বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৩

হাংরি আন্দোলন ( ১৯৬১ থেকে ১৯৮৭ )

 হাংরি আন্দোলন : মলয় রায়চৌধুরী



১৯৫৯-৬০ সালে আমি দুটি লেখা নিয়ে কাজ করছিলুম। একটি হল ইতিহাসের দর্শন যা পরে বিংশ শতাব্দী পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল। অন্যটি মার্কসবাদের উত্তরাধিকার যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এই দুটো লেখা নিয়ে কাজ করার সময়ে হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনটা আমার মাথায় আসে । হাংরি আন্দোলনের ‘হাংরি’ শব্দটি আমি পেয়েছিলুম ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম বাক্যটি থেকে। ওই সময়ে, ১৯৬১ সালে, আমার মনে হয়েছিল যে স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তা টকে গিয়ে পচতে শুরু করেছে উত্তর ঔপনিবেশিক কালখন্ডে। ‘হাংরি’ মানে খাওয়া নয় ; সাওয়ার হাংরি টাইম মানে ‘পচনরত কালখণ্ড’।

উপরোক্ত রচনাদুটির খসড়া লেখার সময়ে আমার নজরে পড়েছিল ওসওয়াল্ড স্পেংলারের লেখা দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েষ্ট বইটি, যার মূল বক্তব্য থেকে আমি গড়ে তুলেছিলুম আন্দোলনের দার্শনিক প্রেক্ষিত। ১৯৬০ সালে আমি একুশ বছরের ছিলুম। স্পেংলার বলেছিলেন যে একটি সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরলরেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়; তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফুরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে। কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময়ে আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন। আমার মনে হয়েছিল যে দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয়। এখানে বলা ভালো যে আমি কলাকাতার আদি নিবাসী পরিবার সাবর্ণ চৌধুরীদের বংশজ, এবং সেজন্যে বহু ব্যাপার আমার নজরে যেভাবে খোলসা হয় তা অন্যান্য লেখকদের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।

ওই চিন্তা ভাবনার দরুণ আমার মনে হয়েছিল যে কিঞ্চিদধিক হলেও, এমনকি যদি ডিরোজিওর পর্যায়েও না হয়, তবু হস্তক্ষেপ দরকার, আওয়াজ তোলা দরকার, আন্দোলন প্রয়োজন। আমি আমার বন্ধু দেবী রায়কে, দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে, দাদার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে আমার আইডিয়া ব্যাখ্যা করি, এবং প্রস্তাব দিই হাংরি নামে আমরা একটা আন্দোলন আরম্ভ করব। ১৯৫৯ থেকে টানা দুবছরের বেশি সে সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় দাদার চাইবাসার বাড়িতে থাকতেন। দাদার চাইবাসার বাড়ি, যা ছিল নিমডি নামে এক সাঁওতাল-হো অধ্যুষিত গ্রামের পাহাড় টিলার ওপর, সে-সময়ে হয়ে উঠেছিল তরুণ শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডা। ১৯৬১ সালে যখন হাংরি আন্দোলনের প্রথম বুলেটিন প্রকাশিত হয়, এবং ১৯৬২ সালে বেশ কয়েক মাস পর্যন্ত, আমরা এই চারজনই ছিলুম আন্দোলনের নিউক্লিয়াস।

ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক ইতিহাসের বনেদের ওপর অর্থাৎ আন্দোলনগুলো ছিল টাইম-স্পেসিফিক বা সময় কেন্দ্রিক। কল্লোল গোষ্ঠী এবং কৃত্তিবাস গোষ্ঠী তাঁদের ডিসকোর্সে যে নবায়ন এনেছিলেন সে কাজগুলোও ছিল কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়্যালিটি বা ঔপনিবেশিক নন্দন-বাস্তবতার চৌহদ্দির মধ্যে, কেননা সেগুলো ছিল যুক্তিগ্রন্থনা নির্ভর এবং তাদের মনোবীজে অনুমিত ছিল যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটি একক, নিটোল ও সমন্বিত। সময়ানুক্রমী ভাবকল্পের প্রধান গলদ হল যে তার সন্দর্ভগুলো নিজেদের পূর্বপুরুষদের তুলনায় উন্নত মনে করে, এবং স্থানিকতাকে ও অনুস্তরীয় আস্ফালনকে অবহেলা করে।

১৯৬১ সালের প্রথম বুলেটিন থেকেই হাংরি আন্দোলন চেষ্টা করল সময়তাড়িত চিন্তাতন্দ্র থেকে সম্পূর্ণ পৃথক পরিসরলব্ধ চিন্তাতন্ত্র গড়ে তুলতে। সময়ানুক্রমী ভাবকল্পে যে বীজ লুকিয়ে থাকে, তা যৌথতাকে বিপন্ন আর বিমূর্ত করার মাধ্যমে যে মননসন্ত্রাস তৈরি করে, তার দরুন প্রজ্ঞাকে যেহেতু কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়, সমাজের সুফল আত্মসাৎ করার প্রবণতায় ব্যক্তিদের মাঝে ইতিহাসগত স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ব্যক্তিক তত্ত্বসৌধ নির্মাণ। ঠিক এই জন্যেই, ইউরোপীয় শিল্পসাহিত্য আন্দোলনগুলো খতিয়ে যাচাই করলে দেখা যাবে যে ব্যক্তিপ্রজ্ঞার আধিপত্যের দামামায় সমাজের কান ফেটে এমন রক্তাক্ত যে সমাজের পাত্তাই নেই কোন। কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর দিকে তাকালে দেখব যে পুঁজিবলবান প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে এবং প্রতিযোগী ব্যক্তিবাদের লালনে সমসাময়িক শতভিষা গোষ্ঠী যেন অস্তিত্বহীন। এমনকি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীও সীমিত হয়ে গেছে দুতিনজন মেধাস্বত্বাধিকারীর নামে। পক্ষান্তরে, আমরা যদি ঔপনিবেশিক নন্দনতন্ত্রের আগেকার প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কথা ভাবি, তাহলে দেখব যে পদাবলী সাহিত্য নামক স্পেস বা পরিসরে সংকুলান ঘটেছে বৈষ্ণব ও শাক্ত কাজ; মঙ্গলকাব্য নামক-ম্যাক্রো-পরিসরে পাবো মনসা বা চন্ডী বা শিব বা কালিকা বা শীতলা বা ধর্মঠাকুরের মাইক্রো-পরিসর। লক্ষণীয় যে প্রাকঔপনিবেশিক কালখন্ডে এই সমস্ত মাইক্রো-পরিসরগুলো ছিল গুরুত্বপূর্ণ, তার রচয়িতারা নন। তার কারণ সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব ও বিকাশ ইউরোপীয় অধিবিদ্যাগত মননবিশ্বের ফসল। সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিটি উপনিবেশে গিয়ে এই ফসলটির চাষ করেছে।

ইতিহাসের দর্শন নিয়ে কাজ করার সময়ে আমার মনে হয়েছিল যে স্পেস বা স্থানিকতার অবদান হল পৃথিবী জুড়ে হাজার রকমের ভাষার মানুষ, হাজার রকমের উচ্চারণ ও বাকশৈলী, যখন কিনা ভাষা তৈরির ব্যাপারে মানুষ জৈবিকভাবে প্রোগ্রামড। একদিকে এই বিস্ময়কর বহুত্ব; অন্যদিকে, সময়কে একটি মাত্র রেখা-বরাবর এগিয়ে যাবার ভাবকল্পনাটি, যিনি ভাবছেন সেই ব্যক্তির নির্বাচিত ইচ্ছানুযায়ী, বহু ঘটনাকে, যা অন্যত্র ঘটে গেছে বা ঘটছে, তাকে বেমালুম বাদ দেবার অনুমিত নকশা গড়ে ফ্যালে। বাদ দেবার এই ব্যাপারটা, আমি সেসময়ে যতটুকু বুঝেছিলুম, স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল লর্ড কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাঙালির ডিসকোসটি উচ্চবর্গের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায়, যার ফলে নিম্নবর্গের যে প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্স বাঙালি সংস্কৃতিতে ছেয়ে ছিল, তা ঔপনিবেশিক আমলে লোপাট হয়ে যাওয়ায়। আমার মনে হয়েছিল যে ম্যাকলে সাহেবের চাপানো শিক্ষাপদ্ধতির কারণে বাঙালির নিজস্ব স্পেস বা পরিসরকে অবজ্ঞা করে ওই সময়ের অধিকাংশ কবি লেখক মানসিকভাবে নিজেদের শামিল করে নিয়েছিলেন ইউরোপীয় সময়রেখাটিতে। একারণেই, তখনকার প্রাতিষ্ঠানিক সন্দর্ভের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের প্রতিসন্দর্ভের সংঘাত আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল প্রথম বুলেটিন থেকেই এবং তার মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রতিটি বুলেটিন প্রকাশিত হবার সাথে-সাথে, যা আমি বহু পরে জানতে পারি, ‘কাউন্সিল ফর কালচারাল ফ্রিডাম’-এর সচিব এ.বি.শাহ, ‘পি.ই.এন ইনডিয়ার অধ্যক্ষ নিসিম এজেকিয়েল, এবং ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা পুপুল জয়াকরের কাছ থেকে।

আমনধারা সংঘাত বঙ্গজীবনে ইতোপূর্বে ঘটেছিল। ইংরেজরা সময়কেন্দ্রিক মননবৃত্তি আনার পর প্রাগাধুনিক পরিসরমূলক বা স্থানিক ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাঙালি ভাবুকের জীবনে ও তার পাঠবস্তুতে প্রচন্ড ঝাঁকুনি আর ছটফটানি, রচনার আদল-আদরায় পরিবর্তনসহ, দেখা দিয়েছিল, যেমন ইয়ং বেঙ্গল সদস্যদের ক্ষেত্রে (হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিরী, রাধানাথ শিকদার, প্যারীচাঁদ মিত্র, শিবচন্দ্র দেব ও দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়) এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও আরও অনেকের ক্ষেত্রে। একইভাবে, হাংরি আন্দোলন যখন সময় কেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক চিন্তাতন্ত্র থেকে ছিড়ে আলাদা হয়, উত্তর ঔপনিবেশিক আমলে আবার স্থানিকতার চিন্তাতন্ত্রে ফিরে যাবার চেষ্টা করেছিল, তখন আন্দোলনকারীদের জীবনে, কার্যকলাপে ও পাঠবস্তুর আদল-আদরায় অনুরূপ ঝাঁকুনি, ছটফটানি ও সমসাময়িক নন্দন কাঠামো থেকে নিস্কৃতির প্রয়াস দেখা গিয়েছিল। তা নাহলে আর হাংরি আন্দোলনকারীরা সাহিত্য ছাড়াও রাজনীতি, ধর্ম, উদ্দেশ্য, স্বাধীনতা, দর্শনভাবনা, ছবি আঁকা, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে ইস্তাহার প্রকাশ করবেন কেন।

হাংরি আন্দোলনের সময়কাল বেশ দীর্ঘ। ১৯৬১ থেকে আটের দশকের মাঝামাঝি  পর্যন্ত। এই আন্দোলন একটিমাত্র পত্রিকাকে কেন্দ্র করে একটি শহরের ঘটনা নয়, তাই চেষ্টা করব সমগ্র যুগকে একটি পরিসরে তুলে আনার। হাংরি আন্দোলন নিয়ে অনেক বই আছে, কিন্তু এর আগে সেই বিস্তৃত কালখণ্ডের যুবক-যুবতীদের কর্মকাণ্ডকে ‘হাংরি যুগ’ হিসাবে চিহ্ণিত করে কোনো বই লেখা হয়নি । যে বইগুলো লেখা হয়েছে সেগুলো গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ।  হাংরি আন্দোলন সক্রিয় ছিল বিভিন্ন শহরে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর  পত্রিকার মাধ্যমে, যেমন প্রতিদ্বন্দী, চিহ্ণ, ক্ষুধার্ত, ক্ষুধার্ত খবর, জিরাফ, ফুঃ, ঋত্বিক, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প, ধৃতরাষ্ট্র, ক্ষুধার্ত সময়, ক্ষুধার্ত প্রতিরোধ, রোবোট, কুরুক্ষেত্র, পাগলা ঘোড়া, দ্রোহ, বিকল্প, দন্দশূক, সময়সূত্র, যুদ্ধযাত্রা, মন্বন্তর, এখন এই রকম, অনার্য, পাখি সব করে রব ইত্যাদি,  এবং  আশির দশকের শেষ পর্যন্ত কলকাতাসহ উত্তরবঙ্গ আর ত্রিপুরার তরুণ কবি-লেখকরা সেই যুগকে করে তোলেন মহামিলন-ক্ষেত্র ।

সদস্যরা ছিলেন : শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায়, বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র,  সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, অবনী ধর, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, অজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায়, অনিল করঞ্জাই,  করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, অলোক গোস্বামী, মলয় মজুমদার, রাজা সরকার, কিশোর সাহা, প্রবীর শীল, রতন নন্দী, কুশল বাগচী, সুমন্ত ভট্টাচার্য, পল্লবকান্তি রাজগুরু, চন্দন দে, বিকাশ সরকার, নির্মল হালদার, সূর্য মুখোপাধ্যায়, দেবজ্যোতি রায়, অরুণেশ ঘোষ, অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ রাউত, আপ্পা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরণি বসু, প্রিতম মুখোপাধ্যায়, সুনীতা ঘোষ,  রবীন দত্ত, সেলিম মুস্তফা, রবিউল, অরুণ বণিক, রসরাজ নাথ, রত্নময় দে, সাত্বিক নন্দী, নিত্য মালাকার, সুভাষ কুণ্ডু, স্বপন চক্রবর্তী, সুবীর মুখোপাধ্যায়, দীপকজ্যোতি বড়ুয়া, নির্মল হালদার, সৈকত রক্ষিত, রবীন্দ্র মল্লিক, বিজন রায়, স্বপন মুখোপাধ্যায়  প্রমুখ । .

এই  সময়ে শতাধিক ছাপান আর সাইক্লোস্টাইল করা বুলেটিন প্রকাশ করা হয়েছিল, অধিকাংশই হ্যান্ডবিলের মতন ফালিকাগজে, কয়েকটা দেয়াল-পোস্টারে, তিনটি একফর্মার মাপে, এবং একটি (যাতে উৎপলকুমার বসুর ‘পোপের সমাধি’ শিরোনামের বিখ্যাত কবিতাটি ছিল) কুষ্ঠিঠিকুজির মতন দীর্ঘ কাগজে। এই যে হ্যান্ডবিলের আকারে সাহিত্যকৃতি প্রকাশ, এরও পেছনে ছিল সময়কেন্দ্রিক ভাবধারাকে চ্যালেঞ্জের প্রকল্প। ইউরোপীয় সাহিত্যিকদের পাঠবস্তুতে তো বটেই, মাইকেল মধুসুদন দত্তর প্রজন্ম থেকে বাংলা সন্দর্ভে প্রবেশ করেছিল শিল্প-সাহিত্যের নশ্বরতা নিয়ে হাহাকার। পরে, কবিতা পত্রিকা সমগ্র, কৃত্তিবাস পত্রিকা সমগ্র, শতভিষা পত্রিকা সমগ্র ইত্যাদি দুই শক্ত মলাটে প্রকাশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপের এই নন্দনতাত্ত্বিক হাহাকারটিকে। পক্ষান্তরে, ফালিকাগজে প্রকাশিত রচনাগুলো দিলদরাজ বিলি করে দেয়া হতো, যে প্রক্রিয়াটি হাংরি আন্দোলনকে দিয়েছিল প্রাকঔপনিবেশিক সনাতন ভারতীয় নশ্বরতাবোধের গর্ব। সেই সব ফালিকাগজ, যারা আন্দোলনটি আরম্ভ করেছিলেন, তাঁরা কেউই সংরক্ষণ করার বোধ দ্বারা তাড়িত ছিলেন না, এবং কারোর কাছেই সবকটি পাওয়া যাবে না। ইউরোপীয় সাহিত্যে নশ্বরতাবোধের হাহাকারের কারণ হল ব্যক্তিমানুষের ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা প্রদান। যে ট্র্যাজেডি-ভাবনা গ্রেকো-রোমান ব্যক্তি এককের পতনযন্ত্রণাকে মহৎ করে তুলেছিল পরবর্তীকালের ইউরোপে তা বাইবেলোক্ত প্রথম মানুষের ‘অরিজিনাল সিন’ তত্ত্বের আশ্রয়ে নশ্বরতাবোধ সম্পর্কিত হাহাকারকে এমন গুরুত্ব দিয়েছিল যে এলেজি এবং এপিটাফ লেখাটি সাহিত্যিক জীবনে যেন অত্যাবশক ছিল।

আমরা পরিকল্পনা করেছিলুম যে সম্পাদনা ও বিতরণের কাজ দেবী রায় করবেন, নেতৃত্ব দেবেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সংগঠিত করার দিকটা দেখবেন দাদা সমীর রায়চৌধুরী, আর ছাপা এবং ছাপানোর খরচের ভার আমি নেব। প্রথমেই অসুবিধা দেখা দিল। পাটনায় বাংলা ছাপাবার প্রেস পাওয়া গেল না। ফলে ১৯৬১ সালের নভেম্বরে যে বুলেটিন প্রকাশিত হল, তা ইংরেজিতে। এই কবিতার ইশতাহারে আগের প্রজন্মের চারজন কবির নাম থাকায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় ক্ষুন্ন হয়েছিলেন বলে ডিসেম্বরে শেষ প্যারা পরিবর্তন করে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে অংশগ্রহণকারীদের নামসহ এই ইশতাহারটি আরেকবার বেরোয়। ১৯৬২ সালের শেষাশেষি সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। দাদার বন্ধু উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় যোগ দেন। আমার বন্ধু সুবিমল বসাক, অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় যোগদেন। সুবিমল বসাকের বন্ধু প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরূপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত সুভাষ ঘোষ, সতীন্দ্র ভৌমিক, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, শৈলেশ্বর ঘোষ, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পান্ডা, মনোহার দাশ যোগ দেন। তখনকার দিনে বামপন্থী ভাবধারার বুদ্ধিজীবীদের ওপর পুলিশ নজর রাখত। দেবী রায় লক্ষ্য করেন নি যে পুলিশের দুজন ইনফর্মার হাংরি আন্দোলনকারীদের যাবতীয় বই পত্র, বুলেটিন ইত্যাদি সংগ্রহ করে লালবাজারের প্রেস সেকশানে জমা দিচ্ছে এবং সেখানে ঢাউস সব ফাইল খুলে ফেলা হয়েছে।

এতজনের লেখালিখি থেকে সেই সময়কার প্রধান সাহিত্যিক সন্দর্ভের তুলনায় হাংরি আন্দোলন যে প্রদিসন্দর্ভ গড়ে তুলতে চাইছিল, সে রদবদল ছিল দার্শনিক এলাকার, বৈসাদৃশ্যটা ডিসকোর্সের, পালাবদলটা ডিসকার্সিভ প্র্যাকটিসের, বৈভিন্ন্যটা কখন-ভাঁড়ারের, পার্থক্যটা উপলব্ধির স্তরায়নের, তফাতটা প্রস্বরের, তারতম্যটা কৃতি-উৎসের। তখনকার প্রধান মার্কেট-ফ্রেন্ডলি ডিসকোর্সটি ব্যবহৃত হতো কবিলেখকের ব্যক্তিগত তহবিল সমৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। হাংরি আন্দোলনকারীরা সমৃদ্ধ করতে চাইলেন ভাষার তহবিল, বাচনের তহবিল, বাকবিকল্পের তহবিল, অন্ত্যজ শব্দের তহবিল, শব্দার্থের তহবিল, নিম্নবর্গীয় বুলির তহবিল, সীমালঙ্ঘনের তহবিল, অধ:স্তরীয় রাগবৈশিষ্ট্যের তহবিল, স্পৃষ্টধ্বনির তহবিল, ভাষিক ইরর্যাশনালিটির তহবিল, শব্দোদ্ভটতার তহবিল, প্রভাষার তহবিল, ভাষিক ভারসাম্যহীনতার তহবিল, রূপধ্বনির প্রকরণের তহবিল, বিপর্যাস সংবর্তনের তহবিল, স্বরন্যাসের তহবিল, পংক্তির গতিচাঞ্চল্যের তহবিল, সন্নিধির তহবিল, পরোক্ষ উক্তির তহবিল, স্বরণ্যাসের তহবিল, পাঠবস্তুর অন্তঃস্ফোটিক্রিয়ার তহবিল, তড়িত বাঞ্জনার তহবিল, অপস্বর-উপস্বরের তহবিল, সাংস্কৃতিক সন্নিহিতির তহবিল, বাক্যের অধোগঠনের তহবিল, খন্ডবাক্যের তহবিল, বাক্যনোঙরের তহবিল, শীংকৃত ধ্বনির তহবিল, সংহিতাবদলের তহবিল, যুক্তিছেদের তহবিল, আপতিক ছবির তহবিল, সামঞ্জস্যভঙ্গের তহবিল, কাইনেটিক রূপকল্পের তহবিল ইত্যাদি।

ইতোপূর্বে ইযংবেঙ্গলের সাংস্কৃতিক উথাল-পাথাল ঘটে থাকলেও, বাংলা শিল্প সাহিত্যে আগাম ঘোষণা করে, ইশতাহার প্রকাশ করে, কোন আন্দোলন হয়নি। সাহিত্য এবং ছবি আঁকাকে একই ভাবনা-ফ্রেমে আনার প্রয়াস, পারিবারিক স্তরে হয়ে থাকলেও, সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর মাধ্যমে হয়নি। ফলত দর্পণ, জনতা, জলসা ইত্যাদি পত্রিকায় আমাদের সম্পর্কে বানানো খবর পরিবেশিত হওয়া আরম্ভ হল। হাংরি আন্দোলনের রাজনৈতিক ইশতাহার নিয়ে প্রধান সম্পাদকীয় বেরোল যুগান্তর দৈনিকে। আমার আর দেবী রায়ের কার্টুন প্রকাশিত হল দি স্টেটসম্যান পত্রিকায়। হেডলাইন হল ব্রিৎস পত্রিকায়। সুবিমল বসারের প্রভাবে হিন্দি ভাষায় রাজকমল চৌধুরী আর নেপালি ভাষায় পারিজাত হাংরি আন্দোলনের প্রসার ঘটালেন। আসামে ছড়িয়ে পড়ল পাঁক ঘেটে পাতালে পত্রিকাগোষ্ঠীর সদস্যদের মাঝে। ছড়িয়ে পড়ল বগুড়ার বিপ্রতীক এবং ঢাকার স্বাক্ষর ও কণ্ঠস্বর পত্রিকাগুলোর সদস্যদের মাঝে, এবং মহারাষ্ট্রের অসো পত্রিকার সদস্যদের ভেতর। ঢাকার হাংরি আন্দোলনকারীরা (বুলবুল খান মাহবুব, অশোক সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী, শহিদুর রহমান, প্রশান্ত ঘোষাল, মুস্তফা আনোয়ার প্রমুখ) জানতেন না যে আমি কেন প্রথম হাংরি বুলেটিনগুলো ইংরেজিতে প্রকাশ করেছিলুম। ফলে তাঁরাও আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন ইংরেজিতে ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে।

যার-যেমন-ইচ্ছে লেখালেখির স্বাধীনতার দরুন হাংরি আন্দোলনকারীদের পাঠবস্তুতে যে অবাধ ডিক্যাননাইজেশান, আঙ্গিকমুক্তি, যুক্তিভঙ্গ, ডিন্যারেটিভাইজেশান, অনির্ণেয়তা, মুক্ত সমাপ্তি ইত্যাদির সূত্রপাত ঘটে, সেগুলোর যথার্থ সার্থকতা ও প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকেন তখনকার বিদ্যায়তনিক আলোচকরা, যাঁরা বিবিধতাকে মনে করেছিলেন বিশৃঙ্খলা, সমরূপ হবার অস্বীকৃতিকে মনে করেছিলেন অন্তর্ঘাত, সন্দেহপ্রবণতাকে মনে করেছিলেন অক্ষমতা, ঔপনিবেশিক চিন্তনতন্ত্রের বিরোধীতাকে মনে করেছিলেন অসামাজিক, ক্ষমতাপ্রতাপের প্রতিরোধকে মনে করেছিলেন সত্যের খেলাপ। তাঁদের ভাবনায় মতবিরোধিতা মানেই যেন অসত্য, প্রতিবাদের যন্ত্রানুষঙ্গ যেন সাহিত্যসম্পর্কহীন। মতবিরোধিতা যেহেতু ক্ষমতার বিরোধিতা, তাই তাঁরা তার যে কোন আদল ও আদরাকে হেয় বলে মনে করেছিলেন, কেননা প্রতিবিম্বিত ভাবকল্পে মতবিরোধীতা অনিশ্চয়তার প্রসার ঘটায়, বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত করে বলে অনুমান করে নেয়া হয়, তা যদি সাহিত্যকৃতি হয় তাহলে সাহিত্যিক মননবিশ্বে, যদি রাজনৈতিক কর্মকান্ড হয় তাহলে রাষ্ট্রের অবয়বে। এখানে বলা দরকার যে, পশ্চিমবাংলায় তখনও রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেনি। তখনকার প্রতিবিম্বিত বিদ্যায়তনিক ভাবাদর্শে, অতএব, যারা মতবিরোধের দ্বারা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছিল, অর্থাৎ হাংরি আন্দোলনকারীরা, তারা অন্যরকম, তারা অপর, তারা প্রান্তিক, তারা অনৈতিক, তারা অজ্ঞান, তারা সত্যের মালিকানার অযোগ্য। বলাবাহুল্য যে, ক্ষমতা ও সত্যের অমনতর পার্থক্যহীন পরিসরে যাদের হাতে ক্ষমতা তাদের কব্জায় সত্যের প্রভূত্ব। অজ্ঞানের চিন্তাভাবনাকে মেরামত করার দায়, ওই তর্কে, সুতরাং, সত্য মালিকের।

প্রাগুক্ত মেরামতির কাজে নেমে বিদ্যায়তনিক আলোচকরা হাংরি আন্দোলনের তুলনা করতে চাইছিলেন পাঁচের দশকে ঘটে যাওয়া দুটি পাশ্চাত্য আন্দোলনের সঙ্গে। ব্রিটেনের অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ও আমেরিকার বিট জেনারেশনের সঙ্গে। তিনটি বিভিন্ন দেশের ঘটনাকে তাঁরা এমনভাবে উল্লেখ ও উপস্থাপন করতেন, যেন এই তিনটি একই প্রকার সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, এবং তিনটি দেশের আর্থ-রাজনৈতিক কাঠামো, কৌমসমাজের ক্ষমতা-নকশা, তথা ব্যক্তিপ্রতিস্ব নির্মিতির উপাদানগুলো অভিন্ন। আমার মনে হয় বিদ্যায়তনিক ভাবনার প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে সীমিত ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞতা, অর্থাৎ কেবলমাত্র বাংলা ভাষাসাহিত্য বিষয়ক পঠন-পাঠন। যার দরুণ সমাজ ও ব্যক্তিমানুষের জীবনকে তাঁরা ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন সাহিত্যের উপকরণ প্রয়োগ করে। যে-সমস্ত উপাদানের সাহায্যে কৌমসমাজটি তার ব্যক্তি এককদের প্রতিস্ব নির্মাণ করে, সেগুলো ভেবে দেখার ও বিশ্লেষণের প্রয়াস তাঁরা করতেন না। প্রতিস্ব-বিশেষের পাঠবস্তু কেন অমন চেহারায় গোচরে আসছে, টেক্সট-বিশেষের প্রদায়ক গুণনীয়ক কী-কী, পুঁজিপ্রতাপের কৌমকৃৎকৌশল যে প্রতিস্ব-পীড়ন ঘটাচ্ছে তার পাপে পাঠবস্ত-গঠনে মনস্তাত্ত্বিক ও ভাষানকশা কীভাবে ও কেন পাল্টাচ্ছে, আর তাদের আখ্যান ঝোঁকের ফলশ্রুতিই বা কেন অমনধারা, এগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করার বদলে, তাঁরা নিজেদের ব্যক্তিগত ভালোলাগা (ফিল গুড) নামক সাবজেকটিভ খপ্পরে পড়ে পাঠক-সাধারণকে সেই ফাঁদে টানতে চাইতেন। যে কোনও পাঠবস্ত একটি স্থানিক কৌমসমাজের নিজস্ব ফসল। কৌমনিরপেক্ষ পাঠবস্ত অসম্ভব।

কেবল উপরোক্ত দুটি পাশ্চাত্য সাহিত্যিক ঘটনা নয়, ষাটের দশকের বাংলা সাহিত্যে অন্যান্য যে আন্দোলনগুলো ঘটেছিল, যেমন নিমসাহিত্য, শ্রুতি, শাস্ত্রবিরোধী এবং ধ্বংসকালীন, তাদের সঙ্গেও হাংরি আন্দোলনের জ্ঞান-পরিমন্ডল, দর্শন-পরিসর, প্রতিপ্রশ্ন-প্রক্রিয়া, অভিজ্ঞতা-বিন্যাস, চিন্তার-আকরণ, প্রতীতি, বিশ্লেষণী আকল্প, প্রতিবেদনের সীমান্ত, প্রকল্পনার মনোবীজ, বয়ন-পরাবয়ন, ভাষা-পরাভাষা, জগৎ-পরাজগৎ, বাচনিক নির্মিতি, সত্তাজিজ্ঞাসা, উপস্থাপনার ব্যঞ্জনা, অপরত্ববোধ, চিহ্নাদির অন্তর্বয়ন, মানবিক সম্পর্ক বিন্যাসের অনুষঙ্গ, অভিধাবলীর তাৎপর্য, উপলব্ধির উপকরণ, স্বভাবাতিযায়ীতা, প্রতিস্পর্ধা, কৌমসমাজের অর্গল, গোষ্ঠীক্রিয়ার অর্থবহতা, প্রতাপবিরোধী অবস্থানের মাত্রা, প্রতিদিনের বাস্তব, প্রান্তিকায়নের স্বাতন্ত্র্য, বিকল্প অবলম্বন সন্ধান, চিহ্নায়নের অন্তর্ঘাত, লেখন-গ্রন্থনা, দেশজ অধিবাস্তব, অভিজ্ঞতার সূত্রায়ন-প্রকরণ, প্রেক্ষাবিন্দুর সমন্বয়, সমষ্টী পীড়াপুঞ্জ ইত্যাদি ব্যাপারে গভীর ও অসেতুসম্ভব পার্থক্য ছিল। ষাটের দশকের ওই চারটি আন্দোলনের সঙ্গে হাংরি প্রতিসন্দর্ভের যে-মিল ছিল তা হল এই যে পাঁচটি আন্দোলনই লেখকপ্রতিম্ব থেকে রোশনাইকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল পাঠবস্তর ওপর। অর্থাৎ লেখকের কেরামতি বিচার্য নয়, যা বিচার্য তা হল পাঠবস্তুর খুঁটিনাটি। লেখকের বদলে পাঠবস্তু যে গুরুত্বপূর্ণ, এই সনাতন ভারতীয়তা, মহাভারত ও রামায়ণ পাঠবস্তু দুটির দ্বারা প্রমাণিত।

অনুশাসন মুক্তির ফলে, লিটল ম্যাগাজিনের নামকরণের ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল হাংরি আন্দোলন, যে, তারপর থেকে পত্রিকার নাম রাখার ঐতিহ্য একবারে বদলে গেল। কবিতা, ধ্রুপদী, কৃত্তিবাস, শতভিষা, উত্তরসূরী, অগ্রণী ইত্যাদি থেকে একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে হাংরি আন্দালনকারীরা তাঁদের পত্রিকার নাম রাখলেন জেব্রা, উন্মার্গ, ওয়েস্টপেপার, ফুঃ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ইত্যাদি। অবশ্য সাহিত্য শিল্পকে উন্মার্গ আখ্যাটি জীবনানন্দ দাশ বহু পূর্বে দিয়ে গিয়েছিলেন, যদিও হাংরি আন্দালনের সময় পর্যন্ত তিনি তেমন প্রতিষ্ঠা পান নি। জেব্রা নামকরণটি ছিল পাঠকের জন্যে নিশ্চিন্তে রাস্তা পার হয়ে হাংরি পাঠবস্তুর দিকে এগোবার ইশারা। হাংরি আন্দোলন সংঘটিত হবার আগে ওই পত্রিকাগুলোর নামকরণেই কেবল এলিটিজম ছিল তা নয়, সেসব পত্রিকাগুলোর একটি সম্পাদকীয় বৈশিষ্ট্য ছিল। বুর্জোয়া মূল্যবোধ প্রয়োগ করে একে-তাকে বাদ দেয়া বা ছাঁটাই করা, যে কারণে নিম্নবর্ণের লেখকের পাঠবস্ত সেগুলোর পৃষ্ঠায় অনুপস্থিত, বিশেষ করে কবিতা। আসলে কোন-কোন রচনাকে ‘টাইমলেস’ বলা হবে সে জ্ঞানটুকু ওই মূল্যবোধের ধারক-বাহকরা মনে করতেন তাঁদের কুক্ষিগত, কেননা সময় তো তাঁদের চোখে একরৈখিক, যার একেবারে আগায় আছেন কেবল তাঁরা নিজে।

‘টাইমলেস’ কাজের উদ্বেগ থেকে পয়দা হয়েছিল ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ ভাবকল্পটি, যা উপনিবেশগুলোয় চারিয়ে দিয়ে মোক্ষম চাল দিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপ। এই ভাবকল্পটির দ্বারা কালো, বাদামি, হলদে চামড়ার মানুষদের বহুকাল পর্যন্ত এমন সম্মোহিত করে রেখেছিল সাম্রাজ্যবাদী নন্দনভাবনা যাতে সাহিত্য-শিল্প হয়ে যায় উদ্দেশ্যহীন ও সমাজমুক্ত, যাতে পাঠবস্তু হয়ে যায় বার্তাবর্জিত, যাতে সন্দর্ভের শাসক-বিরোধী অন্তর্ঘাতী ক্ষমতা লুপ্ত হয়, এবং তা হয়ে যায় জনসংযোগহীন। হাংরি বুলেটিন যেহেতু প্রকাশিত হতো হ্যান্ডবিলের মতন ফালিকাগজে, তা পরের দিনই সময় থেকে হারিয়ে যেত। নব্বইটির বেশি বুলেটিন চিরকালের জন্যে হারিয়ে গেছে। লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির পক্ষেও ও বুলেটিনগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ সম্ভব হয়নি।

যে কোন আন্দোলনের জন্ম হয় কোন না কোন আধিপত্য প্রণালীর বিরুদ্ধে। তা সে রাজনৈতিক আধিপত্য হোক বা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, নৈতিক, নান্দনিক, ধার্মিক, সাহিত্যিক, শৈল্পিক ইত্যাদি আধিপত্য হোক না কেন। আন্দোলন-বিশেষের উদ্দেশ্য, অভিমুখ, উচ্চাকাঙ্খা, গন্তব্য হল সেই প্রণালীবদ্ধতাকে ভেঙে ফেলে পরিসরটিকে মুক্ত করা। হাংরি আন্দোলন কাউকে বাদ দেবার প্রকল্প ছিল না। যে কোন কবি বা লেখক, ওই আন্দোলনের সময়ে যিনি নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী মনে করেছেন, তাঁর খুল্লমখুল্লা স্বাধীনতা ছিল হাংরি বুলেটিন বের করার। বুলেটিনগুলোর প্রকাশকদের নাম-ঠিকানা দেখলেই স্পষ্ট হবে (অন্তত যে-কটির খোঁজ মিলেছে তাদের ক্ষেত্রেও) যে, তা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্নজন কর্তৃক ১৯৬৩-র শেষ দিকে এবং ১৯৬৪-র প্রথমদিকে প্রকাশিত। ছাপার খরচ অবশ্য আমি বা দাদা যোগাতাম, কেননা, অধিকাংশ আন্দোলনকারীর আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপল কুমার বসুও নিজের খরচে প্রকাশ করেছিলেন বুলেটিন। অর্থাৎ হাংরি বুলেটিন কারোর প্রায়ভেট প্রপার্টি ছিল না। এই বোধের মধ্যে ছিল পূর্বতন সন্দর্ভগুলোর মনোবীজে লুকিয়ে থাকা সত্ত্বাধিকার বোধকে ভেঙে ফেলার প্রতর্ক যা সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয়রা এদেশে এনেছিল। ইউরোপীয়রা আসার আগে বঙ্গদেশে পার্সোনাল পজেশান ছিল, কিন্তু প্রায়ভেট প্রপার্টি ছিল না।

হাংরি আন্দোলনের কোন হেড কোয়ার্টার, হাইকমান্ড, গভর্নিং কাউনসিল বা সম্পাদকের দপ্তর ধরণের ক্ষমতাকেন্দ্র ছিল না, যেমন ছিল কবিতা, ধ্রুপদী, কৃত্তিবাস ইত্যাদি পত্রিকার ক্ষেত্রে, যার সম্পাদক বাড়ি বদল করলে পত্রিকা দপ্তরটি নতুন বাড়িতে উঠে যেত। হাংরি আন্দোলন কুক্ষিগত ক্ষমতাকেন্দ্রের ধারণাকে অতিক্রম করে প্রতিসন্দর্ভকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল প্রান্তবর্তী এলাকায়, যে কারণে কেবল বহির্বঙ্গের বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিক ছাড়াও তা হিন্দি, উর্দু, নেপলি, অসমীয়া, মারাঠি ইত্যাদি ভাষায় ছাপ ফেলতে পেরেছিল। এখনও মাঝে মধ্যে কিশোর-তরুণরা এখান-সেখান থেকে নিজেদের হাংরি আন্দোলনকারী ঘোষণা করে গর্বিত হন, যখন কিনা আন্দোলনটি চল্লিশ বছর আগে, ১৯৬৫ সালে ফুরিয়ে গিয়েছে।

বিয়াল্লিশ বছর আগে সুবিমল বসাক, হিন্দি কবি রাজকমল চৌধুরীর সঙ্গে, একটি সাইক্লোস্টাইল করা ত্রিভাষিক (বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি) হাংরি বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন, তদানীন্তন সাহিত্যিক সন্দর্ভের প্রেক্ষিতে হাংরি প্রতিসন্দর্ভ যে কাজ উপস্থাপন করতে চাইছে তা স্পষ্ট করার জন্যে। তাতে দেয়া তালিকাটি থেকে আন্দোলনের অভিমুখের কিছুটা হদিশ মিলবে:

১৯৬৩ সালের শেষ দিকে সুবিমল বসাকের আঁকা বেশ কিছু লাইন ড্রইং, যেগুলো ঘন-ঘন হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত হচ্ছিল, তার দরুণ তাঁকে পরপর দুবার কফিহাউসের সামনে ঘিরে ধরলেন অগ্রজ বিদ্বজ্জন এবং প্রহারে উদ্যত হলেন, এই অজুহাতে যে সেগুলো অশ্লীল। একই অজুহাতে কফিহাউসের দেয়ালে সাঁটা অনিল করঞ্জাইয়ের আঁকা পোস্টার আমরা যতবার লাগালুম ততবার ছিঁড়ে ফেলে দেয়া হল। বোঝা যাচ্ছিল যে, কলোনিয়াল ইসথেটিক রেজিমের চাপ তখনও অপ্রতিরোধ্য। হাংরি আন্দোলনের ১৫ নম্বর বুলেটিন এবং ৬৫ নং বুলেটিন, যথাক্রমে রাজনৈতিক ও ধর্ম সম্পর্কিত ইশতাহারের, যাকে বলে স্লো বলিং এফেক্ট, আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল, এবং আমাদের অজ্ঞাতসারে ক্রুদ্ধ করে তুলছিল মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের এসট্যাবলিশমেন্টকে। আজকের ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে ইশতাহার দুটিকে অলমোস্ট প্রফেটিক বলা যায়। এরপর, যখন রাক্ষস জোকার মিকিমাউস জন্তজানোয়ার ইত্যাদির কাগুজে মুখোশে ‘দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন’ বার্তাটি ছাপিয়ে হাংরি আন্দোলনের পক্ষ থেকে মুখ্য ও অন্যান্য মন্ত্রীদের মুখ্য ও অন্যান্য সচিবদের জেলা শাসকদের, সংবাদপত্র মালিক ও সম্পাদকদের, বাণিজ্যিক লেখকদের পাঠান হল, তখন সমাজের এলিট অধিপতিরা আসরে নামলেন। এ ব্যাপারে কলকাঠি নাড়লেন একটি পত্রিকা গোষ্ঠীর মালিক, তাঁর বাংলা দৈনিকের বার্তা সম্পাদক এবং মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের খোরপোষে প্রতিপালিত একটি ইংরেজি ত্রৈমাসিকের কর্তাব্যক্তিরা।

১৯৬৪ এর সেপ্টেম্বরে রাষ্টের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার হলুম আমি, প্রদীপ চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ, দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ এবং দাদা সমীর রায়চৌধুরী। এই অভিযোগে উৎপল কুমার বসু, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইসু হয়ে থাকলেও, তাঁদের প্রেপ্তার করা হয়নি। এরকম একটি অভিযোগ এই জন্যে চাপান হয়েছিল যাতে বাড়ি থেকে থানায় এবং থানা থেকে আদালতে হাতে হাতকড়া পরিয়ে আর কোমরে দড়ি বেঁধে চোরডাকাতদের সঙ্গে সবায়ের সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। অন্তর্ঘাতের অভিযোগটি সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ থেকে মে ১৯৬৫ পর্যন্ত বজায় ছিল, এবং ওই নয় মাস যাবৎ রাষ্ট্রযন্ত্রটি তার বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনকারীরূপে চিহ্নিত প্রত্যেকের সম্পর্কে খুটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছিল, এবং তাদের তখন পর্যন্ত যাবতীয় লেখালেখি সংগ্রহ করে ঢাউস-ঢাউস ফাইল তৈরি করেছিল, যেগুলো লালবাজারে পুলিশ কমিশনারের কনফারেন্স রুমের টেবিলে দেখেছিলুম, যখন কলকাতা পুলিশ, স্বরাষ্ট্র দফতর, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ ও ভারতীয় সেনার উচ্চপদস্থ আধিকারিক এবং পশ্চিমবঙ্গের অ্যাডভোকেট জেনারালকে নিয়ে গঠিত একটি বোর্ড আমাকে আর দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে কয়েক ঘন্টা জেরা করেছিল।

অভিযোগটি কোন সাংস্কৃতিক অধিপতির মস্তিস্কপ্রসূত ছিল জানি না। তবে অ্যাডভোকেট জেনারেল মতামত দিলেন যে এরকম আজেবাজে তথ্যের ওপর তৈরি এমন সিরিয়াস অভিযোগ দেখলে আদালত চটে যাবে। তখনকার দিনে টাডা-পোটা ধরণের আইন ছিল না। ফলত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে নিয়ে ১৯৬৫ সালের মে মাসে বাদবাকি সবাইকে ছেড়ে দিয়ে কেবল আমার বিরুদ্ধে মামলা রুজু হল, এই অভিযোগে যে সাম্প্রতিকতম হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত আমার ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি অশ্লীল। আমার বিরুদ্ধে মামলাটা দায়ের করা সম্ভব হল শৈলেশ্বর ঘোষ এবং সুভাষ ঘোষ আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে গেলেন বলে। অর্থাৎ হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে গেল। ওনারা দুজনে হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে মুচলেকা দিলেন, যার প্রতিলিপি চার্জশিটের সঙ্গে আদালত আমায় দিয়েছিল ।

প্রসিকিউশনের পক্ষে এই দুজন রাজসাক্ষীকে তেমন নির্ভরযোগ্য মনে হয়নি । তাই আমার বিরুদ্ধে সমীর বসু আর পবিত্র বল্লভ নামে দুজন ভুয়ো সাক্ষীকে উইটনেস বক্সে তোলা হয়, যাদের আমি কোন জন্মে দেখিনি, অথচ যারা এমনভাবে সাক্ষ্য দিয়েছিল যেন আমার সঙ্গে কতই না আলাপ-পরিচয়। এই দুজন ভুয়ো সাক্ষীর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আমাকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা। আমার কৌশুলিদের জেরায় এরা দুজন ভুয়ো প্রমাণ হবার সম্ভাবনা দেখা দিলে প্রসিকিউশন আমার বিরুদ্ধে উইটনেস বক্সে তোলে, বলাবাহুল্য গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়ে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে। ফলে আমিও আমার পক্ষ থেকে সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করাই জ্যোতির্ময় দত্ত, তরুণ সান্যাল আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে। বহু সাহিত্যিককে অনুরোধ করেছিলুম, কিন্তু এনারা ছাড়া আর কেউ রাজি হননি। শক্তি এবং সুনীল, দুই বন্ধু, একটি মকদ্দমায় পরস্পরের বিরুদ্ধে, চল্লিশ বছর পর ব্যাপারটা অবিশ্বস্য মনে হয়। সবায়ের সাক্ষ্য ছিল বেশ মজাদার, যাকে বলে কোর্টরুম-ড্রামা।

তেরটা আদালতঘরের মধ্যে আমার মকদ্দমাটা ছিল নয় নম্বর এজলাসে। বিচারকের মাথার ওপর হলদে টুনি বালবটা ছাড়া আলোর বালাই ছিল না জানালাহীন ঘরটায়। অবিরাম ক্যাচোর-ক্যাচোর শব্দে অবসর নেবার অনুরোধ জানাত দুই ব্লেডের বিশাল ছাদপাখা। পেশকার গাংগুলি বাবুর অ্যান্টিক টেবিলের লাগোয়া বিচারকের টানা টেবিল, বেশ উঁচু, ঘরের এক থেকে আরেক প্রান্ত, বিচারকের পেছনে দেয়ালে টাঙানো মহাত্মা গান্ধীর ফোকলা-হাসি রঙিন ছবি। ইংরেজরা যাবার পর চুনকাম হয়নি ঘরটা। হয়ত ঘরের ঝুলগুলোও তখনকার। বিচারকের টেবিলের বাইরে, ওনার ডান দিকে, দেয়াল ঘেঁষে, জাল-ঘেরা লোহার শিকের খাঁচা, জামিন-না-পাওয়া বিচারাধীনদের জন্যে, যারা ওই খাঁচার পেছনের দরোজা দিয়ে ঢুকত। খাঁচাটা অত্যন্ত নোংরা। আমি যেহেতু ছিলুম জামিনপ্রাপ্ত, দাঁড়াতুম খাঁচার বাইরে। ঠ্যাঙ ব্যথা করলে, খাঁচায় পিঠ ঠেকিয়ে।

পেশকার মশায়ের টেবিলের কাছাকাছি থাকত গোটাকতক আস্ত-হাতল আর ভাঙা-হাতল চেয়ার, কৌঁসুলিদের জন্যে। ঘরের বাকিটুকুতে ছিল নানা মাপের, আকারের, রঙের নড়বড়ে বেঞ্চ আর চেয়ার, পাবলিকের জন্যে, ছারপোকা আর খুদে আরশোলায় গিজগিজে। টিপেমারা ছারপোকার রক্তে, পানের পিকে, ঘরের দেয়ালময় ক্যালিগ্রাফি। বসার জায়গা ফাঁকা থাকত না। কার মামলা কখন উঠবে ঠিক নেই। ওই সর্বভারতীয় ঘর্মাক্ত গ্যাঞ্জামে, ছারপোকার দৌরাত্মে, বসে থাকতে পারতুম না বলে সারা বাড়ি এদিক-ওদিক ফ্যা-ফ্যা করতুম, এ-এজলাস সে-এজলাস চক্কর মারতুম, কৌতুহলোদ্দীপক সওয়াল-জবাব হলে দাঁড়িয়ে পড়তুম। আমার কেস ওঠার আগে সিনিয়ার উকিলের মুহুরিবাবু আমায় খুঁজে পেতে ডেকে নিয়ে যেতেন। মুহুরিবাবু মেদিনীপুরের লোক, পরতেন হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, ক্যাম্বিশের জুতো, ছাইরঙা শার্ট। সে শার্টের ঝুল পেছন দিকে হাঁটু পর্যন্ত আর সামনে দিকে কুঁচকি পর্যন্ত। হাতে লম্বালম্বি ভাঁজ করা ফিকে সবুজ রঙ্গের দশ-বারটা ব্রিফ, যেগুলো নিয়ে একতলা থেকে তিনতলার ঘরে-ঘরে লাগাতার চরকি নাচন দিতেন।

আমার সিনিয়র উকিল ছিলেন ক্রিমিনাল লয়ার চন্ডীচরণ মৈত্র। সাহিত্য সম্পর্কে ওনার কোন রকম ধারণা ছিল না বলে লেবার কোর্টের উকিল সতেন বন্দ্যোপাধ্যায়কেও রাখতে হয়েছিল। চাকরি থেকে সাসপেন্ডেড ছিলুম কেস চলার সময়ে, তার ওপর কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাই ছিল না। খরচ সামলানো অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল।

আদালত চত্বরটা সবসময় ভিড়ে গিজগিজ করত। ফেকলু উকিলরা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে “সাক্ষী চাই? সাক্ষী চাই? এফিডেফিট হবে।” বলে-বলে চেচাত মক্কেল যোগাড়ের ধান্দায়। সারা বাড়ি জুড়ে যেখানে টুলপেতে টাইপরাইটারে ফটর ফটর ট্যারাবেকা টাইপ করায় সদাব্যস্ত টাইপিস্ট, পাশে চোপসানো মুখ লিটিগ্যান্ট। একতলায় সর্বত্র কাগজ, তেলেভাজা, অমলেট, চা-জলখাবার, ভাতরুটির ঠেক। কোর্ট পেপার কেনার দীর্ঘ কিউ। চাপরাসি- আরদালির কাজে যে সব বিহারিদের আদালতে চাকরি দিয়েছিল ইংরেজরা, তারা চত্বরের খোঁদলগুলো জবরদখল করে সংসার পেতে ফেলেচে। জেল থেকে খতরনাক আসামিরা পুলিশের বন্ধ গাড়িতে এলে, পানাপুকুরে ঢিল পড়ার মতন একটু সময়ের জন্যে সরে যেত ভিড়টা। তারপর যে কে সেই। সন্দর্ভ ও প্রতিসন্দর্ভের সামাজিক সংঘাতক্ষেত্র হিসেবে আদালতের মতন সংস্থা সম্ভবত আর নেই। 

সাক্ষ্যাদি শেষ হবার পর দুপক্ষের দীর্ঘ বহস হল একদিন, প্রচুর তর্কাতর্কি হল। আমি খাঁচার কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে। রায় দেবার দিন পড়ল ১৯৬৫ সালের আঠাশে ডিসেম্বর। ইতিমধ্যে আমেরিকার ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে সংবাদ হয়ে গেছি। যুগান্তর দৈনিকে ‘আর মিছিলের শহর নয়’ এবং ‘যে ক্ষুধা জঠরের নয়’ শিরোনামে প্রধান সম্পাদকীয় লিখলেন কৃষ্ণ ধর। যুগান্তর দৈনিকে সুফী এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় চন্ডী লাহিড়ী কার্টুন আঁকলেন আমায় নিয়ে। সমর সেন সম্পাদিত ‘নাউ’ পত্রিকায় পরপর দুবার লেখা হল আমার সমর্থনে। দি স্টেটসম্যান পত্রিকায় হাংরি আন্দোলনের সমর্থনে সমাজ-বিশ্লেষণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হল। ধর্মযুগ, দিনমান, সম্মার্গ, সাপ্তাহিক হিন্দুস্থান, জনসত্তা পত্রিকায় উপর্যুপরি ফোটো ইত্যাদিসহ লিখলেন ধর্মবীর ভারতী, এস. এইচ. বাৎসায়ন অজ্ঞেয়, ফনীশ্বর নাথ রেণু, কমলেশ্বর, শ্রীকান্ত ভর্মা, মুদ্রারাক্ষস, ধুমিল, রমেশ বকশি প্রমুখ। কালিকটের মালায়ালি পত্রিকা যুগপ্রভাত হাংরি আন্দোলনকে সমর্থন করে দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করল। বুয়েনস আয়ার্স-এর প্যানারোমা পত্রিকার সাংবাদিক আমার মকদ্দমা কভার করল। পাটনার দৈনিক দি সার্চলাইট প্রকাশ করল বিশেষ ক্রোড়পত্র। বিশেষ হাংরি আন্দোলন সংখ্যা প্রকাশ করল জার্মানির ক্ল্যাকটোভিডসেডস্টিন পত্রিকা, এবং কুলচুর পত্রিকা ছাপলো সবকটি ইংরেজি ম্যানিফেস্টো। আমেরিকায় হাংরি আন্দোলনকারীদের ফোটো, ছবি-আঁকা, রচনার অনুবাদ ইত্যাদি নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করল সল্টেড ফেদার্স, ট্রেস, ইনট্রেপিড, সিটি লাইটস জার্নাল, সান ফ্রানসিসকো আর্থকোয়েক, র্যামপার্টস, ইমেজো হোয়্যার ইত্যাদি লিটল ম্যাগজিন। সম্পাদকীয় প্রকাশিত হল নিউ ইয়র্কের এভারগ্রিন রিভিউ, আর্জেনটিনার এল কর্নো এমপ্লমাদো এবং মেকসিকোর এল রেহিলেতে পত্রিকায়। পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে কলকাতায় টিটকিরি মারা ছাড়া আর কিছু করেন নি বাঙ্গালি সাহিত্যিকরা।

ভুয়ো সাক্ষী, রাজ সাক্ষী আর সরকারি সাক্ষীদের বক্তব্যকে যথার্থ মনে করে আমার পক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্য নাকচ করে দিলেন ফৌজদারি আদালতের বিচারক। দুশো টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক মাসের কারাদান্ড ধার্য করলে তিনি। আমি হাইকোর্টে রিভিশন পিটিশন করার জন্যে আইনজীবির খোঁজে বেরিয়ে দেখলুম যে খ্যাতিমান কৌঁসুলিদের এক দিনের বহসের ফি প্রায় লক্ষ টাকা, অনেকে প্রতি ঘন্টা হিসেবে চার্জ করেন, তাঁরা ডজনখানেক সহায়ক উকিল দুপাশে দাঁড় করিয়ে বহস করেন। জ্যোতির্ময় দত্ত পরিচয় করিয়ে দিলেন সদ্য লন্ডন-ফেরত ব্যারিস্টার করুণাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে। তাঁর সৌজন্যে আমি তখনকার বিখ্যাত আইনজীবি মৃগেন সেনকে পেলুম। নিজের সহায়কদের নিয়ে তিনি কয়েক দিন বসে তর্কের স্ট্রাটেজি কষলেন। ১৯৬৭ সালের ছাব্বিশে জুলাই আমার রিভিশন পিটিশানের শুনানি হল। নিম্ন আদালতের রায় নাকচ করে দিলেন বিচারক টি. পি. মুখার্জি। ফিস ইন্সটলমেন্টে দেবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন করুণাশঙ্কর রায়।

হাংরি আন্দোলন চল্লিশ বছর আগে শেষ হয়ে গেছে। এখন শুরু হয়েছে তাকে নিয়ে ব্যবসা। সমীর চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি (আমার দাদার নামের মিলটা কাজে লাগান হয়েছে) ‘হাংরি জেনারেশন রচনা সংকলন’ নামে একটা বই বের করেছেন। তাতে অন্তর্ভূক্ত অধিকাংশ লেখককে আমি চিনি না। শক্তি, সন্দীপন, উৎপল, বিনয়, সমীর, দেবী, সুবিমল, এবং আমার রচনা তাতে নেই। অনিল, করুণা, সুবিমলের আঁকা ছবি নেই। একটিও ম্যানিফেস্টো নেই। বাজার নামক ব্যাপারটি একটি ভয়ংকর সাংস্কৃতিক সন্দর্ভ।

তিন

বাংলা সাহিত্যে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে অভিজিৎ পাল একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, এবাদুল হক সম্পাদিত ‘আবার এসেছি ফিরে’ পত্রিকায়, তা থেকে উল্লেখ্য অংশ তুলে দিচ্ছি এখানে :

বাংলা সাহিত্যে ষাটের দশকের হাংরি জেনারেশনের ন্যায় আর কোনও আন্দোলন তার পূর্বে হয় নাই । হাজার বছরের বাংলা ভাষায় এই একটিমাত্র আন্দোলন যা কেবল সাহিত্যের নয় সম্পূর্ণ সমাজের ভিত্তিতে আঘাত ঘটাতে পেরেছিল, পরিবর্তন আনতে পেরেছিল। পরবর্তীকালে তরুণ সাহিত্যিক ও সম্পাদকদের সাহস যোগাতে পেরেছে । 

১ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তাঁরা সাহিত্যকে পণ্য হিসাবে চিহ্ণিত করতে অস্বীকার করেছিলেন । কেবল তাই নয় ; তাঁরা এক পৃষ্ঠার লিফলেট প্রকাশ করতেন ও বিনামূল্যে আগ্রহীদের মাঝে বিতরণ করতেন । তাঁরাই প্রথম ফোলডার-কবিতা, পোস্ট-কার্ড কবিতা, ও পোস্টারে কবিতা ও কবিতার পংক্তির সূত্রপাত করেন । পোস্টার এঁকে দিতেন অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায় । ফোলডারে স্কেচ আঁকতেন সুবিমল বসাক  । ত্রিদিব মিত্র তাঁর ‘উন্মার্গ’ পত্রিকার প্রচ্ছদ নিজে আঁকতেন। পরবর্তীকালে দুই বাংলাতে তাঁদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় ।

২ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা । তাঁদের আগমনের পূর্বে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা করার কথা সাহিত্যকরা চিন্তা করেন নাই । সুভাষ ঘোষ বলেছেন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার অর্থ সরকার বিরোধিতা নয়, সংবাদপত্র বিরোধিতা নয় ; হাংরি জেনারেশনের বিরোধ প্রচলিত সাহিত্যের মৌরসি পাট্টাকে উৎখাত করে নবতম মূল্যবোধ সঞ্চারিত করার । নবতম শৈলী, প্রতিদিনের বুলি, পথচারীর ভাষা, ছোটোলোকের কথার ধরণ, ডিকশন, উদ্দেশ্য, শব্দ ব্যবহার, চিন্তা ইত্যাদি । পশ্চিমবঙ্গে বামপন্হী সরকার সত্বেও বামপন্হী কবিরা মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ থেকে নিষ্কৃতি পান নাই । শ্রমিকের কথ্য-ভাষা, বুলি, গালাগাল, ঝগড়ার অব্যয় তাঁরা নিজেদের রচনায় প্রয়োগ করেন নাই । তা প্রথম করেন হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগন ; উল্লেখ্য হলেন অবনী ধর, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র প্রমুখ । সুবিমল বসাকের পূর্বে ‘বাঙাল ভাষায়’ কেউ কবিতা ও উপন্যাস লেখেন নাই। হাংরি জেনারেশনের পরবর্তী দশকগুলিতে লিটল ম্যাগাজিনের লেখক ও কবিদের রচনায় এই প্রভাব স্পষ্ট ।

৩ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের তৃতীয় অবদান কবিতা ও গল্প-উপন্যাসে ভাষাকে ল্যাবিরিনথাইন করে প্রয়োগ করা । এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা ও গল্প-উপন্যাস । মলয় রায়চৌধুরী সর্বপ্রথম পশ্চিমবাংলার সমাজে ডিসটোপিয়ার প্রসঙ্গ উথ্থাপন করেন । বামপন্হীগণ যখন ইউটোপিয়ার স্বপ্ন প্রচার করছিলেন সেই সময়ে মলয় রায়চৌধুরী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন ডিসটোপিয়ার দরবারি কাঠামো ।উল্লেখ্য তাঁর নভেলা ‘ঘোগ’, ‘জঙ্গলরোমিও’, গল্প ‘জিন্নতুলবিলদের রূপকথা’, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ ইত্যাদি । তিনি বর্ধমানের সাঁইবাড়ির ঘটনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ অবলম্বনে লেখেন ‘আরেকবারে ক্ষুধিত পাষাণ’ । বাঙাল ভাষায় লিখিত সুবিমল বসাকের কবিতাগুলিও উল্লেখ্য । পরবর্তী দশকের লিটল ম্যাগাজিনের কবি ও লেখকদের রচনায় এই প্রভাব সুস্পষ্ট ।

৪ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের চতুর্থ অবদান হলো পত্রিকার নামকরণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে পত্রিকাগুলির নামকরণ হতো ‘কবিতা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘উত্তরসূরী’, ‘শতভিষা’, ‘পূর্বাশা’ ইত্যাদি যা ছিল মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ । হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ পত্রিকার নামকরণ করলেন ‘জেব্রা’, ‘জিরাফ’, ‘ধৃতরাষ্ট্র’, ‘উন্মার্গ’, ‘প্রতিদ্বন্দী’ ইত্যাদি । পরবর্তীকালে তার বিপুল প্রভাব পড়েছে । পত্রিকার নামকরণে সম্পূর্ণ ভিন্নপথ আবিষ্কৃত হয়েছে ।

৫ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনে সর্বপ্রথম সাবঅলটার্ন অথবা নিম্নবর্গের লেখকদের গুরুত্ব প্রদান করতে দেখা গিয়েছিল । ‘কবিতা’, ‘ধ্রুপদি’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘উত্তরসূরী’ ইত্যাদি পত্রিকায় নিম্নবর্গের কবিদের রচনা পাওয়া যায় না । হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের বুলেটিনগুলির সম্পাদক ছিলেন চাষি পরিবারের সন্তান হারাধন ধাড়া । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ তৎকালীন কবিরা তাঁর এমন সমালোচনা করেছিলেন যে তিনি এফিডেভিট করে ‘দেবী রায়’ নাম নিতে বাধ্য হন । এছাড়া আন্দোলনে ছিলেন নিম্নবর্গের চাষী পরিবারের শম্ভু রক্ষিত, তাঁতি পরিবারের সুবিমল বসাক,  জাহাজের খালাসি অবনী ধর, মালাকার পরিবারের নিত্য মালাকার ইত্যাদি । পরবর্তীকালে প্রচুর সাবঅলটার্ন কবি-লেখকগণকে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে দেখা গেল। 

৬ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের ষষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হলো রচনায় যুক্তিবিপন্নতা, যুক্তির কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তি, যুক্তির বাইরে বেরোনোর প্রবণতা, আবেগের সমউপস্হিতি, কবিতার শুরু হওয়া ও শেষ হওয়াকে গুরুত্ব না দেয়া, ক্রমান্বয়হীনতা, যুক্তির দ্বৈরাজ্য, কেন্দ্রাভিগতা বহুরৈখিকতা ইত্যাদি । তাঁদের আন্দোলনের পূর্বে টেক্সটে দেখা গেছে যুক্তির প্রাধান্য, যুক্তির প্রশ্রয়, সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতন যুক্তি ধাপে-ধাপে এগোতো, কবিতায় থাকতো আদি-মধ্য-অন্ত, রচনা হতো একরৈখিক, কেন্দ্রাভিগ, স্বয়ংসম্পূর্ণতা । 

৭) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে লেখক-কবিগণ আশাবাদে আচ্ছন্ন ছিলেন মূলত কমিউনিস্ট প্রভাবে । ইউটোপিয়ার স্বপ্ন দেখতেন । বাস্তব জগতের সঙ্গে তাঁরা বিচ্ছিন্ন ছিলেন । হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ প্রথমবার হেটেরোটোপিয়ার কথা বললেন । হাংরি জেনারেশনের কবি অরুণেশ ঘোষ তাঁর কবিতাগুলোতে বামপন্হীদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। হাংরি জেনরেশনের পরের দশকের কবি ও লেখকগণের নিকট বামপন্হীদের দুইমুখো কর্মকাণ্ড ধরা পড়ে গিয়েছে, বিশেষ করে মরিচঝাঁপি কাণ্ডের পর ।

৮ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে কবি-লেখকগণ মানেকে সুনিশ্চিত করতে চাইতেন, পরিমেয়তা ও মিতকথনের কথা বলতেন, কবির নির্ধারিত মানে থাকত এবং স্কুল কলেজের ছাত্ররা তার বাইরে যেতে পারতেন না । হাংরি জেনারেশনের লেখকগণ অফুরন্ত অর্থময়তা নিয়ে এলেন, মানের ধারণার প্রসার ঘটালেন, পাঠকের ওপর দায়িত্ব দিলেন রচনার অর্থময়তা নির্ধারণ করার, প্রচলিত ধারণা অস্বীকার করলেন । শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতার সঙ্গে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতার তুলনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে ।

৯ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে ‘আমি’ থাকতো রচনার কেন্দ্রে, একক আমি থাকতো, লেখক-কবি ‘আমি’র নির্মাণ করতেন, তার পূর্বনির্ধারিত মানদণ্ড থাকতো, সীমার স্পষ্টিকরণ করতেন রচনাকার, আত্মপ্রসঙ্গ ছিল মূল প্রসঙ্গ, ‘আমি’র পেডিগ্রি পরিমাপ করতেন আলোচক। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ নিয়ে এলেন একক আমির অনুপস্হিতি, আমির বন্ধুত্ব, মানদণ্ড ভেঙে ফেললেন তাঁরা, সীমা আবছা করে দিলেন, সংকরায়ন ঘটালেন, লিমিন্যালিটি নিয়ে এলেন ।

১০ ) হাংরি  জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে শিরোনাম দিয়ে বিষয়কেন্দ্র চিহ্ণিত করা হতো । বিষয় থাকতো রচনার কেন্দ্রে, একক মালিকানা ছিল, লেখক বা কবি ছিলেন টাইটেল হোলডার। হাংরি জেনারেশনের লেখক-কবিগণ শিরোনামকে বললেন রুবরিক ; শিরোনাম জরুরি নয়, রচনার বিষয়কেন্দ্র থাকে না, মালিকানা বিসর্জন দিলেন, ঘাসের মতো রাইজোম্যাটিক তাঁদের রচনা, বৃক্ষের মতন এককেন্দ্রী নয় । তাঁরা বললেন যে পাঠকই টাইটেল হোলডার।

১১ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে কবিতা-গল্প-উপন্যাস রচিত হতো ঔপনিবেশিক মূল্যবোধ অনুযায়ী একরৈখিক রীতিতে । তাঁদের ছিল লিনিয়রিটি, দিশাগ্রস্ত লেখা, একক গলার জোর, কবিরা ধ্বনির মিল দিতেন, সময়কে মনে করতেন প্রগতি । এক রৈখিকতা এসেছিল ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্হের কাহিনির অনুকরণে ; তাঁরা সময়কে মনে করতেন তা একটিমাত্র দিকে এগিয়ে চলেছে । আমাদের দেশে বহুকাল যাবত সেকারণে ইতিহাস রচিত হয়েছে কেবল দিল্লির সিংহাসন বদলের । সারা ভারত জুড়ে যে বিভিন্ন রাজ্য ছিল তাদের ইতিহাস অবহেলিত ছিল । বহুরৈখিকতারে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ‘মহাভারত’ । হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকগণ একরৈখিকতা বর্জন করে বহুরৈখিক রচনার সূত্রপাত ঘটালেন । যেমন সুবিমল বসাকের ‘ছাতামাথা’ উপন্যাস, মলয় রায়চৌধুরীর দীর্ঘ কবিতা ‘জখম’, সুভাষ ঘোষের গদ্যগ্রন্হ ‘আমার চাবি, ইত্যাদি । তাঁরা গ্রহণ করলেন প্লুরালিজম, বহুস্বরের আশ্রয়, দিকবিদিক গতিময়তা, হাংরি জেনারেশনের দেখাদেখি আটের দশক থেকে কবি ও লেখকরা বহুরৈখিক রচনা লিখতে আরম্ভ করলেন ।

১২ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে মনে করা হতো কবি একজন বিশেষজ্ঞ । হাংরি জেনারেশনের কবিরা বললেন কবিত্ব হোমোসেপিয়েন্সের প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য । পরবর্তী প্রজন্মে বিশেষজ্ঞ কবিদের সময় সমাপ্ত করে দিয়েছেন নতুন কবির দল এবং নবনব লিটল ম্যাগাজিন ।

১৩ ) ঔপনিবেশিক প্রভাবে বহু কবি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতেন । ইউরোপীয় লেখকরা যেমন নিজেদের ‘নেটিভদের’ তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করতেন । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে শ্রেষ্ঠ কবি, শ্রেষ্ঠ কবিতা, শ্রেষ্ঠত্ব, বিশেষ একজনকে তুলে ধরা, নায়ক-কবি, সরকারি কবির শ্রেষ্ঠত্ব, হিরো-কবি, এক সময়ে একজন বড়ো কবি, ব্র্যাণ্ড বিশিষ্ট কবি  আইকন কবি ইত্যাদির প্রচলন ছিল । হাংরি জেনারেশন সেই ধারণাকে ভেঙে ফেলতে পেরেছে তাদের উত্তরঔপনিবেশিক মূল্যবোধ প্রয়োগ করে । তারা বিবেচন প্রক্রিয়া থেকে কেন্দ্রিকতা সরিয়ে দিতে পেরেছে, কবির পরিবর্তে একাধিক লেখককের সংকলনকে গুরুত্ব দিতে পেরেছে, ব্যক্তি কবির পরিবর্তে পাঠকৃতিকে বিচার্য করে তুলতে পেরেছে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার কথা বলেছে । সার্বিক চিন্তা-চেতনা ও কৌমের কথা বলেছে । তাঁদের পরবর্তী কবি-লেখকরা হাংরি জেনারেশনের এই মূল্যবোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন ।

১৪ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে শব্দার্থকে সীমাবদ্ধ রাখার প্রচলন ছিল । রচনা ছিল কবির ‘আমি’র প্রতিবেদন । হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকরা বলেছেন কথা চালিয়ে যাবার কথা। বলেছেন যে কথার শেষ নেই । নিয়েছেন শব্দার্থের ঝুঁকি । রচনাকে মুক্তি দিয়েছেন আত্মমনস্কতা থেকে । হাংরি জেনারেশনের এই কৌম মূল্যবোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন পরবর্তীকালের কবি-লেখকরা । এই প্রভাব সামাজিক স্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

১৫ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত ছিল ‘বাদ’ দেবার প্রবণতা ; সম্পাদক বা বিশেষ গোষ্ঠী নির্ণয় নিতেন কাকে কাকে বাদ দেয়া হবে । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে সাংস্কৃতিক হাতিয়ার ছিল “এলিমিনেশন”। বাদ দেবার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংস্কৃতিকে তাঁরা নিজেদের আয়ত্বে রাখতেন । হাংরি জেনারেশনের সম্পাদকরা ও সংকলকরা জোট বাঁধার কথা বললেন । যোগসূত্র খোঁজাল কথা বললেন । শব্দজোট, বাক্যজোট, অর্থজোটের কথা বললেন । এমনকি উগ্র মতামতকেও পরিসর দিলেন । তাঁদের এই চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য পরবর্তীকালের সম্পাদক ও সংকলকদের অবদানে স্পষ্ট । যেমন অলোক বিশ্বাস আটের দশকের সংকলনে ও আলোচনায় সবাইকে একত্রিত করেছেন । বাণিজ্যিক পত্রিকা ছাড়া সমস্ত লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্রে এই গুণ উজ্বল ।

১৬ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত একটিমাত্র মতাদর্শকে, ইজমকে, তন্ত্রকে, গুরুত্ব দেয়া হতো । কবি-লেখক গোষ্ঠীর ছিল ‘হাইকমাণ্ড’, ‘হেডকোয়ার্টার’, ‘পলিটব্যুরো’ ধরণের মৌরসি পাট্টা । হাংরি জেনারেশন একটি আন্দোলন হওয়া সত্বেও খুলে দিল বহু মতাদর্শের পরিসর, টুকরো করে ফেলতে পারলো যাবতীয় ‘ইজম’, বলল প্রতিনিয়ত রদবদলের কথা, ক্রমাগত পরিবর্তনের কথা । ভঙ্গুরতার কথা । তলা থেকে ওপরে উঠে আসার কথা । হাংরি জেনারেশনের পরে সম্পূর্ণ লিটল ম্যাগাজিন জগতে দেখা গেছে এই বৈশিষ্ট্য এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রভাব ।

১৭ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত দেখা গেছে ‘নিটোল কবিতা’ বা স্বয়ংসম্পূর্ণ এলিটিস্ট কবিতা রচনার ধারা । তাঁরা বলতেন রচনাকারের শক্তিমত্তার পরিচয়ের কথা । গুরুগম্ভীর কবিতার কথা । নির্দিষ্ট ঔপনিবেশিক মডেলের কথা । যেমন সনেট, ওড, ব্যালাড ইত্যাদি । হাংরি জেনারেশনের কবি লেখকগণ নিয়ে এলেন এলো-মেলো কবিতা, বহুরঙা, বহুস্বর, অপরিমেয় নাগালের বাইরের কবিতা । তাঁদের পরের প্রজন্মের সাহিত্যিকদের মাঝে এর প্রভাব দেখা গেল । এখন কেউই আর ঔপনিবেশিক বাঁধনকে মান্যতা দেন না । উদাহরণ দিতে হলে বলতে হয় অলোক বিশ্বাস, দেবযানী বসু, ধীমান চক্রবর্তী, অনুপম মুখোপাধ্যায়, প্রণব পাল, কমল চক্রবর্তী প্রমুখের রচনা ।

১৮ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল স্হিতাবস্হার কদর এবং পরিবর্তন ছিল শ্লথ । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ পরিবর্তনের তল্লাশি আরম্ভ করলেন, প্রযুক্তির হস্তক্ষেপকে স্বীকৃতি দিলেন । পরবর্তী দশকগুলিতে এই ভাঙচুরের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, যেমন কমল চক্রবর্তী, সুবিমল মিশ্র, শাশ্বত সিকদার ও নবারুণ ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে ; তাঁরা ভাষা, চরিত্র, ডিকশন, সমাজকাঠামোকে হাংরি জেনারেশনের প্রভাবে গুরুত্ব দিতে পারলেন ।

১৯ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে নাক-উঁচু সংস্কৃতির রমরমা ছিল, প্রান্তিককে অশোভন মনে করা হতো, শ্লীল ও অশ্লীলের ভেদাভেদ করা হতো, ব্যবধান গড়ে ভেদের শনাক্তকরণ করা হতো । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকরা সংস্কৃতিকে সবার জন্য অবারিত করে দিলেন । বিলোপ ঘটালেন সাংস্কৃতিক বিভাজনের । অভেদের সন্ধান করলেন । একলেকটিকতার গুরুত্বের কথা বললেন । বাস্তব-অতিবাস্তব-অধিবাস্তবের বিলোপ ঘটালেন । উল্লেখ্য যে বুদ্ধদেব বসু মলয় রায়চৌধুরীকে তাঁর দ্বারে দেখামাত্র দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন । পরবর্তীকালের লিটল ম্যাগাজিনে আমরা তাঁদের এই অবদানের প্রগাঢ় প্রভাব লক্ষ্য করি ।

২০ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল ইউরোপ থেকে আনা বাইনারি বৈপরীত্য যা ব্রিটিশ খ্রিস্টানরা হা্রণ করেছিল তাদের ধর্মের ঈশ্বর-শয়তান বাইনারি বৈপরীত্য থেকে । ফলত, দেখা গেছে ‘বড় সমালোচক’ ফরমান জারি করছেন কাকে কবিতা বলা হবে এবং কাকে কবিতা বলা হবে না ; কাকে ‘ভালো’ রচনা বলে হবে এবং কাকে ভালো রচনা বলা হবে না ; কোন কবিতা বা গল্প-উপন্যাস  উতরে গেছে এবং কোনগুলো যায়নি ইত্যাদি । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকরা এই বাইনারি বৈপরীত্য ভেঙে ফেললেন । তাঁরা যেমন ইচ্ছা হয়ে ওঠা রচনার কথা বললেন ও লিখলেন, যেমন সুভাষ ঘোষের গদ্যগ্রন্হগুলি । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন বহুপ্রকার প্রবণতার ওপর, রচনাকারের বেপরোয়া হবার কথা বললেন, যেমন মলয় রায়চৌধুরী, পদীপ চৌধুরী ও শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা । যেমন মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা ও ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ উপন্যাস । যেমন সুবিমল বসাকের বাঙাল ভাষার কবিতা যা এখন বাংলাদেশের ব্রাত্য রাইসুও অনুকরণ করছেন । হাংরি জেনারেশনের পরের দশকগুলিতে  তাঁদের এই অবদানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, এবং তা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিনগুলিতে ।

২১ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল আধিপত্যের প্রতিষ্ঠার সাহিত্যকর্ম । উপন্যাসগুলিতে একটিমাত্র নায়ক থাকত । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ আধিপত্যের বিরোধিতা আরম্ভ করলেন তাঁদের রচনাগুলিতে । বামপন্হী সরকার থাকলেও তাঁরা ভীত হলেন না । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে সেকারণে ছিল খণ্ডবাদ বা রিডাকশানিজমের গুরুত্ব । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন কমপ্লেকসিটিকে, জটিলতাকে, অনবচ্ছিন্নতার দিকে যাওয়াকে । যা আমরা পাই বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবিমল বসাক, মলয় রায়চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ প্রমুখের গল্প-উপন্যাসে । পরবর্তী দশকগুলিতে দুই বাংলাতে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় ।

২২ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল গ্র্যাণ্ড ন্যারেটিভকে । হাংরি জেনারেশনের কবি লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন মাইক্রো ন্যারেটিভকে, যেমন সুবিমল বসাকের ‘দুরুক্ষী গলি’ নামক উপন্যাসের স্বর্ণকার পরিবার, অথবা অবনী ধরের খালাসি জীবন অথবা তৎপরবতী কঠিন জীবনযাপনের ঘটনানির্ভর কাহিনি । পরবর্তী দশকগুলিতে দেখা যায় মাইক্রোন্যারেটিভের গুরুত্ব, যেমন গ্রুপ থিয়েটারগুলির নাটকগুলিতে ।

২৩ ) হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ নিয়ে এলেন যুক্তির ভাঙন বা লজিকাল ক্র্যাক, বিশেষত দেবী রায়ের প্রতিটি কবিতায় তার উপস্হিতি পরিলক্ষিত হয় । পরের দশকের লেখক ও কবিদের রচনায় লজিকাল ক্র্যাক অর্থাৎ যুক্তির ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে । যেমন সাম্প্রতিক কালে অগ্নি রায়,  রত্নদীপা দে ঘোষ, বিদিশা সরকার, অপূর্ব সাহা, সীমা ঘোষ দে, সোনালী চক্রবর্তী, আসমা অধরা, সেলিম মণ্ডল, জ্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায়, পাপিয়া জেরিন,  প্রমুখ ।

২৪ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে রচনায়, বিশেষত কবিতায়, শিরোনামের গুরুত্ব ছিল ; শিরোনামের দ্বারা কবিতার বিষয়কেন্দ্রকে চিহ্ণিত করার প্রথা ছিল । সাধারণত বিষয়টি পূর্বনির্ধারিত এবং সেই বিষয়ানুযায়ী কবি কবিতা লিখতেন । শিরোনামের সঙ্গে রচনাটির ভাবগত বা দার্শনিক সম্পর্ক থাকতো । ফলত তাঁরা মৌলিকতার হামবড়াই করতেন, প্রতিভার কথা বলতেন, মাস্টারপিসের কথা বলতেন ।হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ শিরোনামকে সেই গুরুত্ব থেকে সরিয়ে দিলেন । শিরোনাম আর টাইটেল হোলডার রইলো না । শিরোনাম হয়ে গেল ‘রুবরিক’ । তাঁরা বহু কবিতা শিরোনাম র্বজন করে সিরিজ লিখেছেন । পরবর্তী দশকের কবিরা হাংরি জেনারেশনের এই কাব্যদৃষ্টির সঙ্গে একমত হয়ে কবিতার শিরোনামকে গুরুত্বহীন করে দিলেন ; সম্পূর্ণ কাব্যগণ্হ প্রকাশ করলেন যার একটিতেও শিরোনাম নেই ।

চার

দেবেশ রায় প্রথম বলেছিলেন যে হাংরি আন্দোলন থেকে নকশাল আন্দোলনের দিকে সময় একটা বীক্ষার মাধ্যমে প্রসারিত হয়েছিল, কিংবা এই ধরণের কোনো কথা, তারপর অনেকেই নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের ভাবনার একটা যোগসূত্র খুঁজতে চেয়েছেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে রফিক উল ইসলাম জিগ্যেস করেছিলেন যে দুটো আন্দোলনের নিজেদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা । সুনীল বলেছিলেন যে নকশাল আন্দোলনে অনেক মহৎ আত্মত্যাগ হয়েছিল, অনেক তরুণ মারা গিয়েছিল । 

আমার মতে দুটোর মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল তা সময়-পরিসরের রেশের । হাংরি আন্দোলনের চিত্রকর অনিল করঞ্জাই আর করুণানিধান মুখোপাধ্যায় নকশাল আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন আর পুলিশ ওনাদের রাতের মিটিঙের কথা জানতে পেরে স্টুডিও ভাঙচুর করে যাবতীয় পেইনটিঙ নষ্ট করে দিয়েছিল । অনিল, করুণা আর ওদের ছবি আঁকার দলের যুবকরা আগেই খবর পেয়ে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল, অনিল দিল্লিতে আর তারপর এক মার্কিন যুবতীর সঙ্গে আমেরিকায় ; করুণা চুলদাড়ি কামিয়ে, চেহারা পালটিয়ে সপরিবারে পাটনায়, সেখানে দাদা করুণাকে একটা রঙিন মাছের দোকান খুলে দিয়েছিলেন । আমার কাকার মেয়ে পুটি উত্তরপাড়ার বাড়ির বড়োঘরের কড়িকাঠ থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছিল, তার কারণ যে নকশাল যুবকটিকে পুটি ভালোবাসতো তাকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে লোপাট করে দিয়েছিল । 

ব্যাঙ্কশাল কোর্টে আমার এক মাসের সাজা হয়ে গিয়েছিল ২৮ ডিসেম্বর ১৯৬৫ আর কলকাতা হাইকোর্টে উকিলের খোঁজে আমি নানা লোকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করছিলুম । জ্যোতির্ময় দত্ত পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সদ্য লণ্ডন ফেরা ব্যারিস্টার করুণাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে, ব্যাঙ্কশাল কোর্ট থেকে কপি নিয়ে যাবতীয় কাগজপত্র দিয়ে আসতে হচ্ছিল, তাঁর বাড়িতে,  লোহাপট্টিতে, যাতে কলকাতা হাইকোর্টে রেজিস্ট্রারের দপতরে জমা দেয়া যায় । এদিকে কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, নানা জায়গায় রাত কাটাই, পকেট ফাঁকা হয়ে যায় আদালতের কাজে আর দুবেলা খেতে । অনেককাল স্নান না করলে যে নিজের গা থেকে নিজেরই মাংসের গন্ধ বেরোয় তা তখন জেনেছিলুম । বন্ধুবান্ধবরা, সুবিমল বসাক ছাড়া, সবাই হাওয়া ।

তার মাঝেই ২২-২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ খাদ্য আন্দোলনে সারা বাংলা বন্ধ ডাকা হয়েছিল, মনে আছে । তখনকার কলেজ স্ট্রিট এখনকার মতন ছিল না, একেবারে ফাঁকা থাকতো, দিনের বেলাকার মিছিল সত্বেও, সন্ধ্যে হলেই অন্ধকার । বস্তুত, পুরো কলকাতাই একেবারে আলাদা ছিল । রণবীর সমাদ্দারের একটা লেখায় পড়েছিলুম যে নকশাল আন্দোলনের প্রকৃত সময়টা হলো ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ ; আর কোলকাতা হাইকোর্ট আমার মামলা এক দিনেই সেরে ফেলেছিল, ২৬ জুলাই ১৯৬৭ তারিখে, আমার দণ্ডাদেশ নাকচ করে । তাই হয়তো কেউ-কেউ মনে করেন যে হাংরিরা ১৯৬৭-পরবর্তী কালখণ্ডকে নকশালদের হ্যাণ্ডওভার করে দিয়েছিল । সময়-পরিসরকে হ্যাণ্ডওভার করার প্রক্রিয়া চলে আসছে সেই ব্রিটিশ-বিরোধিতার সময় থেকে। প্রফুল্ল চক্রবর্তী ওনার ‘মার্জিনাল মেন’ বইতে লিখেছিলেন যে দেশভাগের পর বহু তরুণ লুম্পেন প্রলেতারিয়েত হয়ে ওঠে এবং তাদের থেকেই পশ্চিমবঙ্গে মাস্তানদের জন্ম । বস্তুত মাস্তানরও সময়-পরিসরকে ক্রমশ হ্যাণ্ডওভার করে চলেছে এখনকার জিঙ্গোবাদী রাজনীতিকদের করকমলে ।

ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে স্বদেশি আন্দোলনের যে রেশ আরম্ভ হয়েছিল, সেই রেশ নানা বাঁক নিয়ে যখন দেশভাগের ঘুর্ণিতে পড়ল তখন তার চরিত্র পালটে গেল, তার আগে সেই রেশে তেমন অ্যাড্রেনালিন ছিল না বলা চলে । এই রেশটাই হাংরি আন্দোলনের উৎসভূমি । এই রেশকে প্রথমে কৃষক নেতারা এবং পরে তরুণ সমাজ নিয়ে যান নকশাল আন্দোলনে এবং এই রেশকেই কেন্দ্র করে বামপন্হীরা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসেন। এই রেশই নন্দীগ্রামে পৌঁছোবার পর বামপন্হীরা দিশেহারা হয়ে পড়েন আর তৃণমূল ক্ষমতা দখল করে । রেশটা থাকে জনগণের মাঝে । আমার মনে হয়, সব সময়েই থাকে,চিরকাল থাকে । 

হাংরি আন্দোলনের পরে-পরেই নকশাল আন্দোলন ঘটেছিল অথচ যাঁরা হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও পুলিশের কাছে নালিশ করেছিলেন তাঁরা কেন আসন্ন উথালপাথাল টের পাননি ? হাংরি আন্দোলনকারীরা সাহিত্যজগতের মূল্যবোধ-মালিক ও প্রকাশক-বাজারের জোতদারদের উৎখাত করতে চেয়েছিল, জন্তুজানোয়ারের মুখোশ পাঠিয়ে বিদ্যায়তনিক জোতদারদের টপলেস অর্থাৎ গলা কেটে ফেলতে চেয়েছিল, সাহিত্যিক ক্ষমতাকে দখল করে বিলিয়ে দিতে চেয়েছিল লিটল ম্যাগাজিনের মাঝে, জুতোর বাক্স রিভিউ করতে দিয়ে এবং শাদা ফুলস্কেপ কাগজকে ছোটোগল্প নামে বাজারি কাগজে জমা দিয়ে সাহিত্যিক জোতদারদের দলিদস্তাবেজ বেদখল করতে চেয়েছিল । এগুলো কোনোরকমের ইয়ার্কি বা প্র্যাঙ্ক ছিল না।

যাঁরা নালিশ ঠুকেছিলেন তাঁদের মধ্যে বিদ্যায়তনিক প্রতিনিধিরাও ছিলেন যাঁদের হাংরি আন্দোলনকারীদের পাঠানো কার্ডে FUCK THE BASTARDS OF GANGSHALIK SCHOOL OF POETRY ঘোষণা পড়ে অপমানবোধ হয়েছিল, জানোয়ার ও দানবের মুখোশ পেয়ে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল । অথচ তার কয়েক বছর পরেই নকশাল তরুণরা শিক্ষকদের গলা কাটা আরম্ভ করলেন, জোতদারদের বাড়ি লুঠ করে দলিল-দস্তাবেজ পুড়িয়ে দিলেন, জমি দখল করে বিলিয়ে দিলেন ভাগচাষিদের । নকশাল আন্দোলনকারীরা জোতদারদের বেদখল করার সময়ে, বাড়িতে-খামারে আগুন ধরিয়ে দেবার সময়ে FUCK THE BASTARDS -এর পরিবর্তে বাংলা ও চোস্ত হিন্দি গালাগাল দিয়েছিল, জোতদার আর ভূস্বামীদের মুখোশ চামড়াসুদ্দু ছিঁড়ে উপড়ে নিয়েছিল । 

নকশাল তরুণরা এসে দেখিয়ে দিল যে হাংরি আন্দোলনকারীদের এই কাজগুলো ঠাট্টা-ইয়ার্কি করার ব্যাপার ছিল না, তা ছিল চোখে আঙুল ঢুকিয়ে বাস্তবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রক্রিয়া । জোতদারদের বিরুদ্ধে যে ইতর বুলি কথাবার্তায় প্রয়োগ করে ক্ষান্ত থেকেছিলেন নকশালরা, তা নিজেদের লেখায় নিয়ে এসেছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীরা যাকে মধ্যবিত্ত পরিবারের বিদ্যায়তনিক ও গ্লসি পত্রিকার চাকুরে আলোচনাকারীরা বলে এসেছেন অশ্লীল ও অশোভন । আলোচকরা ভুলে গিয়েছিলেন যে ছোটোলোকদের ভাষা অমনই হয়। নকশাল আন্দোলনের কবিতা  কিন্তু মধ্যবিত্ত বাঙালির ভাষার আওতার বাইরে বেরোতে পারেনি বলেই মনে হয় । 

যেমন কৃষ্ণ ধর-এর ‘একদিন সত্তর দশকে’ কবিতাটি :-

শিকারকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে

অন্ধকারে মিলিয়ে যায় জল্লাদের গাড়ি

শহরের দেয়ালে দেয়ালে পরদিন দেখা যায় তারই কথা

সে নিদারুণ তৃষ্ণায় একবার জল চেয়েছিল

যে যন্ত্রণায় নীল হয়ে একবার ডেকেছিল মাকে

তবু স্বপ্নকে অক্ষত রেখেই সে

বধ্যভূমিতে গিয়েছিল

একদিন সত্তর দশকে।”

স্বপন চক্রবর্তী লিখেছিলেন :-

‘আমরা সাহায্য চাইনি’

আমরা সাহায্য চাইনি

কারণ আমরা বদল চেয়েছি।

চেয়েছি ক্ষিদের মানসিক যন্ত্রণার বিরুদ্ধে

একটি সকাল, দুপুর, রাত সময়, কাল, অনন্ত সময়।

.কোনদিনই আমরা কমিউনিস্ট হতে চাইনি।

এখন সময়

মানুষের জন্যে আমাদের মানুষের মত হতে শেখাচ্ছে।

মানুষের জন্যে আমাদের মানুষের মত হতে শেখাচ্ছে।

আমরা চাইনি ইজ্জত খুইয়ে ঘাড় হেঁট করে পেট ভরাতে।

আমরা বদল চেয়েছি

চেয়েছি ক্ষিদের যন্ত্রণার বিরুদ্ধে

একটি সকাল, দুপুর, রাত সময়, কাল, অনন্ত সময়।”

নির্মল ঘোষ তার ‘নকশালবাদী আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘অনস্বীকার্য, নকশালপন্থী কাব্যচর্চায় আঙ্গিকের চেয়ে বিষয়কেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। আর এর ফলে বক্তব্যে বহুক্ষেত্রেই আবেগের প্রাধান্য দেখা গেল, যা শেষপর্যন্ত পাঠক মানসকে প্রায়শ প্রভাবিত বা প্রাণিত করতে সমর্থ হয়নি।’ পক্ষান্তরে, কবিতার শৈল্পিক মানের এ বিতর্কে অর্জুন গোস্বামী নকশালবাদী কবিতার পক্ষেই রায় দিয়েছেন, ‘এটা সত্তরের দশক। এই দশক প্রত্যক্ষ করেছে শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে শোষিতশ্রেণীর লড়াই। এই দশকেই প্রমাণিত হয়েছে যে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্রকে উপরে উপরে যতই শক্তিশালী বলে মনে হোক না কেন আসলে তারা হলো কাগুজে বাঘ। স্বভাবতই এই দশকের মানুষের সচেতনতা অনেক বেশি। আমরা এমন কোন কবিতা পড়তে চাই না যাতে আছে হতাশা, আছে যন্ত্রণার গোঙানি। আমরা এমন কবিতা পড়তে চাই যাতে ধরা পড়বে শোষণের আসল স্বরূপ, যে কবিতা পড়ে অনুপ্রেরণা পাবেন লক্ষ লক্ষ খেটে খাওয়া মানুষ এবং যে কবিতা প্রকৃতই হবে শোষিতশ্রেণীর সংগ্রামী হাতিয়ার। আমাদের মধ্যে অনেকে বলেন কবিতা হলো এমন একটা জিনিস যা ঠিক স্লোগান নয়। আমাদের বক্তব্য হলো কবিতার বিষয় ও কবিতার আঙ্গিক এই দুটোর মধ্যে আগে বিষয়, পরে আঙ্গিক। বক্তব্যকে সাধারণের উপযোগী করে বলার জন্য কবিতা যদি কারুর কাছে স্লোগান বলে মনে হয় তবে সেই স্লোগানই হলো সত্তরের দশকের শ্রেষ্ঠ কবিতা।’

হাংরি আন্দোলনের সময়ে আমিও বলেছিলুম,  “কবিতা কেবল মঞ্চে বিড়-বিড় করে পড়ার ব্যাপার নয় ; উন্মাদের মতন চিৎকার করে না পড়লে প্রতিষ্ঠান কষ্ট-যন্ত্রণার গোঙানি শুনতে পায় না ।” বাসব রায়কে দেয়া ‘যুগশঙ্খ’ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন যে মলয়ের কবিতায় অত্যধিক অব্যয় থাকে, চিৎকার থাকে । এই প্রেক্ষিতে নকশালদের সঙ্গে হাংরিদের তুলনা করা চলে, যেমন ত্রিদিব মিত্রের বিখ্যাত কবিতা ‘হত্যাকাণ্ড’ । হাওড়া স্টেশানের প্ল্যাটফর্মে বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে ‘হত্যাকাণ্ড’ কবিতাটা পড়ে ভিড় জমিয়ে ফেলেছিল ত্রিদিব মিত্র ।

হাংরি আন্দোলনের গ্রন্হ রিভিউ করতে গিয়ে শৈলেন সরকার বলেছেন, “হাংরি-র পুরনো বা নতুন সব কবি বা লেখকই কিন্তু অনায়াসে ব্যবহার করেছেন অবদমিতের ভাষা। এঁদের লেখায় অনায়াসেই চলে আসে প্রকৃত শ্রমিক-কৃষকের দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দাবলি। ভালবাসা-ঘৃণা বা ক্রোধ বা ইতরামি প্রকাশে হাংরিদের কোনও ভণ্ডামি নেই, রূপক বা প্রতীক নয়, এঁদের লেখায় যৌনতা বা ইতরামির প্রকাশে থাকে অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ বিবরণ— একেবারে জনজীবনের তথাকথিত শিল্পহীন কথা। অনেকেই প্রায় সমসময়ের নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনকে তুলনা করে এদের অরাজনৈতিক তকমা দেন, কিন্তু ক্ষমতার সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক নিয়ে হাংরি জেনারেশন যে প্রশ্ন তুলেছিল তা ছিল নকশালদের তোলা প্রশ্নের চেয়েও অনেক বেশি মৌলিক। এমনকী তুমুল প্রচার পাওয়া এবং নিজস্ব অস্তিত্ব তৈরি করা সত্ত্বেও দলিত সাহিত্য আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত হাংরি আন্দোলনের থেকে পিছিয়েই রাখতে হয়।” শৈলেন সরকার যে বইটি আলোচনা করেছেন তাতে কোনো কারণে সম্পাদকমশায় হাংরি আন্দোলনের রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টো অন্তর্ভুক্ত করেননি । করলে স্পষ্ট হতো যে হাংরি আন্দোলন অরাজনৈতিক ছিল না ।

প্রবুদ্ধ ঘোষ হাংরি আন্দোলন ও নবারুণ ভট্টাচার্য সম্পর্কে আলোচনা করার সময়ে বলেছেন, “বাড়ি ভেঙ্গে পড়ার শব্দ তখনই শোনা যায়, যখন তা শোনার জন্যে কেউ থাকে। সাহিত্যের কাজ কী? ক্যাথারসিস করা? মানে, মোক্ষণ? বরং হাংরিদের লেখা প্রতিমুহূর্তে ক্যাথারসিসের উল্টোদিকে হাঁটে। মোক্ষণ করা, শান্তি দেওয়া তাঁদের কাজ নয়, বরং আপাতশান্তির বোধটাকে আঘাত করাই মূল উদ্দেশ্য!” একটু আগে আমি যেকথা বলেছি, অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান-সাহিত্যের জোতদারদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে চেয়েছিল হাংরি আন্দোলনকারীরা, তাদের কাজের দ্বারা, লেখার দ্বারা, ড্রইং দ্বারা, সেকথাই বলেছেন প্রবুদ্ধবাবু । তবে প্রবুদ্ধবাবু একটা কথা ভুল বলেছেন, যে হাংরি আন্দোলনকারীরা কেবল আত্মবীক্ষণ ও আত্মআবিষ্কারে আলো ফেলতে চেয়েছেন। হাংরি আন্দোলনকরীরা যদি তাই করতেন তাহলে যে কাজগুলোকে মধ্যবিত্ত আলোচকরা ‘অসাহিত্যিক’ ব্যাপার বলে তকমা দেগে দেন তা তাঁরা করতেন না, বিভিন্ন বিষয়ে ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করতেন না । নকশালরা যে মূর্তির গলা কেটে প্রতীকিস্তরে বিশেষ মূল্যবোধকে আক্রমণ করেছিল, শিক্ষকদের খুন করেছিল, তার সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ-খুনের আক্রমণাত্মক কাজগুলো তুলনীয় ।

সুবিমল বসাকের একটা কবিতা এখানে তুলে দিচ্ছি, যা হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছিল :-

‘হাবিজাবি’

আমারে মাইরা ফেলনের এউগা ষড়যন্ত্র হইসে

চারো কোনা দিয়া ফুসফুস আওয়াজ কানে আহে

ছাওয়াগুলান সইরা যায় হুমকে থিক্যা

অরা আমারে এক্কেরে শ্যায করতে সায়

আমি নিজের ডাকাইতে্যা হাতেরে লইয়া সচেত্তন আসি

কেউ আইয়া চ্যারায় দিশায় চ্যাবা কথা কয় না

আমি সুপসাপ থাকি

ভালাসির গুছাইয়া আমি কথা কইতে পারি না

২ কইতে গিয়া সাত হইয়া পড়ে

১৫ সাইলে ৯ আইয়া হাজির হয়

ছ্যাব ফেলনের লাইগ্যা বিচড়াইতাসি অহন

আহ, আমার দাঁত মাজনের বুরুশ পাইতাসি না

বিশ্বাস করেন, কেউ একজনা আমার মুহের সকরা খাবার খাইসে ।

(হাংরি বুলেটিন নং ১৮ থেকে)

প্রবুদ্ধবাবু বলেছেন “হাংরিদের ‘ক্ষুধা’ বিষয়ে তাঁদের নিজস্ব মতামত ছিল ; এই ক্ষুধা আসলে নিজেকে দগ্ধ করে সত্য আবিষ্কারের ক্ষুধা। সত্য, যা ক্রমাগতঃ এমনকি নিজেকেও ছিঁড়েখুঁড়ে উন্মোচিত করে চলে। তাকাই ফাল্গুনী রায়ের কবিতায়, “আমার বুকের ভিতর লোভ অথচ হৃদয় খুঁজতে গিয়ে বুকের ভিতরে/ রক্তমাংসের গন্ধ পাচ্ছি কেবল”। আজ স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে; প্রকাশ্যে চুম্বন করে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাধানিষেধ ও সমাজের প্রচলিত ‘ট্যাবু’গুলিকে। এই বিদ্রোহ কিন্তু ’৬০ এর দশক থেকেই শুরু করে দিয়েছিলেন ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকেরা। সমস্তরকম গোঁড়ামি এবং ‘ঢাকঢাকগুড়গুড়’ বিষয়ের ভিতে টান মেরেছেন। সাহিত্য বহু আগেই ভবিষ্যতের কোনো এক আন্দোলনের কথা স্বীকার করে যাচ্ছে- তার নিজের মত করে, নিজের প্রকাশে। না, নিশ্চিতভাবেই সাহিত্যের কাজ ভবিষ্যৎদর্শন নয়; কিন্তু হ্যাঁ, সাহিত্যের অন্যতম কাজ ভবিষ্যতের সামাজিক আন্দোলনের, সাহিত্য আন্দোলনের সূত্রগুলোর হদিশ দিয়ে যাওয়া। ফাল্গুনী রায় যখন কবিতায় বলেন, ‘শুধুই রাধিকা নয়, গণিকাও ঋতুমতী হয়’, তখন কি আজকের কথাই মনে হয় না? যেখানে, ঋতুমতী হওয়া কোনো ‘লজ্জা’র বিষয় নয়, ‘অশুদ্ধি’র বিষয় নয়, বরং তা স্বাভাবিক জৈবনিক প্রক্রিয়া। আর, প্রতিমুহূর্তের এই আত্মজৈবনিক বিষয়গুলিই উঠে আসে হাংরি জেনারেশনের লেখায়। বা, সগর্ব্ব মানুষ-প্রমাণ ‘আমি মানুষ একজন প্রেম-পেচ্ছাপ দুটোই করতে পারি’’। এগুলো তো দৈনন্দিন। এগুলো তো স্বাভাবিক। তাহলে? আসলে, ‘শুদ্ধতা’-র একটা অর্থহীন ধোঁয়াশাবোধ তো তৈরি করেই দেয় সমাজ, একটা বর্ডারলাইন। সাহিত্যের নায়ক রক্তমাংসের মতো হবে কিন্তু তার ক্ষুধা-রেচন ইত্যাদি থাকবে না বা পুরাণচরিত্রদের শারীরবৃত্তীয় কার্য নেই! এই ‘মেকি’ ধারণাসমূহ লালন করে আসা আতুপুতু প্রতিষ্ঠানগুলো যখন হাড়-মজ্জা-বোধ জীবন্ত হতে দেখে তখন ‘অশ্লীল সংস্কৃতি’ ছাপ্পা মারে। সমাজের জড়তা, মধ্যবিত্ত ভণ্ডামির মুখোশগুলো খুলে দেয় টান মেরে। আর, তাই ‘নিষিদ্ধ’, অশ্লীল মনে হয় এদের লেখাগুলি। হাংরি-দের যেখানে মূল বক্তব্যই ছিল প্রতিটি লেখায় ও সাহিত্যযাপনে আত্মউন্মোচন, সেখানে এই বিষয়গুলি স্বাভাবিক বীক্ষাতেই উঠে এসেছে। এবং, ‘সাহিত্য বিক্রির জন্যে আরোপিত যৌনতা’ বনাম ‘শিল্প ও জীবনের সাথে সম্পৃক্ত যৌনতা’ এই বিতর্কের ডিস্‌কোর্স তৈরি করেছে।” 

প্রবুদ্ধবাবু আরও বলেছেন, “পণ্যসময়ে বেঁচে থেকে, কিচ্ছু না-পেয়ে বেঁচে থেকে, হতাশার অবিমৃষ্য বোধ তৈরি হয়। ’৬০-’৭০ র দশকের ক্রমাগত অর্থনৈতিক অবক্ষয়, মধ্যবিত্তের আশাহীনতার অভিঘাত নৈরাশ্যের জন্ম দেয়; এমনকি সাহিত্যেও। আর, সেই নৈরাশ্যকে এড়িয়ে গিয়ে কবিতা বা গদ্য লেখা যায় না। অরুণেশ ঘোষ তাঁর ‘কিচ্ছু নেই’ সময়কে লিখছেন- ‘১ পাগল এই শহরের চূড়ায় উড়িয়ে দিয়েছে তার লেঙ্গট/ ১ সিফিলিস রুগী পতাকা হাতে মিছিলের আগে/ ১ রোবট নিজেকে মনে করে আগামীকালের শাসক/ ১ মূর্খ ঘুমিয়ে থাকে শহর-শুদ্ধ জেগে ওঠার সময়… শীতের ভোর রাত্রে- মধ্যবিত্তের স্বপ্নহীনতার ভেতর/ আমাকে দেখে হো হো করে হেসে ওঠে বেশ্যাপাড়ার মেয়েরা’। এই স্বপ্নহীনতাকে বাড়িয়ে তোলে পুঁজিবাদের দমবন্ধ চেপে বসা। ভারতের তথা বাংলার অর্থনীতি-মডেলকে সাজানোর দোহাই দিয়ে বিদেশি শস্যবীজ এবং সবুজ বিপ্লবের সাথেই আমদানি হয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। আর, নগরায়ণের মুখ খুলতে থাকে। ’৯০ র দশকের পরে যে বীভৎস হাঁ-তে ঢুকে যেতে থাকবে ভারতবর্ষের একের পর এক গ্রাম-মফস্বল।”

১৯৬৮ সালে বিনয় ঘোষ ‘কলকাতার তরুণের মন’ নামক প্রবন্ধে লিখছেন- “গোলামরা সব উঁচুদরের ঊর্ধ্বলোকের গোলাম, আগেকার কালের মতো তাঁদের হাত-পায়ের ডাণ্ডাবেড়ি দেখা যায় না। তাঁদের ‘স্টেটাস’ আছে, ‘কমফর্ট’ আছে, ‘লিবার্টি’ আছে। তাঁরা নানাশ্রেণীর ব্যুরোক্র্যাট টেকনোক্র্যাট ম্যানেজার ডিরেক্টর ইঞ্জিনিয়ার সেলস-প্রমোটার বা ‘অ্যাড-মেন’- যাঁরা যন্ত্রের মতো সমাজটাকে চালাচ্ছেন। ব্যক্তিগত ভোগ-স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাধীনতার একটা লোভনীয় মরীচিকা সৃষ্টি করছেন তাঁরা সাধারণ মানুষের সামনে এবং দিনের পর দিন বিজ্ঞাপনের শতকৌশলে নেশার পিল খাইয়ে সেই ভোগস্বাধীনতার স্বপ্নে তাদের মশগুল করে রাখছেন।”। ’৬০-’৭০ র অবক্ষয়ী অথচ পণ্যপ্রিয় ভোগসমাজের কথা সেইসময়ের মতন করেই লেখেন হাংরি আন্দোলনের গল্পকাররা। আর, ভবিষ্যতের পণ্যসমাজের একটা আভাসও থাকে। “আপাতত প্রতীয়মান ধূম্রজালে জড়ানো ধীরে ধীরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর একজন দৈত্যভৃত্য বলে,  ‘আপনার গোলাম, আকা কি হুকুম যা বলবেন যা চাইবেন জীবনে তাই হাজির… একটি সিগারেট। …একটি সিগারেট। পাঁচ বছরে একটি টিভি সেট। দশ বছরে একটি গাড়ি আর বিশ বছরে সিগারেট খেতে খেতে একবার সারা দুনিয়ায় চক্কর দেব। বাতাস স্তব্ধ। অবাক হঠাৎ মেঘের আকাশ-কাঁপানো অট্টহাসি।”[ঘটনাদ্বয় ও তাদের সাজসজ্জাঃ রবিউল] 

বোর্দ্রিয়ারের মতে, উত্তর-আধুনিক সমাজে শ্রেণিবিভাগ আর শুধুমাত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকছে না, বরং তা এখন নির্ভর করছে ভোগের ওপর। কে কোন পণ্য ভোগ করছে, তার ‘ব্র্যাণ্ড’ এবং দামের ওপর নির্ভর করছে তার শ্রেণিঅবস্থান। অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন, পণ্যকৌশলে ভুলিয়ে দিতে চাওয়া দেশকাল-ইতিহাস আর, এমনকি প্রকৃত যৌনতা, সামাজিকতা, সবকিছুরই মৃত্যু ঘটছে- তখনই অধিবাস্তব টেনে নিয়ে চলেছে ‘ভার্চ্যুয়াল’ জগতে, এই সত্য তো হাংরি আন্দোলনকারীদের লেখাতে উদ্ঘাটিত হয়েছে! বস্তুতঃ, তাঁদের লেখায় তাঁরা এটাকেই আক্রমণ শানাতে চেয়েছেন। আজকের মানুষের পরিসর-মাফিক রূপবদলের কথা আমি লিখেছি আমার ‘জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা’ নামের অধিবাস্তব গল্পে আর পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ফাঁসিয়েছি ‘গহ্বরতীর্থের কুশীলব’ নামের অধিবাস্তব কাহিনিতে — যা কিনা সময়-পরিসরের সঙ্গে অ্যাড্রেনালিনের রেশ এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রক্রিয়া ।

হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা-মকদ্দমা করে তাদের বিক্ষিপ্ত করে দেবার পর, প্রতিষ্ঠানের লেখকরা লেখালিখি করে দেখাতে চাইলেন, নকশাল আন্দোলন মধ্যবিত্ত রোম্যাণ্টিকতা ও কাঁচা প্রেমের মতো, বামপন্থা মানেই তা ভ্রষ্ট সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখায় এবং আসলে নিরাজনীতিই মানুষকে ‘মানুষ’ করে তোলে! হাংরিদের পর থেকে তাদের বিরুদ্ধতাকারী পঞ্চাশের ও পরবর্তী সাহিত্যিকরা এহেন ভাবনাগুলোকে সচেতন ভাবেই প্রতিষ্ঠানের  মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন । প্রবুদ্ধ ঘোষ বলেছেন “আশির দশকের বাংলা সাহিত্য থেকেই আর, ’৯০ পরবর্তী প্রাতিষ্ঠানিক ও ‘এলিট’ পত্রিকার সাহিত্যগুলি কিছু অবয়ববাদী বা স্ট্রাক্‌চারালিস্ট ধাঁচা (স্টিরিওটাইপ) এনে ফেলল। যেমন, নকশাল ছেলেটি লেখাপড়ায় মারাত্মক ব্রিলিয়াণ্ট ছিল, ‘ভুল’ রাজনীতির পাল্লায় পড়ে গ্রামে গেল রাজনীতি শিখতে ও ডি-ক্লাস্‌ড হতে, তার প্রেমিকা উচ্চবিত্ত ঘরের এবং যৌনসম্পর্কের বিশদ অনর্থক বর্ণনা, পুলিশের গুলিতে বা অত্যাচারে পঙ্গু হল, আদতে লড়াইটা এবং মতাদর্শটা ব্যর্থ হল এবং অ্যাপলিটিক্সের ওপরে সমাজসেবার ওপরে ভরসা রাখল ব্যর্থ নায়ক! এই অবয়ববাদী ধাঁচায় ফেলে প্রতিষ্ঠানগুলি বিক্রি বাড়াতে লাগল তাদের সাহিত্যের। আর, তার সাথেই ক্রমে ‘সক্রিয় রাজনীতি’ ও বামপন্থা থেকে বিমুখ করে দিতে লাগল বিশ্বায়ন পরবর্তী প্রজন্মকে। 

প্রবুদ্ধবাবু বলেছেন, “হাংরি-দের গল্পের এবং গদ্যের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হচ্ছে, মুক্তসমাপ্তি। অর্থাৎ, কোনও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন না লেখক; হয়তো স্থির সিদ্ধান্ত হয় না কোনও। অন্ততঃ, যে সময়ে তাঁরা লিখছেন, সেই সময়ে অচঞ্চল বিশ্বাস কিছু নেই, কোনও স্থিতি নেই, সিদ্ধান্তে আসার ভিত্তি নেই। বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘বমন রহস্য’ গল্পে আশাহীন এবং আলোহীন ভোগবাদী সমাজের প্রতি ঘৃণা ঠিকরে বেরোয়। গল্পের শেষ লাইন- “বমি করে যাই রক্তাক্ত পথের উপরে। সমস্ত চর্বিত মাংসের টুকরো, সমস্ত জীবন ভোর খেয়ে যাওয়া মাংসের টুকরো আমি বমি উগরে বার করতে থাকি। বমির তোড়ে আমার নিঃশ্বাস যেন আটকে আসে।”। 

আসলে মুক্তসূচনা এবং মুক্তসমাপ্তির জনক হলেন জীবনানন্দ দাশ । ‘মাল্যবান’ যেভাবে শেষ না হয়েও শেষ হয়েছে, তা থেকে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয় । এই শৈলী প্রয়োগে পাঠকের যথেচ্ছ স্বাধীনতা থাকে, জীবনের সাথে মিলিয়ে পরিণতি ভাবার; সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেওয়ার দায় কবির বা লেখকের নয়। প্রবুদ্ধবাবুকে অবশ্য একথা বলার যে, নকশাল আন্দোলন বা ফিদেল কাস্ত্রোর আন্দোলনও ছিল মুক্তসমাপ্তির, আন্দোলনের পরে কি ঘটবে তা আগাম পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল না । নকশাল আন্দোলনকারীরা জানতেন নিশ্চয়ই যে পশ্চিমবঙ্গ বলতে ভারতবর্ষ বোঝায় না । চারু মজুমদার কি জানতেন না যে চীন আদপে তিব্বত দখল করার পর মাও-এর সাম্রাজ্যবদী দিকটাকে ফাঁস করে দিয়েছে ? এখন চীন যা করছে তার ভিত তো মাও-এর গড়ে দেয়া। 

প্রবুদ্ধ ঘোষ বলেছেন, “নবারুণ কবিতার সংজ্ঞাও একপ্রকার নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। ঠিক যেভাবে হাংরি-রা তাদের কবিতার ধারণা স্বতন্ত্র করে দিয়েছেন । নবারুণের কবিতা চিরাচরিত চাঁদ-ফুল-তারার রোম্যাণ্টিকতা অস্বীকার করে। কবিতা যে ‘লেখার’ নয়, বরং কবিতা ‘হয়ে ওঠার’ বিষয়, তা স্পষ্টতর হয় অস্থির সময়ে- “কবিতা এখনই লেখার সময়/ ইস্তাহারে দেওয়ালে স্টেনসিলে/ নিজের রক্ত অশ্রু হাড় দিয়ে/ এখনই কবিতা লেখা যায়…”। কবিতার আসন্ন সম্ভাবনাও লিখে রাখেন শেষ পংক্তিগুলিতে। “কবিতার জ্বলন্ত মশাল/ কবিতার মলোটভ ককটেল/ কবিতার টলউইন অগ্নিশিখা/ এই আগুনের আকাঙ্খাতে আছড়ে পড়ুক”। হাংরি আন্দোলনকারীরাই প্রথম বলেছিল যে কবিতা চাঁদ-ফুল-তারা ইত্যাদির ব্যাপার নয় । আমি আমার কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধে এ-কথা ষাটের দশকেই বলেছিলুম ।

প্রবুদ্ধবাবু বলেছেন, “এখানেই কবিতাকে নতুনভাবে সাজিয়ে নেওয়ার ভাবনার সাথে মিল পাওয়া যায় হাংরি-দের। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা থেকে প্রথম হাংরি বুলেটিন বেরোয় ইংরাজিতে। ‘Weekly manifesto of hungry generation’, যার সম্পাদক দেবী রায়, মুখ্যনেতা শক্তি চ্যাটার্জ্জী এবং ক্রিয়েটর মলয় রায়চৌধুরি। তার প্রথম অনুচ্ছেদ- “Poetry is no more a civilizing maneuver, a replanting of the bamboozled gardens; it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzing of the hymning five, a sowing of the tempestual Hunger.” কবিতা কোনো নিরপেক্ষতার মাপকাঠি নয়, কবিতা শুধুমাত্র ছন্দ-শব্দ দিয়ে বেঁধে রাখার নান্দনিকতা নয়। বরং, অসহ্য জীবনকে তার মধ্যে প্রতিটি ছত্রে রেখে দেওয়া, অনন্ত বিস্ফারের সম্ভাবনায়। আর, এখানেই মনে পড়ে মারাঠি কবি নামদেও ধাসালের লেখা। দলিত জীবনের আখ্যান এবং প্রতিটি পংক্তিতে উল্লেখযোগ্য ঘৃণা; এই ঘৃণাই আসলে জীবন, এখান থেকে ভালবাসার জন্ম।” 

এখানে উল্লেখ্য যে নবারুণ ভট্টাচার্যের বাবা-মা দুজনেই ছিলেন শিক্ষিত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের, কলকাতার সংস্কৃতি জগতের মানুষ । অপরপক্ষে হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় এসেছিলেন চাষি পরিবার থেকে; এমনকি কলকাতার সাহিত্যিকদের টিটকিরি প্রতিহত করার জন্য তিনি পতৃদত্ত নাম হারাধন ধাড়া বর্জন করতে বাধ্য হন।  সুবিমল বসাক এসেছিলেন তাঁতি পরিবার থেকে যাঁর বাবা স্যাকরার কাজ করতে বাধ্য হন এবং মোরারজি দেশাইয়ের গোল্ড কনট্রোলের দরুন দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেন । অবনী ধর ছিলেন জাহাজের খালাসি, বাড়ি ফিরে কলকাতার রাস্তায় হকারি করতেন, ঠেলায় করে কয়লা বেচতেন, ফুটপাতে ছিট কাপড় বেচতেন । এই ধরণের জীবনে জড়িয়ে হাংরি-দের লেখায় পরিপার্শ্বের প্রেক্ষিতে আত্ম-কে আবিষ্কার জরুরি হয়ে ওঠে , জীবনের কেন্দ্রের মূল উৎস গুলোয় ফেরা, সন্ধান করা অসুখের উৎসের। কবিতা থেকে কবিতাযাপন হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। ক্রাইসিস-গুলোকে চিনে নিতে নিতে প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠা। কবিতা মানে বাস্তব থেকে দূরে সরার, অথবা কিছু মিথ্যে স্তোকবাক্য দিয়ে বাস্তবকে আড়াল করার চেষ্টা আর নেই; চাঁদ ফুল তারা নদী আর অতটাও সুন্দর নেই যে তারাই হয়ে উঠতে পারে ‘Aesthetics’-র মাপকাঠি। এস্থেটিক্‌স-ও নিয়ন্ত্রিত হয় পুঁজির দ্বারা, পুঁজির স্বার্থেই! সেই এস্থেটিক্‌স কে প্রবল বিক্ষোভে উপহাস করেন ফাল্গুনী রায়ও- “রাজহাঁস ও ফুলবিষয়ক কবিতাগুলি আমি মাংস রাঁধার জন্যেই দিয়েছিলাম উনোনে…”। বরং দৈনন্দিন যুদ্ধদীর্ণ ‘অসুস্থ’ জীবন থেকেই উঠে আসে ‘Aesthetics’-র সারবত্তা। আর, কবির নিশ্চয়ই দায়বদ্ধতা থাকে সমাজের প্রতি; হাংরি-দের সেই নিজেকে, ভাষাকে, কবিতাকে, নাটককে,  ছিঁড়েখুঁড়ে সত্যের কাছাকাছি পৌছানোর উপলব্ধিকে ঔপনিষদীয় বলা ভুল হবে না ।

রাষ্ট্রের ভণ্ডামিগুলো, ‘আদার্‌’ অর্থাৎ’অপর’ ছাপ্পা মেরে দেওয়াগুলো, ‘নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়া’র গড্ডালিকা স্রোতগুলোর পালটা স্রোত সাহিত্যে-জীবনযাপনে আসে। আর, যতোটা ‘সংস্কৃতি’ ঠিক করে দেওয়া কর্তারা থাকবে, ততটাই থাকবে সেই ‘সংস্কৃতিকে’ প্রত্যাখ্যান। হয়তো সমান্তরাল, তবু থাকবে। প্রবলভাবেই। সমাজশাসকেরা বরাবরই নিজেদের মত করে হেজিমনি চাপিয়ে দেয়, শাসনের ডিস্‌কোর্সের অভিমুখে দাঁড় করাতে চায় সব্বাইকে। আর, যখনই তার বিরুদ্ধে স্বর ওঠে, তা সে সাহিত্যেই হোক বা রাজনিতিতে , তাকে দমিয়ে দেওয়া হয়। ব্রাত্য করে রাখা হয় ‘সংস্কৃতি’-র শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে। জাতীয় সাহিত্যের মাপকাঠিতে ‘অশ্লীল’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে প্রতিপন্ন হয় এই সাহিত্যগুলো ও রাজনীতিগুলো । হাংরি আন্দোলনকারীদের যেভাবে জেলে পোরার চক্রান্ত হয়েছিল, একইভাবে প্রতিষ্ঠানের আরও বৃহত্তর চক্রান্তে একের পর এক হত্যা করে নিশ্চিহ্ণ করা হয়েছিল নকশালদের, সমাজকে ‘শুদ্ধ’ করে তোলার জন্য। 

অরবিন্দ প্রধান সম্পাদিত ‘অপর : তত্ব ও তথ্য’ বইতে সমীর রায়চৌধুরী লিখেছেন, “নিজেদের রয়ালিস্ট, প্রকৃত খ্রিস্টিয়, প্রগতিবাদী ইত্যাদি নির্দিষ্টাত্মক বিশেষণের খপ্পরের ছাঁচে ফেলে দেওয়ার তোড়জোড়ে সাম্রাজ্যবাদী চেতনার জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছেন ঔপনিবেশিক শ্রেষ্ঠত্ববোধসম্পন্ন লেখকরা, ফলে তাঁদের টেক্সটে আশ্রিত হয়েছে চরম অপরত্ব-বোধ । দক্ষিণ আফ্রিকার ঔপন্যাসিক জে. এম. কোয়েতসে তাঁর ‘ওয়েটিং ফর দ্য বারবারিয়ানস’ গ্রন্হে দেখিয়েছেন কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য অপরায়নের প্রক্রিয়া কার্যকরী করে । এই প্রক্রিয়া তার নিজের শ্রেষ্ঠত্ব, এগিয়ে থাকা, সভ্যতাকে শ্রেয় এবং অপরের অসত্বিত্বকে হেয় করতে সাহয্য করে । কেবল টেক্সটে নয়, জীবনের সব এলাকাতে এভাবে স্ব-আধিপত্য প্রতিষ্ঠা সহজ হয়ে ওঠে ।” বলা বাহুল্য যে হাংরি আন্দোলন আর নকশাল আন্দোলনকে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন ‘অপর’ তকমা দিয়ে সমাজ থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল, যেমন আফ্রিকার আদিনিবাসদের মুছে ফেলতে চেয়েছিল ইউরোপের শাসক-সমাজ ।

নারায়ণ সান্যালের বিবরণীতে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার এক অজানা কথা উঠে আসে। “কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগর-মশায়ের মর্মরমূর্তির যেদিন মুণ্ডচ্ছেদ হয় তার মাসখানেকের মধ্যে সিপিএম (এম. এল) দলের এক নেতৃত্বস্থানীয় ছাত্রনেতার সঙ্গে আমার সাক্ষাত্ হয়েছিল! ঘটনাচক্রে সে আমার নিকট আত্মীয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। কট্টর নকশাল। আমার পেচকপ্রতিম বিরস মুখখানা দেখে সে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, ‘বিশ্বাস কর ছোটকাকু! মূর্তিটা যে ভেঙ্গেছে তাকে আমি চিনি। গত বছর হায়ার সেকেন্ডারিতে সে বাংলায় লেটার পেয়েছে। ওর সেই বাংলা প্রশ্নপত্রে প্রবন্ধ এসেছিল তোমার প্রিয় দেশবরেণ্য নেতা। ও লিখেছিল বিদ্যাসাগরের উপর।”

অধিকাংশ আলোচক বলেন হাংরি আন্দোলন এবং নকশাল আন্দোলন দুটিই ব্যর্থ্য এবং তাদের ব্যর্থতার কারণও এক : প্রথমত, প্রশাসনিক আক্রমণ ; দ্বিতীয়ত, আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ ; তৃতীয়ত, আন্দোনের সদস্যদের মধ্যে বিভাজন ; চতুর্থত, তাঁদের কার্যকলাপ । আমি শুধু বলতে চাই যে দুটি আন্দোলনই বাংলার বৌদ্ধিক সমাজে ছাপ ফেলেছে এবং তা ‘ব্যর্থ্য’ তকমা দিয়ে চাপা দেয়া যায় না ।

পাঁচ

হাংরি আন্দোলনকারীদের মত পরাবাস্তব আন্দোলনকারীদের মাঝেও ভাঙন ঘটত, সে কথাও জানিয়েছেন অভিজিৎ পাল ।

১৯১৭ সালে গিয়ম অ্যাপলিনেয়ার “সুররিয়ালিজম” অভিধাটি তৈরি করেছিলেন, যার অর্থ ছিল বাস্তবের অতীত। শব্দটি প্রায় লুফে নেন আঁদ্রে ব্রেতঁ, নতুন একটি আন্দোলন আরম্ভ করার পরিকল্পনা নিয়ে, যে আন্দোলনটি হবে পূর্ববর্তী ডাডাবাদী আন্দোলন থেকে ভিন্ন । ত্রিস্তঁ জারা উদ্ভাবিত ডাডা আন্দোলন থেকে সরে আসার কারণ হল ব্রেতঁ সহ্য করতে পারতেন না ত্রিস্তঁ জারাকে, কেননা কবি-শিল্পী মহলে প্রতিশীল্পের জনক হিসাবে ত্রিস্তঁ জারা খ্যাতি পাচ্ছিলেন। আঁদ্রে ব্রেতঁ সুররিয়ালিজম তত্বটির একমাত্র ব্যাখ্যাকারী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে আরম্ভ করেন। ১৯১৯ সালে ত্রিস্তঁ জারাকে কিন্তু ব্রেতঁ চিঠি লিখে প্যারিসে আসতে বলেছিলেন । একইভাবে ‘হাংরি’ শব্দটি মলয় রায়চৌধুরী পেয়েছিলেন কবি জিওফ্রে চসার থেকে । এই ‘হাংরি’ শব্দটি নেয়ার জন্য মলয় রায়চৌধুরীকে যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, তেমন কিছুই করা হয়নি আঁদ্রে ব্রেতঁ ও ত্রিস্তঁ জারা সম্পর্কে । মলয় রায়চৌধুরী হাংরি জেনারেশন আন্দোলন ঘোষণা করেন ১৯৬৫ সালের পয়লা নভেম্বর একটি লিফলেট প্রকাশের মাধ্যমে ।

পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে, প্রথম থেকেই, আঁদ্রে ব্রেতঁ’র সঙ্গে অনেক পরাবাস্তববাদীর সদ্ভাব ছিল না, কিন্তু পরাবাস্তববাদ বিশ্লেষণের সময়ে আলোচকরা তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন না । আমরা যদি বাঙালি আলোচকদের কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখব যে তাঁরা হাংরি জেনারেশন বা ক্ষুধার্ত আন্দোলন বিশ্লেষণ করার সময়ে হাংরি জেনারেশনের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে অত্যধিক চিন্তিত, হাংরি আন্দোলনকারীদের সাহিত্য অবদান নিয়ে নয় । ব্যাপারটা বিস্ময়কর নয় । তার কারণ অধিকাংশ আলোচক হাংরি জেনারেশনের সদস্যদের বইপত্র সহজে সংগ্রহ করতে পারেন না এবং দ্বিতীয়ত সাংবাদিক-আলোচকদের কুৎসাবিলাসী প্রবণতা । 

আঁদ্রে ব্রেতঁ তাঁর বন্ধু পল এলুয়ার, বেনিয়ামিন পেরে, মান রে, জাক বারোঁ, রেনে ক্রেভালl, রোবের দেসনস, গিয়র্গে লিমবোর, রোজের ভিত্রাক, জোসেফ দেলতিল, লুই আরাগঁ ও ফিলিপে সুপোকে নিয়ে ১৯১৯ পরাবাস্তববাদ আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন । কিছুকাল পরে, রাজনৈতিক ভাবাদর্শের কারণে তাঁর সঙ্গে লুই আরাগঁর ঝগড়া বেধে গিয়েছিল । মার্সেল দ্যুশঁ,  ত্রিস্তঁ জারা এবং আঁদ্রে ব্রেতঁ, উভয়ের সঙ্গেই ছিলেন, এবং দুটি দলই তাঁকে গুরুত্ব দিতেন, দ্যুশঁ’র অবাস্তব ও অচিন্ত্যনীয় ভাবনার দরুন।

পরাবাস্তব আন্দোলনের আগে জুরিখে ডাডাবাদী আন্দোলন আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল এবং আঁদ্রে ব্রেতঁ পরাবাস্তববাদের অনুপ্রেরণা পান ডাডা আন্দোলনের পুরোধা ত্রিস্তঁ জারার কাছ থেকে, কিন্তু ব্রেতঁ চিরকাল তা অস্বীকার করে্ছেন । ডাডা ছিল শিল্পবিরোধী আভাঁ গার্দ আন্দোলন ; অবশ্য প্রতিশিল্পও তো শিল্প । ডাডাবাদের রমরমার কারণে ত্রিস্তঁ জারার সঙ্গে ব্রেতঁর সম্পর্ক দূষিত হয়ে যায় ; একজন অন্যজনের নেতৃত্ব স্বীকার করতে চাইতেন না । ডাডা (/ˈdɑːdɑː/) বা ডাডাবাদ (দাদাবাদ নামেও পরিচিত) ছিল ২০ শতকের ইউরোপীয় ভিন্নচিন্তকদের একটি সাহিত্য-শিল্প আন্দোলন, যার প্রাথমিক কেন্দ্র ছিল সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ক্যাবারে ভলতেয়ার ( ১৯১৬ নাগাদ ) এবং নিউ ইয়র্কে (প্রায় ১৯১৫ নাগাদ)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় ডাডা আন্দোলন গড়ে ওঠে সেইসব শিল্পীদের নিয়ে, যাঁরা পুঁজিবাদী সমাজের যুক্তি, কারণ বা সৌন্দর্যের ধারণা মানতেন না, বরং তাঁদের কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন আপাত-অর্থহীন, উদ্ভট, অযৌক্তিক এবং বুর্জোয়া-বিরোধী প্রতিবাদী বক্তব্য । আন্দোলনটির শিল্পচর্চা প্রসারিত হয়েছিল দৃশ্যমান, সাহিত্য ও শব্দ মাধ্যমে, যেমন- কোলাজ, শব্দসঙ্গীত, কাট-আপ লেখা, এবং ভাস্কর্য। ডাডাবাদী শিল্পীরা হানাহানি, যুদ্ধ এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন এবং গোঁড়া বামপন্থীদের সাথে তাঁদের রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল।

যুদ্ধ-পূর্ববর্তী প্রগতিবাদীদের মধ্যেই ডাডার শিকড় লুকিয়ে ছিল। শিল্পের সংজ্ঞায় পড়েনা এমন সব সৃষ্টিকর্মকে চিহ্নিত করার জন্য ১৯১৩ সালে “প্রতি-শিল্প” শব্দটি চালু করেছিলেন মার্সেল দ্যুশঁ । কিউবিজম এবং কোলাজ ও বিমূর্ত শিল্পের অগ্রগতিই হয়তো ডাডা আন্দোলনকে বাস্তবতার গন্ডী থেকে বিচ্যুত হতে উদ্বুদ্ধ করে। আর শব্দ ও অর্থের প্রথানুগত সম্পর্ক প্রত্যাখ্যান করতে ডাডাকে প্রভাবিত করে ইতালীয় ভবিষ্যতবাদী এবং জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টগণ । আলফ্রেড জ্যারির উবু রোই (১৮৯৬) এবং এরিক স্যাটির প্যারেড (১৯১৬-১৭) প্রভৃতি লেখাগুলোকে ডাডাবাদী রচনার আদিরূপ বলা যেতে পারে।  ডাডা আন্দোলনের মূলনীতিগুলো প্রথম সংকলিত হয় ১৯১৬ সালে হুগো বলের ডাডা ম্যানিফেস্টোতে। এই ম্যানিফেস্টোর প্রভাবে পরবর্তিকালে ব্রেতঁ সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টো লিখতে অনুপপ্রাণিত হন — এই কথা শুনতে ব্রেতঁ’র ভালো লাগত না এবং সেকারণে তিনি বহু সঙ্গীকে এক-এক করে আন্দোলন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন । তাছাড়া ব্রেতঁ মনে করতেন ডাডাবাদীরা নৈরাজ্যবাদী বা অ্যানার্কিস্ট, যখন কিনা তিনি একজন কমিউনিস্ট ।

ডাডা আন্দোলনে ছিল জনসমাবেশ, মিছিল ও সাহিত্য সাময়িকীর প্রকাশনা; বিভিন্ন মাধ্যমে শিল্প, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি নিয়ে তুমুল আলোচনা হতো। আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিত্বরা ছিলেন হুগো বল, মার্সেল দ্যুশঁ, এমি হেনিংস, হানস আর্প, রাউল হাউসম্যান, হানা হৌক, জোহান বাডার, ত্রিস্তঁ জারা, ফ্রান্সিস পিকাবিয়া, রিচার্ড হিউলসেনব্যাক, জর্জ গ্রোস, জন হার্টফিল্ড, ম্যান রে, বিয়াট্রিস উড, কার্ট শ্যুইটার্স, হানস রিখটার এবং ম্যাক্স আর্নেস্ট। অন্যান্য  আন্দোলন, শহরতলীর গান এসবের পাশাপাশি পরাবাস্তববাদ, নব্য বাস্তবতা, পপ শিল্প এবং ফ্লক্সেস প্রভৃতি গোষ্ঠীগুলোও ডাডা আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এই আন্দোলনের অনেকে সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ।

পরাবাস্তববাদ আন্দোলনে যাঁরা ব্রেতঁর সঙ্গে একে-একে যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম হলেন ফিলিপে সুপো, লুই আরাগঁ, পল এলুয়ার, রেনে ক্রেভাল, মিশেল লেইরিস, বেনিয়ামিন পেরে, অন্তনাঁ আতো,জাক রিগো, রবের দেসনস, ম্যাক্স আর্নস্ত প্রমুখ । এঁদের অনেকে ডাডাবাদী আন্দোলন ত্যাগ করে পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯২৩ সালে যোগ দেন চিত্রকর আঁদ্রে মাসোঁ ও ইভস তাঙ্গুই । ১৯২১ সালে ভিয়েনায় গিয়ে ফ্রয়েডের সঙ্গে দেখা করেন ব্রেতঁ । ফ্রয়েডের ধারণাকে তিনি সাহিত্য ও ছবি আঁকায় নিয়ে আসতে চান । ফ্রয়েডের প্রভাবে ব্রেতঁ বললেন, সুররিয়ালিজমের মূলকথা হল অবচেতনমনের ক্রিয়াকলাপকে উদ্ভট ও আশ্চর্যকর সব রূপকল্প দ্বারা প্রকাশ করা। ডাডাবাদীরা যেখানে চেয়েছিলেন প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করে মানুষকে এমন একটি নান্দনিক দৃষ্টির অধিকারী করতে যার মাধ্যমে সে ভেদ করতে পারবে ভণ্ডামি ও রীতিনীতির বেড়াজাল, পৌঁছাতে পারবে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্যে; সেখানে পরাবাস্তববাদ আরো একধাপ এগিয়ে বলল, প্রকৃত সত্য কেবলমাত্র অবচেতনেই বিরাজ করে। পরাবাস্তববাদী শিল্পীর লক্ষ্য হল তার কৌশলের মাধ্যমে সেই সত্যকে ব্যক্তি-অস্তিত্বের গভীর থেকে তুলে আনা। 

সুররিয়ালিজমের প্রথম ইশতেহার প্রকাশ করেন ইয়ান গল। এ ইশতেহারটি ১৯২৪ সালের ১ অক্টোবর প্রকাশিত হয়। এর কিছুদিন পরেই ১৫ অক্টোবর আঁদ্রে ব্রেতঁ সুররিয়ালিজমের দ্বিতীয় ইশতেহারটি প্রকাশ করেন। তিনি ১৯৩০ সালে এ ধারার তৃতীয় ইশতেহারটিও প্রকাশ করেন। ইয়ান গল ও আঁদ্রে ব্রেতঁ—দুজনে দু দল সুররিয়ালিস্ট শিল্পীর নেতৃত্ব দিতেন। ইয়ান গলের নেতৃত্বে ছিলেন ফ্রান্সিস পিকাবিয়া, ত্রিস্তঁ জারা, মার্সেল আর্লেন্ড, জোসেফ ডেলটিল, পিয়েরে অ্যালবার্ট বিরোট প্রমুখ। আন্দ্রে ব্রেতঁর নেতৃত্বে ছিলেন লুই আরাগঁ, পল এলুয়ায়, রোবের ডেসনোস, জ্যাক বারোঁ, জর্জ ম্যালকিন প্রমুখ। এ দুটি দলেই ডাডাইজম আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ ছিলেন। অবশ্য ইয়ান গল ও আন্দ্রে ব্রেতঁ এই আন্দোলন নিয়ে প্রকাশ্য-রেশারেশিতে জড়িয়ে পড়েন। তখন থেকেই পরাবাস্তববাদীরা ছোটো-ছোটো গোষ্ঠীতে বিভাজিত হতে থাকেন, যদিও তাঁদের শিল্প ও সাহিত্যধারা ছিল একই । পরে আন্দোলনে যোগ দেন জোয়ান মিরো, রেমণ্ড কোয়েনু, ম্যাক্স মোরিজ, পিয়ের নাভিল, জাক আঁদ্রে বোইফার, গেয়র্গে মালকাইন প্রমুখ । জিয়োর্জিও দে চিরোকো এবং পাবলো পিকাসো অনেক সময়ে গোষ্ঠির কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন, তবে আন্দোলনের ঘোষিত সদস্য ছিলেন না।

সুররিয়ালিজম বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ডাডাইজম থেকে নিলেও এই মতবাদটি, যে,  ‘শিল্পের উৎস ও উপকরণ’ বিবেচনায় একটি অন্যটির চেয়ে স্বতন্ত্র্য। সুররিয়ালিজম আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন ফরাসি কবি আঁদ্রে ব্রেতঁ। তিনি শিল্প রচনায় ‘অচেতন মনের ওপর গুরুত্ব’ দেওয়ার জন্যে শিল্পীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি মনে করতেন, ‘অচেতন মন হতে পারে কল্পনার অশেষ উৎস।’ তিনি অচেতন মনের ধারণাটি নিঃসন্দেহে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। ডাডাবাদী শিল্পীরা শিল্পের উৎস ও উপকরণ আহরণে ‘অচেতন’ মনের ধারণা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। সুররিয়ালিস্ট শিল্পীরা এসে অচেতন মনের উৎস থেকে শিল্প রচনার প্রতি গুরুত্ব দেন এবং সফলতাও লাভ করেন।

আঁদ্রে ব্রেতঁ মনে করতেন, ‘যা বিস্ময়কর, তা সবসময়ই সুন্দর’। অচেতন মনের গহীনেই বিস্ময়কর সুন্দরের বসবাস। তার সন্ধান করাই সাহিত্যিক-শিল্পীর যথার্থ কাজ। অচেতন মনের কারণেই সুররিয়ালিজমের কবি-শিল্পীরা গভীর আত্মঅনুসন্ধানে নামেন। মনের গহীন থেকে স্বপ্নময় দৃশ্যগুলো হাতড়ে বের করতে এবং মনের অন্তর্গত সত্য উন্মোচনে তাঁরা আগ্রহী ছিলেন। যার কারণে চেতন ও অচেতনের মধ্যে শিল্পীরা বন্ধন স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুররিয়ালিস্ট শিল্পীরা অচেতন মনের সেই সব উপলব্ধিকে দৃশ্যে রূপ দিলেন যা পূর্বে কেউ কখনো করেনি। অচেতনের ভূমিতে দাঁড়িয়ে বাস্তব উপস্থাপনের কারণে খুব দ্রুতই এ মতবাদটি বিশ্ব শিল্পকলায় ‘অভিনবত্ব’ যোগ করতে সমর্থ হয়। এমনকী, পুঁজিবাদ-বিরোধী এই আন্দোলন থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন বহু বিখ্যাত বিজ্ঞাপন কোম্পানি ।

সুররিয়ালিজমকে ‘নির্দিষ্ট’ ছকে ফেলা কঠিন। সুররিয়ালিস্ট শিল্পীরা একই ছাতার নিচে বসবাস করে ছবি আঁকলেও এবং কবিতা লিখলেও, তাঁদের দৃষ্টি ও উপলব্ধির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ফলে এ মতবাদটি সম্পর্কে প্রত্যেকে ব্যাক্তিগত ভাবনা ভেবেছেন। ১৯২৯ সালে সালভাদর দালি এই আন্দোলনে যোগ দেন, যদিও তাঁর সঙ্গেও ব্রেতঁর বনিবনা হতো না । সালভাদর দালি মনে করতেন, ‘সুররিয়ালিজম একটি ধ্বংসাত্মক দর্শন এবং এটি কেবল তা-ই ধ্বংস করে যা দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রাখে।’ অন্যদিকে জন লেলন বলেছেন, ‘সুররিয়ালিজম আমার কাছে বিশেষ প্রভাব নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। কেননা, আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমার কল্পনা উন্মাদনা নয়। বরং সুররিয়ালিজমই আমার বাস্তবতা।’ ব্রেতোঁ বলতেন, ‘ভাবনার যথাযথ পদ্ধতি অনুধাবনের জন্যে সুররিয়ালিজম আবশ্যক।’ এ ধারায় স্বপ্ন ও বাস্তবতার মিশ্রণ হয় বলে সুররিয়ালিজমকে স্বপ্নবাস্তবতাও বলা হয়ে থাকে।

সুররিয়ালিজমের ঢেউ খুব অল্প সময়েই শিল্পের সবগুলো শাখায় আছড়ে পড়ে। কবিতা, গান থেকে শুরু করে নাটক, সিনেমা পর্যন্ত সুররিয়ালিস্টদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত সুররিয়ালিজম ধারায় অন্তত ছয়টি সিনেমা নির্মিত হয়। এ ধারার প্রধান শিল্পীরা হলেন জ্যাঁ আর্প, ম্যাক্স আর্নেস্ট, আঁদ্রে মেসন, সালভাদর দালি, রেনে ম্যাগরেট, পিয়েরো রয়, জোয়ান মিরো, পল ডেলভাক্স, ফ্রিদা কাহলো প্রমুখ। এ ধারার চিত্রকর্মের মধ্যে ১৯৩১ সালে আঁকা সালভাদর দালির ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’ সবচেয়ে আলোচিত ছবি। এটি কেবল এ ধারার মধ্যেই আলোচিত চিত্রকর্মই নয়, এটি দালিরও অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভার নিদর্শন। ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’-তে দালি ‘সময়ের’ বিচিত্র অবস্থাকে ফ্রেমবন্দি করতে চেষ্টা করেছেন। ‘মেটামরফসিস অব নার্সিসাস’, ‘নভিলিটি অব টাইম’, ‘প্রোফাইল অব টাইম’ প্রভৃতি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

সুররিয়ালিজম ধারার প্রধানতম চিত্রকর্মের মধ্যে রেনে ম্যাগরেটের ‘দ্য সন অব ম্যান’, ‘দিস ইজ নট এ পাইপ’, জর্জিও দি চিরিকো-এর ‘দ্য রেড টাওয়ার’, ম্যাক্স আর্নেস্টের ‘দি এলিফ্যান্ট সিলিবেস’, ইভ তঁগির ‘রিপ্লাই টু রেড’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে সুররিয়ালিজম আন্দোলন থেমে যায়। শিল্পবোদ্ধারা মনে করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের মধ্য দিয়ে এ আন্দোলনটির অনানুষ্ঠানিক মৃত্যু ঘটে। কিন্তু অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্প আন্দোলনের মতো সুররিয়ালিজমের চর্চা বর্তমানেও হচ্ছে। বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনেও সুররিয়ালিজমের প্রভাব লক্ষ করা যায়।  ১৯২৪ সালে প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টো । মার্কসবাদের সঙ্গে আর্তুর র‌্যাঁবোর আত্মপরিবর্তনের ভাবনাকে একত্রিত করার উদ্দেশে ব্রেতঁ ১৯২৭ সালে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন । কিন্তু সাম্যবাদীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বেশিদিন টেকেনি । সেখান থেকেও তিনি ১৯৩৩ সালে বিতাড়িত হন । পরাবাস্তববাদীদের “উন্মাদ প্রেম” তত্বটি ব্রেতঁর এবং “উন্মাদ প্রেম” করার জন্য বেশ কিছু তরুণী সুররিয়ালিস্টদের প্রতি আকৃষ্ট হন । যৌনতার স্বেচ্ছাচারিতার ঢেউ ওঠে সাহিত্যিক ও শিল্পী মহলে ; পরাবাস্তববাদীদের নামের সঙ্গে একজন বা বেশি নারীর সম্পর্ক ঘটে এবং সেই নারীরা তাঁদের পুরুষ প্রেমিকদের নামেই খ্যাতি পেয়েছেন । 

তাঁর রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং অন্যান্য কারণে প্রেভের, বারোঁ, দেসনস, লেইরিস, লিমবোর, মাসোঁ, কোয়েন্যু, মোরিস, বোইফার সম্পর্কচ্ছদ করেন ব্রেতঁর সঙ্গে এবং গেয়র্গে বাতাইয়ের নেতৃত্বে পৃথক গোষ্ঠী তৈরি করেন । এই সময়েই, ১৯২৯ নাগাদ, ব্রেতঁর গোষ্ঠীতে যোগ দেন সালভাদর দালি, লুই বুনুয়েল, আলবের্তো জিয়াকোমেত্তি, রেনে শার এবং লি মিলার । ত্রিস্তঁ জারার সঙ্গে ঝগড়া মিটমাট করে নেন ব্রেতঁ । দ্বিতীয় সুররিয়ালিস্ট ইশতাহার প্রকাশের সময়ে তাতে সই করেছিলেন আরাগঁ, আর্নস্ট, বুনুয়েল, শার, ক্রেভাল, দালি, এলুয়ার, পেরে, টাঙ্গুই, জারা, ম্যাক্সিম আলেকজান্দ্রে, জো বনসকোয়েত, কামিলে গোয়েমানস, পল নুগ, ফ্রান্সিস পোঙ্গে, মার্কো রিসটিচ, জর্জ শাদুল, আঁদ্রে তিরিয়ঁ এবং আলবেয়ার ভালেনতিন । ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকা বন্ধু ছিলেন সালভাদর দালি এবং লুই বুনুয়েলের, আলোচনায় অংশ নিতেন, কিন্তু সুররিয়ালিস্ট গোষ্ঠিতে যোগ দেননি । ১৯২৯ সালে তাঁর মনে হয়েছিল যে দালি আর বুনুয়েলের ফিল্ম “একটি আন্দালুসিয় কুকুর” তাঁকে আক্রমণ করার জন্যে তৈরি হয়েছিল ; সেই থেকে তিনি সুররিয়ালিস্টদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন । আরাগঁ ও জর্জ শাদুল ব্রেতঁ’র গোষ্ঠী ত্যাগ করেছিলেন রাজনৈতিক মতভেদের কারণে, যদিও ব্রেতঁ বলতেন যে তিনিই ওনাদের তাড়িয়েছেন ।

১৯৩০ সালে কয়েকজন পরাবাস্তববাদী আঁদ্রে ব্রেতঁ’র একচেটিয়া নেতৃত্বে বিরক্ত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে একটি প্যামফ্লেট ছাপিয়েছিলেন । পরাবাস্তববাদ আন্দোলন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় । ১৯৩৫ সালে ব্রেতঁ এবং সোভিয়েত লেখক ও সাংবাদিক ইলিয়া এরেনবার্গের মাঝে ঝগড়া এমন স্তরে গিয়ে পৌঁছোয় যে প্যারিসের রাস্তায় তাঁদের দুজনের হাতাহাতি আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল । এরেনবার্গ একটি পুস্তিকা ছাপিয়ে বলেছিলেন যে পরাবাস্তববাদীরা পায়ুকামী । এর ফলে পরাবাস্তববাদীদের ইনটারন্যাশানাল কংগ্রেস ফর দি ডেফেন্স অফ কালচার সংস্হা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল । সালভাদর দালি বলেছিলেন যে পরাবাস্তববাদীদের মধ্যে প্রকৃত সাম্যবাদী হলেন একমাত্র রেনে ক্রেভাল । চটে গিয়ে ক্রেভালকে পরাবাস্তববাদী আন্দোলন থেকে বের করে দ্যান ব্রেতঁ । অঁতনা অতো, ভিত্রাক এবং সুপোকে পরাবাস্তববাদী দল থেকে বের করে দ্যান ব্রেতঁ, মূলত সাম্যবাদের প্রতি ব্রেতঁর আত্মসমর্পণের কারণে এই তিনজন বিরক্ত বোধ করেন ।

১৯৩৮ সালে ব্রেতঁ মেকসিকো যাবার সুযোগ পান এবং লিও ট্রটস্কির সঙ্গে দেখা করেন । তাঁর সঙ্গে ছিলেন দিয়েগো রিভেরা ও ফ্রিদা কালহো । ট্রটস্কি এবং ব্রেতঁ একটা যুক্ত ইশতাহার প্রকাশ করেছিলেন, “শিল্পের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা” শিরোনামে । লুই আরাগঁর সঙ্গেও ব্রেতঁর সম্পর্ক ভালো ছিল না । ১৯১৯ থেকে ১৯২৪ পর্যন্ত ডাডাবাদীদের সঙ্গে আন্দোলন করার পর ১৯২৪ সালে আরাগঁ যোগ দেন পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে । অন্যান্য ফরাসী পরাবাস্তববাদীদের সঙ্গে তিনিও ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দ্যান এবং পার্টির পত্রিকায় কলাম ও রাজনৈতিক কবিতা লিখতেন । আরাগঁর সঙ্গে ব্রেতঁর বিবাদের কারণ হল ব্রেতঁ চেয়েছিলেন ট্রটস্কির সঙ্গী ভিকতর সার্জকে সন্মানিত করতে । পরবর্তীকালে, ১৯৫৬ নাগাদ, সোভিয়েত রাষ্ট্র সম্পর্কে নিরাশ হন আরাগঁ, বিশেষ করে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিংশ কংগ্রেসের পর যখন নিকিতা ক্রুশ্চভ আক্রমণ করেন জোসেফ স্তালিনের ব্যক্তিত্ববাদকে । তা সত্ত্বেও স্তালিনপন্হী আরাগঁ ও ট্রটস্কিপন্হী ব্রেতঁর কখনও মিটমাট হয়নি । কাট-আপ কবিতার জনক ব্রায়ন জিসিনকেও গোষ্ঠী থেকে বিতাড়ন করেন ব্রেতঁ ; ব্রায়ান জিসিনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছিলেন বিট ঔপন্যাসিক উইলিয়াম বারোজ । বিট আন্দোলনের প্রায় সকলেই সুররিয়ালিজম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । বিটদের যৌন স্বাধীনতার ভাবনা-চিন্তায় সুররিয়ালিস্টদের অবদান আছে ।

পরাবাস্তববাদই সম্ভবত প্রথম কোনো গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন, যেখানে নারীকে দূরতম কোনো নক্ষত্রের আলোর মতো, প্রেরণা ও পরিত্রাণের মতো, কল্পনার দেবী প্রতিমার মতো পবিত্র এক অবস্থান দেওয়া হয়েছিল। নারী তাদের চোখে একই সঙ্গে পবিত্র কুমারী, দেবদূত আবার একই সঙ্গে মোহিনী জাদুকরী, ইন্দ্রিয় উদ্দীপক ও নিয়তির মতো অপ্রতিরোধ্য। ১৯২৯ সালে দ্বিতীয় সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টোয় আদ্রেঁ ব্রেতঁ নারীকে এরকম একটি অপার্থিব অসীম স্বপ্নিল চোখে দেখা ও দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। পুরুষ শিল্পীদের প্রেরণা, উদ্দীপনা ও কল্পনার সুদীর্ঘ সাম্পান হয়ে এগিয়ে আসবেন নারীরা। হয়ে উঠবেন পুরুষদের আরাধ্য ‘মিউজ’ আর একই সঙ্গে femme fatale। সুদৃশ্য উঁচু পূজার বেদি উদ্ভাসিত করে যেখানে বসে থাকবেন নারীরা। তাঁদের স্বর্গীয় প্রাসাদে আরো সৃষ্টিশীল হয়ে উঠবে পুরুষ।

ব্রেতঁ ছিলেন সেই সময়ের কবিতার অন্যতম প্রধান পুরুষ। তাঁর সম্মোহক ব্যক্তিত্বে আচ্ছন্ন হননি তাঁর সান্নিধ্যে এসেও – এরকম কোনো দৃষ্টান্ত কোথাও নেই। উজ্জ্বল, সাবলীল, মেধাবী, স্বতঃস্ফূর্ত এবং নায়কসুলভ ব্রেতঁ একই সঙ্গে ছিলেন উদ্ধত, আক্রমণাত্মক ও অহমিকাপূর্ণ। নিজের তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে মাঝেমধ্যেই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যেতেন। কিন্তু যদি তাঁর একবার মনে হতো যে কেউ তাঁর প্রভুত্বকে অগ্রাহ্য করছে, সর্বশক্তি দিয়ে তাকে আঘাত করতেন। নেতৃত্ব দেওয়ার সব গুণ প্রকৃতিগতভাবেই ছিল তাঁর মধ্যে। মহিলাদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল তরুণ প্রেমিকের মতো সম্ভ্রমপূর্ণ। তাঁর আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি, অভিজাত ভাষা – এসবের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই মেজাজ হারিয়ে সম্পূর্ণ লাগামহীন হয়ে পড়া আর দুর্বোধ্য জটিল মানসিকতার জন্য পারতপক্ষে অনেকেই ঘাঁটাতে চাইতেন না তাঁকে।

নারী পরাবাস্তববাদীদের সংখ্যা কম ছিল না । কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে উল্লেখ্য ফ্রিদা কাহলো, আসে বার্গ, লিজে দেহামে, আইরিন হামোয়ের, জয়েস মানসোর, ওলগা ওরোজকো, আলেহান্দ্রা পিৎসারনিক, ভ্যালেনটিন পেনরোজ, জিসেল প্রাসিনস, ব্লাঙ্কা ভারেলা, ইউনিকা জুর্ন প্রমুখ । নারী চিত্রকররা সংখ্যায় ছিলেন বেশি । তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য গেরট্রুড আবেরকমবি, মারিয়ন আদনামস, আইলিন ফরেসটার আগার, রাশেল বায়েস, ফ্যানি ব্রেনান, এমি ব্রিজওয়াটার, লেনোরা ক্যারিংটন, ইথেল কলকুহুন, লেনোর ফিনি, জেন গ্রাভেরোল, ভ্যালেনটিন য়োগো, ফ্রিদা খাহলো, রিটা কার্ন-লারসেন, গ্রেটা নুটসন ( ত্রিস্তঁ জারার স্ত্রী ), জাকেলিন লামবা ( আঁদ্রে ব্রেতঁ’র স্ত্রী), মারুহা মালো, মার্গারেট মডলিন, গ্রেস পেইলথর্প, অ্যালিস রাহোন, এডিথ রিমিঙটন, পেনিলোপি রোজমন্ট, কে সেজ ( ইভস তাঙ্গুইর স্ত্রী ), ইভা স্বাঙ্কমাজেরোভা, ডরোথি ট্যানিঙ ( ম্যাক্স আর্নস্টের স্ত্রী ), রেমেদিওস ভারো ( বেনিয়ামিন পেরের স্ত্রী ) প্রমুখ । ভাস্করদের মধ্যে উল্লেখ্য এলিজা ব্রেতঁ ( আঁদ্রে ব্রেতঁ’র তৃতীয় স্ত্রী ), মেরে ওপেনহাইম ( মান রে’র মডেল ছিলেন ) এবং মিমি পারেন্ট । ফোটোগ্রাফারদের মধ্যে উল্লেখ্য ছিলেন ক্লদ কাহুন, নুশ এলুয়ার, হেনরিয়েতা গ্রিনদাত, আইডা কার, দোরা মার ( পাবলো পিকাসোর সঙ্গে নয় বছর লিভ টুগেদার করেছিলেন ), এমিলা মেদকোভা, লি মিলার, কাতি হোরনা প্রমুখ । পুরুষ পরাবাস্তববাদীদের বহু ফোটো এই নারী ফোটোগ্রাফারদের কারণেই ইতিহাসে স্হান পেয়েছে ।

নারীদের নিয়ে পরাবাস্তববাদীদের এই স্বপ্নিল কাব্যময় উচ্ছ্বাস জোরালো একটা ধাক্কা খেল যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পশ্চিম ইউরোপে দ্রম্নত বদলাতে থাকা পরিস্থিতির ভস্ম ও শোণিত স্নাত শোণিত আত্মশক্তিসম্পন্ন নারীরা তাঁদের ভারী বাস্তবতা নিয়ে এসে দাঁড়ালেন সামনে। স্বপ্নে দেখা নারীর আয়না-শরীর ভেঙে পড়ল ঝুরঝুর করে আর বেরিয়ে এলো মেরুদ-সম্পন্ন রক্তমাংসের মানবী। সুররিয়ালিজম চেয়েছিল পুরুষের নিয়ন্ত্রণে নারীদের মুক্তি। কিন্তু যে গভীর অতলশায়ী মুক্তি দরজা খুলে দিলো নারীদের জন্য, সুররিয়ালিজম তার জন্য তৈরি ছিল না। মৃত অ্যালবাট্রসের মতো এই বিমূর্ত আদর্শায়িত ধারণা নারী শিল্পীদের গলায় ঝুলে থেকেছে, যাকে ঝেড়ে ফেলে নিজস্ব শিল্পসত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করা দুঃসাধ্য ছিল। সময় লেগেছে সাফল্য পেতে। কিন্তু দিনের শেষে হেসেছিলেন তাঁরাই। এমন নয় যে, পরাবাস্তবতার প্রধান মশালবাহক ব্রেতঁ চাইছিলেন যে পুরুষরাই হবেন এই আন্দোলনের ঋত্বিক আর দ্যুতিময় নারী শিল্পী এবং সাহিত্যিকদের কাজ হবে মুগ্ধ সাদা পালক ঘাসের ওপরে ফেলে যাওয়া এবং আকর্ষণীয় ‘গুজব’ হিসেবে সুখী থাকা। ১৯২৯ সালে দ্বিতীয় সুররিয়ালিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রকাশের পরবর্তী প্রদর্শনীগুলোতে নারী শিল্পীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু পুরুষ উদ্ভাবিত পরাবাস্তবতা থেকে তাঁদের ভাষা, স্বর ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বতন্ত্র। নিজেদের ভারী অসিত্মত্ব, শরীরী উপস্থিতি জোরালোভাবে জায়গা পেল তাঁদের ছবিতে।

কিন্তু নারী শিল্পীদের কাছে আত্মপ্রতিকৃতি হয়ে উঠল একটি সশস্ত্র ভাষার মতো। নিজস্ব গোপন একটি সন্ত্রাসের মতো। এই আন্দোলনের মধ্যে নারীরা এমন এক পৃথিবীর ঝলক দেখলেন, যেখানে আরোপিত বিধিনিষেধ না মেনে সৃজনশীল থাকা যায়, দমচাপা প্রতিবাদের ইচ্ছেগুলোর উৎস থেকে পাথরের বাঁধ সরিয়ে দেওয়া যায়। নগ্ন ও উদ্দাম করা যায় কল্পনাকে। নোঙর নামানো জাহাজের মতো অনড় ও ঠাসবুনট একটি উপস্থিতি হয়ে ছবিতে নিজের মুখ তাঁদের কাছে হয়ে উঠল অন্যতম প্রধান আইকন। যে ছবি আত্মপ্রতিকৃতি নয়, সেখানেও বারবার আসতে থাকল শিল্পীর শরীরী প্রতিমা। ফ্রিদা কাহ্লোর (১৯০৭-৫৪) ক্যানভাস তাঁর যন্ত্রণাবিদ্ধ শান্ত মুখশ্রী ধরে রাখল। মুখের বিশেষ কিছু চিহ্ন যা তাঁকে চেনায় – যেমন পাখির ডানার মতো ভুরু, আমন্ড আকারের চোখ ছবিতেও আনলেন তিনি। রিমেদিওস ভারোর (১৯০৮-৬৩) ছবিতে পানপাতার মতো মুখ, তীক্ষন নাক, দীর্ঘ মাথাভর্তি চুলের নারীর মধ্যে নির্ভুল চেনা গেল শিল্পীকে। আবার লিওনর ফিনির (১৯১৮-৯৬) আঁকা নারীরা তাদের বেড়ালের মতো কালো চোখ আর ইন্দ্রিয়াসক্ত মুখ নিয়ে হয়ে উঠল ফিনিরই চেনা মুখচ্ছবি। ১৯৩৯ সালের ‘The Alcove : An interior with three women’ ছবিতে ভারী  পর্দা টাঙানো ঘরে দুজন অর্ধশায়িত মহিলা পরস্পরকে ছুঁয়ে আছেন। আর একজন মহিলা দাঁড়িয়ে। তিনজনেই যেন কোনো কিছুর প্রতীক্ষা করছেন চাপা উদ্বিগ্ন মুখে। যে তিনজন নারীর ছবি, তাঁরা যে লিওনর ফিনি, লিওনারা ক্যারিংটন এবং ইলিন অগার – এটা ছবিটিকে একঝলক দেখেই চেনা যায়। এমনকি যখন অন্য কোনো নারীর প্রতিকৃতি আঁকছেন তাঁরা, সেখানেও তাঁদের বিদ্রোহের অস্বীকারের জোরালো পাঞ্জার ছাপ এই শিল্পীরা সেইসব নারীর মুখে ঘন লাল নিম্নরেখা দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হতে ১৯৩৯ সালে অধিকাংশ পরাবাস্তববাদী বিদেশে পালিয়ে যান এবং তাঁদের মধ্যে আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও বক্তব্য নিয়ে খেয়োখেয়ি বেধে যায় । অলোচকরা মনে করেন যে গোষ্ঠী হিসাবে পরাবাস্তববাদ ১৯৪৭ সালে ভেঙে যায়, প্যারিসে “লে সুররিয়ালিজমে” প্রদর্শনীর পর । যুদ্ধের শেষে, প্যারিসে ব্রেতঁ ও মার্সেল দ্যুশঁ’র ফিরে আসার পর প্রদর্শনীর কর্তারা সম্বর্ধনা দিতে চাইছিলেন কিন্তু পুরোনো পরাবাস্তববাদীরা জানতে পারলেন যে একদল যুবক পরাবাস্তববাদীর আবির্ভাব হয়েছে, যাঁরা বেশ ভিন্ন পথ ধরে এগোতে চাইছেন । যুবকদের মধ্যে উল্লেখ্য ছিলেন ফ্রাঁসিস বেকঁ, আলান দাভি, এদুয়ার্দো পোলোৎসি, রিচার্ড হ্যামিলটন প্রমুখ ।

সুররিয়ালিজমের উদ্ভব সত্ত্বেও ডাডার প্রভাব কিন্তু ফুরিয়ে যায়নি, তা প্রতিটি দশকে কবর থেকে লাফিয়ে ওঠে, যেমন আর্পের বিমূর্ততা, শুইটারের নির্মাণ, পিকাবিয়ার টারগেট ও স্ট্রাইপ এবং দ্যুশঁ’র রেডিমেড বস্তু বিশ শতকের শিল্পীদের কাজে ও আন্দোলনে ছড়িয়ে পড়ছিল । স্টুয়ার্ট ডেভিসের বিমূর্ততা থেকে অ্যান্ডি ওয়ারহলের পপ আর্ট, জাসপার জনসের টারগেট ও ফ্ল্যাগ থেকে রবার্ট রাউশেনবার্গের কোলাঝে — সমসাময়িক সাহিত্য ও শিল্পের যেদিকেই তাকানো হোক পাওয়া যাবে ডাডার প্রভাব, সুররিয়ালিজমের উপস্হিতি । ১৯৬৬ সালে মৃত্যুর আগে, ব্রেতঁ লিখেছিলেন, “ডাডা আন্দোলনের পর আমরা মৌলিক কিছু করিনি । ডাডা ও সুররিয়ালিজম আন্দোলনকারীদের ওপর প্রচুর চাপ সৃষ্টি করেছিল এবং কয়েকজন আত্মহত্যা করেন, যেমন জাক রিগো, রেনে ক্রেভেল, আরশাইল গোর্কি, অসকার দোমিংগেজ প্রমুখ । অত্যধিক মাদক সেবনে মৃত্যু হয় গিলবার্ত লেকঁতে ও অঁতনা আতোর ।