শনিবার, ২২ মে, ২০২১

মলয় রায়চৌধুরী : মার্কেজের কামুক-কামুকিনী

 মার্কেজের কামুক-কামুকিনী

মলয় রায়চৌধুরী


          গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের স্মৃতিচারণ ‘লিভিং টু টেল দি টেল’ ( ২০০২ ) থেকে জানা যায় যে তেরো বছর বয়সেই একজন যৌনকর্মী তাঁকে কৌমার্য থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন, যাঁর কাছে তিনি গিয়েছিলেন ডাক্তার বাবার  চিকিৎসার টাকা তুলতে, এবং সেই প্রথম একজন যৌনকর্মীর টানে তিনি তাঁর সঙ্গে শুয়ে প্রথম যৌন অভিজ্ঞতায় আহ্লাদিত হন । মার্কেজের গবেষক-জীবনীকার জেরাল্ড মার্টিন তাঁর ‘গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ - এ লাইফ’ ( ২০০৮ ) বইতে জানিয়েছেন যে মার্কেজের বাবা ছেলেকে তাঁর যৌনজীবনে সঠিক অভিজ্ঞতার খাতিরে বেশ্যাটির কাছে হাতেখড়ির জন্য পাঠিয়েছিলেন। এর কয়েকবছর পর একজন বিবাহিতা মহিলা মার্কেজকে যৌনসঙ্গী করে তোলেন, কিন্তু মহিলাটির শর্ত ছিল যে ক্লাসে পড়াশুনায় যেদিন যেদিন গ্যাব্রিয়েল ভালো ফলাফল করবেন, কেবল সেইদিনগুলোয় তিনি শোবার সুযোগ পাবেন । তাঁর পড়াশুনাতে উন্নতি, সুতরাং, যৌনতার পথেই ঘটেছিল । পরে, যখন তিনি বারানকিলাতে সাংবাদিকের কাজে যোগ দেন, সেখানে তিনি এক বছর ছিলেন একটি বেশ্যালয়ে । ভাড়া মেটাতেন যৌনকর্মীদের নিরক্ষর প্রেমিকদের হয়ে চিঠি লিখে । এর পর পৃথিবীর বহু দেশে গিয়েছেন মার্কেজ, আর যে-শহরেই গেছেন, সেখানকার বেশ্যালয়ে ঢুঁ মেরেছেন । ফলে, নারীদের যৌন আচরণ ও আগ্রহের রকমফেরের সঙ্গে যেমন পরিচিত হয়েছেন,  সেই সঙ্গে তাদের শারিরীক প্রতিক্রিয়া এবং চারিত্রিক বৈভিন্নকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার সুযোগ ঘটেছে । ১৯৭০ সালে মারিও ভারগাজ য়োসার প্রাক্তন স্ত্রী, যিনি মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন, তাঁর চালানো থুতনিতে একটি ঘুষির আঘাতে কুপোকাৎ হয়ে গিয়েছিলেন মার্কেজ । গ্যাব্রিয়েল তাঁর সঙ্গে ফষ্টিনষ্টির চেষ্টা করছিলেন ।  

          ‘ইমেজেস অফ উইমেন ইন দি সেলেক্টেড নভেলস অফ গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ’ ( ২০১২ ) রচনায় লোরনা আরেজোলা বিলানেস বলেছেন যে মার্কেজ তাঁর উপন্যাসগুলোয় দেখিয়েছেন কী ভাবে পিতৃতান্ত্রিক ছাঁচ ভেঙে লাতিন আমেরিকার রক্ষণশীল সমাজের মহিলাও নারীবিরোধী পক্ষপাতকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারেন, এবং চাইলে, যৌনসম্পর্কের ক্ষেত্রেও বেপরোয়া হয়ে যেতে পারেন । বিলানেস বলেছেন যে ক্ষমতার প্রান্তে ঠেলে দেয়া নারীরাও মার্কেজের ইন্দ্রজালের মাধ্যমে বাঁধন কেটে নিজেদের মুক্ত করে তুলতে পারেন, এবং দাদামশায়ের বামপন্হী চিন্তাধারায় লালিত মার্কেজ এভাবেই আক্রমণ করেছেন মেট্রোপলিটান ক্ষমতাপ্রতাপের কেন্দ্রকে ।

           জেরাল্ড মার্টিন জানিয়েছেন, তিন খণ্ডে প্রকাশিত হবার কথা ছিল তাঁর স্মৃতিচারণার ; প্রথম খণ্ডটি লেখার পরই মারা যান স্পষ্টবাক মার্কেজ । মার্কেজের জীবনীতে জেরাল্ড মার্টিন বলেছেন যে নিজের উপন্যাসগুলোর মতনই, নিজের ও পরিবারের সদস্যদের যৌনজীবন সম্পর্কে ঐন্দ্রজালিক ভাষ্য তৈরি করে গেছেন গ্যাব্রিয়েল, এবং কেবল একটি ভাষ্য নয় ; বেশ কয়েকটি ভাষ্য  । ভাষ্যগুলোর মাধ্যমে পাঠকদের নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস করেছেন তিনি, যাতে কোনো একটি ভাষ্যের মাধ্যমে পাঠক তাঁর নিকটস্হ হতে না পারেন, আর তাঁর জীবনকেও তাঁর উপন্যাসগুলোর মতনই, ইন্দ্রজালের অন্তর্গত মনে করে বিস্মিত হন । এরকমই একটি গল্প, যাতে সত্যতা আছে বলে জানিয়েছেন জেরাল্ড মার্টিন, তা হল এই যে গ্যাব্রিয়েলের দাদামশায় নিকোলাস মার্কেজ ছিলেন মাগিবাজ, এবং সতেরোটি অবৈধ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন । তা সত্ত্বেও, মেয়ে লুইজা সান্তিয়াগার সঙ্গে গ্যাব্রিয়েল এলেজিওর বিয়ে সহজে অনুমোদন করেননি, এই অযুহাতে যে প্রথমত এলেজিও ছিলেন নিকোলাসের মতনই মাগিবাজ, আর দ্বিতীয়ত এলেজিও ছিলেন দক্ষিণপন্হী রক্ষণশীল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর মানুষ; এলেজিওর মাগিবাজিকে তিনি ক্ষমা করে দিলেও, তাঁর রক্ষণশীল রাজনীতিকে তিনি ঘৃণ্য মনে করতেন । মার্কেজের বাবা এলেজিও যে মাগিবাজ ছিলেন তা মার্কেজের স্প্যানিশ জীবনীকার দাসো সালিভাস ( ১৯৯৭ ) এবং গ্যাব্রিয়েল নিজেও তাঁর স্মৃতিচারণায় স্বীকার করেছেন । 

         মেয়ে লুইজা সান্তিয়াগার জেদের জন্য মার্কেজের দাদামশায় নিকোলাস শেষ পর্যন্ত এলেজিওর সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হন, কেননা এলেজিও প্রচুর প্রেমের কবিতা, প্রেমের টেলিগ্রাম এবং প্রেমপত্র লিখতেন লুইজাকে, আর প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় লুইজার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বেহালায় সকরুণ সুর তুলে আকর্ষণ করার চেষ্টা করতেন । নিকোলাস বিরক্ত হয়ে এলেজিওর নাগালের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন লুইজাকে, কিন্তু মার্কেজের হবু-বাবা ছিলেন নাছোড়বান্দা । বাবা-মায়ের জীবনের এই পর্যায়টিকে কেন্দ্র করেই মার্কেজ লেখেন ‘লাভ ইন দি টাইম অফ কলেরা’ ( ১৯৮৫ ) । বইটি লেখার জন্য বাবার মাগিবাজি সম্পর্কিত তথ্য যোগাড় করতে অসুবিধা হয়নি একদা সাংবাদিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের । উপন্যাসটিতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ( মার্কেজের বাবা ) আমেরিকা ভিকুনা নামে একটি অনাথ কিশোরীকে আশ্রয় দেন, মেয়েটি আশ্রয়দাতার প্রেমে পড়েন, গোঁড়া ক্যাথলিক হওয়া সত্ত্বেও দুই অবিবাহিত নারী-পুরুষ সমাজের চোখের সামনেই পরস্পরের যৌনসঙ্গী হয়ে উঠেন । আমেরিকা ভিকুনা যখন জানতে পারেন যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আরেকজন মহিলার, অর্থাৎ ফার্মিনা দাজার ( মার্কেজের মা )  প্রেমে পড়েছেন, তখন তিনি কোনো চিঠি-চিরকুট না লিখেই আত্মহত্যা করেন । আত্মহত্যার মাধ্যমে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার স্মৃতিতে সারা জীবনের জন্য একটি ক্ষত তৈরি করে যান আমেরিকা ভিকুনা, যেটি যখন-তখন দগদগে হয়ে উঠত ।

          ফার্মিনা দাজার বোন হিলদেব্রান্দা একদিন যৌনচাঞ্চল্যে আক্রান্ত হন, যখন ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো  হিলদেব্রান্দার দিকে পরীক্ষার জন্য ঝোঁকেন, আর ডাক্তারের গোলাপি ঠোঁটের মাঝে ঝকঝকে দাঁতের সারি দেখে হিলদেব্রান্দার মনে হয় ডাক্তারকে চুমু খেতে-খেতে আগাপাশতলা  খেয়ে ফেলতে পারলে আশ মেটে । এর প্রতিক্রিয়ায় ফার্মিনা দাজা বলে ওঠে, ‘তুই তো দেখছি বেশ্যারও অধম’ । কিন্তু বিধবা কামুকিনী নাজারেতের যৌন অস্বাভাবিকতার কাছে  হিলদেব্রান্দাকে নিছক খুকি বলা যায় । নাজারেতের জীবন ছিল প্রেমের গান আর উত্তেজনা-জাগানো পোশাকে ভরপুর, যে পোশাকে থাকত রঙিন ম্যাকাও পাখি আর উড়ন্ত প্রজাপতির ঝাঁক । নাজারেত তাঁর দেহকে যেকোনো পুরুষের, যাঁরা তাকে চান, তাঁদের  যৌন-আলিঙ্গনে সঁপে দিতে সতত তৈরি । কিন্তু নাজারেত চাউর করে দিয়েছিলেন যে কেবল সেই সব পুরুষের সঙ্গে তিনি শোবেন যাঁদের তিনি পছন্দ করবেন, যখন তিনি চাইবেন সেই সময়টায়, যেভাবে করতে বলবেন সেভাবে, এবং অমন যৌনকর্মের জন্য তিনি একটি টাকাও নেবেন না, কেননা যে পুরুষরা তাঁর সঙ্গে শুতে চাইছেন তাঁরা নাজারেতকেই অনুগ্রহ করছেন ।

          ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সঙ্গে সদ্য বিধবা নাজারেত যৌনকর্মে লিপ্ত হবার আগে গৌরচন্দ্রিকা হিসাবে স্বামীর মৃত্যুজনিত অনুপস্হিতি বাখানের ফাঁকে ফাঁকে এক এক করে শরীর থেকে গলার হার, পোশাক, ওড়না, বডিস খুলে ফেলে দিতে থাকেন যতক্ষণ না শোকার্তা বিধবার চিহ্ণগুলো দিয়ে ঘরে একটা নকশাকাটা কার্পেট তৈরি হয়ে যায় । মেঝের ওপর এক-একটা জিনিস পড়েছে আর তার সঙ্গে মিশেছে দূরাগত তোপধ্বনির আওয়াজ, যেন তারা নাজারেতকে সেলাম জানাচ্ছে । সব শেষে লেস বসানো জাঙিয়াটা খুলে দেবার জন্য ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এগিয়ে গেলে নাজারেত তার আগেই তা খুলে ফেলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ আহ্বান জানান, কেননা পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে নাজারেত এভাবেই নিজেকে মেলে ধরেছেন সঙ্গমের আগে; যৌনকর্মে প্রস্তুতির ধাপগুলোয় কারোর সাহায্য তাঁর কাঙ্খিত নয় । 

         ফ্লোরেন্টিনো আরিজার আরেকজন যৌনসঙ্গিনী অসেনশিয়া সাতানদের, সঙ্গমের পরের দিন যাঁর কথা ভেবে মাঝ রাতে ওনার ঘুম ভেঙে যায়, মনে হয় যেন সঙ্গমকালে এমনই এক গর্তের ভেতরে গিয়ে পড়েছিলেন যার ভেতরে ফ্লোরেন্টিনো একই সঙ্গে ডুবে যেতে  চেয়েছেন, আবার তা থেকে পালিয়েও আসতে চেয়েছেন; কিন্তু যার আঠালো মোহক জাপটের আকর্ষণ থেকে পালিয়ে আসা সহজ ছিল না । অসেনশিয়া সাতানদের  নিজের ওপরে তুলে নিয়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে পুরোপুরি  আগাপাশতলা দিয়ে মুড়ে ফেলতেন । নিজের আনন্দেই মশগুল অসেনশিয়া, কী ভাবে কি করতে হবে, কেমন করে এগোতে হবে, পেছোতে হবে, আঁকড়াতে হবে, ঢিলে করতে হবে, উথলে উঠতে হবে, তার সব কিছুই নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে প্রেমরসের শেষ চটচটে বিস্ফোরণের আনন্দও অসেনশিয়াই ধাপে ধাপে ঘটিয়েছেন, আর যখন তিনি ওই বিস্ফোরণ ঘটান তখন সারা পৃথিবী কেঁপে ওঠে ।

          ‘দি জেনেরাল ইন হিজ ল্যাবিরিন্হ’ ( ১৯৮৯ )  উপন্যাসে বিস্ময়কর লিবোডোর কামুকিনীরা আরেকবার উদয় হন মার্কেজের কলমে, যাঁরা প্রায় সকলেই বিবাহিত, নিজেদের প্রতিদিনের বিরক্তিকর একঘেয়ে রুটিন থেকে বেরোতে পারলে বাঁচেন, যাঁদের জীবন ম্যাদামারা ও আনস্মার্ট স্বামীর পাল্লায় পড়ে হয়ে গেছে আনন্দহীন, যৌনরঙ্গের দীপ্তিবর্জিত আর রহস্যহীন, যাঁরা জেনেরালের বিজয়যাত্রার পথে অপেক্ষায় থেকেছেন, সিমন বলিভারের সঙ্গে শুয়ে তাঁর ঔজ্জ্বল্যের আর পদগরিমার খানিক মাংসল তাপ নেবার অভিপ্রায়ে । এই কামুকিনীদের থেকে জেনেরাল পেয়েছেন ভাবাবেশকর অনুভূতি, কদম-কদম এগিয়ে যাবার রসদ । এঁদের মধ্যে উল্লেখ্য ছিলেন ম্যানুয়েলিতা মাদ্রোনো, আঠারো বছর বয়সের একজন উদ্দাম মিউলাট্যৌ কামুকিনী, যে তরুণীটি জেনেরালের ঘুমহীনতার রোগকে অনায়াসে কাবু করে ফেলতে পারতেন । তাছাড়া জেনারেলের বিশ্বস্ত বন্ধু আর প্রেমিকা ম্যানুয়েলা সায়েনজ তো ছিলেনই সদাসর্বদা সিমন বলিভারের ছায়াসঙ্গিনী হয়ে, পেরু বিজয়ের যুদ্ধযাত্রায়, যাঁকে কাছে-কাছে রাখার জন্য জেনারেল তাঁর মহাফেজখানার জিনিসপত্রের কিউরেটারের পদ দিয়েছিলেন, যাতে যখন ইচ্ছে, যেখানে ইচ্ছে, অ্যামাজনের বন্যপ্রাণীদের সবুজ কলকাকলির মাঝে, টুক করে সঙ্গম সেরে ফেলতে পারেন । এইরকমই অদম্য লিবিডোর আরেক নারী হলেন জুবারিগা দে গামারা, যাঁর স্বামী ছিলেন ফিল্ড মার্শাল, যিনি পরে রিপাবলিকের রাষ্ট্রপতি হন।

          ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচুড’, যে উপন্যাসটির জন্য তাঁর বিশ্বব্যাপী খ্যাতি, সেটি কোলোমবিয়ার ইতিহাসের ঐন্দ্রজালিক রূপক, একটি পরিবারের সাতটি প্রজন্মের কাহিনি, এবং যে পরিবারটির সূত্রপাত ভাই-বোনের ( জোসে আরকাদিও বুয়েন্দিয়া এবং উরসুলা ইগুয়ারান )  অজাচারি সম্পর্কের মাধ্যমে, আর ক্যাথলিক ধর্মাচারের এই ‘প্রথম পাপের’ দোষে সাত প্রজন্ম পরে ধ্বংস হয়ে যায় পরিবারটি  । আত্মীয়দের মধ্যে, যাঁদের লিঙ্গ নানা আকার প্রকারের ও যোনি নানা আঠায় রসালো, তাঁদের পরস্পরের মধ্যেও ঘটে চলে অজাচারি যৌনসম্পর্কে । পরিবারের মাদার মেরি উরসুলার  পাশাপাশি তুলনীয় ক্যারট তাস দেখে যে কামুকিনী মহিলা ভবিষ্যৎ বলে দেন, এবং অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে মনে করিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখেন, তিনি যৌনকর্মী পিলার তেরনেরা, যাঁরা দুজনেই একশো বছর বেঁচেছিলেন ; পিলার তেরনেরা একশো পঁয়তাল্লিশ বছর বেঁচে থাকার পর গোণা ছেড়ে দিয়েছিলেন ।

          পিলার তেরনেরা কম বয়স থেকে বহু যুবকের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক পাতাতেন ; তাঁর গা থেকে ধোঁয়ার গন্ধ আর যৌন আকর্ষণের বিচ্ছুরণের জন্য  যুবকেরা তাঁর টান এড়াতে পারতেন না ।  পরে বুয়েন্দিয়া পরিবারে ঢুকে দুই ভাই অরেলিয়ানো জোসে আর জোসে আরকাদিওকে সঙ্গম করার খুঁটিনাটি বোঝাবার পর তাঁদের সঙ্গে শুয়ে জন্ম দিয়েছেন তাদের বাচ্চাদের । বাচ্চাদের একজন, জোসে আরকাদিও পেত্রোনিয়া,  মাদি-গাধার সঙ্গে সঙ্গম করতেন ; একবার তিনি ধোঁয়ার গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে  নিজের মা পিলার তেরনেরার হাত ধরে টান দিয়েছিলেন সঙ্গম করার জন্য, কেননা তিনি জানতেন না যে পিলার তেরনেরা তাঁর মা । সঙ্গমে রাজি হয়ে পিলার তেরনেরা অন্ধকারে ছেলের দিকে সান্তা সোফিয়াকে নামে একজন ভার্জিন তরুণীকে এগিয়ে দেন । ধোঁয়ার গন্ধ না থাকায় আরকাদিও বুঝতে পারেন যে এটি অন্য কেউ, কিন্তু মেয়েটির ভার্জিনিটি দখলের জন্য তাঁর সঙ্গেই যৌনকর্ম করতে থাকেন আর, যদিও তাঁরা বিয়ে না করেই সংসার পাতেন, তাঁদের তিনটে বাচ্চা হয় । বয়স হয়ে গেলে পিলার তেরনেরা  জন্তুজানোয়ারের বেশ্যালয়ের ম্যাডাম হয়ে ওঠেন । 

          গৃহযুদ্ধের সময়ে কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া বিজয়যাত্রার পথে সতেরোজন কামুকিনী যুবতীর সঙ্গে সঙ্গম করে সতেরোটি ছেলের জন্ম দেন । তাঁদের সকলেরই নাম অরেলিয়ানো । তাঁদের কপালে ছিল রহস্যময় ক্রস চিহ্ণ যা দেখে পরবর্তীকালে সরকার তাঁদের ষোলোজনকে হত্যা করে । উপন্যাসের আরেক কামুকিনী হলেন পেত্রা কোতেস, গায়ের রঙ ময়লা, চুল সোনালি-বাদামি, যা দেখে সবাই তাঁকে চিতাবাঘের সঙ্গে তুলনা করতেন । তিনি মাকোন্দোতে এসেছিল স্বামীর সঙ্গে ; স্বামী মারা যাবার পর তিনি অরেলিয়ানো সেগুন্দোর রক্ষিতা আর প্রেমিকা হয়ে ওঠেন । অপরূপা সুন্দরী স্ত্রী ফার্নান্দা দেল কাপরিও থাকা সত্বেও অরেলিয়ানো সেগুন্দো অ্হরহ সঙ্গম করতেন পেত্রা কোতেসের সঙ্গে, আর সে সঙ্গম এমনই যে তার ফলে বাড়ির পোষা জন্তুজানোয়ারের সংখ্যা হুহু করে বেড়ে যেতো । অরেলিয়ানো সেগুন্দো আর ফার্নান্দা দেল কাপরিওর তিন সন্তান হয়, জোসে আরকাদিও, রেনাটা রেমেডিওস ওরফে মেমে এবং আমারান্তা উরসুলা । আমারান্তা উরসুলা ইউরোপ থেকে বুড়ো বর গ্যাটসনের সঙ্গে মাকোন্দো ফেরেন, কিন্তু না জেনে যে অরেলিয়ানো নামে যে যুবককে অনাথ হিসাবে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন ফার্নান্দা দেল কাপরিও, তিনি রেনাটা রেমেডিওস বা মেমের ছেলে, আমারান্তা বোনপোর সঙ্গে যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হন, অরেলিয়ানোও জানতে পারেন না যে তিনি নিজের মাসিকে সঙ্গম করেন , আর অমন অবৈধ সঙ্গমের ফলে তাঁদের ছেলে শুয়োরের ল্যাজ নিয়ে জন্মান । রেনাটা রেমেডিওস বা মেমের ছেলে অরেলিয়ানোও অবৈধ, কেননা মেমে, মরিসিও ব্যাবিলোনিয়া নামে এক যুবকের সঙ্গে শুয়েছিলেন ।

           অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া একজন কচিখুকি মিউলাট্যৌ যৌনকর্মীর ঘরে ঢোকেন, মেয়েটির বুক তেমন গজায়নি তখনও, যোনি বেশ ছোট্ট । অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার আগে এতজন খদ্দের এসেছিল যে চাদর ভিজে জবজবে, ঘরের বাতাস কাদাটে । মেয়েটির ঠাকুমা শহর থেকে শহরে তাকে নিয়ে যান খদ্দের পাকড়াও করে রোজগারের ধান্দায় । অরেলিয়ানো আর মেয়েটি দুজনে মিলে নেঙড়ান চাদরটাকে, তারপর তার উল্টো দিকে শুতে গিয়ে বোঝা যায় সেই দিকটাও ভিজে । অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার কান্না পেয়ে যায় আর বুঝতে পারেন যে বয়সকালে তিনি প্রেমে পড়ে গেলেন । তিনি নির্ণয় নেন যে মেয়েটিকে মুক্তি দিতে হলে তাকে বিয়ে করতে হবে ; এরকমভাবে ফেলে চলে গেলে চলবে না ।

          ‘দি অটাম অফ দি প্যাট্রিয়ার্ক’ ( ১৯৭৫ ) উপন্যাসে বানানা রিপাবলিকের একনায়ক নিজের বানানা ঝুলিয়ে অজস্র কামুকিনীদের আকর্ষন করেছেন আর তাঁর ১০৭ থেকে ২৩২ বছরের জীবনে ৫০০০ জারজ বাচ্চার জন্ম দিয়েছেন । শেষে  কনভেন্ট থেকে কিডন্যাপ করে আনা এলিসিয়া নাজারেনো নামে এক কচি খুকিকে ধর্ষণ করেছেন একনায়ক  ; কিডন্যাপ করানো হয়েছিল কাঠের বাক্সের ভেতরে, যার ওপর লেখা ছিল ‘অপলকা...এই দিকটা উপরে’। পেটে বাচ্চা এসে গেলে বিয়ে করেন । গণ্ডমূর্খ একনায়ককে পড়াশুনা শেখান এলিসিয়া । কিন্তু এলিসিয়া আর তাঁর বাচ্চাকে কুকুরের দল ছিঁড়ে মেরে ফ্যালে । একনায়কদের বৈধ বাচ্চাদের এই দশা হতে দেখেছি আমরা মিশরে, লিবিয়ায়, ইরাকে । আর অবৈধ বাচ্চারা সাধারণ নাগরিক হয়ে নিজেদের মধ্যে লড়ে মরে। মার্কেজের সেনাধ্যক্ষরা বা একনায়করা বানানা রিপাবলিকগুলোর ডিকটেটরদের প্রতিচ্ছবি, যাঁরা প্রচুর অবৈধ বাচ্চার জন্ম দিয়ে গেছেন, দিয়ে চলেছেন । ক্যাথলিক হলেও ভ্যাটিকান সিটি তাঁদের অবাধ যৌনতার দিকে চোখ বুজে থাকে, একের পর এক একনায়ক উদয় হন আর তা চলে দুশো-আড়াইশো বছর পর্যন্ত। 

          প্যাট্রিয়ার্ক বা গোষ্ঠীপতি মশায়ের যৌনরঙ্গ এভাবে বর্ণনা করছেন তাঁর বারো বছরের এক প্রেমিকা, যাকে একনায়ক নুন-গোলমরিচ মাখিয়ে খেয়ে ফেলে ভালোবাসতে চাইছিলেন ,“আমার বয়ঃসন্ধির প্রথম চাটনিতে রুটিটা মাখিয়ে নিতো, যাবতীয় খাদ্যবস্তু ওখানে ঢুকিয়ে তারপর খেতো, আমাকেও খেতে দিত সেগুলো, অ্যাসপারাগাসের ডাঁটি ওর ভেতরে ঢুকিয়ে ম্যারিনেট করে নিতো, বলতো যে, আমার ভেতরের মজাদার লবণজলে তা সুস্বাদু হয়ে ওঠে, বলতো, তোমার স্বাদ একেবারে পোর্ট ওয়াইনের মতন ।”

          এই ধরণের শাশ্বত নায়কদের তুলে ধরার জন্য মার্কেজ উদ্ভাবন করেছেন দমবন্ধ দুঃস্বপ্নের গদ্য, তিরিশ-চল্লিশ পৃষ্ঠার টানা প্যারাগ্রাফ, এক প্যারাগ্রাফে একটি অধ্যায়, সময় কখনও এগিয়ে যায় আর পেছিয়ে যায়, একই সঙ্গে প্রথম পুরুষ আর তৃতীয় পুরুষ বাক্য, স্ট্রিম অফ কনশাসনেস পদ্ধতিতে রচিত, যাতে উন্মাদ ক্ষমতাপ্রতাপের আবহাওয়াকে স্পষ্ট করা যায়, সেই উন্মাদনার ফাঁকে-ফাঁকে দেহ শীতল করতে উদয় হন বানানা রিপাবলিকের কামুকিনীরা । এরকম বানানা-ঝোলানো রাজনীতিকদের আমরা ভারতেও দেখতে পাই, যারা ধর্ষণ করেও পার পেয়ে যায়, কেননা তাদের মামলাও বানানার মতনই ঝুলে থাকে বছরের পর বছর ।

          ‘ক্রনিকলস অফ এ ডেথ ফোরটোল্ড’ ( ১৯৮১ ) একটি সংকরায়িত জনারের রচনা, যাতে যুগপৎ ব্যবহার করা হয়েছে স্বপ্ন, একটি সত্যকার ঘটনার সাংবাদিক প্রতিবেদন, রহস্যকাহিনির কাঠামো এবং রূপকাশ্রিত গল্প । সানটিয়াগো নাসের নামে একজনকে খুন করা হবে এবং তা করবেন পেদ্রো ভিকারিও আর পাবলো ভিকারিও নামে দুই ভাই তা সারা শহর জেনে ফেলেছে, কেননা তাঁদের বোন অ্যানজেলা ভিকারিও, যাঁকে বিয়ে করবে বলে বেয়ার্দো সান রোমান তৈরি, বিয়ের রাতে বেয়ার্দো আবিষ্কার করেন যে অ্যানজেলা অন্য কারোর কাছে আগেই কুমারীত্ব হারিয়ে বসে আছেন ; ফলত বিয়ে বাতিল হয়ে যায় । বাড়ি ফিরে আসার পর দু ঘণ্টা ধরে অ্যানজেলাকে পিটুনি দেন তাঁর মা পিউরিসমা দেল কারমেন ; মারের চোটে অ্যানজেলা বলে ফ্যালেন যে তিনি কুমারীত্ব হারিয়েছেন সানটিয়াগো নাসেরের কাছে । ‘কুমারীত্ব’ ব্যাপারটাকে আক্রমণ করেছেন মার্কেজ । নাসেরের বাবা ইব্রাহিম ইতিমধ্যে ভিকটোরিয়া গুজমান নামে এক মহিলাকে ধর্ষণ করে চাকরানি বানিয়েছেন ; গুজমানের মেয়ে দিভিনা ফ্লোর-এর যোনি সুযোগ পেলেই খামচান সান্টিয়াগো । গল্পটি জানায় না যে সত্যিই অ্যানজেলা কুমারীত্ব হারিয়েছিলেন কি না, সত্যিই সান্টিয়াগো কোনো অপরাধের জন্য দায়ি কিনা । তা সত্বেও সান্টিয়াগোকে খুন করে অ্যানজেলার দুই ভাই, পরিবারের ‘গৌরব রক্ষার জন্য’, অনেকটা হরিয়ানার খাপগুলোর মতন ।

          এই উপন্যাসেও আছে একজন যৌনকর্মী, তার নাম মারিয়া আলেহান্দ্রিনা সেরভানতেস, যাঁর সঙ্গে নাসেরের যৌনসম্পর্ক পনেরো বছর বয়স থেকে । নাসের উপস্হিত থাকলে অন্য খদ্দেরকে পাত্তা দেন না মারিয়া । অ্যানজেলার বিয়ের দিন রাতে নাসের ছিলেন মারিয়ার যৌনহুল্লোড়ে সঙ্গী । মারিয়া আর নাসেরের যৌনসম্পর্কের কেচ্ছা সারা শহর জানে । অ্যানজেলা যে কুমারীত্ব হারিয়েছেন তা তাঁর হবু বর সঙ্গম না করেই কী করে যে জানলেন তার কোনো ক্লু উপন্যাসে নেই । 

         ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ‘দি ইনক্রেডিবল অ্যাণ্ড স্যাড টেল অফ ইনোসেন্ট এরেনদিরা অ্যাণ্ড হার হার্টলেস গ্র্যাণ্ডমাদার’ নভেলায় ১৪ বছর বয়সের এরেনদিরা, যার ঠাকুমা ছাড়া কেউ নেই, এক দুর্ঘটনায় বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ফ্যালেন । বাড়িতে আগুন ধরানোর খেসারত হিসাবে ঠাকুমা এরেনদিরাকে প্রথমে নিয়ে যান কাছের এক দোকানদারের কাছে, এরেনদিরার কুমারীত্ব বিক্রির দরদস্তুর হয় । দোকানদার বেশি দাম দিতে চান না কেননা ১৪ বছরের মেয়ের সবকিছু ঠিকঠাক তৈরি হয়নি । কিন্তু কুমারী বলে শেষ পর্যন্ত রাজি হন ।  দোকানের পেছনের ঘরে নিয়ে গিয়ে জোর করে ধর্ষণ করেন । ঠাকুমা এর পর এক ট্রাকে চাপেন, তাঁর সঙ্গেও দরদস্তুর হয় এরেনদিরাকে ধর্ষণের বদলে স্মাগলারদের দেশে নিয়ে যাবার জন্য । ট্রাকটা এক জায়গায় ওনাদের নামিয়ে দেবার পর সেখানেই রাস্তার ধারে পড়ে থাকা জঞ্জাল দিয়ে ঘর তৈরি করে এরেনদিরার খদ্দের ধরার জন্য বসে থাকেন ঠাকুমা । একজন ডাকহরকরা যাচ্ছিলেন, ঠাকুমা তাঁকে ফুসলিয়ে এরেনদিরার ঘরে পাঠান, আর ডাকহরকরা  যা দ্যান তা নিয়ে, ঠাকুমা তাঁকে বলেন যে যেতে যেতে রটিয়ে দিও যে পুরুষদের জন্য কচি মেয়ে অপেক্ষা করছে পথের ধারে । এক এক করে কামুক খদ্দেররা আসতে থাকেন, ক্রমে জায়গাটায় মেলার মতন দোকানপাট ভিড় জমে যায় । ইউলিসেস নামে কম বয়সী এক খদ্দের এরেনদ্রিয়ার প্রেমে পড়েন আর ঠাকুমাকে খুন করেন । এরেনদ্রিয়া দৌড়োতে থাকেন দিগন্তের দিকে । তাঁকে আর খুঁজে পান না ইউলিসেস ।

          ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ‘অফ লাভ অ্যাণ্ড আদার ডেমনস’ উপন্যাসের ঘটনা আঠারো শতকের, যে সময়ে আফ্রিকা থেকে ধরে আনা ক্রীতদাসদের ব্যবসা পুরোদমে চলছে আর একই সঙ্গে স্পেন থেকে গিয়ে পৌঁছোচ্ছে খ্রিস্টধর্মের গোঁড়া ধর্মপ্রচারকরা ; ফলত একযোগে সংঘাত ও মিশ্রণ ঘটছে দুটি সংস্কৃতির । এই বইয়ের কামুকিনী হলেন বেরনারদা কারবেরা নামে দাস ব্যাবসায়ী পরিবারের এক মহিলা, যিনি,  লেখকের মতে, একটা সৈন্য-ব্যারাকের প্রতিটি জওয়ানের সঙ্গে সঙ্গমের ক্ষমতা রাখেন । তিনি জোর করে ধর্ষণ করেন তাঁর চেয়ে বেশ ছোটো মারকুইস দ্য কাসালদুয়েরোর সঙ্গে আর পেটে বাচ্চা এসে গেলে তাঁকে বাধ্য করেন বিয়ে করতে । মারকুইস বেশ দুর্বল, ফ্যাকাশে, শোকার্ত কেননা তাঁর দেহ থেকে রক্ত চুষে খেয়ে ফেলেছে বাদুড়েরা; পৃথিবীকে তাঁর বড্ডো ভয় । মারকুইসের প্রেমিকা ছিলেন দুলসে অলিভিয়া নামে এক পাগলি গায়িকা যিনি বাণ মেরে মারকুইসের প্রথম পক্ষের স্ত্রী দোনা ওলালা দ্য মেনডোজাকে আগেই মেরে  ফেলেছেন । দোনা অনেক চেষ্টা করেছিলেন যাতে মারকুইস তাঁর সঙ্গে সঙ্গম করে নিজের কৌমার্য খোয়ান, কিন্তু সফল হননি । বেরনারদা কারবেরার গায়ে মারকুইসের চেয়ে জোর বেশি, তাই মারকুইসকে বাগে আনতে অসুবিধা হয়নি ।

         সিয়েরভা মারিয়া নামে ওনাদের যে মেয়ে হয়, তাঁকে বেরনারদা কারবেরার একদম পছন্দ নয় । সিয়েরভা মারিয়া বড়ো হন ক্রিতদাসদের মাঝে, আর আফ্রিকার সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হন । বেরনারদা কারবেরা তাঁর যৌন অতৃপ্তি মেটাবার জন্য জুদাস ইসকারিয়োতে নামে একজন বলিষ্ঠ সৌম্যকান্তি ক্রীতদাসের সঙ্গে প্রতিনিয়ত  উগ্র যৌনহুল্লোড়ে মাতেন আর মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েন । বারো বছর বয়সে সিয়েরভা মারিয়াকে কুকুর কামড়ায় ; যদিও তাঁর মধ্যে জলাতঙ্ক দেখা দেয় না, তাঁর ওপর ভুতে ভর করেছে অযুহাতে তাকে কনভেন্টে পাঠিয়ে দেয়া হয় । সেখানে সিয়েরভা মারিয়ার প্রেমে  পড়েন যাযক কায়েতানো দেলাউরা, যিনি, সিয়েরভা মারিয়ার দেহ থেকে ভুত ঝাড়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন । ভুত ঝাড়ার যাতনায় মারা যান মেয়েটি । তাঁকে গোর দেবার সময়ে ন্যাড়া করে দেয়া হয়েছিল অথচ তাঁর মাথায় তামাটে চুল গজিয়ে উঠেছিল, যা দুশো বছর পরে জলের ধারার মতন বেড়ে উঠেছে ।

         ‘মেমরিজ অফ মাই মেলাংকলি হোরস’ ( ২০০৪ ) নভেলার নায়ক একজন বুড়ো সাংবাদিক, যিনি নির্ণয় নিলেন যে  নব্বুইতম জন্মদিনের উৎসব পালন করবেন নিজেকে একটি বয়ঃসন্ধিকালীন কুমারীর সঙ্গে অসংযত রাত উপহার দিয়ে । তিনি চিরকাল যৌনকর্মীদের সঙ্গেই শুয়েছেন আর পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর প্রতিটি সঙ্গমের বৃত্তান্ত লিখে রাখতেন ; পঞ্চাশ বছর বয়সে ৫১৪ জন যৌনকর্মীর সঙ্গে শোবার পর আর হিসেব রাখার দরকার মনে করেনি । বেশ্যাপাড়ায়  তিনি দুবার ‘বছরের সেরা খদ্দের’ খেতাবের অধিকারী হয়েছেন । যৌনকর্মীদের সঙ্গে শুতে-শুতে তিনি আর বিয়ে করার সময় পায়নি । একবার বাসে করে যাবার সময় এক অবসর-নেয়া যৌনকর্মী তাঁকে বলেছিলেন যে, শয়তানের কাছ থেকে পাওয়া তাঁর মালবাহী-গাধার লিঙ্গের কারণেই তিনি ভিতু আর কৃপণ ।

          নিজের নির্ণয়কে রূপ দেবার জন্য তিনি বেআইনি একটি বেশ্যালয়ের ম্যাডাম রোজা কাবারকাসকে অনুরোধ করলেন অমন একটি মেয়ে যোগাড় করে দিতে । রোজা যোগাড় করে দিলেন ১৪ বছরের একটি কুমারী মেয়েকে । ঘরে ঢুকে নব্বুই বছরের বৃদ্ধ দেখলেন মেয়েটি সম্পূর্ণ উলঙ্গ, তার জন্মদিনের মতোই অসহায় শুয়ে আছে, ঘামের অনুপ্রভায় দীপ্তিময়ী । রোজা তাকে হালকা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রেখেছে, কেননা মেয়েটির প্রচণ্ড ভয় ; তার এক কুমারী বন্ধু গায়ারার জাহাজের খালাসির সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল, আর তারপর এত রক্ত বেরিয়েছিল যে সে মারা যায় । এমনিতেই গায়ারার পুরুষদের সম্পর্কে কিংবদন্তি হল যে তারা মাদিগাধার সঙ্গে সঙ্গম করলে সঙ্গমকালে  সেই গাধারা  গান গাইতে থাকে ।

          বুড়ো যখনই যান, উলঙ্গ অবস্হায় মেয়েটি প্রায় অর্থচেতন  থাকে ; তাঁদের দুজনের মধ্যে কোনোও কথা হয় না ; বৃদ্ধের নাম যেমন জানা যায় না, তেমনই মেয়েটির নাম জানেন না বৃদ্ধ, রোজা কাবারকাস মেয়েটির নাম বলতে চাইলেও তিনি জানতে চান না । নিজেই মেয়েটির একটা নাম দেন, দেলগাদিনা, লোকগাথার এক নায়িকার নামে নামকরণ করে ; সেই দেলগাদিনার প্রেমে পড়েছিল তারই নিজের বাবা । এই দেলগাদিনাকে বৃদ্ধ প্রতিদিন এসে চেয়ে চেয়ে দ্যাখেন, তাকে গান শোনান, তার জন্য প্রার্থনা করেন, গল্প শোনান, যদিও মেয়েটি তা শোনার অবস্হায় থাকে না কোনো রাতেই । মেয়েটির পাশে শুয়ে রাত কাটান বৃদ্ধ । চুমু খেয়ে মেয়েটির শরীরের তাপ নেন, সঙ্গম করেন না । ক্রমে মেয়েটি তাঁর স্মৃতিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে, স্মৃতিতে তিনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন মেয়েটির সঙ্গে । তিনি অর্ধচেতন মেয়েটির  প্রেমে পড়েন । তাঁর আফশোষ হয় যে জীবন বৃথাই প্রেমহীন কাটিয়ে দিয়েছেন । যদিও তাঁর শরীরের সমস্যাগুলো চাগিয়ে উঠতে থাকে, বদহজমে বুকপেট জ্বালা করে, দিনে কয়েকবার পোঁদে ব্যথা হয়, তিনি দুর্বল হয়ে গেছেন । প্রথম প্রেমের কারণে সংবাদপত্রে তাঁর কলামও আকর্ষক হয়ে ওঠে ; পাঠকরা যা আগে এড়িয়ে যেতেন তা বৃদ্ধের অভিনব উপলব্ধির টানে পড়তে বাধ্য হয় । প্রেম যদি না পাওয়া যায় তাহলে যৌনসঙ্গম হল তার জন্য সান্ত্বনা, মনে করেন বৃদ্ধ ।

          বাঙালি সাহিত্যিকরা নিজেদের স্মৃতিচারণ করার সময়ে যৌন অভিজ্ঞতাকে পুরোপুরি চেপে যান । হাংরি আন্দোলনের মামলায় ব্যাংকশাল কোর্টে যিনি আমার সিনিয়র উকিল ছিলেন তাঁর চেম্বার ছিল সোনাগাছিতে ঢোকবার মুখের ঠিক উল্টো দিকে, সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ের ওপর । আমাকে প্রায়ই তাঁর চেম্বারে গিয়ে বসে থাকতে হতো, কোর্টের প্রতিদিনের জেরা ইত্যাদির সার্টিফায়েড কপির জন্য । ওনার চেম্বারের জানলা দিয়ে দেখতে পেতুম সন্ধ্যাবেলা কারা ঢুকছেন সোনাগাছির গলিটিতে । বিশেষ করে শনিবার দিন হলে, সন্ধ্যাবেলায়, আমার আগের প্রজন্মের কবি লেখকরা দল বেঁধে ঢুকতেন গলির ভেতরে, দিব্বি হেলতে-দুলতে । তাঁদের কারোর কারোর স্মৃতিকথা প্রকাশিত হয়েছে, অথচ এই পর্বটি তাঁরা বেমালুম চেপে গেছেন । হয়তো সে-কারণেই, মার্কেজের উপন্যাসের নারীদের পর্যায়ের চরিত্র আমরা তাঁদের লেখায় পাইনি । অবশ্য মার্কেজের নারীদের চরিত্রগঠনে একই সঙ্গে লাতিন আমেরিকার আদিনিবাসীদের যৌনস্বাধীনতার সংস্কৃতির সঙ্গে মিশেছিল ইউরোপ থেকে চালান দেয়া ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের রক্ষণশীল যৌনতার বিধিনিষেধ, যদিও কোলোম্বাস আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা সেখানে গিয়ে আদিনিবাসীদের সঙ্গে বেপরোয়া যৌনসম্পর্কে পাতিয়ে তাদের গায়ের রঙ আর নাক-নকশা কয়েক প্রজন্মে পালটে জন্ম দিয়েছিল বর্ণসংকরদের, ইংরেজিতে যাদের বলা হচ্ছে মিউল্যাটৌ ( mulatto ), আর এরকমই চোদ্দো বছরের একটি মিউল্যাটৌ মেয়ে মার্কেজের ‘মেময়র্স অফ মাই মেলাংকলি হোরস’ উপন্যাসের নায়িকা। 

          মার্কেজের উপন্যাসে রয়েছে পুরুষের সঙ্গে নারীর জড়তাবর্জিত, লৌকিকতার বাধাবন্ধনহীন সম্পর্ক এবং বহু ক্ষেত্রে নারীরা সমাজের তৈরি যৌন-আচরণের বিধিনিষেধকে মান্যতা দেননি । ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’ উপন্যাসে মার্কেজ লিখেছেন, ‘একজন নারী যদি কোনো পুরুষের সঙ্গে শোয়ার নির্ণয় নিয়ে ফ্যালে, তাহলে এমন কোনো পাঁচিল নেই যা সে ডিঙোবে না, এমন কোনো দুর্গ নেই যা সে ভাঙবে না, এমন কোনো নৈতিক বিধিনিষেধ নেই যা সে আমূল অমান্য করবে না : অর্থাৎ এমন কোনো ঈশ্বর নেই যাঁকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে।’


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন