রবিবার, ১৬ জুলাই, ২০২৩

মলয় রায়চৌধুরীর গল্প : শেষ হাসি

 মলয় রায়চৌধুরীর গল্প : শেষ হাসি




‘হালায় আমাগো পইসচিম বঙে আইসা…’


কথাটা বাক্যে প্রকাশ অপ্রয়োজনীয় মনে করে, ডান পায়ের বুট জুতো, আজকে সকালেই পালিশ-করা, পায়ের গোছে যত শক্তি জড়ো করা যায়, কড়িকাঠ থেকে উল্টো করে ল্যাংটো ঝোলানো, সাঁইত্রিশ বছর বয়সি হাড়গিলে চটকল শ্রমিক কাংগাল চামারের বিচির ওপর হাঁকড়ালেন কন্সটেবল পতিতপাবন পোড়েল । পায়ের জুতো দিয়ে, সরকারি জুতো দিয়ে, অভিব্যক্ত হল বাকি কথাগুলো । অত্যন্ত বিরক্ত হলেন পতিতপাবন পোড়েল, কালো, বেঁটে, মোটা, টাকমাথা । কাংগাল চামারের লিঙ্গে, কাল রাত থেকে, তখন তিরিশে অক্টোবরের রাত এগারোটা ছিল, আজকের একত্রিশে অক্টোবরের রাত্তির একটা পর্যন্ত, এই দু-ঘণ্টায়, নাইলনের হলুদ দড়ি বাঁধা শ্রমিকটার ওপর সরকারি দায়িত্ব পালন করার বাধ্যবাধকতায়, তেরোবার লাথাবার দরুণ, রক্ত আর বীর্যে জুতোটা নোংরা হয়ে গেলে, ঘরের কোনে ফেলে রাখা গামছাটা দিয়ে প্রতিবার পুঁছেচেন । আর রক্তবীর্যের ক্রিমপালিশে, বাঁ-পায়ের তুলনায়, ডান পায়ের জুতোটার মুখ ঝিকমিক করছে ।


কাংগাল চামার, হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা, লাথির ধাক্কায় স্যাঁতসেতে দেয়ালে তাঁর মাথা সশব্দে ঠুকে গেলেও, ঠোঁটের হাসিটি বজায় রেখেছিলেন বলেই হয়তো, ক্রুদ্ধ করে তুলছিলেন তাঁকে ঘিরে থাকা ডাকবাবু বুপিন নামহাটা, কন্সটেবল পবিত্র সরখেল, এ এস আই তারক জানা, এস আই পরমেশ্বর দত্ত, এস ডি পি ও সঞ্জয় কুমার, অ্যাডিশানাল পুলিশ সুপার জংবাহাদুর সিং প্রমুখ আধিকারিকদের ।


‘বাঞ্চোৎ দ্যাখাইতাসি তর হাসি…।’


এস আই পরমেশ্বর দত্ত, বাঁ হাত দিয়ে কাংগাল চামারের শিড়িংগে ঠ্যাংটা ধরে, দোল খাওয়া থামিয়ে, ডান থাতের ব্যাটনখানা এক ঝটকায় প্রায় ছয় ইঞ্চি ঢুকিয়ে দ্যান চটশ্রমিকটির পোঁদে, টেনে বের করেন এবং আবার ঢুকিয়ে দ্যান এবং বের করেন । কাংগাল চামারের ঝুলন্ত শরীরটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে ব্যাটনটা তার মুখের ঘহ্বরে চালান করেন ।


‘হাঃ হাঃ, এরেই কয় জোরকা ঝটকা ধিরে সে লাগে’, পরমেশ্বরবাবুর আত্মতৃপ্ত উক্তিতে উপস্হিত ঊর্ধতন আধিকারিকের হোয়াঃ হোয়াঃ হোয়াঃ হাসিখানি, খাকি ভুঁড়ি দুলিয়ে শেষ হলে, অধস্তনরা হাসবার অনুমতি পায় । মুখের মধ্যে, ব্যাটনসুদ্দু নিজের নিঃশব্দ হাসি বজায় রাখেন কাংগাল চামার । শ্রমিকের সহ্যশক্তি অপরিসীম । সরকার শ্রমিকদরদি হলে সহ্যশক্তির কুলকিনারা থাকে না ।


‘মাদারচোদকা বাচ্চা পচছিম বাংগালে এসচে তো ভাবচে বরাব্রি করচে আমাদের রাজপুতদের সঙ্গে’, বললেন জংবাহাদুর সিং, ‘রাজপুতকে উপর হাত উঠায় ।’ তারপর, ডাকবাবু বিপিন নামহাটাকে তিরস্কার করলেন, ‘আভি তক পে সিলিপ মহাজন থিকে এনক্যাশ করাও নি ? এখানে খড়ে-খড়ে কী মু তাকচো ? যাও, নিজের কাজ করো ।’ হুকুম দিয়ে থানার সিঁড়ি ভেঙে জিপে উঠতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ফিরে এসে কাংগাল চামারের মুখ থেকে ব্যাটনখানা টেনে, ‘ই তো আমার আছে, মাই লাকি ম্যাসকট’, তারপর দ্রুতি বজায় রেখে বসলেন গিয়ে জিপে । তেলে ভেজাল দেয়া ধোঁয়া তুলে চলে গেলেন ঊর্ধতন আধিকারিক ।


কাংগাল চামার তবুও হাসি বজায় রেখেছেন । রুলের বাড়ি খেয়ে-খেয়ে তাঁর পায়ের তলা, খালি পায়ে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটাবার দরুণ, নীল হতে সময় লেগেছিল । তবে তাঁর পাঁজরের অপলকা হাড়, ডানদিকের তিনটে আর বাঁদিকের একটা, তাঁকে ধরে এনে যখন সর্বজনীনভাবেভ পেটানো হচ্ছে, বেদম, বরফের জলে ভেজানো কম্বলে দেহ মোড়া থাকা সত্ত্বেও, পেতল-মোড়া সোঁটার আঘাতে, ভেঙে গিয়েছিল প্রথম দু-মিনিটেই । বাঁ দিকের হাড়টা ভেঙে বেরিয়ে এসেছে চামড়া ভেদ করে, গোলাপি-শাদা মেশানো ।


‘হালায় আমাগো পইসচিম…’


‘আরে কী তখন থেকে পশ্চিমবঙ্গ-পশ্চিমবঙ্গ করছেন’, বলে ওঠেন তারক জানা, এ এস আই, যাঁর ভাতখোর ভুঁড়ির নিচে নেমে-যাওয়া বেল্ট তাঁকে আই পি এস সুলভ চর্বিতে খোলতাই দিয়েছে, ‘কুত্তির বাচ্চাটার মুচি ঠাকুদ্দা এসেছিল সায়েবদের জুতো পালিশ করতে, তখন পশ্চিমবঙ্গ ছিল না’। এই কথাগুলো পতিতপাবন পোড়েলের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি । কাংগাল চামারের দিকে তাকিয়ে, পতিতপাবন পোড়েলের উদ্দেশে তিনি বললেন, যদিও উচ্চারণ করলেন না, ‘বাঞ্চোৎ তোর দাদু তখন বগুড়ার পুকুরে পাটকাঠি চুবিয়ে পাটের এঁশো বের করত।’


যা বলা হল না তা শুনতে না পারায়, যা বলা হল তা শুনে, কিছুটা চিন্তিত হলেন পতিতপাবন পোড়েল । কাংগাল চামারের মুচিদাদুর পালিশকরা বিলিতি সায়েবের পায়ে ঝকঝকে কালো জুতোজোড়া ভেসে ওঠে ওনার কল্পনা-প্রকল্পে, এবঢ নিজের ডান পায়ের জুতো বাঁ পায়ের জুতোর চেয়ে অধিকতর ঝকঝকে হহোয়ায়, তাঁর খেয়াল হল যে, পাথরপ্রতিমা স্কুলকে, তিনি ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে, বাঁ পায়ে মারা গোলে এক-শূন্যতে হারিয়েছিলেন । বাঁ পা দিয়ে একটি লাথি হাঁকড়ালেন কাংগাল চামারের বিচিতে । উৎফুল্ল হলেন জুতোয় যথোচিত ক্রিম লেগেছে দেখে । কাংগাল চামারের গামছা দিয়ে বাঁ পায়ের জুতোটা কয়েকবার ঘষতে, আলোকিত হয়ে উঠল জুতোর এবং পতিতপাবন পোড়েলের মুখ ।


কাংগাল চামার তবুও হাসিটি বজায় রাখলেন । কষ্ট ও যন্ত্রণার সামান্যতম অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন না । না বাংলায়, না হিন্দিতে, না ভোজপুরিতে, না চটকল শ্রমিকের জারজ বাংলা বুলিতে । কাংগাল চামারের দাদু ভুখমারন চামার যখন ১৮৯৭ সনে এসেছিলেন এ তল্লাটে, তখন ভোজপুরি বলতেন । তাঁর বাবা দুখিচাঁদ চামার বলতেন দোআঁসলা । কাংগাল চামার বাংলায় কথা বলতেন । নিজের যন্ত্রণা কোনো ভাষায় প্রকাশ না করে তিনি নিঁশব্দে হাসছেন ভাষাহীন ঝুলন্ত হাসি ।


তখনও কেউ ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ আওয়াজ না দিলেও, মুচিগিরির জন্যে নয়, ভুখমারন চামার এসেছিলেন এলিজাবেথ জুট মিলে কাজ করার জন্যে । বাংগাল-এর লোকেরা কল-মিলে কাজ করতে চায় না বলে বিলাইতি দাল্লাল হরিরাম পরসাদ তাঁদের গাঁয়ে গিয়ে কলকাত্তা যাবার লোভ দেখালে, তাঁদের সীতামড়হি জেলার হিদায়েতপুরের হরিজন বস্তির সব মরদ হরিরামের সঙ্গে চলে এসেছিলেন । ব্যাইরাক-বস্তিতে চুলহা-চাক্কির জায়গা নিশ্চিত হলে, যে যার মেহরারু আর বাচা-বুতরুদের এনে, থেকে গিয়েছিলেন এই হুগলি জেলায় । গ্রামের রাজপুত-ভূমিহার বাবু সাহেবরা যখন ইচ্ছে ওদের বোউ, বোন, মেয়েকে দাবি করলে পাঠিয়ে দিতে হত বলে, বিশেষ কেউ আর ফেরেননি গ্রামে । ভুখমারন চামার কখনো এলিজাবেথ জুট মিলের মালিক টমাস ডাফকে দেখেননি, তবে শুনেছেন যে মালিকের নাম কম্পনি বাহাদুর । তাঁর নাতির,বর্তমান আসল মালিক, রেজিনাল্ড জন ব্রেইলিও কম্পনি বাহাদুর, এবং সেকারণে গর্ববোধ ছিল কাংগাল চামারের । ব্রেইলির কোনো নির্দিষ্ট স্বদেশ নেই ।


বিদেশ থেকে যেসব সায়েব-মেম পয়সাকড়ি কামিয়ে নেটিভদের মগজে মনীষী আর বিলেতের পার্লামেন্টে লর্ড হবার স্বপ্নে কলকাতা বন্দরে নেমেছিলেন, তাঁদের একজন টমাস ডাফ, যিনি চারটে চটকল পত্তন করেছিলেন, তার মধ্যে ব্রিটেনের রানির নামে এলিজাবেথ জুটমিল সবচে বড়ো । তখন, এখনকার মতন, পাটখেতে চায়ের নার্সারি করার রেওয়াজ হয়নি । পাটখেতে পাট, ধানখেতে ধান, আলুখেতে আলু হত । বারো হাজার মজুরের সবাই ছিল কুলি । ক্যাজুয়াল, বদলি, স্পেশাল বদলি, স্হায়ী, জিরো নম্বর এমনতর শ্রেণিবিভাগ ছিল না । কেননা তখনও বিলাইত থেকে শ্রেণিতত্ত্ব আসেনি । তখনও বাংগালিবাবুরা চটকলগুলোয় লিড্রি করতে আসেননি । তখন তো চটকলে শ্রম যার, নেতৃত্ব তার ছিল । ঠিক যেমন লাঙল যার জমি তার । এখন আর নেতা হবার জন্যে শ্রমিক হবার দরকার হয় না । লড়াকু বাংগালিবাবু হতে হবে, লড়াকু, কথায়-কথায় লড়বে, বাতলে দেবে কারা কারা শত্রু । তখন শত্রু বলে ছিল না কিছু ।


‘হ্যাঃ হ্যাঃ, কাগজে আবার লিকেচে মুখ্যমন্ত্রী বলেচেন, মালিকরা চটশিল্পে জঙ্গলের রাজত্ব কায়েম করেচে ।’ কাংগাল চামারকে পাঁচ ঘণ্টা আগে ফুসলিয়ে ধরে আনার পর এই প্রথম কথা বললেন ডাকবাবু বিপিন নামহাটা ।


‘উস জঙ্গল মেঁ তুম সালে হো জংলি খুংখার কুত্তা ।’ বিপিন নামহাটা হেঁঃ-হেঁঃ হেসে অনুমোদন করলেন এস ডি পি ও সঞ্জয় কুমারের দেয়া পদ্মশ্রী ।


‘আর হামলোগ কেয়া হায় শ্যার ?’ আবদার জানান কন্সটেবল পবিত্র সরখেল ।


‘তুম লোগ হো চুতিয়া । সালে সব কোই কাম ঢংসে নহিঁ কর সকতে ।’


‘কেন স্যার ?’


‘আরে ইস গাণ্ডু কাংগাল চামারকে ঘরকে সামনে ওয়হ সালা রাজপুত সিপাহি মরা পড়া থা তো অপনে কো বাল উখাড়নে কা কেয়া জরিরত ?”


‘সাহেব তো বলেছিল যার ঘরের সামনে লাশ পড়েছিল তাকে তুলে আন ।’ জানান বিপিন নামহাটা ।


‘কাউকে তো একটা আনতেই হত’, এস আই পরমেশ্বর দত্ত অধস্তনদের আড়াল দেবার চেষ্টা করেন ।


‘হাট্টা-কাট্টা লানা চাহিয়ে থা ।’


‘হাট্টা-কাট্টা মজুরের দিন আর নেই স্যার । তাই তো এদের আমরা বলি শ্রমিক । যেমন বেশ্যাগুলোকে বলি যৌনকর্মী ।’


‘হ্যাহ্যা।’


‘এবার তাহলে কী করতে হবে স্যার ?’


‘মুঝে নহিঁ মালুম । নামহাট্টা সে পুছো । য়হি সালা চামচাগিরি করতা হ্যায় জংবাহাদুর সাহবকা ।’


বিপিন নামহাটা বাড়ি থেকে ডেকে এনেছিলেন কাংগাল চামারকে । যে-গামছা পরে কাংগাল চামার ঘুমোচ্ছিলেন, তা পালটাতে দেয়া হয়নি । অর্থাৎ একবস্ত্রে ফাঁড়িতে । বস্ত্রখানা এখন অন্য কাজে নিয়োজিত । এলিজাবেথ জুট মিলের ফিনিশিং ডিপার্টমেন্টের মজুর, মানে শ্রমিক, রাত্তিরে সেদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছিলেন, তিরিশ তারিখে, মাইনে পেয়ে । সব মজুররা, মানে শ্রমিকরা, মাইনে পাননি, তাই পে-স্লিপের বদলে তাঁরা টাকা পাননি । পে-স্লিপ ভাঙানো যায়নি, কেননা এলিজাবেথ চটকল কোম্পানির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউণ্ট থেকে টাকা তোলা যায়নি, অ্যাকাউন্টে টাকা ছিল না বলে । চেক ফেরত এসেছিল । মাঝে-মাঝে হয় এরকম । তা নতুন কিছু নয় । সব চটকলেই হয় ।


মহাজনরা, অনেক ইউনিয়ান নেতা মহাজনি করেন আজকাল, তাঁরা, সস্তায় কিনে রাখেন পে-স্লিপগুলো, আর মিলের ক্যাশে টাকা এলে থোক ভাঙান । মজুররা, মানে শ্রমিকরা, পে-স্লিপ বেচে দিয়ে নিশ্চিন্ত । কে জানে পরে আবার ভাঙানো যাবে কি না । মহাজনদের হয়ে পে-স্লিপ সংগ্রহের কাজ বিপিন নামহাটার । কুলি ব্যারাকের, মানে শ্রমিক আবাসের, তাই সবাইকে চেনেন উনি । জানেন কে কোন ইউনিয়ানের সদস্য । রেস্ত থাকলে ওনারা, মানে শ্রমিকরা, সবকটার সদস্য হয়ে যেতেন । বেশির ভাগ মজুররা, মানে শ্রমিকরা, কোনো ইউনিয়ানের নন । আঠারোটা ইউনিয়ানের বারোশো মোটে সদস্য । বিপিন নামহাটা জানতেন যে শালা খোট্টার বাচ্চা কাংগাল চামারটা সদস্য নয় কোনো ইউনিয়ানের । চটকল-ফটকল আর বেশিদিন চলবে না ভেবে অনেকেই সদস্য হন না, বিশেষ করে খোট্টাগুলো । চল্লিশটা চটকল প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা জমা দেয়নি । ছাপ্পান্নটা জমা দেয়নি ই এস আইয়ের টাকা । সেসব কোটি-কোটি টাকা । সোনালি তন্তু না শালা শিবঠাকুরের বাল ।


‘এই কাঙাল, তোকে সায়েব ডেকে পাঠিয়েছে’, বলতেই সাইকেল চালিয়ে চলে এসেছেন কাংগাল চামার । কোন সায়েব, কোথায়, কেন, এসব প্রশ্নও তোলেন না শালারা । রাস্তায় এসে পড়তেই, থাপ্পড় মারতে-মারতে, সাইকেলটা নর্দমায় ঠেলে দিয়ে, জিপগাড়িতে তোলা হয়েছিল । তারপর চলন্ত গাড়িতেই সবাই মিলে দেম্মার দেম্মার । তেমন হাঁউ-মাউ করেননি কাংগাল । একাধটা শ্রমিক হন তিলে খচ্চর । কেঁদে-চেঁচিয়ে লোক জড়ো করার তালে থাকেন । গেল বার সাব্বির মণ্ডল করেছিলেন । শালার হাতের সবকটা নখ উপড়ে নিতে চুপ মেরেছিলেন । সামান্য প্যাঁদানি খেলে বাঞ্চোৎরা চেঁচামেচি করেন । সহ্যশক্তির বাইরে নিয়ে যাও তো একদম চুপ মেরে যাবেন । এই তো, চামারবাবু কেমন ঝুলতে-ঝুলতে হাসছেন ।


‘সায়েব তো নিজের ডাণ্ডা হাতে নাচতে-নাচতে চলে গেলেন আহ্লাদে আটখানা হয়ে, এখন এটাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে তো,’ প্রস্তাব করেন পোড়েল ।


‘যা, জিপ নিয়ে যা, আর খগেন ডাক্তারকে নিয়ে আয় সঙ্গে, ও এসব ঝক্কি সামলাতে ওস্তাদ । সুদে টাকা খাটায় তো কুলিগুলোর মাথায় হাত বুলিয়ে ।’


মিলের লকআউটের দিন থেকে ডাক্তার তো কলকাতায়’।


‘কেন ? লকআউট তো মে মাসে উঠে গিয়েছিল ।’


‘গেলেই বা । মজুররা বকেয়া পাচ্ছে তো এখন । আসবে ঠিক সময়ে গন্ধ পেয়ে ।’


শ্রম কমিশনারকে বসিয়ে তাঁর সামনে আঠারোটা ইউনিয়ানের সঙ্গে চটকল কর্তৃপক্ষ একটা চুক্তি করেছিলেন মে মাসে । অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বকেয়া মাইনের অর্ধেক দেয়া হয়েছিল শ্রমিকদের । দ্বিতীয় হপ্তায় দুশো করেনিকে পুরো, পঁচাত্তরজন দারোয়ান আর ছশো দক্ষ শ্রমিককে দেয়া হয়েছিল অর্ধেক মাইনে । চুক্তি অনুযায়ী তৃতীয় হপ্তায় বাকি মাইনেটা পাবার কথা ছিল সবায়ের । কিন্তু যেদিন তা দেবার কথা, সেদিন দেয়া হয়নি পে-স্লিপ । শ্রমিকরা মিলের জেনারাল ম্যানেজার রুস্তমজির কোয়ার্টারে চড়াও হতে উনি বললেন, ‘চেক ভাঙানো যায়নি, পরশু যাবে ।’


পে-স্লিপ পেয়ে, ভাঙাতে গিয়ে, মজুররা, মানে শ্রমিকরা, জানতে পারলেন টাকা আসেনি, কিন্তু দেখতে পেলেন যে সশস্ত্র পুলিশ ঘিরে রেখেছে অফিস-বাড়ি ।


‘পুলিশ কেন ?’ জানতে চাইলেন সোমবারি মাহাতো, ‘মাইনের বদলে পুলিশ ?’


জবাবে ইউনিয়ান নেতা জানালেন, ‘যাতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা না বাধে ।’


‘কিন্তু আর কোনো নেতাকে দেখতে পাচ্ছি না আমরা ! তাঁরা কোথায় গেলেন ?’


‘কলকাতার অফিসে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছেন ।’


‘এখন আবার কিসের আলোচনা ?’


‘আরে এরাই গদ্দারি করছে ।’


‘তলে-তলে ষড় ।’


‘লুট রহা হ্যায় মাদারচোদ লিডার সব ।’


‘মারো সালোঁকো ।’


‘চল দেখি ইউনিয়ান অফিসে কে বাঞ্চোৎ বাল ওপড়াচ্ছে ।’


আড়ং ধোলাই । দে ছুট । পড়ি কি মরি ।


আঠারোজন ইউনিয়ান নেতার অভিযোগে সাতজন শ্রমিক গ্রেপ্তার ।


ডি এস পি : ‘আমাদের বলে কী হবে ? ইউনিয়ান নেতাদের কাছে যাও ।’


‘ইউনিয়ান অফিসগুলোয় তালা । সব লিডার পালিয়েছে ।’


‘আগুন লাগিয়ে দে ।’


‘ভেঙে ফ্যাল দরোজা । যা আছে আগুন লাগিয়ে দে ।’


‘খুঁটি থেকে উপড়ে ফ্যাল ।’


ডি এস পি : ‘আপনারা সংযত হোন । এ অঞ্চল থেকে চলে যান । নয়তো আমরা গুলি চালাতে বাধ্য হবো । আপনারা উপদ্রব করবেন না । শান্তি রক্ষা করুন । নয়তো পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হবে ।’


‘ফায়ার।’


‘আরে । শালারা গুলি চালাচ্ছে ।’


‘গির গিয়া । সাউজিকো গোলি লগা ।’


মার বাঞ্চোৎ সিপাইগুনোকে ।’


‘মার মাদারচোদ ইউনিয়ান লিডার মালিকের খোচোরগুলোকে ।’


‘দুনিয়ার মজদুর এক হও ।’


‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ ।’


‘মারো ।’


‘মাআআআআআরোওওওওওওওও……’


‘ইসহাক খানের গুলি লেগেছে ।’


‘মারো শালাদের ।’


বিশাল জনসমুদায়ের তাড়া খেয়ে, খাকি উর্দি আর বন্দুক সত্ত্বেও, পালাতে থাকেন সরকার বাহাদুরের প্রতিনিধি নগণ্য কয়েকটা সেপাই । জনতার হাতে ধরা পড়লে কী গতি হবে তা তাঁদের জানা । ছিটকে যে যেদিকে পারেন দৌড়োন । পেছনে নিরস্ত্র জনতা । ক্ষমতার উৎস থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে দৌড়োন । পেছনে অসংখ্যা ছুটন্ত মানুষ । দৌড়োন । পেছনে অগুন্তি শ্রমিক । দৌড়োতে থাকেন হাঁসফাঁস । পেছনে ক্যাজুয়াল, বদলি, স্পেশাল বদলি, স্হায়ী, জিরো নম্বর জনসমুদায়, ঘামে চটের চটচটে গন্ধ । কোথা থেকে ঢুকে কোথা দিয়ে বেরোতে হবে জানানেই কনসটেবলগুলোর, নাদাপেটা ভুঁড়ির ওজনে ধরে রাখতে পারছেন না গতি । পেছনে রোগা, হাড়গিলে, ডিগডিগে, ছেঁড়া জামাকাপড়, মাইনেহীন আধপেটা শ্রমিকদের গতি বাড়তে থাকে । শ্রমিকদরদি সরকারের সিপাই দৌড়োন । পেছনে মজুরের দল । দৌড়োন । পেছনে মজুরেরা । দৌড়োন । পেছনে শ্রমিকেরা । দৌড়োন সরকার বাহাদুর । পেছনে জনগণ । দৌড়োন, দৌড়োন, দৌড়োন, দৌড়োন, দৌড়োন, দৌড়োন, দৌড়োন, দৌড়োন, দৌড়োন, কুলি ব্যারাকের এগলি-ওগলি, শ্রমিক বস্তির ঘিঞ্জি ভুলভুলাইয়ায় । একজনকে ধরে ফ্যালেন জনগণ । শ্রমিকদরদি সরকারের প্রতিনিধিকে ধরে ফ্যালেন জনগণ ।


‘মার শালাকে…’


‘প্যাঁদা ধরে…’


‘রামধুলাই….’


‘হাম কুছ নহিঁ কিয়া । হাম গোলি নহিঁ চলায়া । হামকো ছোড় দো । অঁক । হামকো জানে দো ।


‘শালা গোলি নহিঁ চলায়া ? পোঁদের চামড়া তুলে নেব । ব্রেইলির কুত্তা ।’


‘সে ব্যাটা বিলেতে পাইলেচে ।’


১৯৮৮ সালে রেজিনাল্ড জন ব্রেইলি এলিজাবেথ জুটমিলের দশ লক্ষ শেয়ার কিনে কোম্পানির ছাপ্পান্ন ভাগ মালিকানা পেয়েছিলেন । তার আগে মিলটা চালাতেন মালহোত্রা, ব্রেইলির কাছ থেকে চটকলটা ভাড়া নিয়ে । মিলটাকে ছিবড়ে করে, ইউনিয়ানের নেতাদের খোরপোষ দিয়ে, কাঁচা পাট পাওয়া যাচ্ছে না অজুহাতে, লক-আউট করে দিয়েছিলেন তিনি ।


এলিজাবেথ মিল ছাড়া আর কোথাও যাবার ছিল না কাংগাল চামারের । দাদুর গ্রামে আর কিছুই ওঁদের নেই যে খেতিহর কিসানের মজদুরি করতে যাবেন । আগে রাজপুত-ভূমিহাররা ওঁদের বোউ-বোন-মেয়েকে তুলে নিয়ে যেতেন । এখন যাদব কুর্মিরা নিয়ে যান । আগে ছিল কাংরেস । এখন কাংরেসের নাম সস্তা, জন্তা, রাষ্ট্রিয় জন্তা ইতয়াদি । এলিজাবেথ মিলের কুলি ব্যারাকে ওঁর দাদু এসেছিলেন, এই ঘরেই, বাবাও ছিলেন, এই ঘরেই, ওঁর যে ছেলে হবে মাসখানেক পরে, তিনিও থাকবেন, এই ঘরেই । ছেলের পদবি চামার রাখবেন না উনি । ওঁর দাদু ছিলেন কুলি । ওঁর বাবা ছিলেন মজুর । উনি এখন শ্রমিক । কতবার তো লকআউট হয়েছে, কিন্তু উনি কোথাও যাননি । ওঁর মা আর বোউ তো বাংগালিবাবুদের বাড়িতে চৌকাবর্তন-ঝাড়ুপোছা করে চালিয়ে দ্যান ওই সময়টায় । ডাফ,ম মালহোত্রা, ব্রৈইলিরা আসেন আর যান । চটকলটা তো থাকে, হোক না ভাড়ার চটকল । ভাড়াটেদের স্বার্থ, দেশভাগের পরে, সবার উপরে ।


বিদেশি মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনে ১৯৯০ সালে ধরা পড়েছিলেন রেজিনাল্ড জন ব্রেইলি, অনেক টাকার ঘাপলা করেছিলেন বলে । হাইকোর্টের বিচারপতির বাড়িতে মাঝরাত্তিরে কোর্ট বসিয়ে, আংরেজিতে সওয়াল-জবাব করে, সাম্যবাদী আইনজীবী ছাড়িয়ে এনেছিলেন ব্রেইলিকে । টিটাগড় গ্রুপের চটকলের চেয়ারম্যান ব্রেইলি । বেচারা । এলিজাবেথ জুট মিলে ঘাপলা করে আট কোটি টাকা হাপিস করে আর দু-কোটি টাকার স্হাবর সম্পত্তি বেচে ব্রেইলি হাওয়া । শ্রমিকদের পি এফ আর ই এস আই টাকা মেরে দিয়ে হাওয়া । বাংগালি শ্রমিকদরদি মন্ত্রীদের সঙ্গে ঘনঘোর মেলমিলাপ ছিল বিলাইতি সায়েবের ।


বিলেতেই, স্কটল্যাণ্ডে, ১৮৮৫ সালে, এলিজাবেথ জুট মিলের রেজিস্ট্রি করিয়েছিলেন টমাস ডাফ । তারপর তো সাতচল্লিশ সালে স্বাধীন হয়ে গেল দেশটা । স্বাধীনতা নিয়ে কাটাকাটি-মারামারি হল । চটকল রইল এই পারে, পাটচাষ গেল ওই পারে । এলিজাবেথ জুট মিলের হিন্দু ব্যারাকে আর মুসলমান ব্যারাকে এখনও সেই মুলতুবি মারামারি-কাটাকাটিটা চালু হয়ে যায় মাঝে-মধ্যে । হাতিয়ারবন্দ পুলিশ তাই কাছেপিঠে থাকে, যতদিন না আবার লাগছে ততদিন বসে-বসে হাই তোলে, খইনি ডলে । স্বাধীনতা পেয়ে, ১৯৫৬ সালে, কোম্পানি আইন পাস করে দিলেন জবাহিরলাল । কোনো বিলাইতি কোম্পানি, সেই আইন অনুযায়ী, এদেশে ব্যবসা করতে চাইলে, শতকরা উনপঞ্চাশ ভাগের বেশি শেয়ারের মালিক হতে পারবে না । ব্যাস । গির্ধারিলাল মালহোত্রা, যে লোকটা মিলটাকে পাট যোগাতেন, যাঁর পূর্বপুরুষ সিরাজউদ্দৌলার পোঁদে বাঁশ করার জন্যে মীরজাফর আর কোম্পানি বাহাদুরকে টাকা যুগিয়েছিলেন, টমাস ডাফের চৌত্রিশভাগ শেয়ার সস্তায় হাতিয়ে নিলেন এই তালে । জবাহিরলাল আগেই খবর করে দিয়েছিলেন দিকে-দিকে, বিল পাস হচ্ছে, তৈরি থাকো, হড়পে নাও । মালহোত্রদের সঙ্গে গলগোটিয়ারাও নিলেন খানিক । বাজোরিয়া, নিসানি, সারদা, পাসারি, জৈনও নিলেন কয়েক খাবলা । বাংগালিরা ভয়ে কিছুই নিতেন না তখন, মালকড়ি থাকলেও । রিফিউজিরা হু-হু করে আসছিলেন আর পোঁদে বাঁশ করে দিচ্ছিলেন বাংগালিদের ব্যবসা আর কল-মিল-কারখানায় । সেই থেকে বাংগালিরা ব্যবসা থেকে ভাগলবা, লিখাপড়হি-গানা-বাজানা-নাচ-নৌটাঙ্কি নিয়ে থাকেন ।


চটকলগুলোয় মরচের মতন ঢুকে গেলেন মালহোত্রারা, গলগোটিয়ারা । লোক লাগিয়ে ঠেঙিয়ে দিতেন জুট কর্পোরেশানের সংগ্রহকারী কর্মীদের । অসুখে পড়ে গেল জুট কর্পোরেশান । কর্মীরাও মালহোত্রা-গলগোটিয়াদের বখশিশে খুশি । কে শালা চট সংগ্রহের ধান্দায় জান দেবে । চাষিরা আর কী করবে, পাট বেচতেই হবে মালহোত্রাদের ছড়ানো দালালবাহিনীর কাছে । ওঁরা যে দামে কিনতে চাইবেন, সেই দামেই বেচতে হবে । পাটকাঠি তো আর বাড়িতে রেখে খাওয়া যায় না । কচি-কচি পাটচারার ডগা ফুটিয়ে খেয়ে থাকা যায় ক’দিন । শুকিয়ে গেলেই সেসব পাটকাঠি চাষার পিঠে পড়ে । কাঠি থেকে পাট বের করায় কত হ্যাঙ্গাম । কাঁচাপাটের বাজারে এখন অনেক গোলমাল । কেউ বেশিদিন জুট সাপলায়ার থাকতে চান না । তার ওপর জুট সাপলায়ারদের কাছ থেকে ইউনিয়ানগুলোর নেতারা ভাগা খান । ইউনিয়ানের নেতারা সাপলায়ার নিয়ে গোঁ ধরে থাকলে মালিকের সঙ্গে ঠোকাঠুকি । চটকলগুলোর লাশ ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খেয়ে ফেলার এই সুযোগ । আর কাঁচা পাটই হয় না অত, তো চটকলগুলো না-খেতে পেয়ে মরবেই । মরা হাতি বলে কথা । দাঁত পেতে হলে মারতেই হবে ।


পশ্চিমবঙ্গের সব চটকলগুলো চালু থাকলে এক কোটি বেল কাঁচা পাট দরকার । এক বেল মানে একশো আশি কিলো । সত্তর-আশি লক্ষ বেলের বেশি পাট হয় না । পুকুর আর ডোবাগুলো এত পচে থাকে যে ভাল জাতের কাঠি থেকে পাটকে সোনালি করা যায় না, পেঁকো রঙ হয়ে যায় তাদের । যেটুকু বা পরিষ্কার ডোবায় সোনালি হবার সুযোগ পায়, সব বিদেশে পাচার কিংবা চালানিতে সাফ । মিলমালিক নিজে জুট সাপলায়ার হলে মিলকে সাপলাই না দিয়ে বিদেশে সাপলাই করে দ্যান । ধান আর তেলবীজ রুইলে তবু সমবায় সমিতি কিংবা গ্রামীণ ব্যাঙ্কের দাদন পাওয়া যায় । পাট রুয়ে কোনো সাহায্য পান না চল্লিশ লাখ চাষি । মহাজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে পাটচাষ । মহাজন মানে কাঁচা পাট কেনার দালাল । পাটচাষে লোকসান । পাঁচ লাখ হেক্টর জমি অন্য চাষের কবলে চলে যাওয়ায়, কুড়িলাখ পাটচাষী খেতমজুর ছিতরে গেছেন । যেসব কাজহীণ পাটচাষি দালালদের ধরেকয়ে বদলি হিসেবে কাজ করতে আসেন, তাঁদের কাছ থেকে অনেককিছু জেনেছিলেন কাংগাল চামার, তাঁদের দুখদারি ।


পাট চাষ হোক, মিলে কাঁচা পাট আসুক, মিল পুরোদমে চলুক, মিলের মাল বিক্রি হোক, সবাই নিয়মমত মাইনে পাক, এইটুকুই কেবল চেয়েছিলেন কাংগাল চামার । অথচ এর কোনোটাই হয় না । দাদুর আমলে তো হত । বাবার আমল থেকে দেখা দিয়েছে গোলমাল । বাড়িভাড়া দেবার মতন করে চটকল মালিকরা ভাড়া দিয়ে দেন মিলটাকে, বাবার আমল থেকে । ৫৯২ শ্রমিকের সঙ্গে ছাঁটাই করে দেয়া হয়েছিল বাবাকে, স্হায়ী হওয়া সত্ত্বেও । অবসর নেবার টাকাকড়িও পাননি । কম মাইনেতে একই কাজ করতে রাজি হয়ে আবার ঢুকেছিলেন ক্যাজুয়াল লেবার হয়ে । ভাড়াটে মিল মালিক যখন যাকে ইচ্ছে ছাঁটাই করে দিতে পারেন, বাংগালিবাবুদের ইউনিয়ানের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী । ইউনিয়ান দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে প্রতিদিন আশি টন উৎপাদন বাধ্যতামূলক করেছিল, যা দত্যিদানোর শক্তি দিয়েও করা অসম্ভব । যেখানেই দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছে, সেখানেই খেপেছেন শ্রমিকরা । অম্বিকা, আগরপাড়া, কানোরিয়া, কেলভিন, বরানগর, হনুমান, ভিক্টোরিয়া, ভারত, বালি, প্রেমচাঁদ, তিরুপতি, নর্থব্রুক, গ্যাঞ্জেস, প্রবর্তক, এম্পায়ার, হুকুমচাঁদ, ফোর্ট উইলিয়াম । কুলিরা, মানে মজুররা, মানে শ্রমিকরা, আর বিশ্বাসকরেন না ট্রেড ইউনিয়ান নেতাদের । ভিতর সে খোখলা কর দেতা হ্যায় মাদারচোদ সব ।


কাংগাল চামারও বিশ্বাস করেননি । ওনার বাবা চটের আঁশে ফোঁপরা ফুসফুসে যক্ষ্মা নিয়ে মারা যাবার আগে হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন, ‘ই সালা বাংগালি লিডার সবকো কভি ভি বিসওয়াস মত করিহো । সালা সব অপনা দেশ কা বটওয়ারা করকে গাঁড় মারায়া হ্যায়, দুসরে কা ভলাই কহাঁসে করেগা ! ই লোগ পচছিম বাংগালকা গাঁড় মার-মারকে বরবাদ কর ডালেগা, দেখ লিহো ।’


বিশ্বাস না করলে কী হবে ! লিডারদের আর মালিকের চুক্তি তো মানতে হবেই, তাতে শ্রমিকদের চিন্তা ওরা করুক বা না করুক, চুক্তি হেন কথা । তাই মাইনে থেকে কাটৌতি মেনে নিতে হয়েছে । কাংগাল চামারের কাটৌতি তবু কম হয় । প্রেমচাঁদ, তিরুপতি, অম্বিকা, হনুমান, নর্থব্রুক, কানোরিয়ায় তো অর্ধেক মাইনে কাটৌতিতে চলে যায় । চটকল অসুস্হ বলে রোগ সারাতে শ্রমিকদের মাইনে কাটা যায় । বিমা, ব্যাঙ্ক কি সরকারিও চাকরিতে একদিনের মাইনে কাটলে পোঁদে হুড়কো করে দেবেন বাবুদের লিডাররা । চটকলের বেলায় একই নেতা অন্য ধুন কেন গাইতে থাকেন তা বুঝতে পারেননি কাংগাল চামার । ওসব চাকরিতে কাটৌতি করলে দ[পতর বন্ধ হয়ে যাবে । চটকলে কাটৌতি না করলে মিল বন্ধ হয়ে যাবে । আজব দেশ !


ন্যূনতম মজুরির চেয়ে কম মাইনে দিলে কুলি, মানে মজদুর, মানে শ্রমিক, চটকলের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে পারেন, পেমেন্ট অব ওয়েজেস কোর্টে । কয়েকবছর থেকে কোর্টটায় কোনো বিচারপতি নিয়োগ করেননি শ্রমিকদরদি পচছিমবঙ্গ সরকার, মতলব, বাংগাল সরকার । তাছাড়া কাংগাল চামার এসব ঝুটঝামেলায় যেতে চাননি । ফালতু খিচখিচ । কাটৌতি সামলাতে অনেক মজদুর নিজের কুলি লাইনের ঘর কোনো বাবুকে ভাড়া দিয়ে নিজেরা গিয়ে ঝুগগিঝোপড়িতে সস্তায় থাকেন । যে-মজদুর একা থাকেন, তিনি কাটৌতির পয়সা তুলতে নিজের ঘরটা কোনো রাণ্ডিকে ছেড়ে দ্যান, সন্ধ্যাবেলায় ধান্দা করার জন্যে । সে-মজদুর হাতজোড় করে আকাশকে অনুরোধ করেন, হে ভগওয়ান, রাণ্ডিটাকে আরও খদ্দের পাইয়ে দাও, যাতে আমারও আরেকটু রোজগার হয় ।


মা, ভাই গর্ভবতী বউ নিয়ে অন্য কোথাও যেতে চাননি কাংগাল চামার ।


মজুর জনগণের তাড়া খেয়ে কনসটেবলটা এসে কাংগাল চামারের ঘরের সামনেই ধরা পড়ে গেলেন ভিড়ের ঘেরাটোপে । দরোজার ফাঁক দিয়ে ডেখতে-দেখতে উনিও উত্তেজিত হয়ে বেরোতে যাচ্ছিলেন সরকারি গণশত্রুকে প্যাঁদাতে, কিন্তু মা ভেতরে হিঁচড়ে দরোজা বন্ধ করে দিলেন । বউ এখন গর্ভবতী । এখন এসব কাজে অংশ নিলে পাপ লাগবে । হল্লাগুল্লা, ভিড়ভাড়, কিচাইন ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণ পর । অক্টোবরের হালকা-মেজাজ শীতের চাঁদ বেরিয়ে এসেছিলেন মিলের তেলচিটে আকাশে ।


কনসটেবলের থ্যাঁতা লাশ পরের দিন ভোরে কাংগাল চামারের ঘরের সামনে প্রথম দেখতে পান বিপিন নামহাটা । উনি ভোর থেকেই বেরিয়েছিলেন পে-স্লিপগুলো কিনতে । ভোরবেলা মগ হাতে হেগে ফেরার সময় চিহ্ণিত করতে সুবিধা হয়, বোঝানো যায়, হাগবার পরে মানুষের মাথা পরিষ্কার থাকে, বুঝতে সুবিধা হয় । জমঘট হয় না । লাশ দেখতে পেয়ে তখুনি দৌড়োতে হল ওনাকে । ফাঁড়িতে খবর পৌঁছোতেই ফাঁড়াফাঁড়ি শুরু হয়ে গেল সেপাই আর সেপাই কত্তাদের মাঝে ।


‘মরে গেছে ?’


‘একেবারে মেরে ফেলেছে ?’


‘কারা মেরেছে খোঁজ নিয়েছেন ?’ জানতে চান শার্লক হোমসের সেপাই সংস্করণ ।


‘কাদের বাড়ির কাছে হয়েছে ক্রাইমটা ?’ জানতে চান ডক্টর ওয়াটসনের বাঙালি ডুপলিকেট ।


‘সবকটাকে ধরতে হবে ।’


‘ধরাধরির দরকার নেই, ইন্সট্যান্ট অ্যাকশান নিতে হবে । ড্রাইভারদের ডেকে পাঠান, আর সবাইকে বলুন এক ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট করতে । সন্ধ্যাবেলা অ্যাকশান ।’


সন্ধ্যায় আরম্ভ হয় হিন্দি সিনেমা । কুলি ব্যারেকের গলিপথগুলোর মুখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে যায় জিপ । চলমান কোনো কিছু দেখলেই সোঁটা । দরোজায় কুঁদো । মেয়েদের চুলের ঝুঁটি । উনুন-বাসনকোসনে লাথি, ঝনঝনাঝনঝন । বাচ্চাদের বুকের ওপর জুতো । কর্ণেল ডায়ার যুগ-যুগ জিও । বুড়ো-বুড়িদের কিল-চড়-থাপ্পড়। শ্রমিকদের পেটে, বুকে, মাথায়, পিঠে লাথি । ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক শিশুদের আতঙ্কিত কান্না । কিন্তু সিনেমার মতন ঢিশুম-ঢিশুম আওয়াজ ওঠে না, অনুশীলিত সাউন্ড ডিজাইনারদের দক্ষতায় ।


‘কোন বাঞ্চোতের বাড়ির সামনে লাশ পড়েছিল ?’


‘এইটে স্যার ।’


‘ধরে আনুন, স্যার বলে দিয়েছেন এটাকে স্পেশাল ট্রিটমেন্ট দিতে হবে ।’


‘ঘরে নেই স্যার।’


‘এই বিপিন, লক্ষ রাখ, ব্যাটা ফিরলেই নিয়ে আয় ।’


‘নাম কি মজুরটার ?’


‘কাংগাল চামার ।’


‘চামার ? কী বলছেন কী ! চামার হয়ে রাজপুত কনসটেবলকে মেরে ফেলল ? জংবাহাদুর সিং সায়েব নিজে রাজপুত বলে একজন রাজপুত কনসটেবলের মৃত্যুতে মুষড়ে পড়েছেন । এর পর যখন শুনবেন যে চামারের হাতে…ছি ছি ছি, পশ্চিমবঙ্গের তো মুখ লোকাবার জায়গা রইল না।’


‘হালায়, আমাগো পইসচিম বঙে আইসা…’


অ্যাডিশানাল সুপার রাজপুত কনসটেবলের মৃত্যুতে ব্যথিতচিত্ত ছিলেন । বিহার থেকে ডোম চামার দুসাধ কোইরি কাহার এসে এখানেও ইজ্জত নষ্ট করতে পারে বলে ধারণা ছিল না ওনার । পরপর কয়েকদিনের সংবাদপত্রে পশ্চিমবঙ্গের মণীষীদের উক্তি পড়ে নিজেকে মুগ্ধ করছিলেন তিনি :


সুব্রত মুখোপাধ্যায়, আই এন টি ইউ সি রাজ্য সভাপতি । ‘এরপর তো ভিখিরিরা মিষ্টির দোকান দখল করবে । মিলের গেটে চায়ের কাপে তোমাকে চাই গাইলেই মিল খুলবে না ।’


চিত্তব্রত মজুমদার, সিটু রাজ্য সম্পাদক : ‘যদি বেশিরভাগ শ্রমিকও ওদের সঙ্গে থেকে থাকেন, তাও ওদের নেয়া হবে না । কারণ ওপথ ভুল । ওদের পথা চললে এ রাজ্যে কেউ শিল্প গড়তে আসবে না । ওপথ আসলে এ রাজ্যে শিল্প ধ্বংসের চক্রান্ত ।’


নীরেন ঘোষ, সিটু রাজ্য সভাপতি : ‘কারখানা দখল হয় বিপ্লবের পর । ফুলেশ্বরে কি বিপ্লব হয়ে গেল নাকি ? এই পথে শ্রমিক আন্দোলন হয় না । এটা কোনো পথ নয় । ওরা তো লম্বা লম্বা কথা বলছে । তা করে দেখাক । মিল চালাবে । চালাক তাহলে ।’


ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, সিপিআই সাধারণ সম্পাদক : ‘শ্রমিকদের টাকা মেরে কারখানা বন্ধ করছেন মালিকরা । রাজ্য সরকার এদের গ্রেপ্তার করছে না কেন ? তেলেনিপাড়ায় লালঝাণ্ডার দপতরে শ্রমিকদের হামলা অভাবনীয় ঘটনা । ফ্রন্ট নিষ্ক্রিয় হলে শ্রমিকদের ক্ষোভ তো বাড়বেই ।’


নিখিল দাস, আর এস পি সম্পাদক : ‘রাজনৈতিকভাবে বামফ্রন্ট ঠিকমতো ভূমিকা পালন করছে বলে মনে করি না ।’


খবরের কাগজগুলো পড়তে-পড়তে জংবাহাদুর সিং এর মুচকি হাসি ঠোঁতে ধরে রাখতে বেশ ভালো লাগছিল । তাঁর টেবিলের ওপরেই রয়েছে আইবির রিপোর্ট । দুর্গাপুজোর ষষ্টির দিনে এলিজাবেথ জুট মিলের শ্রমিকরা তাঁদের ইউনিয়ান নেতাদের গলায় জুতোর মালা পরিয়ে ঘুরিয়েছিলেন চটকল এলাকায় । নেতারা শ্রমিকদের কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে তৃতীয়ার দিন সন্ধ্যাবেলা কলকাতার লিটন হোটেলে তাঁরা পাঁচজন চল্লিশ হাজার টাকা করে মালিকের কাছ থেকে ঘুষ খেয়েছেন । ট্রেড ইউনিয়ান এখন ইউনিয়ান ট্রেড । এই টাকা কতটা ওপর ওব্দি ভাগাভাগি হয়েছে তা লেখা আছে রিপোর্টে ।


সিঁড়িতে বুটজুতোর আওয়াজে, মৃদু হাসি বজায় রেখে, তাকালেন স্মার্ট অফিসারটির দিকে ।


‘লোকটাকে ফাঁড়িতে আনা হয়েছে স্যার, নাম কাংগাল চামার ।’


শোনামাত্র, প্রকৃতির কী অদ্ভুত লীলা, মুহূর্তে উবে গেল তাঁর হাসি, লোমশ ভুরু একটার সঙ্গে আরেকটা ধাক্কা খেয়ে বিস্ফোরণ ঘটাল জংবাহাদুর সিং-এর মস্তিষ্কে । টুপি পরে, ব্যাটন হাতে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘চল্লো ।’


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন