। কী যে চায় মৃণা, মহা ধাঁধা। একেক সময় মনে হয়, কী যেন খুঁজছে, অবিরত। ওফ, টস করেও বোঝা দায় এই মেয়ে জাতটাকে। একেক সময় খটকা জাগে,নারী এক হিংসাত্মক ও নাশকতামূলক শিল্প। নারী মৃত্যুর বিজ্ঞান। ডেথোলজি। আচ্ছা, এ নারী কে? এ দিনে এক, রাতে আরেক! এ নারীকে সত্যিই আমি চিনি না। পরিচিত দায়রার যথেচ্ছ-নারীর কাছে কোনোকালেই বিশেষ যাচনা ছিল না আমার। আমি এমন নারী খুঁজিনি যে শুধু ঘুমোতে আগ্রহী বা গামলা-ভরা খাদ্যে। নারীকে নারীর মুখ বা নারীর চোখ মাত্র আলাদা করে চাইনি, কেবলি। চেয়েছি টরসো মূর্ধা সৃক্ক নোলা কল্লা সিনা রাং নিতম্ব পয়োধর নাভি যোনি নবদ্বার সম্বলিত একটি পূর্ণাবয়ব নারী, যাকে স্পর্শ মাত্রের লহমা থেকে শব্দের স্রোত ধেয়ে আসবে বেবাক এবং প্রতিরোধহীন। স্ব-পরিচয়হীনা, জন্মহীনা, ইতিহাসহীনা, নিয়তিহীনা সেরকম কোনও নারী আজও আমার উপজ্ঞার বাইরে রয়ে গেছে। দ্য বেস্ট রিলেশান বিটুইন আ ম্যান অ্যান্ড আ উওম্যান ইজ দ্যাট অফ দ্য মার্ডারার অ্যান্ড দ্য মার্ডারড। দস্তয়ভস্কির কথাটাই কি তবে মোক্ষম? নারী পুরুষকে হালাল করবে, তার আগেই নারী বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত-সব বাহারি শব্দঘোঁটের বিছেহার জোর করে লাথিয়ে ভেঙে ফেলা দরকার যদ্বারা উদ্ঘাটিত হবে নারীর মৌল স্বরূপ।
খামোখা টেনশন নিও না। এটা, এই পুরুষ-সিস্টেমে স্বাভাবিক ব্যাপার। সিস্টেমটা যেহেতু পুরুষের, নারী হাজার বোল্ড হয়েও পুরুষের মতো নিজের কয়টাস চিরোতে পারে না। মানুষের সেক্সউয়াল ইন্টারকোর্স, বা কয়টাস, একটা খাড়া শিশ্নের যোনিতে প্রবেশ মাত্র নয়। সঙ্গমের ব্রড ডেফিনিশন হল, দা ইনসারশন অফ এ বাঁড়া ইনটু অ্যান অরাল, অ্যানাল, অর ভ্যাজাইনাল ওপেনিং, অ্যান্ড এ ওয়াইড ভ্যারাইটি অফ বিহেভিয়ার্স দ্যাট মে অর মে নট ইনক্লুড পেনিট্রেশন, ইনক্লুডিং ইন্টারকোর্স বিটুইন মেম্বার্স অফ দা সেম জেন্ডার্স। কিন্তু কপুলেশন বা চোদাচুদি, যা নিয়ত আমরা আত্ম-সংলাপে সহজ ভাবে ব্যবহার করি, ভদ্দরপুঞ্জে সহজ বা স্বাভাবিক উচ্চারণ নয়। কেননা এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অ্যাস্টোনিশমেন্ট আর ভ্যাজাইনাল সেন্সিবিলিটি। যে-কারণে 'চোদাচুদি' শব্দটা (যার উৎসে রয়েছে 'চোদা' ও 'চুদি' নামের দুই ভাইবোনের হাজার-হাজার বছরের মিথ-উপালেখ্য) আমাদের অন্যান্য অর্গানিক কারবার থেকে বেপোট হয়ে গ্যাছে। এ থেকেই পুরুষতন্ত্র সামাজিক ট্যাবু ম্যানুফ্যাকচার করেছে। শ্লীল-অশ্লীলের মধ্যে ভিড়িয়ে দিয়েছে কোন্দল। ওই কোন্দল আর তার অ্যাডহিরিং লুকোচাপার দরুন এদেশের ফিল্ম আর সাহিত্যেও যৌনতা দেখানো হয় পারভার্টেডলি।
কিন্তু পুরুষের চোখে বা অনুভবে মেয়েদের শরীর? এ ব্যাপারে ভদ্দরলোকই বলো, ছোটলোকই বলো, সব মিনসের এক রা! পুরুষতন্ত্রের ঢালাইঘর নারীকে ঝুটমুঠ বহু 'শেপ' দিয়েছে ---- শঙ্খিনী, পদ্মিনী, চিত্রিণী, হস্তিনী, ---- এগুলো কি বিধাতার কেরামতি? সব শালা পুরুষতন্ত্রের ধুড়কি। পুরুষের চোখে বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন খেপের, বিভিন্ন নেচারের মাগি। তাদের নামও তেমনি ভেরিয়াস। নারী বলতে বুঝি একজন স্তন ও যোনি সমন্বিত মেয়েমানুষ, কিংবা এনি অবজেক্ট রিগার্ডেড অ্যাজ ফেমিনিন। ফের 'স্ত্রী' বললে, যার এঁড়িগেঁড়ি বা পোলাপান আছে, অর্থাৎ বিয়ারার অফ আন্ডাবাচ্চা। মাদি শেয়াল বা বাদুড়ানীও বোঝায়। 'রমণী' বলতে, এ বিউটিফুল ইয়াং উইম্যান, মিসট্রেস ---- এবং, যাহা রমণীয়, রমণযোগ্য 'মাল'। 'ললনা'ও মাল, তবে ওয়ানটেন লেডি। 'লল', অর্থাৎ খেলুড়ে মাগি। বিবিসি। মানে, বাড়ির বউ ছিনাল। 'অঙ্গনা' ---- আ উইম্যান উইথ ওয়েল-রাউন্ডেড লিম্বস।। 'কামিনী' ---- আ লভিং অর অ্যাফেকশনেট উইম্যান, কিংবা টিমিড মাল। কিন্তু কামিনী বললে এসব ভদ্দরলোক তাঁদের চুদাউড়ি বউটিকেই বোঝেন, মরাগরুর দালালটা সঙ্গে অং করে যে মাগিটা পালহুড়কি দিয়েছে। 'বনিতা'ও বউ, তবে 'বধূ' বলতে এঁরা বোঝেন বিয়ে করে আনা বউটি। আর, 'যোষিৎ' বলেছে যাকে সে কেবল ছুঁড়ি, গার্ল, ইয়াং উইম্যান; অ্যান আইটেম।
তো, পুরুষতন্ত্র নারীর এতসব উপনাম দিয়েছে, শুধুমুধু 'যৌনতা'র দৃষ্টি থেকেই তো! মানে, পুরুষের 'একটি-মাত্র' নারী নিয়ে মন ভরে না। তারা চায় একাধিক। একটি নারীমূর্তি গড়তে বহু মডেল ইউজ করতেন প্রাক্সিটিলিস; কারো মাই, কারো মাজা, কারো দাবনা এবং কারো-বা পাছা নিয়ে রচিত হতো তাঁর এক একটি তিলোত্তমা। আমরা পুরুষরাও এহেন একটি হাগিং, লাস্টিং, উইশিং নারীমূর্তি ধারণা করি এবং তার জন্য একটা-করে জবর স্ল্যাং বানিয়ে রেখেছি। এটা পুরুষের যৌনতার হোমওয়র্ক। কাল যেন পড়া ধরবেন স্যার।
নারী বাবদ স্ল্যাং বানাতে বসে প্রথমেই যেটা, নারীদেহের খুফিয়া বিভাগে এন্ট্রি মেরেছে পুরুষ। বস্ত্র সরিয়ে উদোম করেছে, সর্বাগ্রে যাঁদের দর্শন পেয়েছে, তাঁরা যমজ, উভয়েরই নাম 'স্তন'। স্তন বোঝো তো চাঁদু? যা চিলি চিৎকারযোগে নারীর যৌবন অ্যানাউন্স করে। কিন্তু গোড়ায় গলদ। বাংলা ভাষার কুঁয়োর ব্যাঙ গবেষক-সংকলকরা যে শব্দগুলোকে স্তনের এওয়জ ভেবে টুকেছেন, তাতে স্তনের শেপ বোঝা গেলেও অ্যাপিয়ারান্স আর নেচারে গড়বড় আছে। চুচি, মাই, দুদু, বেল, বাতাবি, নারকেল, তরমুজ, লাউ, বেগুন, ডিংলা, বেলুন, হেভি ওয়েট, হেডলাইট ---- এগুলো ঠিক আছে। কিছুটা মেলে। কিন্তু আতা বা উইঢিবি কেন? স্তনের গায়ে গোঁড় আছে, না ভেতরটা ফোরা? ফের দ্যাখো, 'আনারদানা'! ওটা স্তনের দ্যোতক হলো? মানে, ডালিমের দানা! ওই সাইজের স্তন নাকি হয়! হাসলে বাংলার ডাগদার বাবু। ফের কেলিয়েছো 'নিমকি' ঢুকিয়ে। নিমকি তো ঢোকাবার জিনিশ। মানে গুদ। গুদ আর মাই এক হলো? ফের হাসালে পেঁপেসার। 'মেশিন' কেন? মেশিন তো বড়জোর ল্যাওড়া। পূর্ণযুবতীর স্তন হিশেবে 'হরিণঘাটা' চলতে পারে। তবে, 'সিঙ্গাড়া', 'পিরামিড' আর 'হাইহিল' কদাপি নহে। হে বঙ্গভাষার টুলোপণ্ডিতগণ! তোমরা স্ল্যাং-এর কিচ্চু বোজো না। তোমাদের অভিধানে অনেক ঝোলঝাল আচে। ঝুলে গ্যাচে বাবা লেতাই, কাচা তোমার খুলে গ্যাচে।
বলতে চাইছি, স্ল্যাং-এ থাকবে স্তনের গঠন ও প্রকৃতি, তাতে স্তনধারিণীর বয়স ও দেহের বিভাব জেগে উঠবে, সেটাই তো কাম্য। একটি অষ্টাদশী খেলুড়ে ললনার স্তনকে কি 'আমসি' বলা যাবে, নাকি 'বেগুনপোড়া'? কোন-কোন টুলো 'চুচি'কে বাদ দিতে চেয়েছেন স্ল্যাং থেকে। লজিক হলো, ওটা সংস্কৃত মূল শব্দ 'চুচক' থেকে ভায়া হিন্দী তদ্ভব 'চুচি' থেকে সরাসরি বাংলায় এসেছে, ----- এবং অভিধান স্বীকৃতও বটে। ওভাবে দেখলে, তাহলে তো 'চুত' শব্দটাকেও ছেঁটে ফেলতে হয়। কারণ সেটিও সংস্কৃত 'চুদ' জাত তদ্ভব হিন্দী আঞ্চলিক, ----- এবং সেটিও অভিধানে ঠোর পেয়েছে, যার মূল অর্থ 'যোনি'। অভিধানে ঠাঁই পেয়েছে বলে স্ল্যাং হবে না? তাহলে 'চুতমারানি'দের কীভাবে ডাকা হবে? এভাবে, তাহলে, 'মাগি'ও বাদ যাবার কথা। যেহেতু সেটা পালি 'মাতুগাম'-এর তদ্ভব রূপ এবং তার মূল ক্ষরিত অর্থ খালিপিলি 'মেয়েমানুষ'। হিন্দী 'চুচি'তে অষ্টাদশীর লমশমি স্তনের যে ব্যঞ্জনা, সে তো বহুল চালু বাংলা 'মাই'তেও দুর্লভ। আবার ভারিভরকম পেল্লাই থন-দুটিকে তো 'তরমুজ' কিংবা 'ফজলি আম'ই বলব। বড়জোর, 'বউ ফুসলানি আম'।
স্তনের সমীপশব্দ পাচ্ছি 'বুনি' 'বুচি' 'বুটকি'। এগুলো ও-বঙ্গের। খুলনায় চুচির নাম 'ফলনা'। যেটা ময়মনসিংহে গুদের নিকনেম। কুমিল্লায় উচ্চারণদোষে স্তন হয়েছে 'তন'। আমরা বলব, 'থন'। রংপুরে 'টমটমা'। ঢাকায় স্তনযুগলের বেড়ে নাম দিয়েছে, 'জোড়ামুঠিফল'। বগুড়ায় কিশোরীর উঠন্ত চুচির নাম 'বুচি'। আমাদের এদিকে 'কুল' 'লেবু' 'পেয়ারা' দেদার মেলে।
তারবাদে, টনটনে লবলবে বোঁটা দেখে কার না লালকি ঝরে! স্তনবৃন্তের কথাই বলছি, মালপোয়া বা পুলিপিঠের নয়। যা দেখে লিলিক্ষা জাগে, চোষার। তর্জনী ও বুড়ো নিশপিশ করে, দাঁতে চেপে চেবাতে জী ললচায়। স্তনবৃন্তের উপরিভাগকে বাকরগঞ্জে বলে 'পালনি'। 'বুডা' 'বুটা', এগুলোও ও-পাড়ায় চলে। তবে, আমরা সরাসরি 'বোঁটা'ই বলব। বোঁটা, বোতাম, চুমুর, কিশমিশ, নাট, সোপনাট, সুপুরি, রিঠা, ডুমুর। এছাড়া বড়জোর 'তকলি'। 'বাটিকোট' বলব বডিসকে। 'পৈতে' বলি তার স্ট্র্যাপকে। 'ব্রা' আর 'ব্রেসিয়ার' ----- দুটোই শিরশির করা শব্দ। জুড়ি নেই। কড়কড়ে বডিস বললেও অমনটা লাগে না। শকুন্তলা বলছে, 'সখী,অমন আঁট করে বাঁধিসনি,বল্কলের ভেতর বড্ড আইঢাই লাগে!' উত্তরে প্রিয়ংবদা বলছে, অত্র পয়োধর-বিস্তারয়িতৃ আত্মনঃ যৌবমেব উপালভস্ব ----- 'যে যৌবন তোর মাইদুটোকে অত বাড়ন্ত করেছে, তাকে দুষগে যা, আমাকে কেন!'
এবার নিচে নামো। তলার দিকে। চোখে পড়বে পেটি। তার মধ্যমণি 'নাভি'। নাই, নায়, ঢোঁড়ি, পেটি, টুনি, পুঁতি ইত্যাদি কত নাম পড়েছে ওইটুকু গত্তে! এগুলোর মধ্যে হিন্দী 'ঢোঁড়ি' কিন্তু একটা হাইভোল্টেজ স্ল্যাং। ওটা বাংলায় তাংড়ানো উচিত। অন্তত, নারীদেহের নাভির খাটচড়ি শব্দ এর চাইতে বেস্ট আর হয় না।
তা, মলয়দা, এরকম একটি নারীদেহ লাভিত হলে দাঁড়ায় বৈকি। তখন লেকামেকা চুলোয় যাক। বাকি কথা : লিঙ্গের লিঙ্গযোগ (পড়ো 'মনোযোগ') যেখানে দরকার সেখানেই খাড়ায় কেবল। নারী বা যৌনতা নিয়ে লেখার সময় নিরাসক্ত সন্ন্যাসী হয়ে থাকতে হয়, নচেৎ লেখাটা খাড়ায় না। এবং বলি, এই লেখাটিও লেখার সময় দাঁড়ায়নি, নট ইভন হাফ এমএম।

সাহিত্যে 'যৌনতা' বা 'অশ্লীলতা' শব্দ দুটি অচল। কারণ 'নির্মাণ' যদি 'সাহিত্য' হয়, উপরিউক্ত শব্দ দুটি বাতিল। কারণ সাহিত্য সাধনা। বস্তুত মনুষ্যজীবনে ঈশ্বরত্বের অন্য সংজ্ঞা 'সাহিত্যিক' বা 'কবি'। যিনি শ্রেষ্ঠ নির্মাণে ব্রতী, বিশ্বাসী বা সাধনায়, তাঁহার দ্বারা 'কদর্য' কিছু সম্ভব নহে। আমরা প্রায়শই ভুল করি। সাধারণ মগজের ভাবনায় কিছু কিছু 'শব্দে' নেহাৎ অশিক্ষিত, অপরিণত মস্তিষ্কের ব্যবহার করি। ভাবি না। ভাবিতে প্রস্তুত নই। কারণ কিছু কিছু পাঠক ইচ্ছাকৃতভাবেই সৎ, অমোঘ, নিত্য সাহিত্যকে দোষারোপ করা শ্লাঘার ভাবেন। তাঁহারা শ্রেষ্ঠ, সুন্দর দেখিলে বিকৃত হইয়া পড়েন। তাঁহারা এতটাই অশিক্ষিত, অপরিণত যে, 'আদিরস' 'কামরস' 'যৌনতা' ইত্যাদি শব্দ ও অশ্লীল, ভালগার, কদর্য, কুরুচির মধ্যে ব্যবধান করিতে পারেন না। অক্ষম সেইসব পাঠকের অশ্লীল চিলি-চিৎকারে প্রতিবেশী পাঠকের মনও কলুষিত হইতে থাকে।
জনাকয় যুবক-যুবতী মদ্য, মাংস, তামাক সমভিব্যাহারে ভিকটোরিয়া উদ্যানে। রাত্রি সাত ঘটিকা। যুবতীদের পরণে শাড়ি মাত্র। বক্ষবন্ধনী নাই। যুবকেরা কেহ লুঙ্গি, কেহ ধুতি। উত্তমাঙ্গ বিবস্ত্র। এক্ষণে পানীয় এবং যৌবনের তাগিদে যুবতীগণও বস্ত্রখণ্ড ত্যাগ করিল। স্বাস্থ্যবতী তাহারা, উদ্দাম ও যথেচ্ছ। সদ্য যুবতীদের হাসিতামাশা লাবণ্য ও যৌবন অকুস্থলে ক্লেশময় ইহাতে সন্দেহ নাই। কারণ যুবকগণের অর্ধমাঙ্গে নামমাত্র বস্ত্র। উভয়ে কামজর্জর।
ইদৃশ কাল্পনিক ঘটনা নগরে, অবশ্যই কুরুচিকর ও উদ্দেশ্যমূলক। অথচ ঝাড়খণ্ডের গ্রামে-গঞ্জে, একাধিক ভ্রমণে, দেখিয়াছি, যুবক-যুবতীরা হাট শেষে ঢিবরির সামান্য বায়ুতাড়িত শিখা ঘিরিয়া, পানীয়ে মত্ত। হাসিয়া মাতিয়া একাকার। যুবতীদের রৌদ্রস্নিগ্ধ দিনশেষের শরীর, ক্ৰমে পানীয়ে সতেজ ও সুন্দর। কেহই সচেতন নন। যুবক-যুবতী উভয়ে গাহিতেছে, নাচিতেছে, ইহা খুবই সরল সোজা দৃশ্য। ইহাতে বিন্দুমাত্র কুরুচি দেখি না। যৌন শিহরণ যদি বা থাকে তাহা সাহিত্য-রস মাত্র, 'কামরস' নহে। কারণ এইভাবেই তাঁহারা যুগযুগ ধরিয়া নির্বাহ করিতেছেন।
দুইটি দৃশ্যে স্বতন্ত্র ভূগোল, ইতিহাস, দর্শন, বোধ ইত্যাদি কাজ করিতেছে। প্রথম দৃশ্যে কেবল যৌন-বিজয়-সভা। মানুষ বা মনস্কতা তাহাতে বিন্দুমাত্র। কতক্ষণে পান করিয়া মত্ত ও মদির হইবেক, তাহার তাড়না। যাহা যথার্থই কুরুচি ও কুদৃশ্য। দ্বিতীয় দৃশ্যে একটি স্বাভাবিক পাহাড়িয়া জীবনবিন্যাস, আবহমান জীবন প্রবাহ।
মনে পড়ে, একদা মিলার সাহেব তাঁহার বিখ্যাত উপন্যাস 'ট্র্পিক অব ক্যান্সারে' যথেচ্ছ 'কান্ট' ও 'কক' ব্যবহার করিয়াছিলেন। যাহার বাংলা প্রতিশব্দ আমরা ভাবিতে পারি না। গ্রন্থটি অদ্যাবধি আদৃত। আমরা মহাভারত ব্যাপারেও সশ্রদ্ধ। অথচ এই আদিগ্রন্থ, যেখানে সাধুর বীর্য হরিণ ভক্ষণ করে, সাধুর রতিতে অপ্সরা (বেশ্যা) মত্ত, যথেচ্ছ যৌনবিহার। এমন কি ভরা রাজসভায় রানীর বস্ত্রহরণ বা শরীরলুন্ঠন। কুমারসম্ভব, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, ভারতচন্দ্র কে নহে! কেহই 'কাম' লইয়া মাতেন নাই, মাতিয়াছেন আদিরস লইয়া। কারণ নিষিদ্ধ ও আবৃত। যাহা যত আবৃত, তত রহস্যময় ও সুন্দর। এই আবৃত অংশ হইতেই কবিতার জন্ম হয়। 'কবিতা' রমণীর যৌনচিহ্ন হইতে জন্মাইল। ফলে এত সুন্দর, সুগন্ধী ও সুদৃঢ়। কবিতার রহস্য ও গভীরতা, কারণ রমণীর গুপ্ত শরীরে, গোপনে অপেক্ষা করিতেছিল।

আজ মলয়দার অফিসিয়াল জন্মদিন ছিল নাকি! মনের এই হয়েছে লিট্টিমি। ইদানিং বেজায় চাপ। পুজোর দু সপ্তা আগে থেকে আজ অব্দি স্ত্রীর হাসপাতালিকরন এবং তৎসংশ্লিষ্ট ঝক্কি ও উচাটন অথচ তারপরেও অপ্প যে জিরেন নেবো তার যো নেই। লেখার পচুর ফরমাস। এমতাবস্থায় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা তাত্ত্বিক তথা জায়মান কিংবদন্তি মলয় রায়চৌধুরীর জন্মদিনটা যদি ভুলেই যাই --- ক্ষুব্বেশি গাজোয়ারি হলো, বলো তোমরাই!

তো, মনে কিন্তু পড়েই গেল। অগত্যা একটা-কিছু লিখতেই হচ্ছে। একটা জিনিশ মার্ক করেছি, আমাকে বা মলয়দাকে নিয়ে যাঁরাই লেখালেখি করেছেন, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উদয়ন ঘোষ, রবীন্দ্র গুহ, কমল চক্রবর্তী, বারীন ঘোষাল, নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, কার্তিক লাহিড়ী, দেবজ্যোতি রায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজলক্ষ্মী দেবী, দীপঙ্কর দত্ত, বনানী দাস, তনুময় গোস্বামী, তপোধীর ভট্টাচার্য, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ হাসমত জালাল, প্রভাত মিশ্র, দিব্যাংশু মিশ্র, সঞ্জীব নিয়োগী, কৌশিক চক্রবর্তী, কৌশিক মিত্র, অরুণাভ দাস, ইরাবান বসুরায়, শুভম চক্রবর্তী আর যাঁদের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, যাঁরা আমাদের লেখালেখি নিয়ে আলোচনা করেছেন, তাঁদের কেউই আমার বা মলয়ের 'কালচারাল হাইব্রিড'-বোধের ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করেননি, বা, সেটাকে হাইলাইট করেননি। অনেকে হয়ত অজ্ঞানে, বা কলকাতাকেন্দ্রিক অনুশাসনিক ভাবুকতার কারণে সজ্ঞানে বাদই দিতে চেয়েছেন ব্যাপারটিকে। অথচ আমাদের দুজনেরই তামাম জীবন, পড়াশোনা, লেখাচর্চা, রাগ, ঘৃণা, তিক্ততা, আক্রমণের টার্গেট, বেঁচে থাকার বজহ বা অজুহাত, বেস, হয়ে ওঠা ইত্যাদির মূলে এই সাংস্কৃতিক দো-আঁশলাপনার বোধই যুগপৎ সুপ্ত ও মুখর থেকেছে। আজন্ম তথাকথিত 'বহির্বঙ্গে' লালিত এবং বহির্বঙ্গ-ফেরত মূল সংস্কৃতিতে বহিরাগত না-হলে হয়ত আমাদের লেখার নিজস্ব চিন্তাবিশ্বই গড়ে উঠত না। বিগ্রহ বা প্রতিষ্ঠান ভাঙা, প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে মাস্তানি ফুটপথিয়া ভাষায় মলয়ের কবিতায় দুর্যোধন চ্যালেঞ্জ জানায়, দ্যাখো তোমরা -----

"আব্ববে পাণ্ডবের বাচ্চা যুধিষ্ঠির

বহুতল বাড়ি থেকে নেবে আয় গলির মোড়েতে

নিয়ায় ল্যাঙবোট কৃষ্ণ ভীম বা নকুল কে কে আছে

পেটো হকিস্টিক ক্ষুর সোডার বোতল ছুরি সাইকেল চেন

বলে দে দ্রৌপদীকে আলসে থেকে ঝুঁকে দেখে নিক

আমাদের সঙ্গে আজ কিছু নেই কেউ নেই ....

কবিতা বা অন্যবিধ লেখালেখিতে কোনো পূর্বাদর্শ বা বিশুদ্ধতার চর্চা না করে মলয় আগাগোড়া নিজের প্রতি সৎ থাকার চেষ্টা সহ নিজের আহরিত জ্ঞান, মেধা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক রাজনীতিক আর্থিক ও সাংস্কৃতিক তত্ত্বগুলোকে বিশ্লেষণ করেছেন এবং আধুনিকতার এইসব উপাদানের অসারতা প্রতিপন্ন করার মাধ্যমে সীমানা ভাঙার কাজ করে এসেছেন বলেই আজ তিনি মনোযোগ ও বিতর্কের বিষয়। আর এসবের পেছনে স্বাভাবিক ও পরোক্ষ ভিত্তি হিশেবে, অনুঘটকের কাজ করেছে তাঁর শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন ও প্রৌঢ়ত্ব জুড়ে বিহার ও ভারতবর্ষের অন্যান্য ভাষা-সংস্কৃতির রাজ্যে সুদীর্ঘ যাপন। এই যাপনই তাঁকে দো-আঁশলা সাংস্কৃতিক জীব হিশেবে নিজেকে দেখার স্বচ্ছতা ও অকপটতা দিয়েছে ভাবলে ভুল হবে না।

বিহার-বাংলার যৌগ-সংস্কৃতি থেকে উঠে এসেছিলেন বলে, দুষ্কৃতী অধ্যাসিত বস্তিতে প্রতিপালিত হয়েছিলেন বলে, এবং ক্ৰমে-ক্ৰমে বঙ্গসংস্কৃতির বদলায়মান স্বরূপ জলবৎ দেখে ফেলেছিলেন বলে, বাংলা কবিতা ও আখ্যান সাহিত্যে কলকাতার ঔপনিবেশিক প্রভুমুখী দাসত্ব লক্ষ করেছিলেন বলেই, চেতোমান মলয় প্রথম থেকেই তাঁর লেখায়, বিশেষত কবিতায়, সন্ত্রাস অথবা তাঁর স্বীয় ভাষায় 'ছুরি চাকু চালানো' রপ্ত করেছেন। তাঁর বহু কবিতায় ওই সেলাখানার বিবরণ আছে, এবং সেই সন্ত্রাসী চিত্রকল্প। আর এইসব চিত্রকল্পের ধারাবাহিক অনুশীলনে তাঁকে স্বাভাবিক ভাবেই সাহায্য করেছে তার বাস্টার্ড কালচার। তাঁর আশৈশব-আহরিত প্রায় হাজার খানেক অঘোরি ছোটলোকি অশ্লীল কুৎসিৎ কুচেল অসৎ অভাগা দুর্ব্যবহৃত শব্দাবলি ও তার অভ্যন্তরীণ ইথস। বর্তমানের প্রতিফলনের দরুন সন্ত্রাসী ইমেজ, যা নিছক জান্তব বা যৌন নয়, এ এক মলয় রায়চৌধুরীর কবিতাতেই মেলে। যৌগ-সংস্কৃতির ডামাডোল অবস্থান থেকে সীমালঙ্ঘনের, বিগ্রহ ও মসনদ ভাঙার, যৌক্তিকতা ও আধুনিকতার দর্শনকে এভাবে গুমখুন পাল্টাখুন করার কাজটি, ফালগুনী রায়কে মনে রেখেও বলা যায় ---- ইতিপূর্বে বাংলা কবিতায় অন্য কেউ করেছেন বলে মনে হয় না। যৌগ-সংস্কৃতিতে মানসিক দীর্ঘ যাপনের কারণেই, বাংলার তাবৎ শব্দাবলিতে তাঁর নিবাস থাকা সত্ত্বেও, তিনি যখনই কিছু লেখেন, ওই দোআঁশলা সাংস্কৃতিক নিবাসটি তাঁর সদরে এসে কড়া নাড়ে। এই সততা, এই অকপটতা আমরা আর কার মধ্যে দেখেছি?

আসলে, আমার মনে হয়, যে-কথা আজিজুল হকও বলেছেন, মলয় রায়চৌধুরী এক অন্য পেরিফেরির জীব। মলয়ের হার্ট খুব স্ট্রং, রক্তে দুর্নিবার তেজ। মলয়ের চাইতে অনেক গুণ বড়ো ভাবুক ও মেধাবান চরিত্র ছিলেন সমীর রায়চৌধুরী। কিন্তু, আমার মনে হয়, মলয় আগাগোড়াই 'হয়ে উঠতে' চেয়েছেন। এই হয়ে-ওঠা সবার 'বশের' কথা নয়। হয় ক্ষমতার অভাব, নয় তষ্টির। মলয়ের ফলাফলটা বিলকুল যাকে বলে, রেস্পন্সিবল ইরেন্সিবলিটি। এই সূত্রেই একটা না-তোলা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। যে, মলয় রায়চৌধুরী কীসের জোরে নিজেকে হয়ে ওঠালেন, বিগ্রহের বিরুদ্ধে দাঁড় করালেন, হাতুড়ি চালালেন --- সেই মানসিক, চেতনিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটটি সমগ্রতার আলোকে অনুসন্ধানের তাগিদ একটা তাই থেকেই যাচ্ছে গবেষকদের কাছে। আর কিছুদিন সময় নিচ্ছি। হয়ত লোকডাউন ঘুচলে এই নিয়েই আমার একটি গদ্যগ্রন্থ আসবে। তাতে আমার এই গর্ব অবশ্যই নথি থাকবে, যে, একদিকে জাঁদরেল মূর্খ প্রতিষ্ঠান, ব্রিটিশ গুরুর বীর্যিত পচাগলা মূল্যবোধে আকণ্ঠ বাঙালি বুদ্ধিজীবী-আলোচকের কেরবালা যাঁকে বুঝতে না পেরে, বা সভয়ে, এড়িয়ে রয়েছেন, মুখ ফিরিয়ে, তাঁকে সহ্য করতে না-পারা রঙরুট বন্ধুদের রিসালা, তাঁদের সম্মিলিত করাল মেঘের সামনে একটি সেলাই-না-পড়া লেখকের দ্বারা এই অঘটন তাঁদের দিনদাহাড়ে চাক্ষুষ করতে হবে।

মলয় রায়চোধুরীকে বাঙালি পাঠক এখন অনেক ভাবে চেনে। ষাট দশকের হাংরি আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ, নতুন কবিতাধারার প্রবর্তক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সমালোচক ও অনুবাদক; মায়, দু-একটি কাঁপা হাতের স্কেচও আমরা দেখেছি। এই ভার্সাটাইল কাজকর্ম নিয়ে, তিনি একজন পোস্টমডার্ন ভাবুক। জীবনের যা কিছু ---- বাঁচা, বেঁচে থাকা, ভাষা সংস্কৃতি শিক্ষা, বিজ্ঞান অর্থনীতি রাজনীতি, ভূগোল ইতিহাস সাহিত্য ইত্যাদি প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে তাঁর ভাবনাগত আনাগোনা। অথচ তিনি নিজেকে কোন বিশেষ অভিধায় চিহ্নিত করতে নারাজ। কেননা তিনি মনে করেন নিজেকে বা অপরকে অভিধায়িত করার যেসব শব্দাবলি চারপাশে সাজানো আছে, এখনো, সবই ব্রিটিশ মাস্টারদের ফেলে-যাওয়া বইপত্র, অভিধান আর আধুনিকতাবাদীদের বুকনি থেকে নেওয়া। অথচ মলয় বিশ্বাস করেন শেষ বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ার যে হালচাল, রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি তাতে সেরকম মডারনিস্ট স্পেশালাইজড ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার সার-বীজ সব পচে-হেজে নষ্ট হয়ে গেছে। 'আধুনিকতা' ব্যাপারটাই এখন 'একখানি ধ্রুপদী জোচ্চোর'। বলেছেন তিনি, এতদিন, 'আধুনিকতা ভালো, নৈতিক, নান্দনিক, প্রগতিশীল, উন্নত, কাম্য, কল্যাণময় এমনতর ভাঁওতায় ভুলিয়ে রাখা হচ্ছিল বাংলা ভাষাকে।' এহেন সময়ে একজন সমাজ ও সময় সচেতন লেখক যা করতে পারেন, তা হলো, বিগ্রহ ভাঙার কাজ। মলয় রায়চোধুরীর বেশির ভাগ রচনায় হাতুড়ির সেই চিহ্ন আমরা দেখেছি। কোন ধর্মভীরুতা বা প্রলোভন তাঁকে এই ভাঙার কাজ থেকে নিরস্ত করতে পারেনি, না বিদ্যায়তনিক মাস্তানদের ঘাতক-ছুরি। বাংলা ভাষায় প্রতিষ্ঠিত আধুনিক ও এঁদো চিন্তাভাবনা ও তার ভেক্টর প্রতিষ্ঠানের মুখে জোর থাপ্পড় মেরে তার গিল্টি-করা দাঁত উখড়ে দিতে চেয়ে মলয়ের লেখার জগতে প্রবেশ। আজীবন অর্জিত নিজের ভোগান্তি, অভিজ্ঞতা, পড়াশোনা আর প্রজ্ঞাকে অস্ত্র করে তিনি যা-কিছু প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তা-উদ্ভূত, মেরে লটলট ধ্বসিয়ে ফেলতে চেয়েছেন। একজন কালচেতন, সদাজাগ্রত লেখক প্রতিষ্ঠানের সামনে কী ভীষণ প্রব্লেম্যাটিক হয়ে উঠতে পারেন, তার জলজ্যান্ত মিশাল মলয় রায়চোধুরী।

নিজেকে কালচারাল বাস্টার্ড বলেছেন মলয়। নিজেকে বলেছেন, বাঙলার মূল সংস্কৃতিতে আউটসাইডার। তাঁর বিভিন্ন রচনা,গল্প ও উপন্যাসে আমরা তাঁর সেই জারজ উপাদানের সুসম্বদ্ধ রূপটি গড়েও নিতে পারি। মজার ব্যাপার হচ্ছে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতাহীন, হতাশাখোর, তথাকথিত শিক্ষিত হায়ারক্লাস বুদ্ধিজীবীরা মলয়ের পশ্চিমবঙ্গ-হামলার মনসুবাটা ধরতে পারেননি। আমি নিজে তথা-অর্থে 'বহিরাগত' হওয়ার দরুন স্থূল ও সূক্ষ্ম দু-নিরীখেই অনুধাবন করেছি পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক কাঠামোর মূল স্বরূপ বিশ্লেষণে মলয় কিন্তু আগাগোড়াই খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ, যার তন্নতন্ন প্রতিফলন তাঁর লেখাজোখায় দুরনিরীক্ষ্য নয়। বাঙালির ভিড় থেকে, হরির লুঠ থেকে, বাঁধাধরা বঙ্গ-কালচার থেকে স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্ন এবং সর্বোপরি ভারতবর্ষীয় হিন্দু-বাঙালি সংস্কারের সর্বোচ্চ পীঠ বলে কথিত কলকাতা থেকে ২৬০ কিমি দূরে পড়ে আছি বলেই আমার কাছে ইঁদুরের প্রতিটি লাফ আর চাল জলবৎ ধরা পড়ে। তথাকথিত 'প্রবাস'-যাপনের সুবিধে এটাই যে, নিজের সঙ্গে অন্যের সাদৃশ্য ও পার্থক্য হবহু ধরে ফেলা যায়। দেখতে পাই দ্বৈরাজ্যের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই বিশ্বচরাচর, তার প্রতিটি নড়ন ও চড়ন। মলয় রায়চোধুরী আজন্ম মূল বঙ্গ-সংস্কারের বাইরে বাস করে এই একই মাইক্রো-দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা ও বাদ-বাংলার সংস্কৃতিকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি দেখেছেন যে-বঙ্গসংস্কৃতিকে নিয়ে বাঙালির এত আত্মম্ভরিতা, গুমর আর বারফট্টাই ----- সেই বিশুদ্ধ বঙ্গসংস্কৃতির হদিশ পৃথিবীতে আজ কোথাও নেই। ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপে নানা জাতি ও সংস্কারের,বিশেষত মুসলিম ও ইংরেজ বেনিয়ার শাসনে, সর্বোপরি ভৌগোলিক কাটছাঁট, দেশভাগ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক স্পৃহার খপ্পরে পড়ে বাঙালি নিজের সর্বস্ব আজ খুইয়ে ফেলেছে। এমনকী, বিশুদ্ধ পশ্চিমবঙ্গীয় সংস্কৃতিও আজ মিথ মাত্র। ভারতবর্ষীয় বাঙালির কোন সংস্কৃতিই আজ অবশিষ্ট নেই; সময়ের চাপে সব উচ্ছন্নে গেছে। জন্ম নিয়েছে এক জগাখিচুড়ি কালচার। ছত্রখান সংস্কৃতি। বাঙালির পোশাক পাল্টেছে বহুদিন হল,বহু খোঁপা আর সিঁথি এখন বিদেশিনী হয়ে গেছে, এমনসব হেয়ারডু যা বাঙালি কস্মিনকালে ভাবেনি। পুরুষেরা তামুক দোক্তা বিড়ি গড়গড়া ছেড়ে সিগারেট বিয়ার ব্রাউনসুগারে মজেছে। যে-ফুটবলে বাঙালির নিজস্ব দাপ ছিল তা এখন আকখা ওয়ার্ল্ড খেলছে, বাঙালি লোকাল ট্রেনে আর রকে বসে খেলছে তিন-পাত্তি, টোয়েন্টি নাইন। বাঙালি টুসু ভাদু রবীন্দ্রসঙ্গীত ভুলে পাঞ্জাবি পপে মাজা দোলাচ্ছে। পড়াশোনা চাকরি ব্যবসা থেকে ক্ৰমে উৎখাত হতে হতে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি বলে যা রয়ে গেছে, তা হলো, রকে বসে বুকনি ঝাড়া, পরস্পর পেছনে লাগা, লেংগি মারা, মিথ্যে বলা, হীনমন্যতা, চা চপ ঝালমুড়ি, লোকনিন্দা, ভাইয়ে-ভাইয়ে হিংসে, কথায় কথায় মাথাগরম আর খিস্তিবাজি। পাশাপাশি শনি-শেতলার পুজো, তৃণমূল-সিপিএম, আর দুগ্গাপুজোয় চাঁদা আর হুল্লোড়বাজি।

তো, এইখান থেকে আমাদের পাঠ শুরু হয় মলয়-ট্রিলজির শেষ পর্দা-ফাঁস উপন্যাস "নামগন্ধে"র। মলয় জনান্তিকে বলেছেন, এ-উপন্যাস পশ্চিমবঙ্গের কোনো সম্পাদক ছাপতে সাহস পাননি, যে কারণে ঢাকার লালমাটিয়া থেকে বেরিয়েছিল আগে, পরে হওয়া ৪৯ থেকে বেরোয়। গোড়াতেই ফাঁস হয়ে গেল নামগন্ধে কী মাল তিনি দিয়েছেন এবং যা অবধার্য হয়ে উঠেছে এসময়ে, মলয়ের পাঠকৃতি সেই আধুনিক ঝোঁকে স্বতঃউৎসারিত। স্বীয় আয় করা দৃঠি ও অভিজ্ঞতাকে ছিঁড়ে পাঠবস্তুর টুকরো পাত্রে স্বত্বহীনভাবে বিলিয়ে দিচ্ছেন বহুরৈখিক আয়ামে। তাঁর অন্যান্য রচনার মতো এ উপন্যাসও দামাল ঝাপটা মারে ঝাদানভ-প্লেখানভদের বাঙালি ভাবশিষ্যদের এতদিনকার নির্বিঘ্নে মেলে রাখা অরজ্ঞানডির ভুলভুলইয়াপনায়। নামগন্ধেও কাহিনী পরিণাহটি ন্যূন, বক্তব্যেই মূলত মাটাম ধার্য করেছেন মলয়। তিনি সঠিক কষে ফেলেছেন যে বর্তমান কালখণ্ডে ভারতবর্ষীয় হিন্দু-বাঙালির তথাকথিত সংস্কৃতি মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রের ও তার চারপাশের সংস্কৃতি। মানে, ঐ কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী হাওড়া-হুগলি-চব্বিশ পরগণার সংস্কৃতি। সুতরাং গুনসুঁচ নিয়ে ধেয়েছেন ওই ক্ষমতাকেন্দ্রটিকে বেঁধবার জন্য।

উপন্যাস শুরু হচ্ছে একটা সন্ত্রাস দিয়ে, মলয়ের এটা অমোঘ টেকনিক, ----- পাঠকের সামনে সন্ত্রাস ঘটিয়ে, তাকে তার মধ্যে হিঁচড়ে ঢুকিয়ে সন্ত্রস্ত করে, সন্ত্রাসের বিভীষিকা মেলে ধরা। বঙ্গ-কালচারের বর্তমান হাল বোঝাতে মলয় হাওড়া জেলার ভোটবাগানের লোহার কাবাড়িখানা, নদিয়া জেলার কালীগঞ্জের কাঁসা-পেতলের ভাংরি, বিভিন্ন জেলার আলুর কোল্ড-স্টোরেজ মন্তাজ করে ফুটিয়ে বঙ্গভূবন একাকার করে ফেলেছেন। 'মুসলমান রাজার আমলে যেমন ছিল তালুকদার দফাদার পত্তনিদার তশিলদার মজুমদার হাওলাদার, এই আমাদের কালে হয়েচে পার্টিদার, আজগালকার জমিদার'। নমঃশূদ্রদের খুন ধর্ষণ বাড়িঘর জ্বালিয়ে যখন তাড়ানো হয়েছিল খুলনার মাইড়া গ্রাম থেকে, পঞ্চাশ সনে, যুবক ভবেশকাকা রাতারাতি পালিয়ে এসেছিল কচি ফুটফুটে সৎ বোনকে কোলে নিয়ে। পুরনো বাড়ির পাড়ায় ইউনাইটেড রিহ্যাবিলিটেশন কাউনসিলের 'আগুন-খেকো নেতা' ছিল ভবেশকাকা, যিনি বিধান রায় ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ট্রামে আগুন ধরিয়ে দেন। তিরিশ বছর আগে আরামবাগি প্যাঁচে কংগ্রেসি আলুর দাম হঠাৎ বাড়লে, খাদ্য আন্দোলনের দিনগুলোয়, তুলকালাম করেছিলেন। দেশভাগের খেলাপে নারাবাজি করেছিলেন, 'হাতে পেলে জহোরলাল জিনহাকে চিবিয়ে পোস্তবাটা করে'।। সেই ভবেশ মণ্ডল আজ মোকররি আর চাকরান মিলিয়ে বাহান্ন বিঘে জমি আর একলাখ কুইন্টাল ক্ষমতাসম্পন্ন মোহতাজ হিমঘরের অংশীদার। যিশুর / লেখকের মন্তব্য : 'আজকাল গ্রামগুলোর সত্যের স্বামীত্ব ভবেশকাকাদের হাতে।' আর 'চাষির মুখের দিকে তাকালে সর্বস্বান্তের সংজ্ঞা টের পাওয়া যায়।'

মলয় নিজেকে গদ্যকার সাব্যস্ত করতে আদৌ গল্প-উপন্যাসে আসেন নি। তবু, গোড়া থেকেই যেটা সচেতনভাবে করেছেন, গল্প-বানানোর প্রথাগত টেকনিক ও সিদ্ধ নিয়মগুলোকে বানচাল করে বাংলার চলে-আসা মূল সাহিত্যধারাকে একেবারে অস্বীকার করার চেষ্টা। ভাষার ক্ষেত্রেও মিথ, দুয়ো শব্দকলাপ ও পড়িয়ে-নেওয়ার যাবতীয় সরঞ্জাম ইস্তেমাল। এবং বিষয় পুরোপুরি অধীত, সংপৃক্ত, যেন রিচার্ডস ওয়ার্ক পড়ছি। যেমন, 'ডুবজলে', 'জলাঞ্জলি' আর 'নামগন্ধ' ---- এই ট্রিলজিতে মলয় এক-গোছের চাকরির জিগির এনেছেন, সেটা হল, টাটকা আর পচা নোট আলাদা করা, একশোটা নোটের প্যাকেট তৈরি করা, এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, যেন, 'অর্থনীতির স্নাতক হবার এই-ই পরিণাম। অমন বিতিকিচ্ছিরি কায়িক শ্রম করবার জন্যে ওই অফিসটা চেয়েছিল অর্থনীতি গণিত কমার্সে ভালো নম্বর প্রাপক স্নাতক।' অন্যদিকে, আজন্ম শহরবাসী মলয় কীভাবে পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলে পরিব্যাপ্ত রাজনীতি, অর্থনীতি, দুর্নীতি আর কালচার জরিপ করেছেন তা 'নামগন্ধে' পড়ে থ মেরে যায় পাঠক। 'এই ভেবে যে কী করে পারেন! রীতিমত 'আলু-সমাজ-নাম'গুলোর গন্ধতালাশ। প্রান্ত গন্ধ।' কাহিনী বা নাটক সেখানে ন্যূন, আগেই বলেছি, বরং তা ঘনিয়ে ওঠার সম্ভবনা দেখা দিলে মলয় তা নিরাসক্ত ও নির্মোহ মনে ভেঙে দিয়েছেন। অন্বেষণের মেধা প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে পাতায়-পাতায়, বিশেষত উপন্যাসের শেষ দিকটা মার্ভেলাস। খোদ মলয়ের জীবন যেমন, উপন্যাসও তেমনি ----- জীবনেরই, অথচ প্রথানুগতের বাইরে। জীবনেরই ছোট ছোট খণ্ড, জীবনের সমাহার যেন, সম্পূরক। যেমন একযুগ পর ভবেশকাকার।বোন খুশিদিকে দেখে অপ্রত্যাশিত ধাক্কায় নির্বাক আনন্দে ছারখার হয়েছে যিশু। 'পঞ্চাশ বছরের একজন বালিকাকে কাছে পাবার ক্ষমতাকে দুর্জয় করে তুলতে, উঠে বসেছিল যিশু।' ভোগদৃশ্যটা অবিস্মরণীয় ----- 'প্রশ্রয়প্রাপ্ত যিশু গনগনে ঠোঁট বুলায়, রুদ্ধশ্বাস, ত্রস্ত। সিনেমা দেখে, টিভি দেখে, উপন্যাস পড়ে মানুষ-মানুষীর যৌনতার বোধ কলুষিত হয়ে গেছে, সর্বজনীন হয়ে গেছে। খুশিদির জৈব-প্রতিদান, বোঝা যাচ্ছে, সেই অভিজ্ঞতায় নিষিক্ত নয়। থুতনির টোল কাঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে ওঠে খুশিদি; বলল, আয়, ভেতরের ঘরে চল যিশকা।'

আর, যেজন্য এই উপন্যাসের জিগির। মলয়ের লক্ষ্য গপ্পো বলা নয়, উপন্যাস গড়া নয় ---- ভাষা নির্মাণ। যেন, বাংলা গদ্যকে সশক্ত বনেদ পাইয়ে দিতেই তুখোড় কবিতাবাজ মলয় গদ্যের বাদাড়ে এসেছেন। গদ্য, যা বাঙালির যতিচিহ্ন। সমস্ত আবেগময়তাকে জোর ধাক্কা মেরে, থুয়ে রেখে, বাংলা গদ্যভাষাকে আরও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে মলয় মরিয়া। অন্তত নামগন্ধ বাবদ আমার স্বতোচ্ছ্বাস মারহাবা।





মঙ্গলবার, ২৪ আগস্ট, ২০২১

অজিত রায় লিখেছেন

 অজিত রায় লিখেছেন

মলয় রায়চোধুরীকে বাঙালি পাঠক এখন অনেক ভাবে চেনে। ষাট দশকের হাংরি আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ, নতুন কবিতাধারার প্রবর্তক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সমালোচক ও অনুবাদক; মায়, দু-একটি কাঁপা হাতের স্কেচও আমরা দেখেছি। এই ভার্সাটাইল কাজকর্ম নিয়ে, তিনি একজন পোস্টমডার্ন ভাবুক। জীবনের যা কিছু ---- বাঁচা, বেঁচে থাকা, ভাষা সংস্কৃতি শিক্ষা, বিজ্ঞান অর্থনীতি রাজনীতি, ভূগোল ইতিহাস সাহিত্য ইত্যাদি প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে তাঁর ভাবনাগত আনাগোনা। অথচ তিনি নিজেকে কোন বিশেষ অভিধায় চিহ্নিত করতে নারাজ। কেননা তিনি মনে করেন নিজেকে বা অপরকে অভিধায়িত করার যেসব শব্দাবলি চারপাশে সাজানো আছে, এখনো, সবই ব্রিটিশ মাস্টারদের ফেলে-যাওয়া বইপত্র, অভিধান আর আধুনিকতাবাদীদের বুকনি থেকে নেওয়া। অথচ মলয় বিশ্বাস করেন শেষ বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ার যে হালচাল, রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি তাতে সেরকম মডারনিস্ট স্পেশালাইজড ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার সার-বীজ সব পচে-হেজে নষ্ট হয়ে গেছে। 'আধুনিকতা' ব্যাপারটাই এখন 'একখানি ধ্রুপদী জোচ্চোর'। বলেছেন তিনি, এতদিন, 'আধুনিকতা ভালো, নৈতিক, নান্দনিক, প্রগতিশীল, উন্নত, কাম্য, কল্যাণময় এমনতর ভাঁওতায় ভুলিয়ে রাখা হচ্ছিল বাংলা ভাষাকে।' এহেন সময়ে একজন সমাজ ও সময় সচেতন লেখক যা করতে পারেন, তা হলো, বিগ্রহ ভাঙার কাজ। মলয় রায়চোধুরীর বেশির ভাগ রচনায় হাতুড়ির সেই চিহ্ন আমরা দেখেছি। কোন ধর্মভীরুতা বা প্রলোভন তাঁকে এই ভাঙার কাজ থেকে নিরস্ত করতে পারেনি, না বিদ্যায়তনিক মাস্তানদের ঘাতক-ছুরি। বাংলা ভাষায় প্রতিষ্ঠিত আধুনিক ও এঁদো চিন্তাভাবনা ও তার ভেক্টর প্রতিষ্ঠানের মুখে জোর থাপ্পড় মেরে তার গিল্টি-করা দাঁত উখড়ে দিতে চেয়ে মলয়ের লেখার জগতে প্রবেশ। আজীবন অর্জিত নিজের ভোগান্তি, অভিজ্ঞতা, পড়াশোনা আর প্রজ্ঞাকে অস্ত্র করে তিনি যা-কিছু প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তা-উদ্ভূত, মেরে লটলট ধ্বসিয়ে ফেলতে চেয়েছেন। একজন কালচেতন, সদাজাগ্রত লেখক প্রতিষ্ঠানের সামনে কী ভীষণ প্রব্লেম্যাটিক হয়ে উঠতে পারেন, তার জলজ্যান্ত মিশাল মলয় রায়চোধুরী।
 
নিজেকে কালচারাল বাস্টার্ড বলেছেন মলয়। নিজেকে বলেছেন, বাঙলার মূল সংস্কৃতিতে আউটসাইডার। তাঁর বিভিন্ন রচনা,গল্প ও উপন্যাসে আমরা তাঁর সেই জারজ উপাদানের সুসম্বদ্ধ রূপটি গড়েও নিতে পারি। মজার ব্যাপার হচ্ছে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতাহীন, হতাশাখোর, তথাকথিত শিক্ষিত হায়ারক্লাস বুদ্ধিজীবীরা মলয়ের পশ্চিমবঙ্গ-হামলার মনসুবাটা ধরতে পারেননি। আমি নিজে তথা-অর্থে 'বহিরাগত' হওয়ার দরুন স্থূল ও সূক্ষ্ম দু-নিরীখেই অনুধাবন করেছি পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক কাঠামোর মূল স্বরূপ বিশ্লেষণে মলয় কিন্তু আগাগোড়াই খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ, যার তন্নতন্ন প্রতিফলন তাঁর লেখাজোখায় দুরনিরীক্ষ্য নয়। বাঙালির ভিড় থেকে, হরির লুঠ থেকে, বাঁধাধরা বঙ্গ-কালচার থেকে স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্ন এবং সর্বোপরি ভারতবর্ষীয় হিন্দু-বাঙালি সংস্কারের সর্বোচ্চ পীঠ বলে কথিত কলকাতা থেকে ২৬০ কিমি দূরে পড়ে আছি বলেই আমার কাছে ইঁদুরের প্রতিটি লাফ আর চাল জলবৎ ধরা পড়ে। তথাকথিত 'প্রবাস'-যাপনের সুবিধে এটাই যে, নিজের সঙ্গে অন্যের সাদৃশ্য ও পার্থক্য হবহু ধরে ফেলা যায়। দেখতে পাই দ্বৈরাজ্যের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই বিশ্বচরাচর, তার প্রতিটি নড়ন ও চড়ন। মলয় রায়চোধুরী আজন্ম মূল বঙ্গ-সংস্কারের বাইরে বাস করে এই একই মাইক্রো-দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা ও বাদ-বাংলার সংস্কৃতিকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি দেখেছেন যে-বঙ্গসংস্কৃতিকে নিয়ে বাঙালির এত আত্মম্ভরিতা, গুমর আর বারফট্টাই ----- সেই বিশুদ্ধ বঙ্গসংস্কৃতির হদিশ পৃথিবীতে আজ কোথাও নেই। ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপে নানা জাতি ও সংস্কারের,বিশেষত মুসলিম ও ইংরেজ বেনিয়ার শাসনে, সর্বোপরি ভৌগোলিক কাটছাঁট, দেশভাগ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক স্পৃহার খপ্পরে পড়ে বাঙালি নিজের সর্বস্ব আজ খুইয়ে ফেলেছে। এমনকী, বিশুদ্ধ পশ্চিমবঙ্গীয় সংস্কৃতিও আজ মিথ মাত্র। ভারতবর্ষীয় বাঙালির কোন সংস্কৃতিই আজ অবশিষ্ট নেই; সময়ের চাপে সব উচ্ছন্নে গেছে। জন্ম নিয়েছে এক জগাখিচুড়ি কালচার। ছত্রখান সংস্কৃতি। বাঙালির পোশাক পাল্টেছে বহুদিন হল,বহু খোঁপা আর সিঁথি এখন বিদেশিনী হয়ে গেছে, এমনসব হেয়ারডু যা বাঙালি কস্মিনকালে ভাবেনি। পুরুষেরা তামুক দোক্তা বিড়ি গড়গড়া ছেড়ে সিগারেট বিয়ার ব্রাউনসুগারে মজেছে। যে-ফুটবলে বাঙালির নিজস্ব দাপ ছিল তা এখন আকখা ওয়ার্ল্ড খেলছে, বাঙালি লোকাল ট্রেনে আর রকে বসে খেলছে তিন-পাত্তি, টোয়েন্টি নাইন। বাঙালি টুসু ভাদু রবীন্দ্রসঙ্গীত ভুলে পাঞ্জাবি পপে মাজা দোলাচ্ছে। পড়াশোনা চাকরি ব্যবসা থেকে ক্ৰমে উৎখাত হতে হতে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি বলে যা রয়ে গেছে, তা হলো, রকে বসে বুকনি ঝাড়া, পরস্পর পেছনে লাগা, লেংগি মারা, মিথ্যে বলা, হীনমন্যতা, চা চপ ঝালমুড়ি, লোকনিন্দা, ভাইয়ে-ভাইয়ে হিংসে, কথায় কথায় মাথাগরম আর খিস্তিবাজি। পাশাপাশি শনি-শেতলার পুজো, তৃণমূল-সিপিএম, আর দুগ্গাপুজোয় চাঁদা আর হুল্লোড়বাজি।
 
তো, এইখান থেকে আমাদের পাঠ শুরু হয় মলয়-ট্রিলজির শেষ পর্দা-ফাঁস উপন্যাস "নামগন্ধে"র। মলয় জনান্তিকে বলেছেন, এ-উপন্যাস পশ্চিমবঙ্গের কোনো সম্পাদক ছাপতে সাহস পাননি, যে কারণে ঢাকার লালমাটিয়া থেকে বেরিয়েছিল আগে, পরে হওয়া ৪৯ থেকে বেরোয়। গোড়াতেই ফাঁস হয়ে গেল নামগন্ধে কী মাল তিনি দিয়েছেন এবং যা অবধার্য হয়ে উঠেছে এসময়ে, মলয়ের পাঠকৃতি সেই আধুনিক ঝোঁকে স্বতঃউৎসারিত। স্বীয় আয় করা দৃঠি ও অভিজ্ঞতাকে ছিঁড়ে পাঠবস্তুর টুকরো পাত্রে স্বত্বহীনভাবে বিলিয়ে দিচ্ছেন বহুরৈখিক আয়ামে। তাঁর অন্যান্য রচনার মতো এ উপন্যাসও দামাল ঝাপটা মারে ঝাদানভ-প্লেখানভদের বাঙালি ভাবশিষ্যদের এতদিনকার নির্বিঘ্নে মেলে রাখা অরজ্ঞানডির ভুলভুলইয়াপনায়। নামগন্ধেও কাহিনী পরিণাহটি ন্যূন, বক্তব্যেই মূলত মাটাম ধার্য করেছেন মলয়। তিনি সঠিক কষে ফেলেছেন যে বর্তমান কালখণ্ডে ভারতবর্ষীয় হিন্দু-বাঙালির তথাকথিত সংস্কৃতি মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রের ও তার চারপাশের সংস্কৃতি। মানে, ঐ কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী হাওড়া-হুগলি-চব্বিশ পরগণার সংস্কৃতি। সুতরাং গুনসুঁচ নিয়ে ধেয়েছেন ওই ক্ষমতাকেন্দ্রটিকে বেঁধবার জন্য।
 
উপন্যাস শুরু হচ্ছে একটা সন্ত্রাস দিয়ে, মলয়ের এটা অমোঘ টেকনিক, ----- পাঠকের সামনে সন্ত্রাস ঘটিয়ে, তাকে তার মধ্যে হিঁচড়ে ঢুকিয়ে সন্ত্রস্ত করে, সন্ত্রাসের বিভীষিকা মেলে ধরা। বঙ্গ-কালচারের বর্তমান হাল বোঝাতে মলয় হাওড়া জেলার ভোটবাগানের লোহার কাবাড়িখানা, নদিয়া জেলার কালীগঞ্জের কাঁসা-পেতলের ভাংরি, বিভিন্ন জেলার আলুর কোল্ড-স্টোরেজ মন্তাজ করে ফুটিয়ে বঙ্গভূবন একাকার করে ফেলেছেন। 'মুসলমান রাজার আমলে যেমন ছিল তালুকদার দফাদার পত্তনিদার তশিলদার মজুমদার হাওলাদার, এই আমাদের কালে হয়েচে পার্টিদার, আজগালকার জমিদার'। নমঃশূদ্রদের খুন ধর্ষণ বাড়িঘর জ্বালিয়ে যখন তাড়ানো হয়েছিল খুলনার মাইড়া গ্রাম থেকে, পঞ্চাশ সনে, যুবক ভবেশকাকা রাতারাতি পালিয়ে এসেছিল কচি ফুটফুটে সৎ বোনকে কোলে নিয়ে। পুরনো বাড়ির পাড়ায় ইউনাইটেড রিহ্যাবিলিটেশন কাউনসিলের 'আগুন-খেকো নেতা' ছিল ভবেশকাকা, যিনি বিধান রায় ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ট্রামে আগুন ধরিয়ে দেন। তিরিশ বছর আগে আরামবাগি প্যাঁচে কংগ্রেসি আলুর দাম হঠাৎ বাড়লে, খাদ্য আন্দোলনের দিনগুলোয়, তুলকালাম করেছিলেন। দেশভাগের খেলাপে নারাবাজি করেছিলেন, 'হাতে পেলে জহোরলাল জিনহাকে চিবিয়ে পোস্তবাটা করে'।। সেই ভবেশ মণ্ডল আজ মোকররি আর চাকরান মিলিয়ে বাহান্ন বিঘে জমি আর একলাখ কুইন্টাল ক্ষমতাসম্পন্ন মোহতাজ হিমঘরের অংশীদার। যিশুর / লেখকের মন্তব্য : 'আজকাল গ্রামগুলোর সত্যের স্বামীত্ব ভবেশকাকাদের হাতে।' আর 'চাষির মুখের দিকে তাকালে সর্বস্বান্তের সংজ্ঞা টের পাওয়া যায়।'
 
মলয় নিজেকে গদ্যকার সাব্যস্ত করতে আদৌ গল্প-উপন্যাসে আসেন নি। তবু, গোড়া থেকেই যেটা সচেতনভাবে করেছেন, গল্প-বানানোর প্রথাগত টেকনিক ও সিদ্ধ নিয়মগুলোকে বানচাল করে বাংলার চলে-আসা মূল সাহিত্যধারাকে একেবারে অস্বীকার করার চেষ্টা। ভাষার ক্ষেত্রেও মিথ, দুয়ো শব্দকলাপ ও পড়িয়ে-নেওয়ার যাবতীয় সরঞ্জাম ইস্তেমাল। এবং বিষয় পুরোপুরি অধীত, সংপৃক্ত, যেন রিচার্ডস ওয়ার্ক পড়ছি। যেমন, 'ডুবজলে', 'জলাঞ্জলি' আর 'নামগন্ধ' ---- এই ট্রিলজিতে মলয় এক-গোছের চাকরির জিগির এনেছেন, সেটা হল, টাটকা আর পচা নোট আলাদা করা, একশোটা নোটের প্যাকেট তৈরি করা, এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, যেন, 'অর্থনীতির স্নাতক হবার এই-ই পরিণাম। অমন বিতিকিচ্ছিরি কায়িক শ্রম করবার জন্যে ওই অফিসটা চেয়েছিল অর্থনীতি গণিত কমার্সে ভালো নম্বর প্রাপক স্নাতক।' অন্যদিকে, আজন্ম শহরবাসী মলয় কীভাবে পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলে পরিব্যাপ্ত রাজনীতি, অর্থনীতি, দুর্নীতি আর কালচার জরিপ করেছেন তা 'নামগন্ধে' পড়ে থ মেরে যায় পাঠক। 'এই ভেবে যে কী করে পারেন! রীতিমত 'আলু-সমাজ-নাম'গুলোর গন্ধতালাশ। প্রান্ত গন্ধ।' কাহিনী বা নাটক সেখানে ন্যূন, আগেই বলেছি, বরং তা ঘনিয়ে ওঠার সম্ভবনা দেখা দিলে মলয় তা নিরাসক্ত ও নির্মোহ মনে ভেঙে দিয়েছেন। অন্বেষণের মেধা প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে পাতায়-পাতায়, বিশেষত উপন্যাসের শেষ দিকটা মার্ভেলাস। খোদ মলয়ের জীবন যেমন, উপন্যাসও তেমনি ----- জীবনেরই, অথচ প্রথানুগতের বাইরে। জীবনেরই ছোট ছোট খণ্ড, জীবনের সমাহার যেন, সম্পূরক। যেমন একযুগ পর ভবেশকাকার।বোন খুশিদিকে দেখে অপ্রত্যাশিত ধাক্কায় নির্বাক আনন্দে ছারখার হয়েছে যিশু। 'পঞ্চাশ বছরের একজন বালিকাকে কাছে পাবার ক্ষমতাকে দুর্জয় করে তুলতে, উঠে বসেছিল যিশু।' ভোগদৃশ্যটা অবিস্মরণীয় ----- 'প্রশ্রয়প্রাপ্ত যিশু গনগনে ঠোঁট বুলায়, রুদ্ধশ্বাস, ত্রস্ত। সিনেমা দেখে, টিভি দেখে, উপন্যাস পড়ে মানুষ-মানুষীর যৌনতার বোধ কলুষিত হয়ে গেছে, সর্বজনীন হয়ে গেছে। খুশিদির জৈব-প্রতিদান, বোঝা যাচ্ছে, সেই অভিজ্ঞতায় নিষিক্ত নয়। থুতনির টোল কাঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে ওঠে খুশিদি; বলল, আয়, ভেতরের ঘরে চল যিশকা।'
 
আর, যেজন্য এই উপন্যাসের জিগির। মলয়ের লক্ষ্য গপ্পো বলা নয়, উপন্যাস গড়া নয় ---- ভাষা নির্মাণ। যেন, বাংলা গদ্যকে সশক্ত বনেদ পাইয়ে দিতেই তুখোড় কবিতাবাজ মলয় গদ্যের বাদাড়ে এসেছেন। গদ্য, যা বাঙালির যতিচিহ্ন। সমস্ত আবেগময়তাকে জোর ধাক্কা মেরে, থুয়ে রেখে, বাংলা গদ্যভাষাকে আরও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে মলয় মরিয়া। অন্তত নামগন্ধ বাবদ আমার স্বতোচ্ছ্বাস মারহাবা।