মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

ছোটোলোকের ছোটোবেলা -- আলোচনা করেছেন অরিজিৎ সব্যসাচী দাশ

 "ছোটোলোকের ছোটোবেলা" পড়ে লিখেছেন অরিজিৎ সব্যসাচী দাশ


(বই: ছোটোলোকের ছোটোকথা-মলয় রায়চৌধুরী-চর্চাপদ-১৫০/-)
কলকাতার বাঙাল শব্দটির সঙ্গে তো এখন আপনারা সবাই পরিচিত, হ্যাঁ শ্রী অরুণ সেনের দৌলতে। কিন্তু যদি বলা হয় বিহার, থুড়ি পাটনার বাঙালি? অর্থাৎ পাটনারও নিজস্ব বাঙালি আছে! সে থাকতেই পারে। কিন্তু যদি সেখানকার স্মৃতি , সেখানকার রাস্তাঘাট, লোকজন, আচার সমস্ত কিছু রক্তে মজ্জায় মিশে যায় এক বাঙালির! তবে বলা ভালো, শুধু যে পাটনা তা নয়, সঙ্গে এই পশ্চিমবাংলাও মিশে আছে তার রক্তে, তাও এক বিশেষ রক্তে। স্থান কাল পাত্র আলোচনায় পরে আসছি। সেই সমস্ত স্মৃতি যদি নিব ভাঙা জেল পেনের কালির মত উপছে পড়ে দুই মলাটে বন্দী হয়ে থাকা কিছু মলিন পৃষ্ঠার উপর! তখন জন্ম হয় এক এমন আত্মকথার।
মলয় রায়চৌধুরী, নামটা খুবই পরিচিত সকলের কাছে। কিংবা হয়ত অনেকের কাছে নয়। তাঁর বই তো অনেকেই কেনেন, এবং কিছু বই হয়ত আলোচনাও হয়। তবুও কোথাও যেন হয়ত সোশ্যাল মিডিয়ার বই আলোচনার ভিড়ে খুঁজে পেতে কিঞ্চিৎ অসুবিধে হয় তাঁর লেখা ও সেই বিষয়ক আলোচনা। আজ এমন একটা বই হাতে উঠে এল যে বই নিয়ে আলোচনা শুধু সোশ্যাল মিডিয়াতে তো নেইই, অন্তর্জালেও খুব বেশি চোখে পড়ে না। কিন্তু কিন্তু এই বই পড়ার পর যদি একটু দু চার কথা না লিখতে পারি, হয়ত অন্যায় হবে সেটা। বই বিষয়ক বিশদ আলোচনায় কিঞ্চিৎ পরে আসছি। আগে যেহেতু আত্মকথা বা আত্মজীবনী, তাই লেখকের সম্পর্কে দু চার কথা বলে নেওয়াই সমীচীন বোধ করছি।
শুরুর লেখা পড়েই বুঝেছেন আশা করি লেখকের সঙ্গে পাটনার যোগাযোগ আছে। হ্যাঁ, লেখক শৈশব থেকে প্ৰথম যৌবন অবধি পাটনা শহরেই কাটিয়েছেন। হাংরি আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। এবং আরো পরবর্তী সময়ে সেই বিষয়ক বিভিন্ন রচনাতেই তাঁকে পাই আমরা। কিন্তু শুধু কি তাই? গল্পকার ঔপন্যাসিক প্রাবন্ধিক কবি অনুবাদক, সবরকম খেতাবই তাঁর জন্য উপযুক্ত। এমনই বহুমুখী তিনি। আচ্ছা ভাবতেই পারেন, যে হঠাৎ সরাসরি বই নিয়ে না লিখে ওঁর পরিচিতি দিতে আমি এত কেন আগ্রহ বোধ করছি! কারণটা তো আগেই বললাম😊। তবে আর নয়, কারণ বইটি যেহেতু আত্মজীবনী তাই বাকি কথা সেই আলোচনাতেই হবে নাহয়। প্রবীণ সাহিত্যিককে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে আমি তাঁর দুরন্ত লেখনী নিয়েই এবার একটু আলোচনা করি😊, দেখুন মন্দ লাগবে না। (একই সঙ্গে বইয়ের ছবির সাথেও সম্প্রতি লেখকের পোস্ট থেকে পাওয়া তাঁর সেই পূর্বস্মৃতির, সেই পাটনার ছবি গুলি পেলাম, তাঁরই জবানিতে তাঁর অনুমতি সহ সেই ছবি গুলি শেয়ার করলাম, যাতে সকলের বুঝতে সুবিধে হয়।)
হঠাৎই রাস্তায় ভ্রাম্যমান বইপ্রেমীর মত ঘুরতে ঘুরতে এক দোকানে চোখে পড়ে এই বইটি। স্পষ্টতই, ভালো বই এর প্রচার যেমন খুব বেশি আজকাল হতে দেখিনা, তাই এই বইটি সম্পর্কেও খুব বেশি যে ধারণা ছিল আমার তা নয়। কিন্তু একটু উল্টে পাল্টে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বইটি কিনি। নাম "ছোটোলোকের ছোটোবেলা", নামটাই বড় আকর্ষণীয়! লেখকের ছোটবেলার স্মৃতিকথা। কিন্তু তা কতটা মধুর তা বলব না এখনই। বইটি পড়লেই বুঝবেন রাজা সাবর্ণ রায়দের সঙ্গে যোগাযোগ আছে ওঁদের বংশের। এবং তার ফলেই হুগলীর উত্তরপাড়ার সঙ্গেও অবশ্যই যোগাযোগ আছে ওতপ্রোত ভাবে। তাই বাংলা ও বিহার মিলিয়ে এক মিশ্র স্মৃতি। বাস্তবে সাবর্ণভূমি থেকে চ্যুত হয়ে যে মানুষরা পাটলিপুত্রে আশ্রয় নিয়েছিল লেখকরা তাদেরই মধ্যে। এমন এক জায়গা যেখানে ভদ্রলোক বাঙালির সামাজিক সীমানা শেষ। হয়ত তাই লেখক উল্লেখ করছেন, "ছোটলোক"। ঠিক সেজন্যই যেন তাঁরা ছিলেন, ইমলিতলায়(লেখকদের পাড়া, এমন নামের উৎস জানতে হলে বইটি পড়তেই হবে) আলাদা, দরিয়াপুরে আলাদা, পাটনার বড়লোক বাঙালির চেয়ে আলাদা, পেনিটিতে আলাদা, আহিরিটোলায় আলাদা, যে উদ্বাস্তুরা গোলা রোদে আর ভোমরপোখরে এসেছে তাদের চেয়ে আলাদা, যারা কলকাতায় থাকে তাদের চেয়েও আলাদা। আলাদা হয়ে থাকার অনেক ভয়! এমনটাই বলছেন লেখক। বইটি দুটি ভাগে বিভক্ত, প্ৰথম অংশ, 'ছোটোলোকের ছোটোবেলা' এবং পরবর্তী অংশ 'এই অধম ওই অধম'।
লেখকের পুরো স্মৃতিতে প্ৰথম থেকেই জড়িয়ে আছেন তাঁর বাবা, মা, জ্যাঠামশাই-জেঠিমারা, কাকু কাকিমাগন, ঠাকুমা-বটঠাকুমা, ভাই-বোন, দাদা ও সর্বোপরি তাঁর মেজদা।
লেখার শুরুটাই হচ্ছে বাঙালি বনেদি পরিবারের(বা বলতে পারেন বিহারের বাঙালি পরিবার) এক গোপন অথচ রসালো ঘটনা দিয়ে, যা ততোধিক মজাদারও। অবশ্যই তাঁর মেজদাকৃত(ঘটনাটি লক্ষ্যণীয়)। সে এক কেচ্ছা। তারপর একে একে ভিড় করেছে অনেক স্মৃতি। বুল্লুদের বাড়ির চিত্রগুপ্তের পুজো, পাড়ার প্রতিবেশীদের বাড়িতে বাড়িতে অবাধে লুকোচুরি খেলা, ঠররা আর মাংসের পদ দিয়ে ভোজ, প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে আসা ভোজ(যাদের কিনা সেই সময় ছোটলোকের তকমা দিত সকলে), সাবর্ণ রায়চৌধুরীর আসবাব, পায়খানা ও বাথরুমে যাবার বিড়ম্বনা ও সর্বোপরি কুস্তিগির শিউনন্নি। তথাকথিত ছোটলোকের পাড়ায় থাকলেও, তাঁর ঠাকুমা জেঠিমারা কিন্তু সমস্ত আচার ও সংস্কার কঠোর ভাবে মেনে চলতেন। যেমন বাড়িতে আঁশহীন মাছ না ঢোকা বা মুরগির মাংস না খাওয়া প্রভৃতি। লেখকই বোধহয় প্ৰথম যিনি খ্রিষ্টানদের স্কুলে ভর্তি হন কেবলমাত্র তাঁর মায়ের জেদ ও যুক্তিতে। যার ফলে তিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যেন ব্রাত্য ছিলেন। এত নিয়ম কানুন কেন, কারণ তাঁরা সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বংশধর, সমস্ত দোষ যেন ওই মানুষটির উপর। অবশ্য কেবল ইমলিতলার স্মৃতিই কেন , একে একে ভিড় করেছে, ওতোরপাড়ার কথা, দিদিদের উচ্চ মার্গীয় সিলভ্যান হাউস, পানিহাটির মামাবাড়ি, কোন্নগরের সাধুমামার বাড়ি আরো অনেক জায়গা। অর্থাৎ বাংলা ও বিহার একই সঙ্গে এক মিশ্র আবেগ বিজড়িত স্মৃতি হিসেবে উঠে এসেছে। এরপর একের পর এক চড়াই ও উৎরাই! কীভাবে মেজদার বদমাইশিতে তিক্ত হত বাড়ির লোকজন, কীভাবে লুকিয়ে মা কাকিমাদের জন্য তথাকথিত চপ, টফি, আইসক্রিম কিনে আনা হত, বাবার হাত ধরে হেঁটে ওতোরপাড়া থেকে দক্ষিনেশ্বর যাত্রা, সবই যেন লেখকের হাত ধরে আমাদের চোখ রাখতে বাধ্য করে এই ক্যালাইডোস্কোপে। ছটের সময় নগ্ন স্নানরতা সধবা বিহারীদের লাইন লেগে যেত তখন(না, কিচ্ছুটি ভাববেন না, এখন আর সেই সময় নেই) , আর ভলেন্টিয়ার সেজে ফোঁপরদালালি করে দেখার সুযোগ আরো বেশি, এইসবই তার মেজদার থেকে শোনা, ঠিক যেমন শোনা সেই নিষিদ্ধ মেলার গল্প যেখানে নাকি মায়াবিনীদের টান এড়ানো যায়না। এই পর্বের শেষে একদম সেই একদম শুরুর দৃশ্যেই ফিরে যাই আমরা, তখনও ছটের ঠেকুয়া আদান প্রদান বন্ধ হয়নি। তখনই ঘটে মেজদার দ্বারা সেই অন্যায় , যার ফলে উন্মুক্ত হয়ে যায় এমন এক সত্য যার অপেক্ষা হয়ত পাঠক করবেননা। করেননি কোন্নগরখ্যাত খোট্টা খ্রিষ্টান অর্থাৎ লেখক নিজেও।
আগেই বলেছি এই স্মৃতিসরণি কতটা সুখকর বা কতটা হোঁচট খাওয়ার, তা শুধু পাঠকরা কেন লেখক নিজেও হয়ত বুঝতেন না। এই বই গোগ্রাসে গিলে ফেলবার নয়, শুধু সময় নিয়ে পড়ার, রয়ে সয়ে, লেখনীর কৃতিত্ব তো আছে, ততটাই আছে স্মৃতির বৈচিত্র, যা বিরল।
পরের পর্ব 'এই অধম ওই অধম' এও রেশ যায় না সেই অঘটনের। বরং নেমে আসে আরেক স্তব্ধ করে দেবার মত দুর্ঘটনা। মেজদার মৃত্যু, আকস্মিক! না তাঁর মৃত্যু হয় না, বরং বলা ভালো তিনি যেন ইচ্ছে করেই মুক্তি নিয়ে চলে যেতেন চান, আলাদা হয়ে যেতে চান সবার থেকে। হঠাৎ যেন পুরো দৃশ্যাবলী ওলট পালট হয়ে যায়। শোকাচ্ছন্ন না ঠিক শোক নয়, এক অদ্ভুত নিঃস্তব্ধ হয়ে যায় পুরো পরিবার। স্মৃতিগুলি যেন সব কোলাজ আকারে ভিড় করে লেখকের মনে। একই সঙ্গে মনে আসে ইমলিতলার সঙ্গে দরিয়াপুরের স্মৃতি, সেখানে মুসলিমদের বাস। সম্পূর্ণ ভিন্ন এখানে জীবনযাত্রা। নতুনসঙ্গী হয় বুজিদা। একের পর এক বড়দের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন লেখক। হঠাৎই যেন বুদ্ধিমান হতে থাকেন, অর্থাৎ বড় হতে থাকেন তিনি। ভর্তি হয়েছিলেন, খ্রিষ্টান থেকে ব্রাহ্ম স্কুলে। সেখানে লাইব্রেরিয়ান নমিতাদির প্রতি সুপ্ত ভালোবাসা বা সেই শিখের ঘরের নিষিদ্ধ দৃশ্য কিংবা দাশরথিজেঠুকে তিতি বিরক্ত করার নানান উপায়, এসবই তাঁর ছোটবেলা থেকে ক্রমশ বড় হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। অনেক সময় খারাপ হওয়ার ইচ্ছে তাঁরও করত। যেমন টা ঠিক দেওয়ালের পেন্ডুলাম ঘড়িটার করে ঠিক তেমন। মনে পড়ে শুধু মেজদার কথা। এই স্মৃতিকথার পুরোটা জুড়েই আছেন তিনি। তাকে ঘিরেই যত স্মৃতি, ভালো খারাপ, মজার বা দুঃখের! তাঁকে কান্ডারী করেই যেন লেখক তাঁর ছোটবেলার সব স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান হয়ত আজও। তাই এই কাহিনীর শেষ অবধি তাঁরই স্মৃতি তাঁরই কথা উঁকি দেয় মনে, শুধু লেখকেরই নয়, তাঁর পরিবারেরই নয়, পাঠকের মনেও, উজ্জ্বল হয়ে থাকে "ছোটোলোকের ছোটোবেলা"।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন