শুক্রবার, ৭ জুলাই, ২০২৩

মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস : ঘেরাটোপ

 

মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস : ঘেরাটোপ

এক

পচাঞ্জন সরদারকে লোকে এক দুর্গন্ধে চেনে ।

ওর শরীরের শিরাগুলো দিয়ে শহরের নর্দমা বয়, ফোড়া হলে বোঝে দেহের ম্যানহোল। সে একরকম রাজনৈতিক  কাঁচামাংসের জন্য অন্যদের চেয়ে বড়ো আর লাল লকলকে ওর জিভ । পচাঞ্জন জানে ও  শক্তিশালী,  বিপজ্জনক। ওর  পরিস্থিতি যাইই হোক,  ওর থুতকুটে ঠোঁটে  হাসি থাকবে, এইরকম। পচাঞ্জন জানে ও ব্যথা বা মৃত্যুকে ভয় পায় না । সব মানুষেরই খুন করার  আবেগ থাকে , পচাঞ্জন সরদারের মতন; যখন ও কাউকে প্রবলভাবে অপছন্দ করে তখন  অনিচ্ছাকৃতভাবে কামনা করে যে বাঞ্চোৎটা মরে যাক। মরুক শালা মরুক । ও এখনও কাউকে খুন করেনি, তবে ও  কয়েকটা বই পড়ে নোট নিয়ে রেখেছে, যাতে নির্দেশ দেয়া আছে কেমন করে মানুষকে খুন করতে হয় । এমনকি ওর যদি মনে হয় যে  হেরে যাবে, তবু  প্রতিশোধ ওকে নিতেই হবে । এতে প্রজ্ঞা বা কৌশলের কোনো ব্যাপার নেই। আসল পুরুষ মানুষ জয়-পরাজয়ের কথা ভাবে না। সে বেপরোয়াভাবে  ঝাঁপিয়ে পড়ে। ও সেস্টেমের দাস । 

এসব কথা যে যুবক নিজেকে বলছিল, তার জীবনের মতনই ওর নামকরণ  । মহর্ষি যোগ হয়েছিল সব শেষে, যখন কুঁজো হাড্ডিসার হয়ে জেল গেটের বাইরে বেরিয়ে দুপুরবেলায়  বাঁ-হাত তুলে গ্রীষ্মের চড়া রোদকে আড়াল করছিল। তার আগে যোগ  হয় পচা,  কেননা লোকটার গায়ের রঙ জন্মের সময়ে এতো কালো ছিল যে নাড়িকাটার গায়নাক ডাক্তার তিস্তা গঙ্গারিডি, বয়স ছেচল্লিশ,  অকুস্হল স্পষ্ট দেখতে না পেয়ে বুঝতে পারছিল না ছেলে  না মেয়ে। হাত বুলিয়ে লোমে ঘেরা লেংটু পেয়ে আতংকিত উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠেছিল, ‘ছেলে হয়েছে, ছেলে । ‘অ্যাগবারে সাক্ষাৎ ডাকাত সরদার, ড্যাবড্যাবে চোখ দুটো যেন রঘু ডাকাত । এদেশে জন্মের সময় থেকে মানুষ হয়ে যায় সিস্টেমের দাস ।

ডাক্তার তিস্তা গঙ্গারিডি এপর্যন্ত ওনার সাতশো সাতান্ন ডেলিভারিতে কোনও নবজাতকের অমন অকুস্হল পাননি যা বয়স্কদের মতন চুলে ভরা । গায়নাক অবাক হয়েছিলেন যে বাচ্চাটা তো কুচকুচে কালো তার ওপর শুধু যে মাথা ভর্তি কালো চুল তা-ই নয়, সারা গায়ে বয়স্ক পুরুষের মতন কালো লোম  । বাচ্চাটা রক্তমাখা শরীরে, তখনও নাড়ি কাটা হয়নি, হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলল আর গায়নাককে জিগ্যেস করল, “আমার বাপটা কোথায় ?’

প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে, মানুষের কান্নার বিরুদ্ধে অনেক বাধা থাকে। পুরুষ মনে করে এটা দুর্বলতা, বা মেয়েলিপনা বা শিশুসুলভতার প্রকাশ। যে পুরুষ কাঁদতে ভয় পায় সে আনন্দকে ভয় পায়, অভিজ্ঞতা থেকে জানে পচাঞ্জন সরদার। এর কারণ হল যে পুরুষ কাঁদতে ভয় পায় সে নিজেকে শক্তভাবে ধরে রাখে যাতে সে কাঁদতে না পারে; তার মানে, অনমনীয় পুরুষ আনন্দকে যতটা ভয় পায়, সে কাঁদতে ততোটা ভয় পায়। আনন্দের পরিস্থিতিতে সে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে । তার উত্তেজনা শিথিল হওয়ার সাথে সাথে সে কাঁপতে শুরু করে। 

লোকটা একই সঙ্গে দুটো নাম পেল, কালো বলে অঞ্জন, পচা আর সরদার – পুরো নাম পচাঞ্জন সরদার । মায়ের আদরের পচা, বাপের আদরের, না ডাকাত  নয়, সরদার, পচাঞ্জন সরদার ।  পচাঞ্জনের  বাপের পদবি তালুকদার, এখনও যথেষ্ট জমিজমা আছে,  তিনফসলি জমি, তালুকদারত্বের জমি, পার্টি-করিয়ে এক নেতার ছোঁড়া-ছোকরারা তিন বিঘে জমি দখল করার পরেও। তালুকদাররা বাঙালিদের  পরিচিত একটা বংশ পদবি। জমিদারির পরই তালুক ছিল ভূ-সম্পত্তির  বিভাগ। মোগল আর বৃটিশ আমলে রাজস্ব আর জমিজমা  সংক্রান্ত বিষয় থেকে এই পদবির শুঁড় বেরিয়েছিল আর তা আজও বজায় আছে ।

’তালুক’  থেকেই পচাঞ্জনের গোমর টের পাওয়া যায় । ইসলামি প্রভাব থেকে গেছে ওদের পরিবারে কেননা তালুক এসেছে আরবি শব্দ তা’আল্লুক’ থেকে, যার মানে জমিজমার মালিকানা আর তালুকের সঙ্গে ফারসি ‘দার’ জুড়ে গিয়ে তালুকদার’ । বলতে গেলে পরিবারটায় এরকম নানা বিটকেল জোড়াজুড়ি আছে । যারা তালুকদার ছিল তারা  জমি আর ছোটোখাটো ভূ-সম্পত্তির বন্দোবস্ত নিতো, সরকারের কাছ থেকে যেমন, তেমনি জমিদারের কাছে থেকেও, মানে ডবল জোড়াজুড়ি। তালুকদাররা হয়ে উঠতো  উপজমিদার । যারা সম্পত্তি নয়ছয় করেনি, পচাঞ্জন সরদারের বাপের বাপের বাপের বাপ ছিল তাদের একজন । আরও আরও আরও আরও লোভের কলে পড়ে   কালো মেয়েকে বিয়ে করেছিল পচাঞ্জনের বাপের বাপের বাপের বাপ, সেই বউয়ের নাম ছিল রাজনন্দিনী, ডাক নাম দনু – তাকে মনে রাখার জন্য রক্তের ঝাড় থেকে বেরিয়ে এলো কালো কেউটে চুলে ঢাকা পচাঞ্জন । সিস্টেমের জন্য খাপসই ।

সেই বাপের বাপের বাপের বাপকে তার শাশুড়ি বলেছিল, ঘোমটার ভেতর থেকে, দেখো জামাই, লোকে যেন না বলে,  কালো মানে শয়তানজামাই উত্তরে শাশুড়িকে বলেছিল, ‘মা-ঠাকরুণ, জানি, কালো যা আলো নয়, যেমন হীরে পেতে হলে কয়লার খনিতে নামতে হয়’ । আর নিজেকে বলেছিল, কালো মানেই মৃত্যুর, বিশ্বাসঘাতকতার আর ভয়ের প্রতীক, ওগুলো আছে বলে জমিজমা করতে পেরেছি। এই পারিবারিক কিম্বদন্তি পচাঞ্জন সরদার অনেকবার ঠাকুমার মুখে, মায়ের মুখে, পিসিমার মুখে, বাপের মুখে শুনেছে । তাছাড়া ও জানে যে দানবরা জন্মেছিল দনুর পেট থেকে । জানে বলে নিজেকে আরও বেশি শক্তিমান মনে করে । শক্তি না থাকলে সিস্টেম কোনো গুরুত্ব দেয় না ।

সারা গায়ে চুল, তায় আবার চকচকে কালো, বাপের প্রিয় উত্তরাধিকারী পচাঞ্জন । ঠিক যেমন কালো কেউটেরা একা চরে বেড়ায়,  এলাকাগুলো নিজেদের খোলোসের দুর্গন্ধ দিয়ে অদৃশ্য বিজলির তার টেনে দেয়   আর গাছের গোড়ার গর্তে হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখে, পচাঞ্জন সরদার ছোটোবেলা থেকে  রপ্ত করে ফেলেছিল সেই গুণগুলো। কালো জাগুয়ার যেমন নীল চোখের হুমকি দিয়ে যেকোনও ধরণের শিকারের মুখোমুখি হতে পারে, পচাঞ্জন বয়ঃসন্ধি পেরোতেই যার-তার সঙ্গে লড়ে যাবার হিম্মতের মালিক হয়ে গেল স্রেফ গায়ের রঙ, দেহজুড়ে কালো লোম আর পেশিশক্তির উত্তপ্ত জোরে ।  পড়শিরা ভাবতো এরকম দজ্জাল ছোঁড়া কেমন করে ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলে ফিবছর ক্লাসে প্রথম হয় ।  পচাঞ্জনের বিশেষ জাদু শক্তি আছে । কেউ যখন নোংরা চিন্তা করছে তখন ও তার মন পড়তে পারে।রাজনৈতিক সিস্টেমের সমাজতাত্ত্বিক স্বার্থ হল সরকার আর তার জনগণের মধ্যে সম্পর্কের মধ্যে কারা ক্ষমতা রাখে এবং কীভাবে সরকারের ক্ষমতা ব্যবহার করা হয় তা নির্ধারণ করা । এই সিস্টেমের জন্য পাক্কা রেডিমেড মাল হয়ে জন্মেছিল পচাঞ্জন। 

বয়ঃসন্ধি থেকেই পচাঞ্জন নিরর্থকভাবে এমন একটা সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে গেছে যা সত্যিই ওর ভেতরে ঘাপ্টি মেরে আছে আর বছরের পর বছর তা আরও বেশি করে  দুঃখজনক কষ্টে পাল্টে গেছে। ওর বাপ জানতো যে ও জরাসন্ধ এফেক্টে ভোগে । ‘বুঝলি জাগুয়ার, ভগবান তোর পোঁদে সিলভার বুলেট চালিয়ে জরাসন্ধের মতন দুফাঁক করে দিয়েছে’ । 

মায়ের পেটে দুশো আশি দিন ছিলুম । কই একা বোধ করিনি তো । জন্মাবার পর তাহলে একা বোধ করি কেন ? আশেপাশে অজস্র লোকজন আছে বলে ? পচাঞ্জন সরদারের বাবা একজন ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট ছিলেন । ছেলেকে উনি বললেন, একজন ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট আর মনোবিশ্লেষক হিসাবে আমার কাজে, আমি অনেক লোককে অপরিচিত, সহকর্মী, বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে সন্দেহজনক চিন্তাভাবনা আর অনুভূতি বর্ণনা করতে শুনেছি। সেসব অভিজ্ঞতা গভীরভাবে বিচ্ছিন্ন হতে পারে। তোর যা চেহারা, সব সময়ে মনে হবে ওই লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেন ! ওই মেয়েটা আমাকে দেখছে আর মনে-মনে হাসছে । তুই বোকার মতন  জিগ্যেস করবি, ‘আপনি কি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন?’ তোর মনে হবে লোকটা বা মেয়েটা তোর ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করছে। তোকে কথাগুলো এইজন্যে বলছি যে তুই অন্যরকম, বাকিদের থেকে আলাদা । দেখবি, আমাদের সিস্টেম একদিন তোকে কাজে লাগাবে ।

সত্যিই, সিস্টেমের সদর দপতরে যোগ দেবার পর পচাঞ্জনকে এতো ঘোরাঘুরি করতে হতো যে ওর ডাকনাম হয়ে গেলো ঘুরঘুরে পোকা ।

পচাঞ্জন সরদার কলকাতা শহরকে ভালোবাসে। ওর কাছে এটা সমসাময়িক সংস্কৃতির ক্ষয়ের রূপক। শহরটা পচাঞ্জনের মতনই কঠোর আর রোমান্টিক । যৌবনে পৌঁছে ওর কালো রিমড চশমার পিছনে দেখা যায় জংলি বিড়ালের কুণ্ডলীকৃত যৌনশক্তি । পুরো দেশটাকেই পচাঞ্জন ভালোবাসে কেননা ওর মনে হয় দেশটা ওর মতনই কুৎসিত আর নোংরা। এর জলাশয়গুলো এক-একটা কলঙ্ক, এর ব্যাবসায়ীরা জোচ্চোর, ট্র্যাফিক উন্মাদ। তবে একটা ব্যাপার আছে - এদেশে বসবাস করলে এটা বাড়ি হয়ে যায়, বিদেশকে বাড়ি বলে মনে হয় না।দেশটা সিস্টেমের ব্যূহ । এদেশের মানুষ, সেই দানব-দানবী, যারা বাতাসে বাস করে, শহরের অগণিত জনসাধারণ পাথরের পুরুষ-নারী আর পশুপাখি, তাছাড়া এমন জিনিস যা মানুষও নয়, পশুও নয়, খরগোশ এবং উড়ন্ত শেয়াল, বিনা  পায়ের পাখি আর কতো কী ! 

সেই পচাঞ্জন সরদারকে সিস্টেম পাঠিয়ে দিলো খাজুরাহো মন্দিরের দেয়ালে সঙ্গমরত কুশাশ্ব দেবনাথকে খবর দিতে যে কুশাশ্ব যেন অতি তাড়াতাড়ি সিস্টেমের সদর দপতরে হাজিরা দেয় ।

দুই

খাজুরাহো মন্দিরের দেয়াল থেকে মাটিতে লাফাবার সময়, ঘুরঘুরে পোকার মুখে পাঠানো আদেশ তামিল করার জন্যে, বাতাসের মাঝপথে, নিজেকে পাষাণ মূর্তি থেকে রক্তমাংসের মানুষে পালটে নিয়েছিল কুশাশ্ব দেবনাথ নামে স্বাস্হ্যবান যুবকটি, যে কিনা হাজার বছরেরও বেশি চাণ্ডেলাবাড়ির একজন গতরি, ভারি-পাছা, ঢাউসবুক উলঙ্গ দাসীর ঠোঁটে ঠোঁট, যোনিতে লিঙ্গ, আর স্তনে মুঠো দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়েছিল ।

তেরোশো শতাব্দীতে মাহমুদ গজনীর সেনাবাহিনী খাজুরাহো আক্রমণ করে ভেবেছিল অন্য সব মন্দিরের মতন এখানেও কাফেরদের সোনাদানা লুকোনো আছে। অনেকগুলো মন্দির ওরা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল । মাহমুদ গজনী  মন্দির থেকে ওকে উপড়ে নিজের দেশে নিয়ে যাবার মতলবে ছিল । তবে সে ব্যাটা সফল হয়নি। ইসলামি হানাদারদের বর্বরতার  ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। আবু রিহান-আল-বিরুনী, পারস্যের ইতিহাসবিদ যে ১০২২ খ্রিস্টাব্দে চান্দেলা  অভিযানে গজনীর মাহমুদের সাথে ছিল, সে খাজুরাহো মন্দিরে আগ্রাসীদের বর্বরতার উল্লেখ করেছে।  সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবক চান্দেলা রাজ্য আক্রমণ ও দখল করেছিল কিন্তু সেও কুশাশ্ব দেবনাথের মুণ্ডু ভাঙতে পারেনি। মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা খাজুরাহো মন্দির দেখার কথা লিখে গেছে যে,  মূর্তিগুলোকে হানাদার মুসলমানরা বিকৃত করেছে। এই ধর্মান্ধরা খাজুরাহোর দশটা মন্দির শেষ পাথর পর্যন্ত ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল।

সেই রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের বিবাহ। যে যাই বলুক, ইতিহাসজুড়ে ধর্মান্ধদের প্রলয়নৃত্য চলছেই । পাথর হয়ে জমাট বেঁধে থাকলেই বা, জানে কুশাশ্ব দেবনাথ, খনিজ তেল আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভালোবাসা, বিশ্ব রাজনীতি, ওয়াহাবি মতবাদের প্রভাব এবং বিস্তার থেকে শুরু করে সব খেলার চেহারাই বদলে গেল রাতারাতি। এতদিন শুধু মধ্যযুগীয় ওয়াহাবি-শরিয়া আইনে ডুবে থাকলেও এবার কালো সোনায় ডুবে গেল তারা, আর সেই সঙ্গে মুসলমান দেশগুলোতে পূর্ণোদ্যমে শুরু হল ওয়াহাবি মাদ্রাসা, মতবাদ এবং মূল্যবোধের প্রসার।

টিকে থাকা মন্দিরগুলির মধ্যে, ছয়টা শিবকে, আটটা বিষ্ণু আর তাঁর অনুষঙ্গকে, একটা গণেশকে, একটা সূর্য দেবতাকে উৎসর্গ করা । ও, কুশাশ্ব দেবনাথ, শিব মন্দিরের গায়ে একই আঙ্গিকে বছরের পর বছর কাটিয়েছে । রাজারা কুড়ি বর্গ কিলো মিটার জুড়ে পঁচাশিটা মন্দির তৈরি করেছিল যার মধ্যে পঁচিশটা টিকে আছে। ওর আর ওর মতন সবায়ের মূর্তিতে ফুটে ওঠা কামুক ভাস্কর্যের বিস্ময় যা কল্পনার জন্য কিছুই বাকি রাখে না, তা দম্পতিদের মধ্যে, খোলাখুলি মিশেল  বা এমনকি পশুদের সাথে যৌন পাশবিকতাই হোক। এত কামুকতা, এমন রূপ, এমন পরিপূর্ণতা, এমন কল্পনা ঠাণ্ডা পাথরে  কখনও শ্বাস নেয়নি। নিতম্ব প্রসারিত, শ্রোণী উঁচু, পা জোড়া, ঠোঁটে ঠোঁট আর  অঙ্গগুলো একে অপরকে গ্রাস করে এমন অবস্থানে যা আজকালকার দর্শকদের মগজে আগুন জ্বেলে  দেয়। ম্যানিকিউর করা নখ, ভেজা চুল, ফোঁটা ফোঁটা জল, জটিল গহনাগুলো সবই জীবন্ত ।

গাঁধিবাবাও, ওনার  ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতার সাথে মানানসই, খাজুরাহো মন্দিরগুলোকে একেবারে পছন্দ করেননি । গাঁধিবাবা এমনকি চেয়েছিলেন যে ভাঙচুরকারীরা খাজুরাহো মন্দিরের অস্তিত্ব মুছে ফেললে ভালো হতো। গাঁধিবাবা  ভয় পেয়েছিলেন যে, খাজুরাহোর মন্দিরগুলো সারা বিশ্বকে দেখাবে যে আমরা  নৈতিক মানুষ নই ।  যখন ভারত স্বাধীন হলো, তখন গাঁধিবাবা ভেবেছিলেন যে এবার সুযোগ পাওয়া গেছে, হয় মন্দিরগুলো ভেঙে ফেলা হোক বা মূর্তিগুলো ধ্বংস করে ফেলা হোক। ১৯৩০এর দশক থেকে তিনি যা জোর দিয়েছিলেন যে যদি ভারতবাসী  ধ্বংস করতে না চায় তাহলে মূর্তিগুলোকে বিশাল মাটির পাহাড় দিয়ে ঢেকে দাও। কেউ দেখতে চাইলে কাদা সরিয়ে ফেলতে পারে, জায়গাটা পরিষ্কার করতে পারে আর দেখা হয়ে গেলে আবার কাদা দিয়ে ঢেকে দিতে পারে। গাঁধিবাবা মূর্তিগুলোকে ভারতবাসীর  দৃষ্টির বাইরে রাখতে চেয়েছিলেন  যে কোনও উপায়ে ।

—ওফ, মাটিতে ঢাকা পড়ে তো মরেই যেতুম, নিজেকে নিঃশব্দে বলল ও, কুশাশ্ব দেবনাথ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই ভারতের অন্যতম মহান ঐতিহ্য হিসেবে খাজুরাহোর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন আর শিল্পবিরোধী উন্মাদনার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। 

রবিঠাকুর বুঝেছিলেন ওকে, ভাবছিল ও, কুশাশ্ব দেবনাথ । আর গাঁধিবাবা ? উনি তো বিপুল সংখ্যক মহিলার সাথে নগ্ন হয়ে শুতেন, আর কয়েকজন মহিলা যাঁরা তাঁর পরীক্ষায় অংশীদার ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই গাঁধিবাবার পীড়াপীড়িতে তা করেছিলেন, স্বাধীন ইচ্ছার বাইরে নয়। তিনি একটি শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন এবং তাকে ‘না’ বলা খুব কঠিন ছিল। এটা গাঁধিবাবা নিজেই বলেছেন। 

গাঁধিবাবা কেন জওহরলাল নেহেরুকে ছাড় দিয়েছিলেন অথচ ওকে মাটি চাপা দিতে চেয়েছিলেন, ভাবছিল কুশাশ্ব দেবনাথ । প্রায় ১২ বছর ধরে নিজেদের মধ্যে চিঠিপত্র আদানপ্রদান করেন জওহরলাল নেহরু আর মাউন্টব্যাটেনের বউ এডুইনা মাউন্টব্যাটেন। মাউন্টব্যাটেনর ছোট মেয়ে পামেলা হিকস জানিয়েছেন, সেই সময়ই নেহরুর সঙ্গে তাঁর মায়ের গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে, "আমার মায়ের তখন একাধিক প্রেমিক ছিল। বাবা সবকিছুই জানতেন। কিন্তু নেহরুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারেই অন্যরকম ছিল।“ সেই সময় মাউন্টব্যাটেন নিজেই একবার বড়ো মেয়ে প্যাট্রিকাকে বলেছিলেন, এডুইনা আর জওহরলালকে এক সঙ্গে খুব ভালো মানায়। এরা দুজনেই দুজনকে খুব পছন্দ করেন।তবে? এদিকে সেই সময় মাহমুদ গজনীর লোকেদের তাড়া খেয়ে লাখ-লাখ পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে আসছে ।

মধ্যপ্রদেশের বেশ খানিকটা প্রান্তিক এলাকায় খাজুরাহো মন্দিরে কতোকাল যে ও আটকে ছিল তা কহতব্য নয়  । ইতিহাস বলে  মন্দিরের গায়ে ওকে জোর করে অমন আঙ্গিকে দাঁড় করানো  হয়েছিল ৯৫০-১০৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, ওর চান্দেলার রাজত্বকালে। রাজশিল্পীদের উদ্যোগে মন্দিরের গায়ে ওকে আর অনেক যুবক-যুবতীদের  কমনীয় আঙ্গিকে—যার মধ্যে বেশিরভাগ ওদের মিলন মুহূর্তের মূর্তি।ওর আর সবায়ের নগ্ন শরীর, আর যৌনতা–প্রাচীন বা ভারতীয় ঐতিহ্যে বিভিন্ন সংস্কৃত কাব্যে ওর, কুশাশ্ব দেবনাথে সম্পর্কে, অনুপুঙ্খ বিবরণ আছে। মানে তখনকার দিনে ওর  সংস্কৃতিতে মিলনের আঙ্গিককে অশ্লীল বলে মুখ লুকোতো না কেউ। 

এতকাল কত রোদ রোদিয়েছে, কত মেঘ মেঘিয়েছে, কত শীত শীতিয়েছে, কত বৃষ্টি বৃষ্টিয়েছে, কত ঝড় ঝড়িয়েছে, কত ধুলো ধুলিয়েছে, তার গোনাগুনতি নেই। তবু কুশাশ্ব দেবনাথ যেমন স্বাস্হবান যুবক ছিল বহু যুগ আগে, এখনও তেমনই গাঁট্টাগোট্টা সৌম্যকান্তি ।

যারা আজকাল ওদের দেখতে আসে তারা জানেই না,  কাশীতে হেতম্বী নামে পরমা সুন্দরী এক ব্রাহ্মণ যুবতি ছিল। অল্প বয়সেই সে বিধবা হয়।  গ্রীষ্মের  জ্যোৎস্নার  মায়ায়  যখন হেতম্বী পুকুরে  স্নান করছিল, তখন অমন অবস্থায় তাকে দেখে চন্দ্রদেব মুগ্ধ হয় আর পেতে চায় । চন্দ্র মানুষের রূপ নিয়ে পৃথিবীতে আসে।  হেতম্বী আর চন্দ্রদেব ভালোবাসাবাসি করে।  হেতম্বী গর্ভবতী হয়ে পড়ে  আর নিজের ভুল বুঝতে পেরে কী করবে ভেবে পায় না । চন্দ্রদেব তখন ভবিষ্যৎবাণী করেন যে হেতম্বীর গর্ভে যে ছেলে  আছে, সে হবে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী আর খাজুরাহোর প্রথম রাজা।

তিন

—-অ্যাই, তোকে সিস্টেমের সদর দপতরে ডেকে পাঠিয়েছে। অমাবস্যার রাতে কানের ওপর এসে, হুকুম শোনাবার মতন হেঁড়ে গলায়, বলেছিল কেঁদো কালো ঘুরঘুরে পচাঞ্জন সরদার, যে অনেককাল যাবত এই কাজ করছে।কুশাশ্ব দেবনাথ জানে, এই ব্যাটা ঘুরঘুরে কাদের হয়ে কাজ করে ।  মধ্যযুগে রাজনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছিল। জোয়ান অফ আর্ককে, বেওয়েইস আর ইংরেজ গুপ্তচর বিশপ পিয়েরি কচন বিশ্বাসঘাতকতা করে ধরিয়ে দিয়েছিল । প্রথম এলিজাবেথের শাসনের সময়, ফ্রান্সিস ওয়ালসিংহাম একটা দক্ষ রাজনৈতিক গুপ্তচর ব্যবস্থা চালু করেছিল। আজকাল তো বেশিরভাগ দেশগুলোতে  গুপ্তচরবৃত্তি সরকারের একটা মৌলিক কাজে পরিণত হয়েছে। ঘুরঘুরেটাও দপতরের দালাল।

হাজার বছরেরও বেশি অমন পোজ দিয়ে থাকার দরুণ শরীর আড়ষ্ট হয়ে থাকলেও, গায়ে কিন্তু একদম ব্যাথা নেই কুশাশ্ব দেবনাথের। আড়ষ্টতা কাটাবার জন্যে একটু ওঠবোস লাফালাফি ছুটোছুটি করে নিল। পাথর হয়ে সঙ্গমরত থাকলেও, সিস্টেমের ‘দফতর’ শুনে ছাঁৎ করে উঠেছিল নিরেট বুক। মাটিতে দাঁড়িয়ে, রক্তমাংসের দেহে, যদিও উলঙ্গ, ছাঁৎ-ছাঁতানিটা কাটতে সময় লাগল।কুশাশ্ব দেবনাথ শুনেছে, যারা এতোকাল ওদের দেখতে আসতো, তাদের ফিসফিসানি থেকে,  নীতির ক্ষেত্রে সিস্টেমের দপতর নাকি আপোষহীন। একটি জাতি বা রাষ্ট্রর পরিণাম  শুধু রাজারানিদের দিয়েই নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় প্রথমত আর প্রধানত লক্ষ লক্ষ বেওয়ারিস জনসাধারণের কাজ দিয়ে যারা এই মন্দিরগুলো বানিয়েছিল। সুতরাং শুধুমাত্র দপতরকে ইতিহাসের স্রষ্টা বলে  কুশাশ্ব মনে করে  না। 

—-এভাবে যাওয়া অ্যালাউড? জিগ্যেস করল কুশাশ্ব। ওর মনে হলো, সিস্টেমের দপতর শহর নাকি বলে বেড়ায় যে একটা কাল যখন শুরু হয়, তখন তাকে এমন কতকগুলো পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, যা ঘটনার উপাদান হিসেবে সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিল। সেই কালের নিরিখে সিস্টেম পরিস্থিতিগুলোকে যতটা গভীরে হৃদয়ঙ্গম করতে আর কীভাবে তা পরিবর্তন করা যায় তা বুঝতে সক্ষম হয়, তত সহজে পাথরের মানুষদের পুনর্গঠনের কাজটা করা সম্ভবপর হবে।

—-নিজেকে নগন্য করে নে, তিন-চার সেন্টিমিটারের মতন, তাহলে প্রবলেম হবে না। মাপ না বাড়লে লোক-লজ্জার ভয় নেই। কন্ঠস্বরে আদেশ মিশিয়ে বলল ঘুরঘুরে পোকা পচাঞ্জন, যে  এখন  পচাঞ্জন সরদার নামে পুরো গোভারতে বিখ্যাত। এক দুর্গন্ধে সবাই চেনে। কথা বলার সময়ে কারও মুখ থেকে যদি দুর্গন্ধ আসে, সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। নির্ঘাত এ ব্যাটার   অঙ্গের কোনও কিছু ঠিক মতো কাজ করে না,  সেটা গ্যাস হয়ে  রক্তে বেশি করে থেকে যায়। রক্ত থেকে তা ফুসফুসে যায়। আর ঘুরঘুরে পচাঞ্জন যখন নিঃশ্বাস ছাড়ে, তার সঙ্গে বেরিয়ে আসে, হ্যাক থুঃ। শরীরের অভ্যন্তরীণ জটিলতা হলো গন্ধের উৎস। কিন্তু দপতর শহরের সবাই নাকি মনের জটিলতায় ভোগে । বিশেষ করে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় ।

—-যাব কী করে? শরীরের পেশিগুলো ম্যাসাজ করতে-করতে, যাতে একটু ঢিলে-ঢালা হয়, জানতে চাইল কুশাশ্ব।

—-তোর সেই জলফড়িং বন্ধুটা কোথায়? তার তো বেশ হাওয়াইজাহাজের মতন বডি, চার ডানার ইনজিন, চাদ্দিকে দেখার মত ডুমো-ডুমো চোখ। ওটার ওপর বসে চলে যা। জানিস তো, এক পা আগে, দুই পা পিছে চলার নীতিটিকে মেনে চললেই কেল্লা ফতে । জানিস তো, জল-ফড়িং আকারেও নিতান্ত ছোট হয় না। একএকজন  দুই ইঞ্চি পর্য্যন্ত  হয়। ওদের গায়ের রঙ্ লাল হল্‌দে সবুজ নানা রকম দেখেছি। মাথাটা প্রায়ই শরীরের তুলনায় বড় আর চোখ দুটাও প্রকাণ্ড । একএকটা চোখে প্রায় বারো  হাজার ছোট চোখ আছে। তার মানে ওর আটাশ হাজার চোখ আছে। অনেক পোকার অমন হাজার হাজার চোখ আছে, কিন্তু জল ফড়িঙের চোখ অন্যদের চোখের চেয়ে অনেক উন্নত।  জল-ফড়িঙের মাথার দুই ধারে যে দুই-গাদা চোখ বসানো আছে, তা দিয়ে ও কাছের জিনিস দেখে আবার কতকগুলোকে দূরের জিনিস দেখবার সময়ে কাজে লাগায়। কাজেই তোকে নিয়ে যাবার জন্য পারফেক্ট ভেহিকল ।

মনে পড়ল কুশাশ্বর। পতঙ্গিনী ধরিত্রীকন্যা নামে এক জলফড়িং এসে প্রতিদিন নাকের ডগার ওপর বসে ডানা ঝাপটানির আদর দিচ্ছে মাসখানেক যাবত। পতঙ্গিনীও বলছিল, মন্দিরের গা থেকে নেমে, জলজ্যান্ত মানুষ হয়ে দেশঅদেশ দেখতে, ভালমন্দ খেতে, রক্তমাংসের মেয়ের আহ্লাদ নিতে। পতঙ্গিনীর পরিবার নাকি কয়লাযুগের সময় থেকে রয়েছে। তখন ওরা অনেক অবস্হাপন্ন ছিল। এত অবস্হাপন্ন যে ওর পূর্বপুরুষদের বলা হত দৈত্যফড়িং, আর সময়টাকে লোকে বলত রেনেসঁস।

রেনেসঁসের সময়ে ছিলেন ফোরোরাকোস, টিরানোসরাস, ডিপলোডোকাস, ইগুয়ানাডন, ট্রাইসেরাটপাস, মাস্টোডোনসরাস, স্টেগোসরাস, রয়ামোফোরিনকাস, টেরানোডন, ব্লনটোসরাস, আরকিওপটেরিক্স, ট্রাকোডোন, মোসোসৌর প্রমুখ মহান ব্যক্তিত্ব; একদিন বিকেলবেলায় বলেছিল পতঙ্গিনী, যখন বিকেলেরচ সোনারঙআ হাওয়া ওর স্বচ্ছ চারটে ডানাকে ফরফরিয়ে হাওয়াতে চাইছিল। কয়লা-উৎপাদী বনজঙ্গল যখন ফেলে-ছড়িয়ে চারপাশ জংলাচ্ছে, তখন জলে অভিভূত জলায়-জলায় ডানাবাজনার প্রবচন শুনিয়ে সংস্কারের কাজ করতেন ওর তিন ফিট লম্বা পূর্বপুরুষরা।

আর এখন? পতঙ্গিনী ধরিত্রীকন্যা বলে, এখন সবই খুদে-খুদে। ছয়ফুটকি কাঁচপোকা, গোবরঠেলা গুবরে, ডোরাকাটা তেলাপোকা, কালীঝিঁঝি, গন্ধকীট, কেঁচো, কির্মি, মঃকুন, বল্মীক, কিটিভ, জালিক, উচ্চিঙ্গে, ডেঁয়ো, পুতিকা, লুমবিষ, শলভ, শুঙ্গা, কেঁদরাই, জলৌকা, ঘুণ আর চুলচেরারা সমাজ চালায়।

অচেনাসুলভ অচেনাদের একটা জমঘট আছে যাকে খুদেরা আর অখদ্দেরা বলে দফতর। যারা ইনজিরি ভাষা জানে তারা বলে পার্টি- ঘর। ওই দফতরে হাজির হতে বলেছে ঘুরঘুরে। আদেশ দিয়ে, গায়ের ঢাকনা তুলে, গোপন ডানা বের করে, মুখের সামনে কালাশনিকভ উঁচিয়ে চলে গেল স্পেশাল রিজার্ভ ফোর্সের ঘুরঘুরে কমান্ডার। এই গানটা গাইতে গাইতে:  “অন্তহীন মেহনতে বেঁকে গেছে যাদের পিঠ,কাল পর্যন্ত যারা উদ্ধত ভ্রকুটির সামনে মাথা নত করেছে, তারা জেগে উঠবেই, আমরা জানি, পর্বত সরে যাবে মাথা নিচু করে, আশার ডানায় ভর করে তারা উঠবে সবার উপরে।”

পতঙ্গিনী বলেছিল, কাঁচপাখনার খুনসুটিমার্কা কাঁপন তুলে, দফতরের অছিসিংহাসনের মালকিনির সামনের দিকটা সুয়োরানি আর পেছনদিকটা দুয়োরানি; কিন্তু তুমি টেরটি পাবে না কোনটি সুয়ো আর কোনটি দুয়ো।

—-সে কি? আমাদের মন্দিরের গায়ে যে উলঙ্গ যুবতীরা অমর হয়ে রয়েছে তাদের তো সামনে দিক আর পেছনদিক একেবারে আলাদা, অথচ সুয়ো-দুয়োর ব্যাপার নেই।

—-তোমার মন্দিরে যা আছে তা হল স্হপতি আর ভাস্করের কল্পনা। আমি রূঢ় বাস্তবের কথা বলছি ভায়া। কখনও যদি দফতর শহরে যাও, নিজের চোখে দেখতে পাবে।

—-শুধু চোখ কেন আমি তো সব অঙ্গ দিয়েই দেখব। চোখ দিয়ে সবকটা ডাইমেনশান ধরা যায় না। তাছাড়া তোমার মতন চোখ তো আমার নেই।

সিস্টেমের দফতরের ডাকে সে-কারণেই সাড়া দিল কুশাশ্ব দেবনাথ। এই পচাঞ্জনের মতন লোকেরা দড়িবোমা বানাবার লোক রাখে, মুঙ্গের-বেগুসরাই থেকে ওয়ান শটার আনায় আর ছোকরাদের পোষে। যে ছোকরাগুলো আগে ছিল রুবিস্টোনের দলে তারা এখন নাকি চলে গেছে স্যাফায়ার স্টোনের দলে। যারা  মেষ, কর্কট, সিংহ, বৃশ্চিক, ধনু আর মীন রাশির জাতক তারা পোখরাজ স্টোনের দলে যাবার তোড়জোড় করছে ।

এদিকে অমাবস্যার অমিয় অন্ধকার, তারায় তেরিয়ে আকাশ, শীতে শীতোচ্ছে ঝোপঝাড়, বাঁশিয়ে রয়েছে বাঁশবন, হিমে হিমোচ্ছে হালকা হাওয়া; কখন দুজোড়া ডানার কপাট খুলে পতঙ্গিনীর ঘুম ভাঙবে কে জানে।

নগণ্য হবার আগে একবার জঘন্য হয়ে দেখা যাক, ভাবল কুশাশ্ব। বলা তো আর যায় না। যদি দফতর শহরের কাজে লাগে। যদি অছি-সিংহাসনের কাজে লাগে। যদি মালকিনির সুয়ো দিকের কাজে লাগে। যদি মালকিনির দুয়ো দিকের কাজে লাগে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। সারা গায়ে চুল আর শুঁড়োলো মুখ দিয়ে দাঁত বেরোনো শাকাহারী ম্যমথ হয়ে গেল কুশাশ্ব। আট ফুট উঁচু কাঁধ, ছয় মেট্রিক টন ওজন লোমশ শরীরের বাইরেটা  চাদরের মতন কিন্তু কান আর লেজ ছোটো।  গজদন্ত বিশাল আকৃতির গাছে-গাছে গেছো পাখিদের চেঁচামেচিতে লজ্জা পেয়ে আবার ফিরে এলো নিজের চেহারায়। ট্রায়ালটা দিয়ে অবশ্য ফুরফুরে প্রাণে ফুরসত এলো।

সকালে, পতঙ্গিনী এসে যখন রক্তমাংসের কুশাশ্বকে দেখল, ওর তো হেসে-হেসে ডানা ব্যথা হবার যোগাড়। সব শুনে বলল, নগণ্য-জঘন্য বা ধন্যধন্য যা-ই হও, অত দূরে ফ্লাই করার প্রযুক্তি আমার নেই ভায়া। অত এভিয়েশান ফুয়েলও ক্যারি করতে পারি না।

—-তাহলে কী হবে? কেমন করে যাব?

তুমি নগণ্য হয়ে আমার পিঠে দুপাশে পা ঝুলিয়ে বসো, আমি একজন শঙ্খচিলের পিঠে বসিয়ে দেবো তোমায়। ওরা কেউ-কেউ দফতর-শহরের দিকে যায়।

নগণ্য হয়ে, উঠে বসার সময়ে পিছলে যাচ্ছিল কুশাশ্ব। ভোর-ভোর পরাগ মাখাবার ডিউটিতে বেরিয়েছিল পতঙ্গিনী, যাতে বেশি-বেশি হাইব্রিড জন্মায়।

—-হাইব্রিড? জানতে চাইল কুশাশ্ব। অচেনাসুলভ অচেনা?

হ্যাঁ, হাল আমলে আমরা ফড়িংরা অনেক ধরনের হাইব্রিড তৈরিতে সফল হয়েছি।

—-তাই বুঝি?

—-হ্যাঁ তো! গাঁধিবাবার পরাগের সঙ্গে মার্কসের পরাগ, রামদেবের পারাগের সঙ্গে রজনিশের, মাও-এর সঙ্গে মোরারজির, মার্কিনের সঙ্গে চিনা, জেহাদের সঙ্গে সাম্যবাদ, লাউ-এর সঙ্গে লঙ্কার, রবারের টুপির সঙ্গে চামড়ার টুপি; সে-সব হাইব্রিড তুমি দফতর শহরে গেলেই দেখতে পাবে।

—-হাফ-চেনার সঙ্গে উড়ুক্কু হাফ-চেনা মিশিয়ে পুরো একখানা অচেনাসুলভ অচেনা? পিঠের ওপর যুৎ করে বসে বলল কুশাশ্ব। এভাবেই ঘোড়ায় চাপত হাজার-হাজার বছর আগে।

চার

ঝিলের ঝিলমিলে কিনারায় যে শঙ্খচিলটা বসেছিল তাকে, জলে পোঁতা কঞ্চিতে বসে জিগ্যেস করল পতঙ্গিনী, একজনকে দফতর-শহরে নিয়ে যাবেন? ওর ডাক পড়েছে, খুব জরুরি।

ঠোঁটে শুকনো ঘাসের নুটি নিয়ে পেতলের একটা ছোট মূর্তি ঘষেমেজে চকচকে করছিল শঙ্খচিল, এক মনে, মাথা নিচু করে। বলল, গোপালের এই তো সবে ঘুম ভাঙল। দাঁত মাজিয়ে, চান করিয়ে, ব্রেকফাস্ট করিয়ে, তারপর ওকে নিয়ে একটু বেরোব। অনেকেই বাড়িতে নাড়ু গোপালের পুজো করে থাকে। এটা শ্রীকৃষ্ণের শৈশবের চেহারা। তবে পাখির চোখের মতন নীড়ে নাড়ু গোপাল রাখলেই হল না, তার অনেক নিয়ম কানুন রয়েছে। পাখির চোখের মতো নীড়ের বাইরে গেলে গোপালকে কখনই তালাবন্ধ করি না ।  কারন গোপালকে আমরা ছোটো বালক হিসেবে পুজো করি। ফলে তাকে একা রেখে কখনই যাওয়া উচিত নয়। সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াই ।

—-আমাদের সময়ে চান্দেলায় শ্রীকৃষ্ণের গায়ের রঙ তো নীল ছিল । আপনার গোপাল সোনালী কেন? জানতে চাইল কুশাশ্ব দেবনাথ ।

—ভেরি সিম্পল । কেউ কেউ মনে করেন যে ভগবান কৃষ্ণের ত্বকে নীল আভা বস্তুগত দেহের রঙ নয় বরং ভগবানের চিরন্তন আধ্যাত্মিক দেহ যা নীল আভা ছড়ায়। ভগবদ্গীতা অনুসারে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আনন্দময় রূপ শুধুমাত্র শুদ্ধ ভক্তদের কাছেই দৃশ্যমান। তিনি অভক্তদের বিভ্রান্ত করতে পারেন, কিন্তু যারা তাঁর কাছে শুদ্ধ ভক্তিমূলক সেবা নিবেদন করেন তারা সর্বদা তাঁকে তাঁর নীল আনন্দময় রূপে দেখেন। বলল শঙ্খচিল ।

—ওঃ, সরি, জানা ছিল না । আপনি বেশ জ্ঞানী ।

—থ্যাঙ্ক্যু । বলল শঙ্খচিল, যার মাথা শঙ্খের মত সাদা , ঘাড়, বুক, পেটের তলা'র পালক যার উপর মরিচা ধরা খাড়া ছোট রেখা ; ঠোঁট ছোট, লেজ  গোলাকার ; ডানায় , বাদামি  আর দেহের নিচের দিক বহু রেখা ; লেজ আর ডানা একই দৈর্ঘ্যের ।


—-আপনি যতটা যাবেন অন্তত ততদূর পৌঁছে দেবেন নাহয়। তারপর কোনো যানবাহনে চাপিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। প্রস্তাব দিল পতঙ্গিনী।

—-ঠিক আছে, আগে গোপালের সেবাটা করে নিই। এক হাতে গোপালকে, অন্য হাতে তোমার অতিথিকে ধরে নিয়ে যাবো।

শঙ্খচিলের পায়ের কাছে কুশাশ্বকে নামিয়ে, টা-টা করে চলে গেল পতঙ্গিনী। কুশাশ্ব দেখল গোপাল একটা পুতুল, হাতে নাড়ু নিয়ে বসে আছে, জলজ্যান্ত শ্রীকৃষ্ণ নয়। ও নিজে ছিল পাথরের আর নাড়ুগোপাল নিরেট পেতলের।

শঙ্খচিলের পরামর্শ মেনে, যে-হাতে গোপালকে আঁকড়ে ধরল পাখিটা, সেই হাতটা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল কুশাশ্ব। একটা হাত আমার খালি থাকা দরকার, নয়তো নামার সময়ে অসুবিধা হবে, বলেছিল শঙ্খচিল।

দু-তিনবার পাক খেয়েই আকাশের চেয়ে উঁচু আকাশে উঠে পড়ে শঙ্খচিল যখন ফুল স্পিড নিয়েছে, ধাতব হাসি হেসে পেতলের মূর্তিটা ফিসফিস করে কুশাশ্বকে বলল, এত নিচু স্বরে যাতে শঙ্খচিল শুনতে না পায়, এই নিন, নাড়ু খান, আপনার তো মনে হচ্ছে সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি।

সত্যিই বেশ জোরে খিদে পেয়ে গিয়েছিল। বাঁ-হাতে নাড়ুটা নিয়ে খেয়ে নিল কুশাশ্ব। এমন খিদে পেয়েছিল যে প্রশ্ন করার মানে হয় না, গোপাল ছোকরাটার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় না হওয়া সত্বেও।

খেয়ে নিলে, গোপাল বলল, আরো নিচু স্বরে, দফতর থেকে আমারও ডাক পড়েছে, কিন্তু আমার সেবাইত তো ছাড়তেই চায় না, সব সময়ে সঙ্গে থাকে, এমনকি রাত্তিরে ঘন্টা বাজিয়ে মশারি টাঙিয়ে, আমাকে ঘুম পাড়ায় আর নিজে আমার সামনে মাটিতে শুয়ে মশার কামড় খায়।

এরকম উজাড় করে সেবা করছে শঙ্খচিল লোকটা, অথচ আপনি দফতরের ডাকে সাড়া দিতে চাইছেন? কুশাশ্ব বিস্মিত। গলায় নাড়ুর চুরো আটকে আরেকটু হলেই জোরে কেশে ফেলত। সূর্য উঠে গিয়ে থাকলে কী হবে, আকাশ ব্যাপারটাই একেবারে ঠান্ডা, পাথরিনী চান্দেলা যুবতীর চেয়েও। তার ওপর খুচরো মেয়েলি মেঘগুলো মাঝে-মধ্যে সুড়সুড়ি দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।

বন্দী জীবন কাটাচ্ছি, বুঝলেন, চব্বিশ ঘন্টা নজরে-নজরে, একেবারে একপাখিতন্ত্রী যাপন, সর্বগ্রাসীতা হল স্বৈরাচারের একটা বৈচিত্র্য যা একটা একক মতবাদের দ্বারা চিহ্নিত  হয় আর আরও নির্দিষ্টভাবে, একজশক্তিশালী শঙ্খচিল বা ভূবন চিল বা বাদামি চিল যিনি তার ব্যক্তিগত  রাজনৈতিক প্রতিভূ । বলল গোপাল। তারপর যোগ করল, একটু পরেই আমার সেবাইত ছোঁ মেরে নাড়ু তোলার জন্যে একটা বাড়ির ছাদে নামবে, তখন কিছুক্ষণের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে যাবে। বাঁ হাতটা তাই ফাঁকা রেখেছে। ছাদের কাছাকাছি যেই নামবে, আপনি ওর হাতের বগলে কাতুকুতু দিয়ে মাটিতে ঝাঁপ দেবেন, আমিও দেবো সেই সঙ্গে।

কিন্তু পতঙ্গিনী তো বলেছিল ও-ই দফতরে যাবার গাড়িতে তুলে দেবে। আর আকাশের রঙ দেখুন। আপনার পেতলের শরীরের ভেতরের মতন নীল । 

আসলে, বলল গোপাল, আলোর বিক্ষেপণের কারণে আকাশ নীল দেখায়। কোনও কণিকার ওপর আলো পড়লে সেই কণিকা আলোকে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দেয়, যাকে আলোর বিক্ষেপণ বলে। যে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত কম, সেই আলোর বিক্ষেপণ তত বেশি হয়। আলোর বিক্ষেপণ এর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চতুর্ঘাতের ব্যস্তানুপাতিক। বেগুনি ও নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম। তাই আকাশে এই আলো দুটির বিক্ষেপণ বেশি হয়। আবার আপনার চোখ বেগুনি অপেক্ষা নীল বর্ণের আলোর প্রতি বেশি সংবেদনশীল । তাই আকাশ নীল আকাশ দেখছেন । 

—তাহলে কী করব এবার ?

প্রশ্ন করবেন না। সেবাইতদের বলা যায় না। কিছু না পেলে আপনাকেই টুক করে খেয়ে ফেলতে পারে। আমি তো পেতলের, আমায় খেতে পারে না। হয়ত আমি ধাতুর বলেই আমার সেবাইত হয়ে রয়েছে।

পাঁচ

দোটানায় পড়ল কুশাশ্ব।শঙ্কচিল গোঁতা মেরে নামা আরম্ভ করেছিল নিচে। ভাবার আর সময় ছিল না। হালুইকরের বাড়ির ছাদে নাড়ুর বিশাল থালার কাছাকাছি হতেই কাতুকুতু দিয়ে লাফ মারল কুশাশ্ব। গোপাল নাড়ু মাখার পাত্রের মধ্যে পড়ল। তুলে নেবার জন্যে শঙ্খচিল পেছনে বাঁক নিয়ে নেমে এসেছিল বটে, হালুইকরের মা একটা লাঠি নিয়ে ‘এই পালা এই পালা’ চেঁচিয়ে তাড়াল পাখিটাকে। না পালিয়ে ওপরে চক্কোর মারছে দেখে হালুইকরের ভারি নিতম্বের মা লোকজন ডেকে নাড়ুর থালা, যার ফাঁকে কুশাশ্ব লুকিয়ে, আর নাড়ু মাখার বিরাট পাত্রটা, যার মধ্যে গোপাল লুকিয়ে, মাথায় তুলে হাঁপাতে হাঁপাতে নিচের তলার ভাঁড়ার ঘরে গিয়ে রাখল। কুশাশ্ব দেবনাথ অনুমান করল যে এই বাড়িটাই শঙ্খচিলের টার্গেট কেননা যে সমস্ত মহিলাদের নিতম্ব ভারী হয় তাদের দেখতে খুবই সুন্দরী হয়। ছোট নিতম্বের মহিলাদের সেইভাবে সুন্দর দেখতে লাগে না। ভারী এবং স্থূল নিতম্বের মহিলারা স্বাভাবিকভাবেই বেশি আকর্ষণ করতে পারে পুরুষদের। 

কর্মীরা বাইরে বেরিয়ে গেলে, কুশাশ্ব স্তম্ভিত হয়ে দেখল, গোপাল প্রমাণমাপের মানুষের চেহারা নিয়ে ফেলেছে।

-করছ কী? করছ কী? ধরা পড়ে গেলে ভীষণ কেলেংকারি হবে। আমার মতন খুদে হয়ে যাও না। পরে সুযোগ পেলে কেটে পড়ব। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল কুশাশ্ব।

গোপাল বলল, আমি নগণ্য হতে পারি না। সে-ক্ষমতা আমার নেই। আমি যে ঈশ্বর। আমি কেবল বড়, আরও বড়, তার থেকেও বড় হতে পারি। বা ধাতু, কাঠ, মাটি, পাথরের হতে পারি। কিংবা নিরাকার।

—তা জানি, বলল কুশাশ্ব দেবনাথ। তারপর যোগ করল, আমাদের চান্দেলা রাজত্বে, আমাদের ধর্মে ঈশ্বরের ধারণা মূলত নির্দিষ্ট কোনো ঐতিহ্য বা দর্শনের ভিত্তিতে তৈরি ছিল না। চিণ্ময়বাদ, অদ্বৈতবাদ, সর্বেশ্বরময়বাদ, অদ্বৈতবাদ, আস্তিক্যবাদ – সকল প্রকার বিশ্বাসের সমাহার দেখা যেতো আমাদের ধর্মে। আমাদের ধর্ম অনুযায়ী জীব-আত্মা শাশ্বত। অদ্বৈত বেদান্তের ন্যায় অদ্বৈতবাদী বা সর্বেশ্বরময়বাদী দর্শন অনুসারে, জীবনের উদ্দেশ্য হল আত্মা ও পরমাত্মার অভিন্নতা বা একাত্মতা অনুভব করা। আত্মা সর্বশেষে পরমাত্মা বা ব্রহ্মে বিলীন হয়। এই কারণেই এই দর্শন অদ্বৈতবাদ নামে পরিচিত। উপনিষদে বলা হয়েছে, মানুষের পরমসত্ত্বা আত্মাকে যিনি ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন রূপে অনুভব করতে সক্ষম হন, তিনিই মোক্ষ বা মহামুক্তি লাভ করেন। পরমসত্ত্বা রূপে ঈশ্বর  আমাদের ধর্মে ব্রহ্ম, ঈশ্বর, ভগবান বা পরমেশ্বর নামে আখ্যাত। অবশ্য ঈশ্বর শব্দের একাধিক ব্যাখ্যা রয়েছে। মীমাংসাবাদীরা ঈশ্বরে অবিশ্বাস করেন; অপরদিকে সাংখ্যবাদীরা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। আবার অদ্বৈতবাদীরা আত্মা ও ব্রহ্মকে অভিন্ন মনে করেন।

—তাহলেই বুঝুন, বলল গোপাল ।

মনে হল এ-ঘরে কেউ আসছে। পায়ের শব্দ শোনা গেল। ঘরের অন্ধকার কোনে,দ্রুত শুয়ে থাকা পেতলে রূপান্তরিত হল গোপাল। উত্তেজনায় কুশাশ্ব নিজের ছয়ফিট দীর্ঘ প্রকৃত চেহারা নিয়ে ফেলল। হাতে, বাহুতে, পায়ে, গলায় স্বর্ণালঙ্কার সুদ্ধ। কিন্তু দেহে যে পোষাক নেই। খাজুরাহো মন্দিরের দেয়ালে ওভাবে পোশাকহীনই ছিল হাজার বছর।

যে যুবতী-বধু ঘরে ঢুকেছিল, সে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিল ভেতর থেকে, বলল, তোকে রোজ দূর থেকে ডাক দিই, অথচ হেঁসেলে মিষ্টি তৈরি করার বাইরে তোর চোখ যায় না, খুন্তি নাড়াচ্ছিস তো নাড়াচ্ছিস, বলে,  ঝাঁপিয়ে পড়ল কুশাশ্বর ওপর। টাল সামলাতে না পেরে, ডাঁই-করা মিষ্টির পাহাড়ের ওপর পড়ল দুজনে। তাই আওয়াজ গেল না বাইরে। কুশাশ্ব দেবনাথ অবাক হলো যে বউটা জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর শাড়ি পরার  শৈলী জানে ।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বোম্বেতে পড়াশুনা করার পর কলকাতায় শাড়ি পরার এই  শৈলীর প্রচলন ঘটান। এই পদ্ধতির জন্য শাড়ির নিচে সেমিজ বা ব্লাউজ আর শায়া পরতে হয় । বউটা শুধু শাড়ি জড়িয়েই চলে এসেছে।

সকাল থেকে আমার বিশেষ কিছু খাওয়া হয়নি । সম্বিত ফিরে না পেলেও বলল কুশাশ্ব।

—হেঁসেলে কাজ করিস, চুরি করে খেলেই পারিস, আমি তো আছি, কথাগুলো বলতে-বলতে, বাঁ হাত দিয়ে কুশাশ্বর মুখে চোখে নাকে মিষ্টি গুঁজে দিতে লাগল যুবতি, আর ডান হাতে খুলতে লাগল নিজের শাড়ি। মিষ্টির নানা রকম ঢিবির ওপর চলল ওদের দুজনের স্বয়ংক্রিয় সৃজন-কম্মের হুটোপাটি । বউটা  কুশাশ্বর ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ফিসফিস করে গাইতে লাগলো সজনী আমি কি হেরিলাম গৌরাঙ্গরূপ মনোহরা। নিশি অন্তে ভোর যামিনী হেরিলাম গৌরচান্দ গুণমণি। নিদ্রা হইতে চমকিয়া উঠি পাইয়া গৌরচান্দ হইলাম হারা। কি দেখলাম কি দেখলাম। সখী গৌররূপের ঝিকিমিকি। কি দিয়ে গড়িয়াছে গৌরার বাঁকা দুটি নয়নতারা।” 

কুশাশ্ব বুঝতে পারলো, এটা বউটার অরগ্যাজমের গান । মিষ্টির বিছানায় ওদের খেলা স্তিমিত হয়ে এলে, কুশাশ্ব বলল, দফতর শহরে যাবার জন্যে ওকে সাহাজ্য করতে। গোপালের কথাটা চেপে গেল, কেননা এরাও যদি গোপালকে বন্দী করে ফ্যালে তাহলে মুশকিল। বলা যায় না; হয়ত ক্যাশ-বাক্সের ওপর রেখে এরাও গোপালের সেবাইত হতে চাইবে।

মেয়েটি কুশাশ্বর জন্যে একটা থলে, ফুলপ্যান্ট, শার্ট, জুতো আর সোনার এক হাজার সরকারি মুদ্রা এনে দিতে, কুশাশ্ব চান্দেলা যুগের নিজের সবকটা অলঙ্কার গা-হাত-পা থেকে খুলে দিয়ে দিল , স্মৃতিচিহ্ণ হিসাবে। যুবতী যখন দেখতে গেল খিড়কি দরজার দিক ফাঁকা আছে কিনা, গোপালকে তুলে ঝোলায় পুরে নিল কুশাশ্ব।

পেছনের খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে ওপরে তাকিয়ে দেখল, তখনও আকাশে চক্কোর দিচ্ছে শঙ্খচিল। ঝোলা থেকে গোপালকে বের করলে ও-ও প্রমাণ মাপের মানুষের চেহারা নিল , আর মাথা থেকে ময়ূরের পালকটা খুলে ফেলে দিল ছুঁড়ে।

ছয়

ঈশ্বর হয়েও আপনি নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি? আমার নগণতার সুযোগ নিতে হল? গাড়ি-ঘোড়ার খোঁজে হাঁটতে-হাঁটতে গোপালের দিকে প্রশ্ন দুটো ছুঁড়ে দিল কুশাশ্ব।

ঈশ্বরদের অনেক হ্যাপা, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল গোপাল। ঈশ্বররা পাওয়ার শেয়ারিঙে বিশ্বাস করে না, আকাশে উড়ন্ত শঙ্খচিলের দিকে তাকিয়ে বলল গোপাল। তারপর যোগ করল, ঈশ্বররা ভক্তদের দিয়ে অপরাধ করাতে বাধ্য হয়, কেননা তারা নিজেরা নিজেদের হাতে অপরাধ তুলে নিলে ঈশ্বরগিরি হারাবে। গোপিকাদের নিয়ে লীলে খেলায় আমি তো অনেক বেশি অভিজ্ঞ । এমন কি যতই যাই করি কৌমার্য অটুট থাকে। তবু ওই যুবতীকে সন্মোহনে ডেকে পাঠালুম যাতে ওর বাঁজা বরের বদনাম ঘোচাবার অপরাধটা আপনি করেন, আর সেই সঙ্গে যুবতীটি আমাদের পালাবার সুযোগ করে দ্যান।

—-ঈশ্বর হওয়া দেখছি বেশ ঝকমারি! ওই মাহমুদ গজনী আর আইবক, ওরা ওদের ঈশ্বরের হুকুমে আমাদের মন্দিরগুলো মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল । ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড সিরিয়া যেটা পরিচিত আইসিস, আইএস, আইসিল কিংবা দায়িশ নামে, অমন ভাঙচুর চালিয়েছে নানা শহরে। বর্তমান পৃথিবীর এক ভয়ঙ্কর আতঙ্কের নাম। এই জঙ্গী গোষ্ঠীর বর্বর কর্মকাণ্ডের সাথে ইতোমধ্যেই পরিচিত আমরা সবাই। ইরাকের নিনেভে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয় তারা। শহরের প্রাচীন প্রবেশদ্বারে অবস্থিত বিশাল মূর্তি বৈদ্যুতিক ড্রিল মেশিন আর হাতুড়ি দিয়ে চুরমার করেছে।নিমরুদে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত ‘জিগুরাত’ ধ্বংস করে দিয়েছে ওরা। আইসিসের হাতে যে নিদর্শনটি বিধ্বস্ত হওয়ায় মানব সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতি হয়ে গেছে, সেটা হল সিরিয়ার পালমিরা। পালমিরা ছিল সিরিয়ায় অবস্থিত একটি প্রাচীন শহর। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে এই শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ব্রোঞ্জ যুগে নির্মিত হওয়া শহরটি সচল ছিল মানব সভ্যতার আধুনিক যুগের আগমনের পরেও ।

হ্যাঁ, যে ঈশ্বরই হোন না কেন, যে সম্প্রদায়ের বা যে দেশেরই হোন না কেন, এই বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি নেই। নিরাকার হয়েও পার পাওয়া যায় না।

—-তার চেয়ে তো না হওয়াই ভাল।

—-সেই জন্যেই তো পচাঞ্জন সরদারের কথামতন দফতর শহরে যাচ্ছি।

—পচাঞ্জন কি আপনার সঙ্গেও তুইতোকারি করেছে?

—-হ্যাঁ, কেন বলুন তো? গায়ের রঙ কালো, উস্কোখুস্কো চুল আর হাটুরে ধুতি দেখে সিস্টেমের প্রতিনিধিরা তো এমনিতেই তুইতোকারি করেন। কেনই বা আমায় বিশেষ ছাড় দেয়া হবে?

অসহায় গোপালের দিকে তাকাল কুশাশ্ব। পথে, রেডিমেড জামাকাপড়ের প্রথম দোকানটা থেকে দুজনের জন্যে এক সেট করে ট্রাউজার, টি শার্ট আর ট্যাংক জাঙিয়া কিনল। গাময় মিষ্টির রস লেগে চটচটে, স্নান করে পোশাক পালটাতে হবে। নাড়ুঅলার খিড়কি দরজা ছাড়ার সময় থেকে একদল কীর্তনীয়া মাছি ডানার খঞ্জনি বাজিয়ে একঘেয়ে গেয়ে যাচ্ছিল, ‘জামাটা খোল না রে রসিক নাগর, দেহসুধা পান করি…’।

এসব মিষ্টিখোর মাছিদের জানা আছে কুশাশ্বর। এরা ঘোড়া মাছি, এদের ড্যাবডেবে নেশা-করা চোখ দুটো এমন যে মাথা খুঁজে পাওয়া যায় না। মাদিগুলো রক্ত খায়। যখন পাথর হয়ে মন্দিরের গায়ে স্হায়ি সঙ্গমকারীর চাকরিতে ছিল, মরদগুলো লিঙ্গের ওপর বসে মধুরস খাবার তালে থাকত; মাদিগুলো এসে বসত পোঁদের ওপর। কিছু না পেয়ে, ভুল বুঝতে পেরে, কাঁচা খিস্তি দিতে-দিতে উড়ে যেত।

তিতকুটে-সবুজ বনবাদাড়ে ঘেরা একটা ঝলমলে-টলমলে সোমথ্থ ঝিলের কাছে পৌঁছলে, গোপাল বলল, আমি নিজেকে একটু লাঘব করে আসছি, আপনি ততক্ষণ স্নানটা সেরে ফেলুন।

হ্যাঁ, হয়ে আসুন, বলল কুশাশ্ব। তারপর খটকা লাগল, ঈশ্বররা কি হাগেন-মোতেন! কে জানে, হয়ত অমন অবিনশ্বর সমস্যার কারণেই ওনারা হয় নিরাকার হয়ে যান, বা পাথর-মাটি-ধাতু-বরফ কোনো আধারকে আশ্রয় করেন। এও কম ঝকমারি নয়। ও নিজেও যখন পাথর ছিল, তখন হাগা-মোতার সমস্যা ছিল না। পান-ভোজনের দরকার হত না তো মলের প্রশ্নই উঠত না।

জামা-প্যান্ট খুলে ঝিলকিনারায় রাখার পর, ওর, কুশাশ্ব দেবনাথের, পোশাক নিয়ে যখন কীর্তনীয়া মাছিরা ‘মিছা মায়া মধুরসে, বন্দী হয়্যা মায়াপাশে, হরিপদে না রহে ভকতি’ গাইতে-গাইতে কাড়াকাড়ি করছে নিজেদের মধ্যে, ওদিকে খেয়াল দিতে গিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়েছিল, ব্যাস, সেই ফাঁকে একটা চিকনচাম ঠান্ডাবদন ময়ালসাপ ওকে জড়িয়ে বলে উঠল, এইবার বাগে পেয়েছি তোমায়, আর কোথাও যেতে দেব না, তুমি আমায় শেখাবে কী ভাবে বহুক্ষণ নিজের ল্যাজের ডগায় দাঁড়িয়ে নাচতে হয়।তুমি তো হোপি সংস্কৃতির মানুষ, দেখেই চিনেছি, হোপির আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে আছে স্নেক ড্যান্স, যা প্রতি বছর আগস্টের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হয়, সে সময়ে তোর মতন অভিনয়শিল্পীরা  মুখে জীবন্ত সাপ নিয়ে নাচে । তোদের সবচেয়ে বিখ্যাত  অনুষ্ঠান হল হোপিদের সাপ-এন্টিলোপ নাচ,  সাপকে বৃষ্টির জন্য চার দিকে ছেড়ে দিস। এখন তো বর্ষাকাল আসবো-আসবো করছে । 

—-আঃ ছাড়ুন ছাড়ুন, কাতরে উঠল কুশাশ্ব, আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আপনার অশ্লীল আলিঙ্গনের চাপে। আপনি তো ‘হ্যাপি স্নেক’ বলে জানি, নির্বিষ, জগৎ-সংসারের সুখীতম  সদস্য, অলস আর খাদ্য রসিক । ছোট ছোট সাপ, ব্যাঙ, পাখি আপনার ব্রেকফাস্ট । যান না গিয়ে  এ বাড়ির ছাগলছানা, ও বাড়ির বিড়াল, বুনো খরগোশ, হরিণশিশু ভোজন করুন। আপনার করাতের মতন চোয়াল সব হাড়গোড় মিহি করে দেয় জানি। অমন ভারি গতর নিয়ে কোন নাচ নাচবেন মিস ময়ালসুন্দরী ? ভরতনাট্যম, কথাকলি, কত্থক, কুচিপুডি, ওড়িশি, সত্রীয়া, মণিপুরি নাকি মোহিনীঅট্টম ?

—-ছাড়বই যদি তো এই সাড়ে তিন পাকে ধরেছি কেন? জিভ দিয়ে কুশাশ্বর গাল চাটনির মতন চেটে নিয়ে বলল দাগড়া পোশাকের রয়াল বেঙ্গল ময়াল, মুখ দিয়ে বোটকা গন্ধ বেরোচ্ছে পালকসুদ্ধ বুড়ি দেশি মুর্গি খাবার।

—-আরে, অদ্ভুত মশাই, চিনি না জানি না, গলা টিপে ধরে এ কেমন প্রস্তাব! টু-পিস জিমনাস্টদের কাছে যান না শেখার জন্যে। গোপালের এসে পড়ার প্রত্যাশায় এদিক-ওদিক তাকিয়ে, গলার জাপট ছাড়াবার চেষ্টা করতে-করতে বলল কুশাশ্ব। দাঁড়াতে শিখে করবেনটাই বা কী? এই তো বেশ আছেন, সারা জীবন কেবল শুয়ে থেকেই চালিয়ে দ্যান সরকারি চাকুরেদের মতন । একদিন খেয়ে সপ্তাহখানেক ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেন রাজনীতিকদের মতন ।

—-জানিস না মানে? আমার পেটে যাবার আগে শ্বেতকেষ্ট সিংহ নামের শঙ্খচিলটা বলছিল যে তুই হাজার বছর ধরে অশ্লীল ঢঙে দাঁড়িয়েছিলিস, তুইই ওকে ঠকিয়ে ওর সোনার গোপাল হাতিয়ে পালিয়েছিলিস; সেইটে খোঁজার জন্যে ও মাঠে এসে নেমেছিল, আর আমি ওকে খপ করে ধরে গপ করে খেয়ে টপ করে হজম করলুম, যাতে ইয়ে করার আগে গায়ে একটু গত্তি লাগে।

—-তার মানে তো আমি আপনার উপকার করেছি।

—-আমাকে ভড়কি দিসনি। আমার নাম স্বপ্ননীল বাজারি, বুঝলি। সব বাজারের সব্বাই আমাকে এক হাঁকে চেনে। এখন ঘন্টার পর ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে প্রেম করার তরকিবটা বল।তোর মন্দিরে নাকি অনেক কচি মেয়েদের জমঘট হয় সন্ধ্যাবেলায় । আমার বৈঠকখানায় তার চেয়ে বেশি হয়, বুঝলি, আমি হলুম স্বপ্ননীল বাজারি ।

গায়ে মিষ্টি রস লেগে থাকের দরুণ স্বপ্ননীল বাজারির জাপটটা যে পিছলে যাচ্ছে তা টের পাচ্ছিল কুশাশ্ব। এ-ব্যাটার সাড়ে তিন পাক থেকে ছাড়ান পাবার একটাই উপায়। সেটাই করল ও। আচমকা নগণ্যা হয়ে গেল। ফলে আলিঙ্গনের প্যাঁচ ফসকে টুপুস করে পড়ল গিয়ে ঝিলের জলে।

সাত

আশেপাশে কিলবিলে চেঁচামেচি শুনে বুঝতে পারল যে নীলচেসবুজ ব্যাঙাচিদের জলহুল্লোড়ে গিয়ে ও, কুশাশ্ব, পড়েছে। আমাদের উত্তমকুমার, আমাদের সৌমিত্তির, আমাদের বুম্বাদা, আমাদের জিৎ, আমাদের শারুখ, আমাদের সালমান, আমাদের আমির, আমাদের অভিষেক, আমাদের ভিকি কৌশল, আমাদের শাহিদ, আমাদের রণবীর বলে-বলে কুলকুচিগান করতে লাগল মারমেইড ব্যাঙাচিবৃন্দ।

শীতকালে ব্যাঙাচি! বিস্মিত হল কুশাশ্ব। স্বপ্ননীল বাজারীরও তো শীতে কম্বল চাপা দিয়ে গর্তের পালঙ্কে বা ঝাড়ের দোলনায় ঘুমোবার কথা বলে। ঋতুগুলো হয়ত সবাইকে বোকা বানিয়ে ক্যালেন্ডারে জায়গা বদল করে নিয়েছে।

ভাগ্যিস ময়ালের স্টকে ছোবল নেই। নইলে আর দেখতে হত না। জলেতে এক কোপ ছলাৎ মেরে কপাৎ দিলেই তো এক ঝাঁক ভারজিন মারমেইড ব্যাঙাচিদের সঙ্গে স্বপ্ননীল বাজারির এসি মার্কেটে, যেখানে মাথায় রেডইন্ডিয়ানদের মতন পালকের মুকুট পরে রাঙাচোখো শঙ্খচিলটা, শ্বেতকেষ্ট সিংহ, রেগে হালুয়া হয়ে বসে আছে।

ব্যাঙাচি মারমেইডগুলো হাত-ধরাধরি করে নগণ্য কুশাশ্বকে বৃত্তাকারে ঘিরে ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ গাইতে থাকে পানা-বীথিকার সবুজ টলটলে ছায়ায়। গানটার এমনই অলস নিশিডাক যে ব্যাঙাচি মারমেইডদের বৃত্তের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভাসমান কুশাশ্বর হাতদুটো একবার বাঁদিকে উঁচু হয়ে ঢেউ খেলায় তো একবার ডানদিকে উঁচু হয়ে ঢেউ খেলায়। ভালই চলছিল ওর জলনাট্য। একটা দশ কিলো কাৎলা ওকে বিনা বঁড়শির টোপ মনে করে মুখে ঢুকিয়েই ফেলে দিল, থু-থু করে; বলল, শালা তেতো মানুষের বাচ্চা কোথাকার! 

এদিকে বিনা নোটিসে অমন এপাং-ওপাং-ঝপাং তোলায় মারমেইডরা যে যার ল্যাজ-লজ্জা বাঁচিয়ে ছত্রভঙ্গ।

থু-থু করে দূরে ছোঁড়ার ফলে কুশাশ্ব পড়বি তো পড় একটা গর্তের একেবারে ভেতরে। ভয়ে কাঁটা। ভাবল, নিশ্চই কোনো ছোবলধারী সাপের বা দাঁতবের-করা শেয়ালের আড্ডায়  গিয়ে পড়েছে, আর সে-ব্যাটা দাঁত কেলিয়ে জব্বর ঘুম দিচ্ছে। যে-দিক থেকে আলো আসছিল, সেদিক দিয়েই বেরোবার পথ আঁচ করে ল্যাংটো পোঁদে পড়িমরি দেদ্দৌড় লাগাল। ছুটছে তো ছুটছেই, ছুটছে তো ছুটছেই, ছুটছে তো ছুটছেই; শুনতে পেল লোকজনের কথা বলার ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসছে, ওই দিকেই গমগম করছে আলো।

গর্তটা হয়ত কোনো বদলি-হওয়া সরকারি বা বেসরকসরি প্রাণির। কিংবা ভুতুড়ে ছমছমিয়া টানেল মনে করে একমাংসবর্তী জীবরা ছেড়ে চলে গেছে নতুন নিকোনো গর্তে। কিংবা সুন্দরী লুমলুমে শেয়ালনির সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া যুবরাজ শেয়ালের। কিংবা পুলিশ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত গিরগিটির, যে সন্ন্যাসী হয়ে খাইবার পাসের পাথুরে ডেরায় ছররা-মালা জপতে গেছে। যাই হোক, গর্ত থেকে মাথা বের করে কুশাশ্ব দেখল যে ওপরে জায়গাটায় মেলা বসেছে, আর গর্তের হাঁ-মুখের এপাশে-ওপাশে-চারিপাশে নানা রকমের নানা রঙের নানা মাপের খেলনা সাজানো, বেশির ভাগই একটা পেল্লাই-ভুঁড়ি টাকমাথা লোকের ছোট-ছোট চেহারা।

সবকটা মূর্তিতেই চিকনা-টেকোটা গাল ফুলিয়ে হাসছে। দু-হাত ওপরে তুলে নিতাই-গৌর হয়ে, পাশবালিশে হাঁটু রেখে বসে, বাবু হয়ে ভুঁড়ি ঝুলিয়ে বসে, তা সে যত রকমের পোজ হতে পারে তেমন করে, কায়দা করে গাল ফুলিয়ে হাসছে ভুঁড়িদাস থলথলে টাকলুটা। হাসছে তো হাসছেই।

কেউ ওকে দেখতে পাচ্ছে কি না জানার জন্যে বুক পর্যন্ত গর্ত থেকে বেরিয়ে ইতিউতি দেখছিল কুশাশ্ব। ভেবেছিল কারোর নজর না পড়লে বেরিয়েই পোঁপা ছুট মেরে গিয়ে লুকোবে সামনের টিপ নখপালিশ লিপস্টিক শ্যাম্পু ডেওডোরেন্ট ময়েশ্চারাইজার বিক্রির মেয়েভুলোনো দোকানটায়। তারপর এক ফাঁকে কোনো দোকানে লুঙ্গি বা পাজামা বা নিদেন একটা হাফপ্যান্ট যোগাড় করে প্রমাণ-মাপের মানুষ হয়ে মেলার ভিড়ে মিশে যাবে।

তা আর হল না। কাছাকাছি যে টেকো গালফোলা ভুঁড়িদাস খেলনাটা ছিল, সে খপ করে ধরে ফেলল কুশাশ্বকে। আর ও, কুশাশ্ব, ভয়ে কেলিয়ে গিয়ে, ভৎ করে নিজেকে আবার গর্তের মধ্যে লুকিয়ে ফেলল। তার ফলে যা হল তা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না।

গালফোলা হাসিমুখ টেকোটা, যে কুশাশ্বর চুলের মুঠি ধরেছিল, ডিগবাজি খেয়ে সরুসুড়ঙ্গে পড়ল গিয়ে কুশাশ্বর ঘাড়ের ওপর। দুজনে গড়াতে-গড়াতে বেশ খানিকটা ঢুকে গেল টানেলের ভেতর। গড়ানো থামলে, কুশাশ্ব শুনতে পেল টেকোটা অট্টহাসি হাসছে। সে কী জোরে-জোরে হাসি। গমগম করতে লাগল গর্তপথ। হাসছে তো হাসছেই। হাসছে তো হাসছেই।

কুশাশ্ব প্রথমে ভেবেছিল যে ও উদোম ল্যাংটো বলে ভুঁড়িদাসটা বসে-বসে হাসছে। কিন্তু আবছা আলোয় লক্ষ করল যে টেকোটার গায়েও এক চিলতে কাপড় নেই। কেবল ঝোলা ভুঁড়িতে ওর লেংটুটা ঢাকা পড়ে গেছে।

—-আপনি কে? আমাকে বেরোতে দিলেন না কেন? কোনো মানে হয় এ রকম আচরণের? বিরক্ত কুশাশ্ব জবাবদিহি চাইল।

জবাব দেবার বদলে লোকটা নিজের অট্টহাসি বজায় রাখল।

—-আচ্ছা লোক তো মশাই আপনি। আমি কথা বলছি আর আপনি শুধু বোকার মতন এনামেল হাসি হাসছেন।

—-হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-আরে। কী মুশকিল। এরকম হাসাহাসির আবার কী ব্যাপার হল?

—-হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-দেখুন, আপনার মাওসেতুঙি হাসিটা এবার থামান। জানেন তো শি জিন পিঙ হাসেন না । আর আপনি কে মশাই? আমাকে বিপদে ফেলে হাসছেন। আপনার তো দাঁতও নেই দেখছি যে বলব দাঁত বের করে হাসছেন।

—-হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

কুশাশ্ব ভাবল হাসছে হাসুকগে। এক সময় তো চোয়াল ব্যাথা হয়ে থামবে। মাটির দেয়ালে ঠেসান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসল। ফোকলাটার হাসি থামার নাম নেই। দশ মিনিট, পনেরো মিনিট, কুড়ি মিনিট, তিরিশ মিনিট, চল্লিশ মিনিট, পঞ্চাশ মিনিট, কতক্ষণ ধরে টেকোটা টানা হেসে গেল কে জানে।

—-চুপ করুন, ফুলকো হাসি থামান। ধৈর্য রাখতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠল কুশাশ্ব।

জোরে-জোরে হাসি থামাল বটে লোকটা, কিন্তু ফিকফিকে মেটেল হাসি বজায় রাখল গাল ফুলিয়ে।

—-আপনি কে? কী চান? সরাসরি জানতে চাইল কুশাশ্ব।

—-লাঃ ফিং বু ঢ ঢো ঢা। লোকটা এমনভাবে দমফাটা হাসি মিশিয়ে কথাগুলো বলল যে কী বলছে মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারল না কুশাশ্ব।

—-বুঢঢা বুঢঢো, কী বলছেন বুঝতে পারছি না।

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-বুঢঢো? বুদ্ধ? না বুঢঢা?

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-গৌতম বুদ্ধ?

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-বামিয়ান বুদ্ধ? কিন্তু বামিয়ান বুদ্ধদের তো বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে তালিবানরা।  পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো যুগল বুদ্ধমূর্তি ভেঙে ফেলেছিল ওরা।   ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ গান্ধার ভাস্কর্যের আদলে তৈরি হয় এই দুই মূর্তি। একদিকে একটা ৩৮ মিটার উঁচু মূর্তি, আর তার ঠিক উল্টোদিকে আরও বড়ো একটি মূর্তি ছিল।


—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-হীনযানের বুদ্ধ?

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-মহাযানের বুদ্ধ?

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-শাক্যমুনি বুদ্ধ?

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-এই যে বললেন লাফিং বুঢঢা?

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-লাফিং বুঢঢাই শিওর তো?

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-একশো ভাগ নিশ্চিত?

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-আমাকে আটকে দিলেন কেন?

—-গোপাল এই পথ দিয়ে যাবার সময় বললেন আপনি এই গর্ত দিয়ে বেরোবেন। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-তাতে কী? আমি বেরোতে চাইছিলুম। আপনি অযথা বাগড়া দিলেন।

—-আমাকেও সিস্টেমের দফতরে ডেকে পাঠিয়েছে। পচাঞ্জন সরদার হুকুম জানিয়ে গেছে। সামনেই নির্বাচন। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-আপনাকেও? স্তম্ভিত কুশাশ্ব চেঁচিয়ে জিগ্যেস করে ফ্যালে। এখন বের হব কেমন করে? পোশাকই বা যোগাড় হবে কী ভাবে? আপনি তো এমন থপথপে যে আপনার দ্বারা কিছু হবে বলে মনে হয় না।

পাকা সন্ধ্যার থকথকে অন্ধকার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। হাসি বজায় রেখে বলল লাফিং বুঢঢা। তারপর মেঝেয় শুয়ে, বাহুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। নাক ডাকতে লাগল। নাক ডাকা শুনে ভয় হল কুশাশ্বর। ব্যাঙাচিগুলোর মা-মাসি-পিসিরা আবার মেটিং-কল মনে করে না হপহপ ফপফপ করতে-করতে চলে আসে।

আট

এক সময়ে কুশাশ্বও ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল যখন, তখন একটা মেঠো মাদি ইঁদুর পায়ে চিমটি কেটে বলল, এই আপনারা এভাবে যাতায়াতের রাস্তা ব্লক করে রেখেছেন কেন?  আর এটা তো দেখছি অকম্মের ঢেঁকি লাফিং বুঢ়ুয়া, ও আবার এখানে কী করতে এসেছে? তারপর কুটিপাটি ইঁদুরদেঁতো হাসি হাসল। হাসতে হাসতেই বলল, আজকে তো যতদুর জানি দফতর থেকে অবরোধের হুকুম জারি হয়নি, রাস্তায়-রাস্তায় তাহলে তো ক্লাবের ছেলেরা ঝান্ডার ডান্ডা, দড়িবোমা, ওয়ান শটার নিয়ে জনমনিষ প্যাঁদাতে বেরোত!

ইঁদুরের পেছন-পেছন ওরা দুজন গর্তের মুখ পর্যন্ত গিয়ে দেখল মেলাচত্বর ভোঁভাঁ, বাইরে শীত-রাতের শীতে কাহিল আঁধিয়ারি অন্ধকার ঘুটুরঘুটুর করছে। ঝিঁঝিরা বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে  খেয়াল গাইছে। নিশ্চয়ই গোয়ালিয়রের তালিম নেয়া অন্ত বুয়া মানে অনন্ত মনোহর জোশির কাছে, আগ্রার তালিম নেয়া ওই ঘরানার মহাপণ্ডিত উস্তাদ বিলায়েত্ হুসেন খাঁর কাছে আর জয়পুর ঘরানার তালিম নেয়া ওই ঘরানার প্রবর্তক প্রবাদপ্রতিম উস্তাদ আল্লাদিয়া খাঁর ছেলে ভুর্জি খাঁর থেকে। ওরা গানের আসরে এই তিন গায়কি মেশাচ্ছে না, টের পেলো কুশাশ্ব দেবনাথ। 

বাইরে বেরিয়ে দুজনেই একসঙ্গে প্রমাণ মাপের মানুষ হয়ে উঠতে, ‘তাজ্জব ব্যাপার’ বলে চলে গেল মাদি ইঁদুরটা, কেননা মানুষের শরীর থেকে ইঁদুরলিঙ্গহীন ইঁদুর ঝুলতে ও-ও নিজের এত বছরের ধান চুরির অভিজ্ঞতায় দেখেনি।

দূরে দপদপে অথচ টিকিসটিকিস আলো জ্বলতে দেখে, ভৌতিক অন্ধকারের মেঠো সুযোগ নিয়ে, দুজনে সন্তর্পণে সেই দিকে এগোল। আলো জ্বলতে-থাকা প্রথম ঘরের জানলা দিয়ে দেখল, সবুজ পাঞ্জাবি গায়ে একটা লোক খাটের ওপর দলীয় পতাকা বিছিয়ে  আঙুলে মুচকি-হাসি মাখিয়ে নোটের থাক সাজাচ্ছে। তার পাশে একজন হাফ-সুন্দরী যুবতী। এবাড়িতে খাওয়া-পরা-থাকার যোগাড়-যন্তর করা মুশকিল। পোশাক হাতানোটাও কঠিন।

পরের বাড়িটায় পৌঁছে জানলা দিয়ে দেখল, এক প্রৌঢ় দম্পতি সান্ধ্য-সঙ্গমে মশগুল। সঙ্গমকালীন পরিবেশ গড়ার জন্যে আলোও টিমটিমে লিকলিকে। জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে, দম্পতির খুলে-রাখা পোশাক টেনে নিল ওরা। প্রৌঢ় দম্পতির লীলেখেলা দেখে লাফিং বুঢঢা মুখে না হেসে কেবল ভুঁড়ি নাচিয়ে হাসছিল। 

—আমি বারো রকমভাবে ভুঁড়ি নাচিয়ে হাসতে পারি, বলল লাফিঙ বুডঢা ।

শার্ট-প্যান্ট-সোয়েটার পরে নিল কুশাশ্ব। মহিলার শাড়ি লুঙ্গির মতন করে পরে গায়ে আলোয়ান চাপা দিয়ে নিল লাফিং বুঢঢা। তারপর যেদিক থেকে ভারি ট্রাক চলাচলের শব্দ আসছিল সেদিকে রওনা দিল দুজনে।

পৌঁছল জাতীয় সড়কে, কে জানে কত নম্বর, যাচ্ছে আসছে যানবাহন। সরকারি গাড়ি প্রায়ভেট গাড়ি। টেম্পো ট্রেকার জিপ। ডিজেল পেট্রল সিএনজি। কিন্তু কোন দিকে সিস্টেমের দফতর শহর? হাত দেখানো সত্বেও থামছে না কোনো গাড়ি। হেড লাইটের আলোয় ওদের দেখতে পেয়ে গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাতের বেলায় গণতন্ত্র আরও বেশি গণতন্ত্র হয়ে যায়। রাস্তার অন্য পারে গিয়ে হাত দেখিয়েও কোনো কাজ হল না।

—-দাঁড়ান, কোন দিকে হাঁটতে হবে আমি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে নির্ণয় দিচ্ছি, হাসতে-হাসতে কথা কটা বলে আবার হাসতে-হাসতেই এই ফরমুলাটা বলল লাফিং বুঢঢ: ‘আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি, যদুর মাস্টার শ্বশুরবাড়ি, রেল কম ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম’। তারপর নির্ণয় নিল, এই দিকে গেলে পা পিছলে আলুর দম হবে, তাই আমাদের হাঁটতে হবে উল্টো দিকে।

যেমন বলা তেমনি কাজ। বজ্রবাঁটুল বিজ্ঞের বৈজ্ঞানিক বাতেলা বলে বাক্যি। ঢং-ঢাঙাতিদের থেকে বাঁচতে হলে বিজ্ঞানের আশ্রয় নেয়া ছাড়া উপায় নেই। কম্ম কয়াল করতে হবে তো! অতএব বাগড়া-বাগড়ি না করাই ভাল। দুজনেই তো এখন সোঁতের শ্যাওলা । আরম্ভ হল হাঁটা দেয়া।

হাঁটছে তো হাঁটছেই। হাঁটছে তো হাঁটছেই। হাঁটছে তো হাঁটছেই। কোনদিকে দফতর শহর তার নির্দেশবোর্ড নেই কোথ্থাও। খানিক পরে-পরে কেবল মাইলপাথর।তার ওপর যৌনরোগ সারাবার পোস্টার, যার দরুন কী লেখা পড়া কঠিন। যেটুকু বা পড়া গেল কয়েকটায় তাতে অচেনাসুলভ অচেনা জায়গার নাম। আরও হন্টন। লাফিং বুঢঢা রাস্তার পাশে বসে পড়ে বলল, আর পারছি না গো, আপনি বরং এগোন, আমার ভুঁড়ি আর ওজন বইতে পারছে না। মুখে গালফোলা অটুট, কিন্তু হাসি উধাও। ইচ্ছে তো কুশাশ্বরও হচ্ছিল বসে পড়তে। লাফিং বুঢঢার দেখাদেখি ও-ও বসে পড়ল। একটু পরে রাস্তার ধারে শুয়ে পড়ল দুজনে।

লাফিং বুঢঢা সতর্ক করল কুশাশ্বকে, ঘুমিয়ে পড়বেন না যেন, শেষে জন্তু-জানোয়ার টেনে নিয়ে যাবে।জানেন তো, হাঁটার আছে অনেক উপকারিতা- এর ফলে পেশী সুগঠিত হয়, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুরক্ষিত থাকে ও মেরামত হয়, হজমে সাহায্য করে, এবং মস্তিষ্ককেও সতেজ রেখে বার্ধক্য প্রতিরোধ করে। এর পাশাপাশি হাঁটার ফলে মানুষের চিন্তার সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়, মেজাজ বা মুড ভালো রাখে এবং স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কমাতেও সাহায্য করে। স্নায়ুবিজ্ঞানী প্রফেসর শেন ও'মারা হাঁটার কিছু উপকারিতার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি ডাবলিনে ট্রিনিটি কলেজে মস্তিষ্ক বিষয়ে গবেষণা করেন।  

—জানি, জানি, এরপর আপনি বলবেন, নিষ্ক্রিয় থাকার অর্থ শরীরে পেশীর শক্তি কমে যাওয়া। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা এর ফলে মস্তিষ্কও শুকিয়ে মরে যেতে শুরু করে। আমরা যখন হাঁটি তখন পেশীতে তৈরি হওয়া মলিকিউল বা অণু আমাদের মস্তিষ্ককে সচল রাখতে সাহায্য করে। তার মধ্যে একটি বিশেষ অণু মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে সাহায্য করে। এর ফলে আমাদের ব্রেনের কোষগুলো বিকশিত হয়। ফলে হাঁটলে মস্তিষ্ক আরো শক্তিশালী হয়।  বলল কুশাশ্ব দেবনাথ ।

—বরং গল্প করা যাক, কী বলেন। আমি একটা গল্প বলছি। হয়ত গল্প শুনতে-শুনতে জেগে থাকবেন। রসিয়ে-রসিয়ে গল্প বলা আরম্ভ করল লাফিং বুঢঢা।

নয়

অনেক অনেক অনেক দিন-রাত আগেকার কথা। আমাদের সিস্টেমতন্ত্রে এক নেতার চারটে ছেলে ছিল। তারা ছিল পরস্পরের জিগরি দোস্ত। সবসময় মিলে-মিশে থাকে। মলে যায়, মাল্টিপ্লেক্সে যায়, ডিসকোথেকে যায়, নাইট ক্লাবে যায়, বেশ্যালয়ে যায়, ভোট দিতে যায়, পিকনিকে যায়, বাজি পোড়াতে যায়, চিনা রেস্তোরাঁয় যায়, লং ড্রাইভে যায়, সালসা নাচতে যায়, সর্বত্র এক সঙ্গে যায়।

ওদেরও সিস্টেমতন্ত্রের নেতা বানাবার আগে  বাপ ট্রেনিঙে পাঠাল। নেতা বাপ দেশের টাকাকড়ি-সোনাদানা মেরে লুকিয়ে রেখেছিল; আর সব নেতারা যা করে এই নেতাও সেই সব কুকম্ম করে জীবনে উন্নতি করেছিল। তাই ভাবল ছেলেদের এবার পথ দেখানো দরকার। তাহলেই তো সিস্টেমের দপতর শহরে গদির আলো পাবে; নয়তো থাকতে হবে অন্ধকারে। ছেলেদের পাঠিয়ে দিল নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী।

যেতে যেতে, যেতে যেতে, যেতে যেতে, এক জায়গায় ছেলেগুলো দেখতে পেল জটায় শ্যাম্পু, গলায় মুক্তা-পান্না-চুনীর হার, গায়ে সিল্কের আলখাল্লা, মেট্রোসেক্সুয়াল পারফিউম মেখে, একজন লোক মাইক বাজিয়ে শিষ্য যোগাড় করছে। উপস্হিত শিষ্যরা জানাল যে উনি সিদ্ধযোগী।

চারজন প্রণামী দিয়ে বলল, মহারাজ, আপনি তো গুরু লোক, অনেককে পার পাইয়ে দিয়েছেন। আমরাও আমাদের বাপের মতন নেতা হয়ে নেম-ফেম-ব্লেম-শেম কামাতে চাই । আপনি একটু ট্রিকগুলো বাতলে দিন। গডম্যান সন্তুষ্ট হয়ে ওদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে টর্চ দিবে বলল, তোরা এক কাজ কর। চারজনে সিস্টেমের দফতর শহরের দিকে এগিয়ে যা।হাঁটতে থাক । মনে রাখিস শিশুর হাঁটার সময় মা-বাবা কিছু নিয়ম পালন করলে দ্রুত ও সহজে হাঁটা শিখতে পারে । শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের নিয়ম অনুযায়ী হাঁটা শিখতে ১৩ থেকে ১৫ মাস লাগে। একটু বিলম্ব হলে ১৮ মাস থেকে দুই বছরও লেগে যেতে পারেগাড়িঘোড়া নট অ্যালাউড । যেখানে যার টর্চের ব্যাটারি ফুরিয়ে যাবে, সেখানে সে খোঁজ করলেই অঢেল লুকোনো টাকাকড়ি-সোনাদানা পাবে। ব্ল্যাক থেকে হোয়াইট করার টাকার পাহাড়।রাজনীতি করতে হলে লেজার টর্চ চলে না । আরেকটা কথা, পার্থ ঘনিষ্ঠ হলেই কেলো হয়ে যাবে । পার্থ লোকটার আসল রঙ কেউ জানে না ।

গডম্যানের কথামতন চারজন মিলে যাত্রা আরম্ভ করল। দিন যায় রাত যায়, হাঁটে। দিন যায় রাত যায় , হাঁটে। দিন যায় রাত যায়, হাঁটে। দিন যায় রাত যায়, হাঁটে। এক জায়গায় একজনের ব্যাটারি ফুরিয়ে গেল। সেখানে মাটি খুঁড়ে নতুন-পুরানো অঢেল তামার কয়েন পাওয়া গেল। সে অন্য ভাইদের বলল, চল, তামার কয়েনের এই স্টক নিয়েই দেশে ফেরা যাক। নতুন-পুরানো তামা বেচে প্রচুর মাল কামানো যাবে। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১০৪৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টাঁকশালে ভুলবশত দস্তার পরিবর্তে তামা দিয়ে ২০টি কয়েন তৈরি হয়। কয়েনগুলো বাজারেও চলে যায়।কিছুদিনের মধ্যে ব্যাপারটা প্রকাশ হলে গুজব ছড়ায়, যে এই বিরল কয়েন ফেরত দেবে তাকে ফোর্ড মোটর কোম্পানির গাড়ি দেয়া হবে। এই ঘোষণার পর নকল তামার কয়েনে বাজার ভরে যায়।ওই কয়েনগুলোর মধ্যে একটা কয়েন পেয়েছিল ১৬ বছরের জন লুটস জুনিয়র।  তার মধ্যেই একটা তামার কয়েন ছিল।সে পরে জানতে পারে যে, কয়েনের  বদলে গাড়ি দেওয়ার প্রস্তাব পুরোটাই গুজব। তখন কয়েনটি যত্ন করে রেখে দেয় জন। ২০১৮ সেপ্টেম্বরে জন মারা যায়। কয়েনটা নিলামে ওঠে। নিলামে সেটার দাম ওঠে ২ লক্ষ ৪ হাজার ডলার। এর আগে ২০১০ সালে এমনই একটা কয়েনের নিলাম হয়েছিল। দাম উঠেছিল ১ লক্ষ ৭০ হাজার ডলার। অন্য ভাইরা বলল, তুই এসব ফালতু তামার কয়েন নিয়েই থাক। আমরা দেখি আরও দামি জিনিস পাওয়া যায় কিনা। যে তামার কয়েন পেয়েছিল, সে সেগুলো ট্রাক বোঝাই করে বাড়ি ফিরে গেল।

বাদবাকি তিন ভাই এগিয়ে চলল। বেশ কিছুটা হাঁটার পর আরেকজনের টর্চের ব্যাটারি ফুরিয়ে গেল। সে সেখানে পেল রূপোর গয়না আর কয়েনের অঢেল স্টক। প্রবাসী একজন নাগরিক মাটির তলায় লুকিয়ে রেখেছিল। এরপর লোকটা  সেখান থেকে রূপো বের করে নিয়ে যেতো কিন্তু কাউকে সেকথা বলেনি। এ বিষয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে ৯৮ সালে মারা গিয়েছিল সে। দ্বিতীয় ভাই বলল, ভালই হল রে, চল রূপোর কয়েন গয়না আর বাসনকোসন ট্রাকে লোড করে দেশে ফিরি। অন্য দুই ভাই বলল, দূর বোকা, তোর যাবার হয় যা, আমরা আরও বেশি মালকড়ির জন্য এগোচ্ছি। দ্বিতীয় ভাই একাই ফিরে গেল গোটাকতক ট্রাকে লোড করে।

আরও কিছুটা যাবার পর তৃতীয় ভাইয়ের টর্চের ব্যাটারি ফুরিয়ে গেল। সে জায়গাটা খোঁড়াখুঁড়ি করে পেল হাতে গড়া সোনার অজস্র কয়েন আর বিম্বিসারের সময়েরঅলংকার। চতুর্থ ভাইকে সে বলল, চল, আর কি, এ-জিনিস তো মালামাল করে দেবে আমাদের, নেতাগিরিতে ফেল মারলেও ক্ষতি নেই। চার নম্বর ভাই বলল, তুই ফিরে যা, এরকম এক-এক করে পাচ্ছি যখন, তার মানে আরও দামি-দামি হীরে-জহরত ঘয়নাগাটি পাবো। তৃতীয় ভাই ফিরে গেল ট্রাক লোড করে।

চার নম্বর ভাই একলা এগিয়ে চলল টর্চ হাতে। অনেক দূর চলে গেল। টর্চ নেভার নাম নেই। শেষে টর্চ যখন নিভু-নিভু, দেখতে পেল বিটকেল চেহারার একজন লোক তার সামনে পথ আটকে দাঁড়িয়ে। লোকটার মাথার ওপর একটা নীল রঙের চাকা, যাতে স্পোক রয়েছে, আর তা লোকটার মাথার ওপর বাঁই-বাঁই করে আপনা থেকে ঘুরছে । চতুর্থ ভাই অবাক। জিগ্যেস করল, মশাই আপনি কে? আপনার মাথার ওপর আপনা থেকে ঘুরছে ওটা কী? চার নম্বর ভাইয়ের প্রশ্ন শেষ হবার আগেই লোকটার মাথা থেকে চাকাটা ছুটে এসে ওর মাথার ওপর বনবন করে ঘুরতে লাগল।

মাথার ওপর অসহ্য চাপ বরদাস্ত করতে না পেরে আর্তনাদ করে উঠল চার নম্বর ভাই, ওরেব্বাপ, এতো ভিষণ ভারি,মাথা ফেটে যাচ্ছে ব্যথায়, গা গুলোচ্ছে, সইতে পারছি না।

লোকটা বলল, আমার কিছু করার নেই, তোমার আদর্শবাদী সর্বনাশ তুমি নিজেই ডেকে এনেছ। আমিও এককালে তোমার মতন টর্চ হাতে আদর্শের নেশায় এখান অব্দি এসেছিলুম।সিস্টেমকে পালটে দেবার বিপ্লব    করব ভেবেছিলুম। দলে যারা ছিল সবাই পালিয়ে গেল আমায় একা ফেলে ।  এবার বাঁচা গেল। আমার জায়গাটা তুমি পেলে। এখন মাথার ওপর ওই চক্র নিয়ে বিপ্লব করো। যদ্দিন না কোনো রাজনৈতিক আদর্শবাদী এসে তোমার কাছ থেকে চক্রটা নিজের মাথায় তুলে নিচ্ছে, তদ্দিন ওখানে দাঁড়িয়ে দুঃখকষ্ট জ্বালা যন্ত্রণা আত্মগ্লানি ভোগ করো। আমি চললুম, টা-টা, বাই-বাই।

গল্প শেষ হতে চারিদিক থেকে ঝিঁঝিপোকাদের সুরেলা বিপ্লবী গান ভেসে আসতে লাগল,
চান্দের বাত্তির কসম দিয়া ভালবাসিলি
সুর্যের আলোয় ঝলমলাইয়া আমায় পোড়াইলি
চান্দের বাত্তির কসম দিয়া ভালবাসিলি
সুর্যের আলোয় ঝলমলাইয়া আমায় পোড়াইলি
এখন তো চান্দেও চিনে না
আমারে সূর্যেও চিনে না
চিনবো কেমনে যে চিনাইব
সেও তো চিনে না
এখন তো চান্দেও চিনে না
আমারে সূর্যেও চিনে না
চিনবো কেমনে যে চিনাইব সেও তো চিনে না
চান্দের বাত্তির কসম দিয়া ভালবাসিলি
সুর্যের আলোয় ঝলমলাইয়া আমায় পোড়াইলি

দশ

ঘুমিয়ে পড়ল কুশাশ্ব। পরের দিন রোদ যখন রোদাতে-রোদাতে ওর গায়ে এসে ছিস করে ঠেকল, তখন ওর ঘুম ভাঙল। উঠে বসল। এদিক-ওদিক চেয়ে দেখল। লাফিং বুঢঢা আবার কোথায় গেল। ও-ও কি হাগতে বেরোল গোপালের মতন? ধাতু বা চিনামাটির স্হায়ীত্বের মল বলে কথা, এঁটে এঁটেল হয়ে গিয়ে থাকবে। কিন্তু রাস্তার দুপাশ তো ফাঁকা। খেতগুলোয় কোথাও আড়াল করার মতন ঝোপজঙ্গল নেই। হঠাৎ নজর গেল পায়ের কাছে পড়ে থাকা চারটে পেনসিল টর্চ ব্যাটারির দিকে। তুলে দেখে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে তৈরি চারটে বিভিন্ন কোম্পানির ব্যাটারি, এক্সপায়ার করার আগেই  তলার দিকটা সবকটার গলে গেছে।

জুতো-চটি কিছু নেই পায়ে কুশাশ্বর। কার্তিক মাস হলে কী হবে, চলার পথ তেতে গেছে এর মধ্যে। কয়েক-পা হাঁটল কুশাশ্ব। বেশ গরম। হাঁটা মুশকিল। কী করা যায়! খিদেও পাচ্ছে। সড়কের পাশ দিয়ে ধুলোর ওপর হেঁটে এগোল যতটা পারা যায় । বহুদূর থেকে কিছু আসছে দেখে দাঁড়িয়ে থাকল। কাছাকাছি হলে টের পেল, দশ-বারোটা উট নিয়ে এদিকেই আসছে একটা লোক, পরনে নোংরাটে মেটরঙা ধুতি আর কোঁচদেয়া হাফ-পাঞ্জাবি, মাথায় হলদে রঙের পাকানো কাপড়ের পাগড়ি। 

কুশাশ্ব জানে, যারা খাজুরাহো দেখতে আসতো তারা আলোচনা করতো যে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় উটের মেলা হয় রাজস্থানের পুষ্করে। শুধু মাত্র এই মেলা দেখার জন্য প্রচুর দেশি-বিদেশি পর্যটক আসেন। কার্তিক পূর্ণিমার আগে সাত দিন ধরে চলে এই মেলা। শেষ হয় পূর্ণিমার দিন। জগৎপিতা ব্রহ্মার মন্দিরে পুজো দিয়ে ঘরে ফেরে সকলে। কথিত আছে, কার্তিক পূর্ণিমায় হিন্দু দেবদেবীরা পুষ্কর হ্রদে নেমে আসেন। বিশ্বাস, এই পুণ্য সময়ে হ্রদের জলে স্নান করলে কঠিন অসুখ সেরে যায়, পাপ ধুয়ে যায়। এই মেলায় রাজস্থানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উট নিয়ে আসেন বিক্রেতারা। বিস্তৃত মেলা প্রাঙ্গণ ভরে থাকে হাজার হাজার উটে। অনেকে উটকে সাজান সুন্দর করে। কেনাবেচা হয় গরু-ঘোড়াও। মেলার সময়ে রাজস্থান টুরিজ়ম ব্যবস্থা করে বিলাসবহুল তাঁবুর। পুষ্কর ছাড়াও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে হয় নাগৌর মেলা। জোধপুর থেকে বিকানীর যাওয়ার পথে নাগৌর। দশ লক্ষের উপরে পশু বিক্রেতার জমায়েত হয় এখানে! একই সময়ে ডিপার্টমেন্ট অব টুরিজ়ম আর্ট অ্যান্ড ক্রাফ্ট আয়োজন করে বিকানীর উট মেলার। এখানে উটের দৌড়, উটের নাচ, অ্যাক্রোব্যাটের আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া উটের গায়ের লোম ছেঁটে করা ট্যাটু দেখলে অবাক হতে হয়। এই তিনটে মেলাতেই মনোরঞ্জনের জন্য থাকে নানা ধরনের প্রতিযোগিতা, নাচ-গান।

উটগুলোকে আর লোকটাকে হাত দেখিয়ে থামাল কুশাশ্ব। জিগ্যেস করল, আচ্ছা আপনি কি একজন টাকমাথা গালফোলা ভুঁড়িদাস বেঁটেমতন ফর্সা লোককে দেখেছেন?

উটমালিক এমনভাবে মাথা নাড়ল যে বোঝা গেল না হ্যাঁ বলছে, না, না বলছে।

বছর কুড়ির একটা অতিবৃদ্ধা উট যার পিঠে দুটো কুঁজ, বলল, বাবু, আমাদের এখানে সবাই পাগড়ি পরে, কারোর টাক দেখার উপায় নেই, পাগড়ি হল টাকের অন্তর্বাস।

উদ্বিগ্ন কুশাশ্ব জিগ্যেস করল, সিস্টেমের দপতর শহরটা কোন দিকে বলতে পারেন? আঙুল তুলে বলল, ওই দিকে যাবো, না, এদিকটায়?

উটমালিক এমনভাবে মাথা নাড়ল যার মানে জানে না হতে পারে, আবার জানেও হতে পারে।

দুকুঁজো উট বলল, বাবু আমি সিস্টেমের দপতর শহরটা জানি না, কিন্তু দপতর শহরের দেশটা জানি। একবার আমায় চুরি করে ওই দেশে তাড়িপার করাতে নিয়ে গিয়েছিল।

—-তাড়িপার?

—-হ্যাঁ বাবু, আমাদের তাড়িয়ে-তাড়িয়ে ওই পারে পাঠাচ্ছিল, ওই পারের লোকেরা পরবের দিন খাবে বলে। যেমনভাবে গোরুগুলোকে পাচার করে । রাজস্থান, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ এবং পশ্চিম উত্তর প্রদেশই বাংলাদেশে পাচার হওয়া গরুর প্রধান উৎস। অসুস্থ, সন্তান ধারনে অক্ষম আর বলদ প্রজাতির গরুর চাহিদাই  সবথেকে বেশি। ভিনরাজ্যের  হাট থেকে সেই গরু কিনত বাংলা আর বিহারের ক্রেতারা। বাংলায় সেই গরু পাচারের এপিসেন্টার হয়ে উঠেছিল বীরভূমের ইলামবাজার। সেখান থেকে ‘গ্রিন করিডর’ ধরে লরি বোঝাই গরু নিয়ে যাওয়া হয় মালদা ও মুর্শিদাবাদের সীমান্তবর্তী খাটালে। এরপর অপেক্ষা। গরু-ভর্তি ট্রাকের ড্রাইভারকে একটা টোকেন দেয়া হতো। সেই টোকেন থাকলে রাস্তায় পুলিশ সেই ট্রাক ধরতো না ।  সেই ট্রাক পাচারকারীর অফিসে পৌঁছানোর পর মুর্শিদাবাদে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হতো। বিশেষ করে যেখানে নদীই দুই দেশের সীমান্ত সেখান দিয়ে গরু পাচার হতো। মূলত বিএসএফের ৩৬ নম্বর ব্যাটেলিয়ানের অধীনে থাকা নিমতিতা, খান্ডুয়া, গিরিয়া সীমান্ত চৌকির মতো বিভিন্ন এলাকা দিয়ে স্থানীয় রাখালরা গরুপাচার করত বাংলাদেশে। রাত এগারোটা থেকে তিনটের মধ্যে গরু যেত বাংলাদেশে। আমরা খুব জোর বেঁচে গেছি ।  গোপনে খবর পেয়ে পুলিসে আমাদের আর সেই সঙ্গে আরও সাতজন উটকুমারীকে বর্ডারের ব্রথেল থেকে উদ্ধার করেছিল।

—-উটের মাংস খাওয়া যায় নাকি? ও তো ছিবড়ে হবে।

—-না বাবু, উটের মাংস সুস্বাদু আর নরম। উটের দুধও কনডেন্সড মিল্কের মতন। শাস্ত্রে আছে, মরুভূমিতে একদল অসুস্হ লোক উটের  দুধ আর পেচ্ছাপ পান করেছিল আর তাতে তাদের রোগ সেরে গিয়েছিল । উটের মাংসের প্রথম উল্লেখ বাইবেলে পাবেন।  উটের মাংস বহু শতাব্দী ধরে ঐতিহ্যবাহী যাযাবর রান্নার প্রধান ভিত্তি। যাযাবর উপজাতিরা অনেককাল ভাঁড়ারে রেখে  পণ্য হিসাবে ব্যবহার করতে পারত আর অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে উটের মাংস বিনিময় করত। এভাবেই সারা বিশ্বে উটের মাংস জনপ্রিয় হয়েছিল।প্রাচীন রোম আর পারস্য দেশে উটের মাংসকে একটা স্বাদযুক্ত খাবার হিসাবে বিবেচনা করা হত। মঙ্গোলিয়ায়, উটের মাংস থেকে মূল্যবান ফ্যাট তৈরি হয়। উটের মাংস উত্তর আফ্রিকা, মধ্য প্রাচ্য আর মধ্য এশিয়ায় রোজ খাওয়া হয় ।


—-উটের দুধ খাওয়া যায়?

—শুধু দুধ কেন ! কুমারী উটের পেচ্ছাপ বোতলে ভরে বিক্রি হয় মরুভূমির দেশগুলোতে।

—উটের দুধই খাওয়াও তাহলে । বড্ডো খিদে পেয়েছে গো ।

—-হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি ওই সোমথ্থ উটনির থনে মুখ লাগিয়ে দেখুন না। গোরুর দুধের উপকারিতা সম্পর্কে আমরা সকলে জানলেও উটের দুধ তেমন প্রচারের আলো পায় না। মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া উটের দুধের উপকারিতাও সকলের অজানা। মরুভূমিতে বসবাসকারী লোকেদের জন্য এই উটের দুধই পুষ্টির জোগানের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। আজকাল উটের দুধওপ্রক্রিয়াকরণ করে নানান দেশে রফতানি করা হচ্ছে। এমনকি অনলাইনে উটের দুধের গুঁড়ো বা ফ্রোজেন দুধও পাওয়া যাচ্ছে। হালুইকররা উটের দুধের রসগোল্লা বানাচ্ছে ।

মুখ টিপে হেসে সোমথ্থ উটনি বলল, ধ্যাৎ, আমার লজ্জা করে। বাবু আপনি চোখ বুজে খাবেন, আমার মুখের দিকে তাকাবেন না। লোকখিটি।

ছুটে গিয়ে ঠোঁটব্যাকুল বাঁট মুখে পুরে চুষতে-চুষতে পাথরজীবনের কথা মনে পড়ে যাওয়ায়, যেন ঠোঁট চুষছে, পেট ভরে দুধ খেল কুশাশ্ব। কখন কোথায় খাবার-দাবার পাওয়া যাবে তার ঠিক নেই।

ঢেঁকুর তুলে উটমালিককে কুশাশ্ব বলল, আমার পায়ে জুতো নেই, আমি কি কোনো উটের পিঠে বসতে পারি? পথে যে গঞ্জ হাট শহর গ্রাম স্টেশান খেয়াঘাট বা বাস ডিপো পড়বে সেখানে নামিয়ে দেবেন।

উটমালিক এমনভাবে মাথা নাড়ল যার মানে হ্যাঁ-ও হয়, আবার না-ও হয়।

দু-কুঁজো উট মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে বলল, বাবু আসুন, আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে জুতোর দোকান আছে। আপনি সেখান থেকে নানা জায়গায় যাবার গাড়ি পাবেন।

দুটো কুঁজের মাঝখানে বসে, সামনের কুঁজ আঁকড়ে ধরে, ধন্যবাদ জানাতে, দু-কুঁজো জিগ্যেস করল, বানুর কী করা হয়?

কুশাশ্ব: প্রেম করি।

দু-কুঁজো: প্রেম…

কুশাশ্ব: হ্যাঁ, অষ্টপ্রহর প্রেম।

দু-কুঁজো: এখন কী প্রেম করতেই যাচ্ছেন?

কুশাশ্ব: না, অমন প্ল্যান করে প্রেম হয় না, হঠাৎ-হঠাৎ হয়ে যায়..

দু-কুঁজো: আমরা তো দিনকতকের জন্যে হিটে আসি, তখনই প্রেম করি। প্রেমের ঋতু হয়।

কুশাশ্ব: আমার প্রতিদিনের প্রতিমুহূর্তে প্রেমের ঋতু।

উটের কাফিলা পৌঁছোল এক গঞ্জ-শহরে। জুতোর দোকান দেখতে পেয়ে নেমে পড়ল কুশাশ্ব। একজোড়া নাগরা জুতো কিনল, শুঁড়তোলা। তারপর, নানা লোককে জিগ্যেস করেও যখন দফতর শহরের হদিশ পেল না, তখন দাঁড়াল গিয়ে ডিপোর ছাউনিতে। লাফিং বুঢঢার ফরমুলা অনুযায়ী যে-দিকটা পা পিছলে আলুর দম হল তার উল্টো দিকে যাবার গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

এগারো

ট্রাক আসে , যায়। বাস আসে, যায়। অটো আসে যায়।ট্যাক্সি আসে, যায়।টেম্পো আসে, যায়। রিকশা আসে, যায়। টাঙ্গা আসে, যায়। সবই পা পিছলে আলুর দমের দিকে। একবার কুশাশ্বর মনে হল, চলে যাই শালা আলুর দমের দিকেই। পরক্ষণেই মনে হল, বিজ্ঞানের নির্দেশিকা অমান্য করা অমানুষের কাজ।

একজন রোগা ডিগডিগে লোক এসে দাঁড়াল কুশাশ্বর পাশে। সাড়ে-পাঁচ ফিট লম্বা হবে।শাদা ফুল শার্ট কালো প্যান্ট। এত রোগা যে মনে হচ্ছিল লোকটার চেহারার শুধু দুটো ডাইমেনশান। সামনে আর পেছন। ঠিক যেন তালপাতার সেপাই। পুতুলনাচের পুতুলের মত অঙ্গভঙ্গী। মাইকেল জ্যাকসন বা প্রভু দেবা নাচের সময় যে-ভাবে হাত-পা নাড়ায়। কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল। এর কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যাবে ভেবে আলাপ শুরু করতে চাইল কুশাশ্ব।

—-আপনি কোথায় যাবেন?

—-আপনার তাতে দরকার?

—-না, মানে, আমি দফতর শহরে যাবো তো, তাই।

—-তা যান না, কে বারণ করেছে?

—-আসলে কেউ বলতে পারছে না।

—-আমি তাতে কী করব?

—-আপনি যদি একটু বলেন।

—-জানলে তো বলব।

—-এরকম রুষ্ট হচ্ছেন কেন?

—-আপনি বিরক্ত করছেন বলে।

—-আমি কিন্তু একজন প্রেমিক। আমার নাম কুশাশ্ব দেবনাথ। গুপ্তহাসি হেসে ও বলল।

—-আমার নাম গিলগামেশ। আমি দুই-তৃতীয়াংশ দৈব আর এক তৃতীয়াংশ নশ্বর। ইচ্ছেমতন ছোট-বড় হই।

কথাটা শুনে কুশাশ্ব স্তম্ভিত। লোকটা তো ওর চেয়েও দেড় হাজার বছর আগের। কিন্তু এই কি গিলগামেশের চেহারা, যে কিনা খালি হাতে সিংহ মেরে বগলদাবা করে নিয়ে যেত। সারাজীবন বেঁচে থাকার জন্যে কত কত কত অ্যাডভেঞ্চার করেছে গিলগামেশ; ম্যাজিক-ছোঁয়ানো লতাপাতা খুঁজে বের করেছিল, অমর হয়েছিল, অনেক টাকাকড়ি করেছিল। অথচ গিলগামেশ আসলে কাগুজে ল্যাংপ্যাঙে টিংটিঙে, দু-অবিনশ্বর ফুরিয়ে এর অবিনশ্বরে ঠেকেছে।

—গিলগামেশ ? মহাকাব্যের গিলগামেশ ?  গিলাগামেশ মহাকাব্যের প্রধান চরিত্র ? মেসোপটেমীয় পুরাণ অনুযায়ী  সুমের, আক্কাদীয়, আসিরিয়া আর ব্যাবিলনিয়ার লোকে বড়াই করে আপনাকে নিয়ে । সেই গিলগামেশ ?  সুমেররা আমাদের মতন বহু দেবতাবাদী ধর্মের অনুসারি ছিল। তারা প্রাণী বা বস্তুতে নরত্ব আরোপ করে ঈশ্বর বা ঈশ্বরীর প্রতিরূপ সৃষ্টি করতো যারা শক্তি বা বিশ্বের উপস্থিতি নির্দেশ করতো। ভাবতে পারছি না যে আমি গিলগামেশের পাশে দাঁড়িয়ে আছি । আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সালে রচিত এই অসম্পূর্ণ মহাকাব্য কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা হয়েছিল। সম্রাট আসুরবানিপলের গ্রন্থগারে সংরক্ষিত কাব্যটির মোট চরণ সংখ্যা ৩ হাজার। জনশ্রুতি আছে আছে আপনি ছিলেন উরুক রাজ্যের রাজা। এই কাব্যে আপনার দুঃসাহসিক স্বর্গাভিযানের কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে।

—ইউ আর কারেক্ট । আমিই সেই গিলগামেশ ।

—-আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভাল লাগল। আপনার অ্যাডভেঞ্চারের কথা অনেক শুনেছি। গিলগামেশকে প্রীত করার জন্যে ঠৌঁট টিপে হেসে বলল কুশাশ্ব।

মনে হল তেল লাগানোটা কাজে দিয়েছে। দাঁতখিঁচুনির বদলে দেঁতো হাসি হেসে গিলগামেশ বলল, সিস্টেমের দপতর শহরে আমারও কাজ আছে, সেখানেই যাব, কিন্তু কিসে চেপে কী ভাবে যাব জানি না।

—আপনাকে কি পচাঞ্জন সরদার যেতে বলেছে? নৈকট্যকে নিকটতর করার চেষ্টা করল কুশাশ্ব।

—হ্যাঁ, আপনি কী করে জানলেন? সিংহ-মারা তেজ বাদ দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল গিলগামেশ।

—আমাকেও হুকুম করেছে। আপনার সঙ্গেও কি তুই-তোকারি করেছে?

—হ্যাঁ, ওনারা দলতন্ত্রের অধিকার প্রয়োগ করছেন। অপহসিত হাসি হেসে বলল গিলগামেশ। জানেন তো   যখন থেকে  ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তখন থেকেই বিভিন্ন প্রকল্পে বিপুল অঙ্কের টাকা আসতে শুরু করেছে। একেকটা প্রকল্পের জন্য কয়েকশো কোটি টাকাও আসে, আর প্রকল্পের সংখ্যাও কম নয় । বরাদ্দকৃত এই বিপুল অর্থে যে দুর্নীতি হচ্ছে, সেটা প্রধানমন্ত্রী  দেখিয়েছিলেন । তিনি হিসাব দিয়ে বলেছিলেন কেন্দ্র একটা প্রকল্পে যত অর্থ বরাদ্দ করে, তার ৮০ শতাংশ আর শেষ মানুষটি পর্যন্ত পৌঁছয়ই না।  পঞ্চায়েত স্তরে দুর্নীতি বহুকাল থেকেই হয়ে আসছে। আগেও পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেতার জন্য হিংসার আশ্রয় নিত সিস্টেম। পঞ্চায়েতের দুর্নীতিতে প্রতিটা রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরাই জড়িত , কেউ কম কেউ বেশি । কোনও দল বলতে পারবে না যে তাদের সিস্টেমের সদস্যরা দুর্নীতি করেন না। 

অবাক হল কুশাশ্ব। গিলগামেশ বলে কথা। যে কিনা খালি হাতে সিংহ মারে। তার সঙ্গেও তুইতোকারি। কত ক্ষমতা সিস্টেমের অছিসিংহাসনের, বাপরে বাপ, ওই ক্ষমতার জোরে কালো-কেল্টে পচাঞ্জন সরদার নামে ঘুরঘুরে পোকাও রোয়াব ঝাড়ছে। আসলে টাকার জোর । একেক জন গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য তার পাঁচ বছরের মেয়াদে অন্তত ৫০ লক্ষ টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে রোজগার করে , এবং এটা শুধুমাত্র সরকারি প্রকল্পগুলোর টাকা গ্রামের মানুষকে পাইয়ে দেওয়ার বদলে। এর বাইরে তো রাস্তা তৈরি বা অন্যান্য কাজের বরাদ্দ যারা পায়, সেইসব ঠিকাদারদের কাছ থেকেও টাকা তোলে পঞ্চায়েত সদস্যরা। অথচ তাদের সরকারী বেতন মাত্র হাজার তিনেক টাকা, তো এই বিপুল অর্থের হাতছানি যেখানে, সেখানে খুনোখুনি-মারামারির আশ্রয় তো নেবেই। আবার পঞ্চায়েত সদস্যদের নিজস্ব বাহিনীও থাকে। এরা ভোটের সময়ে তাদের ‘দাদা’র হয়ে কাজ করে আর বছরভর নানা সিণ্ডিকেট ব্যবসা ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত থাকে। কংগ্রেস আমল বা বামফ্রন্ট আমলেও এই বাহিনী ছিল। তাদের কখনও বাস-মিনিবাসে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে রোজগারের পথ করে দেওয়া হয়েছিল, কখনও রিকশা-অটোরিকশার পারমিট করিয়ে দিয়ে আয়ের পথ করে দেওয়া হয়েছে, আর এখন নির্মাণ সিণ্ডিকেটের মতো আইন বহির্ভূত, সমান্তরাল অর্থনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হয়। বিনিময়ে ভোটের সময়ে হুমকি-লেঠেলবাজি আর সন্ত্রাস করানো হয় এই লুম্পেন বাহিনীকে দিয়েই।

কুশাশ্ব নিজের ফরমুলা শুনিয়ে কোনদিকে যেতে হবে সে-বিষয়ে মতামত জানাল। গিলগামেশ বলল, ও-ও ওই দিকটাই নিজের বৈজ্ঞানিক ফরমুলা প্রয়োগ করে বাছাই করেছে, যেটা ও সিংহ শিকারের আগে পরীক্ষা করে নিত। ফরমুলাটা হল, ‘গোদা নাটাটা পা ফাটাটা অড়ল বনের ধারে, কুচুৎ করে কানটি কেটে নুনের ভাঁড়ে পোরে।’ আলুর দম আর ভাঁড়ে পোরা একই দিক নির্দেশ করছিল। সেদিকে যাবার একটা জিপ-ট্যাক্সি এসে থামল, প্যাসেঞ্জারে এমন গাদাগাদি যে কার মুখ কোথায় আর ঠ্যাঙ কোথায় টের পাবার উপায় নেই।

ওরা দুজনে পেছন থেকে ডাইভ দেবার ঢঙে গোঁতা মেরে জোরজবরদস্তি ঢুকল জিপ-ট্যাক্সির ভেতরের ঠাসাঠাসি ভিড়ে। হাফশয়নম-হাফপতিতম অবস্হা । ধাতস্হ হতে টের পেল, এটা মহিলাদের স্পেশাল ট্যাক্সি। ততক্ষণে কিল-চড়-থাপ্পড়-ঘুষি-লাথি আরম্ভ হয়ে গেছে। গিলগামেশ কানেকানে কুশাশ্বকে বলল, দেবনাথবাবু, যেতে তো হবেই, দপতরের হুকুমের টালাবাহানা করার যে কি বিপদ তা তো জানেন। তাই বলে মহিলাদের হাতে প্যাঁদানি খেলে ইতিহাস আমায় আস্ত রাখবে না; আমার খালি হাতে সিংহ মারার খ্যাতি সব জলে যাবে। এমনিতেই ইতিহাসকাররা আমাকে কুরে-কুরে গবেষণা করে এরকম রোগাপাৎলা করে দিয়েছেন।

বারো

জুতো খুলে, গিলগামেশের কব্জি শক্ত করে ধরে কুশাশ্ব পরামর্শ দিল, আমি এক দুই তিন গুনছি। তিনের মাথায় একসঙ্গে ছোট্ট হয়ে যাবো দুজনে। ওকে? রেডি, এক…দুই…তিন ।

নিমেষে ছোট্ট হয়েই, খোলা স্প্রিঙের মতন বিঘত খানেক লাফিয়ে এক যুবতীর দুই স্তনের মাঝখানে দুজনে হাত ধরাধরি করে পিছলে পড়ল। কাতুকুতু হেসে যুবতীটি পাশের মেয়েটিকে বলল, অ্যাই, ভালো হবে না বলছি। পাশের মেয়েটা বলল, ওমা, আমি আবার কী করেছি!

স্প্যাঘেটি-স্ট্র্যাপ টপের ভেতরে পড়ে দুজনে পিছলে নেমে আটকে গিয়েছিল পুশ-আপ ব্রাতে। টপের কাপড় ধরে ঝুলতে-ঝুলতে ওরা উঠে বাঁধুনি আঁকড়ে শুনতে লাগল যুবতীদের কথাবার্তা। দেখতেও পাচ্ছিল যুবতীদের, উঁকি দিয়ে। বোধহয় স্নাতকোত্তর ছাত্রী। কিংবা মডেল-মেয়ের দল চলেছে কোনো হোটেলে র‌্যাম্পের ওপর বিল্লিহাঁটন দিতে।

—-জলজ্যান্ত দু-দুটো মরদ, বেমালুম উবে গেল যে রে। বলল, হল্টারনেক।

—-এরা দুজনে মিলে কিলোচ্ছিল-লাথাচ্ছিল। অভিযুগ তুলল সি-থ্রু আকাশি ব্লাউজ।

—-কিলোব না তো কি! লেডিজ স্পেশালে ঢুকবে আর পার পেয়ে যাবে! আবদার নাকি? বলল বাদামি ডাংগারি।

—-কারেক্ট। পিটিয়েছি, ঠিক করেছি। বিকটহাসি হেসে বলল জরিরকাজ শিফনশাড়ি।

—-দ্যাখ, তোরা দুজনে লেসবিয়ান-সতীত্ব ফলাসনি। বলল স্প্যাঘেটি-স্ট্র্যাপ। বুক দোল খাওয়ায় কুশাশ্বর হাত আরেকটু হলেই ফস্কে যাচ্ছিল।

—-ভালো বলেছিস, লেসবিয়ান-সতীত্ব! বাঁকা হাসি হেসে বলল প্লেনটপ সোয়ারস্কি জিনস।

—-সঁতীত্বেঁর শ্বেঁতপদ্ম। সামীচন্দ্র লীলাবতী। বলল ব্যাকলেস-চোলি।

—-সত্যি! দু-দুজন জোয়ান, দুরকম টাইপের জোয়ান, হাতছাড়া হয়ে গেল। একটু ফস্টামি-নষ্টামি তো করা যেত রাস্তার বোরডাম কাটাতে। একগাল হেসে বলল ডিপ-নেক অরগ্যান্ডি।

খুব জোর বেঁচেছি, বলল গিলগামেশ। তারপর যোগ করল, আমি যতরকম অ্যাডভেঞ্চার সম্ভব করেছি কিন্তু কখনও নারীগর্ভে ঢুকে অ্যাডভেঞ্চার করিনি। দেবনাথবাবু, এক কাজ করুন। দুজনে এক-একজন লেসবিয়ান সতীর গর্ভে ঢুকি। কী বলেন?

মনের মতন প্রস্তাব পেল কুশাশ্ব। বলল, আপনি ওই জরিরকাজ শিফনশাড়িতে আশ্রয় নিন। আমি যাচ্ছি বাদামি ডাংগারির ভেতরে। দুজনের একজন অন্তত তো যাবে দফতর শহরের দিকে।

চিলতে কাগজের মতন নিজেকে গুটিয়ে গিলগামেশ চলে গেল নিজের বাছাই করা সলোমান মাইন্সে অ্যাডভেঞ্চার করতে। পায়ের ধুলো ঝেড়ে, গুটিপোকার কায়দায় তিড়িকিনাচন দিয়ে কয়েক লাফে কুশাশ্ব পোঁছোল তীর্থক্ষেত্রের দরজায়।

খিলখিল হেসে জরিরকাজ শিফনশাড়ি বাদামি ডাংগারিকে: অ্যাই স্যাবি, করছিস কি?

দেয়ালা হাসি হেসে বাদামি ডাংগারি জরিরকাজ শিফনশাড়িকে: আমি আবার কী করলুম? আমি তো ভাবছিলুম তুই বুঝি আমাকে কিছু করছিস।

রগড়হাসি হেসে ব্যাকলেস চোলি: সাবিত্রী শীল আর কুন্তি সাহা, তোরা দুজনে কি সকাল থেকেই স্ম্যাক নিস? মডেলিঙের লাইনটাকে বদনাম করে দিলি তোরা।

প্যারাসাইট হিসাবে অনুপ্রবেশ শুরু করে দিয়েছিল কুশাশ্ব, তাই যুবতীদের পরবর্তী শ্লেষবচন কথাবার্তা, ঝগড়ারঙ্গ, খুচরো ছেকোক্তি, কেলিমুখ খেয়োখেয়ি আর কানে গেল না। তবে স্যাবি নামটা ওর ভালো লাগল। মিষ্টি।

ভেতরটা, ঢুকেই, স্নিগ্ধ ভিন্নাঞ্জনপ্রভায় আলোকিত দুটো রাস্তা দুদিকে চলে গেছে। আইকম বাইকম ফরমুলা প্রয়োগ করে নির্ণয় নিল কুশাশ্ব। লেসবিয়ান সতীর টানেলও এরকম শ্লেষ্মা-পেছল হবে আশা করেনি। গুটি মেরে-মেরে এগোতে হচ্ছিল। স্যাবি যে বহুক্ষণ পেচ্ছাপ চেপে রেখেছে তা স্ফিংকটারের হালত থেকে টের পাওয়া গেল।

তেষ্টা পেয়েছিল বলে ফলিকিউলের শরবত খেল কুশাশ্ব। ডিম দেখতে পেয়ে সেটাও কপ করে গিলে নিল। ডিমটা টাতকা। ভালই হ।। মাসের শেষে মেয়াদি রক্তপড়া শুরু হচ্ছে না দেখে দৌড়বে ডাক্তারের বাড়ি আর রিপোর্ট পেয়ে আঁৎকে উঠবে।

ঝালরদেয়া পর্দা সরিয়ে জরায়ুঘরে ঢুকল কুশাশ্বল বেশ ওয়েল ফার্নিশড। বোঝা যাচ্ছে গৃহপ্রবেশ হয়নি। ক্লান্ত কুশাশ্ব ওভালরুমের পালঙ্কে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙতে বুঝতে পারল স্যাবি কোথাও এঁকেবেঁকে হাঁটছে, বোধহয়  মডেলিঙের শোতে বিল্লিহাঁটন দিচ্ছে। নিজেকে ফুলিয়ে একটু বড় করল কুশাশ্ব। কান পেতে শোনার চেষ্টা করল বাইরের চেঁচামেচি। ক্ষীণ ভেসে এলো, অনেকে একসঙ্গে জানতে চাইছে, স্যাবি আর ইউ প্রেগন্যান্ট? আর ইউ প্রেগন্যান্ট?

স্যাবি ছুটে কোথাও গিয়ে বসল, অনুমান করতে পারল কুশাশ্ব। কেউ একজন বলল, গো টু টয়লেট, এই নাও, আমার প্রেগন্যান্সি কিট নিয়ে যাও। স্যাবি উঠল। হাঁটছে। স্ফিংকটার ঢিলে করছে। স্যাবির হাসি আর শরীরের হাসি-কাঁপুনি বোঝা যাচ্ছে। কুশাশ্ব আরেকটু ফোলাল নিজেকে। কেউ ওকে বলল, স্যাবি তুই কিছুদিনের জন্যে বাবা-মায়ের কাছ থেকে ঘুরে আয়।

স্যাবি উঠল। বোধহয় কোনো মোটরগাড়িতে বসল। নামল। বিছানায় লাফিয়ে শুল। কাঁদছে। শরীর কাঁপছে। কুশাশ্ব নগণ্য করে ফেলল নিজেকে। কাঁপন থামল। কুশাশ্ব ওভালরুমে অ্যারোবিক্স করল। এত ছোট পরিসর যে ব্যায়াম করে শরীরটা ঠিক রাখতে হবে।

অনেকক্ষণ কেটে গেছে। বা হয়ত কয়েকদিন কেটে গেছে। রাত না দিন বোঝার উপায় নেই। পানভোজন আর ঘুমে টাইমপাস হচ্ছে কুশাশ্বর। স্যাবি বোধহয় অন্য কোথাও চলে এসেছে। ওভালরুমের দেয়ালে কান পাতল কুশাশ্ব। হ্যাঁ। সম্ভবত স্যাবির মা। অভয় দেয়া কন্ঠস্বর। শুনে, নিজেকে একটু বড় করল কুশাশ্ব। আতঙ্কিত চিৎকার চেঁচামেচি শুনে চুপসে নগন্য হয়ে গেল।

ওভালরুম থেকে বেরিয়ে, আস্তে-আস্তে পিছলে, বাইরে মুখ বের করে সাবিত্রী শীলের কন্ঠস্বর স্পষ্টভাবে শুনতে পেল কুশাশ্ব, ‘ডক্টর শাশ্বতী, তাহলে কোনো প্রবলেম ক্লিনিকালি পাননি তো? আমি এবারে কাজে ফিরে যেতে পারি? আমার কালকের ফ্লাইট বুক করা আছে।’

ঠিকই। ডাক্তার দেখাতে এসেছে স্যাবি। কুশাশ্ব টুক করে লাফিয়ে, স্যাবির দুই পায়ের মাঝ দিয়ে হেঁটে পায়ের পাতার কাছে মুখ বের করল। মহিলা ডাক্তার কিছু লিখতে মগ্ন। ঘরে আর কেউ নেই। ও গুটিপোকার তিড়িঙ বিড়িঙ চিড়িঙ  লাফ দিয়ে ডাক্তারের টেবিলে রাখা কাঠের গ্রিক মূর্তিটার পেছনের ফুটো দিয়ে ঢুকে চুপচাপ বসে রইল। শুনতে পেল হাসতে-হাসতে ফিরছে স্যাবি।

তেরো

ঘর অন্ধকার হয়ে গেলে ফুটো দিয়ে বাইরে বেরিয়ে টেবিলে নেমে একটু ছোটাছুটি করে যেই টেবিল থেকে নিচে লাফাবার জন্যে ঝুঁকেছে, কেউ গমগমে কন্ঠে বলল, ‘এখন যাবেন না; বাইরে ডাক্তারের স্বামী আর কমপাউন্ডার বসে টাকা গুনছে। ডিমনিটাইজেশানের পর ওনারা রোজকার টাকা সোনারুপোয় পালটে নেন ।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না কুশাশ্ব। কন্ঠস্বর আবার বলল, ওরা চলে গেলে বলব। ওপরদিকে তাকিয়ে সাউন্ডবক্স বা ক্লোজ সার্কিট টিভি দেখা গেল না। ধন্দে পড়ে টেবিলে পা ঝুলিয়ে বসল অগত্যা।

হঠাৎ কুশাশ্বর মনে হল উটপালিশ-করা কাঠের গ্রিক মূর্তিটা নয়তো, কেননা এর আগে পেতলের গোপাল আর চিনামাটির লাফিং বুঢঢা প্রথম পরিচয়ের সময়ে অমন ছোট মাপের ছিল। টেবিলের ওপর দিয়ে হেঁটে এসে দাঁড়াল কাঠের মূর্তিটার সামনে। সুপুরুষ সুঠাম স্বাস্হ্যবান যুবক, একেবার গ্রিক চোখ-মুখ-নাক। ও যখন পাথরের ছিল তখন গ্রিস থেকে প্রতিবছর লোকজন এসে ওর ফোটো তুলে নিয়ে যেত। ওদের দেশে অনেক মূর্তিটুর্তি থাকলেও আমার দেয়া পোজের মতন মূর্তি ওদের ভাস্কররা কল্পনাতেও আনতে পারেনি। চুমু খাবার কথাই জানত না ওদের দেশের লোকেরা। এদেশ থেকে শিখে তারপর নিজেদের সমাজে শুরু করেছে।

মেহগনি কাঠের মূর্তির ঠোঁট নড়ে উঠল। গমগমে কন্ঠে বলল, আপনি আমাকে চিনবেন না, আমার নাম ওডিসাস, এককালে ইথাকায় অনেক জমিজমা ছিল; পরে, আমি যখন প্রবাসে, তখন সেখানকার দফতরের খুনেরা সেসব জমিজমা খাস ঘোষণা করে হড়পে নিয়েছিল। তবে অনেকে আমাকে ইউলিসিস বলে জানে।

ইউলিসিস? আপনি তো মশাই বিখ্যাত লোক, এক ডাকে সবাই চেনে, বিশেষ করে যারা কাব্যি-টাব্যি করে। আপনি তো আরবদের রাজা গিলগামেশের চেয়ে বেশি অ্যাডভেঞ্চার করেছেন। উত্তেজিত হয়ে বলল কুশাশ্ব। ঈর্ষণীয় ছিল আপনার রাজনৈতিক মাগিবাজি; এদেশের মন্ত্রী-আমলা-ফিল্ম প্রযোজকরাও আপনার মাগিবাজির কাছে নস্যি। তা আপনি হোমারের ইউলিসিস না জেমস জয়েসের ইউলিসিস ?

—না, না । আমি হোমারের ইউলিসিস । জেমস জয়েস ওর প্রেমিকা নোরাকে যেসব অশ্লীল চিঠি লিখেছিল সেগুলো পড়ার পর লোকটার ওপর ভক্তিছেদ্দা চলে গেছে ।

—অশ্লীল চিঠি ? আপনার কাছে একাধটা আছে নাকি ? মুখস্হ থাকলে শোনাতে পারেন । আপনার স্মৃতি তো ঈর্ষণীয় ।

—-একটা চিঠি মনে আছে । কিন্তু শোনাতে পারব না ।

—আপনি আমাদের খাজুরাহোতে আসলে ভালো হতো । এতো জায়গায় হোমার পাঠালো আপনাকে আর আমাদের দেশে পাঠালো না । আপনার   বারোটা জাহাজ ঝড়ের মুখে পড়ে ভেসে গিয়েছিল শুনেছি তারপর আপনার দলের সঙ্গে  পদ্মভুকদের দেখা হয়। পদ্মভুকেরা আপনার লোকজনদের নিজেদের ফল খেতে দেবার পর  তা খেয়ে তারা বাড়ি ফেরার কথা ভুলে যায়। আপনি সবাইকে টেনে হিঁচড়ে  এনে জাহাজে তোলেন। কতো কী যে শুনেছি আপনার বিষয়ে, ভাবা যায় না ।

গিলগামেশের কথা বলছিলেন ? ওনার সঙ্গে পরিচয় হয়নি। উনি বোধহয় ট্রয়-যুদ্ধে আসেননি। আমার তো অনেক স্পাই মোহোল্লা কমিটি, লোকাল কমিটি, জেলা কমিটি, জোনাল কমিটি, রাজ্য কমিটি ইত্যাদি নানা ঘাঁতঘোঁতে ছিল; কিন্তু ওনার খবর কখনও কারোর মুখে পাইনি। কাষ্ঠহাসি হেসে বলল কাঠের ইউলিসিস।

আপনার বাবা সিসিফাসের লাইফলং পাথর ঠেলার ব্যাপারটা শুনে খুব খারাপ লেগেছিল। চৌকো পেপারও্য়েটের ওপর আরাম করে বসে বলল কুশাশ্ব।

আরে সিস্টেম ষড়যন্ত্র করে ওসব গাঁজাখুরি গপপো ছড়িয়েছে। এসব বিরোধী পক্ষের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। আমার বাবা ছিলেন লেরতস আর মা অ্যান্তিক্লিয়া। ক্ষুব্ধ ইউলিসিস বলল।

কুশাশ্ব আর বলল না যে অ্যান্তিক্লিয়াকে ধর্ষণ করেছিল সিসিফাস, তাই সিসিফাসই তো আপনার আসল বাবা, আর আপনি তো হাইব্রিড । হাইব্রিড না হলে কেউ কি আর অমন জগতখ্যাত নায়ক হয়! তার বদলে কুশাশ্ব বলল, ট্রয় থেকে অত যুবতী লুটে নিয়ে গিয়েছিলেন, তো আপনার স্ত্রী পেনিলোপি রাগারাগি করেননি?

সব তো আমি রাখিনি; সিস্টেমের নিয়মতন্ত্র অনুযায়ী বিভিন্ন কমিটির সদস্যদের মধ্যে বিলি-ব্যবস্হা করে দিয়েছিলাম। সবাই তো আর আমার মতন যুদ্ধ করতে চায় না। অনেকে গুমখুন, সুপারি কিলিং, অপহরণ, বাসলুঠ, চাঁদাখেঁচাই, তোলাবাজি, মাস্তানি, গুন্ডামি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতন দিশি আর ছেঁদো কাজকারবার করে, বলল কাঠের মূর্তি।

কুশাশ্ব প্রসঙ্গ বদলে বলল, আচ্ছা পদ্মফুলের ফলফুল খেয়ে কি সত্যিই আপনার ফেলো-ট্র্যাভেলার সঙ্গীদের স্মৃতি লোপাট হয়ে গিয়েছিল? আর তারা নাকি কাজকর্ম করার ইচ্ছে হারিয়ে কেবল পা ঝুলিয়ে-দুলিয়ে সময় কাটাচ্ছিল? যখন পাথরের মানুষ ছিলুম এদেশের লোকেদের আলোচনা থেকে টের পেতুম যে এখানে পদ্মফুলের ফলফুল না খেয়েই নিষ্কর্মা হয়ে থাকতে চায়, তা তাদের আপনি যতই বোনাস দিন, উপরি নিতে দিন, কাটমানি নিতে দিন না কেন, খেলে না জানি কী হবে!

হাঃ হাঃ, মুচকি হাসি হাসল কাঠের মূর্তি, তারপর বলল, তাইতো ওদের ভাগিয়ে নিয়ে গেলুম সাইক্লোপদের দেশে, যেখানে ওদের জোড়ায়-জোড়ায় খেয়ে ফেলছিল পলিফেমাস, যাকে আমি বলেছিলুম যে আমার নাম হল ‘কেউ না’। আপনি আপনার দেশের যাদের কথা বলছেন, তারা মনে হচ্ছে দল বেঁধে ‘কেউ না’ হয়ে গেছে। বেশির ভাগই তো ভাগানো ভাগেড়া নয়তো তাড়িপার।

কী আর করা যাবে! আপনার সঙ্গীরা যেমন এওলাসের দেয়া ঝড়ভর্তি চামড়ার থলের মুখের বাঁধন খুলে লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল, এখানেও তাই। কত রকমের থলের মুখ খুলে কত রকমের যে ঝড়তি-পড়তি মাল হাওয়ায় ছেড়েছে তার ঠিক-ঠিকানা নেই।ঘুষের কোন প্রকার নেই, যে যেভাবে পারছে ঘুষ নিচ্ছে! অফিসের পিওন থেকে শুরু করে, উর্দ্ধতন কর্মকর্তা পর্যন্ত বিভিন্ন রকম আর বিভিন্ন পরিমান ঘুষ দিতে হয়! কাজ বুঝে ঘুষ, চাকরির জন্যে এক রকম, ফাইল নড়ানোর এক রকম, প্রমোশনের জন্যে এক রকম, ট্রান্সফারের জন্যে এক রকম। এমনকি রিক্সা ওয়ালাদেরও মোহোল্লা কমিটিকে ঘুষ দিতে হয় । নৌকো একেবারে টালমাটাল, এই ডোবে কি সেই ডোবে। বলল কুশাশ্ব।

আমরা ঝড়ফড় তোয়াক্কা না করে উত্তাল সমুদ্রে ভেসে পড়েছিলাম। স্মিত হেসে বলল ইউলিসিস।

তা আপনার সঙ্গীরা এইয়াইয়া পৌঁছে সার্সির ছোঁয়ায় যেমন পশুতে পাল্টে গিয়েছিল, এখানেও তাই। সাংস্কৃতিক খোঁয়াড়-আস্তাবল ভরে গেছে মানুষপ্রতিম আজ্ঞাকারী জীবে।খাজুরাহোর মন্দিরে যারা আসতো তাদের কথাবার্তা থেকে টের পেতুম যে আজকাল  সিস্টেমের  বেশির ভাগ মানুষের  কাছে তোষামদি একটা স্বভাব।লোকে একে  চামচামি বলে থাকে। সিস্টেমে এমন কিছু নেতা আছে যারা শুধু  চামচা নিয়ে ঘুরতে ভালোবাসে। আর চামচারাও  ওইসব নেতাদের সুখ দিতে খাটে খায়। সিস্টেমও খুশি হয়। আর সেই খুশির কথা ভেবে রাতদিন শ্রম দেয় চামচারা। খুশি হলেই তো এক কমিটি থেকে দুই কমিটি তিন কমিটি করে করে টঙে পৌঁছোনো। ওসব চামচা বাহিনী মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশেও  সক্রিয় থাকে।  তাদের চিহ্নিত করাও খুব সহজ।  চেয়ার এগিয়ে দেয়া। চা  আনা। নেতার নামে পুরস্কার ঘোষণা কিংবা নেতাকেই পুরস্কার দেয়া।

—-আমায় ওসব গোলমাল অনেককাল পোয়াতে হয়েছে। এটা হলো ছ্যাঁচড়াদের যুগ ।

—-জানি। তারপর তো আপনার একেবারে ভিখিরির মতন ফাটিচার হাল। খিড়কি দরজা দিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। যাকগে। এবার তাহলে আমি চলি। ওনারা টাকার বান্ডিল বানিয়ে নিয়ে এতক্ষণে চলে গেছেন নিশ্চই।

—-আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভাল লাগল। দেখনহাসি হেসে বলল ইউলিসিস।

—-আচ্ছা, আপনি বলতে পারেন কি সিস্টেমের দফতর শহরটা কোথায়?

—-আরে মশাই এটাই তো দফতর শহর। পথে বেরোলে যে কেউ বলে দেবে সিস্টেমের দফতর-পাট কোথায়।

—-ও কে, গুড নাইট, শুভরাত্রি, শব্বা খ্যায়ের।

—-গুড নাইট। আলহামদুলিল্লাহিল্লাজি বিনিয়মাতিহি তাতিম্মুস সালিহাত।

চোদ্দো

জানলার গ্রিল গলে রাস্তায় লাফ মারল কুশাশ্ব। ঘাড় ঘুরিয়ে চারিদিক দেখল। বেশ ফাঁকা। নিজেকে প্রমাণ মাপের মানুষে পাল্টে ফেলে ঝলমলে আলোর দিকে হনহন করে হাঁটা আরম্ভ করল। ব্যাস বিপত্তি।

খনখনে গলায় কেউ বলল, ‘এই গান্ডু, দেখে চলতে পারিস না?’ আরেকজন চিঁ-চিঁ কন্ঠে বলে উঠল, ‘দে বাঞ্চোৎটাকে ধোলাই।’ তৃতীয়জন ঘড়ঘড়ে স্বরে, ‘দুই-চাইরডা লাথি দিয়া ছাইড়া দে’। কুশাশ্ব নিচু হয়ে দেখল উইপোকা; ওই উইপোকাগুলোই ওকে হুমকি দেচ্ছে। চারিদিকে নজর ঘুরিয়ে দেখল, সারাটা পথে হাইব্রিড ইউপোকার জাল বেছানো; এমন যে না মাড়িয়ে এগোনো যাবে না। কুশাশ্ব, ‘ওহ সরি স্যার, ভেরি সরি’ বলতে, চতুর্থ উইপোকা ফ্যাসফেসে গলায় বলল, ‘ঠিক আছে, যাঃ, ফের এ-পাড়ায় ঢুকবি তো তোর বাপের আসবাব আস্ত রাখব না।’ নিজেকে নগণ্যতর করে, যাতে মাড়াতে না হয়, পোঁ পাঁ পিট্টান দিল কুশাশ্ব।

তেমাথায়, যেখানে উইপোকাদের পথদখল শেষ হয়েছে, উঁচু বেদির ওপর একটা ফুটদশেক ভাস্কর্য, কালো রোমশ ব্রোঞ্জ গোরিলার, দু-হাতে বুক চাপড়াচ্ছে। বেদির নামপট্টে হয়ত পথ-নির্দেশিকা থাকবে, ভেবে, পড়ে দেখতে চাইল ও, কুশাশ্ব। লেখা রয়েছে ‘চেনাসুলভ চেনা সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ অবিরাম ঢঙ’। গোরিলাদের উইপোকা খেতে ভাললাগে বটে, কিন্তু তাদের দোরগোড়ায় এমন বিশাল মূর্তি কেন? থ পেল না কুশাশ্ব। নগন্য আর প্রমাণ মাপের মাঝামাঝি করে তুলল নিজেকে।

সিস্টেমের দফতরপাট বা অছিসিংহাসনের পথনির্দেশ খুঁজতে-খুঁজতে এগোচ্ছিল কুশাশ্ব। অলিগলি সুনসান। দেখল একটা ফুলস্পিড ছুটন্ত ভাল্লুকের পিঠে বসে চারটে বেবুন এদিকেই আসছে। ওদের জিগ্যেস করে দেখা যাক। হাত দেখানো সত্বেও থামল না বাদামি ভাল্লুকটা । উল্টে একটা বেবুন ওর মাথায় জোরে চাঁটি কষালো, আর সবকটা খিঁখিঁ-খিঁখিঁ হাসতে-হাসতে উধাও হল।

বাঁ-দিকের রাস্তায় কিছুটা হাঁটার পর গুবরেদের নাইটক্লাব নজরে এলো কুশাশ্বর। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল, জোড়ায়-জোড়ায় নাচছে বা গোবরমদ খাচ্ছে বাঘাগুবরে, লম্বাশিং-গুবরে, মেহিকানগুবরে, সবুজমাটি-গুবরে, গণ্ডারগুবরে, পরাগগুবরে, হার্লেকুইন-গুবরে, ক্লিক-গুবরে, খামার-গুবরে নারী-পুরুষ। দু-দাঁড়া গুবরে দারোয়ানটাকে সিস্টেমের দফতরপাটে যাবার রাস্তা জিগ্যেস করল কুশাশ্ব। জবাব দিল না গম্ভীর গুঁফো দারোয়ান।

এক-জোড়া পরাগগুবরে ছোকরাছুকরি নেচেকুদে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ছোকরাটা বলল, ‘প্রথমে বাঁদিকে যান, তারপর ডানদিকে যান, তারপর সোজা, তারপর ডানদিক, আবার ডানদিক, বুঝলেন তো?’ হাসতে-হাসতে জড়াজড়ি করে গোবরমদে মাতাল দুজনে চলে গেল।

কুশাশ্ব বিমূঢ়। ওরা ঠিক-ঠিক বলল কিনা খটকা লাগল। হয়ত ওকে বিপথগামী করতে চেয়ে অমন পথনির্দেশ দিল ছোকরাটা। আবার না-ও করে থাকতে পারে। ওদের কথামতন না গিয়ে কুশাশ্ব এগোলো পা পিছলে আলুর দম বৈজ্ঞানিক ফরমুলা প্রয়োগ করতে-করতে। ‘আদর্শ ল্যাজকাটা হোটেল’ বোর্ড দেখে ভেতরে ঢুকে একটা ঘর চাইতে রিসেপশানে বসে হাই তুলতে-থাকা যুবতী বেবুন ওকে জেরা শুরু করল।

—-আপনার ল্যাজ যে কাটা তার প্রমাণ আছে?

—-হ্যাঁ। লজ্জার ল্যাজ খেয়ে পেছন ফিরে প্যান্ট নামিয়ে দেখাল কুশাশ্ব।

—-বাইরে থেকে আপনার প্রজাতির মেয়েমানুষ আনা যাবে না। এখানকার রেগুলার বা স্পেশাল স্টক থেকে নিতে হবে। মানবেন তো? নয়ত—

—-মানে?

—-রেগুলারগুলোকে আমরা বাইরে পাঠাই খদ্দের ধরে আনার জন্যে। স্পেশালগুলো সিস্টেমের নেতাদের জন্যে।

—-আমি তো নেতা নই। 

—-নো প্রবলেম। স্পেশালরা আপনাকে নেতৃত্ব শিখিয়ে দেবে। ভেজ না ননভেজ?

—-ননভেজে আজকে কী আছে?

—-ল্যাজযুক্ত সমস্ত স্তন্যপায়ীর থন আছে।

—-রুমটা একটু দেখব।

—-নিজেই চলে-ফিরে দেখে আসুন না। কেবল কারোর কাজে ইন্টারফিয়ার করবেন না। মানবেন তো? নয়ত—

লাউঞ্জে ঢুকে কুশাশ্ব দেখল একটা টেবিল ঘিরে কয়েকটা ল্যাজকাটা হায়েনা ওয়াইনগ্লাসে চুমুক দিয়ে রক্ত-মার্টিনি খাচ্ছে; একটা টেবিল ঘিরে তাস নিয়ে বসেছে ল্যাজহীন ওরাংওটাংরা; ব্যাক-টু-ব্যাক হবার আগে সোফায় হেলান দিয়ে চুমু খাচ্ছে ল্যাজকাটা কুকুর-কুকুরী; একটা টেবিলে ছুরিছোরা রেখে গ্যাঁজাচ্ছে ল্যাজকাটা মেরিনো ভেড়া কারাকুল ভেড়া আর কানঝোলা ভেড়া। জায়গাটা সুবিধের নয় মনে হল কুশাশ্বর। রিসেপশানের বেবুনকে, যে কিনা ঘুমিয়ে পড়েছিল, ‘বড্ডো কনজেসটেড’ বলে বেরিয়ে এলো রাস্তায়।

গায়ে ‘কুইক সাকসেসের গারেন্টি’ লেখা একটা দু-শিং গন্ডার হেলতে-দুলতে যাচ্ছিল। কুশাশ্ব নিজেকে আরেকটু ছোট  করে ফেলে গন্ডারকে বলল, স্যার, রাতটা কি আপনার পিঠে ঘুমিয়ে কাটাতে পারি? দিনের বেলায় তো কতশত পাখি পিঠে নিয়ে আপনি বেড়ান; সকাল হলেই চলে যাব। গন্ডার রাজি হয়ে গেলে, তার পিঠে শুয়ে কুশাশ্ব জিগ্যেস করল, আপনি কি করেন স্যার? গন্ডার বলল, আমি কোচিং-ক্লাসে পড়াই, সারা জগতে আমার শাখা-প্রশাখা আছে।

রোদ উঠে পরের দিন রোদাচ্ছে দিকবিদিক, ঘুমন্ত গন্ডারের পিঠে শুয়ে মহিলা জলহস্তির রাজনৈতিক বক্তৃতার বাজখাঁই শুনে ঘুম ভেঙে গেল কুশাশ্ব দেবনাথের। দেখল, জলহস্তির দুই পাশে বেশ কিছু ব্যাজারমুখো ছোট-ছোট জলহস্তি। মহিলা জলহস্তি হাঁ-মুখ খুলে ঘামতে-ঘামতে বলছে — “মানুষ চাইছে, মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, মানুষ কাঁদছে, মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে, মানুষ হাই তুলতে পারছে না, মানুষ নাক খুঁটতে পারছে না, মানুষ কুলকুচি করতে পারছে না, মানুষ কান চুলকোতে পারছে না, মানুষের গোঁফদাড়ি বেড়ে যাচ্ছে, মানুষের দাঁতে খাবার আটকে যাচ্ছে, মানুষ খোঁপা বাঁধতে পারছে না, মানুষকে এই দিতে হবে, মানুষকে সেই দিতে হবে, মানুষকে অমুক দাও, মানুষকে তমুক দাও………..”

গোরু বাছুর মোষ শেয়াল বেড়াল ভোঁদড় প্যাঙ্গোলিন ছাগল হাঁস মুর্গি কাক শালিখ পায়রা চড়ুই বাদুড় চামচিকে নীলগাই হরিণ বেঁজি ইঁদুর ছুঁচো কচ্ছপ খরগোশ মিলিয়ে ভিড় বাড়তে লাগল। বিরক্ত গন্ডার জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার উদ্দেশ্যে চার ঠ্যাঙ বাড়াতে, কুশাশ্ব প্রমাণ মাপের মানুষ হয়ে গেল। ও-ই একমাত্র অন্যরকম প্রাণী হওয়ায়  পুরো ভিড়টা হঠাৎ ওর দিকে মুখ ফেরালো। ‘মার ব্যাটাকে’ বলতে-বলতে ধেয়ে এলো।

ভয়ে দৌড় লাগাল কুশাশ্ব। ওর পেছনে ভিড়। ও দৌড় লাগায়। ওর পেছনে ভিড়ও দৌড়োয় । দৌড়োতে-দৌড়োতে একটা বিরাট পোড়ো বাড়িতে ঢুকে গেল কুশাশ্ব। বাইরে থেকে ভেসে আসছে ভিড়ের গালাগাল, হুমকি, বিদ্রুপ, ধিক্কার, দুয়ো, খলোক্তি, ধাতানি, শাপান্ত-বাপান্ত, টিটকিরি– সব রকম জন্তু জানোয়ারের ভাষায়। প্যাঁদানির আতঙ্কে বাড়িটার সামনের ঘরগুলো পেরিয়ে একটা প্রায়ান্ধকার ঘরে গিয়ে লুকোল কুশাশ্ব।

অন্ধকার চোখসহা হলে, ঘরের উঁচু সিলিঙের দিকে তাকিয়ে ভাঙা ঝাড়লন্ঠন, ছেঁড়া ট্যাপেস্ট্রি দেখে কুশাশ্ব অনুমান করল যে এই খন্ডহরের মালিকদের এককালে প্রতিপত্তি ছিল। পরের আরও অন্ধকার ঘরটায় ঢুকল। দেয়ালময় ফোটো টাঙানো। কাছে গিয়ে দেখল সেগুলো সবই কংকালের। সম্ভবত যখন ফোটোগুলো টাঙানো হয়েছিল তখন মানুষের স্বাভাবিক রূপ ছিল; কালের করাল গ্রাস ফোটোগুলোর প্রাণীদের কংকালে পালটে ফেলেছে।ফোটোগুলো থেকে মড়াপোড়ার গন্ধ বেরোচ্ছিল। যার কংকাল তার নাম, জন্মদিন আর মৃত্যুদিন বছরসহ লেখা রয়েছে। ঘরটা ছেড়ে তাড়াতাড়ি পরের আরও বেশি অন্ধকার ঘরে ঢুকল কুশাশ্ব।

এই ঘরটা একেবারে কালোয় কালো অন্ধকার। হঠাৎ কেউ একজন বলে উঠল, আসুন কুশাশ্ব দেবনাথ, আপনার জন্যে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছি আমরা। আপনার অভাবে সিস্টেমতন্ত্রের কোরাম পুরো হয়নি। পরিচিত, শোনা, কন্ঠস্বর মনে হল।

গলার আওয়াজটা যেদিক থেকে ভেসে এসেছিল, সেই দিকে এগোল কুশাশ্ব। পুরোনো ভাঙাচোরা গোল টেবিল ঘিরে কয়েকজন বসেছিল। কুশাশ্ব তাদের কাছে যেতে, তারা উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে হাততালি দিতে লাগল। এবার চিনতে পারল কুশাশ্ব। পেতলের গোপাল, চিনামাটির লাফিং বুঢঢা, তালপাতার গিলগামেশ, কাঠের ইউলিসিস। এদের সামনে টেবিলে একটা করে টর্চ রাখা। আর টেবিলের মাঝখানে নীলরঙের একটা ভাঙা চাকা আর তার দোমড়ানো জংধরা স্পোকগুলো। সিংহাসনের মতন নকশাকাটা চেয়ারে এক জন মহিলা, যার দেহে এক দিকে সাবিত্রী শীলের মুখ, আর বিপরীত দিকে হালুইকরের বাড়ির সেই গৃহবধুর মুখ-বুক।

ফাঁকা চেয়ারটায় গিয়ে বসল কুশাশ্ব দেবনাথ।

                                     —---------------XXXXXXXXXXXXXXX—-----------


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন