শনিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২১

Six Haikus by Malay Roychoudhury translated by Arunava Sinha

 Translated by Arunava Sinha

Six haikus: 
 
Spring in netherland
Swarms of bees knock at the door
The girl's floating corpse
~
Leaning out to see
The sky spread across the wind
Taillights just like blood
~
Her hands on her hips
Emperor Ashoka weeps
Black and freezing rocks
~
Crematorium
Coils of smoke and darting shrimps
The Buddha walks by
~
Someone's dead body
Hanging from the ceiling fan
There's a male spider
~
Memories of thieves
Tagore's slippers on the shelf
Much too large in size

শুক্রবার, ২৭ আগস্ট, ২০২১

"নামগন্ধ" উপন্যাস বিশ্লেষণ করেছেন অজিত রায়

 

“নামগন্ধ” উপন্যাস বিশ্লেষণ করেছেন অজিত রায়
মলয় রায়চোধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় পঁয়ত্রিশ বছর আগে। সামান্য অভূয়িষ্ট পড়াশোনা থেকে ক্ষুধিত প্রজন্মের কবি ও কবিতা নিয়ে একটা আচাভূয়া লেখা লিখেছিলাম ১৯৮২ সনে, এক মফস্বলী কাগজে, সেই তখন। এবং, সেই শুরু। সেদিনের সেই সব্রীড় আত্মপ্রতর্ক থেকে প্ররোচিত হই মলয়-সিসৃক্ষার কলিন অধ্যয়নে। ততদিনে, তার বিশ বছর আগেই হাংরি আন্দোলনের অন্যতম এই স্রষ্টার নখদন্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের শরীরে কিছু পিরেনিয়্যাল আঁচড় কেটে ধাবাড় মেরে গেছিল। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫-কেই বলা যায় হাংরি আন্দোলনের সবচেয়ে উত্তেজনাকর আর ঘনাবহুল অস্তিত্বকাল। যদিও জেব্রা উপদ্রুত ক্ষুধার্থ ফুঃ প্রতিদ্বন্দ্বী স্বকাল চিহ্ন উম্মার্গ ব্লুজ প্রভৃতি কাগজকে ঘিরে পাশাপাশি দেবী রায়, ফালগুনী রায়, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, সুভাষ ঘোষ, শম্ভু রক্ষিত, সুবো আচার্য, ত্রিদিব মিত্র প্রমুখেরা গড়ে তুলেছিলেন হাংরি সিসৃক্ষার আরেকটি চক্র। এবং আন্দোলনের উত্তেজনা থম মেরে গেলেও, তারপরেও সেই সব সেরকশ আর গেঁতো মৌমাছি, প্রাগুক্ত পত্রিকাগুলিকে আঁকড়ে ধরে কিছু কাল শর্করীবাজি চালিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু আসর আর জমেনি।
এহেন বিশাল ব্যবধানে, এই প্রেক্ষিতে কুড়ি-বাইশ বছর আগে বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত সংস্কারের বিরুদ্ধে, তার পচা ভিত্তিকে উৎখাত করার একান্ত অভীপ্সায় দুর্বিনীত আসব যিনি করেছিলেন, সেই মলয় রায়চোধুরী বিশ বছর বাদে লেখালেখির জগতে প্রত্যাবর্তন করতে চাইলে তাঁর কাছে প্রধান সমস্যাটা কী হতে পারে? এমনিতে পঞ্চাশের কবিরা যাঁরা হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন, আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর নিজেদের চরিত্র মোতাবিক লিখে আসছিলেন। শক্তির এতোলবেতোল জীবন শুরু হয়ে যায় আর তিনি রূপচাঁদ পক্ষী হয়ে যান, সন্দীপন একটা নির্দিষ্ট গদ্যে রেওয়াজ করতে করতে নিজস্ব শৈলীতে থিতু হন। বিদেশ থেকে ফিরে উৎপল বসুও কাব্যচর্চার নবাঞ্চল অব্যাহত রাখেন। ষাটের কবি হিশেবে অশোক চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, অরনি বসু, শম্ভু রক্ষিত, প্রদীপ চোধুরী প্রমুখের লেখালেখি থেমে থাকেনি এবং দেখা গেছে বয়স, অভিজ্ঞতা ও সিরিয়াসনেসের দরুন এঁদের কেউ কেউ খুঁজে পেয়েছেন নিজস্ব ফর্ম, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে একজন আলাদা হয়ে উঠেছেন অন্যজনের থেকে।
মলয়ের কেসটা এঁদের চেয়ে আলাদা। এবং আপাত জটিল। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির পীঠস্থান হিশেবে বিজ্ঞাপিত কলকাতার ধুলো মলয়ের পায়ের চেটোয় সেভাবে লাগেনি। কলকাতার একটা পুশিদা ক্লোমযন্ত্র আছে যা বামুন আর চাঁড়ালকে শুঁকে চিনতে পারে। কলকাতা মলয়কে নিজের দাঁত দেখিয়ে দিয়েছিল। কলকাতা তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, তুমি আমাদের কেউ নও। তুমি একটা কৃষ্টিদোগলা। তোমার কলমে নিম্নবিত্ত রক্ত। তোমার টেক্সট আলাদা। আলাদা থিসরাস। তফাৎ হটো তুমি। এবং, কলকাতা মলয়ের সঙ্গে সমস্ত শরোকার ছিন্ন করে। কোনও সম্পাদক তাঁর কাছে আর লেখা চান না, বন্ধুবান্ধবদের চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায় এবং ক্রমশ সবাই স্লিক করে যায়। লেখা ছাপানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই বীভৎস যন্ত্রণা, অপমান আর তিরস্কার একমাত্র কলকাতাই দিতে পারে। এই যন্ত্রণা, এই অপমানই লেখালেখি থেকে নির্বাসন ভোগের আরেক অব্যক্ত যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দিয়েছিল মলয়কে। ২৭ জুলাই ১৯৬৭, মানে, হাইকোর্টের রায়ে বেকসুর খালাস পাওয়ার পরদিন থেকে মলয় কবিতা লেখা ছেড়ে দেন। সবায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়, আর ক্রমশ নিজেকে অসীম একাকীত্বে ঘিরে ফেলেন। প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানের দুর্গদ্বার থেকে অপরিগৃহীত হয়ে লেখার জগৎ থেকে একান্তে অপসৃত হয়ে স্বরচিত নির্জনতার এক সুচারু এরিনায় নিজেকে বন্দী রেখে, রাইটার্স ব্লকের অখল জ্বালা ভোগ করা ---- হাংরিদের মধ্যে এটা একমাত্র মলয়ের ক্ষেত্রেই ঘটেছে।
আত্মবিবাসনের সেই বিবিক্ত দিনে, ১৯৬৮-র ডিসেম্বরে শলিলা মুখার্জির সঙ্গে উদ্বাহ সাময়িক স্বস্তি ফিরিয়ে আনে তাঁর জীবনে। জীবন নামক ভেলকিবাজ বারে-বারে মানুষকে ষাঁড়ের গোবর করে। চটকায়। ঘুঁটে বানিয়ে শুকোতে দেয়। আবার, পেড়েও আনে। জীবন লিখেওছে এমন এক ফিচেল কেলিকিন, যে কবিতা বোঝে না। মন বোঝে না। আদর্শ বোঝে না। আলোপিছল প্রতিষ্ঠানের মসৃণ করিডর দিয়ে হাঁটিয়ে সটান তুলে দেয় আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য আর কর্তৃত্বের সুনিপুণ এলিভেটারে। অর্থাৎ 'একদা আপোষহীন' পরে 'অংশভাক' এই ঐতিহাসিক গল্পের পুনরাবৃত্তি মলয়ের জীবনে ঘটাল সেই নর্মদ। এই ট্রাজেডির জন্যে আমরা ইতিহাস আর সময়কে বাদ দিয়ে বরাবর ব্যক্তিকে দায়ী করি, তাকে ব্যক্তির

 ট্রাজেডি হিশেবে চিহ্নিত করে সৌমনস্য উপভোগ করি, সে আমাদের প্রবলেম।
কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এক অনৈতিহাসিক তত্ত্ব। এ-খবর সত্যি যে বিবাহোত্তর প্রবাসে কিছুদিনের জন্যে এলিট সংসারী হয়ে উঠেছিলেন মলয়। সৃজন, সাহিত্য, বইপড়া, বাংলা ভাষা ইত্যাদি থেকে আরও দূরে সরে 

থাকবার মতো সরঞ্জাম তখন মজুত। মৎসরী বন্ধুরা হয়তো এই জেনে 

কিঞ্চিৎ আরামও উপভোগ করেছিলেন যে গার্হস্থ্য দায়িত্ব নির্বাহ করা ছাড়া মলয় 'আর কিছুই করছেন না'। ..... কিন্তু তাঁদের গুড়ে বালি নিক্ষেপ করে আশির দশকের গোড়ার দিকে বারদিগর লেখালেখির জগতে তুমুল বেগে ফিরে এলেন মলয় রায়চোধুরী।
প্রত্যাবর্তিত মলয়ের মধ্যে অনেক মাল, অনেক ময়ুজ। মানে, দারুণ-একটা রায়বেঁশে, হৈ হল্লা, তারপর নর্তকের আর কোমর-তোমার রইল না, মলয়ের কেসটা সের'ম নয়। তিনি যে হাত-পা ছুঁড়েছিলেন, বেশ-কিছু জ্যামিতিক পারফরম্যান্স দেখিয়েছিলেন ----- বিশ বছর বাদেও দেখছি, সেই কোরিওগ্রাফিটা থেকে গেছে। দেখেশুনে তো মনেই হচ্ছিল গুঁতো দেবার তালেই ছিলেন যেন। আর, গুঁতোবার আগে যেমন মাথা নিচু করে কয়েক পা পিছিয়ে যায় অগ্নিবাহন, তেমনি করে হয়তো-বা আবার করে অঙ্গহার দেখাবেন বলে খানিক জিরিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। কিম্বা, লেখা ছাপানো বন্ধ রেখে পরখ করে নিচ্ছিলেন তিনি টিঁকে আছেন, না উবে গেছেন।
১৯৮০-৮২ নাগাদ, বিশ বছর বাদে ফিরে-আসা সেই হৈচৈ-হীন নিরুত্তেজ উদ্দান্ত-যমিত শান্ত অব্যস্ত নিরুদ্বেগ ঠাণ্ডামাথা মলয় রায়চোধুরীর মধ্যে সে দিনের সেই উত্তপ্ত অস্থির আন্দোলিত প্রবহস্রোতের মাঝে অবগাহনরত মলয় রায়চোধুরীকে খুঁজতে যাওয়া গোঁয়ার্তুমি মাত্র। তবে, বুকের মধ্যে ঢেউয়ের সেই দাপানিটা আর নেই বটে, কিন্তু পানখ সাপের ফণাটা এখনও উদ্যত। সেই কর্কশ আর গতলজ্জ ভাষা, নিলাজ শব্দানুক্ৰমণের ফলাটা এখনো তেমনি পিশুন। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন করে বেড়ে-ওঠা অদম্য উৎসাহ, জেদ আর সামর্থ্য। যেন পুরনো দখলতি হাসিল করতেই তাঁর ফিরে আসা।
মলয়ের প্রাইম কনসার্ন হলো কবিতা। কবিতার মধ্যেই যা-কিছু দেখা ও দেখানো। ছয়ের দশকের মলয়ের চেয়ে অনেক বেশি লিখেছেন আটের দশকের প্রত্যাবর্তিত মলয়। পূর্বাপরের সঙ্গে স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় একটা সীমারেখা তিনি গড়ে ফেলেছেন অনেক দিন আগেই। কী কবিতায় কী গদ্যে পুনরুত্থিত মলয় খুব সচেতনভাবে নিজের একটা জায়গা বানিয়ে নিয়েছেন, এটা অবম বা ঊন কথা নয়। বাংলা সাহিত্যে প্রথা ভেঙে যেখানে কিছুই হয় না, মলয় রায়চোধুরী সেখানে একটা তাক-লাগানো মিশাল। পুনরুত্থিত মলয় গদ্যকার হিশেবেও অভিনিবেশযোগ্য। একটা খুবই সাদামাটা, ঝরঝরে, গতিশীল আর মেদবর্জিত গদ্যের কারিগর তিনি। আন্দোলনের সময়ে লেখা বিভিন্ন ইস্তেহার, প্রবন্ধ, পরবর্তী বা আটের দশক থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার জন্য লেখা হাংরি বিষয়ক আলোচনা, স্মৃতিচারনা, সাহিত্য বিষয়ক নিবন্ধ, তাঁর 'হাংরি কিংবদন্তী' (১৯৯৪) এবং হওয়া ৪৯ প্রকাশনীর 'পোস্টমর্ডানিজম' (১৯৯৫) গ্রন্থদ্বয়ে বাহন হয়েছে এই আকর্ষণীয় ও মূল্যবান গদ্য। অন্যদিকে আর একটি গদ্য আছে তাঁর, যা এখনো নিরীক্ষার পর্যায়ে, যাতে অনিবার নতুন আর আপাত-জটিল শব্দের তোড়, তাকে আশ্রয় করে মলয় তাঁর এখনকার মৌলিক গল্প-উপন্যাসগুলি লিখছেন। দারুন মডার্ন প্রোজ। দারুণ-দারুণ সব কৌণিময়তা, যে-মুহূর্তে ক্লিক করেন, মলয় আমাদের কাছে এ-সময়ের একজন মেজর গদ্যকার হিশেবে ফুটে ওঠেন। কিন্তু, এখানে তিনি শর্ট ডিস্টান্স রানার। বেশিক্ষণ নাগাড়ে ছুটতে পারেন না। এক-একটা প্যারাগ্রাফের দারুণ স্পিড, কিন্তু প্যারা ফুরোতেই যে দমও ফুরিয়ে আসে। মলয়ের বেশির ভাগ গল্প-উপন্যাস এই শ্রেণীর গদ্যে লেখা। যে, কারণে, শুধুমাত্র গদ্যের এই রেসের কারণেই তাঁর 'নামগন্ধ' বাদে অন্য কোনো উপন্যাস আমায় টানেনি। এটা আমার ব্যক্তিগত গদ্যকার হবার কুফলের দরুনও হতে পারে।
কবিতার মতো গদ্যেও মলয় খুব শব্দ-সচেতন। কোনো কোনো কখনওএতে যেন অতিরিক্ত সচেতন। প্রায় প্রত্যেকটা শব্দেই অনেক বেশি করে কলেজা-রক্ত, কিন্তু নুনের পরিমাণ একটু বেশি। শব্দ-ব্যাপারে মলয়ের ঢালাইঘরে অনবরত হিট ট্রিটমেন্ট। দারুণ মেদবিহীন গতিশীল গদ্যের তিনি প্রাকৃত-ভাণ্ডার। কিন্তু যেইমাত্র সচেতন হয়ে ওঠেন যে তিনি গল্প বা উপন্যাস লিখছেন, সেইমাত্র একরাশ আগুন-হলকা তাঁর হাত দিয়ে চাঁদির চন্দোত্তরি করে ফেলেন। ফলত স্ক্র্যাপ আয়রন আর স্টেইনলেস হয় না। ক্র্যাক হয়ে যায়। তিনি ভালোভাবেই জানেন, ধরো তক্তা মারো পেরেক গোছের লেখক তিনি নন। তবু মারা তিনি থামাতে পারেন না। যার ফলে পেরেকের পর পেরেক ভোঁতা হয়ে-হয়ে বেঁকে বেঁকে যায়। এর ফলে।কী হয়, কোনও কোনও অনুচ্ছেদ খুব দারুণ লাগলেও খুব কনট্রাইভড, গদ্য বানাবার দাগগুলো চোখে পড়ে যায়। এটাকে মলয়-গদ্যের দুর্বলতা বলুন, বা বৈশিষ্ট্য।
এই অবক্ষ্যমান গদ্যেই আমি মলয়ের 'দাফন শিল্প' পড়ি ১৯৮৪সালে, 'এবং' পত্রিকায়, যা পরে তাঁর প্রথম গল্পসংগ্ৰহ 'ভেন্নগল্প'-র অন্যতম ভূমিকা হিশেবে পুনর্মুদ্রিত। আবার সেই একই গদ্যে, সামান্য আলগা-ভাবে লেখা তাঁর প্রথম নভেলা 'ঘোঘ' পড়ি ১৯৯২ সনে এবং সেই গদ্যের উত্তরণ দেখি তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাসে' (১৯৯১-৯৩ সালে লেখা, এবং ১৯৯৪-এ প্রকাশিত)। তাঁর পরবর্তী উপন্যাস 'জলাঞ্জলি'ও এই গদ্যে লেখা। এমনকি আমার-পড়া তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস 'নামগন্ধ'ও সেই একই গদ্যে লেখা। ভেন্নগল্পের এক ডজন ছোটগল্প আর এই তিনটি উপন্যাস পড়ে বুঝেছি, তাত্ত্বিক মলয় আর লেখক মলয়ের মধ্যে একটা দারুণ প্রত্যাসত্তি রয়েছে। কিছু সর্ব-অস্তিত্বময় বর্তিষ্ণু চরিত্রকে ঘিরে লেখকের নিজস্ব চাকরিজীবন থেকে হাসিল অভিজ্ঞতা, নানা অন্তর্দেশীয় চেতনা আর আচার-আচরণের সঙ্গে সমকালীন রাজনীতির জটিল প্রভাব, তত্ত্ব ও তথ্যের প্রাচুর্যের সঙ্গে বোধ ও বুদ্ধির বিচিত্র জটিলতার এক-একটি ছবি ফুটে উঠেছে এইসব গল্প-উপন্যাসে। কলকাতার পাতি কাগজগুলোতে বিশেষত 'ডুবজলে'র উচ্চকিত প্রশংসা পড়ে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে বাঙালি পাঠকরা তাঁদের প্রোডরম্যান ফেজ কাটিয়ে উঠেছেন। আসলে আলোচক-পাঠকদের একটা গ্রূপ যে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তার মূলে বাংলা সাহিত্যের অনেক অচ্ছুৎ-অব্যবহৃত শব্দ আর ছবি একটা বিল্টি কেটে পাঠানো হয় সেই প্রথম। সতীনাথ ভাদুড়ী, প্রফুল্ল রায়, সুবিমল বসাককে মনে রেখেও বলা যায়, আবহমান বাংলা আখ্যান-সাহিত্যের ট্রাডিশনে যা আগে কখনো এভাবে খাপ খায়নি। মোটামুটি সবই এসেছে হিন্দি বলয় থেকে। খাস করে বিহারের দেশয়ালি আর সড়কছাপ জং-মরচে লাগা শব্দগুলোকে সামান্য ঝেড়েঝুড়ে তোলা হয়েছে এই ফিকশানে। ঐ ষাট-সত্তর দশক থেকেই বিহারি-ঝাড়খন্ডি বঙ্গকৃষ্টি দারুণ-দারুণ ঝাপটা মেরে বাংলা সাহিত্যের ঘাটে এসে লাগতে শুরু করেছিল। একটা সফল ঝাপটা ছিল ন'য়ের দশকের 'ডুবজলে'। বিহারের আর্থ-সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির এমন ভিতর-বার গুলিয়ে ফেলা ফিকশান আর কোথাওটি পাননি কলকাতার কূপব্যাঙ আলোচক-পাঠকরা। আর তাতেই তাঁরা দারুণ অমায়িক হোস্টেস হয়ে পড়েছিলেন 'ডুবজলে'র। কিন্তু, এটা, মলয়ও জানতেন, রানওয়ে মাত্র--- তিনি উড়ান দেখাবেন পরবর্তীতে। সেই উড়ান-ই হলো মলয়-ট্রিলজির শেষ পর্দাফাঁস উপন্যাস 'নামগন্ধ'।
মলয় জনান্তিকে বলেছেন, এ-উপন্যাস পশ্চিমবঙ্গের কোনো সম্পাদক ছাপতে সাহস পাননি, যে কারণে ঢাকার লালমাটিয়া থেকে বেরিয়েছিল আগে, পরে হওয়া ৪৯ থেকে বেরোয়। গোড়াতেই ফাঁস হয়ে গেল নামগন্ধে কী মাল তিনি দিয়েছেন এবং যা অবধার্য হয়ে উঠেছে এসময়ে, মলয়ের পাঠকৃতি সেই আধুনিক ঝোঁকে স্বতঃউৎসারিত। স্বীয় আয় করা দৃঠি ও অভিজ্ঞতাকে ছিঁড়ে পাঠবস্তুর টুকরো পাত্রে স্বত্বহীনভাবে বিলিয়ে দিচ্ছেন বহুরৈখিক আয়ামে। তাঁর অন্যান্য রচনার মতো এ উপন্যাসও দামাল ঝাপটা মারে ঝাদানভ-প্লেখানভদের বাঙালি ভাবশিষ্যদের এতদিনকার নির্বিঘ্নে মেলে রাখা অরজ্ঞানডির ভুলভুলইয়াপনায়। নামগন্ধেও কাহিনী পরিণাহটি ন্যূন, বক্তব্যেই মূলত মাটাম ধার্য করেছেন মলয়। তিনি সঠিক কষে ফেলেছেন যে বর্তমান কালখণ্ডে ভারতবর্ষীয় হিন্দু-বাঙালির তথাকথিত সংস্কৃতি মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রের ও তার চারপাশের সংস্কৃতি। মানে, ঐ কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী হাওড়া-হুগলি-চব্বিশ পরগণার সংস্কৃতি। সুতরাং গুনসুঁচ নিয়ে ধেয়েছেন ওই ক্ষমতাকেন্দ্রটিকে বেঁধবার জন্য।

একদিন মলয়দা, জায়মান কিংবদন্তী মলয় রায়চৌধুরী বেমক্কা একটা প্রশ্ন হেনে বসলেন ---- "অজিত, একটা কথা জানবার ছিল । নারীর যৌনতা নিয়ে লেখার সময়ে তুমি কি তার প্রেমে পড়ো ? এমন হয়েছে কি, যে লিঙ্গ দাঁড়িয়ে গেছে?"
প্রশ্নটা আমার কাছে মোটেই অস্বস্তিকর ছিল না। জবাবে লিখেছিলাম, মলয়দা, তুমি ভদ্দরলোকদের মতো 'লিঙ্গ' লিখেছো কেন? 'বাণ্ড' বললে কিচাইন হবার চান্স বলে আমি সরাসরি নিজের ভাষায় নামি। 'বাঁড়া' সহজবোধ্য, স্বয়ংসিদ্ধ ও সর্বত্রগামী শব্দ। আধুনিক বিশ্বকোষ প্রণেতা বাঁড়ার নামকরণ করেছেন 'আনন্দদণ্ড'। নামটা খাসা। তবে, অনেকে বলবেন 'মদনদণ্ড'। 'সাধনদণ্ড' বলেও সুখ। কিংবা 'কানাই বাঁশি'। কলকাতার রকফেলার আর হাফ-লিটারেট গবেষকরাও এই যন্তরটিকে নিয়ে কম মেহনত করেননি। 'কলা' 'ডাণ্ডা' 'রড' 'কেউটে' 'ঢোঁড়সাপ' 'পিস্তল' 'যন্তর' 'ল্যাওড়া' 'ল্যাও' 'লাঁড়' 'লন্ড' 'মেশিন গান' 'মটনরোল' 'ঘন্টা' 'ঢেন্ঢেন্পাদ' 'খোকা' 'খোকার বাপ' 'ধন' ' নঙ্কু' 'পাইপ' 'তবিল' 'পেনসিল' 'ফাউন্টেন পেন' 'মেন পয়েন্ট' ---- আরও কী কী সব নাম দিয়েছেন ওই প্রতাপী মহাপ্রাণীকে সদা উজ্জীবিত রাখতে! বিহার-ঝাড়খণ্ড-ইউপিতে 'ল্ওড়া' আর 'লন্ড' সুপার কোয়ালিটির স্ল্যাং, যা পূর্ব ভারতের সর্বত্র একই কিংবা খানিক বিকৃত উচ্চারণে ব্যবহার হয়ে থাকে। বাঙালি জবানে সেটা হয়েছে মিনমিনে 'ল্যাওড়া' 'ল্যাউড়া' 'ল্যাও' আর 'লাঁড়'। কিন্তু বাংলার নিখাদ 'বাঁড়া' বিহারে বোঝে না, পাত্তাও পায় না। ওপার বাঙলায়ও সর্বত্র বোঝে কি? ডাউট আছে। খোদ বর্ধমান আর বীরভূমেই বাঁড়াকে বলে 'বানা'। কুমিল্লায় ধনকে বলে 'দন'। কুমিল্লা, ঢাকা আর খুলনায় 'চ্যাট' শব্দটাও চলে। ময়মনসিংহে যেটা হয়েছে 'চ্যাম'। সিলেটেও 'চ্যাম'। সিলেটে আবার 'বটই'ও বলে। বাকরগঞ্জে 'চ্যাড' 'ভোচা'। বাকরগঞ্জের মোক্ষম স্ল্যাং হলো 'মদন কল'। 'ভোঁচান' আর 'ভুন' বলে রাজশাহীতে। এছাড়া রয়েছে 'ভুন্দু' 'ভুচা'। 'বিচা' বলে ঢাকা, কুমিল্লায়। কুমিল্লায় ফের 'শোল'ও বলে। বলে, 'নসকা'। 'সাঁও' বলে ফরিদপুরে, ময়মনসিংহে। 'প্যাল' আর 'বগা' চলে ময়মনসিংহ, রাজশাহী আর সিলেটে। চাঁটগেঁয়েরা বলে 'ফোডা'। যশোরের 'পাউন্ড' এসেছে খুবসম্ভব 'পিণ্ড' থেকে। 'বাচ্চা' বলে পাবনায়। 'পক্কি' চলে খুলনা, ফরিদপুর আর ময়মনসিংহে। 'পক্কু' শিশুদের শিশ্ন, এ-বঙ্গে যেটা 'নোঙ্কু' ব 'চেনকু' কিংবা ঝুটমুট 'পক'। ময়মনসিংহে বাঁড়ার অপর নাম 'থুরি'। আরেকটা প্রতিশব্দ 'শুনা' কুমিল্লায় চল আছে। চট্টগ্রাম আর নোয়াখালিতে বলে 'সনা'। আসলে, 'সোনা'। কেউ কেউ বলে সোনা, সোনামণি। মদনার বউটা ভোরবেলা আদর করে টুলস দিত, --- ও জামাই, ওঠো, জাগো। শ্বশুরবাড়ি যাবা না? শ্বশুরবাড়ি ছিল ওর ওইটে, আর জামাই ছিল মদনের এইটে। শ্বশুরবাড়ি ভোগে গ্যাচে, ফলে এ ব্যাটা হামানচোদা জামাই এখন ঢোঁড়সাপ হয়ে স্রেফ জাবর কেটেই খালাস। 'জাবর কাটা' বোজো তো? একষট্টি-বাষট্টি। মানে, খুচরো গোনা।। মানে, হাতলেত্তি। মানে হ্যান্ডেল করা। সকলেই নাকি করে। মদনাই বলছিল, 'মেয়েরা আঙুল করে, শুনিচি বেগুনও করে।' সত্তিমিত্তে জানিনে বাপু।
ভালো কথা। আরও একটা শব্দ যোগ করি। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা মলয়দার এই 'লিঙ্গ'কে বলে 'লিকাম'।
তো খালিপিলি এই লিকাম লইয়া পুরুষ কী করিবে? লিখিবেই বা কেন, আঁকিবেই বা কোন আহ্লাদে! ব্যাংক তাহার অচল যদি তার বাঁড়ার উপযুক্ত একটি পার্স না থাকে। বলছি, যেহেতু, বলছি আমাদের চালুচরকি সমাজের দিকে একপাক ঘুরে তাকাও, হালিতেই চোখে পড়বে যৌনতা। এ সমাজে যৌনতা মানে কিন্তু নারীক্ষেত্র। পুরুষ গৌণ। বেচছে ছাতু, দেখাচ্ছে নারীর বক্ষপট। পটকা, টিভি, মোবাইল, ভটভটির কথা না-হয় ছেড়েই দাও, ----- অপথ্যপথটি বাদে সেখানে নারীদেহের সব পার্টসই হাজির। বলে রাখি তোমায়, তুমি জানো, আমার সমস্ত উপন্যাসেই 'নারী' পুরুষের ইন্টেলেক্ট থেকে আঁকা। কিন্তু একজন বখাটে খানাখারাব হলে কি নারীদেহের মহার্ঘ পার্টসগুলোকে আমি অন্য চোখে দেখতাম? হয়ত, একদমই না। এ ব্যাপারে ভদ্দরলোক বলো, ছোটলোকই বলো, সব মিনসের এক রা। মাথার শিরোজ থেকে গোড়ের পদরজ, একটা হোলদামড়ি নারীর কী-ই না ভাল্লাগতো কালিদাসের! তবে আমার-মতো উনি কতখানি সাধুলোক ছিলেন, খটকা আছে। সাধুমণ্ডলে নারীর অষ্টোত্তর শতনাম। শঙ্খিনী, পদ্মিনী, চিত্রিণী, হস্তিনী ----- এসব তো মানুষের নিজস্ব এলেমে হয়নি, খোদ বিশ্বকর্তা নিজের হাতে গড়ে দিয়েছেন। ফের এদের মধ্যে শঙ্খিনী আর পদ্মিনী হলো 'আইটেম' বিশেষ। তেনার 'অন্তিমের মার'ও বলতে পারো। একা তুমি কেন, বাইবেলেও বলেছে, নারীই বিধাতার শেষ সৃষ্টি। 'হে শুভদর্শনা', অশোক ফরেস্টে সীতাকে দেখে রাবণ কেলিয়ে গিয়ে বলছেন, 'আমার মনে হয় রূপকর্তা বিশ্বনির্মাতা তোমায় রচনা করেই নিবৃত্ত হয়েছেন, তাই তোমার রূপের আর উপমা নেই।' অথবা, ঈভার প্রতি মিল্টন : 'ও ফেয়ারেস্ট অফ ক্রিয়েশন, লাস্ট অ্যান্ড বেস্ট / অফ অল গড'স ওয়র্কস'।
বাংলা সাহিত্যেও নারীর উপমা যে একেবারেই নেই, সেটা বললে বাওয়াল হবে। তবে আমি আমার কথাই বলব। 'যোজন ভাইরাসে' কমল রানীর বুকে কান পেতে শুনেছে সমুদ্রের কলকল। নারী সমুদ্র ছাড়া আর কী, বলো! হোক নোনা। কিন্তু নোনা থেকেই লোনা। লোনা থেকে লবণ। লবণ থেকে লাবণ্য। কত নুন খেয়েছো রানী! সব নুন কি তোমার দেহে? আর খেয়ো না। এতে সৌন্দর্য হারায়। অবিকগুলি খসে-খসে সহসা খোয়ায়।
সত্যি, এক বিশাল মহাযোনি পয়োধি এই নারী। আর পুরুষ কেসটা হলো, অই উষ্ণু মাংসল অলীক পাথার-কিনারে বাল্বের ছেঁড়া ফিলামেন্টের মতো অধীর কাঁপুনি সহ দাঁড়িয়ে থাকা পৌনে ছ'ফুট লম্বা একটা হাইটেন্ডেড ও ব্যবায়ী পুরুষাঙ্গ মাত্র। মাইরি একটা কথা কী জানো, খুব কৈশোর থেকে একজন পুরুষ তার যৌন-অহংকার নিয়ে তিল-তিল করে গড়ে ওঠে, স্রেফ, একজন নারীকে জয় করবে বলে। কিন্তু সে কি সেই কাঙ্খিত নারীকে পায়! পরিবর্তে যাকে পায়, তারও তল পায় না। কী যে চায় মৃণা, মহা ধাঁধা। একেক সময় মনে হয়, কী যেন খুঁজছে, অবিরত। ওফ, টস করেও বোঝা দায় এই মেয়ে জাতটাকে। একেক সময় খটকা জাগে,নারী এক হিংসাত্মক ও নাশকতামূলক শিল্প। নারী মৃত্যুর বিজ্ঞান। ডেথোলজি। আচ্ছা, এ নারী কে? এ দিনে এক, রাতে আরেক! এ নারীকে সত্যিই আমি চিনি না। পরিচিত দায়রার যথেচ্ছ-নারীর কাছে কোনোকালেই বিশেষ যাচনা ছিল না আমার। আমি এমন নারী খুঁজিনি যে শুধু ঘুমোতে আগ্রহী বা গামলা-ভরা খাদ্যে। নারীকে নারীর মুখ বা নারীর চোখ মাত্র আলাদা করে চাইনি, কেবলি। চেয়েছি টরসো মূর্ধা সৃক্ক নোলা কল্লা সিনা রাং নিতম্ব পয়োধর নাভি যোনি নবদ্বার সম্বলিত একটি পূর্ণাবয়ব নারী, যাকে স্পর্শ মাত্রের লহমা থেকে শব্দের স্রোত ধেয়ে আসবে বেবাক এবং প্রতিরোধহীন। স্ব-পরিচয়হীনা, জন্মহীনা, ইতিহাসহীনা, নিয়তিহীনা সেরকম কোনও নারী আজও আমার উপজ্ঞার বাইরে রয়ে গেছে। দ্য বেস্ট রিলেশান বিটুইন আ ম্যান অ্যান্ড আ উওম্যান ইজ দ্যাট অফ দ্য মার্ডারার অ্যান্ড দ্য মার্ডারড। দস্তয়ভস্কির কথাটাই কি তবে মোক্ষম? নারী পুরুষকে হালাল করবে, তার আগেই নারী বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত-সব বাহারি শব্দঘোঁটের বিছেহার জোর করে লাথিয়ে ভেঙে ফেলা দরকার যদ্বারা উদ্ঘাটিত হবে নারীর মৌল স্বরূপ।
খামোখা টেনশন নিও না। এটা, এই পুরুষ-সিস্টেমে স্বাভাবিক ব্যাপার। সিস্টেমটা যেহেতু পুরুষের, নারী হাজার বোল্ড হয়েও পুরুষের মতো নিজের কয়টাস চিরোতে পারে না। মানুষের সেক্সউয়াল ইন্টারকোর্স, বা কয়টাস, একটা খাড়া শিশ্নের যোনিতে প্রবেশ মাত্র নয়। সঙ্গমের ব্রড ডেফিনিশন হল, দা ইনসারশন অফ এ বাঁড়া ইনটু অ্যান অরাল, অ্যানাল, অর ভ্যাজাইনাল ওপেনিং, অ্যান্ড এ ওয়াইড ভ্যারাইটি অফ বিহেভিয়ার্স দ্যাট মে অর মে নট ইনক্লুড পেনিট্রেশন, ইনক্লুডিং ইন্টারকোর্স বিটুইন মেম্বার্স অফ দা সেম জেন্ডার্স। কিন্তু কপুলেশন বা চোদাচুদি, যা নিয়ত আমরা আত্ম-সংলাপে সহজ ভাবে ব্যবহার করি, ভদ্দরপুঞ্জে সহজ বা স্বাভাবিক উচ্চারণ নয়। কেননা এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অ্যাস্টোনিশমেন্ট আর ভ্যাজাইনাল সেন্সিবিলিটি। যে-কারণে 'চোদাচুদি' শব্দটা (যার উৎসে রয়েছে 'চোদা' ও 'চুদি' নামের দুই ভাইবোনের হাজার-হাজার বছরের মিথ-উপালেখ্য) আমাদের অন্যান্য অর্গানিক কারবার থেকে বেপোট হয়ে গ্যাছে। এ থেকেই পুরুষতন্ত্র সামাজিক ট্যাবু ম্যানুফ্যাকচার করেছে। শ্লীল-অশ্লীলের মধ্যে ভিড়িয়ে দিয়েছে কোন্দল। ওই কোন্দল আর তার অ্যাডহিরিং লুকোচাপার দরুন এদেশের ফিল্ম আর সাহিত্যেও যৌনতা দেখানো হয় পারভার্টেডলি।
কিন্তু পুরুষের চোখে বা অনুভবে মেয়েদের শরীর? এ ব্যাপারে ভদ্দরলোকই বলো, ছোটলোকই বলো, সব মিনসের এক রা! পুরুষতন্ত্রের ঢালাইঘর নারীকে ঝুটমুঠ বহু 'শেপ' দিয়েছে ---- শঙ্খিনী, পদ্মিনী, চিত্রিণী, হস্তিনী, ---- এগুলো কি বিধাতার কেরামতি? সব শালা পুরুষতন্ত্রের ধুড়কি। পুরুষের চোখে বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন খেপের, বিভিন্ন নেচারের মাগি। তাদের নামও তেমনি ভেরিয়াস। নারী বলতে বুঝি একজন স্তন ও যোনি সমন্বিত মেয়েমানুষ, কিংবা এনি অবজেক্ট রিগার্ডেড অ্যাজ ফেমিনিন। ফের 'স্ত্রী' বললে, যার এঁড়িগেঁড়ি বা পোলাপান আছে, অর্থাৎ বিয়ারার অফ আন্ডাবাচ্চা। মাদি শেয়াল বা বাদুড়ানীও বোঝায়। 'রমণী' বলতে, এ বিউটিফুল ইয়াং উইম্যান, মিসট্রেস ---- এবং, যাহা রমণীয়, রমণযোগ্য 'মাল'। 'ললনা'ও মাল, তবে ওয়ানটেন লেডি। 'লল', অর্থাৎ খেলুড়ে মাগি। বিবিসি। মানে, বাড়ির বউ ছিনাল। 'অঙ্গনা' ---- আ উইম্যান উইথ ওয়েল-রাউন্ডেড লিম্বস।। 'কামিনী' ---- আ লভিং অর অ্যাফেকশনেট উইম্যান, কিংবা টিমিড মাল। কিন্তু কামিনী বললে এসব ভদ্দরলোক তাঁদের চুদাউড়ি বউটিকেই বোঝেন, মরাগরুর দালালটা সঙ্গে অং করে যে মাগিটা পালহুড়কি দিয়েছে। 'বনিতা'ও বউ, তবে 'বধূ' বলতে এঁরা বোঝেন বিয়ে করে আনা বউটি। আর, 'যোষিৎ' বলেছে যাকে সে কেবল ছুঁড়ি, গার্ল, ইয়াং উইম্যান; অ্যান আইটেম।
তো, পুরুষতন্ত্র নারীর এতসব উপনাম দিয়েছে, শুধুমুধু 'যৌনতা'র দৃষ্টি থেকেই তো! মানে, পুরুষের 'একটি-মাত্র' নারী নিয়ে মন ভরে না। তারা চায় একাধিক। একটি নারীমূর্তি গড়তে বহু মডেল ইউজ করতেন প্রাক্সিটিলিস; কারো মাই, কারো মাজা, কারো দাবনা এবং কারো-বা পাছা নিয়ে রচিত হতো তাঁর এক একটি তিলোত্তমা। আমরা পুরুষরাও এহেন একটি হাগিং, লাস্টিং, উইশিং নারীমূর্তি ধারণা করি এবং তার জন্য একটা-করে জবর স্ল্যাং বানিয়ে রেখেছি। এটা পুরুষের যৌনতার হোমওয়র্ক। কাল যেন পড়া ধরবেন স্যার।
নারী বাবদ স্ল্যাং বানাতে বসে প্রথমেই যেটা, নারীদেহের খুফিয়া বিভাগে এন্ট্রি মেরেছে পুরুষ। বস্ত্র সরিয়ে উদোম করেছে, সর্বাগ্রে যাঁদের দর্শন পেয়েছে, তাঁরা যমজ, উভয়েরই নাম 'স্তন'। স্তন বোঝো তো চাঁদু? যা চিলি চিৎকারযোগে নারীর যৌবন অ্যানাউন্স করে। কিন্তু গোড়ায় গলদ। বাংলা ভাষার কুঁয়োর ব্যাঙ গবেষক-সংকলকরা যে শব্দগুলোকে স্তনের এওয়জ ভেবে টুকেছেন, তাতে স্তনের শেপ বোঝা গেলেও অ্যাপিয়ারান্স আর নেচারে গড়বড় আছে। চুচি, মাই, দুদু, বেল, বাতাবি, নারকেল, তরমুজ, লাউ, বেগুন, ডিংলা, বেলুন, হেভি ওয়েট, হেডলাইট ---- এগুলো ঠিক আছে। কিছুটা মেলে। কিন্তু আতা বা উইঢিবি কেন? স্তনের গায়ে গোঁড় আছে, না ভেতরটা ফোরা? ফের দ্যাখো, 'আনারদানা'! ওটা স্তনের দ্যোতক হলো? মানে, ডালিমের দানা! ওই সাইজের স্তন নাকি হয়! হাসলে বাংলার ডাগদার বাবু। ফের কেলিয়েছো 'নিমকি' ঢুকিয়ে। নিমকি তো ঢোকাবার জিনিশ। মানে গুদ। গুদ আর মাই এক হলো? ফের হাসালে পেঁপেসার। 'মেশিন' কেন? মেশিন তো বড়জোর ল্যাওড়া। পূর্ণযুবতীর স্তন হিশেবে 'হরিণঘাটা' চলতে পারে। তবে, 'সিঙ্গাড়া', 'পিরামিড' আর 'হাইহিল' কদাপি নহে। হে বঙ্গভাষার টুলোপণ্ডিতগণ! তোমরা স্ল্যাং-এর কিচ্চু বোজো না। তোমাদের অভিধানে অনেক ঝোলঝাল আচে। ঝুলে গ্যাচে বাবা লেতাই, কাচা তোমার খুলে গ্যাচে।
বলতে চাইছি, স্ল্যাং-এ থাকবে স্তনের গঠন ও প্রকৃতি, তাতে স্তনধারিণীর বয়স ও দেহের বিভাব জেগে উঠবে, সেটাই তো কাম্য। একটি অষ্টাদশী খেলুড়ে ললনার স্তনকে কি 'আমসি' বলা যাবে, নাকি 'বেগুনপোড়া'? কোন-কোন টুলো 'চুচি'কে বাদ দিতে চেয়েছেন স্ল্যাং থেকে। লজিক হলো, ওটা সংস্কৃত মূল শব্দ 'চুচক' থেকে ভায়া হিন্দী তদ্ভব 'চুচি' থেকে সরাসরি বাংলায় এসেছে, ----- এবং অভিধান স্বীকৃতও বটে। ওভাবে দেখলে, তাহলে তো 'চুত' শব্দটাকেও ছেঁটে ফেলতে হয়। কারণ সেটিও সংস্কৃত 'চুদ' জাত তদ্ভব হিন্দী আঞ্চলিক, ----- এবং সেটিও অভিধানে ঠোর পেয়েছে, যার মূল অর্থ 'যোনি'। অভিধানে ঠাঁই পেয়েছে বলে স্ল্যাং হবে না? তাহলে 'চুতমারানি'দের কীভাবে ডাকা হবে? এভাবে, তাহলে, 'মাগি'ও বাদ যাবার কথা। যেহেতু সেটা পালি 'মাতুগাম'-এর তদ্ভব রূপ এবং তার মূল ক্ষরিত অর্থ খালিপিলি 'মেয়েমানুষ'। হিন্দী 'চুচি'তে অষ্টাদশীর লমশমি স্তনের যে ব্যঞ্জনা, সে তো বহুল চালু বাংলা 'মাই'তেও দুর্লভ। আবার ভারিভরকম পেল্লাই থন-দুটিকে তো 'তরমুজ' কিংবা 'ফজলি আম'ই বলব। বড়জোর, 'বউ ফুসলানি আম'।
স্তনের সমীপশব্দ পাচ্ছি 'বুনি' 'বুচি' 'বুটকি'। এগুলো ও-বঙ্গের। খুলনায় চুচির নাম 'ফলনা'। যেটা ময়মনসিংহে গুদের নিকনেম। কুমিল্লায় উচ্চারণদোষে স্তন হয়েছে 'তন'। আমরা বলব, 'থন'। রংপুরে 'টমটমা'। ঢাকায় স্তনযুগলের বেড়ে নাম দিয়েছে, 'জোড়ামুঠিফল'। বগুড়ায় কিশোরীর উঠন্ত চুচির নাম 'বুচি'। আমাদের এদিকে 'কুল' 'লেবু' 'পেয়ারা' দেদার মেলে।
তারবাদে, টনটনে লবলবে বোঁটা দেখে কার না লালকি ঝরে! স্তনবৃন্তের কথাই বলছি, মালপোয়া বা পুলিপিঠের নয়। যা দেখে লিলিক্ষা জাগে, চোষার। তর্জনী ও বুড়ো নিশপিশ করে, দাঁতে চেপে চেবাতে জী ললচায়। স্তনবৃন্তের উপরিভাগকে বাকরগঞ্জে বলে 'পালনি'। 'বুডা' 'বুটা', এগুলোও ও-পাড়ায় চলে। তবে, আমরা সরাসরি 'বোঁটা'ই বলব। বোঁটা, বোতাম, চুমুর, কিশমিশ, নাট, সোপনাট, সুপুরি, রিঠা, ডুমুর। এছাড়া বড়জোর 'তকলি'। 'বাটিকোট' বলব বডিসকে। 'পৈতে' বলি তার স্ট্র্যাপকে। 'ব্রা' আর 'ব্রেসিয়ার' ----- দুটোই শিরশির করা শব্দ। জুড়ি নেই। কড়কড়ে বডিস বললেও অমনটা লাগে না। শকুন্তলা বলছে, 'সখী,অমন আঁট করে বাঁধিসনি,বল্কলের ভেতর বড্ড আইঢাই লাগে!' উত্তরে প্রিয়ংবদা বলছে, অত্র পয়োধর-বিস্তারয়িতৃ আত্মনঃ যৌবমেব উপালভস্ব ----- 'যে যৌবন তোর মাইদুটোকে অত বাড়ন্ত করেছে, তাকে দুষগে যা, আমাকে কেন!'
এবার নিচে নামো। তলার দিকে। চোখে পড়বে পেটি। তার মধ্যমণি 'নাভি'। নাই, নায়, ঢোঁড়ি, পেটি, টুনি, পুঁতি ইত্যাদি কত নাম পড়েছে ওইটুকু গত্তে! এগুলোর মধ্যে হিন্দী 'ঢোঁড়ি' কিন্তু একটা হাইভোল্টেজ স্ল্যাং। ওটা বাংলায় তাংড়ানো উচিত। অন্তত, নারীদেহের নাভির খাটচড়ি শব্দ এর চাইতে বেস্ট আর হয় না।
তা, মলয়দা, এরকম একটি নারীদেহ লাভিত হলে দাঁড়ায় বৈকি। তখন লেকামেকা চুলোয় যাক। বাকি কথা : লিঙ্গের লিঙ্গযোগ (পড়ো 'মনোযোগ') যেখানে দরকার সেখানেই খাড়ায় কেবল। নারী বা যৌনতা নিয়ে লেখার সময় নিরাসক্ত সন্ন্যাসী হয়ে থাকতে হয়, নচেৎ লেখাটা খাড়ায় না। এবং বলি, এই লেখাটিও লেখার সময় দাঁড়ায়নি, নট ইভন হাফ এমএম।

সাহিত্যে 'যৌনতা' বা 'অশ্লীলতা' শব্দ দুটি অচল। কারণ 'নির্মাণ' যদি 'সাহিত্য' হয়, উপরিউক্ত শব্দ দুটি বাতিল। কারণ সাহিত্য সাধনা। বস্তুত মনুষ্যজীবনে ঈশ্বরত্বের অন্য সংজ্ঞা 'সাহিত্যিক' বা 'কবি'। যিনি শ্রেষ্ঠ নির্মাণে ব্রতী, বিশ্বাসী বা সাধনায়, তাঁহার দ্বারা 'কদর্য' কিছু সম্ভব নহে। আমরা প্রায়শই ভুল করি। সাধারণ মগজের ভাবনায় কিছু কিছু 'শব্দে' নেহাৎ অশিক্ষিত, অপরিণত মস্তিষ্কের ব্যবহার করি। ভাবি না। ভাবিতে প্রস্তুত নই। কারণ কিছু কিছু পাঠক ইচ্ছাকৃতভাবেই সৎ, অমোঘ, নিত্য সাহিত্যকে দোষারোপ করা শ্লাঘার ভাবেন। তাঁহারা শ্রেষ্ঠ, সুন্দর দেখিলে বিকৃত হইয়া পড়েন। তাঁহারা এতটাই অশিক্ষিত, অপরিণত যে, 'আদিরস' 'কামরস' 'যৌনতা' ইত্যাদি শব্দ ও অশ্লীল, ভালগার, কদর্য, কুরুচির মধ্যে ব্যবধান করিতে পারেন না। অক্ষম সেইসব পাঠকের অশ্লীল চিলি-চিৎকারে প্রতিবেশী পাঠকের মনও কলুষিত হইতে থাকে।
জনাকয় যুবক-যুবতী মদ্য, মাংস, তামাক সমভিব্যাহারে ভিকটোরিয়া উদ্যানে। রাত্রি সাত ঘটিকা। যুবতীদের পরণে শাড়ি মাত্র। বক্ষবন্ধনী নাই। যুবকেরা কেহ লুঙ্গি, কেহ ধুতি। উত্তমাঙ্গ বিবস্ত্র। এক্ষণে পানীয় এবং যৌবনের তাগিদে যুবতীগণও বস্ত্রখণ্ড ত্যাগ করিল। স্বাস্থ্যবতী তাহারা, উদ্দাম ও যথেচ্ছ। সদ্য যুবতীদের হাসিতামাশা লাবণ্য ও যৌবন অকুস্থলে ক্লেশময় ইহাতে সন্দেহ নাই। কারণ যুবকগণের অর্ধমাঙ্গে নামমাত্র বস্ত্র। উভয়ে কামজর্জর।
ইদৃশ কাল্পনিক ঘটনা নগরে, অবশ্যই কুরুচিকর ও উদ্দেশ্যমূলক। অথচ ঝাড়খণ্ডের গ্রামে-গঞ্জে, একাধিক ভ্রমণে, দেখিয়াছি, যুবক-যুবতীরা হাট শেষে ঢিবরির সামান্য বায়ুতাড়িত শিখা ঘিরিয়া, পানীয়ে মত্ত। হাসিয়া মাতিয়া একাকার। যুবতীদের রৌদ্রস্নিগ্ধ দিনশেষের শরীর, ক্ৰমে পানীয়ে সতেজ ও সুন্দর। কেহই সচেতন নন। যুবক-যুবতী উভয়ে গাহিতেছে, নাচিতেছে, ইহা খুবই সরল সোজা দৃশ্য। ইহাতে বিন্দুমাত্র কুরুচি দেখি না। যৌন শিহরণ যদি বা থাকে তাহা সাহিত্য-রস মাত্র, 'কামরস' নহে। কারণ এইভাবেই তাঁহারা যুগযুগ ধরিয়া নির্বাহ করিতেছেন।
দুইটি দৃশ্যে স্বতন্ত্র ভূগোল, ইতিহাস, দর্শন, বোধ ইত্যাদি কাজ করিতেছে। প্রথম দৃশ্যে কেবল যৌন-বিজয়-সভা। মানুষ বা মনস্কতা তাহাতে বিন্দুমাত্র। কতক্ষণে পান করিয়া মত্ত ও মদির হইবেক, তাহার তাড়না। যাহা যথার্থই কুরুচি ও কুদৃশ্য। দ্বিতীয় দৃশ্যে একটি স্বাভাবিক পাহাড়িয়া জীবনবিন্যাস, আবহমান জীবন প্রবাহ।
মনে পড়ে, একদা মিলার সাহেব তাঁহার বিখ্যাত উপন্যাস 'ট্র্পিক অব ক্যান্সারে' যথেচ্ছ 'কান্ট' ও 'কক' ব্যবহার করিয়াছিলেন। যাহার বাংলা প্রতিশব্দ আমরা ভাবিতে পারি না। গ্রন্থটি অদ্যাবধি আদৃত। আমরা মহাভারত ব্যাপারেও সশ্রদ্ধ। অথচ এই আদিগ্রন্থ, যেখানে সাধুর বীর্য হরিণ ভক্ষণ করে, সাধুর রতিতে অপ্সরা (বেশ্যা) মত্ত, যথেচ্ছ যৌনবিহার। এমন কি ভরা রাজসভায় রানীর বস্ত্রহরণ বা শরীরলুন্ঠন। কুমারসম্ভব, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, ভারতচন্দ্র কে নহে! কেহই 'কাম' লইয়া মাতেন নাই, মাতিয়াছেন আদিরস লইয়া। কারণ নিষিদ্ধ ও আবৃত। যাহা যত আবৃত, তত রহস্যময় ও সুন্দর। এই আবৃত অংশ হইতেই কবিতার জন্ম হয়। 'কবিতা' রমণীর যৌনচিহ্ন হইতে জন্মাইল। ফলে এত সুন্দর, সুগন্ধী ও সুদৃঢ়। কবিতার রহস্য ও গভীরতা, কারণ রমণীর গুপ্ত শরীরে, গোপনে অপেক্ষা করিতেছিল।

আজ মলয়দার অফিসিয়াল জন্মদিন ছিল নাকি! মনের এই হয়েছে লিট্টিমি। ইদানিং বেজায় চাপ। পুজোর দু সপ্তা আগে থেকে আজ অব্দি স্ত্রীর হাসপাতালিকরন এবং তৎসংশ্লিষ্ট ঝক্কি ও উচাটন অথচ তারপরেও অপ্প যে জিরেন নেবো তার যো নেই। লেখার পচুর ফরমাস। এমতাবস্থায় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা তাত্ত্বিক তথা জায়মান কিংবদন্তি মলয় রায়চৌধুরীর জন্মদিনটা যদি ভুলেই যাই --- ক্ষুব্বেশি গাজোয়ারি হলো, বলো তোমরাই!

তো, মনে কিন্তু পড়েই গেল। অগত্যা একটা-কিছু লিখতেই হচ্ছে। একটা জিনিশ মার্ক করেছি, আমাকে বা মলয়দাকে নিয়ে যাঁরাই লেখালেখি করেছেন, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উদয়ন ঘোষ, রবীন্দ্র গুহ, কমল চক্রবর্তী, বারীন ঘোষাল, নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, কার্তিক লাহিড়ী, দেবজ্যোতি রায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজলক্ষ্মী দেবী, দীপঙ্কর দত্ত, বনানী দাস, তনুময় গোস্বামী, তপোধীর ভট্টাচার্য, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ হাসমত জালাল, প্রভাত মিশ্র, দিব্যাংশু মিশ্র, সঞ্জীব নিয়োগী, কৌশিক চক্রবর্তী, কৌশিক মিত্র, অরুণাভ দাস, ইরাবান বসুরায়, শুভম চক্রবর্তী আর যাঁদের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, যাঁরা আমাদের লেখালেখি নিয়ে আলোচনা করেছেন, তাঁদের কেউই আমার বা মলয়ের 'কালচারাল হাইব্রিড'-বোধের ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করেননি, বা, সেটাকে হাইলাইট করেননি। অনেকে হয়ত অজ্ঞানে, বা কলকাতাকেন্দ্রিক অনুশাসনিক ভাবুকতার কারণে সজ্ঞানে বাদই দিতে চেয়েছেন ব্যাপারটিকে। অথচ আমাদের দুজনেরই তামাম জীবন, পড়াশোনা, লেখাচর্চা, রাগ, ঘৃণা, তিক্ততা, আক্রমণের টার্গেট, বেঁচে থাকার বজহ বা অজুহাত, বেস, হয়ে ওঠা ইত্যাদির মূলে এই সাংস্কৃতিক দো-আঁশলাপনার বোধই যুগপৎ সুপ্ত ও মুখর থেকেছে। আজন্ম তথাকথিত 'বহির্বঙ্গে' লালিত এবং বহির্বঙ্গ-ফেরত মূল সংস্কৃতিতে বহিরাগত না-হলে হয়ত আমাদের লেখার নিজস্ব চিন্তাবিশ্বই গড়ে উঠত না। বিগ্রহ বা প্রতিষ্ঠান ভাঙা, প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে মাস্তানি ফুটপথিয়া ভাষায় মলয়ের কবিতায় দুর্যোধন চ্যালেঞ্জ জানায়, দ্যাখো তোমরা -----

"আব্ববে পাণ্ডবের বাচ্চা যুধিষ্ঠির

বহুতল বাড়ি থেকে নেবে আয় গলির মোড়েতে

নিয়ায় ল্যাঙবোট কৃষ্ণ ভীম বা নকুল কে কে আছে

পেটো হকিস্টিক ক্ষুর সোডার বোতল ছুরি সাইকেল চেন

বলে দে দ্রৌপদীকে আলসে থেকে ঝুঁকে দেখে নিক

আমাদের সঙ্গে আজ কিছু নেই কেউ নেই ....

কবিতা বা অন্যবিধ লেখালেখিতে কোনো পূর্বাদর্শ বা বিশুদ্ধতার চর্চা না করে মলয় আগাগোড়া নিজের প্রতি সৎ থাকার চেষ্টা সহ নিজের আহরিত জ্ঞান, মেধা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক রাজনীতিক আর্থিক ও সাংস্কৃতিক তত্ত্বগুলোকে বিশ্লেষণ করেছেন এবং আধুনিকতার এইসব উপাদানের অসারতা প্রতিপন্ন করার মাধ্যমে সীমানা ভাঙার কাজ করে এসেছেন বলেই আজ তিনি মনোযোগ ও বিতর্কের বিষয়। আর এসবের পেছনে স্বাভাবিক ও পরোক্ষ ভিত্তি হিশেবে, অনুঘটকের কাজ করেছে তাঁর শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন ও প্রৌঢ়ত্ব জুড়ে বিহার ও ভারতবর্ষের অন্যান্য ভাষা-সংস্কৃতির রাজ্যে সুদীর্ঘ যাপন। এই যাপনই তাঁকে দো-আঁশলা সাংস্কৃতিক জীব হিশেবে নিজেকে দেখার স্বচ্ছতা ও অকপটতা দিয়েছে ভাবলে ভুল হবে না।

বিহার-বাংলার যৌগ-সংস্কৃতি থেকে উঠে এসেছিলেন বলে, দুষ্কৃতী অধ্যাসিত বস্তিতে প্রতিপালিত হয়েছিলেন বলে, এবং ক্ৰমে-ক্ৰমে বঙ্গসংস্কৃতির বদলায়মান স্বরূপ জলবৎ দেখে ফেলেছিলেন বলে, বাংলা কবিতা ও আখ্যান সাহিত্যে কলকাতার ঔপনিবেশিক প্রভুমুখী দাসত্ব লক্ষ করেছিলেন বলেই, চেতোমান মলয় প্রথম থেকেই তাঁর লেখায়, বিশেষত কবিতায়, সন্ত্রাস অথবা তাঁর স্বীয় ভাষায় 'ছুরি চাকু চালানো' রপ্ত করেছেন। তাঁর বহু কবিতায় ওই সেলাখানার বিবরণ আছে, এবং সেই সন্ত্রাসী চিত্রকল্প। আর এইসব চিত্রকল্পের ধারাবাহিক অনুশীলনে তাঁকে স্বাভাবিক ভাবেই সাহায্য করেছে তার বাস্টার্ড কালচার। তাঁর আশৈশব-আহরিত প্রায় হাজার খানেক অঘোরি ছোটলোকি অশ্লীল কুৎসিৎ কুচেল অসৎ অভাগা দুর্ব্যবহৃত শব্দাবলি ও তার অভ্যন্তরীণ ইথস। বর্তমানের প্রতিফলনের দরুন সন্ত্রাসী ইমেজ, যা নিছক জান্তব বা যৌন নয়, এ এক মলয় রায়চৌধুরীর কবিতাতেই মেলে। যৌগ-সংস্কৃতির ডামাডোল অবস্থান থেকে সীমালঙ্ঘনের, বিগ্রহ ও মসনদ ভাঙার, যৌক্তিকতা ও আধুনিকতার দর্শনকে এভাবে গুমখুন পাল্টাখুন করার কাজটি, ফালগুনী রায়কে মনে রেখেও বলা যায় ---- ইতিপূর্বে বাংলা কবিতায় অন্য কেউ করেছেন বলে মনে হয় না। যৌগ-সংস্কৃতিতে মানসিক দীর্ঘ যাপনের কারণেই, বাংলার তাবৎ শব্দাবলিতে তাঁর নিবাস থাকা সত্ত্বেও, তিনি যখনই কিছু লেখেন, ওই দোআঁশলা সাংস্কৃতিক নিবাসটি তাঁর সদরে এসে কড়া নাড়ে। এই সততা, এই অকপটতা আমরা আর কার মধ্যে দেখেছি?

আসলে, আমার মনে হয়, যে-কথা আজিজুল হকও বলেছেন, মলয় রায়চৌধুরী এক অন্য পেরিফেরির জীব। মলয়ের হার্ট খুব স্ট্রং, রক্তে দুর্নিবার তেজ। মলয়ের চাইতে অনেক গুণ বড়ো ভাবুক ও মেধাবান চরিত্র ছিলেন সমীর রায়চৌধুরী। কিন্তু, আমার মনে হয়, মলয় আগাগোড়াই 'হয়ে উঠতে' চেয়েছেন। এই হয়ে-ওঠা সবার 'বশের' কথা নয়। হয় ক্ষমতার অভাব, নয় তষ্টির। মলয়ের ফলাফলটা বিলকুল যাকে বলে, রেস্পন্সিবল ইরেন্সিবলিটি। এই সূত্রেই একটা না-তোলা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। যে, মলয় রায়চৌধুরী কীসের জোরে নিজেকে হয়ে ওঠালেন, বিগ্রহের বিরুদ্ধে দাঁড় করালেন, হাতুড়ি চালালেন --- সেই মানসিক, চেতনিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটটি সমগ্রতার আলোকে অনুসন্ধানের তাগিদ একটা তাই থেকেই যাচ্ছে গবেষকদের কাছে। আর কিছুদিন সময় নিচ্ছি। হয়ত লোকডাউন ঘুচলে এই নিয়েই আমার একটি গদ্যগ্রন্থ আসবে। তাতে আমার এই গর্ব অবশ্যই নথি থাকবে, যে, একদিকে জাঁদরেল মূর্খ প্রতিষ্ঠান, ব্রিটিশ গুরুর বীর্যিত পচাগলা মূল্যবোধে আকণ্ঠ বাঙালি বুদ্ধিজীবী-আলোচকের কেরবালা যাঁকে বুঝতে না পেরে, বা সভয়ে, এড়িয়ে রয়েছেন, মুখ ফিরিয়ে, তাঁকে সহ্য করতে না-পারা রঙরুট বন্ধুদের রিসালা, তাঁদের সম্মিলিত করাল মেঘের সামনে একটি সেলাই-না-পড়া লেখকের দ্বারা এই অঘটন তাঁদের দিনদাহাড়ে চাক্ষুষ করতে হবে।

মলয় রায়চোধুরীকে বাঙালি পাঠক এখন অনেক ভাবে চেনে। ষাট দশকের হাংরি আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ, নতুন কবিতাধারার প্রবর্তক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সমালোচক ও অনুবাদক; মায়, দু-একটি কাঁপা হাতের স্কেচও আমরা দেখেছি। এই ভার্সাটাইল কাজকর্ম নিয়ে, তিনি একজন পোস্টমডার্ন ভাবুক। জীবনের যা কিছু ---- বাঁচা, বেঁচে থাকা, ভাষা সংস্কৃতি শিক্ষা, বিজ্ঞান অর্থনীতি রাজনীতি, ভূগোল ইতিহাস সাহিত্য ইত্যাদি প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে তাঁর ভাবনাগত আনাগোনা। অথচ তিনি নিজেকে কোন বিশেষ অভিধায় চিহ্নিত করতে নারাজ। কেননা তিনি মনে করেন নিজেকে বা অপরকে অভিধায়িত করার যেসব শব্দাবলি চারপাশে সাজানো আছে, এখনো, সবই ব্রিটিশ মাস্টারদের ফেলে-যাওয়া বইপত্র, অভিধান আর আধুনিকতাবাদীদের বুকনি থেকে নেওয়া। অথচ মলয় বিশ্বাস করেন শেষ বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ার যে হালচাল, রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি তাতে সেরকম মডারনিস্ট স্পেশালাইজড ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার সার-বীজ সব পচে-হেজে নষ্ট হয়ে গেছে। 'আধুনিকতা' ব্যাপারটাই এখন 'একখানি ধ্রুপদী জোচ্চোর'। বলেছেন তিনি, এতদিন, 'আধুনিকতা ভালো, নৈতিক, নান্দনিক, প্রগতিশীল, উন্নত, কাম্য, কল্যাণময় এমনতর ভাঁওতায় ভুলিয়ে রাখা হচ্ছিল বাংলা ভাষাকে।' এহেন সময়ে একজন সমাজ ও সময় সচেতন লেখক যা করতে পারেন, তা হলো, বিগ্রহ ভাঙার কাজ। মলয় রায়চোধুরীর বেশির ভাগ রচনায় হাতুড়ির সেই চিহ্ন আমরা দেখেছি। কোন ধর্মভীরুতা বা প্রলোভন তাঁকে এই ভাঙার কাজ থেকে নিরস্ত করতে পারেনি, না বিদ্যায়তনিক মাস্তানদের ঘাতক-ছুরি। বাংলা ভাষায় প্রতিষ্ঠিত আধুনিক ও এঁদো চিন্তাভাবনা ও তার ভেক্টর প্রতিষ্ঠানের মুখে জোর থাপ্পড় মেরে তার গিল্টি-করা দাঁত উখড়ে দিতে চেয়ে মলয়ের লেখার জগতে প্রবেশ। আজীবন অর্জিত নিজের ভোগান্তি, অভিজ্ঞতা, পড়াশোনা আর প্রজ্ঞাকে অস্ত্র করে তিনি যা-কিছু প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তা-উদ্ভূত, মেরে লটলট ধ্বসিয়ে ফেলতে চেয়েছেন। একজন কালচেতন, সদাজাগ্রত লেখক প্রতিষ্ঠানের সামনে কী ভীষণ প্রব্লেম্যাটিক হয়ে উঠতে পারেন, তার জলজ্যান্ত মিশাল মলয় রায়চোধুরী।

নিজেকে কালচারাল বাস্টার্ড বলেছেন মলয়। নিজেকে বলেছেন, বাঙলার মূল সংস্কৃতিতে আউটসাইডার। তাঁর বিভিন্ন রচনা,গল্প ও উপন্যাসে আমরা তাঁর সেই জারজ উপাদানের সুসম্বদ্ধ রূপটি গড়েও নিতে পারি। মজার ব্যাপার হচ্ছে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতাহীন, হতাশাখোর, তথাকথিত শিক্ষিত হায়ারক্লাস বুদ্ধিজীবীরা মলয়ের পশ্চিমবঙ্গ-হামলার মনসুবাটা ধরতে পারেননি। আমি নিজে তথা-অর্থে 'বহিরাগত' হওয়ার দরুন স্থূল ও সূক্ষ্ম দু-নিরীখেই অনুধাবন করেছি পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক কাঠামোর মূল স্বরূপ বিশ্লেষণে মলয় কিন্তু আগাগোড়াই খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ, যার তন্নতন্ন প্রতিফলন তাঁর লেখাজোখায় দুরনিরীক্ষ্য নয়। বাঙালির ভিড় থেকে, হরির লুঠ থেকে, বাঁধাধরা বঙ্গ-কালচার থেকে স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্ন এবং সর্বোপরি ভারতবর্ষীয় হিন্দু-বাঙালি সংস্কারের সর্বোচ্চ পীঠ বলে কথিত কলকাতা থেকে ২৬০ কিমি দূরে পড়ে আছি বলেই আমার কাছে ইঁদুরের প্রতিটি লাফ আর চাল জলবৎ ধরা পড়ে। তথাকথিত 'প্রবাস'-যাপনের সুবিধে এটাই যে, নিজের সঙ্গে অন্যের সাদৃশ্য ও পার্থক্য হবহু ধরে ফেলা যায়। দেখতে পাই দ্বৈরাজ্যের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই বিশ্বচরাচর, তার প্রতিটি নড়ন ও চড়ন। মলয় রায়চোধুরী আজন্ম মূল বঙ্গ-সংস্কারের বাইরে বাস করে এই একই মাইক্রো-দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা ও বাদ-বাংলার সংস্কৃতিকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি দেখেছেন যে-বঙ্গসংস্কৃতিকে নিয়ে বাঙালির এত আত্মম্ভরিতা, গুমর আর বারফট্টাই ----- সেই বিশুদ্ধ বঙ্গসংস্কৃতির হদিশ পৃথিবীতে আজ কোথাও নেই। ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপে নানা জাতি ও সংস্কারের,বিশেষত মুসলিম ও ইংরেজ বেনিয়ার শাসনে, সর্বোপরি ভৌগোলিক কাটছাঁট, দেশভাগ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক স্পৃহার খপ্পরে পড়ে বাঙালি নিজের সর্বস্ব আজ খুইয়ে ফেলেছে। এমনকী, বিশুদ্ধ পশ্চিমবঙ্গীয় সংস্কৃতিও আজ মিথ মাত্র। ভারতবর্ষীয় বাঙালির কোন সংস্কৃতিই আজ অবশিষ্ট নেই; সময়ের চাপে সব উচ্ছন্নে গেছে। জন্ম নিয়েছে এক জগাখিচুড়ি কালচার। ছত্রখান সংস্কৃতি। বাঙালির পোশাক পাল্টেছে বহুদিন হল,বহু খোঁপা আর সিঁথি এখন বিদেশিনী হয়ে গেছে, এমনসব হেয়ারডু যা বাঙালি কস্মিনকালে ভাবেনি। পুরুষেরা তামুক দোক্তা বিড়ি গড়গড়া ছেড়ে সিগারেট বিয়ার ব্রাউনসুগারে মজেছে। যে-ফুটবলে বাঙালির নিজস্ব দাপ ছিল তা এখন আকখা ওয়ার্ল্ড খেলছে, বাঙালি লোকাল ট্রেনে আর রকে বসে খেলছে তিন-পাত্তি, টোয়েন্টি নাইন। বাঙালি টুসু ভাদু রবীন্দ্রসঙ্গীত ভুলে পাঞ্জাবি পপে মাজা দোলাচ্ছে। পড়াশোনা চাকরি ব্যবসা থেকে ক্ৰমে উৎখাত হতে হতে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি বলে যা রয়ে গেছে, তা হলো, রকে বসে বুকনি ঝাড়া, পরস্পর পেছনে লাগা, লেংগি মারা, মিথ্যে বলা, হীনমন্যতা, চা চপ ঝালমুড়ি, লোকনিন্দা, ভাইয়ে-ভাইয়ে হিংসে, কথায় কথায় মাথাগরম আর খিস্তিবাজি। পাশাপাশি শনি-শেতলার পুজো, তৃণমূল-সিপিএম, আর দুগ্গাপুজোয় চাঁদা আর হুল্লোড়বাজি।

তো, এইখান থেকে আমাদের পাঠ শুরু হয় মলয়-ট্রিলজির শেষ পর্দা-ফাঁস উপন্যাস "নামগন্ধে"র। মলয় জনান্তিকে বলেছেন, এ-উপন্যাস পশ্চিমবঙ্গের কোনো সম্পাদক ছাপতে সাহস পাননি, যে কারণে ঢাকার লালমাটিয়া থেকে বেরিয়েছিল আগে, পরে হওয়া ৪৯ থেকে বেরোয়। গোড়াতেই ফাঁস হয়ে গেল নামগন্ধে কী মাল তিনি দিয়েছেন এবং যা অবধার্য হয়ে উঠেছে এসময়ে, মলয়ের পাঠকৃতি সেই আধুনিক ঝোঁকে স্বতঃউৎসারিত। স্বীয় আয় করা দৃঠি ও অভিজ্ঞতাকে ছিঁড়ে পাঠবস্তুর টুকরো পাত্রে স্বত্বহীনভাবে বিলিয়ে দিচ্ছেন বহুরৈখিক আয়ামে। তাঁর অন্যান্য রচনার মতো এ উপন্যাসও দামাল ঝাপটা মারে ঝাদানভ-প্লেখানভদের বাঙালি ভাবশিষ্যদের এতদিনকার নির্বিঘ্নে মেলে রাখা অরজ্ঞানডির ভুলভুলইয়াপনায়। নামগন্ধেও কাহিনী পরিণাহটি ন্যূন, বক্তব্যেই মূলত মাটাম ধার্য করেছেন মলয়। তিনি সঠিক কষে ফেলেছেন যে বর্তমান কালখণ্ডে ভারতবর্ষীয় হিন্দু-বাঙালির তথাকথিত সংস্কৃতি মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রের ও তার চারপাশের সংস্কৃতি। মানে, ঐ কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী হাওড়া-হুগলি-চব্বিশ পরগণার সংস্কৃতি। সুতরাং গুনসুঁচ নিয়ে ধেয়েছেন ওই ক্ষমতাকেন্দ্রটিকে বেঁধবার জন্য।

উপন্যাস শুরু হচ্ছে একটা সন্ত্রাস দিয়ে, মলয়ের এটা অমোঘ টেকনিক, ----- পাঠকের সামনে সন্ত্রাস ঘটিয়ে, তাকে তার মধ্যে হিঁচড়ে ঢুকিয়ে সন্ত্রস্ত করে, সন্ত্রাসের বিভীষিকা মেলে ধরা। বঙ্গ-কালচারের বর্তমান হাল বোঝাতে মলয় হাওড়া জেলার ভোটবাগানের লোহার কাবাড়িখানা, নদিয়া জেলার কালীগঞ্জের কাঁসা-পেতলের ভাংরি, বিভিন্ন জেলার আলুর কোল্ড-স্টোরেজ মন্তাজ করে ফুটিয়ে বঙ্গভূবন একাকার করে ফেলেছেন। 'মুসলমান রাজার আমলে যেমন ছিল তালুকদার দফাদার পত্তনিদার তশিলদার মজুমদার হাওলাদার, এই আমাদের কালে হয়েচে পার্টিদার, আজগালকার জমিদার'। নমঃশূদ্রদের খুন ধর্ষণ বাড়িঘর জ্বালিয়ে যখন তাড়ানো হয়েছিল খুলনার মাইড়া গ্রাম থেকে, পঞ্চাশ সনে, যুবক ভবেশকাকা রাতারাতি পালিয়ে এসেছিল কচি ফুটফুটে সৎ বোনকে কোলে নিয়ে। পুরনো বাড়ির পাড়ায় ইউনাইটেড রিহ্যাবিলিটেশন কাউনসিলের 'আগুন-খেকো নেতা' ছিল ভবেশকাকা, যিনি বিধান রায় ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ট্রামে আগুন ধরিয়ে দেন। তিরিশ বছর আগে আরামবাগি প্যাঁচে কংগ্রেসি আলুর দাম হঠাৎ বাড়লে, খাদ্য আন্দোলনের দিনগুলোয়, তুলকালাম করেছিলেন। দেশভাগের খেলাপে নারাবাজি করেছিলেন, 'হাতে পেলে জহোরলাল জিনহাকে চিবিয়ে পোস্তবাটা করে'।। সেই ভবেশ মণ্ডল আজ মোকররি আর চাকরান মিলিয়ে বাহান্ন বিঘে জমি আর একলাখ কুইন্টাল ক্ষমতাসম্পন্ন মোহতাজ হিমঘরের অংশীদার। যিশুর / লেখকের মন্তব্য : 'আজকাল গ্রামগুলোর সত্যের স্বামীত্ব ভবেশকাকাদের হাতে।' আর 'চাষির মুখের দিকে তাকালে সর্বস্বান্তের সংজ্ঞা টের পাওয়া যায়।'

মলয় নিজেকে গদ্যকার সাব্যস্ত করতে আদৌ গল্প-উপন্যাসে আসেন নি। তবু, গোড়া থেকেই যেটা সচেতনভাবে করেছেন, গল্প-বানানোর প্রথাগত টেকনিক ও সিদ্ধ নিয়মগুলোকে বানচাল করে বাংলার চলে-আসা মূল সাহিত্যধারাকে একেবারে অস্বীকার করার চেষ্টা। ভাষার ক্ষেত্রেও মিথ, দুয়ো শব্দকলাপ ও পড়িয়ে-নেওয়ার যাবতীয় সরঞ্জাম ইস্তেমাল। এবং বিষয় পুরোপুরি অধীত, সংপৃক্ত, যেন রিচার্ডস ওয়ার্ক পড়ছি। যেমন, 'ডুবজলে', 'জলাঞ্জলি' আর 'নামগন্ধ' ---- এই ট্রিলজিতে মলয় এক-গোছের চাকরির জিগির এনেছেন, সেটা হল, টাটকা আর পচা নোট আলাদা করা, একশোটা নোটের প্যাকেট তৈরি করা, এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, যেন, 'অর্থনীতির স্নাতক হবার এই-ই পরিণাম। অমন বিতিকিচ্ছিরি কায়িক শ্রম করবার জন্যে ওই অফিসটা চেয়েছিল অর্থনীতি গণিত কমার্সে ভালো নম্বর প্রাপক স্নাতক।' অন্যদিকে, আজন্ম শহরবাসী মলয় কীভাবে পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলে পরিব্যাপ্ত রাজনীতি, অর্থনীতি, দুর্নীতি আর কালচার জরিপ করেছেন তা 'নামগন্ধে' পড়ে থ মেরে যায় পাঠক। 'এই ভেবে যে কী করে পারেন! রীতিমত 'আলু-সমাজ-নাম'গুলোর গন্ধতালাশ। প্রান্ত গন্ধ।' কাহিনী বা নাটক সেখানে ন্যূন, আগেই বলেছি, বরং তা ঘনিয়ে ওঠার সম্ভবনা দেখা দিলে মলয় তা নিরাসক্ত ও নির্মোহ মনে ভেঙে দিয়েছেন। অন্বেষণের মেধা প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে পাতায়-পাতায়, বিশেষত উপন্যাসের শেষ দিকটা মার্ভেলাস। খোদ মলয়ের জীবন যেমন, উপন্যাসও তেমনি ----- জীবনেরই, অথচ প্রথানুগতের বাইরে। জীবনেরই ছোট ছোট খণ্ড, জীবনের সমাহার যেন, সম্পূরক। যেমন একযুগ পর ভবেশকাকার।বোন খুশিদিকে দেখে অপ্রত্যাশিত ধাক্কায় নির্বাক আনন্দে ছারখার হয়েছে যিশু। 'পঞ্চাশ বছরের একজন বালিকাকে কাছে পাবার ক্ষমতাকে দুর্জয় করে তুলতে, উঠে বসেছিল যিশু।' ভোগদৃশ্যটা অবিস্মরণীয় ----- 'প্রশ্রয়প্রাপ্ত যিশু গনগনে ঠোঁট বুলায়, রুদ্ধশ্বাস, ত্রস্ত। সিনেমা দেখে, টিভি দেখে, উপন্যাস পড়ে মানুষ-মানুষীর যৌনতার বোধ কলুষিত হয়ে গেছে, সর্বজনীন হয়ে গেছে। খুশিদির জৈব-প্রতিদান, বোঝা যাচ্ছে, সেই অভিজ্ঞতায় নিষিক্ত নয়। থুতনির টোল কাঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে ওঠে খুশিদি; বলল, আয়, ভেতরের ঘরে চল যিশকা।'

আর, যেজন্য এই উপন্যাসের জিগির। মলয়ের লক্ষ্য গপ্পো বলা নয়, উপন্যাস গড়া নয় ---- ভাষা নির্মাণ। যেন, বাংলা গদ্যকে সশক্ত বনেদ পাইয়ে দিতেই তুখোড় কবিতাবাজ মলয় গদ্যের বাদাড়ে এসেছেন। গদ্য, যা বাঙালির যতিচিহ্ন। সমস্ত আবেগময়তাকে জোর ধাক্কা মেরে, থুয়ে রেখে, বাংলা গদ্যভাষাকে আরও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে মলয় মরিয়া। অন্তত নামগন্ধ বাবদ আমার স্বতোচ্ছ্বাস মারহাবা।





মঙ্গলবার, ২৪ আগস্ট, ২০২১

অজিত রায় লিখেছেন

 অজিত রায় লিখেছেন

মলয় রায়চোধুরীকে বাঙালি পাঠক এখন অনেক ভাবে চেনে। ষাট দশকের হাংরি আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ, নতুন কবিতাধারার প্রবর্তক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সমালোচক ও অনুবাদক; মায়, দু-একটি কাঁপা হাতের স্কেচও আমরা দেখেছি। এই ভার্সাটাইল কাজকর্ম নিয়ে, তিনি একজন পোস্টমডার্ন ভাবুক। জীবনের যা কিছু ---- বাঁচা, বেঁচে থাকা, ভাষা সংস্কৃতি শিক্ষা, বিজ্ঞান অর্থনীতি রাজনীতি, ভূগোল ইতিহাস সাহিত্য ইত্যাদি প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে তাঁর ভাবনাগত আনাগোনা। অথচ তিনি নিজেকে কোন বিশেষ অভিধায় চিহ্নিত করতে নারাজ। কেননা তিনি মনে করেন নিজেকে বা অপরকে অভিধায়িত করার যেসব শব্দাবলি চারপাশে সাজানো আছে, এখনো, সবই ব্রিটিশ মাস্টারদের ফেলে-যাওয়া বইপত্র, অভিধান আর আধুনিকতাবাদীদের বুকনি থেকে নেওয়া। অথচ মলয় বিশ্বাস করেন শেষ বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ার যে হালচাল, রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি তাতে সেরকম মডারনিস্ট স্পেশালাইজড ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার সার-বীজ সব পচে-হেজে নষ্ট হয়ে গেছে। 'আধুনিকতা' ব্যাপারটাই এখন 'একখানি ধ্রুপদী জোচ্চোর'। বলেছেন তিনি, এতদিন, 'আধুনিকতা ভালো, নৈতিক, নান্দনিক, প্রগতিশীল, উন্নত, কাম্য, কল্যাণময় এমনতর ভাঁওতায় ভুলিয়ে রাখা হচ্ছিল বাংলা ভাষাকে।' এহেন সময়ে একজন সমাজ ও সময় সচেতন লেখক যা করতে পারেন, তা হলো, বিগ্রহ ভাঙার কাজ। মলয় রায়চোধুরীর বেশির ভাগ রচনায় হাতুড়ির সেই চিহ্ন আমরা দেখেছি। কোন ধর্মভীরুতা বা প্রলোভন তাঁকে এই ভাঙার কাজ থেকে নিরস্ত করতে পারেনি, না বিদ্যায়তনিক মাস্তানদের ঘাতক-ছুরি। বাংলা ভাষায় প্রতিষ্ঠিত আধুনিক ও এঁদো চিন্তাভাবনা ও তার ভেক্টর প্রতিষ্ঠানের মুখে জোর থাপ্পড় মেরে তার গিল্টি-করা দাঁত উখড়ে দিতে চেয়ে মলয়ের লেখার জগতে প্রবেশ। আজীবন অর্জিত নিজের ভোগান্তি, অভিজ্ঞতা, পড়াশোনা আর প্রজ্ঞাকে অস্ত্র করে তিনি যা-কিছু প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তা-উদ্ভূত, মেরে লটলট ধ্বসিয়ে ফেলতে চেয়েছেন। একজন কালচেতন, সদাজাগ্রত লেখক প্রতিষ্ঠানের সামনে কী ভীষণ প্রব্লেম্যাটিক হয়ে উঠতে পারেন, তার জলজ্যান্ত মিশাল মলয় রায়চোধুরী।
 
নিজেকে কালচারাল বাস্টার্ড বলেছেন মলয়। নিজেকে বলেছেন, বাঙলার মূল সংস্কৃতিতে আউটসাইডার। তাঁর বিভিন্ন রচনা,গল্প ও উপন্যাসে আমরা তাঁর সেই জারজ উপাদানের সুসম্বদ্ধ রূপটি গড়েও নিতে পারি। মজার ব্যাপার হচ্ছে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতাহীন, হতাশাখোর, তথাকথিত শিক্ষিত হায়ারক্লাস বুদ্ধিজীবীরা মলয়ের পশ্চিমবঙ্গ-হামলার মনসুবাটা ধরতে পারেননি। আমি নিজে তথা-অর্থে 'বহিরাগত' হওয়ার দরুন স্থূল ও সূক্ষ্ম দু-নিরীখেই অনুধাবন করেছি পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক কাঠামোর মূল স্বরূপ বিশ্লেষণে মলয় কিন্তু আগাগোড়াই খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ, যার তন্নতন্ন প্রতিফলন তাঁর লেখাজোখায় দুরনিরীক্ষ্য নয়। বাঙালির ভিড় থেকে, হরির লুঠ থেকে, বাঁধাধরা বঙ্গ-কালচার থেকে স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্ন এবং সর্বোপরি ভারতবর্ষীয় হিন্দু-বাঙালি সংস্কারের সর্বোচ্চ পীঠ বলে কথিত কলকাতা থেকে ২৬০ কিমি দূরে পড়ে আছি বলেই আমার কাছে ইঁদুরের প্রতিটি লাফ আর চাল জলবৎ ধরা পড়ে। তথাকথিত 'প্রবাস'-যাপনের সুবিধে এটাই যে, নিজের সঙ্গে অন্যের সাদৃশ্য ও পার্থক্য হবহু ধরে ফেলা যায়। দেখতে পাই দ্বৈরাজ্যের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই বিশ্বচরাচর, তার প্রতিটি নড়ন ও চড়ন। মলয় রায়চোধুরী আজন্ম মূল বঙ্গ-সংস্কারের বাইরে বাস করে এই একই মাইক্রো-দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা ও বাদ-বাংলার সংস্কৃতিকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি দেখেছেন যে-বঙ্গসংস্কৃতিকে নিয়ে বাঙালির এত আত্মম্ভরিতা, গুমর আর বারফট্টাই ----- সেই বিশুদ্ধ বঙ্গসংস্কৃতির হদিশ পৃথিবীতে আজ কোথাও নেই। ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপে নানা জাতি ও সংস্কারের,বিশেষত মুসলিম ও ইংরেজ বেনিয়ার শাসনে, সর্বোপরি ভৌগোলিক কাটছাঁট, দেশভাগ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক স্পৃহার খপ্পরে পড়ে বাঙালি নিজের সর্বস্ব আজ খুইয়ে ফেলেছে। এমনকী, বিশুদ্ধ পশ্চিমবঙ্গীয় সংস্কৃতিও আজ মিথ মাত্র। ভারতবর্ষীয় বাঙালির কোন সংস্কৃতিই আজ অবশিষ্ট নেই; সময়ের চাপে সব উচ্ছন্নে গেছে। জন্ম নিয়েছে এক জগাখিচুড়ি কালচার। ছত্রখান সংস্কৃতি। বাঙালির পোশাক পাল্টেছে বহুদিন হল,বহু খোঁপা আর সিঁথি এখন বিদেশিনী হয়ে গেছে, এমনসব হেয়ারডু যা বাঙালি কস্মিনকালে ভাবেনি। পুরুষেরা তামুক দোক্তা বিড়ি গড়গড়া ছেড়ে সিগারেট বিয়ার ব্রাউনসুগারে মজেছে। যে-ফুটবলে বাঙালির নিজস্ব দাপ ছিল তা এখন আকখা ওয়ার্ল্ড খেলছে, বাঙালি লোকাল ট্রেনে আর রকে বসে খেলছে তিন-পাত্তি, টোয়েন্টি নাইন। বাঙালি টুসু ভাদু রবীন্দ্রসঙ্গীত ভুলে পাঞ্জাবি পপে মাজা দোলাচ্ছে। পড়াশোনা চাকরি ব্যবসা থেকে ক্ৰমে উৎখাত হতে হতে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি বলে যা রয়ে গেছে, তা হলো, রকে বসে বুকনি ঝাড়া, পরস্পর পেছনে লাগা, লেংগি মারা, মিথ্যে বলা, হীনমন্যতা, চা চপ ঝালমুড়ি, লোকনিন্দা, ভাইয়ে-ভাইয়ে হিংসে, কথায় কথায় মাথাগরম আর খিস্তিবাজি। পাশাপাশি শনি-শেতলার পুজো, তৃণমূল-সিপিএম, আর দুগ্গাপুজোয় চাঁদা আর হুল্লোড়বাজি।
 
তো, এইখান থেকে আমাদের পাঠ শুরু হয় মলয়-ট্রিলজির শেষ পর্দা-ফাঁস উপন্যাস "নামগন্ধে"র। মলয় জনান্তিকে বলেছেন, এ-উপন্যাস পশ্চিমবঙ্গের কোনো সম্পাদক ছাপতে সাহস পাননি, যে কারণে ঢাকার লালমাটিয়া থেকে বেরিয়েছিল আগে, পরে হওয়া ৪৯ থেকে বেরোয়। গোড়াতেই ফাঁস হয়ে গেল নামগন্ধে কী মাল তিনি দিয়েছেন এবং যা অবধার্য হয়ে উঠেছে এসময়ে, মলয়ের পাঠকৃতি সেই আধুনিক ঝোঁকে স্বতঃউৎসারিত। স্বীয় আয় করা দৃঠি ও অভিজ্ঞতাকে ছিঁড়ে পাঠবস্তুর টুকরো পাত্রে স্বত্বহীনভাবে বিলিয়ে দিচ্ছেন বহুরৈখিক আয়ামে। তাঁর অন্যান্য রচনার মতো এ উপন্যাসও দামাল ঝাপটা মারে ঝাদানভ-প্লেখানভদের বাঙালি ভাবশিষ্যদের এতদিনকার নির্বিঘ্নে মেলে রাখা অরজ্ঞানডির ভুলভুলইয়াপনায়। নামগন্ধেও কাহিনী পরিণাহটি ন্যূন, বক্তব্যেই মূলত মাটাম ধার্য করেছেন মলয়। তিনি সঠিক কষে ফেলেছেন যে বর্তমান কালখণ্ডে ভারতবর্ষীয় হিন্দু-বাঙালির তথাকথিত সংস্কৃতি মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রের ও তার চারপাশের সংস্কৃতি। মানে, ঐ কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী হাওড়া-হুগলি-চব্বিশ পরগণার সংস্কৃতি। সুতরাং গুনসুঁচ নিয়ে ধেয়েছেন ওই ক্ষমতাকেন্দ্রটিকে বেঁধবার জন্য।
 
উপন্যাস শুরু হচ্ছে একটা সন্ত্রাস দিয়ে, মলয়ের এটা অমোঘ টেকনিক, ----- পাঠকের সামনে সন্ত্রাস ঘটিয়ে, তাকে তার মধ্যে হিঁচড়ে ঢুকিয়ে সন্ত্রস্ত করে, সন্ত্রাসের বিভীষিকা মেলে ধরা। বঙ্গ-কালচারের বর্তমান হাল বোঝাতে মলয় হাওড়া জেলার ভোটবাগানের লোহার কাবাড়িখানা, নদিয়া জেলার কালীগঞ্জের কাঁসা-পেতলের ভাংরি, বিভিন্ন জেলার আলুর কোল্ড-স্টোরেজ মন্তাজ করে ফুটিয়ে বঙ্গভূবন একাকার করে ফেলেছেন। 'মুসলমান রাজার আমলে যেমন ছিল তালুকদার দফাদার পত্তনিদার তশিলদার মজুমদার হাওলাদার, এই আমাদের কালে হয়েচে পার্টিদার, আজগালকার জমিদার'। নমঃশূদ্রদের খুন ধর্ষণ বাড়িঘর জ্বালিয়ে যখন তাড়ানো হয়েছিল খুলনার মাইড়া গ্রাম থেকে, পঞ্চাশ সনে, যুবক ভবেশকাকা রাতারাতি পালিয়ে এসেছিল কচি ফুটফুটে সৎ বোনকে কোলে নিয়ে। পুরনো বাড়ির পাড়ায় ইউনাইটেড রিহ্যাবিলিটেশন কাউনসিলের 'আগুন-খেকো নেতা' ছিল ভবেশকাকা, যিনি বিধান রায় ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ট্রামে আগুন ধরিয়ে দেন। তিরিশ বছর আগে আরামবাগি প্যাঁচে কংগ্রেসি আলুর দাম হঠাৎ বাড়লে, খাদ্য আন্দোলনের দিনগুলোয়, তুলকালাম করেছিলেন। দেশভাগের খেলাপে নারাবাজি করেছিলেন, 'হাতে পেলে জহোরলাল জিনহাকে চিবিয়ে পোস্তবাটা করে'।। সেই ভবেশ মণ্ডল আজ মোকররি আর চাকরান মিলিয়ে বাহান্ন বিঘে জমি আর একলাখ কুইন্টাল ক্ষমতাসম্পন্ন মোহতাজ হিমঘরের অংশীদার। যিশুর / লেখকের মন্তব্য : 'আজকাল গ্রামগুলোর সত্যের স্বামীত্ব ভবেশকাকাদের হাতে।' আর 'চাষির মুখের দিকে তাকালে সর্বস্বান্তের সংজ্ঞা টের পাওয়া যায়।'
 
মলয় নিজেকে গদ্যকার সাব্যস্ত করতে আদৌ গল্প-উপন্যাসে আসেন নি। তবু, গোড়া থেকেই যেটা সচেতনভাবে করেছেন, গল্প-বানানোর প্রথাগত টেকনিক ও সিদ্ধ নিয়মগুলোকে বানচাল করে বাংলার চলে-আসা মূল সাহিত্যধারাকে একেবারে অস্বীকার করার চেষ্টা। ভাষার ক্ষেত্রেও মিথ, দুয়ো শব্দকলাপ ও পড়িয়ে-নেওয়ার যাবতীয় সরঞ্জাম ইস্তেমাল। এবং বিষয় পুরোপুরি অধীত, সংপৃক্ত, যেন রিচার্ডস ওয়ার্ক পড়ছি। যেমন, 'ডুবজলে', 'জলাঞ্জলি' আর 'নামগন্ধ' ---- এই ট্রিলজিতে মলয় এক-গোছের চাকরির জিগির এনেছেন, সেটা হল, টাটকা আর পচা নোট আলাদা করা, একশোটা নোটের প্যাকেট তৈরি করা, এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, যেন, 'অর্থনীতির স্নাতক হবার এই-ই পরিণাম। অমন বিতিকিচ্ছিরি কায়িক শ্রম করবার জন্যে ওই অফিসটা চেয়েছিল অর্থনীতি গণিত কমার্সে ভালো নম্বর প্রাপক স্নাতক।' অন্যদিকে, আজন্ম শহরবাসী মলয় কীভাবে পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলে পরিব্যাপ্ত রাজনীতি, অর্থনীতি, দুর্নীতি আর কালচার জরিপ করেছেন তা 'নামগন্ধে' পড়ে থ মেরে যায় পাঠক। 'এই ভেবে যে কী করে পারেন! রীতিমত 'আলু-সমাজ-নাম'গুলোর গন্ধতালাশ। প্রান্ত গন্ধ।' কাহিনী বা নাটক সেখানে ন্যূন, আগেই বলেছি, বরং তা ঘনিয়ে ওঠার সম্ভবনা দেখা দিলে মলয় তা নিরাসক্ত ও নির্মোহ মনে ভেঙে দিয়েছেন। অন্বেষণের মেধা প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে পাতায়-পাতায়, বিশেষত উপন্যাসের শেষ দিকটা মার্ভেলাস। খোদ মলয়ের জীবন যেমন, উপন্যাসও তেমনি ----- জীবনেরই, অথচ প্রথানুগতের বাইরে। জীবনেরই ছোট ছোট খণ্ড, জীবনের সমাহার যেন, সম্পূরক। যেমন একযুগ পর ভবেশকাকার।বোন খুশিদিকে দেখে অপ্রত্যাশিত ধাক্কায় নির্বাক আনন্দে ছারখার হয়েছে যিশু। 'পঞ্চাশ বছরের একজন বালিকাকে কাছে পাবার ক্ষমতাকে দুর্জয় করে তুলতে, উঠে বসেছিল যিশু।' ভোগদৃশ্যটা অবিস্মরণীয় ----- 'প্রশ্রয়প্রাপ্ত যিশু গনগনে ঠোঁট বুলায়, রুদ্ধশ্বাস, ত্রস্ত। সিনেমা দেখে, টিভি দেখে, উপন্যাস পড়ে মানুষ-মানুষীর যৌনতার বোধ কলুষিত হয়ে গেছে, সর্বজনীন হয়ে গেছে। খুশিদির জৈব-প্রতিদান, বোঝা যাচ্ছে, সেই অভিজ্ঞতায় নিষিক্ত নয়। থুতনির টোল কাঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে ওঠে খুশিদি; বলল, আয়, ভেতরের ঘরে চল যিশকা।'
 
আর, যেজন্য এই উপন্যাসের জিগির। মলয়ের লক্ষ্য গপ্পো বলা নয়, উপন্যাস গড়া নয় ---- ভাষা নির্মাণ। যেন, বাংলা গদ্যকে সশক্ত বনেদ পাইয়ে দিতেই তুখোড় কবিতাবাজ মলয় গদ্যের বাদাড়ে এসেছেন। গদ্য, যা বাঙালির যতিচিহ্ন। সমস্ত আবেগময়তাকে জোর ধাক্কা মেরে, থুয়ে রেখে, বাংলা গদ্যভাষাকে আরও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে মলয় মরিয়া। অন্তত নামগন্ধ বাবদ আমার স্বতোচ্ছ্বাস মারহাবা।

 

অনুপম মুখোপাধ্যায় লিখেছেন

 অনুপম মুখোপাধ্যায় লিখেছেন

। মলয় রায়চৌধুরী। আমার মনে হয় এই মুহূর্তে তিনি বাংলা সাহিত্যের একমাত্র জীবিত আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক। প্রায় একাই জ্বলে থাকা আগুন। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় দু-দশক হয়ে গেল। আমার এই সম্পর্ক থেকে পাওয়ার ভাগটা এতই বেশি, এত কিছুই শিখেছি তাঁর কাছে, এটাকে প্রায় একতরফা সম্পর্কই বলা যায়। এখনও তিনি লেখায় সমান সক্রিয়। এমনকি, হয়ত আগের চেয়েও সক্রিয় ও সজীব মনে হচ্ছে তাঁকে আমার আজকাল। আসন্ন শারদীয়ায় আপনারা একাধিক পত্রিকায় তাঁর করা অনুবাদ পাবেন, পত্রিকাগুলোর ঠিকানা নিজেই বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন। হয়ত এই মুহূর্তেই একটা উপন্যাস লিখছেন, যেটা পড়ার পরে আমাদের অনেক কিছু নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। আত্মপ্রচারে তিনি একটা নতুন দিকই খুলে দিয়েছেন, যেদিকটাতে পা রাখার ফলে আমাকেও অনেকে আজ চেনেন। প্রতিষ্ঠান নয়, নিজেই নিজেকে বহন করার এই লেখক। বন্ধুর বদলে শত্রু কুড়িয়ে চলা এই লেখক। এই... কবি। তাঁকে নিয়ে যা বলার বললাম ‘কবিতীর্থ’-এর এই সংখ্যায়। সব কথা যে ভাল বলেছি এমন নয়। মলয় দা আজ অবধি আমার প্রশংসা ছাড়া নিন্দা করেননি। আমার তো একটু দায়িত্ব আছে তাঁকে রাগিয়ে দেওয়ার, তাই না? সত্যি ছাড়া মিথ্যে বলিনি।।


 

সোমবার, ১৬ আগস্ট, ২০২১

মহর্ষি এবাদুল হক : মলয় রায়চৌধুরী

 

মহর্ষি এবাদুল হক

মলয় রায়চৌধুরী

এবাদুল হক ছিলেন মহর্ষি, লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্যজগতের উদ্ভাবনাকেন্দ্রের মহর্ষি, উন্নতভাবনার, উন্নতমানসের উন্নতধী শিক্ষক । ‘ঋষ্’ ধাতুর অনেকগুলি অর্থের মধ্যে একটি অর্থ হচ্ছে ঊর্ধ্বগতি অর্থাৎ ওপরের দিকে ওঠা৷ কোনও বাড়ির একতলা থেকে ওপরে ওঠার জন্যে এই ‘ঋষ্’ ধাতু ব্যবহৃত হতো৷ ‘ঋষ্’ ধাতুূ‘ইন্’ করে ‘ঋষি’ শব্দ পাচ্ছি, যার ভাবার্থ হচ্ছে যিনি ওপরের দিকে ওঠেন আর যোগার্থ হচ্ছে উন্নতমানস, উন্নতধী,.উন্নত ভাবনার পুরুষ৷ ‘ঋষি’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ ‘ঋষ্যা’ হলেও অভিন্নলিঙ্গ (ন্তুপ্সপ্পপ্পপ্সু ন্ধন্দ্বুস্তুন্দ্বব্জ) ‘ঋষি’ শব্দটিও চলতে পারে৷ অর্থাৎ কোন পুরুষকে যেমন ‘ঋষি’ বলা যায় কোন নারীকেও তেমনি ‘ঋষি’ বলা যেতে পারে আবার ‘ঋষ্যা’ তো চলতেই পারে ।উন্নত চেতনার মানুষদের ঋগ্বেদীয় যুগ থেকে ‘ঋষি’ বলে আসা হয়েছে৷ প্রতিটি মন্ত্র যেমন একটি ছন্দে রচিত, অধিকাংশ মন্ত্র যেমন পরমপুরুষের একটি বিশেষ নামে সম্বোধিত, তেমনি প্রতিটি মন্ত্রেরই একজন করে দ্রষ্টা-ঋষি থাকতেন যিনি তাঁর সাধনায় বা ধ্যান-ধারণায় সত্যকে উপলব্ধি করে তা শিষ্যকে কানে কানে শুনিয়ে দিতেন (গোড়ার দিকে অক্ষর ছিল না৷ তাই লিখে শেখানো সম্ভব ছিল না৷ যেহেতু লিপি ছিল না তাই ‘লেখক-ঋষি’ বলা হত না ;বলা হত দ্রষ্টা-ঋষি, অর্থাৎ যে ঋষি ধ্যানে সত্যকে দেখেছেন)৷


ঋগ্বেদীয় যুগ থেকে ঋষিদের মুখ্যতঃ চারটি ভাগে বিভাজিত করে রাখা হয়েছিল–(১) মহর্ষি, (২) দেবর্ষি, (৩) রাজর্ষি ও (৪) ব্রহ্মর্ষি৷ যে সকল মানুষ তাঁদের জাগতিক কর্ত্তব্য যথাবিধি সম্পাদন করার সঙ্গে সঙ্গে ঊধর্বতর জগতের খোঁজে ধ্যান–ধারণা–সাধনা (আরণ্যক ও উপনিষদ) প্রভৃতি করতেন ও তৎসহ সেই অধ্যাত্ম মার্গে সিদ্ধিলাভ করে জগতের সেবা করতেন তাঁদের বলা হত মহর্ষি (যেমন, মহর্ষি বিশ্বামিত্র)৷ (২) যাঁরা দেবকুলে (নর্ডিক, এ্যলপাইন অথবা মেডিটারেনিয়ান উপবর্গীয় ও ককেশীয় বর্গীয় কুলে) জন্মগ্রহণ করে সাধনার দ্বারা আধ্যাত্মিক চেতনায় অধিষ্ঠিত হতেন তাঁদের বলা হত দেবর্ষি (যেমন, দেবর্ষি নারদ) (৩) যাঁরা জাগতিক কর্তব্যের অতিরিক্ত সামাজিক কর্তব্য (যেমন, রাজা) প্রতিপালনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের হূদয়বৃত্তিকে...মনীষাকে আধ্যাত্মিক চেতনায় অভিক্লপ্ত করতেন (হূদামনীষা মনসাহভিক্লপ্তঃ) তাঁদের বলা হত রাজর্ষি  (যেমন, রাজর্ষি জনক) । এবাদুল হক তাঁর জাগতিক কর্তব্য অর্থাৎ নিজের সংসার প্রতিপালন ও স্কুলের শিক্ষকতার চাপ সত্তেও সাহিত্যের উর্ধ্বতর ধ্যান-ধারণা-সাধনা করে গেছেন আজীবন ।


পৌরাণিক যুগের বহু ঋষিদের নাম আমরা জানি : “পৌর, শ্রুতবিদ, মধুচ্ছদা, জেতৃ, মেধাতিথি, অর্চনানা, অজীগর্ত্ত, হিরণ্যস্তুপ, ঘোর, যজত, প্রস্বম্ব, সব্য, নোধা, শক্তি, পরাশর, সপ্তবধ্রি, রহুগণ, দীর্ঘতমা, দিবোদাস, পুরুচ্ছেদ, উচথ্য, উরুচক্রি, সোমাহুতি, উৎকীল, বাহুবৃক্ত, কুশিক, গাধী, ইষীরখ, বুধ, গবিষ্টি, বসুশ্রুত, ইষ, গয়, সুতম্ভর, সত্যশ্রবা, ধরুণ, মৃক্তবাহ, দ্বিত, বব্রি, প্রযস্বস্বৎ, বিশ্বসামা, দুম্ন, বসুযু, গোপায়ন, পুরুকুৎসা, লোপায়ন, লোপামুদ্রা, সুবন্ধু, শ্রুতবন্ধু, বিপ্রবন্ধু, ত্রিকৃষ্ণ, ত্র‍্যরুণ, ভরত, গৌরিবীতি, বক্র, অষ্টবক্র, অবস্যু, গাতু, সম্বরণ, স্বস্তি, প্রভুবসু, কশ্যপ, সাদাপৃণ, প্রতিবথ, প্রতিক্ষত্র, প্রতিভানু, শ্যাবাশ্ব, ঘোষা, অপালা, বিশ্ববারা, ভারতী, গার্গী, বীতহব্য, কৃতযশা, দক্ষিণা, ব্রহ্মজায়া, মৈত্রেয়ী, সরমা, সুহোত্র, শুনহোত্র, নর, শুংযু, ঋজিশ্বা, প্রিয়মেধ, সধ্বংসাখ্যা, কপিল, কনাদ, অন্ধ, বৎস, নীপাতিথী, নারদ, সুদিতি, উশনা, ত্রিশোক, দূষ্মীক, ত্রিত, নাভাক, সোভরি, নৃমেধ,অগস্তি, জৈমিন, দার্ঢ়াচ্যুত, ইম্ববাহ, অগ্নিবৈশ্য, বার্হস্পত্য, অত্রি, আত্রেয়, শাতাতপ, অনাবৃকাক্ষ, গার্গ্য, অব্য, সারস্বত, সাংখ্য, আলম্বায়ন, আস্তিক, দেবল, দুর্বাসা, ভূধর, বাল্মীকি, বৈশ্বানর, মার্কন্ডেয়, জমদগ্নি, প্রজাপতি প্রমুখ । আমাদের সময়ে তেমনই হলেন এবাদুল হক । এবাদুল কেবল যে নিজেই উন্নতভাবনার পুরুষ ছিলেন, তাই নয় ; তিনি নিজের সঙ্গে অন্যদেরও উন্নতভাবনায় নিয়ে যাবার প্রয়াস আজীবন চালিয়ে গেছেন । উপরোক্ত ঋষিদের মতনই এবাদুল রেখে গেছেন লিখিত পাঠবস্তু ; কোনও প্রাসাদ, শিলালেখ তৈরি করিয়ে যাননি । তাঁর বাবার নাম জয়নাল আবেদীন আর মায়ের নাম হামিদা । 


এবাদুল হককে মহর্ষি বলেছি বলে অনেকের গায়ে লেগেছে । সম্ভবত তাঁরা নিজেদের এবাদুল হকের চেয়ে উন্নতধী, উন্নতমনা, লোভ-লালসা বর্জিত মনে করেন । তা-ই যদি হবে, তাহলে এবাদুল হককে মহর্ষি বলায় ঈর্ষা কেন? পৌরানিক যুগে  অনেকেই ঈশ্বর ও ধর্ম সম্পর্কে জানতে গভীর অরণ্যে তপস্যা করতেন । এনারা তপস্যার বলে সমস্ত লোভ-লালসা ত্যাগ করেছিলেন । এই মহাত্মাদের বলা হতো মুনি । যেইসব মুনি তপস্যাবলে বেদের মন্ত্র প্রকাশ করতে পারতেন, তাদের বলা হতো ঋষি । সুতরাং  বোঝা যায় যে, সব ঋষিই মুনি কিন্তু সকল মুনি ঋষি নয় । মুনির স্থান অতিক্রম করেই ঋষির স্থানে অধিষ্ঠিত হতে হয় । এজন্য ঋষিরা ছিলেন মুনিদের থেকে উচ্চস্তরের । ঋষিদের সাতটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে । যথা : ব্রহ্মর্ষি, মহর্ষি, দেবর্ষি, কান্ডর্ষি, রাজর্ষি, পরমর্ষি ও শ্রুতর্ষি ।ব্রহ্ম বা ঈশ্বর সম্পর্কে যেসব ঋষিদের বিশেষ জ্ঞান ছিল, তাদের বলা হতো ব্রহ্মর্ষি । ঋষিদের মধ্যে যারা মহান ও প্রধান ছিলেন তাদের বলা হতো মহর্ষি = মহা + ঋষি । দেবতা হয়েও যারা ঋষি ছিলেন তাদের বলা হতো দেবর্ষী = দেবতা + ঋষি ।বেদের রয়েছে দুইটি কান্ড (জ্ঞানকান্ড ও কর্মকান্ড) এর মধ্যে যে কোন একটির বিষয়ে যাদের বিশেষ জ্ঞান ছিল তাদের বলা হতো কান্ডর্ষি । রাজা হয়েও যিনি ঋষি বা ঋষির মতো আচরন করেন তাকে বলা হতো রাজর্ষি ।পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে যিনি দর্শন করেছেন তাকে বলা হতো পরমর্ষি ।যেসব ঋষিগণ শুনে শুনে বেদ মন্ত্র লাভ করেছিলেন তাদের বলা হতো শ্রুতর্ষি । বলাবাহুল্য যে সাহিত্যের জন্য যে ত্যাগ এবাদুল হক করেছিলেন তা আর কেউ করেছেন বলে মনে হয় না ।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, খ্রিষ্টধর্মের প্রভাব থেকে ভারতীয় যুবকদের রক্ষার জন্য ১৮৬৭ সালে রাধাকান্ত দেব তাঁকে ‘জাতীয় ধর্মের পরিরক্ষক’ ও ব্রাহ্ম সমাজের ‘মহর্ষি’ উপাধিতে ভূষিত করেন । ১৮৪২ সালে দেবেন্দ্রনাথ তত্ত্ববোধিনী সভা ও ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরের বছর তাঁরই অর্থে এবং অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। এই পত্রিকায় দেবেন্দ্রনাথকৃত বৃত্তি ও বঙ্গানুবাদসহ উপনিষদ প্রকাশিত হতে থাকে। দেবেন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায় প্রকাশ্য সভায় বেদপাঠও শুরু হয়। ১৮৪৪ সালে দেবেন্দ্রনাথ প্রথম ব্রহ্মোপাসনা পদ্ধতি প্রণয়ন করেন এবং পরের বছর থেকে তা ব্রাহ্মসমাজে ব্যবহৃত হতে থাকে। দীর্ঘ শাস্ত্রচর্চার ফলে তিনি উপলব্ধি করেন যে, শুধু উপনিষদের ওপর ব্রাহ্মধর্মের ভিত্তি স্থাপন সম্ভব নয়। তাই ১৮৪৮ সাল থেকে তিনি ক্রমাম্বয়ে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ঋগ্‌বেদের অনুবাদ প্রকাশ করতে শুরু করেন, যা ব্রাহ্মধর্ম (১৮৬৯) নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৮৫০ সালে তাঁর অপর গ্রন্থ আত্মতত্ত্ববিদ্যা প্রকাশিত হয়। ১৮৫৩ সালে তিনি তত্ত্ববোধিনী সভার সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং ১৮৫৯ সালে ব্রাহ্মবিদ্যালয় স্থাপন করেন। কিন্তু তিনি নিজের বাবা দ্বারকানাথ ঠাকুরকে শ্রদ্ধা করতেন না, এমনকী দ্বারকানাথ ব্রিটেনে মারা গেলে কোনও খোঁজ নেননি ; দ্বারকানাথকে সেখানেই কবর দেয়া হয় । অথচ দ্বারকানাথ ঠাকুরের রোজগারে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের কাজ করতেন । দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মা মারা গেলে দেবেন্দ্রনাথ শবানুগমন করেননি । তাঁকে যদি মহর্ষি উপাধিতে ভূযিত করা হয়ে থাকে তাহলে এবাদুল হককে করা হবে না কেন ? 


এখানে ‘আবার এসেছি ফিরে’ পত্রিকার নভেম্বর ২০১৯ উৎসব সংখ্যা থেকে এবাদুল হকের লেখা সম্পাদকীয়র অংশ তুলে দিচ্ছি, তা থেকে স্পষ্ট হবে কেন তিনি মহর্ষি : “আবার এসেছি ফিরে আমৃত্যু কথাটি বলে যেতে হবে। ‘আমৃত্যু’ কথাটির ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন । আমি ব্যক্তি এবাদুল ও ‘আবার এসেছি ফিরে’ এক সত্বার দুটি ভিন্ন নাম । কারণ আমার ব্যক্তিজীবন ও পত্রিকার জীবনে অনভ কারোর স্হান কোনোদিন ছিল না । আর এই বয়সে হয়তো কেউ আর আসবেও না । হ্যাঁ, বলে রাখা ভাল আমার সঙ্গে আছেন অগণিত মান্যবর কবিসমাজ । আছেন গবেষক ও কিছু ঋজুদৃঢ় পাঠক । ওনারাই আমার সহায় ও সম্বল । আর আছে শহুরে সভ্যতার দ্বারা লালিত কিছু ঈর্ষাকাতর সাহিত্যের মানুষজন । যাঁরা ভুলে যান ‘আবার এসেছি ফিরে’ পত্রিকার ইতিহাস । ক্ষুদ্র পত্রিকার আঙিনায় এই পত্রিকার যে ইতিহাস আছে তা থেকে বিস্মৃত হয়ে লেখা পাঠান । কিন্তু নিজের পত্রিকা নিয়ে যখন লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে লিখতে বসেন, তখন এককলম আমার জন্য রাখতে ভুলে যান । কেন এই ঔদাসীন্য? গ্রামে লালিত হয়েও বর্তমানে সদর শহরগুলোতে বাস করেন বলে ? আমি অবশ্য অন্যমানুষ । আমার কোনো দল নেই । কোনো রাজনৈতিক দাদাদের দ্বারা পুষ্ট নই । গোষ্ঠীবাজি করা আমার ইতিহাসে ছিল না । হ্যাঁ, রাজনীতি, সমাজনীতি সম্পর্কে দৃঢ় ধারণা আছে বৈকি । আমি বুঝি পৃথিবীতে শাশ্বত বলে কিচু নেই । আছে মানুষ, আছে মানুষের ভাবনাচিন্তা । সেই ভাবনার দোসর হয়ে তাঁদের স্যালুট জানাতে জানি । আমি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের দাসত্ব করি না । ধর্মবোধের মধ্যে যেখানে মিলনের সুর আছে, আমি সেখানেই যাই । আমি কোনো ধর্মের তথাকথিত আইডেনটিটি পাওয়ার জন্য লালিত নই ।মুসলমান ঘরে জন্মেছি তাই আমি মুসলমান, আমি একথাই জেনে এসেছি আজীবন ।মান্যতাও দিই । ডোম.চামার ছুঁলে জাত যায় না আমার । এক থালায় খাবার খেতে আমার এতটুকু কুন্ঠা হয় না । হ্যাঁ, আমার কাছে মানুষের ভালোবাসা আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় প্রাধান্য প্রায়।

তবে, পত্রিকার ব্যাপারে বলি, কারোর খবরদারি একদম পছন্দ করি না । এক্ষেত্রে আমি নিজেকে হিটলারের সাথে তুলনা করি । কারোর উপদেশ আমার কাম্য নয় । কেন এত আত্মকথন ? চল্লিশ বছর সাহিত্যজগতে থেকে দুর্গন্ধ, বস্তাপচা পড়ে পড়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি ।জীবনানন্দীয় ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে ।সুনীল-শক্তির দ্বারা পুষ্টতা আর নয় । ভাঙুন, ভেঙে ফেলুন সাহিত্যের খোলনলচে । নতুন কিছু বলুন, নতুন করে । আর তার জনভই ধরে নিন এলাম ফিরে ।কবি-সাহিত্যিকদের কাছে একান্ত অনুরোধ নতুন ভাবনা চাই ল চাই নতুন আঙ্গিক । গদ্যে-পদ্যে সর্বত্রই আসুক প্লাবন ।”


হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল ১৯৬১ সালে আর তার এক বছর আগে জন্ম হয় এবাদুল হকের, ১৯৬০ সালের চৌঠা জানুয়ারি । নিজের শৈশব সম্পর্কে এবাদুল হক যা লিখেছেন,  তা বেশ মজার, কেননা এবাদুল ( পূর্ব পাকিস্তান ) বাংলাদেশে গিয়েছিলেন, কিন্তু ভালোলাগেনি বলে মুর্শিদাবাদে ফিরে এসেছিলেন ; এরকম ঘটনা বোধহয় সংখ্যায় কম। স্টোইকসদের  থেকে কান্ট পর্যন্ত, একটি সর্বজনীন নৈতিকতার পক্ষে যুক্তি দেয়া হয়েছিল । তাছাড়া ঐতিহাসিকভাবে গঠিত সমাজে নানা রকমের  মানবতার বিভাজন সত্ত্বেও, মানুষের সাথে নিজেকে চিহ্নিত করা এবং মানবতার জন্য নৈতিক উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক ।  বিশ্বজনীনতার প্রধান কাজ হল এই যে তা সার্বজনীনতাকে রক্ষা করে । এবাদুল হক শৈশবে এই বোধের কারণে ফিরে এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে। এবাদুল হক বুঝেছিলেন, ‘প্রলয়’ পত্রিকা প্রকাশের সময় থেকে, যে, অনুভূতির  মূর্ত অবস্থাগুলো - ভালবাসা, ব্যথা, আনন্দ, কৌতূহল, যন্ত্রণা, অহংকার - সবই সাহিত্যে পাওয়া যায় । সাহিত্যে তা এত ভালভাবে বর্ণনা করা হয়, এত তীব্রভাবে যে উনি  অনুভব করেছিলেন, এবং বেশ গভীরভাবে, এমন-কিছু যা হয়তো অনেক বছর আগে কেউ অনুভব করেছিলেন। এই বোধ এবাদুলকে জানিয়েছিল যে মানুষের অভিজ্ঞতা ভাগ করা জরুরি । কেননা তা সান্ত্বনা দেয়, পাঠককে স্পর্শ করে এবং বর্তমান দুঃসময়ে তাকে অনুপ্রাণিত করে। অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী পাঠকের বর্তমানকে রূপ দিতে পারে। 


ওনার ভাষ্যেই শোনা যাক : তখন আমি ক্লাস সিক্স। আমরা যেমনটি আট ভাই এক বোন। আমার কাকা জ‍্যেঠারা তেমনটিই আট ভাই দুই বোন । পাঁচ জ‍্যেঠা এক কাকা আর একজন পিসিমা বাংলাদেশে বিনিময় করে চলে গেছিলেন। আমার আব্বা এখানকার ২১ বিঘা জমি বিনিময় করে দুই দাদাকে সঙ্গে দিয়েছিলেন। আব্বা প্রাথমিক বিদ‍্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তাছাড়াও এখানকার কংগ্রেসি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমার তিন দাদা দুই ভাই এখানে থেকে গেলাম। বাংলাদেশের রাজশাহীতে আমার দুই বড় দাদা চাকরি পেয়ে গেছিল। কিন্তু বাড়িঘর করতে পারেননি। ল কাকার বাড়িতে এক দাদা আর একজন আমাদের গ্রামের মানুষ, এখান থেকে যাওয়া ওদের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছেন। আমি ছাত্র হিসাবে খারাপ ছিলাম না। বাড়ির সবাই বলতেন, আট ভাই এক বোনের মধ্যে আমার ব্রেন শার্প । কঠিন পড়া সহজে ক‍্যাচ করতে পারতাম। মেধা ছিল। তাই বাংলাদেশে নিয়ে গিয়ে রাজশাহীর কোর্ট একাডেমিতে ভর্তির আবেদন জমা দিলাম। ভর্তির পরীক্ষা দিয়ে তের জনের মধ্যে আমি দ্বিতীয় হয়েছিলাম। ১৯৭০ সাল। ভাষা আন্দোলন আর তথাকথিত ভাষা আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। স্বাধীন সার্বভৌমত্বের দাবী করে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে জোর আন্দোলন। মিটিং মিছিল থেকে শুরু করে আইন অমান্য সবকিছু হচ্ছিল। একমাস ক্লাস করার পরেই স্কুলে অশান্তি। উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধের ডাকে সাড়া দিয়ে ক্লাস বয়কট করল। চলল পুরো দশদিন। চুপচাপ ঘরে কাঁহাতক বসে থাকা যায়। খুব বোরফিল করছিলাম। হঠাৎ শোনা গেল বিদ‍্যালয় খুলছে। কিছুদিন ক্লাস করে বুঝতে পারলাম, না এখানকার জল -হাওয়া, বিদ‍্যালয়ের পরিবেশ আমার স‍্যুট করবে না। আমি দূরন্ত ছিলাম ভেতরে ভেতরে কিন্তু বাইরে খুব লাজুক ছিলাম। ঠিক লজ্জাবতীর মত। যেমন হাত দিলেই নিজেকে গুটিয়ে নেয়। আমিও বাইরের দিকে গুটিয়ে রাখা স্বভাবের ছিলাম। এখন পর্যন্ত ওই রকমের থেকে গেছি। যারা এগিয়ে আসে তাদের সঙ্গে পিরীত হয়। গায়েগোছে বন্ধুত্ব নৈব নৈব চ। তাই আমার বন্ধুর সংখ্যা হাতেগোনা। পঁয়তাল্লিশ বছরের পত্রিকা সম্পাদনার পরেও সব লেখকদের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। সে যাইহোক, পারলাম না, রাজশাহী থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হলাম। সদ‍্য ইণ্ডিয়া থেকে পাকিস্তানে যাওয়া আত্মীয় স্বজনেরা কেমন ধারার হয়ে গেছে। এমনকি মুখের কথাতেও যেন কেমন তথাকথিত ভদ্রতার প্রলেপ পড়েছে। এখনও রাজশাহীর ভাষা আমাদের মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলার ভাষার মত। এখনও রাজশাহীতে আমাদের মতই কথ‍্য ভাষার প্রচলন রয়েছে। কোভিড ১৯ এর দুতিন মাস আগে বড়দা এসেছিলেন। ব‍্যাঙ্কে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে মক্কা পরিদর্শন করে ইণ্ডিয়া এসে সকলের সঙ্গে দেখা করে গেছেন। কই তাঁর বলনে - চলনে কোন পরিবর্তন তো আসেনি। আমার থাকার ব‍্যবস্থা হয়েছিল আমার  কাকার বাড়িতে।  কি ক্রমবর্ধমান কৃত্রিম হয়ে ওঠেছে গোটা পরিবার। ক 'বছরের মধ্যে কি সাবলীল অদ্ভূটে পরিবর্তন। এখানে থাকতে মাটির গর্তের পায়খানা ব‍্যবহার করত। ছেলেরা অধিকাংশ বর্তন হাতে উঁচু নবাবী বাঁধের জঙ্গলের ভিতর ঢুকে পড়ত। ভূতরাজের আকাট জঙ্গল। এখনও সবুজ নধর পাতার গন্ধ নাকে আসে। মন উদাস হয়ে যায়। বনকুলের জঙ্গলে পাকা কুলের ঝোঁপে বনবাটুল, ঘুঘুর আনাগোনা। লক্ষ্মীপুরের বাসায় মোজাইক বসানো সেনেটারি পায়খানা। ঝাঁচকচকে। বয়সে আমার বড় কাকাতুতো বোন শিরীন বলেছিল, এই ছোঁড়া পায়খানায় গেলে বেশি করে পানি ঢালবি। খুব সহজ কথা কিন্তু আমার আঁতে লেগেছিল। একি কথা? আমি ভালো করে টয়লেট পরিস্কার না করেই একগুচ্ছের নোংরা রেখে চলে আসব ? দ্বিতীয়ত দাদারা অফিস চলে গেলে ডাইনিং টেবিলে নাস্তা খাবার ডাক পড়ত। ল কাকীমা মেয়েদের কারো নাম করে ডেকে বলতেন - " অলকা, শিরীন, ডলি কইরে, কোথায় আছিস, এবাদুলকে পাঠাইয়া দে নাস্তা করে নিক। "-প্রসঙ্গত বলি, এখানে থাকাকালীন ওরা কুনঠে > কোথায় , প‍্যাঠিয়ে > পাঠাইয়া, লাহারি> নাস্তা, লেক > নিক অর্থাৎ শুদ্ধ উচ্চারণে অভ‍্যস্থ হয়ে উঠেছে। আমার কথা শুনে চোখ টিপাটিপি করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করত ; তা এখনও চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ভাসে। এমন উচ্চারণ শুনেছি, অতিমাত্রার হয়ে বিসদৃশ‍্য মনে হত। আমি মনকে শান্ত করতে পারিনি। কাকীমা মুখের সামনে বিপরীত টেবিলে বসে। আমি সামনে গিয়ে বসলাম। টেবিলটা আমার উচ্চতার তুলনায় একটু বেশি। তবুও বসলাম। একটা চিনা খালি থালা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন - " তোমার তো পান্তা ভাত ( আমরা এখনও বাসি ভাত বলি ) খাওয়া অভ‍্যেস,পরোটা ফরোটা খাও না, দেখ কেমন লাগে। " ছোট্ট পাতলা সাইজের একটা পরোটা আর থালার একপাশে ঝাল আলুর দম তুলে দিলেন। চিবোনা কঠিন হয়ে পড়ছে। কারণ পান্তা ভাতের খোঁচা খিচখিচ করে বুকে বিঁধছে। ল কাকীমা গামলার ঢাকনা তুলতে তুলতে বললেন - " আর নিবা? " মেজাজ টংয়ে। বলেন কি। আমি এধরনের পরোটা চারটি খাব, আর একটা দিয়ে বলেন কিনা, আর একটা দিই ? আমি হাত নেড়ে বলছিলাম, না না আর খেতে পারব না।”


যাঁরা অন্য রকম লিখছেন বা লিখতে চাইছেন, তাঁদের সম্পর্কে এবাদুলের আগ্রহ ছিল সেই ক্লাস নাইনে পড়ার সময় থেকে যখন উনি ‘প্রলয়’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ আরম্ভ করেন । ‘প্রলয়’ নামটি থেকেই এবাদুল হক স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে তিনি ভবিষ্যতে সাহিত্যজগতে কী করতে চলেছেন । ‘প্রলয়’ পত্রিকার জন্য তিনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা সংগ্রহ করে এনে প্রকাশ করেছিলেন ।এরপর ১৯৭৭ সালে যখন উনি ‘রামধনু’ নামে একটা পত্রিকা বের করা আরম্ভ করেন, তখন ওনার কেবল সতেরো বছর বয়স  । পত্রিকাটা কোনো কারণে বন্ধ হয়ে যায় এবং ১৯৭৯ সালে আবার প্রত্রিকা সম্পাদনা আরম্ভ করেন । আগের পত্রিকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে নতুন ত্রৈমাসিকটির নাম রাখলেন ‘আবার এসেছি ফিরে’ । একদিকে বট গাছ অন্য দিকে পাকুড় গাছ মাঝ দিয়ে রাস্তা, একটু এগিয়ে বাঁ দিকে পুকুরপাড়ে ছিল ‘আবার এসেছি ফিরে’ আর ‘এবং পুনশ্চ’ পত্রিকা দুটির আশ্রম ।


মুর্শিদাবাদের সীমান্তবর্তী ভগবানগোলার কানাপুকুরে ছিল এবাদুলের বাড়ি আর সেখান থেকেই পত্রিকা প্রকাশ করতেন । কলকাতা থেকে বহুদূরে একটি প্রায়-গ্রামে বসে যে সাড়া ফেলে দেয়া যায় তা ‘আবার এসেছি ফিরে’ পত্রিকার মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছিলেন এবাদুল । স্হানীয় স্কুলে শিক্ষকতা করতেন এবং অবসর নিয়ে আরেকটি পত্রিকা, কেবল কবিতার জন্য, নতুন কবিদের সবাইকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেবার সুবিধার জন্য ‘এবং পুনশ্চ’ নামে, প্রকাশ করা আরম্ভ করেন । আমার ‘আভাঁ-গার্দ’ কবিতাগুলো প্রকাশ করার সাহস ছিল এবাদুল হকের । কলকাতায় তো বহু হামবড়ুয়ে সম্পাদক জানেনই না কাকে আভাঁ গার্দ বলে । তিনি ঋষি এইজন্যই যে স্কুলের ছাত্ররা তাঁর কাছ থেকে নিজেদের সন্দেহ দূর করতে পারতো । তিনি মহর্ষি এই জন্যে যে দুটি পত্রিকার সম্পাদক হওয়া সত্তেও দাদাগিরি ফলাতেন না, কাঁচি চালাতেন না, দল গড়ে নেতাগিরি ফলাতেন না, যা অধিকাংশ লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকের চরিত্রে দেখা যায় । সংসারের খরচপত্র যতটুকু হয়, তা করার পর নিজের সমস্ত আয় খরচ করতেন ‘আবার এসেছি ফিরে’ আর ‘এবং পুনশ্চ’ পত্রিকা দুটির জন্য । মনে রাখতে হবে যে পত্রিকা দুটির কলেবর ক্ষীণ হতো না ।


বিয়াল্লিশ বছর পত্রিকা সম্পাদনা করে ১৭ই মে ২০২১ তারিখে এবাদুল হক মারা গেলেন করোনা রোগে । দুর্ঘটনার দরুন প্রচুর ওষুধ খেতে হতো এবাদুলকে । মুর্শিদাবাদের বাইরে সাহিত্য সভাগুলোয় যাবার সময়ে ওষুধের ডিবে নিয়ে বেরোতেন । শরীরের সমস্যা দেখা দিয়েছিল ১২ই মে এবং তাঁকে মুর্শিদাবাদ নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয় যেখানে তাঁর করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে । করোনায় যা হয়, দেহে প্রবেশ করার দিন পনেরো পর আচমকা কাবু করা আরম্ভ করে । এবাদুলের  হার্টে ব্লক  ছিল, যা উনি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা পর বইছিলেন, কেননা উনি মারা যান হৃদরোগে । এবাদুল হক ছিলেন তরুণতমদের ছত্রছায়া । বিশ্বাস করতেন তারুণ্য-শক্তিই পারে নতুন-যুগের আগমন ঘোষণা করতে । এবাদুলের মতন নির্মোহ নির্লোভ মানুষ পাওয়া বিরল। তিনি ছিলেন বিরলপ্রজ মানুষ । তাই আমি তাঁকে বলেছি মহর্ষি ।


মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা এবং আরেকটি দুর্ঘটনা সম্পর্কে এবাদুলের বয়ানই শোনা যাক :ভয় ব‍্যাপারটা আমার খুব কম। তবুও সাইকেল, মোটর বাইক, আমার কাছে অচ্ছুত ছিল। অথচ কে জানে, আমারই মোটর বাইক দূর্ঘটনা হল। পেছনে বসে ছিলাম। পাড়ার ভাগনে গাড়ি চালাচ্ছিল। ৯ জানুয়ারি ২০০৭ সাল। কুয়াশাভরা শীতের সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে আসছে। বহরমপুর প্রেসে সারাদিন পত্রিকার ফাইনাল কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলাম। সামনের দিক থেকে একটা লরি আসছিল। আমার ভাগ্নে যথারীতি নিজস্ব সাইড দিয়েছে, অন‍্যদিকে পেছন দিক থেকে একটা লরি এসে আমাদের মোটরসাইকেলে ধাক্কা মেরে দিল। আমার উপরে আমাদের বাইক পড়ে গেল। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ভাগ্নে সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে জঙ্গলের মধ্যে পড়েছিল। তারপর যা ঘটেছে সবই আমার অজানা। পরে যতটুকু জেনেছি তা প্রত‍্যক্ষ দর্শকের কাছ থেকে।  পেছন দিক থেকে আসছিলেন অশোক রায় নামে এক ভদ্রলোক। বানজেটিয়ায় বাড়ি। আমাদের ঘিরে আছেন চায়ের দোকানে আড্ডাবাজ কিছু ব‍্যক্তি। অশোক বাবু এসে স্কুটি থামিয়ে সবাইকে ধমকে আমার উপর থেকে মোটরবাইক তুলেছিলেন। সবাই ভেবেছিলেন মারা গেছি। পুলিশ না এলে হাসপাতালে নেওয়া যাবে না। কিন্তু অশোকবাবু জোর করে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলেন। আমার কাঁধে সবসময়ই শান্তিনিকেতনী ব‍্যাগ থাকে। সেই ক্লাশ নাইন থেকেই। তো ব‍্যাগটাই আমার আশ্রয়স্থল। সবকিছু ব‍্যাগেই থাকত। একটা ক‍্যামেরা সবসময়ই । সেদিন ব‍্যাগের মধ্যে ছিল ত্রিশহাজার টাকা এবং খরচের জন্য আলাদা কিছু খুচরো টাকা পয়সা।  ব‍্যাগটা কাঁধেই ছিল। অশোকবাবু নিজ হেফাজতে নিয়েছিলেন। মোবাইলও ছিল। মোবাইল নিয়ে কল লিস্ট ঘেটে দেখছিলেন বহরমপুরের কেউ চেনাশোনা  আছে কিনা। ভাগ্নের কাছে জেনেছিলেন আমার সংক্ষিপ্ত পরিচয়। সেই ভরসায় তিনি কললিস্ট সার্চ করে একদা আনন্দবাজারে সাংবাদিক অনল আবেদিনকে ফোন করেছিলেন। অনলদা আবার আমার প্রেসের মালিক গল্পকার অংশুমান রায়কে ফোন করে। তারপর অংশুমান আমার বন্ধু পত্রিকার সহসম্পাদক এমদাদউল হক ( ইন্দ্রপ্রস্থে থাকত ) কে ফোন করে। ছুটে আসে সকলে। আমি অজ্ঞান অবস্থায় ছিলাম। ডাক্তার দেখেছেন। নীলরতন হাসপাতালে রেফার করে দিয়েছেন। আমার হিপ জয়েন্ট চুরমার হয়ে গেছে। ডান হাতের কাঁধ ভেঙ্গে গেছে। ডান পা ভেঙ্গে খানখান। রক্তাক্ত শরীর। ক্ষতবিক্ষত। আমি জানিনা কিছুই। আমার যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি নীলরতন হাসপাতালে ইমারজেন্সী ওয়ার্ডের ওয়েটিং রুমে। আমার সঙ্গে আমার বন্ধু এমদাদউল হক। সে জ্ঞান ফিরে পেতেই কি যন্ত্রণা শরীরে। ঈশ্বর যদি থাকেন তিনিও হয়তো এই যন্ত্রণার পরিমাণ পরিমাপ করতে পারেননি। না হলে অন্ততপক্ষে একফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়ত।আমি শীতল হতাম। আমি চিৎকার করে উঠলাম। চেঁচিয়ে উঠে আল্লা, মাগো মরে গেলাম।  জীবনে দ্বিতীয়বার আল্লাহ্ শব্দটা উচ্চারণ করেছি বোধহয়। আরেকবার আমার কলিগ শিক্ষকবন্ধু ভাগ‍্যধর দাস কর্মকারের বিয়েতে বরযাত্রী গেছিলাম বর্ধমান। যে গাড়িতে গেছিলাম সেটি নড়বড়ে। যাইহোক বিয়ে বাড়ির অব‍্যবস্থায় সারারাত মন বিষাক্ত করে তুলেছিল।  বাড়ি ফেরার পথে ড্রাইভার, মেজাজ হারিয়ে সোজা গর্তে নামিয়ে দিয়েছিল। সারারাত আমাদের সঙ্গে ড্রাইভারও উপোস দিয়েছে। বিয়ে শেষ হয়েছে গভীর রাতে। আমাদের যখন খাওয়ার ব‍্যবস্থা করেছিল তখন প্রায় শেষ রাত। আমরা কেউই খেতে পারিনি। বিয়ে বাড়ির লোকজন ড্রাইভারের খোঁজখবর নেয়নি। ফলে সকালবেলায় বরবন্ধুর কাছে বিদায় নিয়ে গাড়িতে। বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে ফুটিসাঁকো স্টপেজে গাড়ি দাঁড়িয়ে পাউরুটি আর গরম গরম দুধ চা। মিষ্টির দোকান থেকে কিছু মিষ্টি আর পরোটা বেঁধে নিলাম। একটা ফাঁকা জায়গাই গাড়ি দাঁড়িয়ে পরোটা মিষ্টি খেলাম। ড্রাইভার কোনমতেই নিলেন না। অনেকখানি রাস্তা পেরিয়ে তারপর তো বাড়ি। মেজাজ টকেছিল তার। মেজাজে গাড়ি জোরে চালাতে গিয়ে খাদের গভীরে। সামনের একটা চাকা খুলে বনবন সামনের দিকে। হেলে পড়েছে গাড়ি। আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে ছিলাম। সবকিছু দেখতে পাচ্ছি। চোখের সামনে দিয়ে নেমে পড়ছে গাড়ি। মাথা ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ গাড়িটা উল্টাপাল্টা খেয়ে জোরে ধাক্কা মেরে দাঁড়িয়ে পড়ল। লাফিয়ে উঠল গাড়ি। আমার মাথাটা গাড়ির ছাদে গিয়ে ধাক্কা মারতেই ইয়া আল্লাহ্ বলে নাকি চিৎকার করে উঠেছিলাম। অজ্ঞাতে অজান্তেই। আর এখানে এই হাসপাতালে। আল্লাগো মাগো। কথায় আছে না, ঠেলার নাম বাবাজী।” ২০১৬ সালের  পথদুর্ঘটনায় মারাত্মক জখম হওয়ার পর বন্ধ হয়ে গেছিল, ‘আবার এসেছি ফিরে’ আর ‘এবং পুনশ্চ’।  দুটিকে ফিরিয়ে এনেছিলেন এবাদুল হক। নিজের খরচে পত্রিকা দুটি প্রকাশ ও সম্পাদনা করতেন, কোনও বিজ্ঞাপন থাকতো না  পত্রিকাতে। শুধু লেখা প্রকাশ করা নয়, লেখক কপিও নিজের  খরচে লেখককে পোস্ট বা বিভিন্ন উপায়ে পৌঁছে দিতেন। নিজের প্রচুর গল্প নাটক লেখা থাকলেও তিনি তা নিজ পত্রিকায় প্রকাশ করতে সঙ্কোচ বোধ করতেন। নতুন লেখকদের আত্মপ্রকাশের জায়গা করে দেওয়াই তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল। 


সাহিত্য নিয়ে যেভাবে কাজ করছিলেন,  খুব কম সময়ের মধ্যেই পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। সাহিত্যের জন্য কখনো  এবাদুল হকশহরমুখী হতে চাননি। বাণিজ্যিক কাগজে লেখা প্রকাশেও তাঁর আগ্রহ ছিল না। কাউকে ধরাধরি করেননি কখনও । পৌরাণিক ঋষিদের মতন নিজেকে নিজেই সুশিক্ষিত করেছেন নিজের স্বভাবসিদ্ধ গরিমায় ।  কলকাতা থেকে বহুদূরে এক মফসসল এলাকায় বসবাস করেও যে পত্রিকা তিনি প্রকাশ করতেন তা ছিল ঋষিতুল্য কর্মোদ্যম ও আত্মাভিমানের প্রমাণ । ‘আবার এসেছি ফিরে’ পত্রিকার এক একটি সংখ্যা প্রায় হাজার পৃষ্ঠার বা তারও বেশি হতো। একজন কবি, প্রাবন্ধিক বা গল্পকার তিনি যত নতুন লেখকই হোন না কেন, তাঁর পত্রিকায় সমান মর্যাদা পেতেন। কলকাতা ও জেলাশহরের দলবাজ নেতা-সম্পাদকদের দ্বারা উপেক্ষিত, অপমানিত, অপরিচিত-নামের প্রান্তিক লেখকদের তিনি বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা দিতেন । তিনি তাঁদের নিয়ে পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাও করেছিলেন। আগামীতেও কয়েকটি সংখ্যা করবেন বলে লেখা সংগ্রহ করছিলেন। অজিত রায়, রবীন্দ্র গু্হ প্রমুখ, যাঁরা ভিন্নধর্মী গদ্যবিন্যাসের কারণে কলকাতার পত্রিকাগুলোর ডাক পান না, তাঁদের কাছ থেকে গদ্য চেয়ে এবাদুল হক প্রকাশ করেছেন নিজের পত্রিকায় । বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন দেবী রায়, অজিত বাইরী, কবিরুল ইসলাম, বেণু দত্ত রায় প্রমুখকে নিয়ে ।  রাণা চট্টোপাধ্যায়, অনন্ত রায়, পুষ্পিত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে সংখ্যা করার জন্য প্রবন্ধ সংগ্রহ করা আরম্ভ করেছিলেন । 

‘আবার এসেছি ফিরে’ সাহিত্য পত্রিকার জন্য ১৯৯২-৯৩ সালে পর-পর দুবার এবাদুল হক পেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর এর ‘সারা বাংলা শ্রেষ্ঠ লিটিল ম্যাগাজিন সম্মান’, ১৯৯৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র যুব উৎসব পুরস্কার, ১৯৯৫ সালে নিজের লেখা নাটকের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একাঙ্ক নাটক পুরস্কার, ২০১৩ সালে অদ্বৈত মল্লবর্মণ জ্মশতবর্ষ স্মারক পুরস্কার, ২০১৬ সালে সারা ভারত লিটল ম্যাগাজিন প্রতিযোগীতায় সাদাত হাসান মান্টো পুরস্কার এবং ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমির দেওয়া শ্রেষ্ঠ লিটল ম্যাগাজিনের পুরস্কার । এই পুরস্কারটি  সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী তুলে দিয়েছিলেন এবাদুল হকের হাতে । এছাড়াও বিভিন্ন জেলার লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার পেয়েছিলেন এবাদুল ওঁর পত্রিকার ডাকাবুকো সম্পাদনার জন্য। 

ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা জনিত কারণে কয়েক বছর যাবৎ তিনি অত্যন্ত অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু তাঁর ছিল  অদম্য মনোবল । শরীরের সমস্যা কোনোদিন তাঁর সাহিত্যকর্মকে প্রভাবিত করতে পারেনি। তাঁর কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৭টি নাটকের সংকলন ‘এখনও লক্ষিন্দর’ এবং প্রায় একশটি গল্পের সংকলন ‘অনন্ত’ । নিজের লেখা নাটকে অভিনয় করেছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা সাতটি । সেগুলি হল ‘কবিতা ও কাকলি’, ‘সূর্যাস্তের আগে ও পরে’, ‘নাগকেশরের ফুল’,’অগ্নিজল’, ‘বাউলজল’, ‘এক গ্লাস জলের ছায়া’ আর ‘পলাতক ছায়া। 'একগ্লাস জ্বলের ছায়ায়' গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই ভার্স লিবরে আঙ্গিকে লেখা । তিনি উপন্যাসও লিখতে শুরু করেছিলেন । মুর্শিদাবাদের ডোমকল শহরে ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১  অনুষ্ঠিত হয়েছিল একটি সাহিত্য সভা।  এবাদুল হক  তাঁর স্বাগত ভাষণে  তরুণ ফেসবুকীয়া কবিদের বলেন যে কবিরা তাঁদের নিজস্ব ভাবনা ও ভঙ্গিতে কবিতা লিখবেন , তা কেউ ভালো বলুক বা না বলুক, কিন্তু কারো নকল বা কপি করে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া কখনই উচিত নয় । ২০১২ সালে যখন সারাবাংলা লিটিল ম্যাগাজিন প্রতিযোগিতায় ‘আবার এসেছি ফিরে’ প্রথম স্থান অধিকার করেছিল সেইদিন রবীন্দ্রসদন চত্বরে স্টেজে ছিলেন জয় গোস্বামী এবং মহাশ্বেতা দেবী । পুরস্কার দেবার সময়ে ‘আবার এসেছি ফিরে’ পত্রিকাকে মফসসলের পত্রিকা বলে উল্লেখ করা হলে,  এবাদুল হক চিৎকার করে বলেছিলেন “মফসসল কথাটা আপনারা ব্যবহার করবেন না ; আমি মফস্বল থেকে এসছি এবং ‘আবার এসেছি ফিরে’ আপনাদের কাছে আজ মফস্বল থাকলো না।” এবাদুল হক  এমনই ডাকাবুকো মানুষ ছিলেন। যা বলতেন সামনাসামনি এবং সত্যি কথাটা জোর দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন, বলে দিতেন, কারও তোয়াক্কা করতেন না। কিন্তু সব কিছুর চেয়ে বেশি, এবাদুলের কাছে সাহিত্য ছিল মানবসংযোগ। পত্রিকার সূত্রে অখ্যাত অথচ অসাধারণ ব্যক্তির সংগে যোগাযোগ ঘটেছে তাঁর, অখ্যাত হলেও যাদের কাছ থেকে নতুন কিছু শেখা যায় ; যাদের সাথে মিশে হাসা যায় এবং আনন্দ ভাগাভাগি করা যায় । 

মহর্ষি এবাদুল হকের সঙ্গে আমার পরিচয় বহুকাল আগে । গ্রামীণ উন্নয়নের চাকুরির সূত্রে আমি যখন বদলি হয়ে কলকাতায় ফিরি, তখন নাকতলার ফ্ল্যাটে থাকতুম । আমি কলকাতার সাহিত্যজগতকে এড়িয়ে চলতুম বলে কবি-লেখকদের বিশেষ আনাগোনা ছিল না আমার ফ্ল্যাটে । একদিন হঠাৎই এক যুবক এলেন, নিজের নাম বললেন এবাদুল হক, এসেছেন মুর্শিদাবাদের কানাপুকুর থেকে, আমার লেখা চান আর আমাকে নিয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করতে চান । যুবকটির প্রস্তাব ছিল স্তম্ভিত করে দেবার মতন কেননা সাহিত্যিক হিসেবে কলকাতায় আমাকে বড়ো একটা পছন্দ করা হতো না আর একজন যুবক কিনা বহুদূর থেকে এসেছেন আমার লেখা নিতে আর আমাকে নিয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করার প্রস্তাব নিয়ে । সেই থেকে এবাদুলের সঙ্গে আমার আলাপ । এবাদুল আমার দুটি বই প্রকাশ করেছিলেন, একটি ছোটোগল্পের, “অতিবাস্তব গল্পগাছা” নামে এবং আরেকটি “হাংরি ইশতাহার সংকলন” । আমার লেখালিখি নিয়ে বহুকাল আগে সেই প্রথম ক্রোড়পত্র প্রকাশের পর   নভেম্বর ২০১৯ সালে ৪১ বর্ষ প্রথম সংখ্যায় আবার ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেন ।