বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৩

কবি জয়িতা ভট্টাচার্য'র "হয়ে ওঠা"

 কবি জয়িতা ভট্টাচার্যের ‘হয়ে ওঠা’ : মলয় রায়চৌধুরী

পত্র-পত্রিকায় দেখি জনপ্রিয় ও মঞ্চসফল পুরুষ কবিদের তুলনায় মহিলা কবিদের আলোচনা প্রায় হয় না । রাজলক্ষ্মী দেবী, কবিতা সিংহ, বিজয়া মুখোপাধ্যায়, মিতুল দত্ত,  শতরূপা সান্যাল কবিতায় বাঁকবদল ঘটিয়েছেন অথচ তাঁরা তেমন আলোচিত নন । মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতা আলোচনা হয় তার কারণ তাঁর স্বামী সাহিত্যের পীঠস্হানের পদাধিকারী। জানি না পঞ্চাশ বছর পর কী হবে । পুরুষ কবি-লেখকদের ‘হয়ে ওঠা’ নিয়ে আলোচকরা ভাবেন অথচ নারী কবি-লেখকদের ‘হয়ে ওঠা’ নিয়ে চিন্তা করেন না।

পুরুষ কবি ও লেখকদের ‘হয়ে ওঠা’ নিয়ে নানা আলোচনা পড়ার সুযোগ হয়েছে,  কোনও পুরুষ লেখক বা কবির গ্রন্হে তাঁর ‘হয়ে ওঠা’ বর্ণিত হয়েছে তা পড়েছি ইংরেজিতে, কেননা তাঁরা ইউরোপিয় সাহিত্যিক, এবং এই ‘হয়ে ওঠা’ ব্যাপারটির তত্ব তাঁদেরই গড়া । সাহিত্যিক নিজেই যদি লেখেন তাহলে তা বিলডুংসরোমান ( Bildungsroman )-এর সাবাজনার কুন্সটলরোমান  ( Kunstlerroman ) অথবা ‘শিল্পীর নিজস্ব ন্যারেটিভ’ হিসাবে চিহ্ণিত হয়েছে । অন্যের লেখা হলে তা বিলডুংসরোমান । 

আমি এই প্রবন্ধে জয়িতা ভট্টাচার্যের ‘হয়ে ওঠা’ নিয়ে লিখছি । তিনি বহুকাল যাবত লিখছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, কলকাতা ও তার বাইরে অনুষ্ঠানগুলোতে কবিতা পাঠ করেছেন । ‘বর্ণমালার সাতকাহন’ নামে একটা আত্মজৈবনিক উপন্যাসে সবকিছু খোলাখুলি লিখেছেন যা সচরাচর বাঙালি মহিলা কবি-লেখকদের করতে দেখা যায় না । কবি জয়িতা ভট্টাচার্যর এই গ্রন্হের ন্যারেটিভ ওই দ্বিতীয় বর্গে পড়ে, যদিও তা কেবল ‘হয়ে ওঠা’য় সীমাবদ্ধ নয় । কিন্তু, এখানে একটা ‘কিন্তু’ আছে, তা এই যে জয়িতা বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে, ইউরোপিয় পরিবারে প্রতিপালিত মেমযুবতী নন । তাঁর ‘হয়ে ওঠা’র সঙ্গে এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিঙের ‘অরোরা লেই’, মারিয়া বেনেডিটা বোরম্যানের ‘লেসবিয়া’, প্যাট্রিসিয়া হাই স্মিথের ‘দি প্রাইস অফ সল্ট’, অ্যালিস মুনরোর ‘লাইভস অফ গার্লস অ্যাণ্ড উওমেন’, মার্গারেট লরেন্সের ‘দি ডিভাইনার্স’, মার্গারেট অ্যাটউডের ‘ক্যাটস আই’, জেনিফার ডোনেলির ‘এ নর্দার্ন লাইট’ বইগুলোর তুলনা করা ভুল হবে । তার কারণ তাঁরা লড়েছেন মূলত সমাজের চাপিয়ে দেয়া সেই মূল্যবোধের সঙ্গে যা নারীর পক্ষে অস্বস্তিকর এবং একজন মহিলা কবি-লেখককে লেখার স্বাধীনতা বা বেঁচে থাকার স্বাধীনতা তেমনভাবে দেয় না, ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’ দেয় না, যা একজন পুরুষকে দেয় । জয়িতা লিখেছেন, আমাদের দেশে শৈশব থেকেই অবদমিত করার কারসাজি শুরু হয়ে যায়। কারণ, "কেন" এই একটা প্রশ্ন টলিয়ে দিতে পারে অনেককিছু, একটা সমাজ, একটা সংসার বা একটা সম্পর্ক।’  অন্যান্য সব সাহিত্যের মতো বাংলা-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও বাঙালি পুরুষ, সব জাতির পুরুষের মতোই, নারীসাহিত্যকে অনুমোদন করার ব্যাপারে খুঁতখুঁতে, নারীকে দেখেছেন রান্নাবান্না বা সংসারের-সেবাদাসীরূপে; নারী-লেখকদের মধ্যেও তারা খুঁজেছেন আদর্শ স্ত্রীকে। নারী-লেখক বা তাঁর লেখা এক্ষেত্রে মূল্যবান নয়। পুরুষের কাছে তাই নারীসাহিত্যের কোনও ইতিহাস আজও লেখা হয়নি, তাঁদের প্রতিভার প্রকৃত বিচার ও মূল্যায়ন হয়নি, এমনকী তাঁদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ তথ্যও বেশ দুষ্প্রাপ্য। স্বর্ণকুমারী দেবী, অনুরূপা দেবী, নিরুপমা দেবী, শৈলবালা ঘোষজায়া, সীতা দেবী, শান্ত দেবী ও আরও অনেক লেখিকার সব বইয়ের নামও খুঁজে পাওয়া যায় না। খুঁজে পাওয়া যায় না তাঁদের বইয়ের প্রকাশের তারিখ। এই তথ্য বাংলা সাহিত্য-সমাজে অত্যন্ত লজ্জার। তাঁরা শিকার হয়েছেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের উপেক্ষার। পুরুষ-সমালোচকেরা ধরেই নিয়েছিলেন তাঁদের সাহিত্য অপাঠ্য, বিশেষ করে যাঁদের বই জনপ্রিয় হয়েছিল তাঁরাও সম্পূর্ণ অপাঠ্য, এমন একটি ধারণাও প্রচলিত ছিল যার রেশ পুরোপুরি ফুরিয়ে যায়নি।

জুন ১৯৯০ সালে জয়িতা বিয়ে করেন ; উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়নি তখনও।তারপর এম.কম, ইংরেজিতে এম.এ, কমপিটার সফ্টওয়ার অ্যানালিসিসপড়াশোনা শেষে সরকারি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরির একবছর পর মেয়ে, ২০০১ সালে। তার দুবছর পর মৃত কন্যা। ২০০৬ সালে ছেলে ।  জয়িতা ভট্টাচার্যকে প্রথম থেকেই লড়তে হয়েছে দশভূজার মতন, বা হয়তো আরও বেশি হাতে, এবং তিনি পা-ও চালিয়ে থাকতে পারেন । ‘বর্ণমালার সাতকাহন’ বইটি পড়লে পাঠক বুঝতে পারবেন যে তাঁর লড়াই এখনও শেষ হয়নি । সাহিত্যের জগতে জয়িতার প্রবেশ, কৈশোর-তারুণ্যের  বাধানিষেধের বিরুদ্ধে, ব্যক্তিগত এক কনটেমপ্লেশান, নিজের অন্তর্জগতের অভিপ্রায়, আবেগ ও আকুল কামনার সঙ্গে পরিচিত হবার উদ্দেশ্যে । ‘বর্ণমালার সাতকাহন’ আত্মজৈবনিক উপন্যাস। চারটি কবিতার বই আছে তাঁর, ‘নিঃশব্দ শিশির হৃদয়’, ‘সন্ত্রাসকে ভালোবেসে’, ‘শিখিপাখা ও শাইলক’ এবং ‘নাভি ভরে থাকে বিষ’ । গল্পগ্রন্হ একটি, ‘পাঠক্রমে নেই’ । অনুবাদ করেছেন লোরকা, মায়া এঞ্জেলু, নাদিয়া আঞ্জুমান, সিলভিয়া প্লাথ, গিরিজা প্রসাদ মাথুর, বিশ্বনাথ তেওয়ারি প্রমুখের কবিতা । জয়িতা কুন্ঠাবোধ করেন বহুল প্রচারিত পত্র-পত্রিকার ক্ষমতাবান সম্পাদকদের এবং সরকারি পীঠস্হানের কর্তাদের তোয়াজ করতে, যা না করলে যুবক কবি-লেখকরাও বিশেষ পাত্তা পান না ।

জয়িতা ভট্টাচার্য বিষয়কে কবিতার কেন্দ্রে রাখেন না । কবিতার কেন্দ্র থেকে তত্ত্ব এবং তর্ককে সরিয়ে দিয়ে তিনি  দাপটের সঙ্গে  বাংলা কবিতায় এনেছেন নারীর উত্তর-আধুনিকতা ।  এই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজটি করে জয়িতা বাংলা কবিতাকে অনেকখানি আন্তর্জাতিক করতে পেরেছেন। তাঁর অন্তর্ঘাতী, ক্যাননভঙ্গকারী, সৃজনশীল কবিতাগুলো যা ধরার প্রয়াস করেছে  তা হল “মানবেতিহসের প্রেক্ষিতে এই মুহূর্তের সংঘর্ষময় নবাঞ্চল”। জয়িতার ইতিহাসবোধ কেবল সময়কেন্দ্রিক নয় । তাঁর ‘বর্ণমালার সাতকাহন’ বইতে  জ্ঞানের বিকাশে অভিজ্ঞতার ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছেন, রৈখিক সময়ের একটিমাত্র ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, বস্তুত ‘সময়বোধ’-এ বিপ্লব আনতে চেয়েছেন, এবং  সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সংঘর্ষময় জায়গাটাকে ভরে তুলতে চেয়েছেন নবাঞ্চলের ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতা দিয়ে, অভেদের সন্ধান দিয়ে  ।

ভারতীয় উপমহাদেশে, পরিবারে কন্যাসন্তান কেউ সাধারণত চান না, আর প্রথম সন্তান কন্যা হলে পাড়া-পড়শিরাও যেচে বাড়ি এসে হাহুতাশ বিলিয়ে যান । জয়িতার পরিবারে সবায়ের আশা ছিল ছেলে হবে । হল না । জয়িতার যখন ভাই হল, তখন তাঁদের চাহিদা পূরণ হলো । কিন্তু ছেলে হবার দরুন জয়িতার আদরযত্নের খেয়াল রাখার প্রয়োজন মনে করলেন না তাঁরা । পরিবারে যে একটা স্পেস বা পরিসরের প্রয়োজন হয়, মেয়েদের বিশেষ করে, তাকে গুরুত্ব দিতে চান না ভারতীয় উপমহাদেশের বয়স্ক আত্মীয়-স্বজনরা । আমার মনে হয়, যাঁরা লেখালিখি করেন , তাঁদের মস্তিষ্কে একটি স্ট্রিম অফ কনশাসনেস বইতে থাকে, নানা খাতে বইতে থাকে । জয়িতাকে তো কেউ প্রশ্রয় দেননি লেখালিখির, তবু তাঁর মনে হয়েছে যে মগজের ভেতরে যে চেতনার ধারা বহমান তাকে প্রকাশ করা প্রয়োজন । কবিতার নীল বিষ গলায় ধরে রাখা আরম্ভ করলেন । সাহিত্যে নারী লেখকদের একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হয়। এ প্রথা সর্বকালের এবং সর্বযুগের। ইংরেজি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায় মূলত পুরুষদের দ্বারা সাহিত্য নিয়ন্ত্রিত। কখনো কখনো নারী লেখকদের লেখাকে বিভিন্ন সাহিত্যে অবমূল্যায়নও করা হয়ে থাকে।

 তিনি স্কুলে ভর্তি হলেন, কৈশোরে পৌঁছে টের পেলেন যে অযাচিত রোমিওদের মোকাবিলা করতে হবে তাঁকে, এই ধরণের অভিজ্ঞতা সচরাচর কিশোরদের হয় না । মেয়েদের কৈশোর পেরোবার পর বাড়িরে বাইরে একটা ভিন্ন জগত গড়ে উঠতে থাকে, আর যেমন-যেমন কিশোরীটি যৌবনের দিকে এগোন, তাঁর সমস্যা বাড়ে । বাড়ির বয়স্ক মহিলারা, কিশোরীকে বলেন না যে তার বয়স হয়েছে, একদিন যোনি থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে পারে, এবং তা প্রতিমাসে হবে, তাকে স্যানিটারি ন্যাপকিন বাঁধতে হবে । কৈশোরে প্রথম রক্তের অভিজ্ঞতা এবং পিরিয়ডজনিত শারীরিক কষ্ট তার জীবনে একটি জলবিভাজক । এখনকার কিশোরীদের, টিভির বিজ্ঞাপন ও বন্ধুদের অভিজ্ঞতার দরুন, ব্যাপারটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবার সুযোগ হয়, যা জয়িতার সময়ে ছিল না ।

 স্বাভাবিকভাবে মন ও দেহ প্রেমের ডাক জাগায়, মস্তিষ্ক ডাক দেয় কবিতার দিকে, সামাজিক বিপ্লবের দিকে । জয়িতা কবিতা লেখা আরম্ভ করেন ; তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয় বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে । তিনি বামপন্হী ‘পার্টি করা’ আরম্ভ করেন । তিনি  প্রেমে পড়েন । প্রেমে পড়লে যেমন হয়, জয়িতা প্রেমিককে বিশ্বাস করে বিয়ে করার পর জানতে পারেন যে স্বামী কোনো চাকরি-বাকরি করেন না, তাঁর বিদ্যায়তনিক শিক্ষা নেই, অর্থাৎ চাকরির বাজারে তিনি অচল । শশুরবাড়ি গিয়ে, অতএব, সংসার সামলাবার আর্থিক দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে হলো জয়িতাকে । বাড়ির বিরক্তিকর ভাড়াটে তোলার দায়ও তাঁর ওপর বর্তালো, বহু পুরোনো বাড়ি সারাবার দায়িত্ব তাঁর ওপর বর্তালো ।

 ভাগ্যক্রমেই বলতে হবে, তিনি একটি  সরকারি স্কুলে শিক্ষিকার চাকরি পান । তিনি সন্তানসম্ভবা হয়ে ওঠেন।  তাঁরও প্রথম সন্তান একটি মেয়ে, যার দরুন মা ও মেয়েকে একই সঙ্গে খোঁটা খেতে হয় । প্রথম দিকে শিশুকে কোলে নিয়ে চাকরি করতে যেতেন । পরে তাকে বাড়িতে রেখে আসতেন; বুকে বাড়তি দুধ হবার ফলে প্রতিদিন স্কুলের টয়লেটে গিয়ে দুধ গেলে ফেলে দিতে হতো, এবং শিশুটির জন্য লুকিয়ে কেঁদে নিতে হতো । এইটুকু সময়ের মধ্যে কতোকিছু হয়ে উঠলেন তিনি– কবি, প্রেমিকা, স্ত্রী, রাঁধুনি, শিক্ষিকা, মা, বউমা, সংসারের আর্থিক মেরুদণ্ড, ভাড়াটেদের নিয়ন্ত্রক !

 মনের ভেতরের প্রবাহ তো থামে না, তা অভিজ্ঞতার প্রহারের সঙ্গে ঢেউয়ের আছাড় মেরে এগিয়ে নিয়ে যায় পরবর্তী সংঘাতের দিকে । জয়িতার শশুর আক্রান্ত হলেন ব্রেন টিউমারে এবং শাশুড়ি  আক্রান্ত হলেন ক্যানসারে, এবং জয়িতার সেবার দায়িত্ব বাড়ল । সংসারের চাপে তাঁর লেখালিখি ছেড়ে গেল, কফিহাউসে যাওয়া, কবিদের সঙ্গে সময় কাটানো, নতুন কবিতা কেমন লেখা হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা করা বন্ধ হয়ে গেল । ‘পার্টি করা’ থেকে তিনি নিজেই বেরিয়ে এলেন যখন চোখের সামনে দেখলেন যে তথাকথিত নেতারা নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন, সাধারণ মানুষের জন্য কিছুই করছেন না । জয়িতার ঘরের দেওয়ালে ধুলোর আড়ালে ঝুলে রইলেন চে গ্বেভারা । যাপন ও প্রেম সম্পর্কে মোহমুক্তি তাঁকে বার-বার টেনে নিয়ে গেছে লেখালিখির দিকে, যার জন্য তাঁর পক্ষে ‘সময় বের করে নেয়া’ ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে  পুরুষদের পক্ষে এই ‘সময় বের করে নেয়া’ অতোটা কঠিন নয় । 

জয়িতাকে একজন লেখিকা ও মানবী হিসাবে  আবিষ্কার করতে এবং খুঁজে পাবার প্রয়াস করতে হয়েছে আত্মপ্রকাশের নিয়মনিষ্ঠ প্রণালী । জয়িতা তাঁর কবিতায় ও আত্মজীবনীমূলক ন্যারেটিভে  অবজেকটিভ লেখিকা হিসাবে তাঁর নৈতিক লড়াইকে প্রতিফলিত করতে চেয়েছেন, নিজেকে প্রশ্ন করেছেন তাঁর নির্ণয়গুলো সম্পর্কে, কেননা তাঁর অন্তরজগতের বিক্ষোভ, চাঞ্চল্য, কলরোলগুলোই পরিচালিত করেছে তাঁর পাঠবস্তুকে।  যেন মনে হয় টেক্সটের প্রট্যাগনিস্ট এমন স্হিতিতে রয়েছেন যা তাঁকে গণ্ডির বাইরে বেরোতে দিচ্ছে না । জয়িতার শুরুর দিকের, এমনকি এখনকার কবিতা পড়লেও একজন নারীর এই অনুপ্রাণন পাওয়া যাবে । লেখালিখির জগতে প্রবেশ করে ডাঁটিয়াল ও প্রাতিষ্ঠানিক পুরুষ র‌্যাম্বো-সম্পাদকদের হুমকি সামলাতে হয় জয়িতাকে, যাঁরা, জয়িতার কবিতা বা গদ্য তাঁদের পত্রিকায় প্রকাশ করার পর বলেন, “যা, পাতিরাম থেকে কিনে নে”। বলা বাহুল্য যেদামিনী : মহিলা কবিদের বাংলা কবিতার সংকলন ১৪০০-২০০০’ ( সম্পাদনা : নমিতা চৌধুরী ও অনিন্দিতা বসু সান্যাল ।প্রথম প্রকাশ: বইমেলা ২০১৩, নান্দীমুখ সংসদ) গ্রন্হে জয়িতা ভট্টাচার্য অন্তর্ভুক্ত নন। এই সংকলনে বিংশ শতাব্দীর মহিলা কবিদের তালিকা বিশাল, ২১১ জন কবি রয়েছেন এখানে। এই সময়ের শেষপর্ব সম্পাদকদের সময়ের অন্তর্গত। কবি নির্বাচনে ব্যক্তিগত সম্পর্ক এক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকর। অনেক কবির ভিড়ে বেশ কিছু কবি যাঁরা বাঁকবদল ঘটিয়েছেন, তাঁরা অমনোযোগে বাদ পড়েছেন।

 ওপরে যে বিদেশিনি লেখিকাদের প্রসঙ্গ তুলেছি, তাঁদের কয়েকজনের মতন জয়িতার জীবনেও শৈশব থেকেই লেখন-প্রক্রিয়ার দিগন্তকে বাঙালি গেরস্তবাড়ির নিয়মনীতি দিয়ে একটা ঘেরাটোপে বেঁধে ফেলার সীমারেখা গড়ে দিয়েছিল, আশেপাশের লোকজনরাও সেই রেখাকে স্হায়ী করার প্রয়াস যে করেননি তা বলা যাবে না । এই বাঁধনকে জয়িতা অস্বীকার করেছেন উইল পাওয়ারের মাধ্যমে, এই উইল পাওয়ার প্রকৃতপক্ষে নিজস্ব পরিসরে স্হান তৈরি করার কৌশল, নিজের উৎসভূমি থেকে বেশ দূরে, যেখানে নিজের স্বপ্ন এবং কাঙ্খিত বৃত্তিকে সাফল্য প্রদান করা যায় । তাঁর  গল্প ও কবিতাগুলো সেই সাফল্যের খতিয়ান ।








কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন