(ইউটিউবের জন্মও হয়নি সেদিন। সেই ষাটের দশকেই অশ্লীলতার অভিযোগে গ্রেফতার, কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের হাংরি জেনারেশনের কবি সাহিত্যিকদের। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে একটি কবিতা, ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’। লিখেছেন অপূর্ব সাহা।)

রোম্যান্টিক বাংলা সাহিত্যের ভেজা ভেজা স্যাঁতস্যাতে নরম মাটিকে চড়া রোদ্দুরের তাপ ঝলসে দিয়েছিল সেই ষাটের দশকেই। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সমান্তরালে দানা বেঁধে উঠেছিল হাংরি জেনারেশন আন্দোলন। মধ্যবিত্ত ভন্ডামিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সমাজ তথা প্রতিষ্ঠানের বেঁধে দেওয়া শিল্প সাহিত্য প্রকরণ তছনছ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন ক্ষুধার্ত প্রজন্মের কবি-লেখকেরা। খানিকটা বিচ্ছিন্ন ভাবেই পাটনা, ত্রিপুরা, বাঁকুড়া, কলকাতার সম-মানসিকতা সম্পন্ন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, ফাল্গুনী রায়, হারাধন ধাড়া, সুবিমল বসাক প্রমুখ জড়ো হয়েছিলেন ক্ষুধিত প্রজন্মের ছাতার তলায়। নিকটবর্তী ছিলেন বিনয় মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সতীন্দ্র ভৌমিকেরা।

বুলেটিন, ইস্তাহার বিলি বিতরণের পাশাপাশি আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে সমালোচনার জন্য জুতোর বাক্স পাঠাতেন তাঁরা। ডাকযোগে সমাজের তাবড় ‘প্রতিভাশালী’দের মুখোশ পাঠিয়ে সেখানে লিখে দিতেন— মুখোশ খুলে ফেলুন। নোবেলজয়ী কবি অ্যালেন গিনসবার্গ ও তাঁর পুরুষ বন্ধু পিটার অরলোভস্কি ভারতে এসে হাংরিদের সঙ্গে রাত কাটিয়ে গিয়েছেন শ্মশানে, সোনাগাছিতে। অন্ত্যজ জীবনযাপন প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক শব্দ ব্যবহারে তোলপাড় হয়েছিল তৎকালীন প্রসাধন-শোভিত বাঙালি বুদ্ধিজীবি, পাঠক, সিংহভাগ লেখকেরা। স্বভাবতই সাজানো বুলিতে বিরাশি সিক্কার এই হাংরি-থাপ্পড় আলোড়িত করেছিল প্রতিষ্ঠানের রাজাগজাদের। অচিরেই প্রয়োজন হয়েছিল বাপের অবাধ্য ছেলেদের একটু কড়কে দেওয়ার।

ষাটের দশকে অশ্লীলতার দায়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল কয়েকজন হাংরি কবি-লেখকের বিরুদ্ধে। কবি শৈলেশ্বর ঘোষ এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘‘২রা সেপ্টেম্বর, ১৯৬৪, সকাল ৭.৩০ মিনিট। সুভাষ এবং আমি সবে ঘুম থেকে উঠেছি, বাইরে গিয়ে চা খাবো, এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খোলামাত্র ঘরের মধ্যে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ৮-১০ জন লোক। মেঝেয় বিছানায় জুতো-সহ দাঁড়িয়ে গেল ওরা। টেনে হিঁচড়ে ফেলতে লাগল জিনিসপত্র, বইপত্র। হাতে সার্চ ওয়ারেন্ট ধরিয়ে দিয়ে বলল, তারা লালবাজার থেকে আসছে।…৯.৩০-এ জানানো হল যে আমাদের ওরা গ্রেফতার করছে।…পরের দু-তিন দিনের মধ্যে কলকাতায় দেবী রায়, পাটনায় মলয় রায়চৌধুরী এবং সমীর রায়চৌধুরী গ্রেফতার হয়। মলয় ও সমীরকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ত্রিপুরায় প্রদীপ চৌধুরী গ্রেফতার এড়িয়ে কিছুকাল কাটায় বটে, কিন্তু তাকেও গ্রেফতার করে কলকাতা আনা হয়।’’ মলয় লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও সাহিত্যে অশ্লীলতার অভিযোগে’ তাঁদের গ্রেফতার করা হলেও ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছিল উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও। যদিও তাঁদের গ্রেফতার করা হয়নি।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে নানা সময়ে বিভিন্ন বই বাজেয়াপ্ত হয়েছে। কিন্তু অশ্লীলতার অভিযোগে বাড়ি থেকে থানা, থানা থেকে আদালত কোমরে দড়ি দিয়ে শিল্পী-সাহিত্যিকদের টেনে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা এর আগে বাংলার মাটিতে কখনও ঘটেনি। কলকাতার ব্যাঙ্কশাল কোর্টে মামলা চলেছিল ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পরের বছর মে পর্যন্ত, মোট নয় মাস। অভিযুক্তদের কেউ কেউ রাজসাক্ষীও হয়ে যান। এই মামলায় শক্তি-সুনীল-সন্দীপন সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। মূল অভিযোগের কেন্দ্রে ছিল মলয় রায়চৌধুরী লিখিত ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি। মলয়ের কবিতাটি ‘অবসিন’ কি না, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে সরকারি উকিল জানতে চান। প্রশ্ন করেন, কবিতাটা পড়ে কি আপনার অশ্লীল মনে হচ্ছে? সুনীল বলেন, ‘‘কই না-তো! আমার তো বেশ ভাল লাগছে পড়ে।’’ শক্তি বলেছিলেন, কবিতাটি তাঁর ভাল লাগেনি। মলয় সেকথা জানিয়েছেন তাঁর নিজের লেখাতেই।

এই মামলা হাংরি জেনারেশনকে আন্তর্জাতিক পরিচিতি এনে দেয়। যুগান্তর-আনন্দবাজার- দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় সংবাদ, সম্পাদকীয়, কার্টুন ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। আমেরিকার ‘টাইম’ ম্যাগাজিন, আর্জেন্টিনার বুয়েনস এয়ার্সের ‘প্যানোরমা’ পত্রিকা-সহ মেক্সিকো, জার্মানির বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় হাংরি আন্দোলনকারীদের লেখালেখি ও সেই সংক্রান্ত মামলার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আমেরিকান কবি ক্যারল বার্জ ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটির ইংরাজি অনুবাদ  করে পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করেন।

বিচারক অমলকুমার মিত্র মোকদ্দমার রায় ঘোষণা করেছিলেন ১৯৬৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর। রায়ে বলা হয়েছিল, ‘‘অভিযুক্তের অপরাধ প্রমাণিত এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯২ ধারায় দণ্ডিত এবং সেই ধারা বলে তাকে ২০০ টাকা জরিমানা করা হল। অন্যথায় একমাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। আলোচ্য প্রকাশনার যে কপিগুলি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, সেগুলি নষ্ট করে ফেলার আদেশ দেওয়া হল।’’ পরে হাইকোর্ট অবশ্য মলয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ খারিজ করে। এবং নিম্ন আদালতের জরিমানার রায় প্রত্যাহার করে।