শুক্রবার, ২১ মে, ২০২১

শঙ্করনাথ চক্রবর্তী : মলয় রায়চৌধুরী

 শঙ্করনাথ : মলয় রায়চৌধুরী

শঙ্করনাথের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ১৯৮৫ সালের বইমেলায় । ওনার জন্ম ৩১ ডিসেম্বর ১৯৫২ তারিখে । তারপর আমি চাকুরির সূত্রে সারা ভারত চষে বেড়াতে লাগলুম আর শঙ্করনাথ ক্রমশ অসুখে ঘরবন্দি হয়ে পড়লেন । কলকাতায় থিতু হবার পরও সাক্ষাৎ হয়নি । শঙ্করনাথ মারা যাবার খবরটা ফেসবুকে দিয়েছিলুম ; কিন্তু মনে হলো, নির্দিষ্ট পাঠক ছাড়া, বেশির ভাগ লোক ওনার নামের সঙ্গে তেমন পরিচিত নন । আশ্চর্য হবার কিছু নেই, কেননা উনি তো জমায়েত বা দরবারে যেতেন না, একমনে একের পর এক কবিতা লিখে যেতেন আর আঁকতেন । বাইশে জুলাই ২০০২তে উনি আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন, পড়লে ওনার সম্পর্কে জানতে পারবেন :


প্রিয় মলয় রায়চৌধুরী

“আমার জন্ম দর্জিপাড়ার এক হাসপাতালে । আজন্ম কলকাতার টালা অঞ্চলে বসবাস করে আসছি -- আগে ভাড়া বাড়িতে, পরে বাবার তৈরি বাড়িতে । পূর্বপুরুষের ভিটে ছিল বাংলাদেশের ফরিদপুরে । বিশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে বা তার কিছু পূর্বে ঠাকুরদা, জ্যাঠামশায় ও বাবা উত্তর কলকাতায় বাস নির্দিষ্ট করেন । বাংলাদেশের জমিজমা বেহাত না হলেও, ঔদাসীন্য, তত্বাবধানের  অভাবে ভোগে লাগেনি । বাবা কিছুকার ব্যবসায় থেকে, পরে করপোরেশানের ইন্সপেক্টার হন । সেই পদ থেকেই অবসর নেন । মৃত্যুর সময়ে বয়স আশি ছাড়িয়েছিল। মা ঢাকার মেয়ে । মাতামহ আসামে পোস্টঅফিসে চাকরি করেছেন, থেকেছেন সেখানে সপরিবারে । তারপর পাকাপাকি টালিগঞ্জে বাড়ি করে আমৃত্যু সেখানে ছিলেন । মা এখনো জীবিত । আমরা দুই ভাই, এক বোন । আমি অবিবাহিত । বোনের এক ডাক্তারের সঙ্গে বিবাহ হয়েছে । ভাই তার আর্ট কলেজের ছাত্রী অনসূয়াকে বিয়ে করেছে । ভাইঝি এষাকে ঘিরেই এখন সংসার । আজন্ম কলকাতায় বাস করায় আমার পূর্ববঙ্গীয় আচার-আচরণ, ভাষার সঙ্গে যেমন ধাতুসম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, তেমনি এ-দেশীয়দেরও সম্যকরূপে বোঝা সম্ভব হয়নি । উভয় পক্ষেই উপযুক্ত সুযোগের অসদ্ভাব ছিল ।

স্কুলে থাকতেই লেখার দিকে ঝোঁক আসে । লিখতে থাকি । পরে সেসব লেখার নব্বি ভাগ ফেলে দিয়েছি । কিছু হয়নি। স্কুলে ছাত্র খুব খারাপ ছিলুম না । কিন্তু কলেজে ফাঁকিটাই মুখ্য হল । সাহিত্য আর অ্যাকাডেমিক পড়াশুনাকে মেলাতে পারিনি । নকশাল আন্দোলনও তখন তুঙ্গে -- আরও কিছু পরোক্ষ প্রভাব থাকতে পারে। বি এ পার্ট টু পরীক্ষা ফলত, অসমাপ্ত রেখেই কলেজ ছাড়ি । তারপর দশ বছর বেকার । বেকার জীবনে লেখা আর পড়াই অবলম্বন । বাড়ির লোক বাধাও দেয়নি, নন্দিতও করেনি । লেখা তখন ছাপা হতই না বলা চলে । কবিতা, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ সবরকমই লিখেছি । সঙ্গে জার্নাল, ও বন্ধুবান্ধবীদের কাছে অগণিত পত্র । ৭৯-৮০ সাল নাগাদ প্রয়াত চিত্ত সিংহ সম্পাদিত সৃজনীতে মোটের ওপর লেখা প্রকাশ হতে থাকে । ধীরে, এদিক-সেদিক । ১৯৮২ সালে ‘রতিপল্লী’ প্রকাশ করার পর কিছুটা সমীহ মেলে। তারপর তো চালিয়ে গেছি । থামাবার কথা ভাবিনি । তখন মিছিলের মতো নারীদের কাছ থেকে পাওয়া আঘাত, তজ্জনিত কারণে পাগলামির স্তরে পৌঁছে মনোবিদের নিরীক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত বিরামহীন নেশা -- এসব কেটে যাওয়ার পরে একের পর এক অসুখের ধাক্কা, যা এখনো চলছে -- হতে পারে আমার লেখার ক্ষেত্রে বেশ জোরালো অবলম্বন স্বরূপ ; লেখকের চাওয়া না চাওয়ার তারা ধার ধারে না । এ-ভিন্ন শৈশবে পোলিও আক্রান্ত হয়ে অঙ্গহানির পরে-পরে কৈশোরে উপান্ত সময় পর্যন্ত ভারি-ভারি ব্যাধিতে আমি সেসময়ে প্রায়ই হাসপাতালে । মননের ক্ষেত্রে সময়টির দূরপ্রসারী প্রভাব থেকেই যায়।”

আপনার 

শঙ্করনাথ

কলকাতা

২২/৭/২০০২”


উৎপলকুমার বসু শঙ্করনাথকে লিখেছিলেন : ““তোমাদের প্রতি, অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত কমবয়সীদের প্রতি, আমাদের শুধু এটুকুই বলা যে এই তো পৃথিবী নামক আস্তাকুঁড় আমরা রেখে গেলাম। এর ভালোমন্দ—সবই তোমাদের।”


শঙ্করনাথ যখন আমাকে তাঁর পাঠক মনে করে ১৯৮৫ সালে কয়েকটি কবিতার বই দেন তখন আমার যথেষ্ট দুর্নাম ছিল ; কেউ বড়ো একটা মিশতে চাইত না । আমার সম্পর্কে শঙ্করনাথের মনোভাবে আশ্চর্য লেগেছিল বইকি । কিন্তু এও মনে হয়েছিল যে যাঁদের বয়স আমার থেকে কম তাঁদের কেউ-কেউ আমাকে নতুন ভাবনাচিন্তার মানুষ বলে মনে করতে আরম্ভ করেছেন । মাঝে যে দশ-বারো বছর লেখালিখি করিনি তখন পড়াটাই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছিল ; সব বিষয়ের বই পড়তুম । দাদা “হাওয়া৪৯” প্রকাশ করা আরম্ভ করলে সেই সমস্ত পড়াশুনা বেশ কাজে দিয়েছিল । তারপর থেকে, আমার প্রবন্ধ ও প্রবন্ধের বই যখন প্রকাশিত হতে লাগল, অনেকেই নিজেদের মুখ বন্ধ রাখাটা শ্রেয় বলে মনে করলেন । 


শঙ্করনাথ ওনার প্রকাশিতব্য একটি বইয়ের ভূমিকা লিখে দিতে বলেছিলেন, আমি কলকাতায় ফেরার পর । আমি বলেছিলুম বইয়ের দশ-বারোটা নাম ভেবে নিয়ে তা থেকে একটা বাছাই করতে । ফলে ওনার ‘উড়ন্ত স্যানাটোরিয়াম” কাব্যগ্রন্হের ভূমিকা আমি লিখে দিই । বয়সের কারণে স্মৃতি গোলমাল হয় বলে নিশ্চিত নই, তবে মনে হয় বইটিতে শঙ্করনাথের আঁকা ড্রইং ছিল । বইটিতে আমি শঙ্করনাথের জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে বিশদে ভূমিকা লিখেছিলুম । হয়তো সেই কারণেই ‘দমদম জংশন’-এর কর্নধার বৈদ্যনাথ মিশ্র চাইলেন যে প্রয়াত শঙ্করনাথ সম্পর্কে আমি কিছু লিখি। 


আমার আর নতুন করে বলার কিছু নেই । বিশদে লিখেছিলুম “উড়ন্ত স্যানাটোরিয়াম”-এর ভূমিকায় । তবে শেষ করছি শঙ্করনাথের এই কথাগুলো দিয়ে, যা উনি ১৯৮৭ সালে লিখেছিলেন : “লিখতে হয় তাই লিখি, কোন দুর্মর উদ্দেশ্যকে এখনো এর সঙ্গে জড়িত করিনি । বা বলতে পারো : লিখতে ভালোবাসা বলেই লেখা -- স্রেফ কোনো একটি ফাঁক-ফিকিরে কলমটিকে দৌড় করিয়ে আনা।”


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন