শনিবার, ২২ মে, ২০২১

মলয় রায়চৌধুরী : নারীস্তনের যৌনতা

 নারীস্তনের যৌনতা : মলয় রায়চৌধুরী

যেভাবে বুক দুটোকে বেঁধে রাখিস

মনে হয় ওরা তোর মেয়ে

একটুখানি ঢিলে দিলে বেয়াড়া অসভ্য হয়ে

ডেকে আনবে পাড়ার ছেলেদের

স্নানের সময় যেই খুলে দিস

হুটোপাটি করে ওরা স্নান করে

কেউ কাউকে একটু কষ্ট না দিয়ে

যে যার মতো একা (দুর্বার জন্য কবিতা -- মিতুল দত্ত )

স্তন শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ‘যে শব্দ করে’। অর্থাৎ জানিয়ে দেয় যে, যৌবন আসছে দেহে। হাংরি আন্দোলনের সময়ে একটা বিয়ের কার্ডে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল যে লিণ্ডসে স্ট্রিটে এক তরুণীর খোলা বুক প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়েছে, শিল্পানুরাগীরা যেন তা দেখার জন্য সন্ধ্যাবেলায় অকুস্হলে আসেন । কার্ডটি পাঠানো হয়েছিল মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবিদের এবং তাঁদের অনেকেই চটে গিয়েছিলেন । আবু সয়ীদ আইয়ুব চটে গিয়ে অ্যালেন গিন্সবার্গকে হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলেন । বুদ্ধিজীবিদের চটে যাবার প্রধান কারণ হল আধুনিক সমাজে নারীস্তনের যৌনতা, যার প্রতি পুরুষদের টান নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আব্রাহামিক সংস্কৃতি ভারতে প্রবেশের আগে কিন্তু নারীর বুক ঢেকে রাখার চল সমাজের সব কয়টি স্তরে এবং সব কয়টি অঞ্চলে ছিল না । রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ আবু সয়ীদ আইয়ুব ‘কড়ি ও কোমল’-এর ‘স্তন’ কবিতাটা পড়েননি, সেকথা মানা যায় না :

 বাহিরে,

সৌরভ সুধায় করে পরান পাগল।

মরমের কোমলতা তরঙ্গ তরল

উথলি উঠেছে যেন হৃদয়ের তীরে।

কী যেন​​ বাঁশির ডাকে জগতের প্রেমে

বাহিরিয়া আসিতেছে সলাজ হৃদয়,

সহসা আলোতে এসে গেছে যেন থেমে--নারীর প্রাণের প্রেম মধুর কোমল,

বিকশিত যৌবনের বসন্ত সমীরে

কুসুমিত হয়ে ওই ফুটেছেশরমে মরিতে চায় অঞ্চল-আড়ালে।

প্রেমের সংগীত যেন বিকশিয়া রয়,


উঠিছে পড়িছে ধীরে হৃদয়ের তালে।

হেরো গো কমলাসন জননী লক্ষ্ণীর--

হেরো নারীহৃদয়ের পবিত্র মন্দির।

নারীর স্তন সম্পর্কে পুরুষেরা ইন্দ্রিয়কাতর ; সব কয়টি ইন্দ্রিয়কে সজাগ করে তোলে নারীর বর্তুল স্তন । যৌবনে পৌঁছেই নারীর মনে হয় যে পুরুষরা তাদের সঙ্গে নয়, তাদের স্তনের সঙ্গে কথা বলে । তার সত্যতা হলো যে মুখমণ্ডল সুশ্রী না হলেও পুরুষ অবচেতনে স্তনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বাবা-মায়ের বাছাই করা মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়, এমনকী প্রেমেও পড়ে একই কারণে।

পোপ যখন পর্তুগাল আর স্পেনকে নির্দেশ দিলেন যে তারা যথাক্রমে পূর্ব আর পশ্চিম বিশ্বকে লুটপাটের জন্য ভাগাভাগি করে নিক, তার পর  সমস্ত প্রাচীন  সংস্কৃতি মূল থেকে ধ্বংস হয়ে গেছে -- মিশরীয়, পারস্য, মেসোপটেমিয়ান, গ্রিক এবং রোমান, আমেরিকার মায়া ও অ্যজটেক  এবং আরও আদিম জীবন-পদ্ধতি। ভারতে তারপর আবির্ভাব হলো ইসলামি শাসকদের । নগ্নতাকে যৌন ‘পাপ’ হিসাবে দেগে দিয়েছে তারাই, এমনকী যৌনতাকেও তারা লজ্জাজনক পাপকর্ম হিসাবে চিহ্ণিত করে দিয়েছে বিভিন্ন উপনিবেশে।  স্তন যেহেতু যৌন আহ্লাদ উদ্রেক করে, তাই স্তন ঢাকার চল শুরু হল তাদের আবির্ভাবের পর । অজন্তায় বুদ্ধের মা নিজের স্তন ঢেকে রাখেননি, এবং তা সম্ভব হয়েছে ভারতে নগ্নতাকে লজ্জাজনক মনে করে হতো না বলে । দক্ষিণ আফ্রিকার জুলু আদিবাসদীরা এখনও স্তনকে খোলা রাখেন -- প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জেকব জুমার নবম বিয়েতে তাঁর হবু স্ত্রী সমেত আগের বউরা আর কুড়িটা বাচ্চাদের মধ্যে মেয়েরা বুক খুলে নেচে ছিলেন ।

প্রাচীন ভারতে স্তনের সঙ্গে যেমন ফার্টিলিটির সম্পর্ক ছিল তেমনই ছিল যৌনতার । ধনী পরিবারের নারীর পরিধান ছিল উত্তরীয়, অন্তরীয় আর কোমরবন্ধ -- উত্তরীয় এখনকার ওড়নির মতন যেটি দিয়ে বুক বাঁধা যেতো । অনেকে বাঁধতেন না, কেবল ঢেকে রাখতেন । মোগল বেগমরাও যে স্বচ্ছ মসলিনে ঢেকে রাখতেন তা এঁকে গেছেন মিনিয়েচার চিত্রকররা । জেনানা মহলে তাঁরা স্তনকে লুকোবার চিন্তায় ভুগতেন না তার কারণ খোজারা ছিল তাঁদের রক্ষী। কোনো কোনো বেগম, যাঁদের বিয়ে হতো না, তাঁরা স্তনে খোজাদের আদর নিতেন ।

নারীর স্তনের প্রতি বয়ঃসন্ধি-অতিক্রান্ত স্বাভাবিক আধুনিক পুরুষের যৌন আকর্ষণ  অদম্য । ‘স্বাভাবিক’ এইজন্য বলছি যে বয়ঃসন্ধির পর কিশোরেরা কিশোরীদের বদলে অন্য কিশোরদের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করতে পারে । কোনো কিশোরী অন্য কিশোরীর প্রতি আকর্ষিত হলে তারা পুরুষের মতো পরস্পরের স্তনকে যৌন-আহ্লাদের আরেকটি উৎস হিসাবে ব্যবহার করতে পারে।    নারীর  স্তন স্বাভাবিক পুরুষের কাছে সবচেয়ে ‘রহস্যজনক’। বয়ঃসন্ধি কালেই এই ভাবনার উৎপত্তি। একটি ছেলে যখন বড় হতে থাকে, তখন সে নারী শরীরে এমন একটি অংশ দেখতে পায়, যা তার নিজের শরীরে নেই। এই ভাবনা থেকেই নারীর স্তন, বিশেষ করে দুই স্তনের মাঝের খাঁজ,  তার কাছে আজীবন রহস্যজনক ও আকর্ষণীয় রয়ে যায়। স্তন দেখে আধুনিক পুরুষের শরীরে যৌন উত্তেজনা অনুভূত হয় এবং ঋতুমতী তরুণীরা সেকথা ক্রমশ উপলব্ধি করেন। যে নারীদের স্তন অপেক্ষাকৃত ছোটো, তাঁদের যৌন-হীনমন্যতায় ভোগার সম্ভাবনা থাকে। এখন তাই সিলিকন জেলের সাহায্যে স্তনকে বড়ো, নিটোল আর স্হায়ী করার শল্যচিকিৎসা জনপ্রিয় । 

মানুষই হল একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যার যৌন উত্তেজনার সঙ্গে স্তনের সম্পর্ক রয়েছে। সাধারণত বড়ো মাপের স্তনের প্রতি পুরুষ বেশি আকর্ষণ অনুভব করে। নারী শরীরের অন্যতম নরম অংশ হল স্তন। এই কোমলতা পুরুষকে আকর্ষণ করে। ফলে স্তন স্পর্শ করতে, মুখ দিতে, মাথা রাখতে, এমনকী নারী দুই হাতে দুটি স্তনকে পরস্পরের সঙ্গে চেপে সঙ্গমছিদ্র তৈরি করলে পুরুষ আগ্রহ বোধ করে। নারী-স্তন পুরুষের কাছে অত্যন্ত আরামদায়ক। স্তনে মাথা রেখে বিশ্রাম নেওয়া তার সুপ্রাচীন অভ্যাস। জীবজগতে একমাত্র মানুষের ক্ষেত্রে নারীর স্তন বয়সের সঙ্গে মাপে বড়ো হয়, যখন কিনা স্তন্যপায়ী পশুদের স্তনের মাপ বড়ো হয় তারা পোয়াতি হয়ে বুকে দুধ আসার পর ; বাচ্চা বড়ো হবার পর আবার আগের মতো হয়ে যায় ।  ঋতুর বয়সে পড়লে নারীর বুকে কেন চর্বি জমে অমন আকর্ষক পিণ্ড গড়ে ওঠে তার নানা রকম ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন গবেষকরা। কিন্তু প্রধান তর্ক হল যে তা পুরুষকে আকর্ষণের জন্য প্রকৃতির অবদান । ২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘দি কেমিস্ট্রি বিটউইন আস : লাভ, সেক্স অ্যান্ড দি সায়েন্স অব অ্যাট্রাকশান’ বইতে ল্যারি ইয়াং ও ব্রায়ান আলেকজান্ডার জানিয়েছেন যে নারীর স্তন সম্পর্কে পুরুষদের অবশেসন ঘটে যখন সে মায়ের কোলে শুয়ে দুধ খায় এবং মায়ের অক্সিটোসিন হরমোন নির্গত হয় যার দরুন স্তনের সঙ্গে পুরুষের পাকা বাঁধন তৈরি হয়ে যায়, অবচেতনায় গেঁথে যায় । পুরুষ তার সঙ্গিনীর মধ্যে সেই একই বাঁধনযোগ্যতা খোঁজে আর তার জন্য সে বড়ো মাপের স্তনের প্রতি আকৃষ্ট হয় । যারা বেশ্যালয়ে যাতায়াত করে তারাও সুন্দর মুখমণ্ডলের বদলে বর্তুল স্তন আর খাঁজের খদ্দের হয়ে ওঠে । পুরুষ যখন চোখে দেখে, ছোঁয়, মুখ দেয়, টেপে, তখন তার অবচেতনায় শৈশবের ভালোলাগা স্মৃতি কাজ করে । বড়ো মাপের স্তনের প্রতি পুরুষের আকর্যণের কারণ হল অবচেতনে তারা স্তনকে দুধের ভাঁড়ার হিসাবে দ্যাখে ; যতো বড়ো স্তন ততো বেশি দুধ । সন্তান প্রসবের পর কোনো কোনো নারীর অত্যধিক দুধ হয় যা আগেকার কালে গেলে ফেলে দেবার চল ছিল ; এখন ডাক্তাররা বলেন যে তা সংগ্রহ করে অন্যান্য শিশুদের দিতে কিংবা তা স্বামী নিজেই স্তন থেকে পান করতে পারেন ।

ভারতে নারীস্তনের যৌনতার ভাস্কর্য ও আঁকার গুরুত্ব বহু প্রাচীন এবং সেই স্তনগুলো ছোটো মাপের যে নয় তা আমরা খাজুরাহো, মীনাক্ষীমন্দির, কোনারক এমনকি অজন্তাতেও দেখেছি । পক্ষান্তরে ইউরোপে নারীস্তনের  যৌনতা অতো প্রাচীন নয় । গ্রিসে যখন ভাস্কর্যে নারীস্তনকে  গুরুত্ব দেয়া আরম্ভ হল তখন সেই নারীদের স্তন ছিল ছোটো মাপের । সৌন্দর্য ছিল একটি মনঃশারীরিক বিষয় যা বুকের আকারের মতো চরিত্র এবং ঐশ্বরিক অনুগ্রহের সাথে জড়িত ছিল । ক্লিওপেট্রার যে মূর্তিগুলো পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায় তাঁর স্তন ছিল ছোটো মাপের অথচ তাঁর আকর্ষণ সম্রাটরাও প্রতিরোধ করতে পারেননি । রেনেসঁসের সময়ে আঁকা ভার্জিন মেরি আর ইভের স্তনও অনেক ছোটো করে এঁকেছেন চিত্রকররা, কেননা তাঁদের থেকেই ‘অরিজিনাল সিন’ তত্ত্বের আরম্ভ । সময়ের সমাজবীক্ষার সঙ্গে নারীর স্তন সম্পর্কে সমাজভাবনারও পরিবর্তন ঘটেছে । আদর্শ স্তন বলতে কেবল তার মাপই নয়, তার আকার, দুই স্তনের মাঝে ফাঁক, ত্বকের রঙ এবং বোঁটার মাপ আর আভার ব্যাপারেও চিন্তার বদল ঘটেছে । একটি বিশেষ সময়ের নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক উদ্বেগ, ভীতি, বিশ্বাস ও ধর্মকর্মও প্রতিফলিত হয়েছে সেই সময়ের আঁকায় আর ভাস্কর্যে ।

পালেওলিথিক আর নিওলিথিক যুগের আঁকা বা ভাস্কর্যে নগ্নিকাদের মাথা ছিল ছোটো কিন্তু স্তন আর পাছার মাপ বিপুল, কেননা সেটাই ছিল আদর্শ নারীদেহ । ফ্যারাওদের সময়ে মিশরে দেবী ও রানিদের স্তন খোলা থাকতো, তাঁদের মাতৃত্ব ও ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে কিন্তু তাদের মাপ ছিল ছোটো । টিউরিনের পাপিরাসে পেছন দিক থেকে এক নারীর সঙ্গে সঙ্গমরত পুরুষের ছবিতে দেখানো হয়েছে পুরুষের লিঙ্গের মাপ বড়ো আর নারীর স্তন ছোটো  । প্রাচীন গ্রিসে সৌন্দর্য ও ভালোবাসার দেবী আফ্রোদিতির মূর্তিগুলোর স্তন বেশ ছোটো । কিন্তু গ্রিসের মূর্তিগুলোও ক্রমশ ঢাকা পড়তে লাগল গায়ের চাদরে । পক্ষান্তরে রোমানরা গড়ে গেছে বড়ো মাপের স্তন ও ছোটো মাপের লিঙ্গ ; রোমান নারীরা বুক বেঁধে রাখতেন ; হয়ত তা থেকেই বডিসের জন্ম । নবম শতকের টাআং রাজত্বেও দেখা গেছে চীনা নারীদের বড়ো মাপের স্তন, যদিও চীনাদের স্তন অপেক্ষাকৃত ছোটো হয় বলে মাপ বৃদ্ধি করার ওষুধপত্র খেতেন ও মাখতেন নারীরা । সে সময়ে চিনের আদর্শ নারীরা ছিলেন বড়ো স্তন, মোটাসোটা আর ভারি পাছার। রাজ দরবারে তাঁরা দুই হাত দিয়ে স্তন ঢেকে রাখতেন । 

নবম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতের চোল সাম্রাজ্যে পার্বতীর মূর্তি আর ছবিতে একেবারে বর্তুল নিটোল স্তন আর উঁচু বোঁটা দেখা যায় । তিনি ছিলেন নারীদেহের নিখুঁত সৌন্দয্যের প্রতিনিধি । দক্ষিণ ভারতে আজও স্তনের মাপ বড়ো করার জন্য শৈশব থেকে টক জিনিস খাওয়ানো হয় আর রাজা রবি বর্মার ক্যালেণ্ডার আর্টে দেবীদের স্তন বড়ো মাপের দেখাবার দরুন তা সমাজে বাহবাযোগ্য হয়ে ওঠে । চিনে সম্রাটের পছন্দ ছিল বড়ো স্তন, তাই তা সৌন্দর্য্যের মাপকাঠি। দক্ষিণ ভারতে মাতৃত্ব আর যৌনতার জন্য স্তনের আকার ছিল মাপকাঠি । সব দেশের সম্রাট চিনের মতন ছিলেন না । ইংল্যাণ্ডে ষষ্ঠ হেনরির আমলে ( ১৪২১ - ১৪৬১ ) নির্দেশ ছিল যে নারীরা তাঁদের বুক এমনভাবে ঢেকে রাখবেন যাতে তা সমতল মনে হয়, কোনো ছবি ও ভাস্কর্যেও সেই নিয়ম মেনে চলতে হতো । রানি প্রথম এলিজাবেথের স্তন ছিল ছোটো, তাই তিনিও বড়ো মাপের স্তন আঁকা বা ভাস্কর্ষে দেখানোকে প্রশ্রয় দেননি । ইউরোপের রেনেসাঁ চিত্রকর্মে বোঁটা মেলে ধরাকে গুরুত্ব দেয়া হতো, এবং স্তনও নানা ধরনের, চিত্রকরের পছন্দ অনুযায়ী । 

স্তনকে ইউরোপের সংরক্ষণশীল মেজাজ যেভাবে তুলে ধরছিল তার তুলনায় জাপানের এডো পর্বে ( ১৬৩০ - ১৮৬৮ ) ‘শুঙ্গা চিত্রাঙ্কনে’ নতুন শৈলী দেখা দিয়েছিল এবং তা স্পষ্ট ইন্দ্রিয়কাতরতার । এই ছবিগুলোতে খোলাখুলি যৌন সম্পর্ক চিত্রায়িত করে হতো । আদর্শ  বলতে বোঝাতো  বেশ বড়ো আর কিছুটা ঝোলা স্তন । তাছাড়া ত্বকের রঙকে দেখানো হতো ফর্সা, বোঁটা ছোট্ট আর গোলাপি, ইউরোপে রেনেসঁসের সময়ের চিত্রগুলোর মতো । সেই সময়ের পুরুষদের কাছে স্তনের পছন্দসই যৌনতার আঁকা ছবিগুলো থেকে টের পাওয়া যায় । সপ্তদশ শতকের ব্রিটেনে মনে করা হতো যে বোঁটা গোলাপি থাকলে মেয়েরা সুস্হ থাকে আর কালো হতে থাকা বোঁটা খারাপ স্বাস্হ্যের লক্ষণ । ২০০৪ সালে ব্রিটেনের রয়াল সোসায়টি এক গবেষণাপত্রে জানায়, বড়ো মাপের স্তনের নারীদের এসট্রাডিওল হরমোন বেশি থাকে যা গর্ভবতী হবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে । 

ইউরোপে বারোক পর্বে স্তনকে বাস্তববাদী করে আঁকার চল আরম্ভ হয়েছিল । যেমন রুবেন্স তাঁর ছবিগুলোতে আদর্শ স্তন বাদ দিয়ে বড়ো স্তন এঁকেছেন যা বর্তুল নয় ; বোঁটাও যেমনটা সচরাচর দেখা যায়, তেমনই । সেসব স্তনে খুঁত থাকলেও তা কামোত্তেজক । অবাস্তব কল্পিত স্তন আঁকার চল ক্রমশ বিদায় নিয়ে বাস্তব জগতের স্তন বিভিন্ন ছবিতে দেখা দেয় । উনিশ শতকের ফ্রান্সে স্তন আর বোঁটা হয়ে উঠল কামুকতা আর ইরটিক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু । নগ্নিকাদের নগ্নতাতে স্তন ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল বিশ শতকে । পরাবাস্তববাদীরা এবং পিকাসো যোনি ও স্তনকে একেবারে ভিন্ন আঙ্গিক দিতে লাগলেন, যেগুলো একেবারে ইউনিক যাতে যোনি আর স্তন দেখে চিত্রকরকে চেনা যায় । আধুনিক বক্ষবন্ধনী আবিষ্কার হয়েছিল ১৯১৪ সালে, দুটো রুমালকে বেঁধে পেছনে রিবন দিয়ে আটকে । যেহেতু পুরুষরা বড়ো স্তনে আকৃষ্ট হয়, প্যাডেড ব্রা দেখা দিলো বাজারে । ১৯৪৮ সালে হলিউডের ফ্রেডরিক মেলিঞ্জার আবিষ্কার করলেন ‘পুশ-আপ ব্রা’ যাতে স্তনকে বর্তুল আর প্রকৃত মাপের চেয়ে বড়ো দেখায় । পুশ-আপ ব্রাকে আরেকটু উন্নত করা হলো যাতে ঝোলা স্তনকেও আঁটো মনে হয় আর খাঁজ দেখা যায় । এখন সিলিকন জেলের কাটলেট ব্রাতে ঢুকিয়ে ইচ্ছানুযায়ী ছোটো-বড়ো করা যায় ।

নারীরা কেন স্তনের মাপ বৃদ্ধি করতে চান বা ছোটো স্তনের নারীরা কেন হীনম্মন্যতায় ভোগেন? নিঃসন্দেহে, পুরুষের কামদৃষ্টিতে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য । বস্তুত বড়ো স্তন আর ছোটো স্তনের ভূমিকা একই, তবুও কেন এমনটা হয় ! আগেই লিখেছি যে পালেওলিথিক যুগে, মানে ৩৫,০০০ বছর আগে, বড়ো মাপের স্তনকে গুহাবাসীরা গুরুত্ব দিয়েছে ; অর্থাৎ পুরুষদের পছন্দ ছিল বড়ো মাপের স্তনের নারী । সম্ভাব্য কারণ, বড়ো মাপের স্তনকে মনে করা হতো স্বস্হ্যের লক্ষণ আর সন্তানের জন্য উপযুক্ত । আজকের দিনেও গবেষকরা দেখেছেন যে গরিব ঘরের পুরুষরা অবধারিতভাবে বড়ো মাপের স্তন পছন্দ করেন ।

আরেকটি কারণ হল বিবাহযোগ্য বা প্রতিযোগীতার বাজারে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য স্তনকে বড়ো মাপের করে তোলার ইচ্ছা । ধনীদের বিবাহের আর ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার বাজার সমানভাবে অবারিত নয় । উপযু্ক্ত পুরুষ বাছাই করার জন্য নিজেকে আকর্ষক করে তোলাটা জরুরি, তেমনই ফিল্মস্টার বা মডেলদের জন্য জরুরি বাজারকে দখল করা । ব্যাপারটা বিবর্তনের সঙ্গে জড়িত । পুরুষ যতো ইচ্ছা বাচ্চা পয়দা করতে পারে কিন্তু নারীর হাতে সময় কম, তাই নারীকে গেঁথে তুলতে হয় তার সন্তানের জন্য সবচেয়ে যোগ্য বাবা। বক্তব্যটা সেক্সিস্ট, কিন্তু এটাই সত্যি । কেবল যৌন আকর্ষণের জন্যই নয়, বড়ো মাপের স্তনের নারীকে দেখলে মনে হবে পরিণত, সেই নারী নিজেকেও মনে করবে পরিণত । কোনো নারীই চাইবেন না যে ছোটো মাপের স্তনের কারণে পুরুষেরা তাঁকে মনে করছেন অপ্রাপ্তবয়স্ক । 

আমরা এখন ভোগবাদী সমাজে বাস করি, আর কোনো চাকরি বা কাজের জন্য বুদ্ধিমতী হলেও, শারীরীক আকর্ষণ হল সফলতার একটা সিঁড়ি । সুন্দর মুখমণ্ডলের ও দৈহিক কাঠামোর নারীরা কাজের বাজারে বেশি সুযোগ পান । তবে অত্যন্ত বড়ো মাপের স্তন আবার এক্ষেত্রে ক্ষতিকারক হতে পারে, তখন শল্যচিকিৎসা করিয়ে স্তনের মাপ ছোটো করার পথ ধরতে হবে । এখনকার ফ্যাশানও হয়েছে বড়ো মাপের বর্তুল স্তন আর খাঁজ । পোশাকের ডিজাইনাররা সেইভাবেই সুন্দরীদের উপস্হাপন করেন । অত্যন্ত বড়ো মাপের বা অত্যন্ত ছোটো মাপের স্তন হলে বাজারে ব্রা পাওয়াও কঠিন হয়ে যায় । সিলিব্রিটি সংস্কৃতির জগতে ছোটো মাপের স্তন নারীজগতে ঠাট্টা-ইয়ার্কির ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় --- স্তনের মাপ বাড়িয়ে তোলার এও একটা কারণ । খ্যাতি আর জনপ্রিয়তার ভোগবাদী বাজারে স্তন এখন গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র -- শল্যচিকিৎসা নারীকে বহুকাল যৌবন ধরে রাখার সুযোগ করে দিয়েছে । মিডিয়া যেহেতু সেলিব্রিটিদের  রোল মডেল  হিসাবে তুলে ধরে, তরুণীরা তাঁদের পথ অনুকরণ করেন । পর্ন ফিল্মগুলোতে যাঁরা অভিনয় করেন তাঁদের স্তন বেশ বড়ো হয় এবং অনেকে অমন ফিল্মে অভিনয় করার জন্যও স্তনের মাপ অবিশ্বাস্যভাবে বড়ো করে তোলেন । সানফ্রানসিসকোতে বুক-খোলা মেয়েরা জুতো পালিশ করেন, বার-ডান্স করেন বুক খুলে । বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদের জন্য নারীরা বুক খুলে দাঁড়িয়ে পড়েন । স্তনের যৌনতা একই সঙ্গে আক্রমণের অস্ত্র আবার অনুরাগের ডাক দেবার কুহক।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন