সোমবার, ৭ আগস্ট, ২০২৩

অঁতনা আতো'র প্রগত্যাখ্যাত কবিতা সম্পর্কে মরিস ব্লাশোঁ

 অঁতনা আতো’র প্রত্যাখ্যাত কবিতা সম্পর্কে মরিস ব্লাশোঁ 

মলয় রায়চৌধুরীর 

এক

মরিস ব্লাশোঁ (  ২২ সেপ্টেম্বর ১৯০৭ – ২০ ফেব্রুয়ারি ২০০৩) ছিলেন একজন ফরাসি লেখক, দার্শনিক ও সাহিত্য সমালোচক। জিল দ্যলুজ, মিশেল ফুকো, জাক দেরিদা ও জঁ-ল্যুক নঁসির মতো উত্তর-গঠনবাদী দার্শনিকদের ওপর তার কাজের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। 

.

ব্লাশোঁ সম্পর্কে অধ্যাপক সুমিত চক্রবর্তী লিখেছেন, “ফরাসি দার্শনিক মরিস ব্লাঁশো তাঁর ‘স্পেস অব লিটারেচার’ প্রবন্ধে সাহিত্যিক বা লেখকের পরিসর বিষয়ে একটা ভারী চমৎকার চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। তিনি লিখছেন কী ভাবে সাহিত্যিক সর্বদাই রয়েছেন এক রকম নির্বাসনে। হেঁটে বেড়াচ্ছেন একটা জনহীন মরুভূমির ভিতর। এই মরুভূমিকে ব্লাঁশো বলছেন একটা ‘প্রিভিলেজড জ়োন’ যেখানে আর কেউ ঢুকতে পারছেন না। লেখকের নিভৃত এই পরিসরে রয়েছে শুধুমাত্র স্বাধীনতা আর একাকিত্ব। এই মরুভূমি ক্রমাগত হয়ে উঠছে লেখকের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। তিনি রয়ে যাচ্ছেন এই অজান্তে তৈরি হয়ে ওঠা একাকিত্বের সাম্রাজ্যে। আর তিনি যা লিখছেন? প্রতিটি শব্দ, বাক্য, চিন্তা লেখা হয়ে যাওয়া মাত্রই তা হয়ে উঠছে অন্য কোনও সত্তার প্রকাশ, শব্দ হয়ে পড়ছে শূন্যগর্ভ। লেখক নিজের কল্পনাকে, নিজের চিন্তাকে বেঁধে উঠতে পারছেন না তাঁরই লেখা শব্দের ভিতর। ক্রমাগত তৈরি হয়ে চলেছে লেখার সঙ্গে লেখকের অনিবার্য দূরত্ব। ব্লাঁশো বলছেন, সাহিত্যকর্মের নির্যাসকে সময়ের গ্রাস থেকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় এই দূরত্ব। লেখার উপজীব্য লুকিয়ে রয়েছে তার অদৃশ্য হওয়ার ভিতরে, লেখকের অদৃশ্য হওয়ার ভিতরে। এই শূন্যতাই জন্ম দেয় ‘টাইমলেস মাস্টারপিস’-এর।তার মানে কি লেখক কোনও সামাজিক জীব নন? তিনি কি প্রতি দিনের বাইরের এক জন মানুষ? নিশ্চয়ই তা নয়। এই প্রতি দিনের ভিতর থেকেই তিনি সংগ্রহ করছেন তাঁর চিন্তার রসদ, এখানেই ক্রমাগত বুনে চলেছেন তাঁর কল্পনার একান্ত জগৎ। তার পর কখন, অজান্তেই ঢুকে যাচ্ছেন তাঁর মরুভূমির ভিতর। এই যে মরুভূমির কথা ব্লাঁশো বলছেন, তা কিন্তু লেখকের স্বেচ্ছাকৃত নয়, এই পরিসর তৈরি হয়ে যাচ্ছে তাঁর অজান্তেই। ভিতর-বাহিরের বোধ তাঁর ভিতর তৈরি হচ্ছে না, ভিড় করে আসা শব্দেরা আপনা আপনিই তৈরি করে দিচ্ছে এই বিচ্ছেদ।”

.

দুই

নিজের তত্ব ব্লাশোঁ প্রয়োগ করেছেন অঁতনা আতো’র এক গুচ্ছ প্রত্যাখ্যাত কবিতার ক্ষেত্রে । ব্লাশোঁ লিখেছেন, “আতো’র বয়স যখন সাতাশ বছর তখন তিনি একটি পত্রিকায় কিছু কবিতা পাঠান। এই জার্নালের পরিচালক বিনয়ের সাথে সেগুলো প্রত্যাখ্যান করেন। আতো তারপর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন কেন তাঁর পক্ষপাত রয়েছে এই ত্রুটিপূর্ণ কবিতাগুলির প্রতি : কারণ তিনি চিন্তার এমন নির্জনতায় ভুগছেন যে তিনি তাঁর কেন্দ্রীয় অনস্তিত্ব থেকে ফর্মগুলোকে পরিত্যাগ করতে পারবেন না, তা যতই অপর্যাপ্ত হোক না কেন।

.

এইভাবে পাওয়া কবিতাগুলোর  মূল্য কী ? আতো ও সম্পাদকের চিঠির আদান-প্রদান হয়েছিল, এবং সম্পাদক জাক রিভিয়ে হঠাৎ করে এই অপ্রকাশ্য কবিতাগুলি সম্পর্কে আতোর লেখা চিঠিগুলি প্রকাশ করার প্রস্তাব দেন (কিন্তু এবার সম্পাদক জানান যে উদাহরণ  হিসাবে চিঠির সঙ্গে কবিতার অংশ তিনি প্রকাশ করবেন )। আতো তা মেনে নেন, এই শর্তে যে কবিতায় কোনও পরিবর্তন করা চলবে না। তার ফলে জাক রিভিয়ের সাথে আদান-প্রদান করা আতোর চিঠি আর কবিতা, যা এখন বিখ্যাত , তা এক মহান তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হয়ে উঠল । ব্লাশোঁ প্রশ্ন তুলেছেন, জাক রিভিয়ে কি এই অসঙ্গতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন? তিনি যখন কবিতাগুলোকে অপর্যাপ্ত এবং প্রকাশের অযোগ্য বলে বিবেচনা করেছিলেন, সেগুলি যখন তাদের অপ্রতুলতার অভিজ্ঞতার বর্ণনার সঙ্গে প্রকাশিত হলো, তখন তা আর প্রকাশের অযোগ্য রইলো না। যেন তাদের মধ্যে কী অভাব ছিল, তাদের ত্রুটি, এই অভাবের প্রকাশ্য অভিব্যক্তি এবং এর প্রয়োজনীয়তার যুক্তির দ্বারা কবিতাগুলো প্রয়োজনীয় পূর্ণতার ভিত্তি পেয়ে গেল। 

.

কাজ হিসাবে কবিতাগুলোর পরিবর্তে, যা কিনা নিশ্চিতভাবে কাজের অভিজ্ঞতা, এবং যে প্রক্রিয়া কবিতাগুলো রচনার দিকে কবিকে  নিয়ে গিয়েছিল, এবং অভিজ্ঞতার কথা শুনে, যা জাক রিভিয়েকে আগ্রহী করেছিল, তা রচনাগুলোর তখনও পর্যন্ত অনামা একজন কবির, আনাড়িভাবে লেখা, অস্পষ্ট ছাপ গড়ে তুলেছিল । আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ব্যর্থতা, যা আতোর প্রতি আলোচকদের  তখনও ততটা আকৃষ্ট করতে পারেনি, যতটা পরে কবিতা আর চিঠিগুলো সম্পর্কে যাঁরা লিখবেন এবং যাঁরা পড়বেন তাঁদের মনের একটি কেন্দ্রীয় ঘটনার উপলব্ধিযোগ্য লক্ষণ হয়ে উঠবে,  যার ওপর আতোর ব্যাখ্যাগুলো একটা আশ্চর্যজনক আলো ফেলবে, আর ফেলেছেও। ফলে  আমরা , এমন একটি ঘটনার সীমানায় পৌঁছে যাই যার সাথে সাহিত্য এবং এমনকি শিল্পও যুক্ত বলে মনে হয়: যেন সেগুলো কবিতা নয়, যদি না এটির কৌশল বা "বিষয়" হিসাবে এদের  কবিতা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া ও উদ্দীপনা আমাদের কাছে  উপলব্ধ হয়, আবার অনেক সময়ে তা না জানার কারণে বাতিল করতে হয়।

 .

 আমরা এখানে রিল্কের চিঠিটির প্রসঙ্গ তুলতে পারি, যা পনেরো বছর বা তারও আগে লেখা: ‘যত এগিয়ে, এবং যতো বেশি ব্যক্তিগতভাবে , একজন যায়, তত বেশি অনন্য হয়ে ওঠে জীবন । শিল্প হিসাবে একটি কাজের এই অনন্য বাস্তবতা প্রয়োজনীয়, যা অকাট্য, চিরকালের জন্য নির্দিষ্ট অভিব্যক্তি। তাতেই রয়েছে অসামান্য সাহায্য, যা কাজটাকে তৈরি করতে কবি বা শিল্পীকে বাধ্য করে।

.

এটা আমাদের সুনিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যা করে যে আমাদের নিজেদের সবচেয়ে চরম অগ্নিপরীক্ষায় পুড়তে হবে, তবুও, মনে হয়,  কাজটায় নিজের মাথা পুরোপুরি গোঁজার  আগে ,  একটি শব্দের শ্বাসও সামনে আনা উচিত নয় , এমনকি তাদের সম্পর্কে বলাবলি করে  তাদের হালকা করা উচিত নয়, কেননা তা অনন্য , যা অন্য কেউ বুঝতে পারবে না বা বোঝার অধিকার নেই। এই ধরণের উড়াল যা আমাদের কাছে অনন্য, কেবলমাত্র আমাদের কাজের মধ্যে নিজেকে বোঝানোর মাধ্যমে বৈধ হয়ে উঠতে পারে, যাতে তার নিজস্ব নিয়মে আসল নকশার স্বচ্ছ শিল্পকর্মটি দৃশ্যমান হয় ও  প্রকাশ করা যায়। রিল্কে তার মানে বলতে চেয়েছেন , কাজটি যে অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের কাছে আসে  তা সরাসরি প্রকাশ করা উচিত নয় : এই চরম অগ্নিপরীক্ষার মূল্য এবং সত্য কেবল তখনই পাওয়া যায়  যখন এটি সেই কাজের মধ্যে চাপা দেয়া থাকে  যেখানে এটি একই সঙ্গে দৃশ্যমান-অদৃশ্য, শিল্পের সুদূর দিবালোকের প্রতিভায়। কিন্তু প্রশ্ন হল রিলকে নিজে কি সবসময় এই গাম্ভীর্য বজায় রাখতেন? এবং তিনি কি তাকে রক্ষা করার সময় একই সঙ্গে ভেঙে ফেলার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে প্রয়াস করেননি ?  অধিকন্তু রিল্কে জেনেছিলেন যে এই ভাঁড়ার ভাঙার ক্ষমতা তাঁর বা কারও নেই। তিনি কি  কেবল এটির সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য তর্ক দিয়েছেন যে এই ধরণের উড়াল যা আমাদের কাছে অনন্য। “যা  চিন্তা করা হয়েছে তাকে ভাবা যে অসম্ভব” তা জাক রিভিয়ের বোঝাপড়া, মনোযোগ এবং সংবেদনশীলতায় ধরা পড়েছে।  কিন্তু সংলাপে, ভুল বোঝাবুঝির ভূমিকা সুস্পষ্ট থেকে যায়, যদিও তাকে চিহ্ণিত করা কঠিন। আতো, সেই সময়ে যদিও খুব ধৈর্যশীল, ক্রমাগত এই ভুল বোঝাবুঝির উপর নজর রাখছিলেন । তিনি  তাঁদের পত্রালাপ থেকে  আশ্বস্ত হন যে তাঁর মধ্যে যে সংগতির অভাব রয়েছে তা স্পষ্ট,  আর  মনের ভঙ্গুরতা মনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু আতো আশ্বস্ত হতে চান না। তিনি এমন ভয়ানক কিছুর সংস্পর্শে আছেন যে তিনি একে কমিয়ে ফেলতে পারেন না। তিনি অসাধারণত্ব অনুভব করেন, এবং তাঁর কাছে প্রায় অবিশ্বাস্য, তাঁর চিন্তাধারার ভাঙনের সঙ্গে কবিতাগুলির  সম্পর্ক যা তিনি এই "প্রকৃত ক্ষতি" সত্ত্বেও লিখতে সফল হয়েছিলেন।

.

একদিকে, জাক রিভিয়ে অসাধারণ ঘটনাটির ব্যতিক্রমী ব্যাপারটাকে ভুল বোঝেন, আবার অন্যদিকে তিনি কবিতাগুলোর ‘সাহিত্যিক চরিত্রকে’ ভুল বোঝেন, কেননা মনের ভেতরকার যে চরম বৈশিষ্ট্য , যা থেকে কবিতাগুলো সৃষ্ট, সেই মনের অনুপস্থিতি থেকে কবিতাগুলো লেখা।

.

তিন

.

অঁতনা আতো যখন ঠাণ্ডা মাথায় রিভিয়েকে চিঠি লিখছেন, সেই চিঠি পড়ে অবাক হন জাক রিভিয়ে। আতো চিঠিতে যা বলতে চেয়েছেন তা এতোই স্পষ্ট যে টের পাওয়া যায় তিনি নিজেকে প্রকাশ করায় দক্ষ ।  কবিতাগুলো তাঁর চিন্তার কেন্দ্রহীনতার  ক্ষতির দিক উন্মোচিত করে, যে মানসিক বিপর্যয়ে তিনি ভোগেন।  এটি একটি অসহ্য যন্ত্রণা যা তিনি পরে তীব্র অভিব্যক্তির সাথে স্মরণ করেছেন, যেমন আতো বলেছেন: " আমি অনুপস্থিতির কথা বলছি, একটি ফোকরের মতো, এক ধরণের অতিশীতল, চিত্রহীন কষ্ট, অনুভূতিহীন, গর্ভপাতের অবর্ণনীয় দ্বন্দ্বের মতো।

.

তাহলে কেনই বা তিনি কবিতা লেখেন? কেন তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতন নিজেকে সন্তুষ্ট রাখেন না, যিনি তাঁর জিভকে দিনানুদৈনিক আটপৌরে কাজে ব্যবহার করেন ? সবকিছুই ইঙ্গিত দেয় যে কবিতা, তাঁর জন্য সেই ধরনের ক্ষয়ের সাথে সংযুক্ত, অথচ যা অপরিহার্য এবং ক্ষণস্থায়ী চিন্তা করায় তাঁকে দিয়ে। আর এইভাবেই, মূলত, কেন্দ্রীয় ক্ষতির সাথে জড়িত, তাঁকে সেই ক্ষতি প্রকাশ করার বাহন হিসাবে   নিশ্চয়তা এবং তাকে প্রতিশ্রুতি দেয়। নির্দিষ্ট পরিমাণে, কবিতাগুলো লিখে, এই ক্ষতি নিজেই তাঁকে উদ্ধার করবে, তাঁর চিন্তাভাবনাকে যতদূর সম্ভব ফুরিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে।  সুতরাং তিনি অধৈর্য ও অহংকার সহকারে বলেছেন: " আমি সেই মানুষ যে চিন্তার সাথে তার ভাষার সম্পর্কের মধ্যে স্তম্ভিত অব্যবস্থা অনুভব করেছে l  প্রকৃতপক্ষে আমি আমার চিন্তায় নিজেকে হারিয়ে ফেলি যেমন  স্বপ্ন দেখার সময়ে লোকে নিজেকে হারিয়ে ফ্যালে কিংবা হঠাৎ করে নিজের চিন্তায় ফিরে আসে,  আবার নিজের চিন্তায় ডুবে যায়। আমি সেই লোক যে ক্ষতি লুকানোর জায়গাগুলো জানে।"

.

আতোর কাছে "সঠিকভাবে চিন্তা করা, সঠিকভাবে দেখা" বা এমন চিন্তাভাবনা যেগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত–সঠিকভাবে বাছাই করা আর প্রকাশ করা–সে সমস্ত ক্ষমতা তিনি জানেন যে তাঁর আছে, তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। এবং যখন তাঁর বন্ধুরা তাঁকে বলেন যে  “কিন্তু আপনি তো বেশ ভালোভাবে চিন্তা করেন, যদিও শব্দের অভাব  সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়”, তখন আতো বিরক্ত বোধ করেন। একটি চিঠিতে আতো লিখেছেন,”অনেক সময়ে  অক্ষমতা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আমাকে অতি-উজ্জ্বল  হিসাবে দেখা হয় যখন কিনা আমার অপ্রতুলতা, আমার গভীর ঘাটতি,  কাল্পনিক নয় এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গঠিত নয় ।”  তিনি জানেন, ব্যথার অভিজ্ঞতা তাঁকে যে গভীর যন্ত্রণা দেয়, চিন্তা করা মানে ভাবা নয়, এবং যে চিন্তাগুলি তাঁর মগজে আসে তা তাঁকে অনুভব করায় যে তিনি "এখনও ভাবতে শুরু করেনি।"

.

 এটা সেই কঠিন যন্ত্রণা যাতে আতো ফিরে যান । যেন তিনি ছুঁয়ে ফেলেছেন,  নিজেকে জানা সত্ত্বেও, একটা সকাতর ভুলের মাধ্যমে, যা তাঁকে ভেতরে-ভেতরে কাঁদায়,  যে বিন্দুতে চিন্তা সবসময় ভাবতে পারে না: এটা "শক্তিহীনতা”,  যা তাঁর চিন্তার অপরিহার্য অংশ, কিন্তু যা  একটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়, একটি ব্যর্থতা যা দ্রুত কেন্দ্রটি থেকে উজ্জ্বল আভা হয়ে ওঠে এবং তিনি যা ভাবেন তাকে তাঁর শারীরিক অবস্হা গ্রাস করে, সমস্ত স্তরে নিজেকে কয়েকটি বিশেষ অসম্ভাব্যতায় ছারখার করে দেয়। তাঁর কবিতাগুলো চিন্তার ওই অসম্ভাব্যতার সাথে যুক্ত যা চিন্তা করা হয়েছে –- এটা এমন এক সত্য যা প্রকাশ করা যায় না, কারণ এটি সর্বদা মুখ ফিরিয়ে নেয় আর কবিকে বাধ্য করে  সেই স্তরের তলায় নেমে অনুভব করতে   যেখানে তিনি সত্যিকার অর্থে এটির অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেন।

.

 এটa কেবল এক আধিভৌতিক অসুবিধাই নয়, এটি বেদনার বিদার, এবং কবিতা এই অবিরাম বেদনা, এটি "ছায়া" এবং "আত্মার রাত !," "কান্নার কণ্ঠ না থাকার ব্যাপার”। বিশ বা তারও বেশি বছর পরে লেখা একটি চিঠিতে, যখন অঁতনা আতো বিভিন্ন মানসিক চিকিৎসালয়ে অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছেন, আর যা তাঁকে একটি কঠিন এবং জ্বলন্ত সত্তায় পরিণত করেছে, তিনি সবচেয়ে সরলভাবে লিখেছেন :  "আমি সাহিত্যে বই লিখতে শুরু করেছি এই কথা বলার জন্য যে আমি কিছু লিখতে পারি না । আমার যখন কিছু লেখার কথা ছিল তখন আমাকে  চিন্তা করতে দেয়া হয়নি।” তারপর লিখেছেন, "আমি এই কথা বলার জন্য লিখেছি যে আমি কখনও লিখিনি,  আমি কখনও কিছু করিনি, কিছুই করতে পারিনি এবং যা কিছু করেছি, তা আসলে কিছুই নয়। আমার পুরো কাজ গড়ে উঠেছিল, আর গড়ে উঠতে পারে, কেবলমাত্র শূন্যতার ওপর”। সাধারণ জ্ঞানের লোকেরা অবাক হবে: কিন্তু কেন, যদি তাঁর লেখার কিছুই না থাকে তাহলে তিনি কি আসলে কিছুই লেখেননি?  এটা এই জন্য যে একজন লোক তখন কিছুই না-বলে নিজেকে সন্তুষ্ট করতে পারে যখন কিছুই নয় বলতে কিছুই নয় বোঝায়।  এখানে, যদিও মনে হচ্ছে এটি এমন এক মুছে যাবার প্রশ্ন  যা এতই বৈপ্লবিক যে, এটি যে বাহুল্যের  প্রতিনিধিত্ব করে,  যে বিপদের দিকে  দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেয় এবং  যে উত্তেজনাকে উস্কে দেয়, এটা দাবি করে, যেন এটা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, এমন এক প্রাথমিক কথাবার্তার সূচনা করে যার মাধ্যমে এমন শব্দ ব্যবহার করা হবে যে তা কিছুই বলে না।

.

প্রশ্ন হল কার কিছু বলার নেই? কেমন করে  একজন লোক নিজেকে কথা বলা থেকে রুদ্ধ করতে পারে আর নিজেকে প্রকাশ করতে পারে ? আতো বলছেন, “ আচ্ছা ! যতই যাই হোক না কেন, লিখতে চাওয়া এবং নিজেকে প্রকাশ করতে চাওয়াটা আমার নিজের দুর্বলতা এবং অযৌক্তিকতা। আমি এমন একজন মানুষ যে  অনেক মানসিক  কষ্ট পেয়েছি এবং এই কারণে আমার কথা বলার অধিকার আছে।"


 চার

.

এই শূন্যতার জন্য একটি যুদ্ধের বর্ণনা, যে তাঁর কাজ–স্বাভাবিকভাবে,  একটি এমন কাজই নয় যার সম্পর্কে আমি উচ্ছসিত হব এবং নিন্দা করব, তাকে অতিক্রম করে যাব আর সংরক্ষণ করব, কেননা তা নিজেই ইচ্ছা প্রয়োগ করে এর জন্ম দিয়েছ । আতো এমন এক আবেগ জাগিয়ে তুলবেন যাতে তিনি  দক্ষ ।  শুরুতে, এই শূন্যতা বোধের আগে, তিনি তখনও কিছুটা পূর্ণতা উপলব্ধি করার চেষ্টা করে গেছেন, যাকে তিনি  মনে করে ছিলেন নিশ্চিত, যা তাঁকে স্বতঃস্ফূর্ত সমৃদ্ধি, তাঁর অনুভূতির অখণ্ডতা এবং বিষয়গুলির ধারাবাহিকতার সাথে  নিখুঁত আনুগত্যের  সম্পর্ক গড়ে দিয়েছিল আর যা তাঁর কবিতাকে স্ফটিকত্ব দিয়েছিল ।  তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে তাঁর এই “সুগভীর অনুষদ” আছে এবং সেইসাথে এটি প্রকাশ করতে সক্ষম আঙ্গিক এবং শব্দের সম্পদ আছে তাঁর কাছে। আতো বলছেন,  "যে মুহূর্তে আত্মা তার ঐশ্বর্য, তার আবিষ্কার, এই উদ্ঘাটনকে সংগঠিত করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে, সেই অচেতন মুহুর্তে যখন জিনিসটি নির্গত হওয়ার জন্য তৈরি, একটি শক্তিশালী এবং শয়তান ইচ্ছা আত্মাকে অ্যাসিডের মতন আক্রমণ করে, শব্দময়-চিত্রকল্পকে আক্রমণ করে , অনুভূতি-পিণ্ডের সাহিত্যের প্রশ্নকে আক্রমণ করে , এবং আমাকে, আমাকে, আমার জীবনের  দরজায় হাঁপাবার জন্য ছেড়ে দেয়।"

.

আতো যে  এখানে তাৎক্ষণিক বিভ্রমের শিকার তা বলা যথেষ্ট সহজ; সেটা খুবই সহজ; কিন্তু সবকিছুই সেইভাবে শুরু হয় যেভাবে তিনি এই অব্যবহিত অবস্থা থেকে দূরে রয়েছেন  যাকে তিনি বলছেন "জীবন"। কোনও বিলীন হতে থাকা নস্টালজিয়া নয় বা অদৃশ্য স্বপ্নকে পরিত্যাগ করে  নয়;  বরং তার বিপরীতে, এমন একটি সুস্পষ্ট বিদার দিয়ে, যা নিজের কেন্দ্রে একটি অবিরাম বাঁক-বিমুখতার দাবির পরিচয় দেয়, যা তাঁর আসল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের নৃশংস আশ্চর্যের মতো তাঁর অন্তরতম আত্মার অংশ হয়ে যায়। এইভাবে, একটি নিশ্চিত এবং বেদনাদায়ক উপস্হাপনের মাধ্যমে, তিনি আবেগের মেরুকে উল্টে দিতে পারেন আর তারপর অপসারণকে প্রাথমিকতা দেন , "তাত্ক্ষণিক পূর্ণতাকে" নয়,  যার দরুন এই অপসারণ প্রথমে সাধারণ অভাব বলে মনে হয়েছিল। যা প্রধান তা সত্তার পূর্ণতা নয়; প্রধান জিনিসটি হল বিদার এবং ফাটল, ক্ষয় এবং ধ্বংস, বিরতি এবং কুরে-খাওয়া একাকীত্ব : সত্তা তখন সত্তা নয় , এটি সত্তার অভাব, একটি জীবন্ত অভাব যা জীবনকে অক্ষম, পলাতক এবং অবর্ণনীয় করে তোলে, শুধুমাত্র  কান্নাকে রোধ করে থাকা।

.

সম্ভবত অঁতনা আতো, যখন তিনি ভেবেছিলেন যে তাঁর "অবিভাজ্য বাস্তবতার" পূর্ণতা আছে, তখন অন্য কিছু না করে তিনি ওই শূন্যতার দ্বাঁরা তার পিছনে প্রক্ষিপ্ত ছায়ার ঘনত্বে নিজেকে কাঁদানো ছাড়া আর কিছুই করেননি, কারণ একমাত্র জিনিস যা তাঁর মধ্যে ভরাট পূর্ণতার সাক্ষ্য দেয় তা হল প্রবল শক্তি যাকে অস্বীকার করা হচ্ছে । এটি, অস্বীকৃতির বাড়াবাড়ি যা সর্বদা সক্রিয় এবং শূন্যতার অসীম বিস্তার ঘটাতে সক্ষম ।  এটা এমন এক চাপ যা এতটাই ভয়ানক যে এটা তাঁকে ফাঁস করে দেয়, আর একই সাথে দাবি করে যে তিনি এটি তৈরি করতে এবং এর অভিব্যক্তি বজায় রাখতে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করবেন। 

.

 তবু, জাক রিভিয়ের সাথে চিঠিপত্র আদান-প্রদানের সময়, এবং যখন তিনি  কবিতা লিখে চলেছেন, তিনি প্রকাশ্যে নিজেকে নিজের উচ্চতায় তুলে আনার আশা বজায় রেখেছেন, যা এমনই এক সমতা, যে কবিতাগুলো সেই মুহূর্তেই নষ্ট হয়ে যায় যখন তিনি তাদের পুনরুদ্ধার করেন। তিনি তখন বলেন যে "তিনি কম হারে চিন্তা করছেন"; "আমি নিজের মানদণ্ডের নীচে রয়েছি, আমি তা জানি, আমি এ থেকে ভুগছি।"  পরে, তিনি লিখবেন: "আমার গভীর অনুষদ এবং আমার বাহ্যিক অসুবিধার মধ্যে এ এক বিরোধিতার যন্ত্রণা, যার কারণে আমি  মারা যাচ্ছি।" সেই মুহুর্তে, যদি তিনি উদ্বেগ ও অপরাধবোধে ভুগছেন , তবে এটি তাঁর চিন্তাভাবনার ক্ষমতার স্তরের নীচে চিন্তা করার জন্য, যা দিয়ে তিনি  তাঁর আদর্শ সততাকে রক্ষা করার  জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলেন , যাতে এটি প্রকাশ করার সময়, এমনকি একটি শব্দ দ্বারাও এটি প্রকাশ করলে, তাঁর সত্যিকারের মহত্ত্ব তাঁর নিজের সম্পর্কে পরম সাক্ষী হয়ে থাকবে। যন্ত্রণা এই সত্য থেকে উদ্ভূত হয় যে তিনি তাঁর চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে সক্ষম নন, এবং কবিতা তাঁর ভেতরে বাসা বেঁধে থাকে এই জন্য যে এই ঋণকে মিটিয়ে ফেলার আশা  রয়ে যায়, অথচ  তা সত্ত্বেও যা তাঁর অস্তিত্বের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে। জাক রিভিয়ের সাথে চিঠিপত্র পড়ে কখনও কখনও  মনে হয় যে কবিতাগুলির প্রতি রিভিয়ের যেটুকু আগ্রহ ছিল তা আতোর নিজের সমস্যা উথ্থাপনার দরুন কেন্দ্রীয় সমস্যাটির প্রতি রিভিয়ের আগ্রহ লেখার গুরুত্বকে স্থানচ্যুত করে।
আতো কবিতা লিখছিলেন শূন্যতাবোধের বিরুদ্ধে, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য লিখতেন। রিভিয়েরের সাথে চিঠিপত্রে, যদিও, তিনি সমস্যাটির সামনে নিজেকে উন্মোচিত করেছেন এবং বোঝা যায়  তিনি একে প্রকাশ করার চেষ্টা করে এবং এটি থেকে অভিব্যক্তি সংগ্রহ করে কবিতাগুলো লিখেছিলেন।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন