বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০২৩

তিনকড়ি হালদার : মলয় রায়চৌধুরীর ছোটোগল্প

 তিনকড়ি হালদার : মলয় রায়চৌধুরীর গল্প

          তিনকড়ি হালদার, ডাক নাম তিনে, যে নামে মলয়ের জ্যাঠা-বাবা-কাকারা তাঁকে ডাকতেন, সাত ভাইয়ের সবচেয়ে ছোটো বোন কমলার স্বামী । ওন আর শরিকি অগ্রজরা, আর মলয়ের ঠাকুমা, ওনাকে তিনিুখোকা বা স্রেফ খোকা বলে ডাকতেন, ওনার আটষট্টি বছর বয়সেও, যখন উনি মারা যান, আর কমলাকে ডাকতেন খুকি বলে। পারফেক্ট খোকা-খুকি দম্পতি । 

          তিনকড়ি হালদারের সঙ্গে কমলার বিয়ে হয়েছিল যে কারণটির জন্যে, তার নাম বংশগৌরব। শরিকি খেয়োখেয়িতে আহিরিটোলার বিশাল বাড়ি একঘর-দেড়ঘরে টুকরো-টুকরো হয়ে গিয়ে অনেকে হাঘরে পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে থাকলেও,কমলার বিয়ের সময়ে বংশগৌরব নামে গাঁজার ধোঁয়াটির মালিকানাটুকু তিনকড়ি পরিবারের ছিল। পাত্র হিসেবে তিনকড়ির ছিল বার্ড অ্যাণ্ড হিলজার্স কোম্পানিতে টেণ্ডার খোলার আধিকারিকের চাকরি, আর প্রখ্যাত সাঁতারুর সুপুরুষ চেহারা । গর্ব করে বলতেন যে, আহিরিটোলা ক্লাবের জিতেন্দ্রলাল মুখোপাধ্যায় আর কলকাতা সুইমিং ক্লাবের এক সদস্যের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শ্যামচাঁদ চালু করে ছিলেন ওয়াটারপোলো। তুখড় সাঁতারু ছিলেন, ১১০ গজ সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন। ১৯১৮-য় যোগ দেন কলেজ স্কোয়্যার সুইমিং ক্লাবে, তাঁর দক্ষতায় সে বছরই সিনিয়র ডিভিশন লিগে চ্যাম্পিয়ন হয় এই ক্লাব, রানার্স হয় শিল্ডে। 

          বংশগৌরব অর্থে তিনকড়ি ছিলেন কালীঘাট মন্দিরে রাজা বসন্ত রায়ের সময়কার সেবায়েত আত্মারাম ব্রহ্মচারীর বংশধর । হালদারদের যে শরিকেরা মন্দিরের অছি পরিষদের সদস্য, আর আয়ের বখরা পান, তাঁদের সঙ্গে অবশ্য তিনকড়ি পরিবারের মুখ দেখাদেখি ছিল না, কেননা, তিনকড়ির ভাষায়, ‘বংশখানা আমাদের ধরিয়ে গৌরব নিজেদের কাচে রেকে নিয়েচেন ওঁয়ারা।’ তিনকড়ি কিন্তু রোয়াবে প্রতিদিন সটান কালীপ্রতিমার কাছে বিনা বাধায় পৌঁছে যেতেন, ওই অদৃশ্য বংশখানার জোরে, যা এভাবে ভাষান্তরিত হতো, ‘বলে দে তিনকড়ি হালদার এয়েচে।’

          যাঁরা অছি পরিষদের সদস্য, সেই হালদাররা এখনও কালীঘাটের বাড়িতেই । প্রায় এক বিঘা জমিতে গড়ে ওঠা হালদার বাড়ির মধ্যিখানের অংশটা ব্রহ্মস্থল৷ তাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে ঘর -বারান্দাগুলি৷ পূব দিকে পঞ্চশিবের মন্দির৷ এখনও সকাল-বিকেল পুজো পান দেবতা৷ কাঠের সব আসবাবই হয় বার্মা সেগুন না -হয় মেহগিনির৷ মেঝে-দেওয়ালে ইটালিয়ান মার্বেল আর টাইলসের কাজ৷ বারান্দার কাস্ট আয়রনের বিম এবং রেলিং আনা হয়েছিল ব্রিটেন থেকে৷ মেঝের মার্বেলে নকশা বোনা হয়েছে রঙিন ভাঙা কাঁচে৷ কালীঘাট মন্দিরের সেবাইত এই হালদার পরিবার৷ কালীঘাট মন্দির প্রাঙ্গনেই রয়েছে তাঁদের আরও একটা বাড়ি৷ যেটার বয়স প্রায় পাঁচশো বছর৷ কালীঘাটের  বাড়িটার প্রায় চল্লিশ ঘরে বাস করেন পাঁচ শরিকের পরিবার৷ তিনকড়ির পূর্বপুরুষ চলে এসেছিলেন আহিরিটোলায়, নিজের অংশ বুঝে নিয়ে ।

          অচেনা কারোর সঙ্গে পরিচয় হলে তিনকড়ি বলতেন, ‘এ-তিনকড়ি সে-তিনকড়ি নয়।’ কিংবা বলতেন, ‘আমি সাঁতারু তিনকড়ি, মাগি তিনকড়ি কি ফেরারি তিনকড়ি ভেবোনি; , সাঁতার ছেড়ে দেবার পঁয়ত্রিশ বছর পরও। হেদোর সাঁতার ক্লাবের কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন অনেককাল, নানা নদ-নদী-হ্রদ-সমুদ্রে সাঁতার প্রতিযোগীতায় জেতা মেডেল কাপ শিল্ড অযত্নে কালচে-সবুজ অবস্হায় টিকে থাকতে দেখা গেছে ওনার একমাত্র ঘরের কড়িকাঠের কাছাকাছি র‌্যাকে, যেগুলো তাঁর ছেলেরা তাঁর বার্ধক্যের উদাসীনতায় এক-এক করে বেচে দিয়েছিল, যে তাকের ওপর ওগুলো সাজানো ছিল, সেই তক্তাটিসহ ।

          অভিনেত্রী তিনকড়িকে উনি বলতেন মাগি তিনকড়ি, যিনি বীণা থিয়েটারে মীরাবাঈ নাটকে নাম-ভূমিকায় অভিনয় করে পরিচিতি পেয়েছিলেন । তারপর গিরিশচন্দ্রের ডাকে মিনার্ভা থিয়েটারে ‘লেডি ম্যাকবেথের’ ভূমিকায় অভিনয় করে বিখ্যাত হন । তিনকড়ি হালদার তাঁকে দেখে থাকবেন ‘জনা’ বা ‘করমতি বাঈ-এর ভূমিকায়, বয়ঃসন্ধির সময়ে, যখন ওই অভিনেত্রী. যাকে বলা হতো ‘কলকাতার ধনী রসিকমহল’, সে-সব লোকের মাঝে আলোচ্য ও লোভনীয় হয়ে ওঠেন । যাত্রা থিয়েটারের ব্যাকস্টেজ গার্লসদের প্রতি তাঁর আকর্ষণ সে-সময় থেকে হলেও, নারী জগতের উল্লাস-আহ্লাদে তাঁর বিবাহোত্তর প্রবেশ চাকুরিসূত্রে ।

          ফেরারি তিনকড়ি বলতে উনি বোঝাতেন হুগলি জেলার তিনকড়ি চট্টোপাধ্যায় আর তিনকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়কে, যাঁরা স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে আত্মগোপন করেছিলেন । বন্দ্যোপাধ্যায় মশায় চন্দননগর থেকে প্রকাশিত ‘প্রজাবন্ধু’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, ব্রিটিশের সমালোচনা করে তাদের চটান আর চাকরি খোয়ান । চট্টোপাধ্যায় মশায় অস্ত্র আর লাঠি চালানোর আখড়া খুলে ইংরেজদের নেকনজরে পড়ায় পণ্ডিচেরিতে পালিয়ে গিয়েছিলেন । এনারা দুজনে মলয়ের ঠাকুমার বাবা কৃষ্ণলাল মুখোপাধ্যায়ের আত্মীয়  বলে মনে হয় । মলয়ের ঠাকুমা এনাদের ‘বাপের বাড়ির লোক’  বলতেন । তা হয়তো তিনকড়ি হালদারের ঈর্ষার কারণ ছিল । তিনি তো সাতভাই চম্পার একমাত্র বোনের স্বামী ।

          তিনকড়ি হালদাতরের মায়ের ছেলেপুলে হয়ে মরে যেত বলে, ওনার বহুবার বলা গল্প অনুযায়ী, সদ্য ভূমিষ্ঠ তিনকড়িকে তাঁর জেঠিমাকে দান করে, তিনটি কড়ি দিয়ে কিনেছিলেন তাঁর মা । গল্পের সত্যতা কৈশোরে মলয় অবিশ্বাস করলেও পরে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় যখন একদিন শরিকি ঝগড়ার তুঙ্গে, তিনকড়ির অতিবৃদ্ধা জেঠিমা রাগে কাঁপতে কাঁপতে, ঝাঁপিসুদ্ধ সেই তিনটে কড়ি ছুঁড়ে মেরেছিলেন তিনকড়ি হালদারকে লক্ষ করে আর শ্লেষ্মামাখা ভাঙা গলায় বলেছিলেন, ‘নিয়ে যা তোর শেষ পারানির কড়ি।’ঝুঁকে, কড়ি তিনটেকে শঙ্কর হালদার লেনের লাল সিমেন্টের শান দেওয়া রাস্তায় খুঁজে, ঝাঁপিতে তুলে, পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন তিনকড়ি হালদার । কখনও বিশাল হালদারবাড়ি ছিল, শরিকি ঝগড়াঝাঁটিতে বেখাপ্পা ভাগাভাগির ফলে, সেই বাড়ির দালানপথগুলো কোনও একজন হালদারের নামে নামাঙ্কিত হয়ে অমুক লেন-তমুক লেন হয়ে গিয়েছিল, সম্ভবত চিঠিপত্র প্রাপ্তির সুবিধার জন্য । একাধটা লেনের মাথার ওপর আংশিক ছাদ ছিল, মারোয়াড়ি বিল্ডারদের নেকনজরে না-পড়া পর্যন্ত । বাইরে বেরোবার জন্য অনেকে গলির দিকের দেওয়াল কেটে দরোজা বসিয়েছেন, কিংবা যেদিকে বেরোবার পথ বন্ধ হয়ে গেছে, সেদিকের দরোজা উপড়ে এনে গলির দিকে বসিয়েছেন। কারোর বাড়ির দরোজা আর্চ দেওয়া পেল্লাই সেকেলে, আবার কারোর বাড়ির ছফুটিয়া একেলে । তিনকড়ি হালদারের বাড়ির দরোজা ছিল সেকেলে, এতো ভারি যে ভোরবেলা খোলার পর বন্ধ হতো একবারই, উনি, মানে তিনকড়ি হালদার বেহেড মাতাল-তালে-ঠিক অবস্হায় বাড়ি ফিরলে । 

          প্রাচীন কলকাতার মায়ায় আটক তিনকড়ি হালদারের মতন, কোনো হালদার শরিক, অবস্হাপন্ন হলেও, নিজের অংশ ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাননি, সেকেলে বাবুদের ধুতি-পাঞ্জাবি ছাড়তে পারেননি ; বাড়ির বড়ো বউরা অতিব্যবহারে মলিন গরদের শাড়ি পরে আহিরিটোলা ঘাটে পূণ্যস্নান বাদ দিতে পারেননি । । ওদিকে রিফিউজিরা থিতু হবার পর কলকাতা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে ঝকমকে চকচকে কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবার ধান্দায় ।

          দেড়-দুঘরের বাসস্হানগুলোকে বোধহয় বাড়ি বলা যায় না । তিনকড়ির ভাগের আস্তানায়্, দরোজা দিয়ে ঢুকে, বাঁ-দিকে ওপরে যাবার সিঁড়ি। দেখে টের পাওয়া যায়, শরিকি আর পারিবারিক ঘর ভাগাভাগির পর ওপরের ঘরে যাবার জন্য সিঁড়িটা পরে বানানো হয়েছে, ধাপগুলো উঁচু-নিচু, ইঁটের দাঁত বেরোনো, ওপরে চিলতে আকাশ ।সিঁড়ির তলায় পায়খানা । পায়খানায় ঢুকতেও বেঢপ সিঁড়ি, পরে বানানমো হয়েছে বলে, যার ওপর শ্যাওলা জমে সবুজ কার্পেট, যে-কারণে কলকাতার একেবারে মাঝখানে হাগতে বসে গ্রামীণ বাদার সোঁদা গন্ধ টের পাওয়া যেতো । রোদে পুড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে দরোজার অবস্হা এমন কাহিল যে ছিটকিনি বা খিল খসে গেছে । পায়খানায় গেলে মগটা বাইরে সিঁড়ির ওপর রাখতে হতো, যাতে বোঝা যায় ভেতরে কেউ আছে। বাথরুম ছিল না। পেচ্ছাপ পেলে পুরুষ সদস্যরা বি কে পাল অ্যাভেনিউতে গিয়ে কাজ সারতো,পায়খানার পিছল সিঁড়ির হ্যাঙ্গাম এড়াতে, তাছাড়া পায়খানার সামনেই স্নান করার জলের চৌবাচ্চা, যার চারপাশটা স্নান করে, কাপড় কেচে, বাসন মেজে এতো পিচ্ছিল যে, পায়খানায় ঢুকতে হলে, অদি জন্মাবধি অনুশীলন না থাকে, ভারসাম্য বজায় রেখে পা ফেলা কঠিন ।রপ্ত না থাকলে সামলানো অসম্ভব ।

          ঢোকার সদর দরজা দিয়ে রান্নাঘর দেখা যেতো । মাঝে ছোট্টো খোলা উঠোন। রান্নাঘরে জানালা নেই, তিনদিক অন্য শরিকদের দেয়াল দিয়ে বন্ধ। কান পাতলে সেসব শরিকদের সাংসরিক কথাবার্তা, কুচুটে উক্তিসহ, দিব্বি শোনা যায়, আর শুনে অন্য শরিকদের কাছে এর-ওর হাঁড়ির খবর পৌঁছে দেয়া যায় । রান্নাঘর সব সময়ে অন্ধকার, তেলচিটে হলদে একশো ওয়াটের বালব সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঝুলে । শংকর হালদার লেন দিয়ে যেতে-আসতে লোকে দেখতে পেতো রান্না ঘরে তোলা উনুনের সামনে বসে তিনকড়ি হালদারের স্ত্রী কমলা কী করছে, আবছা-আবছে, কেননা উনুনের ধোঁয়ায় দেয়ালগুলো এমন কালচে চটচটে যে, পলেস্তারা খসিয়ে আবার চুনকাম না করালে তার চেহারা, অন্তত কিছুটা, ফেরার উপায় ছিল না, আর সেব্যাপারে কোনও উৎসাহ ছিল না তিনকড়ি হালদারের, কিংবা তাঁর ছেলেরা বড়ো হলে, তাদের । কলকাতার পুরোনো বনেদি পরিবারের মতন হালদাররাও ভবিতব্যের নির্ণয়ের ওপর নির্ভর করেছে, প্রতিটি খসে-পড়া চুন-সুরকি-নোনা ইঁটের শব্দের ইশারার মতন।

          এককালে বাস্ত্ত মেনেই  তৈরি করা হয়েছিল বাড়িটা৷ উত্তরের বাতাস যাতে বাড়িতে না ঢুকতে পারে সেই উদ্দেশ্যেই বাড়ির উত্তর দিকে গড়া হয়েছিল তিনতলা৷ আর দখিনা বাতাস যাতে বাড়ির প্রতিটি প্রান্তে খেলতে পারে , সে কারণেই দক্ষিণের শেষ প্রান্ত একতলা , তারপরের অংশ দোতলা গড়া হয়েছিল৷ তিনকড়ির আমলে পৌঁছে হাওয়াও ভাগাভাগি হয়ে গেছে ।

          রান্নাঘরের ওপরের ঘরটা অন্য কোনও শরিকের। তার প্রবেশপথ আলাদা । সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে একফালি জায়গা আর কমলা-তিনকড়ি পরিবারের একমাত্র ঘর । তার তলাকার ঘরটা আরেক শরিকের, যার প্রবেশপথ পেছন দিকে, অন্য কোনও হালদারের নামের গলিতে । আড়াই-তিনশো বছরের পুরোনো বিশাল বাড়িটায় প্রতিটি সংসারের অমন হিজিবিজি অবস্হা। যাদের হাল আমলের প্রজন্মের পয়সা হয়েছে, ধুতি-পাঞ্জাবি ছেড়ে শার্ট-ট্রাউজার ধরেছে, তারা কেটে পড়েছে, এই ভাঙা বাড়িতে কোনও আড়াল নেই, তাই। তিনকড়ি হালদারের ভালো আয়, আর তার চেয়েও ভালো উপরি পেলেও, যাননি । বলতেন, মাতা খেইচিস ! আইরিটোলা ছেড়ে আবার কোতায় যাবো।’ তাঁর কাছে কলকাতা বলতে আইরিটোলা বোঝাতো। আহিরিটোলে বলতেন না কখনও, বলতেন আইরিটোলা । শশুরবাড়ি উত্তরপাড়াকে বলতেন ওতোরপাড়া, পানিহাটিকে বলতেন পেনিটি, আড়িয়াদহকে এঁড়েদা, কৃষ্ণনগরকে কেষ্টনগর, চন্দননগরকে চন্নগর। অথচ শুদ্ধ উচ্চারণগুলো তাঁর জানা ছিল।তিনকড়ি হালদারের ছেলে-মেয়েরাও কেউ এই একঘরের বাড়ি ছিড়ে কোথাও যেতে চাইত না । আহিরিটোলা ছাড়া মানে তাদের কাছে কলকাতা থেকে চলে যাওয়া ।

                   ‘আহিরিটোলা’ বা ‘আহেরিটোলা’ নামের ইতিহাস হালদাররা সবাই জানে কিন্তু জানে না কেমন করে হালদাররা এই পাড়ায় ঘাটি গাড়লো।  ১৬৯০ সালে  জব চার্নক আসার আগে থেকেই ছিল একটা ছোটখাট আর্মেনীয় উপনিবেশ। হালদাররা যাদের আর্মানি বা আর্মেনিয়ান বলে, তাদের আরেকটা জাতিনাম ছিল,  এখনও আছে। আর্মানিরা নিজেদের বলে ‘হায়ের’ বা ‘হায়েরি’। একজন আর্মেনিয়ান হলে তাকে বলা হয় ‘হে’  । আর্মেনিয়া দেশটারও তাই অন্য আর এক নাম ‘হায়াস্তান’।  আর্মেনিয়ান বা আর্মানিরা প্রথমে উত্তর কলকাতায় পা রেখেছিল। হাওড়ার সালকিয়া থেকে নৌকোয় চেপে  গঙ্গা পার হয়ে আহিরিটোলা অঞ্চলে তারা এসেছিল। উত্তর কলকাতার আর্মেনিয়ানদের বাসা ছিল এই ‘আহিরিটোলা’। আর্মেনীয়দের  ‘হায়েরি’ থেকেই গড়ে ওঠে ‘হায়েরিটোলা’। ‘হায়েরিটোলা’ লোকমুখে পালটে গিয়ে ‘আহেরিটোলা’ বা ‘আহিরিটোলা’ হয়ে গিয়েছে। হালদাররা এই গল্পটাই বিশ্বাস করে । কেউ যদি বলে যে, আরে, আপনাদের এলাকায় তো গোয়ালারা বা আহিররা থাকতো বলে এর নাম আহিরিটোলা, তাহলে তিনকড়ি হালদারের মতন অন্য হালদাররাও চটে যান ।

          আহিরিটোলার রান্নাঘর এতো অন্ধকার ছিল যে চল্লিশ পেরোতে পেরোতে প্রায়ান্ধ হয়ে গিয়েছিলেন কমলা। হাতড়ে হাতড়ে রান্নাবান্না করতেন । তাতে স্বাদগন্ধের গোলমাল হতো না । দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ নষ্ট হবার পরও তাঁর রান্নার হাত বজায় ছিল । তিনকড়ি হালদার চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কমলা জেদাজেদি করে যাননি, প্রতিবাসর উচ্চকন্ঠ ঝগড়া করেছেন, আর বাড়ি থেকে চুপচাপ বেরিয়ে গেছেন তিনকড়ি হালদার। রান্নাঘরের অন্ধকারে দিনের পর দিন কাটানোর ফলে যে তিনি আর দেখতে পান না, তা বিশ্বাস করতেন না কমলা। উনি মনে করতেন, একজন লোকের পায়ের আর হাতের ছয়টা করে আঙুল দেখে ফেলেছিলেন বলে চোখ দুটো খারাপ হয়ে গেল ।তাঁর ছেলেরা, অজয়-বিজয়-সঞ্জয়-ধনঞ্জয়-বাবলি-টাবলি, কিংবা মেয়েরা গীতা আর খুকু, কেউ রান্নাঘরে সাহায্য করতো না কমলাকে । নিরন্তর একটা করে শিশু সন্তান নিয়ে অমন সংসার তিনি কী করে সামলাতেন কে জানে ! রান্নাঘরের ছাদটা এমন ছিল যে তার কড়ি-বরগাগুলো বেশ কয়েকটা শালখুঁটির ঠেকনো দেয়া, যাতে হুড়মুড় করে ভেঙে মাথায় না পড়ে । শালখুঁটিগুলোতে পাতা লাগিয়ে দিলে রান্নাঘরটা শালজঙ্গল হয়ে যেতো।

          স্ত্রী আর আট ছেলে-মেয়ে নিয়ে ছাদের ছোট্ট ঘরে জীবন কাটিয়ে দিতে পেরেছিলেন তিনকড়ি হালদার। ওই একটিমাত্র ঘরেই সবকিছু । ঘুমোনো, পড়াশুনা, অতিথি আপ্যায়ন, ঠাকুর দেবতা, আলনা, সুটকেস-ট্রাঙ্ক, আড্ডা এবং সন্তানোৎপাদন । ঘরের অর্ধেকটা জুড়ে বেশ উঁচু মেহগনি কাঠের কালো অ্যান্টিক পালঙ্ক, কালীঘাট থাকে বিচ্ছিন্ন হবার সময়কার  আসবাব , যার ওপর দুজনের বেশি শোয়া যায় না। বাকি অর্ধেকটায় একটু ফাঁকা জায়গা ছেড়ে দেয়াল ঘেঁষে পুরোনো আমলের আলমারি, কালীঘাটের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হবার সময়কার আরেক নিদর্শন, পাশে বাক্স, তোরঙ্গ, আলনা। উঁচু খাট বলে খাটের তলাতেও শোবার জায়গা। মেঝের ওপর শোবার দরুন খাটের তলাটা ঝকঝকে তকতকে । শীতের সময়ে কলকাতায় গেলে মলয় আর ওর দাদা  সমীর শুয়েছে খাটের তলায়, গ্রীষ্মকালে ছাদে । দিনের বেলা ওইটুকু ঘরে গাদাগাদি এড়াতে তিনকড়ির ছেলে-মেয়েরা যতটা পারা যায় বাড়ির বাইরে সময় কাটাতো । সকালে জলখাবার খেয়ে সবাই এদিক-ওদিক হাওয়া । আবার দুপুরের খাওয়া সেরে এদিক-ওদিক হাওয়া । তারপর রাতের খাওয়া সেরে যে যার বাঁধা জায়গায় ঘুম। খাটের তলায় বিনা বালিশে শোয়া অভ্যাস করে ফেলেছিল ছয় ভাই । বোনেরা মাদুরের ওপর ফাঁকা জায়গায় । সঞ্জয় ছাড়া কেউই বেশি দিন স্কুলের জীবন আর রুটিন মেনে নিতে পারেনি।

          মায়ের শাদা আর বোনেদের রঙিন শায়া পরে বি কে পাল অ্যাভেনিউতে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেতো অজয়কে। বাবার ধুতিকে অশৌচের মতন গায়ে জড়িয়ে টোটো করতে দেখা যেতো বিজয়কে। ছেলে-মেয়েরা কে কোথায় যায় তা নিয়ে আগ্রহ ছিল না তিনকড়ি আর কমলার । তিনকড়ি আর তাঁর ছেলেরা স্নান সারতে যেতেন আহিরিটোলা ঘাটে । দুই মেয়ে সেই ফাঁকে চৌবাচ্চাতলায় স্নান সেরে নিতো । তিনকড়ি ছাড়া বাড়ির আর কারোর কালীঘাটের কালী বা পুজো পাঁজি তিথি নক্ষত্র কুষ্ঠি-ঠিকুজি ঠাকুর-দেবতা পুজোর জামা কাপড় নিয়ে চিন্তা ছিল না, দরকারও হতো না । কেউ জানতে চাইলে বলতো, আরে ছাড়ুন তো সেবায়েতের কথা, কবে কে ছিল তার ঠিক নেই।

          ওই ছোট্ট ঘরের ওপরের ছাদে যাবার জন্য কাঠের সিড়ি করিয়েছিলেন তিনকড়ি হালদার, ছেলেমেয়েরা যেমন যেমন বড়ো হতে থাকবে তেমন তেমন যাতে ঘ্রীষ্মকালে যাতে রাতে ছাদে শুতে পারে। ঘরের গাদাগাদি এড়াতে, শীতের দিন পনেরো আর বর্ষাকাল ছাড়া সবাই ছাদে শুতো, মাঝে মধ্যে তিনকড়ি হালদারও । ঘরে, তিনশো পঁয়ষট্টি রাত শুতেন কমলা, মাদুরে, বালিশহীন । স্হানাভাবে বালিশহীন শোয়ায় অভ্যস্হ ছিল সবাইল একটিমাত্র বালিশ ছিল ; বংশগৌরবকালীন বলে যার শিমুলতুলো রূপান্তরিত হয়েছিল ধুলোয় । শরিকানার পাঁচিল না থাকায় ছাদটা ছিল বিশাল, আঁকাবাঁকা । তবু অলিখিত নিয়মে এক শরিক সদস্যরা অন্যের ছাদে যেতেন না, সাধারণত যেতেন না। বেশির ভাগ পরিবারে স্হানাভাবের কারণে রাতের বেলায় ছাদ ভরে যেতো, একেবারে বড়ো বাজারের ফুটপাথের মতন গড়াগ্গড়। দুচারজনের খাট-বিছানা-মশারিও ছিল, ছাদে ।

          শরিকদের মাঝে যাদের পারিবারিক অবনিবনা ছিল না, তাদের ছেলে-মেয়েরা সদর দিয়ে সেসব অংশে যাবার বদলে, যেত ছাদ দিয়ে, অন্য শরিকদের নজর এড়িয়ে। ফলে হাফপ্যান্ট-ফ্রকের বা দুই স্কুল ইউনিফর্মের শর্ট পিরিয়ড প্রেম তো ঘটতই, অনেক সময়ে অমুকের স্বামীর সঙ্গে তমুকের স্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে বাগবিতণ্ডা ঘটতে দেখা যেতো । তিনকড়ি হালদার ছেলে-মেয়েদের হুঁশিয়ারি দিতেন, ‘যে যা ইচ্ছে করগি যা, কিন্তু এখেনে এনোনি বাপু, জায়গা হবে না।’ তিনকড়ি হালদার কলকাতার বাইরে গেলে শুদ্ধ বাংলা বলতেন, অথচ কলকাতায় নিজের কলকাত্তাই বাংলা বলতেন। যুক্তি দিতেন, ‘মুক দিয়ে কি লোকে লেকালিকি করে যে অমন বই লেকার ঢঙে কথা কইবো ?’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছিলেন তিনকড়ি হালদারত । বার্ড অ্যাণ্ড হিলজার্সে চাকরি পেয়েছিলেন পড়াশুনোয় ভালো ফলাফলের জন্য । বলতেন, ‘বুজলিনে ? মাকালী তো আমার আত্মীয় ; ওনার রক্ত বইচে আমার গায়ে।’ 

          সঞ্জয় ছাড়া ওনার ছেলে-মেয়েরা কেউ স্কুল ডিঙোতে পারেনি । বাড়ির বাইরে বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে সবাই এক-দুবার ফেল করে স্কুল ড্রপআউট । সঞ্জয়ও, বাড়ির বাইরে থাকার ফলে, বি কে পাল অ্যাভেনিুতে এক কমার্স শিক্ষকের বাড়ি সময় কাটাতে কাটাতে, কমার্স স্নাতক হয়ে যেতে পেরেছিল । তিনকড়ি হালদার আর কমলা ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার দিকে নজর দিতে পারেননি। কমলা তাঁর রান্নাঘরকে অত্যধিক ভালোবাসতেন বলে সময় পেতেন না । তিনকড়ি হালদার সকালে বেরিয়ে ফিরতেন মাঝরাতে । বাড়ির বাইরে ভালোবাসার বহু উপকরণ তাঁর নাগালে পৌঁছে দেবার লোকের অভাব ছিল না ।

          হেদোর কর্মকর্তা, যৌবনে অবিভক্ত বাংলার বিখ্যাত অ্যামেচার সাঁতারু তিনকড়ি হালদার, কলকাতার ভালোবাসাবাসি-উপকরণের জগতে ঢুকেছিলেন  তাঁর চাকরিটির দৌলতে। স্বদেশে মাল কিনে বিদেশে বিক্রির ম্যানেজিঙ এজেন্সি কোম্পানিতে তাঁর কাজ ছিল দরপত্র আহ্বান করা, দরপত্রের সিলবন্ধ খাম খোলা, আর বিকিকলিনি সম্পর্কে নির্ণয় নেবার জন্য নোট তৈরি করা । লক্ষ লক্ষ ট্যাকার ব্যাপার, টনটন মালপত্তরের লেনদেন, জাহাজভর্তি সাপলাই। ট্রামে চেপে অফিস যাতায়াতের সময়ে ছেঁকে ধরতে লাগল দরপত্র জমাদানকারী মালিকেরা, দালালেরা । তারা ট্যাক্সিতে যাতায়াতের ব্যবস্হা করে দিলে।প্রা্য়ভেট গাড়ি কখনও বা । এর আগে সাঁতার প্রতিযোগীতায় জেতার জন্য ঢুঁ মারতেন কালীঘাট মন্দিরে, নিজের বা ক্লাবের খাতিরে। নিখরচায় গাড়ি পেয়ে প্রতিদিন অফিসের পর পেন্নাম করতে যাবার বাঁধা নিয়ম করে ফেললেন, তাঁর ‘বলে দে, তিনকড়ি হালদার এয়েচে’ উক্তিসহ, অর্থাৎ মাকালীকে বলে দে আমি এসেছি। কমলা আর বড়ো ছেলে অজয় প্রীত যে প্রতিদিন মায়ের প্রসাদ এনে বংশগৌরব ফিরে পাচ্ছেন তিনকড়ি হালদার । প্রসাদের টুকরো টুকরো ফুল-বেলপাতা-মিষ্টি পাবার জন্য হাসিমুখ-শরিকরাও পৌঁছে যেতেন ।

          হেদোয় ক্লাবের কাজটা ছেলে অজয়ের ওপর ছেড়ে দিলেন তিনকড়ি হালদার। তাঁর গাড়ি রেস খেলার দিনগুলোয় হেদোয় যাবার বদলে রেসের মাঠের দিকে বাঁক নিয়ে তারপর কালীঘাট যেতে লাগল । খেলার খরচ তো আর তাঁকে দিতে হচ্ছে না, অথচ জিতলে টাকাটার অর্ধেক তাঁর আর অর্ধেক মাকালীর । ব্রিটিশ ডার্বি, কেন্টাকি ডার্বি, ইত্যাদিতে খেলার ঘাঁতঘোঁতও জেনে ফেললেন। ভালোই শিখে ফেললেন রেস খেলাটা। ঘোড়ানিদের বংশ পরিচয়, আর জকিদের জীবনচরিত, মুখস্হ করে ফেলেছিলেন বটে, তবে মোক্ষম দাঁও জিততেন না বড়ো একটা । রেসের মাঠে যাতায়াত করে তিনকড়ি হালদার জানতে পারলেন যে তাঁর আইরিটোলা পাড়াতেই প্রচুর রেসুড়ে আছে । সাঁতার ক্লাবের বন্ধুদের আড্ডা থেকে তিনি নিজেকে স্হানান্তরিত করলেন রেসুড়েদের জমায়েতে । 

          সাঁতার কাটার দিনগুলোতে একাধ ঢোঁক দিশি মদ খেতেন তিনকড়ি হালদার, যাকে উনি বল;তেন ধান্যেশ্বরী । মাল সাপ্লায়ার আর ক্রেতাদের দালালদের মাধ্যমে কলকাতার প্রতিটি ধান্যেশ্বরী ঠেকের সঙ্গে পরিচয় হল তাঁর । তারপর জীবনে ধান্যেশ্বরীকে ছাড়েননি কখনও । খাঁটি স্কচ আর সিঙ্গল মল্ট উপঢৌকন পেতেন। নিতেন না । ‘ধান্যেশ্বরী তো মাকালীর আরেক রূপ, তাকে ছেড়ে বিদিশি মাগির পেচন-পেচন ছুটবে, তেমন শর্মা নয় এই তিনকড়ি হালদার’, বলতেন, কেউ প্রশ্ন তুললে। কিংবা বল;তেন, ‘আমায় কি বালিগঞ্জিকা পেইচিস!’ বালিগঞ্জিকা অর্থে যে এলিট বাঙালিরা বা অভদ্রবিত্তরা, তখনকার দিনে বালিগঞ্জে থাকতেন, তখনও তাঁদের খেদিয়ে তাড়ায়নি মারোয়াড়ি ব্যাবসাদাররা । এখন তো মারোয়াড়ি আর বিহারিরা বালিগঞ্জের বাড়ি-দোকানপাট দখল করে নিয়েছে, তাই বালিগঞ্জিকা বলতে যে শহুরে নকল বাঙালিয়ানা বোঝাতো, তা টের পাবার উপায় নেই । উনি বলতেন, ‘কালীঘাটের হালদার হয়ে বাংলা মদ খাবে না তো কী খাবে, সত্যনারাণের বোষ্টুমি চন্নামেত্তর?’ 

         শরিকদের সবায়ের বাড়িতে ধান্যেশ্বরী খাবার চল ছিল, এমনকী গৃহকর্ত্রীরাও খেতেন কয়েকটা পরিবারে, কেবল ধান্যেশ্বরী বা ধেনো বা দিশি,  কমলাও বাদ যাননি । এখন যাকে বাংলা মদ বলা হয়, তাকে বোধহয় ধান্যেশ্বরী বলা যাবে না, কেননা তিনকড়ি হালদারের পারিবারিক কিংবদন্তি অনুযায়ী, অমুক বাড়ির রাঙাকাকু বা তমুক বাড়ির ফুলদিদা ছিপি খুলে গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারতেন ধান্যেশ্বরীটি কোন চাল থেকে তৈরি – কমলার বুলিতে ‘তোয়ের’-- হয়েছে, তা হাঁসকাটি, ঝিঙাশাল, বকুলফুল, ভাসামাণিক, লালঝুলুর, কণকচুর নাকি আটপৌরে । চালগুলো ‘মায়ের এক একটি রূপ, ধানের খোসা তাঁর পরিধান । ভাত হলো শ্বেতাঙ্গিনী বিবস্ত্রা।’ বলতেন তিনকড়ি হালদার ।

           মদ খাবার পর হালদারদের এক খানা প্রিয় গান ছিল, কাঁসারি তারক প্রামাণিকের গান, যা তিনকড়িও গাইতেন, মাতাল অবস্হায় বাড়ি ফেরার সময় । গানটা এরকম:

শহরে এক নূতন

হুজুগ উঠেছে রে ভাই

অশ্লীলতা শব্দ মোরা আগে শুনি নাই।           

বৎসরান্তে একটি দিন

কাঁসারিরা যত

নেচে কুঁদে বেড়ায় সুখে

দেখে লোকে কত।

যদি ইহা এত মন্দ

মনে ভেবে থাকো

নিজের মাগকে চাবি দিয়ে

বন্ধ করে রাখো।

          ধান্যেশ্বরী তাঁর প্রতিদিনের সঙ্গিনী হয়ে ওঠার পর, তিনকড়ি হালদার অফিস থেকে কালীঘাট, সেখান থেকে ‘মায়ের প্রসাদ’ হাতে ধান্যেশ্বরীর ঠেক, যা তখনও বজায় ছিল, অ্যালকোহোলে আক্রান্ত হয়নি, তারপর মদের ঠেক থেকে প্রসাদ হাতে অবিরাম মা-মা-মা-মা করতে করতে আহিরিটোলা । রেসের দিন অফিস থেকে ঘোড়দৌড়ের মাঠ হয়ে যাবতীয় ইতিকর্তব্য । সাঁতার কাটার হেদোর দিনগুলো থেকেই, থিয়েটার দেখার নেশা ছিল তিনকড়ি হালদারের, মূলত নাটকগুলোর এক্সট্রা নারীচরিত্রগুলোর কারণে । থিয়েটারের দিনগুলোতে মদের ঠেক হয়ে পৌঁছোতেন নাটক দেখতে । নাটকটা দেখতেন না তিনি । দেখতেন যুবতী এক্সট্রাদের ।কোনও একজনকে পছন্দ হলে, তার নাটক বারবার দেখতেন । সেই চরিত্রের ভূমিকাটি নাটকে যেখানে শেষ হতো, তিনকড়ি হালদারের কাছে সেখানেই শেষ হতো নাটকটা। ভূমিকাটি নাটকের শেষ দৃশ্য পর্যন্ত থাকলে, তিনি সম্পূর্ণ নাটকটি দেখতেন । অধিকাংশ ক্ষেত্রে, সম্পূর্ণ নাটক দেখার প্রয়োজন তাঁর হতো না, এমনকি একশোজন এক্সট্রা অংশগ্রহণকারীতে ঠাশা শিশিরকুমার ভাদুড়ীর ‘সীতা’ নাটকটিও নয় । 

         নাটকের ব্যাকস্টেজ মেয়েদের তাঁর পরিচয় তিনি নিজে উপযাচক হয়ে হেদোর দিনগুলোয় করতেন বটে, কিন্তু ব্যাপার অনেক সময়ে অন্যান্য অভিলাষী পুরুষদের কারণে ঘোরালো হয়ে উঠতো। কিংবা বিপজ্জনক হয়ে উঠতো যুবতিটির পণ্যযোগ্যতা চিনতে ভুল হলে ।এক্ষেত্রেও তিনি অফিসসূত্রে মারোয়াড়ি পৃষ্ঠপোষকদের সাহায্য পেলেন । থিয়েটারের ব্যাকস্টেজ নারীজগত থেকে কলকাতা শহরের যৌনকর্মী জগতে অনায়াসে উত্তরণ ঘটল তাঁর। তখনকার অবিনাশ কবিরাজ এবং বৌবাজারে — যদিও বৌবাজারের শরৎচন্দ্রীয় গরিমা তখন অবসানমুখী — কয়েকটি বাড়ি একএকজন যৌনকর্মীর নামে বিখ্যাত ছিল, রাধারানির বাড়ি, চারুমতির বাড়ি, সুখময়ীর বাড়ি ইত্যাদি, যেগুলোয় নিয়মিত যাতায়াতে একটি বিশেষ কারণে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন । তিনকড়ি হালদার ওই যুবতিদের সবাইকে, যখন যাঁর বাড়ি যেতেন, তাঁকে সেদিন কমলা বলে ডাকতেন। মাতাল অবস্হায় ওপর দিকে দুহাত তুলে মাঝরাতের প্রায় স্তব্ধ আর টিমটিমে কলকাতায় ‘কমলা কমলা’  চিৎকার করতে করতে বাড়ি ফিরতেন । ‘মায়ের প্রসাদ’ ছেড়ে যেতো ডুপলিকেট কমলার বাড়ি ; অনেক সময়ে তাকেই দিয়ে আসতেন । তিনকড়ি হালদার মা-মা-মা-মা নাকি কমলা-কমলা চেঁচাতে চেঁচাতে বাড়ি ফিরছেন, তা শুনে আসল কমলা বুঝে যেতেন তিনকড়ি হালদার কোথা থেকে ফিরছেন ।

          মলয় আর তাঁর দাদা সমীর যখন হাংরি আন্দোলনসূত্রে গ্রেপ্তার হন, তখন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে জামিন পাবার জন্য তিনকড়ি হালদার ছাড়া কলকাতায় আর কোনো আত্মীয় তাঁদের ছিল না। কলকাতায় কোনো উকিলের কথাও জানতেন না তাঁরা।উকিল  চণ্ডীচরণ মৈত্র অবিনাশ কবিরাজ লেনের ঠিক উল্টো দিকের চেম্বারে বসতেন। তিনকড়ি হালদার তাঁকে চিনতেন কেননা সোনাগাছিতে পুলিশ কোনো অপরাধের কারণে কাউকে গ্রেপ্তার করলে পরিত্রাতা ছিলেন চণ্ডীচরণ মৈত্র । তিনকড়ি হালদার ভেবেছিলেন উকিলমশায় প্রতিদিন কাউকে না কাউকে যখন উৎরে দিচ্ছেন, তখন মলয় আর ওর দাদা সমীরকেও দেবেন। এ তো আর বেআইনি যৌনকাজ নয়, এ তো শুধু বেআইনি যৌন লেখালিখি। ব্যাঙ্কশাল কোর্টের পেশকার বলেছিলেন, ‘কোথ্থেকে এসব উকিল পেয়েচেন বলুন তো ? একজন মাগিদের দালালদের আর গুণ্ডা-বজ্জাতদের উকিল, আরেকজন মজুরদের উকিল । মলয়ের আরেক উকিল ছিলেন লেবার কোর্টের সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায় । চণ্ডীচরণ মৈত্রর চেম্বারের জানলা দিয়ে মলয় দেখতো কৃত্তিবাস পত্রিকার দলের কারা কারা অবিনাশ কবিরাজের মোড়ের দোকান থেকে গোড়ের মালা কিনে হাতে জড়িয়ে সোনাগাছিতে দলবেঁধে ঢুকছে, ফি শনিবারের সন্ধ্যায় ।

          রাতে তিনকড়ি যতোই ধান্যেশ্বরীর সেবা করুন আর ডুপলিকেট কমলাদের সেবা নিন, সকালে উঠে উনি একেবারে তরতাজা । হ্যাঙওভারের বালাই ছিল না বংশানুক্রমে । নিজের এই ধরণের কার্যকলাপকে তিনি মনে করতেন আগের জন্মের পূণ্যফল আর পূর্বপুরুষদের রক্তের জোর । তাঁর অফিসের ব্রিটিশ কর্মকর্তারা তাঁর ব্যক্তিগত কাজ কারবারের কথা জানতেন। তাঁরা এও জানতেন যে, তিনকড়ি হালদার একটি ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর — বিকিকিনির মালকে সর্বোৎকৃষ্ট হতে হবে, যাতে কোম্পানির বদনাম না হয় । প্রয়োজনে তিনি নিজেই যাচাই করতে যেতেন, ভারতবর্ষের যেখানে হোক। অফিস থেকে এভাবে গাপ মারার  সুবিধের জন্য  কলকাতার বাইরে স্বজনজ্ঞাতিদের বাড়িতে এক কাপড়ে হাজির হতেন, হাতের থলেতে ভেটকি বা ইলিশ, প্রায় পচ ধরেছে, ‘বাজার করতে বেরিয়ে হাওড়া পোলের মাতাটা দেখতে পেলুম সেজবৌদি, কতোকাল তোমার হাতের ফুলকপি আর গরম মশলা দেয়া ভেটকি খাইনি গো’, কিংবা ‘ট্যাক্সিটা পাশ দিয়ে যেতে চেপে বসলুম মাইমা, তোমার ভাপা ইলিশের মতন ভূভারতে আর কেউ রাঁধতে পারেবেনি’।

          তিনকড়ি হালদারের বড়ো ছেলে অজয় হালদারও যে আগের জন্মে পূণ্য করেছিলেন, তা আচমকা আবিষ্কার করেছিলেন তিনি । আংশিক পূণ্য । অজয় হালদার রেসের মাঠ আর কালীঘাটে যেতেন না । অজয়ের ডাকনাম ছিল সেন্টু আর ওই নামেই চিনতো সবাই, সমীরের বন্ধু শক্তি, সুনীল, সন্দীপনরাও । কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে ধান্যেশ্বরীর সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়েছিলেন অজয় হালদার । শক্তি আর অজয় একই সঙ্গে সমীরের চাইবাসার বাসায় বছর-বছর কাটিয়ে দিতেন আর মহুয়ার মদ খেয়ে টলতে টলতে জড়াজড়ি করে শালজঙ্গলে এই ধরনের গান গেয়ে ফিরতেন: 

শাল তলে বেলা ডুবিল দিদি লিলো লো

শাল তলে বেলা ডুবিল।

ও লিলাক দিদি লিলো লো, লিলো লো, লিলো লো

শাল তলে বেলা ডুবিল,

শাল তলে বেলা ডুবিল দিদি লিলো লো

শাল তলে বেলা ডুবিল।

.

আরে লুধুরার লদীতে বান পড়িল দিদি,

আরে লুধুরার লদীতে বান পড়িল দিদি

ও দিদি লিলো লো, লিলো লো, লিলো লো

শাল তলে বেলা ডুবিল।

শাল তলে বেলা ডুবিল দিদি লিলো লো

শাল তলে বেলা ডুবিল।

.

আরে বারে বারে করি মানা সাঁজলা

সোনার ছাতা পেলো না

সোনার ছাতা পেলো না

সোনার ছাতা ধৈর না গো

আরে পশ্চিমের বাতাসে দক্ষিণের মেঘেতে,

পশ্চিমের বাতাসে দক্ষিণের মেঘেতে

সোনার ছাতা ভাঙিল,

সোনার ছাতা ভাঙিল

সোনার ছাতা ভাঙিল রে।

শাল তলে বেলা ডুবিল দিদি লিলো লো

শাল তলে বেলা ডুবিল।

.

আর আগাম জলে দাঁড়াল রে সাঁজলা

হাঁটু জলে পারা নরে কাপড় ভিজি গেল

ওই বাঘমুণ্ডীর পাহাড়ে, মারাংবুরু আহারে

হাঁটু জলে পারা নরে কাপড় ভিজি গেল

শাল তলে বেলা ডুবিল দিদি লিলো লো

শাল তলে বেলা ডুবিল।

ও লিলাক দিদি লিলো লো, লিলো লো, লিলো লো

শাল তলে বেলা ডুবিল..

          অত্যাধিক মদ খেয়ে সামাল দেবার প্রশিক্ষণও অজয়ই দিয়েছেন সমীরের বন্ধুদের। সমীর কর্তৃক প্রকাশিত যে হাংরি বুলেটিনের কারণে মলয়ের বিরুদ্ধে পঁয়ত্রিশ মাস মকদ্দমা হয়েছিল, তার ঠিকানা ছিল তিনকড়ি হালাদারের বাড়ির আর এলোমেলে বাড়ির ঠিকানা মেলাতে পারেনি কলকাতার পুলিশ ।

          তিনকড়ি হালদার যেদিন মাইনে পেতেন, সেদিন অজয় হালদার, অজয় কলকাতায় না থাকলে সঞ্জয় হালদার,  বার্ড অ্যাণ্ড হিলজার্স কোম্পানির অফিসে গিয়ে মাইনের টাকাটা বাপের কাছ থেকে নিয়ে আসতেন যাতে না টাকাগুলো উনি খরচ করে ফেলেন। অফিস থেকে বাবা বেরিয়ে গিয়ে থাকলে খালাসিটোলা, ব আরদুয়ারি, খিদিরপুর, চিৎপুর, গ্যালিফ স্ট্রিট, ইত্যাদি ঠেকগুলোর কোনো একটায় বাবাকে পেয়ে যেতেন অজয় বা সঞ্জয় । তিনকড়ি হালদার বুঝতে পারেন যে পাড়া-বেপাড়ার সব ঠেকই তাঁর ছেলেদের জানা ।

          অজয় হালদারকে মনোহর দাস কাটরার এক ব্যাবসাদারের আড়তে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনকড়ি। কাটরার মালিকরা দোকানে রাখতেন না কিছু । তাঁদের সাইনবোর্ডে লেখা থাকতো তাঁরা কী-কী বিক্রি করেন ।  তাঁদের প্রত্যেকের কাছে থাকতো চাবির গোছা । কেউ কোনও কিছু কিনতে এলে চাবির গোছাটা কর্মীকে দিয়ে বলতেন, অমুক নম্বর গোডাউন থেকে মালটা নিয়ে আয়। একটা দোকানে এরকমই কর্মী ছিলেন অজয় হালদার । কোনও দোকানের কোনও গোডাউন ছিল না । চাবির গোছাটি নিয়ে হোল সেলারের কাছ থেকে কম দামে জিনিস কিনে বেশি দামে বেচে দেয়া হতো । বিহার, ওড়িষা, আসাম বা বাংলার মফসসল থেকে যে ব্যবসাদাররা কিনতে আসতো, তারা একটা দোকানে সব জিনিস পেয়ে যেতো, বাজারে খোঁজাখুঁজির হয়রানি থেকে বাঁচতো।

          বাজারের নানা ধান্দাবাজি শেখার পর অজয় হালদার নিজে ব্যবসা ফাঁদার চেষ্টা শুরু করলেন । কলকাতায় কিনে বিহার, ওড়িষা, আসামে গিয়ে বিক্রি, যার অর্ডার উনি মনোহরদাস কাটরার ক্রেতাদের থেকে নিতেন, তাদের আড়ালে ডেকে । দুটো কাজ একসঙ্গে চলল না । চাবি হাতে গোডাউনে যাবার কাজটাই বজায় রইলো । 

          একদিন কোনও সাবিত্রীরানি বা জ্ঞানদাবালার বাড়িতে যখন তিনকড়ি হালদার সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলেন, তিনি দেখলেন তাঁর বড়ো ছেলে দ্রুত তাঁর পাশ দিয়ে নেমে রাস্তায় বেরিয়ে গেল । আহিরিটোলায় সোনাগাছিকে বলা হতো কামরেখা পাড়া। তিনকড়ি চাননি তাঁর ছেলেদের কেউ তাঁর মতন হোক । তাঁর ইচ্ছে আংশিক পুরো হয়েছিল । কেবল অজয় হয়েছিলেন বাপের মতন, দিশি মদ আর মহুয়ার মদ খে্য়ে অজয়ের দাঁতে কালো ছোপ ধরেছিল, কখনও তো দাঁত মাজতো না। তিনকড়ি হালদার দাঁত মাজা, গন্ধ সাবান মাখা, টাক পড়ে গিয়ে থাকলেও জবাকুসুম তেল মাখা শেষ দিন পর্যন্ত বজায় রেখেছিলেন ।

          সেই দিন অজয় হালদার সোজা বাড়ি ফিরে, টিনের সুটকেসে জামাকাপড় ঠেশে, বাবা বাড়ি ফেরার আগে, যা কিছু সঞ্চয় ছিল কুড়িয়ে-বাড়িয়ে রওনা দিওলেন পাটনা, মামার বাড়ি । চাইবাসা আর পাটনাকে কেন্দ্রকরে ব্যবসা করতে লাগলেন । কলকাতা থেকে মাল কিনে মামার বাড়ি বা মামাতো ভাইয়ের বাড়িতে স্টক করতেন ।কলকাতায় গিয়েও আহিরিটোলায় নিজের বাড়ি যেতেন না, উত্তরপাড়ায় দিদিমার ভাঙা খণ্ডহরে আশ্রয় নিতেন । কলকাতা থেকে কিনে পাটনায় পোর্টেবল আয়না আর ছবি আঁকার তুলি নিয়ে যেতেন। আয়নায় যেখানে বাবল বা ঢেউ খেলে গেছে সেখানে ‘বেলজিয়ান গ্লাস’ বা ‘এক্সপোর্ট কোয়ালিটি’ স্টিকার লাগাতেন, যেগুলো বাগড়ি মার্কেটে পাওয়া যেতো । তুলিগুলো যে লোমেরই হোক, বেশির ভাগ বেঁজি বা শুয়োরের,  রাজাবাজার থেকে কিনে, তাতে ‘মেড ‘অফ স্কুইরল হেয়ার, এমবস করিয়ে আনতেন । মামাতো ভাইবোনদের বোঝাতেন, ‘সব বাঞ্চোৎদের বিদিশি মাল চাই, বুঝলিনে !’ 

          অজয় হালদার বেশিদিন ধান্যেশ্বরীতে অনুগত থাকতে পারেননি । রামেশ্বরী, ভোদকাশ্বরী, ব্র্যাণ্ডিশ্বরী, হুইস্কিশ্বরী, তাড়িশ্বরী — আয় অনুযায়ী আনুগত্য পালটেছে । পাটনায় ধান্যেশ্বরী পেতেন না । যে দিশি মদ পেতেন তার নাম ঠররা, যা অত্যধিক খাবার ফলে নিচের পাটির কয়েকটা দাঁত তুলে ফেলে নকল দাঁত বসাতে হয়েছিল, যেটা ঘুমোবার সময়ে  নেশায় বুঁদ থাকার দরুন, প্রায়ই খুলে রাখতে ভুলে যেতেন । হাঁ করে ঘুমোবার অভ্যাসের দরুন তাঁর হাঁ-মুখ থেকে দাঁতের ঘুমন্ত সেট ছিটকে বেরিয়ে যেতো, আর মাঝরাতে পেচ্ছাপ করতে উঠে মাড়িয়ে ভেঙে ফেলতেন । নতুন পাটি না হওয়া পর্যন্ত মুখে হাত চাপা দিয়ে কথা কইতেন । যে সংকট কলকাতায় তৈরি করে অজয় হালদার আহিরিটোলার বাড়ি থেকে কেটে পড়েছিলেন, তাকে ছাপিয়ে আরও জটিল সংকট তিনকড়ি হালদারের পরিবারে উপস্হিত হলে অজয় বাড়ি ফেরার সুযোগ পেলেন।

          বড়ো মেয়ে গীতার যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল সে গীতার চেয়ে বয়সে যথেষ্ট বড়ো, কালো আর উঁচু দাঁত বাইরে বেরিয়ে থাকে বলে পছন্দ হয়নি গীতার । বিয়ের তন মাসের মধ্যে গীতা ওর বরের সৌম্যকান্তি ভাইপোর সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে সংসার পেতেছে শুনে তিনকড়ি হালদার বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন । অজয় হালদার কলকাতায় ফিরে বোনকে তার লিভ-ইন পার্টনারের সঙ্গে বিয়ে দিলেন আর প্রথম স্বামীকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে তাকে দিয়ে সম্প্রদানের কাজটি করিয়ে নিলেন । বাবা, ছেলে, মেয়ের জটিল কর্মকাণ্ড এভাবেই পারস্পরিক আর সামাজিক স্বীকৃতি পেলো ।

          বোনের বিয়ে মিটমাটের পর অজয় হালদার পাটনায় মামার বাড়ি ফিরলেন, আর চেষ্টা চালাতে লাগলেন যাতে কোনো বাড়িতে ঘরজামাই হওয়া যায় । মামাতো ভাই চাইবাসা থেকে বদলি হয়ে চলে গিয়েছিলেন লাহেরিয়াসরাই, তাঁর ডাকে অজয় হালদার সেখানে পৌঁছে, ঘরজামাই-প্রার্থী পরিবারের কর্তাকে ইনটারভিউ দিলেন । দ্বারভাঙ্গায় একজন বাঙালি ঘিয়ের হোলসেল ব্যাবসাদার তাঁর একমাত্র মেয়ের জন্য ঘরজামাই পাত্র খুঁজছিলেন । মেয়ের বাবা বিজয় ব্যানার্জি বড়ো ব্যবসাদার জানতে পেরে পাত্রী কেমনতর জানার দরকার হয়নি অজয়ের । অজয়ের মামাশশুর হবেন বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় শুনে যদিও যৎসামান্য ভয় হয়েছিল অজয় আর সমীরের, কেননা অজয়ের পরিবারের কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করাতে চায়নি পিসতুতো-মামাতো ভাইজুটি । দেখতে-শুনতে ভালো আর ব্যবসাদারের মতন সড়গড় কথাবার্তা শুনে অজয়কে পছন্দ হয়ে গেল আর দ্রুত বিয়ের তারিখ নিশ্চিত করে ফেলা হলো।

         বরকর্তা বা অজয়ের পরিবারের একজনের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য সমীরের পরিচিত টাকমাথা যুবক মিলন চক্রবর্তীকে রাজি করানো হলো, যদিও অজয় খাঁটি কলকাতিয়া আর মিলন ছিলেন কাঠবাঙাল । হুইস্কির পরিমাণ বেশি হয়ে যাওয়ার ফলে বিয়ের আসরে মিলন চক্রবর্তী অবিরাম নিজের ঢাকার বুলিতে কথা বলে গেলেন। আহিরিটোলার কলকাত্তাই ছেলের বাঙাল বরকর্তা দেখে বিভূতিভূষণ গোলমাল ধরে ফেলতে, সমীরকে পুরো ব্যাপারটা খোলোসা করতে হলো । ফুলশয্যার রাতে অজয়ের দাঁতের পাটি ঘুমন্ত অবস্হায় যথারীতি বেরিয়ে গিয়েছিল, আর অজয়ের নতুন বউ মাঝরাতে উঠে টয়লেটে যাবার সময়ে যথারীতি গুঁড়িয়ে ফেলেছিল । শশুরের ব্যবসায় গ্যাঁট হয়ে বসে কালক্রমে প্রায়-বিহারি আড়তদারে রূপান্তরিত হলেন অজয় হালদার। নামের বিহারিকরণে অজয় উত্তর বিহারের ঘিয়ের বাজারে পরিচিত হলেন হলধর বা হলধর শেঠ নামে । হলধর শেঠ আর আহিরিটোলামুখি হলেন না । ওনার বাবা ছেলের হিল্লে হয়ে গেছে শুনে আনন্দিত হলেও কমলা বেশ চটে গেলেন সমীরের ওপর । বলেছিলেন, ‘এটা কেমন বিয়ে ? মা-বাপ জানতে পারলো না!’ যাই হোক, হলধর শেঠের দুই ছেলে হলো যারা কলকাত্তাই বা ঢাকাই কোনো বাংলা শিখল না, কথাও বলতে লাগলো মৈথিলিতে, স্হানীয় ভাষায় ।

          আর তিনকড়ি হালদার ?

          চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্তির পর রেসখেলা, দেহবাজার, ধান্যেশ্বরী, সব কিছু ছেড়ে গেল একে একে । আহিরিটোলা থেকে কখনো-কখনো হেঁটে চলে যেতেন হেদোয় । উদাসীন চিন্তা করতেন যে আহিরিটোলায় আর টেকা যাবে না, কেননা নতুন যে লোকগুলো মহাকরণ আর পুরসভার দখল নিয়েছে তারা বাজোরিয়া, কানোরিয়া, সরদা, জালান, জৈন, কাংকারিয়ে, পাসারিদের তেল খেয়ে, পুরসভার কর বাড়িয়ে-বাড়িয়ে, আদি নিবাসীদের কলকাতা-ছাড়া করবেই, তাড়িয়ে পাঠাবে উত্তর আর চব্বিশ পরগণায়। সব শরিক নিজের অংশটুকু বিল্ডারদের বেচে দিয়ে পালিয়েছে মফসসলে। সবাই সবাই সব্বাই । জলের কিনারায় একা বসে তাকিয়ে থাকতেন সন্তরণরত কিশোরদের দিকে, যারা কেউ জানে না যে ক্লাবঘরে যাদের যৌবনকালের ফোটো আবছা হলুদ হয়ে এসেছে, সেসব সাঁতারজয়ীদের মধ্যে তিনিও একজন । কখনও বা আহিরিটোলা ঘাটে গিয়ে বসে থাকতেন চুপচাপ । চোখে পড়ত কোনো প্রৌঢ়া, আধপাকা চুল, মোটা থলথলে সাবিপীরানি, জ্ঞানদাবালা, চারুমতী বা সুখময়ীকে, বাড়িউলি মাসিতে রূপান্তরিত, সঙ্গে ডজনখানেক নেপালি আর বাংলাদেশি বোনঝি ।

          অমাবস্যার এক রাতে, আহিরিটোলার ছাদে মাদুরে শুয়েছিলেন তিনকড়ি হালদার, লুঙ্গি আর ফতুয়া গায়ে। ঘুম ভেঙে গেল আচমকা।  আকাশে তারায় তারা। তাঁর আশে-পাশে দূরে-কাছে পাথরের ঢিবি, সিল মাছ, শুশুক ধরণের জলপ্রাণীরা এলিয়ে পড়ে আছে । সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসছে। উঠে, সমুদ্রের দিকে পা বাড়ালেন উনি ।

          শবের পরিধানের পাশপকেট থেকে একটা চিরকুট পেয়েছিল জোড়াবাগান পুলিশ । তাতে লেখা, ‘আনন্দধারা বহিছে ভূবনে।’

[ রচনাকাল : অক্টোবর ২০০৩]





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন